অধ্যায় ৩৫
লুইস ক্রিডের বিশ্বাস তার জীবনের শেষ অতি আনন্দের দিন ছিল মার্চ ২৪, ১৯৮৪। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই তার জীবনে চরম বেদনার শীতলতা নেমে আসে। তার ধারণা, ওসব বেদনাদায়ক ঘটনা না ঘটলেও সে সেই দিনটার কথা সবসময়ই মনে রাখতো। মানুষের জীবনে খুশির দিন-একদম বিশুদ্ধ খুশির দিন-খুব একটা এমনিতেও আসে না। একজন সাধারন মানুষের জীবনে হয়তো টর্চ দিয়ে খুঁজলেও ত্রিশদিনের বেশি নির্ভেজাল আনন্দের দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। লুইসের মনে হয়, ঈশ্বর তার অসীম জ্ঞান নিয়ে মানুষকে আনন্দ থেকে বেদনা দিয়ে পরীক্ষা করতেই বেশি ভালোবাসেন।
দিনটি ছিল রোববার। রাচেল আর এলি দুপুরে বাজার করতে যায় আর গেজকে দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। তারা জাডের সাথে জাডের পুরনো পিকাপে চড়ে গেছে। তাদের নিজেদের গাড়ি ঠিকই আছে তবে বুড়ো তাদের সাথে কিছু সময় কাটাতে বেশ পছন্দ করবেন ভেবেই এই ব্যবস্থা। রাচেল লুইসকে জিজ্ঞেস করেছিল গেজকে দেখাশোনা করতে তার কোন সমস্যা আছে কি না। সে খুশি মনেই বলে কোন সমস্যা নেই। মন থেকেই সে চাইছিল রাচেল একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসুক; শীতে তেমন একটা বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি ও।
গেজ বেলা দুটোর দিকে জেগে ওঠে এবং উঠেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এই মহাজগতের ব্যাপারে সে মহাবিরক্ত। লুইস নানান কায়দা কসরত করে তাকে খুশি করার চেষ্টা করে কিন্তু সবই বিফলে যায়। তার ওপর গেজ পায়খানা করে দেয়, এবং সে পায়খানার আয়তন আশ্চর্যজনক। লুইস সেই বিরাট পায়খানার ওপর একটা নীল মার্বেল দেখতে পায়, এলির মার্বেল। লুইস মনে মনে ঠিক করে এলির মার্বেল সব বাসা থেকে ফেলে দিতে হবে। সিদ্ধান্তটা খুবই প্রশংসনীয়, কিন্তু তাতে গেজের বিরক্ত মেজাজ একদমই পরিবর্তন হয় না।
লুইস বাইরে বসন্তের বাতাসের আনাগোনা শুনতে পায় আর পাশের মাঠে মেঘের ছায়া আর রোদের লুকোচুরি দেখতে পায়। ওর হঠাৎ সেই ঘুড়িটার কথা মনে পড়ে যায়, যেটা সে পাঁচ-ছয় সপ্তাহ আগে ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে ঝোঁকের বসে কিনে ফেলে।
“গেজ!” সে বলে। গেজ সোফার নিচে একটা মোমের রংপেন্সিল পেয়ে সেটা দিয়ে এলির একটা গল্পের বইয়ের ওপর শিল্পচর্চা করছিল। এতে যে তার আর তার বোনের মধ্যে সৌহার্দের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়া হচ্ছে, লুইস তা ভেবে মুচকি হাসে। এলি যদি এটা নিয়ে বেশি ঘ্যান ঘ্যান করে তাহলে লুইস তাকে গেজের হাগুর মধ্যে পাওয়া মার্বেলের কথা মনে করিয়ে দিবে।
“কী!” গেজ জ্ঞানীর মত জবাব দেয়। ও অল্প বয়সে এখন ভালই কথা বলতে শিখে গেছে। লুইস প্রায় নিশ্চিত গেজ বড় হয়ে মেধাবি হবে।
“বাইরে যাবে?”
“বাইরে যাব!” গেজ খুব আনন্দের সাথে উত্তর দেয়। “বাইরে যাব। আমার নিক্সগুলো কই, বাবা?”
গেজ আসলে যেটা বলল সেটা হচ্ছেঃ আমা নিক্স গু কৈ, বাবা? আর এটার শুদ্ধ রূপ হবেঃ আমার জুতোগুলো কোথায়, বাবা? গেজের কথা শুনে লুইসের প্রায়ই অবাক লাগে। এর কারণ এটা না যে এসব খুব কিউট, এর কারণ বাচ্চারা কথা বলে বিদেশিদের মত করে, যারা ভাষাটা এখনো রপ্ত করতে পারেনি, তাই আবোল তাবোল বলে। বাচ্চারা মানুষের পক্ষে সম্ভব সব রকমের শব্দ করতে পারে… আরবদের টান, জার্মান বর্ণমালার মোটা মোটা স্বরবর্ণ, অস্ট্রেলিয়ার বুশ জংলিদের করা শব্দ, সব। কিন্তু তারা তাদের মাতৃভাষা শিখতে শিখতে সেসব ভুলে যায়। লুইস ভাবে শৈশব শুধু শেখার সময়ই না, ভোলারও সময়।
গেজের নিক্সগুলো অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল, সোফার নিচে। লুইস এখন মোটামুটি বিশ্বাস করে যেসব বাসায় ছোট বাচ্চা কাচ্চা আছে সেসব বাসার সোফার নিচটা একটা ব্লাক হোলে পরিণত হয়ে আশেপাশে যা আছে সব টেনে নেয়; রংপেন্সিল থেকে শুরু করে সিসেমি স্ট্রিটের ম্যাগাজিন, যেটার পাতায় আবার খাবার লেপ্টে আছে।
গেজের জ্যাকেটটা অবশ্য সোফার নিচে ছিল না। এটা সে সিঁড়ির রেলিঙে পায়। গেজের রেড সক্স ক্যাপটা খুঁজে পেতে ওর সবচাইতে কষ্ট হয় আর এই ক্যাপ ছাড়া গেজ বাসা থেকে বের হবেই না। আর এর কারণ ক্যাপটা ঠিক জায়গাতেই ছিল-ক্লজেটে। ওই জায়গায় স্বাভাবিকভাবেই সে সবার শেষে খুঁজতে যায়।
“কৈ যাই, বাবা?” গেজ তার বাবাকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে।
“আমাদের প্রতিবেশীর মাঠে,” সে বলে। “চলো, ঘুড়ি ওড়াবো।”
“গুররি?” গেজ দ্বিধা নিয়ে বলে।
“হুম, ঘুড়ি। খুব মজার।” লুইস বলে। “এক মিনিট, পিচ্চি।”
তারা দুজনে গ্যারেজে আসার পর লুইস স্টোরেজ ক্লজেট থেকে ঘুড়ির ব্যাগটা বের করে।
“এতা কী বাবা?” গেজ এমনভাবে ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন সেটার ভিতর অজানা দেশের না জানি কী লুকিয়ে আছে।
“ঘুড়ি, বাবা।” লুইস বলে। ঘুড়িটা বের করে সেটার ভাঁজ খোলে সে। ঘুড়িটা প্রায় পাঁচ-ছয় ফুটের মত লম্বা এবং বানানো হয়েছে শকুনের আকৃতিতে।
“পাকি!” গেজ চেচিয়ে ওঠে। “পাকি, বাবা! পাকি!”
“হুম বাবা, পাখি।”
সে ঘুড়িটা রেখে পাঁচশো ফুট লম্বা সুতোর রিলটা খুঁজতে থাকে যেটা সে ঘুড়িটার সাথেই কিনেছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে গেজের দিকে ফিরে বলে, “তোমার খুব পছন্দ হবে, বুড়ো খোকা।”
গেজ ঘুড়ি ওড়ানোটা খুব পছন্দ করে।
তারা ঘুড়িটা নিয়ে তাদের প্রতিবেশী মিসেস ভিন্টনের মাঠে যায়। লুইস প্রথম চেষ্টাতেই ঘুড়িটা আকাশে উড়িয়ে ফেলে, যদিও সে শেষবারের মত আকাশে ঘুড়ি উড়িয়েছিল…কবে?…তার বয়স যখন বারো? উনিশ বছর আগে? বাব্বাহ!
তাদের প্রতিবেশী মিসেস ভিন্টনের বয়স জাডের সমান কিন্তু তিনি জাডের চাইতে অনেক বেশি বুড়িয়ে গেছেন। এই মাঠটার এক মাথায় তার বাসা, আর আরেক দিকে জঙ্গলার সীমারেখা যেখান দিয়ে এগোলে প্রথমে পড়বে পেট সেমেটারি আর এরপর মিকমেকদের গোরস্থান। তিনি তার বাসা থেকে খুব কমই বের হন এখন।
“গুরি উরচে, বাবা!” গেজ চেঁচায়।
“আবার জিগায়! দেখো কত দূরে যায়!” লুইসও হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে জবাব দেয়। সে একহাতে সুতোর রিলটা ধরে আছে আর আরেক হাতে সুতোটা। ঘুড়িটা এতো জোরের সাথে সুতো টেনে নিচ্ছে যে সে টের পাচ্ছে তার সুতো ধরা হাতের চামড়া সুতোর ঘর্ষণে প্রায় পুড়ে যাচ্ছে। “শকুনটা দেখো গেজ! আজকে ও আকাশের রাজা!”
“রাজাআআ! গেজ চেঁচিয়ে উঠে উচ্চস্বরে হাসে। আকাশের একটা মেঘের পাঁজার পেছন থেকে হঠাৎ সূর্যটা উঁকি দেয় এবং তাতে চারপাশের তাপমাত্রা যেন একলাফে পাঁচ ডিগ্রীর মত বেড়ে গেল। তারা দুজনে মার্চের ক্ষণস্থায়ী উষ্ণতায় দাঁড়িয়ে আকাশে শকুনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। শকুনটা তার প্লাস্টিকের ডানা মেলে নীল আকাশ বেয়ে তরতর করে আরো ওপরে উঠে যায়। লুইসের ইচ্ছে হচ্ছে ঘুড়িটার কাছে উঠে যেতে; ছোটবেলার মতো। ইচ্ছে হতো ঘুড়িটার সাথে ভেসে ভেসে পৃথিবীর আসল আকৃতি দেখতে, প্রকৃতি দেখতে, দিগন্তরেখার ওপারে কি আছে তা দেখতে।
“গেজ, দেখো কী সুন্দর উড়ছে!” লুইস হেসে হেসে বলে।
গেজ পেছনের দিকে বাঁকা হয়ে মাথা তুলে ঘুড়িটাকে উড়তে দেখছে। ও এতো ঝুঁকে পড়েছে যে লুইসের ভয় হচ্ছে ও উল্টে পড়ে ব্যথা পাবে। ওর মুখে প্রশস্থ হাসি।
লুইস গেজের কাছে গিয়ে গেজকে তার একহাত বাড়িয়ে দিতে বলে। গেজ না তাকিয়েই তার হাত বাড়িয়ে দেয়, সে বাতাসে মাঠের একপাশ থেকে আরেকপাশে উড়তে থাকা ঘুড়িটা থেকে তার চোখ সরাতে পারছে না। ঘুড়িটার সাথে সাথে মাঠের ঘাসে সেটার ছায়াও ছোটাছুটি করছে।
লুইস ঘুড়িটার সুতো গেজের হাতের সাথে পেঁচিয়ে দিলে ও নিচে তাকায়। সুতোর টানে তাকে বেশ অবাক মনে হচ্ছে।
“কী!” সে বলে।
“ওটা তুমি ওড়াচ্ছ এখন,” লুইস বলে। “আকাশের রাজার সুতো এখন তোমার হাতে, তুমিই এখন রাজা। এখন ঘুড়িটা তোমার।”
“গেজ ওড়াচ্ছে?” গেজ বিশ্বাস না করতে পেরে নিশ্চিত হবার জন্যে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে। সে কৌতুহলী হয়ে সুতোটায় টান দিলে ঘুড়িটা নড়ে ওঠে। সে এবার আরো জোরে টান দেয় আর ঘুড়িটা একটা গোত্তা খেয়ে আবার উড়তে থাকে। লুইস আর গেজ একসাথে হেসে ওঠে। গেজ তার খালি হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাতড়াতে থাকলে লুইস সেটা নিজের হাতে ধরে। তারা পিতা-পুত্র হাত ধরাধরি করে মিসেস ভিন্টনের মাঠে দাঁড়িয়ে উড়ন্ত ঘুড়িটাকে দেখতে থাকে।
ছেলের সাথে এই মুহূর্তটা লুইস সবসময় মনে রেখেছে। লুইস যেমন কল্পনা করতো সে ঘুড়িটার সাথে উড়ে উড়ে আকাশ থেকে সব দেখছে, তেমনি তার ইচ্ছে হতে থাকে গেজের চোখে সবকিছু দেখতে। গেজের ছোট্ট দেহের বড় বড় চোখগুলো দিয়ে কোটি কোটি মাইল দূরের ঘুড়িটাকে দেখতে, তার পাশে দাড়িয়ে থাকা দানবীয় মানুষটাকে দেখতে।
“ঘুড়ি উড়ছে!” গেজ চেঁচিয়ে উঠলে লুইস তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমো খায়। তার ছোট্ট গালে লাল গোলাপ ফুটে ওঠে।
“আই লাভ ইউ, গেজ,” সে বলে। এটা একান্তই তাদের নিজেদের মুহূর্ত।
আর গেজ, যার হাতে আর মাত্র দুই মাস আয়ু আছে, সে খিল খিল করে হাসতে থাকে আর চেঁচাতে থাকে, “ঘুড়ি উড়ছে! ঘুড়ি উড়ছে, বাবা!”
এলি আর তার মা যখন ফিরে আসে তখনও তাদের ঘুড়ি আকাশে। তারা দুজনে মিলে ঘুড়ি এতো ওপরে উড়িয়েছে যে তাদের সুতো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ঘুড়ির শকুনের আকৃতি এখন আর বোঝা যাচ্ছে না, ঘুড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশের মধ্যে একটা ছোট্ট কালো বিন্দু।
লুইস ওদের দুজনকে পেয়ে আরো খুশি হয়। এলি তার হাত থেকে সুতোর রিলটা ফেলে দিলে গেজ আনন্দে হেসে ওঠে। রিলটা পড়ে গেলে সেটা মাঠের ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। রিলের সুতো যখন প্ৰায় শেষ হয়ে খুলে যাবে যাবে করছে তখন এলি সেটাকে ধরে ফেলে। তাদের দুজন আসার পরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় তবে বিশ মিনিট পর রাচেল যখন বলে গেজের যথেষ্ঠ বাইরে থাকা হয়েছে, তার খুব একটা কষ্ট লাগে না। রাচেলের মনে হচ্ছে গেজ বাইরে আরো বেশি সময় ধরে থাকলে ওর বুকে ঠান্ডা লেগে যাবে।
অগত্যা লুইস সুতো টেনে টেনে ঘুড়িটাকে নামিয়ে আনতে থাকে। ঘুড়িটা প্রতি মুহূর্তে নিচে নামতে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবশেষে ধরা দেয়। লুইস শকুনটাকে বগলদাবা করে নিয়ে গ্যারেজের স্টোরেজ ক্লজেটে বন্দি করে রাখে। সেদিন রাতে গেজ হট ডগ আর বিনস খায়, অন্যদিনের চাইতে অনেক বেশি। রাচেল যখন গেজকে ঘুমের পোশাক পড়িয়ে দিচ্ছিল লুইস এলিকে একটু পাশে নিয়ে গিয়ে তার মার্বেলগুলোর ব্যাপারে সাবধান করে দেয়। অন্যদিন হলে এলির সাথে এইরকম আলাপ ধমকাধমকিতে গিয়ে শেষ হয় কারণ এলিকে কোন অপরাধের কথা বললে সে নানান অপমানসূচক কথা বলে আর খোঁড়া যুক্তি দিয়ে একগুঁয়ের মত আত্মপক্ষ সমর্থন করতে থাকে। তবে আজকের দিনের সেই মধুর স্মৃতির জন্যে তার মেজাজ খুব ভালো ছিল আর এলিও সহজেই তার কথা মেনে নিয়ে বলে সে তার মার্বেলগুলোর ব্যাপারে আরো সচেতন হবে। এরপর এলি নিচতলায় নেমে যায় টিভিতে সাড়ে আটটায় তার প্রিয় শো দেখার জন্যে। যাক, একটা সমস্যা কমানো গেছে, লুইস ভাবে। কিন্তু সে জানে না যে মার্বেলগুলো কোন সমস্যা না, এমনকি বাইরের ঠান্ডাও কোন সমস্যা না। সমস্যা হতে যাচ্ছে অরিংকো কম্পানির একটা বিশাল ট্রাক, সমস্যা হতে যাচ্ছে তাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা…যেটার ব্যাপারে জাড ক্র্যান্ডাল তাকে প্রথম দিনেই সাবধান করেছিল।
***
গেজকে বিছানায় শুইয়ে দেয়ার মিনিট পনেরো পরে লুইস ওপরে যায়। গেজ চুপচাপ শুয়ে থাকলেও ও জেগেই ছিল। ও সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ফিডারের দুধের শেষ অংশটা চুষে চুষে খাচ্ছে।
লুইস গেজের একপা তুলে ধরে চুমু খেয়ে আবার নামিয়ে রাখে। “গুড নাইট, গেজ,” সে বলে।
“ঘুড়ি উড়ছে, বাবা,” গেজ বলে।
“আসলেই উড়েছে, তাই না?” লুইস বলে এবং কোন কারণ ছাড়াই তার চোখে পানি এসে যায়। “একদম আকাশের সীমানা পর্যন্ত উড়েছে, বাবাই।”
“ঘুড়ি উড়ছে,” গেজ বলে। “কাশ পর্যন্ত।
গেজ ওপাশ হয়ে শুয়ে মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।
লুইস সেখান থেকে চলে যাবার আগে দরজার কাছে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে ক্লজেটের দরজার ফাঁক দিয়ে দুটো হলদে-সবুজ, অশরীরি চোখ দেখতে পায়। চোখগুলো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্লজেটের দরজাটা সামান্য একটু ফাঁক করা ছিল। তার হৃৎপিন্ড লাফ মেরে গলার কাছে চলে আসে আর মুখে আতঙ্কের তীব্র ছাপ ফুটে ওঠে।
সে ক্লজেটের দরজা খুলতে খুলতে ভাবে নিশ্চয়ই এটা জেল্ডা… দরজা খুললেই সে তার কালো জিভ লকলক করে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু আসলে এ চার্চ ছাড়া আর কেউ না। চার্চ তাকে দেখতে পেয়ে এমনভাবে ধারালো দাঁত বের করে হিসিয়ে ওঠলো যেটা শুধু হরর মুভিতেই দেখা যায়।
“যা, ভাগ এখান থেকে,” লুইস ফিসফিস করে বলে।
চার্চ নড়ে না। লুইস গেজের পড়ে থাকা খেলনাগুলোর মধ্যে হাতে যেটা উঠে সেটা দিয়েই ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করে চার্চকে ভয় দেখায়। চার্চ একটুও না নড়ে আবার তার দিকে হিসিয়ে ওঠে। এবার লুইসের মাথায় আগুন চড়ে যায়। এবার সে ভয় দেখানোর ছলে বা খেলার ছলে না, বরং আঘাত করার নিয়তেই খেলনাটা গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারে। সে প্রচন্ড ক্ষেপে গেছে। চার্চের আচরণে মনে হচ্ছে তার ছেলের রুমের ক্লজেটে কিলবিল করার অধিকার চার্চের আছে।
খেলনাটা গিয়ে চার্চের মাথায় আঘাত করে। চার্চ ক্যাক করে আওয়াজ করে ক্লজেট থেকে লাফিয়ে পড়ে পড়িমড়ি করে ছুটে পালায়। পালানোর সময় আনাড়িভাবে বেশ কয়েক জায়গায় ধাক্কা খায় বিড়ালটা।
গেজ নড়ে উঠে কিছু বিড়বিড় করে আবার চুপ হয়ে যায়।
“লুইস?” রাচেল নিচ থেকে ভয়ার্ত গলায় ডেকে ওঠে। “গেজ বিছানা থেকে পড়ে গেছে নাকি?”
“না, ও ঠিক আছে। চার্চ ধাক্কা দিয়ে ওর কয়েকটা খেলনা ফেলে দিয়েছে।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
লুইসের এরকম মনে হচ্ছে-যেন গেজের গায়ের ওপর কোন সাপ কিলবিল করছিল বা ওর গায়ের ওপর কোন মরে ফুলে যাওয়া ধেড়ে ইঁদুর পড়ে ছিল। লুইস জানে তার চিন্তাটা অযৌক্তিক, কিন্তু তারপরও বিড়ালটা যখন ওর দিকে তাকিয়ে হিসিয়ে ওঠে…আচ্ছা, সে কি আসলেই ভয় পাচ্ছিল ক্লজেটের ভেতর জেল্ডা বসে আছে?
সে গেজের ক্লজেটের দরজা চাপিয়ে দেয়। দরজার পাল্লার সাথে সাথে গেজের কতগুলো খেলনাও ক্লজেটের ভেতর ঢুকে যায়। সে দরজা চাপিয়ে দেয়ার পর কি একটা ভেবে পাল্লাটির ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়।
এরপর সে গেজের পাশে এসে দাঁড়ায়। গেজ লাথি দিয়ে তার কম্বল গা থেকে ফেলে দিয়েছে। লুইস কম্বলটা টেনে দিয়ে সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেজের দিকে তাকিয়ে থাকে, দীর্ঘ সময়ের জন্যে।