পেট সেমেটারি – ৪০

অধ্যায় ৪০

কিন্তু এসব কিছুই ঘটেনি। এই সব কিছু-গমগম করতে থাকা ট্রাক, গেজের জাম্পারে ছুঁয়ে যাওয়া আঙুল, রাচেলের গেজের ফিউনারেলে যাওয়ার জন্য পরা ঘরের কোট, এলির গেজের ছবি নিয়ে ঘোরাঘুরি আর গেজের চেয়ার বিছানার পাশে নিয়ে ঘুমানো, স্টিভ মাস্টারটনের চোখের পানি, আরউইন গোল্ডম্যানের সাথে মারামারি, জাড ক্র্যান্ডালের বলা টিমি ব্যাটারম্যানের বিভৎস কাহিনি-এই সব কিছুর অস্তিত্ব ছিল লুইসের মনে, যখন সে ছুটতে থাকা গেজের পিছনে দৌড়াচ্ছিল, সেই কয়েক সেকেন্ডে। ওর পেছন থেকে রাচেল আবার চিৎকার করে উঠে, “গেজ! থামো! প্লিজ আর দৌড়ায় না, বাবা! কিন্তু লুইস একটুও ভ্রুক্ষেপ করে না, সে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। হ্যাঁ, ওইসব ঘটনার একটা ঘটলো। সে দূর থেকে একটা ট্রাকের ইঞ্জিনের গমগম আওয়াজ শুনতে পেল আর হঠাৎ করেই তার জাড ক্র্যান্ডালের প্রথম দিন বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল, তুমি শুধু বাচ্চারা রাস্তার আশেপাশে যায় কি না খুব খেয়াল রাখবে, মিসেস ক্রিড। এই রাস্তাটায় বড় বড় ট্রাক দিনরাত চলে।

গেজ এখন উঠোনের হালকা ঢাল দিয়ে দৌড়াচ্ছে, রুট-১৫’র দিকে। তার ছোট্ট ছোট্ট পাগুলো এলোমেলোভাবে তাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আনাড়িভাবে দৌড়ানোর কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে পড়ছে না; সে ছুটেই চলছে। ট্রাকের ইঞ্জিনের গমগম শব্দ এখন গর্জনের মত শোনাচ্ছে, ট্রাকটা এখন খুব কাছেই। ঘুমের ঘোরে সে এই শব্দ প্রায়ই শোনে, তখন এই শব্দটা তার বেশ আরামদায়ক মনে হয়; কিন্তু আজ সেই একই শব্দ তার খুব ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে।

ওহ খোদা! প্লিজ ওকে যেন আমি ধরতে পারি। প্লিজ ওকে রাস্তায় যেতে দিও না!

লুইস চূড়ান্তভাবে তার গতি বাড়ায় এবং লম্বা লাফ দেয়, আমেরিকান ফুটবল খেলোয়ারদের ট্যাকেল করার মত করে। যে মুহূর্তে গেজের গতি তাকে রোডের ওপর নিয়ে যাচ্ছিল, লুইসের আঙুলগুলো গেজের জ্যাকেটের পেছনে স্পর্শ করে….এবং সে তাকে ধরে ফেলে।

সে চোখের পলকে গেজকে হ্যাচকা টানে খসখসে নুড়ি পাথর বিছানো মিটিতে ফেলে দেয়। পড়ে গিয়ে লুইসের নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে যায়। সে তার অন্ডকোষেও প্রচন্ড ব্যথা পায়। ওহ! আমি ফুটবল খেলব জানলে অন্ডকোষের গার্ড পড়েই নামতাম, লুইস ভাবে। কিন্তু তার নাকের ব্যথা আর অন্ডকোষের ব্যথা ছাপিয়ে তার মন থেকে একটা পাথর নেমে যাওয়ার অনুভূতি হয়, যখন সে গেজের ব্যথায় কাতর হওয়া কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। একটু পরেই ট্রাকের গর্জনে তার কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে যাবে।

লুইস তার তলপেটে মারাত্নক ব্যথা থাকার পরেও সে কোন মতে উঠে বসে গেজকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। এর একটু পরেই রাচেলও তাদের সাথে যোগদান করে। “কক্ষনো রাস্তায় দৌড়াবে না, গেজ! কক্ষনো না! এই রাস্তাটা খুব পচা! পচা!” আর গেজ এতো অবাক হয় যে সে তার কান্না বাদ দিয়ে তার মায়ের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।

“লুইস, তোমার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে,” এরপর সে লুইসকে হঠাৎ করে এতো জোরে জড়িয়ে ধরে যে লুইসের প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসে।

“শুধু তাই?” সে বলে। “আমি মনে হয় খোজা হয়ে গেছি…আহ… ব্যথা!”

এটা শুনে রাচেল হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মত হাসতে শুরু করে। তা দেখে লুইসের মনে হয়, গেজ যদি আসলেই মারা যায়, তাহলে হয়তো রাচেল সত্যই পাগল হয়ে যাবে।

কিন্তু গেজ মারা যায়নি; ওই সব কিছুই তার কল্পনায় ঘটেছে, যখন সে গেজের মৃত্যুর সাথে পাল্লা দিয়ে উঠোনের ওপর ছুটছিল। মারাত্মক পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিনাটি বিষয়ের বিবরণসহ ছিল সেই কল্পনা।

গেজ গ্রামার স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে, আর সাত বছর বয়সে সে ক্যাম্পে যাওয়া শুরু করে, যেখানে সে সাঁতারে বেশ ভালই দক্ষতা দেখাতে শুরু করে। আর সে এটাও প্রমাণ করে সে তার বাবা-মাকে ছাড়া একমাস থাকার পরেও তেমন কোন উল্লেখযোগ্য মানসিক রোগে ভোগেনি। ওর বয়স যখন দশ, তখন সে তার পুরো গ্রীষ্ম আগাওয়াম ক্যাম্পে কাটাতে থাকে। সে এগারো বছর বয়সে চারটা ক্যাম্পের সব বাচ্চাদের নিয়ে আয়োজিত সাতার প্রতিযোগিতায় দুটি নীল মেডেল আর একটি লাল মেডেল জেতে। সে লম্বা হয়, বড় হয়, কিন্তু সে সেই আগের মিষ্টি গেজই থেকে যায়।

সে হাইস্কুলে প্রথম সারির ছাত্র হয় আর স্কুলের সাঁতারু দলের সদস্য হয়। এই স্কুলটা লুইস সাজেস্ট করেছিল কারণ সেখানে সাঁতারের ভালো সুবিধা আছে। রাচেল খুবই মন খারাপ করে যখন সতেরো বছর বয়সে গেজ ক্যাথলিক খ্রিস্টান হতে চায়। রাচেলের ধারণা এসবই গেজ করছে তার গার্লফ্রেন্ড মেয়েটাকে খুশি করার জন্যে। রাচেল বলেছিল, “যদি ওই বেশ্যা মেয়েটা ওর মাথায় এসব ঢুকিয়ে না থাকে, তাহলে আমি কাচা গু খাবো।” রাচেল ধারণা করেছিল গেজ অলিম্পিকের স্বপ্ন কবর দিয়ে খুব শীঘ্রই মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলবে, তার পড়াশোনারও ইতি হবে। কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা যাবে সে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বেঢপ ভুড়ি নিয়ে ট্রাকের ড্রাইভারি করছে আর দুনিয়াতে আরো দশটা ক্যাথলিক বাচ্চার জন্ম দিয়েছে।

লুইস অবশ্য ভেবেছিল গেজ এসব নিজের ইচ্ছেতেই করছে। যেদিন গেজ চার্চে গিয়ে দীক্ষা নেয় সেদিন লুইস সেটার ফটো তুলে তার শ্বশুড়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়, ক্ষেপানোর উদ্দেশ্যে। রাচেলের ধারণা ভুল হয়, ও সেই মেয়েটিকে বিয়ে করে না। আর মেয়েটিও যে কোন বেশ্যা না সেটার প্রমানও তারা ভালোভাবেই পায়।

সে জন হপকিন্সে যায় এবং অলিম্পিক সাঁতারু দলে জায়গা করে নেয়। এরপর একদিন, ট্রাকের হাত থেকে গেজকে বাঁচানোর প্রায় ষোল বছর পর, গেজ নিজের দেশের হয়ে অলিম্পিকে সাঁতারে সোনার মেডেল জেতে। যখন তাকে মেডেল পরিয়ে দেয়া হয় এবং তার দেশের জাতীয় সঙ্গিত বাজিয়ে শোনানো হয়, গেজ তার জাতীয় পতাকার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্যটা লুইস আর রাচেল তাদের বাসার টিভির সামনে বসে দেখে, তাদের চুল ততদিনে পেকে গিয়েছে, আর তাদের দুজনের

দুজনের চোখেই পানি। “যাক…অবশেষে।” সে কাঁপা গলায় বলে রাচেলকে জড়িয়ে ধরার জন্যে সেদিকে ফিরে। রাচেলের দিকে তাকিয়ে সে দেখলো রাচেল তার দিকে বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। লুইসের চোখের সামনেই রাচেলের বয়স আরো বেড়ে যেতে লাগলো, প্রথমে মাস, পরে বছরকে বছর। টিভিতে জাতীয় সঙ্গিতের আওয়াজ ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। যখন লুইস টিভির দিকে ফিরে তাকালো সেখানে সে গেজের জায়গায় আরেকটা কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেকে দেখতে পেল, যার মাথার কোকড়া চুলে লেগে থাকা ঘাম চিকচিক করছে।

অবশেষে।

শেষ।

ওহ খোদা! সব শেষ!

লুইস বৃষ্টি ভেঁজা সকালে জেগে উঠলো, একটা বালিশ জাপটে ধরা অবস্থায়। তার মাথায় তীব্র ব্যথা, যেটা হার্ট বিটের সাথে তাল মিলিয়ে ওর মাথায় হাতুড়ির মত পেটাচ্ছে; ব্যথাটা বাড়ে, এরপর কমে, বাড়ে এরপর কমে। সে একটা পুরনো বিয়ারের গন্ধ মিশ্রিত ঢেকুর তুলে। ওর পেট ফুলে উঠেছে। সে ঘুমের মধ্যেই কাঁদছিল, চোখের জলে তার বালিশটা ভিজে গেছে। ঘুমের মধ্যেও তার একটা অংশ সত্যটা জানতো আর সেজন্যেই সে কেঁদেছে।

সে উঠে কোনরকমে পা হড়কাতে হড়কাতে বাথরুমে যায়। একদম অন্তিম মুহূর্তে টয়লেটের কমোডের কাছে পৌঁছায় এবং গতরাতের খাওয়া একগাদা বিয়ার উগড়ে দেয়।

হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে সে, এরপর চোখ বন্ধ রেখেই হাতড়ে হাতড়ে টয়লেটের ফ্লাশটা টেনে দেয়। সে আয়নার সামনে যায়, নিজের চোখ কতটুকু লাল হয়েছে বোঝার জন্যে। কিন্তু গ্লাসটা ঢাকা ছিল। ওর মনে পড়ে গেল রাচেল ওদের বাসার সবগুলো আয়নার গায়ে কভার লাগিয়ে দিয়েছে।

কিসের অলিম্পিক সাঁতারু দল, আর কিসের কি, লুইস আনমনে ভাবতে ভাবতে তার বিছানায় ফিরে যায়। তার মুখে আর গলায় বিয়ারের টক বিস্বাদের আস্তর লেগে আছে। সে শপথ করলো যে সে আর জীবনেও এই বিষ ছোবে না। অলিম্পিক মেডেল না হয় না হবে। কিন্তু এই শপথ এই বারই সে প্রথম করছে না, বা এটা তার শেষ বারও না।

লুইস তার বিছানায় বসে থাকে। জানালা দিয়ে অলস ভঙ্গিতে বৃষ্টির পানি পড়ছে। তার মাথা গতরাতের নেশার দরুন ব্যথায় দপদপ করছে। আর এরই মধ্যে পুত্রশোক তাকে জেঁকে ধরে। শোক এসে তার ভেতরের সবগুলো বাধ ভেঙে দেয়। সে তার দুহাতে মুখ গুজে দুলে দুলে কাঁদতে শুরু করে আর ভাবতে থাকে যে সে একটা দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়ার জন্যে সব কিছু করতে পারে, সব কিছু।

অধ্যায় ৪১

গেজকে সেদিন দুপুর দুটোয় কবর দেয়া হয়। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিল। গেজের ফিউনারেলে আসা বেশিরভাগ লোকজনই আন্ডারটেকারের দেয়া কালো ছাতা বহন করছে।

রাচেলের অনুরোধে ফিউনারেল পরিচালক গেজের জন্যে খোঁড়া কবরের পাশে দাড়িয়ে বাইবেল থেকে কিছু বাণী পড়লেন। বাণীটা ছিল ছোট বাচ্চাদের নিয়ে। লুইস কবরের অন্যপাশে দাড়িয়ে থাকা তার শ্বশুড়ের দিকে তাকায়। গোল্ডম্যান এক পলকের জন্যে তার দিকে চেয়ে চট করে চোখ নামিয়ে নিলেন। তার ভেতরে আর ঝগড়া করার মত কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। তার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, তার সিল্কের ছোট টুপির পাশ দিয়ে তার সাদা চুল বাতাসে এলোমেলোভাবে উড়ছে। মুখের কাঁচা-পাকা দাড়িতে তাকে আগের চাইতেও বেশি খিটখিটে স্বভাবের মনে হচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি ঠিক মত জানেনই যে তিনি কোথায় আছেন। কিন্তু লুইস চেষ্টা করেও উনার জন্যে তার মনে কোন সহানুভূতির উদ্রেক করতে পারলো না।

গ্রেভ লাইনারটার ওপর একটা চকচকে ফ্রেমের ওপর গেজের ছোট্ট সাদা কফিনটা রাখা হয়েছে। খুব সম্ভবত কফিনের ছিটকিনি ঠিক করা হয়েছে। কবরের চারপাশ নকল ঘাস দিয়ে কার্পেটিং করা হয়েছে, সেসব ঘাস এতো সবুজ যে তা দেখে লুইসের চোখে জ্বালা হচ্ছে। সেই সব ঘাসের ওপর কয়েক ঝুড়ি ফুল রাখা হয়েছে। লুইস ফিউনারেল পরিচালকের কাঁধের ওপর দিয়ে সামনের দিকে তাকায়। সামনে একটা ছোট টিলার মত, সেখানে বেশ কিছু কবর আর একটা বিশাল মনুমেন্ট। মনুমেন্টের গায়ে খোঁদাই করে লেখা : ফিস। সেই মনুমেন্টের ওপর দিয়ে হলুদ একটা কিছু দেখতে পায় সে। সেটা ভালো করে দেখার জন্যে নড়ে চড়ে তাকায়। যখন ফিউনারেল পরিচালক সবাইকে বললেন, চলুন আমরা সবাই মৃতের জন্যে মাথা নিচু করে প্রার্থনা করি কিছুক্ষণ,’ তখনো লুইস মাথা উঁচু করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ ভালোভাবে তাকানোর পর সে বুঝতে পারে সেটা কী। সেটা একটা বড় পে-লোডার ট্রাক। ট্রাকটা লোকজনের দৃষ্টি সীমার বাইরে রাখা হয়েছে; সঙ্গত কারণেই। ফিউনারেলের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই সেটার ড্রাইভার লাফিয়ে ট্রাকে উঠবে, তার জ্বলন্ত সিগারেটটা পিষে কোথাও লুকিয়ে ফেলে, কারণ ফিউনারেল হোমের কর্মচারীরা সিগারেটের ফিল্টার এখানে সেখানে ফেলে রাখলে খুব শীঘ্রই তাদের চাকরি খেয়ে দেয়া হয়। কারণ এখানকার অনেক কাস্টমারই ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে মারা গিয়ে থাকে। ট্রাকে উঠে সে ট্রাকের লোডে যা আছে তা গেজের কবরের ওপর ফেলবে এবং গেজকে দিনের আলো থেকে বঞ্চিত করবে, চিরতরে…অথবা অন্তত পুণরুত্থান দিবস পর্যন্ত।

পুণরুত্থান… আহ, একটা শব্দ বটে।

(যেটার চিন্তা থেকে নিজেকে তোমার হাজার মাইল দূরে রাখতে হবে এবং তুমি সেটা খুব ভাল করেই জানো)।

ফিউনারেল পরিচালক যখন “আমেন” বললেন, তখনই লুইস রাচেলের হাত ধরে সেখান থেকে চলে আসতে চায়। রাচেল বিড়বিড় করে সামান্য প্রতিবাদ করে, ‘আরেকটু থাকি, প্লিজ লুইস।” কিন্তু লুইস সেটা গ্রাহ্য করে না। তারা তাদের গাড়ির দিকে এগুতে থাকে। লুইস দেখে ফিউনারেল ডিরেক্টরের সহকারী সবার হাত থেকে তাদের ফিউনারেল হোমের ছাপ মারা ছাতাগুলো নিয়ে স্ট্যান্ডে সাজিয়ে রাখছে। লুইস ডান হাতে রাচেলের হাত ধরে আছে আর বাম হাতে এলির সাদা গ্লাভস পড়া হাত। এলি নরমা ক্র্যান্ডালের ফিউনারেলে যে ড্রেস পরেছিল, সেই একই ড্রেস পরেছে আজকে।

লুইস যখন ওদের গাড়িতে বসিয়ে দিলো তখন জাড আসেন। জাডকে দেখেও মনে হচ্ছে তার রাতটা খুব একটা ভালো যায়নি।

“তুমি ঠিক আছো, লুইস?”

লুইস মাথা ঝাঁকায়। জাড একটু নিচু হয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে রাচেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি ঠিক আছো, রাচেল?”

“আমি ঠিক আছি,” রাচেল প্রায় ফিসফিস করে জবাব দেয়। এরপর তিনি এলির দিকে তাকিয়ে বলেন, “তোমার কি খবর, সোনামনি?”

“আমি ভালো আছি,” বলে এলি বিশ্রীভাবে হাসে, জাডকে বোঝানোর জন্যে যে সে কতটা ভালো আছে।

“তোমার ওই ছবিটা কিসের?”

লুইসের একবার মনে হচ্ছিল যে এলি জাডকে ছবিটা দেখাবে না, কিন্তু পরমুহূর্তেই এলি ছবিটা খুব বিব্রতভাবে জাডের হাতে তুলে দেয়। জাড ছবিটা নিয়ে তার লম্বা, শুকনো আঙুলগুলো দিয়ে ধরে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। তার আঙুলগুলো দেখলে মনে হয় সেটা কল-কারখানা বা কন্সস্ট্রাকশনের কাজের জন্যে উপযোগী-কিন্তু এই আঙুল দিয়েই তিনি কতোটা স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই না গেজের গা থেকে মৌমাছির হুল তুলে নিয়েছিলেন, অনেকটা জাদুকরের মত…বা সার্জনের মত।

“খুব সুন্দর তো ছবিটা,” জাড বলেন। “তুমি ওকে স্লেজে চড়িয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছো। ও নিশ্চয়ই খুব মজা পাচ্ছিল, তাই না?”

কাঁদতে শুরু করা এলি মাথা ঝাঁকায়।

রাচেল কিছু বলতে চাইলে লুইস তার হাত চেপে নিষেধ করে-একটু শান্ত থাকো।

“আমি ওর সাথে এভাবে অনেক খেলতাম,” এলি ফোপাতে ফোপাতে বলে, “আর ও শুধু হাসতো আর হাসতো। আর খেলার পর আম্মু আমাদের কোকা বানিয়ে দিতো আর বলতো, ‘তোমাদের বুট জুতোগুলো জায়গামত রাখো,’ আর গেজ তখন ওর বুটগুলো ধরে উঁচু করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতো ‘বুট! বুট!’ এতো জোরে বলতো যে আমার কান ফেটে যেত। তোমার মনে আছে, আম্মু?”

রাচেল মাথা ঝাকায়।

“আমি নিশ্চিত খুব ভালো সময় ছিল সেটা,” ছবিটা ফিরিয়ে দিয়ে জাড বলেন। “ও মরে গিয়ে থাকতে পারে, এলি, কিন্তু তুমি চাইলে ওর স্মৃতিগুলো তোমার কাছে রাখতে পারো।”

“আমি তাই করবো,” এলি নিজের মুখ মুছতে মুছতে বলল। “আমি ওকে খুব ভালোবাসতাম, মিস্টার ক্র্যান্ডাল।”

“আমি জানি, সোনামনি।” তিনি নিচু হয়ে ওর গালে চুমু খেলেন। এরপর তিনি রাচেল আর লুইসের দিকে তাকালেন, তার চাহনিতে একটা প্রশ্ন। রাচেল জাডের দিকে তাকিয়েই তার চোখ নামিয়ে নিল, সে ঠিক বুঝতে পারছে না জাডের চাহনির মানে। কিন্তু লুইস ঠিকই বুঝতে পারে। তোমরা তোমাদের মেয়ের জন্যে কি করছো? জাডের চোখগুলো জিজ্ঞেস করছে। তোমাদের ছেলে মরে গেছে, কিন্তু তোমাদের মেয়ে এখনো বেঁচে আছে। ওর জন্যে তোমরা কী করছো?

লুইস তার চোখ সরিয়ে নেয়। সে এলির জন্যে কিছুই করতে পারবে না, অন্তত এখনো না। ওকে ওর কষ্টের সমুদ্র নিজে নিজেই পাড়ি দিতে হবে। লুইসের মাথা এখন তার ছেলের চিন্তায় ঠাসা।

অধ্যায় ৪২

বিকেল হতে হতে আকাশে আরেক পাল নতুন মেঘ এসে হাজির হয় এবং খুব বাতাস বইতে থাকে। লুইস একটা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে দেয়ালের হুক থেকে তার গাড়ির চাবিটা নেয়।

“কোথায় যাচ্ছ, লু?” রাচেল জিজ্ঞেস করে। ওর প্রশ্নে তেমন কোন আগ্রহ নেই। দুপুরের খাবারের পর থেকে ও আবার কাঁদতে শুরু করেছে। এর পর থেকে ও অনবরত কেঁদেই যাচ্ছিল, একটুও না থেমে। লুইস ওকে শান্ত করার জন্যে জোর করে একটা ভ্যালিয়াম ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছে। এখন ও একটা পত্রিকার ক্রসওয়ার্ডের পাতা খুলে বসে আছে, যেটার তেমন কিছুই সলভ করা হয়নি। পাশের রুমে এলি চুপচাপ বসে টিভিতে একটা ছায়াছবি দেখছে।

“আমি ভাবছিলাম একটা পিজ্জা নিয়ে আসবো।”

“তখন খেতে পারোনি?”

“তখন ক্ষুধা ছিল না,” সে সত্য বলে, এরপর মিথ্যেটা বলে, “এখন ক্ষুধা পাচ্ছে।”

আজ বেলা তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত লাডলোর ফিউনারেল হোমে গেজের ফিউনারেলের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতা হয়ে গিয়েছে, খাওয়া-দাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা। স্টিভ মাস্টারটন এবং তার স্ত্রী এসেছিল হ্যামবার্গার আর নুডুলস নিয়ে। চার্লটন এসেছিলেন কুইচে নিয়ে। “এটা তোমরা যতদিন ইচ্ছে ফ্রিজে রেখে খেতে পারবে, যদি আজ বেঁচে যায়,” তিনি রাচেলকে বলেন।

“কুইচে খুব সহজেই গরম করে নিতে পারবে।” প্রতিবেশি ডেনিকাররা বেকড হ্যাম নিয়ে এসেছেন। গোল্ডম্যানরা নানান রকমের খাবার আর চিজ নিয়ে এসেছেন। তারা এসে একবারও লুইসের সামনে পড়েননি; এতে লুইস বেশ খুশিই হয়েছে। জাড়ও চিজ নিয়ে এসেছেন, তার প্রিয় মিস্টার র‍্যাট চিজ। সুরেন্দ্র হারদু নিয়ে এসেছে আপেল। দেখা গেল ফিউনারেলের খাবারের আনুষ্ঠানিকতায় ধর্ম একটা বিবেচ্য বিষয়।

ফিউনারেল পার্টিটা নীরব হলেও একদম স্তব্ধ ছিল না। সাধারণ পার্টির মত দেদারসে মদ গেলা না হলেও কিছু ঠিকই গেলা হয়েছে। লুইস গতকালই প্রতিজ্ঞা করেছিল সে আর এই বিষ ছোঁবে না, কিন্তু গতকালের ঘটনা আজ তার কাছে অনেক অতীতের কিছু বলে মনে হচ্ছে। সে কয়েকটা বিয়ার গেলার পর ভাবছিল তার চাচা কার্লের কাছ থেকে শোনা ফিউনারেলের নানান গল্প লোকজনকে বলে শোনাবে। যেমন, সিসিলির কুমারী মেয়েরা নাকি মৃতের গায়ের কাপড় থেকে কিছু কাপড় কেটে নিয়ে যায়, কারণ তাদের বিশ্বাস সেই কাপড় তাদের বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমালে তারা দ্রুত প্রেমিক খুঁজে পাবে। আবার আইরিশ ফিউনারেলে নকল বিয়ের আয়োজন করা হয় মাঝে মাঝে, আর তাদের পায়ের বুড়ো আঙুলগুলো এক সাথে বেঁধে দেয়া হয় কারণ তাদের বিশ্বাস এতে করে মৃতের ভূত পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারে না।

রাচেল একবার কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু তার মা তাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসেন। রাচেল তার মায়ের গলা জড়িয়ে আঝোরে কাঁদছে, যেটা সে লুইসের সাথে করতে পারেনি; এর কারণ হয়তো সে নিজেকে এবং লুইসকে গেজের মৃত্যুর জন্যে কিছুটা হলেও দায়ি করে। তাই হয়তো সে তার মায়ের কাছে সান্ত্বনার জন্যে গিয়েছে এবং তার মা তাকে সেটা দিচ্ছে। তাদের দুজনের কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আরউইন গোল্ডম্যান তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার এক হাত রাচেলের কাঁধের ওপর রাখা এবং তিনি চোখে মুখে বিজয়ীর অসুস্থ ভঙ্গিমা নিয়ে রুমের অপর পাশে লুইসের দিকে তাকিয়ে আছেন।

এলি একটা সিলভার ট্রেতে খাবার নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। ট্রেতে টুথপিক দিয়ে গাঁথা কেনাপি পরিবেশন করা। গেজের ছবিটা সে তার বগলের নিচে শক্ত করে গুঁজে রেখেছে।

লুইসকে যারা সমবেদনা জানাচ্ছে সে তাদেরকে ধন্যবাদ দিলো। তার আচরণ একটু শীতল, লোকদের সাথে থেকেও যেন সে নেই। সে কোথায় যেন তাকিয়ে কী ভাবছে। বাকিরা হয়তো ভাবছে সে তার অতীত নিয়ে চিন্তা করছে, চিন্তা করছে তার গেজবিহীন সামনের জীবনের কথা। কিন্তু কেউ এটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি সে আসলে একটা কবর ডাকাতির কথা চিন্তা করছে; হয়তো জাড়ও না। সে শুধুই ভাবছে। ভাবলেই যে সেটা করতে হবে এমন তো কোথাও লেখা নেই।

লুইস অরিংটন কর্নার স্টোর থেকে এক ডজন বিয়ারের ক্যান আর দুটো পেপারনি-এন্ড-মাশরুম পিজ্জার অর্ডারের জন্য পিজ্জার দোকানে ফোন দেয়।

“কি নাম লিখবো পিজ্জার অর্ডারে, স্যার?”

ওজ দ্য গেয়েট অ্যান্ড টেয়িল, লুইস ভাবে।

“লু ক্রিড।”

“আচ্ছা, লু, আমরা আজ খুব ব্যস্ত আছি। তাই হয়তো পয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে আপনার অর্ডারের জন্যে। তাতে আপনার চলবে?”

“শিওর,” লুইস বলে ফোন রেখে দিল। সে তার গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করলে তাকে এই ভাবনাটা খোঁচায় যে ব্যাঙ্গরে কমপক্ষে বিশটা পিজ্জার দোকান আছে। কিন্তু সে সেই দোকানেই অর্ডার করেছে যেই দোকানটা গেজের গোরস্থান প্লেজেন্টভিউর কাছাকাছি। তাতে কী? লুইস অস্বস্তি নিয়ে ভাবে। তারা আসলেই ভালো পিজ্জা বানায়। ফ্রিজের ময়দার কাই তারা ব্যবহার করে না। তারা পিজ্জার রুটি বানানোর সময় সেটা ওপরে ছুঁড়ে মারে আবার ক্যাচ ধরে, কাস্টমারদের চোখের সামনেই। এটা দেখে কী হাসিটাই না গেজ-

সে তার চিন্তাটা বাদ দেয়।

পিজ্জার দোকানটাকে পাশ কাটিয়ে গেজের গোরস্থান প্লেজেন্টভিউর দিকে গাড়ি চালিয়ে যায় সে। হয়তো ধারণা করেছিল, সে এই কাজটাই করবে। কিন্তু তাতে কি কোন ক্ষতি আছে? নেই। গাড়িটা পার্ক করে রাস্তা পেরিয়ে গোরস্থানের গেটের কাছে আসে। গোরস্থানের লোহার গেটটা গোধুলীর শেষ আলোয় হালকা ঝকমক করছে। গেটের ওপরের বোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা : ‘অপরূপ দৃশ্য।” গোরস্থানের নামের কি বাহার…মনোরম দৃশ্য। কিন্তু দৃশ্যটা লুইসের কাছে মনোরমও লাগলো না আবার অপ্রীতিকরও মনে হলো না। গোরস্থানটা বেশ কয়েকটা টিলা নিয়ে গড়া। গোরস্থানের ভেতর সারি সারি গাছ আর বিক্ষিপ্তভাবে লাগানো কিছু কাদুনে গাছ। গাছগুলোকে শেষ বিকেলের মৃদু আলোতে কুচকুচে কালো দেখাচ্ছে। গোরস্থানটা একদমই নীরব না, পাশের মহাসড়ক থেকে বিরামহীনভাবে ভারি যানবাহনের আওয়াজ আসছে। আর অন্ধকার হতে থাকা আকাশে একটা আলোর আভা দেখা যাচ্ছে: ব্যাঙ্গর এয়ারপোর্টের আলো।

গেটটা সম্ভবত লক করা, ভেবে সে গেটের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু গেটটাতে কোন লক ছিল না। হয়তো এতো আগে গেটের লক লাগানো হয় না। আর যদি গেট লক করেও তাহলে কেন করে? মাতাল, বদ ছেলেপেলে আর স্টান্টবাজদের দূরে রাখতে? এদেশে তো গরিব দেশের মত লাশ চুরি হয় না। গেটের ডানের পাল্লাটা মৃদু প্রতিবাদ করে খুলে যায়। তাকে কেউ দেখছে কি না সেটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে লুইস গেটের ভেতরে ঢুকে যায়। সে গেটটা পেছনের দিকে ধাক্কা দিয়ে লাগিয়ে দিলে গেটটা লাগার ক্লিক শব্দ শুনতে পায়।

সে মৃতের শহরে দাঁড়িয়ে চারপাশ ভালো করে দেখতে থাকে।

চমৎকার নির্জন একটা জায়গা। মানুষের মন কী বিচিত্র। তাদের বাসস্থানহীন জীবিতেরা রাস্তায় ঘুমালেও মৃতরা ঠিকই মনোরম জায়গায় ঘুমায়। তার মনের ভেতর জাড কথা বলে উঠেন। তার কণ্ঠে দুশ্চিন্তা আর-আতঙ্ক? হ্যা। আতঙ্ক।

লুইস, তুমি এখানে কী করছ? তুমি এমন এক রাস্তার দিকে তাকাচ্ছো যেই রাস্তায় তোমার যাওয়া একদমই ঠিক হবে না।

সে কন্ঠটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। সে শুধু নিজের ওপরই অত্যাচার করছে, অন্য কারো ওপর না। আর কারোর জানার প্রয়োজন নেই যে সে সন্ধ্যার আলোতে এই গোরস্থানে এসেছিল।

সে গেজের কবর লক্ষ করে এগোয়। গাছের সারির নিচ দিয়ে হাঁটতে থাকে। গাছের কচি পাতা তার মাথার ওপর বাতাসের দুলুনিতে কানাকানি করতে থাকে। তার হৃৎপিন্ডে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। কবর আর স্মৃতিস্তম্ভগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো। কিছুক্ষণ পর পর কবরস্থানের বড় বড় ম্যাপ লাগানো। ম্যাপে পুরো কবরস্থানে দেখা যাচ্ছে কোন কবরগুলো ভরাট আর কোনগুলো এখনো খালি আছে। বিক্রির জন্যে প্লট। এক রুমের এপার্টমেন্ট ঘুমোনোর কামরা।

পেট সেমেটারির মত না জায়গাটা, ভেবে সে ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়ায়। না, একদমই না। পেট সেমেটারির কবরগুলো এলোমেলো হলেও একটা শৃঙ্খলা আছে, যেন বিশৃঙ্খলার ভেতর থেকেই শৃঙ্খলার আবির্ভাব হয়েছে। গোলাকার কবরের সারিগুলো খুব শৃঙ্খলার সাথেই একদম মাঝখানে গিয়ে মিলিত হয়েছে। যেন বাচ্চা কাচ্চারা কিছু না বুঝেই একটা প্যাটার্ন তৈরি করে ফেলেছে তাদের সমষ্টিগত চেতনা থেকে, যেন…

হঠাৎ লুইসের মনে হলো পেট সেমেটারিটা একরকমের… বিজ্ঞাপন। মেলাতে সার্কাসের বিজ্ঞাপন করা হয় সার্কাসের প্রধান তাঁবুর বাইরে। তাঁবুর বাইরে ফ্রিতে আগুনের খেলা দেখে লোকজন আগ্রহী হয়ে পয়সা দিয়ে টিকেট কিনে সার্কাসের শো দেখতে যায়। সার্কাসের মালিকরাও জানে লোকজনকে কাবাব পোড়া ধোঁয়া না দেখালে তারা কাবাব কিনতে আসবে না।

পেট সেমেটারির কবরগুলোর বৃত্তাকার শেপটা পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন ধর্মীয় চিহ্নের সাথে মিলে যায়। একটা বৃত্তের ভেতরে আরেকটা বৃত্ত, তার ভেতরে এভাবে আরো অনেক বৃত্ত। ভেতরের বৃত্ত ছোট হতে হতে বিন্দুতে পরিণত হয়। অনেকের মতে সেই বিন্দুটা অসীম বা ইনফিনিটি।

বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা, অথবা শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলা, যে যেভাবে নিতে চায়। এই চিহ্নটা মিসরীয়রা তাদের ফারাওদের সমাধিতে খোদাই করে দিত, ফিনিশিয়ানরা তাদের রাজাদের কবরে এঁকে দিত; গিল্ডকিংরা বৃটেনের বিখ্যাত স্টোনহেঞ্জ বানিয়েছে পৃথিবীর ঘড়ি হিসেবে, সেখানেও এরকম প্যাটার্ন পাওয়া যায়; জুডিও ক্রিশ্চিয়ান বাইবেলেও এরকম চিহ্নের কথা আছে, ঈশ্বর যখন জবের সাথে কথা বলেন তখন এরকম আকৃতির একটা ঘূর্ণি তৈরি হয় বাতাসে।

ওই চিহ্নটা পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন ক্ষমতার চিহ্ন। এই চিহ্নটাই হয়তো সবচাইতে পুরনো সূত্র, যেটা উপসাগরীয় অঞ্চল বা গালফের সাথে সারা পৃথিবীর সম্ভাব্য সম্পর্কের প্রমাণ।

অবশেষে সে গেজের কবরের কাছে পৌঁছায়। পে-লোডার ট্রাকটা আশে- পাশে নেই। নকল ঘাসের কার্পেটটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। গেজ যেখানে শুয়ে আছে সেখানটার ওপরে আয়তক্ষেত্রের মত একটা জায়গায় ঝুরঝুরে মাটি দেখা যাচ্ছে, এই ঝুরঝুরে মাটির গভীরতা খুব সম্ভবত পাঁচ ফুট হবে। ওর কবরের ফলকটি এখনো লাগানো হয়নি।

লুইস কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। দমকা বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে। এতক্ষণে চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, আকাশে মেঘের দল ছুটে বেড়াচ্ছে।

কেউ আমার মুখে টর্চের আলো ফেলে জিজ্ঞেস করতে আসেনি আমি এখানে কী করছি। কোন পাহারারত কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে আসেনি। গেটটাও লক করা নেই। আমি যদি একটা কোদাল আর বেলচা নিয়ে আসতাম-

সে ঝাঁকি দিয়ে নিজের মাঝে ফিরে আসে। ধরা যাক গোরস্থানের কেয়ারটেকার বা পাহারাদার এসে তাকে তার ছেলের নতুন কবরে খোঁড়া গর্তের মধ্যে আবিষ্কার করলো, তখন কী হবে? হয়তো এটা পত্রিকায় যাবে না, কিন্তু আবার যেতেও তো পারে। তাকে হয়তো পুলিশে দেয়া হবে। কোন অপরাধে? লাশ চুরি? মনে হয় না। ভ্যান্ডালিজমের দোষে অভিযুক্ত করার সম্ভাবনাই বেশি। আর এই খবর চাপা থাকবে না। লোকজন ঠিকই জেনে যাবে; এরকম একটা খবর না ছড়িয়ে পারে না। স্থানীয় এক ডাক্তারকে তার রোড অ্যাক্সিডেন্টে নিহত দুই বছরের ছেলের নতুন কবর খুঁড়তে থাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে; কি রসালো খবর! সে তার চাকরি হারাবে। আর তা না হলেও, এসব গল্প শুনে রাচেলের কি অবস্থা হবে সে তা চিন্তাও করতে পারছে না। আর এলিকে তার ক্লাসের বাচ্চারা যে কি বলে ক্ষেপাবে সেটাও সে কল্পনা করতে পারছে। লাশচোরের বাচ্চা। ওকে হয়তো মানসিক ডাক্তারের কাছে মাথা ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করতে পাঠানো হবে।

কিন্তু আমি গেজকে আবার জীবন ফিরিয়ে দিতে পারি! আমি ওকে আবার আমার কোলে ফিরিয়ে আনতে পারি!

কিন্তু সে কি আসলেই এই কথা বিশ্বাস করে?

সত্য হচ্ছে, সে বিশ্বাস করে। গেজের মৃত্যুর আগে এবং পরে, সে বার বার নিজেকে বুঝিয়েছে যে চার্চ আসলে সেবার মরেনি, শুধু জ্ঞান হারিয়েছিল। চার্চকে কবর দেয়ার পর সে সেখান থেকে মাটি সরিয়ে বের হয়ে ফিরে এসেছে। মনিব ভুলে তার পোষা প্রাণীকে কবর দিয়ে দেয়, আর বিশ্বস্ত প্রাণীটা কবর থেকে নিজেকে বের করে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু সেটা একদমই সত্য না। চার্চ আসলেই মরে গিয়েছিল আর মিকমেকদের গোরস্থান ওকে আবার ফিরিয়ে এনেছে।

সে গেজের কবরের পাশে বসে তার জানা সবগুলো তথ্য গুছিয়ে ভাবতে থাকে, যতটুকু গুছিয়ে ভাবনা এই কালো যাদু তাকে করতে দেয়।

টিমি ব্যাটারম্যান। প্রথমত, সে কি গল্পটা বিশ্বাস করেছে? দ্বিতীয়ত, তাতে কি কিছু যায় আসে?

জাড যেই পরিস্থিতিতে গল্পটা তার থলে থেকে বের করেছেন সেটা বেশ সন্দেহজনক। কিন্তু তারপরও লুইস সেটার বেশিরভাগটাই বিশ্বাস করেছে। যদি লোকজন মিকমেক কবরস্থানের ওই ক্ষমতার কথা জানে তাহলে কেউ না কেউ সেই ক্ষমতা নিয়ে একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে সেটাই স্বাভাবিক। আর সেটা শুধু কুকুর-বিড়ালেই সীমাবদ্ধ থাকবে সেটাও বিশ্বাস করা কঠিন।

আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে কি সে এটাও বিশ্বাস করে টিমি ব্যাটারম্যান একটা শয়তান বা জম্বিতে পরিণত হয়েছিল?

এটা অধিকতর কঠিন প্রশ্ন। আর সে এটা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা করছে কারণ সে জানে সে এটা বিশ্বাস করতে চায় না। আর এরকম একপেশে মানসিকতা নিয়ে চিন্তা করলে ফলাফল কি হয় সে আগেও দেখেছে।

না, সে এটা বিশ্বাস করতে চায়না টিমি ব্যাটারম্যান কোন অশুভ কিছুতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে সে এই কারণে নিজের চিন্তা-ভাবনা ঘোলাটে হয়ে যেতে দিতে পারে না।

লুইস হ্যানরাট্টির কথা ভাবে; মিকমেকদের গোরস্থানে কবর দেয়া সেই ষাঁড়টার কথা। জাড বলেছিলেন ষাঁড়টা খুব বিগড়ে গিয়েছিল, অনেকটা টিমি ব্যাটারম্যানের মতই। পরবর্তীতে যে লোক অমানসিক পরিশ্রম করে মিকমেকদের গোরস্থানে ষাঁড়টাকে স্লেজে করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, সেই লোকই সেটাকে গুলি করে সরিয়ে দেয় তার বদ স্বভাবের কারণে। টিমি ব্যাটারম্যানকেও প্রায় একইভাবে তার বাবা দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেন।

কিন্তু সেই ষাঁড়টা বদ হয়ে গিয়েছিল মানে কি বাকি সব পশুরাও বদ হয়ে গিয়েছিল? না। তাহলে দেখা যাচ্ছে ষাঁড়ের ঘটনাটা স্বাভাবিক কেস না, বরং অস্বাভাবিক কেস। অন্য কেসগুলো দেখি—জাডের কুকুর স্পট, বুড়ো মহিলার টিয়া, চার্চ নিজে। তারা সবাই পরিবর্তিত হয়ে ফিরে এসেছে, তাদের পরিবর্তনগুলোও চোখে পড়ার মতই; কিন্তু অন্তত স্পটের ক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলো এতো জঘন্য ছিল না সেটা নিশ্চিত হয়ে বোঝা যায়, কারণ তাহলে জাড নিশ্চয়ই লুইসকে সেখানে নিয়ে যেতেন না। পরে অবশ্য সেই কাজের জন্যে তিনি অনুতপ্ত হয়েছেন, অনেক হাবি-জাবি কথা বলেছেন যেগুলোর আসলেই কোন আগা-মাথা নেই।

সে কিভাবে শুধু এক টিমি ব্যাটারম্যানের গল্প শুনে এই সুযোগটা হাতছাড়া করবে? একটা উদাহরণ দিয়ে তো সবটা বোঝা যায় না।

তুমি নিজে যেই ফলাফল চাও, সেটা প্রমাণ করার জন্যে সব যুক্তি সেইদিকেই ব্যবহার করছো, তার মন বিরোধীতা করে ওঠে। অন্তত নিজেকে চার্চের ব্যাপারের সত্যটা তো বলো। তুমি যদি ওর নির্মমভাবে খুন করা ইঁদুর আর পাখিগুলোর কথা বাদও দাও,-ও যেরকম হয়ে গেছে সেটা নিয়ে তুমি কী বলতে চাও? ওকে এখন যেটা বলা যায় তা হচ্ছে বেকুব; এর চাইতে ভালো কিছু ওর সম্পর্কে বলা যায় না। গেজকে নিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর দিনটার কথা মনে আছে তোমার? কতটা প্রাণবন্ত ছিল গেজ? তুমি গেজের সেই স্মৃতিটা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাও? নাকি ওকে ফালতু হরর মুভির জম্বিদের মত কবর থেকে উঠিয়ে আনতে চাও? আর জম্বি না হলেও খুব বেশি হলে একটা বেকুব বাচ্চা ছেলে হিসেবেই নাহয় তাকে ফেরত পাবে, যে রোবটের মত সারাদিন টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে, আর খাওয়ার সময় চারদিকে খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়, কারণ তার জন্যে নিজে নিজে খাওয়াটাও একটা বিরাট জটিল কাজ; আর যে কখনো নিজের নামটাও লিখতে পারবে না। এই ব্যাপারে তুমি কি বলবে? মনে আছে জাড তার কুকুরকে নিয়ে কি বলেছিল? আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা মাংসপিন্ডকে গোসল করাচ্ছি।” এটাই কি তুমি চাও? শ্বাস নিতে পারা একটা মাংসপিন্ড? আর তা নিয়েও যদি তোমার কোন সমস্যা না থাকে তাহলেও তুমি তোমার ফিরে আসা মৃত ছেলের ব্যাপারে তোমার স্ত্রীর কাছে কি জবাব দিবে? এলিকে কি বলবে? স্টিভ মাস্টারটনকে কি বলবে? পুরো দুনিয়াকে কি বলবে? মিসি ডেন্ডিজ যখন তোমাদের বাসায় এসে ড্রাইভওয়েতে গেজকে তার তিন চাকার সাইকেল চালাতে দেখবে তখন কি হবে? তুমি কি তার আর্তচিৎকার শুনতে পারছো? তুমি কি তার আতঙ্কিত চেহারাটা দেখতে পাচ্ছো? তুমি সাংবাদিকদের কি বলবে? রিয়ালিটি টিভির লোকজন যখন তোমার আর তোমার পুণরুত্থান ঘটা ছেলেকে নিয়ে প্রোগ্রাম করার জন্যে বাসায় ক্যামেরা নিয়ে হাজির হবে তখন তুমি তাদের কি বলবে?

কিন্তু আসলেই কিছু যায় আসে না কি এটা তার ভেতরের কাপুরুষত্বের কন্ঠ? সে কি বিশ্বাস করে যে এসব কিছু সামাল দেয়া যাবে না? রাচেল কি তার মৃত ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরানো ছাড়া অন্য কিছু করবে?

হ্যাঁ, সে বুঝতে পারছে খুব ভাল সম্ভাবনা আছে যে গেজ ফিরতে পারে…ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে। কিন্তু তাই বলে কি ওর প্রতি তার ভালোবাসা কমে যাবে? যাদের বাচ্চা বোবা-কালা বা অন্ধ, পেট বাইরে ঝোলা হয়ে জন্মায় তারা কি তাদের সন্তানকে ভালোবাসে না? যাদের সন্তান ধর্ষণ, খুন বা নিরপরাধীর উপর জুলুমের মত অপরাধ করে, তারা কি তাদের সেইসব সন্তানদের জন্যে বিচারকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে না?

সে কি মনে করে গেজ যদি একটা অথর্ব হয়ে ফিরে আসে তাহলে সে তাকে ভালোবাসতে পারবে না? যদি সে আট বছর পর্যন্ত ডায়াপার পরে, যদি সে দশ বছরে প্রথম শ্রেণী পাশ করে? বা যদি জীবনেও না করে? সে কি তার ছেলেকে একেবারে ত্যাগ করবে, যখন একটা শেষ চেষ্টা করার উপায় আছে?

কিন্তু লুইস তুমি তো মহাশূন্যে বাস করো না! লোকে কী বলবে-

সে এই চিন্তাটা খুব ক্ষিপ্রভাবে মন থেকে সরিয়ে দেয়। এখন যেসব বিষয় পাত্তা দেয়া যাবে না সেসবের মধ্যে ‘মানুষ কী ভাববে’ লিস্টের সবচাইতে ওপরে।

লুইস মাথা নিচু করে গেজের কবরের দিকে তাকালে তার শরীর দিয়ে আতঙ্কের একটা শিহরণ বয়ে যায়। নিজের অজান্তেই তার আঙুলগুলো গেজের কবরের মাটির ওপর একটা প্যাঁচানো বৃত্তাকার চিহ্ন এঁকেছে।

সে সাথে সাথে তার দুহাতের আঙুলগুলো দিয়ে চিহ্নটা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এরপর সে গোরস্থান থেকে বেরিয়ে যায়, দ্রুতপদে, প্রতিনিয়ত ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করতে করতে। তার মনে হচ্ছে এখনি কেউ তার পথ আগলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে এখানে এই সময়ে সে কী করতে এসেছে।

পিজ্জা নিতে অনেক দেরি হয়ে যায় তার। যদিও এটাকে একটা ওভেনের ওপর অল্প তাপে রেখে দেয়া হয়েছিল, সেটাকে এখন দেখতে তেলতেলে ঠান্ডা রুটির মত দেখাচ্ছে। সেটাকে মুখে দিয়ে লুইসের মনে হলো সে রান্না করা মাটি খাচ্ছে। একটা পিস কোন রকমে গিলে বাকিটা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, বক্স সহ। সে চায় না রাচেল তাদের বাসার ময়লার ঝুড়িতে একটা প্রায় না খাওয়া পিজ্জা দেখুক। কারণ তাহলে রাচেল হয়তো বুঝে যাবে তার ব্যাঙ্গর আসার প্রধান কারণ পিজ্জা খাওয়া ছিল না।

লুইস এখন সময় আর পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছে।

সময়। সময় হয়তো খুবই গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয়। টিমির মৃত্যুর পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছিল যতক্ষণে তার বাবা তাকে মিকমেকদের কবরস্থানে কবর দেয়। টিমি গুলি খেয়েছিল উনিশ তারিখে। তাকে প্রথমবার কবর দেয়া হয়েছিল খুব সম্ভবত বাইশ তারিখে; জাডের মতে। এর চার থেকে পাঁচ দিন পর মার্জারি তাকে রাস্তার ওপর হাঁটতে দেখেন।

আচ্ছা, ধরা যাক বিল ব্যাটারম্যান তার ছেলের প্রথম কবরের চার দিন পর…না, হিসেবে ত্রুটি থাকলে সেটা রক্ষণশীল দিকেই ধরা যাক। ধরা যাক তিন দিন পর। আর তর্কের খাতিরে ধরা যাক টিমির পুনরুত্থান ঘটে পচিশ তারিখে। তাহলে এক রকম বলা যায় যে তার মৃত্যু আর কবর থেকে উঠে আসার মধ্যে তফাত ছিল ছয় দিনের। আর সেটা হয়তো দশ দিনও হতে পারে। গেজের ক্ষেত্রে চারদিন এর মধ্যেই চলে গেছে। বিলি ব্যাটারম্যান যদি ছয় দিনের মধ্যেও কাজটা করে থাকে যার কমে আসলে সেটা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না-তাহলেও লুইসের এখনো তার চাইতে কম সময়ে কার্যসিদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। যদি…

যদি সে চার্চের সময় যে পরিস্থিতি ছিল সেই একই পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। চার্চ খুব ভালো সময়ে মরেছিল, তাই না? তার পরিবারের কেউই বাড়িতে ছিল না, যখন চার্চ রাস্তায় গাড়ির ধাক্কা খেয়ে মারা যায়।

তার পরিবারের সবাই তখন শিকাগোতে বেড়াচ্ছে।

লুইসের কাছে ধাঁধাঁর শেষ অংশটাও পরিস্কার হয়ে যায়।

***

“আমাদের তুমি কী করতে বলছো?” রাচেল লুইসের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

রাত প্রায় দশটা। এলি ঘুমিয়ে পড়েছে। রাচেল আরেকটা ভ্যালিয়াম খেয়েছে এর মধ্যে। সেও অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিল, কিন্তু লুইসের কথাটা ঠিকই তাকে ধাক্কা দিয়েছে।

“আমি চাচ্ছি তোমরা তোমার বাবা-মার সাথে শিকাগোতে ফিরে যাও,” লুইস ধৈর্য সহকারে আবারো বলে। তুমি যদি এখনি তাদের এয়ারলাইন্সে ফোন করো, তাহলে তোমরা একই প্লেনে যেতে পারবে।”

“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? বাবার সাথে তোমার ওই মারামারির পর-”

লুইস মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে আনাড়ি। কিন্ত কোন অদ্ভুত এক কারণে সে নিজের মধ্যে মিথ্যা বলার জন্যে একরকম অনুপ্রেরণা পাচ্ছে।

“ওই মারামারিই একটা বড় কারণ। আমার মনে হয় আমাদের মীমাংসা হয়ে যাওয়া উচিত। পুরনো ঘা আরো খুঁচিয়ে লাভ নেই, তা আমি বুঝতে পারছি রাচেল…মারামারির ঠিক আগে আমি ওইরকমই কিছু করার চিন্তা করছিলাম। মারামারি শুরুর আগে সত্যই আমি সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চাচ্ছিলাম।”

“কিন্তু এই সময়ে তোমাকে ফেলে তাদের কাছে যাওয়া আমার একদমই ভালো লাগছে না। তোমাকে এখন আমাদের প্রয়োজন। আর তোমারও আমাদেরকে প্রয়োজন।” রাচেলের চোখগুলো লুইসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। “অন্তত আমি আশা করি যে তোমার আমাদেরকে প্রয়োজন। আর আমাদের কারোই এমন অবস্থা নেই যে-”

“এখানে থাকার মত কোন অবস্থা তোমাদের নেই,” লুইস জোর দিয়ে বলে। তার মনে হচ্ছে তার জ্বর আসছে। “আমি খুশি যে তোমার আমাকে প্রয়োজন আর আমারো তোমাদেরকে প্রয়োজন। কিন্তু এই বাসাটা এখন তোমার থাকার জন্যে দুনিয়ার সবচাইতে নিকৃষ্ট জায়গা। গেজ এই বাসার সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাছাড়া আমার মনে হয় এটা এলির জন্যেও খুব খারাপ।”

সে রাচেলের চোখে স্পষ্ট বেদনার ছাপ দেখতে পায়। তার এই নিচুদরের যুক্তি শুনে সে নিজের কাছেই লজ্জিত। সে যত পড়াশোনার বই পড়েছে, সবগুলো তাকে বলেছে কারো প্রিয়জন মারা গেলে তাদের প্রথমেই খুব ইচ্ছে হয় ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে। আর এই কাজটা তার জন্যে খুবই ক্ষতিকর, কারণ সে তার নতুন বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাচ্ছে, বাস্তবতা না মেনে নিয়ে। বইয়ে লেখা আছে কারো প্রিয়জনের মৃত্যু হলে তাদের উচিত তারা যেখানে ছিল সেখানেই থাকা এবং শোকের মাঝেই শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা। কিন্তু লুইস এখন এসব কিছুই পরোয়া করে না। সে শুধু চায় তার পরিবারকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে, অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও।

“আমি জানি,” রাচেল বলে। “তুমি ব্যাঙ্গর যাওয়ার পর আমি ঘরটা ভ্যাকিউম ক্লিনার দিয়ে পরিস্কার করছিলাম; কিছু করে নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে। তখন আমি সোফাটা একটু সরালে সেটার নিচে গেজের ছোট ছোট গাড়িগুলো দেখি…মনে হচ্ছিল…গাড়িগুলো অপেক্ষা করছে গেজের জন্যে…তাদের নিয়ে খেলার জন্যে…” রাচেলের কাঁপতে থাকা কন্ঠ এবার একদম ভেঙে যায়, তার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে শুরু করে। “এরপর আমি আরেকটা ভ্যালিয়াম খাই কারণ আমি আমার কান্না থামাতে পারছিলাম না…আমি এখনো এজন্যেই কাঁদছি…কী এক নরক শুরু হলো আমাদের জীবনে লুইস?…লুইস আমাকে একটু ধরবে?”

লুইস তাকে জড়িয়ে ধরে, খুব ভালোভাবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার নিজেকে একটা ভন্ড বলে মনে হচ্ছে। তার মনের ভেতর নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিভাবে এই চোখের পানিকে তার নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো যায়।

“এরকম আর কয়দিন চলবে লুইস? আমি কসম খেয়ে বলতে পারি আমি যদি ওকে ফিরে পেতাম তাহলে ওর আরো বেশি বেশি খেয়াল রাখতাম, ওরকম কিছুই ওর সাথে হতে দিতাম না। লুইস, ওই ড্রাইভার খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল, কিন্তু তাই বলে আমাদের দোষও মাফ হয়ে যায় না। আমি কখনো কল্পনাও করিনি এতো কষ্ট থাকতে পারে জীবনে। লুইস, এই যন্ত্রণা থেকে আমার কোন রেহাই নেই; যখন আমি ঘুমোতে যাই তখনো আমি স্বপ্নে ওই দৃশ্যটাই দেখি, বার বার…আমি দেখি ও রাস্তাটার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে… আর আমি চিৎকার করে ওকে ডাকছি…

“শ্‌শ্‌শ্…রাচেল, শ্‌শ্‌শ।”

রাচেল তার ফোলা মুখ তুলে তার দিকে তাকায়। “লুইস, গেজতো কোন দুষ্টুমিও করছিল না…ওর কাছে দৌড়ে পালানো ছিল একটা নিছক খেলা…ট্রাকটা খারাপ সময় এসে পড়েছিল…মিসি ডেন্ড্রিজ ফোন করেছিল যখন আমি কাঁদছিলাম… উনি বললেন খবরের কাগজে বেরিয়েছে ওই ট্রাকের ড্রাইভারটা না কি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।”

“কী?”

“সে না কি তার গ্যারাজে গলায় দড়ি দিয়ে মরার চেষ্টা করেছে। সে খুবই ডিপ্রেশনে আছে, খবরের কাগজে এ রকমই নাকি লিখেছে…”

“ও মরলেই ভালো,” লুইস ঘৃণা ভরা কন্ঠে বলে, কিন্তু তার নিজের কন্ঠস্বর তার কাছে অনেক দূরের কিছু বলে মনে হয়। তার সমগ্র শরীরে হঠাৎই কাঁটা দিয়ে ওঠে।…সেটা আগেও ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছিল, আর আমার ভয় হচ্ছে সেটা সামনেও আবার ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসবে…”আমার ছেলে মরে কবরের নিচে শুয়ে পচছে। আর সে হাজার ডলারে জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে আরো বেশি ডিপ্রেসড হোক। আর কিইবা শাস্তি হবে ওর আমাদের ছেলেকে খুন করার জন্যে? বেশি হলে ওর লাইসেন্স কিছুদিনের জন্যে বাতিল করা হবে আর কিছু টাকা জরিমানা হবে…”

“মিসি বলছিলেন তার স্ত্রী আর বাচ্চারাও নাকি তাকে ছেড়ে চলে গেছে, “ রাচেল মৃদু গলায় বলে। “এই খবর অবশ্য তিনি খবরের কাগজ থেকে পাননি। ওখানকার একজনকে না কি মিসি চিনেন। ড্রাইভার লোকটা সেই সময় নেশাগ্রস্থ ছিল না, কোন ড্রাগসও সে নেয়নি। তার আগেও বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর কোন পুলিশ রেকর্ড নেই। সে বলেছে সে যখন লাডলো পৌঁছায় তার না কি হঠাৎ একটা ঝোঁক চাপে স্পিডের প্যাডেলে চাপ দেয়ার। সে বলেছে এরকম সে কেন করেছে সে নিজেও জানে না।”

ঝোঁক চাপে…স্পিডের প্যাডেলে চাপ দেয়ার।

জায়গাটার ক্ষমতা আছে…

লুইস চিন্তাগুলো ঠেলে সরিয়ে দেয়। সে আস্তে করে তার স্ত্রীর হাত চেপে ধরে। “তোমার বাবা-মাকে ফোন কর, এক্ষুনি। তোমার আর এলির এই বাসায় আর একদিনও থাকা উচিত না। এক দিনও না।”

“তোমাকে ছাড়া না,” রাচেল বলে। “লুইস, আমি চাই আমরা সবাই একসাথে থাকি। এটাই সবচাইতে বেশি দরকার।”

“আমি তিন দিন পরেই চলে আসবো তোমাদের কাছে-আর খুব বেশি হলে চার দিন।” সবকিছু ঠিকঠাক মত চললে রাচেল আর এলি আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই এখানে ফিরে আসতে পারবে। “অফিসে আমার বদলে আরেকজনকে দায়িত্ব দিয়ে যেতে হবে। অন্ততপক্ষে কোন পার্টটাইম ডাক্তার হলেও লাগবে। নাহলে সুরেন্দ্র খুব বিপদে পড়ে যাবে। জাডকে বললে তিনি নিশ্চয়ই আমাদের বাসাটা দেখে রাখবেন। আর আমাদের বিদ্যুত বন্ধ করে ফ্রিজে যা আছে তা মিসি ডেন্ডিজদের ডিপ ফ্রিজে রেখে যেতে হবে।”

“এলির স্কুল…”

“ম্যানেজ করা যাবে। খুব বেশি হলে তিন সপ্তাহের ক্লাস বাকি আছে। আমি ওদের বলে নিশ্চয়ই ম্যানেজ করতে-”

“লুইস?”

লুইস থামে। “কী?”

“তুমি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছো।”

“লুকোচ্ছি?” সে রাচেলের দিকে স্বাভাবিকভাবে তাকায়। “কী বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“কিছু লুকোচ্ছো না?”

“না। একদমই না।”

“আচ্ছা, আমি এখনি তাদের ফোন করছি…তুমি যদি আসলেই আমাদের সেখানে পাঠাতে চাও।”

“আমি চাই,” সে বলে, আর তার কথাগুলো তার মাথার ভেতর প্রতিধ্বনি করতে থাকে। “এলির জন্যেই এটা বেশি প্রয়োজন।”

রাচেল তার লাল চোখগুলো দিয়ে লুইসের দিকে তাকায়। ভ্যালিয়ামের প্রভাবে তার চোখ চকচক করছে। “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার জ্বর এসেছে, লুইস।”

রাচেল লুইসের জবাব দেয়ার আগেই ফোন তুলে তার বাবা-মায়ের হোটেলে ফোন দেয়।

***

গোল্ডম্যানরা রাচেলের শিকাগো যাওয়ার প্রস্তাবে যারপরনাই খুশি হন। তিন- চার দিন পর লুইসের আবির্ভাবের ব্যাপারটা তারা এতো উৎসাহের সাথে নিলেন না, কিন্তু চিন্তা কী? লুইসের শিকাগো যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সে ভেবেছিল কোন ঝামেলা হলে প্লেনের টিকিট নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। কিন্তু সেখানেও তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে দেখা দিল। রাচেল তার বাবা-মায়ের প্লেনেই টিকিট পেয়ে গেল; তবে পুরো পথের না। মাঝখানে সিনসিনাটিতে একটা যাত্রা বিরতি আছে। সেখানে রাচেল আর এলি নেমে যাবে অন্য প্লেনে ওঠার জন্যে। খুব বেশি হলে তাদের এক ঘণ্টা বেশি লাগবে শিকাগো পৌঁছাতে।

অনেকটা জাদুর মত, লুইস এয়ারলাইন্সের সাথে কথা বলার পর ফোন রাখতে রাখতে ভাবে। তার মাথায় জাডের কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। জায়গাটার ক্ষমতা আছে…সেই ক্ষমতা আসে ধাপে ধাপে…আর আমার ভয় হচ্ছে সেটা সামনেও আবার…

দূর হ!, সে জাডের কণ্ঠকে কর্কষভাবে বলে। আমি গত দশ মাসে অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখেছি আবার বিশ্বাসও করেছি। কিন্তু তাই বলে আমি এটা বিশ্বাস করবো না যে এক টুকরো জমির প্লেনের টিকেট বিক্রির ওপর প্রভাব খাটানোর মত ক্ষমতা আছে।

“আমার ব্যাগ গুছাতে হবে,” রাচেল প্যাডে লেখা ফ্লাইটের সময় দেখে বলে।

“একটা বড় সুটকেস নাও শুধু।” লুইস বলে।

“আমাদের দুজনের জিনিসের জন্যে? লুইস, তুমি কি ফাজলামো করছো আমার সাথে?”

“আচ্ছা, ঠিক আছে আরো দুই-একটা ছোট ব্যাগ নাও লাগলে। কিন্তু আগামী তিন সপ্তাহের প্রত্যেক দিনের জন্যে আলাদা ড্রেস নিতে গিয়ে কাহিল হবার দরকার নেই,” সে বলে, কিন্তু সে ভাবছে, যেহেতু তোমরা খুব শীঘ্রই এখানে ফিরে আসছো। “বেশি হলে এক সপ্তাহ বা দশ দিনের জন্যে প্যাক কর। আর তোমার কাছে তো চেকবই আর ক্রেডিট কার্ড আছেই। প্রয়োজন পরলে কিনে নিও সেখান থেকে।”

“কিন্তু আমাদের সেই সামর্থ্য-” রাচেল বলতে গিয়ে থেমে যায়। তার কাছে এখন সব কিছুই ঘোলাটে মনে হয়।

“আছে, আমাদের সেই সামর্থ্য আছে।” লুইস বলে। “ গেজের কলেজের জন্যে আমরা যেই টাকাটা জমিয়েছিলাম সেটা তুলে খরচ করা যাবে। হয়তো ব্যাংকের ফর্মালিটিসের জন্যে দুই-এক দিন দেরি হবে–”

রাচেলের মুখটা আবারো কুঁচকে যেতে আরম্ভ করে। লুইস তাকে জড়িয়ে ধরে। ও ঠিকই বলেছিল…যন্ত্রণাটা বারে বারে আঘাত করে…করতেই থাকে… ‘রাচেল, প্লিজ,” সে বলে। “প্লিজ, কেঁদো না।” থাকে…‘রাচেল,

কিন্তু রাচেল কাঁদে-না কেঁদে উপায় কী?

রাচেল যখন ওপরতলায় ব্যাগ গুছাচ্ছে, ফোনটা বেজে ওঠে। লুইস ছোঁ মেরে ফোনটা লুফে নেয়। তার ধারণা এয়ার টিকেটের অফিস থেকে ফোন দেয়া হয়েছে এবং এখনি তাকে বলা হবে যে একটা ভুল হয়ে গেছে, আসলে কোন ফ্লাইট পাওয়া যাচ্ছে না আপনাদের সুবিধা মত। আমি জানতাম সব কিছু যেন একটু বেশি বেশি সহজেই হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু আসলে ফোন করেছেন আরউইন গোল্ডম্যান।

“আমি রাচেলকে ডেকে দিচ্ছি,” লুইস বলে।

“না।” এরপর বেশ কিছুক্ষণ ফোনের কোন পাশেই কেউ কথা বলে না, অস্বস্তিকর নীরবতা। বুড়ো হয়তো ভাবছে আমাকে কোন গালিটা আগে দিবে।

গোল্ডম্যান যখন নীরবতা ভেঙে কথা বললেন, তার কন্ঠ শুনে মনে হলো তিনি খুব কষ্ট করে কথাগুলো মুখ দিয়ে বের করছেন। “আমি তোমার সাথেই কথা বলতে চাই। ডোরি চায় আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই…আমার ব্যবহারের জন্যে। আমার মনে হয়…লুইস, আমার মনে হয় আমি নিজেও তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাই।”

বাহ! মহৎ লোক! আপনার জন্যে সম্মানে আমার পেশাব পেয়ে যাচ্ছে।

“আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে না,” লুইস যান্ত্রিক গলায় বলে।

“আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য,” তিনি বলেন। এখন মনে হচ্ছে তিনি ঠেলে ঠেলে এক একটা শব্দ নিজের গলা দিয়ে বের করছেন। “রাচেল আর এলিকে শিকাগো আসতে বলায় আমি বুঝতে পেরেছি তোমার মনটাই বড়, আর আমি যা করেছি তা ছোট মনের কাজ।”

এরকম কথা যেন সে আগেও শুনেছে, খুব পরিচিত মনে হচ্ছে কথাটা।

হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল। মনে পড়ায় তার অনুভূতি হলো মারাত্নক টক লেবু চুষে খাবার মত। সেরকম কথা রাচেল বলে। রাচেলও বলে, আমি খুব দুঃখিত তোমার সাথে এরকম করেছি; কিন্তু তা বলে নিজের ইচ্ছেটাই ফাইনাল হবার পর। ঠিক তার বাবার মতন। বাপকা বেটি, সিপাইকা ঘোড়া; কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া।

বুড়ো তার মেয়েকে আর নাতনীকে ফিরে পেয়েই যারপরনাই খুশি। তারা ঠিক সেখানেই যাচ্ছে যেখানে তিনি তাদের চান। ইচ্ছে যখন পূরণ হয়েই গিয়েছে, এখন তিনি নিজের উদারতা দেখাতেই পারেন। আরউইন যদ্দুর জানেন, তার হিসেবে তিনি জিতেছেন। অতএব চলো যা ঘটেছে সব ভুলে যাই আমরা। চলো ভুলে যাই আমি তোমাকে তোমার ছেলের ফিউনারেলের দিন তার লাশের সামনে ঘুষি মেরেছি, চলো ভুলে যাই তুমি যখন পড়ে গেছিলে তখন আমি তোমার পাছায় লাথি মেরেছি, চলো ভুলে যাই যে আমার ধাক্কা লেগে তোমার ছেলের কফিন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল-যাতে সেটার ছিটকিনি ভাঙায় তুমি কফিনের খুলে আসা ডালার ফাক দিয়ে শেষ বারের মত তোমার ছেলের গোলাপি হাতটা দেখতে পাও। চলো সব ভুলে যাই। যা হয়েছে তা মনে রেখে লাভ কি?

কিন্তু আরউইন, জানিস? আমি চাই তুই এই মুহূর্তে জাহান্নামের রাস্তা ধর। কিন্তু শুধু আমার পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে বলে…

“সমস্যা নেই, মি. আরউইন,” সে বলে। “দিনটা…আসলে দিনটা আমাদের সবার জন্যেই খারাপ একটা দিন ছিল।”

“না, সমস্যা আছে,” তিনি বাধা দিয়ে বলেন। তার কন্ঠ শুনে তার মনে হচ্ছে তিনি আন্তরিকভাবেই দুঃখিত। লুইসের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না, কিন্তু আসলেই বুড়োকে আন্তরিকই মনে হচ্ছে। বুড়ো এখন প্রায় ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তার গলার স্বর ধীর এবং কাঁপা কাঁপা। “দিনটাকে সবার জন্যে খারাপ বানিয়েছি আমিই। আমার আহাম্মকির জন্যেই এসব ঘটেছে। যখন আমাকে আমার মেয়ের সবচাইতে বেশি দরকার ছিল, ঠিক তখনই আমি ওকে আঘাত করেছি…তোমারো হয়তো আমাকে দরকার ছিল…কিন্তু আমি তোমাকেও কষ্ট দিয়েছি। আমি তোমার সাথে জঘন্য আচরণ করার পরও যখন তুমি আমার সাথে ভালো ব্যাবহার করছো, আমার নিজেকে এখন আসলেই একটা দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার বস্তা মনে হচ্ছে। এবং আমার এরকমই মনে হওয়া উচিত।”

এই ব্যাটা চুপ কর। নইলে কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি করে সব ভন্ডুল করব, লুইস মনে মনে বলে।

“রাচেল সম্ভবত তোমাকে বলেছে লুইস…আমাদের আরেকটা মেয়ে ছিল।”

“জেন্ডা,” লুইস বলে। “হ্যাঁ, রাচেল আমাকে বলেছে ওর কথা।”

“ওই ঘটনাটা আমাদের সবার জন্যে খুব কঠিন ছিল। রাচেলের জন্যে হয়তো সবচাইতে কঠিন ছিল-জেন্ডার মৃত্যুর সময় সেখানে রাচেল একাই ছিল। কিন্তু সেটা আমার আর ডোরির জন্যেও কম কষ্টের ছিল না। ডোরি প্রায় ভেঙেই পড়েছিল-”

আপনার কি মনে হয় রাচেল ভেঙে পড়েনি? আপনার কি মনে হয় না বাচ্চারাও ভেঙে পড়তে পারে? বিশ বছর পর এখনো সে মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত যেকোন কিছু থেকে কয়েকশো হাত দূরে থাকে। কিন্তু এখন তার সাথেই এই ঘটনা ঘটলো। এটা একটা বিস্ময় যে ওকে এখনো হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নাকে নল দিয়ে খাওয়ানো লাগছে না। তাই, আমাকে এসব বালের কথা বলতে আসবেন না, যে সেটা আপনাদের জন্যে কেমন কষ্টের ছিল। টাকলার বাচ্চা টাকলা।

“জেন্ডার মৃত্যুর পর থেকে রাচেলই আমাদের একমাত্র অবলম্বন… আমরা ওর ব্যাপারে সবসময় দরকারের চাইতে একটু বেশিই হুশিয়ার থাকতাম…ওর পিঠের ব্যথার কষ্টগুলো পুষিয়ে দিতে চাইতাম…আমরা ওই সময় সেখানে ছিলাম না এই অপরাধটাও পুষিয়ে দিতে চাইতাম।”

হ্যাঁ, বুড়ো এখন সত্যই কান্না করছে। তার কান্না করার কি দরকার? এটা দেখে লুইসের তার প্রতি নিজের অকৃত্রিম ঘৃণাটা বজায় রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হলেও সে এখনো বজায় রাখতে পারছে। সে ইচ্ছে করেই গোল্ডম্যানের সেই চেকবই বের করে লুইসকে কিনতে চাওয়ার দৃশ্যটা মনে করে; কিন্তু ওই দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ডে সে জেল্ডাকে দেখতে পায়। ব্যথায় কাতর হয়ে চিৎকার করতে থাকা জেল্ডা, যার মুখ ফ্যাকাসে কুঁচকানো আর হাতের আঙুলগুলো পাখির থাবার মত। একটি গোল্ডম্যান বংশের ভূত।

“প্লিজ,” সে বলে। “প্লিজ, মিস্টার গোল্ডম্যান। ব্যাপারটা যতটুকু খারাপ তার চাইতে আর খারাপ না করি, ওকে?”

“আমি এখন বিশ্বাস করি তুমি একজন ভালো মানুষ এবং আমি আগে তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আমি জানি তুমি কী ভাবছো। তুমি ভাবছো যে আমি যা চাই তা পেয়ে গেছি তাই আমি এখন এসব বলছি…তুমি হয়তো ভাবছো আমি একদিন চেক দিয়ে তোমাকে কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লুইস, ঈশ্বরের কসম…”

“আর না,” লুইস ভদ্রভাবে বলে। “প্লিজ, থামুন…..আমি সত্যই আর পারছি না।” এখন তার গলাও কাঁপছে।

“আচ্ছা, ঠিক আছে,” গোল্ডম্যান বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। “আমি আর শুধু এটুকুই বলতে চাই যে আমি আসলেই দুঃখিত। আমি তোমার কাছে আমার অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাই। তোমার আমাকে মাফ করতে হবে না। কিন্তু আমি এটা বলার জন্যেই ফোন দিয়েছিলাম। আমি ক্ষমা চাই।”

“আচ্ছা,” লুইস বলে। তার মাথা দপদপ করছে, সে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলে। “ধন্যবাদ, আপনাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে।”

“তোমাকে ধন্যবাদ লুইস,” তিনি বলেন। “আর এজন্যেও ধন্যবাদ যে ওদেরকে তুমি যেতে দিচ্ছ। হয়তো এটাই ওদের জন্যে সবচাইতে ভালো। আমরা ওদের জন্যে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করবো।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে,” লুইস বলে। হঠাৎ ওর মাথায় একটা আইডিয়া আসে এবং সেটার স্বাভাবিকতার কারণে সেটাকে খুবই লোভনীয় মনে হচ্ছে। সে সব ভুলে যাবে…এবং সে গেজকে তার ‘প্লেজেন্টভিউ’ গোরস্থানের কবরেই শুয়ে থাকতে দিবে। যে দরজা তার মুখের ওপর অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেই দরজা নিয়ে সে আর টানাটানি করবে না; বরং দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তার স্ত্রীকে যা বলেছে সে আসলে তাই করবে। কয়েক দিনের মধ্যে এদিকটা একটু গুছিয়ে নেবে এবং এরপর সাথে সাথে প্লেনে চড়ে তাদের কাছে পৌঁছে যাবে। তারা হয়তো পুরো গ্রীষ্মটাই সেখানে কাটিয়ে আসবে, তার স্ত্রী এবং কোমল হৃদয়ের মেয়ের সাথে। তারা চিড়িয়াখানায় যাবে, লেকে নৌকায় চড়তে যাবে, জাদুঘরে যাবে। সে এলিকে সিয়ার্স টাওয়ারের সবচাইতে ওপরের তলায় নিয়ে গিয়ে শহরটা সেখান থেকে কেমন চমৎকার দেখায় তা দেখাবে। এরপর যখন আগস্টের মাঝামাঝি তারা ফিরে আসবে, তারা ফিরে আসবে একটা মৃতপ্রায় বাড়িতে। হয়তো তাদের নতুন করে সব শুরু করতে হবে, নতুন সুতো দিয়ে বুনন শুরু করতে হবে; এখন এখানে যে সুতো আছে সেই সুতো নোংরা, সুতোয় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।

কিন্তু একি তার ছেলেকে আরেকবার খুন করার সামিল না?

তার ভেতর থেকে আরেকটা কন্ঠ তার সাথে এই ব্যাপারে তর্ক করতে চায়, কিন্তু লুইস সেটার গলা টিপে ধরে।

“আরউইন, আমার এখন যেতে হবে। রাচেল সব ঠিকভাবে নিয়েছে কি না চেক করে ওকে বিছানায় নিয়ে যেতে হবে।”

“আচ্ছা। গুড বাই, লুইস। আর আরেক বার–”

সে যদি আরেকবার বলে সে দুঃখিত, আমি চিৎকার করবো। “গুড বাই, আরউইন,” সে বলেই ফোনটা রেখে দিল।

***

রাচেল তাদের রুমে কাপড়ের মাঝে ডুবে আছে। খাটের ওপর ব্লাউস, চেয়ারের ওপর ব্রা, দরজার হাতলে পাজামার হ্যাঙ্গার ঝুলছে। জানালার নিচে সারিবদ্ধ সৈন্যদলের মত অনেকগুলো জুতো লাইন করে রাখা। দেখা যাচ্ছে ও ধীরে ধীরে গোছগাছ করলেও বেশ ভালোভাবেই গোছাচ্ছে। লুইস মনে মনে হিসেব করে দেখলো এসব নেয়ার জন্যে অন্তত তিনটা সুটকেস লাগবে, হয়তো চারটা। কিন্তু এটা নিয়ে ওর সাথে তর্ক করার মত কিছু সে খুঁজে পেল না। তার চাইতে সে বরং রাচেলকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়।

“লুইস,” শেষ সুটকেসটা বন্ধ করে রাচেল বলে। সুটকেসটি মৈনাক পর্বতের মত লাগছে। এটার চেন লাগানোর জন্যে লুইস সেটার ওপর উঠে বসে আর রাচেল নানান কায়দা করে চেন লাগায়। “তোমার সত্যি আর কিছু বলার নেই?”

“ওহ খোদা…কী সেটা বউ?”

“আমি জানি না,” সে জবাব দেয়। “আমি তো জানতেই চাচ্ছি।”

“তোমার কী মনে হচ্ছে? আমি মাগীপাড়ায় শুতে যাবো? সার্কাসে যোগ দিব? না কি?”

“জানি না। কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তুমি আমাদের এখান থেকে তাড়াতে চাইছো।”

“রাচেল, ফালতু কথা বলো না!” সে অনেকটা নকল রাগ নিয়ে বলে। তার এই অবস্থাতেও আফসোস হতে থাকে যে সে এতো সহজে ধরা পড়ে যাচ্ছে।

রাচেল তিক্তভাবে হাসে। “লু, তুমি কখনোই ঠিক করে মিথ্যা বলতে পারো না।”

লুইস প্রতিবাদ করতে চাইছিল কিন্তু রাচেল তাকে সেই সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে, “এলি গত রাতে স্বপ্নে দেখেছে তুমি মারা গেছ। গত রাতে ও হঠাৎ কান্না করতে করতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আমি ওর সাথে দু-তিন ঘন্টা ঘুমোনোর পর আবার তোমার কাছে এসে শুয়েছি। স্বপ্নে ও দেখেছে তুমি কিচেনের টেবিলে বসে আছো, তোমার চোখগুলো খোলা কিন্তু ও জানে যে তুমি মরে গেছো। ও না কি স্টিভ মাস্টারটনকেও কাঁদতে শুনেছে।”

লুইস তার দিকে হতাশা ভরা চোখে তাকায়। “রাচেল, ওর ভাই মাত্র মারা গেছে। এখন এটা স্বাভাবিক যে ও স্বপ্নে ওর পরিবারের অন্য কাউকে মৃত-”

“সেটা আমিও জানি। কিন্তু ও যেভাবে বলছিল…সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল স্বপ্নটার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণীর মত কিছু একটা ছিল।” রাচেল শুকনোভাবে হাসে। “তুমি সেখানে থাকলে হয়তো বুঝতে।”

“হয়তো,” লুইস বলে।

স্বপ্নটার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণীর মত কিছু একটা ছিল।

“আমার সাথে শুবে চলো,” রাচেল বলে। “ভ্যালিয়ামের প্রভাব কেটে গেছে আর আমি নতুন করে খেতেও চাই না। কিন্তু আমার ভয় লাগছে। আমি নিজেও স্বপ্ন দেখছি…”

“কিসের স্বপ্ন?”

জেল্ডাকে দেখি,” রাচেল সরলভাবে বলে। “গেজ মারা যাবার পর থেকে যখনি আমি ঘুমোতে যাই, জেল্ডা আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। ও বলে এবার সে আমাকে ঠিকই উচিত শিক্ষা দিবে। বলে যে ও আর গেজ দুজন মিলেই আমাকে উচিত শিক্ষা দিবে। কারণ আমি ওদের মরতে দিয়েছি।”

“রাচেল, এটা—”

“আমি জানি। স্বপ্ন স্বপ্নই। স্বাভাবিক জিনিস। কিন্তু তবুও আমার সাথে বিছানায় এসো আর পারলে স্বপ্নগুলোকে দূরে রাখো।”

তারা অন্ধকারে শুয়ে আছে।

“রাচেল, জেগে আছো?”

“হুম।”

“একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?”

“কর।”

লুইস ইতস্তত করে। সে চায় না রাচেলের কাতরতা আরো বাড়িয়ে দিতে।

“তোমার মনে আছে, গেজের যখন নয় মাস, আমরা ওকে নিয়ে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম?”

“হ্যা, অবশ্যই মনে আছে। কেন?”

গেজের যখন নয় মাস বয়স, লুইস তার ছেলের মাথার আকার দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। বার্টেরিয়ার চার্টের হিসেবে গেজের বয়সের তুলনায় ওর মাথা স্বাভাবিকের চাইতে বড় দেখাচ্ছিল। গেজ অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই তার মাথা উঁচু করতে পারতো, কিন্তু লুইস তারপরও গেজকে জর্জ টার্ডিফের কাছে নিয়ে যায়, যিনি হয়তো সমগ্র দেশের না হলেও শিকাগোর সবচাইতে ভালো নিউরোলজিস্ট। রাচেল জানতে চেয়েছিল গেজের কী সমস্যা আর লুইস ওকে সত্য কথাটাই বলেছিল। ওর ধারণা তাদের ছেলের হয়তো হাইড্রোসেফালিক রোগ হয়েছে, যে রোগে মাথা অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যায়। শুনে রাচেলের মুখ একদম সাদা হয়ে যায়।

“ওকে তো আমার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়.” রাচেল বলে।

লুইস মাথা ঝাঁকায়। “আমার কাছেও, কিন্তু তার পরও আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না।”

“অবশ্যই, আমিও চাই না।”

ডাঃ টার্ডিফ গেজের মাথার মাপ নেন। এরপর তিনি দুটো আঙুল দিয়ে গেজের মুখে গুতো দেন, থ্রি স্টুজেস স্টাইলে। গেজ চমকে ওঠে। টার্ডিফ হাসেন। লুইসের হার্ট কিছুক্ষণের জন্যে গলে তরল হয়ে যায়। ডাক্তার গেজের হাতে একটা বল দেন। গেজ সেটা কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর ফেলে দেয়।

এরপর ডাক্তার সাহেব বলটা নিয়ে বাউন্স করাতে থাকেন, গেজের চোখের দিকে নজর রাখতে রাখতে। গেজের চোখগুলো বলটিকে অনুসরণ করছিল।

“আমার ধারণা ফিফটি-ফিফটি চান্স আছে যে গেজের রোগটা আছে,” তিনি পরে অফিসে বসে লুইসকে বলেন। “না-হয়তো চান্স আরেকটু বেশি। কিন্তু রোগটা যদি থাকেও, যেটা খুব প্রকট না। ওকে চারপাশের ব্যাপারে খুব সচেতন মনে হচ্ছে। আর যদি সমস্যা থাকেও, এখন এর জন্যে ভালো শান্ট অপারেশন আছে।”

“শান্ট অপারেশন…মানে ব্রেইন সার্জারি,” লুইস বলে।

“ছোট ব্রেইন সার্জারি।”

সে গেজের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা শুরু করার পরে ওই অপারেশনটা সম্পর্কে জেনেছে। অপারেশনে মাথা থেকে অতিরিক্ত তরল পদার্থ বের করে আনা হয়। ওই অপারেশনটা তার কাছে একদমই ছোট মনে হয়নি। কিন্তু সে মুখে কিছু বলে না। তাও ভাগ্য ভাল যে অপারেশনটা আছে।

“আর, খুব ভাল সম্ভাবনা আছে যে আপনার ছেলের মাথা এমনিতেই স্বাভাবিকের চাইতে একটু বড়। সিএটি স্ক্যান থেকে শুরু করি আমরা, কি বলেন?”

লুইস রাজি হয়েছিল। গেজ এক রাত হাসপাতালে কাটায়। গেজকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দেয়া হয় এবং নানান কিসিমের যন্ত্র তার মাথায় লাগানো হয়। রাচেল আর লুইস হাসপাতালের নিচ তলাতেই অপেক্ষা করে আর এলি তার নানার বাসায় গিয়ে তাদের কেনা নতুন ভিডিও রেকর্ডারে টানা সিসেমি স্ট্রিট দেখতে থাকে। লুইস বসে বসে হিসেব কষছিল। জেনারেল এনেসথেসিয়ায় মৃত্যুর শতকরা সম্ভাবনা, শান্ট অপারেশানে মৃত্যুর শতকরা সম্ভাবনা, হাইড্রোসেফালাসে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি হওয়ার শতকরা সম্ভাবনা, মৃগী রোগি হওয়া বা অন্ধ হয়ে যাওয়ার শতকরা সম্ভাবনা…ওহ! অসংখ্য রকমের সম্ভাবনা।

টার্ডিফ লম্বা সময় পর ওয়েটিং রুমে আসেন, যেখানে রাচেল আর লুইস বসেছিল। তার সাথে তিনটি সিগার। তিনি লুইসের মুখে একটা গুজে দিলেন, একটা রাচেলের মুখে, আরেকটা নিজের মুখে। রাচেল এতো অবাক হয় যে সে মানা করার সুযোগটিও হারায়।

“গেজ একদম ঠিক আছে।”

“এটা জ্বালিয়ে দিন,” রাচেল হাসি আর কান্না মেশানো কন্ঠে বলে। “আজ বমি করে সব ভাসিয়ে দিলেও আমি এটা টেনেই ছাড়বো।”

মুচকি হাসতে হাসতে ডাক্তার তার সিগারটা জ্বেলে দেন।

খোদা ওকে রুট-১৫ তে মরার জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, লুইস এখন ভাবে।

“রাচেল, যদি গেজের আসলেই হাইড্রোসেফালিক রোগ থাকতো, আর যদি ওকে আমরা সুস্থ করতে না পারতাম…তাহলেও কি তুমি ওকে ভালবাসতে?”

“এই অদ্ভুত প্রশ্ন কেন লুইস!”

“পারতে? ওকে ভালোবাসতে?”

“অবশ্যই। যা কিছুই ঘটতো, আমি ওকে ভালোবাসতাম।”

“যদি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধি হয়ে যেত, তাহলেও?”

“হুম, অবশ্যই।”

“তুমি কি ওকে কোন নার্সিং হোমে রাখতে?”

“না, আমার মনে হয় না,” রাচেল ধীরে ধীরে বলে। “তুমি এখন যেরকম উপার্জন করছো তাতে হয়তো সেটা আমরা করতে পারতাম, কিন্তু আমি ওকে আমার কাছেই রাখতাম যদি সেটা সম্ভব হত। কিন্তু লুইস, এসব আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?”

“আমি তোমার বোন জেল্ডার কথা ভাবছিলাম,” সে বলে। সে নিজের মিথ্যে বলার স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়। “ভাবছিলাম ওই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তুমি আবার যেতে পারতে কি না।”

“দুটো এক না,” রাচেল বলে। “গেজ হচ্ছে…মানে, গেজ হচ্ছে গেজ, আমাদের ছেলে। এটাই যথেষ্ট। হয়তো খুব কঠিন হত, কিন্তু…তুমি নিজে কি ওকে নার্সিং হোমে রাখতে চাইতে? পাইনল্যান্ডের মত একটা জায়গায়?”

“চল ঘুমোই।”

“ভালো আইডিয়া। আমার মনে হচ্ছে আমি এখন ঘুমোতে পারবো,” ও বলে। “আজকের দিনটাকে ভুলতে চাই।”

“আমেন,” লুইস বলে।

বেশ কিছুক্ষণ পর রাচেল ঘুম জড়ানো গলায় বিড়বিড় করে কিছু বলে।

“হুম…হুম…,” লুইস রাচেলের কানের পাতায় চুমু খায়। “এখন ঘুমোও।”

স্বপ্নটার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণীর মত কিছু একটা ছিল।

অনেকটা সময় লুইস নির্ঘুম শুয়ে থাকে। অবশেষে সে যখন ঘুমোয় ততক্ষনে চাঁদের বাকানো শিং জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

অধ্যায় ৪৩

পরদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও প্রচন্ড গরম পড়ে। লুইস যখন রাচেল আর এলির লাগেজগুলো চেক-ইন করে কম্পিউটার থেকে তাদের টিকিট দুটো নেয়, ততক্ষনে ও দরদর করে ঘামছে। তার ব্যস্ত থাকতে ভালই লাগছে। গতবার যখন ওরা থ্যাঙ্কসগিভিংয়ে গিয়েছিল, সেবারের সাথে কিছু কিছু জিনিস মিলিয়ে বুকে একটা চিনচিন ব্যথা অনুভব করে সে।

এলি মনমরা হয়ে আছে আর কিছুটা অদ্ভুত আচরণ করছে। আজকে সকালে এলির মুখ দেখে লুইসের কয়েকবার মনে হয়েছে এলি কিছু সন্দেহ করছে।

চোরের মন পুলিশ পুলিশ, সে নিজেকে বলে।

সকালে যখন এলিকে বলা হলো ও আর ওর আম্মু ওর বাবাকে ফেলে শিকাগো যাচ্ছে, হয়তো পুরো গ্রীষ্মের জন্যে, এলি কিছু না বলেই তার ব্রেকফাস্ট খেতে থাকে (গেজের পছন্দের ব্রেকফাস্ট কোকা বেয়ারস)। ব্রেকফাস্ট সেরে ও নিজের রুমে গিয়ে সেখানে রাচেলের রাখা পোশাক আর জুতো চাপিয়ে নেয়। সে এয়ারপোর্টে তার আর গেজের সেই ছবিটা নিয়ে এসেছে। লুইস যখন টিকেটের জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে, এলি তখন শান্ত মেয়ের মত লবিতে ট্রাভেলারদের জন্যে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ছিল।

মিস্টার এবং মিসেস গোল্ডম্যান ফ্লাইটের চল্লিশ মিনিটের মত আগে এসে উপস্থিত হন। প্রচন্ড গরমের মধ্যেও আরউইন গোল্ডম্যান আঁটসাট কোট-টাই চাপিয়ে এসেছেন। এসেই তিনি মিসেস গোল্ডম্যানকে এলি আর রাচেলের সাথে বসিয়ে তার ভাড়া করা গাড়িটি জমা দিতে গেলেন।

লুইস আর গোল্ডম্যান একই সময়ে বাকিদের সাথে এসে মিলিত হয়। লুইস প্রথমে একটু ভয়ে ভয়ে ছিল, সে ভেবেছিল এখানেও হয়তো তিনি আবার তার নাটক শুরু করবেন। কিন্তু তা থেকে লুইস বেঁচে যায়। তিনি লুইসের সাথে খুব জোরে হ্যান্ডশেক করেন এবং বিড়বিড় করে ‘হ্যালো’ বলেন। তার দিকে তার শ্বশুড়ের এক মুহূর্তের লজ্জা মেশা চাহনি দেখেই লুইস বুঝে নেয় যে তার শ্বশুড় গতদিন ফোনে কথা বলার সময় মাতাল অবস্থায় ছিলেন।

তারা সবাই এস্কেলেটর দিয়ে ওপর তলার বোর্ডিং লাউঞ্জে গিয়ে বসে। ডোরি গোল্ডম্যান তার সাথে করে একটি এরিকা জংয়ের উপন্যাস নিয়ে এসেছেন কিন্তু তিনি সেটা খুলেও দেখছেন না; তিনি তাকিয়ে আছেন এলির হাতে থাকা ছবিটার দিকে।

লুইস তার মেয়েকে জিজ্ঞেস করে ও প্লেনে পড়ার জন্যে বইয়ের দোকান থেকে কোন বই কিনতে চায় কি না।

এলি আবার তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। এই ব্যাপারটা লুইসকে নার্ভাস করে দিচ্ছে।

“তুমি নানা বাড়িতে গিয়ে দুষ্টুমি করবে না তো?” লুইস বইয়ের দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এলিকে জিজ্ঞেস করে।

“না বাবা। বাঙ্ক অফিসার কি আমাকে ধরবে? এন্ডি বলেছে যারা স্কুল ফাঁকি দেয় তাদেরকে বাঙ্ক অফিসার ধরে শাস্তি দেয়ার জন্যে।”

“তোমার বাঙ্ক অফিসারকে নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না। আমি সব ম্যানেজ করে নেব। তুমি আগামী সেমিস্টারে ফিরে এসে আবার ক্লাশ শুরু করতে পারবে।”

“আমার পরের সেমিস্টার যে কেমন হবে…” এলি বলে। “আমি তো কখনো কোন গ্রেডে পড়িনি। শুধু কিন্ডারগার্টেনে পড়েছি। গ্রেডের ছাত্ররা কি করে আমি জানি না। মনে হয় হোমওয়ার্ক করে।”

“ভালোই হবে, মামনি।”

“বাবা, তুমি কি এখনো নানার ওপর রেগে আছ?”

“তুমি এরকম কেন ভাবলে যে আমি তোমার নানাকে পছন্দ করি না?” এলি এমনভাবে তার কাঁধ দুটো উচু করে যেন এই বিষয়টাতে তার তেমন আগ্রহ নেই। “তুমি যখন নানার কথা বলো, তুমি সব সময় রেগে থাকো।”

“ছি! বাজে কথা বলে না।”

“সরি।”

এলি আবারো তার দিকে সেই অদ্ভুত চাহনিটা দিয়ে বাচ্চাদের বুক কর্নারের বইগুলো দেখতে গেল। বাচ্চারা এতো কিছু কিভাবে বোঝে? ও আরো কতকিছু বোঝে কে জানে! এটা কি ওর ওপর কোন খারাপ প্রভাব ফেলছে? ওর নানাকে নাকি আমি পছন্দ করি না! অবশ্যই করি না, হাজারবার করি না।

“বাবা, এই বইগুলো কিনে দেবে?” এলি কয়েকটা বাচ্চাদের বই হাতে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে। বইগুলো দেখে লুইস কয়েক মুহূর্তের জন্যে নস্টালজিক হয়ে পড়ে, সেগুলোর মধ্যে একটা তার ছোটবেলার সবচাইতে প্রিয় গল্পের বই যেটা সে এতোদিন পর দেখলো।

“হ্যা, মামনি, কিনে দিচ্ছি।” বলে ওরা ক্যাশ কাউন্টারের লাইনে দাঁড়ায়।

“আমি আর তোমার নানা একজনকে আরেকজন অপছন্দ করি না,” লুইস বলে। তার মনে পড়ে গেল বাবা-মায়েরা কিভাবে তাদের বাচ্চাদের মিথ্যা বলে, কিভাবে তারা তাদের বাচ্চাদের শেখায় কেউ যদি মন থেকে বাচ্চা চায়, তাহলে সেটা তারা খুঁজে পায়, বা ডাকপিয়ন এসে বাচ্চা দিয়ে যায়। সে ঠিক করেছিল সে কখনো তার বাচ্চাদের সাথে এরকম মিথ্যা বলবে না। কিন্তু সে গত কয়েকদিন যাবত বেশ পাকা মিথ্যুক হয়ে উঠেছে, এখন আর থেমে ফায়দা কি?

“ওহ,” এলি বলেই চুপ হয়ে যায়।

নীরবতাটা লুইসের খুব অস্বস্তিকর লাগতে থাকে। তাই সে বলে “শিকাগোতে খুব মজা করবে, তাই না?”

“মনে হয় না.”

“না কেন?”

ও লুইসের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, “আমার ভয় লাগছে।” লুইস ওর হাত ধরে বলে, “কিসের ভয় মামনি? তুমি কি প্লেনে চড়তে ভয় পাচ্ছ?”

“না,” এলি বলে। “আমি জানি না আমি কিসের ভয় পাচ্ছি। বাবা, আমি স্বপ্ন দেখেছি একটা। আমরা সবাই গেজের ফিউনারেলে আর ফিউনারেলের লোকটা গেজের কফিন খোলে কিন্তু কফিনের ভেতর গেজ নেই। এরপর আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি বাসায়। বাসায় আমি গেজের বিছানায় গিয়ে দেখি বিছানাও খালি, গেজ নেই, কিন্তু সেখানে কাদা লেগে আছে।”

লেজারাস, উঠে এসো।

কয়েক মাসের মধ্যে প্রথমবারের মত লুইসের পাস্কোর মৃত্যুর পরে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে; সেই স্বপ্নটা, যেটা দেখার পর সে পায়ে কাদা মাটি আর পাইনের সুচারু পাতা নিয়ে জেগে উঠেছিল।

লুইসের ঘাড়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়।

“স্বপ্ন কিছু না মামনি,” সে এলিকে বলে এবং অন্তত তার নিজের কাছে তার গলাটা বেশ স্বাভাবিক মনে হয়। “এগুলো এমনিই চলে যাবে।”

“আমি চাইছিলাম তুমি আমাদের সাথে আসো,” এলি বলে। “আর না হলে আমরাও থেকে যাই। আমরা থাকতে পারি, বাবা? আমি নানা-নানীর সাথে যেতে চাই না…আমি শুধু স্কুলে ফিরে যেতে চাই। ঠিক আছে?”

“কয়েকটা দিনের ব্যাপার মাত্র, এলি” সে বলে। “এখানে আমার কিছু”–সে ঢোক গিলে-”কাজ আছে, এরপর আমি তোমাদের কাছে চলে যাব। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিবো কী করা যায়।”

লুইস ভেবেছিল এলি তর্ক শুরু করবে বা ওর দুর্বার ক্রোধের বহিপ্রকাশ ঘটবে। হয়তো লুইস তাতে কিছুটা খুশিও হতো, কারণ এলির এই ব্যাপারটা সে চেনে, কিন্তু এলির সেই অদ্ভুত চাহনিটা সে একদমই চেনে না। কিন্তু এলি কিছুই বলে না, সে তার চেহারাটা গম্ভীর করে রাখে আর ওর নীরবতায় লুইসের ভেতরে তোলপাড় চলতে থাকে। লুইস ওকে আরো কিছু জিনিস জিজ্ঞেস করতে পারতো, কিন্তু তার সেই সাহস হলো না; সে যতটুকু জানতে চায় ইতিমধ্যে তার চাইতে বেশি জেনে গেছে।

এলি আর লুইস বাকিদের কাছে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লাইটের ব্যাপারে ঘোষনা দেয়া হয় এবং ওরা চারজন লাইনে দাঁড়ায়। লুইস তার স্ত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়।

এরপর সে এলিকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খায়। এলি তার দিকে তার ভবিষ্যৎদ্রষ্টা চোখগুলো দিয়ে তাকায়। “আমি যেতে চাই না,” এলি এতো আস্তে আস্তে বলে যে চারদিকের কোলাহলের কারণে লুইস ছাড়া সেটা আর কেউ শুনতে পায় না। “আম্মুও থেকে যাক।”

“এলি, এমন করে না মামনি,” লুইস বলে। “তুমি ভালই থাকবে।”

“আমি ভালই থাকব,” ও বলে। “কিন্তু তুমি কেমন থাকবে? বাবা, তুমি কেমন থাকেবে?”

প্যাসেঞ্জারদের লাইন এগোতে শুরু করেছে। রাচেল এলির হাত ধরে টানলে এলি বাঁধা দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বাবার দিকে তাকিয়। এতে পেছনের লাইন কিছুক্ষণের জন্যে থেমে যায়। গতবার শিকাগো যাওয়ার সময় এলি দ্রুত যাওয়ার জন্যে কেমন ছটফট করছিল তা লুইসের চোখের সামনে ভাসে-চল, চল, চল!

“বাবা?”

“যাও মামনি, প্লিজ।”

রাচেল এলির দিকে তাকালে প্রথমবারের মত তার অদ্ভুত চাহনিটা দেখে কিছুটা চমকে ওঠে। “এলি,” রাচেল হতবাক হয়ে এলির দিকে তাকিয়ে বলে। লুইসের মনে হচ্ছে রাচেল একটু ভয়ও পেয়েছে। “তুমি লাইন আটকে রেখেছো, মামনি।”

এলির ঠোট কেঁপে উঠে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এরপর রাচেল ওকে সামনের দিকে টানলে ও আর বাঁধা দেয় না। এলি লুইসের দিকে ফিরে তাকালে সে তার মেয়ের চোখে মুখে পরিস্কার আতঙ্কের ছাপ দেখতে পায়। সে মুখে নকল হাসি ফুটিয়ে এলির দিকে হাত নাড়ে।

জবাবে এলি তার হাত নাড়ে না।

অধ্যায় ৪৪

লুইস এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার সাথে সাথে একটা শীতল চাদর তার মনকে ঘিরে ধরে। সে বুঝতে পারে সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। তার যে ব্রেনের সাহায্যে সে মেডিকেলে পড়া শেষ করে এসেছে বৃত্তি আর রাচেলের ওয়েট্রেসিংয়ের আয় থেকে, সেই একই ব্রেন পুরো পরিকল্পনাটাকে অনেকগুলো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিয়েছে; তার পরীক্ষার সময় পড়াগুলো যেভাবে ভাগ করে নিত। যেন এটা তার জন্যে আরেকটা পরীক্ষা, কিন্তু সে এই পরীক্ষায় একশো মার্ক পেতে চায়।

সে একটা হার্ডওয়ারের দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করে ভেতরে ঢুকে। “কী সাহায্য করতে পারি?” দোকানের ক্লার্ক জিজ্ঞেস করে।

“আমার একটা ফ্লাশ লাইট লাগবে-আর সেটার মাথার হুড। বা ওরকম কিছু।”

দোকানের ক্লার্ক একজন ছোট খাট মানুষ। সে মুচকি হাসে, কিন্তু হাসিটা মজা পাবার হাসি না। “শিকারে যাচ্ছেন নাকি?”

“মানে?”

“মানে হরিণ শিকারে যাচ্ছেন নাকি?”

“একদমই না। আমার শিকারের লাইসেন্স নেই।”

ক্লার্ক লুইসকে চোখ টিপে দেয় এবং হাসে। “আমার নাক গলানোর কিছু নেই, বুঝতে পেরেছি। হুম, ওইরকম বড় লাইটের হুড পাওয়া যায় না। তবে একটা মোটা কাপড়ের মাঝখানে ফুটো করে ব্যবহার করে দেখতে পারেন। তাতে আলোর রশ্মি কমে একটা পেন লাইটের আলোর মত হবে।”

“হুম, তাতেও চলবে,” লুইস বলে। “ধন্যবাদ।”

“শিওর। আর কিছু?”

“হ্যা,” লুইস বলে। “আমার একটা কুঠার, একটা বেলচা আর একটা কোদাল লাগবে। ছোট-হাতলওয়ালা বেলচা আর বড়-হাতলওয়ালা কোদাল। মোটা দড়ি, আট ফিট লম্বা। এক জোড়া কাজ করার গ্লাভস। আট ফিট বাই আট ফিট ত্রিপল।”

“সবই আছে।”

“একটা সেপটিক ট্যাঙ্ক খুঁড়তে হবে,” লুইস বলে। “দেখা যাচ্ছে আমি আমার এলাকার কিছু নিয়ম ভঙ্গ করছি, আর আমার খুব নাক গলানো কিছু প্রতিবেশি আছে। আমি জানি না আমার লাইটটায় হুড লাগিয়ে কোন লাভ হবে কি না কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে চাই।”

ওহ! তাহলে নাক বন্ধ করে রাখার জন্যে একটা কাপড়ের ক্লিপও কিনে নিন।”

লুইস হাসে, যেন এটা খুব হাসির একটা কৌতুক হয়েছে এবং হাসাটা তার কর্তব্য। তার সব মিলিয়ে বিল আসে প্রায় ঊনষাট ডলার। সেটা সে কার্ডে পরিশোধ না করে নগদে পরিশোধ করে। সে কারো জন্যে কোন সূত্র রাখতে চায় না।

***

লুইস জিনিসপত্রগুলো নিয়ে একটু বিপদে পড়ে যায়। গাড়ির পেছনে করে এসব নিয়ে বাসায় ফিরলে সেটা যে জাডের নজরকে ফাঁকি দিতে পারবে না সেটা লুইস জানে। আর এসব দেখলে জাডের সবকিছু বুঝতে এক সেকেন্ড লাগবে। আজ সে এই ঝুঁকি একদমই নিতে চায় না।

এরপর হঠাৎ তার মনে হলো তার আসলে বাসায় ফেরার কোন প্রয়োজন নেই। সে গেজের কবরস্থানটার সামান্য দূরে হাওয়ার্ড জনসনস মোটর লজ নামের একটা মোটেলে যায়। সে সেখানে চেক ইন করে ডি.ডি. রামোর নামে আর রুমের ভাড়া পরিশোধ করে নগদ টাকায়।

সে একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়, কারণ আগামীকাল সকালে বিশ্রামটা তার কাজে লাগবে। তার সামনে অনেক অনেক উদ্ভট কাজ বাকি।

কিন্তু তার ব্রেন ঘুমুতে রাজি হয় না।

সে অচেনা এক মোটেলের রুমে মাথার নিচে হাত পেতে শুয়ে থাকে। সে তার জামা কাপড় ছাড়েনি, শুধু জুতো খুলেছে আর ওয়ালেট এবং চাবির গোছাটা খাটের পাশের নাইট টেবিলে রেখেছে। তার নিজেকে পরিচিত পৃথিবী থেকে একদম বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে-তার পরিবার, তার অফিস, সবকিছু থেকে। হঠাৎ তার ব্রেনে একটা চিন্তা উঁকি মারে, তার পরিচিত কোন মানুষের সাথে দেখা হবার আগে তার ছেলের সাথে দেখা হচ্ছে।

পরিকল্পনাটা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। সে প্রত্যেক কোণ থেকে চিন্তা করে দেখে সেটার কোন ত্রুটি আছে কি না। চিন্তা করতে করতে সে বুঝতে পারে সে উন্মাদ হওয়ার খুব কাছাকাছি আছে। উন্মাদ হবার জন্যে প্রয়োজনীয় সব উপকরণই তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং নিজেকে ঠিক রাখতে হলে তাকে পা টিপে টিপে এগুতে হবে। কিন্তু সে এটাও বুঝতে পারছে যে সে উন্মাদ হবার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

টম রাসের কন্ঠ তার মাথার ভেতর স্বপ্নের মত ভেসে বেড়াতে থাকে :

‘ও মৃত্যু, তোমার হাত খুব শীতল! আমি তোমার হাত আমার হাঁটুতে টের পাচ্ছি…তুমি আমার মাকে নিয়েছ, আবারো কি ফিরে আসবে না তুমি?’

উন্মত্ততা। চারদিকে উন্মত্ততা। উন্মত্ততা তাকে খেদিয়ে বেড়াচ্ছে।

সে মানসিক সুস্থতা এবং বিকারের মাঝামাঝি সূক্ষ্ম রেখার ওপর হাঁটছে। সে তার পরিকল্পনাটা আরেকটু ঝালিয়ে নেয়।

আজ রাত এগারোটার সময় কবর খুঁড়ে কফিন থেকে সে তার ছেলের লাশ বের করে আনবে। লাশটাকে সে ত্রিপলে পেচিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্কে রাখবে। এর আগে সে কফিনটা আগের জায়গায় রেখে কবরটা আবারো আগের মত করে ভরে ফেলবে। এরপর সে লাডলোতে ফিরে যাবে এবং গেজের লাশ ট্রাঙ্ক থেকে বের করবে…আর এক জায়গায় বেড়াতে যাবে। হ্যাঁ, সে এক জায়গায় বেড়াতে যাবে।

গেজ ফিরে আসলে সেটার ফলাফল দুরকম হতে পারে। হয়তো গেজ ফিরে আসবে গেজ হিসেবেই। হয়তো তার বুদ্ধি-সুদ্ধি অনেকটাই লোপ পাবে বা সে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে ফিরে আসবে। তবে লুইসের মনের এক কোণে এই আশাটাও লুকিয়ে আছে, গেজ একদম ভালো হয়েই ফিরে আসবে। কিন্তু যাই হোক, গেজ তো গেজই, তার ছেলে, রাচেলের ছেলে এবং এলির ভাই।

আর হতে পারে গেজের বদলে অশুভ কিছু বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসবে। লুইস মেনে নিয়েছে যে এমন কিছু ঘটতে পারে। হতে পারে গেজের মৃতদেহে খুব খারাপ কিছু ভর করে ফিরে আসবে। সেক্ষেত্রে গেজের প্রকৃত সত্তাকে চিরতরেই হারাতে হবে।

তবে ফলাফল যাই হোক, সে আর তার ছেলে ছাড়া আর কেউ বাসায় থাকবে না তখন। আর সে…

আমি ওকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব।

হ্যা। সে তাই করবে।

আমি ওকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব, শুধু ওর দেহের না, ওর সত্তারও। অ্যাক্সিডেন্টের ট্রমার জন্যে আমি ওকে কিছু ছাড় দেব, যেটার কথা তার মনে থাকতেও পারে আবার নাও পারে। চার্চের উদাহরণ থেকে আমি অনুমান করছি যে গেজের মানসিক সমস্যা থাকবে, হয় কম বা খুব বেশি। আমি ওর অবস্থা দেখে ভেবে দেখব যে গেজ কি আসলেই আবারো আমাদের পরিবারের অংশ হতে পারবে কি না। এজন্যে আমি চব্বিশ ঘন্টা থেকে বাহাত্তর ঘন্টা পর্যন্ত সময় নেব। এরপর যদি মনে হয় যে ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি, যেমন গেজ ফিরে আসে আরেক টিমি ব্যাটারম্যানের মত অশুভ কিছু হিসেবে আমি ওকে মেরে ফেলব।

একজন ডাক্তার হিসেবে সে অনুভব করে যে, গেজ যদি গেজ না হয়ে অন্য কোনকিছুর জন্যে একটা বাহন মাত্র হয়, তাহলে লুইস জিনিসটাকে সহজেই মেরে ফেলতে পারবে। জিনিসটার কান্না বা আকুতি-মিনতিতে সে সেটাকে মেরে ফেলা থেকে পিছু পা হবে না। একটা প্লেগের জীবাণুবাহী ইঁদুরকে সে যেমন অনায়াসে মেরে ফেলতে পারবে, ওই অশুভ জিনিসটাকেও সে সেভাবেই মেরে ফেলতে পারবে। হয়তো কোন পানীয়ের সাথে পিল মিশিয়ে ওকে খাইয়ে দেবে, বা ইঞ্জেকশনের শট। ওর ব্যাগে যথেষ্ট পরিমাণে মরফিন আছে। আর সেই রাত্রে সে তার ছেলের মৃতদেহ প্লেজেন্টভিউ কবরস্থানে আগের জায়গাতে রেখে আসবে। ধরা না পড়ে কাজটা করার জন্যে তার নিজের ভাগ্যের ওপর দ্বিতীয়বারের মত ভরসা করা ছাড়া ওর কিছুই করার নেই। যদিও সে এখনো জানে না তার ভাগ্য প্রথমবারেও তার প্রতি সুপ্রসন্ন হবে কি না। মিশন বিফলে গেলে পেট সেমিটারিতেই তার ছেলেকে আবার কবর দেয়ার কথা সে প্রথমে ভেবেছিল, কিন্তু তা নাকচ করে দেয়। সে চায় না তার ছেলের অন্তিম ঠিকানা সেখানে হোক। এর অনেকগুলো কারণ আছে। কোন বাচ্চা পাঁচ বা দশ বছর পর তার প্রিয় কুকুরকে সেখানে কবর দিতে গিয়ে হয়তো গেজের হাড়-গোড় খুঁজে পাবে-সেটা একটা কারণ, কিন্তু সবচাইতে বড় কারণ হচ্ছে-পেট সেমিটারি তার বাড়ির খুব কাছে।

আর এরপর সে প্লেন ধরে শিকাগো গিয়ে তার পরিবারের সাথে মিলিত হবে। রাচেল বা এলি কেউ তার এই ছোট্ট এক্সপেরিমেন্টের কথা জানতেও পারবে না।

আর ফলাফল যদি অন্য রকম হয়, যেটা সে তার মন প্রান দিয়ে চায়ঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় পেরিয়ে গেলে বাপ-বেটা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়বে, রাতের আঁধারে। সে কিছু জরুরি কাগজ-পত্র নিজের সাথে নিয়ে নিবে এবং এখান থেকে সে চিরতরেই চলে যাবে। তারা দুজন একটা মোটেলে উঠবে, হতে পারে এখন সে যে মোটেলে আছে সেটাতেই।

পরদিন সকালে সে তাদের সবগুলো ব্যাংক একাউন্টের টাকা নগদে আর ট্রাভেলার্স চেক হিসেবে পরিবর্তন করে নেবে। এরপর তারা একটা প্লেনে চেপে বসবে-খুব সম্ভবত ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে সে রাচেলকে ফোন করে বলবে এলিকে নিয়ে তার কাছে চলে আসতে, ও কোথায় যাচ্ছে সেটা ওর বাবা-মাকে না জানিয়ে। লুইস বিশ্বাস করে সে এই ব্যাপারে রাচেলকে রাজি করাতে পারবে। কোন প্রশ্ন করো না, রাচেল। শুধু একটা প্লেনে চেপে চলে এসো, এক্ষুনি।

সে রাচেলকে তার (তাদের) ঠিকানা দিবে। এলি আর রাচেল একটা গাড়ি ভাড়া করে এয়ারপোর্ট থেকে চলে আসবে সেই ঠিকানায়। তারা দরজায় নক করলে দরজা খোলার জন্যে গেজকে সাথে নিয়ে যাবে। গেজের গায়ে হয়তো তখন থাকবে গোসলের পোশাক।

এবং এরপর-

এর পরের কথা চিন্তা করার মত সাহস তার হলো না; সে বরং পরিকল্পনার শুরুর দিকটা নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করে আবারো। সে ভেবে দেখলো তাদের একদম নতুন করে, নতুন পরিচয়ে জীবন শুরু করতে হবে, যাতে আরউইন গোল্ডম্যান তার পেটমোটা চেকবইয়ের জোরে তাদের খুঁজে বের করতে না পারেন।

তার এবং তার পরিবারের লাডলোর বাড়িতে প্রথম আসার দিনের একটা স্মৃতির কথা লুইসের মনে পড়ে গেল। সে ক্লান্ত, ত্যক্ত আর বিরক্ত হয়ে ভেবেছিল সবকিছু ছেঁড়ে ছুড়ে দিয়ে অরলান্ডোতে পালিয়ে গিয়ে ডিজনি ওয়ার্ল্ডে মেডিকের কাজ জুটিয়ে নিবে। হয়তো সেটা খুব খারাপ একটা আইডিয়া ছিল না।

সে ঘুমিয়ে পড়ে। সে তখনো ঘুমোচ্ছিল যখন তার মেয়ে এলি নায়াগ্রা জলপ্রপাতের আশে পাশে একটা প্লেনে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে; সে ঘুমোচ্ছিল যখন প্লেনের একজন স্টুয়ার্ডেস ছুটে দেখতে আসে কি হয়েছে; সে ঘুমোচ্ছিল যখন রাচেল তার মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করে; সে ঘুমোচ্ছিল যখন এলি বার বার চিৎকার করে বলতে থাকেঃ ‘আম্মু! গেজ! আম্মু গেজ বেঁচে আছে! গেজ আব্বুর ব্যাগ থেকে ছুরি বের করে আমাকে মারতে এসেছে! আমাকে ওর কাছ থেকে বাঁচাও! বাবাকে ওর হাত থেকে বাঁচাও!’

সে তখনো ঘুমোচ্ছে, যখন এলি কিছুটা শান্ত হয়ে মায়ের বুকে মাথা দিয়ে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে, আর ডোরি ভাবছেন রাচেলেরও এরকম হয়েছিল যখন জেল্ডা মারা যায়।

সে যখন ঘুম থেকে ওঠে ঘড়িতে তখন সোয়া পাঁচটা, বাইরে বিকেলের রোদ কমে আসছে।

বর্বর কাজ, ভেবে সে উঠে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *