1 of 2

পেপির দক্ষিণ পদ

পেপির দক্ষিণ পদ

বিলাত থেকে বাংলাদেশে ফিরছি।

জাহাজ যখন এডেন বন্দরে, একজন বুড়ো আরব আমার সামনে মোট নামিয়ে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে শুধোলে, ‘কিউরিও কিনবেন? ভালো ভালো কিউরিও!’

কিউরিও কেনবার বাতিক আমার ছিল। কলকাতায় আমার বৈঠকখানা দেখে বন্ধুরা মত প্রকাশ করত, ঘরখানাকে আমি প্রায় ছোটোখাটো মিউজিয়াম করে তুলেছি; কারণ সেখানে দিকে দিকে সাজানো ছিল দেশ-বিদেশের নানান শিল্প ও কৌতুক সামগ্রীর নমুনা।

বুড়ো আরবটাকে সাগ্রহে বললুম, ‘খোলো তোমার মোট, দেখাও তোমার মাল।’

মোটের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল রকম-বেরকম জিনিস। বেশিরভাগই আজেবাজে ছেলেখেলার শামিল। কিন্তু একটা জিনিস বিশেষভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে।

চোখ দেখে আমার মনের ভাব বুঝে চালাক আরবটা বললে, ‘ওটি হচ্ছে দুর্লভ পদার্থ। চার হাজার বছর আগেকার মমির পা।’

প্রাচীন মিশরের সুরক্ষিত, বিশুষ্ক মৃতদেহের কথা সকলেই শুনেছে। মিশরের বা আধুনিক ইজিপ্টের জাদুঘরে আমি অনেক মমি দেখেছি। কলকাতার জাদুঘরেও মমির একটি নিদর্শন আছে; যদিও তার অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু এই বুড়ো আরবটা যা দেখালে, তা গোটা মমি নয়, বিশুষ্ক মনুষ্যদেহের হাঁটুর নীচে থেকে কেটে নেওয়া একখানা পা মাত্র। একেবারে নিখুঁত পা, তার কোনো অংশই একটুও নষ্ট হয়নি।

জিজ্ঞাসা করলুম, ‘গোটা মমিটা কোথায় গেল?’

সে বললে, ‘কেউ তা জানে না। মহাশয়, এই মমির পায়ের ইতিহাস আছে। প্রায় চার হাজার বছর আগে প্রথম মেন্টুহোটেপ যখন মিশরের রাজা, তখন শেয়ালমুখো দেবতা আনুবিসের মন্দিরে এক পুরোহিত ছিল, নাম তার পেপি। কী কারণে জানি না, রাজা মেন্টুহোটেপের হুকুমে পেপির প্রাণদণ্ড হয়। ঘাতক আগে তার দুই হাত আর দুই পা একে-একে কেটে নেয়, তারপরে করে মুণ্ডচ্ছেদ। অনেক চেষ্টার পর আমি কেবল পেপির এই ডান পা-খানা সংগ্রহ করত পেরেছি।’

আমি বুঝলুম, বুড়োর এই বাজে গালগল্পটা ব্যাবসাদারির একটা চাল মাত্র। তা নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে, খানিকক্ষণ দরদস্তুরের পর মমির সেই পা-খানা আমি কিনে ফেললুম।

জাহাজের কাপ্তেন সেইখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি কী কিনেছি দেখে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘মি. সেন, এসব জিনিস কেনার খেয়াল ভালো নয়। ইজিপ্টের মমিকে তার স্বদেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে আমার কোনো কোনো বন্ধু সমূহ বিপদে পড়েছেন, কারণ সেটা হচ্ছে পবিত্র বস্তুর অপব্যবহার।’

কাপ্তেনের কথা হেসেই উড়িয়ে দিলুম।

কলকাতার বাড়িতে ফিরে আসতেই আমার মা করলেন মমির এই দক্ষিণপদের বিরুদ্ধে বিষম বিদ্রোহ ঘোষণা। স্পষ্ট ফতোয়া দিলেন, ‘আমার বাড়িতে ওই পচা মড়ার ঠাঁই হবে না।’

আমি বললুম, ‘পচা নয় মা, শুকনো। এই যেমন শুঁটকি মাছ আর কী! অনেকে কি শুটকি মাছ খায় না?’

মায়ের নাসিকাযন্ত্রকে সত্য-সত্যই যেন আক্রমণ করলে কোনো উৎকট দুর্গন্ধ! তাড়াতাড়ি নাকে কাপড় চাপা দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘ওরে পিশাচ, থুঃ থুঃ থুঃ! ম্লেচ্ছের মুল্লুকে গিয়ে তুই কি শুঁটকি মড়াও খেতে শিখেছিস?’

অনেক চেষ্টা ও খোশামোদের পর শেষপর্যন্ত মায়ের সঙ্গে এই রফাই হল যে, পুরোহিত পেপির দক্ষিণ-পদখানি অতঃপর বিরাজ করবে সদর-মহলে একতলার বৈঠকখানায় ‘গ্লাস-কেসে’র মধ্যে এবং কোনো ওজরেই তাকে নিয়ে আমি বাড়ির ওপরতলায় উঠতে বা অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারবে না।

তেরাত্রি পোয়াতে-না-পোয়াতে যেসব ঘটনা ঘটতে লাগল, তার কোনো মানে হয় না।

এক সকালে ঘরের বাইরে এসেই শুনলুম, মহা শোরগোল শুরু করে দিয়েছে আমাদের দ্বারবান।

কাল রাত্রে সে নাকি নিজের হাতে সদর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু আজ ভোরবেলায় উঠে দেখে, দরজা কে দোহাট করে খুলে দিয়েছে!

কিন্তু তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার দেখে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। দরজার সামনে চলন-পথে পড়ে রয়েছে পুরোহিত পেপির কর্তিত দক্ষিণ-পদ!

এই পা-খানাকে আমি স্বহস্তে রেখে দিয়েছিলুম বৈঠকখানার চাবিবন্ধ ‘গ্লাস-কেসে’র ভেতরে এবং সে-ঘরের দরজাও ছিল বাইরে থেকে তালাবন্ধ!

এ অঞ্চলের থানার ইনস্পেক্টর নবীন হচ্ছে আমার বন্ধু।

আজ সকালেও আমাদের সদর দরজা ছিল খোলা এবং সেই হতচ্ছাড়া কাটা ডান পা-খানা পড়েছিল চলন-পথের ওপরে! বলা বাহুল্য, আজও সে সচল হয়ে বেরিয়ে এসেছে তালাবন্ধ ঘরের চাবিবন্ধ ‘গ্লাস কেসে’র ভেতর থেকে!

আড়ষ্ট ও নিরুপায়ভাবে তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময়ে নবীনের প্রবেশ। এসেই সে বললে, ‘ওহে, কাল নিশুতি রাতে এমন একটা ব্যাপার দেখেছি, যা আজব বলাও চলে।’

‘আজব ব্যাপার? কোথায়?’

‘তোমাদের সদর দরজার সামনে।’

‘তার মানে?’

‘রোঁদে বেরিয়েছিলুম। হঠাৎ দেখি আমাদের আগে আগে যাচ্ছে একটা মস্ত ঢ্যাঙা মূর্তি। মাথা-সমান উঁচু একগাছা লাঠির ওপরে ভর দিয়ে সে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে পথ চলছিল।’

‘খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে?’

‘হ্যাঁ। পথের আধা আলো আর আধা অন্ধকারে তাকে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। তবু মনে হল সে বিদেশি আর তার ডান পা-খানা নেই।’

আমি রুদ্ধশ্বাসে শুধালুম, ‘তারপর?’

‘লোকটা যখন তোমাদের বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত এসেছে, তখন আমার কেমন সন্দেহ হল। আমি তাকে চেঁচিয়ে ”চ্যালেঞ্জ” করলুম। সঙ্গে-সঙ্গে সেই মূর্তিটা— বললে তুমি বিশ্বাস করবে না— ঠিক যেন বাতাসের সঙ্গে একেবারে মিলিয়ে গেল! এমন আশ্চর্য চোখের ভ্রম আমার আর কখনো হয়নি।’

এ-কথার উত্তরে কোনোরকম উচ্চবাচ্য করা আমি বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলুম না।

এবারে চূড়ান্ত ঘটনা।

যদি কোনো বিশেষজ্ঞ এই ঘটনা শোনেন, তবে তিনিই বলতে পারবেন, আমি স্বপ্নচারণ-রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলুম, না, যা দেখেছিলুম তা হচ্ছে ‘হ্যালুসিনেশন’ বা ভ্রান্তি মাত্র।

সে রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল আচমকা।

তিনতলার ছাদের ওপরে স্পষ্ট শুনলুম ধুপ-ধুপ-ধুপ শব্দ। যেন কে ভারী পা ফেলে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে ছাদের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত।

চোর নাকি? কিন্তু চোর কি পদচারণা করবে এমন সশব্দে?

দৌড়ে গিয়ে উঠলুম ছাদের ওপরে। অন্ধকার ঘুটঘুটে রাত। কিন্তু দুর্ভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত মূর্তি! ঠিক যেন পুরু অথচ স্বচ্ছ কালো মেঘ দিয়ে গড়া এক আশ্চর্য মনুষ্যদেহ এবং তার মেঘবরণ মুখমণ্ডলের মধ্যে জ্বলছে স্থির বিদ্যুৎবর্তুলের মতো দুটো নিষ্পন্দ চক্ষু!

স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলুম— দুই মিনিট, কী দুই ঘণ্টা, জানি না!…

আচম্বিতে যেন অন্য জগৎ থেকেই জেগে উঠল ভোরের পাখিদের প্রথম কাকলি।

সঙ্গে-সঙ্গে শুনলুম বীভৎস আর্তনাদ! সভয়ে রোমাঞ্চিত দেহে দেখলুম, সেই অসম্ভব মূর্তিটার বাম-হাতখানা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছাদের ওপরে গিয়ে ঠিকরে পড়ল, তারপর আবার আর্তনাদ এবং বিচ্ছিন্ন হল তার ডান বাহু, আবার আর্তনাদ এবং এবারে বিচ্ছিন্ন হল বাম পদ, তারপর মূর্তিটা একেবারে শুয়ে পড়ে আবার আর্তনাদ করে উঠল এবং তার বিচ্ছিন্ন দক্ষিণ পদখানা বিক্ষিপ্ত হল আমার পায়ের কাছে! তারপর আর আর্তনাদ শুনলুম না, কেবল দেখলুম মূর্তির ধড় থেকে বিযুক্ত হয়ে গেল মুণ্ডটা, নিবে গেল দুটো অগ্নিচক্ষু এবং ফিনকি দিয়ে ছুটতে লাগল রক্ত আর রক্ত আর রক্ত!

আর আমি সইতে পারলুম না, মাথা ঘুরে পড়ে গেলুম সেখানেই।

ছাদের ওপরেই চোখ মেললুম প্রথম রোদের ছোঁয়া পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই। আমি একলা। কেবল আমার পাশে পড়ে রয়েছে মমির সেই দক্ষিণ-পদ। সেই অভিশপ্ত বস্তুটাকে গঙ্গাজলে বিসর্জন দিয়ে স্নান করে বাড়িতে ফিরে এলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *