অধ্যায় ৬০
লুইসের চোখে গনগনে সূর্যের আলো পড়লে সে জেগে ওঠে। সে বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করলে পিঠে ব্যথার ঘাইয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। আবারো বালিশের ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়ে। নিজের শরীরের দিকে নজর বুলিয়ে দেখে সে। বাইরের পোশাক পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।
বেশ কিছুক্ষণ সেভাবেই শুয়ে থাকে লুইস। তার শরীরের প্রত্যেকটি পেশি আড়ষ্ট হয়ে আছে। নিজেকে ধীরে ধীরে ওই অবস্থা থেকে বের করার চেষ্টা করে। এর পর সে উঠে বসে।
“ওহ শিট,” সে বিড়বিড় করে। তার স্পষ্ট মনে হচ্ছে রুমটা মৃদুভাবে দুলছে। তার পিঠটা নষ্ট দাঁতের মত ব্যথায় টনটন করছে। মাথা নাড়লে তার মনে হয় তার ঘাড়ের রগের জায়গায় কতগুলো মরিচা পড়া হ্যাচকো ব্লেড লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে সবচাইতে মারাত্মক অবস্থা ওর হাঁটুর। সেখানে Ben- Gaz. মাখিয়ে দুই পয়সার লাভও হয়নি। তার উচিত ছিল একটা কটিশনের ইঞ্জেকশন নেয়া। হাঁটুর কাছে তার প্যান্টটা এমনভাবে টাইট হয়ে লেগে আছে যেন ভেতরে কোন বেলুন ফুলিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
“খুব ভালো,” সে বিড়বিড় করে। “ফার্স্ট ক্লাস ডাক্তারি।
সে বিছানার পাশে পা নামিয়ে বসার জন্যে খুব ধীরে ধীরে আহত পা টা বাঁকা করতে চেষ্টা করে। ব্যথা সহ্য করার জন্যে তার এক ঠোঁট আরেক ঠোঁটের সাথে এতো জোরে চেপে ধরে যে সেগুলো পুরো সাদা হয়ে যায়। যখন পাটা একটু একটু করে বাঁকা হতে শুরু করে, সে মনোযোগ দিয়ে ব্যথার কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করে, এবং বোঝার চেষ্টা করে, অবস্থা কতটা নাজুক।
গেজ! গেজ কি এসেছে?
ভাবনাটা তাকে ব্যথা সত্ত্বেও নিজের দু পায়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। তাদের রুম থেকে প্রথমে গেজের রুমে যায়। সে গেজকে পাগলের মত খুঁজতে থাকে, গেজের নাম বিড়বিড় করতে করতে। কিন্তু রুমে গেজ নেই। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলির রুমে যায়। সেটাও খালি। এরপর সে তাদের বাড়তি রুমটাতে যায়, যেটা রাস্তার দিকে মুখ করা। সেটাও খালি। তবে-
রাস্তার ওই পাড়ে একটা অচেনা গাড়ি পার্ক করা, জাডের গাড়ির পেছনে।
তাতে কী হয়েছে?
ওই পাশে একটা অচেনা গাড়ি ঝামেলার সংকেত হতে পারে। সেটাই সমস্যা।
লুইস জানালার পর্দা এক পাশে সরিয়ে গাড়িটা ভালো করে দেখে। ছোট একটা নীল গাড়ি। আর সেটার ওপরে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে চার্চ, হয়তো ঘুমোচ্ছে।
সে পর্দাটা ছেড়ে দেয়ার আগে বেশ লম্বা সময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। জাডের সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে। তাতে কী? আর গেজের কী হয়েছে সেটা বোঝার জন্যে আরো অপেক্ষা করতে হবে। চার্চ ফিরে এসেছিল দুপুর একটার দিকে, আর এখন বাজে মাত্র সকাল নয়টা। মে মাসের এক সুন্দর দিনের সকাল নয়টা। সে ভাবে সে নিচে গিয়ে কফি বানাবে নিজের জন্যে, এরপর হিটিং প্যাডটা বের করে সেটা তার হাঁটুতে পেঁচিয়ে-
—আর চার্চ ওই গাড়ির ওপরে কী করছে?
“আরে ধুর,” সে উঁচু গলায় স্বগতোক্তি করে নিচতলায় যাবার জন্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পা ফেলতে থাকে। বিড়াল হচ্ছে অলসের গুষ্টি,” কোন জায়গায় আরাম পেলেই সেটা সে নিজের বিছানা বানিয়ে ফেলে।
কিন্তু চাৰ্চতো এখন আর রাস্তা পেরোয় না, মনে নেই?
“ধুর, ফালতু চিন্তা,” সে বিড়বিড় করে বলে এবং সিঁড়ির মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে যায়। সে নিজের সাথে কথা বলছে, ব্যাপারটা ভালো লক্ষণ না। ব্যাপারটা-
জঙ্গলে কাল রাতে জিনিসটা কি ছিল?
ব্যাপারটা অনাহূতের মত তার মাথায় আসে এবং সেটা ভেবে সে আবারো তার ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে, যেমনটা বিছানা থেকে ওঠার সময় করেছিল। সে কাল রাতের ওই জিনিসটাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছে। সে স্বপ্নে দেখেছে জিনিসটা তাকে ছুঁয়ে দিয়েছে, তার ভেতরের যা কিছু পবিত্র ছিল তা সব আজীবনের জন্যে নষ্ট করে দিয়েছে। আর সেটা তাকে শুধু মানুষখেকো বানায়নি বরং মানুষখেকোদের সর্দার বানিয়ে দিয়েছে। সে দেখে সে পেট সেমেটারিতে আছে, কিন্তু একা নয়। বিল এবং টিমি ব্যাটারম্যানও সেখানে ছিল। জাডও সেখানে ছিলেন, তাকে লাগছিল মরা লাশের মত। তার কুকুর স্পট তার পাশে বসে ছিল এবং সেটার কলারে বাধা দড়িটা ছিল তার হাতে। লেস্টার মরগানও তার লম্বা লোহার শিকলে বাধা ষাঁড় হ্যানরাট্টিকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিল। হ্যানরাট্টি মাটিতে বসে চারদিকে হিংস্র চোখে তাকাচ্ছিল। এবং কোন এক কারণে রাচেলও সেখানে ছিল। তার হয়তো খাবার টেবিলে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছিল হয়তো কেচাপের বোতল থেকে ক্যাচাপ ছিটকেছে অথবা ক্রেনবেরি জেলির ডিস উল্টে গেছে। কারণ তার জামায় ছিল লাল ছোপ ছোপ দাগ।
আর ধ্বংসস্তূপের পেছনে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের মত লম্বা, গিরগিটির মত চামড়া, জ্বলন্ত হারিকেনের মত হলুদ চোখ আর কানের বদলে পেঁচানো শিং ওয়ালা জিনিসটা। উইন্ডিগোটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সেটা কোন গিরগিটি আর মানবীর মিলনের ফলে জন্ম নিয়েছে। জিনিসটা তার তীক্ষ্ণ নখওয়ালা আঙুল সবার দিকে তাক করলে সবাই মাথা উঁচু করে সেটার দিকে তাকায়।
“থাম,” লুইস ফিসফিস করে বলে এবং নিজের গলা শুনে নিজেই ভয় পেয়ে যায়। সে ঠিক করে কিচেনে গিয়ে নিজের জন্যে ব্রেকফাস্ট বানাবে, যেকোন সাধারণ দিনের মত। ব্যাচেলরদের ব্রেকফাস্ট, মজাদার কোলেস্টেরলে ভরপুর। ফ্রাইড-এগ স্যান্ডউইচ, সাথে অনেক অনেক মেয়নেজ এবং বারমুডা অনিয়নের স্লাইস। তার নোংরা গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, কিন্তু গোসল সে পরেই করবে। জামাকাপড় ছাড়াটাকে তার অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ বলে মনে হচ্ছে। আর ওর ভয় হচ্ছে ওর ফুলে যাওয়া হাঁটু প্যান্ট থেকে বের করতে হলে ওকে হয়তো ওর ব্যাগে রাখা স্কালপেলটা দিয়ে প্যান্টের পাটা কাটতে হবে। স্কালপেলের মত সূক্ষ্ম যন্ত্র এসব কাজের জন্যে না। কিন্তু বাসায় থাকা কোন ছুরি দিয়েই তার জিন্সের প্যান্টটা কাটা যাবে না, রাচেলের সেলাইয়ের কেচি দিয়েও এই কাজ হবে না।
তবে প্রথমে ব্রেকফাস্ট।
সে কিচেনে যাওয়ার সময় সামনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে জাডের ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা নীল গাড়িটার দিকে তাকায়। গাড়িটির গায়ে শিশির জমে আছে, তার মানে গাড়িটি এখানে বেশ কিছু সময় ধরেই আছে। চার্চ এখনো গাড়ির ছাদেই আছে তবে এখন সে ঘুমোচ্ছে না। চার্চের দিকে চোখ গেলে লুইস দেখে চার্চ তার নোংরা হলদে-সবুজ চোখগুলো দিয়ে তার দিকেই চেয়ে আছে।
লুইস চমকে পিছিয়ে আসে, যেন সে উঁকি দিতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেছে। সে কিচেনে গিয়ে ঝনঝন শব্দ করে একটা ফ্রাইং পেন বের করে চুলোয় বসিয়ে দেয়। ফ্রিজ থেকে ডিম নিয়ে আসে সে। কিচেনটা ঝকঝকে, তকতকে। সে শিস্ বাজানোর চেষ্টা করে, এরকম একটা সকালে শিস্ বাজিয়ে সকালটাকে আরো সুন্দর করার জন্যে, কিন্তু সক্ষম হয় না। সবকিছু ঠিকঠাক দেখালেও আসলে সবকিছু ঠিকঠাক নেই। বাসাটাকে মারাত্মক শূন্য লাগছে আর গতরাতের অভিজ্ঞতা এখনো তার ওপর পাথরের মত চেপে আছে। কিছুই ঠিক নেই। তার মনে হয় একটা ছায়া নড়ছে এবং তার ভয় হতে লাগে।
সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাথরুমে গিয়ে দুটো অ্যাসপিরিন নিয়ে অরেঞ্জ জুস দিয়ে গিলে নেয়। চুলার কাছে ফিরে যাবার পথে টেলিফোনটা বেজে ওঠে।
সে সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ না করে বোকার মত সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন তার সামনে জটিল কোন ধাঁধাঁ পরিবেশন করা হয়েছে।
ফোনটা রিসিভ করো না লুইস। ফোনটা তোমার জন্যে স্রেফ খাঁটি দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। লুইস তুমি এমন এক দড়ি নিয়ে টানাটানি করছো যেটার আরেক মাথা আছে একদম গভীর অন্ধকারে। তুমি সত্যই জানতে চাও না দড়ির ওপাশে কি হচ্ছে। তোমার এখন যেটা করা উচিত সেটা হচ্ছে গ্যারেজ থেকে গাড়িটা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাওয়া। খবরদার ফোনটা-
সে ফোনের রিসিভারটা তুলে নেয়। আরউইন গোল্ডম্যান ফোন করেছেন। আর তিনি যখন হ্যালো বললেন ঠিক তখনই লুইস কিচেনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত পায়ের ছাপ দেখতে পায়-ছোট্ট ছোট্ট কাদা মাখা পায়ের ছাপ—তার মনে হলো তার হার্ট জমে গেছে এবং তার চোখের বলগুলো বড় হয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার বিশ্বাস তাকে দেখাচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর পাগলা গারদের কোন পাগলের মত। এগুলো গেজের পায়ের ছাপ। গেজ রাতে এখানে এসেছিল। অতএব এখন ও কোথায় আছে?
“আরউইন বলছি, লুইস…লুইস? আছো? হ্যালো?”
“হ্যালো, হ্যা, বলুন,” সে বলে এবং তার মনে হচ্ছে সে জানে তিনি কি বলতে যাচ্ছেন। সে নীল রংয়ের গাড়িটার রহস্য বুঝতে পারছে। সে সবই বুঝতে পারছে…বুঝতে পারছে দড়ির ওপাশে কি আছে…সে যদি আগেই বুঝতে পারতো…কিন্তু তা আর সম্ভব না। এখন দড়িটা এবং দড়ির সাথে যা এসেছে সবই তার দায়।
“ওহ, ভেবেছিলাম কেটে গেছে,” তিনি বললেন।
“নাহ, রিসিভার আমার হাত থেকে পিছলে গিয়েছিল,” লুইস জবাব দেয়, শান্ত কন্ঠে।
“রাচেল কি গতরাতে বাসায় ফিরেছে?”
“ওহ, হ্যা, ফিরেছে,” সে নীল গাড়িটার কথা ভাবতে ভাবতে বলে। সেটার ওপর শুয়ে থাকা চার্চের কথা ভাবে আর ভাবে কী নিঃসঙ্গই না লাগছিল গাড়িটিকে। তার চোখ মেঝেতে পায়ের ছাপগুলো অনুসরণ করছে।
“আমার ওর সাথে কথা আছে কিছু,” তিনি বলেন। “এক্ষুনি দরকার। এলির ব্যাপারে।”
“এলি? এলির কী হয়েছে?”
“আমার মনে হয় রাচেলকে-”
“রাচেল এখন এখানে নেই। দোকানে রুটি আর দুধ কিনতে গেছে। এলির কি হয়েছে? বলুন, প্লিজ!”
“আমাদের ওকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। ও কিছু দুঃস্বপ্ন দেখে একদম হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অবস্থা ভালো না হওয়ায়—”
“তারা ওকে সিডেটেড করেছে?”
“মানে?”
“মানে স্নায়ু ঠান্ডা করার জন্যে কিছু দিয়েছে?”
“ও, হ্যাঁ। ওকে একটা পিল দিয়েছিল। এরপর ও ঘুমিয়ে পড়ে।”
ও কিছু বলেছে? কি দেখে এতো ভয় পেয়েছে?” লুইস এখন ফোনের রিসিভারটা প্রচন্ড শক্তি দিয়ে খামচে ধরে আছে।
ফোনের ওপাশে নীরবতা-বেশ লম্বা নীরবতা। তবে এবার লুইস কিছু বলে না।
“ওই জিনিসটাই ডোরি সব চাইতে বেশি ভয় পেয়েছে,” অবশেষে তিনি বললেন। “ও প্রথম দিকে অনেক আবোল তাবোল বলে…এরপর কান্নার জন্যে কিছু বোঝা যায়নি। ডোরি নিজেও…মানে…”
“এলি কি বলেছিল?”
“ও বলে ওজ দ্য গ্রেট অ্যান্ড টেরিব্ল ওর মাকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু ও জিনিসটা উচ্চারণ করে ‘ওজ দ্য গেয়িট অ্যান্ড টেয়িল।” যেভাবে আমাদের আরেক মেয়ে জেল্ডা উচ্চারণ করতো। বিশ্বাস করো লুইস, আমি চাইছিলাম এই প্রশ্নটা রাচেলকে করি। তোমরা এলিকে জেল্ডা আর জেন্ডার মৃত্যুর ব্যাপারে কতটুকু বলেছো?”
লুইস তার চোখ বন্ধ করে ফেলে; ওর মনে হচ্ছে ওর পায়ের নিচের মাটি মৃদু কাঁপছে। মিস্টার গোল্ডম্যানের কণ্ঠটা মনে হচ্ছে খুব ঘন কুয়াশা ভেদ করে আসছে।
তুমি হয়তো কিছু শব্দ শুনতে পাবে, মানুষের গলার মত। কিন্তু ওসব কিছু না। গুগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাঁসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।
“লুইস, আছো?”
“ওর অবস্থা কি ভালোর দিকে?” লুইস জিজ্ঞেস করে। তার নিজের কন্ঠও যেন দূর থেকে ভেসে আসছে। “আর কেন এরকম হলো ডাক্তার কিছু বলেছে?”
“ওর ভাইয়ের ফিউনারেলের শক থেকে,” গোল্ডম্যান বলেন। “আমার নিজের ডাক্তার এসেছিলেন। লেনথর্প। ভালো ডাক্তার। উনি বলেছেন এলির গায়ে জ্বর আছে তবে ও ঘুম থেকে উঠার পর হয়তো এসব ঘটনা মনেও করতে পারবে না। কিন্তু তারপরও আমার মনে হয় রাচেলের চলে আসা উচিত। লুইস, আমি ভয় পেয়ে গেছি। আমার মনে হয় তোমারও চলে আসা উচিত।”
লুইস কোন জবাব দেয় না।
“লুইস, গেজ মারা গেছে, “ গোল্ডম্যান বলেন। “আমি জানি এটা তোমাদের জন্যে মেনে নেয়া অনেক কঠিন। কিন্তু তোমাদের মেয়ে তো বেঁচে আছে। এবং এখন ওর তোমাদের দুজনকেই খুব প্রয়োজন।”
ঠিকই বলেছেন। আপনি একটা বুড়ো ভাম হতে পারেন, কিন্তু ১৯৬৫র এপ্রিলের সেই দিনে আপনার দুই মেয়েকে নিয়ে ঘটা সেই দুঃসহ ঘটনা হয়তো আপনার মাথায় কিছু আক্কেলের উদয় ঘটিয়েছে। আমি জানি ওর আমাকে প্রয়োজন, কিন্তু আমি আসতে পারবো না, কারণ আমার ভয় হচ্ছে-খুব ভয় হচ্ছে- যে আমার হাতে হয়তো ওর মায়ের তাজা রক্ত লেগে আছে।
লুইস তার হাতগুলোর দিকে তাকায়। হাতের নখের নিচে জমে থাকা মাটির দিকে তাকায়, যেসব কিচেনের মেঝের পায়ের ছাপের মাটির মতই।
“আচ্ছা,” সে বলে। “আমি বুঝতে পেরেছি। আমরা যত শীঘ্র পারি চলে আসবো, আরউইন। পারলে আজ রাতেই চলে আসবো। ধন্যবাদ।”
“আমরা যতটুকু সম্ভব করছি,” তিনি বলেন। “হয়তো আমরা অনেক বুড়িয়ে গেছি। লুইস, সেটা হয়তো আমরা সব সময়ই ছিলাম।”
“ও কি আর কিছু বলেছে?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
গোল্ডম্যানের জবাবটা তার কাছে মনে হলো ফিউনারেলের ঘন্টার মত।
“অনেক কিছুই বলেছে, তবে আমি শুধু এটুকুই বুঝেছি, ‘প্যাক্সকাও বলেছে অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
সে টেলিফোনটা রেখে হতবুদ্ধি অবস্থায় চুলার দিকে এগোতে থাকে; হয়তো ব্রেকফাস্ট তৈরি করে আপাতত সব কিছু ভুলে থাকতে। কিচেনের মাঝামাঝি গিয়ে ওর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে, চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করে। ও মেঝেতে পড়ে যাচ্ছে… যাচ্ছে তো যাচ্ছেই…মনে হচ্ছে ও ঘোলাটে গভীরতায় ডুবে আছে। ওর মনে হয় ও পড়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা পাক খায়। এক সময় তার আহত হাঁটুতে আঘাত লাগে এবং একটা তীব্র ব্যথার ঝলকানি তার পা থেকে সারা শরীরে পৌঁছে যায়। সে কিছুক্ষণ হামাগুড়ি দিয়ে এগোয় এবং তার চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে যায়।
অবশেষে সে উঠে দাঁড়ায়। সে দুলছে। কিন্তু তার মাথা এখন পরিস্কার লাগছে।
পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং সে সত্যি সত্যি প্যান্টের পকেটের ওপর হাত রেখে গাড়ির চাবিটার আরামদায়ক অস্তিত্ব অনুভব করে। সে এক্ষুনি পারে তার গাড়িটায় উঠে শিকাগো চলে যেতে। সেখান থেকে সে এলিকে নিয়ে গা ঢাকা দিবে। গোল্ডম্যান হয়তো ততক্ষনে বুঝতে পারবে কোন একটা ঝামেলা আছে, সেটা একটা সমস্যা। কিন্তু তার পরও সে এলিকে সাথে করে নিয়ে যাবে, দরকার হলে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।
সে তার হাত চাবির ফুলে থাকা অংশ থেকে সরিয়ে নেয়। পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেছে। সেটা তার অনুশোচনা, ক্লান্তি বা হতাশার কারণে নয়। এর কারণ মেঝের পায়ের ছাপগুলো। মনে মনে সে স্পষ্ট দেখতে পায় সে দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে, প্রথমে ইলিনয়েস, তারপর ফ্লোরিডা; প্রয়োজন পড়লে বিশ্বের আরেক মাথায় পালিয়ে যেতেও তার আপত্তি নেই। কিন্তু এমন একদিন ঠিকই আসবে যেদিন সে তার দরজা খুলে দেখবে সেখানে গেজ দাড়িয়ে আছে; ওকে দেখাবে ওর পূর্বের অবয়বের একটা হাস্যকর রেপ্লিকার মত, ওর নীল চোখগুলো হবে নোংরা হলুদ আর ও মিটমিট করে হাসবে লুইসকে দেখে। অথবা এলি হয়তো গোসলের জন্যে বাথরুমের দরজা খুলে দেখবে বাথটাবে গেজ দাড়িয়ে আছে, তার সারা গায়ে সেই অ্যাক্সিডেন্টের অসংখ্য ক্ষত; তার শরীরে কবরের গন্ধ।
সেই দিন আসবেই-তার মনে এক ফোঁটা সন্দেহও নেই।
“আমি এতো বড় বোকামি কিভাবে করলাম?” সে শূন্য রুমে স্বগতোক্তি করে। “কিভাবে?”
বোকামি না লুইস, শোক। এর মধ্যে পার্থক্য আছে…খুব সূক্ষ্ম, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এটাই ওই জায়গাটার শক্তির উৎস। সেটার শক্তি বাড়ছে, জাড বলেছিলেন এবং তিনি সঠিক ছিলেন-এবং এখন তুমি নিজেও সেই শক্তির একটা অংশ। সে তোমার শোক থেকে নিজের খাবার নিংড়ে বের করে নিয়েছে, এবং সে তোমার শোকের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছে…দ্বিগুন করেছে, বর্গ করেছে, বাড়াতে বাড়াতে nতম পাওয়ারে নিয়ে গেছে। এটা শুধু শোক থেকেই নিজের খাবার নিংড়ে নেয় না, এটা তোমার মানসিক সুস্থতাকেও নিজের খাবার বানিয়েছে। এটা খেয়েছে তোমার স্ত্রীকে, এবং প্রায় নিশ্চিতভাবে তোমার সবচাইতে কাছের বন্ধুটিকেও এবং তোমার ছেলেকেও। এমনই হয়, যখন রাতের আঁধারে তোমার দরজায় অশুভ কিছু এসে কড়া নাড়লে তুমি তাকে তাড়িয়ে দিতে দেরি কর।
আমি এখন আত্মহত্যা করবো, খুব সম্ভবত। এ সুযোগ এখনো আমার হাতে আছে। আমার ব্যাগে তার জন্যে বেশ কার্যকরী জিনিসও আছে। জিনিসটা সবকিছু খুব নিখুঁতভাবে সাজিয়েছে, একেবারে শুরু থেকে। ওই গোরস্তান অথবা উইন্ডিগো, যেই হোক জিনিসটা। সেটাই আমাদের বিড়ালকে রাস্তায় ঠেলে দিয়েছে মরার জন্যে, এবং খুব সম্ভবত গেজকেও। সেটা রাচেলকেও ডেকে এনেছে, তবে তার সুবিধামত সময়ে। আমার এখন আত্মহত্যাই করা উচিত…এবং আমি করতেও চাই।
কিন্তু এর আগে কিছু জিনিস ঠিক করা দরকার, তাই না?
হ্যা। দরকার।
গেজের ব্যাপারটা দেখা দরকার। গেজ এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে, সেগুলো ডাইনিং রুম থেকে লিভিং রুম হয়ে ওপরের সিঁড়িতে উঠে গেছে। এখানে ছাপগুলো অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে, কারণ সে ওপর থেকে নামার সময় না দেখে সেগুলো মাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর পায়ের ছাপটা তার বেডরুমে যায়। সে এখানে এসেছিল, লুইস অবাক হয়ে ভাবে, সে একদম এখানেই এসেছিল, এরপর সে দেখতে পায় যে তার মেডিকেল ব্যাগের ডালাটা খোলা।
ভেতরের জিনিসগুলো, যেগুলো সে সব সময় খুব গুছিয়ে রাখে, এলোমেলো অবস্থায় আছে। ব্যাগে যে স্কালপেলটা নেই সেটা বুঝতে তার খুব বেশি দেরি হয় না এবং সেটা বুঝতে পেরে সে দু হাতে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ বসে থাকে, তার গলা দিয়ে মৃদু গোঙানীর শব্দ বেরুচ্ছে।
অবশেষে সে ব্যাগটা খুলে আবারো ভেতরের জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে।
আবারো নিচতলায় থামে।
ভাঁড়ার ঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। একটা কাপবোর্ড খোলার এবং এরপর বন্ধ করার শব্দ হলো। এরপর ক্যান ওপেনারের কর্কশ গোঙানি। সবশেষে গ্যারেজের দরজা খোলার এবং বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। এরপর বাড়িটা মে মাসের রোদে শূন্যভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, যেমনটা দাঁড়িয়ে ছিল গত বছরের আগস্ট মাসের এক দিনে, এক নতুন পরিবারের আগমনের অপেক্ষায়…যেমন হয়তো আরেকটা নতুন পরিবারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে ভবিষ্যতের কোন এক সময়। হয়তো কোন সদ্য বিবাহিত যুবক-যুবতী আসবে-ছেলেটি কোন ব্যাংকের ক্রেডিট ডিপার্টমেন্টে কাজ করবে, আর মেয়েটি হয়তো কোন ডেন্টাল সার্জন বা চোখের ডাক্তারের এ্যাসিসটেন্ট হবে। ছেলেটা হয়তো ফায়ারপ্লেসের জন্যে কাঠ চিরবে আর মেয়েটা হয়তো চুল পনিটেল করে মিসেস ভিন্টনের মাঠে ঘাসফুল কুড়োতে যাবে, তার সোনালী চুল রোদে ঝকঝক করবে কিন্তু সে কখনই জানবে না যে এই আকাশে একটা অদৃশ্য শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা নিজেরা নিজেদের অভিনন্দন জানাবে, তাদের কোন ফালতু কুসংস্কারে বিশ্বাস না করার জন্যে, এই বাড়িটা কেনার মত প্রয়োজনীয় দৃঢ় মনোবল থাকার জন্যে। তারা হয়তো তাদের বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে বলবে বাড়িটার ইতিহাসের জন্যে তারা বাড়িটা প্রায় পানির দরে পেয়েছে। তারা তাদের এটিতে থাকা ভূতের ব্যাপারেও কৌতুক করবে এবং ক্যাসেট প্লেয়ারে ব্যাকগেমন বা মাইল বর্নের গান শুনবে।
এবং হয়তো তাদের একটি পোষা কুকুর থাকবে।
অধ্যায় ৬১
একটা রাসায়নিক সার ভরা অরিংকো ট্রাক দ্রুতগতিতে লুইসের গায়ে দমকা হাওয়া লাগিয়ে চলে গেল। এরপর লুইস রাস্তা পার হয়, তার পিছু পিছু তার ছায়াও আসছে। তার এক হাতে একটি মুখ খোলা বিড়ালের খাবারের ক্যান।
চার্চ তাকে আসতে দেখে উঠে বসে এবং সাবধানী চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকে।
“হাই, চার্চ, “ লুইস বাড়িটা পরীক্ষা করে দেখতে দেখতে বলে। “ক্ষুধা লেগেছে?”
সে খাবারের ক্যানটা নীল গাড়িটার ট্রাঙ্কের ওপর রাখে এবং সাবধানে চার্চকে দেখতে থাকে। চার্চ খাবারের লোভে গাড়ির ছাদ থেকে ট্রাঙ্কে নেমে আসে এবং খেতে শুরু করে। লুইস তার এক হাত জ্যাকেটের পকেটে ঢোকায়। চার্চ তার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়, যেন সে লুইসের মতলব আঁচ করতে পারছে। লুইস মুচকি হেসে গাড়ি থেকে এক পা সরে দাঁড়ায়। চার্চ আবারো খেতে শুরু করে এবং লুইস তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে আনে। সে সিরিঞ্জের কাগজের মোড়ক খুলে ফেলে এবং সেটায় পচাত্তর মিলিগ্রাম মরফিন ঢুকিয়ে নেয়। সে মাল্টিডোজের ভায়ালটা তার পকেটে রেখে চার্চের দিকে হেঁটে যায়, যে আবারো চারদিকে সন্দিগ্ধভাবে তাকাচ্ছে। লুইস চার্চের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “খেয়ে নাও, চার্চ। চল চল চল, তাইনা?” সে চার্চের ঘাড়ের লোমে হাত বুলিয়ে দেয় এবং চার্চ কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আবার খেতে শুরু করে। লুইস এবার চার্চের পেটের কাছে চেপে ধরে পাছার মধ্যে সিরিঞ্জের সুইটা ঢুকিয়ে দেয়।
চার্চ তার হাত থেকে ছোটার জন্যে পড়িমরি করে তড়পাতে থাকে আর খামচি মারতে থাকে, কিন্তু লুইস তাকে চেপে ধরে রাখে, সিরিঞ্জটা একদম খালি করা পর্যন্ত। চার্চ গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে লাফিয়ে পড়ে। সে হিংসাত্মক ভঙ্গিতে লুইসের দিকে তার হলদে-সবুজ চোখে তাকায় এবং চায়ের কেটলির মত হিসিয়ে উঠতে থাকে। চার্চ লাফিয়ে পড়ায় তার পাছায় বিদ্ধ সিরিঞ্জটা নিচে বাড়ি খেয়ে ভেঙে গেছে। তাতে লুইসের কোন ভাবান্তর হলো না। ওই জিনিস তার কাছে আরো আছে।
চার্চ প্রথমে রাস্তার দিকে যেতে শুরু করলেও পরে আবার বাসার দিকে ফিরে যেতে থাকে, যেন সে ভুলে কিছু ফেলে গেছে। অর্ধেক পথে সে মাতালের মত দুলতে শুরু করে। পোর্চে ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপটাতে ওঠে এবং ঢলে পড়ে যায়। সেখানে এক পাশ হয়ে শুয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস টানতে থাকে সে।
লুইস নীল চেভেট গাড়িটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে। সে যে ব্যাপারে আগে থেকেই প্রায় নিশ্চিত হয়ে আছে, এখন তার প্রমান পায়। গাড়ির সিটে রাচেলের পার্স, স্কার্ফ এবং একটা ডেল্টা এয়ারলাইনের ফোল্ডার থেকে বেরিয়ে থাকা প্লেনের টিকিট।
যখন সে জাডের বাসার পোর্চের দিকে এগুতে আরম্ভ করে, চার্চের বুকের ওঠা নামা একদম বন্ধ হয়ে গেছে। চার্চ মারা গেছে। আবারো।
লুইস সেটাকে ডিঙ্গিয়ে পোর্চের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
“গেজ?”
জাডের বাড়ির সামনের হল ঘরটায় বেশ ঠান্ডা লাগছে। ঠান্ডা এবং অন্ধকার। তার কথাটা নীরবতার ওপর এমনভাবে আছড়ে পড়ে যেমনটা কোন পাথর আছড়ে পড়ে গভীর কূপের জলে।
“গেজ?”
কিছুই না। এমনকি পার্লারের ঘড়ির টিকটিকও বন্ধ হয়ে গেছে। আজ সকালে ঘড়িতে চাবি দেয়ার কেউ ছিল না।
কিন্তু ফ্লোরে পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে।
লুইস লিভিং রুমে যায়। সেখানে সিগারেটের গন্ধ, তবে বেশ পুরনো। সে জানালার পাশে জাডের চেয়ারটা দেখতে পায়। সেটা এক পাশে ঠেলে সরানো আছে, যেন কেউ সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে গেছে। জানালার দেয়ালে একটা অ্যাশট্রে এবং সেটার ওপর একটা জ্বলে শেষ হওয়া সিগারেটের ছাইয়ের রোল।
জাড এখানে বসে কিছুর দিকে নজর রাখছিলেন। কিন্তু কিসের দিকে? অবশ্যই আমার জন্যে, আমার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। তবে উনি আমাকে দেখেননি। যেভাবেই হোক এড়িয়ে গেছেন।
লুইস লাইন করে রাখা চারটা বিয়ারের ক্যানের দিকে তাকায়। এই কটা বিয়ার তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট না। হয়তো তিনি সেই সময় উঠে বাথরুমে গিয়েছিলেন। তবে যাই হোক, সেটাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নেয়া যায় না, তাই না?
কাদামাখা পায়ের ছাপ জানালার চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেছে। মানুষের ছাপের সাথে কিছু বিড়ালের পায়ের হালকা ছাপও আছে। চার্চ গেজের ছোট্ট জুতোর ছাপের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে এবং তখন চার্চের পায়ে কাদা লেগে হালকা ছাপগুলো পড়েছে। এপর ছাপগুলো কিচেনের দরজার দিকে গেছে।
লুইস ছাপগুলো অনুসরণ করে। তার বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে।
ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে সে এবং মেঝেতে জাডের সবুজ প্যান্ট পড়া ছড়িয়ে থাকা পা আর গায়ের চেক শার্ট দেখতে পায়। বৃদ্ধ রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝেতে পড়ে আছেন, সেই রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে যাচ্ছে।
লুইস হাত দিয়ে নিজের গালে থাপ্পর মারে, যেন সে অন্ধ হয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু সেটা সম্ভব না; সে চোখ জোড়া দেখতে পাচ্ছে, জাডের খোলা চোখ জোড়া। তিনি যেন লুইসকে দোষারোপ করছেন; হয়তো নিজেকেও করছেন এই সব কিছুর সূচনা করে দেয়ার জন্যে।
কিন্তু তিনি কি দায়ি? লুইস ভাবে। তিনি কি আসলেই দায়ি?
জাডকে জায়গাটার কথা বলেছে স্টানি বি., আর স্টানি বি.কে সেটার কথা বলেছে তার বাবা, এবং স্টানি বি.র বাবাকে বলেছে তার বাবা, যিনি ইন্ডিয়ানদের সাথে ব্যবসা করা শেষ ব্যবসায়িদের একজন, যিনি একজন ফ্রেঞ্চ, এবং সে সময় ফ্রাঙ্কলিন পিয়ার্স জীবিত ছিলেন এবং ছিলেন দেশের প্রেসিডেন্ট।
“ওহ জাড়,আমাকে ক্ষমা করে দিন,” সে বিড়বিড় করে বলে।
জাড তার শূন্য দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“প্লিজ, মাফ করে দিন,” লুইস আবারো বলে।
তার পা নিজে থেকেই নড়তে আরম্ভ করে এবং তার মন গত থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের কথা কল্পনা করতে থাকে। সেদিনের রাতের কথা না, যখন সে আর জাড মিলে চার্চকে পেট সেমেটারিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বরং সেদিন দিনের বেলাতে নরমা টেবিলে যে টার্কি ডিনার পরিবেশন করেছিলেন তার কথা। সেদিন নরমা তাদের কিচেনের লোয়ার ড্রয়ার থেকে একটা লন কাপড়ের টেবিল ক্লথ বের করে টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিয়েছিলেন। লুইস টেবিল থেকে কাপড়টা নিয়ে সেটা জাডের নিথর দেহের ওপর বিছিয়ে দেয়। জিনিসটা মাটিতে নামতে থাকা প্যারাশুটের মত জাডের দেহের ওপর বিছিয়ে যায়, সাথে সাথেই সেটির গায়ে কতগুলো লাল লাল গোলাপের পাপড়ির মত দাগ দেখা দেয়।
“আমাকে মাফ করে দিন,” সে তৃতীয় বারের মত বলে। “মাফ করে—”
ওপর তলায় কিছু নড়ে ওঠে, কিছু ঘষা খাওয়ার শব্দ হয়। লুইসের কথা তার ঠোঁটেই মরে যায়। শব্দটা মৃদু এবং খুব নরম, তবে সেটা যে ইচ্ছাকৃতভাবে করা, তাতে তার মনে কোন সন্দেহ নেই। শব্দটা তাকে শোনানোর জন্যেই করা হয়েছে।
তার হাত কেঁপে উঠতে চায় কিন্তু সে তা হতে দেয় না। হেঁটে সে দাবার ঘরের ডিজাইনের রেক্সিনে ঢাকা টেবিলটার কাছে যায়। তার পকেট থেকে আরো তিনটা বেকটন-ডিকসন সিরিঞ্জ বের করে সেগুলো কাগজের মোড়ক থেকে বের করে টেবিলের ওপর সুন্দরভাবে লাইন করে রাখে। সে আরো তিনটি মাল্টিডোজ ভাইল বের করে সিরিঞ্জগুলো ভরে নেয়। সিরিঞ্জের প্রত্যেকটিতে যে পরিমাণ তরল আছে তা দিয়ে একটি করে বড়সড় ঘোড়া মেরে ফেলা যাবে-অথবা হ্যানরাট্টি নামের ষাঁড়টাকে; যদি প্রয়োজন পড়ে। সে সিরিঞ্জগুলো আবারো নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।
কিচেন থেকে বেরিয়ে লিভিং রুম পেরিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ায়।
“গেজ?”
ওপরের অন্ধকার থেকে একটা শিশুসুলভ খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে—সেই হাসির শীতলতায় লুইসের পিঠের চামড়া কাটা দিয়ে ওঠে।
সে ওপরে উঠতে শুরু করে। ওপরে উঠার সময়টা তার কাছে বেশ লম্বা মনে হয়। সে বুঝতে পারে কোন অভিযুক্ত আসামীকে যখন পিছমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় মঞ্চে ওঠানো হয় তখনও হয়তো তার সময়টা এরকম লম্বা (এবং ভয়ঙ্কর রকম স্বল্প) মনে হয়।
অবশেষে ওপরে ওঠে সে, এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। সে এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে? জানে না। সে বুঝতে পারছে তার মাথা আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারছে, যেন সেটা এক রকমের অনুভূতি। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। সে ভাবে কোন তুষারের ভারে বোঝাই হওয়া গাছ যখন ঝড়ের বাতাসে উপড়ে যায়, তার ঠিক আগ মুহূর্তে গাছটার যে রকম অনুভূতি হয়-আদৌ যদি গাছেরা কিছু অনুভব করতে পারে-, তারও সেরকমই লাগছে। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং…মজাদার।
“গেজ, আমার সাথে ফ্লোরিডা যাবে?”
আবারো সেই শিশুসুলভ খিলখিল হাসি।
পাশে তাকালে তার স্ত্রীর মৃতদেহের দৃশ্য তাকে আমন্ত্রণ জানায়, যাকে সে একবার দাঁতে কামড়ে ধরে গোলাপ উপহার দিয়েছিল। ওর মৃতদেহ হলের মাঝ বরাবর পড়ে আছে। তার পা দুটোও জাডের পায়ের মত ছড়িয়ে আছে। তার পিঠ আর মাথা একটু বাঁকা হয়ে দেয়ালে ঠেস দেয়া। কেউ বিছানায় বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলে যেমন দেখা যায়, ওকে ঠিক তেমন লাগছে।
লুইস তার মৃত স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যায় এবং পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে।
হ্যালো, ডার্লিং, সে ভাবে, তুমি ফিরে এসেছো।
রক্ত ছিটে দেয়ালের ওয়ালপেপারে লেগেছে, নানা আকৃতিতে। রাচেলকে স্কালপেল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে বহুবার। এক ডজন বার, দুই ডজন বারও হতে পারে, কে জানে? তার স্কালপেলটা নিজের যোগ্যতার ভালো প্রমান দেখিয়েছে।
হঠাৎ করে লুইস তার স্ত্রীকে দেখতে পায়; প্রকৃত অর্থেই দেখতে পায় এবং সে চিৎকার করতে আরম্ভ করে।
তার তীক্ষ্ণ চিৎকার বাড়ির ভেতর প্রতিধ্বনি আর বিকট নাদ সৃষ্টি করে, যেখানে বর্তমানে শুধুমাত্র মৃত্যুরই বসবাস। তার চেহারা পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে, পেছনের চুল খাড়া হয়ে আছে, চোখগুলো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে চিৎকার করতে থাকে। তার শুকনো গলার চিৎকারের ধ্বনি নরকের ঘন্টার মত বাজছে। একে একে সব বিভৎস চিত্রগুলো লাগামহীন হয়ে আছড়ে পরে তার মনের দেয়ালে। ইনফার্মারির কার্পেটে ভিক্টর পাস্কোর মৃত্যু, গোঁফে সবুজ পলিথিনের টুকরো নিয়ে চার্চের ফিরে আসা, রাস্তায় পড়ে থাকা গেজের রক্তভেজা বেসবল ক্যাপ … কিন্তু সবচাইতে বেশি দেখলো ঈশ্বরের জলার কাছের সেই জিনিসটা, যেই জিনিসটা একটা আস্ত গাছ উপড়ে দিয়েছিল, সেই হলুদ চোখের জিনিসটা; উইন্ডিগো নামের মৃত জিনিসটা যার স্পর্শ অকথ্য রকমের প্রবৃত্তির জন্ম দেয়।
রাচেলকে শুধু হত্যা করা হয়নি।
কেউ তার ওপর…কেউ তার ওপর নিজের মনের ঝাল মিটিয়ে নিয়েছে।
(ক্লিক!)
দরজা খোলার শব্দ হয়।
লুইস চিৎকাররত অবস্থাতেই মুখ তুলে তাকায়। অবশেষে সে দেখা পায়। এইতো গেজ। ওর মুখ রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে, চিবুক দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে, আর মুখে একটা নারকীয় মুচকি হাসি। তার এক হাতে লুইসের স্কালপেল।
স্কালপেল ধরা হাতটা যখন লুইসের দিকে নেমে আসে, কিছু চিন্তা না করেই একটু পিছিয়ে যায় সে। স্কালপেলটা ঝট করে তার মুখের কাছ দিয়ে চলে যায়, আর গেজ কিছুটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সে চার্চের মতই নড়বড়ে। লুইস গেজের পা বরাবর লাথি মারে এবং গেজ উদ্ভট ভঙ্গিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আর সে উঠে পড়ার আগেই লুইস তার দুপাশে দু হাঁটু রেখে চেপে বসে। তার এক হাঁটুর নিচে গেজের স্কালপেল ধরা হাতটা।
“না,” তার নিচে চাপ খাওয়া জিনিসটা বলে উঠে। জিনিসটার মুখ কুচকে গেছে এবং ঘৃণা প্রকাশ পাচ্ছে। “না, না, না – “
লুইস তার পকেটের ভেতর থেকে একটা সিরিঞ্জ খামচে ধরে। তাকে খুব দ্রুত কাজ করতে হবে। নিচের জিনিসটাকে একটা পিচ্ছিল মাছের মত মনে হচ্ছে এবং জিনিসটার কব্জিতে যত জোরে চাপই দেয়া হোক না কেন, সেটা স্কালপেলটা হাত থেকে ছাড়ছে না। এরপর লুইসের মনে হলো যে তার তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই জিনিসটার চেহারা মুচড়ে মুচড়ে পাল্টে যাচ্ছে। প্রথমে চেহারাটা জাডের চেহারার মত পাল্টে গেল; মৃত জাডের শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা চেহারা। এরপর সেটা বদলে ভিক্টর পাস্কোর বিপর্যস্ত চেহারার মত হয়ে যায় এবং চোখগুলো এলোমেলোভাবে ঘুরতে আরম্ভ করে। ভিক্টরের চেহারাটা অনেকটা আয়নার মত মনে হচ্ছে, কারণ লুইসকেও তার মতই দেখাচ্ছে, ফ্যাকাসে এবং উন্মত্ত। এরপর সেটা আবারো বদলে গেল। এবার সেটা জঙ্গলের সেই জিনিসটার চেহারা ধারণ করলো -নিচু কপাল, মৃত হলুদ চোখ, লম্বা জিভ; দ্বিখন্ডিত এবং চোখা। জিনিসটা মৃদু হাসছে এবং হিস হিস করছে।
“না, না, না-না-না—”
জিনিসটা নিচ থেকে প্রচন্ড ঝটকা দিয়ে লুইসকে সরিয়ে দিতে চায়। লুইসের হাত থেকে সিরিঞ্জটা ছিটকে পড়ে গড়িয়ে হলের মাঝামাঝি চলে যায়। সে তার পকেট থেকে হাতড়ে আরেকটা সিরিঞ্জ বের করে আনে এবং সোজা গেজের পিঠে সেটা বসিয়ে দেয়।
জিনিসটা তার নিচে প্রচন্ডভাবে তড়পাতে শুরু করে এবং তাকে প্রায় ছুঁড়েই ফেলছিল আরেকটু হলে। তিন নাম্বার সিরিঞ্জটা বের করে লুইস ঘোৎ করে একটা শব্দ করে সেটা গেজের বাহুতে বসিয়ে দেয় এবং সিরিঞ্জটা চেপে পুরোটা তরল গেজের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেয়। এরপর সে উঠে হলওয়ের দিকে ধীরে ধীরে এগুতে থাকে। গেজ উঠে খুব দ্রুত পায়ে তার দিকে এগুতে শুরু করে। কিন্তু পাঁচ কদম পরেই জিনিসটার হাত থেকে স্কালপেলটা খসে পড়ে। স্কালপেলের ব্লেডটা প্রথমে মেঝে স্পর্শ করে এবং তারপর পুরো স্কালপেলটা। সেটা কাঠের মেঝেতে আঘাত করে কাঁপতে থাকে। দশ কদম পরে জিনিসটার চোখের অদ্ভুত হলদে আলোটা ফিকে হয়ে আসতে থাকে। আর দুই কদম এগিয়ে সেটা হাঁটুতে ভর দিয়ে পড়ে যায়।
এবার গেজ মাথা তুলে লুইসের চোখের দিকে তাকায়-তার ছেলে ওর চেহারা দুঃখী-দুঃখী, যন্ত্রণায় কাতর।
“বাবা!,” ও চিৎকার করে ওঠে, এবং পরমুহূর্তেই মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
লুইস নিজের জায়গায় আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর সে সাবধানে গেজের দিকে এগোয়; সে কোন রকম ছলচাতুরীর জন্যে নিজেকে সতর্ক রাখছে। কিন্তু কোন ছলচাতুরী ঘটে না, গেজের হাত খপ করে তাকে খাবলে ধরারও চেষ্টা করে না। সে গেজের গলার নিচে একটা আঙুল দিয়ে ওর পাল্স খুঁজে সেটা চেপে ধরে থাকে। সে তার জীবনে শেষবারের মত ডাক্তারি করছে, পালস চেক করছে যতক্ষণ না সেটা একদম হারিয়ে যায়।
যখন পালস একদমই বন্ধ হয়ে যায় তখন লুইস উঠে দাঁড়িয়ে অলস ভঙ্গীতে হলের অপর প্রান্তে হেঁটে যায়। সে হলের এক কোণে বসে পড়ে এবং নিজেকে দেয়ালের কোণায় চেপে একটা ছোট বলের মত করে গুটিয়ে নেয়। তার মনে হয় সে যদি নিজের আঙুল চুষতে শুরু করে তাহলে সে হয়তো নিজেকে আরো ছোট করে ফেলতে পারবে। তাই সে মুখে তার বুড়ো আঙুলটা ঢুকিয়ে চুষতে শুরু করে।
এভাবে প্রায় দু ঘন্টার মত থাকে…এবং ধীরে ধীরে অন্ধকার এবং খুব- সম্ভব একটা আইডিয়া তার মাথায় আসে। সে তার মুখ থেকে আঙুলটা বের করে। তাতে একটা পপ করে শব্দ হয়। লুইস আবারো চলতে শুরু করে (হেই-হেই! চলো, চলো)।
যে রুমে গেজ লুকিয়ে ছিল, সে রুমে ঢুকে বিছানার চাদরটি নিয়ে আসে লুইস। সে চাদরে তার স্ত্রীর দেহটা মুড়িয়ে নেয়, খুব যত্নসহকারে, ভালবাসার সাথে। সে টেরও পায় না যে সে গুনগুন করছে।
***
জাডের গ্যারেজ থেকে গ্যাসোলিন খুঁজে বের করে লুইস। ঘাস কাটার যন্ত্রটার পাশে পাঁচ গ্যালনের একটা লাল ক্যান। যথেষ্টর চাইতে বেশি। সে শুরু করে কিচেন থেকে, যেখানে জাডের লাশ টেবিল ক্লথের নিচে পড়ে আছে। লুইস সেটা গ্যাসোলিনে ভিজিয়ে দেয় এবং সেখান থেকে লিভিং রুমে যায় গ্যাসোলিন ঢালতে ঢলতে। কার্পেট, সোফা, ম্যাগাজিনের র্যাক, চেয়ার সবকিছুতে গ্যাসোলিন ঢেলে সে নিচতলার হল পর্যন্ত যায়। বাতাসে গ্যাসোলিনের তীব্র গন্ধ।
জাড়ের থেমে থাকা ঘড়িটা যে চেয়ারে ছিল সেখানেই সে জাডের ম্যাচের বক্স খুঁজে পায়; সিগারেট প্যাকের ওপর। লুইস সেটা নিয়ে নেয়। বাড়ির সামনের দরজার কাছে গিয়ে সে একটা ম্যাচের জ্বলন্ত কাঠি তার কাঁধের ওপর দিয়ে পিছনে ছুঁড়ে মারে এবং দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আগুনের ব্লাস্টের তাপ তার ঘাড়ের চামড়ায় এসে আছড়ে পড়ে। সে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দেয় এবং পোর্চে কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়ায়, দরজার পর্দার ওপাশে কমলা শিখার নাচানাচি দেখতে। এরপর সে হেঁটে বারান্দা পেরোয়, তার মনে পড়ে সে আর জাড মিলে এখানে লক্ষ বছর আগে বিয়ার গিলত। বাড়ির ভেতর থেকে লেলিহান আগুনের চাপা গর্জন ভেসে আসছে। এরপর সে বেরিয়ে পড়ে।
অধ্যায় ৬২
লুইসের বাড়ির আগের মোড়ে এসে স্টিভ মাস্টারটন ধোঁয়া দেখতে পায়-লুইসের বাসা থেকে না, তার বিপরীত দিকের বুড়োর বাড়িটা থেকে।
লোকটা লুইসকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিল তাই সকাল সকাল এখানে চলে এসেছে। চার্লটন তাকে আগের দিনে রাচেলের ফোনকলের ব্যাপারে বলেছেন, যা স্টিভের মনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক করে।
সে আসলে ঠিক জানে না কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে, কিন্তু তার মনে ব্যাপারটা বারবার খোঁচাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তার একবার লুইসের বাড়ি গিয়ে দেখে আসা উচিত সব ঠিক আছে কিনা মানে বর্তমান পরিস্থিতিতে যতটুকু ঠিক থাকা সম্ভব আর কি।
বসন্তের চমৎকার আবহাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল ইনফার্মারি প্রায় রোগি শূন্য এবং সুরেন্দ্র তাকে বলেছে ও একাই সবকিছু সামাল দিতে পারবে, চাইলে যেতে পারে সে। শুনে স্টিভ লাফিয়ে তার বাইকে উঠে লাডলোর দিকে ড্রাইভ করে চলে আসে। হয়তো তার দরকার ছিল না, কিন্তু তার খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। তার এটাও মনে হচ্ছিল যা হবার তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। চিন্তাটা খুব অর্থহীন, কিন্তু তার পেটের মধ্যে কেমন কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে-ঠিক যেমনটা হয়েছিল ভিক্টর পাস্কোর ওই ঘটনার সময়। কোন বিচারেই সে ধার্মিক না (যখন কলেজে ছিল তখন সে সেখানকার নাস্তিক ক্লাবের মেম্বার ছিল। তার এডভাইজার তাকে ডেকে আন- অফিসিয়ালি বলেছিলেন যে এতে করে তার মেডিকেল স্কুলে স্কলারশিপ পেতে সমস্যা হতে পারে। সেই কথা শুনে অবশ্য সে নাস্তিক ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসে), কিন্তু যে কোন জীবের মতই তার ভেতর আশঙ্কার জন্ম হচ্ছে। আর ভিক্টর পাস্কোর মৃত্যুটাও যেন তার পরের এক বছরের টোন সেট করে দিয়েছিল, যেভাবেই হোক। বছরটা কোনভাবেই ভালো বলা যায় না। এর মধ্যে সুরেন্দ্রর দুইজন আত্মীয় ইন্ডিয়ার জেলে আটক হয়েছেন, রাজনৈতিক কারণে। আর সুরেন্দ্র তাকে পরে বলেছে যে তাদের মধ্যে একজন তার খুব প্রিয় চাচা, যাকে এখন একরকম মৃতই বলে দেয়া যায়। সুরেন্দ্র খুব কেঁদেছিল বলতে বলতে, আর তার মত একজন ঠান্ডা ভারতীয় লোকের অমন কান্না দেখে স্টিভ একরকম ভয়ই পেয়ে যায়। চার্লটনের মায়ের ব্রেস্ট কেটে ফেলে দিতে হয়েছে এবং ডাক্তার তারপরও কোন রকম ভরসা দেননি। ভিক্টর পাস্কোর মৃত্যুর পর স্টিভ নিজে চারটা ফিউনারেলে অংশগ্রহণ করেছে-তার শ্যালিকা, যে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে, একজন কাজিন, যে মারা গেছে একদম একটা তুচ্ছ বাজি লেগে, (বৈদ্যুতিক পোলে চড়া তার জন্যে কোন ব্যাপারই না, সেটা প্রমাণ করতে গিয়ে); তার বৃদ্ধ দাদা; আর লুইসের ছোট্ট ছেলে।
সে লুইসকে খুবই পছন্দ করে এবং সে নিশ্চিত হতে চায় যে লুইস ঠিক আছে। লুইসের জীবন বর্তমানে নরকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
যখন সে ধোঁয়াটা প্রথমে দেখতে পেয়েছিল তখন সে ভেবেছিল ভিক্টর পাস্কোর একাউন্টে হয়তো আরেকটা স্কোর যোগ হতে যাচ্ছে। মরে গিয়ে ভিক্টর পাস্কো হয়তো অশুভ কোন বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু ভাবনাটা বোকার মত, এবং লুইসের বাড়িটি তার প্রমাণ। সকালের রোদে নিউ ইংল্যান্ড আর্কিটেকচারের সাদা বিল্ডিংটা সহি সালামতেই দাঁড়িয়ে আছে।
লোকজন বুড়োর বাড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। স্টিভ যখন তার বাইকটা লুইসদের বাড়ির ড্রাইভওয়েতে পার্ক করছে তখন সে দেখতে পেল একজন লোক পুড়তে থাকা বাড়িটার পোর্চে উঠে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে পরক্ষণেই ফিরে আসে। লোকটার ভাগ্য ভালো, কারণ মুহূর্ত পরেই দরজাটার কাঁচ বার্স্ট হয় এবং সেখান থেকে লকলকে আগুন দাউদাউ করে বেরিয়ে আসে। সে যদি দরজাটা খুলতো তাহলে সে হয়তো এতক্ষণে কাবাব হয়ে যেত।
আগুনের আদিম রহস্যে স্টিভ কিছুক্ষণের জন্যে লুইসকে ভুলে যায়। সব মিলিয়ে হাফ ডজনের মত লোক জড়ো হয়েছে। ‘হতে পারতো হিরো’ লোকটা বাদে সবাই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখছে। ‘হতে পারতো হিরো’ দাঁড়িয়ে আছে ক্র্যান্ডালদের উঠোনে। এবার পোর্চ আর বাড়ির দেয়ালের জানালাগুলো ভয়ঙ্করভাবে বিস্ফোরিত হয় আর ‘হতে পারতো হিরো’ মাথা নিচু করে পড়ি মড়ি করে ছুটতে থাকে। বাড়ির ভেতর থেকে আগুনের কমলা হাতের ছোঁয়ায় পোর্চের দেয়ালের সাদা রং ফোসকার মত উঠে যেতে শুরু করে। স্টিভ দেখলো পোর্চে রাখা একটা ইজি চেয়ার কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ার পর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
বাড়ি পুড়তে থাকার মট মট শব্দের মধ্যে ‘হতে পারতো হিরো’ চিৎকার করে বলে, “বাড়িটার আর কোন আশা নাই। ভেতরে যদি জাড থাকে তাহলে উনিও এতক্ষণে আর নেই।”
স্টিভ যেই চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল যে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়া হয়েছে কি না, তখনি সে দূর থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির ক্ষীণ সাইরেন শুনতে পায়। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে অনেকগুলো গাড়িই আসছে। তারা আসছে, কিন্তু ‘হতে পারতো হিরো’র কথাই ঠিক। বাড়িটার আর কোন আশা নেই। হাফ-ডজন ভাঙা জানালা দিয়ে আগুনের শিখা বেরিয়ে এসেছে আর বাড়ির সামনের দিকের দেয়ালেও আগুন ধরে গেছে।
এরপর তার লুইসের কথা মনে পড়ে। লুইস যদি বাসায় থাকতো তাহলে কি তার এতক্ষণে পুড়তে থাকা বাড়ির সামনে চলে আসার কথা না?
স্টিভ তার চোখের কোন দিয়ে কিছু একটা দেখতে পায়।
লুইসের ড্রাইভওয়ের পেছনে একটা মাঠ পেছন দিকের একটা পাহাড়ে ধীরে ধীরে উঠে গেছে। মে মাসেই মাঠের ঘাস বেশ লম্বা হয়ে গেছে। কিন্তু মাঠে খুব যত্ন করে ঘাস কেটে একটা রাস্তা বানানো হয়েছে, অনেকটা গলফ কোর্টের ছাটা ঘাসের মত করে। পথটা মাঠের অপর প্রান্তে গিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে ওপরের দিকে উঠে গেছে। মাঠটা যেখানে জঙ্গলের সবুজের সাথে মিলিত হয়েছে ঠিক সেখানে সে একটা উজ্জ্বল সাদা জিনিস দেখতে পায়। জিনিসটা দেখার পর বুঝে উঠার আগেই সেটা আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু যতটুকু দেখেছে তাতে ওর মনে হয়েছে একজন লোক একটা সাদা বান্ডিল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
লোকটা লুইসই ছিল, তার মন অযৌক্তিক হলেও খুব জোরালোভাবে তাকে বলে। লোকটা লুইসই, আর তুমি দ্রুত ওর কাছে যাও। কারণ খুব খারাপ কিছু ঘটেছে এবং তার চাইতে আরো খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে, যদি তুমি ওকে না থামাও।
সে লুইসের ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে আর বার বার পা বদল করতে থাকে।
স্টিভ বাবু, ভয়ে তোমার পেট পাতলা হয়ে গেছে, তাই না?
হ্যাঁ, একদম। সে কোন কারণ ছাড়াই ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে। কিন্তু আবার এক রকমের একটা…..
আকর্ষণ।
হ্যাঁ, একটা আকর্ষণও কাজ করছে ওই পথটার দিকে, যেটা মাঠ পেরিয়ে বনের দিকে চলে গেছে। ওই পথটা নিশ্চয়ই কোন নির্দিষ্ট জায়গায় যাবার পথ, তাই না? সব পথেরই একটা গন্তব্য থাকে।
লুইস। লুইসের কথা ভুলে বসো না বেকুবের মত! তুমি এখানে লুইসের জন্যে এসেছো, বনে পিকনিক করতে আসেনি।
“ওখানে কী পেলে রেন্ডি?” ‘হতে পারতো হিরো’ চিৎকার করে উঠে। তার বিকট চিৎকারটা কেমন যেন আশাবাদী রকম শোনায়
রেন্ডির উত্তর অবশ্য সাইরেনের আওয়াজে অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। “মরা বিড়াল।”
“পোড়া?”
“পোড়া মনে হয় না,” রেন্ডি জবাব দেয়। “এমনিই মরা।”
রেন্ডি আর ‘হতে পারতো হিরো’র কথোপকথন শুনে স্টিভের কোন এক অদ্ভুত কারণে মনে হয় যে সে যা ভেবেছিল তাই ঠিক। লোকটা লুইসই ছিল।
সে আগুনে পুড়তে থাকা বাড়িটা পেছনে ফেলে মাঠের পথটা ধরে হাঁটতে শুরু করে। সে যখন বনের কাছে পৌঁছে ততক্ষণে সে ঘেমে উঠেছে। বনে পৌঁছালে গাছের ছায়া তার বেশ আরামদায়ক লাগে। বনে নানান গাছপালা আর বুনো ফুলের একটা মিষ্টি গন্ধ।
বনের ভেতরে ঢুকে সে ছুটতে শুরু করে। সে নিজেও জানে না সে কেন ছুটছে বা কেন তার হার্টবিট বেড়ে দ্বিগুন হয়ে গেছে। পাহাড় থেকে নামার রাস্তায় সে আরো জোরে দৌড়ায়। রাস্তাটা খুবই পরিস্কার। অবশ্য সে যখন পেট সেমেটারির গেট দিয়ে ঢুকে তখন সে শুধু দ্রুত হাঁটছে। তার ডান পাশে বগলের নিচে জ্বালা করছে, হয়তো খোঁচা লেগেছে কিছুর সাথে।
সে পেট সেমেটারির কবরগুলোর বৃত্তাকার আকৃতি, কবরগুলোতে টাঙ্গানো পিটিয়ে সোজা করা টিন বা বোর্ডের লেখা-কিছুই মনোযোগ দিয়ে দেখলো না। তার দৃষ্টি আরো সামনে, লুইসের দিকে। লুইস একটা মরা গাছ-পালার ধ্বংসস্তূপের ওপর চড়ছে, অভিকর্ষ বলকে একরকম কাচকলা দেখিয়ে। সে একটার পর একটা পা ফেলে ধ্বংসস্তুপটার ওপর উঠে যাচ্ছে, নিচে না তাকিয়ে, শুধুমাত্র সামনের দিকে তাকিয়ে; যেন সে সম্মোহিত অবস্থায় আছে, অথবা যেন সে স্লিপ ওয়াকিং করছে। লুইস তার দুই হাতে পাজাকোলা করে সাদা জিনিসটা বহন করছে যেটা স্টিভ তার চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেয়েছিল। কাছ থেকে দেখে আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই-জিনিসটা একটা লাশ। জিনিসটার এক মাথা দিকে একটা লো হিলের জুতো পড়া পা বেরিয়ে আছে। আর স্টিভ সাথে সাথেই খুব নিশ্চিত আশঙ্কার সাথে বুঝতে পারে সেটা রাচেলের দেহ।
লুইসের চুল সাদা হয়ে গেছে।
“লুইস!” স্টিভ চিৎকার করে ওঠে।
লুইস ফিরে তাকায় না, থামেও না। সে স্তুপটার একদম মাথায় উঠে আবার ওইদিকে নামতে শুরু করে।
ও পড়ে যাবে। সে খুব লাকি, অসম্ভব লাকি, কিন্তু এখনি ও পড়ে যাবে। আর কমসে কম ওর পা তো ভাঙবেই-
কিন্তু লুইস পড়ে যায় না। সে কিছুক্ষণের জন্যে স্টিভের দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর স্তূপের ওপাশে বনের রাস্তায় সে আবার লুইসকে দেখতে পায়।
“লুইস!” স্টিভ আবারো চিৎকার করে ওঠে।
এবার লুইস থেমে পেছন ফিরে তাকায়।
স্টিভ যা দেখতে পায় তাতে সে একদম হতভম্ব হয়ে পড়ে। পাকা চুলের পাশাপাশি লুইসের চেহারাও একদম বুড়িয়ে গেছে।
প্রথমে তাকে লুইস বলে চেনাই যাচ্ছিল না। কিন্তু স্টিভ ধীরে ধীরে ওকে চিনতে পারে। লুইসের ঠোঁটগুলো নড়ছিল। কিছুক্ষণ পর স্টিভ বুঝতে পারে যে লুইস হাসার চেষ্টা করছে।
“স্টিভ,” সে ভাঙা গলায় বলে, অনিশ্চিতভাবে। “হ্যালো, স্টিভ। আমি ওকে কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছি। খালি হাতেই কাজটা করা লাগবে মনে হচ্ছে। কাজ শেষ হতে হতে মনে হয় অন্ধকার হয়ে যাবে। ওখানকার মাটি খুব পাথুরে। মনে হয় না তুমি আমাকে সাহায্য করতে চাও, তাই না?”
স্টিভ তার মুখ খুলে, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। সে হকচকিয়ে গেছে এবং আতঙ্কিত বোধ করছে। কিন্তু তার পরও সে লুইসকে সাহায্য করতে চায়। যেভাবেই হোক, এই জঙ্গলের পরিবেশে সেটাই খুব…খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
“লুইস,” সে অবশেষে কর্কশ স্বরে বলতে সক্ষম হয়। “কী হয়েছে, লুইস? ঈশ্বরের দোহাই লাগে লুইস…কি হয়েছে? ও কি…ও কি আগুনে পুড়ে গেছে?
***
“আমি গেজের বেলা অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম,” লুইস বলে। “আমার দেরির কারণে গেজের ভেতরে একটা কিছু ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু রাচেলের বেলা সেরকম হবে না, স্টিভ। আমি জানি রাচেলের বেলা অন্যরকম হবে।”
লুইস তার দিকে একটু এগিয়ে আসে। স্টিভ বুঝতে পারছে লুইস পাগল হয়ে গেছে—সেটা সে খুব পরিস্কারভাবে বুঝতে পারছে। লুইসের মাথা খারাপ হয়ে গেছে আর ওকে দেখাচ্ছে ভয়ঙ্কর ক্লান্ত। তবে লুইসের ক্লান্তির ব্যাপারটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্টিভের মনে অধিক নাড়া দেয়।
“তুমি সাহায্য করলে খুব উপকার হতো,” লুইস বলে।
“লুইস, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাইলেও তো তা সম্ভব না। এই মরা ডালপালার স্তূপ আমি কোনভাবেই পেরুতে পারবো না।”
“আরে পারবে,” লুইস বলে। “অবশ্যই পারবে। তোমার যেটা করা লাগবে তা হচ্ছে নিচের দিকে না তাকিয়ে একদম স্বাভাবিকভাবে হেঁটে উঠে যেতে হবে। এটাই সিক্রেট, স্টিভ।”
লুইস ঘুরে দাঁড়ালো এবং স্টিভ তাকে আরো ডাকলেও সে তা না শুনে পথ ধরে বনের ভেতর ঢুকে যায়। কিছুক্ষণের জন্যে স্টিভ গাছপালার ফাঁক দিয়ে সেই সাদা চাদরের ফরফরানি দেখতে পায়। এর পর আর কিছুই দেখা যায় না।
সে দৌড়ে ডালপালার স্তুপটার কাছে যায় এবং কোন রকম চিন্তা করা ছাড়াই সেটা বেয়ে উঠার চেষ্টা করে। সে হাতড়ে হাতড়ে শক্ত কিছু ধরে সরীসৃপের মত স্তূপটার গা বেয়ে উঠতে চেষ্টা করে, পা দিয়ে ডাল ঠেলে ঠেলে। তার শরীরে একটা পাগলা উত্তেজনা ভর করেছে-যেন সে একদম বিশুদ্ধ অক্সিজেন টেনে নিয়েছে শরীরে। তার বিশ্বাস ছিল সে উঠতে পারবে-এবং সে উঠেও যায়। সে সাবলীলভাবেই কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই স্তূপটার ওপরে উঠে যায়। স্তূপটার ওপর কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়ায় সে। ভারসম্য রাখার জন্যে সে হালকা হালকা দুলছে ডালের ওপর। সে আবারো লুইসকে দেখতে পায় জংলী পথটাতে।
লুইস পিছে ফিরে স্টিভের দিকে তাকায়। তার স্ত্রীর লাশ পেঁচানো চাদরের রোলটা সে পাঁজাকোলা করে ধরে রেখেছে।
“তুমি হয়তো কিছু শব্দ শুনতে পাবে,” লুইস বলে। “মানুষের গলার মত। কিন্তু ওসব কিছু না। ওগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।”
“লুইস-”
কিন্তু লুইস আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
স্টিভ আরেকটু হলেই লুইসকে ফলো করতে শুরু করেছিল আর একটু হলেই।
আমি হয়তো ওকে সাহায্য করতে পারবো…আর আমি ওকে আসলেই সাহায্য করতে চাই। কারণ চোখে যা দেখা যাচ্ছে তার বাইরেও হয়তো আরো কিছু আছে, যেটা আমার জানা দরকার। ব্যাপারটাকে খুব…খুব গুরত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা একটা সিক্রেট। একটা রহস্য।
তক্ষুনি ওর পায়ের নিচে একটা ডাল খুব জোরে মট শব্দ করে ভেঙে যায়। ডাল ভাঙার শব্দটাকে শোনায় রেস শুরু হবার আগের গুলির আওয়াজের মত। ও হঠাৎ করেই নিজের মধ্যে ফিরে আসে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারে সে ঠিক কি করছে এবং ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। কেউ স্লিপ ওয়াকিং করে কোন বড় দালানের ছাদের শেষ মাথায় এসে জেগে উঠলে তার যে অবস্থা হবে, স্টিভের অবস্থাও হয়েছে ঠিক সেই রকম। তার চেহারায় ভীষন আতঙ্ক
রাচেল মরে গেছে আর আমার ধারণা লুইসই ওকে খুন করেছে। লুইস উন্মাদ হয়ে গেছে, বদ্ধ উন্মাদ, কিন্তু-
এখানে শুধু পাগলামি না-আরো অনেক অনেক খারাপ কিছু একটা আছে। তার মনে হচ্ছে জঙ্গলের ভেতর কিছু একটা তার ব্রেনকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে। লুইস যেখানে রাচেলের লাশ নিয়ে যাচ্ছে আকর্ষণটা তাকে সেখানেই নিয়ে যেতে চাচ্ছে।
আহা, এসোই না…এসে দেখো পথটা কোথায় গেছে। ওখানে তোমার দেখার মত কিছু জিনিস আছে, স্টিভানো, এমন সব জিনিস যেগুলো তুমি তোমার নাস্তিক ক্লাব থেকে জানতে পারবে না।
এরপর, হয়তো জিনিসটা একদিনের জন্যে যথেষ্ট শিকার পেয়ে যাওয়ায় স্টিভের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, এবং স্টিভের পথটা ধরে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে যেন হঠাৎ করেই উবে যায়। স্টিভ পেছনের দিকে টলমলভাবে দু পা পিছিয়ে যায়। এবার ওর পায়ের নিচ থেকে আরো অনেকগুলো ডাল সরে যায় এবং ওর বা পা-টা ফসকে ভেতরের দিকে ঢুকে যায়। পা ঝাটকা দিয়ে টেনে বের করতে গেলে ভাঙা ডালের চোখা অংশে লেগে ওর পায়ের স্নিকার খুলে আসে এবং ডালটি পায়ের মাংসের ভেতর ঢুকে যায়। সে পেট সেমেটারির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আরেকটু এদিক সেদিক হলেই একটা কমলা রঙের কবরের ফলকের চোখা কাঠ ওর পেটে ঢুকে যেত।
উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে বিভ্রান্তের মত তাকাতে থাকে সে আর ভাবতে থাকে তার সাথে কি হয়েছে…বা আদৌ কিছু হয়েছে কি না। এর মধ্যেই ব্যাপারটাকে ওর স্বপ্নের মত লাগছে।
এরপর গভীর বনের ভেতর থেকে, যেখানে ফকফকা রোদের আলোতেও মনে হয় সেখানকার আলোর রং সবুজ, সেখান থেকে একটা চাপা কিন্তু বিকট খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে। স্টিভ চিন্তাও করতে পারে না কি সেই জিনিস, যার হাসির শব্দ এতো বীভৎস।
জুতো ছাড়া এক পা নিয়েই সে ছুটতে আরম্ভ করে এবং চিৎকার করার চেষ্টা করে, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না। সে যখন লুইসের বাড়ির কাছে আসে, তখনো সে দৌড়াচ্ছে। সে যখন তার বাইকে বসে ইঞ্জিন চালু করে তখনো সে চিৎকার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে বিপরীত দিক থেকে আসতে থাকা একটা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির একদম গা ঘেষে যায়। হেলমেটের ভেতরে তার মাথার পেছন দিকের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে।
যখন অরনোতে তার নিজের ফ্লাটে পৌঁছে, তার মন থেকে একদম মুছে যায় যে সে লাডলোতে গিয়েছিল। সে অফিসে ফোন করে অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে নেয় আর একটা পিল খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
স্টিভ মাস্টারটন সেদিনটার কথা আর কখনই মনে করতে পারেনি…শুধু সেসব স্বপ্নে ছাড়া যেগুলো একদম ভোরের দিকে দেখে। সেসব স্বপ্নে সে দেখতে পায় খুব দানবাকৃতির কিছু একটা তাকে ছুঁয়ে দিতে চাচ্ছে… কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে এসে জিনিসটা আর ওকে ছোঁয় না।
জিনিসটার হলুদ চোখগুলো মস্ত আকারের…অনেকটা ফগ ল্যাম্পের মত।
স্টিভ এসব স্বপ্ন থেকে মাঝে মাঝে চিৎকার করতে করতে বিষ্ফোরিত চোখে জেগে ওঠে এবং সে ভাবেঃ তোমার মনে হচ্ছে তুমি চিৎকার করছো। কিন্তু ওসব কিছু না। কিন্তু ওসব কিছু না। গুগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাঁসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।
কিন্তু সে জানতো না, মনে করতে পারতো না এই ভাবনার মানে কী। পরের বছর সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেশের আরেক মাথায় একটি চাকরি জুটিয়ে নেয়, সেন্ট লুইসে।
লুইসের সাথে তার শেষ সাক্ষাত এবং তার নতুন চাকরির জন্যে চলে যাওয়ার মধ্যকার সময়ে সে একবারের জন্যেও লাডলো যায়নি।
পরিশিষ্ট
সেদিন বিকেলের আগে পুলিশ আসে। তারা নানা রকম প্রশ্ন করলেও তাদের মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক হয় না। জাডের পোড়া বাড়ির ছাই এখনো গরম, সেগুলো নেড়েচেড়ে এখনো ভেতরে দেখা হয়নি। লুইস তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়। তাদের দেখে মনে হলো তারা সন্তুষ্ট। তারা লুইসের সাথে কথা বলে বাড়ির বাহিরে। পুরোটা সময় লুইস মাথায় হ্যাট পড়ে ছিল। তাতে ভালোই হয়েছে, নাহলে ওর পাকা চুল দেখে হয়তো তারা নানান প্রশ্ন করতো। সেটা খুব খারাপ হতো তার জন্যে। সে তার বাগান করার গ্লাভসও পড়ে ছিল এবং তাতেও খুব ভালো হয়েছে। কারণ ওর হাতগুলো ছিল রক্তাক্ত এবং ক্ষত- বিক্ষত।
সেই রাতটা সে সলিটায়ার খেলে পার করে দেয়, প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত।
তাসের একটা নতুন হাত বাটতে বাটতে বাড়ির পেছনের দরজাটা খোলার শব্দ পায়।
তুমি যা করবে সেটা তোমারই বাকির খাতায় লেখা থাকবে এবং আগে হোক পরে হোক তা ঠিকই তোমার কাছে ফিরে আসবে, লুইস ক্রিড় ভাবে।
সে সেদিকে ফিরে না তাকিয়ে তার কার্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার পেছন থেকে ধীরে ধীরে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে আসতে থাকা পায়ের শব্দ আসতে থাকে। তাসের রাণীটা দেখতে পায় সে। তার হাত সেটার ওপর রাখে।
পায়ের শব্দ একদম তার পেছনে এসে থেমে যায়।
নিস্তব্ধতা।
লুইসের কাঁধে কেউ একটা ঠান্ডা হাত রাখে। এরপর রাচেলের খরখরে, মাটি ভরা কন্ঠ শোনা যায়।
“ডারলিং,” জিনিসটা বলে।
.
ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ – ডিসেম্বর ১৯৮২
***