পেন্টাগ্রাম
মধ্যরাত্রির বিভীষিকাময় অন্ধকার জগতে আপনাকে স্বাগত৷ দেখতেই পাচ্ছেন, ঘরের মেঝেতে একটা লাল রঙের পাঁচ মাথা তারা আঁকা আছে আজ৷ না, না—ওটা নিয়ে চিন্তা করবেন না৷ নিজের পছন্দমতো একটা বসার জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে পড়ুন৷
ধরুন, একটা ফুটবল ম্যাচে আপনি ৭-১ গোলে হারছেন৷ জিত প্রায় অসম্ভব৷ এ অবস্থায় আপনি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হতে পারেন, কিন্তু আমরা জানি, Mills of God grinds slowly ফলে তিনি ধান পিষতে পিষতে আপনার ৯০ মিনিট শেষ৷ অগত্যা ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে, আপনি অন্য একজনের শরণাপন্ন হতে পারেন, যিনি বলেছিলেন— ‘‘All is not lost, the unconquerable will and the study of revenge in mortal head and the courage never to submit on youth…’’৷ কথাগুলো শুনলেই যেন ভিতরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, আপনি দ্বিগুণ উদ্যমে দৌড়তে শুরু করেন৷
হাজার-হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বহু মানুষ এই দ্বিতীয় ব্যক্তির রীতিমতো উপাসনা করে আসছেন৷ অথচ তাঁর যত ছবি পৃথিবীতে পাওয়া যায়, তার সবই আর্টিস্টের কল্পনা; শুধুমাত্র একটি ছবি ছাড়া৷ কথিত আছে, ওই একটি ছবি নাকি, মডেলকে সামনে দেখে এঁকেছিলেন আর্টিস্ট৷ আজ, সেই আর্টিস্টের মতো, আমি আর আপনিও তাঁকে দেখার চেষ্টা করব৷
আমাদের এই অন্ধকার ঘরের মেঝেতে ওই তারাটার ঠিক মাঝখানে এসে উপস্থিত হবেন তিনি৷ তারপর যে যার ইচ্ছে মতো বর চেয়ে নিতে পারেন তাঁর থেকে৷ তাহলে চলুন, আমরা এক মনে তাঁকে ডাকতে থাকি৷ হয়তো দেখব কোনও এক ফাঁকে, দর্শক আসনে বসেই মন দিয়ে আমাদের গল্প শুনছেন তিনি৷
ঘরের ভিতরে একটা আলো জ্বলছে টিমটিম করে৷ আলো-আঁধারির মধ্যে দেখা যাচ্ছে দুটো মানুষকে৷ একটা গমগমে চাপা শব্দ ভেসে আসছে কোথাও থেকে৷ হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে দু-জনে৷ ওদের ঠিক সামনে একটা তেপায়া টেবিল৷ সেই টেবিলের উপরে ঘরের একমাত্র আলোর উৎস একটা মোমবাতি৷
টেবিলের উপরে জড়ো করে রাখা আছে একতাড়া কাগজ৷ সেই কাগজ থেকে দেখে কিছু একটা উচ্চারণ করে চলেছে মানুষ দু-জন৷ ভাষাটা কোনো পরিচিত ভাষা নয়৷ তবে ভালো করে শুনলে বোঝা যায়, কাউকে যেন ডাকছে তারা৷
টেবিলের পাশ জুড়ে রক্ত দিয়ে আঁকা চারটে পাঁচকোনা তারা৷ পেন্টাগ্রাম৷ রক্তের ধারা লাইন বেয়ে তার আশপাশে ছড়িয়েছে৷
চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে৷ অস্থির চাপা নৈঃশব্দ্য গোটা ঘরটাকে গ্রাস করছে একটু-একটু করে৷
মন্ত্র পড়া থেমে যেতে দু-জনের একজন আরেকজনের দিকে এগিয়ে এল৷ টেবিলের উপর পড়ে থাকা একটা ছোট ছুরি তুলে নিল হাতে৷ মোমবাতির শিখাতেও বেশ বোঝা যায় ছুরিটা ধারালো৷ সেটা নিপুণ দক্ষতায় নিজের বাঁ হাতে ধরে নিজেরই ডানহাতের কবজির কাছে ঠেকিয়ে টান দিল সে৷ মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হল না৷ শুধু হাতের গোড়া থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে কয়েক ফোঁটা মাটিতে পড়ল৷
রক্তের বাকি ফোঁটা সমেত হাতটা টেবিলে রাখা বাটির উপরে ধরল মানুষটা৷ বাটির ভিতরে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত জমতে শুরু করেছে৷ পাশের জনও একই ভাবে কবজির উপর ছুরি টেনে সেটা এগিয়ে ধরল বাটির উপরে৷ ভিতরে মিশতে লাগল দু-জনের রক্ত৷ ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত মিশে একটা বিশেষ আকৃতি নিতে লাগল সেখানে৷ একটা গমগম শব্দ শোনা যেতে লাগল ঘরময়৷
টেলিফোনের তীব্র শব্দে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল আমার৷ কাল রাতে ঘুমাতে-ঘুমাতেই আড়াইটে বেজেছে৷ ভেবেছিলাম দুপুর না গড়ালে আর ওঠা হবে না, উঠে কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে সকাল সাড়ে সাতটা বেজেছে৷ এমনিতে আমার চেহারাটা বেশ ছোটখাটো৷ তার উপরে ফোনটা রাখা আছে দূরে৷ ফলে শুয়ে-শুয়ে সেটা অবধি হাত যাবে না৷
ল্যান্ডলাইন, সাইলেন্ট করারও উপায় নেই৷ মোবাইল ফোন আমি ব্যবহার করি না৷ ইচ্ছা করে না একেবারে৷ এত বড় ঝক্কিটা সারাদিন ট্যাঁকে নিয়ে না বেরোলে লোকে সেকেলে বলুক আর যাই বলুক, কিছু যায় আসে না৷
মাথাটা গরম হয়ে গেল৷ হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে একটু ধমকের গলাতেই বললাম, ‘কী হয়েছে কী?’
‘মিস্টার ঘোষ? আমি থানা থেকে বলছি৷’
‘অ্যাঁ!’ পরের কথাটাও ধমকের গলাতেই বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু গিলে নিয়ে বললাম, ‘পুলিশ! কী ব্যাপার বলুন তো?’
‘একটা ব্যাপারে আপনার একটু সাহায্য দরকার৷ আপনি ফ্ল্যাটেই আছেন তো আপাতত?’
‘হ্যাঁ তা আছি, কিন্তু…’ আর কিছু বলার আগেই গত কয়েক মাসের আলগা পাপগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল৷ নাঃ, তেমন কিছু তো করিনি! মানে সাতসকালে পুলিশে কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে যেতে পারে তেমন কিছু করিনি৷ ভেবে-চিন্তে খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম৷ গলাটা একটু সামলে নিয়ে বললাম, ‘বেশ তো, আসুন না, আমি আপাতত ফাঁকা আছি৷’
ফোনটা রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করলাম৷ এক নিঃশ্বাসে দু-দুটো সিগারেট ফুঁকে ফেললাম৷ সকালে ঘুম ভেঙে মেজাজটা খিঁচড়ে গেছিল৷ ভেবেছিলাম উটকো লোক বা কাস্টমার কেয়ারের ফোন৷ এখন মনে হচ্ছে সেগুলো হলেই হয়তো ভালো হত৷
রাতের জামাকাপড় ছেড়ে রেডি হয়ে থাকলাম৷ তিনি যে কখন আসবেন আর কী বলবেন সেটা ভেবেই মনটা অস্থির হয়ে উঠল৷
আধ ঘণ্টার বদলে ঠিক কুড়ি মিনিট পরে আমার ফ্ল্যাটের দরজায় বেল বেজে উঠল৷ কপাল থেকে ঘাম মুছে আমি তড়িঘড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম৷
পুলিশ অফিসারের চেহারাটা বেশ নাদুস-নুদুস৷ একবার দেখেই বোঝা যায় আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে আসেননি৷ উলটে ঠোঁটের ডগায় একটা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘সমীর ঘোষ, তাই তো?’
আমি দুশ্চিন্তাটা কাটিয়ে উঠে বললাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’
‘আমি অবশ্য আপনার ছবি দেখেই আসছি৷ চোখে পড়ার মতো চেহারা আপনার৷ বাঙালিদের মধ্যে এমন লম্বা-চওড়া ভারী একটা দেখা যায় না৷
ভিতরে আসছি একটু…’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ… আসুন না৷’
ভদ্রলোক নিজে হাতেই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এলেন৷ সাধারণত দেখেছি পুলিশ অফিসাররা কোথাও ঢোকার আগে ঘরের ভিতরে যিনি আছেন তাকে সৌজন্য-টৌজন্য দেখানোর ধার ধারেন না৷ সটান ঢুকে আসেন৷ শহরের সবকটা বাড়ির অন্দরমহলেই তাদের অদৃশ্য মালিকানা আছে৷ নিজের বাড়িতে নিজে ঢুকবেন সরেজমিন করতে তাতে আবার বাধা দেবে কে?
যাই হোক, এখন আর এসব কথা মাথাতেও আনছি না আমি৷ হাতের পাঁচটা আঙুল বাড়িয়ে সোফাটা তাঁকে দেখিয়ে দিয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? মানে আমাদের ছোটবেলায় বাড়িতে পুলিশ এলে পাড়াপড়শি ভাবত ভয়ঙ্কর কিছু একটা কেলেঙ্কারি হয়েছে৷’
ভদ্রলোক সোফায় বসতে-বসতে বললেন, ‘এখন আর সে জমানা নেই৷ বাড়িতে ইনকাম ট্যাক্স রেইড হওয়াটা এখন বেশ গর্বের ব্যাপার৷ লোকে বোঝে এ লোকের বিস্তর টাকা আছে৷ আরে দামি ফ্রিজ টিভি এখন সবাই কিনতে পারে৷ আসল খানদানি জিনিস হল আয়কর হানা, কী বলেন?’
আমার খুব একটা হাসি পেল না৷ তাও গাজোয়ারি একটা হাসি ফুটিয়ে তুললাম মুখে৷ বিদেশি সিনেমায় দেখেছি পুলিশের গুড কপ ব্যাড কপ রুটিন বলে একটা জেরা করার পদ্ধতি আছে৷ প্রথমে একজন শুন্ডির রাজা চেহারার পুলিশ বিস্তর মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে, চা সিগারেট খাইয়ে, পেট থেকে কথা বের করার চেষ্টা করেন৷ তাতে কাজ না হলে হাল্লার রাজা এসে বেদম ঠ্যাঙানি দিয়ে হাড়মাস এক করে দেন৷
‘কোনও অ্যাক্সিডেন্ট-ট্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল নাকি এর মধ্যে?’ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি৷ এতক্ষণে সোফায় ঠেনা নিয়েছেন তিনি৷
‘কই না তো৷’ একটু থতমত খেয়ে বললাম আমি৷
‘তাহলে মুখে এরকম কাটা দাগ?’
মুখে হাত বুলিয়ে আমি কিছু অনুভব করতে পারলাম না৷ কাটা দাগ আমার মুখে তো থাকার কথা নয়৷ আমি উত্তর না দিতে প্রসঙ্গটা আর এগোল না৷
‘যাক গে, আপনার থেকে কয়েকটা কথা জানার ছিল৷’ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, ‘তবে তার আগে আপনার হাতটা একবার দেখতে চাই৷’
‘হাত!’ আমি আবার পাপের লিস্ট লেখা খাতাটা চোখের সামনে মেলে ধরলাম৷
‘হ্যাঁ… মানে আপনার কবজিটা, বাঁ হাতের কবজি…’
‘কিন্তু কেন বলুন তো?’
‘আহা দিন না…’ একরকম এগিয়ে এসেই আমার কবজিটার উপরে ঝুঁকে পড়লেন তিনি৷ আমি আর বাক্যব্যয় না করে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে৷ আমার হাতের কবজির উপরে একটা ছোট আড়াআড়ি চেরা দাগ আছে৷ শুকনো কাটা দাগ৷ ঘড়ি পরলে ঢাকা পড়ে যায়৷ সেটার দিকে কিছুক্ষণ মন দিয়ে তাকিয়ে থেকে হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘এই দাগটা তো বেশ পুরনো মনে হচ্ছে, নিজে কেটেছিলেন?’
একটু সময় নিয়ে উপরে-নীচে মাথা দোলাই আমি, ‘হ্যাঁ, মাস ছয়েক আগে, ক্ষতটা গভীর হয়েছিল বলে এখনও মেলায়নি দাগটা৷’
‘কেন? হঠাৎ নিজের হাত কাটলেন কেন? কোনও প্রেম-টেম?’
‘কী যে বলেন, এই বয়সে প্রেমে হাত কাটব! ওসব কিছু নয়৷’
‘তাহলে?’
এবার আর উত্তর না দিয়ে আমি তার দিকে মুখ তুলে তাকালাম৷ গলায় আত্মবিশ্বাস এনে জিগ্যেস করলাম, ‘ঠিক কী হয়েছে বলুন তো? আমার হাতের দাগ দেখতে থানা থেকে আপনাকে পাঠায়নি নিশ্চয়ই…’
‘অনুপম পাল আর মৃগাঙ্ক সান্যাল, এই দু-জনকে আপনি চেনেন?’
এতক্ষণে একটা খটকা লাগতে শুরু করেছে আমার৷ কিছু একটা যেন আঁচ করতে পারছি, বললাম, ‘হ্যাঁ, চিনি৷ কেন?’
‘কাল রাতে ওনারা দু-জনেই মারা গেছেন৷’
‘মা… মারা গেছে! একসাথে!’ আমি উঠে দাঁড়াতে গিয়েও বসে পড়লাম৷
‘হ্যাঁ৷ একসাথে, একই ঘরে৷ রাত ঠিক সাড়ে বারোটা নাগাদ৷’
‘কিন্তু কী করে?’
‘এপারেন্টলি দে কমিটেড সুইসাইড৷ বাই কাটিং দেয়ার ভেইন্স৷’
ব্যাপারটা মাথার ভিতরে ধরতে একটু সময় লাগল আমার৷ কপালে একটা হাত রেখে বসে রইলাম কিছুক্ষণ, মাথা না তুলেই বললাম, ‘আজ অনেক মাস হয়ে গেল ওদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই আমার৷ তবে আমি যতদূর জানি ওরা নিজেদের লাইফে খুশিই ছিল৷ হঠাৎ এইসব যে কেন করতে গেল… ডিপ্রেশনে ভুগে…’
‘না, ডিপ্রেশন নয়৷ এবং সেটাই পুলিশের সন্দেহর কারণ৷ সারকামস্টেন্স দেখে আমাদের মনে হচ্ছে দে ওয়্যার ইনটু সাম কাইন্ড অফ স্যাটানিক রিচ্যুয়ালস৷’
‘হোয়াট!’ আমার চিৎকারটা মুখ থেকে এত জোরে বেরিয়েছে যে গোটা ফ্ল্যাট জুড়ে তার একটা মৃদু প্রতিধ্বনি শোনা গেল, ‘স্যাটানিক রিচ্যুয়াল! এই কলকাতা শহরে! অ্যাবসার্ড৷’
‘খুব বেশি অ্যাবসার্ড নয় মিস্টার ঘোষ৷ ও কাজটা যে আপনিও আগে করেছেন সেটা আপনার হাতের শুকিয়ে যাওয়া দাগটা দেখলেই বোঝা যায়৷’
‘সে সবের একটা আলাদা কারণ ছিল, খানিকটা ঝোঁকের বশেই বলতে পারেন৷’
‘সে ঝোঁক এখন কেটে গেছে বলছেন?’ বাঁকা চোখে তাকালেন তিনি৷
আমি কিছুক্ষণের জন্যে কী উত্তর দেব ভেবে পেলাম না৷ গলাটা নরম করে বললাম, ‘এসব একসময় পিয়ার প্রেশারে এসে করেছি৷ হয়তো একটু বড় বয়সেই করেছি৷ তার মানে তো এই নয় যে এ ঘটনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে৷’
‘আমি কি তাই বলছি নাকি?’ শুরুর হাসিটা আবার মুখে ফিরিয়ে আনলেন তিনি, ‘আমি তো ফোন করেই আপনাকে বলেছিলাম আপনার সঙ্গে একটু দরকার আছে, আসলে…’ এবার নিজের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করলেন, ‘আসলে যে রিচুয়ালটা করতে গিয়ে ওনারা মারা গেছেন, সেটা ঠিক কী ধরনের তা আমরা জানতে চাই৷ আপনি যখন আগেও এই দু-জনের সঙ্গে কাজটা করেছিলেন তখন আপনার থেকে ভালো ব্যাপারটা কে জানবে, তাই না?’
ঘাড়ে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করলাম আমি৷ একটু আগে যেভাবে ভিতরের উত্তেজনাটা প্রকাশ করে ফেলেছি তাতে ব্যাপারটা খারাপের দিকেই এগোচ্ছিল৷ কানের পিছনটা এখনও গরম হয়ে আছে৷ বললাম, ‘সেসব গোড়া থেকে বলতে গেলে অনেকটা টাইম লাগবে৷’
‘আপনি যে ফোনে বললেন আপনি আজ ফাঁকা৷’
‘হুম…’
মুখে-চোখে একটু জল দিয়ে এলাম আমি৷ এবার আর চেয়ারে না বসে ভদ্রলোকের পাশে সোফাতেই বসে পড়ে বললাম, ‘ব্যাপারটা শুরু হয় মৃগাঙ্কর হাতে ধরে৷ ওই আমাকে আর অনুপমকে কোডেক্স গিগাসের ব্যাপারটা জানায়৷ আমাদের আগ্রহটা তারপর থেকেই বাড়তে থাকে৷’
‘কোডেক্স গিগাস! সেটা কী আবার?’
‘একটা বই৷ অতি প্রাচীন বই৷ লেখা হয় সাতশো বছর আগে৷ অতদিন আগে লেখা যেক-টা বইয়ের অরিজিনাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট এখনও টিকে আছে তার মধ্যে কোডেক্স গিগাস বৃহত্তম৷ লম্বায় একমিটার, চওড়ায় কুড়ি ইঞ্চি, পাতার সাইজ কল্পনা করে নিন৷ পুরোটাই ল্যাটিনে লেখা৷’
‘বাবা! সে তো ঢাউস জিনিস! কিন্তু কী লেখা আছে এতে?’
আমার ঠোঁটের কোণে একটা সরু হাসি খেলে যায়৷ আর একটু সরে এসে বলি, ‘সেটা পরে বলছি, আগে বইটার সম্পর্কে কয়েকটা কথা জেনে নিন৷ বানিয়ে বলছি না কিন্তু, চাইলেই এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ কাউকে জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন৷’
‘বেশ, বলুন…’
‘লম্বা এবং চওড়া ছাড়াও বইটা প্রায় সাড়ে আট ইঞ্চি মোটা৷ প্রতি পাতায় অসংখ্য ছবি, নকশা এবং সোনা বা রূপার জলরং করা ইন্সক্রিপ্সশান৷ বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন এই সমস্ত লেখা এবং আঁকা কেউ যদি দিনে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে শেষ করতে চান তাহলে তাঁকে টানা পাঁচ বছর ধরে লিখে যেতে হবে৷ অথচ সেই বিজ্ঞানীরাই গবেষণা করে বলেছেন যে কোডেক্স গিগাস লেখা হয়েছিল অত্যন্ত কম সময়ে৷ সম্ভবত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে৷’
‘সে তো হতেই পারে৷ হয়তো একজনের বদলে কয়েকজন মিলে লিখেছিল৷’
‘উঁহু… তা হতে পারে না৷ মনে রাখবেন বইটা পুরোটা হাতে লেখা৷ প্রথম থেকে শেষ অবধি একই হাতের লেখা, একই অক্ষরবিন্যাস, একই ধরনের কালির টান৷ আমাদের বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে লেখার ধরনেও কিছু পরিবর্তন আসে৷ এক্ষেত্রে কিন্তু বইয়ের প্রথম থেকে শেষ অবধি কোনও বদল আসেনি৷ যার থেকে তাঁরা ধারণা করেন বইটা খুব অল্প সময়ে লেখা হয়েছে৷ একটা পাঁচ বছরের কাজ কী করে একটা মানুষ কয়েক হপ্তায় শেষ করল সে প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেনি৷’
‘কিন্তু এর সঙ্গে আপনাদের সম্পর্কটা…’
‘আহা আপনি বড্ড তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছেন৷ আমার বলা এখনো শেষ হয়নি৷’
‘বেশ, বলতে থাকুন৷’
‘জনশ্রুতি চালু আছে যে কোডেক্স গিগাস কয়েক সপ্তাহে নয়, মাত্র এক রাতেই লেখা হয়৷ মধ্যরাত থেকে ভোর অবধি সময়ের মধ্যে৷ বিশেষ একজনের সহযোগিতায়৷’
‘কার সহযোগিতায়?’
এ প্রশ্নের উত্তর দিই না আমি, বলতে থাকি, ‘গল্পটা অনেকটা এইরকম৷ চেক প্রজাতন্ত্রের বেনেডিক্টাইন মনস্ট্রির এক সাধু চার্চের আইনকানুন লঙ্ঘন করে এক ভয়াবহ পাপ করেন৷ সেকালে সেটা ছিল ভয়ানক অপরাধ৷ ফলে অবিলম্বে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷ তবে ফাঁসি কিংবা শূলে চড়ানো নয়, চার্চেরই এক পরিত্যক্ত ঘরের ভিতরে তাঁকে ঢুকিয়ে ঘরের দরজা পাথরের দরজা দিয়ে সিল করে দেওয়া হয়৷ অর্থাৎ দেওয়ালের ভিতরে জীবন্ত সমাধি৷
তো সিল করা সেই ঘরে বসে সাধু ভাবলেন মরার আগে কিছু একটা করে যাওয়া উচিত৷ ফলে তিনি এতদিন সাধনা করে যা-যা জানতে পেরেছেন সেই সবই কোথাও একটা লিখে যাবেন ঠিক করলেন৷ কিন্তু এও বুঝলেন যে খাদ্য জল ছাড়া তাঁর আয়ু বেশিদিন না৷ তার মধ্যে এত কিছু লিখবেন কী করে?
অনেক ভাবনা-চিন্তার পরে তিনি শয়তানের শরণাপন্ন হলেন৷ গোপন তন্ত্রের জাদুতে জাগিয়ে তুললেন শয়তানকে৷ তার সাহায্য নিয়েই মাত্র একরাতে শেষ করলেন বইটা৷ তবে শয়তান তো আর খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পাত্র নয়৷ তার শর্ত হল, সাহায্যের বদলে বইতে ঈশ্বরের পাশাপাশি শয়তানের সম্পর্কেও কিছু লিখতে হবে৷ সাধু রাজি হয়ে গেলেন… আপনার গুগলে কোডেক্স গিগাস লিখে একবার সার্চ করে দেখুন, একটা ছবি আসবে…’
‘কিসের ছবি?’ একটু যেন হকচকিয়ে গেলেন ভদ্রলোক৷
‘আহা করুনই না…’
পকেট থেকে ফোন বার করে গুগলে গিয়ে সার্চ করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘এ তো অনেকটা আমাদের মহিষাসুরের মতো মনে হচ্ছে৷’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ… কথিত আছে ওই ছবিটি নাকি শয়তানের একমাত্র পোর্ট্রেট৷ বাকি যারা এঁকেছেন তাঁরা কল্পনা করে এঁকেছেন৷ তাঁকে নিজের চোখের সামনে দেখে তাঁর শর্ত মতো একটা গোটা পাতা জুড়ে ছবিটা এঁকেছিলেন সেই সাধু৷ এই কারণেই কোডেক্স গিগাসকে ডেভিলস বাইবেল বলা হয়৷’
‘কিন্তু কী লেখা আছে এতে?’
‘বেশিরভাগটাই বাইবেলের ল্যাটিন ভার্সন৷ যাকে বলা হয় ভালগেট৷ ভালগেট বাইবেলই চার্চের কাছে সব থেকে পবিত্র বাইবেল৷ তাছাড়াও কিছু ছোটখাটো গুপ্তবিদ্যা ইত্যাদির আভাস পাওয়া যায় এতে৷ বইয়ের প্রতিটা পাতা কাগজ নয়, প্রাণীর চামড়া দিয়ে তৈরি৷ হিসেব করে দেখা গেছে এই বইটা বানাতে মোট একশো ষাটখানা গাধাকে কেটে তাদের চামড়া ব্যবহার করা হয়েছিল৷’
‘এটা এখন আছে কোথায়?’
‘সুইডেনের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে, যদিও জনসাধারণকে সেটাকে দেখতে দেওয়া হয় না৷’ এতক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলাম আমি৷ এবার মুখ তুলে বললাম, ‘এবার আশা করি আপনার আজকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব—আমার দুই বন্ধুর সঙ্গে এই বইয়ের সম্পর্ক কোথায়৷’
ভদ্রলোক আর নতুন করে কিছু বললেন না৷ আমি বলে চললাম, ‘সমস্ত বিষয়টা যদি আপনি অস্বীকার করেন, তাও ভেবে দেখুন, ল্যাটিন ভাষায় লেখা ভালগেট বাইবেল৷ যা কিনা সব থেকে বেশি পবিত্র, তাতে হঠাৎ লেখক শয়তানের ছবি আঁকতে যাবেন কেন? তাহলে কি বাইবেলটা খোলস? আসলে অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেওয়া ছিল তাতে? কিন্তু তেমন কিছু তো লেখা নেই৷ এখানেই আসল রহস্য৷ এই কোডেক্স গিগাস একটি অসম্পূর্ণ বই৷ বইয়ের বাঁধাই পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর ভিতর থেকে প্রায় বাহান্নটি পাতা কোনও সময়ে কেউ ছিঁড়ে নিয়েছে৷ কে নিয়েছে এবং কেন নিয়েছে তা আর জানা যায় না৷ কথিত বিশ্বাস অনুযায়ী সেই বাহান্নটি পাতাতেই আসল সংকেত দেওয়া ছিল৷ মৃগাঙ্কের ধারণা ছিল এই বাহান্নটি পাতায় কী লেখা ছিল তা সে জানত!’
‘সেকি! সেটা কেমন করে সম্ভব?’
‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওর দাদু ইংল্যান্ডের এক আর্কিওলজিস্টের আন্ডারে কাজ করত৷ তিনি খুন হয়ে যেতে দাদু আর সেখানে কাজ পাননি৷ তাছাড়া সে এক ভায়োলেন্ট সময়৷ কে কখন কার শত্রু হয়ে দাঁড়ায় বলা তো যায় না৷ ফলে বিদেশি সেক্রেটারি রাখত না কেউ৷ এই আর্কিওলজিস্ট- ই নাকি সে পাতাগুলোর ঠিকানা জানতে পেরেছিলেন কোনওভাবে৷ সেগুলো উদ্ধার করেছিলেন কি না জানি না, তবে তার কনটেন্ট সম্পর্কে দাদুকে মরার আগে কিছু জানিয়ে যান তিনি৷ বছরখানেক আগে সেই দাদুর মৃত্যুর পর তার একটা পুরনো ডায়েরি মৃগাঙ্কের হাতে আসে৷ সে পদার্থবিদ্যার কৃতী ছাত্র ছিল৷ সেখান থেকে ধীরে-ধীরে অকাল্টের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷’
একটু দম নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘অর্থাৎ সেই ডায়েরি থেকেই এই রিচ্যুয়ালের আভাস পায় সে৷ আর এই অনুপম পাল?’
‘ও আমার মতোই৷ মৃগাঙ্কের মুখে সব শুনেটুনে ইন্টারেস্টেড হয়ে রাজি হয়৷ তবে আমি আর অনুপম একবারের বেশি ওসব করতে চাইনি৷’
‘কেন?’
‘কেন আবার কী? একবার করেই বুঝেছিলাম এসব স্রেফ গাঁজা৷ হাতের কাটাটার জন্যে ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করতে হয়েছিল কিছুদিন৷ তারপর থেকেই মৃগাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ নেই আমাদের৷ অনুপম যে আবার কেন গেল সেটাই ভাবছি৷’
‘কিন্তু মারা গেল কেন বলুন তো? মানে রিচ্যুয়ালে শুধু হাত কাটার কথা লেখা ছিল নাকি রক্ত বইয়ে একেবারে মৃত্যু অবধি৷’
‘সেসব আমাদের খুলে বলেনি মৃগাঙ্ক৷ শুধু বলেছিল কাজটা যদি ঠিকঠাক ভাবে হয় তাহলে ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে৷ যাতে নাকি আমরা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে বেশি কিছু ক্ষমতার অধিকারী হব৷’
‘কীরকম ক্ষমতা?’
‘তা জানি না৷ প্রাণের বন্ধু ছিল, আর একটু হাত কাটাকাটি বই তো নয়৷ অত ভেবেচিন্তে এগোইনি৷’
কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে রইলেন ভদ্রলোক৷ আর মনে হয় প্রশ্ন নেই কিছু৷ উঠতে উঠতে বললে, ‘আপাতত যা জানার ছিল জেনে নিলাম৷ আমাদের প্রাইমারিলি মনে হচ্ছে অতিরিক্ত রক্ত বেরনোর জন্যে দু-জনেই সেন্সলেস হয়ে যান৷ তারপর রক্ত বেরিয়ে মারা যান৷ আজ উঠি, ঘটনাস্থলে যদি আপনার দরকার পড়ে তাহলে আবার যোগাযোগ করব৷’
ভদ্রলোক চলেই যাচ্ছিলেন, আমি এবার তাকে থামিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা একটা কথা৷ যদিও খুব একটা দরকারি নয়… হয়তো কোনও কাজেও লাগবে না…’
‘কী কথা?’
একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘এই ধরুন দিন পাঁচেক আগে দুপুরের দিকে আমার এই জানলার পর্দা সরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলাম৷ হঠাৎ মনে হল ঠিক আমার মতো দেখতে একটা লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার জানলার দিকে চেয়ে আছে৷ একেবারে হুবহু আমার মতো৷’
‘ডপেলগ্যাঙ্গার! তারপর?’
‘আমাকে জানলায় দাঁড়াতে দেখে ধীরে-ধীরে সরে পড়ল৷’
‘ইন্টারেস্টিং, তারপর আর কিছু হয়নি?’
‘উঁহু, আর দেখতে পাইনি তাকে৷ তবে দুটো মানুষের চেহারায় এত মিল থাকতে পারে সেটা লোকটাকে দেখার আগে ভাবতেও পারিনি আমি৷’
‘ওকে, জানা থাকল, আচ্ছা আজ চলি৷’
লোকটা বেরিয়ে যেতে আমিও চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ কবজির কাটা দাগটায় হাত বুলিয়ে নিলাম একবার৷ একবছর আগের সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে৷ এমনকি মৃগাঙ্ক সেদিন ঠিক কী কারণে রিচ্যুয়ালটা করতে চেয়েছিল সেটাও আমি জানি৷ কিন্তু সব কথা তো আর পুলিশকে বলা যায় না৷ তবে যে কথাটা ভেবে আমার সব থেকে বেশি আশ্চর্য লাগছে তা হল, এতদিন পরে হঠাৎ দু-জন মিলে ওসব করতে গেল কেন? বিশেষ করে সেদিনের কাজটা যখন সফল হয়েছিল…
যে পুলিশ অফিসারটি সেদিন আমার বাড়িতে এসেছিলেন তার নাম অংশুমান চৌধুরী৷ যাওয়ার আগে কোনও এক ফাঁকে আমার টেবিলে একটা কার্ড রেখে গেছিলেন তিনি৷ তাতে নম্বরটা লেখা ছিল৷ ফোন এল সপ্তাহ খানেক পরে৷ প্রথমেই জানালেন যে এই আত্মহত্যা দুটো যে তন্ত্রমন্ত্র করতে গিয়ে হয়েছে সেটা বেশ কায়দা করেই পাঁচকান হতে দেয়নি পুলিশ৷ ফলে খুব একটা বাড়াবাড়ি করেনি মিডিয়া৷ পুলিশের খাতাতেও ব্যাপারটা কোল্ড কেসের আওতায়ই ফেলে দেওয়া হয়েছে৷
আমিও যে খুব একটা মাথা ঘামিয়েছি তা নয়৷ ওদের দু-জনের সঙ্গে আমার এমনিতেই সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না৷ মরল কি বাঁচল তাতে আমার কী যায় আসে! তবে অংশুমানবাবু বললেন এই কেসটা নিয়ে নাকি তার নিজের কিছু আগ্রহ জন্মেছে৷ মৃগাঙ্ক আর অনুপম ঠিক কিসের সাধনায় ব্ল্যাক ম্যাজিকের আশ্রয় নিয়েছিল সেটা না জানা অবধি তাঁর রাতে ঘুম হচ্ছে না৷ সেই কারণেই একবার আমাকে সঙ্গে নিয়ে অকুস্থলে ঘুরে আসতে চান৷ ভেবে দেখলাম প্রস্তাবটা খারাপ নয়৷ অল্প একটু আগ্রহ যে আমার হচ্ছে না, তা নয়৷ ভেবে-চিন্তে যাওয়াই ঠিক করলাম৷
অংশুমানবাবুর গাড়িতে উঠে বসতে সরু একটা হাসি হাসলেন তিনি৷ তারপর স্টার্ট দিতে-দিতে বললেন, ‘আপনাদের তিনজনের মধ্যে যে একটা গাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছিল তার একটা কারণ বুঝতে পারছি জানেন?’
‘কী কারণ?’ আমি উইন্ডস্ক্রিনে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম৷
‘আপনারা তিনজনেই একা থাকতেন৷ মানে পরিবার-পরিজন বলতে তেমন কেউ ছিল না৷ বাকি দু-জনের খোঁজ নিয়ে দেখলাম…’
‘আমরা তিনজনেই অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি৷ সেখান থেকেই বন্ধুত্ব… তাই পরিবার বলতে কিছু থাকার কথাও নয়৷’
‘মানে বেশ ছোটবেলা থেকেই বন্ধুত্ব, তাই না?’
‘জ্ঞান হওয়া থেকেই৷ আচ্ছা আমরা স্ট্যান্ড রোড দিয়ে যাব তো?’
‘আপনি মৃগাঙ্কর বাড়ি চেনেন?’
‘না চেনার কী আছে? একসময় নিয়মিত যাতায়াত ছিল৷’
হ্যাঁ, তা তো বটেই৷’
পোস্তায় বাজারের পাশ দিয়ে গাড়িটা এসে দাঁড়াল মৃগাঙ্কের ফ্ল্যাটের সামনে৷ বাইরে থেকে দেখে মোটেই বোঝার উপায় নেই সপ্তাহখানেক আগে এখানে একসাথে দুটো মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷
ফ্ল্যাটটাকে ছ-মাস আগে যেরকম দেখেছিলাম এখন তার সঙ্গে তেমন কোনও পার্থক্য নেই৷ আশপাশে কয়েকটা লোককে চোখে পড়ল৷ তারা আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না৷
বাইরের দরজা দিয়ে আমরা দু-জনে ভিতরে ঢুকে এলাম৷ মৃগাঙ্কের অ্যাপার্টমেন্টটা ছিল তিনতলায়৷ লিফটে উঠে করিডর পেরিয়ে একদম শেষমাথায় রুমটা৷ অংশুমানবাবুর হাতে চাবি ছিল৷ তিনি নিজেই এগিয়ে গিয়ে দরজার নবে সেটা ঢুকিয়ে একটু চাপ দিয়ে বললেন, ‘ভিতরে যদিও কিছু চিহ্ন নেই আর৷ স্টিল ইটস আ ক্রাইম সিন৷ বি কেয়ারফুল৷’
ভিতরে ঢুকে কিন্তু আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ এতদিন ওদের দু-জনের সঙ্গে দেখা নেই৷ মনের আনাচ-কানাচ থেকেও একেবারে সরিয়েই ফেলেছি৷ তাও মুখ দুটো মনে পড়তেই বিষণ্ণতায় ভরে উঠল মনটা৷ একসময় এই ঘরটায় বসে কত তাস কিংবা ক্যারাম খেলেছি৷ এমনকি জীবনের প্রথম সিগারেটে অবধি এখানে বসেই টান দিয়েছি৷
বাঁদিকে একটা সময়ে মৃগাঙ্কের ছবি টাঙানো থাকত, এখন সেটা কেউ সরিয়ে নিয়েছে৷ ফ্রেমের পিছনের দাগটা ফুটে আছে৷ তার মুখটাও যেন আবছা হয়ে এসেছে আমার মনের ভিতরে৷ সেই ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বললাম, ‘মৃগাঙ্কের একটা অসুখ ছিল জানেন?’
‘অসুখ? কীরকম?’
‘নামটা ঠিক জানি না, নার্ভের কোনও রোগ৷ ভয়ানক ব্যথা হত৷ ব্যথা সহ্য করতে না পেরে নিজেই নিজের শরীর কামড়ে মাংস তুলে ফেলত৷ আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল কয়েকবার, আমরাই বাধা দিয়ে…’
অংশুমানবাবু এগিয়ে এলেন আমার দিকে, কী যেন ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা আপনি তো ওদের ছোট থেকে চিনতেন৷ এইসব তন্ত্র-মন্ত্র কি সে ছোট থেকেই করত, নাকি একটু বড় বয়সে?’
‘ছেলেবেলা থেকে আগ্রহ ছিল দেখেছি, স্কেপ্টিক টাইপের৷ কিন্তু আগ্রহটা জন্মেছিল এই ধরুন বছর খানেক আগে থেকে৷’
‘হঠাৎ করেই? কোনও কারণ ছিল না?’
‘থাকতে পারে, আমাকে জানায়নি৷’
ঘরের চারিদিকে চোখ ফেরাতে-ফেরাতে ভদ্রলোক বললেন, ‘দেখুন আমার মনে হয়, মানুষের বেশিরভাগ যুক্তিহীন বিশ্বাসই ভয় থেকে জন্মায়৷ এমনও তো হতে পারে তার বিশ্বাসটা রোগের যন্ত্রণা সহ্য করার অসহায়তা থেকেই জন্মেছিল৷ আই মিন রোগটা যখন পেইনফুল বললেন…’
‘ধুর…’ আমি মাথা নাড়ালাম৷ ‘তন্ত্র করে শয়তানকে ডেকে তাকে রোগ সারাতে বলবে, এইটা কেমন মশা মারতে কামান দাগার মতো শোনাল৷’
‘তাহলে তো মশাই কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না৷’
আমি চুপ করে গেলাম৷ কারণটা আমি জানি৷ বেশ ভালো করেই জানি৷ স্কেপ্টিক কেন, মৃগাঙ্ক ছিল ঘোর নাস্তিক৷ সেই ছেলের মধ্যে যে কী করে অন্ধবিশ্বাস এসে বাসা বাঁধল…
ভদ্রলোক মোবাইল ক্যামেরা বের করে পরপর বেশ কয়েকটা ছবি তুলছেন ঘরের৷ সুইসাইডের সাতদিন পরে ফাঁকা ঘরের ছবি তুলে কী লাভ হচ্ছে তা উনিই জানেন৷ শেষে মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, ‘আপনি কিছু বুঝতে পারলেন?’
আমি দু-দিকে মাথা নাড়ালাম, এ ঘর দেখে আর কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই৷ ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আসুন আমরা বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াই৷ বেশ খোলামেলা জায়গাটা৷’
‘হ্যাঁ… চলুন৷’
বারান্দায় এসে একটা সিগারেট জ্বালালাম আমি৷ খোলা হাওয়ায় কমলা শিখাটা জ্বলে উঠল তাড়াতাড়ি৷ নীচে ব্যস্ত কলকাতা শহর পড়ে আছে৷ গাড়িঘোড়ার ছোটাছুটি শুরু হয়েছে৷
অংশুমানবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা সকালে আপনারা যখন ডেডবডি দুটো উদ্ধার করলেন, তখন টেবিলের উপরে কী কী ছিল?’
পকেট থেকে একটা ছোট নোটবই বের করে দেখে নিয়ে তিনি বললেন, ‘একটা গলে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া মোমবাতি৷ একটা বাটি যার মধ্যে খানিকটা রক্ত ছিল৷ তাছাড়া মেঝেতে রক্ত দিয়ে চারটে তারা আঁকা ছিল৷’
‘মানে পেন্টাগ্রাম, চারটে? আপনি নিশ্চিত?’
‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি, এতদিনে অবশ্য সেসব দাগ উঠে গেছে৷’
‘কিন্তু চারটে হলে তো…’
‘কী?’
আমি সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে বললাম, নিয়ম হল রিচ্যুয়ালে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেকটা এন্টিটির জন্যে একটা করে পেন্টাগ্রাম থাকবে৷ সেবার চারটে তারা ছিল৷ এবার সেক্ষেত্রে তিনটে থাকার কথা৷
‘একটা বেশি কেন?
‘ওটা শয়তানের জন্যে, তারও তো অস্তিত্ব আছে একটা৷’
এতক্ষণ বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম আমি৷ এবার তার দিকে ফিরে বললাম, ‘এবার বলুন তো, আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?’
‘ওমা আপনাকে তো আগের দিন ফোনেই বললাম…’
‘এখানে কোনও মৃত্যু ঘটেনি, একসপ্তাহ এমনকি একবছর আগেও না৷ আপনার ধান্দাটা ঠিক কী?’
ভেবেছিলাম ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে উঠবেন৷ তার বদলে আমাকে অবাক করে তার মুখে একটা সাফল্যের হাসি ফুটে উঠল, বললেন, ‘যদি বলি আপনাকে এটা বোঝাতেই নিয়ে এসেছে৷’
‘তার মানে?’ আমি বেশ জোর গলাতেই জিজ্ঞেস করলাম৷
‘মানে পরে বোঝাচ্ছি, আগে দেখুন তো এঁকে চেনেন কি না৷’
ভদ্রলোকের হাত অনুসরণ করে পিছনে তাকিয়েই আমি চমকে উঠলাম৷ বুকের ভিতরে এমন একটা ধাক্কা এসে লাগল যে আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম রেলিং টপকে৷ ‘কে… কে এটা?’ প্রায় চিৎকার করে উঠলাম৷
দরজার কাছে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক আমারই মতো দেখতে সেই লোকটা৷ আমার চেহারার সঙ্গে তার চেহারার কোনও পার্থক্য নেই৷ ঠিক যেন আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি৷
‘নিজের ছেলেবেলার বন্ধুকে চিনতে পারছেন না? ইনি সমীর ঘোষ৷’ হাসিমুখে বললেন অংশুমানবাবু৷
এ কী দেখছি আমি! এও কি সম্ভব? মুখ, চোখ, নাক, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, হাসিটা এমনকী আড় চোখে দেখলাম আমার কবজির কাটা দাগটা অবধি…
‘কী? কী হচ্ছে এসব? আমাকে নিয়ে কি ছেলেখেলা করছেন আপনারা?’ আমি একটা ঠেলা দিলাম অংশুমানবাবুকে, ‘আপনি মোটেই পুলিশের লোক না৷ আপনি ফ্রড, কী চান আপনি?’
‘আপনি ঠিক ধরেছেন৷ আমি পুলিশের লোক নই, একজন সামান্য ডাক্তার৷’
‘ডাক্তার? তো আমার সঙ্গে এসব খেল খেলছেন কেন?’
‘খেল আমি খেলছি না স্যার, আপনি নিজে নিজের সঙ্গে খেলছেন, কিছুটা স্বেচ্ছায়৷ প্রথমদিন আপনাকে বলেছিলাম আপনার মুখে একটা কাটা দাগ আছে৷ সাধারণ যে কেউ হলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখত দাগটা আছে কি না৷ আপনি দেখেননি কারণ আপনার বাড়িতে কোনও আয়না নেই৷ কেন মৃগাঙ্কবাবু? আপনি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না কেন?’
‘বেশ করি, আমার ইচ্ছা আমি ব্যবহার করি না৷ আপনি বলার কে? আর আমার নাম মৃগাঙ্ক নয়, আমি সমীর ঘোষ৷’ দ্বিতীয়বার তাঁকে ধাক্কা দিতে যাচ্ছিলাম আমি৷ তার আগেই আমার মতো দেখতে সেই লোকটা এসে আমার হাত ধরে ফেলল৷ আমি এক ঝটকায় সরিয়ে নিলাম৷
আগের হাসিটা মুখে মেখেই অংশুমানবাবু বললেন, ‘আপনি অসুস্থ৷ আসুন আমরা ভিতরে গিয়ে বসি৷ তারপর সব বুঝিয়ে বলছি৷’
মাথাটা ধরে আসছিল আমার৷ বাইরের শনশনে হাওয়াটা অস্বস্তিকর লাগতে শুরু করেছে৷ আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না৷ তাও বুঝতে পারলাম এরা দু-জন মিলে দলে ভারী৷ আমাকে সহজে এখান থেকে নড়তে দেবে না৷ কিছু একটা উদ্দেশ্য তো নিশ্চয়ই আছে৷
ঘরের ভিতরে ফিরে তিনজনেই বসলাম চেয়ারে৷ ঠিক আমার মতো দেখতে লোকটা একটানা তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ মিটিমিটি হাসছে৷ একটাও কথা বলেনি এতক্ষণে৷ আমি তাকে বেশি গুরুত্ব দিলাম না৷ মাথাটা চেপে ধরে বললাম, ‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন, আমাকে যেতে হবে৷’
‘কোথায় যাবেন?’
‘আমার ফ্ল্যাটে৷ এখানে বসে আপনাদের তামাশা দেখব নাকি আমি?’
চারপাশটা দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘এটাই তো আপনার ফ্ল্যাট… ভালো করে দেখুন মৃগাঙ্কবাবু…’
‘আঃ… বলেছি এই নামটা…’
উত্তরটা দিতে গিয়ে এক সেকেন্ডের জন্যে থমকে গেলাম আমি৷ তারপর হেসে উঠলাম হো-হো করে৷ সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে এতক্ষণে৷ কিন্তু এই কথাগুলো এরা জানলেন কেমন করে! হাসতে- হাসতেই বললাম, ‘সব জেনে ফেলেছেন, তাই না? কিন্তু আর কিচ্ছু করার নেই, আর কারও কিচ্ছু করার নেই৷ আমার পুরনো জরাজীর্ণ শরীরটাতে আর ফেরাতে পারবেন না আমাকে৷ সেইদিনের সেই ব্ল্যাক মাস রিচ্যুয়ালে…’
‘কোনও কাজ হয়নি মৃগাঙ্কবাবু, ওসব প্রাচীন গল্পগাঁথা, অন্ধবিশ্বাস মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে জন্মায়, তারপর আরও অসহায় করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় তাকে…’
‘কাজ যে হয়েছে তা তো আপনার চোখের সামনে…’
‘কাজ যে হয়নি তার প্রমাণ আমি তোকে দেখাতে পারি মৃগাঙ্ক…’ এতক্ষণে আমার মতো দেখতে সেই লোকটা কথা বলে উঠেছে৷ আমার দিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে এসেছে সে৷ গলাটাও অবিকল আমার মতো, সেটা শুনে প্রথমে খানিকটা ঘাবড়ে গেছিলাম আমি, সে বাকি কথাটা শেষ করল, ‘তবে তার আগে আসল গল্পটা তোর জানা দরকার৷ নিজের মন গড়া গল্পটা নয়…’
‘বেশ রপ্ত করেছেন গলাটা, শোনান আপনার আসল গল্প…’
একহাতে আমার একটা হাত চেপে ধরে সে বলল, ‘আজ থেকে বছর খানেক আগে তোর একটা রোগ ধরা পড়ে, জেরাইন রসি সিন্ড্রোম, ভয়াবহ সে রোগের যন্ত্রণায় তুই সারাদিন ছটফট করতে থাকিস৷ আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলি৷ তারপর থেকে চোখে-চোখে রাখা হয় তোকে৷ আমরা সারাক্ষণ কেউ না কেউ পাহারা দিতাম৷ তোকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে আমাদের ভালো লাগত না৷
ভয়াবহ, পাশবিক সে যন্ত্রণা৷ বিজ্ঞান মুখ ফিরিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে অন্য কোনওভাবে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করতে থাকিস তুই৷ শেষে একদিন কোডেক্স গিগাসের ব্যাপারটা চোখে পড়ে৷ তুই তখন বাস্তব হোক অবাস্তব হোক যে-কোনও ভাবে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া৷ অসহ্য কষ্ট সহ্য করতে-করতে মানুষের বাস্তব জ্ঞান লোপ পায়৷ তোরও পেয়েছিল৷ ছেলেমানুষের মতো তোর মনে হয় ব্ল্যাক মাসের সাধনা করে তন্ত্র-মন্ত্র করে তোর রোগটা সেরে যাবে৷ এই নিয়ে পড়াশোনা করতে-করতে কোনো একসময় আমাকে আর অনুপমকেও দলে টেনে নিস তুই৷ আমাদের আপত্তি ছিল না৷ শুধু একটু রক্ত দিতে বলেছিলি তুই৷ বন্ধুর অন্তত মানসিক কষ্ট দূর করার জন্যে এটুকু করাই যায়৷ তবে তন্ত্রে ঠিক কী কাজ হবে সেটা বলিসনি আমাদের৷
আজ থেকে ছ-মাস আগে একদিন রাতে ঠিক এই ঘরটাতেই আমরা রিচ্যুয়ালটা শুরু করি৷ শুরুর কিছুক্ষণ পরে রক্তটক্ত দেখে বিরক্ত হয়ে অনুপম সেখান থেকেই বিদায় নেয়৷ বাকি কাজটা আমি আর তুই মিলে করি৷
তুই এমনিতেই অসুস্থ ছিলি৷ তার উপরে বেশ খানিকটা রক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় তুই অজ্ঞান হয়ে পড়িস৷ সম্ভবত অজ্ঞান অবস্থায় কিছু একটা স্বপ্ন দেখিস তুই৷ খুব স্বাভাবিক, তোর মন ওই স্বপ্নটাই খুব ডেস্প্যারেটলি দেখতে চাইছিল৷ সেটা দেখে তোর মনে হয় ব্ল্যাক মাসের মাধ্যমে তোর অর্থাৎ মৃগাঙ্কের আত্মা শরীর ছেড়ে এসে ঢুকেছে আমার অর্থাৎ সমীরের শরীরে৷’
‘না না, এসব আজগুবি কথা…’
‘হ্যাঁ মৃগাঙ্কবাবু, ঠিক এইসময়ে আপনার মন দুটো স্পষ্ট ভাগে ভেঙে যায়৷ প্রথমে আপনার সজাগ মন, যে বিশ্বাস করে আপনার আত্মা তার শরীর ত্যাগ করে অন্য শরীরে ঢুকেছে৷ তাই শারীরিক সমস্ত যন্ত্রণা আপনার শরীর আর অনুভব করে না৷ শরীর নিজের চেষ্টাতেই কিছু সংবেদনশীল নার্ভ থেকে সংকেত গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয়৷ আপনার অবচেতন মন আপনার মস্তিষ্ককে বোকা বানিয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে নেয়৷ আপনার অবচেতন মনই এই সাজানো নাটকের নেপথ্য নির্দেশক, যে শহরের অন্য জায়গায় আপনাকে ফ্ল্যাট কিনে থাকতে বাধ্য করে৷ আপনার বাড়িতে কোনও আয়না নেই কারণ সে জানে নিজের চেহারা দেখলে আপনার সজাগ মনের কল্পনা আঘাত পাবে৷ স্মার্টফোন আপনি ব্যবহার করেন না কারণ তাতে ছবি তোলা যায়, স্ক্রিনে মুখ দেখা যায়… নিজে থেকেই আর বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না আপনি… শারীরিক যন্ত্রণার ওষুধ হিসেবে আপনি নিজের পরিচয় ধ্বংস করেন, এমনকি পরিচিতদের থেকেও সরিয়ে নেন নিজেকে…’
‘এসব মিথ্যে বলছেন আপনারা… কী প্রমাণ আছে…’
‘এই যে প্রমাণ…’
পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে আমার সামনে তুলে ধরলেন অংশুমানবাবু, তার স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠেছে একটু আগে তাঁর নিজের তোলা ঘরের ছবিগুলো৷ কয়েকটা ছবিতে আমাকে বুঝতে না দিয়ে ঘরের ছবি তোলার অছিলায় আমার মুখটাই ধরেছেন তিনি৷ সেই মুখটা দেখেই আমার হাত-পা অবশ হয়ে এল৷ এতো মৃগাঙ্ক, আমার পুরনো চেহারা৷ এই শরীর আমি ছেড়ে এসেছি আজ পাঁচমাস হল৷
মাথাটা ভোঁ-ভোঁ করতে শুরু করেছে৷ মনে হচ্ছে এক্ষুনি চেয়ার থেকে উলটে পড়ে যাব৷ আরও শক্ত করে দু-হাতে মাথা চেপে ধরলাম৷ ওদিকের মানুষগুলোর মিহি গলার স্বর একটু-একটু করে মিলিয়ে আসছে যেন…
‘আপনার ভুল ভাঙিয়ে আমাদের কোনও লাভ নেই মৃগাঙ্কবাবু৷ আপনি নিজের অবচেতন মনের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন, নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন৷ আপনাকে কোনও ওষুধ খাওয়াতে পারি না আমরা, কারণ আপনি মনে করেন কোনও রোগ নেই আপনার শরীরে৷ এভাবে যন্ত্রণা হয়তো হয় না আপনার… কিন্তু… এভাবে বিনা চিকিৎসায় বেশিদিন বাঁচতে পারবেন না আপনি… এই শেষ সুযোগ, ভেবে নিন…. কুসংস্কার আর অসহায়তার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন নাকি সাহস নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করবেন…’
বহুদিন পর একটা তীব্র যন্ত্রণার ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার শরীর লক্ষ্য করে৷ আমার নার্ভের প্রতিটা নিউরোন এতদিনের সমস্ত প্রবঞ্চনার ক্ষোভ একসাথে উগরাতে শুরু করেছে৷ হাত দিয়ে চেয়ার খামচে ধরলাম আমি… শরীরের প্রতিটা কোষ, রক্তের প্রতিটা কণা যেন ছুরি দিয়ে কেটে আলাদা করছে কেউ… আমার চোখ বন্ধ হয়ে এল…
চোখ যখন খুলল তখন বিকেল নেমে পড়েছে৷ ঘরের ভিতরটা খালি৷ শুয়ে থাকতে-থাকতে চেয়ারের দু-পাশে হাতগুলো ছড়িয়ে পড়েছে৷ ঝুলে থাকতে-থাকতে ঝিনঝিনে ধরে গেছে এতক্ষণে৷ সেগুলো গুটিয়ে নিয়ে, মাথাটা তুলে আমি উঠে বসলাম৷
ঘরটা খালি, ওরা দু-জনে হয়তো চলে গেছে এতক্ষণে৷ সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ আমার চেনা ঘরটার চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম৷ বাইরের বারান্দার দরজাটা এখনও খোলা আছে৷ মিহি হাওয়ার ধাক্কা এসে লাগছে সেখান থেকে৷ সেদিকে এগোতে গিয়ে আমি থমকে দাঁড়ালাম৷
ঘরের একমাত্র বিছানার ঠিক উপরেই একটা ছবি পড়ে আছে৷ দেওয়ালে ঝোলানো ছবি৷ ধীর পায়ে সেটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি৷ বহুদিন কোথাও চাপা দিয়ে রাখা ছিল হয়তো৷ জামার তলার দিকটা দিয়ে ধুলোর পরতটা মুছে দেওয়ালের সেই ফাঁকা জায়গায় টাঙিয়ে রাখলাম নিজের ছবিটা৷ সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এগিয়ে এলাম বারান্দার দিকে৷ বিকেল পেরিয়ে সন্ধে নামতে শুরু করেছে৷ বাইরে লোকজনের চেহারা অন্ধকারে ঢেকেছে এতক্ষণে৷ আকাশের বুক থেকে রং শুষে নিয়ে একটু-একটু করে ডুবে যাচ্ছে সূর্য৷ নরম হাওয়াটা গায়ে মাখতে-মাখতে অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে এত অন্ধকারের মাঝেও উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠছে একটা পেন্টাগ্রাম৷ মিহি আলোয় চিকচিক করছে পাঁচকোনা তারাটা৷ সেখান থেকে আর একটা, আর একটা… একটু-একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত আকাশ জুড়ে…
নিকষ অন্ধকারের বুকেও সারারাত জ্বলবে এই নতুন তারাগুলো৷ তাদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা শান্ত হয়ে এল আমার…