তৃতীয় পৰ্ব
ওজ দ্য গেয়েট
অ্যান্ড টেয়িব্ল
“ব্যাপারটা মাত্র আমার মাথায় এসেছে,” মিসেস হোয়াইট হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে বলেন। “ব্যাপারটা আগে কেন আমার মাথায় আসেনি? তোমার মাথায়ই বা কেন আসেনি?”
“মাথায় কী আসেনি?” মিস্টার হোয়াইট জিজ্ঞেস করেন।
“আমাদের বাকি দুটো ইচ্ছে,” তিনি দ্রুত জবাব দেন। “আমরা মাত্র একটা ইচ্ছে ব্যবহার করেছি।”
সেটাই কি যথেষ্ট না?” তিনি অনেকটা রেগে জানতে চান স্ত্রীর কাছে।
“না!” তিনি চিৎকার করে বলেন। “আমরা আরেকটা ইচ্ছে ব্যবহার করবো। শিগগির নিচে গিয়ে জিনিসটা নিয়ে এসে সেটার কাছে আমাদের ছেলেকে আবারো বাচিয়ে তোলার ইচ্ছেটা করো।”
—ডব্লিউ. ডব্লউ, জেকবস্ (দি মাঙ্কিস্ প)
অধ্যায় ৫৮
জাড ক্র্যান্ডাল ঝাঁকি দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। তিনি আরেকটু হলে ঝাঁকির চোটে চেয়ার থেকেই পড়ে যাচ্ছিলেন। তিনি মনে করতে পারছেন না তিনি কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন; পনের মিনিট হতে পারে আবার তিন ঘন্টাও হতে পারে। তিনি হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন পাঁচটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। তার মনে হচ্ছে ঘরের সবকিছুই যেন অতিসূক্ষ্মভাবে তাদের স্থান পরিবর্তন করেছে। বসে ঘুমানোয় তার পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে।
আরে, ভীমরতি হওয়া বুড়ো, দেখো তুমি কী করেছ!
কিন্তু তিনি জানেন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে দোষ তার একার না। কিছু তাকে পাহারারত অবস্থায় জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।
ব্যাপারটা বেশ ভীতিজনক। কিন্তু কিসে তার ঘুম ভাঙল? এটা আরো বেশি ভীতিজনক। তিনি কিছু একটা শুনতে পেয়েছেন। তিনি নিশ্বাস চেপে রেখে কান পেতে রাখলেন; তিনি নিজের হার্টবিটের দপদপানি শুনতে পারছেন।
আবার শব্দ হলো। যে শব্দে তিনি জেগে উঠেছেন এরকম কিছু না। দরজার কবজার চাপা ক্যাচক্যাচ শব্দ।
জাড তার বাড়ির সব রকম শব্দ চেনেন-মেঝের কোন কাঠটা ক্যাচক্যাচ করে, সিঁড়ির কোন ধাপটা কিচকিচ শব্দ করে, ছাদের থেকে পানি পড়ার টিনের নালা কোথায় কোথায় মাতাল হাওয়ার তোড়ে শব্দ করে, যেমনটা গতরাতে করেছে। এই শব্দটাও তিনি খুব ভালো করেই চেনেন। এটা তার বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢোকার ভারি দরজাটার শব্দ, সেটাকে মাত্রই কেউ খুলেছে। এবার তিনি বুঝতে পারলেন তার ঘুম ভেঙেছে কিসের শব্দে। শব্দটা তার বারান্দা থেকে বাইরে যাওয়ার স্বচ্ছ দরজার স্প্রিংয়ের শব্দ।
“লুইস?” তিনি দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু তিনি জানেন এটা লুইস হবার আশা নেই বললেই চলে। যে এসেছে, এসেছে তাকে শাস্তি দেয়ার জন্যে।
পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে লিভিং রুমের দিকে এগোতে থাকে।
“লুইস?” তিনি আবারো ডাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু ডাকটা তার গলাতেই মরে যায়, কারণ তিনি শেষ রাতের আগন্তুকের সাথে আসা গন্ধটাও টের পাচ্ছেন। গন্ধটা খুব নোংরা। পচে যাওয়া বিষাক্ত কাদার দুর্গন্ধ।
তিনি ঘরের কোথায় কী আছে তা দেখতে পাচ্ছেন-নরমার আলমারি, ড্রেসার, ওয়ারড্রব কিন্তু আবছা আবছাভাবে। তিনি তার পানি জমে যাওয়া পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। তার মন চিৎকার করে বলছে যে তার আরো সময় দরকার। আচমকা এই জিনিসটার মোকাবেলা করার অবস্থা তার বুড়ো দেহে নেই। টিমি ব্যাটারম্যানের সময় তিনি যুবক ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি ভীমরতিগ্রস্ত এক বুড়ো।
তার সামনের দরজাটা খুলে যায় এবং মাঝেতে বেশ কয়েকটা নতুন ছায়ার আবির্ভাব হয়। তাদের মধ্যে একটি ছায়া বেশ বড়।
ওহ খোদা! কি দুৰ্গন্ধ!
অন্ধকারে আবারো পায়ের শব্দ।
“গেজ?” জাড অবশেষে নিজ পায়ে দাঁড়ান। তিনি তার চোখের এক কোণ দিয়ে অ্যাশট্রেতে তার না খাওয়া সিগারেটটির ছাইয়ের রোলটা দেখলেন। “গেজ, তুমি?”
এরপর জিনিসটা চিৎকার করে ওঠে এবং মুহূর্তের মধ্যে জাডের হাড়গুলো সাদা বরফে পরিণত হয়। জিনিসটা লুইসের ছেলে না। গোরস্তান থেকে অন্য কোন প্রেত উঠে এসেছে।
না। এর কোনটিই না।
শব্দটা করেছে লুইসের হুলো বেড়াল চার্চ। বিড়ালটার চোখগুলো ময়লা লাইটের মত জ্বলজ্বল করছে। এরপর সে চোখগুলো অন্য এক দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার সাথে আসা সঙ্গির দিকে।
জাড পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি নিদারুণ দুর্গন্ধের মাঝে নিজের চিন্তা ভাবনা ঠিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘরটা প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে গেছে। জিনিসটা সাথে করে শীতলতা বয়ে নিয়ে এসেছে।
জাডের পা দুটো টলমল করে ওঠে- বিড়ালটা তার পা ঘেষে ঘেষে আদুরে ভঙ্গিতে পুর্র্ পুর্র্ করছে। তিনি ভয়ানক চমকে গিয়েছিলেন। জাড লাথি মেরে বিড়ালটাকে পায়ের কাছ থেকে খেদান। লাথি খেয়ে চার্চ দাঁত মুখ খিচিয়ে হিসিয়ে ওঠে।
ভাবো। বেকুব বুড়ো। হয়তো এখনো দেরি হয়ে যায়নি। হয়তো এখনো সামান্য সময় আছে তোমার বুড়ো হাতে… জিনিসটা ফিরে এসেছে, কিন্তু এটাকে আবারো মেরে ফেলা যাবে…যদি তুমি ভালোভাবে চিন্তা করতে পারো…
তিনি কিচেনের দিকে পিছিয়ে যান এবং তার হঠাৎ মনে পড়ে যায় যে কিচেনের তৈজসপত্র রাখার ড্রয়ারে একটা মাংস কাটার ছুঁড়ি আছে।
তিনি পিছিয়ে যেতে থাকলে তার পায়ে কিচেনের দরজাটা বাড়ি খায়। তিনি সেটা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলেন। তার বাসায় কী এসে ঢুকেছে সেটা এখনো অস্পষ্ট, কিন্তু তিনি সেটার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। তিনি সেটার এক হাতের সামনে পিছে আগু-পিছু করা দেখতে পাচ্ছেন। জিনিসটার হাতে কিছু একটা আছে, কিন্তু কি তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি কিচেনে ঢুকে পড়লে দুই পাল্লার দরজাটা নিজে থেকেই বুজে যায় এবং উল্টো দিকে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করেন তৈজসপত্র রাখার ড্রয়ার লক্ষ্য করে। ঝাঁকি দিয়ে ড্রয়ারটা খুলে ছুঁড়িটা পেয়ে গেলেন। ছুঁড়ির হাতলটা শক্ত করে চেপে ধরে তিনি আবার দরজার দিকে ফিরলেন। কিছুটা সাহস ফিরে পেয়েছেন তিনি।
মনে রেখ, এটা কোন মানুষের বাচ্চা না। ওকে তুমি কব্জা করে ফেললে হয়তো তোমার মন গলাতে কান্না শুরু করবে বা চিৎকার চ্যাঁচামেচি করবে, কিন্তু ভুলেও তা পাত্তা দেয়া যাবে না। তুমি বহুবার ধরা খেয়েছ, বুড়ো। এটা তোমার শেষ সুযোগ।
দরজার কপাট দুটো আবারও খুলে যায়। প্রথমে বিড়ালটা ঢুকলো। জাড়ের চোখ সেটাকে অনুসরণ করে কিছুক্ষণের জন্যে। এরপর তিনি আবার দরজার দিকে তাকান।
কিচেনটা পূর্বমূখী এবং জানালা দিয়ে ভোরের মৃদু দুধ-সাদা আলো ঘরে প্রবেশ করছে। অল্প আলো, কিন্তু যথেষ্ট।
গেজ ক্রিড ঘরে ঢোকে। তার গায়ে তার ফিউনারেলের স্যুট। স্যুটের কাঁধের কাছে এবং গলার দুদিকের ভাজ করা অংশে শ্যাওলা জন্মেছে। তার সাদা শার্টও শ্যাওলায় নোংরা হয়ে আছে। তার মাথার সুন্দর সোনালী চুলগুলো কাদায় লেপ্টে আছে। একটি চোখ একদম উল্টে গেছে, সেটা শূন্য দৃষ্টিতে অনির্দিষ্ট দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকটা চোখ জাডের দিকে তাক করা।
গেজ তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
“হ্যালো জাড,” গেজ তার শিশুসুলভ কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলে। “আমি তোর পচা গলা আত্মাটাকে নরকে পাঠাতে এসেছি। তুই একবার আমার চরম ক্ষতি করেছিলি। তুই কি ভেবেছিস আমি সব ভুলে যাবো আর কখনো প্রতিশোধ নেব না?”
জাড ছুঁড়িটা শাসানোর ভঙ্গিতে উঁচু করে ধরেন। “আয় তাহলে, দেখি কে কার ক্ষতি করে।”
“নরমা মরে গেছে। তোর মৃত্যুর পর কাঁদার জন্যে আর কেউ নেই, “ গেজ বলে। “কী এক সস্তা মাগী যে ছিল তোর বউ। সে তোর সব দোস্তের সাথে বিছানায় গেছে, জাড। সে তাদেরকে তার পাছায় ঢোকাতে দিত। এভাবেই ও সবচাইতে বেশি মজা পেত। মাগী এখন নরকে জ্বলছে। আমি ওকে সেখানে দেখেছি, জাড। আমি ওকে সেখানে নিজের চোখে দেখেছি।”
জিনিসটা আরো দু পা এগোয়। মেঝেতে ছোট ছোট কাদা মাখা জুতোর ছাপ পড়ে। জিনিসটা তার এক হাত সামনে বাড়িয়ে দেয়, হাত মেলানোর ভঙ্গিতে; আরেক হাত পেছনে মোড়া।
“শোন, জাড,” সেটা ফিসফিসিয়ে বলে-জিনিসটার মুখ হা হয়ে খুলে যায় আর মুখের দুধ দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ে। যদিও সেটার ঠোঁটগুলো নড়ে না কিন্তু সেটার গলা দিয়ে নরমার কন্ঠ বেরিয়ে আসে।
“তোমাকে নিয়ে আমি কত ঠাট্টা করেছি! আমরা সবাই তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা করতাম। আমরা হাসতে হাসতে—”
“থাম!,” জাড তার হাতের ছুঁড়িটা দিয়ে শাসান।
“আমি তোমার বন্ধুদের সাথে তোমার-আমার খাটে সেক্স করেছি। হের্কের সাথে করেছি, জর্জের সাথে করেছি, আমি তোমার সব বেশ্যাদের কথা জানতাম, কিন্তু তুমি জানতে না যে তুমি একটা বেশ্যাকেই বিয়ে করে এনেছো। আর আমরা যে তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতাম, জাড! আমরা সেক্স করতাম আর তোমাকে নিয়ে হাসসসসতে হাসসসসতে-”
“চুপ কর!” জাড চিৎকার করে ওঠেন। তিনি জিনিসটার ওপর আঘাত করার জন্যে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে যান এবং তখনই পাশের টেবিলের নিচে ঘাপটি মেরে বসে থাকা চার্চ বেরিয়ে এসে তার পায়ের ওপর হামলে পড়ে। চার্চ দুই কান পেছনের দিকে নিয়ে হিংস্রভাবে হিসিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যান। তার হাত থেকে ছুঁড়িটা ছিটকে পড়ে যায়। ছুঁড়িটা মেঝেতে শব্দ করে গড়াতে গড়াতে রেফ্রিজারেটরের নিচের ফাঁকে ঢুকে যায়।
জাড বুঝতে পারেন তাকে আবারো বোকা বানানো হয়েছে এবং সান্ত্বনা হচ্ছে এবারই হয়তো শেষবার। বিড়ালটা তার পায়ের ওপর চড়ে বসে দাঁত-মুখ খিচিয়ে চায়ের কেটলির মত হিসিয়ে যাচ্ছে। চার্চের চোখ জ্বলজ্বল করছে। এরপর গেজ তার ওপর উঠে আসে। গেজ তার পেছনে লুকিয়ে রাখা হাতটা সামনে নিয়ে আসে এবং জাড দেখতে পান গেজ তার হাতে কি ধরে আছে। জিনিসটা লুইসের কালো ব্যাগে থাকা একটা স্কালপেল। পেন্সিলের সাইজের জিনিসটা দিয়ে ডাক্তারেরা কাটাকুটি করেন। সেটার মাথায় থাকে মারাত্নক ধারালো একটি ব্লেড।
“ওহ খোদা!” জাড আতঙ্কিত কণ্ঠে বলেন এবং ডান হাত বাড়িয়ে আঘাত থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। তার চোখে ভেল্কি লেগে গেল; নিশ্চয়ই তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে কারণ তিনি স্কালপেলটা একই সাথে তার হাতের তালুর দুপাশেই দেখতে পাচ্ছেন। এরপর উষ্ণ কিছু তার মুখের ওপর গড়িয়ে পরতে থাকে, এবং তিনি বুঝতে পারেন।
“আমি তোর বারোটা বাজাব, বুড়ো ভাম!” গেজের ভেতরের জিনিসটা খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলে। হাসির সাথে সাথে জিনিসটার বিষাক্ত নিশ্বাস জাডের মুখে এসে লাগছে। “তোকে ভালোমত শায়েস্তা করবো আমি! একেবারে রামচোদা চুদবো তোকে…যত…খুশি!”
জাড খপ করে গেজের কব্জি ধরতে গেলেন। তার হাতের মুঠোয় গেজের হাতের রাবারের মত চামড়ার খাবলা উঠে আসে।
গেজ স্কালপেলটা জাডের হাত থেকে টেনে বের করে ফেলে। স্কালপেলটা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটা লম্বা ক্ষত রেখে যায়।
“আমার…যত…ইচ্ছে!”
স্কালপেলটা আরেকবার নেমে আসে।
এরপর আরেকবার।
এরপর আরেকবার।
অধ্যায় ৫৯
“এখন স্টার্ট দিন তো ম্যাম,” ট্রাক ড্রাইভার বলে। সে রাচেলের ভাড়া গাড়ির ইঞ্জিন চেক করছে।
রাচেল চাবিটা মোচড় দেয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনটা গর্জন করে ওঠে। ট্রাক ড্রাইভার লোকটা ইঞ্জিনের ডালা বন্ধ করে রুমালে হাত মুছতে মুছতে গাড়ির জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার মুখটা হাসি হাসি, মাথায় একটা টমস ট্রাক কোম্পানির ক্যাপ।
“আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ,” রাচেল বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে। “আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।”
“ওহ, এটা একটা বাচ্চা ছেলেও ঠিক করতে পারবে। তবে এতো নতুন গাড়ির এরকম সমস্যা আগে কখনো দেখিনি।”
“কেন? কি হয়েছিল?”
গাড়ির ব্যাটারির তার খুলে এসেছিল। কেউ ওটা নিয়ে টানাটানি করেনি তো?”
“না,” রাচেল বলে। সে গুলতির রাবার ব্যান্ডের ইলাস্টিসিটির বিরুদ্ধে চলতে থাকার অনুভূতির কথা ভাবে।
“তাহলে হয়তো চলতে চলতেই এমন হয়ে গেছে। কিন্তু আমি জিনিসটা খুব টাইট করে লাগিয়ে দিয়েছি। আর কোন সমস্যা হবার কথা না।”
“আমি আপনাকে কিছু টাকা দিতে পারি?” রাচেল দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলে। লোকটা গলা ফাটিয়ে হাসতে থাকে। “নাহ, ম্যাম,” সে বলে। “আমরা হচ্ছি এই রোডের রক্ষক, জানেন না?”
রাচেল মুচকি হাসে। “আচ্ছা… ধন্যবাদ।”
“ওয়েলকাম,” সে হাসিমুখে বলে। সকালের রোদে তার চেহারা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
জবাবে রাচেলও তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এরপর সে রাস্তার দুপাশ দেখে নিয়ে গাড়িটা পার্কিং লট থেকে রাস্তায় উঠিয়ে দেয়। রাচেল যতটুকু আশা করেছিল, কফিটা তার চাইতে অনেক বেশি কাজে দিয়েছে। তার ঘুম একেবারে পালিয়েছে, এক ফোটা ঝিমুনিও আসছে না আর। কিন্তু ওই অস্বস্তিকর চিন্তাটা তাকে আবারো পাখির পালকের মত আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। ওকে কেউ আটকে রাখতে চাইছিল। ব্যাটারির তার এরকম অদ্ভুতভাবে খুলে আসা…যাতে ওকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আটকে রাখা যায়….
রাচেল নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসে। নির্দিষ্ট সময়টা কিসের জন্যে?
অপরিবর্তনীয় কিছু ঘটার জন্যে।
বাজে চিন্তা। ফালতু। কিন্তু রাচেল তবুও গাড়ির গতিটা একটু বাড়িয়ে দেয়।
পাঁচটা বাজে, জাড ক্র্যান্ডাল যখন তার হাত দিয়ে বন্ধু ডাঃ লুইস ক্রিডের ব্যাগ থেকে চুরি হওয়া একটি স্কালপেল থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলেন, এলি তখন একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, আর রাচেল মহাসড়ক থেকে লোকাল রাস্তায় প্রবেশ করে। সে হ্যামন্ড স্ট্রিট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যায়, যে রাস্তাটা তার ছেলের গোরস্তানের পাশেই, যেখানে তার ছেলের কফিনে একটি কোদাল ছাড়া আর কিছুই নেই। এরপর সে ব্যাঙ্গর-ব্রিউয়ার ব্রিজ পেরোয়। পৌনে পাঁচটার দিকে ও রুট ১৫ তে উঠে আসে এবং লাডলো বরাবর গাড়ি ছোটাতে থাকে।
রাচেল ঠিক করে সে আগে জাডের সাথেই দেখা করবে। তার করা প্রমিজের এটুকু অন্তত সে রাখার চেষ্টা করবে। তাছাড়া তাদের হোন্ডা সিভিক গাড়িটা তাদের ড্রাইভওয়েতে নেই, সম্ভবত লুইস সেটা নিয়ে কোথাও গিয়েছে। তবে গাড়িটা তাদের গ্যারেজে থাকার সম্ভাবনাও আছে, কিন্তু তাদের বাসাটাকে দেখে মনে হচ্ছে বাসাটা শূন্য, সেখানে কেউ নেই। তার একবারের জন্যেও মনে হয় না লুইস বাসায় আছে।
রাচেল তার গাড়িটা জাডের পিকাপের পেছনে পার্ক করে। সতর্কভাবে চারদিক দেখে নিয়ে সে তার গাড়ি থেকে নামে। সকালের নতুন আলোতে ঘাসের শিশির ঝকমক করছে। কোথাও একটা পাখি ডেকে আবারো চুপ হয়ে গেল। সে বড় হবার পর থেকে হাতে গোনা কয়েকবার এতো সকালে জেগে ছিল, তাও কোন না কোন দরকারে। তবে একাকিত্বের অনুভূতি থাকলেও এরকম নতুন সকাল ওর কাছে সবসময়ই ভালো লাগে, নতুন এবং শুভ কিছুর সূচনা বলে মনে হতো। কিন্তু আজকের সকালের কিছুই তার কাছে ভালো বলে মনে হচ্ছে না। তার ভেতরে একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করছে যেটার জন্যে শুধু গত চব্বিশ ঘন্টা এবং তার মৃত ছেলের শোকই দায়ি না।
সে বারান্দার স্বচ্ছ দরজাটা খুলে বারান্দায় প্রবেশ করে পুরনো ধাঁচের বেলটা বাজানোর জন্য। ও আর লুইস যেবার জাডদের বাসায় প্রথম এসেছিল তখন এই বেলটা ওর বিশেষ পছন্দ হয়েছিল। বেলের প্রজাপতির মতো সুইচটা ক্লকওয়াইজ ঘোরালে একটা জোরালো মিউজিকাল সাউন্ড বেজে ওঠে। পুরনো দিনের মিউজিকটা ওর বেশ লাগে।
বেলটা চাপতে গেলে মেঝের দিকে তাকিয়ে ও ভ্রু কুচকে ফেলে। সেখানে কাদামাখা পায়ের ছাপ, কেউ কাদা মাখা পায়ে পোর্চের দরজা থেকে এখানে হেঁটে এসেছে। পায়ের ছাপের আকার বলে দিচ্ছে সেটা কোন বাচ্চার পায়ের ছাপ। কিন্তু সে সারারাত জেগে ড্রাইভ করলেও কোন বৃষ্টির দেখা পায়নি। বাতাস ছিল, কিন্তু কোন বৃষ্টি হয়নি।
সে পায়ের ছাপগুলোর দিকে লম্বা সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এবং সে টের পায় বেল চাপার জন্যে তাকে তার হাতটা ঠেলে সামনের দিকে নিতে হচ্ছে। সে বেলটা ধরে…কিন্তু ওর হাত আবারো নিচে নেমে আসে।
আমার অবচেতন মন হয়তো এই নিস্তব্ধতা ভেঙে বেল বাজাতে চাচ্ছে না। হয়তো জাড গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আর এই জোরালো বেল শুনে তিনি লাফিয়ে…
কিন্তু তার ভয়টা এই জায়গায় না। ওর যখন থেকে মনে হচ্ছিল যে ও চাইলেও জেগে থাকতে পারছিল না, তখন থেকেও ওর বেশ নার্ভাস লাগছিল, এক রকম ভয়ও লাগছিল। কিন্তু এই ভয়টা একদম নতুন। এই ভয়ের উৎস এই ছোট ছোট পায়ের ছাপগুলো। তার মন চিন্তাটাকে থামাতে চেয়েছিল, কিন্তু তার মন অত্যন্ত ক্লান্ত।
—গেজের পায়ের ছাপ।
থামো তো। থামো।
ও বেলের সুইচটা ঘুরিয়ে দেয়।
সে যা ভেবেছিল তার চাইতেও বিকট আওয়াজ করে ওঠে বেলটা, এবং চারদিকের নীরবতায় সেটাকে মিউজিকাল বলেও মনে হয় না। রাচেল চমকে লাফিয়ে পিছিয়ে যায়। সে মৃদু হাসে কিন্তু সেই হাসিতে কোন কৌতুক নেই। সে জাডের পায়ের শব্দের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু তেমন কিছুই শুনতে পায় না। নিস্তব্ধতার পর আরো নিস্তব্ধতা। সে বুঝতে পারছে না সে আবারো ওই প্রজাপতির মত বেলের সুইচটা ঘোরাতে পারবে কি না। তবে যখন দরজার ওপাশ থেকে শব্দটা আসে, সেটার জন্যে রাচেল একদমই প্রস্তুত ছিল না।
ওয়ায়াও!…ওয়ায়াও!… আওওও!
“চার্চ?” সচকিত হয়ে রাচেল ডাকে। সে দরজার কাঁচ দিয়ে ওপাশটা দেখার জন্যে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ায় কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। দরজার গ্লাসের অংশটা পর্দা দিয়ে ঢাকা; খুব সম্ভবত নরমার কাজ। “চার্চ, তুমি?”
ওয়ায়াও!
রাচেল দরজা ধাক্কা দেয়। দরজার লক খোলা। চার্চ হলওয়েতে লেজ দুপায়ের চারদিকে প্রায় গোল করে গুটিয়ে বসে আছে। বিড়ালটার গায়ের পশমে গাঢ় কিছু লেগে আছে। রাচেল প্রথমে ভাবে সেটা কাদা, কিন্তু পরক্ষণেই দেখতে পায় চার্চের গোফে ফোটা ফোটা তরল লেগে আছে, যেগুলোর রং লাল।
চার্চ রাচেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই নিজের থাবাটা উঠিয়ে চাটতে শুরু করে। চার্চের চোখ রাচেলের দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরে না।
“জাড!” রাচেল উচ্চস্বরে ডাকে। তাকে এখন আতঙ্কিত শোনাচ্ছে। সে বাড়ির ভেতর পা রাখে।
বাড়িটা তাকে কোন জবাব দেয় না; শুধুই নিস্তব্ধতা।
রাচেল ভাবতে চেষ্টা করে কিন্তু কোত্থেকে যেন জেল্ডার চিন্তা তার মাথার ভেতর ঢুকে তাকে ভাবতে বাধা দিতে থাকে। কিভাবে জেন্ডার হাতগুলো মুচড়ে বাকা হয়ে গিয়েছিল, কিভাবে জেল্ডা রেগে গেলে দেয়ালে মাথা ঠুকতো আর তাতে কিভাবে সেই কাঠের দেয়ালের কাগজের প্রলেপ উঠে এসেছিল। এখন জেল্ডাকে নিয়ে ভাবার সময় না, যেখানে জাড হয়তো বিপদে পড়েছে। তিনি কি বেহুশ হয়ে পড়ে গেছেন? তার মত বুড়ো লোকের ক্ষেত্রে সেটা অস্বাভাবিক কিছু না।
ব্যাপারটা ভেবে দেখো। সেই স্বপ্নগুলোর কথা ভাবো তুমি ক্লজেটের দরজা খুললে ভেতর থেকে জেল্ডা তোমার ওপরে লাফিয়ে পড়তো, তার কালচে হয়ে যাওয়া চেহারাটা থাকতো হাসি হাসি; বাথটাবে গোসল করতে থাকার স্বপ্ন, যেটাতে তুমি দেখতে পেতে বাথটাবের পানি যাওয়ার ডেনের ফুটো দিয়ে জেল্ডা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে; বেসমেন্টের স্বপ্ন যেখানে তুমি তাকে বেসমেন্টের ফার্নেসের পেছনে কিলবিল করতে দেখতে, ওই স্বপ্নটা যেখানে-
চার্চ আবারো তার ধারালো দাঁত বের করে চিৎকার করে ওঠে, ওয়ায়াও!
লুইসের কথাই ঠিক ছিল। চার্চকে খোজা করানো ঠিক হয়নি। কিন্তু লুইস বলেছিল খোজা করলে ওর ভেতরের জংলীভাব চলে যাবে। লুইসের কথা ভুল ছিল; চার্চ এখনো শিকার করে। সে-
ওয়ায়াও! চার্চ আবারো চেঁচিয়ে ওঠে এবং ছুটে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে।
“জাড?” রাচেল আবারো ডাকে। “আপনি ওপরে আছেন?”
ওয়ায়াও! যেন রাচেলের প্রশ্নের হ্যাঁ সূচক জবাব দিতেই চার্চ আবারো চিৎকার করে ওঠে। এরপর সে হলে অদৃশ্য হয়ে যায়।
ও এখানে ঢুকলো কী৭ করে? জাড কি ওকে দরজা খুলে ঢুকতে দিয়েছে? দিলে কেন দিলেন?
রাচেল অস্বস্তিতে পা বদল করে দাঁড়ায়। সবচাইতে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা হচ্ছে…মনে হচ্ছে কেউ এই সবকিছু পরিকল্পনা করে করছে, যেন কেউ চাইছিল সে এখানে আসুক, আর-
এরপর ওপর থেকে একটা ব্যথায় কাতর, চাপা আর্তনাদ ভেসে আসে-জাডের গলা, কোন সন্দেহ নেই। উনি হয়তো বাথরুমে পড়ে গেছেন অথবা হোঁচট খেয়ে পা ভেঙে ফেলেছেন, বা মাজার হাড় মচকে ফেলেছেন; বুড়োদের হাড় খুব নরম। আর তুমি কি হাবিজাবি ভাবছো এখানে দাঁড়িয়ে? চার্চের গায়ের লোম রক্তে মাখা ছিল, রক্ত। জাড আঘাত পেয়েছেন আর তুমি এখানে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছো? সমস্যাটা কি তোমার?
“জাড!” তার গলায় আবারো আওয়াজ ফিরে আসে এবং সে দৌড়ে সিঁড়ির ওপর উঠতে থাকে।
সে আগে কখনো জাডের বাসার ওপরতলায় আসেনি। হলের জানলাটা নদীর দিকে মুখ করা, পশ্চিমমুখী; তাই জায়গাটা এখনো খুব অন্ধকার। সিঁড়ির রেলিঙের পাশ দিয়ে হলটা বাড়ির পেছনের দিকে চলে গেছে। দেয়ালে একটা প্রাচীন গ্রীসের দালানের ছবি টাঙ্গানো।
(জেল্ডা অনেক বছর ধরে তোমার অপেক্ষায় আছে আর এবার শুর অপেক্ষা শেষ হতে চলছে। ঠিক দরজাটা খোল, তোমাকে ধরার জন্যে জেল্ডা সেখানেই থাকবে, ওর বাঁকানো পিঠ নিয়ে, পেশাব আর মৃত্যুর গন্ধ নিয়ে। আজ জেন্ডার পালা এসেছে)
কাতর, চাপা আর্তনাদটা আবারো ভেসে আসে, ডানের দ্বিতীয় দরজার ওপাশ থেকে।
রাচেল দরজাটার দিকে হাঁটতে থাকে। তার জুতোর হিল মেঝের বোর্ডে খট-খট শব্দ করছে। তার মনে হচ্ছে সে কোন ওয়ার্পের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে-টাইম ওয়ার্প বা স্পেস ওয়ার্ল্ড না, বরং সাইজ ওয়ার্স। এগোনোর সাথে সাথে সে ছোট হতে শুরু করেছে। প্রাচীন গ্রীসের দালানের ছবিটা মনে হচ্ছে ক্রমশ উঁচু হয়ে যাচ্ছে। দরজার কাচের গোলাকার হাতলটা মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর চোখের উচ্চতায় চলে আসবে। সে হাতলটা ধরার জন্যে হাত বাড়ায়…এবং সেটা স্পর্শ করার আগেই সেটা ঝটকা মেরে খুলে যায়।
সেখানে জেল্ডা দাড়িয়ে আছে।
সে কুঁজো হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে এবং ওর পিঠ মুচড়ে বাঁকা হয়ে গেছে। ওর শরীর এতোটাই বিকৃত হয়েছে যে ওকে দু ফিটের মত লম্বা একটা বামনের মত দেখাচ্ছে। এবং কোন এক অদ্ভুত কারণে জেন্ডা গেজের কবরের পোশাক পরে আছে। কিন্তু এটা জেল্ডাই, ওর চোখগুলো এক উন্মাদ আনন্দে জ্বলজ্বল করছে, মুখটা একদম বেগুনী। জেল্ডা চিৎকার করে বলে, “আজ তোকে আমি বাগে পেয়েছি, রাচেল। আমি তোর পিঠ আমার পিঠের মত মুচড়ে দেব আর তোকে সারাজীবন বিছানায় পচে গলে মরতে হবে। বিছানা থেকে তুই আর জীবনেও উঠতে পারবি না, জীবনেও না-”
চার্চ জেন্ডার এক কাঁধের ওপর বসে আছে। জেল্ডার চেহারা হঠাৎ মোচড়াতে মোচড়াতে পরিবর্তন হয়ে যায়। রাচেল বিষম আতঙ্ক নিয়ে দেখলো যে এটা আসলে জেল্ডা না-ও কিভাবে এই ভুলটা করতে পারলো? এটা তো গেজ। ওর মুখটা কালো হয়ে যায়নি, বরং মুখটা রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। আর ওর মুখটা ফুলে গেছে, যেন ও প্রচন্ডভাবে আঘাত পেয়েছিল এবং এরপর কেউ আনাড়ি হাতে ওকে ঠিক করে দিয়েছে।
রাচেল চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকে, দুহাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে। গেজ ছুটে গিয়ে তার মায়ের দুহাতে নিজেকে সপে দেয়। পুরো সময়টা সে তার এক হাত পিছমোড়া করে রাখে, যেন সেই হাতে সে কোন বনো ফুলের তোড়া ধরে আছে।
“আমি তোমার জন্যে একটা গিফট এনেছি, মা!” গেজ চিৎকার করে বলে। “আমি তোমার জন্যে একটা গিফট এনেছি, মা! আমি তোমার জন্যে একটা গিফট এনেছি, আমি তোমার জন্যে একটা গিফট এনেছি!”