অধ্যায় ৪৫
তিনটা দশ মিনিটে যখন প্লেন থেকে সব যাত্রীরা নেমে পড়ে, এলি ক্রিড তখন প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। এলির অবস্থা দেখে রাচেল খুব ভয় পেয়ে গেছে।
কেউ স্বাভাবিকভাবে ওর কাঁধে হাত রাখলেও ও লাফিয়ে উঠছে এবং তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে। আর ওর পুরো শরীর কাঁপছে। প্লেনের দুঃস্বপ্ন দেখাটা খারাপ ছিল কিন্তু এটা…রাচেলের বুঝতেও পারছে না সে কি করবে।
টার্মিনালে গিয়ে নিজের পায়ের সাথে হড়কে গিয়ে এলি মেঝেতে পড়ে যায়। ও পড়ে গিয়ে ওঠার কোন চেষ্টাও করলো না। লোকজন করুণা ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ব্যস্তভাবে হেঁটে যাচ্ছে। রাচেল ওকে টেনে তোলে।
“এলি, কী হয়েছে মামনি?” রাচেল জিজ্ঞেস করে।
কিন্তু এলি কোন উত্তর দেয় না। তারা লাগেজের জন্যে গেলে রাচেল তার বাবা-মাকে তাদের দিকে হাত নাড়তে দেখে। সেও তাদের দিকে হাত নাড়ে এবং তারা রাচেলদের কাছে চলে আসে।
“রাচেল, এলির কী অবস্থা?”
“ভালো না, মা।”
“আম্মু এদিকে বাথরুম আছে? আমি বমি করবো।”
“ওহ, ঈশ্বর,” রাচেল হতাশা ভরা কন্ঠে বলে ওঠে আর এলির হাত ধরে সামান্য দূরের লেডিস রুমটার দিকে দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করে।
“রাচেল, আমি আসবো?” রাচেলের মা বলেন।
“না, বরং আমার লাগেজগুলো নিন, আপনি তো চেনেন।”
সৌভাগ্যক্রমে লেডিস রুমটা ফাঁকাই ছিল। টয়লেটের দরজার লক খোলার জন্যে কয়েন দরকার। রাচেল তার ব্যাগের ভেতর কয়েনের জন্যে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে সে খেয়াল করে সেখানকার মোট তিনটি টয়লেটের লক নষ্ট; খোদাকে ধন্যবাদ জানায় সে। টয়লেটের একটা দরজার ওপর কেউ পেন্সিল দিয়ে লিখে রেখেছেঃ ডোনাল্ড জন একটা সেক্সিস্ট শুয়োর!
রাচেল টান দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে। এলি তার পেট চেপে গোঙাচ্ছে। ও ওয়াক ওয়াক করলো বেশ কয়েকবার, কিন্তু বমি করলো না; গলা দিয়ে শুধু বাতাস বেরিয়ে এলো শব্দ করে।
এলি যখন বলল ওর একটু ভালো লাগছে, রাচেল ওকে বেসিনের কাছে নিয়ে ওর মুখ ধুয়ে দিল। এলি ভয়ঙ্কর ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, আর ওর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।
“এলি, কী হয়েছে? আমাকে বলবে?”
“আমি জানি না, আম্মু,” ও বলে। “কিন্তু আমি জানতাম কোন একটা ঝামেলা আছে যখন আব্বু আমাকে আমাদের শিকাগো যাওয়ার কথা বলেছে। আব্বুর কিছু একটা হয়েছিল।”
লুইস তুমি কী লুকাচ্ছো? তুমি কিছু যে লুকাচ্ছো তা জলের মত পরিস্কার। এমনকি এলিও সেটা বুঝতে পারছে।
রাচেলের নিজেরও খুব অস্থির লাগছে। মাসিক শুরু হবার দু-তিন দিন আগে মেজাজ যেমন খিটমিটে হয়ে থাকে, তেমন লাগছে ওর।
“কী?” রাচেল সামনের আয়নায় এলির প্রতিবিম্বকে লক্ষ করে বলে। “মামনি, বাবার কি হয়েছে বলে তোমার মনে হয়?”
“জানি না,” এলি বলে। “আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। সেটা গেজ বা চার্চের ব্যাপারে। আমার মনে নেই।”
“এলি, তোমার স্বপ্নটা বলো আম্মুকে।”
“আমি দেখেছি আমি পেট সেমিটারিতে,” এলি বলে। “প্যাক্সকাও আমাকে নিয়ে গিয়েছে আর বলেছে বাবাও সেখানে যাবে আর খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।”
প্যাক্সকাও?” রাচেল একটা অজানা আতঙ্কে চমকে ওঠে। নামটা ওর কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে, সে আগে শুনেছে নামটা কোথাও কিন্তু মনে করতে পারছে না। “তুমি দেখেছো যে প্যাক্সকাও তোমাকে পেট সেমিটারিতে নিয়ে গেছে?”
“হ্যা, ও নিজের এই নামই বলেছিল। আর-” হঠাৎ এলির চোখগুলো প্রশস্ত হয়ে যায়।
“তোমার আর কিছু মনে আছে?”
“ও বলেছিল ওকে পাঠানো হয়েছে সতর্ক করার জন্যে কিন্তু ও সতর্ক করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। সে আরো বলেছে…কি যেনো…বাবা নাকি তার খুব কাছে ছিল যখন তার আত্মাকে ক-কব-কি যেন মনে নেই।” ও চড়া গলায় বলে।
“মামনি,” রাচেল বলে। “আমার মনে হয় তুমি গেজকে নিয়ে খুব বেশি ভাবছো তো, তাই এরকম স্বপ্ন দেখেছো। আর আমি নিশ্চিত তোমার বাবা ভালই আছে। এখন ভালো লাগছে?”
“না,” এলি ফিসফিস করে বলে। “আম্মু, আমার ভয় করছে। তোমার করছে না?”
“উ-হু,” রাচেল হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ে-কিন্তু ও সত্যিই ভয় পাচ্ছে; প্যাক্সকাও নামটা ওর ভেতরে ছোটখাটো তোলপাড় শুরু করিয়ে দিয়েছে। ওর মনে হচ্ছে ও নামটা কোন এক খারাপ সময়ে শুনেছে, সেটা হতে পারে কয়েক মাস বা কয়েক বছর আগে, কিন্তু শুনেছে।
“সবকিছুই ঠিক আছে,” রাচেল এলিকে বলে। “নানা-নানুর কাছে ফিরে যাই চলো।”
“আচ্ছা,”
একজন মহিলা তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে বকতে বকতে লেডিস রুমে ঢুকলেন। ছেলেটা হিসু করে তার শর্টস ভিজিয়ে ফেলেছে। বাচ্চাটাকে দেখে রাচেলের গেজের কথা মনে পড়ে গেল। ওর ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকা আগুনে যেন কেউ হাপড় দিয়ে হাওয়া দিয়েছে।
“চলো,” সে বলে। “আমরা তোমার নানাবাড়ি গিয়েই আব্বুকে ফোন দিব।”
“ও শর্টস পড়ে ছিল,” এলি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে। “কে শর্টস পড়া ছিল আম্মু?”
“প্যাক্সকাও,” এলি বলে। “আমার স্বপ্নে ও লাল শর্টস পড়ে ছিল।
নামটা আবারো শুনে রাচেলের পেটে একটা পাক দিয়ে ওঠে… নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েই আবার অনুভূতিটা চলে যায়।
গোল্ডম্যানদের কাছে ফিরে গেলে ডোরি জিজ্ঞেস করেন, “এখন একটু ভালো লাগছে, সোনামনি?”
“একটু,” এলি বলে। “আম্মু”
এলি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। রাচেল মুখে হাত দিয়ে হতভম্ব ভঙ্গিতে বসে আছে, তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ওর মনে পড়েছে। নামটা যেন ওকে হাতুড়ির বাড়ির মত আঘাত করেছে। ওর আরো আগেই নামটা মনে পড়া উচিত ছিল। ও ওই ঘটনাটা ভুলে যেতে চেয়েছিল বলেই হয়তো এতক্ষণ মনে পড়ছিল না।
“আম্মু?”
রাচেল ধীরে ধীরে তার মেয়ের দিকে তাকায়। এলি তার মায়ের ঘাড়ের হলকা মটমট শব্দ শুনতে পায়। রাচেল তার মুখের ওপর থেকে হাত সরায়।
“তোমার স্বপ্নের লোকটা কি তার পুরো নাম বলেছে?”
“আম্মু, তোমার কি হ-”
“তোমার স্বপ্নের লোকটা কি তার পুরো নাম বলেছে?”
ডোরি তার কন্যা এবং নাতনীর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যেন ওরা দুজনেই পাগল হয়ে গেছে।
“হ্যা, কিন্তু আমার মনে নেই…আম্মু ব্যথা পাচ্ছি তো—”
রাচেল নিচে তাকিয়ে দেখলো সে নিজের অজান্তেই এলির হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে।
“ওর নামের শুরুতে কি ভিক্টর?”
এলি চমকে একটা দ্রুত শ্বাস টেনে নেয়। “হ্যা, ভিক্টর! ও বলেছিল ওর নাম ভিক্টর। আম্মু, তুমিও কি ওকে স্বপ্নে দেখেছো?”
“প্যাক্সকাও না পাস্কো,” রাচেল বলে। “পাস্কো।”
“আমি তো সেটাই বলেছি, প্যাক্সকাও।”
“রাচেল, কি হয়েছে?” ডোরি জিজ্ঞেস করেন। তিনি রাচেলের হত ধরে সেটার শীতলতা টের পেয়ে ভুরু কুঁচকে ফেলেন। “আর এলির কি হয়েছে?”
“ওর কিছু হয়নি,” রাচেল বলে। “তবে আমার ধারণা লুইসের কিছু হয়েছে। অথবা কিছু হতে যাচ্ছে। এলির সাথে একটু বসো, মা। আমি বাসায় ফোন করবো।”
রাচেল উঠে টেলিফোন বুথের কাছে যেতে যেতে ব্যাগ থেকে একটা পয়সা খুঁজে বের করে। সে কল করলে বেশ কিছুক্ষণ ফোন রিং হয়, কিন্তু ওদিক থেকে কেউ ফোন ধরে না।
ও হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ও বলেছিল ওকে পাঠানো হয়েছে সতর্ক করার জন্যে কিন্তু ও সতর্ক করা ছাড়া কিছুই করতে পারবে না…বাবা না কি তার খুব কাছে ছিল যখন তার আত্মাকে…
রাচেল ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করে। আসলে কী হচ্ছে তাদের সাথে? কেন লুইস তাদের এরকম অদ্ভুতভাবে শিকাগো পাঠিয়ে দিচ্ছে? গেজের মৃত্যু ছাড়াও কি আরো কিছু আছে এর পেছনে? আর ভিক্টর পাস্কো, যে লুইসের প্রথম অফিসের দিনে মৃত্যু বরণ করে, এলি তার ব্যাপারে কতটা জানে?
কিছুই জানে না, তার মন নিশ্চিতভাবে জবাব দেয়। তুমি এই ব্যাপারটা এলির কাছ থেকে দূরে রেখেছিলে, যেমনটা যেকোন মৃত্যুর ব্যাপারে তুমি করে থাকো। তোমার মনে আছে এলির বিড়ালের সম্ভাব্য মৃত্যুর ইস্যু নিয়ে সেদিন লুইসের সাথে কিরকম বেকুবের মত ঝগড়া করেছিলে তুমি? কারণ তুমি মৃত্যুকে ভয় পেতে, এবং এখনো পাও। তার নাম ছিল ভিক্টর পাস্কো, এবং এলিকে এই নাম তুমি কখনোই বলোনি। রাচেল, এসব কী হচ্ছে?
রাচেলের হাত এমনভাবে কাঁপছে যে তার কয়েনটা আবার টেলিফোনে ঢুকাতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করতে হয়। ও এবার লুইসের অফিসে ফোন করে এবং চার্লটন ফোন ধরেন। তিনি একটু অবাক হয়েই বলেন যে তিনি লুইসকে দেখেননি এবং আজ লুইসকে অফিসে দেখলেই বরং অবাক হতেন। এই বলে চার্লটন আবারো রাচেলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এরপর রাচেল তাকে বলে, যদি লুইস অফিসে যায় তাহলে যেন তিনি লুইসকে রাচেলের বাবার বাসায় ফোন দিতে বলেন। হ্যা, লুইসের কাছে আমার বাবার বাসার ফোন নাম্বার আছে, সে চার্লটনের প্রশ্নের জবাবে বলে। রাচেল আসলে তার বাবার বাসার ফোন নাম্বার আর এরিয়া কোড দিয়ে চার্লটনকে বুঝতে দিতে চাইছিল না তার বাবার বাড়ি মহাদেশের আরেক মাথায়।
রাচেল ফোন রেখে দেয়। তার শরীর হালকা হালকা কাঁপছে।
এলি পাস্কোর নাম হয়তো অন্য কোথাও শুনেছে। তুমি নিশ্চয়ই ওকে খাঁচার ভেতর বন্দি করে লালন-পালন করো না। হয়তো ও টিভি বা রেডিওতে শুনেছে, অথবা ওর ক্লাসে কেউ ওকে বলেছে। হতেও তো পারে, তাই না?
রাচেলের তার কলেজে বক্তৃতা দেয়া এক মনোবিজ্ঞানীর কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন সঠিক পরিস্থিতি তৈরি করা গেলে একজন মানুষ তার জীবনের সব পরিচিত (হোক যত সামান্য পরিচয়) মানুষের নাম মনে করতে পারবে। এমনকি কোন দিন সে কী খেয়েছে, তার দীর্ঘ জীবনের কোন দিনের আবহাওয়া কেমন ছিল সবকিছু মনে করতে পারবে। তিনি বলেছিলেন মানুষের ব্রেনের স্মৃতি শক্তি যদি কম্পিউটারের মেমোরির সাথে তুলনা করা হয় তাহলে মানুষের ব্রেনের অসংখ্য মেমোরি চিপের প্রতিটির ধারন ক্ষমতা হবে ১৬ K, 32K বা 64K না, বরং শত কোটি K। আর সেসব চিপের প্রতিটিতে কতটুকু স্মৃতি ধারণ করা যায় তার কোন ধারণা মানুষের এখনো নেই। অতএব মানুষের ব্রেনে এতো জায়গা যে সেখানে কখনো নতুন তথ্য স্টোর করার জন্যে আগের তথ্য মুছে ফেলার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সব তথ্য আমাদের আসলেই প্রয়োজন নেই। তাই আমাদের ব্রেন যেটা করে সেটা হচ্ছে মেমোরির কিছু অংশ সে সুইচ অফ করে রাখে। না হলে অপ্রয়োজনীয় তথ্যের স্রোতে আমরা পাগল হয়ে যেতাম, যেটাকে বলে ইনফর্মেশনাল ইনস্যানিটি। তিনি বলেছিলেন, “যদি তোমাদের মাথায় পুরো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সেই তথ্যের পাহাড়ে তুমি তোমার পায়ের মোজা খুলে কোথায় রেখেছো তা খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে।”
এটা শুনে ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা হাসাটা কর্তব্য মনে করে হেসে উঠেছিল।
কিন্তু এটা কোন মনোবিজ্ঞান ক্লাস না, যেখানে বোর্ডে কিছু বিষয়ভিত্তিক শব্দ লেখা থাকে আর কোন আঁতেল প্রফেসর পিরিয়ডের শেষ পনেরো মিনিটে কথার ঝড় তুলে প্রচুর জ্ঞান ভিক্ষা দেন তার ছাত্রদের। এখানে কিছু একটা সাংঘাতিক ঘাপলা আছে-তুমি সেটা অনুভব করতে পারছো। আমি জানি না সেটার সাথে পাস্কো, চার্চ বা গেজের কোন সম্পর্ক আছে কি না, কিন্তু সেটার সাথে লুইসের কিছু না কিছু সম্পর্ক আছে। কী সেটা? এটা কী—
হঠাৎ একটা আশঙ্কা ওর হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়। ও আবারো টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নেয়, আর তার খুচরা কয়েনের জন্যে টেলিফোনের নিচে হাত পেতে রাখে। লুইস কি আত্মহত্যার কথা চিন্তা করছে? এজন্যেই কি ও সবাইকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছে? আর এলি কি আসলেই কোন টেলিপ্যাথি বা ওইরকম কিছু দেখেছে?
কয়েনের অভাবে সে এবারের কলটা কালেক্ট কল করে, মানে যে ফোন রিসিভ করবে সে খরচ দিবে। ফোনটা পাচ… ছয়…সাত বার রিং হয়। ফোনটা রেখে দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা কণ্ঠ বলে ওঠে, “হ্যালো?”
“জাড! জাড আমি-”
“এক মিনিট ম্যাডাম,” টেলিফোন অপারেটর বলে। “আপনি কি মিসেস ক্রিডের কাছ থেকে একটা কালেক্ট ফোন কল রিসিভ করবেন?”
“হুম,” জাড বলেন।
“দুঃখিত স্যার, এটা কি হ্যা ছিল নাকি না?”
“আমি রিসিভ করবো,” জাড বলেন।
“আচ্ছা। ধন্যবাদ। আপনারা কথা বলুন,” অপারেটর বলে।
“জাড, আপনি লুইসকে দেখেছেন আজকে?”
“আজ তো দেখিনি, রাচেল। কিন্তু আমি সকালে বাজার করতে গ্রোসারির দোকানে গিয়েছিলাম। আর দুপুরে বাড়ির পেছনের বাগানে কাজ করেছি। কেন বল তো?”
“ওহ, তেমন কিছু না। এলি আজ প্লেনের মধ্যে একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে। তাই আমি ওর মনের ভার কমাতে চাচ্ছিলাম আর কী।”
“প্লেন?” জাডের কন্ঠ হঠাৎ একটু তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। “তুমি এখন কোথায়, রাচেল?”
“শিকাগো,” সে বলে। “এলি আর আমি আমার বাবা-মার সাথে কিছুদিন থাকার জন্যে এসেছি।”
“লুইস তোমাদের সাথে যায়নি?”
“ও কয়েক দিন পরে আসবে,” রাচেল বলে। জাডের কন্ঠে এমন কিছু আছে যাতে ওর নিজের কন্ঠ স্বাভাবিক রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যাপারটা ওর একদম ভালো লাগছে না।
“লুইসের ইচ্ছেতেই কি তোমরা শিকাগো গিয়েছ?”
“উম্ম্, হ্যাঁ। জাড, কি হয়েছে? কিছু একটা হয়েছে, ঠিক?”
“তুমি এলির স্বপ্নের ব্যাপারটা আমাকে বলবে?” জাড কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বললেন।
অধ্যায় ৪৬
রাচেলের কথা বলার পরে জাড একটা পাতলা কোট গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। বাইরে মেঘ জমেছে আর বেশ বাতাস বইছে। লুইসের বাসায় যাওয়ার জন্যে রাস্তা পার হবার আগে তিনি খুব ভালো করে রাস্তায় কোন ট্রাক আছে কি না দেখে নেন। সব নষ্টের মূলে হচ্ছে এই ট্রাকের গুষ্টি। বজ্জাত ট্রাকের গুষ্টি।
তিনি অনুভব করতে পারছেন পেট সেমিটারি তাকে টানছে। আগে টানটা ছিল খুব লোভাতুর, তাকে নানান লোভ দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার করতো সেটা। কিন্তু এবারে একদম উল্টোটা। এবার অশুভ জিনিসটা তাকে যেন হুমকি দিচ্ছে। নাক গলাবে না, বুড়ো।
কিন্তু তিনি নাক গলাবেন। কারণ এর অনেকটা দায় তারই।
তিনি দেখতে পান লুইসের হোন্ডা সিভিক গাড়িটা গ্যারেজে নেই। আরেকটা ধুলো পড়া ফোর্ড ওয়াগন গাড়ি গ্যারেজে পড়ে আছে। তিনি বাড়ির পেছনের দরজাটা চেক করে দেখেন সেখানে তালা দেয়া নেই।
“লুইস,” তিনি কোন উত্তর পাবেন না জেনেও ডাকলেন, নীরবতা কাটান দেয়ার জন্যে। বুড়িয়ে যাওয়াটা তাকে খুব যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। তার হাত-পা এখন আগের চাইতে কয়েক গুণ ভারি মনে হয়। বাগানে মাত্র দু ঘন্টা কাজ করে তার কোমরে আজ প্রচন্ড ব্যথা হয়েছে। তখন মনে হচ্ছিল তার বাম কোমরের হাড়ে কেউ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
তিনি বাড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। মনে হচ্ছে তিনি লুইসের বাসায় চুরি করে ঢুকেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বুড়ো চোর, ভেবে তিনি কাজে লেগে পড়লেন। তিনি এমন কিছু দেখতে পেলেন না যা দেখলে তিনি আসলেই খুব ভয় পেয়ে যেতেন, যেমনঃ দাতব্য সংস্থায় গেজের কাপড় আর খেলনাগুলো না দিয়ে (রাচেল বলেছিল গেজের জিনিসপত্রগুলো দাতব্য সংস্থায় দান করে দিবে) ঘরেই বক্স করে রাখা…বা গেজের রুমে তার ছোট খাটটা আবারো পেতে রাখা। কিন্তু বাড়ির ভেতর এসবের কোন চিহ্ন তিনি খুঁজে পেলেন না। কিন্তু বাড়িটায় একটা শূন্য অনুভূতি হচ্ছে, যেন শূন্য বাড়িটা পূৰ্ণ করার জন্যে কিছু একটা অপেক্ষা করছে।
হয়তো আমার প্লেজেন্টভিউ গোরস্থানে যাওয়া উচিত, সেখানে কী হচ্ছে দেখার জন্যে। হয়তো লুইসের সাথেও আমার দেখা হয়ে যাবে। তাহলে ওকে নিয়ে আমি ডিনারে গেলাম বা ওরকম কিছু।
কিন্তু বিপদ প্লেজেন্টভিউ সেমিটারিতে না, আসল বিপদ এখানে, এই বাড়িতে আর এর পেছনে।
জাড লুইসদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন। তিনি কিচেনের ফ্রিজ থেকে একটা বিয়ারের সিক্স প্যাক বের করে সামনের লিভিং রুমের জানালার সামনে বসলেন। এই জানালা দিয়ে লুইসের বাড়িটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। তিনি একটা বিয়ারের ক্যান খুললেন আর একটা সিগারেট জ্বালালেন। বিকেল প্রায় শেষ হয়ে আসছে। নানান চিন্তা জাডের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। রাচেলের মনোবিজ্ঞানী শিক্ষকের কথাগুলো যদি জাড জানতেন তাহলে বলতেন এক দিক দিয়ে সেই মনোবিজ্ঞানী ঠিকই বলেছে। কিন্তু বুড়োদের স্মৃতির প্রদীপ দিন দিন নিষ্প্রভ থেকে নিষ্প্রভতর হতে থাকে। সাথে সাথে তার শরীরের অন্য অঙ্গ- প্রত্যঙ্গগুলোও। পুরনো ঘটনাগুলো একটু একটু করে মনে করতে হয়। স্মৃতি থেকে ঝাপসা সেপিয়া টোনের ছবিগুলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে থাকে, রঙ্গিন হতে থাকে, কণ্ঠগুলো দূর থেকে ভেসে আসা প্রতিধ্বনির মত শোনা যায় আর এরপর ধীরে ধীরে সেগুলো বোধগম্য হয়। এটাকে ইনফরমেশন খোঁজা বলে না, জাড ওই মনোবিজ্ঞানীকে বলতেন। এটাকে বলে ভীমরতি জাড তার মনের পর্দায় লেস্টার মরগানের ষাঁড় হ্যানরাট্টিকে দেখতে পেলেন, যেটা চোখ আগুনের মত লাল করে নড়তে থাকা যে কোন জিনিসকে শিং দিয়ে গুতিয়ে জন্মের শিক্ষা দিতে চাচ্ছে। এমন কি বাতাসে কোন গাছের পাতা নড়লে ঘাড়টা সেই গাছকেও রেহাই দিচ্ছে না। লেস্টার ষাঁড়টাকে মেরে ফেলার আগে ষাঁড়টা নিজের মস্তিষ্কবিহীন মাথার শিং দিয়ে গুতিয়ে সীমানার ভেতরের সব গাছের গুড়ি ছ্যাড়াব্যাড়া করে ফেলে। ষাঁড়টাকে মেরে ফেলার পর লেস্টারের যেমন বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছিল, জাডেরও এখন তাই হচ্ছে।
তিনি বিয়ার গিলতে থাকলেন আর সিগারেট ফুঁকতে থাকলেন। দিনের আলো মিলিয়ে গেলেও তিনি ঘরের বাতি জ্বালালেন না। ধীরে ধীরে তার জ্বলন্ত সিগারেট অন্ধকারে একটা লাল বিন্দুতে পরিণত হয়। তিনি লুইস ক্রিডের ড্রাইভ ওয়ের দিকে নজর রাখছেন। তার বিশ্বাস লুইস যখন ফিরে আসবে, যেখান থেকেই সে ফিরে আসুক-তিনি ওকে অল্প কিছু কথা বলবেন। লুইস যেন উল্টো পাল্টা কিছু করতে না পারে সেই জিনিসটা তিনি দেখবেন।
কিন্তু তিনি এখনো সেই শয়তানের জায়গাটার অশুভ শক্তির হালকা টান অনুভব করতে পারছেন। শক্তিটা সেখানকার পাথরের স্মৃতিস্তম্ভগুলোর নিচের অপবিত্র মাটি থেকে বেরিয়ে আসছে।
নাক গলাবে না, বুড়ো। নাক গলালে আফসোস করবে, খুব আফসোস। জিনিসটাকে পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা করে তিনি সিগারেট আর বিয়ার শেষ করছেন এবং অপেক্ষা করতে লাগলেন।
অধ্যায় ৪৭
জাড যখন রকিং চেয়ারে বসে তার বাড়ির দিকে নজর রাখছে, লুইস তখন হাওয়ার্ড জনসনস ডাইনিং রুমে বসে বেশ কিছু বিস্বাদ খাবার দিয়ে তার ডিনার সারছে।
তার সামনে প্রচুর খাবার এবং সবগুলো খাবারই কুখাদ্য-একদম তার দেহ যা চায়। বাইরে গোধূলীর আলো মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। সে খাবারগুলো তার গলা দিয়ে ঠেলে দেয়। একটা স্টেক। একটা বেকড পটেটো। একটা বিনসের সাইড ডিশ, যেটাতে সবুজের নাম মাত্র নেই। একটা আপেল পাই ওয়েজ, তার ওপরে দেয়া আইস্ক্রিম, যেটা গলে গলে পড়ছে। সে রেস্টুরেন্টের এক কোণের একটা রুমে বসেছে। লোকজনের আসা যাওয়া দেখছে আর ভাবছে পরিচিত কারো সাথে না দেখা হয়ে যায়। সে আবার ক্ষীণ আশাও করছে যেন কোন পরিচিত মানুষের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। তাহলে নানান রকম প্রশ্ন হবে-রাচেল কোথায়? তুমি এখানে কী করছ? কী হচ্ছে?-এবং এসব প্রশ্নের কারণে হয়তো জটিলতা সৃষ্টি হবে, এবং সে হয়তো তাই চাচ্ছে। ইস্তফা দেয়ার একটা ছুঁতো।
এবং আসলেই দেখা গেল তার পরিচিত এক দম্পতি ডাইনারে এসে ঢুকেছে। সে তখন তার আপেল পাই শেষ করে তার দ্বিতীয় কাপ কফি পান করছে। রব গ্রিনেল, ব্যাঙ্গরের একজন ডাক্তার এবং তার সুন্দরি বউ বারবারা। লুইস তাকে দেখে চেনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু ওয়েট্রেস দুজনকে দূরের একটা বুখে নিয়ে যায়। লুইস তাদের আর দেখতে না পেলেও মাঝে মাঝে গ্রিনেলের অল্প বয়সের পাকা চুলের উঁকিঝুঁকি দেখতে পাচ্ছে।
ওয়েট্রেস চেক নিয়ে আসে। সে চেকে সাইন করে এবং সাইনের নিচে তার রুম নাম্বার লিখে দেয়। এরপর সে বেরিয়ে পড়ে।
বাইরে বেশ বাতাস বইতে শুরু করেছে। আকাশে কোন তারা নেই কিন্তু প্রচুর মেঘ দ্রুত বেগে ভেসে বেড়াচ্ছে। লুইস ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণের জন্যে, হাতগুলো পকেটে ঢুকিয়ে, বাতাসের দিকে মাথা উচু করে। এরপর সে তার রুমে ফিরে গিয়ে টিভি চালিয়ে দেয়। মারাত্নক কিছু করার জন্যে হাতে অনেক সময় আছে আর বাইরের বাতাসটা তাকে নার্ভাস করে দিচ্ছে।
সে টানা চার ঘন্টা টিভি দেখে। একটি কমেডি প্রোগ্রামের আধা ঘন্টার আটটি পর্ব এক বসায় দেখে ফেলে সে। তার মনে পড়ে সে অনেক দিন পর এতো লম্বা সময় ধরে টিভি দেখলো। অনুষ্ঠানের মহিলাদের দেখে তার মনে হচ্ছে এদেরকেই সে আর তার হাই স্কুলের বন্ধুরা ‘মাল’ বলতো।
ঠিক এই সময়েই শিকাগোতে ডোরি গোল্ডম্যান চিৎকার করে উঠেন, “ফিরে যাবে? এখনি ফিরে যেতে চাচ্ছো তুমি? তুমি মাত্র এসে পৌঁছেছ এখানে!”
লাডলোতে নিজের বাসার জানালার কাছে বসে জাড ক্র্যান্ডাল সিগারেট ফুঁকছেন, বিয়ার গিলছেন এবং নিজের স্মৃতির ডাইরি নেড়েচেড়ে দেখছেন। আগে হোক, পরে হোক, লুইস ঠিকই তার বাড়িতে ফিরে আসবে। পেট সেমিটারিতে যাওয়ার অন্য রাস্তা আছে ঠিক, কিন্তু লুইস সেসব চেনে না। যেতে হলে তাকে তার নিজের বাড়ির কাছ থেকেই শুরু করতে হবে।
এসব ঘটনার ব্যাপারে কিছু না জেনেই লুইস তার সামনে থাকা রঙ্গিন টেলিভিশন সেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এসব টিভি প্রোগ্রামের ব্যাপারে যা শুনেছিল- একটা শ্বেতাঙ্গ পরিবার, একটি ব্লাক পরিবার, একটা বড় লোকের স্টুপিড পরিবারের সাথে একটি খুব বুদ্ধিমান ছেলের বসবাস, একজন সিঙ্গেল মহিলা, একজন বিবাহিত মহিলা এবং একজন ডিভোর্সি মহিলা। সে টিভির সামনে বসে জানালা দিয়ে বাইরের রাত দেখার ফাঁকে ফাঁকে এই সবকিছুই দেখে ফেলেছে এর মধ্যে।
টিভিতে ১১টার সংবাদ শুরু হওয়া মাত্র লুইস টিভি অফ করে বেরিয়ে পড়ে। বেরিয়ে পঢ়লো সেই কাজটি করতে, যেই কাজটি করার সিদ্ধান্ত হয়তো সে রাস্তার ওপর গেজের রক্ত মাখা বেসবল ক্যাপটা পড়ে থাকতে দেখেই নিয়ে নিয়েছিল। তাকে সেই শীতলতার চাদর আবারো জাপটে ধরছে, কিন্তু তার ভেতর থেকেও একটা উষ্ণতার বিকিরন হচ্ছে। এই উষ্ণতা হচ্ছে তার ব্যগ্রতা, আবেগ অথবা লোভ। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এই উষ্ণতা তাকে সেই শীতলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগাচ্ছে। সে যখন নিজের হোন্ডা সিভিক গাড়িটার ইঞ্জিন ইগনিশন করলো, তখন সে ভাবল জাডের কথাই হয়তো ঠিক; জায়গাটার ক্ষমতা বাড়তে থাকে। সে এখন সেই ক্ষমতা তার চারপাশে টের পাচ্ছে, যেটা তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে এবং সে ভাবে, আমি কি থামতে পারবো? আমি যদি থামতে চাই তাহলেও কি আমি থামতে পারবো?
অধ্যায় ৪৮
“তুমি কী চাচ্ছো? ডোরি আবারো জিজ্ঞেস করেন। “রাচেল…তুমি খুব ক্লান্ত…রাতটা ভালো করে ঘুমিয়ে তারপর…”
রাচেল শুধু তার মাথা নাড়ে। সে তার মাকে বোঝাতে পারবে না যে কেন তার ফিরে যাওয়া খুব দরকার। অনুভূতিটা তার ভেতরে প্রথমে কেবল মাঠের ঘাসের ডগাগুলোতে ঢেউ খেলানো বাতাসের মত আবির্ভাব হয়। এরপর সেটা বাড়তে বাড়তে চারদিকের সব গাছপালা দোলাতে থাকে; এরপর সেটা বাড়িঘর কাঁপানো ঝড়ো হাওয়ার মত বইছিল; আর অবশেষে সেই হাওয়া হারিকেনের রূপ নিয়েছে এবং যে কোন মুহূর্তে তা চারদিকের সব কিছু ভেঙেচূড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
শিকাগোতে তখন ছয়টা বাজে। ব্যাঙ্গরের ডাইনারে লুইস তার বিস্বাদ খাবারের সামনে বসে ছিল। রাচেল আর এলি খাবার টেবিলে বসে তাদের খাবার নাড়াচাড়া করছে, কিন্তু তেমন কিছুই খাচ্ছে না। রাচেল বারবার খাবারের প্লেট থেকে মুখ তুলে এলির দিকে তাকাচ্ছে। এলি তার আবেদন ভরা চাহনি দিয়ে রাচেলের দিকে তাকিয়ে বলছে যে আম্মু তুমি বাবাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্যে কী করছো?
রাচেল জাডের টেলিফোনের জন্যে অধীরভাবে অপেক্ষা করছে। ফোনটা যখন অবশেষে বেজে উঠলো রাচেল প্রায় লাফিয়ে উঠে ছো মেরে রিসিভারটা তুলে নিল। কিন্তু জাড ফোন করেননি, করেছেন ডোরির ব্রিজ ক্লাবের একজন বান্ধবি, ডোরি ঠিকভাবে ফিরেছেন কি না জানার জন্যে।
বড়রা সবাই কফি খাওয়া শুরু করলে রাচেল হঠাৎ তার ন্যাপকিনটা ছুঁড়ে ফেলে বলে উঠলো, “বাবা…মা… আমি সরি, কিন্তু আমার বাসায় যেতে হবে। আমি যদি আজ একটা প্লেন ধরতে পারি তাহলে আজ রাতেই যাব।”
ওর বাবা মা হতভম্ব হয়ে পড়েন কিন্তু এলি স্বস্তিতে তার চোখ বন্ধ করে ফেলে।
তারা রাচেলকে বুঝতে পারে না এবং রাচেলও তাদের ব্যাপারটা বোঝাতে পারে না। সে বিশ্বাস করে না এলি ভিক্টর পাস্কোর নাম কোন টিভির খবরে শুনেছে আর তার বাবার সাথে পাস্কোর সংযোগটা ও বুঝে নিয়েছে অবচেতন মনে।
“রাচেল, মা আমার।” তার বাবা খুব নরম ঠান্ডা গলায় বলে, যেভাবে কেউ কোন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগির সাথে কথা বলে। “এগুলো সবই তোমার ছেলের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া। তুমি আর এলি দুজনেই ব্যাপারটায় খুব কঠিনভাবে রিয়েক্ট করছো, কিন্তু সেটা তোমাদের দোষ না। কিন্তু তুমি একদম ভেঙে পড়বে যদি তুমি—”
রাচেল তার কথার জবাব দেয় না। সে ফোনের কাছে গিয়ে টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে ডেল্টা এয়ারলাইন্সের নাম্বার বের করে ডায়াল করতে থাকে। ডোরি ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওকে বলছেন যে ওর অন্তত আরেকবার চিন্তা করে দেখা উচিত, লাভ ক্ষতিগুলো লিস্ট করে দেখা উচিত…এবং তার পেছনে এলি দাঁড়িয়ে আছে মুখ কালো করে কিন্তু এখন ওর মুখে একটা হালকা আশার আভা দেখা যাচ্ছে, যা দেখে রাচেল কিছুটা ভরসা পাচ্ছে।
“ডেল্টা এয়ারলাইন্স,” ফোনের ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠ বলে। “কিম বলছি। কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“আমার আজ রাতেই শিকাগো থেকে ব্যাঙ্গর যাওয়া প্রয়োজন, খুবই ইমারজেন্সি। আপনি একটু চেক করে দেখবেন ভেঙে ভেঙে যাওয়ার টিকিট পাওয়া যাবে কিনা?”
“ম্যাম, এটা খুব শর্ট নোটিস,” কিম সন্দেহের গলায় বলে।
“তাও, প্লিজ চেক করে দেখুন,” রাচেল বলে, সামান্য ভাঙা গলায়।
“আমি স্ট্যান্ডবাই বা যে কোন কিছু নিতে রাজি আছি।”
“আচ্ছা, ম্যাম। একটু ধরুন তাহলে।” টেলিফোনটা নীরব হয়ে যায়।
রাচেল তার চোখ বন্ধ করে ফেলে এবং কয়েক মুহূর্ত পরে সে তার বাহুতে একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করে। সে তার চোখ খুলে দেখে এলি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আরউইন এবং ডোরি নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন তাদের দিকে তাকিয়ে। যেভাবে মানুষ বদ্ধ পাগলের দিকে তাকায়, রাচেল ভাবে। ও এলির দিকে তাকিয়ে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে হাসে।
“মা, উনাদের কথা শুনবে না, প্লিজ,” এলি নিচু গলায় বলে। “প্লিজ।”
“ঠিক আছে, বিগ সিস্টার,” রাচেল বলেই চেহারা কুচকে ফেলে। গেজের জন্মের পর থেকে তারা এলিকে বিগ সিস্টার বলে ডাকতো। কিন্তু এখন সে আর কারো বড় বোন না।
“থ্যাঙ্কস,” এলি বলে।
“এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই না?”
এলি ওপর নিচে মাথা ঝাঁকায়।
“মামনি, আমারও মনে হচ্ছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তুমি আমাকে আরো কিছু বলতে পারলে আমার বুঝতে সুবিধে হতো। এটা কি শুধু ওই স্বপ্নটা?”
“না,” এলি বলে। ‘এটা… এটা সব কিছুই। মনে হচ্ছে এটা আমার শরীরের ভেতর দিয়ে বইছে। তুমি কি এটা টের পাচ্ছো, মামনি? অনেকটা ইয়ের মত—”
“অনেকটা বাতাসের মত।”
এলি চমকে উঠে।
“কিন্তু তুমি কি জানো এটা কী? আর ওই স্বপ্নের ব্যাপারে আর কিছু মনে আছে তোমার?”
এলি খুব জটিলভাবে চিন্তা করে কিন্তু এরপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুপাশে মাথা নাড়ে। “আব্বু। চার্চ। আর গেজ। আমার শুধু এই মনে আছে। কিন্তু এই তিনে মিলে কী হয়েছিল আমার মনে নেই!”
রাচেল খুব শক্ত করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। “সব ঠিক হয়ে যাবে মামনি,” রাচেল বলে কিন্তু তার মনের ভার একটুও কমে না।
“হ্যালো, ম্যাম,” রিজার্ভেশন ক্লার্ক বলে।
“হ্যালো?” রাচেল টেলিফোনের রিসিভার আর এলির হাত দুটোই খুব শক্ত করে ধরে।
“আমার মনে হয় আমি আপনাকে ব্যাঙ্গর পর্যন্ত ভাংতি টিকিট জোগাড় করে দিতে পারবো। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার অনেক রাত হয়ে যাবে।”
“সেটা কোন ব্যাপার না.” রাচেল বলে।
“আপনার কাছে কলম আছে? ব্যবস্থাটা খুব জটিল।”
“হ্যা, এক সেকেন্ড,” রাচেল ড্রয়ার থেকে একটা পেন্সিল বের করতে করতে বলে। ও একটা চিঠির খাম নেয় সেটার পেছনে লিখার জন্যে। “এবার বলুন।”
রাচেল খুব মন দিয়ে শুনে সব লিখে রাখে। এয়ারলাইন ক্লার্কের বলা শেষ হলে সে মৃদু হেসে হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনি দিয়ে • বানিয়ে এলিকে দেখিয়ে বোঝায় সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো, সব ঠিক হয়ে যাবে, সে মনে মনে বলে। শিকাগো থেকে ব্যাঙ্গর যাওয়ার যে রুট সে পেয়েছে তার জন্যে তাকে কয়েকবার প্লেন চেঞ্জ করতে হবে এবং তার মধ্যে অল্প সময়ের মধ্যে বস্টনে একটা প্লেন থেকে নেমে আরেকটা প্লেন ধরা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। “প্লিজ, সবগুলো বুক করে ফেলুন,” রাচেল বলে। “এবং আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
কিম রাচেলের নাম এবং ক্রেডিট কার্ডের ইনফর্মেশন নেয়ার পর ফোন রাখে। রাচেল ফোন রেখে বাবার দিকে তাকায়। “বাবা, তুমি আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসবে গাড়িতে করে?’
“আমার তোমাকে নিষেধ করা উচিত,” গোল্ডম্যান বলেন। “আমার উচিত এই পাগলামো এখানেই বন্ধ করা।”
“খবরদার!” এলি চিৎকার করে ওঠে। “এটা কোন পাগলামি না! একদম না!” গোল্ডম্যান চোখ পিটপিট করে পিছিয়ে যান। তিনি এলির ফেটে পড়া দেখে বেশ হকচকিয়ে গেলেন।
ওকে পৌঁছে দিয়ে এসো, আরউইন,” ডোরি কিছুক্ষণ নীরবতার পরে বললেন।”আমার নিজেরও নার্ভাস লাগছে। লুইসের খবর নেয়াটা আমারও জরুরি মনে হচ্ছে।”
গোল্ডম্যান কিছুক্ষণ তার স্ত্রীর দিকে তাকানোর পর তার মেয়ের দিকে ফিরলেন। “আচ্ছা, আমি তোমাকে পৌঁছে দেব, সেটাই যদি তোমার ইচ্ছে হয়,” তিনি বলেন। “আর…তুমি চাইলে আমিও তোমার সাথে যেতে চাই।”
রাচেল দুপাশে তার মাথা নাড়ে। “ধন্যবাদ বাবা। কিন্তু আমার সিটগুলোই প্লেনের শেষ সিট। খোদা যেন আমার জন্যেই সেগুলো বাঁচিয়ে রেখেছেন।”
আরউইন গোল্ডম্যান দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। হঠাৎ তাকে খুব বুড়ো মনে হতে থাকে। রাচেলের হঠাৎ মনে হলো তার বাবাকে জাড ক্র্যান্ডালের মত লাগছে।
তোমার এখনো ব্যাগ গুছানোর সময় আছে,” তিনি বলেন। “আমাদের এখান থেকে এয়ারপোর্ট যেতে চল্লিশ মিনিট লাগবে, যদি আমি আগের মত গাড়ি চালাই, যখন তোমার মা আর আমার বিয়ে হয়েছিল। ওকে তোমার একটা ব্যাগ খুঁজে দাও, ডোরি।”
“আম্মু,” এলি বলে। রাচেল তার মেয়ের দিকে ফেরে। এলির চেহারায় এখন হালকা ঘাম চিকচিক করছে।
“কী, মামনি?”
“সাবধান থেকো, মা,” এলি বলে।
অধ্যায় ৪৯
গাড়ি থেকে সন্ধ্যার আলোতে রাস্তার পাশের গাছগুলোকে মনে হচ্ছিল সেগুলো দ্রুত বেগে পেছনে চলে যাচ্ছে। লুইস তার হোন্ডাটা মেসন স্ট্রিটে পার্ক করে। রাস্তাটা প্লেজেন্টভিউর দক্ষিণ সীমানা ঘেষে। এখানে বাতাস এতো জোরে বইছে যে সে গাড়ির দরজা খোলার সাথে সাথে তার হাত থেকে দরজাটা ছুটে যায়। দরজাটা তাকে বেশ শক্তি খরচ করে বন্ধ করা লাগে। তার জ্যাকেট বাতাসে উড়ছে। গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে ত্রিপলে পেঁচানো মাটি খোঁড়ার জিনিসগুলো বের করে সে।
ত্রিপলে মোড়া জিনিসগুলো দুহাতে পাজঁকোলা করে দুটো স্ট্রিট লাইটের মাঝখানের অপেক্ষাকৃত অন্ধকার জায়গায় এসে দাঁড়ায়। সাবধানে চারদিক চেক করে রাস্তা পেরিয়ে গোরস্তানের লোহার বেড়ার সামনে যায়। সে চায় না কেউ তাকে দেখুক। এমনকি যে পথচারী তাকে এক মুহূর্তে দেখে পরের মুহূর্তে ভুলে যাবে, সেরকম কেউ তাকে দেখুক সেটাও সে চায় না। পাশে একটা দেবদারু গাছের ডালপালা বাতাসে গর্জন করছে। তার প্রচন্ড ভয় হচ্ছে। এই কাজটা শুধু বর্বর না, এটা পাগলামি।
রাস্তায় কোন গাড়ি নেই। মেসন স্ট্রিটের স্ট্রিট ল্যাম্পগুলোকে মনে হচ্ছে অনেকগুলো ছোট হতে থাকা আলোর গোলা, যেগুলো রাস্তার পাশের ফুটপাত আলোকিত করে রেখেছে। দিনের বেলা পাশের ফেয়ারমাউন্ট গ্রামার স্কুল ছুটি হলে ছেলেরা এখানেই বাইক চালায় আর মেয়েরা দড়িলাফ খেলে, পাশের গোরস্তানের দিকে খেয়াল না করেই। কিন্তু হ্যালোয়িনের সময় জায়গাটার কদর বেড়ে যায়। তখন হয়তো তারা রাস্তাটা পেরিয়ে গোরস্তানের লোহার বেড়ার গায়ে কাগজের কঙ্কাল ঝুলিয়ে দেয় তাদের জানা কিছু কৌতুক নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে। এই গোরস্থানটা শহরের সব চাইতে জনপ্রিয় জায়গা; এখানে আসার জন্যে মানুষেরা মরেই যাচ্ছে। আর কেউ একবার এসে ঢুকতে পারলে আর বেরোতেও চায় না।
“গেজ,” সে বিড়বিড় করে বলে। গেজ ওখানেই আছে, লোহার বেড়ার ওপাশে; তাকে অযাচিতভাবে মাটির জেলে আটকে রাখা হয়েছে। তোমাকে আমি বের করে আনবো গেজ, সে ভাবে। তোমাকে বের করে আনবো, বা চেষ্টা করতে করতে মারা যাব।
সে আবারো চারদিকে ভালো করে দেখে নিয়ে হাতের জিনিসগুলো বেড়ার ওপাশে ছুঁড়ে দেয়। বান্ডেলটা মাটিতে পড়ে যাবার সময় একটা ধাতব শব্দ হয়। হাত ঝেড়ে নিয়ে লুইস সেখান থেকে সরে যায়। জায়গাটা সে নিজের মনে চিহ্ন দিয়ে রাখে। যে যদি ভুলেও যায় তাহলেও খুব একটা সমস্যা নেই। ভেতরে গিয়ে লোহার বেড়া বরাবর হেঁটে ওর হোন্ডা সিভিক বরাবর এসে দাঁড়ালেই হবে।
কিন্তু গেট কি খোলা থাকবে এতো রাতে?
সে মেসন স্ট্রিটের স্টপ সাইনের দিকে হেঁটে যায়। বাতাসের কারণে রাস্তার ওপর গাছের ছায়া নৃত্য করছে।
মোড় নিয়ে প্লেজেন্ট রোডে ওঠে সে, লোহার বেড়াটা অনুসরণ করতে করতে। একটা গাড়ির হেড লাইটের আলো দেখতে পেয়ে লুইস পাশের দেবদারু গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। গাড়িটা কোন পুলিশের গাড়ি না; সাধারণ একটা ভ্যান। সেটা বেশ খানিকটা দূরে যাওয়ার পর সে আবারো হাঁটতে শুরু করে।
অবশ্যই গেট খোলা থাকবে। থাকতেই হবে।
সে গেটের কাছে পৌঁছে যায়। সে গেটে ধাক্কা দেয়।
গেট লক করা।
আরে বেকুব, এটা তো লক থাকারই কথা। তুমি কি সত্যি ভেবেছিলে যে পৌরসভার এলাকার মধ্যে একটা গোরস্তানের দরজা কেউ রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা রাখবে? এখন আর কেউ লোকজনকে এতোটা বিশ্বাস করে না, বন্ধু। সুতরাং, এখন তুমি কী করবে?
এখন তাকে বেড়াটা টপকাতে হবে। বানরের মত লোহার বেড়াটার ওপরে উঠতে হবে। সে শুধু আশা করতে পারে যে সেসময় কেউ টিভি থেকে তাদের চোখ সরাবে না।
হ্যালো, পুলিশ স্টেশন? আমি মাত্র দেখলাম দুনিয়ার সবচাইতে ধীর আর বুড়ো খোকাকে, প্লেজেন্টভিউ গোরস্থানের দেয়াল টপকাতে। দেখে মনে হচ্ছিল সে ভেতরে ঢোকার জন্যে মরে যাচ্ছে। আমার মনে হয় ব্যাপারটা আপনাদের একটু দেখা উচিত। কে জানে, হয়তো কেঁচো খুঁড়তে …
লুইস প্লেজেন্ট স্ট্রিট ধরে হাঁটতে থাকে এবং কিছুক্ষণ পর ডানে মোড় নেয়। তার পাশপাশি লোহার বেড়াটাও এগিয়ে চলছে, বিরামহীনভাবে। বাতাসের তোড়ে তার কপালের ঘাম বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। তার ছায়া কখনো স্ট্রিট লাইটের আলোয় গাঢ় হয়ে উঠছে আবার কখনো আলোর অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। সে চলতে চলতে মাঝে মাঝে বেড়াটার দিকে চট করে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এরপর সে দাঁড়ায় এবং বেড়াটার দিকে ভালো করে তাকায়।
তুমি এটার ওপরে চড়বে, খোকা? হাসিও না।
লুইস ক্রিড যথেষ্ট লম্বা একজন পুরুষ, সে লম্বায় প্রায় ছয় ফুট দুই ইঞ্চি, কিন্তু লোহার বেড়াটার উচ্চতা হবে কমপক্ষে নয় ফুট। আর লোহার প্রত্যেকটা শিক ওপরের দিকে তীরের ফলার মত সুচারু। দেখতে বেশ সুন্দর, কিন্তু যদি বেড়া টপকানোর সময় পা পিছলে যায় এবং তার ভারি শরীরের ওজন সেই ফলাগুলোর ওপর পড়ে তাহলে কোন একটা ফলা তার অন্ডকোষ ফাটিয়ে দিলে অবাক হবার মত কিছু নেই। আর তখন শিকে গাথা বারবিকিউড শুয়োরের মত লটকে থাকতে হবে, যতক্ষণ না তার চিৎকার শুনে কেউ পুলিশে খবর দেয়।
তার জামা ঘামে ভিজে পিঠের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। চারদিক বেশ সুনশান, শুধু হ্যামন্ড রোড থেকে কিছু গাড়ি চলাচলের শব্দ আসছে।
ভেতরে ঢোকার একটা উপায় অবশ্যই পাওয়া যাবে।
পেতেই হবে।
লুইস, ভেবে দেখো। তুমি পাগল হতে পারো কিন্তু এতোটা পাগল তুমি না। হয়তো তুমি কোনভাবে বেড়ার ওপরে উঠতে পারবে। কিন্তু ওই সুচারু ফলাগুলোতে নিজের বিচি না গেথে টপকে যেতে একজন ট্রেইনড জিমন্যাস্ট লাগবে, যেটা তুমি নও। আর ধরলাম তুমি কোনভাবে ঢুকতে পারলে, কিন্তু সেখান থেকে গেজকে নিয়ে তুমি কিভাবে বেরিয়ে আসবে?
সে হাঁটতে থাকে। সে বুঝতে পারে চক্রাকারে গোরস্থানটাকে প্রদক্ষিণ করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই সে করছে না।
ঠিক আছে, উত্তর পাওয়া গেছে। আজ রাতে আমি বাসায় ফিরে কাল আবার এখানে আসবো, বিকেলের দিকে। চারটার দিকেই আমি ভেতরে ঢুকে লুকিয়ে থাকবো মাঝরাত পর্যন্ত। এভাবে চিন্তা করলে কাজটা আজও করতে পারতাম।
খুব ভালো বুদ্ধি, ওহ গ্রেট স্বামী লুইসানন্দ! আর তুমি যে কবর চুরি করার যন্ত্রপাতিগুলো ভেতরে ছুঁড়ে ফেলেছ, সেগুলো দেখলে গোরস্থানের লোকেরা কি আঙুল চুষবে?
জিনিসগুলো ঝোপের ভেতর পড়েছে। কে দেখতে যাবে ওসব?
ভাবনাটা বেশ যৌক্তিক, কিন্তু সে এখানে কোন যৌক্তিক কাজ করতে আসেনি। তার মন বলছে আজ যদি সে ফিরে যায়, তাহলে সে কাল এখানে ফিরে আসতে পারবে না। হয় কাজটা সে আজ করবে, নাহলে কখনোই করতে পারবে না। এই সেই মুহূর্ত।
এই রাস্তায় বাড়ির সংখ্যা তুলনামূলক কম। বেড়ার ভেতর দিয়ে সে দেখতে পায় এখানকার কবরগুলো বেশ পুরনো; ফলকগুলো বেশি গোলাকার আর তাদের অনেকগুলোই সামনে বা পেছনের দিকে হেলে পড়েছে। একটু সামনেই আরেকটা স্টপ সাইন। আরেকবার মোড় নিলে সে যেই রাস্তা থেকে শুরু করেছিল কবরস্থানের বিপরীত দিকে, সেই রাস্তার প্রায় সমান্তরাল আরেকটা রাস্তায় গিয়ে হাজির হবে। আর যখন সে তার শুরুর জায়গায় ফিরে যাবে তখন সে কি করবে? আরেকটা টিকেট কেটে আবারো কবরস্থানের চারপাশে বেড়াতে আসবে? না কি পরাজয় মেনে নেবে?
সামনের মোড়ে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। লুইস চট করে আরেকটা গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। গাড়িটা খুব ধীরে ধীরে চলছে এবং একটু পরেই গাড়ির প্যাসেঞ্জার সাইড থেকে একঠা স্পট লাইট গোরস্থানের লোহার বেড়ার ওপর এসে পড়ে। লুইসের হৃৎপিন্ড লাফিয়ে তার গলার কাছে চলে আসে। এটা একটা পুলিশের গাড়ি, সেমেটারিটা চেক করছে।
সে নিজেকে গাছটার সাথে একদম মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, মুখটা গাছের খসখসে বাকলের ওপর চেপে ধরে। সে প্রার্থনা করতে থাকে যেন গাছটা তাকে ঢেকে রাখার জন্যে যথেষ্ট মোটা হয়। স্পটলাইটের আলো তার দিকে ছুটে আসে। সে তার মুখ নিচু করে ফেলে যাতে ঝাপসা আলোয় তার চেহারা না বোঝা যায়। লাইটটা গাছের কাছে পৌঁছে এক মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে যায় এবং পরমুহূর্তেই গাছের ডান দিক থেকে আবারো আত্মপ্রকাশ করে। সে সামান্য একটু বায়ে সরে যায়। সে অপেক্ষা করতে থাকে কখন গাড়ির ব্রেক লাইট জ্বলে উঠবে, এরপর গাড়ির দরজা খুলে যাবে। কে! কে ওখানে? গাছের পেছনে কে! ওখান থেকে বেরিয়ে আসুন বলছি! দুহাত যেন খালি থাকে! এখুনি বেরিয়ে আসুন বলছি!
পুলিশের গাড়িটা চলতেই থাকে। এরপর মোড়ের কাছে গিয়ে বাঁয়ে চলে যায়। লুইস গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। সে দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে এবং তার গলা শুকিয়ে গেছে। সে ভাবে পুলিশের গাড়িটা হয়তো তার হোল্ডা সিভিকটা দেখবে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ মেসন রোডে সন্ধ্যার পর থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত পার্কিং করার অনুমতি আছে। আর সেখানে আরো বেশ কিছু গাড়ি পার্ক করা আছে। সেগুলোর মালিক আশেপাশের বাড়ির মালিকেরাই হবেন।
লুইস খেয়াল করলো সে তার রক্ষক গাছটার ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
তার মাথার ওপর থেকেই গাছের একটা ডাল বেরিয়ে গেছে। সে ভাবলো হয়তো-
আর কিছু চিন্তা না করেই সেই ডালে পা রেখে গাছে উঠতে থাকে। তার টেনিস জুতোর ঘষায় গাছের মরা বাকল ঝুর ঝুর করে ঝড়ে পড়তে থাকে নিচের ফুটপাতে। সে আরেকটু কসরত করে গাছের উরুসন্ধিতে নিজেকে টেনে তোলে। পুলিশের গাড়িটা যদি আবারো এই রাস্তায় ফিরে আসে তাহলে তাদের স্পটলাইট হয়তো এই গাছের ডালে একটা অদ্ভুত জন্তু আবিষ্কার করবে। তাকে খুব দ্রুত এগুতে হবে।
সে আরেকটু উঁচু একটা ডালে চড়লো, যে ডালটা লোহার বেড়ার ওপর দিয়ে গোরস্তানের ভেতরে চলে গেছে। তার নিজেকে বারো বছরের কিশোর বলে মনে হতে থাকে, যেটা এক সময় হয়তো সে ছিল। গাছটা একদম স্থির না, বিরামহীন বাতাসে সেটা সহজেই দুলছে। গাছের পাতাগুলো বাতাসে মর্মর আওয়াজ করছে। লুইস তার বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে এবং আর বেশি কিছু না ভেবেই ডালটা ধরে ঝুলে পড়ে। ডালটা একজন মানুষের বাহুর চাইতে একটু বেশি মোটা। তার পা মাটি থেকে প্রায় আট ফিট উপরে ঝুলছে। সে একটু একটু করে বেড়াটার দিকে এগুতে থাকে। ডালটা কিছুটা নিচে নেমে এলেও ভাঙার কোন চিহ্ন দেখালো না। নিচের ফুটপাতে তার ছায়াটাকে দেখা যাচ্ছে গাছে ঝুলতে থাকা একটা বানরের মত। বাতাসে তার উষ্ণ বগল শীতল হয়ে যাচ্ছে। তার মুখ আর ঘাড় বেয়ে নামতে থাকা ঘামের মধ্যেই সে শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার নড়াচড়ার সাথে সাথে গাছের ডালটিও দুলতে থাকে। সে যত সামনে এগোয়, দুলুনিও তত বাড়তে থাকে। তার হাত ক্লান্ত হয়ে আসছে আর তার ভয় হচ্ছে তার ঘামে ভেজা হাত হয়তো পিছলে যাবে।
সে বেড়ার কাছে পৌঁছে গেছে। তার টেনিস জুতোগুলো বেড়ার চোখা ফলা থেকে প্রায় এক ফুট নিচে ঝুলছে। এই কোণ থেকে ফলাগুলোকে একদমই ভোঁতা মনে হচ্ছে না। ভোঁতা হোক আর ধারালো হোক, সে এখন বুঝতে পারছে এখানে শুধু তার অন্ডকোষই বিপদে নেই। সে যদি বেকায়দায় ফলাগুলোর ওপর গিয়ে পড়ে তাহলে তার ওজন তীক্ষ্ণ ফলাগুলোকে তার ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। ফিরে আসা পুলিশেরা হয়তো তাহলে হ্যালোয়িনের জন্যে খুব জীবন্ত একটা আগাম ডেকোরেশন পাবে প্লেজেন্টভিউর বেড়ার ওপর।
হাঁপিয়ে না উঠলেও সে খুব দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। তার পাগুলো দিয়ে বেড়ার ফলাগুলো খুঁজতে থাকে, একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্যে। তার পাগুলো শূন্যে নেচে বেড়াচ্ছে কিন্তু যা খুঁজছে তা পাচ্ছে না।
সে একটা আলো দেখতে পায় যেটা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
ওহ খোদা! গাড়ি আসছে!
সে দ্রুত হাত চালাতে চেষ্টা করে কিন্তু তার হাতের তালু কিছুটা ফসকে যায়। তার এক হাতের আঙুলের সাথে আরেক হাতের আঙুলের বজ্র আটুনি খুলে আসছে।
পা দিয়ে বেড়া খুঁজতে খুঁজতেই সে তার ব্যথা হয়ে যাওয়া বাম বাহুর নিচ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। এটা একটা গাড়িই, তবে সেটা থামার কোন রকম চিহ্ন না দেখিয়ে মোড়ের দিকে চলে যায়। খুব লাকি। যদি সেটা-
তার হাত আবারো পিছলে যায়। ডালের খসে পড়া বাকল তার মাথার ওপর ঝরে পড়ে। তার এক পা বেড়া খুঁজে পেয়েছে, আর আরেক পায়ের প্যান্ট বেড়ার ফলার সাথে আঁটকে গেছে। কিন্তু তার আর বেশিক্ষণ ঝুলে থাকার মত শক্তি নেই। লুইস প্রাণপণে তার পা ঝাড়া দেয়। ডালটা নিচু হয়ে আসে এবং তার হাত আরেকটু পিছলে যায়। সে কাপড় ছেঁড়ার আওয়াজ শুনতে পায় এবং পর মুহূর্তেই খেয়াল করে সে বেড়ার দুটো ফলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ফলাগুলো তার টেনিস জুতোর সোলে বিপদজনকভাবে খোঁচা দিচ্ছে এবং তার যন্ত্রণাও হচ্ছে কিন্তু সে তারপরও সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ তার হাতের সামান্য আরাম তার পায়ের ব্যথার চাইতে অনেক বেশি দামি বলে মনে হচ্ছে।
সে বাঁ-হাতে ডালটা ধরে থেকে ডান হাতের তালু জ্যাকেটে মুছে নেয়। এর পর একইভাবে সে বাম হাতও মুছে নেয়।
ফলাগুলোর ওপর আরেকটু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর সে আবার সামনে এগোয়। ডালটা এখানে আরো চিকন হয়ে যাওয়ায় সে এখন বেশ ভালোভাবেই ডালটা ধরতে পারছে। টারজানের মত ঝুলে ঝুলে এগিয়ে যায় বেড়ার ফলা পেছনে ফেলে। হঠাৎই ডালটা খুব বিপদজনকভাবে নিচে নেমে আসে। সে একটা ‘মট’ শব্দ শুনতে পায় এবং ডাল থেকে হাত ছেড়ে দেয় নিজেকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে।
খুব বাজেভাবে মাটিতে পড়ে সে। তার এক হাঁটু একটা কবরের পাথুরে ফলকের সাথে ঠুকে যায়, তীব্র যন্ত্রণা টের পায় পায়ে। হাঁটু চেপে ধরে ঠোট কামড়ে ঘাসের ওপর গড়াগড়ি খেতে থাকে সে। প্রার্থনা করতে থাকে তার হাঁটুর বাটি যেন না ফেটে যায়। অবশেষে ব্যথা কমে আসে এবং তার মনে হয় সে হয়তো তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে যদি সে ব্যথাটাকে তাকে পেয়ে বসতে না দেয়। হয়তো।
সে উঠে দাঁড়িয়ে মেসন স্ট্রিটের বেড়ার দিকে হাঁটতে থাকে, যেখানে তার জিনিসগুলো রয়েছে। তার ব্যথা প্রথমে অনেক বেশি ছিল এবং সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল; কিন্তু হাটার সাথে সাথে সেটা একটা ভোতা ব্যথায় পরিণত হয়। তার গাড়ির ফার্স্ট এইড কিটে অ্যাসপিরিন আছে। সেটা মনে করে নিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাস্তায় গাড়ির জন্যে সে চোখ খোলা রাখে। কোন গাড়িকে আসতে দেখলেই সে একটু ভেতরের গাঢ় অন্ধকারে সেধিয়ে যায়।
মেসন স্ট্রিটে লোকজনের আনাগোনা তুলনামূলক বেশি তাই সে বেড়ার একটু ভেতর দিয়ে হাঁটে, তার গাড়ি বরাবর পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত। সে যখন দ্রুত পায়ে তার ত্রিপলের বান্ডেলটা নিয়ে আসার জন্যে প্রস্তুত হয় তখন সে পায়ের শব্দ আর একজন মহিলার আওয়াজ শুনতে পায়। সে একটা কবরের ফলকের পেছনে বসে পড়ে-হাঁটুতে ব্যথা না থাকলে সে হয়তো হাঁটু গেড়ে বসতো। সে রাস্তার ওপাশের ফুটপাত দিয়ে একটি প্রেমিক জুটিকে হেঁটে আসতে দেখে। তারা একে অপরের হাত জড়াজড়ি করে আসছে, আর হালকা আলোয় তাদের হাঁটতে দেখে লুইসের একটা টিভি প্রোগ্রামের কথা মনে পড়ে। পরের মুহূর্তে তার প্রোগ্রামটার নামটিও মনে পড়ে : ‘দ্য জিমি ড্যুরনেইট আওয়ার।” লুইস যদি এখন কবরের ফলকের পেছন থেকে লাফিয়ে বের হয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে, “শুভরাত্রি, মিসেস কালাবাস!”
তারা লুইসের গাড়ির পেছনের স্ট্রিট লাইটের আলোর নিচে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। তাদের দেখে লুইসের নিজের প্রতি একরকমের ঘৃণা বোধ হয়। তার নিজেকে কোন সস্তা কমিক বইয়ের চরিত্র মনে হতে থাকে, যে মতের শহরে ঘাপটি মেরে লোকজনের প্রেম-পিরিতি গিলে গিলে খায়। মাথা ঠিক আর নষ্টের মাঝের বিভাজন রেখাটা কি আসলেই এতো সূক্ষ্ম? সে ভাবে। এতোই সূক্ষ্ম যে কেউ চাইলেই এক পাশ থেকে আরেক আশে পা ফেলতে পারে? গাছে চড়া, গাছের ডালে ঝোলা, কবরস্থানে লাফিয়ে পড়া…গর্ত খোঁড়া? এতোই কি সোজা? এসবই কি পাগল হবার জন্যে যথেষ্ট না? আমার ডাক্তার হতে লেগেছে আট বছর, আর আমি আজ এতো সহজেই একজন লাশ চোর হয়ে গেলাম?
সে তার হাত মুঠো করে মুখে পুরে দেয়, তার ভেতর থেকে বের হতে চাওয়া কিছু শব্দকে রুখে দিতে।
লুইস অধৈর্য হয়ে প্রেমিক জুটির প্রস্থানের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা হেঁটে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে শেকড় বেয়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়ায়। লোকটা কিছুক্ষণ চাবির জন্যে পকেট হাতড়ায় এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। রাস্তাটা আবারো নির্জন হয়ে পড়ে। চারদিকে বাতাসে গাছের নড়াচড়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। তার ঘামে ভেজা কপালের ওপরের চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে।
লুইস ছুটে বেড়াটার কাছে গিয়ে নিচু হয়ে তার ত্রিপলে মোড়া বান্ডেলটার জন্যে ঝোঁপের নিচে হাতড়ায়। জিনিসটা এখানেই ছিল, সে তার আঙুলের নিচে সেটার অস্তিত্ব টের পায়। জিনিসটা তুলে নিলে সেটা একটা চাপা ধাতব শব্দ করে। সে বান্ডেলটা নিয়ে নুড়ি বিছানো পথে উঠে আসে।
রাস্তাটার একদম ধার ঘেষে হাঁটতে থাকে সে, কারণ কাউকে দেখতে পেলে সে যেন সহজেই পাশের দেবদারু গাছের আঁধারে সেঁধিয়ে যেতে পারে। হতেই পারে কবরস্থানের কোন ফুল টাইম কেয়ারটেকার আছেন এবং হয়তো তিনি মাঝে মাঝে কবর পাহারা দিতে ঘুরে বেড়ান।
কিছুদূর গিয়ে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেলে সে বামের রাস্তাটা বেছে নেয়। এই রাস্তাটি তাকে গেজের কবরে পৌঁছে দিবে। গেজের কবরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার মনে হয় সে গেজের চেহারা মনে করতে পারছে না। চিন্তাটা তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। সে থমকে দাঁড়িয়ে সামনের কবরের সারি আর ফলকগুলোর দিকে চেয়ে থেকে গেজের চেহারা মনে করার চেষ্টা করে। গেজের মুখাবয়বের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য তার আলাদা আলাদা করে মনে পড়তে থাকে—ওর সোনালী চুল, ওর তির্যক চোখ, ওর ছোট ছোট সাদা দাঁত, শিকাগোর বাসার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ওর চিবুক কেটে গিয়েছিল, সেই দাগটা। সে সবগুলো জিনিস আলাদাভাবে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ ছবি সে দাঁড় করাতে পারছে না। সে দেখতে পায় গেজ রাস্তাটার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে, দৌড়ে যাচ্ছে অরিংকো ট্রাকটার সাথে তার সাক্ষাতের দিকে, কিন্তু গেজের মুখ উল্টো দিকে হওয়ায় সে তা দেখতে পাচ্ছে না। সে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন রাতের বেলা গেজকে তার খাটে কল্পনা করে, কিন্তু গেজের মুখের জায়গায় সে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না।
গেজ, তুমি কোথায়?
লুইস তুমি কি একবারও ভেবে দেখেছো যে তুমি হয়তো তোমার ছেলের কোন উপকারই করছো না? হয়তো ও যেখানে আছে আনন্দেই আছে…হয়তো পরকালের ব্যাপারে তোমার ফালতু ধারনা ঠিক না। হয়তো ও ফেরেশতাদের সাথে খেলছে অথবা ঘুমোচ্ছে। আর ও যদি আসলেই ঘুমিয়ে থাকে তাহলে তুমি কি জানো ওর বদলে কাকে তুমি জাগিয়ে তুলবে?
ওহ গেজ, তুমি কোথায়? আমাদের বাড়িটা তোমাকে ছাড়া খাঁ খাঁ করছে।
কিন্তু ও কি আসলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে? কেন সে গেজের চেহারা মনে করতে পারছে না আর কেনই বা সে জাড, ভিক্টর পাস্কো আর তার নিজের আক্কেলের বিরুদ্ধে গিয়ে এসব পাগলামো করছে?
লুইস পেট সেমেটারির স্মৃতি চিহ্নগুলোকে মনে করে। মনে করে কিভাবে কবরের সারিগুলো বৃত্তের মত গোল হতে হতে কেন্দ্রে গিয়ে মিলিত হয়েছে এবং সে আবারো সেই শীতলতা অনুভব করে নিজের চারপাশে। সে এখানে কেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেজের চেহারা মনে করার চেষ্টা করছে?
সে খুব শীঘ্র তার ছেলের চেহারা বাস্তবেই দেখতে পাবে।
গেজ উইলিয়াম ক্রিড গেজের এপিটাফে লেখা, সাথে তার জন্ম তারিখ এবং মৃত্যু তারিখ। আজ কেউ ওর কবরে এসেছিল। সে কবরের ওপর তাজা ফুল দেখতে পায়। কে এসেছিল? মিসি ডেনড্রিজ?
তার হার্টবিট খুব জোরালো হলেও বেশ লম্বা তফাতে হচ্ছে। ধুকপুক…ধুকপুক। সে যদি কাজটা আসলেই করতে চায়, তাহলে তার এখনই শুরু করা উচিত। রাত অফুরন্ত নয় এবং রাতের পরই ভোরের আলো ফুটবে।
সে নিজেকে শেষবারের মত প্রশ্ন করে উত্তর পায়, হ্যাঁ, সে আসলেই কাজটা করতে চায়। তার মাথা উপর নিচে ঝাঁকায় এবং পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট পকেট নাইফ বের করে আনে। সে ত্রিপলের বান্ডেলটা স্কচটেপ দিয়ে পেচিয়ে নিয়েছিল। টেপটা সে তার পকেট নাইফ দিয়ে কেটে নেয়। সে বান্ডেলটা খুলে যন্ত্রপাতিগুলো সাজিয়ে রাখে, ঠিক যেভাবে সে অপারেশনের আগে তার সার্জারির যন্ত্রপাতিগুলো সাজিয়ে নেয়।
যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে আছে ফ্লাশ লাইটটা, যেটার মুখ সে হার্ডওয়্যারের দোকানের ক্লার্কের পরামর্শ অনুযায়ী মোটা কাপড় দিয়ে পেচিয়ে নিয়েছে। কাপড়টার ওপর একটা পয়সা রেখে স্কালপেল দিয়ে একটা গোল ফুটোও করে নিয়েছে সে। আছে ছোট হাতলের কুঠারটা, যেটা এখানে তার ব্যবহার করার কোনই পরিকল্পনা নেই। কবরের মুখটা ঢালাই করে লাগানো থাকলে বা মাটি যদি পাথুরে হতো তাহলে জিনিসটা কাজে দিত। আর আছে বেলচা, কোদাল, দড়ি আর গ্লাভস। সে দুহাতে গ্লাভস পড়ে কোদাল তুলে নিয়ে কাজ শুরু করে।
কবরের মাটি এখনো বেশ নরম, তাই খোঁড়া খুব সহজ। কবরের সীমানা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে এবং কবরের মাটি কবরের সীমানার বাইরের মাটি থেকে তুলনামূলক নরম। তার মন একটা তুলনা করেঃ এখানে খোঁড়াখুঁড়ি করা আর যেখানে সে গেজকে কবর দেয়ার পরিকল্পনা করছে সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করার মধ্যে। সেখানে তার কুঠারটা দরকার হবে। এরপর সে চিন্তা করা একদম বন্ধ করার চেষ্টা করে। চিন্তা তার কাজে বাধা দিচ্ছে।
সে মাটি খুঁড়ছে এবং বায়ে ফেলছে; একটা ছন্দের মত করে, যে ছন্দটা গর্ত গভীর হবার সাথে সাথে মেনে চলা কঠিন হতে থাকে। সে কবরের খোঁড়া গর্তে পা রাখে এবং নতুন মাটির একটা সোদা গন্ধ তার নাকে লাগে। গন্ধটা সে আঙ্কেল কার্লের সাথে কাজ করার সময় থেকে চেনে।
ডিগার, সে থেমে তার কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভাবে। তার আঙ্কেল কার্ল বলেছিলেন যারা কবর খোঁড়ে পুরো আমেরিকায় তাদের ডিগার বলা হয়।
সে আবারো খুঁড়তে শুরু করে।
সে শুধু আরেকবার থামে, তার হাত ঘড়ির সময় দেখার জন্যে। বারোটা বেজে বিশ মিনিট। মনে হচ্ছে সময় তার হাত থেকে বান মাছের মত পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
চল্লিশ মিনিট পর তার কোদাল শক্ত কিছুকে আঘাত করে এবং তার হৃৎপিন্ড একটা পালস মিস করে। সে ফ্লাশ লাইটটা নিচের দিকে মুখ করে সুইচ টিপে দেয়। মাটির ফাঁক দিয়ে একটা ধূসর-রুপালী কিছু দেখা যাচ্ছে। এটা গ্রেভ লাইনারের ছাদ। লুইস আর কোদাল ব্যবহার করতে চাইলো না কারণ এতে গ্রেভ লাইনারের ছাদের সাথে কোদাল লেগে বিকট শব্দ হবে, যা এতো রাতে মোটেই কাম্য না।
সে কবরের গর্ত থেকে বের হয়ে দড়িটা নিয়ে আসে। গ্রেভ লাইনারের পার্ট পার্ট ছাদের প্রতিটি অংশের সাথে একটা করে লোহার রিং লাগানো আছে। সে ছাদের অর্ধেক অংশের প্রতিটি রিংয়ের ভেতর দিয়ে দড়িটা ঢুকিয়ে দেয়। এরপর কবর থেকে বেরিয়ে ত্রিপলটি বিছিয়ে সেটার ওপর হাঁটু গেড়ে বসে দড়ির দুই মাথা দু হাতে নেয়।
লুইস, এটাই তোমার শেষ সুযোগ।
ঠিক। এটাই আমার শেষ সুযোগ আর আমি সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছি।
সে দড়ির দুই মাথা ধরে টান দেয়। কনক্রিটের স্ল্যাবগুলো উঠে আসে এবং কবরের পাশে লম্বালম্বিভাবে দাড়িয়ে থাকে।
লুইস দড়িটা রিংগুলো থেকে বের করে পাশে ছুড়ে মারে। পরের অংশের জন্যে তার দড়িটা আর কাজে লাগবে না।
সে আবারো কবরে নেমে পড়ে, খুব সাবধানে, যাতে খাড়া করে রাখা কনক্রিটের স্ল্যাবগুলো পড়ে না যায়। কিছু পাথর গড়িয়ে গেজের কফিনের ওপর পড়ে ফাপা থাপ থাপ শব্দ করে।
নিচু হয়ে বাকি গ্রেভলাইনারের ছাদটা ধরে সে ওপরের দিকে টেনে তোলে। টেনে তোলার সময় তার মনে হয় তার হাতের ভেতর ঠান্ডা কিছু গলে যায়। যখন গ্রেভলাইনারের বাকি অংশ টেনে দাঁড় করায় এবং এরপর নিজের হাতের দিকে তাকায়, সে দেখতে পায় একটা কেচো সেখানে মৃত্যুযন্ত্রণায় কিলবিল করছে। সে ঘৃণায় নিঃশব্দ চিৎকার করে তার হাতটা কবরের পাশের মাটিতে ঘষে ঘষে মুছে নেয়।
এরপর সে ফ্লাশ লাইটের আলো আবারো নিচে ফেলে।
ফিউনারেল সার্ভিসে শেষ দেখা কফিনটা লুইস আরেকবার দেখতে পায়। এই সেফটি-ডিপোজিট বক্সেই তার ছেলেকে নিয়ে তার সব স্বপ্ন কবর দেয়ার কথা। পূর্বের শীতলতার বিপরীতে এবার তার মধ্যে ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। না, সে তা হতে দেবে না।
লুইস হাতড়ে হাতড়ে কোদালটা খুঁজে নেয়। সে কোদালটা তার কাঁধের ওপর তুলে কফিনের ছিটকিনির ওপর আঘাত করে। একবার, দুবার, তিনবার, চারবার। সে চোখ মুখ খিচিয়ে রেখেছে।
গেজ, কফিন ভেঙে তোমাকে বের করে আনব আমি। দেখে নিও।
ছিটকিনিটা প্রথমবারের আঘাতেই প্রায় খুলে আসে। কিন্তু লুইস তারপরও উপর্যুপুরি আঘাত করতে থাকে, শুধু সেটাকে খোলার জন্যে না; বরং সেটাকে আঘাত করার জন্যে। তার হুশ ফিরে এলে সে থামে, কোদালটা উঁচু করা অবস্থায়।
কোদালের ব্লেডটা বাকা হয়ে গেছে। সেটা পাশে ছুড়ে ফেলে দুর্বল পায়ে কবরের বাইরে এসে দাঁড়ায় সে। তার পেট গুলিয়ে আসছে। তার রাগ যেমন হঠাৎ করে এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করেই চলে গেছে। এর বদলে তার ভেতর আবারো সেই শীতলতা প্রবেশ করে। তার জীবনে কখনো এতো একা লাগেনি। তার নিজেকে একজন এস্ট্রনট মনে হচ্ছে, যে তার শিপ থেকে মহাশূন্যে ছিটকে পড়েছে এবং ট্যাঙ্কের অক্সিজেন ফুরিয়ে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে। বিল ব্যাটারম্যানেরও কি এমন লাগছিল? সে ভাবে।
সে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। তার পায়ের আড়ষ্ট ভাব কমে আসলে উঠে বসে কবরে নামে। সে ফ্লাশলাইটের আলো ছিটকিনির ওপর ফেলে দেখে যে সেটা শুধু ভাঙেনি, সেটা এক কথায় ধ্বংস হয়ে গেছে। সে রাগে অন্ধ হয়ে কোদালের আঘাতগুলো করেছিল, কিন্তু দৈবক্রমে আঘাতের প্রত্যেকটিই একদম জায়গা মত পড়েছে। ছিটকিনির আশেপাশের কাঠও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে।
লুইস ফ্লাশ লাইটটা বগলে চেপে ধরে। সে একটু নিচু হয়ে বসে। হাতড়ে হাতড়ে কফিনের ঢাকনার খাঁজ খুঁজে বের করে সেখানে নিজের আঙুলগুলো প্রবেশ করিয়ে দেয়। সে এক মুহূর্তের জন্যে থামে, কিন্তু সেটা থামার জন্যে নয়। এরপর সে কফিনের দরজাটা খোলে।