পেয়ালা পিরিচ

পেয়ালা পিরিচ

আমার একটা সোয়েটার ছিল। কারুর স্নেহের হাতের বোনা নয়। নিরস দোকান থেকে কেনা। সেই সোয়েটার আমাকে ছাত্রজীবনের শেষভাগ থেকে চাকুরেজীবনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত শীতে আশ্রয় দিয়েছিল। তারপর স্ত্রীযোগে সোয়েটার বিয়োগ হল। প্রথম দিকে স্ত্রীরা দু-এক বছর বড়ো মধুর ব্যবহার করে থাকেন। অঙ্গে বৌভাতের রাতে পাওয়া কখনো নীল শাড়ি, কখনো লাল শাড়ি। এলো চুলে ফুলশয্যা আর গায়ে-হলুদের তত্ত্বে পাওয়া গন্ধতেলের সুবাস। কপালে আঁকা যত্নের গোল টিপ। মুখে মৃদু শুনচো, শুনচো সম্বোধন। স্বামীরাও তখন পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে পোষা বেড়ালের মতো। ডাকের সে কী বাহার! সোহাগে জরজর, হ্যাঁগা। স্ত্রী আমার সেই পাটকেল রঙের সোয়েটারটিকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করল। এ আবার মানুষে গায়ে দেয়! যেন এতকাল আমি জানোয়ার ছিলুম, বিবাহের পর, মনুষ্য-পদবাচ্য হয়েছি। (বছর চারেক পরে অবশ্য আবার আমি জানোয়ার হয়ে গেছি। এখন উঠতে-বসতে শুনি, জানোয়ারের হাতে পড়ে জীবনটা গেল। তার মানে স্বামী পুরোনো হলেই জানোয়ার হয়ে যায়। যেমন চামড়া পাকা হলে জুতো হয়।)

প্রথমে আলমারির এক কোণে, তারপর আলমারির পেছনে, সব শেষে সেই সোয়েটার এসে পড়ল কয়লার গাদায়। অবশেষে সেটির মালিক হল আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে তার স্বামী। আর আমার স্ত্রী নস্যি রঙের উলের জমিতে হলুদ রঙের সাপ খেলিয়ে বেশ আহামরি গোছের একটি বুকখোলা সোয়েটার বুনে দিলে। মেডেন সং-এর মতো মেডেন সোয়েটার। সেই প্রথম আর সেই শেষ। অমন পাপ কর্ম সে আর দ্বিতীয়বার করেনি। (পুরোনো স্বামীর মতো পাপী ব্যক্তি পুলিশের খাতাতেও নেই। ছুপা রুস্তম।)

বছর ঘুরতেই খোকা। আবার বছর ঘুরতেই খুকি। স্ত্রী হাতছাড়া হয়ে গেল। জননীর অনেক যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার অংশীদার হয়েই জীবন কাটাতে হবে। সুখের সীমানা বড়ো সংকীর্ণ। সেই স্ত্রী এখন সোয়েটার বোনে তবে আমার নয়, ছেলে-মেয়ের। ইতিমধ্যে তার নিজস্ব জগৎও বেশ বড়ো হয়েছে। হাঁকডাক বেড়েছে। ঠাকুরপো-টাকুরপোও গোটাকতক জুটেছে। তাদের জন্যেও মাঝে মধ্যে সোয়েটার বোনার সময় করে নিতে পেরেছে। আমি তো ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর। আমার স্বাদ কমে গেছে। আমার বাহবার তেমন দাম নেই। আমি খুশি হলেই বা কী, অখুশি হলেই বা কী, (স্বামীরা আসলে ক্লীব লিঙ্গ। সামান্য আস্কারায় নিজেদের পুংলিঙ্গ ভেবে আস্ফালন প্রকাশ করে যথাস্থানে যথোচিত ঠোক্কর খেয়ে একপাশে চিত হয়ে পড়ে। অনেকটা বিরাট আকৃতির গুবরে পোকার মতো। ঘরে ঢুকে জেট-প্লেনের মতো সগর্জনে খুব উড়ছে। ভীতু ভাবছে না জানি কি মাল। যার আয়তন আর আওয়াজ এত সাংঘাতিক তার কামড় নিশ্চয়ই মারাত্মক হবে। কিন্তু যে জানে সে জানে। উড়তে উড়তে এক সময় দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে পড়বে আর একবার চিত হলেই ভোলা মহেশ্বর। পড়ে পড়ে সারা রাত শুঁড় নাড়বে। সকালে চিত থেকে সোজা করে দাও গোঁ-গোঁ করে উড়ে বাইরে চলে যাবে। বিবাহিত মানুষের সঙ্গে অসাধারণ মিল। বাড়ি ঢুকল গোঁ-গোঁ করতে করতে। স্ত্রী ছাড়া সকলেই তটস্থ। ঠ্যাকাস করে পয়লা ধাক্কাতেই ফ্ল্যাট। বাবু চিত হয়ে রইলেন। সকালে ঝ্যাঁটা দিয়ে উপুড় করে দাও। সামনে এককাপ চা ধরো। তারপর দেখো বাজার, দোকান সব ঠিকঠাক। নটার সময় উড়তে উড়তে কর্মস্থলে। অত বড়ো ক্ষমতাশালী মহাদেব, তাঁকে চিত করে সেই যে একবার মা কালী বুকে উঠে দাঁড়ালেন, আজও তিনি সেইভাবে পড়ে আছেন আর উঠতে হল না।)

মানুষের জ্ঞানোদয় হলে তার আর কোনো দুঃখ থাকে না। আমারও নেই। প্রত্যাশাই দুঃখের মূল কারণ। আমি মূলোচ্ছেদ করে দিব্যি আছি। আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে আর কিছুই আশা করি না। আমি জানি সকালের কুয়াশার মতোই স্ত্রীর প্রেম ক্ষণস্থায়ী। (শুনেছি জাপানে এক ধরনের মারাত্মক বিষাক্ত মাছ পাওয়া যায়। সেই বিষ বের করে যাঁরা রাঁধতে পারেন তাঁরা জানেন এর চেয়ে সুস্বাদু মাছ আর দ্বিতীয় নেই। স্ত্রীও অনেকটা সেইরকম। বিষ বের করে যাঁরা নাড়াচাড়া করার কৌশল জানেন তাঁরা বলেন, ধনধনা ধনধনা, এ-ধন যার ঘরে নেই তার কীসের ধিনতাধিনা।) সংসারে থাকবে ভারবাহী বলদের মতো। সৃষ্টিরক্ষার জন্যে ঈশ্বর তোমাকে ফাঁদে ফেলবেনই। তোমার নিজেও কিছু মুখ্যুমি থাকবে। সব মিলিয়ে ন্যাজে গোবরে হয়ে জীবন কাটাতে হবে।

সবই যখন জানি তখন একটা সোয়েটার নিয়ে এত ধানাইপানাই কেন? মানুষের ভ্রম হয়, মতিভ্রম হয়। আমার মতিভ্রম হয়েছিল। হাঁড়ির একটা চাল তুলে টিপে দেখে সব চালের অবস্থা বুঝেও বুঝিনি। একটু স্নেহটেহ, প্রেমট্রেম খুঁজতে আবার ছিপ ফেলেছিলুম। আমার মনে হয়েছিল জীবনটা অনেকটা কম্বিনেশান তালার মতো। ঘোরাতে ঘোরাতে এক সময় নম্বরে নম্বর মিলে গেলেই খুলে যাবে। এই মহিলাটির সঙ্গে মিল হয়নি, কুছ পরোয়া নেই। কম্বিনেশান মেলাতে পারিনি, তাই সংসারের ফটকে টাম্বলার তালার মতো গোমড়া মুখে ঝুলতেই থাকবে সারাজীবন। থাকুক। কত কিছুই ত খোলে না জীবনে। সংসারে কত শিশি থাকে যার ঢাকনা খোলা যায় না। আড়প্যাঁচ হয়ে পড়ে থাকে। গরম জলে চুবিয়ে, আগুনের ছেঁকা দিয়েও খোলা যায় না। বিজ্ঞানীরা বলে, ট্রায়াল অ্যাণ্ড এরার মেথড। ভুল হতে হতে এক সময় মিলে যাবে। স্ত্রীরা প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুলের মাশুল। মুষল বিশেষ। সংসারের মোহ-মুদগর। বিবাহের পরই বোঝা যায় এ-তালার চাবি আমার হাতে নেই। আমি হলাম অন্য তালার চাবি।

সেই তালাটি যে অফিসে আমার চেয়ারের তিনটি চেয়ার পরে এতকাল বসে বসে ফাইল নাড়তেন তা কি আমি জানতুম! (বিবাহ না করিলে মানুষের দৃষ্টি খোলে না) পৃথিবীতে স্ত্রী-নিগৃহীত স্বামী যেমন আছে তেমনি স্বামী-নিগৃহীত স্ত্রীও আছেন। বিধাতার কৌতুকে সবলে দুর্বলেই জোড় বাঁধে। কদাচিৎ সবলে সবলে মোলাকাত যে হয় না তা নয়। পাড়ায় এই রকমের দম্পতি দু-একটি দেখা যায়, শোনাও যায়। শোনা যাবে না কেন, তাঁরা এতই সরব এবং রোষযুক্ত যে তাঁদের সৌরভ যোজন বিস্তৃত। যাই হোক এরকম হাম ভি মিলিটারি তোম ভি মিলিটারি গোছের মিলন বিধাতার হাত ফসকেই যায়। (আমি মাঝ নদীতে একবার একটা নৌকো দেখেছিলুম। হাল, দাঁড় ফেলে দুই মাঝিতে পাটাতনে দাঁড়িয়ে মল্লযুদ্ধ করছে। নৌকো ভেসে চলেছে স্রোতের টানে। জীবনও তো তাই। হাল ধরি আর না ধরি ভাসতে ভাসতে ঠিক চলে যায় মৃত্যু-মোহনায়।)

তা সেই শান্ত চেহারার, মিষ্ট ভাবের মহিলাটির সঙ্গে সামান্য উসখুসেই একটা হৃদ্যতা জন্মে গেল। জন্মাতেই পারে। এক পালকের পাখি এক জায়গায় জড় হয়। আমার তো কোনো দোষ ছিল না। আমার স্ত্রীর উপেক্ষাতেই আমার বিপথে গমন। এ তো জানা কথাই, ছেলে-মেয়েরা স্নেহ ভালোবাসা না পেলেই কুসঙ্গে চলে যায়। আমি স্ত্রী হলেও ছেলে তো, আর যার সঙ্গে আমার ভাব ভালোবাসা সে অন্যের স্ত্রী হলেও মেয়ে তো। এ-যুক্তি জজেও মানবে। আর দু-জনেই ঘা খাওয়া প্রাণী। তা ছাড়া ‘ঘৃতশাস্ত্রে’ বলেছে—অগ্নি সমীপে ঘৃতের অবস্থানে অগ্নি উদ্দীপিত হয়। পুরুষ আর নারী সেই অগ্নি ও ঘৃত। কে অগ্নি, ঘৃত তা জানি না! শাস্ত্র বাক্যে সাবধান না হয়ে কর্মস্থলের কতৃপক্ষ দহনশীল ও দাহ্যবস্তু দুটিকে এত পাশাপাশি রাখলেন কেন? দোষ আমার নয়। দোষ যখন আমার নয় বিবেক তখন মুক্ত। বেশ করেছি ভাব করেছি। কার তাতে কী। (কার বাপের কি?—বললে, শ্বশুর মশাইকে বোঝায়। নিগৃহীত স্বামী হলেও আমি অভদ্র নই) নিজের স্ত্রীর যখন সময় নেই, মেজাজ নেই, তখন অন্যের বাতিল স্ত্রীর সঙ্গে ভাব বিনিময়ে দোষের কিছু নেই। (সমাজ এখন অনেক লিবার‌্যাল) কথা বলতে গেলেই সংসারের কথা। হরেক উপদেশ। পিতার কর্তব্য কী? কন্যার বিবাহ। অমুকের তমুক। গুষ্টির পিন্ডি। মুখ খুলেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চুলোচুলি, খুনোখুনি, দক্ষযজ্ঞ। (স্ত্রীরা কত আপনজন ন্যাজে পা পড়লেই বোঝা যায়। স্বরূপ বেরিয়ে পড়ল সঙ্গেসঙ্গে। কোন ব্যাটা বলেছে বিবাহবন্ধন জন্মের বন্ধন, সাতপাকে বাঁধা। কিস্যুই তিনি জানতেন না। এলো সুতোর একতে ঘুড়ি ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছে। পান থেকে চুন খসলেই শ্বশুর মহাশয়ের কন্যার অন্য রূপ। কে ওই বামা এলোচুলে! বড়ো পলকা বন্ধন। ঘাঁটাঘাঁটি না করলে বেশ আছে। ঘাঁটালেই ভীমরুলের চাকে খোঁচা। স্ত্রীর পিরিত চাকের মধু। চাকেই থাকে।) অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য চেহারা। হাসিহাসি মুখ। উজ্জ্বল চোখ। ডগমগ অবস্থা। (রামকৃষ্ণ বলতেন, অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে লড়ে যাবে। লড়ে যাবে বলেননি, সংসার করতে বলেছিলেন। তার মানে স্বামীকে আঁচলে বেঁধে দাপটে সংসার। আর প্রবাদ আছে, যার শিল যার নোড়া তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া) আমি পিতা হতে পারি, বাজার সরকার হতে পারি, মুদ্দোফরাশ হতে পারি, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো হতে পারি, পারি না কেবল স্নেহভাজন স্বামী হতে। শাস্ত্রে আছে যেমন কুকুর তেমন মুগুর, আছে বাঘা ওল বুনো তেঁতুল। সুতরাং এই জাতীয় একস্ট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স-এ আমার অধিকার আছে। আমার বিবেকের সমর্থন আছে। তা ছাড়া পার্শ্ববর্তিনী মহিলাটির সঙ্গে এমন কিছু করছি না যা অসামাজিক।

দুজনে অবসর সময়ে সুখ দুঃখের আলোচনা করি। কে ক-ঘা খেলুম। কে কেমন আঁচড়ালে। অন্যমনস্ক চীনেবাদাম দাঁতে কাটতে কাটতে দীর্ঘশ্বাস ফেলা। একই চাতালে দাঁড়িয়ে ক্ষত অনুসন্ধান আর লেহন। অনেকটা কুকুরের মতো। কামড়া-কামড়ি, ঝটাপটির পর একপাশে বসে বসে কেমন তারিয়ে তারিয়ে চাটে। এইভাবে মনের দুঃখ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে এক ধরনের সান্নিধ্য গড়ে উঠল। দু-জনেরই মনে হতে লাগল এ জীবনে যা হবার নয় তাই হলে একটা সুখের সংসার গড়ে উঠত। একটা খুব ভালো প্লট কাঁচা লেখকের হাতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। সমবেদনায় বেদনামাখা দুটো মন এক হয়ে গেল। আমরা অফিস ছেড়ে ছুটির পর মাঝে মধ্যে পার্কে গিয়ে পাশাপাশি বসতে শুরু করলুম। একে বলে সংযত প্রেম। যৌবনের ফোঁসফোঁসানি নেই, আবেগ নেই। টুকটাক কথা, ভাঁড়ে চা, মাঝে মধ্যে একটু দর্শন আলোচনা আর আশেপাশের জোড়ায় জোড়ায় যুবগ-যুবতীদের দেখে তাদের ভবিষ্যৎ ভেবে আঁতকে ওঠা। একটা দুটো সিনেমাও হত। সেকেণ্ড হ্যাণ্ড প্রেমের একটা আলাদা মাধুর্য। কোনও দাবি নেই, বন্ধন নেই, তিক্ততা নেই, এক সময় যে যার চুল্লিতে ফিরে যাও। পরের দিন মিলিয়ে দেখো কে কতটা ঝলসালে।

চলতে চলতে মানুষ কত কী আবিষ্কার করে। হঠাৎ মনে হতে লাগল আমার স্ত্রীর নাকটা ভীষণ ফ্ল্যাট। মুখের অনেকটা জায়গা জুড়ে আনাড়ির হাতে তৈরি সিঙাড়ার খোলের মতো পড়ে আছে। চোখে কোনো বুদ্ধির দীপ্তি নেই। প্যাঁচার মতো গোলগোল। চুলে তেমন চেকনাই নেই। ঘোড়ার বালামচির মত সোঁটা সোঁটা। হাতের রান্না তেমন নয়। সব কাজেই অপটু। শরীরে তেমন লাবণ্য নেই। কপালটা আবার উঁচু। (কী করে তখন যে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতুম ঈশ্বরই জানেন। তখন বোধ হয় অন্ধ ছিলুম। বেড়ালের চোখ ফোটে দেরিতে।)

রাতে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে মনে হয় পাঁচিলের পাশে শুয়ে আছি। যে কোনো কথারই হুঁ আর হুঁ ছাড়া কোনো উত্তর নেই। এক অক্ষরের আলাপন। শরীরে হাত ঠেকলেই খ্যাঁক করে ওঠে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি স্বামীর পাশে শুয়ে আছে না ভাসুরের পাশে। শোবার সময় ভগবানের নাম নিতে হয়। হে করুণাময়। আমাকে সুনিদ্রার তটে প্রভাতের উজ্জ্বল আলোতে নিয়ে চলো। সেসব নেই। হঠাৎ অন্ধকারে বলে উঠল, চিনি ফুরোলো, কাল সকালের চায়ের মতো পড়ে আছে। চা আনতে হবে। এবারের চায়ে তেমন লিকার ছিল না। তার মানে খরচ বেশি হয়েছে। পরশু তপুর ছেলের অন্নপ্রাশন। কিছু দিতে হবে! কী দেবে? সামনের শনিবার বিকাশের বিয়ে। কী দেবে? অবিরাম দেহি দেহি। যেন ট্যাঁকশালের পাশে এসে শুয়েছে। সব সময় স্বার্থ। বিছানাটা আলাদ করে নিতে হবে। কী দরকার বাবা! ভুলে কোথাও হাতটাত পড়ে গেলে বড়ো অপমানিত হতে হয়। কপালে! ভীষণ মাথা ধরেছে। কাঁধে? সংসারের ভার। পেটে বোধ হয় টিউমার। পায়ে গুঁপো। এ জিনিস বিছানায় কেন? ডাক্তারের টেবিলে শোয়া উচিত ছিল।

সোয়েটার থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। না সরে আসতে পারিনি। শীত ফিরে ফিরে আসে। এক মাঘে শীত যায় না। প্রথম শীতেই আমার সেই অফিসের মহিলা সুন্দর একটি সোয়েটার উপহার দিলেন। আমরা দু-জনে একটা ইংরেজি ছবি দেখলাম। সিনেমা হলে সেই সোয়েটারটা তাঁর কোলে থেকে গরম হয়ে উঠল। নস্যি রঙের উলে নকশার বিনুনি হাত ধরাধরি করে চলেছে। হাতে নিলেই বোঝা যায় দামি উল। হালকা, নরম। ছবি দেখতে দেখতে মন খুশিতে নেচে উঠেছিল জয়ের আনন্দে। (মন জয় করার যে গর্ব। রাজত্ব জয় কোথায় লাগে!) নতুন এক মহাদেশে নৌকো নোঙর ফেলেছে। এক একটি মন অজানা এক একটি মহাদেশ। ইংরেজি বই চলার মাঝে মাঝেই মনে বাংলা গান গুমরে গুমরে উঠছে, আমার কী হবে তারিণী, ত্রিগুণধারিণী।

তারিণী জানতেন, ব্যাটাচ্ছেলে তোর কী হবে। প্যাকেট বগলে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। বলদাত্রী, সোয়েটারদাত্রী চলে গেছেন। পরে আছি স্ত্রীর হাতে বোনা প্রেমের তাজমহল। সম্পর্কের শুরু ও শেষের উল-ফলক (মর্মর ফলকের মতোই, হেথায় চিরশায়িত সেই মানুষটির প্রেম। আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে, ঘাড়ে ধরে পিতা গছিয়েছেন। ভুল করে বোনা সোয়েটার ভুল অঙ্গে চেপে বসেছে।) গায়ের সোয়েটার যেন বগলের সোয়েটারকে প্রশ্ন করছে, কোথায় চললে? কেন, তোমার সঙ্গে! তুমি যে ইললিগ্যাল মানিক। ঝ্যাঁটা খাবার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি। তুমি কোন উৎস হইতে উঠিয়া কোথায় চলিয়াছ? বাঘের ঘরে কি ঘোঘ বাসা বাঁধিতে চলিয়াছে? তুমি তো আমার সতীন হে। একটু ভয় ভয় ভাব যে হচ্ছে না তা নয়। অফিস থেকে সিনেমা, সোয়েটার উপহার, অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে পাশাপাশি বসে থাকা, রেস্তোরাঁ, খানা, এতক্ষণে বেশ ঘোরে ছিলুম। এইবার একা একা বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনটা যেন ক্রমশই এলিয়ে পড়েছে। সে শক্তি আর নেই। চোখের আড়ালে আত্মিক অনুসন্ধানে বিপদের ঝুঁকি কম। বামাল বাড়ি ঢুকলে চুলোচুলি তো হবেই। সোয়েটার তো আর আসমান থেকে পড়ে না, ছেলেরাও বোনে না। কোন মহিলার এই কীর্তি? কিসের এত খাতির। (যার ওপর দুর্ব্যবহার করা হয় তাকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়। মার খেতে খেতে পালিয়ে না যায়। অন্য কোথাও ছিটকে গিয়ে আদরে না থাকে। আমার পাঁঠা। ন্যাজে কাটব, মুড়োয় কাটব।) হঠাৎ তোমাকে কেন সোয়েটার বুনে দেওয়া। সোহাগ না থাক সজাগ দৃষ্টি ঠিক আছে। (কুস্তিগীর খেটেখুটে, তেল ঢেলে জমি তৈরি করে, তার ওপর নিত্য দাপাদাপি করার জন্য। এর নাম আখড়া। স্বামীর হল স্ত্রীদের আখড়া। যে যার আখড়ায় কুস্তি করবে। অন্যের প্রবেশ নিষেধ।) এমন জিনিস রাস্তায় তো আর ফেলে দিতে পারি না। তা ছাড়া এর প্রতিটি বুনোনে ভালোলাগা, ভালোবাসা। যা হয় হোক সতীন বগলেই বাড়ি ঢুকব। ঠাণ্ডা লড়াই একদিন গরম লড়াই হবেই। যত তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয়ে যায় স্নায়ুর পক্ষে ততই ভালো। ধিকি ধিকি তুঁষের আগুনের মতো না জ্বলে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠুক। (অশান্তিটাও এক সময় বিলাস হয়ে দাঁড়ায়। উট যেমন কাঁটা চিবিয়ে রক্তাক্ত হতে ভালোবাসে।)

সোয়েটার বগলে বাড়ি ঢোকার দিনটিতে তেমন কিছু হল না। কারণ আমার আসা, আমার যাওয়া তেমনভাবে আর কারুর নজরে পড়ে না। সে ছিল প্রথম দিকে। ফিরতে একটু দেরি হলে দূর থেকেই দেখতে পেতুম জানলায় একটি মুখ। আমি পথ চেয়ে রব। বেরোবার সময় ফিসফিসে অনুরোধ, তাড়াতাড়ি ফিরো। বেশি রাত কোরো না। (আমাদের সেই মঙ্গলা গোরুটার মতো। দেশের বাড়িতে দেখেছি। সকালে চরতে বেরোলো। (জানা আছে বিকেলে ঠিক ফিরে আসবে যেখানেই থাকুক। কোনো চিন্তা নেই। মাঝে কেউ একবার গোয়ালে উঁকি মেরে আসত। মঙ্গলা শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। মঙ্গলা দুধ দিত আমি টাকা দি এই যা তফাৎ।) সুতরাং নি:শব্দে বাড়ি ঢুকে প্যাকেটটা আলমারিতে গুঁজে রাখলাম। শীত আসুক তখন সাদা প্যান্টের সঙ্গে পরা যাবে। আর তখনই হবে ধুমধাড়াক্কা। ততদিন সম্পর্কটা আরোই বিষিয়ে উঠবে। ফোড়া থেকে কার্বাঙ্কল।

শীত এল। যেমন আসে। মৃদু আমেজ। প্রথম কয়েকদিন আমার সেই পেটেন্ট সোয়েটার দিয়েই উদ্বোধন করা গেল। ঝলঝলে মাল। রং জ্বলে গেছে। যৌবন ঝরে গিয়ে বার্ধক্যের দশা। কাপ্তেনি করার বয়েস চলে গেছে বলে মানিয়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে শুনে আসছি শীত চলে গেলেই ওটাকে আবার খুলে বোনা হবে। যেমন শোনা যায় রামরাজত্ব আবার আসবে। যাই হোক নতুন সোয়েটারের তখনও তেমন প্রয়োজন হল না। চলছে চলুক। এরই মধ্যে একদিন বৃষ্টি হয়ে শীতটা জাঁকিয়ে পড়ল। অফিসের সেই মহিলা বললেন, সোয়েটারটা এবার একদিন পরুন। তুলে রেখে রেখে পোকায় যে কেটে দেবে। গিন্নীর ভয়ে পরছেন না বুঝি! (পৃথিবীতে কত রকমের ভয়! আরশোলার ভয়, সাপের ভয়, ছোঁয়াচে রোগের ভয়, মাসের শেষে কারুর বিয়ের ভয়, বড়কত্তার ভয়, সবার সেরা গিন্নীর ভয়।)

উপলক্ষ একটা জুটে গেল। আজ অফিসের এক সহকর্মীর বউভাত। সদলে যেতে হবে। সামান্য মাঞ্জা দিলে ক্ষতি কি? সাদা প্যান্টের ওপর নতুন সোয়েটার। যথাস্থানে হাত চলে গেল। হাত ফিরে এল। প্যাকেট স্থানচ্যুত, আলমারি তোলপাড়। শীতল একটি গলা শোনা গেল, ‘কী খোঁজা হচ্ছে? সব যে বারোটা বেজে গেল। কী চাই আমাকে বললেই তো হয়। হাঁটকেপাঁটকে একসা!’

‘একটা প্যাকেট ছিল।’

‘কীসের?’

‘সোয়েটারের।’

‘ও সোয়েটার! নস্যি নস্যি রং। কার সোয়েটার?’

‘আমার, আবার কার?’

‘কে বুনে দিলে?’

‘বউদি।’

‘তোমার আবার বউদি কোথা থেকে এল?’

‘তোমার একগাদা ঠাকুরপো থাকতে পারে আমার একজন বউদি থাকতে পারে না!’

‘রসের বউদি! তলে তলে আজকাল এইসব হচ্ছে। বুড়ো বয়সে লজ্জা করে না! ছেলে-মেয়ে বড়ো হচ্ছে। মুখ দেখাবে কী করে?’

‘তুমি যদি দেখাতে পার আমিও পারব।’

‘তার মানে?’

‘বুঝে নাও।’ আবার আমি আলমারি হাঁটকাতে শুরু করলাম।

‘তার মানে আমিও তোমার মতো চরিত্রহীন!’

‘যে যেমন অর্থ করে।’

‘আচ্ছা-আ।’

‘আচ্ছা’ শব্দটা ধারালো ছুরির মতো হাওয়া কেটে গেল। আলমারির সব কিছু ঠিকঠাক রেখে সোয়েটার খোঁজার ধৈর্য আর নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। দুমদাম করে সব ফেলতে লাগলুম। রাগে সর্বশরীর জ্বলছে।

‘সোয়েটার ওখানে নেই।’

‘কোন চুলোয় আছে?’

‘ভবানীপুর।’

‘ভবানীপুরে?’

‘হ্যাঁ ভবানীপুরে। তোমার ছোটোশালা পরে চলে গেছে।’

‘বা:, বারে শ্বশুরবাড়ি। যেখানে যা পাবে হাতিয়ে নিয়ে চলে যাবে! দেবার মুরোদ নেই, নেবার বেলায় শত হস্ত!’

‘কী নিয়েছি শুনি? কী-ই বা তুমি দিয়েছ?’

‘কী নেয় না শুনি! দেওয়া? দেওয়ার অপেক্ষা রাখে? তোমার ওই বাহারের ছোটোভাইটি যেখানে যা পাবে ঝেড়ে নিয়ে চলে যাবে। যেন কর্পোরেশনের মাল রে! এই তো সেদিন একটা জামা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। কী? না জামার রংটা ভীষণ ভালো। ভীষণ অ্যাপিলিং ইংরেজি শিখেছে, ইংরেজি। আমার আর ভালো কিছু পরে দরকার নেই। ছেঁড়া পরে ঘুরে বেড়াই। আর তুমি একটি গোমুখ্যু। বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি করে সারাটা জীবন হেদিয়ে মলে।’

‘তাই তো বলবে! হ্যাদানোর কী দেখলে? আর তুমি যখন আমার শাড়ি ধরে টানাটানি কর!’

‘তোমার শাড়ি? তোমার ত্রিসীমানায় যেতে আমার ঘেন্না করে। আমি জানি, আপনার চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বন ভালো।’

‘তা ঠিক। পর তো ভাল হবেই। বাইরে বাইরে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত ফষ্টিনষ্টি। তাদের তো আর অন্য কোনো দায়দায়িত্ব নিতে হবে না। ঘরেরটাকে জিইয়ে রেখে বাইরের এক একটাকে ধরে একটু খেলু খেলু। বাবুর খেলা হচ্ছে। খেলা। হাজারবার তাগাদার পর একটা শাড়ি এল। না পরে তুলে রাখলাম। তারপর যেই একটা বিয়ে এল বাবুর অমনি নাকে কান্না, মাসের শেষ, বড়ো টানাটানি, কী করা যায়, তোমার ওই শাড়িটা দিয়েই এ যাত্রা ম্যানেজ করি। তোমাকে আরও ভালো শাড়ি কিনে দেব। ব্যস হয়ে গেল। ফুর্তিতে টাকা ওড়ালে সংসারের এই হালই হয়। তোমার রকমসকম দেখে আমারও ঘেন্না ধরে গেছে। তোমার ত্রিসীমানায়, তোমার কোনো কিছুতে থাকতে ইচ্ছে করে না।’

‘থাকার দরকার নেই। এসেছি একলা যাবও একলা। তোমার ভাইকে এই সোয়েটারটা, এই শালটা, এই জামাটা, এই প্যান্টটা, এই কলারঅলা গেঞ্জিটা দয়া করে নিয়ে যেতে বোলো। আমি সন্ন্যাসী হয়েই দিন কাটাব।’

সব টেনে টেনে, ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলে দিলুম। ভেতরটা বেশ খোলসা হল। কোষ্ঠকাঠিন্যের পরের আনন্দ। অফিসে বেরোবার তাড়া না থাকলে বেশ ভালোভাবে লড়া যেত। যাক তবু কিছুটা লন্ডভন্ড করা গেছে। (ক্রোধে শরীরের রক্তসঞ্চালন ভালো হয়। কল্পনার স্বপ্নজগৎ থেকে বাস্তবে বেশ কিছুদিনের জন্যে ফিরে আসা সম্ভব হয়। গন্ডারের মতো গোঁ গোঁ করে গোঁত্তা মারার জায়গার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। মুহ্যমান ভাব কেটে যায়। কাজে কর্মে গতি আসে।)

অফিসে আমার সেই বান্ধবী বললেন, ‘কী হল? কাল নতুন সোয়েটার পরার কথা বলায় একেবারে উদোম হয়ে চলে এলেন যে?’

‘বাহুল্য বর্জন।’ বলতে পারলুম না যে আপনার সযত্নে বোনা সোয়েটার ভবানীপুরের এক মাল পরে আশুতোষ কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে শিকার করছে।

‘ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে? আজ ফিরতে অনেক রাত হবে তো!’

‘বিকল্প ব্যবস্থা আছে।’

‘সেটা কী?’

‘ছিলিম। বিকেলে বেরিয়ে বটতলায় বাবাজির কাছে উবু হয়ে বসে দু- টান মেরে যাব।’

ঠাণ্ডা লাগার কথা আমার বউও বলেছিল তবে বাঁকা করে। ‘ঠাণ্ডা লেগে নিমোনিয়া হলে সেবা করতে পারব না কিন্তু।’ সেবার নমুনা তোমার দেখা আছে। ছেলেবেলায় আমাদের পড়তে বসার মতো। এদিকে তাকাচ্ছি, ওদিকে তাকাচ্ছি, কাগজের গোল্লা তৈরি করছি, পেনসিল চিবোচ্ছি। শেষে হাওয়ায় বইয়ের পাতা উড়ছে, পড়ুয়া মাঠে দৌড়োচ্ছে। তোমার সেবাও তো তাই। আমার কপাল রইল কপালে। তোমার হাত রইল হাতে। মুখে বারকতক বললে, কপালে হাত বুলিয়ে দোব? কপালে?

বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হল। দশটা-টশটা হবে। শোবার ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলুম। এতদিনের জোড়া খাট সিঙ্গল হয়ে গেছে। ঘরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা দেখাচ্ছে। শব্দ করলে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। ছেলে আর মেয়ে দু-জনেই ঘরে ছিল। বড়োসড়ো হয়েছে। বুঝতে সুঝতে শিখেছে। মেয়ে বলল, ‘কী গো তোমার রাগ কমেছে?’

ছেলে বলল, ‘কক ফাইটের ভয়ে রাত করে ফিরলে?’

আরে তাই তো, বেরোবার সময় বলে যেতে ভুলেই গেছি, আমার নিমন্ত্রণ ছিল। অবাক হয়ে আমাকে ঘরের এপাশে-ওপাশে ঘুরতে দেখে ছেলে বললে, ‘আর ফাইট করতে পারবে না। মাতাঠাকুরানি আলাদা হয়ে গেছে।’

মেয়ে বললে, ‘ফিমেল খাটটা মেল খাটকে ডাইভোর্স করেছে।’

আজকাল ছেলে-মেয়েরা কী সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে। ভালো ভালো। যত তাড়াতাড়ি বুঝতে টুঝতে শেখে ততই ভালো। আগে যাত্রা শুরু করলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে। জামা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী ব্যাপার, তোমরা দুটিতে এখনও এখানে বসে?’

মেয়ে বললে, ‘তোমাদের একটু হেল্প করার জন্যে বসে আছি।’

‘হেল্প মানে?’

‘এখন তো দিনকতক তোমাদের কথা বন্ধ থাকবে তাই আমরা দু-জনে দূতের কাজ করব।’

ছেলে বললে, ‘একবার দেখে নাও হাতের কাছে সব ঠিক আছে কি না। আমরা তো জানি না তোমার কী লাগে না লাগে।’

মেয়ে বলল, ‘যতটা জানি সব গুছিয়ে রেখেছি। মাকে তোমার এখন কিছু বলার আছে?’

‘হ্যাঁ আছে। বলে দাও, বাবা কিছু খাবে না।’

ছেলে বললে, ‘জানতাম, তুমি আজ খাবে না।’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলে, ‘বাইরে ভালো করে খেয়ে এসেছ তো? তুমি লড়ে যাও। আমরা তোমাদের পেছনে আছি।’

মেয়ে বললে, ‘মায়ের সকাল থেকেই উপোস চলছে। আমাদের মাছের ভাগ বেড়ে গেছে।’

ছেলে বললে, ‘তা হলে তুমি এক গেলাস জল খেয়ে এবার শুয়ে পড়ো। বেশ শীত পড়েছে। ওষুধ-টষুধ কিছু খাবে? এ সময় আবার জ্বরে পড়ে হেরে যেও না যেন। প্রত্যেকবার তুমিই হার। এবার কিন্তু জিততে হবে।’

‘না ওষুধ-টষুধ লাগবে না। এ ঠাণ্ডায় জ্বর হবে না।’

‘তুমি সোয়েটারটা পরলে না কেন? একটু বোকা আছে। ছোট মামা তোমার কী নেবে? নিয়ে পার পাবে? আমরা আছি না। মামার বাড়ি যাই আর আসার সময় ভালো প্যান্টটা জামাটা, যা পাই বাগিয়ে আনি। তুমিও যেমন! এই তো ও! মাসির দুখানা শাড়ি নিয়ে চলে এসেছে।’

মেয়ে বললে, ‘আর তিনখানা আনতে পারলেই সমানে সমান হয়ে যাবে রে দাদা।’

‘ও মায়ের বুঝি পাঁচখানা নিয়ে গেছে? চল তা হলে আর একবার যাই!’

মেয়ে এক গেলাস জল এনে চাপা দিয়ে রেখে গেল। মশারি-টশারি বেশ পরিপাটি করে খাটানো। ছেলে মাকে বলছে শুনলাম, ‘তোমার কিছু বলার আছে মা?’

‘আছে, খাবে না যখন আগে বলতে কী হয়েছিল? পয়সা কি সস্তা?’

ছেলে ওঘর থেকে হেঁকে বললে, ‘পয়সা কী সস্তা? মেয়ের বিয়ে, ছেলের পড়ার খরচ। পয়সা কি সস্তা?’ তারপর মাকে বলছে শুনলুম, ‘কী কী খেতে হবে বলো, আমরা দু-জনে সাবাড় করে দিয়ে যাই। নষ্ট হওয়াটা ঠিক নয় মা। যা বাজার কি বল? ভাগ্যিস আমরা ছিলুম!’

আমাদের কথাই ওদের দিক থেকে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। জীবনের অংশীদার বেড়ে গেছে। একা একা আর কিছু করা যাবে না। সব স্বাধীনতা চলে গেছে, এমনকী মান-অভিমানের স্বাধীনতাও। যাক যা হবার তা হয়েছে। পা পিছলে গেলে পড়ে যেতে হয়। জীবন পিছলে গেলে সংসার স্রোতে এইভাবেই ভেসে যেতে হয়। সাঁতার জানলেও কোনো লাভ হয় না।

বিছানায় শুয়ে পড়েছি। ছেলে-মেয়ে বাইরে থেকে সমস্বরে বলে উঠল, ‘গুড নাইট।’

‘গুড নাইট।’

মেয়ে বললে, ‘তোমার আবার একা শুতে ভয় করবে না তো?’

‘ভয়ের কি আছে? ভয় করবে কেন?’

ছেলে বললে, ‘যদি ভয় করে তাহলে তুমি যেন আবার মায়ের বিছানায় এসে ঢুকো না? আমাদের ঘরে চলে আসবে, কেমন?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব হয়েছে। অনেক উপদেশ ঝেড়েছিস, ‘এবার শুয়ে পড়।’

অন্যদিন আলো জ্বেলে বেশি রাত পর্যন্ত পড়ার উপায় থাকে না। আর একজনের চোখে আলো লাগে। সারাদিন কী ভীষণ খাটুনি! ঘুমের ব্যাঘাত হয়। আমাদের সারাদিন তো কোনো পরিশ্রম হয় না। অফিসে আমরা আড্ডা মারতে যাই। ফুর্তি করতে যাই। আজ আলো জ্বেলে ইচ্ছে করলে সারারাত পড়া যায়। জীবন ছোটো হয়ে আসছে। বরফের টুকরোর মতো ক্রমশই গলে যাচ্ছে। কত কী পড়ার আছে, জানার আছে। যাবার দিনে পৃথিবীর কতটুকুই বা দেখে যেতে পারব। কতরকমের খাবার আছে। কত দেশ আছে। কতরকমের জীবন আছে। পিঁপড়ের পিঠে খাওয়ার মতো এক কোণে ধরে একটা ফুটো ফাটা করে সরে পড়া। সেই এক মহিলা, এক কন্ঠস্বর, এক বাড়ি, এক ঘর, এক রাস্তা, এক অফিস। এই জগতে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে, থাকা আর না থাকার তফাতটাই ভুলে গেছি।

হ্যাঁ, অনেক জ্ঞানলাভ হয়েছে। আজ শুয়েই পড়া যাক। বিছানা ছোটো হয়ে গিয়ে ঘরটা বড়ো হয়ে গেছে। কতটা নতুন জায়গা বেরিয়েছে। আলমারিটা যেন দূরে সরে গেছে। টেবিল আর চেয়ারটা যেন ছোটো দেখাচ্ছে। যে দিকে খুশি ইচ্ছেমতো হাত পা ছুড়ছি কারুর গায়ে লাগছে না। অন্ধকারে কোনো প্রতিবাদ ভেসে আসছে না। বিছানাটাও কেমন যেন বেশি শীতল মনে হচ্ছে। এতদিনের অভ্যাস, পাশে একটা প্রতিরোধ নিয়ে ঘুমোনো! (মেছুনীকে রাজবাড়ির শয্যায় শুতে দেওয়া হয়েছিল। কিছুতেই ঘুম আসে না। শেষে মাঝরাতে আঁশের ঝুড়িটাকে জল ছিটিয়ে মাথার পাশে রেখে তবেই ঘুমোতে পারল।)

ঘুম আর কিছুতেই আসতে চায় না। সারাদিন না খেয়ে আছে। এদিকে আমি একপেট ভালোমন্দ খেয়ে শুয়ে আছি। না, আমি খোশামোদ করে খাওয়াতে পারব না। অসম্ভব। আমার বান্ধবী এখন কী করছে? নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েছে। কার পাশে শুয়েছে? সেই শয়তান লোকটার পাশে? তিনি নাকি অন্য এক মহিলাতে আসক্ত। সে শয়তান, আমি শয়তান, স্ত্রী শয়তান? দেবতারা কোথায় গেল কে জানে? না, পরস্ত্রীর কথা চিন্তা করা উচিত নয়। নির্জন, অন্ধকার, ঘরে, একা শয্যায় অন্য নারীর চিন্তা আক্ষেপ বাড়িয়ে তোলে। জীবনকে আরও অসহনীয় করে তোলে। অনেক বয়েস হয়েছে। আমার এক বন্ধু বলেছিল, পুণ্য করার জন্য সাহসের দরকার হয় না, পাপ করতে গেলে সাহস চাই। জেনুইন লম্পট হওয়া খুব শক্ত। সন্ন্যাসীকে যেমন সব ছাড়তে হয়, লম্পটকেও তেমনি সব ছাড়তে হয়। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—তিন থাকতে নয়—আমার বউটাকে ঈশ্বর যদি একটু সুবুদ্ধি দিতেন, বেশ হত। সব সময় যেন কাঁকড়াবিছের মতো খরখর করে বেড়াচ্ছে।

একটু ঘুম বোধ হয় এসেছিল। কীসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার পক্ষের রাত। বাইরে পাগলা হাওয়া উঠেছে। মাঝরাতে পৃথিবীটা কেমন যেন অচেনা হয়ে যায়। নিজের পরিচিত ঘরটাও তখন বিশালে হারিয়ে যেতে চায়। মহাকাশে ড্যাবা ড্যাবা তারা। সমুদ্র থেকে মেঘ উঠছে। চারপাশ নিস্তব্ধ। মাঝে মধ্যে কুকুরের আর্তনাদ। পাশেরই কোনো বাড়িতে রোগের যন্ত্রণায় কেউ ওঁওঁ শব্দ করছে। নি:শব্দে আকাশ গুটিয়ে চলেছে পুব থেকে পশ্চিমে। এত অন্ধকার, যেন জানালার বাইরে হাত বাড়ালে হাতে কালো রঙ লেগে যাবে।

ছেলেবেলা থেকেই আমার একটু ভূতের ভয় আছে। একা একা শুতে পারি না। একবার কৃষ্ণনগরে গিয়ে তিন রাত ঠায় বিছানায় জেগে বসে কাটিয়েছি। এই যে ঘুম ভেঙে গেল আর আসবে না। এইবার একে একে তারা আসবে। হারু গলায় দড়ি দিয়েছিল। সেই হারু আসবে এখুনি। নিত্যর মা পুড়ে মরেছিল। সেই কালো, পোড়া কাঠের মতো নিত্যর মা আসবে। বসন্ত খুন হয়েছিল। সে আসবে স্কন্ধকাটা হয়ে। সেই ছেলেটি জলে ভেসে উঠবে। গঙ্গায় যে ভাসছিল প্যান্ট জামা পরে উপুড় হয়ে। সবাই আসবে একে একে। শেষে এমন অবস্থা হবে ইচ্ছে হলেও বাথরুমে যাবার সাহস থাকবে না। এতখানি বয়েস হল তবু ভূতের ভয় আর গেল না। ইদানীং আবার চোরের ভয় ঢুকেছে। বাইরে সামান্য শব্দ হলেই মনে হচ্ছে কেউ পা টিপে টিপে হাঁটছে।

তবু বেশ কিছুক্ষণ মন শক্ত করে বিছানায় পড়ে রইলুম। চোখ বন্ধ। তবে বেশ জানি ঘরে আমি আর একা নই। অনেকে এসে গেছে। মন আর কোনো যুক্তি মানতে চাইছে না। রাত যে অচেনা। সত্য মিথ্যা, লৌকিক অলৌকিক সব ঢেকে দিয়েছে। বউয়ের সঙ্গে লড়াই আমি চালাতে পারব না। রাতে আমি বড়ো অসহায়। নরওয়ে হলে পারতুম, যেখানে ছ-মাস দিন, ছ- মাস রাত। দিনের ছ-মাস অন্তত ভূতের হাত থেকে নিষ্কৃতি। সাবিত্রী সত্যবানকে আগলে রেখেছিল বলে যমেও ছুঁতে পারেনি। স্ত্রী পাশে থাকলে ভূতে কী করবে গো। হাজার চেষ্টা করলেও আমার গলা দিয়ে এখন শব্দ বেরোবে না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ও ঘরেও কী যেতে পারব। খাটের নিচে কী আছে কে জানে? পা নামালেই যদি টেনে ধরে। ভয়! কীসের ভয় তা জানি না। ভূত আছে কী নেই কেউ স্ট্যাম্প পেপারে লিখে দিতে পারবে কি? যার কাছে আছে তার কাছে আছে।

এইবার মনে হচ্ছে খাটের তলায় কে যেন ধীরে ধীরে তালে তালে টোকা মারছে। দূরে একটা কুকুর মড়াকান্না কাঁদছে। আর নয়। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। ও সব বান্ধবী-টান্ধবী কেউ কিছু নয়। বউই সব। প্রকৃতির বেগে, ভূতের তাড়ায় মানুষ সব পারে। গ্রাম্য কথাতেই আছে হাগার নেই বাঘার ভয়। পাশের ঘরে কোনো মতে গিয়ে মশারির দড়িমড়ি ছিঁড়ে হুড়মুড় করে সেই রাগিণী দেবীর ঘাড়ে গিয়ে পড়লুম।

শীতের চেয়ে, ভূতের চেয়েও ঠাণ্ডা গলা ভেসে এল, ‘এলে তাহলে? পারলে না শেষ পর্যন্ত?’

‘না, পারলুম না।’

‘ঘেন্না করছে না?’

‘না, ও ছিল কথার কথা। অন্তরের কথা নয়।’

’তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ।’ মনে হল মাঝরাতে সিনেমার রামকৃষ্ণ কথা বলে উঠলেন।

‘এ ঘরে ভীষণ ঠাণ্ডা। উত্তরের ঘর, ড্যাম্প, ও ঘরে চলো। রাতের যেটুকু বাকি আছে সেইটুকু অন্তত ঘুমিয়ে নাও।’

এত স্নেহ কোথায় ছিল চকমকি? ঘষা না লাগলে বুঝি আগুন বেরোয় না।

সকালে একেবারে সোনার পাতের মতো রোদ উঠেছে। কোথায় কী? ভূতটূত এখন সব ভাগলবা। গরমগরম চা চলেছে। মন আর মেঘলা নেই। বর্ষার পরেই তো শরৎ আসে। বাঁ-পাশে বসে আছে ছেলে। সে খুব দুঃখের গলায় বললে, ‘এ বারেও হেরে গেলে?’

ডান পাশে বসেছে মেয়ে। সে খুব ভারিক্কি চালে লেডি ডাক্তারের গলায় বললে, ‘এবারেও ভূতের ভয়?’

ছেলে বললে, ‘তা ছাড়া আবার কী?’

মেয়ে বললে, ‘তোমাকে পাঁচু ঠাকুরের কাছ থেকে একটা মাদুলি এনে পরিয়ে দিতে হবে।’

ছেলে জিজ্ঞেস করলে, ‘তোমরা এবারে কদিন ঠাণ্ডা থাকবে?’

এর উত্তর আপাতত আমার জানা নেই। তোমাদের যখন বিয়ে হবে তোমরাও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। তবে জীবনের সার কথা মনে হয় এতদিনে বুঝতে পেরেছি। ভাগ্যের চুল্লি থেকে নিশিদিন জোড়ায় জোড়ায় পেয়ালা পিরিচ বেরিয়ে আসছে, ডিজাইনে ডিজাইনে মিলিয়ে। একটি গেলে আর একটি খোঁড়া। যার সঙ্গে যা। যেমনটি মিলিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ঠুংঠাং করতে করতে একদিন একটা ভাঙবেই। তখন অন্যটা পড়ে থাকবে সংসারের এক কোণে অবহেলায়। যতক্ষণ জোড়ে আছে, দাপটে আছে। হাতে হাতে ঘুরছে। জীবনের নির্যাসে ভরা সেই পেয়ালা পিরিচ থেকে জীবনের সুগন্ধ বেরোচ্ছে। কখনো অসাবধানে ছলকে পড়ে গেলেও পিরিচেই জমা থাকছে। একদিন একটা ভাঙবেই। তবে কোন দিন কোনটা আমিই জানি না তা তোমাদের বলব কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *