পেট সেমেটারি – ৫৫

অধ্যায় ৫৫

লুইসের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। সে মাঝে মাঝেই নিচে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে তার হাতে ত্রিপলের বান্ডেল নাকি সবুজ পলিথিনের ব্যাগ। তার মনে পড়ে যে, জাডের যেদিন চার্চকে কবর দেয়ার জন্যে তাকে এই পথে নিয়ে গিয়েছিলেন তার পরদিন ঘুম থেকে উঠে তার আগের রাতের ঘটনা তার কাছে কেমন ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল-কিন্তু তার এটাও মনে পড়ে যে সে রাতের অনুভূতিগুলো কতটা জীবন্ত ছিল, তার ইন্দ্রিয়গুলো কেমন তীক্ষ্ণ হয়ে গিয়েছিল, কিভাবে তার মনে হচ্ছিল যে তার ইন্দ্রিয়গুলো তার দেহ থেকে বেরিয়ে তাকে ঘিরে রেখেছিল আর আশেপাশের গাছ-পালাগুলোকে ছুঁয়ে দিয়ে যেন তাদের সাথে টেলিপেথিকভাবে যোগাযোগও করছিল।

সে পথ ধরে কখনো নিচে নামছে কখনো উপরে উঠছে। কোথাও পথটা রুট ১৫’র মত প্রশস্থ আবার কোথাও এতো সরু যে তাকে বান্ডেলটা লম্বালম্বি ভাবে নিতে হচ্ছে যাতে সেটা দুপাশের ঝোঁপঝাঁড়ের সাথে না বেজে যায়। সে পাইনের কষের গন্ধ পাচ্ছে এবং তার পায়ের নিচে পাইনের সুচারু পাতার মচমচ টের পাচ্ছে-যে অনুভূতিটা কানে শোনার চাইতে পায়ে বেশি অনুভব হচ্ছে।

অবশেষে বেশ কিছুক্ষণ যাবত পথটা আরো বেশি ঢালু হয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পর তার এক পা অল্প পানির নিচের থকথকে কাদায় ফ্যাচ করে ডেবে যায়…চোরাবালি, যদি জাড ঠিক বলে থাকেন। লুইস নিচে তাকিয়ে চারদিকের অবস্থাটা দেখে নেয়। মাঝে মাঝে কিছু বিশ্রী রকম ঝোঁপঝাড়। ঝোঁপঝাড়ের পাতাগুলো এতো বড় বড় যে সেগুলো দেখে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ মনে হচ্ছে। তার মনে পড়ে সেদিন রাতেও কেমন একটা উজ্জ্বল আভা ছিল চারদিকে। কেমন যেন বৈদ্যুতিক।

সামনের জায়গাটাও ওই স্তুপটার মত-স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে হবে। আমাকে ফলো করো আর নিচে তাকাবে না।

আচ্ছা ঠিক আছে…আর হ্যা, এরকম গাছ এই এলাকায় আর কখনো দেখেছো? এই এলাকায় বা অন্য কোথাও? কি আজগুবি গাছ এগুলো?

বাদ দাও, লুইস…সামনে চলো।

সে শুধু প্রথম পা একটা ঘাসের স্তূপে ফেলার সময় নিচে তাকিয়ে দৃষ্টি ওপরে তুলে সামনের দিকে তাকায় এবং সাবলীল ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়। তার পা অভ্যস্থভাবেই একটার পর একটা ঘাসের আঁটির ওপর পড়ছে। বিশ্বাস হচ্ছে অভিকর্ষ বলকে সত্য বলে মেনে নেয়া, সে ভাবে; এই কথাটা সে কোন দর্শন বা ধর্ম লেকচারে শোনেনি, বরং তার হাই স্কুলের পদার্থ শিক্ষকের কাছ থেকে শুনেছিল একদিন ক্লাসের একদম শেষ মুহূর্তে…যেটা লুইস কখনো ভোলেনি 1

সে মেনে নিয়েছে মিকমেকদের গোরস্থানের মৃতকে পুণরুখান করার ক্ষমতা আছে এবং সেজন্যেই সে ঈশ্বরের জলা দিয়ে ছেলের লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, নিচের দিকে বা পেছনে না তাকিয়ে। শরৎকালের শেষ সময় হওয়াতে এবার জায়গাটিতে শোরগোল তুলনামূলক বেশি। ঝোঁপের ভেতর থেকে অনবরত ঝিঁঝিঁর দল সমবেত সঙ্গিত গেয়ে যাচ্ছে, যেটা শুনে লুইসের মনে হচ্ছে তারা এখানে লুইসকে চায় না। একটা ব্যাঙ মাঝে মাঝে তার গলা সেধে যাচ্ছে। জলাতে বিশ কদম এগোনোর পর তার খুব কাছে দিয়ে কিছু একটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে যায়…হয়তো কোন বাদুড় হবে।

মাটির ওপরে ভাসতে থাকা কুয়াশা তার চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। ঘন কুয়াশায় প্রথমে তার জুতো অদৃশ্য হয়ে যায়, এরপর তার হাঁটু এবং অবশেষে কুয়াশা তাকে চারদিক থেকে ক্যাপসুলের মত ঘিরে ফেলে। তার মনে হচ্ছে আজকের আলোর আভাটা বেশি উজ্জ্বল, যেটা কোন অদ্ভুত হৃৎপিন্ডের পালসের মত দপদপ করছে। সে প্রকৃতির শক্তিগুলোকে কখনোই এরকম সমবেত রূপে দেখেনি, যেন এটা কোন সত্তা… সচেতন কোন সত্তা। জলাটা জীবিত। কিন্তু তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় সেটা কি রকম তাহলে সে তা বর্ণনা করতে পারবে না। কিন্তু সে জানে জায়গাটা সম্ভাবনা এবং শক্তিতে ভরপুর। এর মাঝে লুইসের নিজেকে খুব অসহায় এবং ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।

এরপর সে একটা শব্দ শুনতে পায়, যেটা সে আগেও শুনেছেঃ একটা অট্টহাসি, যেটা শেষে কান্নায় পরিণত হয়। কিছুক্ষণ নীরবতার পর হাসিটা আবারো শোনা গেল, এবার সেটা বাড়তে বাড়তে উন্মত্ত চিৎকারের মত শোনা যায় এবং আতঙ্কে লুইসের রক্ত জমাট বেঁধে যায়। কুয়াশা তার চারদিকে স্বপ্নের মত ঘুরছে। হাসিটা ফিকে হয়ে আসে, বাতাসে সেটার মৃদু গুঞ্জন শোনা গেলেও ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না। না, এটা অবশ্যই প্রকৃতির কোন খেলা। বাতাস বইলে তার চারপাশের কুয়াশার চাদর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিত…তবে লুইস নিশ্চিত না কুয়াশার ওপাশে যা আছে সে তা দেখতে চায় কি না।

তুমি হয়তো কিছু শব্দ শুনতে পাবে, মানুষের গলার মত। কিন্তু ওসব কিছু না। ওগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।

“লুন হাঁস,” লুইস বলে এবং তার ভাঙা গলা দিয়ে বের হওয়া কর্কশ কন্ঠটা সে নিজেই ঠিক মত চিনতে পারে না। কিন্তু নিজেকে শুনে তার মনে হয়েছে সে কৌতুকের গলায় শব্দটা বলেছে। ওহ খোদা… তার গলাটা আসলেই কৌতুকপূর্ণ মনে হয়েছে।

সে একটু ইতস্তত করে আবারো সামনে এগোয়। তার এই সামান্য থেমে যাওয়ার শাস্তি হিসেবেই যেন তার এক পা ঘাসের গুচ্ছের ওপর না পড়ে কাদায় গিয়ে পড়ে এবং দেবে যায়। থকথকে কাদা থেকে পা টেনে বের করতে গিয়ে সে আরেকটু হলেই জুতোটা হারাতে বসেছিল।

কণ্ঠটা যদি সেটা তাই হয়ে থাকে আবারো ফিরে এলো, এবার তার বাম পাশ থেকে। মুহূর্ত পরে তার পেছন থেকে…একদম পেছন থেকে, তার মনে হচ্ছিল সে ঘাড় ঘুরালেই তার এক ফুট দূরে জ্বলজ্বলে চোখ আর চকচকে দাঁত সম্বলিত কোন রক্তে মাখা জিনিস দেখতে পাবে…কিন্তু লুইস এবার একটুও গতি কমায় না। সে একদম সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো।

হঠাৎ করেই তার চারদিকের কুয়াশার আভাটা কমে যায় এবং সে বুঝতে পারে যে সামনে বাতাসে একটি মুখমন্ডল ভাসছে, যেটির চোখে কটাক্ষের দৃষ্টি এবং মুখ দিয়ে আবোল তাবোল কিছু বলছে। মুখমন্ডলটির চোখগুলো চাইনিজ পেইন্টিংয়ের মানুষের চোখগুলো যেমন ওপরের দিকে তীর্যকভাবে টেনে দেয়া হয় সেরকম। কালচে-হলুদ চোখগুলো যেন জ্বলজ্বল করছে। মুখে একটা বাঁকা হাসি আর নিচের ঠোঁটটা বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছে এবং এতে করে মুখের কালচে-বাদামি দাঁতগুলো বেরিয়ে পরেছে যেগুলো ক্ষয় হতে হতে একদম বেদানার দানার মত হয়ে এসেছে। কিন্তু লুইসের সবচাইতে অবাক লাগে জিনিসটার কান দুটো, যেগুলো আসলে কান না বরং পেঁচানো শিং…শিংগুলো শয়তানের শিংয়ের মত নয়। শয়তানের শিং হয় ছাগলের শিং এর মত। এই শিংগুলো ভেড়ার শিংয়ের মত ভেতরের দিকে পেঁচানো।

ভেসে থাকা ভয়ঙ্কর মাথাটা যেন কথা বলছে-হাসছে। এর ঠোঁটগুলো নড়ছে কিন্তু বাইরে ঝুলে থাকা নিচের ঠোঁটটি কখনোই স্বাভাবিক অবস্থায় গেল না। জিনিসটির নাক দিয়ে শ্বাস- প্রশ্বাসের সাথে সাথে বাষ্প বেরুচ্ছে।

লুইস সামনে এগুতে থাকে এবং এক পর্যায়ে জিনিসটা জিভ বের করে দেয়। জিভটা লম্বা এবং সুচারু, নোংরা হলুদ রংয়ের। জিভের গায়ে মাছের মত আঁশ এবং হঠাৎ একটি আঁশ ম্যানহোলের ঢাকনার মত উঠে আসে এবং সেখান থেকে একটি কৃমি কিলবিল করে বেরিয়ে আসে। জিনিসটার কন্ঠমনি যেখানে থাকার কথা, জিভটা ওই পর্যন্ত ঝুলে লিক লিক করছে… জিনিসটা হাসছে।

লুইস গেজকে তার বুকের সাথে চেপে ধরে, ওকে রক্ষা করার ভঙ্গিতে। ওর পা কেঁপে যায় এবং তার পা পাতলা ঘাসে পিছলে যেতে শুরু করে।

তোমার সেইন্ট এলমোর আগুন চোখে পড়তে পারে, যেটাকে নাবিকরা ফু-লাইট বলতো। এটা অদ্ভুত অদ্ভুত আকার আকৃতি তৈরি করে, কিন্তু এটা আসলে ইলেক্ট্রিকাল চার্জের খেলা ছাড়া কিছুই না। যদি এরকম কোন অদ্ভুত কিছু তোমার চোখে পড়লে ভয় লাগে, তাহলে অন্যদিকে তাকাবে।

জাডের কন্ঠ তাকে এই বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দেয়। সে আবারো সোজা সামনের দিকে হটতে শুরু করে, প্রথমে একটু ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এবং একটু পরই সে নিজের ভারসাম্য খুঁজে পায়। সে অন্যদিকে তাকায়নি কিন্তু এটা বুঝতে পারে যে মুখটা যদি জিনিসটা আসলেই কুয়াশা এবং তার মনের কারসাজি না হয়ে থাকে সবসময় তার থেকে সমান দূরত্ব রেখে চলছে। এবং কয়েক সেকেন্ড বা মিনিট পরে মুখটা স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

এই জিনিস সেইন্ট এলমোর আগুন না।

না, অবশ্যই না। জায়গাটা নানান রকম প্রেতাত্মা দিয়ে ভরপুর; এক কথায় গিজগিজ করছে। এখানে কেউ তার মাথা ঘুরালেই হয়তো এমন জিনিস দেখতে পাবে যাতে তার মাথার তার ছিঁড়ে কয়েক হাজার টুকরো হয়ে যাবে। সে এসব নিয়ে ভাববে না। এসব নিয়ে ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। কোন প্রয়োজন নেই-

কিছু একটা আসছে।

লুইস একদম ঠায় দাঁড়িয়ে যায় আর কান পেতে শব্দটা শুনতে থাকে…অপ্রতিরোধ্য কিছুর এগিয়ে আসার শব্দ। তার মুখ একদম মরা মাছের মুখের মত হা হয়ে যায়, যেন তার মুখ বন্ধ রাখার পেশিগুলো স্রেফ অকেজো হয়ে গেছে।

এরকম শব্দ সে আগে কখনোই শোনেনি—জীবন্ত এবং দানবাকৃতির কিছু। শব্দটা আরো কাছিয়ে আসছে, সাথে সাথে ডালপালা ভাঙার নিকট থেকে নিকটতর শব্দও দ্রুত এগিয়ে আসছে। সেই বিশাল আকৃতির পায়ের তলায় একটা ঝোঁপের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার শব্দ হলো। লুইসের পায়ের নিচের জেলির মত মাটি একই সুরে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে বুঝতে পারে যে সে গোঙাচ্ছে (ওহ খোদা! ও আমার খোদা! কুয়াশার মধ্যে দিয়ে এটা কি আসছে) এবং আবারো গেজকে নিজের বুকে চেপে ধরেছে; সে টের পায় যে আশেপাশের ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো একদম চুপ করে গেছে; সে আরো টের পায় চারদিকের বাতাসে একটা জঘন্য, অপবিত্র, কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে যার গন্ধ পচা শুয়োরের মাংসের মত।

জিনিসটা যাই হোক, জিনিসটা দানবীয় কিছু।

লুইসের আতঙ্কিত চেহারা একটু একটু ওপরের দিকে উঠতে থাকে, যেন সে কোন সদ্য উড্ডয়ন হওয়া রকেটকে অনুসরণ করছে। জিনিসটা চারদিক কাঁপিয়ে তার দিকেই ধেয়ে আসছে, এবং কাছেই একটা গাছ উপড়ে পড়ার বিকট মটমট শব্দ হয়-একটা আস্ত গাছ, শুধু একটা ডাল নয়।

লুইস কিছু একটা দেখতে পায়।

চারদিকের কুয়াশা সামান্য এক পলকের জন্যে কিছুটা ধূসর হয়ে আসে এবং সে দেখতে পায় জিনিসটির কোন নির্দিষ্ট আকার বা আকৃতি নেই, কিন্তু জিনিসটি কমসে কম ষাট ফিট উঁচু হবে। জিনিসটা কোন স্রেফ চোখের ভেল্কি বা অশরীরী কিছু না; দানবীয় জিনিসটা চলাচল করার সাথে যে বাতাসের ঝাপটার সৃষ্টি হয়েছে সেটা সে খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে।

এক মুহূর্তের জন্যে তার মনে হয় সে তার ওপরে দুটো কমলা-হলুদ রংয়ের আলোর গোলা দেখতে পেয়েছে, যেগুলো দেখতে চোখের মত।

এরপর শব্দটা ফিকে হয়ে যেতে আরম্ভ করে। শব্দটা চলে যেতে থাকলে একটা ঝিঁঝিঁ বিব্রত ভঙ্গিতে ডেকে ওঠে। এরপর তাকে জবাব দেয় দ্বিতীয় একটি ঝিঁঝিঁ। তাদের আলাপে যোগ দেয় তৃতীয় আরেকটি ঝিঁঝিঁ; এরপর চার নাম্বার ঝিঁঝিঁ তাদের সাথে আড্ডা জুড়ে দেয়; এরপর পঞ্চম এবং ষষ্ঠ ঝিঁঝিঁ মিলে ঝিঁঝিঁদের সমবেত সঙ্গিত আরম্ভ করে। জিনিসটার চলাচলের শব্দ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে…আরো কমে…এবং এক সময় আর শোনা যায় না।

অবশেষে লুইস আবারো চলতে শুরু করে। তার পিঠ এবং কাঁধ ব্যথায় টনটন করছে। সে এতো ঘেমেছে যে তার মনে হচ্ছে সে গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঘামের আন্ডারওয়্যার পড়ে আছে। এই মৌসুমে জন্ম নেয়া ক্ষুধার্ত মশাগুলো তাকে নাস্তা বানিয়ে খাচ্ছে।

ওহ খোদা! এটাই সেই উইন্ডিগো—যেটা দেশের উত্তরাঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ায়, যেটা স্পর্শ করলে মানুষ মানুষখেকো হয়ে যায়। এটাই সেই জিনিস। জিনিসটা আমার ষাট গজের মধ্যে চলে এসেছিল।

সে নিজেকে বোকার মত চিন্তা করতে নিষেধ করে। তাকে হতে হবে জাডের মত আর পেট সেমেটারির পরের জঙ্গলে যা দেখবে সেগুলো নিয়ে বেশি ভাববে না—এগুলো হচ্ছে লুন হাঁস, সেইন্ট এলমোর আগুন আর নিউ ইয়র্ক বুলপেনের সদস্য। এগুলো আর যাই হোক জঙ্গলে ছোঁকছোঁক করতে থাকা কোন প্রেত না। পৃথিবীতে আছে ঈশ্বর, ঈশ্বরের প্রার্থনার জন্যে রবিবার দিন, আছে তার প্রার্থনাকারী শুভ্র পোশাকধারী যাজকেরা…আর রাতের আঁধারে বিচরণ করতে থাকা প্রেত বা পিশাচ বলে কিছু নেই।

লুইস তার ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে থাকে এবং এক সময় তার পায়ের নিচের মাটি শক্ত হতে আরম্ভ করে। আরেকটু সামনে এগিয়ে সে একটা উপড়ে পড়া গাছ দেখতে পায়, যেটি দেখে মনে হচ্ছে গাছটা আসলে কোন দৈত্যের ফেলে দেয়া সবুজ পালকের ঝাড়ু।

গাছের গোড়াটা ভেঙে একদম চৌচির হয়ে গেছে। আর ভাঙা অংশটি এতো টাটকা যে সেটির ভাঙা জায়গাগুলো দিয়ে এখনো কষ বেরুচ্ছে। গাছটা তার পথের ওপর পড়েছে। লুইস পড়ে থাকা গাছটার ওপরে উঠলে তার হাতে সেই কষ লাগে, যেটা এখনো উষ্ণ। আর গাছের ওপাশে ছিল একটা গর্তের মত যেটা থেকে বের হওয়ার জন্যে তার দু-হাতের সাহায্য লাগে। যদিও গর্তের তলায় ঝোঁপঝাড়গুলো একদম চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। সে এটাকে কোন পায়ের ছাপ বলে মেনে নিতে নিজেকে সুযোগ দিবে না। সে হয়তো চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পারতো এরকম গর্ত আরো আছে কি না, কিন্তু সে নিজেকে সেই অনুমতি দেয় না। সে শুধু হেঁটে গেল, তার গায়ের চামড়া ঠান্ডা হয়ে এসেছে, মুখটা এখনো গরম আর হৃদয়টা উড়ে বেড়াচ্ছে।

তার পায়ের নিচের মাটির ফ্যাচফ্যাচ কমে এসেছে। কিছুক্ষণের জন্যে সে নিজের পায়ের নিচে পাইনের সুচারু পাতার মচমচ শুনতে পায় এবং তার পরেই মাটি পাথুরে হতে আরম্ভ করে। সে তার গন্তব্যের খুব কাছে চলে এসেছে।

ভূমি দ্রুত ওপরের দিকে খাড়া হয়ে উঠে যাচ্ছে। একটা মাথা বের করে থাকা পাথরে তার হাঁটুর নিচের হাড় যন্ত্রণাদায়কভাবে ধাক্কা খায়। কিন্তু সেটা সাধারন কোন পাথর না। লুইস তার এক হাত নিচে নামিয়ে সেটা স্পর্শ করে এবং এতে তার অসাড় হয়ে যাওয়া কনুই যন্ত্রনায় চিৎকার করে ওঠে।

এখান থেকে পাথরে কাটা সিঁড়ি। শ্রেফ আমাকে অনুসরণ করো। এটার ওপরে উঠলেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব।

সে ধাপগুলো দিয়ে উঠতে আরম্ভ করে এবং তার মাঝে আবারও ক্লান্তিকে পরাজিত করে উত্তেজনা ফিরে আসে…কিছুটা হলেও। সে ওপরে ওঠার সাথে সাথে বিরামহীন বাতাসের রাজ্যে প্রবেশ করতে থাকে। সে মনে মনে ধাপের সংখ্যার হিসেব রাখছে। শক্তিশালী বাতাস তার গা থেকে তার জামা খুলে নিতে চাচ্ছে, গেজের লাশ মোড়ানো ত্রিপলটা বাতাসের তোড়ে ফটফট করে শব্দ করেই চলছে, অনেকটা নৌকার পালের মত।

মাথা পেছনে নিয়ে আকাশে তারকারাজির বিস্তৃত বিন্যাসের দিকে তাকায়। সে তারাদের মাঝে চেনা কোন বিন্যাস দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে নিচের দিকে তাকায়। এর পাশেই পাথরের দেয়ালটা। দেয়ালটা একদমই মসৃণ নয় বরং খুবই এবড়ো থেবড়ো, ঝুরঝুরে এবং সেটার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছোট ছোট পাথর বেরিয়ে আসছে। কোথাও সেটাকে নৌকার মত লাগে, কোথাও লাগে চোখ মুখ সহ মানুষের মাথার মত। শুধু ধাপগুলো পাথর কেটে বানানো হওয়ায় সেগুলো বেশ মসৃণ।

লুইস একদম ওপরে পৌঁছে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। সে দুলে দুলে কাঁদছে এবং ফোঁপাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে তার বুকে কেউ শেল বিধিয়ে দিয়েছে।

বাতাস তার চুল নাচাচ্ছে আর কানের সামনে ড্রাগনের মত গর্জন করছে। আজ জায়গাটিকে বেশি আলোকিত মনে হচ্ছে। আগের দিন কি আকাশ মেঘলা ছিল? নাকি সে ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি? যাই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে এবং তাতেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিহরণ মাথা থেকে নিচে নেমে যায়।

একদম পেট সেমেটারির মত।

তুমি এটা ঠিকই জানতে, সে চারদিকের পাথরের ছোট ছোট স্তুপগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকলে তার মন তাকে ফিসফিস করে বলে। স্তুপগুলো এক সময় পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ ছিল। তুমি জানতে, অথবা তোমার জানা উচিত ছিল যে-এগুলো একই বিন্দুতে মিলিত বৃত্ত নয়, এগুলো স্পাইরাল…

হ্যাঁ। এই পাথুরে ছাদের ওপরে একটা বিশাল স্পাইরাল, যেটার সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মানুষের হাতে। কিন্তু এখন কোন পাথরের স্তম্ভ অবশিষ্ট নেই। লুইস দেখে কবর দেয়া লাশগুলো প্রাণ ফিরে পেয়ে মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসার ফলে প্রতিটি স্তম্ভই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কিন্তু তার পরেও পাথরের স্তূপগুলো এমনভাবে পড়ে আছে সেগুলোর সমন্বয়ে তৈরি স্পাইরাল শেপটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

কেউ কি এটা আকাশ থেকে দেখেনি? লুইস অবাক হয়ে ভাবে। তার মনে পড়ে যায় সেসব ড্রয়িংয়ের কথা, যেগুলো কোন এক ইন্ডিয়ান গোত্র দক্ষিণ আমেরিকার মরুভূমির বুকে তৈরি করেছিল। কেউ কি আকাশ থেকে এসব দেখেনি? আমার প্রশ্ন হচ্ছে দেখে থাকলে ওরা এটাকে ভেবেছেটা কি?

সে হাঁটু গেড়ে বসে গেজের লাশটা মাটিতে রেখে ঘোঁৎ করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে।

অবশেষে তার ভেতর সম্বিত ফিরে আসতে শুরু করেছে। সে তার পকেট নাইফ দিয়ে পিঠে ঝুলিয়ে রাখা কুঠার আর বেলচার টেপটা কেটে দেয়। সেগুলো ধাতব শব্দ করে মাটিতে পড়ে। লুইস দুহাত ঈগল পাখির মত দুদিকে ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। সে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের তারার দিকে চেয়ে থাকে।

জঙ্গলে জিনিসটা কী ছিল? লুইস, লুইস, যে নাটকের চরিত্রগুলোর মধ্যে ওই জিনিসটা আছে, সেই নাটকের সমাপ্তি কি ভালো কিছুতে হতে পারে?

কিন্তু এখন ফিরে যাওয়ার জন্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং সে নিজেও সেটা জানে।

তাছাড়া, সে নিজেকে বোঝায়, ভালো কিছু হলেও তো হতে পারে; ঝুঁকি নেয়া ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না; আবার হয়তো ভালোবাসা ছাড়াও ঝুঁকি নেয়া যায় না। আর আমার সেই ব্যাগটা তো আছেই, নিচতলারটা না, বাথরুমের শেলফের ব্যাগটা, যেটা আনার জন্যে আমি জাডকে পাঠিয়েছিলাম নরমার হার্ট অ্যাটাক করার রাতে। সেখানে সিরিঞ্জ আছে, আর যদি কিছু হয়…খারাপ কিছু…তাহলে আমি ছাড়া অন্য কারো সেটা জানার প্রয়োজনও পড়বে না।

তার হাত যখন কুঠারের হাতল হাতড়াচ্ছে, তার চিন্তাগুলো প্রার্থনার গুনগুনের মত তার মাথায় বাজতে থাকে। সে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অবস্থায়ই কুঠার দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে শুরু করে। প্রত্যেকবার কোপ দেয়ার পরই সে ক্লান্তিতে কুঠারের হাতলের ওপর পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ধীরে ধীরে গর্তটা বড় হতে থাকে এবং তার কাঙ্ক্ষিত আকার ধারণ করতে থাকে। সে হাতড়ে হাতড়ে গর্তের পাথরগুলো একপাশে স্তূপের মত করে সরিয়ে রাখছে। কিন্তু কিছু পাথর সে আলাদা করে রাখে।

পাথরের স্তম্ভ বানানোর জন্যে।

অধ্যায় ৫৬

রাচেল নিজের গালগুলো চড় মেরে মেরে জ্বালিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তার পরও সে ঝিমুচ্ছে। সে এখন পিটসফিল্ডে এবং মহাসড়কে তার গাড়ি ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই। হঠাৎ তার মনে হয় ডজনখানেক রুপালি চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে এবং ক্ষুধার্ত আগুনের মত লক লক করছে।

সেগুলো আস্তে আস্তে নিজেদের রাস্তার সীমানার ছোট ছোট থামের গায়ে আলোর প্রতিফলন হিসেবে নিজেদের জানান দেয়। গাড়িটা থামগুলোর একদম গা ঘেষে চলছে, সামান্য বাঁয়ে দিয়ে।

রাচেল সম্বিত ফিরে পেয়ে ঝটকা দিয়ে স্টিয়ারিংটা বামে ঘুরিয়ে দেয়। টায়ারের তীক্ষ্ণ কান্নার সাথে সাথে ও একটা চাপা ধাতব শব্দও শুনতে পায়! খুব সম্ভবত গাড়িটার সামনের বাম্পারের ডান দিকটা রাস্তার সীমানার কোন এক থামে আলতো চুমু খেয়েছে। তার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে গলার কাছে চলে যায় এবং তার বুকে এমনভাবে হাতুড়ি পেটাতে থাকে যে সে চোখে কিছু আজব আকৃতি দেখতে থাকে এবং সেই আকৃতিগুলোও বিটের তালে তালে ছোট হচ্ছে, আবার বড় হচ্ছে। এই আতঙ্ক এবং একটুর জন্যে বেঁচে যাওয়ার অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এতো কিছুর পরও কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই ও আবারো ঝিমুতে শুরু করে, যদিও রেডিওতে রবার্ট গর্ডন চিৎকার করে “Red Hot” গানটা গেয়ে যাচ্ছে।

একটা ভীতিকর চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খায়। “ভীতিকর, তা ঠিক, সে রক এন্ড রোলের মাঝে বিড়বিড় করে বলে। ও হাসার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। কারণ চিন্তাটা এখনো যায়নি এবং এই অন্ধকার ভূতুরে রাতে চিন্তাটাকে কিছুটা বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। তার নিজেকে একটা কার্টুনের চরিত্র বলে মনে হচ্ছে, যে একটা মস্ত গুলতির রাবার ঠেলে দৌড়াতে চেষ্টা করছে। দৌড়াতে দৌড়াতে রাবারটা লম্বা হতে থাকে এবং একসময় তার শক্তি আর রাবারে জমা হওয়া বিভব শক্তি সমান হয়ে যায়… বস্তুর জড়তার ফলে…কি?…সাধারণ পদার্থবিদ্যা…কিছু ওকেও পেছনে টেনে ধরে রাখতে চেষ্টা করছে…নাক গলাবে না, তোমাকেই বলছি…স্থির বস্তু তার স্থিতি বজায় রাখতে চেষ্টা করে…উদাহরণস্বরুপ, গেজের লাশ…একবার তাতে গতির সঞ্চার করে দিলে…..

এবারের গাড়ির টায়ারের চিৎকার আগেরবারের চাইতেও বিকট হয়ে শোনা যায়; কয়েক মুহূর্তের জন্যে গাড়িটা রাস্তার সীমানার থামের বেড়াতে ঘষতে ঘষতে তীব্র ধাতব ক্যাচক্যাচ শব্দ করতে করতে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্যে গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। গাড়িটা থমকে দাঁড়ালে রাচেল ব্রেকে পা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এবার সে ঝিমুচ্ছিল না, একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিল, গাড়ি ষাট মাইল বেগে চলতে থাকা অবস্থায়। তার ভাগ্য খুব ভালো যে সে এখনো অক্ষত আছে। যদি রাস্তার সীমানার বেড়া না থাকতো বা যদি…

সে গাড়িটা রাস্তার পাশে পার্ক করে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে। সে হতভম্ব এবং আতঙ্কিত।

কিছু একটা আমকে ওর থেকে দূরে রাখতে চাইছে।

যখন ওর মনে হয় ও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে, ও আবারো গাড়ি চালাতে শুরু করে।

গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কোন ক্ষতি হয়নি। তবে কাল গাড়িটা ফেরত দিতে গেলে যে অনেকগুলো কড়া প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে ও তা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে।

বাদ দাও। সেটা পরে দেখা যাবে। আগে আমার ভেতরে কিছু কফি ঢালা লাগবে-এটাই আপাতত প্ৰথম কাজ।

মাইল খানেক ড্রাইভ করার পর ও একটা লম্বা সোডিয়াম লাইটের সাইন দেখতে পায় এবং ডিজেল ইঞ্জিনের বিরতিহীন গুঞ্জন শুনতে পায়। সে রেস্টুরেন্টের সাথে লাগোয়া ফিলিং স্টেশান থেকে গাড়িটায় তেল ভরে নেয়। “গাড়িটার এই পাশটাকে তো একদম ধর্ষণ করে দিয়েছে কেউ,” তেল দিতে দিতে ফিলিং স্টেশনের লোকটা বলে। এরপর ও গাড়িটা পার্ক করে ডাইনারে ঢুকলে ওর নাকে বেশ কয়েক রকম ঘ্রাণ আসে চর্বি ওয়ালা মাংস রাইয়ের, ডিমের ওমলেট…এবং ফ্রেশ পবিত্র কফির সুঘ্রাণ।

রাচেল এক এক করে তিন কাপ কফি গলায় ঢেলে দেয়, অনেকটা ওষুধের মত-কালো এবং কড়া মিষ্টি। ডাইনারের এক কোণে কিছু ট্রাক ড্রাইভার মিলে ওয়েট্রেসদের সাথে ঠাট্টা মশকরা করছে। ফ্লুরোসেন্ট বাতির আলোয় ওয়েট্রেসদেরকে ক্লান্ত নার্সদের মত লাগছে, যারা অনেক অনেক দুঃসংবাদ বয়ে বেড়াচ্ছে।

রাচেল তার বিল পরিশোধ করে গাড়ির কাছে ফিরে যায়। কিন্তু গাড়িটা চালু হতে চায় না। চাবি ঘোরালে গাড়িটা শুধু হালকা করে কাশছে।

রাচেল স্টিয়ারিং হুইলে দুর্বলভাবে ঘুসি মারতে থাকে। কিছু একটা তাকে থামাতে চাইছে। এই গাড়িটা প্রায় নতুন। সব মিলিয়ে গাড়ির অডোমিটারে পাঁচ হাজার মাইল হবে। এটার এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু তার পরেও সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর সে তার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে পিটসফিল্ডে আটকা পড়েছে।

সে ট্রাকগুলোর বিরতিহীন গুঞ্জন শুনতে থাকে। তার হঠাৎ করে মনে হয়, যেই ট্রাকটা গেজকে হত্যা করেছে সেটা এই ট্রাকগুলোর মধ্যেই আছে।

রাচেল তার মাথা নুইয়ে কাঁদতে শুরু করে।

অধ্যায় ৫৭

লুইস কিছুতে পা হড়কে একেবারে ভূপাতিত হয়। তার মনে হচ্ছে সে আর উঠতে পারবে না—ওঠে দাঁড়ানো তার সাধ্যের বাইরে। তাকে এখানেই শুয়ে শুয়ে পেছনের ঈশ্বরের জলার ঝিঁঝিঁদের সমবেত সঙ্গিত শুনতে হবে এবং তার শরীরের অসংখ্য স্থানের সমবেত ব্যথা সইতে হবে। সে এখানেই শুয়ে থাকবে যতক্ষণ না সে ঘুমিয়ে পড়ে। বা মরে যায়। সম্ভবত সে মরেই যাবে।

তার মনে আছে সে তার খোঁড়া গর্তে ত্রিপলের বান্ডেলটা রেখে গর্তটা খুঁড়ে তোলা পাথুরে মাটি দিয়ে নিজ হাতে ঢেকে দিয়েছে। এরপর ভরে ফেলা গর্তটার গায়ে একটার ওপর একটা পাথর রেখে রেখে স্তম্ভ তৈরি করেছে, যেটার গোড়ার দিকে মোটা আর ওপরের দিকে চিকন। এটুকু তার মনে আছে…

এরপর কী হয়েছে সে তেমন মনে করতে পারছে না। তাকে অবশ্যই সিঁড়ির ধাপগুলো ভেঙে নামতে হয়েছে, সেটা নাহলে তার এখানে থাকা সম্ভব হতো না…সে এখন আছেটা কই? সে আশেপাশে তাকিয়ে পাইন গাছের জঙ্গল দেখে যদ্দূর বুঝলো সে পেট সেমেটারির মরা গাছের ধ্বংসস্তূপটার কাছে চলে এসেছে। সে কি এমনি এমনি হাঁটতে হাঁটতেই ঈশ্বরের জলা পেরিয়ে এসেছে? হয়তো তাও সম্ভব। হয়তো।

এই জায়গাটা ভালোই দূরে আছে। এখানেই ঘুম দেই।

কিন্তু নিজেকে দেয়া মিথ্যা আশ্বাসটাই যেন তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং সামনে চলার শক্তি যুগিয়ে দেয়। কারণ সে যদি এখানে থাকে তাহলে হয়তো ওই জিনিসটা ওকে ধরে ফেলবে… হয়তো জিনিসটা এখনো জঙ্গলেই আছে আর তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

দু হাতের তালু দিয়ে নিজের মুখটা ঘষতে থাকে সে এবং এক হাতে রক্ত দেখে অবাক হয়। কোন এক সময় সে তার নাক ফাটিয়ে ফেলেছে। “তাতে কী বাল হয়েছে?” সে কর্কশ গলায় বিড়বিড় করে এবং চারদিকে হাতড়াতে থাকে যতক্ষণ না কুঠার আর বেলচাটা পায়।

মিনিট দশেক পরে সে সামনে মরা গাছের ধ্বংসস্তূপটা দেখতে পায়। লুইস সেটায় চড়ে বসে এবং বেশ কয়েকবার একদম ভূপাতিত হতে হতে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। সে প্রায় নিচে নেমে আসে। সে তার পায়ের দিকে তাকায় এবং সাথে সাথেই একটা ডাল ভেঙে যায় (নিচে তাকিও না, জাড বলেছিলেন)। এরপর আরেকটা ডাল নিচ থেকে সরে যায় এবং সে ধপাস করে মাটির ওপরে গিয়ে পড়ে।

আজ রাতে এই নিয়ে দুটা গোরস্তানে আমি পড়ে গেছি। আর দুবারই যথেষ্ট!

সে আবারো হাতড়ে হাতড়ে তার বেলচা আর কুঠারটা খুঁজে বের করে। এরপর একটু থেমে সে চারদিকে ভালো করে দেখে। তার পাশেই স্মাকি র কবর। খুবই অনুগত ছিল সে, লুইসের ক্লান্ত মন ভাবে। এর একটু পরেই ট্রিক্সি, কিল্ট অন দ্য হাইওয়ে। বাতাস এখনো বেশ জোরেই বইছে এবং সে একটা চাপা ধাতব টিং-টিং শব্দ শুনতে পায়। হয়তো কোন মৃত পোষা প্রাণীর শোকাতুর মালিক তার বাবার যন্ত্রপাতি দিয়ে টিনের কৌটো কেটে সেটিকে পিটিয়ে সোজা করে একটা লাঠির সাথে পেরেক মেরে লাগিয়ে দিয়েছে। শব্দটা তার মধ্যে আবারো ভয় ঢুকিয়ে দেয়। সে অত্যধিক ক্লান্ত। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে একটা অসুস্থ পালস বিটের মত মনে হচ্ছিল। সে কাজটা করে ফেলেছে। আর সেই টিং টিং শব্দটা যেন তাকে সেটা জানান দিতেই ঘন্টার মত অনবরত বেজে চলছে।

সে পেট সেমেটারির ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। সে ‘মার্তা আমাদের প্রিয় খোরসগোশ’-এর কবরটা পেরিয়ে যায়, যে ১৯৬৫’র পহেলা মার্চ মারা গেছে। পলিনেশিয়া’র শেষ বিশ্রামস্থলটা ডিঙিয়ে যায়। ধাতব টিং টিং শব্দটা এখন আরো জোরালোভাবে শোনা যাচ্ছে। থেমে নিচে তাকায় সে। তারার আলোয় ঢলে পড়া খুঁটির সাথে লাগানো আয়তাকার টিনের গায়ের লেখাটা পড়ে। রিঙ্গো আমাদের প্রিয় ইঁদুর, ১৯৬৪-১৯৬৫। এই টিনটাই বার বার পেট সেমেটারির প্রথম বৃত্তের আরেকটা বোর্ডের সাথে বাড়ি খাচ্ছে আর টিং- টিং আওয়াজ করছে। সে টিনটা বাঁকা করে দেয়ার জন্যে নিচু হয়…এবং এরপর আতঙ্কে জমে যায়।

কিছু একটা নড়ছে। ধ্বংসস্তূপের ওপাশে কিছু একটা নড়ছে।

সে যেই শব্দটা শুনেছে সেটা কারো গোপনীয়তার সাথে চলাচলের শব্দ-পাইনের সুচের মচমচ, ঝোঁপঝাঁড়ের নড়াচড়া। বাতাসে আশে পাশের পাইন গাছের কোলাহলের মাঝে সেই শব্দটা প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল।

“গেজ?” লুইস চিৎকার করে ডাকে।

রাতের অন্ধকারে পেট সেমেটারিতে দাঁড়িয়ে সে তার মৃত ছেলের নাম ধরে ডাকছে, ব্যাপারটা বোধগম্য হওয়ার সাথে সাথেই তার মাথার তালুর সবগুলো চুল খাড়া হয়ে যায়। সে মারাত্নক জ্বরে আক্রান্ত রোগির মত কাঁপতে শুরু করে।

“গেজ?”

শব্দটা আর নেই।

সময় হয়নি; আরো সময় লাগবে। জানি না আমি কিভাবে জানি, তবে আমি জানি। ওটা গেজ না। ওটা…অন্য কিছু।

লুইসের হঠাৎ তাকে বলা এলির কথাটা মনে পড়ে যায়, যিশু বলেছিলেন, ‘লেজারাস, উঠে এসো’…কারণ যিশু যদি শুধু ‘উঠে এসো’ বলতেন তাহলে ওই কবরস্থানের সব মরা উঠে আসতো।

ধ্বংসস্তূপের ওপাশের শব্দটা আবারো শুরু হয়েছে। বাঁধের ওপাশে। বাতাসের কারণে শব্দটা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। যেন কোন অন্ধ কিছু তার ওপর নজর রাখছে। তার মারাত্নক উত্তেজিত মস্তিষ্ক নানান বীভৎস, অসুস্থ জিনিস কল্পনা করতে থাকে, কোন দানবীয় চিকা অথবা কোন মস্ত বাদুড় ওড়ার পরিবর্তে ঝোঁপঝাঁড়ের ভেতর দিয়ে দাপাদাপি করতে করতে এগোচ্ছে।

লুইস ধ্বংসস্তুপটার দিকে নজর রেখে এক পা এক পা পেছাতে থাকে, যতক্ষণ না সে বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দেয়। এরপর সে সামনের দিকে ফিরে পা চালায়। আর তার বাড়ির পেছনের মাঠ যখন সিকি মাইল দূরে, সে দৌড়াতে শুরু করে।

লুইস গ্যারেজের ভেতর লক্ষ্যহীনভাবে কুঠার আর বেলচাটা ছুঁড়ে ফেলে। এরপর সে তার বাড়ির ড্রাইভওয়ের মাথায় দাঁড়িয়ে সে যে রাস্তায় এসেছে সেদিকে তাকায়। এরপর সে আকাশের দিকে তাকায়। রাত পৌনে চারটা। রাত আর বেশি বাকি নেই। আটলান্টিকের পাড়ে হয়তো ভোরের আলো ফুটে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু লাডলোতে এখনো নিকষ রাত। বাতাস এখনো বিরামহীন স্রোতে বয়ে চলছে।

সে গ্যারেজের দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে পেছনের দরজা খুলে বাসায় ঢোকে। কোন বাতি না জ্বেলেই কিচেনের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কিচেন আর ডাইনিং রুমের মাঝখানের ছোট বাথরুমে ঢুকে পড়ে। বাথরুমে ঢুকে সে সুইচটা টিপে দেয় এবং প্রথমেই সে যা দেখতে পায় তা হচ্ছে টয়লেটের ট্যাঙ্কের ওপরে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে থাকা চার্চ। চার্চ তার হলদে-সবুজ চোখ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“চার্চ,” সে বলে। “আমার মনে আছে তোকে কেউ বাসার বাইরে বের করে দিয়েছিল।”

চার্চ জবাব না দিয়ে ট্যাঙ্কের ওপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। হ্যা, কেউ আসলেই চার্চকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছিল; সে নিজে। সেটা তার খুব পরিস্কারভাবে মনে আছে। যেমনটা তার মনে আছে বাড়ির সেলারের জানালাটা বদলে সে ভেবেছিল সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু সে এখন ভালো করেই জানে, যখন চার্চ ঘরে ঢুকতে চায়, সে যেভাবেই হোক ঢুকে পড়ে। কারণ সে এখন আর আগের মত নেই।

তাতে কিছু আসে যায় না। যেসব ঘটছে তাতে তার মনে হচ্ছে কিছুতেই কিছু এসে যায় না। তার নিজেকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে সে জর্জ রোমারিওর সিনেমার কোন বেকুব জম্বি, অথবা এলিয়টের হলোম্যান কবিতার কোন চরিত্র। আমি থাবাওয়ালা কোন জন্তু হলে কিন্তু বেশ হত, তাহলে চার হাত পায়ে ভর দিয়ে লাফাতে লাফাতে ঈশ্বরের জলা পেরিয়ে মিকমেক গোরস্থানে পৌঁছে যেতাম, সে ভাবতে ভাবতে ফিক করে হাসে।

“আমার মাথার ভেতরে শুধু শুকনো খড়, চার্চ” সে ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলে। সে এখন তার শার্টের বোতাম খুলছে। “এটা বিশ্বাস না করলে তোর খবর আছে রে।”

তার বাঁ পাশের পিঠে পাজরের নিচ থেকে কোমর পর্যন্ত কালশিটে পড়ে গেছে। আর প্যান্ট খুলে সে দেখতে পায় হাঁটুর যেখানে সে ব্যথা পেয়েছিল সেই জায়গাটা ফুলে একদম আলুর মত হয়ে গেছে। জায়গাটা এখনই পচে যাওয়া মাংসের মত কালচে বেগুনি রং ধারণ করেছে। তার ধারণা এখন হাঁটু নড়াচড়া করা বন্ধ করে দিলেই সেটা একদম শক্ত হয়ে যাবে, একেবারে সিমেন্টের মত। আঘাতটা দেখে মনে হচ্ছে সেটা হয়তো বৃষ্টির দিনে হঠাৎ হঠাৎ নিজের সুপ্ত অস্তিত্বের জানান দিতে চাবে, যতদিন সে বেঁচে থাকবে ততদিন।

লুইস হাত বাড়িয়ে চার্চের গায়ে এক ঘা বসিয়ে দিতে চায়, কিছুটা আরামবোধ হবে ভেবে। কিন্তু চার্চ চট করে ট্যাঙ্কের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে তার অদ্ভুত চলনে হেঁটে হেঁটে চলে যায়, অন্য কোন বিশ্রামের জায়গার খোঁজে। যাওয়ার আগে চার্চ একবারের জন্যে লুইসকে দেখে নেয়।

মেডিসিন কেবিনেটে বেনর-গাজ ছিল। লুইস টয়লেটের সিট নামিয়ে সেটার ওপর বসে। তারপর এক দলা মলম সে তার আহত হাঁটুতে মেখে দেয়। এরপর সে আরো কিছু মাখে তার কালশিটে পরা পিঠে-হাতুড়ে অপারেশন।

টয়লেট থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে যায়। সে হলের লাইটটা জ্বেলে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে থাকে। কি অদ্ভুত লাগছে! এখানে দাঁড়িয়েই সে ক্রিসমাস ইভে রাচেলকে নীলকান্তমণিটা উপহার দিয়েছিল। জিনিসটা ছিল তার রোবের পকেটে। ওইতো তার চেয়ারটা, যেখানে বসে সে নরমা ক্র্যান্ডালের হার্ট অ্যাটাকের পর এলিকে মৃত্যুর ব্যাপারে বুঝিয়েছিল—যে ব্যাপারগুলো সে এখন নিজেও বিশ্বাস করে না। ক্রিসমাস ট্রি-টা ছিল ওই কোণে, এলির আঁকা টার্কিটা—যেটাকে লুইসের কাছে ভবিষ্যতের কোন কাক বলে মনে হয়েছিল- স্কচ টেপ দিয়ে জানালার সাথে ঝোলানো, আর তারো আগে এখানে কিছু ইউনাইটেড ভ্যান লাইন্সের বক্স ছাড়া কিছুই ছিল না, যেগুলো দেশের মিড-ওয়েস্ট থেকে ট্রাকে করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল আর সেগুলোর ভেতরে ছিল তার পরিবারের যত জিনিসপত্র। ওর মনে পড়ে যায় বক্সের ভেতরে তাদের জিনিসপত্রগুলোকে তার কাছে কেমন গুরুত্বহীন মনে হচ্ছিল-যেন তার পরিবার আর বিশ্বের মাঝের একটা সুরক্ষিত দেয়াল, যেটা তার পরিবারকে দূরে রাখে সেই পৃথিবী থেকে যেখানে তাদের নাম অথবা পারিবারিক রীতিগুলো কেউ জানে না।

সবকিছু কী যে অদ্ভুত লাগছে তার কাছে…কতই না ভালো হতো যদি সে ইউনিভার্সিটি অফ মেইনের নাম কখনোই না শুনতো, অথবা লাডলো নাম, অথবা জাড ক্র্যান্ডাল বা নরমা ক্র্যান্ডালের নাম, অথবা এখানকার কোন কিছুর ব্যাপারেই।

সে ওপরতলার বাথরুমে গিয়ে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে মেডিসিন কেবিনেটের ওপর থেকে তার ছোট কালো ব্যাগটা নামিয়ে আনে। সে ব্যাগটা নিয়ে মাস্টার বেডরুমে গিয়ে সেটার ভেতরের জিনিসগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে। হ্যা, কয়েকটা সিরিঞ্জ আছে, যদি প্রয়োজন পড়ে। আর সার্জিকাল টেপের রোল এবং সার্জিকাল গাটের মাঝে কয়েকটা সাঙ্ঘাতিক তরলের এম্পুল রয়েছে।

যদি প্রয়োজন পড়ে।

লুইস ব্যাগের ডালাটা লাগিয়ে সেটা বিছানার পাশে রেখে দেয়। সে রুমের বাতি নিভিয়ে মাথার নিচে হাত দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। বিছানার আরামে তার শরীর গলে যায়। তার চিন্তা আবারো ডিজনি ওয়ার্ল্ডের দিকে মোড় নেয়। দেখতে পায় ডিজনি ওয়ার্ল্ডে সে সাদা পোশাক পড়ে একটা সাদা মাইক্রো গাড়ি চালাচ্ছে যেটার গায়ে মিকি মাউসের কানের লোগো আঁকা-যাতে বাইরে থেকে দেখে বোঝা না যায় এটা একটা রেস্কিউ ইউনিট। পয়সা দিয়ে ঘুরতে আসা কাস্টমারদের ভয় পাইয়ে ফায়দা কি?

গেজ তার পাশে বসে আছে। ওর গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে আকর্ষনীয় রকম তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। তাদের বাঁয়েই গুফি দাঁড়িয়ে আছে, সে একটা ছোট ছেলের সাথে হ্যান্ডশেক করছে; ছেলেটা নিজের সৌভাগ্য যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। একটু সামনেই ‘উইনি দা পুহ্,’ দুজন বুড়ি দাদীর সাথে দাঁড়িয়ে ছবির পোজ দিচ্ছে আর তৃতীয় দাদী হাসতে হাসতে তাদের ছবি তুলছে; আর একটা খুব সুন্দর পোশাক পড়া ছোট্ট মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি, টিগার! আমি অনেক পছন্দ করি তোমাকে, টিগার!”

তারা দুজন মিলে পাহারা দিচ্ছে। তারা দুজন এই জাদুর দুনিয়ার রক্ষক এবং তারা সব সময় তাদের সাদা গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইমার্জেন্সির জন্যে রাখা তাদের গাড়ির লাল ফ্লেশার বাতিটা ড্যাশবোর্ডে যত্ন সহকারে ঢেকে রাখা হয়েছে, লোক চক্ষুর আড়ালে। তারা বিপদ খুঁজে বেড়াচ্ছে না তবে বিপদ যদি তার চেহারা দেখায় তাহলে তাকে মোকাবেলার জন্যে ওরা একদম প্রস্তুত। মৃত্যু এখানেও ঘুরে বেড়াচ্ছে, যদিও জায়গাটার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র নির্মল বিনোদন। মৃত্যুকে হিসেবের বাইরে রাখার কোন উপায় নেই। হয়তো দেখা যাবে মেইন স্ট্রিট থেকে ফিল্ম কিনতে থাকা হাসি মুখের মানুষটা হঠাৎ মুখ বাঁকা করে নিজের বুক চেপে ধরছেন, অথবা স্কাই চেরিয়টের সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে কোন গর্ভবতী মহিলার হয়তো প্রসব বেদনা উঠবে, নরমান রকওয়েলের মত কোন পরমা সুন্দরি তরুণী হয়তো হঠাৎ মৃগি রোগে আক্রান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যাবে এবং খিঁচুনির কারণে তার ব্রেইন সিগনালগুলো জ্যাম হয়ে সে হয়তো কাটা মুরগির মত তড়পাতে থাকবে। লোকজনের সান-স্ট্রোক, হিট-স্ট্রোক, ব্রেইন-স্ট্রোক হয়, অনেকের আবার বিভিন্ন রাইডে চড়েও স্ট্রোক হয়ে যায়। এমনকি এখানে স্বয়ং ওজ দ্য গেয়েট অ্যান্ড টেয়িল নিজেও আছে। তাকে পার্কের বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝেই দেখা যায়। লুইস এবং গেজের কাছে সে পার্কের অন্যান্য কার্টুনের চরিত্র, যেমন মিকি, গুফি বা টিগারের মতই পরিচিত। কিন্তু সে এমনই একটা চরিত্র যার সাথে কেউ ছবি তুলতে চায় না, বা কেউ তাদের ছেলে-মেয়েদের তার সাথে পরিচিত করিয়ে দিতে যায় না। লুইস আর গেজ তাকে খুব ভালো করে চেনে। তারা কিছু দিন আগে নিউ-ইংল্যান্ডে তার মোকাবেলা করছে। সে কাউকে বালিশ চাপা দেয়ার জন্যে, গলায় মার্বেল আটকে দম বন্ধ করে মারার জন্যে বা বিদ্যুতের সাথে লাগিয়ে ঝলসে দেয়ার জন্যে ঘাপটি মেরে আছে। তাকে পাওয়া যাবে পাশের বৈদ্যুতিক বোর্ডে বা বাতির খালি সকেটে, এক্ষুনি। মৃত্যু আছে অর্ধেক ঠোঙ্গা বাদামে, এক পিস চর্বিওয়ালা গরুর মাংসে, বা পরবর্তী সিগারেটের প্যাকে। সে আছে সব সময়। সে মরণ আর অসীম জীবনের সবগুলো চেকপয়েন্টে ওৎ পেতে আছে। আছে নোংরা সুঁচ, বিষাক্ত পোকা, পানিতে ডুবে থাকা বিদ্যুতের তার, বনের দাবানলে। কেউ তার গোসলের চৌবাচ্চায় ঢুকলে সেখানেও তার বন্ধু ওজ সর্বদা হাজির। কেউ যখন প্লেনে চড়ে, ওজ-ও তাতে চড়ে বসে। সে আছে খাবার পানিতে, খাবারে। কেউ যখন একলা অন্ধকারে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে? কে ওখানে?” তখন তার উত্তরটাই ফিরে আসেঃ ভয়ের কিছু নেই বন্ধু। আমি। হাই! আছো কেমন? তোমার পাছায় ক্যান্সার হয়েছে বন্ধু, খুব সরি আমি। সেপ্টিসেমিয়া! লিউকেমিয়া! খেলাসেমিয়া! করনারি থ্রম্বসিস! এন্সেফালাইটিস! অস্টেওমায়েলিটিস! হে হে! চলো চলো! দরজার ওপাশে ছুড়ি দিয়ে ঠেক দেয়া হিরোইঞ্চি। মাঝ রাতের ফোনকল। হাত ভর্তি ট্যাবলেট, চিবিয়ে খাও। এ্যাস্কাইজিয়েশর পরে নখের নীলচে হয়ে যাওয়া-ব্রেন তখন বাঁচার জন্যে সব অক্সিজেন টেনে নেয় এমনকি নখের নিচের জীবন্ত কোষগুলো থেকেও। হ্যালো, ভাই ও বোনেরা, আমার নাম ওজ দ্য গেয়েট অ্যান্ড টেয়িল, তবে চাইলে শুধু ওজ বললেও হবে আমার সাথে তো এতোদিনে সবার এক রকম দোস্তিই হয়ে গেছে। আপনাদের সবাইকে একটু হার্ট ফেল বা মস্তিষ্কের জমাট রক্ত বা অন্য কিছু উপহার দিতে এসেছি। সময় নেই একদম, এর পরই আমাকে আবার ছুটতে হবে এক প্রসূতি মহিলার কাছে, গিয়ে বাচ্চার মাথা আগে না বেরিয়ে যেন পাছা আগে বেরিয়ে একটা গিরিঙ্গি লাগে সেটাও তো দেখতে হবে। তারপর আবার ছুটতে হবে নিউ ইয়র্কে, গ্যাসের লাইনের লিক থেকে পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মারতে।

আর চিকন কণ্ঠটা কাঁদতে থাকে, “আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি, টিগার! আমি অনেক পছন্দ করি তোমাকে, টিগার! আমি সব সময় তোমাকে পছন্দ করবো আর আমি সব সময় ছোট থাকবো। আর আমার মনে শুধু নেবরাস্কার ওই ভদ্র নকল ওজ’ই বেঁচে থাকবে! আমি তোমাকে অনেক…

আমরা ঘুরে বেড়াই…আমি আর আমার ছেলে…আমরা এটা সেক্স বা যুদ্ধের খাতিরে করি না, করি ওজ দ্য গেয়িট অ্যান্ড টেয়িল-এর বিরুদ্ধে এক মহান এবং হতাশাজনক লড়াইয়ে লড়ে যেতে। আমি আর আমার ছেলে, আমাদের সাদা গাড়িতে করে ফ্লোরিডার আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াই। আর সাইরেনের লাল বাতিটা ঢেকে রাখা আছে, কিন্তু প্রয়োজন হলেই সেটা বের করা হবে…আর এটা আমাদের ছাড়া আর কারো জানারও প্রয়োজন নেই কারণ মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে। মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।

এসব উদ্ভট আধো-স্বপ্নের চিন্তা করতে করতে লুইস ক্রিড ঘুমে তলিয়ে যেতে শুরু করে, বাস্তবতার সাথে তার সব সংযোগ একটা একটা করে খুলে পড়তে শুরু করে যতক্ষণ না তার শ্রান্তি তাকে এক গভীর স্বপ্নহীন কালো দুনিয়ায় টেনে নেয়।

পূবের আকাশে ভোরের রেখা দেখা দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যায়। খুব ধীরে এবং ঢেপসাভাবে পা পড়ছে। হলের ছায়ার ভেতর ছায়ামূর্তিটা চলাচল করে। এর সাথে একটা গন্ধও আসে- খুব বাজে দুর্গন্ধ। এমনকি লুইস তার গাঢ় ঘুমের মাঝেও বিড়বিড় করে গন্ধের দিক থেকে অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নেয়।

ছায়ামূর্তিটা মাস্টার বেডরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, অনড় হয়ে। এরপর সেটা ভেতরে ঢোকে। লুইসের মুখ বালিশে ডুবে আছে। একটা সাদা হাত এগিয়ে আসে এবং বিছানার পাশের ডাক্তারি ব্যাগ খোলার ‘ক্লিক’ শব্দ হয়।

এরপর ভেতরের জিনিস নড়াচড়ার আরো কিছু চাপা শব্দ।

হাতটা ব্যাগের ঔষধ, এম্পুল আর সিরিঞ্জ অনাগ্রহের সাথে ঠেলে সরিয়ে দেয়। এরপর সে একটা জিনিস পায় এবং সেটা বের করে আনে। প্রভাতের প্রথম আভায় সামান্য একটু রূপালি ঝলক দেখা গেল।

ছায়ামূর্তি রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *