পেয়ারা গাছের নীচে
বুড়ো দাদু আর মনুয়া দিনভর পেয়ারা গাছতলায় বসে থাকে। শীত এসে যায়, পেয়ারা গাছের পাতা বড়ো কম, ডালের মাঝখান দিয়ে রোদ এসে ওদের গায়ে পড়ে, ডালপালার আঁকাবাঁকা ছায়া ওদের গায়ে পড়ে। সেই ছায়ার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ওপর দিকে চেয়ে মনুয়া দেখে আকাশের নীল গায়েও ওইরকম ডালপালা সাদা রং দিয়ে আঁকা।
মনুয়া একটা জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে, বুড়ো দাদু, কাল আমার জন্মদিন, আমার বন্ধু কাকরের তাই নেমন্তন্ন।
বুড়ো দাদু নীল আকাশ যেখানে নীল বনের পেছনে ডুবে গেছে, সেদিকে চেয়ে বলেন, কাল আমারও জন্মদিন, আমার বন্ধুদেরও নেমন্তন্ন করতে হবে।
মনুয়া বলে, কারা তোমার বন্ধুরা, বুড়ো দাদু? তাদের চিঠি দিতে হবে-না? মা কাল কিশমিশ দিয়ে পায়েস রাঁধবে।
বুড়ো দাদু আরাম কেদারার তলা থেকে ছোট্ট টিনের হাতবাক্স বের করে, কাগজপত্র ঘেঁটে বলেন, কী জানি, তাদের নাম তো মনে পড়ছে না। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমি যে কোপাই নদীতে চান করতে যেতুম, তাদের না বললে যে তারা মনে দুঃখ পাবে।
মনুয়া উঠে এসে বলে, দাও তো দেখি তোমার হাতবাক্স, আমি খুঁজে দেখি তাদের নাম ঠিকানা পাই কি না।
কিন্তু বুড়ো দাদু কিছুতেই বাক্স দেবেন না। বলেন, না রে মনুয়া, তোর বাবাকে, নাকি তার বাবাকে কাকে যেন একবার দিয়েছিলুম সে ঘেঁটেঘুঁটে তছনছ করে দেছল। পরে রসিদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তুই বরং অন্য কোথাও খুঁজে দেখি।
তাহলে মাকে ক-জনার জন্যে পায়েস রাঁধতে বলব, বুড়ো দাদু?
–বল গে এই পাঁচজনার জন্যে। না রে, দাঁড়া দাঁড়া, যে আমার নতুন চটি কোপাইয়ের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল তাকে বলে কাজ নেই। তার নষ্টামির আর শেষ নেই। কী জানি তোদের এসব ফুলগাছটাছ যদি ছিঁড়ে মাড়িয়ে একাকার করে। ওকে বাদ দিলেই ভালো।
বেশ তাহলে বলি চার জন?
–না রে দাঁড়া, দাঁড়া। ওই যার কটা চোখ, সে ভারি ঝগড়ুটি রে মনুয়া। শেষটা যদি তোর বন্ধু কাকরের সঙ্গে মারপিট করে? ওকেও না বলাই ভালো।
–তবে কি তিন জনকে বলা হবে বুড়ো দাদু?
বুড়ো দাদু অবাক হয়ে বলেন, তিন জন আবার কোথায় পেলি মনুয়া? গয়লাবাড়ির ওপারে যে থাকে, গয়লাদের কাছ থেকে চুরি করে সর মাখন খেয়ে খেয়ে, তার যে শরীরের আর কিছু নেই। অত পায়েস তার সইবে কেন? ওর নামটাও কেটে দে।
মনুয়া বললে, তাহলে আমার বন্ধু কঁকর আর কাকরের ছোটো ভাই উদো আসবে। আর তোমার বন্ধু দু-জন তো? যাই মাকে বলে আসি গে।
বুড়ো দাদু তাই শুনে মহা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কী জ্বালা! অত তাড়াটা তোর কীসের শুনি? ওই দুজনের এক জনের মুখে সারাক্ষণ মন্দ কথা লেগেই আছে, সেসব শুনে যদি তোরা শিখে ফেলিস? থাক, ওকে না বলাই ভালো।
মনুয়া বুড়ো দাদুর কাছে ঘেঁষে এসে বলে, তবে কি মোটে এক জনকে বলব?
বুড়ো দাদু, এদিকে-ওদিকে বাগানের চারদিকে, দূরে পাকড়াশিদের বাঁশঝাড়ের দিকে আমতলির পথের দিকে চেয়ে বলেন, আবার একজন কোথায় পেলি রেমনুয়া? আমাকে সুষ্ঠু নিয়ে বলেছিলুম পাঁচ জন।
মনুয়া বুড়ো দাদুর পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে, তবে কি তোমার বন্ধুরা কেউ আসবে না? বুড়ো দাদু শুনে অবাক হন।
–কেউ আসবে না কীরে? ওরা ক-জনাই শুধু আসবে না, আর তো সবাই থাকবে। কাকর, কাকরের ভাই উদো, তুই, তোর মা বাবা, কাকা, পিসি, তাদের বাবা আর ভুলো। ভুলোকে ভুলিস নে যেন নেড়িকুত্তো হলে কী হবে, কী গায়ের জোর ভুলোর। ও হয়তো একটু বেশিই খাবে। কিন্তু
মনুয়া বুড়ো দাদুর পায়ে হাত বুলিয়ে বলে, কিন্তু কী বুড়ো দাদু।
–আমি তোকে কী দেব? দে তো দেখি আমার হাতবাক্সটা। বল কী চাস্? গয়না চাস?
–গয়না তুমি কোথায় পাবে বুড়ো দাদু?
–কেন? আমার ঠাকুমার কত গয়না ছিল! ডাকাতদের সর্দার ছিল আমার ঠাকুমার বাবা। তার ভয়ে এ-অঞ্চলে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। সন্ধ্যের পর ভয়ে কেউ পথে বেরুত না। বেরুলে তাদের মেরে কেটে, গয়নাগাটি যা ছিল কেড়েকুড়ে,–ও কী মনুয়া মুখ ঢাকছিস কেন? আচ্ছা, আচ্ছা, গয়নাগাটি না-ই নিলি। তা ছাড়া সেসব নেইও। মোহর নিবি? থোলো থোলো সোনার মোহর একটাও ডাকাতি করে পাওয়া নয়। রাজা ছিল রে আমার ঠাকুরদা। ওদের বাড়িতে সবাই দুধে চান করত, সোনার খাটে বসে রুপোর খাটে পা রাখত, তকমা-পরা দাস-দাসীরা সোনা-বাঁধানো চামর দোলাত।
মনুয়া বললে, কোথায় পেত থোলো থোলো সোনার মোহর ওরা?
বুড়ো দাদু হেসে বললেন, ওমা তাও জানিস নে বুঝি? প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হত যে, না দিয়ে সব যাবে কোথা! ধান কেটে, ঘর জ্বালিয়ে
–ও কী মনুয়া, কঁদছিস নাকি? আচ্ছা মোহর না-ই নিলি, সেসব হয়তো খরচও হয়ে গেছে। অ্যাদ্দিনে। তুই বরং এই মোটা কাচের কাগজ চাপাটা নে। বুড়ো দাদু মোটা কাচের কাগজ চাপা উঁচু করে তুলে ধরেন। বুড়ো দাদুর পায়ের কাছে মাদুরে শুয়ে মনুয়া সেই কাচের মধ্যে দিয়ে ঘন নীল আকাশ দেখতে পায়। কাচের ওপর রোদ পড়ে; ধার দিয়ে রামধনুর রং ছিটোয়। রামধনুর রং এসে বুড়ো দাদুর গায়ে, মনুয়ার গায়ে বেগনি, নীল, কমলা, লাল রঙের আঁকিবুকি কাটে। পেয়ারা গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ে। পেয়ারা গাছের আঁকাবাঁকা ডালপালার ছায়া ওদের গায়ে এসে পড়ে।
মা এসে বাটি করে ওদের জন্যে গরম দুধ, পাঁউরুটি আর নরম নরম লাল চিনি দিয়ে যান। বলেন, ও মনুয়া, কাল তোর জন্মদিনে কাঁকরদের নেমন্তন্ন করে আসিস।
মনুয়া বলে, কাল বুড়ো দাদুরও জন্মদিন। বুড়ো দাদুও কাঁকরদের নেমন্তন্ন করবে।