পেতনির বোঝা
সন্ধ্যার দেরি আছে এখনও ঘণ্টাখানিক।
তা, এই এক ঘণ্টায় আরও মাইল তিনেক অন্তত এগিয়ে যেতে পারে হিকি। সকালের দিকে চার মাইলের মতোই হেঁটেছে ঘণ্টায়। কিন্তু এখন আর পারবে না তা। সারাদিনই পাহাড় আর জঙ্গল, জঙ্গল আর পাহাড় ভাঙছে তো! দেহটা বইছে না আর।
পারে! আরও মাইল তিনেক ও পারে যেতে সন্ধ্যার আগে। কিন্তু যাওয়াটা উচিত হবে কি? এখানে এই ভাঙা বাড়িটা পাওয়া যাচ্ছে। রাতে মাথা গুঁজতে পারা যাবে। আরও তিন মাইল যদি সে এগিয়ে যায় এখন, তার মাথায় এমন আর একখানি আশ্রয় কি জুটবে?
আশা করা যায় না। এই তো সারাদিনটা গেল। সারাদিনই হেঁটেছে হিকি। এক দুপুরের একটা ঘণ্টা বাদ দিয়ে। ওই সময়টা একটা সোতা পেয়েছিল বনের মধ্যে তার পাড়ে গাছতলায় বসে এক টুকরো রুটি সে চিবিয়ে নিয়েছিল। মনিব-বাড়ি থেকে না-বলে চেয়ে-আনা রুটি। হিসাবমতো বারো পাউন্ড মাইনে পাওনা হয়েছিল তার। তার এক পেনি তবু উশুল হল। বাকিটা? লে বাবা মনিব, তুইই নে। ভগবান তেরা ভালা করে। কবরে যাবার দিন সঙ্গে নিয়ে যাস গরিব হিকির খাটুনির পয়সা!
কিন্তু এখনকার ভাবনা তা নয়। উপস্থিত যেটা জরুরি প্রশ্ন হিকির কাছে, তা হল এই যে, আরও এগিয়ে যাওয়া উচিত কি অনুচিত এই আসন্ন সন্ধ্যায়। পথটা জনমনিষ্যিহীন। এ পথে লোকালয় বলতে এই ভাঙা বাড়িটাই চোখে পড়ল এইমাত্র। আসলে এটা পথই তো নয় কিনা! মনিব-বাড়ি থেকে ডাম্বিটং শহরে যেতে হলে অন্য দিক দিয়ে বেশ ভালো রাস্তা আছে তার। মেটেই বটে সে-রাস্তাও, কিন্তু লোকজন আখছারই চলছে তাতে, দুই পাশে পরের পর গ্রাম আর আবাদি জমি, সে-সবেতেও পায়ে পায়ে মানুষ। কিন্তু সে-পথে চলতে সাহস হবে কী করে শ্রীমান হেক্টরের? মনিব হার্ডি হ্যারিসনকে সবাই জানে ও-তল্লাটে, চেনে হ্যারিসনের চাকর মজুরদেরও। হিকির অন্তর্ধানের কথা কানে আসামাত্র হ্যারিসন সেই পথে বেরিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। ঘোড়ার পিঠে, চাবুক হাতে করে। সে-পথে ডাম্বিটংয়ের কানাচ পর্যন্ত কোনো জায়গায় হিকি থাকত যদি, ধরা পড়া অনিবার্য ছিল তার। জোর করেই নিয়ে যেত হার্ডি হ্যারিসন। বেঁধে নিয়ে যেত। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করতে এলে সাফ শুনিয়ে দিত, ‘শয়তানের বাচ্চাটা আগাম বারো পাউন্ড ধার নিয়েছিল, খেটে দেবার কড়ারে। এখন সেইটে ফাঁকি দেবার মতলবে পালিয়ে যাচ্ছে বদমাশ।’ লোকে এ-অভিযোগ বিশ্বাস করুক বা না-করুক, এ-নিয়ে তর্ক করতে কেউ আসত না হার্ডিকে ভয় করে ও-তল্লাটের সব্বাই, এ্যানাক্রস থেকে ডাম্বিটং পর্যন্ত। ডাকসাইটে গুন্ডা ও।
ওইটিই হল আসল কথা। ধরা পড়ার ভয়ে সদর রাস্তার দিকে যায়নি হিকি। ধরেছে এই পাহাড়-জঙ্গলের পথ। কম নয়, অন্তত ত্রিশ মাইল ওই ডাম্বিটং। রাস্তা দিয়ে যদি যাও, ত্রিশ মাইল। জঙ্গলের পথে যাও যদি, আরও কিছু বেশিই হবে, খবর নিয়েছে হিকি আগেই।
ভোর হতে হতেই পালিয়েছিল, তখনও বাড়ির লোক জাগেনি কেউ। জাগবে, হিকির চম্পট দেওয়ার কথা টের পাবে, মালিককে জানাবে, দুটো ঘণ্টা এতে কেটেছে নিশ্চয়। ওই দুই ঘণ্টা হিকি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছে বনের ভিতর দিয়ে। তারপর হেঁটেছে রয়ে বসে, মাঝে মাঝে জিরিয়ে নিয়ে। দেহটাকে বেশি কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। অসুখ বাধিয়ে বসলেই সর্বনাশ!
তা অর্ধেকের বেশি পথই এসে গিয়েছে হিকি। বাকিটা কাল যদি মেরে দিতে পারে, রাতের অন্ধকারে ডাম্বিটং পেরিয়ে যাবে। তারও ওধারে মাইল দশেক গেলে তবে নিজের দেশ-গাঁ দেখতে পাবে হিকি। একবার সেখানে পৌঁছোতে পারলে হয়। আর সে নিজের গাঁ ছেড়ে বেরুচ্ছে না। অন্তত পাঁচ-সাত বছর তো না। এই সবে তেরো বছর বয়স তার। কুড়িতে পা না-দিয়ে আর না। দেহটা মজবুত হওয়ার আগে আর না। হার্ডি হ্যারিসন জাতীয় মনিবকে কিল-চড়ের বদলে পালটা কিল-চড় ফিরিয়ে দেবার মতো তাকত যতদিন না জন্মাচ্ছে, ততদিন আর না। ওঃ, কী পিশাচ ওই হার্ডি হ্যারিসন! হিকিদের গাঁয়ে সেন্ট এ্যাগনেস-এর মেলার সময় গিয়েছিল। হিকি তখন ফিকির খুঁজছিল বাড়ি থেকে সরে পড়বার। এমন কিছু কারণ ছিল না। স্রেফ দেশ দেখবার ঝোঁক, অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। হার্ডি ফুসলানি দিল, ‘যাবে আমার সঙ্গে? কাজ খুবই হালকা। খাওয়া পাবে চার বেলা, মাসে দুই পাউন্ড মাইনে। বছর পুরলেই এক প্রস্থ পোশাক।’ মন্দ লাগেনি কথাটা হিকির কাছে। এক বছর ওখানে কাজ করলে চব্বিশ পাউন্ড জমবে তাতে। তা নিয়ে লন্ডনেও যেতে পারে ও। সেখানে বড়ো মানুষ হবার মতো কত শত পথই তো আছে!
কাজ? মেহনতি ঘরের ছেলে হিকি, এই বয়সেই সব কাজ জানে মোটামুটি। মানে, খামারবাড়ির কাজ। কাজে সে কাতর নয়। কিন্তু ব্যবহারটা চায় ভদ্র। হুকুম করুক মনিব। মনিব যখন, হুকুম কেন করবে না? কিন্তু সে-হুকুমের সঙ্গে আগে একটা পরে একটা গালাগালি জুড়ে না-দিলেই কি নয়? ওইতেই আপত্তি ছিল হিকির। আর হার্ডি, পাষণ্ড হার্ডি, যেই টের পেল যে ফুসলিয়ে আনা এই তেরো বছরের ছেলেটা গালাগালি শুনতে রাজি নয়, অমনি গালাগালির পর্যায় ছেড়ে সে উঠে গেল মার-গুঁতোর পর্যায়ে। ইদানীং কথায় কথায় মারছিল ধরে ধরে। অসুরের মতো ষণ্ডা, হিকি তার সঙ্গে পারবে কেন? মরিয়া হয়ে একদিন কামড়ে দিয়েছিল হার্ডির হাতে। তার ফলে সাত দিন তাকে বেঁধে রেখেছিল গোয়ালে। খেতে দিয়েছিল কালো রুটি শুধু, তাও একবেলা। মাইনে? ছয় মাস কাজ করেছে হিকি, একটা পেনি আদায় করতে পারেনি। ‘যেদিন ছুটি দেব, সেইদিন বুঝিয়ে মিটিয়ে দেব মাইনে। তার আগে না। ছোটোদের হাতে কাঁচা পয়সা দেব, এমন মুখ্য আমি না। গাঁয়ে মদ বিক্রি হচ্ছে আজকাল। নেশা করে পড়ে থাকবি তুই, আর আমি বুঝি নিজে যাব ভেড়া চরাতে?’
এইরকমই ছিল মনিব বাড়ির অবস্থা। দিন দিন সে-অবস্থা চরমে পৌঁছে যাচ্ছিল। এমন সময় এল এই পালাবার সুযোগ। হার্ডি তার বউকে নিয়ে নেমন্তন্ন খেতে গেল ভিন গাঁয়ে, ফিরবে পরদিন সকালে, প্রাতরাশের পরে। ‘বামুন গেল ঘর, লাঙল তুলে ধর’— নীতির ব্যাপক সমাদর দেখা গেল সেদিন ভৃত্যমহলে। রাত তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত চলল তাদের হুল্লোড়। ঘুমোল শেষ রাত্রে, উঠবে সেই বেলা নয়টায়। এই সুযোগ। রাত্রে ঘুম হিকিরও হয়নি। তবু সে রাত থাকতেই উঠল। ভোরের আলো ফুটেছে কী না-ফুটেছে, বেরিয়ে পড়ল খিড়কি দোর দিয়ে, ঢুকে পড়ল জঙ্গলে।
যা বলছিলাম, সারাদিন পথ চলেছে হিকি। কখনো ঊর্ধ্বশ্বাসে, কখনো রয়ে বসে। দিনান্তে তার তো মনে হল, অর্ধেকের বেশি পথই সে এসেছে পেরিয়ে। এইভাবে বরাবর চলতে পারলে কাল বিকেল নাগাদ সে ডাম্বিটং-এর কাছাকাছি পৌঁছোতে পারবে। তারপর রাতেই ডাম্বিটং পেরিয়ে—
কিন্তু কাল রাতের কথা তখন কাল রাতে ভাবা যাবে। উপস্থিত ভাবা দরকার আজ রাতের কথা। কোথায় থাকবে সে আজ রাতে? জঙ্গলটা বৃহৎও বটে, নিবিড়ও বটে। কিন্তু নেকড়ে ছাড়া অন্য কোনো শ্বাপদ এখানে নেই বলে শুনেছে হিকি। নেকড়ে যারা আছে, তারাও মানুষকে আক্রমণ করে না, বিশেষ করে দিনের বেলায় তো নয়ই। সারাদিন এই তো ঝোপঝাড় ঠেলে ঠেলেই পথ চলে এল হিকি। গোটা দুই শেয়াল ছাড়া অন্য কোনো জন্তুই চোখে পড়েনি তার।
কিন্তু রাতের কথা আলাদা। তখন যে নেকড়ে বেরুবে না, কে তা বলতে পারে? আর বরাত মন্দ হলে সে সব নেকড়ে যে আক্রমণও করবে না হিকিকে, তারই বা নিশ্চয়তা কী? সুযোগ পেলে সভ্যসমাজের মানুষও যে অকারণ হামলা করে অন্যের উপরে, হার্ডিই তো হাতে-কলমে তা দেখিয়ে দিয়েছে। নেকড়েরাও যে সুযোগ পেলে বৃহত্তর বিবেকের পরিচয় দেবে হার্ডির চেয়ে, কে এমন আশ্বাস দিচ্ছে হিকিকে?
মনটা টানছে এগিয়ে যাবার দিকে। সে মনকে ধমকে দিল হিকি, ‘না, ও কোনো কাজের কথা নয়। বাড়িঘর নেই এ-জঙ্গলে। শেষপর্যন্ত যদি গাছে উঠে রাত কাটাতে হয়, মোটেই সেটা ভালো কথা হবে না। হাতের মুঠোয় পাওয়া গিয়েছে যখন বাড়িটা, এইখানেই কাটানো যাক রাত।’
শেয়াল-চলাচলের সুঁড়িপথ ধরেই এ যাবৎ চলে এসেছে হিকি। সেইরকমই একটা সুঁড়িপথ ওই বাড়ির দিকেও গিয়েছে যেন। হিকি সেই দিকেই ঘুরল। বেশিদূর যেতে হবে না। খুব কাছের বাড়িটা।
ঝোপেঝাড়ে সমুখ দিকটা আড়াল হয়েই ছিল। কী ধরনের বাড়ি যে এটা, আগে তার আন্দাজ পায়নি হিকি। এখন এগিয়ে এসে সমুখে দাঁড়াতেই সে অবাক হয়ে গেল। বেশ বড়ো-সড়ো বাড়িই তো! তবে ভেঙেচুরে পড়েছে খুবই। আর কার্নিসে ছাদে আগাছাও গজিয়েছে অগণ্য।
বেলা আর বেশি নেই। তবু পশ্চিমের আকাশ থেকে একফালি লালচে রোদ্দুর ছিটকে এসে পড়েছে বাড়ির ছাদের উপর। আরে, ও কী? মানুষ আছে তাহলে এ বাড়িতে? একটি তারই বয়সি মেয়ে এইমাত্রই যেন দাঁড়িয়ে ছিল ওই রোদ্দুরের ফালিটার মধ্যে? সুট করে সরে গেল যেন তাকে দেখে? কেন? সরে যাবার কারণটা কী হতে পারে তার? হিকিকে দেখলে যে চোর বদমাশ-গুন্ডার মতো মনে হতে পারে কখনো, এমনটা তো ধারণা হয় না হিকির। কোথায় এই অজগরবনে একটা নতুন মানুষের মুখ দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠবে মেয়েটা, তা না-হয়ে সে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল?
যাক, একটা মেয়েকে যখন দেখতে পাওয়া গিয়েছে, তখন আরও লোক অবশ্যই আছে বাড়িতে। একা একটা বারো-তেরো বছরের মেয়ে তো নিশ্চয়ই থাকতে পারে না এখানে! কোনোখানেই পারে না, তা এটা তো আবার জঙ্গলের ভিতর বাড়ি! আছে, মানুষ অবশ্যই আছে। দরজায় কড়া নাড়লেই—
দরজার দিকে এগুতেই বিষম খটকা লাগল হিকির। আরে, দরজার কাছে যাওয়াই যে অসম্ভব? একটা ঝাড়ালো কাঁটাগাছ এমনভাবে ডালপালা দিয়ে ঢেকে রেখেছে জায়গাটা, সেটা পেরুনোই যায় না। এ-বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই এ-দরজা দিয়ে যাতায়াত করে না। তা যদি করত, এ-কাঁটার ঝাড় তারা কখনোই থাকতে দিত না এখানে!
তাহলে? এ-দরজা যদি ব্যবহারের বাইরেই গিয়ে থাকে—
ভাঙা বাড়ি যখন, দরজাটাও হয়তো খুবই ভাঙা। বাইরে থেকে বোঝা না-গেলেও, ভিতর দিকে হয়তো এমন কিছু গুরুতর গলদ আছে দরজার যে, ওকে খোলা-টোলা যায় না আর। মেরামতের সুবিধে হয়তো নেই। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই নেই। মেরামতের সুবিধে থাকলে তো বাড়িটাই মেরামত করত ওরা। সম্ভবত আসল মালিক যারা, তারা ঝাড়েবংশে নির্মূল হয়েছে বা দেশান্তরে চলে গিয়েছে। যারা আছে বাড়িতে, তারা উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা লোক, অন্য কোথাও আশ্রয় নেই বলেই এই জঙ্গুলে বাড়িতে এসে ঠাঁই নিয়েছে!
কিন্তু কথা হল, সমুখের এই দরজা যদি গেরস্তরা বাতিল করেই দিয়ে থাকে, তাহলে অন্য একটা দরজা তো তারা নিশ্চয়ই বার করে নিয়েছে অন্য কোনোখানে! সেটা কোথায়? বাড়ির লোক বাড়ি থেকে বেরুবে না কখনো, এমন তো হতেই পারে না!
হিকি ঠাহর করে দেখছে। গোটা বাড়িরই সমুখ দিকটা পর্যবেক্ষণ করছে। সারি সারি জানালা, বেশ বড়ো-সড়ো জানালা। কবাট কোনোটাতে আছে, কোনোটাতে নেই। কিন্তু মোটা মোটা লোহার গরাদ আছে সব জানলাতেই। ওর কোনটা দিয়ে যে মানুষ ঢুকবে বা বেরুবে, তার উপায় নেই কিছু। তাহলে? মানুষ কি সত্যি সত্যি নেই তাহলে এখানে? ওই যে একটা মেয়েকে পলকের তরে সে দেখেছিল, ছাদে দাঁড়িয়ে রোদ পোয়াচ্ছে, সে কি তাহলে চোখেরই ভুল হিকির?
অসম্ভব কী? এমন ধারা চোখের ভুল তো হয় মানুষের!
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে হিকি। মানুষ, মানে অন্য মানুষ থাকুক বা না-থাকুক এ-বাড়িতে, হিকি নামক এই ত্রয়োদশ বর্ষ বয়স্ক মনুষ্যটি আজ রাত্রে থাকবেই এখানে। থাকবেই, কারণ তার যাওয়ার অন্য কোথাও কোনো জায়গা নেই। যেভাবেই হোক, তাকে ঢুকতেই হবে বাড়িতে, যেকোনো একটা ঘর যথাসম্ভব পরিষ্কার করে নিয়ে সেইখানেই গড়িয়ে পড়তে হবে রাত কাটাবার জন্য। ঢুকতেই হবে বাড়িতে। কিন্তু দরজা কই?
কিছুক্ষণ থেকেই হাওয়ায় জোর দিচ্ছিল একটু একটু। তাইতেই একটা বন্ধ জানালার কবাট হঠাৎ হাট হয়ে খুলে গেল। আর সেদিকে তাকিয়েই উৎফুল্ল হয়ে উঠল হিকি। এই জানালাটাতেই কোনো গরাদ নেই। যাকে বলে, ‘ফরাসি জানালা’, এটা তাই। সাধারণ দরজার চাইতে আকারে খানিকটা ছোটো হলেও এ দিয়ে আগম-নিগম বেশ চলে।
আর তাহলে অসুবিধা কিছু রইল না। খোলা জানালা দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল হিকি।
রক্ষা করো যিশু! এ-ঘরে দশ বছরের মধ্যেও মানুষ ঢুকেছে বলে তো বিশ্বাস করা যায় না। সারাঘরজোড়া মাকড়সার জাল। সে-জাল দেয়াল থেকে দেয়াল, জানালা থেকে জানালা সর্বত্র এমনভাবে ছড়িয়ে আছে, তার ভিতর দিয়ে ওদিককার দরজায় পৌঁছোবে কার সাধ্য!
বোঝা সহজ, বাড়ির লোকের যাতায়াতের পথ ওই ফরাসি জানালা দিয়ে নয়। অবশ্যই অন্যদিক দিয়ে অন্য কোনো দরজা আছে তাদের ব্যবহারের জন্য। তা থাকুক গে। হিকির এমন সময় নেই যে সেই দরজা এখন সে খুঁজে বেড়াবে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এল। ভাঙা বাড়ি আঁধারে ডুবে যাওয়ার আগেই তাকে একটা আস্তানা খুঁজে নিতে হবে। এ-ঘরটার জানালা খোলা, ঠিক নিরাপদ হবে না আস্তানা হিসেবে।
আবার বাইরে গিয়ে একখানা সরুপানা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে এল হিকি, মাকড়সার জালগুলোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে পথ পরিষ্কার করে নিল ওদিককার দরজা পর্যন্ত। এক-শো মাকড়সার কী সে দৌড়োদৌড়ি এই আকস্মিক হামলায়! নিজের জরুরি প্রয়োজনের কথা ভুলে যেতে পারলে হিকি হয়তো তাদের জন্য সমবেদনাই বোধ করতে পারত।
ঘর থেকে বেরিয়েই হিকি দেখল, সমুখে একটা শান-বাঁধানো উঠোন, আর সেই উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। ছাদের সেই মেয়েটিই হবে নিশ্চয়। হিকি আশ্বস্ত হল অনেকখানি। তারই বয়সি মেয়েটি। ভাব জমিয়ে নেওয়া সহজ হবে।
আরে সর্বনাশ! এ-মেয়ে হিকির মনের কথাটি টের পেল কেমন করে? এ কি অন্তর্যামী না কি? বলছে মেয়েটি, বেশ মিষ্টি গলায় মৃদু অথচ স্পষ্ট ভাষায় বলছে, ‘তুমি যা ভাবছ, তা নয়। আজ আমার বয়স তেষট্টি বছর হবার কথা! তেরো বছর বয়সেই মরে গেলাম কিনা, তাই সেই তেরো বছরের মতোই রয়ে গিয়েছে চেহারাটা।’
হিকি পাড়াগাঁয়ের ছেলে, ভূতে বিশ্বাস না-করে পারে কখনো? বিশ্বাস করে, ভয়ও করে। তবে সে-ভয় এমন সাংঘাতিক ভয় নয় যে ভূত দেখামাত্র ভিরমি খেয়ে উলটে পড়বে। সাপ দেখলে মানুষ ভয় পায়, ক্ষ্যাপা কুকুর দেখলে মানুষ ভয় পায়, কিন্তু তাদের দেখে ভিরমি কেউ খায় না। সাবধান হয়, এইমাত্র। হিকিও সাবধান হল। অর্থাৎ বুকের উপর ক্রশ আঁকল, আর ‘এভমেরিয়া’ স্তোত্রটা চটপট আউড়ে নিল একবার মনে মনে।
মেয়েটি হেসে উঠল খিলখিল করে, ‘কী গো, বাক্যি হরে গেল তেষট্টি বছরের কথা শুনে? আমি কিন্তু মিথ্যে বলিনি। বাড়ি ভরতি মানুষ ছিল গো, বাড়ি ভরতি মানুষ ছিল। এক রাতে ডাকাতে কেটে ফেলল সবাইকে। সবাই স্বর্গে চলে গেল, আমার যাওয়া হল না। হয়েছিল কী জানো? ডাকাতরা যখন লুঠপাট করে চলে গেল, তখনও বাবা আর আমি বেঁচে আছি। ডাকাতরা অবশ্যি ভেবেছিল, মরেই গেছি আমরা। তাকায়নি আর আমাদের দিকে।
‘আমরা পড়েছিলাম যে ঘরে, বাবা সেই ঘরের দেওয়ালে একটা জায়গা দেখিয়ে দিল আমাকে। ‘ওইখানে ধাক্কা দিলেই দেয়াল সরে যাবে, একটা ফোকর দেখা যাবে, তাতে এক কাঁড়ি মোহর’। বাবা মরে গেল তার পরই, তার পরই মরে গেলাম আমিও। বাবা ওই গুপ্তধনের ভার দিতে পেরেছিল আমার উপরে, কাজেই সে মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু আমি আর ভার দেবার লোক পাব কোথায়, আজ পুরো পঞ্চাশ বছর ধরে বসে বসে পাহারা দিচ্ছি সেই মোহরের কাঁড়ির। আজ তুমি এলে এ-বাড়িতে, পঞ্চাশ বছরের ভিতরে প্রথম মানুষ। তুমি যদি ওসবের ভার নাও ভাই, আমি মুক্ত হয়ে যেতে পারি। একা একা আর পারছি না আমি এখানে থাকতে। লক্ষ্মী ভাই, তুমি নিয়ে যাও। জ্যান্ত মানুষের তো ঢের কাজে লাগে পয়সাকড়ি! আমিও তো তেরো বছর পর্যন্ত জ্যান্তই ছিলাম! পয়সাকড়ির কদর কত, আমি জানি তা।’
হিকি হুঁশিয়ার ছেলে, আগে থেকেই কথা পরিষ্কার করে নিল, ‘তুমি যখন ভাই বলেছ আমায়, আমার ঘাড় মটকাবে না, এটা আশা করতে পারি নিশ্চয়?’
‘না, না’— জিভ কামড়ে জবাব দিল মেয়েটি। ‘ঘাড় মটকাব কী? কোনো ভূত, কোনো পেতনি কখনোই ঘাড় মটকায় না কারও। তবে মানুষের মধ্যে যারা অসম্ভব ভীতু, আমাদের দেখলে অজ্ঞান হয়ে উলটে পড়ে, ঘাড় আপনিই মটকে যায়। তুমি তো ভীতু নও!’
‘না, ভীতু আমি নই’— এই বলে পকেট থেকে মোম আর দেশলাই বার করে আলো জ্বেলে ফেলল হিকি, ‘তোমার অবশ্য অন্ধকারে অসুবিধে হয় না, কিন্তু আমার হয়। আলো ধরছি আমি, তুমি আমায় একটা জায়গা দেখিয়ে দাও, যেখানে রাতটা শুয়ে থাকা যায়। আর এক কথা, তোমার মোহরের কাঁড়ির দায় থেকে মুক্ত করা, সে সব কাল সকালে হবে। আজ তুমি আমার বিছানার পাশে বসে পাহারা দেবে আমায়। তা নইলে ভয় করবে আমার। কেমন রাজি?’
আবার খিলখিল হাসি মেয়েটির, ‘রাজি না-হয়ে করছি কী? বোঝাটা নামাতে তো হবে আমায়!’