1 of 2

পেরিন সাহেবের বাগান

পেরিন সাহেবের বাগান 

আজ বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী যে মাঠে অনুষ্ঠিত হয়, এককালে সেখানেই ছিল পেরিন সাহেবের বাগান বাড়ি। যাঁরা কলকাতা নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা সকলেই পেরিন সাহেবের বাগান বাড়ির কথা বলেন। কিন্তু যে কথা তাঁরা বলেন না তা হচ্ছে এই যে পেরিন সাহেব কে ছিলেন, এবং বাগবাজারে তাঁর বাগান বাড়িটা কবে ছিল। সেটা জানাবার জন্যই এই প্রবন্ধের অবতারণা। 

পেরিনের পুরা নাম ছিল ক্যাপটেন চার্লস পেরিন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি যখন কলকাতায় বসতি স্থাপন করে, তখন এখানে অনেক অবৈধ বণিকের (interlopers) আবির্ভাব ঘটে। পেরিন তাদেরই অন্যতম। তাঁর নিজের জাহাজ ছিল, এবং সেই জাহাজে করে তিনি দেশদেশান্তরে অবৈধ বাণিজ্যে লিপ্ত হতেন। কিন্তু তাঁর জন্মস্থান ও পিতামাতা সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না। তাঁর সম্বন্ধে যেটা আমরা জানি সেটা হচ্ছে, কোন সময়ে তিনি কলকাতায় ছিলেন এবং এখানে ঘরবাড়ি ও বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন। এই সময়কালটা জানবার সূত্র হচ্ছে মাত্র তিনটা—(১) কলকাতার প্রথম কালেকটার র‍্যালফ্ শেলডনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ, (২) ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির খাতায় তাঁর নামের উল্লেখ ও (৩) আলেকজাণ্ডার হ্যামিলটন নামে আরেকজন অবৈধ বণিকের সঙ্গে তাঁর সমসাময়িকতা। এই তিন সূত্র থেকে আমরা বুঝতে পারি যে অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে সূচনায় পেরিন কলকাতার অধিবাসী ছিলেন। 

উপরোক্ত এই তিন সূত্র ধরে ক্যাপটেন চার্লস পেরিনের জীবনী সম্বন্ধে আমরা যতটা জানি, তাই এখানে বিবৃত করছি। ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা সুতানটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর এই তিনখানা গ্রামের জমিদারী স্বত্ব (এটা জমিদারী স্বত্ব নয়, এ মতবাদ একেবারে ভুল) কেনেন। ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁরা জমিদারী পরিচালনার জন্য র‍্যালফ শেলডন নামে এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন। তিনিই হচ্ছেন কলকাতার প্রথম কালেকটর। তিনি একাধারে কালেকটর ও ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। আবার রোটেশন গভর্নমেন্টের আমলে তিনি সপ্তাহান্তরে কলকাতার গভর্নরও ছিলেন। ১৭০৬ খ্রীষ্টাব্দে বেঞ্জামিন বাউচার কলকাতার কালেকটর ছিলেন। এসব তথ্য থেকে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, তা হচ্ছে যে অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে সূচনায় র‍্যালফ শেলডন কলকাতার অধিবাসী ছিলেন। 

এই র‍্যালফ শেলডনের কাছ থেকে ৫০০ পাউণ্ড ধার নিয়ে ক্যাপটেন চার্লস পেরিন বাণিজ্য উপলক্ষে পারস্য দেশে যান। এই টাকা কর্জ নেবার সময় পেরিন, শেলডনকে একখানা খত বা ‘বণ্ড’ লিখে দেন। পারস্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করে পেরিন বিশেষ লাভবান হন। উঁচু দামে কলকাতায় বেচবার জন্য তিনি পারস্য দেশ থেকে উৎকৃষ্ট মদ সংগ্রহ করে, কলকাতার দিকে রওনা হন। ফেরবার পথে তিনি গোয়ায় সস্তা দরে একখানা জাহাজ বিক্রি হচ্ছে দেখে জাহাজখানা কিনে নেন। গোয়া থেকে কালিকটে গিয়ে তিনি সেখান থেকে লঙ্কা কিনে গোয়ায় কেনা নতুন জাহাজখানাতে সেই লঙ্কা তুলে নেন। কলকাতায় ফিরে এসে পেরিন আমদানীকৃত লঙ্কা ও মদ শেলডনকে বেচবার জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু পারস্য দেশে বাণিজ্যে গিয়ে পেরিন বেশ লাভবান হয়েছে দেখে শেলডন বেশ ঈর্ষান্বিত হয়। মাত্র যে পরিমাণ লঙ্কা প্রচলিত বাজার দরে কিনলে পেরিনের দেনা শোধ হয়, সেই পরিমাণ লঙ্কা নিয়ে শেলডন পেরিনকে তার খতখানা ফেরত দিতে অস্বীকার করে। বলে তুমি অবৈধভাবে যেথায় সেথায় গিয়ে বাণিজ্য করছ, সেই হেতু তোমাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখবার জন্য তোমার খতখানা আমি আমার জিম্মায় রেখে দেব। উপরন্তু শেলডন ঘোষণা করে দেয় যে পেরিন যে লঙ্কা নিয়ে এসেছে সে লঙ্কা পচা লঙ্কা এবং পারস্য দেশ থেকে যে মদ এনেছে, তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট মানের। ফলে পেরিনের পক্ষে কলকাতার বাজারে লঙ্কা ও মদ বেচা অসম্ভব হয়। বিষণ্ণ মনে একদিন তিনি লাল দিঘির উদ্যানে পরিভ্রমণ করছেন। এমন সময় আলেকজাণ্ডার হ্যামিলটনের (১৬৮৮ থেকে ১৭২৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রাচ্যদেশসমূহের সহিত অবৈধ বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন।) সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। পেরিন নিজের দুঃখের কাহিনী হ্যামিলটনের কাছে বিবৃত করেন। কিন্তু হ্যামিলটন পেরিনকে বলে যেহেতু সে নিজেই একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি (reckoned a Criminal guilty of that unpardonable sin of inter loping) সেই হেতু সে পেরিনকে এ বিষয়ে বিশেষ কিছু সাহায্য করতে পারবে না। সেজন্য হ্যামিলটন পেরিনকে বলে তুমি যেনতেন প্রকারেন (on any terms of agreement whatsoever) শেলডনের সঙ্গে তার ঝগড়া যেন মিটিয়ে নেয়। পেরিন হ্যামিলটনের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথোপকথন করছে, এটা শেলডন নিজের বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল। দুজনে কি কথাবার্তা হচ্ছে তা জানবার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। পেরিনকে সে ডেকে পাঠায়। সব শুনে শেলডন পেরিনকে বলে আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি তোমার নিজের জাহাজে করে পারস্য দেশে বাণিজ্য করতে যেতে পারবে। 

কিন্তু অবিক্রীত মদগুলো যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থাতেই রয়ে গেল। 

শেলডনের ঘোষণার পর সে মদগুলোর এমনই দুর্নাম হয়েছিল যে সে মদ কেউ কিনতে চাইল না, যদিও তখন কলকাতায় মদের অভাব ছিল। সেজন্য হ্যামিলটন পেরিনকে পরামর্শ দিল যে একদিন রাত্রে সে যেন গোপনে মদগুলো হ্যামিলটনের জাহাজে তুলে দেয় এবং তারপর হ্যামিলটন সেগুলো বিক্রি করে দেবার চেষ্টা করবে। এর পরই হ্যামিলটন এক দিন কলকাতা কাউনসিলের দু’জন সদস্যকে তাঁর বাড়ি নিমন্ত্রণ করে এবং তাঁদের ওই মদে আপ্যায়ন করে। তাঁরা ওই মদের এমনই প্রশংসা করে যে হ্যামিলটনের পক্ষে ২৫০ পেটি মদ দ্বিগুন দামে বিক্রি করা সম্ভবপর হয়। পেরিনের কলকাতায় অনেক দেনা ছিল, কিন্তু মদের দ্বিগুণ দাম পেয়ে তার পক্ষে সে দেনা মেটানো সম্ভবপর হয়। 

ইতিমধ্যে শেলডনের সম্মতি অনুযায়ী পেরিন পারস্য দেশে যাবার আয়োজন করে। শেলডন নিজের কতগুলো পচা লঙ্কা ও ছেঁড়া চটের থলে পারস্য দেশে বেচার জন্য পেরিনের জাহাজে তুলে দেয় এবং তাকে দিয়ে বিল অব লেডিং এ সহি করিয়ে নেয় যে সেগুলো দোষমুক্ত ও অক্ষত। পেরিন তাতেই রাজি হয়। কিন্তু যাত্রার প্রাক্কালে শেলডন বিশ্বাসঘাতকতা করে পেরিনের বিরুদ্ধে ২৫০০ টাকার একটা বিল পরিশোধ করবার নোটিশ জারি করে দেয়। যাহোক এই ব্যাঘাতের হাত থেকে পিরিন বেঁচে যায়, কেননা ওই বিলটা হ্যামিলটন শোধ করে। পারস্য থেকে বাণিজ্য করে কলকাতায় ফিরলে শেলডন আবার তার বিরুদ্ধে ১১,০০০ পাউণ্ডের একটা ঋণ পরিশোধ করতে বলে। পেরিন আবার হ্যামিলটনের শরণাপন্ন হয়, কিন্তু- হঠাৎ মারা যাওয়ায় তার সম্পত্তি ইংরেজদের দখলে আসে। এ ভাবেই তখন কলকাতার প্রশাসন চলছিল। এ সম্বন্ধে হ্যামিলটন লিখে গেছেন -’One may form an idea of the depravity and dismal image and tyranny and villainy supported by a power, that neither divine nor human laws have force enough to bridle or restrain.’ 

১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কনসালটেসনস বহি থেকে আমরা জানতে পারি যে ওই বৎসর পেরিন sceptre নামক এক জাহাজের মালিক ছিলেন। মনে হয় পরে তিনি ওই জাহাজেই পারস্য দেশে বাণিজ্যে গিয়েছিলেন। কলকাতায় ফেরবার পর খুব সম্ভবত কলকাতায় তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল। কেননা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দের খাতা বহি থেকে আমরা জানতে পারি যে ওই সালে পেরিন মৃত। আগেই বলেছি যে পেরিনের মৃত্যুর পর তার সমস্ত সম্পত্তি ইংরেজদের দখলে আসে। পরে পেরিনের বাগান বাড়ি কেনেন ক্যাপটেন জন বুকানন নামে এক ব্যক্তি। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে সিরাজদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করে, বুকানন তখন মৃত। কেননা অন্যান্য ইংরেজদের সঙ্গে বুকাননের বিধবা তখন ফলতায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। পলাতক ইংরেজদের মধ্যে তখন তরুণ বয়স্ক ওয়ারেন হেস্টিংসও ছিলেন। ফলতায় বুকাননের বিধবার সঙ্গে হেস্টিংস-এর ভাব হয় এবং তার পরিণতিতে হেস্টিংস বুকাননের বিধবাকে বিবাহ করে। এই বিধবার গর্ভে হেস্টিংস-এর এক পুত্র ও এক কন্যা হয়। হেস্টিংসের এই স্ত্রীর মৃত্যু হয় ১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দে কাশিমবাজারে। মেয়েটিও কাশিমবাজারে মারা যায়। ছেলেটিকে হেস্টিংস বিলাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু হেস্টিংস প্রথমবার বিলাতে ফিরে যাবার কিছু পূর্বে ছেলেটির মৃত্যু ঘটে। 

এই বিবাহের সূত্রেই হেস্টিংস বাগবাজারে পেরিন সাহেবের বাগানের মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু কবে ওই বাগান তিনি বিক্রি করেছিলেন, বা কি করে তা কলকাতা করপোরেশনের হাতে এসেছিল, তা আমরা জানি না। করপোরেশন রাস্তা নির্মাণের জন্য প্রস্তরকুচি জমা করবার জন্য এই ভূমিখণ্ড ব্যবহার করে বলে এর নাম হয় ‘মেটাল ইয়ার্ড’। ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে যখন বাগবাজার সার্বজনীন রেজেষ্ট্রিকৃত হয়, তখন এর নামকরণ করা হয় দুর্গানগর 

পেরিন অবৈধ বণিক ছিলেন। সেজন্য মনে হয় যে অবৈধভাবে আনীত পণ্য তিনি ওই বাগান বাড়িতে লুকিয়ে রাখতেন। সামনে গঙ্গার ধারেই তাঁর জাহাজ নোঙর করা থাকত। সেজন্যই বোধ হয় জায়গাটাকে ‘পেরিং পয়েণ্ট’ বলা হত। ‘পেরিং পয়েন্ট’এর কথা আমরা ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দেও শুনি। ওই সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখের কোম্পানির এক ইস্তাহারে পড়ি—শহরের মধ্যে আতসবাজী ছোঁড়ায় অনেক স্থানের চালাঘরে আগুন লেগে পাড়াকে পাড়া ভস্মীভূত করে দিয়েছে। পেরিন পয়েন্ট ও শহরের মধ্যে আমাদের যে বারুদখানা আছে—এরূপ আতসবাজীর দ্বারা তারও বিপদ ঘটতে পারে। এজন্য আদেশ করা যাচ্ছে, কলকাতার মধ্যে আর আতসবাজী ছুঁড়তে দেওয়া হবে না। বাজীর দোকানগুলি তুলে দেওয়া হবে।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *