পেট সেমেটারি – ৫

অধ্যায় ৫

নয়টার মধ্যে শ্রমিকরা সবাই চলে যায়। এলি এবং গেজ দুজনেই চরম ক্লান্ত হয়ে এখন যার যার নতুন রুমে ঘুমোচ্ছে। গেজ ঘুমোচ্ছে তার বেবি বিছানায়, যেটার চারদিকে কাঠের খাচার মতো ঘের লাগানো। আর এলি ঘুমোচ্ছে মেঝেতে পাতা একটা তোষকের ওপর যার চারপাশে ঘিরে আছে বাক্সের পাহাড়। ওর কোটি কোটি রং পেন্সিল, যার কিছু আস্ত, কিছু অর্ধেক ব্যাবহার করা, কিছু ভোঁতা; ওর সেসিমি স্ট্রিটের কিছু পোস্টার; ওর কিছু ছবির বই; ওর কাপড়-চোপড়; আর ঈশ্বর জানে আরও কত কী। আর বরাবরের মতো চার্চও ওর সাথেই আছে। বেড়ালটা ঘুমের মধ্যেই চাপা কণ্ঠে গোঁ গোঁ করছে। হুলো বেড়ালটা আদুরে পুরর পুরর শব্দ করতে না পারলেও এই নকল গোঁ গোঁ শব্দ দিয়েই ওই কাজ চালায়।

কিছুক্ষণ আগে রাচেল গেজকে কোলে নিয়ে বাড়িময় অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। লুইস যেসব জায়গায় শ্রমিকদের জিনিসপত্র রাখতে বলেছিল সেসব তার পছন্দ না হাওয়ায় সেগুলো আবার সাজিয়েছে। সে শ্রমিকদের চেকটা হারায়নি, আর বকশিশ দেয়ার জন্যে রাখা পাঁচটা ১০ ডলারের সাথে সেটা তখনো তার পকেটেই ছিল। অবশেষে ভ্যান থেকে শ্রমিকেরা সব মাল বাড়ির ভেতর পৌঁছে দেয়া শেষ করলে সে চেক আর টাকা দুটোই তাদের হাতে দেয়। তারা ধন্যবাদ দিলে তার জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে তাদের প্রাপ্তি বিলে সই করে দেয়। এরপর সে সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ট্রাকটার ফিরে যাওয়া দেখে। শ্রমিকেরা হয়তো ব্যাঙ্গরে নেমে বিয়ার গিলে আজকের দিনের ইতি টানবে। এই মুহূর্তে বিয়ার পেটে পড়লে বেশ লাগবে। সেটা তাকে ক্র্যান্ডালের নিমন্ত্রণের কথা আবারো মনে করিয়ে দেয়।

সে আর রাচেল কিচেন টেবিলে বসে আছে। সে দেখতে পায় রাচেলের চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। “এই তুমি, হ্যাঁ তোমাকেই বলছি!” লুইস বলে। “যাও, শুয়ে পড় আর দেরি না করে।

“ডাক্তারের আদেশ?” রাচেল স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে।

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা,” সে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে। “আমি অসম্ভব ক্লান্ত। আর গেজ তো আজ রাতে জ্বালাবেই, আমাদেরও জাগাবে। তুমি আসছো?”

সে খানিকটা ইতস্তত করে। “না, এখনই না। স্ট্রিটের ওপারের বুড়ো। “ “মফস্বল এলাকায় এরকম স্ট্রিটকে রোড বলে। অথবা জাডসন ক্র্যান্ডালের উচ্চারণে বললে রাড।

“আচ্ছা, রাডের ওপারে। উনি আমাকে বিয়ারের দাওয়াত দিয়েছেন। মনে হচ্ছে উনার দাওয়াত আমি গ্রহণ করব। আমি ক্লান্ত, তবে অস্থির লাগছে। তাই এখনই ঘুমাবো না।”

রাচেল মৃদু হাসে। “দাওয়াতে গিয়ে দেখবে নরমা ক্র্যান্ডাল তোমাকে তার কোথায় কোথায় ব্যথা আর তিনি কেমন জাজিমে ঘুমান সেসব বলছেন।”

লুইস হাসে আর ভাবে, ব্যাপারটা কী হাস্যকর, ভয়ঙ্কর যে বউরা কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামীদের মন পড়ে ফেলতে পারে।

“আমাদের বিপদে তিনি আমাদের পাশে দাড়িয়েছিলেন,” সে বলল। “আমারো তাকে কিছু সাহায্য করা উচিত বলেই আমার মনে হচ্ছে।”

“আগেকার দিনের বিনিময় প্রথা?”

সে কাঁধ ঝাঁকালো। সে যে ক্র্যান্ডালকে অল্পতেই পছন্দ করে ফেলেছে ব্যাপারটা সে স্ত্রীকে বলতে চাচ্ছে না, কিভাবে বলবে তা-ও বুঝতে পারছে না।

“ওনার স্ত্রীটা কেমন?”

“খুব মিষ্টি স্বভাবের মহিলা,” রাচেল বলে। “ গেজ ওনার কোলে একদম দিঘীর শান্ত জলের মত বসে ছিল। আমি অবাক হয়েছি কারণ এমনিতেই ওর দিনটা খুব খারাপ গেছে, আর তুমি তো জানোই ও চমৎকার পরিস্থিতিতেও অল্প সময়ে নতুন লোকদের পছন্দ করে না। তাছাড়া ওনার একটা পুতুল উনি এলিকে খেলতে দিয়েছিলেন।”

“ ওর বাতের ব্যথা কেমন দেখলে?”

“বেশ খারাপ।”

“হুইল চেয়ারে?”

“না…তবে তিনি খুব ধীরে নড়াচড়া করেন। আর ওনার আঙুলগুলো…” রাচেল তার আঙুলগুলো বড়শির মতো বাঁকা করে পাখির থাবার মতো ভঙ্গি করে বোঝায়। লুইস মাথা ঝাঁকায়। “যাই হোক, দেরি করবে না, লু। অচেনা বাড়িতে আমার গা ছমছম করে।”

“বেশিদিন অচেনা থাকবে না,” লুইস কথাটা বলে তাকে চুম্বন করে।

অধ্যায় ৬

বাসায় ফেরার পর লুইসের নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। সেখানে কেউ তাকে নরমা ক্র্যান্ডালের অসুখ পরীক্ষা করে দেখতে বলেনি। যখন সে রোড (রোড, সে নিজেকে মনে করিয়ে মৃদু হাসে) পার হয়ে ও বাড়ি যায় ততক্ষণে ভদ্রমহিলা ঘুমিয়ে পড়েছেন। সামনের ঘেরা বারান্দার জাল জাল স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে জাডকে দেখা যাচ্ছিল অস্পষ্ট ছায়ামূর্তির মতো। মেঝেতে বিছানো পুরনো লিনোলিয়ামের ওপর রকিং চেয়ারের আরামদায়ক ক্যাচক্যাচ শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। লুইস স্ক্রিন দরজায় নক করলে দরজাটা অমায়িকভাবে সেটার ফ্রেমের মধ্যে কেঁপে ওঠে। ক্র্যান্ডালের সিগারেটটা গ্রীষ্মের রাতের আধারে মস্ত একটা লাল জোনাকির মতো জ্বলজ্বল করছে। একটা রেডিও থেকে রেডসক্স টিমের খেলার ধারাভাষ্যের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। সবকিছু মিলে লুইসের নিজের বাড়ি ফেরার অদ্ভুত একটা অনুভূতি তৈরি হয়।

“ডাক্তার,” ক্র্যান্ডাল বললেন। “আমি ভেবেছিলাম তুমিই হবে।”

“বিয়ারের দাওয়াতটা মিছেমিছি দেননি তো?” লুইস ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে।

“ওহ! বিয়ারের ব্যাপারে আমি কখনো মিথ্যা বলি না।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “যে বিয়ার নিয়ে মিথ্যা বলে তার শত্রু বাড়ে। বসো ডাক্তার। আমি তোমার কথা ভেবেই কিছু বাড়তি বরফ দিয়েছিলাম, বিয়ার বেশি সময় ধরে ঠান্ডা রাখতে।”

সরু হলেও বেশ লম্বা বারান্দাটা বেতের চেয়ার আর সোফা দিয়ে সাজানো। লুইস সেগুলোর একটায় গা এলিয়ে দেয়। তবে সেটা যে এতই আরামদায়ক হবে সে ভাবেনি। ওর বামে একটা বরফের কিউব ভরা বালতিতে কয়েক ক্যান ব্ল্যাক লেবেল। সে একটা নেয়।

“থ্যাংক ইউ,” বলে সে ক্যানটা খোলে। দুই ঢোক গিলেই তার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।

“আরে খাও খাও,” ক্র্যান্ডাল বলল। “আশা করি এখানে তোমার ভালোই লাগবে।”

“চিয়ার্স,” লুইস বলে।

“বিস্কিট খাবে নাকি? বাসায় খুব ভালো মানের ইঁদুরের টুকরোও আছে।”

“কিসের টুকরা?”

“ইঁদুর চিজের টুকরো।” ক্র্যান্ডাল বলে বেশ মজা পান।

“ধন্যবাদ, তবে বিয়ারেই চলবে আমার।”

“তাহলে বাদ দেই।” ক্র্যান্ডাল তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন।

“আপনার স্ত্রী শুয়ে পড়েছে না কি?” ক্র্যান্ডালের কিছুক্ষণ আগে দরজা খোলার ভঙ্গি দেখে লুইস জিজ্ঞেস করলো।

“হুম। ও মাঝে মাঝে আমার সাথে বসে, কখনও আগেই শুয়ে পড়ে।”

“ওনার বাতের ব্যথা খুব বেশি তাই না?”

“এমন কোনো রোগি দেখছো যার কম ব্যথা?” ক্র্যান্ডাল জিজ্ঞেস করল।

লুইস মাথা নাড়ে।

“আমার মনে হয় ওর ব্যথাটা ও সহ্য করতে পারে।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “ওর এ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। আমার বুড়ি খুকি খুব ভালো।” তার কণ্ঠে গাঢ় আবেগ। সামনের রুট-১৫ দিয়ে একটা তরলবাহী ট্যাংকার ট্রাক গুঞ্জন করতে করতে চলে যায়। ট্রাকটা এতো বড় আর লম্বা যে কয়েক মুহূর্তের জন্যে রাস্তার ওপাশে নিজের বাড়িটা লুইসের চোখের আড়াল হয়ে যায়। প্রায় মুছে যাওয়া দিনের শেষ আলোয় ট্রাকের গায়ে অরিনকো লেখাটা পড়া গেল।

“বিশাল ট্রাক,” লুইস মন্তব্য করল।

অরিনকো কারখানাটা অরিংটনের পাশেই।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “রাসায়নিক সার কারখানা। রাতভর এগুলি আসা যাওয়া করে। আরো আছে; তেলের ট্যাঙ্কার, ময়লার ট্রাক, আর সেসব লোকজনের গাড়ি, যারা ব্যাঙ্গর বা ব্রুয়ারে দিনে কাজ করতে গিয়ে রাতে ফেরে।” তিনি তার মাথা নাড়লেন। “লাডলোর এই একটা ব্যাপার আমি আর একদমই পছন্দ করি না। এই বালের রাস্তাটা। শান্তি নষ্ট। দিন রাত চলছে তো চলছেই। প্রায়ই নরমার ঘুম ভেঙে যায়। মাঝে মধ্যে আমার ঘুমই ভেঙে যায়, যেই আমি কি না মরা কুত্তার মতো ঘুমাই।”

লুইস শিকাগোর কনস্ট্যান্ট রোড পেরিয়ে ভেবেছিল মেইনের এই অদ্ভুত জায়গাটা ভয়ঙ্কর নির্জন। সে ক্র্যান্ডালের কথায় সায় দিয়ে শুধু মাথা ঝাকায়।

“একদিন আরবরা তেল দেয়া বন্ধ করে দেবে। তখন এই আজাইরা রাস্তাটার ঠিক মাঝখানে আফ্রিকান ভায়োলেটের চাষ করা যাবে।” ক্র্যান্ডাল বললেন।

“হয়তো ঠিকই বলেছেন।” লুইস ওর ক্যানটা কাত করে ধরতেই বুঝতে পারে সেটা খালি।

ক্র্যান্ডাল হেসে উঠলেন। “আরেকটা মেরে দাও, ডাক্তার।”

লুইস ইতস্তত করে বলল, “ঠিক আছে, তবে এই শেষ। যেতে হবে আমাকে।

“তা তো অবশ্যই। বাড়ি বদল করা বিরাট যন্ত্রণা, কি বল?”

“ঠিক,” লুইস সম্মতি জানায়, এবং কিছুক্ষণের জন্যে তারা একদম নীরব হয়ে বসে থাকে। নীরবতাটা আরামদায়ক ছিল, যেন তারা বহুদিনের পরিচিত। এটা এমন একটা অনুভূতি যেটা লুইস বইয়ে পড়লেও আগে কখনো অনুভব করেনি। কিছুক্ষণ আগের ফ্রি চিকিৎসা নিয়ে তার ভাবনার জন্যে এখন তার লজ্জা লাগছে।

সামনের রাস্তা দিয়ে একটা সেমি ট্রাক গর্জন করতে করতে দূরে ছুটে যায়, সেটার লাইটগুলো আকাশের তারার মতো মিটমিট করতে থাকে।

“খুব বড় রাস্তা এটা।” ক্র্যান্ডাল দুশ্চিন্তার সাথে বলেন, আনমনে, তারপর তিনি লুইসের দিকে ফিরেন। তার মুখে অদ্ভুত একটা মৃদু হাসি। তিনি নিজের হাসি মুখে একটা চেস্টারফিল্ড বিড়ি ঠুকে, বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ম্যাচ জ্বালালেন।

তোমার পিচ্চি মেয়েটা যে পথটার কথা বলছিল তোমার মনে আছে?”

লুইস প্রথমে মনে করতে পারছিল না; এলি সারাদিন হাজারো ব্যাপারে কথা বলতে বলতে অবশেষে বিছানায় গিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে সেই ঘাস ছেটে বানানো পথটার কথা, যেটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের ওপর চলে গেছে।

“হ্যাঁ, মনে আছে। আপনি ওকে কথা দিয়েছেন যে ওটার ব্যাপারে ওকে একসময় বলবেন।”

“কথা দিয়েছি এবং আমি সে কথা রাখবো।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “পথটা বনের মধ্যে দিয়ে প্রায় দেড় মাইল পর্যন্ত গেছে। রুট-১৫ আর মিডল ড্রাইভের স্থানীয় বাচ্চাকাচ্চারা রাস্তাটা দেখাশোনা করে কারণ ওরাই আসলে রাস্তাটা ব্যবহার করে। বাচ্চাকাচ্চারা আসে আর যায়… আমি যখন ছোট ছিলাম তখনকার চাইতে এখন মানুষ বাড়িঘর বদলায় খুব বেশি; আগে লোকে একটা জায়গা বেছে নিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যেতো। তবে ছোটরা একে অপরকে রাস্তাটার ব্যাপারে জানিয়ে দেয় বলেই আমার ধারণা, আর প্রতি গ্রীষ্মে তাদের কয়েকজন মিলে রাস্তার আগাছা সাফ করে। পুরো গ্রীষ্ম জুড়েই ওরা রাস্তাটা সাফ রাখে। শহরের বড়দের অনেকেই ওখানে কী আছে জানে না। অবশ্য অনেকেই জানে, তবে একটা বড় অংশই জানে না কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে ছোটরা সবাই জানে।

“কী আছে ওখানে?”

“পেট সেমেটারি,” ক্র্যান্ডাল বললেন।

“পোষা প্রাণীদের গোরস্থান,” লুইস অবাক হয়ে বলে।

“ব্যাপারটা যতটা অস্বাভাবিক শোনায় আসলে ততটা না,” রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে বিড়িতে টান দিয়ে ক্র্যান্ডাল বললেন। “সব দোষ ওই রাস্তাটার। রাস্তাটা প্রচুর জানোয়ার গিলে খায়। বেশির ভাগই কুকুর বেড়াল, তবে আরো জিনিস আছে। রাইডার পরিবারের বাচ্চাদের একটা পোষা রেকুন ঐ রকম একটা অরিনকো ট্রাকের নিচে পিষে মরে। সেটা ছিল…হুম…’৭৩ এ, অথবা তারও আগে। রাজ্য সরকার যখন রেকুন বা পোষা ভোঁদড় পর্যন্ত পালা নিষিদ্ধ করল, তার আগে তো অবশ্যই।”

“সরকার এটা কেন করলো?”

“জলাতঙ্ক,” ক্র্যান্ডাল বললেন।” মেইন শহরে এখন জলাতঙ্কের খুব ভয়। কয়েক বছর আগে রাজ্যের ভেতরের দিকে সেন্ট বার্নার্ড জাতের একটা বিরাট কুকুরের জলাতঙ্ক হয়। কুকুরটা চারজন মানুষকে খুন করে। খুব মাতামাতি হয়েছিল ঘটনাটা নিয়ে। কুকুরটাকে ওর মালিক ভ্যাক্সিন দেয়নি যদি ওর মালিকেরা ওটাকে ভ্যাক্সিন দেয়াতো তাহলে এরকম হতো না। তবে রেকুন অথবা ভোঁদড়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। তুমি বছরে দু’বার করে ভ্যাক্সিন দিলেও মাঝে মধ্যে তাতে কাজ হয় না। তবে রাইডারদের বাচ্চাদের রেকুনটা খুব ভদ্র ছিল। নাদুস নুদুস রেকুনটা হেলতে দুলতে তোমার একদম কাছে চলে আসবে আর কুকুরের মতো মুখ চেটে দেবে। ওদের বাবা এক পশু ডাক্তারকে দিয়ে অপারেশন করিয়ে ওটার হাতের নখ ভেতর থেকে ফেলে দেন চিরদিনের জন্যে আর ডিম্বাশয় সরিয়ে ফেলেন যাতে বাচ্চা না দেয়। ওই অপারেশনে নিশ্চয়ই রাজ্যের টাকা খরচ যায় তার!”

“রাইডার লোকটা ব্যাঙ্গর শহরে আইবিএম-এ চাকরি করতো। তারা কলোরাডোতে চলে যায় বছর পাঁচেক আগে…ছয় বছরও হতে পারে। এখন বাচ্চাগুলোর ড্রাইভিং শেখার বয়স হয়ে গেছে ভাবলেই অবাক লাগে। রেকুনটার মৃত্যুতে ওরা একদম ভেঙে পড়েছিল। মেটি রাইডার এত লম্বা সময় ধরে কেঁদেছিল যে ছেলেটির মা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমার বিশ্বাস ও এতো দিনে ঠিকই মানিয়ে নিয়েছে, কিন্তু মনে ঠিকই রেখেছে। প্রিয় পোষা প্রাণী মারা গেলে ছোটরা কখনো ভুলে না।”

লুইসের এলির কথা মনে পড়ে যায়। আজকে রাতে এলিকে সে শেষ দেখেছে ওর নতুন রুমে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে আর ওর বিছানায় পায়ের কাছে চার্চ পুরর্ পুরর্ করছে।

“আমার মেয়েটার একটা বিড়াল আছে,” সে বলল। “উইনস্টন চার্চিল আমরা ছোট করে চার্চ ডাকি।”

“চার্চেরটা ফেলে দিয়েছো না কি আছে?”

“বুঝতে পারিনি কী বললেন…” লুইস বৃদ্ধের কথার আগা মাথা কিছুই ধরতে পারে না।

“ওর বীচি আছে না ফেলে দিয়েছো?”

“না,” লুইস বলল, “ওরটা ফেলে দেইনি।”

তবে চার্চকে নিয়ে শিকাগোতেও কিছু সমস্যা হয়েছে। রাচেল চাচ্ছিল বিড়ালটাকে পশু ডাক্তার দিয়ে খাসি করিয়ে ফেলতে; এমন কি ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্টও করা হয়েছিল। লুইসই সেটা বাতিল করে। তবে এখনো তার মাথায় আসে না ঠিক কেন সে সেটা বাতিল করেছিল। অনেকে বোকার মতো বলতে পারে সে ওই হুলো বিড়ালটার মধ্যে নিজের পৌরুষত্বের ছায়া দেখেছিল বা পাশের বাড়ির মুটকি মহিলার ময়লার পোটলা ঠিকঠাকভাবে না রাখার দায়ে বিড়ালটাকে খোজা করাটা সে একদম মেনে নিতে পারছিল না। ওই সিদ্ধান্তের পেছনে এসব কারণেরও কিছুটা অবদান ছিল, তবে আসল কারণটা ছিল ভিন্ন। ওই কাজটা করলে বিড়ালটার মধ্যে থেকে একটা জিনিস নষ্ট হয়ে যেত যেটা সে নিজে খুব মূল্যায়ন করে, সেটা হচ্ছে বিড়ালটার সবুজ চোখে “মারা খাও” মার্কা কঠিন চাহনিটা। শেষে সে রাচেলকে বুঝায় তারা মফস্বল এলাকায় চলে যাচ্ছে, সেখানে ওকে নিয়ে আর সমস্যা হবে না। আর এখন জাডসন ক্র্যান্ডাল তাকে বলছে এখানে বসবাস করা মানে রুট ১৫’র সাথে মানিয়ে চলা, আর তাই তাকে জিজ্ঞেস করছে তার বিড়ালের বীচি ফেলা হয়েছে কি না। ডক্টর ক্রিড, দেখো জীবন কিভাবে বিদ্রূপ করছে তোমার সাথে, এই বিদ্রূপ ভিটামিনের মতোই উপকারী

“আমি তোমার জায়গায় হলে ওটাকে খাসি করিয়ে আনতাম,” বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনীর মধ্যে সিগারেটটা পিষে ফেলতে ফেলতে ক্র্যান্ডাল বললেন। খাসি করা বেড়াল বেশি ঘোরাঘুরি করে না। তবে বিড়ালটা যদি সারাদিন রাস্তার এপাশ ওপাশ করে, তাহলে একদিন হয়তো ঘটনা ঘটে যাবে আর শেষে ওটার জায়গা হবে রাইডার বাচ্চাদের রেকুন, পিচ্চি টিমি ডিসলারের স্পেনিয়্যাল কুকুর আর মিসুস ব্রাডলির টিয়ার সাথে। টিয়াটা যদিও রাস্তায় চাপা খেয়ে মরেনি, এমনিতেই একদিন ওপরের দিকে পা তুলে পটল তুলেছিল।”

“ব্যাপারটা ভেবে দেখবো,” লুইস বলল।

“ভাবো,” বলে ক্র্যান্ডাল উঠে দাঁড়ালো। “তোমার বিয়ারের কী অবস্থা?

আমি যাই, এক স্লাইস মিস্টার র‍্যাট খেয়েই নেই।”

“বিয়ার শেষ,” লুইসও উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, “আমারো যেতে হবে। কালকে একটা বিশেষ দিন।”

“কালকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করছো?”

লুইস মাথা নাড়ে। “ছাত্রছাত্রিরা আসতে আসতে আরো দু সপ্তাহ। তবে তারা আসার আগেই আমার কাজ বুঝে নেয়া উচিত, কী বলেন?”

“হ্যা। তুমি যদি দরকারের সময় কোথায় কি আছে হাতড়ে মরো তাহলে বিপদ হবে।” ক্র্যান্ডাল হাত বাড়িয়ে দিলে লুইস সেটা ধরে মৃদুভাবে ঝাঁকায়। সে মনে মনে ভাবে বুড়োদের হাড্ডিতে অল্পতেই ব্যথা লাগে।

“যে কোনো দিন বিকেলে চলে এসো,” তিনি বললেন। “তোমার সাথে নরমার পরিচয় করিয়ে দিবো। ও তোমাকে পছন্দ করবে।”

“আচ্ছা আসবো,” লুইস বলে। “আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল।”

“আমারো। জায়গাটা ভালোই লাগবে তোমার। হয়তো বেশ কিছুদিন থেকেও যাবে।”

“আমারও তাই ইচ্ছে।”

লুইস জাডের বাড়ির হিজিবিজি নকশা করা বাঁধানো পথ দিয়ে সড়কটার কাছে হেটে আসার পর দাড়িয়ে যায়। তার সামনে সড়কটা দিয়ে একটা ট্রাক আর তার পেছনে ৫টা গাড়ি লাইন ধরে বাক্সপোর্টের দিকে চলে যায়। তারপর সে তার হাত তুলে স্যালুটের মতো করে রোড (রাড, সে নিজেকে আবারো মনে করিয়ে দিল) পেরিয়ে তার নতুন বাসায় ঢুকে পড়ে।

বাসায় ঘুমের গুঞ্জনের নিস্তব্ধতা। এলিকে দেখা গেল একফোঁটাও নড়েনি আগের জায়গা থেকে, গেজ ঘুমাচ্ছিল তার বেড় দেয়া শিশু বিছানায়, তার চিরচেনা ঘুমের পজিশনে; ঈগল পাখির মতো দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে, দুধের ফিডারটি একদম নাগালেই। লুইস সেখানে কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়িয়ে তার ছেলের দিকে চেয়ে থাকে। ছেলের জন্যে তীব্র মমতায় তার মন দ্রবীভূত হয়, আবেগটা এতো তীব্র যে সেটাকে প্রায় বিপজ্জনক লাগছিল। সে ভাবে এর কারণ হতে পারে তাদের আগের বাড়ির প্রতি, আশেপাশের মানুষগুলো আর চেনা জায়গাগুলোর প্রতি গভীর টান। মাইলের পর মাইল পাড়ি দেয়ায় সেগুলো যেন তাদের মন থেকে এমনভাবে হারিয়ে গিয়েছে যেন পূর্বে তাদের কোন অস্তিত্বও ছিল না। বাচ্চা কাচ্চারা আসে আর যায়…এখন মানুষ বাড়িঘর বদলায় খুব বেশি; আগে লোকে একটা জায়গা বেছে নিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যেতো। কথাটা ঠিকই।

সে তার ছেলের কাছে এগিয়ে যায়, আর যেহেতু আশেপাশে দেখার কেউ নেই, এমনকি রাচেলও না, বিছানার চারপাশের বারের ফাক দিয়ে সে বাবুর আঙুলগুলিতে চুমু খেয়ে সেগুলি গেজের গালে মৃদু চেপে আদর করে দেয়। গেজ ঘুমের মাঝেই কোঁ কোঁ করে পাশ ফেরে।

“ঘুমাও বাবা,” লুইস বলল।

***

সে নিঃশব্দে জামা ছেড়ে তার বিছানার অর্ধেকে অংশে শুয়ে পড়ে। বিছানা বলতে আপাতত দুটো সিঙ্গেল জাজিম মেঝেতে ঠেলে একসাথে করা। সে অনুভব করল যে সারাদিনের টনটনে চাপ তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। রাচেল নড়ে না। রুমের মধ্যে খোলা বক্সগুলো ভূতুড়েভাবে স্তুপ করা। ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সে নিজের কনুইয়ে ভর দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। রুমটা তাদের বাড়ির সামনের দিকে, তাই সে এখান থেকে রাস্তার ওপারে ক্র্যান্ডালদের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে। বাইরে গাঢ় অন্ধকারে কোনো ছায়ামূর্তিও দেখা যাচ্ছে না, হয়তো পূর্ণিমা হলে দেখা যেতো, তবে সে একটা সিগারেটের আগুনের বিন্দু দেখতে পাচ্ছিল। এখনো জেগে আছে, সে ভাবে, তিনি হয়তো অনেক রাত অবধি জাগবেন। বুড়োদের ঘুম হয় না, হয়তো তারা জেগে জেগে পাহারা দেয়।

কিসের পাহারা দেয়?

লুইস ভাবতে ভাবতেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। স্বপ্নে দেখলো, সে ডিজনিল্যাণ্ডে একটা রেড ক্রসের চিহ্নওয়ালা ভ্যান গাড়ি চালাচ্ছে। গেজ তার পাশে বসে আছে যার বয়স হবে কমপক্ষে দশ। গাড়ির সামনে ড্যাশবোর্ডে বসে থাকা চার্চ লুইসের দিকে তার উজ্জ্বল সবুজ চোখে তাকিয়ে আছে। আর ১৮৯০-এর ট্রেন স্টেশনের পাশের মেইন স্ট্রিটে মিকি মাউস তাকে ঘিরে থাকা বাচ্চাদের সাথে হ্যান্ডশেক করছে। তার মস্ত বড় কার্টুনিশ গ্লাভসগুলো বাচ্চাদের ছোট্ট হাতগুলোকে যেন গিলে গিলে খাচ্ছে।

অধ্যায় ৭

পরের দুই সপ্তাহ ক্রিড পরিবারের খুব ব্যস্ততার মাঝে কাটে। ধীরে ধীরে লুইস তার নতুন চাকরিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ হাজার শিক্ষার্থী, যাদের অনেকেই মাদক আর মদে আসক্ত, কেউ যৌন রোগে আক্রান্ত, কেউ ফলাফল নিয়ে উদ্বিগ্ন, আবার কেউ প্রথমবারের মতো বাড়ি ছেড়ে আসার কারণে বিষণ্ন; অনেকে, বিশেষ করে ছাত্রিরা ক্ষুধা মন্দায় ভুগছে…এরা সবাই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রিত হয়, তখন সেখানে ডাক্তার হিসেবে যতটুকু অভ্যস্ত হওয়া যায় আর কি। আর লুইস যখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মেডিকেল অফিসার হিসেবে তার দায়িত্ব বুঝে নিতে থাকে, রাচেল বাড়িটার হাল ধরে।

গেজ নতুন বাসায় অভ্যস্ত হওয়ার বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কিছুদিনের জন্যে তার রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার রুটিনটা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তবে দ্বিতীয় সপ্তাহের মাঝে এসে সে আবারো এক ঘুমে রাত কাবার করে দিতে শুরু করে। তবে এলি, নতুন জায়গায় নতুন স্কুল শুরু করার ভাবনায় সবসময়ই উত্তেজিত হয়ে আছে। সে অল্পতেই হাসতে হাসতে প্রায় ফিট হয়ে যাচ্ছে, আবার সামান্য কারণেই রেগে মেগে আগুন হয়ে যাচ্ছে। রাচেল লুইসকে বলেছে এলি যখন দেখবে ওর নতুন স্কুল ওর কল্পনার মতো কোনো নরকের গর্ত না, ও ঠিক হয়ে যাবে। লুইসের ধারণা রাচেলের কথাই ঠিক। কারণ এলি একদম শুরু থেকেই খুব মিষ্টি একটা মেয়ে।

বিকেলে জাড ক্র্যান্ডালের সাথে বিয়ার পান করাটা তার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যখন গেজের ঘুমের সমস্যা দূর হয়, তখন লুইস দু-তিন রাত পরপর নিজেও সিক্স প্যাক নিয়ে জাডদের বাড়িতে হাজির হতে শুরু করে। নরমা ক্র্যান্ডালের সাথেও তার পরিচয় হয়। খুবই মিষ্টি স্বভাবের মহিলা। তিনি গিট ফোলানো বাতের ব্যথায় আক্রান্ত জঘন্য রকমের গিট্ ফোলানো বাতের ব্যথা, যা কি না বয়সকালের যা কিছু ভালো, তার অনেককিছুই বিষাদ করে দেয়—তবে এই ব্যাপারে তার মনোভাব বেশ ভালো। উনি কিছুতেই বাতের ব্যথার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না; কোনো সাদা পতাকা তিনি ওড়াবেন না। যা হয় হোক। লুইস ভাবল তার সামনে হয়তো আরো পাঁচ থেকে সাত বছর কার্যক্ষম বছর রয়েছে, যদিও সেগুলো খুব আরামের হবে না।

সে নিজের তৈরি করা নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজে থেকেই গরজ দেখিয়ে মহিলার অসুখ পরীক্ষা করে দেখে। এরপর ওনার ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশনগুলো একত্রে গুছিয়ে ফাইল বানালো এবং পড়ে দেখলো যে সব ঠিকঠাকই আছে। তার নিজের একটু হতাশাই লাগে যে সেখানে তার আর কিছু করার বা পরামর্শ দেয়ার মতো কোনো সুযোগই ছিল না। ওনার চিকিৎসক ডা: ওয়েব্রিজ সব ঠিকভাবেই দেখাশোনা করছেন, যতটুকু নরমা ক্র্যান্ডালের মত রোগির জন্যে করা সম্ভব। হয়তো হঠাৎ কোন ব্রেকথ্র হয়ে তার রোগ ভালোর দিকে গেলেও যেতে পারে, তবে সেটার ওপর তো আর ভরসা করলে চলে না। এসব মেনে নিতে শিখতে হয়, নাহলে তোমার শেষ পরিণতি হবে কোনো ছোট্ট রুমের চার দেয়ালের ভেতরে, যেখান থেকে মোমের রং পেন্সিল দিয়ে তুমি বাসায় চিঠি লিখে যাবে।

রাচেল উনাকে বেশ পছন্দ করেছে। তারা তাদের বন্ধুত্ব অফিসিয়ালি সিলমোহর করে তাদের রান্নার রেসিপি দেয়া-নেয়া করে, যেমনটা ছোট বাচ্চারা তাদের প্রিয় খেলোয়াড়ের ছবির কার্ড লেনদেন করার মাধ্যমে করে থাকে। এই লেনদেন শুরু হয় নরমা ক্র্যান্ডালের আপেলের পিঠা আর রাচেলের গরুর গোশতের রেসিপি দিয়ে। নরমা ক্রিডদের দুই বাচ্চাকেই খুব পছন্দ করলেন, বিশেষ করে এলিকে। তার মতে এলি বড় হয়ে দেখতে হবে রূপকথার রূপসীদের মতো। লুইস সেদিন রাতে রাচেলকে বিছানায় বলেছিল, অন্ততঃপক্ষে উনি বলেন নাই যে এলি বড়ো হলে অনেক মিষ্টি একটা রেকুনের মতো হবে। রাচেল এমনভাবে হাসলো যে সে হাসতে হাসতে সশব্দে বায়ু ছাড়ে। আর তারপর দুজনে মিলে যেভাবে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠে তাতে পাশের রুমে ঘুমন্ত গেজ জেগে ওঠে কেঁদে।

এলির স্কুলের প্রথম দিন চলে আসে। লুইস ততদিনে তার হাসপাতাল এবং চিকিৎসা সেবাগুলোর দায়িত্ব বেশ ভালোভাবে গুছিয়ে এনেছে। তাই সে দিনটা ছুটি নিয়ে নেয়। তাছাড়া হাসপাতাল এখন গড়ের মাঠ, সর্বশেষ রোগি যে কি না স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সিঁড়িতে পা ভেঙেছিল, গত সপ্তাহেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়।

লুইস লনে গজকে কোলে নিয়ে রাচেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, যখন মস্ত হলুদ বাসটা হেলতে দুলতে তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। বাসের সামনের দরজা খুলে গেলে মধ্য সেপ্টেম্বরের বাতাসে বাচ্চাদের কলরব আর হৈচৈয়ের আওয়াজ ভেসে আসে।

এলি তাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে করুণভাবে তাকায়, যেন বাবা- মাকে সে জিজ্ঞেস করতে চায় এই অবশ্যাম্ভাবী প্রক্রিয়াটা কি কোন ভাবেই বন্ধ করা যায় না? হয়তো তার বাবা-মার মুখভঙ্গিতে সে যা দেখলো তাতেই সে উপলব্ধি করলো তা আর সম্ভব নয় এবং আজকের দিন থেকে যা ঘটতে যাচ্ছে তা সবই মেনে নিতে হবে-ঠিক যেমন নিজের বাতের ব্যথা নরমা ক্র্যান্ডালকে মেনে নিতে হয়েছে।

এলি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বাসের সিঁড়িতে ওঠে। ড্রাগনের নিশ্বাসের মতো শব্দ করে বাসের দরজাটা লেগে যায়। বাসটা চলতে শুরু করলে রাচেল কান্নায় ফেটে পড়ে।

“কেঁদো না, ঈশ্বরের দোহাই লাগে,” লুইস বলে। সে নিজেও দাঁত চেপে নিজের কান্না চেপে রেখেছে। “সবে তো দিনের মাত্র অর্ধেকটা গেছে।”

“অর্ধেক দিনই যথেষ্ট,” রাচেল ঝাড়ি দিয়ে আরো প্রবল বেগে কাঁদতে থাকে। লুইস তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। গেজ নিজের দুই হাত দিয়ে দুজনের গলা জড়িয়ে ধরে। সাধারণত রাচেল কাঁদলে গেজও কাঁদে। তবে আজ গেজ কাঁদলো না। সে আমাদের দুজনকেই সম্পূর্ণ নিজের করে পেয়েছে, লুইস ভাবলো, এবং সে এটা খুব ভালো করেই জানে।

***

তারা এলির ফেরার জন্যে চিন্তিতভাবে অপেক্ষা করছে, প্রচুর কফি গিলছে আর জল্পনা করছে কিভাবে এলির প্রথম দিনটা যাচ্ছে। লুইস পেছনের রুমে যায়, যেটা তার অফিস হবে। সেখানে সে করার কিছু না পেয়ে কিছু কাগজের স্তুপ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উদ্দেশ্যহীনভাবে নড়াচড়া করতে থাকে। রাচেল সময় হওয়ার অনেক আগেই লাঞ্চ শুরু করে দেয়।

সোয়া দশটার দিকে ফোন বেজে উঠলে রাচেল ছো মেরে রিসিভার তুলে নেয়, দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার সুযোগ না দিয়েই। রুদ্ধশ্বাসে সে বলে, “হ্যালো?” লুইস কিচেন আর তার অফিসের মাঝখানের ডোরওয়েতে দাড়িয়ে ভাবে অবশ্যই এলির শিক্ষকের ফোন হবে। তিনি ফোন দিয়েছেন এটা জানাতে যে, এলির দ্বারা স্কুল সম্ভব না; পাবলিক এজুকেশন ব্যবস্থা ওকে হজম করতে না পেরে উগরে দিয়েছে। কিন্তু দেখা গেল আসলে এরকম কিছুই না, নরমা ফোন দিয়েছেন। তিনি বললেন, জাড তাদের সবশেষ কিছু ভুট্টা ক্ষেত থেকে তুলে এনেছে এবং ওরা চাইলে কিছু নিজেদের জন্যেও নিতে পারে। লুইস একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে যায় আর জাডকে বকে কেন সে তাকে ভুট্টা তোলায় সাহায্য করার জন্যে ডাকেনি।

“বাল মার্কা জিনিসগুলো এমনিতেও কোনো কাজে লাগে না,” জাড বলেন।

“অন্তত আমি কাছে থাকলে এসব নোংরা কথা বলবে না,” নরমা বলেন। তিনি আগেকার দিনের একটা কোকাকোলার ট্রেতে করে আইসড টি নিয়ে সামনের বারান্দায় বেরিয়ে আসলেন।

“সরি, মহামান্য বুড়ি।”

“সে এক ফোঁটাও সরি না।” নরমা লুইসকে বললেন। এরপর বসতে গিয়ে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন।

“এলিকে স্কুলবাসে উঠতে দেখলাম,” জাড একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে বলেন।

“ও মানিয়ে নিতে পারবে,” নরমা বললেন। “প্রায় সব বাচ্চারাই পারে।”

প্রায়, লুইস বিষাদের সাথে ভাবে।

***

তবে এলির স্কুল জীবনের প্রথম দিন ভালোই কেটেছে। সে দুপুরে তার নতুন স্কুল ইউনিফর্ম নাচাতে নাচাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বাড়ি ফেরে (যদিও তার হাঁটুতে একটা নতুন আচড়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে)। ওর হাতে একটা ছবি, যেটায় দুইটা পিচ্চিকে দেখা যাচ্ছে যারা একটা স্টিলের ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে পাশাপাশি হেটে যাচ্ছে। এলির একটা জুতোর ফিতে খোলা, একটা চুলের ফিতে নিখোঁজ। “আমরা আজকে ‘ওল্ড ম্যাকডোনাল্ড’ গানটা গেয়েছি! বাবা! মা! আমরা ‘ওল্ড ম্যাকডোনাল্ড’ গেয়েছি, ঠিক ক্র্যাস্টেয়ার্স স্ট্রিট স্কুলের মতো!”

রাচেল লুইসের দিকে তাকায়, যে কি না জানালার পাশে গেজকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বাবুর তখন ঘুম ঘুম অবস্থা। রাচেলের চাহনিতে একটা বিষাদ ছিল, যদিও সে খুব দ্রুত তার নজর ফিরিয়ে নেয় তবুও লুইস বুঝতে পারে এবং লুইস হঠাৎ মারাত্মক আতঙ্কিত বোধ করে। আমরা বুড়িয়ে যাচ্ছি। এটা আসলেই সত্য। আমাদের বেলায় এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না। রাচেল বুড়িয়ে যাচ্ছে…এবং আমরাও।

এলি লুইসের দিকে ছুটে আসে এবং তাকে একই সাথে তার আঁকা ছবি, নতুন করে ছিলে যাওয়া হাঁটু, ‘ওল্ড ম্যাকডোনাল্ড’ আর মিসেস বেরিমেনের ব্যাপারে বলতে শুরু করল। চার্চ ওর দুপায়ের ফাঁক দিয়ে বারবার পাক খাচ্ছিল আর সশব্দে পুরর্ পুরর্ করছে আর এলিও প্রায় দৈবক্রমেই ওকে পায়ের নিচে মাড়িয়ে দিচ্ছে না।

“স্,” লুইস ওকে থামিয়ে চুমু খায়। গেজর তার বোনের এতসব উত্তেজনার কোনো হুশ নেই, সে বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। “আমি বাবুকে শুইয়ে দিয়ে এসে সব শুনছি মামনি।”

সে গেজকে নিয়ে সেপ্টেম্বরের হেলে থাকা রোদের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগে। সিঁড়ি ভেঙে অর্ধেক ওঠার পর এক অজানা আতঙ্ক আর চারদিকের অন্ধকার ওকে এমনভাবে ঘিরে ধরে যে ও একদম ঠায় দাঁড়িয়ে যায় আর চারদিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে হঠাৎ তার সাথে কী হলো এটা। সে গেজকে আরো দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরলে গেজ অস্বস্তিতে নড়ে চড়ে ওঠে। লুইসের হাত আর পিঠের লোম একদম খাড়া হয়ে যায়।

ব্যাপারটা কী? সে আতঙ্কিত এবং হতবাক হয়ে ভাবে। তার মাথার তালুতে শীত লাগছে এবং সে তার চোখের পেছনে এড্রেনালিনের ঢেউ টের পাচ্ছে। প্রচন্ড ভয়ে মানুষের চোখ ভালোভাবে কাজ করে না, সে জানে। ওই অবস্থায় চোখগুলো যে শুধু বড় বড় হয়ে যায় তাই নয়, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায় খুলিতে তরলের বাড়তি চাপে চোখগুলো বাইরের দিকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে। হয়েছেটা কী এখানে? ভৌতিক কিছু? ওহ ঈশ্বর! আমার মনে হচ্ছে কেউ গা ঘেসে চলে গেল। যেন আরেকটু হলেই তাকে চোখে দেখতে পেতাম।

নিচতলার কাছের দরজাটা প্রচন্ড জোরে চৌকাঠের সাথে বাড়ি খায় লুইস ক্রিড লাফিয়ে ওঠে প্রায় চিৎকার করে ওঠে এবং পরক্ষণেই হেসে উঠে। এগুলো সাধারণ সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার যেগুলো মানুষ মাঝে মাঝে অনুভব করে, এর চাইতে কিছু বেশিও না আবার কিছু কমও না। ক্ষনিকের অনুভূতি। এগুলি মাঝে মাঝে হয়, এটুকুই। স্ক্রুজ জেকব মার্লির আত্মাকে কী বলেছিল? তুমি একটা অল্প সিদ্ধ আলুর চাইতে বেশি কিছু না। বরং তোমার চাইতে বেশি ভয় ঐটিতেই। চার্লস ডিকেন্স নিজেও হয়তো জানতেন না যে তিনি কতটা সঠিক বলেছিলেন-শরীরতাত্ত্বিক এবং মনস্তাত্বিক উভয়ভাবেই। ভূত বলতে কিছু নেই, অন্তত তার অভিজ্ঞতায়। সে তার পেশাদারি জীবনে অন্তত দুই ডজন মানুষকে মৃত ঘোষণা করেছে, কিন্তু মৃতদেহ থেকে আত্মার প্রস্থানের মতো কিছুই সে অনুভব করেনি।

সে গেজকে ওর রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ছেলের গায়ে কম্বল টেনে দিতে গেলে তার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে এবং হঠাৎই তার কার্ল চাচার “শোরুম”-এর কথা মনে পড়ে যায়। ওই ‘শোরুম’-এ কোনো নতুন গাড়ি বা ডিশওয়াসার ছিল না। সেখানে ছিল শুধু কফিন। তার সেই চাচা ছিলেন মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থাকারী ব্যক্তি। একজন আন্ডারটেকার।

আজব! কিসে এতো ভয় পাচ্ছ? এসব কিছুই না। এসব ফালতু জিনিস ভাবা বাদ দাও।

সে তার ছেলেকে চুমু খেয়ে নিচতলায় যায় তার মেয়ের স্কুলে প্রথম দিনের গল্প শোনার জন্যে।

অধ্যায় ৮

পরের শনিবার আসতে আসতে এলি তার জীবনের স্কুলের প্রথম সপ্তাহ পার করে ফেলে। আর লুইসের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর সময়ও একদম ঘনিয়ে আসে।

ক্রিড পরিবারের সবাই তাদের বাড়ির সামনের উঠোনে ঘাসের ওপর বসে ছিল যখন জাড ক্র্যান্ডাল রাস্তা পেরিয়ে তাদের কাছে আসে। এলি তার সাইকেল থেকে নেমে আইসড টি খাচ্ছে। গেজ ঘাসের ওপর হামাগুড়ি দিচ্ছে, পোকামাকড় পরীক্ষা করছে এবং তাদের মধ্যে থেকে হয়তো কিছু গিলেও ফেলছে; গেজ কোত্থেকে নিজের প্রোটিন সংগ্রহ করে সেই ব্যাপারে সে খুব উদার।

“জাড,” লুইস উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে।” আপনার জন্যে একটা চেয়ার নিয়ে আসি।”

“লাগবে না।” জাডের পরনে ছিল জিন্স আর শার্ট, আর এক জোড়া সবুজ বুট। উনি এলির দিকে তাকালেন। “ওই পথটা কোথায় যায় দেখতে চাও, এলি?”

“হ্যাঁ!” এলি বলেই সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। কৌতুহলে ওর চোখ চকচক করছে। “স্কুলের জর্জ বাক আমাকে বলেছে ঐটা পেট সেমেটারি। আমি আম্মুকে বলেছি কিন্তু আম্মু বলছে আপনার জন্যে অপেক্ষা করতে। কারণ আপনি জায়গাটা ভালোভাবে চেনেন।”

“হ্যাঁ, চিনি বৈকি,” জাড বললেন। “তোমার বাবা মা রাজি থাকলে আমরা ঐ দিকে হাঁটতে যেতে পারি। তবে তোমার বুট জুতো লাগবে, ওখানকার মাটি জায়গায় জায়গায় কাদা হয়ে থাকে।”

এলি ছুটে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।

জাড ওর দিকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। “তুমিও আসতে পারো, লুইস।”

“আমি যাবো,” লুইস বলে। সে রাচেলের দিকে তাকায়। “তুমি যাবে?”

“গেজকে কী করবো? মাইল খানেক পথ হবে মনে হচ্ছে।”

“ওকে পিঠে গেরিপ্যাকে করে চালান করে দেয়া যায় আমাদের সাথে।”

রাচেল হাসে। “আচ্ছা মিস্টার…পিঠে করে চালান করবে তুমি, আমি না।”

***

দশ মিনিটের মধ্যেই গেজ বাদে বাকিরা পায়ে বুট চাপিয়ে রওনা হয়ে যায়। গেজ লুইসের পিঠে গেরিপ্যাকে চেপে লুইসের ঘাড়ের ওপর দিয়ে চারদিক চোখ বড় বড় করে দেখছে। এলি ফুল তুলতে তুলতে আর প্রজাপতির পিছু পিছু ছুটে সবার থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে।

পেছনের মাঠের ঘাসগুলো ছিল কোমর সমান, আর এখন তার সাথে যোগ হয়েছে নানান গুল্ম আর শেষ গ্রীষ্মের জঙ্গলের চিরচেনা গুনগুন গান যা প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে আসে। তবে আজকের বাতাসে শরতের কোনো ছিটেফোটা নেই; সূর্যটায় এখনো আগস্টের তেজ, যদিও দুই সপ্তাহ আগেই ক্যালেন্ডারে আগস্ট পেরিয়ে গেছে। তারা যখন ঘাস কেটে বানানো রাস্তাটা দিয়ে সাবধানে হেটে হেটে প্রথম টিলাটার মাথায় ওঠে, ততক্ষণে লুইসের বগল ঘামে ভিজে ওঠেছে।

জাড থামলেন। প্রথমে লুইস ভেবেছিল বৃদ্ধ মনে হয় হাঁপিয়ে গেছেন। কিন্তু তার পরই সে তার পেছনের দৃশ্যের দিকে খেয়াল করে।

“এখানে দাঁড়ালে বেশ ভালো ভিউ দেখা যায়,” দাঁতের ফাঁকে একটা ঘাসের ডগা চিবুতে চিবুতে জাড বললেন। লুইসের মনে হলো এরকম উক্তি সে আগে কখনো শোনেনি।

“অসাধারণ,” রাচেল মৃদু কণ্ঠে বলে লুইসের দিকে কিছুটা অভিযোগের সুরে তাকালো। “তুমি এই জায়গাটার ব্যাপারে আগে বলোনি কেন?”

“কারণ আমি নিজেই জানতাম না,” লুইস একটু লজ্জিত কণ্ঠে বলে। তারা এখনো তাদের সম্পত্তির সীমানা পেরোয়নি; আসলে এখানে চড়ার সময়ই পায়নি আজ পর্যন্ত।

এলি অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। এখন সেও ফিরে এসে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। চার্চ এলির গোড়ালিতে আদুরেভাবে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে।

টিলাটা তেমন উঁচু না, তবে তাতে কিছু যায় আসে না। পূর্বদিকে গভীর জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না, তবে পশ্চিমে তাকালে দূরে নিচের জায়গাটাকে স্বর্ণময় এবং কোন শেষ গ্রীষ্মের স্বপ্নের অংশ বলে মনে হয়। সবকিছুই স্থির, নীরব আর ঝাপসা। এমনকি নিস্তব্ধতা ভাঙার জন্যে রাস্তার কোন অরিনকো ট্যাঙ্কারও নেই।

তারা সবাই নদী উপত্যকার দিকেই চেয়ে ছিল; নদীর নাম পেনবস্কট। ওই নদী দিয়েই আগেকার দিনের কাঠ ব্যবসায়িরা গাছের গুড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যেত, উত্তরপূর্ব দিক থেকে ব্যাঙ্গর আর ডেরিতে। তবে এই জায়গাটা ব্যাঙ্গরের দক্ষিণে আর ডেরির সামান্য উত্তরে। প্রশস্থ নদীটা বেশ শান্তভাবে বয়ে চলছে, মনে হয় যেন কোনো গভীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। লুইস দূরের হ্যাম্পটন আর উইন্টারপোর্ট দেখে চিনতে পারে। আর নদীর সমান্তরালে বয়ে চলা রুট ১৫-কেও সাপের মতো একে বেঁকে প্রায় বাকস্পোর্ট পর্যন্ত দেখতে পায় লুইস। তারা নদীর ওপারে সবুজ শ্যামলিমা, রাস্তা আর মাঠ দেখতে পায়। সবুজের শামিয়ানা ভেদ করে নর্থ লাডলো চার্চের মিনার দেখা যাচ্ছে আর ডানে তাকিয়ে লুইস এলির স্কুলের লাল দালান দেখতে পায়।

মাথার ওপরে সাদা মেঘ ধূসর জিন্স রঙের দিগন্তপানে ভেসে চলছে। আর চারদিকে অগণিত শেষ গ্রীষ্মের কটা রঙের মাঠ।

“এরকম দৃশ্যকে অসাধারণ না বলাটা ফৌজদারি অপরাধ,” অবশেষে লুইস বলে।

“এটাকে আগেকার দিনে লোকে সুন্দর টিলা বলতো,” জাড বললেন। তিনি তার ঠোঁটের কোনায় একটা সিগারেট ঠেসে দিলেও সেটা জ্বালালেন না। “কিছু লোকে এখনো বলে। তবে কমবয়সি লোকজন সবাই শহরের দিকে চলে যাওয়ায় এ জায়গাটা বেশিরভাগ লোকেই চেনে না। আমার মনে হয় না খুব বেশি মানুষ এখানে আর ঘুরতে আসে। টিলাটা ছোট বলে মনে হয় যে এখান থেকে তেমন কিছু দেখা যাবে না। তবে দেখতেই পাচ্ছ-” তিনি তার হাত দিয়ে চারদিকে ইশারা করে চুপ করে গেলেন।

“এখান থেকে চারদিকের সবকিছু দেখা যায়,” রাচেল মৃদু, বিমোহিত কণ্ঠে বলে। সে লুইসের দিকে তাকায়। “এই জায়গাটা কি আমাদের?”

লুইসের উত্তর দেয়ার আগেই জাড বললেন, “একদম। এটা ওই বাড়ির সীমানারই অংশ।”

দুটো অবশ্য এক জিনিস না, লুইস ভাবে।

***

জঙ্গলের ভেতর তুলনামূলক ঠান্ডা, তাপমাত্রা অন্তত আট-দশ ডিগ্রী কম। পথটা এখনো বেশ প্রশস্থ, কিছুদূর পর পর টব বা কফির ডিব্বায় ফুল রেখে চিহ্ন দেয়া (ফুলগুলো বেশির ভাগই বাসি)। ঝাউ গাছের সুচালো পাতা পথে বিছানো। তারা যখন প্রায় সিকি মাইল পাড়ি দিয়েছে এবং টিলার নিচের দিকে নামছে তখন জাড এলিকে পেছন থেকে ডাকলেন।

এই জায়গাটা ছোট মেয়েদের হাঁটার জন্যে বেশ ভালো। তবে তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি এখানে আসলে কখনো এই পথ ছেড়ে যাবে না।”

“কথা দিলাম,” এলি সাথে সাথেই উত্তর দেয়। “কিন্তু কেন?”

তিনি বিশ্রামরত লুইসের দিকে তাকালেন। ঝাউ আর দেবদারু গাছের ছায়ার নিচেও গেজকে পিঠে বয়ে নিয়ে চলা বেশ শক্ত কাজ। “তুমি জানো আমরা এখন কোথায় আছি?” জাড লুইসকে জিজ্ঞেস করলেন।

লুইস কিছু উত্তর চিন্তা করে সেসব বাতিল করে দিলো: লাডলো, লাডলো, নর্থ বাড়ির পেছনে। সে মাথা নাড়ে।

জাড় তার বুড়ো আঙুল কাঁধের ওপর তুলে পেছনদিকে নির্দেশ করে বলল, “শহরটা ঐ দিকে। আর এইদিকে জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই নেই, তাও অন্তত পঞ্চাশ মাইল জুড়ে। এটাকে লোকে নর্থ লাডলোর জঙ্গল বলে, তবে অরিঙটনেও কিছু অংশ আছে এটার, তারপর চলে গেছে একদম রকফোর্ড পর্যন্ত। এটার সীমানা শেষ হয়েছে ওই সরকারি জমিতে গিয়ে, যেটার সম্পর্কে তোমাকে বলেছিলাম; যে জমিগুলো ইন্ডিয়ানরা ফেরত চায়। ব্যাপারটা বেশ মজার যে তোমার বিদ্যুতের বাতি, ক্যাবল টিভি আর টেলিফোনওয়ালা বাড়িটা একটা বনের সীমানায়।” তিনি এলির দিকে ফিরে তাকালেন। “এই জঙ্গলে একদম উল্টোপাল্টা ঘোরাঘুরি করবে না। এই জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেললে ঈশ্বরই জানেন কী হবে।”

“আচ্ছা, মিস্টার ক্র্যান্ডাল।” এলি বেশ মুগ্ধ হয়েছে, এমন কি কিছুটা অবাকও হয়েছে। কিন্তু লুইস খেয়াল করল ও একবিন্দু ভয়ও পায়নি। রাচেল জাডের দিকে উৎকণ্ঠিতভাবে তাকিয়ে আছে আর লুইসের নিজেরও কিছুটা দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সে ভাবলো, জঙ্গলের ভীতি হয়ত শহুরেদের অনেকটা সহজাত বৈশিষ্ট্য। বিশ বছর আগে স্কাউটিংয়ে লুইস শেষবারের মতো কোনো কম্পাস ছুঁয়ে দেখেছিল। আর নর্থ ষ্টার বা গাছের গায়ে কোন পাশে শ্যাওলা পড়েছে দেখে দিক চেনাটা তার কাছে ছোট বেলায় শেখা নানান রকমের গিট্ দেয়া শিক্ষার মতই অস্পষ্ট।

জাড ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। “তবে এই জঙ্গলে ১৯৩৪- এর পর থেকে কেউ হারায়নি, অন্তত স্থানীয় কেউ না। শেষ যে লোকটা হারিয়েছিল তার নাম উইল জেপসন-কারো কিছু যায় আসেনি তাতে। আমার মনে হয় উইল তখন এদিককার সবচাইতে বড় মাতাল।”

“স্থানীয় কেউ হারিয়ে যায়নি বললেন, তবে কি স্থানীয় না এমন কেউ—” রাচেল অস্বাভাবিক স্বরে বলে আর লুইস যেন ওর মনের কথাটা বুঝতে পারে: আমরা স্থানীয় না। অন্তত পক্ষে এখনো না।

জাড থেমে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানান। “দুই-তিন বছর পর পর দুই-একজন পর্যটক যে জঙ্গলে হারিয়ে যায় না, তা না। তারা ভাবে, রাস্তার এতো কাছেই তাদের হারিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। তবে হারিয়ে যাওয়া সবাইকেই পাওয়া গেছে শেষ পর্যন্ত, তুমি অস্থির হয়ো না।

“এখানে মুস হরিণ আছে?” রাচেল শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলে লুইস মুচকি হাসে। রাচেল যদি অস্থির হয়, তাহলে সে কোমর বেঁধেই অস্থির হয়।

“হুম, মাঝে মধ্যে দুয়েকটা দেখা যায়, তবে ওরা কোনো ঝামেলা করে না। ওদের মেটিং সিজন আসলে একটু উৎপাত করে তবে অন্য সময় তারা ভদ্রলোক। ওই সময়টা বাদে অন্য সময় তারা শুধুমাত্র ম্যাসাচুসেটস’র লোকজন পেলে দাবড়ানি দেয়। জানি না ওরা কেন এমন করে, তবে এমনটাই দেখেছি সব সময়।” লুইস ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বুড়ো মজা করছে কি না, কারণ জাডকে দেখে সিরিয়াসই মনে হচ্ছে। “বার বার দেখেছি এমনটা। বিভিন্ন লোককে দেখেছি গাছের মাথায় চড়ে চিৎকার করে করে মুস হরিণের পালের কথা বলতে, যাদের এক একটা না কি মিনি ট্রাকের সমান। আর ঐসব দৌড়ানি খাওয়া লোকদের মধ্যে একটাই মিল, তারা সবাই ম্যাসাচুসেটসের। মনে হয় মুস হরিণগুলো লোকজনের গায়ে ম্যাসাচুসেটস’র গন্ধ পায়। আমি চাই কোনো পশু বিশেষজ্ঞ ব্যাপারটা নিয়ে একটা রিসার্চ পেপার লিখুক, তবে মনে হয় না কেউ কাজটা করবে।”

“মেটিং সিজন কী, মা?” এলি জিজ্ঞেস করে।

“কিছু না,” রাচেল বলে। “তুমি এখানে বড়দের ছাড়া একদম আসবে না, ঠিক আছে এলি?” রাচেল লুইসের দিকে এক কদম এগিয়ে যায়।

জাডকে দেখে মনে হলো তিনি কষ্ট পেয়েছেন। “আমি তোমাদের ভয় ধরিয়ে দিতে চাইনি, তোমাকেও না তোমার মেয়েকেও না। এই জঙ্গলে ভয়ের কিছু নেই। এই পথটা চমৎকার; বসন্তে জায়গাটা পোকামাকড়ে কিলবিল করে আর সারা বছরই কাদায় পিচ্ছিল হয়ে থাকে-‘৫৫ সন বাদে, আমার দেখা সবচেয়ে খরার মৌসুম সেটাই। এমনকি এখানে বিষাক্ত আইভি বা বিষাক্ত ওক গাছও নেই, যেগুলো তুমি বাচ্চাদের স্কুলের মাঠের পেছন দিকেই পেতে পারো। আর এলি, ওইসব থেকে একশো হাত দূরে থাকবে, যদি না তোমার জীবনের তিন সপ্তাহ সময় স্টার্চ বাথ নিয়ে শেষ করতে না চাও।”

এলি তার মুখে হাত চেপে হেসে উঠলো 1

“এই পথটা নিরাপদ,” জাড আন্তরিকভাবেই রাচেলকে বললেন। কিন্তু রাচেলকে দেখে মনে হচ্ছে না সে তার আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছে। “কারণ, আমি বাজি ধরে বলতে পারি পথটা গেজও অনুসরণ করতে পারবে, আর শহরের বাচ্চারা যে এখানে প্রায়ই আসে তাতো তোমাদের আগেই বলেছি। তারা পথটাকে দেখাশোনা করে, আর তারা এটা করে নিজে থেকেই। আমি সত্যই চাই না এলি এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হোক।” তিনি এলির দিকে ঝুঁকে চোখ টিপলেন। “ব্যাপারটা জীবনের আরও অনেক কিছুর মতই এলি। সঠিক পথ ধরে চললে সব ঠিক। আর পথ থকে সরে গেলে দেখা যাবে তুমি পথ হারিয়ে ফেলেছ, যদি তোমার ভাগ্য খারাপ থাকে। আর তোমাকে খোঁজার জন্যে তখন এখানে সার্চ পার্টি পাঠাতে হবে।”

***

তারা এগিয়ে চলে। বেবি ক্যারিয়ারের ওজনে লুইসের পিঠে খিল ধরে গেছে। গেজ হরদম লুইসের চুল ধরে টানছে অথবা উৎফুল্ল হয়ে তার কোমরে লাথি মারছে। মশারা তার কাঁধ আর মুখের চারপাশে উড়ছে আর অসহ্য পিন্‌ পিনন শব্দ করে চলছে। পথটা নিচের দিকে বক্রাকারভাবে নেমে গেছে। কখনও বড় দেবদারু গাছের কারণে বেঁকেছে, কখনও কাটাঝোপের পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। ওদের এখন কাদা ভেঙে হাঁটতে হচ্ছে, লুইসের বুট কাদা আর পানিতে পচপচ্ করে এগিয়ে চলছে। একসময় জলা মতন একটা জায়গা এলে তারা পানির ওপরে থাকা ঘাসের বড় বড় আটির ওপর পা ফেলে এগিয়ে যায়। এটাই পথের সবচাইতে বন্ধুর অংশ। আবার তারা পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলে গাছপালাও আগের মত বেড়ে যায়। গেজের ওজন যেন জাদুর বলে দশ পাউন্ড বেড়ে গেছে, আর একই জাদুতে দিনের তাপমাত্রাও দশ ডিগ্রি বেড়ে যায়। লুইসের মুখ বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে।

“কী অবস্থা তোমার?” রাচেল জিজ্ঞেস করে। “ওকে আমার কাছে দেবে নাকি কিছুক্ষণের জন্যে?”

“না। আমিই পারব।” সে বলে। সে আসলেই পারবে তবে তার হৃৎপিণ্ড দ্রুতগতিতে তার বুকের খাচায় ধাক্কা দিচ্ছে। সে নিজে শারীরিক কসরত করার চাইতে অন্যদের তা প্রেসক্রাইব করতে বেশি অভ্যস্ত।

জাড এলির পাশে হাঁটছেন। ওর টিয়া রঙের টাইট্স আর লাল জামা ছায়াময় সবুজ-পিঙ্গলের বিষণ্নতার মাঝে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

“লু, উনি কি আসলেই জানেন আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?” রাচেল নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, তার কণ্ঠে দুশ্চিন্তা।

“অবশ্যই,” লুইস বলে।

জাড় ঘাড় ঘুরিয়ে উৎসাহের সাথে বললেন, “আর বেশি পথ বাকি নেই…তুমি চলতে পারছ তো, লুইস?”

ওরে ঈশ্বর, লুইস ভাবে, লোকটার বয়স আশি পেরিয়েছে, অথচ একটুও হাঁপায়নি।

“আমি ঠিক আছি,” সে একটু চড়া গলায় উত্তর দেয়। সে যদি হাঁপাতে হাঁপাতে হার্টফেল করার মত অবস্থায় থাকত, তাহলেও হয়ত তার আত্মসম্মান তাকে একই উত্তর দিতে বাধ্য করত। সে শুকনো করে হেসে পিঠের গেরিপ্যাকের স্ট্রাপ একটু টাইট করে এগিয়ে চলে।

তারা দ্বিতীয় টিলাটিতে ওঠার পর পথটা ঢালু হয়ে এক মানুষ সমান লম্বা ঝোঁপঝাঁড়ের মাঝে দিয়ে নেমে যায়। পথটা ক্রমশ সরু হতে থাকে, আর তার একটু পরেই লুইস দেখতে পায় এলি আর জাড বোর্ডের তৈরি একটা জীর্ণ অর্ধবৃত্তাকার খিলানের নিচে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। ওটার গায়ে কালো কালিতে অনেকটা মুছে যাওয়া লেখাটা কোন রকমে পড়া যাচ্ছে: পেট সেমিটারি।

লুইস আর রাচেল একে অপরের সাথে খুশিমনে চোখাচোখি করে। তারা দুজন সেই খিলানের নিচে এসে পাশাপাশি দাঁড়ায় এবং আপনাথেকেই একে অপরের হাত চেপে ধরে, যেন তারা বর আর কনে, এখানে বিয়ে করতে এসেছে।

সেদিন দ্বিতীয়বারের মত বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে লুইস ক্রিড।

এ জায়গাটায় আগের মত পাইনের সুচারু পাতা ছেয়ে নেই। চল্লিশ ফিটের মত ব্যাসের একটা বৃত্তাকার জায়গার ঘাস ছেটে পরিস্কার করা। জায়গাটার তিনদিকে ঘন ঝোঁপঝাঁড়ের জঙ্গল, আর আরেকদিকে ঝড়ে উপড়ে পড়া অনেকগুলো মরা গাছের বিরাট স্তূপ, যেটা দেখতে অশুভ এবং বিপজ্জনক। কোন পুরুষ মানুষ ওই ধ্বংসস্তূপ ভেদ করে যেতে চাইলে বা ওটার ওপর উঠতে গেলে তার উচিত হবে লোহার আন্ডারওয়ার পড়ে নেয়া, নাহলে পা ফসকে পড়ে গিয়ে পুরুষত্ব গলে যাওয়ার ভাল সম্ভাবনা আছে, লুইস মনে মনে ভাবে। সাফ করা জায়গাটা নানান রকম স্মৃতিফলকে ঠাসা। সেগুলো দেখে খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সেসব আনাড়ি বাচ্চাদের হাতে বানানো। বাচ্চারা হাতের কাছে যা পেয়েছে-বাক্সের টুকরো, বাতিল কাঠের টুকরো, পিটিয়ে সোজা করা টিনের টুকরো ইত্যাদি দিয়ে এগুলো তৈরি করেছে। জায়গাটার চারদিকের জঙ্গলগুলো এত ঘন যে প্রত্যেকটা উদ্ভিদ তার নিজস্ব জায়গা আর সূর্যের আলোর জন্যে প্রতিযোগিতা করছে। কিন্তু এর মাঝেই আনাড়ি হাতের ফলকগুলো যেন জায়গাটার গুরত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর জঙ্গলের পরিবেশ জায়গাটায় গভীর অসামান্যতা যোগ করেছে, যা খ্রিস্টীয় না, বরং পেগান।

“চমৎকার জায়গা,” রাচেল বলে, তবে বোঝা গেল না সে মনের কথা বলেছে কি না।

“ওয়াও!” এলি চেচিয়ে ওঠে।

লুইস গেজকে পিঠ থেকে নামিয়ে বেবি ক্যারিয়ার থেকে বের করে ঘাসের ওপর ছেড়ে দেয়। লুইসের পিঠ যেন মুক্তির নিশ্বাস ছাড়ে।

এলি একটার পর একটা স্মৃতিফলকের দিকে ছুটে যাচ্ছে আর প্রতিটি দেখেই আনন্দে চিৎকার করছে। লুইস ওর পিছে পিছে যায় আর রাচেল বাবুর দিকে চোখ রাখে। জাড একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে পা ভাজ করে বসে পড়েন আর বিড়ি টানতে থাকেন।

লুইস খেয়াল করে জায়গাটা দেখে। জায়গাটা দেখলে শুধু গোছানো মনে হয় তা না, জায়গাটায় আসলেই একটা প্যাটার্ন আছে। সূর্যের চারপাশে যেমন গ্রহগুলো বৃত্তাকার অক্ষে ঘোরে, সেরকম অনেকগুলো অক্ষ বরাবর কবরের ফলকগুলো পোতা।

স্মাকি নামের বেড়ালটা ছিল প্রভুভক্ত-একটা ফলক বলছে। হাতের লেখায় শিশু শিশু ভাব থাকলেও বোঝা যাচ্ছে, লেখাটা খুবই যত্ন করে লেখা। তার নিচেই লেখা, ১৯৭১-১৯৭৪। লুইস বৃত্তগুলোর মধ্যে সবচাইতে বাইরের বৃত্তে একটা প্রাকৃতিক স্লেট পাথরের ফলক দেখতে পায়। সেটার গায়েও একটা নাম, অনেকটা মুছে গেলেও লাল কালির লেখাটা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। বিফার, আর তার নিচেই একটা ছড়া লেখা :

বিফার বিফার, অ্যা হেলুভা স্নিফার
আনটিল হি ডাইড হি মেইড আস রিচার।

“বিফার হচ্ছে ডেস্লারদের পোষা ককার জাতের স্পেনিয়্যাল কুকুর,” জাড বলল। তিনি তার জুতার হিল দিয়ে মাটিতে একটা ছোট গর্ত করে সেটায় সিগারেটের ছাই ফেলছিলেন। “গত বছর একটা ময়লার ট্রাকের নিচে চাপা পড়েছিল। ছড়াটা কিন্ত বেশ, তাই না?”

“আসলেই,” লুইস সম্মতি জানায়।

কিছু কবরে ফুল দেয়া, যেগুলোর কিছু তাজা, কিছু পুরনো আর কিছু একদমই পচে গেছে। ফলকগুলোর মধ্যে অর্ধেকের গায়ের কালি বা পেন্সিলের লিখা কিছুটা বা একদমই পড়া যায় না। আর বাকি অর্ধেকের গায়ে কিছুই লেখা নেই। লুইস ভাবল এসব ফলকের গায়ে হয়তো চক বা মোমের রঙপেন্সিল দিয়ে লেখা ছিল।

“আম্মু!” এলি চেচিয়ে ওঠে। “এখানে একটা গোল্ড ফিশ! দেখে যাও!”

“দেখা লাগবে না,” রাচেল বললে লুইস তার দিকে এক নজর দেখে। রাচেল সবচাইতে বাইরের বৃত্তের ওপাশে চরম অস্বস্তি নিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। এই রকম একটা জায়গায় এসেও ও আপসেট হয়ে পড়েছে, লুইস ভাবে। ও মৃত্যু ব্যাপারটাকে কখনোই সহজে নিতে পারে না, খুব সম্ভবত ওর বোনের মৃত্যুর কারণে। আবার ভাবল, কেউই হয়তো একদম সহজভাবে মৃত্যু ব্যাপারটাকে নিতে পারে না। রাচেলের বোন ছোট থাকতে মারা যায়, আর লুইস বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে নেয় ওই ঘটনা নিয়ে রাচেলকে না ঘাটাতে। ওর বোনের নাম ছিল জেলডা আর তার মৃত্যু হয়েছিল মেরুদণ্ডের মেনিনজাইটিস রোগে। দীর্ঘ দিন এই প্রাণঘাতী রোগে ভুগে ওর বোন মারা যায়, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সে সময় রাচেল ছিল তার বয়ঃসন্ধিতে আর তাই ও ছিল অত্যন্ত অনুভূতি প্রবণ। আর রাচেল যে ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চায়, তাতে লুইস কোন দোষ দেয় না তাকে।

লুইস রাচেলকে চোখ টিপে দিলে রাচেল জবাবে কৃতজ্ঞতাভরা মুচকি হাসি ফেরত দেয়।

লুইস ওপরের দিকে তাকায়। জায়গাটা প্রাকৃতিকভাবেই ফাঁকা। সে ভাবল, ফাঁকা বলেই রোদের আলো মাটি পর্যন্ত পৌঁছে। আর সে জন্যেই এখানকার ঘাসগুলো বেশ সতেজ। তারপরেও, পরিচর্যা বা পানি দেয়া ছাড়া এরকম সম্ভব না। তার মানে বাচ্চারা বোতলের পর বোতল পানি ঢেলেছে এখানে অথবা ইন্ডিয়ান পাম্প কাঁধে বয়ে এনেছে, যেগুলোর একেকটার ওজন ওর নিজের পিঠে গেরিপ্যাকে বসা গেজের চাইতেও বেশি হবে। ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের ছোট ছোট শরীর দিয়ে এসব কাজ কিভাবে করেছে, তা ভেবে লুইস বিস্মিত হয়। তাছাড়া এরকম একটা কাজ বাচ্চারা এত লম্বা সময় ধরে চালু রেখেছে, সেটাই বা কম কী। ওর নিজের ছোটবেলায় কোন কাজের উৎসাহ উদ্দীপনা খুব অল্প সময়েই বাতাসে কর্পূরের মত উবে যেত। আর এলির বাবা হিসেবেও সে একই জিনিস দেখেছে এলির মধ্যে।

যত ভেতরে যাওয়া হলো, কবরগুলি ততো পুরনো হতে থাকে। আর সাথে সাথে লেখা পড়া যায় এমন ফলকের সংখ্যাও কমতে থাকে। তবে যেগুলো পড়া যাচ্ছে সেগুলো দেখে বোঝা যায় কবরগুলো বহু আগের।

একটা স্মারকে লেখা-ট্রিক্সি, হাইওয়েতে মৃত্যু, সেপ্টেম্বর ১৫, ১৯৬৮। একই বৃত্তে আরেকটা বেশ বড় বোর্ড মাটিতে ঠেসে পোঁতা। বারবার শীতে জমে জমে জিনিসটা দুমড়ে গেছে আর এক কোনার একটা অংশ একদমই মুচড়ে গেছে। তবুও লুইস পড়তে পারে : আমাদের পোষাপ্রাণী মার্তার স্মরনে,

মৃত্যু: ১ মার্চ, ১৯৬৫।

সামনের সারিতে একটাতে লেখা : জেনারেল প্যাটন, মৃত্যু: ১৯৫৮ (আমাদের সুবোধ কুকুর!-কথাটা আবার খুব বড় বড় অক্ষরে লেখা)। আরেকটাতে লেখা পলিনিশিয়া (এটা একটা টিয়া হবে, লুইস ভাবলো), যে কি না তার শেষ কথা ‘পোজ একটা ক্র্যাকার চায়’ বলেছিল ১৯৫৩ সালের গ্রীষ্মে। পরের দুই সারিতে একদম কিছুই পড়ার মত অবস্থায় নেই। তারপর আরেকটা ফলক পাওয়া গেল যেটা এখনো বৃত্তের কেন্দ্র থেকে বেশ দূরে তবে পড়া যায়। বেলে পাথরের ফলকটার গায়ে কোন রকমে খোদাই করে লেখা : ‘হ্যানা ছিল এ পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা কুকুর, ১৯২৯-১৯৩৯। বেলেপাথর তুলনামূলক নরম পাথর আর তাই সেটার গায়ের খোদাই করা লেখাগুলোর ক্ষয়ে ক্ষয়ে করুণ অবস্থা হয়ে গেছে। লুইস ভাবতেও পারছে না যে, একটা বাচ্চার কত পরিশ্রম আর সময়ের ফলাফল ওই পাথরের ফলকটার গায়ের খোদাই করা নয়টি শব্দ। পোষা প্রাণীর প্রতি বাচ্চাদের ভালবাসা আর তাদের হারানোর শোকের তীব্রতা লুইসকে আবারো বিস্মিত করে। নিজের সন্তান বা পিতামাতা মারা গেলেও তো এতো কিছু করে না।

“বাপরে! এগুলো তো অনেক আগের,” সে এদিকে হেঁটে আসতে থাকা জাডকে বলে।

জাড মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানান। “এদিকে এসো লুইস, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।”

তারা হাঁটতে হাঁটতে কেন্দ্র থেকে তিন নাম্বার সারিতে চলে আসে। পেছনের এলোমেলো করে কোনমতে বৃত্তাকার অক্ষে থাকা কবরগুলোর তুলনায় এখানকার কবরগুলো একদম সঠিকমাপে বৃত্তাকারে সাজানো। জাড মাটিতে পড়ে থাকা একটা ছোট স্লেট পাথরের পাশে এসে থামলেন। সাবধানে হাঁটু গেড়ে বসে ফলকটা সোজা করে দিলেন বৃদ্ধ।

“ফলকটাতে কিছু লেখা ছিল,” জাড বললেন। “আমি নিজের হাতে খোদাই করে লিখেছিলাম, তবে ক্ষয় হয়ে গেছে। আমার প্রথম কুকুরটাকে এখানে কবর দিয়েছিলাম। স্পট। ও বুড়ো হয়ে মারা যায়, সেটা ১৯১৪ সালের কথা, যে বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।”

এই পোষা প্রাণীর কবরস্থানটা যে অনেক মানুষের কবরস্থানের চাইতেও বেশি পুরনো, ব্যাপারটা ভেবে লুইস চমকে ওঠে। ও একেবারে কেন্দ্রের দিকে হেটে যায় এবং যেতে যেতে ফলকগুলো ভালো করে দেখে। একটা ফলকও পড়ার মত অবস্থায় নেই, আর তার মধ্যে আবার অনেকগুলোকে উদ্ভিদেরা ইচ্ছেমত গ্রাস করে নিচ্ছে। এ জায়গাটার ঘাস বেশ বড়। লুইস সেখান থেকে এক মুঠো ঘাস টেনে তুলে ফেলতে গেলে নিচের মাটি বাধা দিয়ে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। ঘাস তোলা ন্যাড়া জায়গাটায় কানা গুবরে পোকা কিলবিল করছে। তার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। ও ভাবে, জীব-জানোয়ারের গোরস্তান ব্যাপারটা খুব একটা ভালো লাগছে না।

“জায়গাটা কত বছরের পুরনো?”

“কে জানে। অন্তত আমি জানি না,” জাড তার প্যান্টের পকেটে নিজের হাত দুটো ঢুকিয়ে বললেন। “তবে স্পট মারা যাওয়ার আগে থেকেই জায়গাটা আছে, বুঝতেই পারছো। আমার তখন বন্ধু-বান্ধবের অভাব নেই। ওরা আমাকে সাহায্য করেছিল ওর জন্যে কবর খুঁড়তে। এখানে কবর খোঁড়া ছেলে খেলা না, মাটি খুবই শক্ত আর পাথুরে, সহজে উঠতে চায় না। আমিও ওদের বেলায় সাহায্য করেছি, বহুবার।” তিনি বেশ কয়েক জায়গায় তার তর্জনিটা তাক করে দেখালেন। “ওই যে ওখানে আছে পিটের কুকুরটা যদি আমার ঠিকঠাক মনে থাকে, আর ওখানটায় পাশাপাশি তিনটা কবরে আছে আলবিওনের ৩টা বিড়াল।

“বুড়ো ফ্রিটচি রেসের কবুতর পালতেন। তার কুকুর একবার একটা কবুতর মেরে ফেললে আমি, এ্যাল প্রোটলি আর কার্ল হান্নাহ মিলে ওখানটায় সেটাকে কবর দিয়েছিলাম।” তিনি থেমে কিছু একটা ভাবলেন। “আমার দলের মধ্যে কেবল আমিই বাকি আছি, বুঝলে? আমার গ্যাংয়ের আর কেউ বাকি নেই।”

লুইস কিছু না বলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে কবরগুলো দেখতে থাকলো।

“জায়গাটা পাথুরে,” জাড় বললেন। “এমনিতেও জায়গাটা লাশ পোতা ছাড়া অন্য কাজের যোগ্য না, অন্তত আমার তাই ধারনা।”

অদূরেই গেজ কান্না শুরু করে। রাচেল ওকে কোলে করে লুইসের কাছে নিয়ে আসে। “ওর খিদে পেয়েছে,” রাচেল বলে। “আমাদের যাওয়া উচিত।” প্লিজ লুইস, চলো এখান থেকে, লুইসকে ওর চোখগুলো বলছে।

“আচ্ছা,” লুইস বলে গ্যারিপ্যাকটা আবারো নিজের পিঠে চাপিয়ে নিয়ে রাচেলের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ায়, যাতে রাচেল সেখানে গেজকে বসিয়ে দিতে পারে। “এলি! এই এলি, কোথায় গেলে মামনি?”

“ঐতো ওখানে ও,” রাচেল মরা ডালপালার মস্ত স্তুপটার দিকে আঙুল তাক করে বলে। এলি স্তুপটাতে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওর কাছে হয়তো জিনিসটাকে স্কুলের মাঙ্কিবারের জারজ খালাতো ভাই বলে মনে হয়েছে।

“ওহ! ওখান থেকে নেমে এসো!” জাড আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন। “ভুলভাল জায়গায় তোমার পা পড়লে নিচের মরা ডাল সরে যেতে পারে, আর তাতে তোমার ঠ্যাংটাও ভাঙবে।”

এলি লাফিয়ে নামে। “আউ!” ওদের দিকে কোমর ডলতে ডলতে ও এগিয়ে আসে। সেখানকার চামড়া কেটে না গেলেও কিছুটা ছিলে গেছে। তবে একটা শক্ত মরা ডালে লেগে ওর স্কিন টাইট পাজামা ছিঁড়ে গেছে।

“দেখলে তো?” আদুরে ভঙ্গিতে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে জাড বললেন। “পুরনো গাছপালার স্তুপ খুবই বিপজ্জনক। যারা জঙ্গলের সাথে খুব অভ্যস্ত, তারাও না পারতে এসবে চড়ে না। মরা গাছের গুড়ি আর ডালপালার জঞ্জাল পড়ে থাকতে থাকতে খুব হিংস্র হয়ে ওঠে। তক্কে তক্কে থাকে কামড়ে দেয়ার জন্যে।”

“সত্যি?” এলি জিজ্ঞেস করে।

“সত্যি। গাছের গুড়ি আর ডালপালাগুলো এখান-সেখান থেকে পাহাড়ি ঢলে ভেসে এসে খড়ের গাদার মত স্তুপ হয়ে আছে। উল্টোপাল্টা জায়গায় পা দিয়েছো কী অমনি সব হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।”

“আব্বু, সত্যি?”

“হ্যাঁ, মামনি।”

“ইয়াক,” ও স্তুপটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে। “তুই আমার প্যান্ট ছিঁড়েছিস বজ্জাত মড়া গাছের দল!”

বাকি তিনজনই হেসে ওঠে। হাসলো না শুধু মরা গাছের স্তূপটা। সেটা খোলা আকাশের নিচে চুপচাপ বসে আছে, যেমনটা আছে যুগের পর যুগ ধরে। মরা গাছের স্তুপটাকে দেখে লুইসের সেটাকে কোন দানবের কঙ্কালের হাড়গোড়ের মত মনে হচ্ছে, যেটাকে কোন এক বীর যোদ্ধা কপালগুণে খুন করে এখানে ফেলে রেখে গেছে। হয়তো কোন ড্রাগনের কঙ্কাল, জঞ্জালের মত পড়ে আছে এই গোরস্তানে।

তখনো লুইসের মনে হচ্ছিল যে স্তুপটার ওপাশে হয়তো কিছু একটা আছে। সেটা আর গোরস্তানের প্রাচীর হিসেবেই কী এই স্তুপটা? জাড ক্র্যান্ডাল বলেছেন স্তূপটার ওপাশে জঙ্গল, যেটাকে রেড ইন্ডিয়ানদের জঙ্গল বলে। সে জায়গা আর এখানকার মাঝে যেন এটা একটা দেয়াল। প্রকৃতির খেয়াল কি এতো বেশি পরিকল্পিত হয়? এটা-

হঠাৎ গেজ তার এক কান টেনে মুচড়ে ধরে আর আনন্দে চেঁড়চাতে থাকে। লুইস স্তুপটার কথা একদমই ভুলে যায়। সময় হয়েছে, বাড়ি ফেরার।

অধ্যায় ৯

এলি পরদিন বিমর্ষ মুখে লুইসের কাছে আসে। সে তার স্টাডিতে একটা মডেল নিয়ে কাজ করছিল। মডেলটা একটা ১৯১৭ রোলস রয়েসের, যেটার মোট ছয়শো আশিটা আলাদা পার্টস, সেসবের মধ্যে আবার পঞ্চাশটা হচ্ছে মুভিং পার্টস। জিনিসটা জোড়া দেয়ার কাজ প্রায় শেষের দিকে। সে গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে ড্রাইভারের ইউনিফর্ম পরা একজন মানুষকে কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছে। ড্রাইভারটা আবার উনিশ শতকের ঘোড়া গাড়ির চালকদের সরাসরি বংশধর। সে বসে আছে রাজকীয় কায়দায়।

তার দশ বছর বয়স থেকেই মডেলের পাগলামো। এই বিষয়ে তার হাতে খড়ি হয়েছিল একটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ট্যাঙ্ক দিয়ে, যেটা তার আঙ্কেল কার্ল তাকে কিনে দিয়েছিলেন। এরপর সে প্লেনের অনেকগুলো মডেল নিয়ে কাজ করেছে। কৈশোরে আর প্রথম যৌবনে সে আরো বড় বড় এবং আরো ভালো ভালো মডেলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। একবার তার ‘বোতলের ভেতরে জাহাজ’ পর্ব চলেছে, আরেকবার যুদ্ধাস্ত্রের পর্ব চলেছে। আরেক পর্বে সে এমন সব বাস্তব দেখতে পিস্তল বানাতো, সেগুলো দেখলে বিশ্বাসই হতো না সেগুলোর ট্রিগার টিপে দিলে গুলি বেরিয়ে আসবে না। কোল্ট, উয়িনচেস্টার এমন কি একটা বান্টলাইন স্পেশাল। আর গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে ক্রুজ জাহাজের পর্ব। লুসিটানিয়া এবং টাইটানিকের দুটো মডেল তার ইউনিভার্সিটি অফিসের শোভা বর্ধন করছে। আর আন্দ্রে ডোরিয়ার মডেলটি, যেটি সে শিকাগো ছেড়ে আশার আগে দিয়ে শেষ করেছে, সেটা ভাসছে ফায়ার প্লেসের ওপরের একটা তাকে। আর বর্তমানে তার মাথায় ক্লাসিক গাড়ির ভূত চেপেছে। আর যদি সবকিছু আগের মতই চলে, তাহলে এই ভূত আগামী চার-পাঁচ বছরে নামার কথা না। রাচেল তার স্বামীর উল্লেখ করার মত এই একটি মাত্র শখকে ‘আজাইরা’ বলেই মনে করে। বিয়ের দশ বছর পরেও তার মনে একটা ক্ষীণ আশা আছে তার স্বামী হয়তো একদিন এসব ছেলেমানুষী ছেড়ে দিবে। হয়তো রাচেলের এই মনোভাবের জন্যে তার বাবা কিছুটা দায়ি। এখনো রাচেলের বাবা ভাবেন তার মেয়েকে তার কাছ থেকে যে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে সে একটা অপদার্থ, আস্ত বজ্জাত।

হয়তো, সে ভাবে, হয়তো রাচেলের কথাই ঠিক। হয়তো আমি একদিন ঘুম থেকে উঠে আমার সব মডেল স্তূপ করে রেখে গ্লাইডিং করতে শুরু করবো নতুন শখ হিসেবে।

এলিকে খুব গম্ভীর মনে হচ্ছে।

রবিবারের চার্চের ঘন্টা দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে। চার্চ তার প্রার্থনাকারীদের আহবান জানাচ্ছে।

“হাই, আব্বু,” ও বলে।

“হ্যালো, মামনি। কি হয়েছে?”

“ওহ, কিছু না,” ও বলে, কিন্তু ওর চেহারা বলছে আসলে অনেক কিছু হয়েছে। এবং সেসব ভালো কিছু না। ওর সদ্য ধোয়া চুল কাঁধের ওপর ছড়িয়ে আছে। রুমের আলোতে ওর চুল বাদামী থেকে বেশি সোনালী বলেই মনে হচ্ছে। যদিও বড় হলে ওর চুল বাদামীই হবে। ও একটা নতুন জামা পড়ে আছে। লুইসের মনে হলো এলি প্রতি রোববারেই নতুন জামা পড়ে থাকে, যদিও তারা কেউই এদিনে চার্চে যায় না।

“তুমি ওটা কী বানাচ্ছ বাবা?”

সযত্নে আঠা দিয়ে একটা মাডগার্ড লাগাতে লাগাতে লুইস বলে, “এটা দেখ,” সাবধানে এলির হাতে একটা হাব ক্যাপ তুলে দিয়ে লুইস বলে, “এই পাশাপাশি R-গুলো দেখতে পাচ্ছো? খুব সূক্ষ্ম ডিটেইল, তাই না? আমরা থ্যাঙ্কসগিভিংয়ে যদি প্লেনে চড়ে শাইটাউন যাই, আর বিমানটা যদি হয় L- 1011, তাহলে বিমানের জেট ইঞ্জিনের দিকে তাকালেই তুমি এই ‘R’গুলো দেখতে পাবে।”

“এটা হাব-ক্যাপ। তাতে কী যায় আসে?”

“আরে কী বলছো,” সে বলে। “রোলস রয়েসের এটাকে বলে হুইল কাভারিং। তোমার যদি রোলস রয়েস কেনার মত টাকা থাকে তাহলে খুব বুক ফুলিয়ে চলতে পারবে। দুই মিলিয়ন ডলার কামানোর পর আমি নিজে একটা কিনবো। রোলস রয়েস কর্নিস। ওই গাড়িতে উঠে গেজের বমি পেলে সে একেবারে খাটি চামড়ার সিট কভার বমি দিয়ে ভাসিয়ে দিতে পারবে।” আর, ভালো কথা, এলি, তুমি আসলে কি বলতে চাও সত্যি সত্যি বলবে? এলিকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই বলবে না। ও নিজেকে কখনোই সম্পূর্নভাবে প্রকাশ করতে চায় না কারো আছে, কিছু জিনিস নিজের ভেতরে চেপে রাখাই ওর পছন্দ। আর এলির এই স্বভাবটা লুইস খুব পছন্দ করে।

“আমরা কি বড়লোক, বাবা?”

“না, মামনি,” সে উত্তর দেয়, “তবে আমরা না খেয়ে মরার মত ফকিরও না।”

“স্কুলের মাইকেল বার্ন বলেছে যে সব ডাক্তারেরাই নাকি বড়লোক।”

“আচ্ছা তাহলে তুমি ওকে বলে দিবে, অনেক ডাক্তারই বড়লোক হয় ঠিক, তবে সেটা ২০ বছর ডাক্তারি করার পরে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে কাজ করে কেউ বড়লোক হয় না। বড়লোক হয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা। গাইনোকোলজিস্ট, অর্থোপেডিস্ট অথবা নিউরোলোজিস্ট। তারা রাতারাতি বড়লোক হয়ে যায়। আর আমার মত তৃনমূল ডাক্তারের বড়লোক হতে অনেক সময় লাগে।

“তাহলে তুমি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হচ্ছো না কেন বাবা?”

লুইসের মাথায় আবারো তার মডেলগুলোর ভাবনা চলে আসে। তার মনে পড়ে একদিন তার হঠাৎ করেই আর যুদ্ধবিমান নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না। আবার একইভাবে সে টাইগার ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান স্টেশান বানাতে বানাতেও বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, আবার একদিন হঠাৎ করেই তার মনে হলো যে বোতলের ভেতর মডেল বানানো এক্কেবারে আহাম্মকি। আর তার মধ্যে এসব পরিবর্তন হয়েছিল রাতারাতি। এরপর সে ভাবে, তার পুরো জীবনটা বাচ্চাদের পায়ের হ্যামার টো পরীক্ষা করতে কেমন লাগবে, অথবা মহিলাদের যোনির ভেতর তার স্পেশালিস্ট আঙুল ঢুকিয়ে কোন রোগ খুঁজতেও বা কেমন লাগবে?

“আমার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে ইচ্ছে করে না, মামনি,” সে বলে।

চার্চ লুইসের অফিসে এসে ঢুকলো। এরপর সে থেমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে তার উজ্জ্বল সবুজ চোখগুলো দিয়ে। সে লাফ দিয়ে জানালার দেয়ালে উঠে ঘুমোনোর জন্যে শুয়ে পড়ে।

এলি চার্চের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়, যেটা লুইসের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে। সাধারণত এলি চার্চের দিকে এতো গদগদ আদরে তাকায়, যেটা দেখলে একটু বিরক্তই লাগে। এলি ঘুরে ঘুরে অফিসটা দেখতে থাকে আর প্রায় স্বাভাবিক গলায় বলে, “বাপরে, পেট সেমেটারিতে অনেক কবর, তাই না বাবা?”

এই তো আসল কথা বেরিয়েছে এতক্ষণে, লুইস ভাবে। সে এলির দিকে না তাকিয়ে তার রলস রয়েসের মডেলের গায়ের কেরেজ ল্যাম্পটা জোড়া দিতে থাকে। “হুম,” লুইস বলে। “কমসে কম একশো’র বেশি কবর আছে ওখানে।”

“আব্বু, পোষা প্রাণীরা কেন তাদের মালিকদের সমান বাঁচে না?”

“শোন, কিছু কিছু প্রাণী আছে যারা মানুষের সমানই বাঁচে, আবার কিছু কিছু মানুষের চাইতেও বেশি বাঁচে। যেমন ধরো, হাতি অনেক দিন বাঁচে তারপর কিছু সামুদ্রিক কচ্ছপ আছে যেগুলো এতো বুড়ো যে তাদের বয়স কত সেটাও কেউ জানে না…অথবা হয়তো জানে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না।”

এলি কথাটা মানতে পারে না। “হাতি আর সামুদ্রিক কচ্ছপ তো আর কেউ পোষে না। পোষা প্রাণীরা একদমই বেশি দিন বাঁচে না। মাইকেল বার্ন বলেছে মানুষের এক বছর কুকুরের নয় বছরের সমান।”

“সাত বছর,” লুইস ভুলটা ঠিক করে দেয়। “মামনি, আমি বুঝতে পারছি তুমি কি বলতে চাইছো, এবং সেটা কিছুটা ঠিকও। একটা বারো বছর বয়েসি কুকুর আসলেই একটা বুড়ো কুকুর। মেটাবলিজম বলে একটা ব্যাপার আছে। মেটাবলিজমের একটা কাজ হচ্ছে শরীরের ঘড়ি হিসেবে কাজ করা। মেটাবলিজম অন্য কাজও করে-যেমন অনেক মানুষ আছে অনেক খায়, কিন্তু মোটা হয় না, যেমন তোমার মা। আবার অনেকে আছে অল্পতেই মুটিয়ে যায়, যেমন আমি। এর কারণ আমাদের মেটাবলিজম আলাদা। তবে শরীরের ঘড়ি হিসেবে কাজ করা মেটাবলিজমের সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ একটা কাজ। কুকুরের মেটাবলিজম অনেক দ্রুত চলে। সেই তুলনায় মানুষেরটা বেশ ধীর। মানুষেরা অধিকাংশই এজন্যে সত্তর-বাহাত্তর বছর বাচে। আর মা, এটা খুব লম্বা একটা সময়।”

এলিকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। সে মনে মনে দোয়া করলো যেনো সে নিজে কথাটা যতটুকু বিশ্বাস নিয়ে বলেছে সেটা যেন তার চাইতে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে এলির কাছে। তার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ আর তার মনে হচ্ছে যে এই বছরগুলো চোখের নিমিষেই পেরিয়ে গেছে। “আর সামুদ্রিক কচ্ছপ, ওদের মেটাবলিজম—”

“বিড়ালের মেটাবলিজম কেমন, বাবা?” এলি জিজ্ঞেস করে আবারো চার্চের দিকে তাকায়।

“আচ্ছা। বিড়াল প্রায় কুকুরের সমান বাঁচে,” সে বলে। “অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।” কথাটা ডাহা মিথ্যা কথা এবং সে তা খুব ভালো করেই জানে। বিড়ালের স্বভাব খুব সহিংস এবং তারা প্রায়ই মর্মান্তিকভাবে পটল তুলে। তার একটা বড় কারণ বিড়াল মানুষের দৃষ্টি সীমার নিচে দিয়ে চলাচল করে, এবং একারণে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। আর এই যে চার্চ। যে প্রতি রাতে তার মেয়ের বিছানায় ঘুমোয়, যে ছোট থাকতে সুতোর বল নিয়ে খেলতে গিয়ে সুতোয় প্যাঁচ খেয়ে অবস্থা কাহিল করতো। চার্চ বাচ্চা থাকতে খুব কিউট ছিল। সেই

চার্চকেই সে সেদিন দেখেছে একটা ডানা ভাঙা অসহায় পাখির ওপর হামলা করার জন্যে ওৎ পেতে থাকতে। সেসময় চার্চের সবুজ চোখগুলো কী জ্বলজ্বলই না করছিল, কৌতূহল আর-হ্যাঁ, লুইস ভুল দেখেনি-শীতল আনন্দে। ও সাধারণত শিকারের জন্যে ওৎ পেতে থাকলেও শিকারকে একদম মেরে ফেলে না। তবে একবার পাশের বাড়ির চিপা গলিতে আটকে যাওয়া একটা ইঁদুরের বারোটা বাজিয়ে ইহলীলা সাঙ্গ করে দেয়। সেটার অবস্থা এতটাই বীভৎস হয়েছিল তা দেখে গেজকে নিয়ে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা রাচেল বাথরুমে ছুটে গিয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সহিংস জীবন এবং সহিংস মরন। হয়তো কোন কুকুর তাদের সুবিধা মত বাগে পেয়ে ফালাফালা করে ফেলে। কুকুরেরা বিড়ালের মত খেলার ছলে আটকে রেখে ছেড়ে দেয় না। অথবা অন্য কোন হুলো বিড়াল তার খেল খতম করে দেয়, বা কোন বিষাক্ত টোপ গিলে মরন বা গাড়ি চাপা পড়ে পরলোক গমন। বিড়াল হচ্ছে গ্যাংস্টার প্রাণী। তারা কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করে না এবং সহিংস জীবন যাপন করে। তাদের মৃত্যুটাও তাই অনেক সময় সেভাবেই ঘটে। এবং তাদের অনেকের ক্ষেত্রে সেই ঘটনা বুড়ো হবার আগেই ঘটে যায়।

তবে এসব কথা নিজের পাঁচ বছরের মেয়েকে বলা যায় না, যে প্রথম বারের মত মৃত্যু ব্যাপারটাকে বুঝতে চেষ্টা করছে।

“আমি বলতে চাচ্ছি,” সে বলে, চার্চের বয়স এখন মাত্র তিন। আর তোমার বয়স পাঁচ। তুমি যখন হাই স্কুলে পড়বে তখনো হয়তো ও বেঁচে থাকবে। আর সেটা অনেক লম্বা সময় পরের কথা।”

“আমার কাছে সেটা লম্বা সময় বলে মনে হচ্ছে না,” এলি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে। “মোটেই না।”

লুইস কাজ করার অভিনয়ে ক্ষান্ত দিয়ে এলিকে তার দিকে আসার জন্যে ইশারা করে। এলি তার কোলে এসে বসে। বিমর্ষতার কারণে এলিকে আরো মায়াবতী লাগছে। মেয়ের সৌন্দর্য দেখে লুইস আবারো অবাক হয়। ওর গায়ের রংটা একটু পোড়া, কিছুটা লোভেন্টাইন। টনি বেন্টন নামে লুইসের এক কলিগ ওকে ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস বলে ডাকতো।

“মামনি,” সে বলে, “আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমি চার্চকে একশ বছর বাঁচিয়ে রাখতাম। কিন্তু সেই ক্ষমতা আমার নেই, মা।”

“তাহলে কার আছে?” ও জিজ্ঞেস করে এবং পরে নিজে নিজেই বলে ওঠে, “মনে হয় ঈশ্বরের।”

লুইসের হাসি পায়, কিন্তু সে তা চেপে রাখে। ব্যাপারটা মোটেই হাসির কিছু না।

“ঈশ্বর অথবা অন্য কেউ,” সে বলে, “দেহের ঘড়ি একসময় বন্ধ হয়ে যায়, আমি শুধু সেটুকুই বলতে পারি। এই ব্যাপারে কোন রকমের গ্যারান্টি নেই, মামনি।”

“চার্চ মরতে পারে না!” হঠাৎ ও ছলছল চোখে কেঁদে বলে ওঠে। “চার্চ কক্ষনো মরতে পারে না! ও আমার বিড়াল! ও ঈশ্বরের বিড়াল না। ঈশ্বর তার নিজের বিড়াল নিয়ে যা খুশি করুক। চাইলে উনি সব বুড়ো বিড়াল মেরে ফেলুক। কিন্তু চার্চ তো ঈশ্বরের বিড়াল না, ও আমার বিড়াল!”

রান্নাঘরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল এবং সেখানে রাচেলকে কিছুটা হতচকিত অবস্থায় দেখা গেল। এলি লুইসের বুকে মুখ গুজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। মৃত্যুর বিভীষিকা সম্পর্কে সে জানতে পেরেছে। মৃত্যুর ব্যাপারে আর কিছু করা না গেলেও কান্না করা যায়।

“এলি,” লুইস এলিকে কোলে দোলাতে দোলাতে বলে, “এলি, এলি, চার্চ তো বেঁচে আছে; ওইতো ও ওখানে ঘুমোচ্ছে।”

“কিন্তু ও তো যে কোন সময় মরে যেতে পারে,” ও কাঁদতে কাঁদতে বলে।

লুইস এলিকে জড়িয়ে ধরে দোল দিতে থাকে। তার বিশ্বাস এলি কাদছে কারণ, মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, মৃত্যু কোন যুক্তি মানে না, এবং মৃত্যু সুনিশ্চিত ভাবেই অনিশ্চিত। মানুষের ইশারা থেকে উপসংহার টানার সাংঘাতিক সুন্দর ক্ষমতা আছে। আর সেটাও এলির দুঃখ পাবার পেছনের একটা কারণ। যেহেতু পেট সেমেটারিতে অতগুলো মৃত প্রাণীর কবর আছে, তার মানে নিশ্চয়ই চার্চও মরে যেতে পারে। (যে কোন সময়!) এবং এটা যদি চার্চের সাথে ঘটতে পারে তাহলে সেটা হয়তো তার বাবা, মা এবং ছোট ভাইয়ের বেলাতেও ঘটতে পারে। ওর কাছে মৃত্যুর ধারণা অস্পষ্ট তবে পেট সেমেটারি একদম আসল।

সেখানকার পুরনো ফলকগুলো যে সত্যটা ধারণ করে, তা একটা শিশুও বুঝতে পারবে।

এই অবস্থায় মিথ্যা বললেই সহজ হতো, ঠিক যেমনটা সে একটু আগে হুলো বিড়ালের গড় আয়ু সম্পর্কে বলেছে। তবে এক সময় এসব মিথ্যা বাচ্চারা ধরতে পারে এবং বাবা মাকে বাচ্চারা পেরেন্টিং-এর রিপোর্ট কার্ডে একটা F বসিয়ে দেয়। লুইসের নিজের মাও তাকে একবার এরকম একটা মিথ্যে বলেছিলেন। তার প্রশ্নটা ছিল বাচ্চা কিভাবে হয়, বাচ্চাদের খুব সাধারন একটা প্রশ্ন। ওর মা ওকে বলেছিলেন মায়েরা বাচ্চা চাইলে তারা মাঠের শিশির ভেজা ঘাসের ওপর বাচ্চা কুড়িয়ে পেতেন। যদিও মিথ্যেটা তখন তার কোন ক্ষতি করেনি, কিন্তু তার পরেও সে তার মায়ের এই মিথ্যেটা বলার অপরাধ কখনোই মাফ করতে পারেনি। অথবা সে হয়তো নিজেকেই ক্ষমা করতে পারেনি এমন একটা আজগুবি কথা বিশ্বাস করে ফেলার জন্যে।

“মামনি,” লুইস বলে, “জীবন এমনই মা। আর মৃত্যুটা জীবনেরই একটা অংশ।”

“খুব পঁচা অংশ,” ও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। “এটা খুবই পঁচা একটা অংশ।”

এর কোন জবাব লুইসের কাছে নেই। ও কাঁদতে থাকে। কান্না করুক। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ওর কান্না বন্ধ হবে। মৃত্যুকে মেনে নেয়ার জন্যে এটাই প্রথম ধাপ। মৃত্যু খুব অপ্রিয়, কিন্তু একে রোখার কোন পথ নেই। সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।

সে এলিকে জড়িয়ে ধরে রেখে দূর থেকে ভেসে আসা চার্চের ঘন্টা শুনতে থাকে। এলির কান্না বন্ধ হবার কিছুক্ষণ পর লুইস বুঝতে পারে চার্চের মত এলিও ঘুমিয়ে পড়েছে।

ওকে ওর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিচ তলায় কিচেনে নেমে আসে সে, যেখানে রাচেল খুব জোরে জোরে কেক বানানোর খামির নাড়ছে। লুইস রাচেলকে এলির ঘুমিয়ে পড়ার কথাটা বলে। সে এও বলে যে এরকম সকাল বেলায় তো এলি কখনো ঘুমোয় না।

“না,” রাচেল খামিরের বোলটা ঠাস করে টেবিলের ওপর রেখে বলল। ও এই সময় ঘুমায় না; তবে গত রাতের বেশির ভাগ সময় ও জেগে ছিল। আমি ওকে অনেক রাত পর্যন্ত বিছানায় এপাশ ওপাশ করেতে শুনেছি। আর চার্চ রাত তিনটার দিকে বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্যে চেচামেচি শুরু করেছিল। এলি খুব অস্থির হয়ে থাকলে চার্চ এরকম করে।”

“ও কেন রাতে-?”

“ওহ! কারণটা তুমি খুব ভালো করেই জানো!” রাচেল রাগান্বিত কণ্ঠে বলে। “ওই বালের পেট সেমেটারিতে ঘোরাঘুরির জন্যে! ব্যাপারটা ওর শিশু মনে খুব আঘাত করেছে, লু। এটা ওর দেখা প্রথম কবরস্থান। আর জিনিসটা ওকে খুব…খুব আঘাত করেছে। আর সেজন্যে তোমার বন্ধু জাডকে অসংখ্য ধন্যবাদ!”

ও, এখন সে আমার বন্ধু হয়ে গেছে, লুইস কিছুটা অবাক আর বিস্মিত হয়ে ভাবে।

“রাচেল-”

“আর আমি চাই না ওখানে এলি আর কখনো যাক।”

“রাচেল, জাড পথটার ব্যাপারে যা বলেছেন তা জেনেই বলেছেন।”

“সমস্যাটা রাস্তায় না এবং তা তুমি জানো, লুইস ক্রিড।” রাচেল বলে। সে আবারো খামিরের বোলটা তুলে নিয়ে আগের চাইতেও জোরালোভাবে খামির ঘুটতে থাকে। “সমস্যাটা ওই জায়গাটার। বাচ্চাদের জন্যে জায়গাটা ভালো না। বাচ্চাদের ওই রকম একটা জায়গায় যাওয়া, কবরস্থানের দেখাশোনা করা, রাস্তার দেখাশোনা করা… পুরোটাই খুব খুব বিশ্রী। এই শহরের বাচ্চাদের কী রোগে ধরেছে আমি জানি না, কিন্তু সেই রোগে আমি এলিকে আক্রান্ত হতে দিবো না।”

লুইস হতভম্ব হয়ে রাচেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন প্রতি বছর বন্ধুদের ডিভোর্সের খবর পায় তখন লুইস তার বিয়ে টিকে থাকার কারণ বলে একটা জিনিসকেই সন্দেহ করতো-সেটা হচ্ছে একটা বিশেষ রহস্যকে সম্মান করা। তার মাঝে মাঝে মনে হয় বিয়ে বলতে আসলে কিছু নেই, মিলন বলে কিছু নেই। প্রত্যেকেই একা। এটাই হচ্ছে রহস্যটা। কেউ ভাবতে পারে সে তার সঙ্গিকে পুরোপুরি চিনে ফেলেছে, কিন্তু সে ভুলের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাকেও সময়ে সময়ে তার সঙ্গির এমন কিছু ব্যাপারের মুখোমুখি হতে হবে যে তার মনে হবে সে তার সঙ্গির মনের কিছুই বুঝতে পারছে না। সে আবিষ্কার করে তার আর তার সঙ্গির মাঝখানে হয়তো কোন দেয়াল আছে, বা কোন গভীর গিরিখাদ আছে। তখন সে তার সঙ্গিকে চিনতেই পারবে না। সঙ্গির কোন বিশ্বাস বা ব্যবহার তার কাছে এতোটাই অদ্ভুত কিসিমের মনে হবে যে তখন হয়তো সঙ্গিকে তার সাইকো বলে মনে হবে। অন্তত লুইসের বেলায় এমন হয়। আর এসব ব্যাপারে খুব ভেবে চিন্তে প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত। মনের শান্তির কথা বিবেচনা করে এসব ব্যাপারে একদম রাগারাগি না করাই বুদ্ধির কাজ।

“এটা স্রেফ একটা পেট সেমেটারি,” সে বলে।

“এলি ওখানে যেভাবে কাঁদছিল,” রাচেল তার খামির লাগা চামচটা দিয়ে লুইসের অফিসের দিকে তাক করে বলে, “তাতে কি তোমার এখনো মনে হচ্ছে যে জায়গাটা এলির কাছে স্রেফ একটা পেট সেমেটারি? ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ওর মনে একটা স্থায়ী ক্ষত রেখে যাবে। ও আর কখনো ওই ফালতু জায়গাটায় যাবে না, লু। সমস্যা ওই রাস্তার না, সমস্যা ওই জায়গাটার। দেখলে তো ও ভাবছে যে চার্চ মরে যাবে।”

লুইসের হঠাৎ মনে হয়, সে এখনো এলির সাথেই কথা বলছে। যেন এলি হঠাৎ লম্বা হয়ে গেছে, মায়ের জামা কাপড় গায়ে দিয়েছে আর মুখে লাগিয়েছে একদম রাচেলের মুখের মতন দেখতে একটা মাস্ক। এমন কি ওদের কথা বলের ভাব-ভঙ্গিও একই রকম-বাইরে বাইরে রাগ দেখাচ্ছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে।

সে বিষয়টা এড়িয়ে গেল, সেই রহস্যটাকে সম্মান জানিয়ে। তার মনে হচ্ছে রাচেল নিজের দুই চোখ চেপে ধরে আছে সত্যটা না দেখার জন্যে।

“রাচেল,” সে বলে, “চার্চ কিন্তু আসলেই মরে যাবে।”

রাচেল তার দিকে কটমট করে তাকায়। “আমি সেটা বোঝাইনি,” রাচেল কাটা কাটা গলায় বলে। “চার্চ তো এখনি মরে যাচ্ছে না, তাই না? আজ ও না, কালও না, কিংবা পরশু।”

“কেউ তা নিশ্চিতভাবে বলতে—”

“অবশ্যই নিশ্চিতভাবে বলা যায়!” রাচেল চিৎকার করে বলে ওঠে। “আমরা তো চার্চের কোন যত্নআত্তির কমতি করছি না, যে ও মরে যাবে! ও মরবে না, এই বাসায় কেউ মরবে না! তাহলে কেন তুমি মেয়েটাকে এমন একটা ব্যাপার বলে কষ্ট দিচ্ছো যেটা বোঝার মত অর্ধেক বয়সও ওর হয়নি?”

“রাচেল, শোন।”

“কিন্তু রাচেলের শোনার কোন ইচ্ছেই নেই। সে তার মত বলেই গেল। ‘এমনিতেই মৃত্যুর সাথে মানিয়ে নেয়া অনেক কষ্টের-হোক সেটা কোন পোষা জীব, বন্ধু বা আত্মীয়ের মৃত্যু-আর সেই মৃত্যুর মত ব্যাপারটাকে নিয়ে একটা টুরিস্ট স্পট বানানো- বনের মধ্যে মরা জানোয়ারের জন্যে বাগান বানানো -” তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করে।

“রাচেল,” লুইস রাচেলের দুকাঁধে তার দুহাত রেখে বলে। রাচেল কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার হাত দুটো সরিয়ে দেয়।

“বাদ দাও,” রাচেল বলে, “তুমি কি করে বুঝবে আমি কী বলতে চাইছি…”

লুইস দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, “আমার মনে হচ্ছে আমি কোন চোরা দরজা দিয়ে ইলেক্ট্রিক মিক্সারের ভেতর পড়ে গেছি,” লুইস রাচেলকে একটু হাসানোর আশায় কৌতুক করে বলে। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। রাচেল শুধু তার দিকে তার জ্বলতে থাকা কালো চোখে তাকিয়ে আছে। বাপরে, রাচেল আজ ক্ষেপে গেছে, লুইস ভাবে, শুধু অভিমান নয় এটা। চূড়ান্তভাবে ক্ষেপেছে। “রাচেল,” সে বলে উঠে, এবং এরপর কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করে বসে, “কাল রাতে তোমার ঘুম কেমন হয়েছে?”

“বাহ! চমৎকার!” অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাচেল ঘৃণা ভরা কণ্ঠে বলে-তবে রাচেলের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার আগেই এক মুহূর্তের জন্যে লুইস ওর চোখের আহত দৃষ্টিটা দেখতে পায়। “খুবই চমৎকার বলেছো। খুবই চমৎকার। তুমি কখনই বদলাবে না লুইস। কিছু ঘটলেই সেটার দোষ রাচেলকে না দিলে তোমার পেটের ভাত হজম হয় না, তাই না? সব কিছুই স্রেফ রাচেলের আবেগের ফল।”

“এটা ঠিক না, রাচেল, “

“তাই?” রাচেল খামিরের বোলটা টেবিলের ওপর প্রায় আছাড় দিয়ে রেখে বলে। এরপর সে একটা কেকের ছাঁচে তেল ঢালতে লাগলো দুই ঠোঁট চেপে।

লুইস এবার স্বাভাবিক গলায় বলে, “একটা বাচ্চা মৃত্যু সম্পর্কে জানবে এটাই স্বাভাবিক, রাচেল। এমনকি আমার মনে হয় বাচ্চাদের এই ব্যাপারে সঠিক ধারণা থাকাটা জরুরিও। এলির কান্নাকাটি আমার কাছে স্বাভাবিকই লেগেছে। এটার মধ্যে-”

“ওহ! খুব স্বাভাবিক,” বিদ্রুপের সুরে বলে রাচেল, “এটা এতোই স্বাভাবিক যে এলি তার সুস্থ সবল বিড়ালের মরে যাবার ভয়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে-”

“চুপ করো,” লুইস বলে, “তোমার কথার যে কোন আগা মাথা নেই তুমি সেটা বুঝতে পারছো না?”

“আমি এ ব্যাপারে আর কোন কথা বলতে চাই না।”

“তুমি না চাইলেও বলতে হবে,” রাগান্বিত কণ্ঠে লুইস বলে।

“এলি আর কখনো ওই ফালতু জায়গাটায় যাচ্ছে না, ব্যাস।”

“এলি জানে মানুষের বাচ্চা কিভাবে হয়। এটা আমরা ওকে গত বছরই বলেছি। তুমি হয়তো ভুলে গেছো আমরা ঠিক করেছিলাম, বাচ্চাদের জানা উচিত মানুষের জন্ম কিভাবে হয়।”

“সেটার সাথে এটার কোন সম্পর্ক-”

“আছে, সম্পর্ক আছে।” সে কঠিন গলায় বলে। “এলির সাথে কথা বলার সময় আমার মনে পড়েছিল আমার মা কিভাবে মানুষের বাচ্চা হয় সে ব্যাপারে আমাকে একটা গাঁজাখুড়ি কেচ্ছা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মিথ্যা কথাটা আমি এখনো ভুলিনি, কখনো ভুলবোও না। আমার বিশ্বাস বাচ্চারা তাদের বাবা-মায়ের বলা মিথ্যাগুলো কখনোই ভুলে না।”

“বাচ্চারা কোথা থেকে আসে সেই প্রশ্নের সাথে ওই বালের পেট সেমেটারির কোন সম্পর্ক নেই!” রাচেল ক্ষিপ্র কন্ঠে জবাব দেয়। তার চোখ বলছে তাকে যতই বোঝানো হোক, সে বুঝতে চাইছে না।

তবুও লুইস চেষ্টা করে।

“এলি জানে কিভাবে জীবনের শুরু হয়। আর পেট সেমেটারি জীবনের শেষের সাথে সম্পর্কিত। এই ব্যাপারে ওর কৌতুহল খুবই স্বাভাবিক। আর মৃত্যু জিনিসটা জীবনের সব চাইতে স্বাভাবিক।”

“চুপ কর!” রাচেল চেচিয়ে উঠে-সত্যিকার অর্থেই চেঁচিয়ে ওঠে। লুইস চমকে ওঠে আর এতে ওর কনুইতে ধাক্কা লেগে টেবিলে রাখা ময়দার প্যাকেটটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ফেটে যায়। কিচেনের মেঝেতে ময়দা বিশ্রীভাবে ছড়িয়ে পড়ে, আর বাতাসে উড়তে থাকা ময়দা সাদা মেঘের মত ভাসতে থাকে।

“ ধুর বাল!” সে চরম বিরক্তি নিয়ে বলে।

ওপরতলা থেকে গেজের কান্নার শব্দ ভেসে আসে।

ওহ, চমৎকার!” রাচেল কাঁদতে কাঁদতে বলে। “বাবুকেও ঘুমোতে দিলে না। ঝগড়াঝাটি ছাড়া খুব শান্তিপূর্ণ একটা ছুটির সকালের জন্যে তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ।”

লুইস রাচেলের বাহুতে তার হাত রাখলে সে চমকে ওঠে। “আচ্ছা শোন,” লুইস বলে, “আমি একজন ডাক্তার। আমি জানি যে যেকোন জীবের যেকোন সময় যেকোন রকমের খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। ওর বিড়ালের যে কোন সময় লিউকেমিয়া বা ডিফথেরিয়া হতে পারে, বিড়ালের ক্ষেত্রে এসব খুব কমন ব্যাপার। আবার চার্চ রাস্তায় গাড়িচাপা পড়েই মারা পড়তে পারে। এখন আমাকে এটা বলো যে, যদি চার্চের এ রকম খারাপ কিছু হয়, তাহলে সেই ব্যাপারটা তুমি নিজে এলিকে বোঝাবে তো?”

“ছাড় আমাকে,” রাচেল প্রায় হিসিয়ে ওঠে। ওর চোখে আতঙ্ক এবং বেদনার ছাপ। ওর অভিব্যক্তি জানান দিচ্ছে, আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না, আর তুমি আমাকে জোর করে কথা বলাতেও পারবে না। “আমাকে যেতে দাও, গেজ ওর ক্রিব থেকে পড়ে গেল কি না-”

“ওই কথাটা তোমাকেই বলতে হবে,” লুইস বলে। “আচ্ছা তুমি ওকে বলে দিও যে ভদ্রলোকেরা এসব জিনিস নিয়ে কথা বলে না। এসব কথা তারা কবর দিয়ে রাখে—উপ্‌স! কবর শব্দ তো আবার বলা নিষেধ।”

“আই হেট ইউ!” রাচেল কেঁদে উঠে নিজেকে লুইসের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়।

রাচেলের জন্যে লুইসের বেশ খারাপ লাগতে শুরু করে। সে রাচেলকে আবারো জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে।

“রাচেল-”

রাচেল ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ও আরো কাতর হয়ে কাঁদতে শুরু করে। “আমাকে একা থাকতে দাও।” রাচেল চলে যাবার সময় কিচেনের দরজায় থেমে পেছন ঘুরে। “আমি এই ব্যাপারে আর একটা কথাও শুনতে চাই না আর। তুমি এলির সাথে এসব নিয়ে কিছু বলবে না, ব্যস। মনে থাকে যেন। মৃত্যুর মধ্যে স্বাভাবিক কিছু নেই। কিচ্ছুই নেই। ডাক্তার হিসেবে তোমার সেটা আরো ভালো করে জানার কথা।”

রাচেল আবারো ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যায়, লুইসকে কিচেনে একা ফেলে। কিচেনটা এখনো তাদের তপ্ত স্বরে কাঁপছে। সে ভাঁড়ার ঘর থেকে একটা ঝাড়ু নিয়ে এসে জায়গাটা পরিস্কার করতে করতে তার আর রাচেলের সদ্য শেষ হওয়া আলাপের কথা ভাবে। মৃত্যুর মত একটা ব্যাপারে তাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে এতো ফারাক সেটা এতোদিন কেন প্রকাশ পায়নি সেটা ভেবেই সে কূল পায় না। ডাক্তার হিসেবে সে জানে জন্মের পর মৃত্যুর মত স্বাভাবিক ঘটনা মানুষের জীবনে আর একটিও নেই। কেউ স্কুলে যেতে পারে, নাও পারে; কেউ চোখে দেখতে পারে, নাও পারে, কিন্তু মরতে তাকে হবেই হবে। মৃত্যু কাউকেই ছেড়ে দিবে না। মানুষের জীবনটা একটা ঘড়ির মত, আর এই ঘড়ি টিক টিক করতে করতে এক সময় না এক সময় ক্ষয় হতে বাধ্য। সাগরের কচ্ছপের জীবনেও এক সময় মৃত্যু ঠিকই ছোবল মারে, আর বাকি সব প্রাণীর মতই।

“জেলডা,” লুইস উচ্চস্বরে বলে ওঠে। “হায় ঈশ্বর! তিনিই জানেন, জেন্ডার মৃত্যুতে রাচেলের অবস্থা কতটা খারাপ হয়েছিল।”

প্রশ্নটা হচ্ছে লুইস কি মেনে নেবে না কি এই ব্যাপারে কিছু করবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *