পেট সেমেটারি – ৫০

অধ্যায় ৫০

রাচেল ক্রিড আরেকটু হলেই বস্টন থেকে পোর্টল্যান্ডের প্লেনটা ধরতে পারতো। আরেকটু হলেই। শিকাগোর প্লেনটা ঠিক সময়েই ছাড়ে (একটি আশ্চর্য হবার মত ঘটনা), লা গার্ডিয়াতেও সময় মত পৌঁছে (আরেকটি) আর নিউ ইয়র্ক ত্যাগ করে শিডিউলের পাঁচ মিনিট পর। প্লেনটা বস্টন পৌঁছে পনেরো মিনিট লেটে-এগারোটা বারোতে। তার হাতে সময় ছিল তের মিনিট।

তাও সে হয়তো প্লেনটা ধরতে পারতো, কিন্তু যে শাটল বাসটা লোগান টার্মিনালে চক্রাকারে চলে, সেটা আসতে দেরি করে। রাচেল অধীর ব্যগ্রতা নিয়ে বাসটার জন্যে অপেক্ষা করে, শরীরের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ে বদলে, যেন ওর বাথরুম চেপেছে, আর তার মায়ের দেয়া ট্রাভেল ব্যাগটা বার বার হাত বদল করে।

এগারোটা পঁচিশেও যখন বাসটা না আসে, রাচেল দৌড়াতে শুরু করে। ওর জুতোর হিল লো হলেও সেটা তার দৌড়ে সমস্যা করছিল। ও এক পা হড়কে গিয়ে ব্যথা পায় এবং জুতোগুলো খুলে হাতে নেবার জন্যে থামে। এখন সে শুধু প্যান্টিহোস পায়ে দৌড়াচ্ছে। সে এলিগেনি এবং ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স পেরিয়ে যায়। ও জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে এবং ওর শরীরের এক পাশে ব্যথা করতে শুরু করেছে।

ও হাঁপাতে শুরু করে, ব্যথাটাও বাড়তে থাকে। এখন ও ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল পেরোচ্ছে, আর একটু সামনেই ডেল্টা এয়ারলাইনের টার্মিনাল। সে ছুটতে ছুটতে দরজা দিয়ে ঢোকে। ঘড়িতে সময় এগারোটা সাইত্রিশ।

ডিউটিতে থাকা ক্লার্কের একজন রাচেলের দিকে তাকায়।

“১০৪ নাম্বার ফ্লাইট,” রাচেল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। “পোর্টল্যান্ডের ফ্লাইট। সেটা কি চলে গেছে?”

ক্লার্ক লোকটি মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখানে বলছে এখনো যায়নি, কিন্তু ফাইনাল বোর্ডিংয়ের জন্যে আরো পাঁচ মিনিট আগে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আমি ফোন করছি। কোন ব্যাগ আছে চেক-ইনের জন্যে?”

“না,” রাচেল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। সে তার ঘামে ভেঁজা চুলগুলো চোখের ওপর থেকে সরায়। ওর হার্ট বুকের ভেতরে পাগলের মত লাফাচ্ছে।

“তাহলে আমার ফোনের জন্যে অপেক্ষা না করে যত জোরে পারেন দৌড়ান।

রাচেল খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে না-তার সেই সামর্থ্য আর নেই। সে যতটুকু পারলো ততটুকু জোরেই দৌড়ায়। রাতের জন্যে এস্কেলেটর বন্ধ আছে, রাচেল তাই সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে। সিকিউরিটি চেক পয়েন্টে পৌঁছানোর পর সেখানকার হতভম্ব মহিলা সিকিউরিটি গার্ডের দিকে তার ব্যাগটা প্রায় ছুঁড়ে মারে। ব্যাগটা এক্স-রে চেম্বারের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় সে তার হাতের মুষ্টি বার বার খুলতে আর বন্ধ করতে থাকে। এক্স-রে চেম্বার থেকে ভালোভাবে বের হবার আগেই সে ব্যাগের ফিতা ধরে ছো মেরে ব্যাগটা নিয়ে আবারো ছুটতে শুরু করে। ব্যাগটা উড়তে উড়তে তার কোমরে গিয়ে ধাক্কা খায়।

দৌড়াতে দৌড়াতে সে ওপরের মনিটরের দিকে চোখ বুলায় : ফ্লাইট ১০৪ পোর্টল্যান্ড শিড ১১: ২৫, গেট নং- ৩১ বোর্ডিং।

৩১ নাম্বার গেট আরো বেশ খানিকটা দূরে। মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে নিতে ও খেয়াল করলো যে বোর্ডিং শব্দটা পরিবর্তন হয়ে ডিপার্টিং শব্দটি ব্লিঙ্ক করতে শুরু করেছে। ছেড়ে যাচ্ছে প্লেনটা।

একটা হতাশার চিৎকার ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। ও গেটের কাছে গিয়ে দেখতে পেল গেটের এটেনডেন্ট ফিতা সরাচ্ছে, যেটাতে লেখা : ফ্লাইট ১০৪ বোস্টন-পোর্টল্যান্ড ১১:২৫।

“চলে গেছে?” ও অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলে। “আসলেই চলে গেছে?”

এটেন্ডেন্ট ওর দিকে সমবেদনার চোখে তাকায়। “প্লেনটা এগারোটা চল্লিশে ছেড়ে গেছে, আমি সরি ম্যাম। একটুর জন্যে মিস করেছেন।” সে লম্বা জানালা দিয়ে একটা প্লেন দেখায়। সেটা হরেক রকম বাতি ব্লিঙ্ক করতে করতে টেক অফের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।

“কেউ আপনাকে বলেনি আমি আসছি?” চিৎকার করে বলল রাচেল।

“ওরা যখন ফোন করে, ততক্ষণে প্লেনটা অ্যাক্টিভ ট্যাক্সিওয়েতে চলে গেছে। সেটাকে ওই অবস্থায় ডেকে ফেরত পাঠালে পাইলট, প্যাসেঞ্জার সবাই মিলে আমার মুন্ডু চিবিয়ে খেত। আমি সরি। আপনি যদি আর চার মিনিট আগেও আসতে পারতেন—”

রাচেল বাকি কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা না করেই উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে। সিকিউরিটি চেক পয়েন্টের মাঝামাঝি রাস্তায় এসে ওর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। ও ফ্লোরেই বসে থাকে, যতক্ষণ না সুস্থ বোধ করে। এরপর সে জুতোগুলো পড়ে নেয়। এর আগে ওর এক পায়ের ছিড়ে ফালাফালা হয়ে যাওয়া স্টকিং থেকে একটা সিগারেটের ফিল্টার সে তুলে ফেলে দেয়। আমার পা নোংরা এবং আমার বালও সেটা কেয়ার করে না, সে ভাবে।

টার্মিনালের দিকে হেঁটে যায় সে।

ওই মহিলা সিকিউরিটি তাকে দেখে বললে, “মিস করেছেন?”

“হুম।”

“আপনি যাবেন কোথায়?”

“পোর্টল্যান্ডের ফ্লাইট ছিল। সেখান থেকে ব্যাঙ্গর।”

“তাহলে আপনি একটা গাড়ি ভাড়া করে নেন না কেন? সাধারণ কেস হলে আপনাকে আমি এয়ারপোর্টের কাছের কোন হোটেলে উঠতে পরামর্শ দিতাম। কিন্তু আমার যদি কখনো কোন মহিলাকে দেখে মনে হয়ে থাকে তাদের গন্তব্যে যাওয়া খুব জরুরি, আপনিই সেই মহিলা।”

“আমিই সেই মহিলা, তাতে কোন সন্দেহ নেই।” সে ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবে। “আপনার আইডিয়াটা কাজ করতে পারে, তাই না? যদি এজেন্সিগুলোয় গাড়ি পাওয়া যায় আর কি।”

সিকিউরিটি গার্ড মহিলা হাসে। “গাড়ি পাবেন। যদিও আবহাওয়া খারাপ থাকলে গাড়ি পাওয়া যায় না, আর এখানে আবহাওয়া প্রায়ই ঝামেলা করে।”

রাচেল মহিলার কথা শুনেও শুনলো না। তার ব্রেন ইতিমধ্যে হিসেব কষতে শুরু করে দিয়েছে।

পোর্টল্যান্ডে ড্রাইভ করে গিয়ে ব্যাঙ্গরের ফ্লাইট ধরা অসম্ভব, এমনকি যদি ও সুইসাইডাল স্পিডে গাড়ি চালায় তবুও। তার চাইতে একেবারে সোজা ব্যাঙ্গর যাওয়াই ভালো। কতক্ষণ লাগবে? সেটা নির্ভর করে দূরত্বের ওপর। আড়াইশো মাইল সংখ্যাটা তার মনে আসে, সম্ভবত জাডের কাছে এরকম কিছুই সে শুনেছিল। ওর রওনা দিতে অন্তত রাত সাড়ে বারোটা বাজবে। পুরো রাস্তা পঁয়ষট্টি মাইল বেগে গেলে পুলিশের গতিসীমা লঙ্ঘনের জন্যে থামানোর সম্ভাবনাও কম। সে মনে মনে আড়াইশো কে পঁয়ষট্টি দিয়ে ভাগ করে। চার ঘন্টার কিছু কম…চার ঘন্টাই ধরা যাক। ওর অন্তত একবার বাথরুমে যাওয়ার জন্যে থামা লাগবে। যদিও ওর মনে হয় না এই পরিস্থিতিতে ঘুম আসার কোন সম্ভাবনা আছে, তারপরও ও নিজেকে যদ্দূর চেনে ওর অন্তত একবার ব্ল্যাক কফির জন্যে থামতে হবে। এসব কিছুর পরেও ও ভোরের আগেই লাডলো পৌঁছতে পারবে। মনে মনে হিসেব শেষ করে ও সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে-গাড়ি ভাড়ার ডেস্ক নিচ তলায়।

“গুড লাক, ম্যাম,” সিকিউরিটি গার্ড মহিলা বললেন। “ভালো থাকবেন।”

“ধন্যবাদ,” রাচেল বলে। রাচেলেরও মনে হয় কিছুটা গুড লাক তার প্ৰাপ্য।

অধ্যায় ৫১

গন্ধটা ওর নাকে মোক্ষম আঘাত করে এবং সে কাশতে কাশতে কুকড়ে যায়। সে কবরের পাড় জাপটে ধরে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে থাকে। যখন তার মনে হয় যে তার একটু ভালো লাগছে ঠিক তখনই তার পেট থেকে রাতের খাবারগুলো বেরিয়ে আসে। সে কবরের বাইরে বমি করে ভাসিয়ে দেয়। এরপর সে কবরের পাড়ের মাটিতে মাথা রেখে হাঁপাতে থাকে। এক সময় বমি ভাবটা চলে যায়। সে দাঁতে দাঁত চেপে বগল থেকে ফ্লাস লাইটটা নিয়ে খোলা কফিন বরাবর ধরে।

একটা প্রচন্ড আতঙ্ক ওকে প্রায় অবশ করে দেয়, ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখলে যেমনটা হয়; যে স্বপ্নগুলো দেখে জাগার পর আর মনে করা যায় না।

গেজের লাশের মাথাটা নেই।

লুইসের হাতগুলো এমনভাবে কাঁপতে থাকে যে সে দুহাত দিয়ে ফ্লাশ লাইটটা চেপে ধরে; শিক্ষানবিস পুলিশদের ট্রেনিংয়ে দুহাত দিয়ে যেভাবে পিস্তল ধরতে শেখানো হয়, সেভাবে। কিন্তু তার পরেও আলোর রশ্মি কাঁপতেই থাকে। আলোর রশ্মিটাকে কবরে ফিরিয়ে আনতে তার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে।

এটা অসম্ভব, সে নিজেকে বলে। তুমি যা দেখেছো, সেটা অসম্ভব।

লুইস ধীরে ধীরে আলোর চিকন রশ্মিটা গেজের পা থেকে মাথার দিকে ওঠাতে থাকে। প্রথমে ওর পায়ের জুতো, এরপর স্যুটের প্যান্ট, এরপর ওর ছোট্ট কোট (ওহ খোদা, কোন দু বছরের বাচ্চার স্যুট পড়ার প্রয়োজন হওয়াটা উচিত না), এরপর স্যুটের কলার, এরপর-

গেজের মৃত্যুকে ঘিরে সব ক্রোধ তার মধ্যে এসে ভর করে। তার মনে হচ্ছে সে পাগল হয়ে যাবে।

লুইস তার প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে হাতড়ে তার রুমালটা বের করে আনে। এক হাতে লাইটটা ধরে সে বেশ খানিকটা নিচু হয়। এই অবস্থায় যদি খাড়া করে রাখা গ্রেভ লাইনারের কোন স্ল্যাব তার ওপর এসে পড়ে তাহলে নিশ্চিতভাবেই তার ঘাড় ভাঙবে। সে খুব আলতোভাবে তার রুমালটা দিয়ে গেজের মুখের ওপর জন্মানো শ্যাওলাগুলো মুছে দেয়-শ্যাওলাগুলো এতো গাঢ় সবুজ রঙের যে তা দেখে লুইস ভেবেছিল গেজের মাথাই হয়তো গায়েব হয়ে গিয়েছে।

শ্যাওলাগুলো পাতলা হয়ে জন্মেছে। এরকমটা হতে পারে তার বোঝা উচিত ছিল; এর মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে এবং গ্রেভ লাইনার ওয়াটার প্রুফ না। ফ্লাশ লাইটের আলো দুদিকে ফেলে লুইস দেখতে পায়, গেজের কফিনটার চারদিকে বেশ কাদা। মর্টিশিয়ান যদিও জানতেন যে সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্টের কারণে গেজের কফিন খোলার সম্ভাবনা নেই, তার পরও তিনি তার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন-যেটা মর্টিশিয়ানরা প্রায় সব সময়ই করে থাকে। তার ছেলেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা বাজেভাবে বানানো পুতুল। তার মাথার কয়েক দিকে অসমভাবে ফুলে আছে। তার চোখগুলো চোখের পাতার অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে। ওর মুখ থেকে সাদা কিছু বেরিয়ে আছে, যেটাকে একটা সাদা জিবের মত দেখাচ্ছে। লুইস ভাবে মর্টিশিয়ান হয়তো অতিরিক্ত ক্যামিকেল ব্যবহার করে ফেলেছেন, আর একটা ছোট শিশুর ক্ষেত্রে কতটুকু যে যথেষ্ট তা বোঝাটাও নিশ্চয়ই কঠিন

এরপর সে বুঝতে পারে জিনিসটা আসলে তুলো। লুইস নিচু হয়ে তুলোটা গেজের মুখ থেকে তুলে নেয়। গেজের ঠোটগুলো একটা ‘প্লিপ’ শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায়। ওর ঠোঁটগুলোকে অস্বাভাবিক কালো আর দীর্ঘ মনে হচ্ছে। লুইস তুলোটা কবরের কাদার মধ্যে ফেলে দিলে সেটাকে কালোর মধ্যে এক টুকরো ঘৃণিত শুভ্রের মত দেখায়। তুলোটা সরানোতে গেজের এক গাল একদম ভেতরে ডেবে গেছে।

“গেজ,” সে ফিসফিস করে বলে, “তোমাকে বের করে নিয়ে যাচ্ছি, ঠিক আছে?”

সে প্রার্থনা করে যাতে কেউ এদিকে না চলে আসে, যেমন কেয়ারটেকারের রাত সাড়ে বারোটার টহল বা ওরকম কিছু। এখন ব্যাপারটা শুধু এমন না যে লুইস শুধু ধরা পরতে চায় না, এখন যদি কেউ এসে ওর মুখে টর্চের আলো ফেলে তাহলে ও কোদালটা তুলে তার মাথায় বসিয়ে দেবে।

তার হাত গেজের লাশের নিচে ঢুকিয়ে দেয়। গেজের দেহ হাড্ডিবিহীন লাশের মত থলথল করে ওঠে। তার নিশ্চিতভাবে মনে হচ্ছে সে গেজের লাশটা তুললে সেটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে এবং তার হাতে কয়েকটা টুকরো ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। ও এরপর কবরের ভেতর দাঁড়িয়ে টুকরোগুলো বুকে নিয়ে চিৎকার করে উঠবে। আর এভাবেই লোকেরা উন্মাদ লুইসকে খুঁজে পাবে।

থামিস না, ভীতুর ডিম। থামিস না!

গেজের গায়ের বোটকা স্যাতস্যাতে অবস্থা সত্ত্বেও লুইস গেজকে তার দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়, যেভাবে সে ওকে ওর খাট থেকে বহুবার তুলেছে। গেজের মাথা নিচের দিকে ঝুলে যায়। গেজ সেই সেলাইগুলো দেখতে পায় যেটা গেজের মাথাটাকে তার কাঁধের সাথে লাগিয়ে রেখেছে।

দুর্গন্ধে লুইসের নাড়িভুড়ি উল্টে আসছে। ওই অবস্থাতেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে গেজকে কোন রকমে কফিন থেকে বের করে আনে।

অবশেষে সে গেজকে কোলে শুইয়ে বসে পড়ে কবরের পাশে। লুইসের পাগুলো কবরের গর্তে ঝুলছে, মুখটা ভয়ঙ্কর ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, চোখগুলোকে গর্তের মত লাগছে এবং ওর মুখটা দুঃখে নিচের দিকে বাঁকা হয়ে আছে।

“গেজ,” লুইস বলে গেজকে তার কোলে দোল দিতে থাকে। গেজের চুলগুলো লুইসের কব্জির সাথে লেগে আছে, যেগুলো একদম তামার তারের মতই মৃত। “গেজ, বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে। আরেকটু ধৈর্য ধরো। আজ রাতটা শুধু অপেক্ষা করো, প্লিজ গেজ। আমি তোমাকে ভালবাসি গেজ, বাবা তোমাকে ভালোবাসে।”

লুইস তার ছেলেকে কোলে করে দোল দিতে থাকে।

রাত পৌনে দুটোর মধ্যে লুইস কবরস্থান ছেড়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়। গেজের লাশটার ব্যবস্থা করাই সবচাইতে কঠিন ছিল-ওই সময় তার মন; মহাশূন্যে ভাসতে থাকা মহাকাশচারী সবচাইতে দূরে ভেসে গিয়েছিল। তার পিঠ আর কোমরের পেশিগুলো ব্যথায় দপ দপ করছে। তার মনে হচ্ছে পেশিগুলো লাফাচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থায় বিশ্রাম নিতে নিতে সে ভাবে সে হয়তো গেজকে ফিরিয়ে আনতে পারবে। হয়তো পুরোটাই ফিরিয়ে আনতে পারবে।

সে গেজের লাশ ত্রিপলের ওপর রেখে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নেয়। এরপর টেপ দিয়ে ভালোমত পেচিয়ে দুই মাথা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলে। সে কফিনের দরজাটা বন্ধ করে; এরপর একটা চিন্তা করে দরজাটা খুলে সেটার ভেতর ভচকে যাওয়া কোদালটা রেখে দেয়। জিনিসটা প্লেজেন্টভিউতেই থাক; প্লেজেন্টভিউ তার ছেলেকে হারাচ্ছে, কিন্তু কোদালটা সে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিক। সে কফিনের দরজাটা বন্ধ করে গ্রেভলাইনারের অর্ধেক স্ল্যাব জায়গামত নামিয়ে আনে। সে ভেবেছিল বাকি অর্ধেক সে ধাক্কা দিয়ে জায়গামত ফেলে দিবে, কিন্তু তাতে সেগুলো ভেঙে যেতে পরে বলে ও থামে। একটু চিন্তা করে সে তার বেল্টটা লোহার রিংগুলোর ভেতর ঢুকিয়ে সেগুলো শুইয়ে দেয়। এরপর সে বেলচাটা ব্যবহার করে গর্তটা ভরাট করতে থাকে। এবারও দেখা গেল কবর পুরোপুরি ভর্তি করার জন্যে যথেষ্ট মাটি নেই। কবরটিকে সামান্য নিচু দেখাচ্ছে যেটা কারো চোখে পড়তে পারে। আবার নাও পারে। আবার চোখে পড়লেও হয়তো এটাকে কেউ আমলে নিবে না। সে নিজেকে এটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে দেয় না-কারণ তার সামনে আরো অনেক জটিল এবং বর্বর কাজ পড়ে আছে। এবং সে প্রচন্ড ক্লান্ত।

চলো, চলো!

“ঠিক” লুইস বিড়বিড় করে।

বাড়ন্ত বাতাসে আশেপাশের গাছপালা নেচে উঠলে লুইস ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকায়। সে তার যন্ত্রপাতিগুলো ত্রিপলের বান্ডেলটার পাশে রাখে। তার লাইট ব্যবহার করতে ইচ্ছে হলেও সে ইচ্ছেটা দমন করে। লাশ আর জিনিসগুলো রেখে লুইস যে পথে এসেছিল সেই পথে হেঁটে হেঁটে ওই লোহার শিকের বেড়াটার কাছে যায়, পাঁচ মিনিট পর। তার গাড়িটা রাস্তার ওপাশে পার্ক করা আছে। এতো কাছে, কিন্তু বহু দূরে।

সে ওদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘুরে আরেক দিকে হাঁটতে থাকে। এবার সে গেটের উল্টো দিকে যায়, বেড়াটার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে, যতক্ষণ না বেড়াটা মেসন স্ট্রিট থেকে প্রায় নব্বই ডিগ্রী কোণে মোড় নিয়েছে। সেখানে সে একটা ছোট ডোবা দেখতে পায়, যাতে নর্দমার ময়লা এসে পড়ে। সেখানে যা দেখলো তাতে সে কেঁপে ওঠে। ডোবাটা নষ্ট ফুলে ভরা। এক স্তরের ওপর আরেক স্তর ফুল। বৃষ্টি আর বরফগলা পানিতে এগুলো এখানে ভেসে এসেছে।

ওহ খোদা।

না, এই জিনিসগুলো ঈশ্বরের জন্যে না। এসব হচ্ছে সেই অপদেবতার জন্যে যা খ্রিস্টধর্মের চাইতেও অনেক বেশি পুরনো। রাচেলের বোন সেটাকে বলতো : ওজ দ্য গেয়িট অ্যান্ড টেয়িল, মৃত জিনিসের দেবতা, নর্দমার পচা ফুলের দেবতা, রহস্যের দেবতা।

লুইস ডোবাটার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তাকে হিপনোটাইজ করা হয়েছে। এবং অবশেষে সে একটা লম্বা শ্বাস গিলে এমনভাবে সেদিক থেকে চোখ সরায় যেন কেউ এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনে তাকে হিপনোটাইজড অবস্থা থেকে ফিরিয়ে এনেছে।

সে এগোয়। একটু সামনে গিয়েই যা খুঁজছিল তা পেয়ে যায় সে। তার মনে হচ্ছে গেজের কবরের দিনই তার মন অবচেতনভাবে এই জিনিসটা মনে রেখেছে।

অন্ধকারে লুইস দাঁড়িয়ে আছে গোরস্তানের লাশঘরের সামনে। ফেব্রুয়ারির শীতে যখন মাটি শক্ত হয়ে যায় এবং বুলডোজার দিয়েও মাটি খোঁড়া সম্ভব হয় না তখন লাশগুলো এই ঘরে সংরক্ষণ করা হয়। তাছাড়া অন্য সময়েও ব্যবসার চাপ বেড়ে গেলেও এই ঘরটা কাজে লাগে।

লুইস জানে যে গোরস্থানে ব্যবসা মাঝে মাঝে বেড়ে যায়। কোন এলাকায় হঠাৎ হঠাৎ কোন বোধগম্য কারণ ছাড়াই অনেক মানুষ মারা যায়।

“সব মিলিয়ে ব্যালেন্স হয়ে যায়,’ আঙ্কেল কার্ল বলেছিলন। ‘যদি দেখা যায় মে মাসের দুই সপ্তাহে কেউ মরেনি, তাহলে আমি বলে দিতে পারি যে নভেম্বরের দুই সপ্তাহেই আমার দশটা ফিউনারেল করা লাগবে। তবে নভেম্বরে এরকম খুব কমই হয় আর ক্রিসমাসের সময় কখনোই হয় না, যদি অনেকেই মনে করে ক্রিসমাসের সময় অনেক মানুষ মারা যায়। ক্রিসমাস ডিপ্রেসন; যতসব ফালতু কথা। এই ব্যবসার যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে তোমাকে তাই বলবে। বেশিরভাগ মানুষই ক্রিসমাসের সময় খুশি থাকে আর তাই তারা আরো বাঁচতে চায়। তাই তারা আসলেই বেঁচে থাকে। সাধারণত ফেব্রুয়ারির সময় মৃত্যুর ঢল নামে। অনেকে ফ্লুতে মরে, কারো নিউমোনিয়া হয়-কিন্তু এসবই আসল কারণ না। অনেকে দেখা যায় এক/দেড় বছর ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করেছে পালোয়ানের মত। কিন্তু ফেব্রুয়ারি আসলে তাদের মনে হয় তারা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এবং এই সুযোগে তাদের ঘরের ফুটো দিয়ে মৃত্যুও প্রবেশ করে সাপের মত। জানুয়ারির একত্রিশে এ দেখা গেল তাদের ক্যান্সার ভালোর দিকে, আর ফেব্রুয়ারির চব্বিশে তাকে পাওয়া যাবে কবরের গর্তে। ফেব্রুয়ারিতে মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয়, ফেব্রুয়ারিতে মানুষের স্ট্রোক হয়, ফেব্রুয়ারিতে মানুষের ব্রেইন হেমারেজ হয়। ফেব্রুয়ারি একটা খারাপ মাস। আর আমরা যারা এই ব্যবসায় আছি, তারা এই ব্যাপারে অভ্যস্ত। আবার কোন কারণ ছাড়াই এই একই ঘটনা জুনে বা অক্টোবরেও হয়। কিন্তু আগস্টে কখনো হয় না। আগস্ট খুব স্লো সময় আমাদের ব্যবসায়। যদি না কোন গ্যাস বিস্ফোরণ হয় বা কোন বাস ব্রিজের ওপর থেকে পড়ে যায়; তাছাড়া আগস্টে কখনোই লাশ ঘর ভরে না। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে দেখা যায় আমরা কফিনের ওপর কফিন রেখেও জায়গা করতে পারছি না। এরপর আমাদের একটু গরমের জন্যে দোয়া করা লাগে যাতে করে লাশ রাখার জন্যে আমাদের কোন এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা না লাগে।

আঙ্কেল কার্ল হেসেছিলেন। লুইসও হেসেছিল।

লাশ ঘরটা দেখলে মনে হবে ছোট একটা টিলার ভেতর মাটি কেটে দরজা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। টিলাটা স্বভাবতই প্রাকৃতিক না। সুন্দর একটা লাশ ঘর বানানোর জন্যেই এটা তৈরি করা হয়েছে। টিলাটার দুটো উঁচু অংশ আছে, অনেকটা মানবীর স্তনযুগলের মত। এই টিলাটা লম্বায় লোহার বেড়াটা থেকে ফুট দুই-এক কম। আর টিলার ওপরের দিকটা সমতল।

লুইস চারদিক দেখে ঢালু বেয়ে ওপরে উঠে যায়। বেড়ার ওপাশে প্রায় দুই একরের মত খালি জায়গা…না একদম খালি না, একটা ছোট ছাউনি দেয়া ঘর দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত গোরস্তানের যন্ত্রপাতি রাখার ঘর, লুইস ভাবে।

চারদিক একদম সুনশান, জন মানবের কোন চিহ্ন নেই। বাতাসে গাছ পালার নড়াচড়া ছাড়া সে আর কোন নড়াচড়া দেখতে পায় না।

সে পাছায় ভর দিয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে নিচে নামে, তার ভয় হচ্ছিল সে পড়ে গিয়ে আবারো হাঁটুতে ব্যথা পাবে। এরপর সে তার ছেলের কবরের কাছে ফিরে যায়। আরেকটু হলেই ত্রিপলে মোড়া নিজের ছেলের লাশের সাথে পা হড়কে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। সে খেয়াল করে দেখলো টানা দুবার পা হড়কাতো, প্রথমবার লাশে, পরের বার তার পাশে রাখা তার যন্ত্রপাতিতে। সে কোমরের ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিচু হয়ে ত্রিপলের রোলটা তুলে নেয়। বান্ডেলের ভেতরে গেজের লাশের এপাশ ওপাশ সরে যাওয়া টের পায় এবং সে অনবরত শুনতে থাকা একটা কণ্ঠ ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যেটা বলেই যাচ্ছে যে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

সে লাশ মোড়ানো ত্রিপলের বান্ডেলটা লাশ ঘরটার কাছে নিয়ে যায়। সে ভেবে দেখে তার হাতের চল্লিশ পাউন্ডের জিনিসটা টিলার ওপর ওঠাতে তার কী করা লাগবে, যেহেতু তার দড়িটা আর নেই। সে একটু পিছিয়ে যায়, এরপর প্রাণপণে টিলার ঢাল বরাবর দৌড়াতে থাকে। বেশ খানিকটা ওঠার পর ঘাসে ওর পা পিছলে যায় আর ও শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে বান্ডেলটা সামনের দিকে ছুঁড়ে মারে। বান্ডেলটা একদম টিলার চূড়ার কাছে গিয়েই পড়ে। বাকি অংশটা সে ক্রল করে করে ওঠে। চারদিকে তাকিয়ে বান্ডেলটি বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে সে বাকি জিনিস আনতে ফিরে যায়।

সে আবারো টিলার চূড়ায় ওঠে এবং হাতে গ্লাভস পড়ে নিয়ে জিনিসগুলো বান্ডেলের পাশে সাজিয়ে রাখে। এরপর সে বেড়ায় হেলান দিয়ে বসে, হাঁটুর ওপর হাতগুলো রেখে একটু জিরিয়ে নেয়। ক্রিসমাসে রাচেলের উপহার দেয়া ডিজিটাল ঘড়িটা বলছে সময় এখন দুইটা এক।

সে নিজেকে সামলে নেয়ার জন্যে পাঁচ মিনিট সময় নেয়। এরপর সে বেলচাটা বেড়ার ওপাশে ফেলে দেয়। সে ঘাসের ওপর সেটা পড়ার ‘ধাপ’ শব্দ শুনতে পায়। সে ফ্লাশ লাইটটা তার পকেটে আটাতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। বেড়ার শিকের ফাঁক দিয়ে সেটাকে ঢুকিয়ে দিয়ে ছেড়ে দেয়। সেটা যেন কোন পাথরে বাড়ি খেয়ে না ভেঙে যায় যায় সেই আশা করতে করতে সে টিলার গা বেয়ে সেটার গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে থাকে। তার এখন মনে হচ্ছে তার প্যাকস্যাক পড়া দরকার ছিল।

সে তার পকেট থেকে টেপটা বের করে সেটা দিয়ে কুঠারের হাতলটা খুব ভালোভাবে ত্রিপলের বান্ডেলটার সাথে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লাগায়। শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেপ প্যাঁচাতেই থাকে এবং সেটা শেষ হয়ে গেলে সেটার খালি রিংটা পকেটে পুরে রাখে। সে বান্ডেলটা উঁচু করে বেড়ার ওপর ধরে; তার কোমড় ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে এবং সে বুঝতে পারে আগামী সপ্তাহের পুরোটা তাকে আজ রাতের মাশুল গুনতে হবে। এরপর সে বান্ডেলটা ছেড়ে দেয় এবং সেটার মাটিতে পড়ার শব্দে সে চোখ-মুখ কুচকে ফেলে।

এবার সে তার এক পা বেড়ার ওপাশে দিয়ে দুটো শিকের মাথা হাত দিয়ে ভালোভাবে ধরে আরেকটি পাও ওপাশে নিয়ে যায়। এরপর বেড়ার গায়ের খাঁজে পা বাজিয়ে সে মাটিতে নেমে আসে।

ও টিলাটার নিচের দিকে নেমে এসে সাথে সাথেই বেলচাটা পেয়ে যায়। গাছের ফাক দিয়ে স্ট্রিট লাইটের আলো পড়ে সেটার ফলাটা মৃদু জ্যোতি ছড়াচ্ছে। ফ্লাশ লাইটটা খুঁজে পেতে তার বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। সেটা যেখানে থাকবে বলে লুইস ভেবেছিল সেখানে সেটা নেই। সে তাই হামাগুড়ি দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে সেটা খুঁজতে থাকে ঘন ঘাসের মধ্যে। সে তার নিশ্বাস এবং হৃৎপিন্ডের পালস নিজ কানে শুনতে পাচ্ছে।

অবশেষে সেটা খুঁজে পায়, তার অনুমান থেকে পাঁচ ফিট দূরে। সে তার হাত দিয়ে ফ্লাশ লাইটের মাথাটা চেপে ধরে সুইচ টিপে দেয়। তার হাত জ্বলে উঠলে সে বুঝতে পারে জিনিসটা ঠিকই আছে।

সে তার পকেট নাইফ দিয়ে টেপ কেটে কুঠারটা বান্ডেল থেকে আলাদা করে এবং যন্ত্রপাতিগুলো ঘাসের ওপর থেকে গাছগুলোর দিকে নিয়ে যায়। সে সবচাইতে বড় গাছটার পেছনে দাঁড়িয়ে মেসন স্ট্রিটের দুই দিকে তাকায়। জন মানব শূন্য। পুরো রাস্তা জুড়ে একটা বাড়ির দোতলাতে আলো জ্বলছে-হয়তো কোন ইনসমনিয়া রোগি।

সে দৌড়ায় না, কিন্তু বেশ জোরে হেঁটে হেঁটে ফুটপাতে উঠে আসে। গোরস্তানের অন্ধকার থেকে স্ট্রিট লাইটের আলোতে বেরিয়ে তার খুব অনিরাপদ বোধ হতে শুরু করে। সে একটা কুঠার, একটা বেলচা আর একটা ফ্লাশ লাইট নিয়ে ব্যাঙ্গরের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাড্ডিখানার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে; কেউ তাকে দেখে ফেললে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে এক এক সেকেন্ডের বেশি লাগার কথা না।

দ্রুত রাস্তা পেরোয় সে। তার গাড়িটা আর পঞ্চাশ গজের মত দূরে কিন্তু তার মনে হচ্ছে পাঁচ মাইল। সে ঘামতে ঘামতে এগোয়, আর কোন গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ, বা কোন পায়ের আওয়াজ যেটা তার নিজের না, বা জানালা খোলার শব্দের জন্যে কান খাড়া করে।

সে তার গাড়ির গায়ে কুঠার আর বেলচাটা ঠেস দিয়ে পকেটে চাবির জন্যে হাতড়াতে থাকে। চাবিটা নেই, দুই পকেটের একটিতেও। সে আবারো ঘামতে শুরু করে। তার হৃৎপিন্ড আবারো প্রচন্ডভাবে লাফাতে থাকে আর দাঁতের সাথে দাঁত লেগে যায়। তীব্র আতংক তাকে জাপটে ধরে।

সে চাবি হারিয়ে ফেলেছে, খুব সম্ভবত যখন সে গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে গড়াগড়ি খেয়েছিল তখন। চাবিটা হয়তো ঘাসের ভেতর পড়ে আছে। ঘাসের ভেতর থেকে ফ্লাশলাইটটা খুঁজে পেতেই তাকে গলদঘর্ম হতে হয়েছিল, আর চাবি খুঁজতে গেলে সেটা পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু সে তা ভালো করেই জানে। শেষ, সব শেষ। একটা ছোট ভুলের কারণে সব শেষ।

এক মিনিট, পকেটটা আবারো চেক করো লুইস। পকেটের পয়সাগুলো যেহেতু পড়ে যায়নি, চাবিটাও পড়ে যাওয়ার কথা না।

লুইস এবার খুব ধীরে ধীরে পকেট দুটো চেক করে, পয়সাগুলো বের করে, এমনকি পকেটগুলো উল্টো করে বের করে।

কোন চাবি নেই।

গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে সে ভাবে কী করবে। তাকে আবারো বেড়া পেরিয়ে কবরস্থানের ভেতর ঢোকা লাগবে, গেজের লাশ যেখানে আছে সেখানে রেখেই। ভেতরে ঢুকে ফ্লাশ লাইট দিয়ে চাবি খুঁজতে গিয়ে হয়তো সারা রাত পেরিয়ে যাবে কিন্তু চাবি খুঁজে পাওয়া-

হঠাৎ একটা ভাবনা ওর ক্লান্ত মনে উঁকি দেয়।

সে একটু বাঁকা হয়ে গাড়ির ভেতরে তাকায়। তার চাবির গোছাটা গাড়ির ইগনিশন সুইচ থেকে ঝুলছে।

ঘোৎ করে শব্দ করে দৌড়ে গাড়ির ওপাশে গিয়ে দরজা খুলে চাবির গোছাটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। তার মাথার মধ্যে একটা প্রোগ্রামে কার্ল মালডেনের কণ্ঠ ভেসে আসেঃ গাড়ি লক কর। চাবিটা নিয়ে নাও। একটা ভালো ছেলেকে খারাপ হতে সাহায্য করো না।

সে গাড়িটার পেছনে গিয়ে ট্রাঙ্ক খুলে সেখানে বেলচা, কুঠার আর ফ্লাশ লাইটটা রেখে ট্রাঙ্কের দরজাটা ধাম করে লাগায়। এরপর গাড়ি থেকে বিশ বা ত্রিশ ফিট সামনে যাওয়ার পর তার মনে পড়ে সে আবারো চাবিটা ফেলে যাচ্ছে, এবার ট্রাঙ্কের তালায় ঝুলন্ত অবস্থায়।

স্টুপিড! সে মনে মনে নিজেকে গালি দেয়। এরকম ছাগলামি করলে সব কিছু ভুলে যাও, তোমাকে দিয়ে কিসসু হবে না!

সে ফিরে গিয়ে চাবি নিয়ে আসে।

গেজকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে মেসন স্ট্রিটের প্রায় অর্ধেক চলে আসার পর কোথাও একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। না-শুধু ঘেউ ঘেউ না, সেটা রীতিমত রাগে গজরাচ্ছে। গর্র্র্-ঘেউ! ঘেউ! রাস্তাটা কুকুরের গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

লুইস একটা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে ভাবতে থাকে কী হতে যাচ্ছে আর সে কী করবে। সে সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে যে রাস্তার পাড়ের সবগুলো বাড়ির বাতি হয়তো এক এক করে জ্বলে ওঠবে।

কিন্তু দেখা গেল মাত্র একটা বাতি জ্বলে উঠেছে, লুইস যে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে তার বিপরীতে। একটু পরে একজন ধমকের সুরে বলে উঠে, “চুপ কর, ফ্রেড!”

গর্‌র্‌র্‌-ঘেউ! ফ্রেড জবাব দেয়।

“কুত্তাটাকে চুপ করাও, স্ক্যানলন, নাহলে আমি পুলিশে ফোন করছি!,” লুইস রাস্তার যে পাশে সেখান থেকে একজন চিৎকার করে বলে ওঠে আর লুইস চমকে প্রায় লাফিয়ে ওঠে এবং বুঝতে পারে এখানকার নির্জনতা আসলে কতটা ক্ষণস্থায়ী। তার চারদিকে অসংখ্য চোখ, আর কুকুরটা মানুষের ঘুমে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে, যে জিনিসটা এখানে তার একমাত্র বন্ধু। বদমাইস কুত্তা! তোর গুষ্টি কিলাই!

ফ্রেড আবারো তার গলা সাধা শুরু করে; কিন্তু সে যেই গর্র্র্ করার পর ঘেউ করে উঠবে এমন সময় ফ্রেড কারো আঘাতে কেউউউ করে কঁকিয়ে ওঠে এবং সেখান থেকে সামান্য হুটোপুটির আওয়াজ আসতে থাকে।

ফ্রেডের বাসার দরজা বন্ধ হবার শব্দের পর থেকে আবারো চারদিকে অমূল্য নীরবতা নেমে আসে। সেই বাসার লাইটটা আরো কয়েক মুহূর্ত পরে নিভে যায়।

লুইসের মনে হচ্ছিল তার আরো কিছুক্ষণ ছায়ায় ঘাপটি মেরে থাকা উচিত, কিন্তু সময় হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

সে গেজের লাশের বান্ডেলটা হাতে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গাড়ির পেছনে যায় এবং কাউকেই দেখতে পায় না। ফ্রেড তার শান্তি বজায় রাখছে। সে বান্ডেলটা এক হাতে নিয়ে চাবি দিয়ে ট্রাঙ্কের ডালাটা খোলে।

গেজের জায়গা হবে না।

লুইস লম্বা-লম্বি ভাবে, সটানভাবে এবং আড়া-আড়িভাবে বান্ডেলটা ট্রাঙ্কে ঢোকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কোনভাবেই জায়গা করতে পারে না। ট্রাঙ্কটা খুব ছোট। লুইস বান্ডেলটা ঠেসে ঠুসে, মুচড়িয়ে ঢুকিয়ে দিলেও হয়তো গেজ রাগ করবে না, কিন্তু তার দ্বারা সেটা সম্ভব না।

সে তার ছেলের লাশ হাতে নিয়ে ট্রাঙ্কের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কি করা যায় এবং সে তখনই একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। গাড়িটা এদিকেই আসছে। সে আর কিছু চিন্তা না করে দ্রুত গাড়ির প্যাসেঞ্জার সাইডে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বান্ডেলটা সিটে রেখে দেয়।

সে সামনের দরজাটা বন্ধ করে দৌড়ে গাড়ির পেছনে গিয়ে ট্রাঙ্কের ডালাটা বন্ধ করে। ঠিক এই মুহূর্তেই গাড়িটা তাকে প্রদক্ষিণ করে এবং সে ওই গাড়ি থেকে কিছু মাতালের শোরগোল শুনতে পায়। সে ড্রাইভিং সিটে বসে যেই হেডলাইট জ্বালাতে যাবে তখনি একটা আতঙ্কের চিন্তা তাকে নাড়া দেয়। গেজ নিচের দিকে মুখ করে নেই তো? ওর হাঁটু এমন হয়ে ভাঁজ হয়ে আছে যা দেখে মনে হচ্ছে গেজ ওপরের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে ওর পা মুচড়ে উল্টো দিকে ভাঁজ হয়ে আছে?

তাতে কী আসে যায়? তার ক্লান্ত বিরক্ত মন বলে। এসব মাথা থেকে কি ঝেড়ে ফেলতে পারবে তুমি? এসবে কিচ্ছু আসে যায় না!

আসে যায়। অনেক কিছু আসে যায়। কারণ এটা কোন কাপড়ের বান্ডেল না, এটা গেজ!

ও গেজের দিকে ঝুঁকে পড়ে বান্ডেলটার গা হাতড়ে হাতড়ে ভেতরের জ্যামিতি বোঝার চেষ্টা করে। তাকে একজন অন্ধের মত মনে হচ্ছে, যে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে জিনিসটা কি তা বোঝার চেষ্টা করছে। অবশেষে সে একটা উঁচু জিনিস হাত দিয়ে অনুভব করতে পারে যেটা গেজের নাক ছাড়া আর কিছু হতে পারে না-গেজ ঠিকভাবেই আছে।

এরপরই সে গাড়িটা চালু করে লাডলোর পঁচিশ মিনিটের যাত্রা শুরু করতে পারে।

অধ্যায় ৫২

রাত একটায় জাড ক্র্যান্ডালের ফাঁকা বাড়িতে তার টেলিফোনটা বেজে উঠলে তিনি চমকে জেগে উঠেন। স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। স্বপ্নে তার বয়স ছিল তেইশ বছর আর তিনি জর্জ চ্যাপলিন এবং রেনে মিকাউড, তার দুই বন্ধুর সাথে একটা ট্রেনের কাপলিং শেডে বসে হুইস্কি গিলছিলেন। তাদের সামনে ট্রেনের ইঞ্জিনের জ্বলতে থাকা কয়লার লাল আভা ঝাপসা কাচের ওপাশ থেকে বিকিরণ করছে। তারা এক এক করে রসালো গল্প বলে যাচ্ছেন আর বাকিরা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার বয়স তেইশ এবং নরমাও নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। রেনে মিকাউড এক ইহুদিকে নিয়ে আরেকটা রসালো গল্প ফাঁদতে যাচ্ছে-

এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে এবং তিনি ঝাঁকি দিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। তিনি নিজের কাঁধের ব্যথায় ককিয়ে ওঠেন, যেন কোন ভারি পাথর তার ওপর এসে পড়েছে-ভারি জিনসটা হচ্ছে তেইশ থেকে তিরাশি, মোট ষাটটি বছর একবারে তার ওপরে এসে আছড়ে পড়ার ফল। তিনি আরো ভাবেন, তুমি ঘুমাচ্ছিলে খোকা। এভাবে রেলপথ চালালে কাজ হবে না…অন্তত আজ রাতে না।

তিনি তার কাঁধ এবং কোমরের ব্যথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে উঠে দাঁড়িয়ে ফোনের কাছে যান।

রাচেলের ফোন।

“জাড, ও কি বাসায় ফিরেছে?”

“না,” জাড বলেন। “রাচেল, তুমি কোথায়? তোমাকে আগের চাইতে কাছে মনে হচ্ছে?”

“আমি আগের চাইতে কাছেই আছি,” রাচেল বলে। যেভাবেই হোক বোঝা যাচ্ছে যে রাচেল আগের চাইতে বেশ কাছে আছে এবং ফোনের তারে দূর থেকে ভেসে আসা এক রকম গুন গুন শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা বাতাসের। এই শব্দটা সবসময় তাকে মৃতদের কন্ঠের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেন অনেক মৃতের কন্ঠ এক সাথে সমবেত সঙ্গিত গাইছে। “আমি মেইনের বিডেফোর্ডে একটা দোকান থেকে বলছি।”

“বিডেফোর্ড!”

“আমার পক্ষে আর শিকাগোতে বসে থাকা সম্ভব হয়নি। এলির সাথে যাই হচ্ছিল না কেন, তা আমার সাথেও হচ্ছিল। আর আপনিও সেটা অনুভব করতে পারছেন, আমি আপনার গলা শুনেই বুঝতে পারছি।”

“হুম।” তিনি প্যাক থেকে একটা বিড়ি তার ঠোঁটের কোণে চালান করে দেন। এরপর তিনি একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে সেটাকে তার নিজের হাতের কাঁপুনির সাথে কাঁপতে দেখেন। তার হাত কাঁপতো না, অন্তত এই দুঃস্বপ্ন শুরু হবার আগে। তিনি বাইরের বাতাসের কালো গর্জন শুনতে পান। মনে হচ্ছে সেটা বাড়িটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঝাকাচ্ছে।

অশুভ ক্ষমতা বাড়ছে। আমি অনুভব করতে পারছি।

তার বুড়িয়ে যাওয়া হাড়ে আতঙ্ক ঢুকে পড়ে।

“জাড, প্লিজ বলুন এসব কি হচ্ছে!”

তার মনে হয় রাচেলের সব কিছু জানার অধিকার আছে; এবং সেটার প্রয়োজনও আছে। এবং তিনি তাকে সব খুলে বলবেন। পুরো গল্পটা। তিনি ওকে বলবেন ঘটনাগুলো কিভাবে একটার সাথে আরেকটা লেগে একটা চেইন তৈরি করেছে-নরমার হার্ট অ্যাটাক, এলির বিড়ালের মৃত্যু, ওখানে কোন মানুষকে কবর দেয়া হয়েছে কি না সে ব্যাপারে লুইসের প্রশ্ন, গেজের মৃত্যু। আর খোদাই জানে লুইস সেই চেইন আরো কতদূর টেনে নিয়ে গেছে। তিনি ওকে সবই খুলে বলবেন। কিন্তু ফোনে না।

“রাচেল, তুমি প্লেনের বদলে মহাসড়কে কেমন করে?”

রাচেল সব খুলে বলে কিভাবে ও বস্টনে ফ্লাইট মিস করেছে। “আমি একটা এভিস গাড়ি ভাড়া করেছি। তবে আমি যে সময়ের হিসেব করেছিলাম তা থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। লোগানে একবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম, আর এখন আমি মাত্র মেইনে এসে পৌঁছেছি। আমি হয়তো ভোরের আগে এসে পৌঁছাতে পারবো না। কিন্তু…জাড…প্লিজ। প্লিজ আমাকে বলুন এসব কি হচ্ছে। আমার খুবই ভয় হচ্ছে আর আমি এও বুঝছি না কেন আমার ভয় হচ্ছে।”

“রাচেল। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন,” জাড বললেন, “তুমি পোর্টল্যান্ড পর্যন্ত ড্রাইভ করে এসে একটা হোটেলে রুম নিয়ে থেকে যাও। একটু ঘুমিয়ে-”

“জাড, এ রকম করা আমার পক্ষে সম্ভব?”

“একটু ঘুমিয়ে নাও। ভয়ের কিছু নেই রাচেল। এখানে হয়তো কছু একটা ঘটতে চলেছে, আবার সেটা নাও হতে পারে। আর যদি আমি যা ভাবছি তাই ঘটে তাহলে তোমার এখানে থাকা একদমই উচিত হবে না। আমি ব্যাপারটা দেখবো। এটা আমি দেখবো কারণ এর দায় আমারই। আর কিছু না হলে তুমি দুপুরের আগে দিয়ে চলে এসো তাতেও কোন সমস্যা নেই। আমার ধারনা লুইস তোমাকে দেখে খুব খুশিই হবে।”

“আমি আজ রাতে ঘুমোতে পারবো না, জাড।”

“পারবে,” জাড আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন-হয়তো যে রাতে যিশুকে জেলে নেয়া হয়েছিল, পিটারও সেদিন একই রকম ভেবেছিল। পাহারারত অবস্থায় ঘুম। “হ্যা, তুমি পারবে। রাচেল, তুমি যদি গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাও তাহলে একবারও ভেবে দেখেছো এলি আর লুইসের কী হবে?”

“তাহলে আমাকে বলুন কী হচ্ছে এসব। যদি আমাকে সব খুলে বলেন তাহলে আমি হয়তো আপনার কথা শুনবো। কিন্তু আমার জানতে হবে!”

“লাডলোতে আসার পর তুমি তোমার বাসায় না গিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে আসবে। আমি যা জানি তার সব তোমাকে খুলে বলবো রাচেল। আর আমি লুইসকে দেখে রাখবো।”

“না, এখুনি বলুন, প্লিজ,” রাচেল বলে।

“নো, ম্যাম। এই কথা ফোনে বলার কথা না। রাচেল, এটা সম্ভব না। তুমি আসো তারপর বলবো। তুমি এখন পোর্টল্যান্ডে এসে ঘুমিয়ে নাও।”

এরপর বেশ লম্বা একটা নীরবতা।

“আচ্ছা,” রাচেল বলে। “হয়তো আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু একটা কথা বলুন, ব্যাপারটা কতটুকু খারাপ?”

“ব্যাপারটা আমি সামলাতে পারবো,” জাড ঠান্ডা গলায় বলেন। “তবে কোন ব্যাপার ঠিক যত খারাপ হতে পারে, ব্যাপারটা ঠিক ততই খারাপ।”

বাইরে একটি গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যায়, ধীর গতিতে চলছে সেটি। জাড চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে সেটাকে ভালো করে দেখেন। এরপর সেটা লুইসের বাসার সামনে এসে গতি বাড়িয়ে চলে গেলে তিনি আবারো বসে পড়েন।

“আচ্ছা, ঠিক আছে,” রাচেল বলে। “বাকি রাস্তা ড্রাইভ করাও মাথার ওপর একটা মস্ত পাথর বলে মনে হচ্ছে।”

“পাথরটাকে গড়িয়ে যেতে দাও,” জাড বলেন। “প্লিজ, নিজেকে আগামীকালের জন্যে ঠিক রাখো। এখানে সব ঠিকঠাক থাকবে।”

“আপনি প্রমিজ করছেন আমি এলে সব বলবেন?”

“হ্যাঁ। বিয়ার খেতে খেতে তোমাকে সব কিছু পরিস্কার করে খুলে বলবো।”

“গুড বাই, তাহলে,” রাচেল বলে। “এখনকার জন্যে।”

“এখনকার জন্যে,” জাড সম্মতি জানান। “তোমার সাথে কাল দেখা হবে, রাচেল।”

রাচেলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি ফোনটা রেখে দিলেন।

.

তিনি ভেবেছিলেন কেবিনেটে ক্যাফেইন পিল আছে, কিন্তু তিনি খুঁজে পেলেন না। তিনি নিজেকে গাল দিতে দিতে বাকি বিয়ারগুলো ফ্রিজে তুলে রেখে এক মগ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নিলেন। তিনি কফির মগ নিয়ে আবারো জানালার পাশে এসে আগের জায়গায় বসে পাহারা দিতে লাগলেন।

কফি এবং রাচেলের সাথে কথাবার্তা তাকে আরো পয়তাল্লিশ মিনিটের মত জাগিয়ে রাখে, কিন্তু এর পর তিনি আবারও ঢুলতে শুরু করেন।

পাহারায় বসে কিসের ঘুম, বুড়ো? যা হচ্ছে তার জন্যে তুমি দায়ি এবং এর মাশুলও তোমাকেই দিতে হবে। সুতরাং পাহারায় বসে কোন ঘুম নেই।

তিনি ফ্রেশ সিগারেট জ্বালিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে কাশতে শুরু করলেন। তিনি তার সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে রেখে দুহাত দিয়ে দুচোখ কচলাতে লাগেন। বাইরে একটা দশ চাকার ট্রাক রাস্তা আলোকিত করে রাতের বাতাস ফুরে দ্রুতবেগে এগিয়ে যায়।

তিনি আরেকবার ঘুমে ঢলে পড়ছেন টের পেয়ে নিজের দুই গালে হাতের এপিঠ ওপিঠ দিয়ে দুটো চড় মারলেন ঘুম তাড়াতে। চড় খেয়ে তার কান ভো ভো করছে। তার হৃদয়ে আতঙ্ক ঢুকে পড়েছে, গুপ্ত আততায়ীর মত।

জিনিসটা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে…হিপনোটাইজ করছে… জিনিসটা চায় না আমি জেগে থাকি। কারণ ও কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। হ্যা, আমি সেটা টের পাচ্ছি। এবং জিনিসটা চায় যাতে আমি তার পথে কোন বাধা সৃষ্টি করতে না পারি।

“না,” তিনি গম্ভীর হয়ে বলেন। “একদম না। শুনতে পাচ্ছিস? আমি এটা থামাবই। এমনিতেই বহুদূর জল গড়িয়েছে।”

চারদিকে বাতাস গর্জন করে ওঠে আর রাস্তার ওপাশের গাছগুলো যেন হিপনোটাইজ করার দোলকের ন্যায় দুলছে। তার মন আবারো ট্রেন ইঞ্জিনের সামনের সেই দিনে ফিরে যায়। তারা সারাটি রাত কথা বলে কাবার করে দিচ্ছিলেন; তিনি, জর্জ আর রেনে মিকাউড। তিন জনের মধ্যে এখন শুধু তিনি একাই টিকে আছেন। রেনে ১৯৩৯ এর মার্চে এক ঝড়ের রাতে দুটো গাড়ির মাঝখানে পিষ্ট হয়ে মারা যায় আর জর্জ গত বছর হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। তার চেনাজানা অনেকের মধ্যেই সে একাই বেঁচে আছেন এবং এক বুড়ো বেকুবে পরিণত হয়েছেন। বেকুবের কাছে বেকুব মার্কা কাজগুলোকে প্রায়ই পরোপকার বলে মনে হয়, কখনো গৌরব বলে মনে হয়-প্রাচীন রহস্য বলে বাহবা নেয়া, সেটাকে আরো কারো কাছে পৌঁছে দেয়া, পুরনো গ্লাস থেকে জল নতুন গ্লাসে ঢেলে দেয়া…

ওই ইহুদি কী বলে শোন। “আমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যেটা তোমার বাপের জন্মেও দেখোনি। এই পোস্ট কার্ডগুলো, দেখে মনে হচ্ছে মেয়েগুলো সাঁতারের ছোট-খাটো পোশাক পড়ে আছে তাই না? কিন্তু এটাকে যদি ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছে দাও, তাহলে গায়ের কাপড় সব উধাও হয়ে ওরা জন্মদিনের পোশাক পড়ে ফেলবে, চোখের-”

জাডের মাথা তার বুকের দিকে ঝুঁকে যায়।

“-চোখের নিমিষে। কিন্তু আবার কার্ডগুলো শুকিয়ে নিলেই ওদের গায়ের কাপড় ফিরে আসবে। শুধু তাই না। আমার কাছে আরো আছে—”

রেনে সামনের দিকে ঝুঁকে হেসে হেসে গল্প বলছে আর জাড বিয়ারের বোতল ধরে আছেন-তার মনে হলো বোতলটা তার হাতেই আছে এবং সেটা ধরার জন্যে তিনি বাতাসে হাত মুঠো করলেন।

অ্যাশট্রেতে সিগারেটটা জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাকে টানার কেউ নেই। জাড ঘুমিয়ে পড়েছেন।

আর চল্লিশ মিনিট পর যখন লুইসের গাড়ির পেছনের বাতি জ্বলে উঠলো এবং লুইস তার গাড়িটা নিয়ে ড্রাইভওয়ে দিয়ে গ্যারেজে ঢোকে, জাড কিছুই শুনলেন না, নড়লেন না বা জেগেও উঠলেন না; যেমনটা পিটারও টের পাননি, যখন রোমান সৈন্যরা যিশুকে ধরে নিয়ে যায়।

অধ্যায় ৫৩

লুইস কিচেনের ড্রয়ার থেকে আরেকটা নতুন টেপ নিয়ে সেটা দিয়ে কুঠার আর বেলচা ভালো করে একসাথে পেচিয়ে নেয়। এরপর গ্যারেজ থেকে একটা রশি নিয়ে যন্ত্রপাতিগুলো বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়ার জন্য বেঁধে নেয়।

রশিতে ঝুলছে যন্ত্রপাতি। হাতে গেজ।

জিনিসগুলো সে তার পিঠে ঝুলিয়ে নেয়। এরপর গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে ত্রিপলের বান্ডেলটা বের করে আনে। গেজ চার্চের চাইতে অনেক ভারি। ওকে নিয়ে মিকমেক গোরস্তানে যেতে গেলে হয়তো শেষের দিকে তাকে বুকে ভর দিয়ে দিয়ে যেতে হবে। আর এরপর তাকে সেই পাথুরে জায়গায় কবর খুঁড়তে হবে, কুঠার দিয়ে পাথরের গা থেকে ফুল্কি ছোটাতে ছোটাতে।

কিন্তু সে সব করবে। যেভাবেই হোক।

লুইস ক্রিড তার গ্যারাজ থেকে বেরিয়ে বাতি নেভানোর জন্যে থামে। সে সামান্য দূরে অন্ধকারের মধ্যেও পেট সেমেটারিতে যাওয়ার পথটা দেখতে পাচ্ছে। ছোট ছোট ঘাসে ঢাকা রাস্তাটা এক অদ্ভুত নরম উজ্জ্বলতায় অন্ধকারের মাঝেও বেশ বোঝা যাচ্ছে।

দমকা হাওয়া ওর চুলগুলোতে বিলি কেটে দিচ্ছে। হঠাৎ ছোটবেলার অন্ধকারের ভয় তাকে পেয়ে বসে। সে নিজেকে খুব অসহায়, দূর্বল ভাবার সাথে সাথে প্রচন্ড আতঙ্কিতও হয়ে পড়ে। সে কি আসলেই এই অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাতে একটি লাশ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে? এই গভীর রাতে, একাকী?

এতো কিছু ভেবো না। এগিয়ে যাও।

লুইস হাঁটতে শুরু করে।

বিশ মিনিট পর সে যখন পেট সেমেটারিতে পৌঁছে, ওর হাত পা অবসাদে কাঁপছে। সে তার কোলে বান্ডেলটা নিয়ে মাটির ওপর বসে পড়ে। বিশ মিনিটের জন্যে বিশ্রাম নেয় সে, ঝিমুতে ঝিমুতে। তার ভয় ভয় ভাবটা কেটে গেছে। অবসাদ তার ভীতিকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুশ্চিন্তা করে যে সে আসলেই মরা গাছের ধ্বংসস্তুপটার ওপর উঠতে পারবে কি না। কিন্তু সে জানে যে তাকে চেষ্টা করতে হবে। তার হাতের চল্লিশ পাউন্ডের বান্ডেলটা এখন দুইশো পাউন্ড বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু আগে যেমনটা হয়েছিল, আবারো সেটাই ঘটলো। ব্যাপারটা অনেকটা পুরনো স্বপ্ন মনে করার মত…না, ঠিক মনে করার মত না, অনেকটা বাস্তবের মত অনুভব করার মত। তার মনে হয় কেউ তাকে ঠেলে ওপরে উঠিয়ে দিচ্ছে; ঠিক যেমন প্রথমবার মরা গাছের স্তুপে পা রাখার সময় অদ্ভুত অনুভূতিটা হয়েছিল। তার শরীর এখনো ক্লান্ত কিন্তু সেটা এখন খুব নগন্য বিষয় বলে মনে হচ্ছে।

শুধু আমাকে অনুসরণ করো। আমাকে অনুসরণ করো আর নিচের দিকে একদম তাকাবে না, লুইস। আগুপিছু করবে না আর নিচে তাকাবে না। আমি রাস্তা চিনি। তবে আমাদের খুব দ্রুত যেতে হবে।

দ্রুত এবং কোন কিছু না ভেবে, হ্যা- যেভাবে জাড গেজের গা থেকে মৌমাছির হুলটা টেনে তুলেছিলেন।

আমি রাস্তা চিনি।

কিন্তু যাওয়ার পথ একটাই। হয় সেটা তোমাকে যেতে দিবে, নয়তো দিবে না। আগে সে একবার নিজে নিজে এটার ওপর ওঠার চেষ্টা করে পারেনি কিন্তু এবার সে দ্রুত এবং কোন কিছু না ভেবে পা তুলে দিয়েছে, যেমনটা জাড তাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

সে ওপরে উঠছে, নিচের দিকে একদমই না তাকিয়ে, হাতে নিজের ছেলের ত্রিপলের কাফনে মোড়া লাশ নিয়ে। একদম ওপরে উঠে গেলে আবারো বাতাস তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে শুরু করে।

একদম ওপরে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায় সে এবং এরপরই নামতে শুরু করে, সিঁড়ি বেয়ে নামার মত করে। কুঠার আর বেলচাটা তার পিঠের সাথে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ধাতব শব্দ করছে। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যেই সে পাইনের সুচারু পাতা ভরা মাটিতে নেমে আসে। তার পেছনে গোরস্তানের সেই লোহার বেড়ার চাইতেও উঁচু ধ্বংসস্তূপটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

সে তার ছেলেকে নিয়ে পথ চলতে শুরু করে, গাছের ডাল-পালায় বাতাসের কান্না শুনতে শুনতে। শব্দটাকে তার আর একদমই ভয় লাগছে না। এই রাতের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

অধ্যায় ৫৪

রাচেল ক্রিড “বামে পোর্টল্যান্ড” লেখা একটা সাইনবোর্ড দেখে; কিছুটা সামনে গিয়ে বামে মোড় নিতে হবে পোর্টল্যান্ড যেতে চাইলে। সে রাস্তার পাশে আরেকটি সবুজ সাইন বোর্ড দেখে, হলিডে ইন মোটেলের। একটি বিছানা, ঘুম। এই অজানা, অসহনীয় টেনশন থেকে সাময়িক মুক্তি। এবং সাময়িক হলেও তার ছেলের তীব্র শোক থেকে রেহাই, যে ছেলে আর পৃথিবীতে নেই। তার মনে হচ্ছে এই শোকের যন্ত্রণা অনেকটা আক্কেল দাঁত তোলার মত। প্রথমে অবশ করার ইনজেকশনের প্রভাবে ব্যথা তেমন সুবিধে করতে পারে না, কিন্তু সেটা ধূর্ত বেড়ালের মত ঘাপটি মেরে থাকে হামলে পড়ার জন্যে। আর যখন ইনজেকশনের প্রভাব চলে যায়, ওব্বাবা, তুমি একদমই হতাশ হবে না।

লোকটা এলিকে বলেছে তাকে পাঠানো হয়েছে সতর্ক করার জন্যে… কিন্তু সে নিজে থেকে কিছু করতে পারবে না। লোকটা এলিকে বলেছে সে আর তার বাবা পাশাপাশি ছিল যখন তার আত্মা বের করে নেয়া হয়।

জাড জানেন, কিন্তু বলতে চাচ্ছেন না। কিছু একটা হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কি?

আত্মহত্যা? এটা কি আত্মহত্যা? লুইস এরকম করবে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু ও মিথ্যা বলছিল তা দিনের আলোর মত পরিস্কার। সেটা ওর চোখ বলছিল… ধুর, শুধু চোখ না, পুরো চেহারাই এক কথা বলছিল…যেন ও চাইছিল আমি মিথ্যাটা ধরে ফেলি…এবং বাধা দেই…কারণ ওর একটা অংশ খুব ভয় পাচ্ছিল।

ভয়? লুইস তো কখনোই ভয় পায় না!

হঠাৎ সে গাড়ির স্টিয়ারিং কষে টেনে বামে ঘুরিয়ে দেয়। ছোট গাড়িটার টায়ার তীব্র আওয়াজ করে প্রতিবাদ জানায়। এক মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হয়েছিল গাড়িটা বুঝি উল্টেই যাবে। কিন্তু সেরকম কিছু হয় না এবং ও হলিডে ইন পেছনে ফেলে পোর্টল্যান্ডের পথে চলতে থাকে। সামনে আরেকটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে তার, যেটায় চকচকে রঙে লেখা : জেরুজালেম লট। অদ্ভুত নাম, সে ভাবে। নামটা কেমন যেন…এসো, জেরুজালেমে ঘুমোতে এসো।

কিন্তু আজ রাতে ওর চোখে ঘুম নেই। জাডের কথায় সে আশ্বস্ত হতে পারছে না। সে একেবারে বাসায় চলে যেতে চাচ্ছে। জাড জানেন কী হচ্ছে এবং তিনি প্রতিজ্ঞাও করেছেন তিনি খারাপ কিছু ঘটতে দিবেন না। কিন্তু তিনি একজন আশি বছরের বৃদ্ধ এবং মাত্র তিন মাস আগে তিনি তার স্ত্রীকে হারিয়েছেন। ভরসা করার মত অবস্থা তার নেই। লুইস যে তাকে এভাবে এক প্রকার বাসা থেকে খেদিয়ে দিলো, সেটা মেনে নেয়া তার কোনভাবেই উচিত হয়নি। কিন্তু গেজের মৃত্যু তাকে দুর্বল করে দিয়েছে। এলির সেই ছবিটি সর্বদা সাথে নিয়ে ঘোরা, ছবিতে গেজ আর এলির নিষ্পাপ মুখ…রাতের অন্ধকারে ওর বারবার ইচ্ছে হয়েছে লুইসকে ঘৃণা করতে, তার ভেতরে এই বেদনার জন্ম দেয়ার জন্যে আর ওকে সান্ত্বনা না দেয়ার জন্যে (অথবা তার থেকে সান্ত্বনা না নেয়ার জন্যে, যেটা দেয়া রাচেলের খুব প্রয়োজন ছিল), কিন্তু ও পারেনি। সে এখনো লুইসকে প্রচন্ড ভালোবাসে, আর ওর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল…কেমন নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল…

গাড়ির স্পিড মিটারের কাটা ষাট মাইলের এর ঘর থেকে একটু ডানে সরে আছে। মিনিটে এক মাইল করে। আড়াই ঘন্টায় হয়তো লাডলো পৌঁছানো যাবে। হয়তো ও সূর্যাস্তের আগেই সেখানে পৌঁছে যাবে।

সে হাতড়ে হাতড়ে গাড়ির রেডিওটা চালু করলে একটা পোর্টল্যান্ডের রক এন্ড রোল স্টেশান খুঁজে পেল। ও ভলিউম বাড়িয়ে সাথে সাথে গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করে, ঘুম তাড়াবার জন্যে। পোর্টল্যান্ড থেকে দূরে চলে আসায় আধা ঘন্টা পর স্টেশনটা হারিয়ে যেতে শুরু করলে সে একটা অগাস্টা স্টেশনে ফিরে যায়। সে জানালার কাচ নামিয়ে দিয়ে বিরামহীন রাতের বাতাস তার গায়ে বইতে দেয়।

সে ভাবে, এই রাত কি কখনো শেষ হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *