অধ্যায় ৩৬
মানুষের আতঙ্কের কোন শেষ আছে মনে করাটা ভুল। অন্যদিকে, আঁধার যখন বাড়তে থাকে, এক রকম এক্সপোনেন্সিয়াল ইফেক্ট বা ভ্রম তৈরি হয়-এক আতঙ্ক থেকে আরো আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, এক শয়তান আরো শয়তানের জন্ম দেয় এবং শেষে সবকিছু গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। আর সবচাইতে ভয়াবহ প্ৰশ্ন হচ্ছে নিজের মাথা ঠিক রেখে মানুষের মন এর কতটুকু সহ্য করতে পারে? এবং এক পর্যায়ে এর সবকিছুই হাস্যকর মনে হতে থাকে। এই পর্যায়ে মানুষের মাথা ঠিক থাকে অথবা তার মনের সুপ্ত রসবোধ জেগে ওঠে।
সতেরোই মে-তে তার ছেলের ফিউনারেলে লুইস ক্রিডের মনেও হয়তো এরকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে তখনো যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারছিল বা চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয় না যখন তার শ্বশুড় মাতাল হয়ে তার সাথে মারামারি লাগায়। এবং এর ফলে রাচেলের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণের যে শেষ বিন্দুটা বাকি ছিল, রাচেল সেটাও হারায়। সেদিনের বিশ্রী কান্ডগুলোর উপসংহার হয় পাগলের মত চিৎকার করতে থাকা রাচেলকে সেখান থেকে টেনে বের করে এবং ঘুমের ওষুধ দিয়ে শান্ত করার মাধ্যমে।
রাচেলকে সেদিন হয়তো সেই মুষ্টিযুদ্ধ দেখা লাগতো না যদি সেটা বিকেলের ভিজিটিং আওয়ারে না ঘটে সকালের ভিজিটিং আওয়ারে ঘটতো, কারণ সে সকালে সেখানে উপস্থিত ছিল না। তার সেখানে আসার মত অবস্থা ছিল না। সে সময়টা রাচেল জাড ক্র্যান্ডাল এবং স্টিভ মাস্টারটনের সাথে বাসায় বসে ছিল। লুইস জানে না জাড ক্র্যান্ডাল আর স্টিভ মাস্টারটন পাশে না থাকলে সে কিভাবে বিগত আটচল্লিশ ঘন্টা পার করতো।
লুইসের নিজের কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার মত অবস্থা ছিল না, এমনকি রাচেলের দুর্দশা কমানোর জন্যে তাকে কিছু শট দেয়ার কথাও সে ভাবতে পারছিল না। স্টিভ মাস্টারটন খুব দ্রুত তাদের বাসায় চলে আসায় লুইস এবং তার পরিবারের অনেক উপকার হয়েছে। লুইস খেয়ালও করেনি যে রাচেল সকালের ভিজিটিং আওয়ারে যাওয়ার জন্যে তার ঘরে পড়ার কোট চাপিয়ে বসে আছে এবং কোটের বোতামগুলো ভুলভাবে লাগানো। ওর চুল এলোমেলো হয়ে আছে, শূন্য চোখগুলো যেন কোন জীবন্ত কঙ্কালের খুলির কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। ও খাবার টেবিলে বসে বাটার না দিয়েই শুকনো টোস্ট চিবুচ্ছিল এবং মাঝে মাঝে অস্ফুটে আবোল তাবোল বকছিল। একপর্যায়ে ও হঠাৎ করে বলে ওঠে, “লু, তুমি যে ক্যারাভানটা কিনতে চেয়েছিলে…” লুইস রাচেলকে ক্যারাভান কেনার কথা শেষ বলেছিল ১৯৮১ সালে।
লুইস মাথা নেড়ে নিজের ব্রেকফাস্ট খেতে থাকে। সে এক বাটি কোকা বেয়ার খাচ্ছিল; গেজের প্রিয় নাস্তা। খুব বিস্বাদ লাগলেও সে খাবারটা ইচ্ছে করেই খাচ্ছে। সে তার সবচাইতে ভালো স্যুটটা পড়ে আছে। ফিউনারেলে পড়ার জন্যে তার কোন কালো কোট নেই, তবে এই কোটটা গাড় ছাই রঙের। সে শেভ করেছে, গোসল করেছে, চুল আঁচড়েছে। তাকে ভালো দেখালেও সে গভীর শোকে আচ্ছন্ন।
এলির পরনে ছিল একটা ব্লু জিন্স আর হলুদ জামা। ও ব্রেকফাস্টের টেবিলে গেজের একটা ছবি নিয়ে এসেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে গেজ এবং এলি বরফে স্লেজ নিয়ে খেলছে। গেজ স্লেজে বসে আছে আর এলি ওকে টানছে। এলি ঘাড় ঘুড়িয়ে গেজের দিকে তাকিয়ে আছে আর গেজও ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। ছবিটা রাচেল তুলেছিল একটা এস.এক্স – ৭০ ক্যামেরা দিয়ে, যেটা লুইস এবং বাচ্চারা তাকে তার জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল।
এলি ছবিটা নিয়ে বসে আছে তবে কোন কথা বলছে না।
লুইসের পাশে তার স্ত্রী এবং মেয়ে কে কী করছে তার দিকে কোন খেয়াল তার নেই। সে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে এবং তার মনে অ্যাক্সিডেন্টের দৃশ্যটা বারবার চলচ্চিত্রের মত চলছে। কিন্তু সেই মনের চলচ্চিত্রের শেষটা বাস্তবের চাইতে ভিন্ন। সেই চলচ্চিত্রে লুইস আরো অনেক দ্রুত গেজকে বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া গেজ শুধু কথা না শোনার জন্যে অনেকগুলো বকা খায়।
স্টিভই রাচেল এবং এলির অবস্থাটা বুঝতে পারে। সে রাচেলকে এই অবস্থায় সকালের ভিজিটিং-এ যেতে নিষেধ করে। এমনিতেও সেখানে গেজকে দেখা যাবে না, কারণ কফিনের ডালা বন্ধ থাকবে। যদি ডালা খোলা থাকতো তাহলে হয়তো সকলে চিৎকার করতে করতে সেখান থেকে ছুটে পালাবে- হয়তো সে নিজেও। স্টিভ এলিকেও যেতে নিষেধ করলে রাচেল তার বিরোধীতা করে; এলি শুধু তার আর গেজের ছবিটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে ছিল।
স্টিভই রাচেলকে তার দরকারি ওষুধ দেয় এবং এলিকে এক চামচ রঙহীন তরল খেতে দেয়। এলিকে যেকোন ঔষধ খাওয়াতে গেলে সে সাধারণত বেশ ঝামেলা করে, খেতে চায় না, খেলেও চোখ মুখ কুঁচকে বমি করার মত অবস্থা করে; কিন্তু আজ সে কোন ঝামেলা ছাড়াই তা খেয়ে নেয়, চোখ মুখ কোঁচকানো ছাড়াই। সকাল দশটার মধ্যেই সে নিজের বিছানায় ঘুমে কাঁদা হয়ে যায়, তখনো তার হাতে গেজের ছবিটা আঁকড়ে ধরা। রাচেল টেলিভিশনের সামনে বসে ‘হুইল অফ ফরচুন’ দেখছে। সে স্টিভের প্রশ্নের জবাব ধীরে ধীরে দিচ্ছে। ও অনেকটা নেশাগ্রস্তের মত হয়ে গেছে তবে তার চেহারার সেই উন্মাদনার ছায়া, যেটা দেখে স্টিভ ভয় পেয়ে গিয়েছিল, সেটা আর নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না জাডই ফিউনারেলের ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো দেখছেন। তিনি তিন মাস আগে নিজের স্ত্রীর ফিউনারেলের সময় যেভাবে ঠান্ডা মাথায় সবকিছুর ব্যবস্থা করেছিলেন ঠিক সেভাবেই আবারো সব ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু লুইস যখন ফিউনারেল হোমের জন্যে রওনা হচ্ছিল তখন স্টিভ মাস্টারটনই তাকে পাশে ডেকে নেয়।
“আমি ব্যাপারটা দেখবো যাতে রাচেল বিকেলের ভিজিটিং আওয়ারে সেখানে উপস্থিত থাকতে পারে; যদি ওর সেরকম অবস্থা থাকে,” সে লুইসকে বলে।
“ওকে।”
“ততক্ষণে ওষুধের প্রভাব কমে যাবে। আর মিস্টার ক্র্যান্ডাল বলেছেন বিকেলের ভিজিটিং আওয়ারে তিনি বাসায় এলির সাথে থাকবেন—”
“হুম।”
“-আর মনোপলি বা ওইরকম কিছু খেলবেন ওর সাথে-”
“আচ্ছা।”
“কিন্তু”
“ওকে।”
স্টিভ থেমে গেল। তারা গ্যারেজে দাঁড়িয়ে আছে, চার্চের আস্তানা, যেখানে চার্চ মরা পাখি আর ইঁদুর নিয়ে আসতো। যেগুলোর জন্যে দায়ি লুইস নিজে। বাইরে মে মাসের রোদ, তার মধ্যে ড্রাইভওয়েতে একটা রবিন পাখি খুব ব্যস্তভাবে ছোটাছুটি করছে যেন ওর খুব জরুরি কাজ আছে কোথাও। কে জানে? হয়তো আছে।
“লুইস?” স্টিভ বলে। “নিজেকে সামলাও।”
লুইস জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্টিভের দিকে তাকায়। স্টিভ যা বলেছে তার বেশিরভাগই সে শুনেও শোনেনি। সে ভাবছিল, আরেকটু দ্রুত দৌড়ালেই সে হয়তো গেজকে বাঁচাতে পারতো।
“আমার মনে হয় না তুমি খেয়াল করেছো,” স্টিভ বলে, “কিন্তু এলি কথা বলছে না। আর রাচেল এতোটা শক খেয়েছে যে ওর সময়ের হিসেবও হযবরল হয়ে গেছে।”
“হ্যা!” লুইস বলে। সে জোর দিয়ে বলে, কিন্তু কেন বলে সে নিজেও জানে না।
স্টিভ লুইসের কাঁধে হাত রাখে। “লু,” সে বলে, “ওদের এখন তোমাকে সব চাইতে বেশি প্রয়োজন। বন্ধু, আমি তোমার স্ত্রীকে ওষুধ দিতে পারি, কিন্তু দেখো…লুইস, প্লিজ…ওহ খোদা, কী যে একটা বিশ্রী অবস্থা তৈরি হয়েছে!”
লুইস অবাক হয়ে দেখলো স্টিভ কাঁদতে শুরু করেছে। “শিওর,” লুইস বলে। কিন্তু তার মনে সে তখনো দেখছে যে গেজ লন থেকে ছুটে রাস্তাটার দিকে যাচ্ছে। তারা চিৎকার করে ওকে থামতে বলছে, কিন্তু ও থামছে না-ইদানিং সে একটা খেলা শিখেছে, বাবা-মার কাছ থেকে ছুটে পালানো—ওরাও ওর পেছন পেছন ছুটছে। লুইস দ্রুতই রাচেলকে পিছে ফেলে দেয় কিন্তু ততক্ষণে গেজ অনেক এগিয়ে গেছে। গেজ হাসছে, সে তার বাবার কাছ থেকে ছুটে পালাচ্ছে-এটাই তার খেলা আর লুইস তার আর গেজের মাঝের ব্যবধান কমিয়ে আনছে, কিন্তু খুব ধীরে। গেজ লনের হালকা ঢালু পথ বেয়ে দৌড়ে নামছে, রুট ১৫র দিকে, আর লুইস মনে প্রানে প্রার্থনা করছে যাতে গেজ পা হড়কে পড়ে যায় বাচ্চারা যখন খুব জোড়ে দৌড়ায় ওরা প্রায় সব সময়ই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, কারণ পায়ের ওপর তাদের পাকাপোক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। লুইস ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যাতে গেজ পড়ে যায়, ও ব্যথা পেলে পাক, পা ভাঙলে ভাঙুক, মাথা ফাটলে ফাটুক, তারপরও যেন ও পড়ে যায়, কারণ সে একটা দশ চাকার মস্ত ট্রাকের ছুটে আসার গমগম শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ও তখন চিৎকার করে গেজের নাম ধরে ডাকে আর তার বিশ্বাস ও ওর নাম শুনে থামতে চেষ্টাও করেছিল। গেজ সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল যে তার খেলা শেষ, কারণ এটা যদি খেলাই হতো তাহলে তার বাবা-মা তার নাম ধরে চিৎকার করতো না। ও থামতে চেষ্টা করে আর ততক্ষণে ট্রাকের গমগমে শব্দটা গর্জনে রুপ নিয়েছে। এবার লুইস প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে এগুতে থাকে এবং তার বিশ্বাস তার আঙুলের মাথাটা গেজের জ্যাকেটে ঘষাও খেয়েছিল, কিন্তু গেজের গতি তাকে ঠেলে রাস্তার ওপর নিয়ে যায়। আর ট্রাকটা বজ্রপাতের ন্যায় ধেয়ে আসে, ট্রাকের চকচকে বডিতে রোদ ঝকমক করছে, ড্রাইভার সেটার ব্রেক চেপে ধরেছে আর বিকট শব্দে হর্ন দিচ্ছে…আর সেটা ছিল গত শনিবার, তিন দিন আগে।
“আমি ঠিক আছি,” সে স্টিভকে বলে। “আমার এখন যাওয়া উচিত।”
“তুমি প্লিজ নিজেকে সামলাও, ওদের সাহায্য করো,” স্টিভ জ্যাকেটের হাতায় চোখ মুছে বলে। “এতে তোমার নিজের সাহায্যও হবে। তোমাদের তিনজনের একসাথে এই সময়টার মোকাবেলা করতে হবে লুইস। এছাড়া আর দ্বিতীয় কোন উপায় নেই।”
“ঠিক,” লুইস সম্মতি জানায়। তার মনে সেদিনের ঘটনা আবারো ঘুরপাক খেতে থাকে, শুধু এবারে সে লাফিয়ে দুই ফিট এগিয়ে গিয়ে গেজকে ধরতে পেরেছে এবং বর্তমানে যা হচ্ছে তার কিছুই ঘটেনি।
একই সময়ে পূর্বদিকের রুমটাতে এলি জাড ক্র্যান্ডালের সাথে মনোপলি খেলছে, কোনরকম মনোযোগ ছাড়াই-সে লক্ষ্যহীনভাবে তার মনোপলি মার্কার নাড়ছে। এক হাতে মনোপলির ডাইস ঝাঁকাচ্ছে আর আরেক হাতে তার আর গেজের সেই ছবিটা ধরে আছে সে।
স্টিভ মাস্টারটন সিদ্ধান্ত দেয় দুপুরে রাচেল গেজের ফিউনারেলের ভিজিটিং আওয়ারে যেতে পারবে; যে সিদ্ধান্তের জন্যে তার পরবর্তীতে অনুশোচনা হয়।
রাচেলের বাবা-মা সকালেই ব্যাঙ্গরে বিমানে করে চলে এসেছেন। তারা উঠেছেন হলিডে ইন হোটেলে। মিস্টার গোল্ডউইন দুপুর নাগাদ চারবার ফোন করেছেন তার মেয়ের সাথে কথা বলার জন্যে। স্টিভ তাকে কঠিন থেকে কঠিনতরভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে। চতুর্থবারে সে বৃদ্ধকে একরকম ধমক দিয়েই বলে তাকে তার মেয়ের সাথে কথা বলতে দেয়া হবে না। মিস্টার গোল্ডম্যান বলেন নরকের সব কুকুর মিলেও তাকে তার মেয়ের সাথে কথা বলা থেকে আটকে রাখতে পারবে না। স্টিভ বলে রাচেলের কিছু একা সময় প্রয়োজন, তার ছেলের ফিউনারেলে যোগ দেয়ার আগে। আর সে নরকের সকল কুকুরের কথা জানে না কিন্তু সে স্টিভ নামের এক আইরিশ আমেরিকান ডক্টর অ্যাসিস্ট্যান্টের কথা জানে যে রাচেলের সাথে কাউকে কথা বলতে দেবে না; যতক্ষণ না সে নিজের ইচ্ছেয় সবার সাথে দেখা করে। এরপর আত্মীয়- স্বজনরা যা ভালো বুঝবে তাই করবে, কিন্তু তার আগে না।
বৃদ্ধ তাকে গালাগাল দিয়ে ঠাস করে ফোন রেখে দেয়। স্টিভ ভেবেছিল গোল্ডম্যানরা হয়তো দুপুরের ভিজিটিং আওয়ারে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিবে, কিন্তু দেখা গেল তারা আসলে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল। দুপুরের আগে রাচেলকে দেখে মনে হলো ওর বেশ উন্নতি হয়েছে। অন্তত সে বুঝতে পারছিল সে কোন টাইমফ্রেমে আছে। ও কিচেনে গিয়ে দেখলো যে স্যান্ডউইচ বানানোর কিছু আছে কি না, কারণ অনুষ্ঠানের পর কেউ কেউ হয়তো বাসায় আসবে, তাই না? সে স্টিভকে জিজ্ঞেস করে।
স্টিভ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
ফ্রিজে বাটারবল টার্কি ছাড়া কিছু ছিল না, রাচেল সেটাই ওভেনে চড়িয়ে দেয়। স্টিভ কয়েক মিনিট পর কিচেনে গিয়ে দেখে রাচেল ওভেনের টার্কির দিকে তাকিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
“রাচেল?”
ও স্টিভের দিকে তাকায়। “গেজ টার্কির সাদা মাংস খুব পছন্দ করতো। আমার মাত্র মনে হলো যে ও আর কখনো টার্কির মাংস খাবে না।”
স্টিভ রাচেলকে ওপরতলায় পাঠায় ড্রেস-আপের জন্যে; যেটা ওর মানসিক অবস্থা বোঝার জন্যে একটা টেস্টও বটে। কিন্তু ও যখন একটা কালো জামা গায়ে দিয়ে আর একটা কালো পার্স হাতে নিয়ে নেমে এলো তখন স্টিভের মনে হলো রাচেল আসলেই ফিউনারেলের অনুষ্ঠানে যেতে পারবে এবং জাডও তার সাথে সম্মতি জানায়।
স্টিভ রাচেলকে ড্রাইভ করে শহরে ফিউনারেল অনুষ্ঠানে নিয়ে আসে। সে সুরেন্দ্র হারদুর সাথে লবিতে দাঁড়িয়ে রাচেলকে তার ছেলের ফুলে ঢাকা কফিনের দিকে প্রেতাত্মার মত এগিয়ে যেতে দেখে।
“কি অবস্থা, স্টিভ?” সুরেন্দ্র নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে।
“বালের অবস্থা,” স্টিভ নিচু গলায় কর্কশভাবে বলে। “তুমি কী রকম হবে ভেবেছিলে?”
“বালের অবস্থাই ভেবেছিলাম।”
ঝামেলা শুরু হয় যখন গোল্ডম্যান তার মেয়ে জামাইয়ের সাথে হ্যান্ডশেক করতে অস্বীকার করলেন।
বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনদের দেখে লুইস তার শোকের জাল থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছিল। ও খেয়াল করতে শুরু করেছে ওর চারদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে। সে এখন একটা ভোতা শোকের মধ্যে আছে যেটা ফিউনারেল হোমের পরিচালকদের চেনা এবং কাস্টমারের এই অবস্থাটা তারা নিজেদের লাভের জন্যে যতটুকু পারেন ব্যাবহার করে নেন। লুইস দাবার ঘোড়ার মতো
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে।
পূর্বের রুমের বাইরে একটা ছোট হলঘর আছে যেখানে লোকজন ইজি চেয়ারে বসে সিগারেট ফুকতে পারে। চেয়ারগুলোর দুর্দশা দেখলে মনে হয় সেগুলো কোন দেউলিয়া হয়ে সব বিক্রি করা মেন্স ক্লাব থেকে কেনা। ভিউইং রুমের দিকের দরজার পাশে একটা ফলক ঝোলানো যেটাতে লেখা : গাজে উইলিয়াম ক্রিড। পুরো ভবনটা বেশ বড়। এই দালানের অপর দিকেই আরেকটা হলঘর আছে যেটার দরজার পাশের ফলকে লেখা : আলবের্তা বুরনাম নিডি। ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে কফিনের শো রুম, সেখানে থরে থরে নানান ডিজাইন এবং দামের কফিন সাজিয়ে রাখা।
গেজ মারা যাওয়ার পরদিন লুইস জাডের সাথে এখানে এসেছিল। তারা গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামলে লুইস কফিনের শোরুমে না গিয়ে একটা হলওয়ে ধরে সোজা হেটে একটা সাদা দরজার সামনে চলে আসে। জাড আর ফিউনারেল ডিরেক্টর উভয়েই দ্রুত বলে উঠে,” ওদিকে না,” এবং লুইস তাদের কথা শুনে ফিরে আসে। লুইস জানতো ওই সাদা দরজার ওপাশে কি আছে, তার আঙ্কেল একজন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যবস্থাপনার ঠিকাদার ছিলেন।
গেজের কফিনটা লুইসই পছন্দ করেছে; আমেরিকান ক্যাসকেট কোম্পানির রোজউডের একটা ডিজাইন, যেটার নাম ‘চির বিশ্রাম’। কফিনের গায়ে গোলাপী রঙের সিল্কের লাইন আছে। ফিউনারেল পরিচালক পাকা ব্যবসায়ির মত বলেন, লুইস দারুণ একটা কফিন পছন্দ করেছে তবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন যে গোলাপীর বদলে নীল লাইনের ডিজাইন তার কাছে নেই। এরপর তিনি লুইসকে জিজ্ঞেস করেন সে ফিউনারেলের খরচ কিভাবে পরিশোধ করতে চায় সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না। যদি না নিয়ে থাকে তাহলে তারা তার অফিসে বসে তাদের অফার করা তিনটি জনপ্রিয় প্ল্যান নিয়ে কথা বলতে পারেন।
লুইসের মনে একটা কন্ঠ বলে উঠে : আমি গেজের কফিন সাশ্রয়ী অফারে কিনতে পেরেছি, হুররে!
মোহাচ্ছন্নের মত বলেছিল সে, “সব খরচ আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পে করবো।”
“আচ্ছা।” পরিচালক বলেন।
কফিনটা লম্বায় চার ফুটের বেশি হবে না; বামন সাইজের কফিন। কিন্তু এর দাম ধরা হয়েছে ছয়শ ডলারেরও বেশি। কফিনটা এখন একটা কাঠের ফ্রেমের ওপর রাখা, তবে সেটার ওপর এতো ফুল দেয়া হয়েছে যে ফুল ছাড়া তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লুইসের কফিনটার কাছে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, ফুলের গন্ধে ওর বমি আসছে।
এখান থেকে হলঘরে যাওয়ার করিডোরের মুখে একটা স্ট্যান্ডে একটা চামড়ায় বাধানো খাতা রাখা আছে; আর স্ট্যান্ডের সাথে চেন দিয়ে একটা কলমও বেঁধে রাখা আছে। ফিউনারেল ডিরেক্টর লুইসকে এই জায়গায় অবস্থান করতে বলেছেন যাতে সে তার আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুদের ‘স্বাগতম’ জানাতে পারে।
তার বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়েরা সেই খাতায় তাদের ঠিকানা সহ নাম লিখে রাখবে। এই প্রথার ফায়দাটা কী লুইসের সেটা কখনোই মাথায় ঢোকেনি; এখন এটা নিয়ে সে কোন প্রশ্নও করলো না। তার ধারণা ফিউনারেল শেষ হয়ে গেলে ফিউনারেল হোমের পক্ষ থেকে খাতাটা তাদের দিয়ে দেয়া হবে। এটা তার কাছে পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। বাসার কোন ভুলে যাওয়া স্থানে তার স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন, কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন, মেডিকেল কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন পড়ে আছে; এমনকি তাদের বিয়েরও একটা বই আছে, যেটার চামড়ার মলাটের ওপর আমার বিয়ের দিন স্ট্যাম্প করে লেখা আছে। বইয়ের শুরুর ছবিটায় রাচেল তার বিয়ের পোশাক গায়ে দিচ্ছে এবং তার মা তাকে সাহায্য করছে, আর শেষের ছবিটা তাদের হানিমুনের সময় থাকা হোটেলের দরজার। বন্ধ দরজাটার সামনে দেখা যাচ্ছে তাদের দুই পাটি জুতো। এলির একটা বেবি এ্যালবামও আছে তাদের। সেখানে একটা পাতায় লেখা ‘আমার প্রথম হেয়ার কাট’ আর সাথে স্কচটেপ দিয়ে এটে দেয়া কিছু চুল; আরেক পৃষ্ঠায় লেখা ‘উপস!’ আর সাথে একটা ছবি, যেটাতে দেখা যাচ্ছে এলি আছাড় খেয়ে তার পাছার ওপর পড়ে যাচ্ছে-সবটাই ভীষন কিউট।
আর এখন তাদের কালেকশনে সেসব বইয়ের সাথে আরেকটি বই যোগ হতে যাচ্ছে। এটাকে কী বলে যেনো?
লুইস স্ট্যান্ডের পাশে অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে পার্টি শুরু হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কী বলে এটাকে? আমার মৃত্যু ম্যাগাজিন? ফিউনারেল অটোগ্রাফস? গেজকে মাটিতে পোঁতা দিবস?
সে খাতাটা বন্ধ করে দেখলো তাদের বিয়ের এলবামের মত এটির মলাটও চামড়ায় বাধানো কিন্তু তফাতটা হচ্ছে এর গায়ে কিছুই লেখা নেই।
ক্রিডদের বাড়ির পরিচারিকা মিসি ডেন্ডিজ সকালে সবার আগে চলে এসেছিলেন। নরম মনের মিসি ডেন্ডিজ বহুবার তাদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করেছেন রাচেলের অনুরোধে। লুইসের মনে পড়ে যায় যেদিন ভিক্টর পাস্কো মারা গিয়েছিল সেদিনও মিসি গেজ আর এলিকে দেখাশোনা করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর এই ফুরসতে সেদিন রাচেল তার সাথে দুবার…একবার বাথটাবে আরেকবার বেডরুমে।
মিসি কাঁদছিল, অঝোরে। আর লুইসের নির্লিপ্ত শান্ত চেহারা দেখে তার কান্নার পরিমাণ আরো বেড়ে গেল। তিনি লুইসকে জড়িয়ে ধরার জন্যে প্রায় হাতড়াতে লাগলেন। লুইসও তাকে জড়িয়ে ধরে। লুইস ভাবে, এরকমই হওয়ার কথা ছিল; যে একজনের মানবিক বোধ আরেকজনকে স্পর্শ করবে, তার তীব্র শোককে হালকা করবে…
“আমি খুবই সরি,” মিসি বলেন। “এতো মিষ্টি একটা মাসুম বাচ্চা…আমি যে ওকে কতো ভালোবাসতাম, লুইস। আমি খুব দুঃখিত। ওই রোডটা খুনি। আর আমি আশা করি ওই ট্রাকের ড্রাইভারকে ওরা সারা জীবন জেলে পচিয়ে মারবে। এতো জোরে কেউ ট্রাক চালায়? অতো মিষ্টি ছেলেটা, এতো চালাক…খোদাই জানেন কেন তিনি ওকেই নিয়ে গেলেন; আমরা সেটা কোনদিনই বুঝবো না। আমি খুব দুঃখিত।”
লুইস তাকে জরিয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো। সে টের পেলো মিসির চোখের জলে তার শার্টের কলার ভিজে গেছে। তিনি রাচেলের খোঁজ করলে লুইস বলল রাচেল বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছে। তিনি প্রমিজ করলেন যে তিনি বাসায় গিয়ে রাচেলকে দেখে আসবেন। মিসি আরো বললেন তিনি যেকোন সময় এলিকে দেখার জন্যে রাজি আছেন, যতবার তাদের প্রয়োজন হয়। লুইস তাকে ধন্যবাদ জানালো।
তিনি চলে যাচ্ছিলেন; তার চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। তিনি কফিনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন যখন লুইস তাকে পেছন থেকে ডাকলো। ফিউনারেল পরিচালক, যার নামটাও লুইসের মনে পড়ছে না; সে বলেছে সবাইকে দিয়ে ওই খাতাটা সাইন করাতে এবং লুইস সেটা করেই ছাড়বে।
অতিথি, প্লিজ সাইন করুন, সে ভাবে আর এ চিন্তা করে সে প্রায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল।
মিসির দুঃখ ভরা চোখগুলো তার সেই হাসির বেগ দূর করে দেয়।
“মিসি, আপনি এই খাতায় একটা সাইন করবেন?” সে জিজ্ঞেস করে এবং তার মনে হলো আরেকটা কথা যোগ করা প্রয়োজন; “রাচেলের জন্যে।”
“অবশ্যই,” তিনি বলেন। হঠাৎ করেই লুইসের মনে হলো সে জানে মিসি এক্ষুনি কী বলতে যাচ্ছেন এবং কোন এক কারণে সে সেই কথাটার প্রতি তীব্র ঘৃণা বোধ করতে থাকে। কিন্তু তবুও কথাটা তাকে শুনতেই হবে, কোন মুক্তি নেই। শুধু একবার নয়, আজকের দিনে হয়তো শত শত বার এই কথায় তার হৃদয় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবে, কিন্তু সামাজিকতা রক্ষার খাতিরে এটা তাকে হজম করতে হবে।
“খোদাকে ধন্যবাদ যে ও বেশি কষ্ট পায়নি, লুইস। অন্তত পক্ষে যা ঘটার চোখের পলকেই ঘটে গেছে।”
হুম, একদম চোখের পলকেই, সে মিসিকে বলবে বলে ভাবে- আহ, শুনলে মিসির চেহারাটা আবার কুঁকড়ে যাবে, সে কথাটা মিসিকে শুনিয়ে দেবার জন্যে লুইসের মুখ নিশপিশ করছে। এক নিমিষেই, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর এজন্যেই কফিনের মুখ খোলা হচ্ছে না ফিউনারেলে, কারণ ওকে দেখলে আপনার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। অন্য লাশদের যেমন মেকাপ পাউডার দিয়ে পুতুল সাজিয়ে কফিনে শুইয়ে রাখা হয়, সেরকমটা গেজের ক্ষেত্রে সম্ভব না; কারণ দুনিয়ার সব মেকাপ ব্যবহার করেও ওকে এমনভাবে মানুষের সামনে দেখানো যাবে না যাতে তাদের রাতে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন না হয়। একদম বিদ্যুৎ বেগে সব ঘটে গেছে মিসি ডিয়ার। এই মুহূর্তে ও রাস্তার ওপর ছিল আর পরের মুহূর্তেই ও পড়ে ছিল রিঙ্গারদের বাড়ির সামনের রাস্তায়। ট্রাকটা ওকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলে; মেরে ফেলার পর ওকে টেনে হিচড়ে প্রায় একশো গজ দূরে নিয়ে যায়; পুরো একটা ফুটবল মাঠের থেকেও বেশি দূরত্বে। মিসি, আমি ওর পেছনে পেছনে পাগলের মত দৌড়াচ্ছিলাম, ওর নাম ধরে চিৎকার করতে করতে। আর আমি মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যাতে ও বেঁচে থাকে। আমি দশ গজ দৌড়ানোর পর ওর বেসবলের ক্যাপ রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখলাম, বিশ গজ পর পেলাম ওর স্টার ওয়ার্স স্নিকার্স। যখন চল্লিশ গজ দৌড়ালাম, ততক্ষনে ট্রাকটা রাস্তার ওপর থেকে ছিটকে পড়ে রিঙ্গারদের বার্নের পেছনের মাঠের ওপর ছুরির ফলার মত ঢুকে গিয়েছে। লোকজন তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঁকি ঝুকি দিচ্ছে আর আমি পাগলের মত ওর নাম ধরে চিৎকার করতে করতে ছুটছিলাম। পঞ্চাশ গজ পৌঁছানোর পর রাস্তার ওপর গেজের গায়ের জাম্পারটা পেলাম, উল্টানো অবস্থায় আর সত্তর গজ পর পেলাম গেজের আরেক পাটি জুতো আর এর পর পেলাম গেজকে।
হঠাৎ করেই লুইসের পৃথিবী ধূসর হয়ে আসে। তার চোখের সামনে থেকে সব কিছু হারিয়ে যায়। সে তার হাতের তালুতে খাতা রাখা স্ট্যান্ডটা অনুভব করতে পারছিল হালকা হালকা, ব্যস এটুকুই।
“লুইস?” মিসির কন্ঠ। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা রহস্যজনক কন্ঠটা তার কানে বাজতে থাকে।
“লুইস?” এবার কাছ থেকে। একটু আতঙ্ক মিশ্রিত কণ্ঠে।
লুইসের পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে তার চোখের সামনে এসে পড়ে।
“তুমি ঠিক আছো?”
লুইস মৃদু হাসে। “আছি,” সে বলে। “আমি ঠিক আছি।”
মিসি তার নিজের এবং তার স্বামীর হয়ে সাইন করলেন-মিস্টার এন্ড মিসেস ডেভিড ডেন্ড্রিজ-সাথে তিনি তাদের ঠিকানাও লিখলেন-রুরাল বক্স ৬৭, ওল্ড বাকস্পোর্ট রোড-তিনি লুইসের দিকে তাকিয়ে চট করে চোখ নামিয়ে নিলেন, যেন যেই রোডে গেজ মারা গিয়েছে সেই রোডে তার ঠিকানা হওয়াটা একটা অপরাধ।
“ভালো থেকো, লুইস,” তিনি ফিসফিস করে বলেন।
মিসির হাজবেন্ড লুইসের সাথে হ্যান্ডশেক করে বিড়বিড় করে কিছু বলে, আর তার গলার পুরুষালী কণ্ঠমণি ওঠানামা করে কিন্তু লুইস কিছুই শুনতে পায় না। তারপর সে তার স্ত্রীর পিছে পিছে কফিনটার দিকে এগিয়ে যায়, যেটা তৈরি করা হয়েছে ওহাইওতে, যেখানে গেজ কখনো যায়নি, না সেখানে তাকে কেউ চেনে।
***
ডেন্ডিজদের পর বাকিরা আসতে শুরু করে। লুইস তাদেরকে রিসিভ করলো আর তারা লুইসকে আলিঙ্গন করলো,তার সাথে হ্যান্ডশেক করলো, তার কাছে চোখের জল ফেলল। তার শার্টের কলার এবং তার ধূসর কোটের হাতার ওপরের অংশ কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ ভিজে গেল। ফুলের গন্ধ ধীরে ধীরে এদিকেও আসতে শুরু করে এবং চারদিকে ফিউনারেলের গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। এই ঘ্রাণের সাথে সে একদম ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। গেজের কষ্ট না পেয়ে দ্রুত মৃত্যু কথাটা সে শুনলো বত্রিশ বার, তার নিজের হিসেবে। খোদা তার বিস্ময়গুলো রহস্যজনকভাবে ঘটান, এটা সে শুনলো পচিশ বার। ও এখন বেহেশতে ফেরেশতাদের সাথে খেলছে, এটা সে শুনলো সর্বমোট বারো বার।
লুইসের অসহ্য লাগছে। এই কথাগুলোর যা কিছু আবেদন ছিল, বার বার শোনার কারণে তাও আর অবশিষ্ট নেই। কথাগুলো ওকে যতবার বলা হচ্ছে সেগুলো শেল হয়ে তার হৃদয়ের তত গভীরে গিয়ে আঘাত করছে। যতক্ষণে তার শ্বশুরড়-শ্বাশুড়ি এসে উপস্থিত হন ততক্ষনে অনেকটা মারমুখি মেজাজে ছিল।
লুইসের মাথায় প্রথম ভাবনা যেটা এলো সেটা হচ্ছে-রাচেল যা বলেছিল সেটাই ঠিক। তার শ্বশুড় আসলেই অনেক বুড়িয়ে গেছে। তার বয়স কত? আটান্ন, ঊনষাট? কিন্তু আজ তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স অন্তত সত্তর। তাকে হাস্যকরভাবে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের মত লাগছে, মাথায় মস্ত টাক আর চোখে বেমানান চশমা। রাচেল থ্যাঙ্কস গিভিং ট্রিপ থেকে ফিরে বলেছিল তার বাবা বুড়িয়ে গিয়েছেন, কিন্তু এতোটা লুইস ভাবেনি। ঠিকই আছে, সে ভাবে, হয়তো তিনি তখন এতো বুড়িয়ে যাননি এখন যেমনটা লাগছে। কারণ তখনো তার দুটো নাতি-নাতনিই বেঁচে ছিল।
লুইসের শ্বাশুড়ি ডোরি হেঁটে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার মুখ কালো জাল জাল কাপড়ের আচ্ছাদনে ঢাকা। তার চুলে নীল রঙের শেড, যেটা এই সময়কার ধনী বয়ষ্ক মহিলারা বেশ পছন্দ করে। লুইস কালো জালের নিচে ওনার চোখের চিকচিক করতে থাকা পানি দেখতে পাচ্ছে।
হঠাৎ তার মনে হলো সে আগের ঝামেলা সব ভুলে যাবে। হঠাৎ করেই যেন তাদের মধ্যের আগের সেই বোঝার ভার লুইসের কাছে অসহ্য মনে হতে থাকে।
“আরউইন, ডোরি,” সে মৃদু স্বরে বলে। “আসার জন্যে আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।”
লুইস তার দুই হাতই সামনে বাড়িয়ে দেয়। এক হাত শ্বশুড়ের সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য বাড়িয়ে দেয়ার মত করে আর একই সাথে আরেক হাত তার শ্বাশুড়িকে আলিঙ্গন করাতে আহ্বান করার মত করে। অথবা দুজনকেই একসাথে জড়িয়ে ধরার মত করে। সে প্রথমবারের মত তার চোখ দিয়ে পানি ঝরা টের পায়। তার হঠাৎ ধারণা হলো তারা তার এবং তাদের মাঝের যে দেয়ালটা আছে, সেটা সরিয়ে ফেলবেন। গেজ মরে গিয়ে অন্তত এটুকু উপকার করে যাবে। ঘটনাটা যেন কোন রোমান্টিক নভেলের কাহিনির মত হবে, যে কারো মৃত্যুতে শোকের সাথে সাথে অনেকের মাঝে বোঝাপড়াও হবে।
ডোরি তার দিকে এগিয়ে আসছে, এবং হয়তো তিনি লুইসের দিকে তার নিজের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি কিছু বললেন, “ওহ, লুইস …,” এতোটুকু লুইস বুঝতে পারলো, বাকিটা না-এবং তখনই গোল্ডম্যান তার স্ত্রীকে পেছনে টেনে নিলেন। কয়েক মুহূর্তের জন্যে তারা তিনজন এমনভাবে দাঁড়িয়ে গেল যেটা হয়তো শুধু তারা তিনজন ছাড়া আর কেউ খেয়াল করেনি। হয়তো ফিউনারেল পরিচালকের চোখে পড়েছে, লুইস ভাবে, কারণ এরকম কিছু হলে তার আঙ্কেল কার্লের চোখেও নিশ্চয়ই পড়তো। লুইস তার হাত বাড়িয়ে আছে আর আরউইন এবং ডোরি কাপড়ের দোকানের কাপড় পরানো পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে।
লুইস চেয়ে দেখলো তার শ্বশুড়ের চোখে কোন পানি নেই; বরং তার চোখ ঘৃণায় জ্বলজ্বল করছে। সে কী ভেবেছে আমি তাকে ক্ষেপানোর জন্যে গেজকে মেরে ফেলেছি? তিনি তার চোখগুলো দিয়ে লুইসকে মেপে দেখছিলেন, লুইসের মাঝে সেই ছোটলোকটাকে খুঁজছেন যে তার মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে এবং এই দুর্ভাগ্য এনে দিয়েছে। এরপর ওনার চোখ লুইসের পাশে সরে গেল-গেজের কফিনের দিকে-এবং এরপর তার চোখ কিছুটা শীতল হলো।
লুইস তারপরেও শেষ চেষ্টা করে। “আরউইন,” সে বলে। “ডোরি। প্লিজ। আমাদের এই জিনিসটা একসাথে অতিক্রম করতে হবে।”
“লুইস,” ডোরি আবারো বলেন-লুইসের মনে হয় তিনি বেশ দয়ার্দ্র কন্ঠেই বলেন-এবং পরমুহূর্তেই তারা হেঁটে লুইসের পাশ থেকে সরে যান। আরউইন গোল্ডম্যান হয়তো তার স্ত্রীকে একরকম টেনেই নিয়ে যাচ্ছেন; তিনি ডানে বায়ে কোনদিকেই তাকাচ্ছেন না, লুইসের দিকে তো নয়ই। তারা কফিনের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং গোল্ডম্যান তার পকেট থেকে একটা ছোট্ট কালো তালু টুপি হাতড়ে বের করলেন।
আপনারা খাতায় সাইন করেননি, লুইস ভাবে। তার ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে ঘৃণা বেরিয়ে আসে। সে ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।
একসময় সকালের অনুষ্ঠান শেষ হয়। লুইস বাসায় ফোন করে। জাড ফোন ধরে জিজ্ঞেস করে কেমন হলো অনুষ্ঠান। “ভালো,” লুইস বলে। সে জাডকে জিজ্ঞেস করে স্টিভের সাথে কথা বলা যাবে কি না।
“ও যদি নিজে নিজে পোশাক পরে রেডি হতে পারে তাহলে আমি ওকে দুপুরের ভিজিটিং আওয়ারে যেতে দিব,” স্টিভ বলে। “ঠিক আছে?”
“আচ্ছা,” লুইস বলে।
“তোমার কী অবস্থা, লু? কোন ফাজলামি না, সত্যি করে বলো।”
“আছি আর কী,” লুইস বলে। “মানিয়ে নিচ্ছি।” আমি সবাইকে দিয়ে খাতায় সাইন করিয়েছি, শুধু আমার শ্বশুড় শাশুড়ি ছাড়া। তারা সাইন করবে না।
“আচ্ছা,” স্টিভ বলে। “তাহলে লাঞ্চে দেখা হচ্ছে?”
লাঞ্চ। লাঞ্চে দেখা। ব্যাপারটাকে লুইসের এতো অচেনা মনে হচ্ছে যেন সেটা সে কোন সায়েন্স ফিকশান মুভিতে দেখেছে কিশোর থাকতে। লেফটেনেন্ট এব্যেলসান, এই গ্রহের অধিবাসীদের একটা অদ্ভুত রীতি আছে। যখন তাদের কারো বাচ্চা মারা যায়, তখন তারা লাঞ্চে একে অপরের সাথে দেখা করে। আমি জানি ব্যাপারটা কত অদ্ভুত আর বর্বর, কিন্তু কি আর করা-এই গ্রহ এখনো টেরাফর্মড করা হয়নি।
“শিওর,” লুইস বলে। “সকাল আর দুপুরের ভিজিটিং আওয়ারের ফাঁকে যাওয়ার জন্যে কোন রেস্টুরেন্টটা ভালো হবে, স্টিভ?”
“
“টেক ইট ইজি, লু,” স্টিভ বলে। লুইসের মনে হলো না স্টিভ খোঁচা খেয়ে রাগ করেছে। এমন উন্মত্ত অবস্থাতেও লুইসের মনে হলো সে অনেক পরিস্কারভাবে লোকজনদের বুঝতে পারছে। হয়তো এটা একটা ভ্রম, কিন্তু তার কাছে সেরকম মনে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে স্টিভ ভাবছে যে লুইসের এই খোঁচা মেরে কথা বলাও তার আগের নির্লিপ্ততা থেকে ভালো।
“চিন্তা করো না,” সে স্টিভকে বলে। “বেঞ্জামিনে গেলে কেমন হয়?”
“শিওর,” স্টিভ বলে। “বেঞ্জামিনে গেলেই হবে।”
লুইস ফিউনারেল পরিচালকের অফিস রুম থেকে ফোন করেছিল। সে যখন ফোন রেখে বের হয় তখন দেখে যে হলরুম পুরো খালি, শুধু একদম সামনের সারিতে আরউইন আর ডোরি গোল্ডম্যান মাথা নিচু করে বসে আছে। তাদের দেখে লুইসের মনে হলো তারা অনন্তকালের জন্য এখানে বসে থাকবে।
বেঞ্জামিনে যাওয়াটা ভালো সিধান্ত ছিল। এখানকার লোকজন সকাল সকাল লাঞ্চ করে ফেলে। বেলা একটা হতে হতেই জায়গাটা বেশ ফাঁকা মনে হচ্ছে। স্টিভ আর রাচেলের সাথে জাডও এসেছেন। তারা চারজন ফ্রাইড চিকেন অর্ডার করে। এক সময় রাচেল বাথরুমে গিয়ে এতো দেরি করে যে স্টিভ নার্ভাস হয়ে পড়ে। স্টিভ আরেকটু হলেই কোন ওয়েট্রেসকে বলতে যাচ্ছিল বাথরুমে গিয়ে রাচেল ঠিক আছে কি না চেক করার জন্যে, আর তখনই রাচেল ফিরে আসে লাল চোখ নিয়ে
লুইস তার চিকেন নিয়ে নাড়াচাড়া করে আর প্রচুর বিয়ার গিলতে থাকে। জাডও লুইসের সাথে পাল্লা দিয়ে বিয়ার গিলতে থাকেন, কোন কথা না বলে।
চারজন তাদের খাবার প্রায় কিছুই খায়নি। লুইস তার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাবলে দেখতে পেল তাদের মোটা ওয়েট্রেস মেয়েটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছে খাবারে কোন সমস্যা আছে কি না। কিন্তু সে যখন রাচেলের লাল চোখ দেখলো তখন ভাবলো সেটা জিজ্ঞেস করা হয়তো ঠিক হবে না। এরপর কফি খেতে খেতে রাচেল হঠাৎ এমন অকপটে একটা কথা বলে উঠে যাতে সবাই শকড় হয়-বিশেষ করে লুইস, যার প্রচুর বিয়ার খাবার ফলে অবশেষে একটু ঘুম আসছে। “আমি ওর কাপড়গুলো সালভেশন আর্মি সংস্থার মাধ্যমে দান করে দিব।”
“তাই?” স্টিভ কয়েক মুহূর্ত পরে বলে।
“হুম,” রাচেল বলে। “ওর সব জাম্পারগুলো…প্যান্টগুলো…শার্টগুলো কেউ এগুলো পেলে খুশি হবে। ওগুলো প্রায় সবগুলোই ভালো অবস্থায় আছে। শুধু সেদিন যেগুলো পড়া ছিল সেগুলো বাদে। ওগুলো…নষ্ট হয়ে গেছে।”
কথার শেষ শব্দগুলো বলতে গিয়ে রাচেলের গলা ধরে আসছে। ও কফি খেতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। একটু পরেই ও দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে।
এরপর এক অদ্ভুত মুহূর্ত শুরু হয়। সবাই যেন লুইসের কাছ থেকে কিছু আশা করছে। তার সুপার পাওয়ার, যেটা সে সারাদিন ধরে অনুভব করছে, সেটা তাকে আগের চাইতেও অনেক জোরালোভাবে বলছে সবাই তার কাছে কী চাইছে। এমনকি ওয়েট্রেস মেয়েটাও তার কাছ থেকে কিছু আশা করছে। মুহূর্তখানেক সময় সে বিভ্রান্ত অবস্থায় থেকে এরপর বুঝতে পারে কী হয়েছে। তারা চাচ্ছে সে তার স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিক।
কিন্তু সে তা করতে পারলো না। সে তা করতে চাচ্ছে আর সে জানে সেটা করা তার দায়িত্বও। কিন্তু তারপরও সে তা করতে পারল না। কারণ তাদের বিড়ালটা। ওই হতচ্ছাড়া বিড়ালটা। চার্চ, যে ইঁদুর শিকার করে নাড়িভুড়ি বের করে ফেলে, যে পাখি ধরে মাথা খুবলে ছিড়ে নেয়। লুইস যখন এগুলো দেখতে পায় সে বিনা প্রতিবাদে সেগুলো পরিস্কার করে। কারণ ওসবের জন্যে তো লুইস নিজেই দায়ি। কিন্তু গেজের জন্যেও কি তার সে রাতে মিকমেকদের গোরস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দায়ি?
সে তার আঙুলগুলো দেখে। দেখতে পায় তার আঙুলগুলো গেজের জ্যাকেটের গায়ে ঘষা খাচ্ছে। এরপর গেজের জ্যাকেট আর নেই। গেজ ও আর নেই।
লুইস তার কফি কাপের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তার স্ত্রীকে তার পাশে কাতর হয়ে কাঁদতে দেয়। সে রাচেলকে কোন সান্ত্বনা দেয় না।
কয়েক মুহূর্ত পরে-ঘড়ির হিসেবে খুব অল্প সময় হলেও বাস্তবে তাদের জন্যে তা ছিল অত্যন্ত দীর্ঘ-স্টিভ রাচেলকে নম্রভাবে জড়িয়ে ধরে। স্টিভ রাগান্বিতভাবে লুইসের দিকে তাকিয়ে আছে। লুইস জাডের দিকে তাকায় সমর্থনের জন্যে, কিন্তু তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, লজ্জায়। লুইস তার কাছ থেকে কোন সাহায্য পেল না।
অধ্যায় ৩৭
“আমি জানতাম এরকম কিছু একটাই হবে,” আরউইন গোল্ডম্যান বললেন। ঝামেলার শুরু সেখান থেকেই। “ও যখন তোমাকে বিয়ে করেছিল আমি তখনই বলেছিলাম, ‘তুমি কষ্ট পাবে। যতটুকু সহ্য করতে পারবে তার চাইতে আরো বেশি কষ্ট পাবে,’…আমি বলেছিলাম। এখন দেখো…কী ঘটলো।”
লুইস ধীরে ধীরে তার শ্বশুড়ের দিকে তাকায়। তাকে তার কালো টুপিতে অদ্ভুত লাগছে। এরপর সে নিজ থেকে পুরো রুম খুঁজে দেখলো রাচেল আছে কি না। এই বেলা সেই খাতাসহ স্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব ছিল রাচেলের। কিন্তু রাচেল সেখানে নেই।
দুপুরের সেশনে ভীড় তুলনামূলক কম হয়েছে। শুরুর আধ ঘন্টা পর থেকে লুইস প্রথম সারিতে গিয়ে বসে আছে, একদম অসাড় হয়ে। কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। সে শুধু টের পাচ্ছে তার ঘুম পাচ্ছে; আর ফুলের অসহ্য গন্ধ। ঘুম পাওয়ার কারণ হয়তো কিছুক্ষণ আগে বিয়ার গেলা। ঘুম পাওয়াতে হয়তো ভালই হয়েছে। হয়তো টানা ষোল ঘন্টা ঘুমোলে সে
রাচলকে সান্ত্বনা দেয়ার মত অবস্থায় যেতে পারবে।
লুইস আরো কিছুক্ষণ সময় মাথা নিচু করে নিজের হাতগুলো দেখতে থাকে। লাঞ্চ থেকে ফিরে দুপুরের সেশনে যখন গোল্ডম্যানদের দেখতে না পেয়ে লুইস একটু খুশিই হয়েছিল; কিন্তু তার বোঝা উচিত ছিল গোল্ডম্যানদের একেবারে চলে যাওয়াটা হয়তো তার জন্যে একটু বেশিই উচ্চাভিলাসী ছিল।
“রাচেল কোথায়?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
“ওর মায়ের সাথে। যেখানে ওর থাকা উচিত।” গোল্ডম্যান অনেকটা বিজয়ীর ভঙ্গীতে বললেন। তার মুখ থেকে ভুরভুর করে মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। তিনি লুইসের সামনে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যেন তিনি উকিল আর লুইস নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত আসামী। উনার পা কাঁপছে।
“আপনি ওকে কী বলেছেন?” ঝামেলার গন্ধ পেয়ে লুইস বলে। ও বুঝতে পারছে গোল্ডম্যান রাচেলকে কিছু বলেছেন। সেটা লুইস তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছে।
“যা সত্য তাই বলেছি। বলেছি বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করলে কী হয়। আমি বলেছি-”
“আপনি সত্যি এসব বলেছেন?” লুইস অবিশ্বাসের সাথে বলে। “আপনি আসলেই এটা বলেননি, রাইট?”
“অবশ্যই বলেছি। আরো বলেছি,” আরউইন বলেন। “আমি জানতাম এরকমই কিছু একটা ঘটবে। আমি যেদিন তোমাকে দেখেছি সেদিনই বুঝেছি তুমি কেমন লোক।” তিনি লুইসের দিকে আরো ঝুঁকে এলেন আর তার মুখ থেকে মদের গন্ধ লুইসের নাকে এসে ধাক্কা মারে। “আমি একদম তোমার ভেতরটা দেখতে পেয়েছিলাম, হাতুড়ে ডাক্তার। তুমি আমার মেয়েকে ফুসলে বিয়ে করে কাজের মেয়ে বানিয়েছ। আর এখন ওর বাচ্চাকে তুমি রাস্তায় মরতে দিয়েছো…কুকুরের মত।”
বেশিরভাগ কথাই লুইসের মাথার ওপর দিয়ে গেল। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না এই বেকুব বেঁটে লোকটা…”আপনি এসব ওকে বলেছেন?” সে আবারো বলে। “আপনি এসব বলেছেন?”
“আমি চাই তুমি নরকে পচে মর!” গোল্ডম্যান বলেন এবং রুমের বাকি চোখগুলো তার দিকে ঘুরে যায়। গোল্ডম্যানের রক্তিম বাদামি চোখগুলো দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করে। তার টাকমাথা ফ্লোরোসেন্ট লাইটের আলোয় চকচক করছে। “তুমি আমার চমৎকার মেয়েটিকে একটা কাজের মেয়ে বানিয়েছো…ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছো তুমি…আর আমার নাতিকে রাস্তায় মরতে দিয়েছো তুমি।”
তার গলার আওয়াজ উঁচু হতে হতে গর্জনের মত শোনা যায়।
“কই ছিলে তুমি? ও যখন রাস্তার ওপর খেলছিল তুমি কি তখন বাল ছিঁড়ছিলে? নিজের ছাইপাশ মেডিকেল আর্টিকেল নিয়ে ভাবছিলে? কি করছিলে তুমি তখন? ফাউলের ফাউল! ফালতু লোক! খুনী! খু—”
লুইস হঠাৎ খেয়াল করে তার হাত ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। সে দেখলো তার কোটের হাতা থেকে তার মুষ্টি বেরিয়ে আসছে। সেই মুষ্টি তার শ্বশুড়ের মুখে গিয়ে মিলিত হয়। সে টের পেল তার মুষ্টির নিচে তার শ্বশুড়ের ঠোট পিষে যাচ্ছে। এতে তার কোন আত্মতুষ্টি হচ্ছে না। তার শ্বশুড়ের ঠোঁটের নিচে লুইস ওনার দাঁতের পাটি অনুভব করতে পারছে।
গোল্ডম্যান হুমড়ি খেয়ে পিছিয়ে গেলেন। তার একহাত গেজের কফিনে লেগে সেটিকে কাত করে দিলো। ধাক্কায় কফিনের ওপর রাখা একটা ফুলদানি পড়ে গিয়ে বিকট শব্দে ভেঙে চৌচির হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। একটা চিৎকার শোনা গেল।
চিৎকার করেছে রাচেল। তার মা তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছে আর সে ছোটার জন্যে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সেখানে যে দশ-পনেরোজন ছিল, প্রায় সবাই ভয় আর লজ্জায় থতমত খেয়ে গেছে। স্টিভ জাডকে নিয়ে লাডলোতে ফিরে গেছে আর লুইসের মনে হলো তাতে বেশ ভালো হয়েছে। এই দৃশ্যটা সে জাডকে দেখাতে চাচ্ছিল না।
“আমার বাবাকে মেরো না!” রাচেলের চিৎকার শোনা গেল। “লুইস, আমার বাবাকে মেরো না!”
“বুড়োদের মারতে খুব ওস্তাদ, তাই না?” পেটমোটা চেকের মালিক আরউইন গোল্ডম্যান খেকিয়ে ওঠলেন। তিনি রক্তাক্ত মুখে হাসছেন। বুড়োদের মারতে ওস্তাদ, তাই না? আমি অবাক হইনি, শুয়োরের বাচ্চা। আমি একদমই অবাক হইনি।”
লুইস তার দিকে ঘুরলে তিনি লুইসের কাঁধে একটা ঘুষি বসিয়ে দেন। ঘুষিটা তিনি সুবিধামতো মারতে পারেননি। কিন্তু লুইস এটার জন্যে একদমই প্রস্তুত ছিল না। ব্যথায় সে অসাড় হয়ে গেল। পরবর্তী দুই ঘন্টা সে ব্যথার চোটে ঢোক গিলতে পারেনি। সে একপাশে এক হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে পড়ে।
প্রথমে ফুলদানিটা, এরপর আমাকে… সাবাস! লুইস হাসতে চায় কিন্তু তার গলা দিয়ে কোকানো ছাড়া কিছুই বের হয় না।
রাচেল আবারো চিৎকার করে ওঠে।
আরউইন গোল্ডম্যান লুইসের দিকে এগিয়ে এসে ওর কিডনির ওপর একটা কষে লাথি বসিয়ে দিলেন। তীব্র যন্ত্রণায় লুইস চোখে অন্ধকার দেখে। সে কার্পেটে হাত দিয়ে নিজেকে ফ্লোরে ভূপাতিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। “বুড়োদের সাথেও তো পারিসনে হারামজাদা!” গোল্ডম্যান কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠলেন। তিনি আবারো লাথি কষালেন। তবে এবার কিডনি মিস করলেন। লাথি গিয়ে লাগলো লুইসের পাছার ওপরের অংশে। লুইস ব্যথায় ঘোঁৎ করে ওঠে। এবার সে সত্যই ফ্লোরের ওপর পড়ে যায়। তার থুতনি মেঝেতে ধাক্কা লেগে জিভে কামড় লেগে যায়।
“উচিত শিক্ষা!” গোল্ডম্যান চিৎকার করে ওঠলেন। “আরো আগেই পাছায় লাথি মারা দরকার ছিল, হারামজাদা। যেদিন তোকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই তোর পাছায় লাথি মেরে কুত্তার মত খেদানো দরকার ছিল।” তিনি আবারো লাথি মারলেন, এবার দুই পাছায় একসাথে। গোল্ডম্যান ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাসছিলেন। লুইস প্রথমবারের মত খেয়াল করলো গোল্ডম্যান শেভ করে আসেননি-শোকের চিহ্ন। ফিউনারেল ডিরেক্টর তাদের দিকে ছুটে আসছে। রাচেল তার মায়ের হাত থেকে ছুটে চিৎকার করতে করতে তাদের দিকে ছুটে আসছে।
লুইস কোনরকমে উঠে বসে। তার শ্বশুড় আবারো তাকে লক্ষ্য করে লাথি মারে। কিন্তু এবার সে বুড়োর জুতো ধরে ফেলে আর গায়ের সব শক্তি দিয়ে পেছনে ঠেলে দেয়।
গর্জন করতে করতে গোল্ডম্যান একরকম উড়ে চলে গেলেন, ভারসাম্য পাওয়ার জন্যে এলোমেলোভাবে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে। তিনি গেজের ‘চিরস্থায়ী বিশ্রাম’ কফিনের ওপর গিয়ে পড়লেন, যেটা তৈরি হয়েছে ওহাইওতে এবং মোটেই সস্তা না।
পেটমোটা ময়লার বস্তাটা আমার ছেলের কফিনের ওপর গিয়ে পড়েছে, লুইস ঘোরের মধ্যেই ভাবে। কফিনটা তার নিচের ফ্রেম থেকে বিকট আওয়াজ করে নিচে পড়ে। প্রথমে বাম দিকটা পড়ে, এরপর ডান দিক। কফিনের ছিটকিনি ভেঙে গেছে। এতো চিৎকার, গোল্ডম্যানের এতো তর্জন-গর্জনের মধ্যেও লুইস ঠিকই তার ছেলের কফিনের ছিটকিনি খুলে আসার আওয়াজ শুনতে পায়।
কফিন থেকে অবশ্য উৎসুক জনতার নির্লজ্জভাবে চেয়ে দেখার জন্যে গেজের থেতলানো লাশটা বেরিয়ে এলো না। তবে লুইস জানে যে গেজের লাশ কফিন থেকে বেরিয়ে আসেনি কারণ কফিনটা পাশ হয়ে পড়েনি, যেটা খুব সহজেই হতে পারতো। তবে কফিনটা পড়ার পর যখন ছিটকিনি ভেঙে ডালা খুলে এসেছিল কিছু সময়ের জন্যে, লুইস কফিনের ভেতরে তার ছেলের ধূসর কোটের রং দেখতে পায়। আরো দেখতে পায় হালকা গোলাপি রঙের কিছু, হয়তো গেজের হাতের তালু।
ফ্লোরে বসে নিজের দুহাতে মুখ গুজে লুইস কাঁদতে শুরু করে। সে তার শ্বশুড়ের প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এম.এক্স মিসাইলের প্রতি, গ্লোবাল ওয়ার্মিং’এ পৃথিবীর মৃত্যুর প্রতি। এই মুহূর্তে লুইসের মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। হঠাৎ করেই, কোন কারণ ছাড়াই তার চোখের সামনে একটা ছবি ভেসে ওঠেঃ গেজ নকল মিকি মাউসের কান পড়ে ডিজনিল্যান্ডে হাসি মুখে আরেক বড় মিকি মাউসের সাথে হাত মেলাচ্ছে। সে ছবিটা খুব পরিস্কারভাবে দেখলো।
কফিনের জায়গাটায় এখন একটা হযবরল অবস্থা। কফিন মাটিতে পড়ে আছে। কফিনের সাপোর্টের ফ্রেমগুলো কোনটা উল্টে গেছে, কোনটা কাত হয়ে আছে। ফুলগুলোর মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে গোল্ডম্যান পড়ে আছেন, ক্রন্দনরত অবস্থায়। ফুলদানিগুলো থেকে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। ফুলগুলো অনেকগুলোই ভেঙে গেছে; ভেঙে গিয়ে সেগুলো থেকে আরো বেশি গন্ধ ছড়াচ্ছে।
রাচেল চিৎকার করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে।
রাচেলকে থামানোর জন্যে লুইস কিছুই করতে পারে না। গেজ আর মিকি মাউসের ছবিটা ফিকে হয়ে আসছে; এবার সে ডিজনিল্যান্ডের মাইকে ঘোষনা শুনতে পেলো একটু পরে আতশবাজির শো হবে; এরপর তার চোখের সামনে থেকে ছবিটা সরে যায়। সে নিজের হাতে মুখ গুজে সেখানে বসে থাকে। সে চায়না কেউ তার চোখের পানি দেখুক, তার লজ্জা দেখুক, তার হতাশা দেখুক, তার দুর্দশা দেখুক, আর তার এই জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়ার কাপুরুষতা দেখুক।
ফিউনারেল পরিচালক এবং ডোরি ধরাধরি করে চিৎকাররত রাচেলকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। ওকে নিয়ে যে রুমে রাখা হয় সেটা রাখাই হয়েছে এরকম অবস্থার জন্যে; যারা শোকে উন্মত্ত হয়ে যায় বিশেষ করে তাদের জন্যে। সেখানে গিয়ে রাচেল একদম পাথরের মত চুপ হয়ে যায়। লুইসের অবস্থা কিছুটা টলমলে হলেও সে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রেখেছে। সে এবার নিজেই রাচেলকে ঘুমের ওষুধ দেয় আর বাকিদের বলে তাদের দুজনকে একটু একা থাকতে দিতে।
বাসায় ফিরে লুইস রাচেলকে বেডে নিয়ে যায় এবং আরেকটা ঘুমের ওষুধ দেয়। সে রাচেলকে বিছানায় শুইয়ে গলা পর্যন্ত চাদরে ঢেকে দেয়। এরপর রাচেলের ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “রাচেল, আমি সরি…আমি যদি পারতাম তাহলে পৃথিবীর যেকোন কিছুর বদলে যা ঘটেছে তা ফিরিয়ে নিতাম।”
“আচ্ছা,” রাচেল ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে। এরপর ঘুরে খাটের নিজের পাশে পাশ ফিরিয়ে শোয়, লুইস থেকে দূরে সরে।
লুইস বলতে চাচ্ছিল তুমি ঠিক আছো? কিন্তু নিজের মনের ভেতর কথাটা শুনেই সে কথাটার অসাড়তা টের পেল। এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কোন মানে হয় না। তাই সে অবশেষে জিজ্ঞেস করে, “কতটা খারাপ লাগছে?”
“খুব খারাপ, লুইস,” সে জবাব দেয়। এরপর সে একটা কথা বলে যেটা শুনে মনে হয় রাচেল হাসছিল। “সত্যি করে বলতে গেলে, জঘন্য।”
লুইসের হয়তো আরো কিছু বলা বা করার দরকার ছিল, কিন্তু সে তা করতে পারলো না।
সে বাতি নিভিয়ে সেখান থেকে চলে এলো। সে বুঝতে পারছে তার মেয়েকে সান্তনা দেয়ার মত অবস্থাও তার নেই।
এলির রুমের ছায়াঘেরা পরিবেশ দেখে লুইসের হঠাৎ মনে হলো এলির রুমে যে আছে সে আসলে গেজ। আর যা ঘটছে সব কিছুই হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্নের অংশ, ভিক্টর পাস্কোর সেই স্বপ্নের মত। তার ক্লান্ত মন কয়েক মুহূর্তের জন্যে তা বিশ্বাসও করে নিল। রুমের ছায়াগুলো তাকে এরকম অদ্ভুত চিন্তা করতে প্ররোচিত করছে। রুমে ছায়া ছাড়া আর আছে টিভির বাড়তে কমতে থাকা উজ্জ্বলতা। টিভিটা জাড এলির রুমে রেখে গিয়েছে সময় কাটানোর জন্যে।
অবশ্যই এটা গেজ না, এটা এলিই। এখন এলি শুধু তার ভাইয়ের ছবি হাতে ধরে আছে তা না, ও তার ভাইয়ের নাম ছাপা ছোট্ট ক্যানভাসের চেয়ারটায় বসে আছে। রাচেল আর লুইস চিঠিতে অর্ডার করে পরিবারের চারজনের জন্যে চারটা চেয়ার আনিয়েছিল, প্রত্যেকটার পেছনে নিজেদের নাম ছাপা। এলি গেজের রুম থেকে চেয়ারটা নিজের রুমে নিয়ে এসেছে।
গেজের চেয়ারে এলি খুব চাপাচাপি করে বসেছে। চেয়ারের নিচের অংশ বিপদজনকভাবে ঝুলে পড়েছে। সে গেজের ছবি বুকে নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে যেখানে একটা মুভি চলছে।
“এলি,” লুইস টিভি অফ করে দিয়ে বলে, “শোবার সময় হয়েছে।”
এলি কায়দা কসরত করে পিচ্চি চেয়ারটা থেকে বেরিয়ে এসে চেয়ারটাকে ভাঁজ করলো। দেখা যাচ্ছে ও হয়তো চেয়ারটা সাথে নিয়ে ঘুমানোর পরিকল্পনা করছে।
লুইস চেয়ারের ব্যাপারে কিছু বলবে কি না ভেবে একটু ইতস্তত করে সেই চিন্তা বাদ দিল। “তুমি কি চাও আমি তোমাকে শুইয়ে দিই, মামনি?”
“হ্যা, বাবা,” ও বলে।
“তুমি কি…তুমি কি আজ রাতে তোমার আম্মুর সাথে ঘুমোতে চাও?”
“নাহ, থ্যাঙ্কস।”
“তুমি শিওর?”
এলি মুচকি হাসে। “হুম, মা গায়ের চাদর টেনে নেয় ঘুমের মধ্যে।
“ জবাবে লুইসও মুচকি হাসে। “আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে।”
গেজের চেয়ারটা বিছানায় নেয়ার বদলে এলি সেটাকে বিছানার মাথার দিকে মেলে দিল। লুইসের মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা আসলো-এলির রুমটাকে পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষুদে সাইকিয়াট্রিস্টের রুম বলে মনে হতে লাগলো।
এলি গেজ আর তার ছবিটা বালিশের নিচে রেখে জামা বদলে বাথরুমে গেল দাঁত ব্রাশ করার জন্যে। এরপর ফিরে এসে ছবিটা বের করে ও সেটাকে নিয়ে শুতে গেল।
লুইস এলির পাশে বসে বলল, “মামনি, আমরা যদি একে অপরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরি তাহলে এই শোক আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো।”
প্রত্যেকটা শব্দ যেন লুইসের গায়ে হুল ফুটিয়ে দিল। লুইস এটুকু বলেই বড্ড ক্লান্ত অনুভব করতে থাকে।
“আমি অনেক ভালোভাবে দোয়া করবো,” এলি বলে, “যাতে খোদা গেজকে ফিরিয়ে দেন।
“এলি-”
“খোদা চাইলেই ওকে ফিরিয়ে দিতে পারেন,” এলি বলে। “খোদা চাইলে সব করতে পারেন।”
“এলি, ঈশ্বরের ক্ষমতা থাকলেও ঈশ্বর এরকম কিছুই করেন না, “ লুইস ইতস্তত করে বলে আর তার মনের পর্দায় সে চার্চকে দেখতে পায়, টয়লেটের বন্ধ সিটে বসে তার দিকে ওই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকতে।
“উনি এরকম করেন তো,” এলি বলে। রবিবারের ধর্ম স্কুলের শিক্ষক আমাদের লেজারাসের কথা বলেছেন। সে মরে গিয়েছিল আর যিশু তাকে পুনরায় বাঁচিয়ে তোলেন। যিশু বলেছিলেন, ‘লেজারাস, উঠে এসো, কারণ আমাদের শিক্ষক বলেছেন যিশু যদি শুধু ‘উঠে এসো’ বলতেন তাহলে ওই কবরস্থানের সব মরা উঠে আসতো।”
“মামনি, সেটা অনেক অনেক আগের কথা।”
“আমি গেজের জন্যে সবকিছু রেডি রাখবো,” ও বলে। “আমার কাছে ওর ছবি থাকবে আর আমি ওর চেয়ারটাও ব্যবহার করবো-
“এলি, তুমি গেজের চেয়ারে বসতে পারবে না,” লুইস এলির উষ্ণ হাত ধরে বলে; এলির হয়তো জ্বর আসছে। “তুমি বসলে পিচ্চি চেয়ারটা ভেঙে যাবে।”
“ঈশ্বর এটাকে ভাঙতে দিবেন না,” এলি কোমল গলায় বললেও লুইস ওর চোখের নিচের বাদামি কালি দেখতে পায়। মেয়েকে এভাবে দেখে লুইসের হৃদয়টা ভেঙে যায়, সে ওর চেহারা থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। হয়তো চেয়ারটা ভেঙে গেলেই ভালো হবে, তাহলে হয়তো এলির চোখ খুলতে পারে।
“আমি সব সময় ওর ছবি আমার সাথে রাখবো আর ওর চেয়ারে বসবো,” সে বলে। “আমি ওর ব্রেকফাস্টও খাবো।” এলি আর গেজের দুরকম সিরিয়াল আছে ব্রেকফাস্টের জন্যে। এলি একবার গেজের সিরিয়াল খেয়ে বলেছিল সেটা খেতে নাকের ময়লার মত। এলির সিরিয়াল শেষ হয়ে গেলেও ও গেজের সিরিয়াল ছুঁয়ে দেখতো না, সেদিন সে সিদ্ধ ডিম দিয়ে নাস্তা করতো বা কিছুই খেত না। “আমি ওর সিরিয়াল ঘৃণা করলেও খাবো। আমি ওর ছবিওয়ালা গল্পের বইগুলো পড়বো…আমি…সব কিছু রেডি রাখবো, যদি…”
ও এখন কাঁদছে। লুইস ওর কান্না থামানোর কোন চেষ্টা না করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ও যা বলছে একদিক দিয়ে ঠিকই বলছে। গেজের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে ও। গেজকে ও অতীত হয়ে দিতে চাইছে না, গেজকে ও টপচার্টে জিন্দা রাখতে চাইছে… যতক্ষণ গেজের জন্যে সবার কষ্ট হবে, ততক্ষণই গেজ সবার মাঝে থাকবে। কষ্ট লাগা শেষ, গেজও হারিয়ে যাবে, চিরতরে।
“এলি, কেঁদো না মামনি,” সে বলে। “এরকম চিরকাল ধরে থাকবে না।”
এলি প্রায় চিরকাল ধরেই কান্না করলো, পাক্কা পনেরো মিনিট। ওর কান্না বন্ধ হবার আগেই ও ঘুমিয়ে পড়লো। নিচ তলার ঘড়িতে দশটা বাজার ঘন্টা বেজে উঠলো।
ওর স্মৃতি জিন্দা রাখো, এলি, সত্যই যদি তুমি চাও, ভেবে লুইস এলিকে চুমো খেলো। সাইকিয়াট্রিস্টরা বলবে এরকম করা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে মোটেও ঠিক না-তা বলুক গে। কারণ আমি জানি তুমি কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো এই শুক্রবারেই ছবিটার কথা ভুলে যাবে। দেখা যাবে ছবিটা তোমার খাটের ওপর নিঃসঙ্গ অবস্থায় পরে থাকবে আর তুমি ড্রাইভ ওয়েতে সাইকেল চালাবে,বা বাসার পেছনের মাঠে খেলবে, হয়তো বা বান্ধবীর বাসায় গিয়ে পুতুলের জন্যে জামা বানাবে। গেজ তোমার সাথে আর থাকবে না; তোমার কোমল হৃদয়ের টপ চার্ট থেকে ও খসে পড়বে। ও হয়ে যাবে একটা
স্মৃতি যেটা ১৯৮৪ সালে ঘটেছিল। অতীতের কথা
লুইস রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়; সে একবার বিছানায় যাবার কথা চিন্তা করে, কিন্তু সে চিন্তা পালে হাওয়া পায় না।
ও জানে ওর কী লাগবে এবং সেটার জন্যে সে নিচতলায় নামে।
***
লুইস আলবার্ট ক্রিড ঠিক করেছে সে মাতাল হবে। নিচতলার সেলারে পাঁচ কেস বিয়ার আছে। লুইস বিয়ার খায়, জাড খায়, স্টিভ মাস্টারটন খায়, মিসি ডেন্ডিজও বাচ্চাদের দেখা-শোনা করার সময় দুই-একটা বিয়ার খায়, এমনকি চার্লটনও যে কয়েকবার ওদের বাসায় এসেছে সে বিয়ারই খেতে চেয়েছে। চাহিদার কথা চিন্তা করে একটা মদের দোকানের সেল চলাকালে সেখান থেকে গত শীতে দশ কেসের এক বিরাট চালান সে কিনে এনেছে।
লুইস এক কেস বিয়ার এনে একটা রেখে বাকিগুলো ফ্রিজে ঠেসে দেয়। বিয়ারের মুখ খোলার পরই সে চার্চকে দেখতে পায়। ফ্রিজ খোলার আওয়াজ পেয়ে সে খাবারের লোভে হেলতে দুলতে হাজির হয়ে লুইসের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিড়ালটা ওর খুব কাছে ঘেঁষলো না। উপর্যুপরি লাথির কারণে হয়তো সে তার প্রতি লুইসের মনোভাব বুঝতে পেরেছে।
“তোর জন্যে কিছুই নেই,” লুইস বলে। “তোকে আজ তোর খাবারের ক্যান দেয়া হয়েছে। ক্ষুধা লাগলে পাখি মেরে খা গিয়ে।”
চার্চ বসে বসে লুইসকে দেখতে থাকে। লুইস অর্ধেক ক্যান বিয়ার গেলার সাথে সাথে বুঝতে পারে সেটা তার মাথায় চলে গেছে।
“তুই তো গুগুলো মেরে খাসনে, তাই না?” সে জিজ্ঞেস করে। “খুন করেই তোর মজা।”
চার্চ এখানে কোন খাবার পাবে না বুঝতে পেরে ড্রইং রুমের দিকে রওনা হয়। লুইস চার্চের পিছে পিছে যায়।
লুইস একটা চেয়ারে বসে চার্চের দিকে তাকায়। চার্চ কার্পেটের ওপর ভর দিয়ে সন্তর্পণে বসে আছে। যদি লুইস আবারো লাথি মারতে উদ্যত হয় তাহলেই দৌড়ে পালানোর জন্য প্রস্তুত সে।
তার পরিবর্তে লুইস চিয়ার্স করার ভঙ্গিতে তার বিয়ারের ক্যান উঁচু করে বলল, “গেজের জন্যে…আমার ছেলে…যে একদিন শিল্পী হতে পারতো, হতে পারতো অলিম্পিক সাতারু, অথবা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তুই কী বলিস, বজ্জাত বিড়াল?”
চার্চ তার অদ্ভুত ঘোলা চোখগুলো দিয়ে মিটমিট করে তাকায়।
লুইস বাকি বিয়ারটা লম্বা লম্বা ঢোকে পেটে চালান করে দেয়। গলায় জ্বালা হলেও সে উঠে ফ্রিজ থেকে আরেকটা বিয়ার নিয়ে আসে।
তিন নাম্বার বিয়ার পেটে চালান করার পর লুইসের মনে হলো সেদিনে প্রথমবারের মত সে নিজের মধ্যে ভারসাম্য টের পাচ্ছে। ছয়টা বিয়ার উধাও করে দেয়ার পর তার মনে হলো সে হয়তো আর ঘন্টাখানেক পর ঘুমোতে পারবে। অষ্টম বা নবম (সে এর মধ্যে বিয়ারের ক্যানের হিসেব হারিয়ে ফেলেছে) বিয়ার নিয়ে ফিরে আসার পর তার চোখ চার্চের ওপর পড়ে। বিড়ালটা কার্পেটের ওপর ঘুমোচ্ছে-বা ঘুমানোর ভান ধরেছে। ভাবনাটা ওর মাথায় এতো স্বাভাবিকভাবে এলো যেনো সেটা তার মনের এক কোণে আগে থেকেই ছিল, শুধু নিজেকে জানান দেয়ার অপেক্ষায় ছিলঃ
তুমি কাজটা কখন করবে? কখন তুমি গেজকে মিকমেকদের গোরস্থানে কবর দেবে?
এরপর, লেজারাস, উঠে এসো।
এলির ঘুমে ভেজা কন্ঠ,
স্যার বলেছেন যিশু যদি শুধু ‘উঠে এস’ বলতেন, তাহলে গোরস্থানের সব মরা উঠে আসতো।
লুইসের শরীর এতো তীব্রভাবে শিহরিত হয়ে উঠলো যে লুইস কুঁকড়ে যায়। তার হঠাৎ এলির স্কুলের প্রথম দিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল। এলি স্কুল থেকে ফিরে এসে অনর্গল তার স্কুলের গল্প বলে যাচ্ছিল। ও আর রাচেল এলির গল্প শুনছিল আর ওই অবস্থাতেই গেজ লুইসের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। ও যখন গেজকে ওপরে নিয়ে গিয়েছিল ওর একটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল; কোন অশুভ কিছু যেন ওর পথ আগলে দাড়িয়েছিল। লুইস এখন বুঝতে পারছে; সেপ্টেম্বরের সেই দিনেই লুইসের মনের একটা অংশ বুঝতে পেরেছিল যে গেজ মারা যাবে। জিনিসটা অযৌক্তিক, জঘন্য, কুসংস্কার বাল ছাল… কিন্তু সত্য। সে জানতো। বিয়ারের ক্যান থেকে বিয়ার ছলকে উঠে ওর শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছে। চার্চ মাথা উঁচু করে ওর দিকে দুশ্চিন্তার সাথে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে যে আজকের বিড়াল খেদানো লাথি শুরু হলো বলে কি না।
জাডকে করা তার প্রশ্নটা লুইসের মনে পড়ে গেল; মনে পড়ে গেল প্রশ্নটা শুনে জাড কিভাবে চমকে উঠেছিল এবং হাতের ঝাঁকিতে কিভাবে দুইটা বিয়ারের বোতল উনি টেবিল থেকে ফেলে দিয়েছিলেন। একটা বোতল ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। ‘এসব কথা মুখেও আনবে না লুইস!”
কিন্তু সে কথাটা মুখে আনতে চাচ্ছে-বা অন্তত ভেবে দেখতে চাচ্ছে। পেট সেমিটারির ব্যাপারে; তার পেছনে যা আছে তার ব্যাপারে। বিষয়টার একটা মারাত্মক আকর্ষণ আছে। ব্যাপারটায় একটা অনস্বীকার্য ভারসাম্য আছে। চার্চ রাস্তায় মারা গিয়েছিল; গেজ রাস্তায় মারা গেছে। এই যে চার্চ-নিঃসন্দেহে অনেক বদলে গেছে-কিন্তু সে তাদের মাঝেই আছে। গেজ, এলি রাচেল সবাই তার সাথে মানিয়ে নিয়েছে। ও পাখি মারে, সত্য, ও কিছু ইঁদুর মেরে নাড়ি-ভুড়ি বের করে দিয়েছে, সত্য; কিন্তু এসব তো বিড়ালেরা করেই। চার্চ কোনভাবেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বিড়ালে পরিণত হয়নি। ভেবে দেখলে ও অনেক দিক দিয়ে আগের মতই আছে।
তুমি খোঁড়া যুক্তি দিচ্ছ, একটা কন্ঠ ফিসফিস করে উঠে। ও আর আগের মত নেই। ও বদ হয়েছে। কাক, লুইস…কাকটার কথা মনে আছে?
“ওহ খোদা!” লুইস কাঁপা কাঁপা গলায় উচ্চস্বরে বলে উঠে। নিজের কন্ঠ সে নিজেই চিনতে পারে না।
খোদা? এতো কিছু থাকতে ঈশ্বরের নাম? ঈশ্বরের নিয়মে চার্চ মরেছিল। সেটা পছন্দ না হওয়ায় ওকে ফিরিয়ে এনে এখন ঈশ্বরের নাম নেয়া হচ্ছে?
সাবাস!
সে কি নিজেকে মিথ্যে বলছে? শুধু খোঁড়া যুক্তি না; সে নিজেকে মিথ্যেই বলছে।
তাহলে সত্যটা কী? তোমার সত্য জানতে এতো চুলকানি হচ্ছে, তাহলে সত্যটা কি?
সত্যটা হচ্ছে, প্রথমত চার্চ আসলে কোন বিড়াল না। ওকে বিড়ালের মত দেখা যায়, ও বিড়ালের মত অভিনয় করে, কিন্তু আসলে ও একটা নকল বিড়াল। হয়তো ভুয়া বিড়াল। চোখে দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। লুইসের একরাতের কথা মনে পড়ে; সেরাতে চার্লটন তাদের বাসায় এসেছিল প্রি-ক্রিসমাসের ডিনারে। খাওয়া দাওয়ার পর ওরা সবাই এখানে বসে গল্প করছিল এমন সময় হঠাৎ চার্চ চার্লটনের কোলে লাফিয়ে ওঠে। চার্লটন এক মুহূর্ত দেরি না করে ধাক্কা দিয়ে চার্চকে সরিয়ে দেন। তার চেহারায় একটা স্পষ্ট ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠেছিল।
এটা হয়তো কোন বিশেষ ঘটনাই না। কেউ এটা নিয়ে কোন কথাও বলেনি। কিন্তু…চার্লটন বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি কিছু না জেনেও ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে বিড়ালটার সমস্যা আছে। লুইস বাকি বিয়ারটা গলায় ঢেলে দিয়ে আরেকটার জন্যে ফিরে গেল। গেজ যদি এরকমভাবে ফিরে আসে তাহলে ব্যাপারটা আসলেই জঘন্য হবে।
সে ক্যানের মুখ খুলে ঢকঢক করে বিয়ার গিলে। সে এখন মাতাল, নিরেট মাতাল এবং নিঃসন্দেহে কাল ওর জন্যে একটা ভালো রকমের মাথা ব্যথা অপেক্ষা করছে। ‘কিভাবে আমি মাতাল অবস্থায় আমার ছেলের ফিউনারেলে গিয়েছিলাম’, লেখক লুইস ক্রিড। তিনি আরো লিখেছেন ‘কিভাবে আমি ওকে এক মুহূর্ত পিছিয়ে পড়ার কারণে হারিয়েছি’ এবং আরো অনেক বই।
মাতাল। পাড় মাতাল। তার ধারণা সে মাতাল সেজন্যেই ওই আইডিয়াটা নিয়ে সে পরিস্কারভাবে চিন্তা করতে পারছে।
এতো কিছুর পরও আইডিয়াটার মারাত্নক রকম আকর্ষণ ক্ষমতা আছে, লোভ আছে, প্রাচুর্য আছে।
জাড তার মনের কানে কথা বলে ওঠেঃ
“এই কাজটা আমরা করেছি, কারণ এটা আমাদের পেয়ে বসেছিল। ওই গোরস্থানটা একটা গোপন জায়গা, আর এর গোপনীয়তা তুমি অন্যদের জানাতে চাইবে। আর তখন তুমি এটা কাউকে জানানোর জন্যে উপযুক্ত কারণ খুঁজে নিবে। এরপর তুমি সেটা করবেই। তুমি নিজেই সেটার পেছনে যুক্তি দাঁড় করাবে…এবং সেই যুক্তিগুলো তোমার কাছে খুব ঠিক মনে হবে…তবে আসল কথা তুমি সেটা করতে চাও। অথবা তুমি সেটা করতে বাধ্য।
জাডের আঞ্চলিক টান মাখা কন্ঠ ওর গায়ের রক্ত হিম করে দেয়, ওর গায়ে কাটা দেয়ায়, ওর ঘাড়ের লোমগুলো সব দাঁড় করিয়ে দেয়।
মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে…মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।
জাড তাকে মিকমেকদের গোরস্থান সম্পর্কে আর কী কী বলেছে সেগুলো একটা একটা করে সে ভাবতে থাকে। সে তথ্যগুলো নিয়ে চিন্তা করতে থাকে, সেগুলো নেড়ে চেড়ে দেখে-ঠিক যেমনটা কোন পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময় লুইস করতো।
স্পট, জাডের কুকুর।
“যেখানটাতে ওর কাঁটাতার লেগে ঘা হয়েছিল সেটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম-জায়গাটায় কোন পশম ছিল না। কোন ঘা শুকিয়ে যাওয়ার পাঁচ বছর পর জায়গাটা যেমন দেখা যায়, স্পটের ঘায়ের জায়গাটাও তেমন দেখা যাচ্ছিল।
লেস্টার মরগানের পুরষ্কার জেতা ষাঁড়।
কালো ষাঁড়টার নাম ছিল হ্যানরাট্টি…শরীরের ভেতরের এক রকম ইনফেকশনে সেটা মারা যায় আর লেস্টার একটা স্লেজে করে সেই মরা ষাঁড়টাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। সে কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করেছিল তা আমি জানি না-কিভাবে সে ওই মরা গাছের স্তূপের ওপর ওটাকে তুলেছিল তাও জানি না-লোকজন বলে যে কেউ মন থেকে কিছু করতে চাইলে সে অবশ্যই সফল হয়। তবে যতক্ষণ আমরা ওই গোরস্থানটার ব্যাপারে বলছি, এই কথাটা একদম সত্য।
যাই হোক, হ্যানরাট্টি ফিরে আসে তবে লেস্টার তাকে দুই সপ্তাহের মাথায় গুলি করে মেরে ফেলে। ষাঁড়টা খুব বিগড়ে গেছিল-বিগড়ে গেছিল মানে চরমভাবেই বিগড়ে গেছিল। তবে এরকম আর কোন পশুর সাথে হতে আমি শুনিনি।
তুমি আবার কিসের দায় নিতে চাও, লুইস? চাঁদের আলোয় সেই জঙ্গলের ভেতরের পথে আবারো হাঁটতে চাও তুমি? আবার চড়তে চাও সেই সিঁড়িতে? হরর মুভির নায়ক বা নায়িকা ওই সিঁড়িগুলোতে চড়তে চাইলে দর্শকরা তাদের আহাম্মক বলবে। কিন্তু এই দর্শকেরাই সিগারেট খায়, সিটবেল্ট ছাড়া গাড়ি চালায়, এমন একটা ব্যস্ত এবং বিপজ্জনক রাস্তার পাশে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে আসে যেখান দিয়ে বিরামহীনভাবে ভারি ভারি ট্রাক চলাচল করে। অতএব, লুইস, তোমার কী মত? চড়বে ওই সিঁড়িগুলোয়? তুমি কি তোমার ছেলেকে মৃতই রাখতে চাও না কি দেখতে চাও এক নাম্বার দরজার পিছনে কী আছে, দু নাম্বার দরজার পিছনে কী আছে বা তিন নাম্বার দরজার পিছনে কী আছে?
চলো, চলো!
ষাঁড়টা খুব বিগড়ে গেছিল…একবারই এরকম হয়েছে…ক্ষতটা…
লুইস বাকি বিয়ারটুকু সিঙ্কে ঢেলে দেয়। তার পৃথিবী দুলছে। মনে হচ্ছে তার বমি হবে।
দরজায় কেউ কড়া নাড়ে।
লম্বা সময় ধরে ওর মনে হলো এটা ওর শোনার ভুল, হ্যালুসিনেশন। কিন্তু দরজার আওয়াজ হতেই থাকে, হতেই থাকে। এবং হঠাৎ করেই লুইসের বানরের থাবার গল্পটা মনে পড়ে যায়। সেটা মনে হতেই ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে ব্যাপারটা শারীরিকভাবে অনুভব করতে পারে; একটা হাত, মরা হাত-যেটা ফ্রিজের ভেতর রাখা হয়েছিল; সুযোগ বুঝে ওর শার্টের ভেতর ঢুকে গিয়েছে আর ওর হৃৎপিন্ডের ওপরে থাবা বসানোর জন্যে কিলবিল করছে। চিন্তাটা খুব ফালতু, কিন্তু লুইসের মনে সেটা মোটেই ফালতু মনে হচ্ছে না, একদমই না।
লুইস তার পা অনুভব করতে পারছে না কিন্তু কোনভাবে সেই পাগুলো দিয়েই হেঁটে দরজার কাছে গেল এবং হাতের অসাড় আঙুলগুলো দিয়ে কোনরকমে ছিটকিনি খুললো। সে টান দিয়ে দরজাটা খুলতে খুলতে ভাবেঃ নিশ্চয়ই পাস্কো এসেছে, মৃতের জগৎ থেকে, জগিং শর্টস পড়ে মুখে মাস খানেকে গজানো দাড়ি। মাথা থেতলানো পাস্কো; তার সেই সতর্কবাণী নিয়েঃ ওখানে যেও না। কী যেন একটা গান আছে না? যেও না সাথী…ও ও ও…যেও না সাথী…
দরজাটা খুলে গেলে দেখা গেল মাঝরাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে দরজার সামনে জাড ক্র্যান্ডাল দাড়িয়ে আছেন। তার মাথার পাতলা সাদা চুল হাওয়ায় এলোমেলোভাবে উড়ছে।
লুইস হাসার চেষ্টা করে। তার মনে হলো সময় পিছিয়ে গিয়েছে। যেন আজ সেই থ্যাঙ্কসগিভিং’এর রাত আর কিছুক্ষণ পর তারা দুজনে এলির মরা বিড়ালটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে সেই কবরস্থানে গোর দিতে যাবে। ‘ওহ, এখন কিছু জানতে চেয়ো না; শুধু আমার পিছে পিছে চলো।”
“আমি আসতে পারি লুইস?” জাড় জিজ্ঞেস করেন। তিনি তার শার্টের পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে ঠোঁটে গুঁজে দিলেন 1
“জানেন,” লুইস বলে। “অনেক রাত হয়েছে আর আমি বালতি বালতি বিয়ার গিলেছি।”
“হুম, গন্ধ পাচ্ছি,” জাড বলেন। তিনি একটা ম্যাচের কাঠি জ্বাললেন কিন্তু বাতাসে সেটা টিকতে পারলো না। এরপর তিনি হাত দিয়ে ঢেকে আরেকটা কাঠি জ্বালালেন কিন্তু সেটারও অকাল পরিণতি হলো। তার হাত কাঁপছে। তিনি আরেকটা কাঠি বের করে জ্বালাতে গিয়ে থেমে লুইসের দিকে তাকালেন। “আমি জ্বালাতে পারছি না,” জাড বলেন। “আমাকে কি ভেতরে ঢুকতে দেবে, লুইস?”
লুইস সরে দাঁড়ালে জাড ভেতরে ঢুকলেন।
অধ্যায় ৩৮
তারা দুজনে কিচেন টেবিলে বসে। জাড একটা বিয়ার নিলেন। হঠাৎ এলির কান্নার শব্দ আসলে ওরা দুজনেই জমে বরফ হয়ে যায়, বাচ্চাদের খেলায় বরফ হবার মত। কিন্তু এলির কান্না আর শোনা যায় না।
“আচ্ছা,” লুইস বলে। “আপনি আমার ছেলেকে কবর দেয়ার আগের রাতে বারোটার পর এখানে কি করছেন? আপনি একজন বন্ধু। কিন্তু এটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে।”
জাড বিয়ারে চুমুক দিয়ে হাতের উল্টো পাশে মুখ মুছে একদম লুইসের চোখ বরাবর তাকালেন। তার চোখে পরিস্কারভাবেই এমন কিছু ছিল যা দেখে লুইস চট করে নিজের চোখ নামিয়ে নেয়।
“লুইস, তুমি জানো আমি কেন এসেছি,” জাড বললেন। “তুমি এমন সব জিনিস ভাবছো যেটা ভাবা একদমই উচিত না। আর আমার ভয় তুমি শুধু ভাবছই না, তুমি সেটা বিবেচনাও করছো।”
“আমি বিছানায় গিয়ে ঘুমোনো ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না, লুইস বলে। “কাল সকালে আমার ছেলেকে কবর দেয়া হবে।”
“তোমার আজ যেটুকু কষ্ট হবার ছিল তার চাইতে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে, আর এজন্যে একরকম আমিই দায়ি,” জাড নরম গলায় বললেন। “আর হয়তো তোমার ছেলের মৃত্যুর জন্যেও আমিই দায়ি।”
লুইস চমকে জাডের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে “কী সব আবোল তাবোল বলছেন!”
“তুমি গেজকে ওইখানে কবর দেয়ার কথা ভাবছো। প্লিজ, অস্বীকার করো না যে ওই চিন্তাটা তোমার মাথায় একবারো খেলেনি।”
লুইস কোন জবাব দেয় না।
“ওই জায়গাটার প্রভাব কতদূর তুমি জানো? না। আমি নিজেও জানি না, যদিও আমি আমার সারা জীবন এই জায়গাতেই কাটিয়ে দিয়েছি। আমি মিকমেকদের ব্যাপারে জানি, জানি যে ওরা ওই জায়গাটাকে মান্য করে…কিন্তু ভালো কিছু হিসেবে না। স্টানি আমাকে এই কথা বলেছিল। আমার বাবাও আমাকে পরে এই কথাই বলেছিলেন, যখন স্পট দ্বিতীয়বারের মত মারা গিয়েছিল। বর্তমানে মিকমেকরা, মেইন স্টেট আর আমেরিকান সরকার সবাই মিলে আইনী লড়াই লড়ছে জায়গাটার মালিকানার জন্যে। আসলে জায়গাটার মালিক কে সেটা কেউ বলতে পারে না। এক-এক সময় এক-এক জন নানান দাবি করেছে কিন্তু কোন দাবিই টেকেনি। যেমন ধরা যাক এই শহরের প্রতিষ্ঠাতার নাতির ছেলে এনসন লাডলোর কথা। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে তার দাবিই সবচাইতে জোড়ালো, কারণ শহরের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ লাডলো এই পুরো এলাকাটা তখনকার রাজা জর্জের কাছ থেকে অনুদান পেয়েছিলেন। কিন্তু এনসন লাডলো ছাড়াও অন্য লাডলোরাও ওই জমির মালিকানার দাবি করে। পিটার ডিমার্ট বলে এক লোক আছে, যে দাবি করে সে কাগজে কলমে না হলেও একজন লাডলো এবং এই ব্যাপারে তার নাকি উপযুক্ত প্রমাণ আছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ লাডলো শেষের দিকে টাকায় গরীব ছিলেন কিন্তু জমিতে বড়লোক ছিলেন। তিনি নাকি কাউকে পছন্দ হলেই শখানেক একর জমি দিয়ে দিতেন। তেমন দাবীদারও আছে।”
“এসবের কোন রেকর্ড নেই?” লুইস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“ওহ, তা রেখেছিলেন উনারা,” আগের সিগারেটের পাছা থেকে একটা নতুন সিগারেট জ্বালিয়ে জাড বলেন। “দলিলে ঠিক এরকম লেখা,” জাড চোখ বন্ধ করে উদ্ধৃতি দিলেন, “কুইন্সবেরি রিজের বুড়ো মেপল গাছ থেকে অরিংটন খাল পর্যন্ত উত্তর থেকে দক্ষিণের সীমানা।” জাড নিরানন্দভাবে মুচকি হাসলেন। “কিন্তু ওই মেপল গাছ ১৮৮২ সালে উপড়ে পড়ে যায় আর ১৯০০ সাল হতে হতে পচে মাটির সাথে মিশে যায়। আর অরিংটন খালটা কয়েক শাখায় ভাগ হয়ে এখন একটা জলায় পরিণত হয়েছে, সেটাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ঘটনা। সব মিলিয়ে একটা লেজে-গোবরে অবস্থা। আর এক সময় বুড়ো এনসন লাডলোর ও এসবে আর কিছু যায় আসে না, কারণ বুড়ো ১৯২১ এ ওই কবরস্থানটার কাছে বজ্রপাতে পটল তুলেন।”
লুইস জাডের দিকে তাকায়। জাড তার বিয়ারে চুমুক দিলেন।
“যাই হোক। এরকম বহু জমি আছে যেটার মালিকানা নিয়ে কম কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়নি। এসব কেসে লাভ শুধু আইনজীবীদের। আমার ধারনা ইন্ডিয়ানরা এক সময় এটা ফেরত পাবে আর এমনটাই হওয়া উচিত। যদিও ওসবে কিছু যায় আসে না, লুইস। আমি আজ তোমার কাছে এসেছি টিমি ব্যাটারম্যান আর তার বাবার কথা বলতে।”
“টিমি ব্যাটারম্যানটা আবার কে?”
“টিমি ব্যাটারম্যান ছিল সেই ২০ জন ছেলের একজন যাদের লাডলো থেকে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে পাঠানো হয়। ও ১৯৪২ সালে এখান থেকে যায় আর ফেরত আসে ১৯৪৩ সালে, পতাকায় ঢাকা একটা কফিনে করে। ও ইতালিতে মারা যায়। তার বাবা, বিল ব্যাটারম্যান, আজীবন এখানে থেকেছেন। সে তার ছেলের খবরের টেলিগ্রাম পাওয়ার পর পাগলপ্রায় হয়ে যান…এবং এরপর তিনি একদম শান্ত হয়ে যান। তিনি মিকমেকদের গোরস্থানের ব্যাপারে জানতেন, বুঝলে? এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি কি করবেন।”
লুইসের গা ঝিমঝিম করছে। সে জাডের দিকে লম্বা সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সে বৃদ্ধের চোখে মিথ্যার চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা করছে কিন্তু সেখানে এরকম কিছুই নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে এরকম একটা কাহিনির উদয় হওয়া আসলেই সন্দেহজনক।
“আমাকে এটা আপনি আগে বলেননি কেন?” লুইস অবশেষে বলে। “যখন আমরা…বিড়ালটাকে…এরপর যখন আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওইখানে কেউ কোন মানুষকে কবর দিয়েছে কি না। আপনি বলেছিলেন কেউ কখনো এরকম কিছু করেনি।”
“কারণ তখন তোমার জানার প্রয়োজন ছিল না,” জাড বললেন। “কিন্তু এখন প্রয়োজন।”
লুইস বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। “ও ছাড়া আর কাউকে কবর দেয়া হয়নি সেখানে?”
“আমি ব্যক্তিগতভাবে শুধু তার কথাই জানি,” জাড গম্ভীর গলায় বললেন। “কিন্তু আমি মনে করি না যে আর কেউ কখনো এরকম কিছু চেষ্টা করেনি। যেটা একবার হয়েছে, সেটা আগেও হয়েছে…এবং হয়তো তার আগেও।”
তিনি তার মেসতার দাগওয়ালা হাতের দিকে নিচু হয়ে তাকালেন। লিভিং রুমের ঘড়ি সাড়ে বারোটা বাজার জানান দেয় মৃদুভাবে।
“তুমি একজন ডাক্তার। তুমি লক্ষণ দেখে রোগ চেন…ফিউনারেল হোমের মর্টনসন আমাকে বলেছে তুমি কনক্রিটের ঢালাইয়ের ছাদের কবরের বদলে লাইনার কবরের জন্যে অর্ডার করেছো। এটা শুনেই আমি ঠিক করেছি তোমার সাথে সোজা-সাপ্টা কথা বলবো।”
লুইস লম্বা সময় ধরে জাডের দিকে তাকিয়ে থাকে। জাড চোখ মিটমিট করলেও চোখ সরালেন না।
অবশেষে লুইস বলে, “আপনি তো বেশ ভালোই গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমি এর জন্যে দুঃখিত।”
“আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি তুমি কোন ধরনের কবরের অর্ডার করেছো।”
“তাই? হয়তো সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেননি।”
জাড এই কথার কোন জবাব দেন না। তিনি এক দৃষ্টিতে লুইসের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
অবশেষে লুইস দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে। তার প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। “ ধুর বাল। আমার এতে কিছু যায় আসে না। হয়তো আপনি ঠিকই বলেছে। হয়তো এটা আমার মনে ছিল। আর যদি থেকেও থাকে তবে ছিল আমার অবচেতন মনে। আমি অর্ডার করার সময় এতো কিছু ভাবিনি। আমার মাথায় তখন ছিল গেজ, আর কিছু না।”
“আমি জানি তুমি গেজকে নিয়ে ভাবছিলে। কিন্তু এই দুই রকম কবরের তফাতটা তুমি জানো। তোমার আঙ্কেল একজন কবরের ঠিকাদার ছিলেন।”
হ্যাঁ, সে তফাতটা জানে। ঢালাইয়ের ভল্ট কবর হচ্ছে প্রচন্ড মজবুত একটা কাঠামো, যেটা বহু বছর ধরে টেকে। প্রথমে মাটির গর্তে একটা ছাদহীন রুমের মত তৈরি করা হয়, রড আর কনক্রিটের ঢালাই দিয়ে। এরপর এর ভেতরে কফিন রাখার পর একটা ক্রেন দিয়ে কিছুটা বৃত্তাকার একটা ভারি কনক্রিটের ছাদ বসিয়ে দেয়া হয়। আর সেটা জোড়া লাগানো হয় এমন মিক্সচার দিয়ে যেটা রাস্তার গর্ত ভরাট করতে ব্যবহার করা হয়। তার আঙ্কেল কার্ল তাকে বলেছে ওই মিক্সচার কিছু সময় পর খুব শক্তভাবে এটে যায়, যেটাকে ‘চিরস্থায়ী লক’ বলা হয়।
আঙ্কেল কার্ল অনেকের মতই গল্প করতে ভালোবাসতেন, তবে নিজের লোক পেলে তার গল্প করার প্রবণতা অনেকাংশে বেড়ে যেত। লুইস তার সাথে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেশ কিছুদিন কাজ করেছিল, সহকারী আন্ডারটেকার হিসেবে। তিনি তার ভাতিজাকে তার করা একটি লাশ উত্তোলনের গল্প বলেছিলেন। ডিস্ট্রিক্ট এটর্নির অফিস থেকে তার কাছে অর্ডার এসেছিল একটা ঢালাই করা কবরের লাশ উত্তোলনের জন্যে, পুনরায় ময়নাতদন্তের প্রয়োজনে। তিনি গ্রোভল্যান্ডে গিয়েছিলেন কাজটা তদারকি করার জন্যে। ঢালাই কবর খুঁড়ে লাশ বের করা সহজ কাজ না। যারা হরর মুভি দেখে লাশ বের করা বুঝতে চাইবে তারা ভুল বুঝবে। দুইজন মানুষকে যদি শাবল কোদাল দিয়ে ওইরকম একটা কবর থেকে লাশ বের করতে বলা হয় তবে তারা দুই সপ্তাহেও তা করতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। কাজ ভালোই আগাচ্ছিল; অন্তত শুরুতে। কবরের ওপর থেকে মাটি সরিয়ে ক্রেনের সাথে ছাদটা বাধা হয় শিকল দিয়ে। কিন্তু ক্রেন যখন ছাদটা উপরের দিকে টানতে থাকে, কথা মত উঠে না এসে সেটা খুব শক্ত হয়ে লেগে থাকে নিচের কাঠামোর সাথে। আঙ্কেল কার্ল চিৎকার করে ওই ক্রেনের অপারেটরকে থামতে বলছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন তার অফিসে ফেরত গিয়ে ওই জোড়া আলগা করার কিছু উপকরণ নিয়ে আসতে।
অপারেটর হয় শোনেনি অথবা তাকে গুরত্ব দেয়নি। হয়তো সে একেবারে শেষ দেখতে চাচ্ছিল। যাই হোক, ক্রেনের টানে ছাদের সাথে সাথে নিচের কনক্রিটের কাঠামোটাও উঠে আসতে শুরু করে। বলদটা আরেকটু হলে কাজটা করেও ফেলেছিল সফল ভাবে। আঙ্কেল কার্ল আর তার সহযোগী কবরটার ভেতর থেকে পানির শব্দ পাচ্ছিলেন, কয়েকদিন যাবৎ বেশ বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যখন কাঠামোটির প্রায় তিন চতুর্থাংশ বের হয়ে আসে, তখন ক্রেনটাই উল্টে গিয়ে সেই কাঠামোর ওপর ধপাস করে পড়ে। ক্রেনের ভালো ক্ষতি হলেও ড্রাইভার শুধু তার নাকটা ভাঙার পর বেঁচে যায়। ওইদিনের ওইসব ঝামেলার জন্যে সরকারের তিন হাজার ডলার খরচ হয়, যেখানে গড়ে খরচ পড়ে নয়শ ডলারের মত। আঙ্কেল কার্ল এই গল্পটা বলেছিলেন ওই ক্রেনের অপারেটরের খাতিরে। কারণ ওই বেকুব ড্রাইভার ছয় বছর পরে ওই এলাকার ট্রাক-চালক সমতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিল।
আর লাইনার কবরগুলো খোলা এর চাইতে অনেক সহজ। এই কবরের বক্সের মত অংশটা বানানো হয় ঢালাই দিয়েই, কিন্তু খুব পাতলা কনক্রিট দিয়ে। আর ছাদ হিসেবেও হালকা একটা কনক্রিটের পাত দেয়া হয় আর সেটা শুধু বাক্সটার ওপর রেখে দেয়া হয়, কিছু দিয়ে আটকানো হয় না। যে কেউ একটু কায়দা করলেই সেটার ছাদ সরিয়ে লাশ বের করে নিতে পারবে। আর জাডও সেটাই ইঙ্গিত করছেন।
কায়দা করে যে কেউ তার ছেলের লাশ সেখান থেকে বের করে নিয়ে অন্য কোথাও কবর দিতে পারবে।
ছিহ্! আমরা এরকম কথা বলি না। এসব গোপন কথা।
হুম, আমি ভল্ট কবর আর লাইনার কবরের তফাতটা জানি বৈকি, লুইস বলে। “কিন্তু আপনি যা ভাবছেন সেরকম কোন চিন্তাই আমি করিনি।”
“লুইস-”
“অনেক রাত হয়েছে,” লুইস বলে। “অনেক রাত হয়েছে। আমার নেশা হয়ে গেছে আর বুকে ব্যথা করছে। আপনার যদি মনে হয় আমাকে গল্পটা শোনাবেন তাহলে আর আর দেরি করবেন না প্লিজ।” আমার উচিত ছিল বিয়ার না খেয়ে মার্টিনি খাওয়া। তাহলে দরজা খুলে বুড়োকে ঢুকতে দেয়ার আগেই বেহুশ হয়ে পড়তাম।
“আচ্ছা, লুইস। ধন্যবাদ।”
“বলুন।”
জাড কয়েক মুহূর্তের জন্যে চুপ করে থাকেন। এরপর তিনি বলতে শুরু করেন।
অধ্যায় ৩৯
“ওই সময়-মানে বিশ্বযুদ্ধের সময় আমাদের অরিংটনেও ট্রেন থামতো। বিল ব্যাটারম্যান তার ছেলে টিমির লাশ নেয়ার জন্যে স্টেশনে এসেছিলেন। চারজন ট্রেনের লোক তার ছেলের কফিনটা ধরাধরি করে নামায়। আমি তাদের মধ্যে একজন ছিলাম। লাশ নিয়ে এসেছিলেন একজন আর্মির লোক। তিনি একবারের জন্যেও ট্রেন থেকে নামেননি। তিনি তার বাকি বারোটা কফিনের সাথে ট্রেনের কামরার ভেতর নেশাগ্রস্থ হয়ে বসে ছিলেন।
“আমরা টিমিকে একটা ফিউনারেল হোমের ক্যাডিলাক গাড়িতে ওঠালাম। ওই সময় লাশ নেয়া লাগতো খুব দ্রুত, কারণ এখনকার মত লাশ পচা থামানোর মত ব্যবস্থা তখনো ছিল না। লাশ পচে যাওয়ার আগে কবর দেয়া অনেকটা রেসের মত ছিল। বিল ব্যাটারম্যান সবকিছু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। তার চেহারা পাথরের মত শক্ত হয়ে ছিল…তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন একটা অনুভূতিহীন পাথরের মূর্তি। তিনি এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেননি। হুয়ে গার্বার সেদিন লাশবাহী ট্রেনটা চালাচ্ছিলেন। সে আমাকে বলেছিল লাশগুলো নিয়ে আসা আর্মির লোকটা নিজেও একটা বিচিত্র ভ্রমণ করেছে।
আর্মির লোকটা হুয়ের কাছে এসে নিজের শার্ট থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করে গলায় বেশ কিছুটা চালান করে দিয়ে বলেছিলেন, “ড্রাইভার সাহেব কি জানেন যে আপনি আজ এক রহস্যময় ট্রেন চালাচ্ছেন?”
“হুয়ে তার মাথা নাড়েন।
“চালাচ্ছেন। না জানলেও চালাচ্ছেন। অন্তত এলাবামা স্টেটে লোকে এসব ট্রেনকে রহস্যময় ট্রেনই বলে। এরপর লোকটা নিজে বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে বলে ‘আমাদের হুল্টনে দুটা লাশ ডেলিভারি করে শুরু করতে হবে, এরপর একটা পাসাদুমকাগে, ব্যাঙ্গরে দুটো, একটা ডেরিতে আর একটা লাডলোতে…এবং আরো অনেকগুলো। আমার নিজেকে দুধওয়ালার মত মনে হচ্ছে। মাল খাবেন নাকি একটু?”
হুয়ে সেই প্রস্তাব নাকোচ করেন, কারণ তার তখনো অনেকটা পথ ট্রেনটা চালিয়ে নিতে হবে। আর তখন শহরের মাঝে দিয়ে ট্রেন চালানো এতো সহজও ছিল না। হুয়ে বলেছিলেন তারা যত জায়গায় লাশ ডেলিভারি দিয়েছেন সবখানেই লাশ নিতে আসা আত্মীয়-স্বজনদের কান্না-কাটি, শোকের মাতম দেখেছেন, শুধু লাডলো ছাড়া। ছেলের লাশ নিতে আসা বিলকে দেখে তার মনে হয়েছিল তিনি ভেতরে ভেতরে একদম মরে গিয়েছেন, এখন শুধু আত্মা পচে গন্ধ বের হওয়া বাকি। যখন হুয়ে গাড়ি থেকে নামলেন তিনি ওই আর্মির লোকটাকেও ডেকে নামালেন। এরপর তারা বেশ কয়টা ক্লাবে হানা দিলেন মাতাল হবার জন্যে। এমনকি তিনি না কি সেদিনই প্রথম কোন পতিতার সাথে বিছানায় গিয়েছিলেন। আর এরপর ঘুম থেকে উঠে হুয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এরপর থেকে তিনি কানে ধরেছেন যে আর কোনদিন ওইরকম ‘রহস্যের’ ট্রেন তিনি চালাবেন না।
টিমির মরদেহ গ্রীনস্পেন ফিউনারেল হোমে নিয়ে যাওয়া হয় এবং দুই দিন পর তাকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় প্লেজেন্টভিউ গোরস্থানে কবর দেয়া হয়।
“টিমির মা মারা গিয়েছিলেন তারো প্রায় দশ বছর আগে, টিমিকে জন্ম দিতে গিয়ে। তো বুড়ো বিলের জীবনে আসলে টিমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। তার ওই নিঃস্ব হয়ে যাওয়াটাই অনেকাংশে দায়ি, যা ঘটেছিল তার জন্যে। তার আরেকটা বাচ্চা থাকলে হয়তো সে এরকম কিছু করতো না, সে জানতো আরো কেউ কষ্টে আছে এবং তাকে তার সাহায্য করতে হবে শোক কাটিয়ে ওঠার জন্যে। লুইস, শোনঃ তুমি এদিক দিয়ে ভাগ্যবান, কারণ তোমার আরেকটি সন্তান আছে। তোমার একটি সন্তান আছে এবং স্ত্রীও আছে।
বিল তার ছেলের প্লাটুনের লেফটেনেন্টের হাতের যে চিঠি পেয়েছিলেন তাতে টিমির মৃত্যুর বর্ণনা ছিল। সে ১৯৪৩’র জুলাইয়ের পনেরো তারিখ রোম যাবার পথে গুলিতে নিহত হয়। তার মরদেহ দুইদিন পরে দেশে ফেরত আনা হয় আর সেটা লাইমস্টোনে পৌঁছে উনিশ তারিখে। টিমির লাশ এর পর দিনই হুয়ে গারবের রহস্যের ট্রেনে তুলে দেয়া হয়। বিশ্বযুদ্ধের আমেরিকান সৈন্য যারা ইউরোপে মারা গিয়েছিল তাদের বেশিরভাগকেই ইউরোপেই কবর দেয়া হয়। কিন্তু ওই ট্রেনে সেদিন যাদের যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল তারা সবাই স্পেশাল ছিল; টিমি মারা গিয়েছিল বীরের মত, একটা মেশিনগানের আস্তানা চার্জ করতে গিয়ে। সে মরনোত্তর সিলভার স্টার পদক পেয়েছিল।
“টিমিকে যেদিন কবর দেয়া হয়েছিল, তারিখটা আমার পরিস্কার মনে নেই, তবে খুব সম্ভবত বাইশে জুলাই। তার চার কী পাঁচদিন পরের ঘটনা। মার্জারি নামে এখানে এক মহিলা ডাকপিয়ন ছিলেন। তিনি সেদিন রাস্তায় টিমিকে হেঁটে যেতে দেখেন, ইয়র্কস লিভারি আস্তাবলের দিকে। তিনি তার গাড়ি নিয়ে রাস্তার পাশেই পড়ে যাচ্ছিলেন; বুঝতেই পারছো অবস্থাটা। তিনি সাথে সাথে পোস্ট অফিসে ফেরত গিয়ে জর্জ এন্ডারসনকে ডেস্কের ওপর তার পৌঁছে না দেয়া চিঠির ব্যাগ ছুঁড়ে মারেন এবং বলেন তিনি এক্ষুনি বাড়ির পথ ধরবেন।
“মার্জারি, তুমি কি অসুস্থ? তোমার মুখ বোয়াল মাছের পেটের মত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।”
“আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছি, কিন্তু আমি সেটা নিয়ে তোমাকে কিছু বলতে চাই না,” মার্জারি বলে। “আমি এ ব্যাপারে ব্রায়ানের সাথেও কথা বলতে চাই না, আমার মায়ের সাথেও না, কারো সাথেই না। মরার পর যিশু যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে তাহলে হয়তো বলতে পারি কিন্তু আমি নিশ্চিত না।”
“শহরের সবাই জানতো টিমির মৃত্যুর কথা। তার মৃত্যুর খবর এখানকার স্থানীয় দৈনিকে তো ছাপা হয়েছিলই আবার কয়েকটা জাতীয় দৈনিকেও ছাপা হয়েছিল। তার ফিউনারেলে শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ হাজির হয়। কিন্তু মার্জারি তাকে তার ফিউনারেলের পাঁচদিন পর দেখলেন, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে। তিনি অবশ্য এটা জর্জ এন্ডারসনকে বলেছিলেন অবশেষে, বিশ বছর পর, তিনি যখন তার মৃত্যুশয্যায়। জর্জ আমাকে বলেছিল তিনি তার মৃত্যুর আগে ওই ঘটনাটা কাউকে বলে যেতে চেয়েছিলেন। জর্জ বলেছিল ওই ঘটনাটা মহিলাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
“টিমিকে তিনি প্রচন্ড ফ্যাকাসে দেখেছিলেন। তার পরনে ছিল একটা পুরনো প্যান্ট আর একটা শিকারের জ্যাকেট, যদিও সেদিন চারদিক গরমে খা খা করছিল। তার চুলগুলো পেছনের দিকে টানা ছিল আর চোখগুলোকে লাগছিল কেকের ওপর লেগে থাকা কিসমিসের মত। তিনি জর্জকে বলেছিলেন, ‘আমি সেদিন ভূত দেখেছিলাম, জর্জি। তাই আমি সেদিন ওরকম ভয় পেয়েছিলাম। আমি কখনো চিন্তাও করিনি এরকম কিছু দেখবো।
যাই হোক, এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। খুব শীঘ্রই আরো কিছু লোক টিমিকে দেখতে পায়। মিসেস স্টার্টন; যাকে আমরা সবাই মিসেস ডাকতাম কিন্তু তার আসলেই বিয়ে হয়েছিল কি না কেউ জানতো না। তার গানের রেকর্ডের বেশ ভালো কালেকশান ছিল। তুমি তাকে ১০ ডলার দিলেই সে তোমার জন্যে পার্টির আয়োজন করে ফেলতো আর পার্টি শেষে বিছানায় যেতেও কোন আপত্তি করতো না। তিনি পেড্রেসন রোড যেখানে হেনকক রোডের সাথে মিলেছে সেখানে একটা দুই রুমের বাসায় একা থাকতেন। তার বাসার বারান্দা থেকে টিমিকে দেখছিলেন। তার ভাষ্যমতে টিমি তার বাসার সামনের রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল।
“ও শুধু সেখানে দাড়িয়ে ছিল। তার হাত দুটো দুপাশে ঝুলছিল, আর তার মাথাটা অস্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছিল। মিসেস বলেছিলেন এই দেখে তিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই পাথরের মত দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর টিমি ঘুরতে শুরু করে। সে প্রথমে তার এক পা এগিয়ে দেয় এবং পরে আরেক পা এতো সামনে রাখে যে সে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল। এরপর টিমি একদম তার চোখ বরাবর তাকায়। তা দেখে তার হৃৎপিন্ড প্রায় বন্ধই হয়ে যায় আর কি। তিনি এতোটাই চমকে গিয়েছিলেন যে তার হাতের কাপড়ের ঝুঁড়িটা হাত থেকে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
“তিনিও টিমির চোখগুলোর কথা বলেছিলেন। তার মতে টিমির চোখগুলো ছিল একদম মৃত, মার্বেলের মত ঘোলাটে। কিন্তু তিনি বলেছিলেন যে টিমি তাকে ঠিকই দেখতে পেয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে সে মুচকি হাসে। শুধু হাসি না, সে তাকে উদ্দেশ্য করে কথাও বলে। টিমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার সেই রেকর্ডের কালেকশান এখনো আছে কি না। থাকলে সে হয়তো এসে তার সাথে সঙ্গিত চর্চা করবে, আবার রাতও কাটাবে; হয়তো সেদিন রাতেই। এরপর মিসেস স্টার্টন দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেন এবং পরের পুরো এক সপ্তাহ তিনি আর ঘর থেকে বের হননি। ততদিনে অবশ্য ঝামেলাও শেষ হয়ে যায়।
“অনেকেই টিমিকে দেখেছে। তাদের বেশিরভাগই এখন কবরে। তবে কয়েকজন এখনো বেঁচে আছে, যেমন আমি। এদেরকে ঠিকভাবে জিজ্ঞেস করলে তুমি এই ঘটনা জানতে পারবে।
“আমরা ওকে দেখেছিলাম। ও তার বাবার বাসার সামনের পেড্রেসন রোড দিয়ে হেঁটে একবার এক মাইল পূর্বে যাচ্ছিল আবার এক মাইল পশ্চিমে যাচ্ছিল। এই আগু-পিছু সে সারাদিন করতে থাকে; কে জানে, হয়তো সারা রাতও করেছে। শার্ট অর্ধেক ইন থেকে বের হয়ে আছে, প্যান্টের চেন খোলা, ফ্যাকাশে মুখ…আর সেই চাহনি….”
জাড একটা সিগারেট ধরানোর জন্যে থামলেন। ম্যাচের কাঠির নীল ধোয়ার ভেতর দিয়ে তিনি লুইসের দিকে তাকালেন। গল্পটা যতই উদ্ভট হোক, তার চোখে একবিন্দু মিথ্যাও ছিল না।
“হরর মুভিতে এখন অনেক জম্বি দেখা যায়। তারা হেলতে দুলতে হাটে, ধীরে স্থিরে। তাদের চোখগুলোও থাকে তাদের মতই মৃত। টিমি ব্যাটারম্যানও সেরকমই ছিল; জম্বির মতই, কিন্তু জম্বি থেকে আরো বেশি কিছু। তার চোখগুলোর পেছনে কিছু একটা ছিল, লুইস। সেটাও আবার সব সময় বোঝা যায় না। সেটা কি ছিল আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। হয়তো বুদ্ধিমত্তা…না এই শব্দ এখানে ব্যবহার করা একদম ঠিক হবে না।
“জিনিসটা বেশ চতুর ছিল। সে যেভাবে মিসেস স্টার্টনের সাথে রাত কাটানোর কথা বলেছে তাতে অতটুকু অন্তত বোঝা যায়। তার ভেতরে কিছু চলছিল, কিন্তু সেটাকে ‘চিন্তা শক্তি’ আমি বলবো না। আর আমার এটাও মনে হয় না তার ভেতরের সেই জিনিসটা টিমির সত্তা…টিমির সাথে সেটার কোন মিল ছিল না। ওকে দেখলে মনে হবে ওকে নিয়ন্ত্রণ করছে কেউ দূর থেকে বসে, রেডিও সিগনালের মত কিছু দিয়ে। মনে হবে ও যদি তোমাকে স্পর্শ করে তাহলে তুমি চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেলবে।
“পরদিন আমি কাজ থেকে বাসায় ফিরে দেখি জর্জ এন্ডারসন আমার বাসার পোর্চে বসে বরফ চা খাচ্ছে। তার সাথে আরো ছিল হানিবল বেনসন, যে তখন আমাদের এলাকার নির্বাচিত কর্তাদের মধ্যে দ্বিতীয় আর এলান পুরিন্টন, যে ছিল ফায়ার সার্ভিসের চিফ। নরমাও সেখানে বসেছিল, কিন্তু ও একটা কথাও বলেনি।
“জর্জ তার কাটা পায়ের ডগায় ম্যাসেজ করছিল। রেলে কাজ করার সময় অ্যাক্সিডেন্টে তার পা কাটা যায়। গরমের দিনে ওই কাটা জায়গায় ওর খুব ব্যথা হতো। ও সেই অবস্থাতেই আমার বাসায় এসেছিল, পরিস্থিতির কারণে।
“ঘটনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে,’ জর্জ আমাকে বলে। ‘একদিকে আমার একজন মহিলা ডাক-পিওন আছে যে ওই পেড্রেসন রোডে চিঠি বিলি করতে যাবে না, তার গলা কেটে ফেললেও না। আবার অন্যদিকে এই সমস্যা সরকারের কাছেও একটা বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।”
“সরকারের সাথে আবার কী হলো?’ আমি জিজ্ঞেস করি
“হানিবল বলছিল ওয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে তার কাছে এক কিংসম্যান নামের লেফট্যানেন্ট ফোন করেছিল। তার কাজ হচ্ছে গুজব থেকে সত্য বের করা। ‘ওয়ার ডিপার্টমেন্টের কাছে চার-পাঁচটা চিঠি গিয়েছে এবং চিঠি পড়ে কিংসম্যান একটু চিন্তিতও বটে। যদি একজন একটা চিঠি লিখত তাহলে সেটা হেসে উড়িয়ে দেয়া যেত। আবার একই লোক যদি সবগুলো চিঠি লিখে পাঠাতো তাহলেও কিংসম্যান লোকাল পুলিশের কাছে ফোন করে বলতো যে তাদের এখানে একটা সাইকোপ্যাথ আছে যার হয়তো ব্যাটারম্যান পরিবারের সাথে কোন শত্রুতা ছিল। কিন্তু চিঠিগুলোর হাতের লেখা ছিল বিভিন্ন মানুষের, আর তারা সবাই একই ঘটনা বলছিল। তাদের কথা হচ্ছে টিমি ব্যাটারম্যান যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে তাদের রাস্তায় তার জীবন্ত লাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
“এই কিংসম্যান কোন লোক পাঠাবে বা নিজেই চলে আসবে যদি ঝামেলাটা আরো দূরে গড়ায়,’ হানিবল বলে।
“তারা জানতে চায় টিমি আসলেই মারা গিয়েছে কি না; আর না হলে কফিনের ভেতর টিমির বদলে কে শুয়ে আছে।”
“লুইস, তুমি বুঝতেই পারছো কী রকম একটা লেজে গোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছিল। আমরা সেখানে ঘন্টাখানেক বসে আলাপ করি আর বরফ চা খাই। নরমা একবার জিজ্ঞেস করেছিল স্যান্ডউইচ বানিয়ে আনবে কি না। আমরা সবাই না করি
“আমরা নানান রকম ফন্দি ফিকির করলাম কিভাবে কি করা যায়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা ব্যাটারম্যানদের বাড়িতে সশরীরে যাব। আমি সেই রাতের কথা কখনোই ভুলবো না, এমনকি যদি আরো একশ বছরও বেঁচে থাকি। সেদিন ছিল মারাত্মক গরম, মনে হচ্ছিল নরক তার প্রত্যেকটা দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে। আমাদের কারোরই ইচ্ছে ছিল না সেখানে যাওয়ার, কিন্তু আমাদের সেখানে যাওয়াটা ছিল খুবই প্রয়োজন। নরমাও সেটা বুঝতে পেরেছিল। তাও ও অন্য একটা দরকারের ছুঁতোয় আমাকে ভেতরে ডেকে বলেছিল, ‘ওদের পিছিয়ে আসতে দিয়ো না খবরদার। তোমরা যেটা করতে যাচ্ছো সেটা শেষ করে আসবে। এরকম বীভৎস ঘটনা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।”
জাড লুইসের দিকে তাকিয়ে তাকে পরীক্ষা করলেন।
“নরমা এই শব্দটাই ব্যাবহার করেছিল। বীভৎস। এরপর ও প্রায় কানে কানে আমাকে বলে, ‘কিছু উল্টাপাল্টা ঘটলে কোন দিকে, কারো দিকে না তাকিয়ে খিচে দৌড়াতে শুরু করবে। প্রত্যেকের দায়িত্ব তার নিজের নিজের। তুমি আমার কথা চিন্তা করে পালিয়ে আসবে কিছু ঘটলে।”
“আমরা সবাই হানিবল বেনসনের গাড়িতে করে রওনা হলাম; ওই শালার তখন আঙুল ফুলে কলাগাছ অবস্থা। গাড়িতে আমরা সবাই চুপচাপ ছিলাম আর চিমনির মত সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিলাম।
“যাই হোক আমরা সেখানে পৌঁছানোর পর এলেন বাড়ির মূল দরজায় নক করে, কিন্তু কেউ জবাব দেয় না। এরপর আমরা বাড়িটার পেছনে গিয়ে দেখলাম বিল ব্যাটারম্যান বাড়িটার পেছনের সিঁড়ির ওপর বসে আছে একটা বিয়ারের কেস নিয়ে। আর টিমি পেছনের উঠোনে দাঁড়িয়ে ডুবতে থাকা লাল সূর্যটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সূর্যের কমলা রোদে তার ফ্যাকাসে মুখটাও কমলা লাগছিল; মনে হচ্ছিল ওর মুখের চামড়া জীবন্ত অবস্থায় কেউ খুলে নিয়েছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল শয়তানের কাছ থেকে সাত দিনের দীক্ষা লাভ করার পর ও শয়তানের শিষ্য হয়েছে। ওর জামাগুলো থলথল করছিল; ওর কম করে হলেও পচিশ কেজি ওজন কমেছে। ওর চোখগুলো একদম ভেতরে বসে গিয়েছিল। চোখগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল দুটো গর্ত আর গর্তগুলোর ভেতর কোন পশু লুকিয়ে আছে। তার ঠোঁট দুটো লাফাচ্ছিল, বাম দিকে, ঘড়ির কাটার মতন।
জাড কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করে বলে, “ওকে একদম অভিশপ্তের মত লাগছিল।”
টিমি আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসে…এমন বীভৎস সেই হাসি, লুইস, দেখলে তোমার গলা ফাটিয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসবে। এরপর টিমি আবার সূর্যাস্ত দেখায় মন দেয়। বিল বলেন, ‘আমি তোমাদের নক শুনতে পাইনি, ‘ যেটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা কারণ এলেন এমন ভয়ঙ্করভাবে দরজায় শব্দ করেছে যা শুনলে…শুনলে বধির লোকও লাফিয়ে উঠবে।
“পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল কেউ কিছু বলবে না। তাই আমি নিজেই বলি, ‘বিল, আমরা শুনেছিলাম আপনার ছেলে ইতালিতে মারা গিয়েছিল।”
“সেটা একটা ভুল কথা,’ তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন। “তাই না কি?’ আমি বলি।
“তুমি ওকে ওখানে দেখতে পাচ্ছো না? না কী কানা হয়ে গেছ?”
“আচ্ছা, তাহলে প্লেজেন্টভিউ গোরস্থানে কবর দেয়া কফিনে কে ছিল?” এলেন এবার জিজ্ঞেস করে।
“তার আমি কী জানি?’ বিল বলেন, ‘আর তাতে আমার কিছু যায় আসে ও না।” এরপর তিনি একটা সিগারেটের প্যাক থেকে সিগারেট বের করতে গেলে হাত ফসকে সবগুলো সিগারেট মাটিতে পড়ে যায়। এরপর তিনি সেগুলো তুলতে গেলে দু/তিনটা ভেঙেও ফেলেন।
“‘হয়তো লাশ উত্তলন করে দেখা হবে,’ হানিবল বলে। ‘আমাকে ওয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন দেয়া হয়েছিল, বিল। তারা জানতে চায় টিমির বদলে অন্য কোন মায়ের ছেলেকে কবর দেয়া হয়েছে কি না।”
“তাতে আমার কি? বিল উচ্চস্বরে বলেন। ‘আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি আমি তাতেই খুশি। টিমি সেদিন বাসায় এসে হাজির। ও হয়তো শেলের আঘাত থেকে শকে আছে অথবা ওরকম কিছু। একটু কেমন কেমন করছে, কিন্তু আমি জানি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আসেন আমরা ফাজলামি বন্ধ করি,’ আমি বলি। আমার হঠাৎ করেই মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়। “তারা যদি ওই কফিন খুঁড়ে তুলে তাহলে দেখবে সেটা একদম ফাঁকা। আমি জানি কী ঘটেছে, হানিবাল, জর্জ আর এলেনও জানে কি ঘটেছে এবং আপনিও খুব ভাল করেই জানেন কি ঘটেছে। আপনি জঙ্গলে গিয়ে খুব জঘন্য একটা কাজ করেছেন এবং আপনার নিজের ওপর আর এই শহরের ওপর গজব ডেকে এনেছেন।”
“তোমরা আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও,” তিনি বললেন। “তোমাদের কাছে আমার কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি যখন ওই টেলিগ্রামটা পেয়েছিলাম আমার আত্মা আমার শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, সেই অনুভূতি তোমরা বুঝবে না। যাই হোক, আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি এতেই আমি খুশি। ওদের কোন অধিকার ছিল না আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার। ওর বয়স মাত্র সতেরো। আমার জীবনে আমার ছেলেই একমাত্র সম্বল আর ওদের কাজটা ছিল অবৈধ, একদম অবৈধ। আমি মারা খাক, ওয়ার ডিপার্টমেন্ট মারা খাক, ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা মারা খাক আর তোমরাও মারা খাও। ও আমার কাছে ফিরে এসেছে। ও ঠিক হয়ে যাবে। আমার আর কিছুই বলার নেই। তোমরা এখন বিদেয় হও।”
“টিমির ঠোঁটগুলো বিকৃত হয়ে হয়ে কাঁপছিল। ওর কপাল বেয়ে বড় বড় ফোটায় ঘাম ঝরছিল। আর আমি তখনই খেয়াল করি যে ও একটা উন্মাদ। জিনিসটা হয়তো আমাকেও উন্মাদ বানিয়ে দিতো।”
লুইসের পেটে কেমন কেমন করছে। সে খুব দ্রুত অনেকগুলো বিয়ার খেয়ে ফেলেছে। বেশ বুঝতে পারছে কিছুক্ষনের মধ্যেই তার হড়হড় করে বমি হবে, সে। পেটের গুড়গুড়ানি তাকে জানান দিচ্ছে তার আর বেশি দেরি নেই।
“এরপর আমাদের আর কিছু করার ছিল না। আমরা ফেরার প্রস্তুতি নেই। হানিবল বলে, ‘বিল, খোদা তোমাকে রক্ষা করুক।”
“বিল বলেন, ‘খোদা আমাকে রক্ষা করেননি, আমি নিজেই নিজেকে রক্ষা করেছি।”
“তখনি টিমি আমাদের দিকে হেঁটে আসে। ও ঠিক মত হাঁটতেও পারছিল না। ওর হাঁটার ধরন ছিল অনেকটা বুড়োদের মত। সে তার এক পা অনেক উচুতে উঠিয়ে দেয়, এরপর সেটা সামনে এনে ধপাস করে ফেলে, এরপর একইভাবে আরেক পা… ওকে দেখলে কাঁকড়ার হাঁটাচলার কথা মনে পড়ে। ওর হাতগুলো প্রায় ওর হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছিল। ও যখন বেশ কাছে চলে আসে তখন ওর মুখে লাল লাল দাগ দেখা যায়, দাগগুলো ব্রনের মত বা ছোট ছোট পোড়ার মত। আমার ধারণা ওগুলো ছিল মেশিন গানের বুলেটের ছিদ্র। ওর মাথা গুলির চোটে প্রায় উড়েই গিয়েছিল।
“আর ওর গায়ে কবরের গন্ধ ছিল। এক রকমের কালো গন্ধ, যেন ওর ভেতরের সবকিছু পচে গেছে। আমি দেখলাম এলেন হাত দিয়ে নিজের নাক চাপা দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর বাজে গন্ধ। গন্ধের চোটে মনে হবে এখনি ওর সারা গায়ে পোকা কিলবিল করতে দেখবে।
“থামুন,” লুইস কর্কশ কণ্ঠে বলে। “অনেক শুনেছি।”
“না, শোননি,” জাড বলেন। তিনি খুব দৃঢ় কণ্ঠে বলেন। “পুরোপুরি না। সেখানে যা ঘটেছিল তা মুখে বলে বোঝানো সম্ভব না। ব্যাপারটা যে কতটা জঘন্য ছিল তা বোঝার জন্যে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে, লুইস। সে ছিল মৃত, আবার জীবিতও। আর সে…সে…সে কিছু কিছু জিনিস জানতো।”
“কিছু জানতো, মানে?” লুইস সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে।
“হুম। সে এলেনের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দাঁত বের করে হাসে। এরপর সে নিচু গলায় কিছু বলে। তার কন্ঠ এতোই ক্ষীণ ছিল যে সেটা শুনতে তোমাকে ঝুঁকে পড়তে হবে। আর তার গলার শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল তার কণ্ঠনালীর ভেতর নুঢ়ি পাথর ঢুকে আছে। ‘তোমার বৌ ড্রাগস্টোরে যেই ব্যাটার সাথে কাজ করে তার সাথে শুয়ে বেড়াচ্ছে, বুঝলে পুরিন্টন? তোমার বউয়ের হয়ে যাওয়ার সময় ও চিৎকার করে ওঠে। কী করবে তুমি পুরিন্টন?’
“এলেন একদম চমকে যায়, তুমি ওকে দেখলেই বুঝতে কথাটা ওর গায়ে লেগেছে। এলেন এখন একটা নার্সিং হোমের বাসিন্দা, শেষবার যা শুনেছি। ওর বয়স এখন নব্বই এর মত। ওই সময় ওর বয়স ছিল চল্লিশ আর সেসময় ওর দ্বিতীয় বউ নিয়ে লোকমুখে নানান রসালো কথা ঘুরে বেড়াতো। তার ওই বউ ওর দূরসম্পর্কের কাজিন। সে এলেন আর তার প্রথম বউ লুসির সাথে কিছুদিনের জন্যে থাকতে এসেছিল। লুসি যুদ্ধের আগে দিয়ে মারা যায় আর তার এক বছর পর এলেন ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে বসে। মেয়েটার নাম ছিল লরিন, বয়স তখন চব্বিশ এর মত হবে। তখন থেকেই তার নামে নানান কথা বলতো লোকে, যে ওকে সহজেই পটিয়ে বিছানায় নেয়া যায় এরকম বিভিন্ন কথা বার্তা। কিন্তু ওই মেয়ে ভাবতো কেউ কিছুই বুঝে না। এলেনও হয়তো এসব নিয়ে দু-একবার ভেবেছে কারণ সে চিৎকার করে বলে উঠেছিল, ‘চুপ শালা! পাছায় লাথি মারবো শুয়োরের বাচ্চা!”
“চুপ করো টিমি,’ বিল বলেন। বিলকেও অসুস্থ দেখাচ্ছিল, যেন তিনি তখনি ফিট হয়ে যাবেন বা বমি করে চারদিক ভাসিয়ে দিবেন। ‘একদম চুপ, টিমি।”
“কিন্তু টিমি তার বাবার কথা গ্রাহ্যই করলো না। এরপর সে জর্জ এন্ডারসনের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার নাতি, যার জন্যে তুমি একটা দোকান করে দিয়েছো, সে তোমার মরার জন্যে দিন গুনছে। সে শুধু তোমার টাকার আশায় তোমার দেখাশোনা করে। ইস্টার্ন ব্যাংকে জমানো তোমার টাকার লোভে। এজন্যেই সে তোমার এতো খাতির করে। কিন্তু পিছে সে তোমার নামে টিটকারি মেরে ল্যাংড়া বুড়ো বলে; ও আর ওর বোন দুজনই।” লুইস, বিশ্বাস করবে না, টিমির গলা এর মধ্যেই অন্যরকম হয়ে গেছে। ওকে আরো নিষ্ঠুর শোনাচ্ছিল। ও এমনভাবে বলছিল যেন সাক্ষাত এন্ডারসনের নাতিই কথাগুলো বলছিল।
“কী আশা নিয়েই না তোমার নাতি তোমার মরনের জন্যে প্রতিক্ষা করছে! কিন্তু যখন তোমার মরার পর ও জানবে যে তোমার ফুটো কড়িটাও নেই, তখন কি হবে জর্জ?”
“কথাটা শুনে বিল হকচকিয়ে পিছিয়ে যায় আর বাড়ির বারান্দার সিঁড়িতে পা হড়কে ও মাটিতে পড়ে যায়।
“বিল কোনরকমে জর্জকে আবার দাঁড় করায় আর টিমিকে ধমকে ধমকে চুপ করতে বলেন। এরপর টিমি হানিবলের সম্পর্কে কিছু বলে, এরপর আমার সম্পর্কে। ততক্ষণে ও বদ্ধ উন্মাদের মত ক্ষিপ্রভাবে কথা বলছে, চিৎকার করছে। আমরাও ততক্ষণে পেছাতে থাকি, আর এরপর দৌড়ে পালাতে শুরু করি। জর্জ পড়ে যাওয়ায় ওর নকল পা টা নড়ে যায়। তার পা এখন উল্টোদিকে দেখাচ্ছে। আমরা ওকে আমাদের কাঁধে ভর দিয়ে কোন রকমে সেখান থেকে পালাই।
“আমি টিমিকে তখনই শেষ দেখি। বিকেলের শেষ রোদে তাকে একদম লাল দেখাচ্ছিল, তার মুখের দাগগুলো, উস্কোখুস্কো চুল… সে আমাদের লক্ষ্য করে চিৎকার করছিল আর গলা ফাটিয়ে হাসছিল। ‘বোকাচোদা! ল্যাংড়া বুড়ো! ভদ্দরলোক! মাগীবাজ!’ এগুলো সে বার বার বলতে থাকে আর এরপর সে হাসতে শুরু করে। আসলে সে চিৎকার করছিল…তার ভেতর থেকে কিছু একটা সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করছিল।”
জাড থামলেন। তিনি বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছেন।
“জাড,” লুইস বলে। “টিমি যেসব বলেছিল…সেগুলো কি সত্যি?”
“সত্য,” জাড বিড়বিড় করে বলে। “ওহ খোদা! সেসব একদম সত্য ছিল। আমি ব্যাঙ্গরের একটা বেশ্যা পাড়ায় যেতাম মাঝে মাঝে। যেটায় এখানকার অনেকই যেতো। আমার মাঝে মাঝে একঘেয়েমি চলে আসলে নতুনত্বের খোঁজে সেখানে যেতাম। অথবা যেসব জিনিস আমার স্ত্রী করতে চাইতো না সেসব কোন মহিলাকে দিয়ে টাকার বিনিময়ে করিয়ে নিতাম। কিন্তু সেসব আমি তখন থেকে আরো সাত/আট বছর আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এসব নরমা জানতে পারলে আমাকে যে ছেড়ে চলে যেতো তা না, তবে ওর মনের ভেতরে কিছু একটা মরে যেত, চিরতরে; খুব প্রিয় আর মধুর কিছু।”
জাড়ের চোখ লাল হয়ে ফুলে গেছে। বুড়ো মানুষের চোখের জল খুব কুৎসিত, লুইস ভাবে। কিন্তু জাড যখন তার হাত ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। লুইস তার হাত খুব শক্ত করে ধরলো।
“সে আমাদের খারাপ দিকটাই শুধু বলেছিল,” তিনি কয়েক মুহূর্ত পরে বলেন। “শুধুই খারাপগুলো। আর খোদা জানে যে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই যথেষ্ট খারাপ জিনিস আছে, তাই না? তার দুই/তিন দিন পর এলেনের দ্বিতীয় বউ লরিন চিরতরে লাডলো ছেড়ে চলে যায়। আর এই ব্যাপারে এলেন আমাদের সাথে কখনোই কোন কথা বলেনি। জর্জ মারা গিয়েছিল ১৯৫০ সালে। তার মৃত্যুর পর সে তার নাতি নাতনীদের জন্যে কিছু রেখে গিয়েছিলেন বলে শুনিনি। হানিবলকে ওর অফিস থেকে বের করে দেয়া হয়, টিমি তাকে যেই দোষ দিয়েছিল ঠিক সেরকম একটা দোষে। সেটা কী ছিল আমি তোমাকে বলবো না, তবে এটুকু বলতে পারি সেটা ছিল শহরের ফান্ড থেকে তার নিজের সুবিধার জন্যে খরচ করা। এরকম কথাও শোনা যাচ্ছিল তাকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করা হবে, কিন্তু সেটা আর করা হয়নি। তাকে চাকরি থেকে বের করে দেয়াই যথেষ্ঠ কঠিন শাস্তি ছিল তার জন্যে। সে আকাশ থেকে এক লাথিতে মাটিতে এসে পড়ে।
“কিন্তু এসব মানুষের মধ্যে অনেক ভালো জিনিসও ছিল। কিন্তু মানুষ সেটা ভুলে যায়। হানিবলই কিন্তু ইস্টার্ন জেনারেল হাসপাতালের ফান্ড জোগাড় করে দিয়েছিল, ঠিক যুদ্ধের আগে দিয়ে। এলেন ছিল আমার চেনা সবচাইতে দরাজ দিলের লোক, সে বহু মানুষের উপকার করেছে। আর জর্জ এন্ডারসন শুধু চেয়েছিল পোস্ট অফিসের দায়িত্বটা খুব ভালোভাবে চালিয়ে নিতে, তার সাধ্য মত।
“কিন্তু সেই জিনিসটা শুধু আমাদের খারাপ দিকগুলোই বলেছিল। সে চেয়েছিল আমরা আমাদের খারাপ দিকগুলোই মনে রাখি কারণ সেটা নিজেই খারাপ ছিল…আর সে জানতো যে আমরা ওর জন্যে বিপজ্জনক। যুদ্ধে যাবার আগে যেই টিমি ব্যাটারম্যানকে আমরা চিনতাম সে ছিল খুবই ভদ্র একটা ছেলে। হয়তো একটু বোকা, কিন্তু খুব ভালো মনের। কিন্তু সেদিন আমরা যাকে দেখেছিলাম, যে লাল সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল…সেটা ছিল একটা শয়তান। অথবা একটা জম্বি অথবা একটা ভূত। হয়তো সেটা কি ছিল সেই নামটাও আমি জানি না, তবে আমার ধারনা মিকমেকরা হয়তো ঠিকই বলতে পারবে।
“কী?” লুইস অসাড়ভাবে জিজ্ঞেস করে।
“যে জিনিসকে উয়িন্ডিগো ছুয়ে দিয়েছে,” জাড বললেন। তিনি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরে সেটা ছাড়লেন। এরপর তিনি নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকালেন।
“ওহ! অনেক রাত হয়ে গেছে, লুইস। আমি যতটুক বলবো ভেবেছিলাম তার দশ গুন বলে ফেলেছি।”
“আমার মনে হয় না,” লুইস বলে। “খুব দ্রুতই বলেছেন। এখন বলুন ঘটনার শেষটা কিভাবে হলো।”
“দুদিন পরে ব্যাটারম্যানদের বাড়ি আগুনে পুড়ে যায়,” জাড বলেন। “বাড়িটা একদম পুড়ে গিয়েছিল। এলেন বলেছিল যে কোন সন্দেহ নেই বাড়িটাতে ইচ্ছে করেই আগুন লাগানো হয়েছে। বাড়ির একমাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত কেরোসিন ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই তেলের গন্ধ তিনদিন পরেও পাওয়া যাচ্ছিল।”
“তারা দুজনেই পুড়ে যায়?”
“হুম, তারা পুড়ে যায় ঠিকই। কিন্তু তারা আগে থেকেই মৃত ছিল। টিমির বুকে দুইবার গুলি করা হয় একটা পুরনো কোল্ট পিস্তল দিয়ে, যেটা বিলের হাতে পাওয়া গিয়েছিল। সবকিছু দেখে যা মনে হয় তা হলো, বিল প্রথমে তার ছেলেকে গুলি করে খুন করে। এরপর তাকে বিছানায় শুইয়ে সে পুরো বাড়িতে কেরোসিন ছিটিয়ে দেয়। এরপর সে নিজের ইজি চেয়ারে বসে কোল্ট পিস্তলের নলটা নিজের মুখে পুরে নেয়।”
“ওহ খোদা!” লুইস বলে।
“তাদের লাশ ভীষনভাবে পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কাউন্টি মেডিকেল অফিসার লাশ পরীক্ষা করে বলেছিলেন টিমি প্রায় দুই/তিন সপ্তাহ আগেই মারা গিয়েছে।”
নীরবতা।
জাড উঠে দাঁড়ান। “আমি যখন বলেছিলাম হয়তো আমিই তোমার ছেলেকে মেরে ফেলেছি তখন আমি একটুও বাড়িয়ে বলিনি। মিকমেকদের গোরস্থানটা খুব শক্তিশালী একটা জায়গা। মিকমেকরা এটার সম্পর্কে জানতো কিন্তু তার মানে এই না যে জায়গাটার জন্যে তারাই দায়ি। জায়গাটা খুবই বাজে একটা জায়গা। আমার কখনোই উচিত হয়নি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া, সেটা আমি এখন বুঝতে পারছি। জায়গাটার ক্ষমতা আছে ঠিক, কিন্তু তুমি যদি তোমার আর তোমার পরিবারের ভালো চাও তাহলে সেই ক্ষমতা থেকে সাবধান থাকবে। আমি ওই ক্ষমতার কাছে তখন খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। তুমি নরমার জীবন বাঁচিয়েছিলে আর তাই আমি তোমার উপকার করতে চেয়েছিলাম। আর এই সুযোগ নিয়ে ওই বদ জায়গাটা আমার ভালো নিয়তকে খারাপ কাজে ব্যাবহার করেছে। জায়গাটার ক্ষমতা আছে… আমার ধারনা সেই ক্ষমতা আসে ধাপে ধাপে, অনেকটা চাঁদের মত। সেটা আগেও ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছিল, আর আমার ভয় হচ্ছে সেটা সামনেও আবার ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসবে। আমার ধারনা জায়গাটা আমার মাধ্যমে তোমার কাছে পৌঁছাতে চাইছে তোমার ছেলের উসিলায়। তুমি বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি?” তিনি কাতর চোখে লুইসের দিকে তাকান।
“আমার মনে হয় আপনি বলতে চাইছেন যে জায়গাটা জানতো যে গেজ মারা যাবে,” লুইস বলে।
“না, আমি বলতে চাইছি ওই জায়গাটাই হয়তো গেজকে খুন করেছে কারণ আমি তোমাকে সেখানকার ক্ষমতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আমি বলতে চাইছি আমি হয়তো ভালো নিয়তে তোমার ছেলেকে খুন করেছি, লুইস।”
“আমি এসব বিশ্বাস করি না,” লুইস কাঁপা কাঁপা গলায় বলে। “আমরা কালকে গেজকে ব্যাঙ্গরে কবর দিচ্ছি। ও ব্যাঙ্গরেই থাকবে। আমার ওকে পেট সেমেটারি বা তার পিছনে নিয়ে কবর দেয়ার কোন ইচ্ছে নেই।”
“প্রমিজ করো! জাড শক্ত গলায় বলেন। “আমাকে প্রমিজ করো।”
“প্রমিজ,” লুইস বলে।
কিন্তু তার মনের পেছনে একটা ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, একটা ক্ষীণ আশার ভাবনা। সেটা কোনভাবেই তার মন থেকে যাচ্ছে না।