পেট সেমেটারি – ৩০

অধ্যায় ৩০

সপ্তাহখানেক পরে গেজের ভাইরাস জ্বর সেরে যায়। কিন্তু এর পরের সপ্তাহেই আবার ও ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হয়। ওর থেকে এলি আর রাচেলও আক্রান্ত হয়, ক্রিসমাসের আগে আগে। ওরা তিনজন পাল্লা দিয়ে কাশে আর কাশতে কাশতে বৃদ্ধ কুকুরের মত হাঁপায়। লুইসের সাথে অবশ্য এই রোগের জীবাণু বিশেষ সুবিধা করতে পারে না আর এজন্য রাচেল ওর ওপর যেন একটু অভিমানও করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সপ্তাহটা খুব ঝামেলার মধ্যে কাটে লুইস আর তার কলিগদের। ফ্লু ছড়িয়ে না পড়লেও প্রচুর ব্রঙ্কাইটিস, মাম্পস আর নিউমোনিয়ার পেশেন্ট আসে তাদের কাছে। আর ক্রিসমাসের আগে ক্লাস শেষ হবার দুদিন আগে ছয়জন গোঙাতে থাকা মাতাল ছাত্রকে তাদের বন্ধুরা ধরাধরি করে ইনফার্মারিতে নিয়ে আসে। তাদের নিয়ে আসার পর একদম হযবরল অবস্থা তৈরি হয় যার সাথে পাস্কোর ঘটনার অনেকটা সাদৃশ্য আছে। এই ছয় স্টুপিড মাতাল অবস্থায় পাহাড়ের ওপর থেকে একসাথে একটা স্লেজে চড়ে নিচে নেমে আসতে যায়। খুব মজা। এমনকি এদের একজন নাকি সবার পিছনের জনের ঘাড়ের ওপর বসে ছিল। পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে স্লেজটা বেশ ভালো গতি অর্জন করে আর নিচে এসে একটা সাজিয়ে রাখা আমেরিকান সিভিল ওয়ারের কামানের ওপর পড়ে। এবং এতে তাদের সম্মিলিত অর্জন হচ্ছে দুটি ভাঙা হাত, একটি ভাঙা কব্জি, সর্বমোট সাতটি ভাঙা পাজর, একজনের মাথায় প্রচন্ড আঘাত আর অসংখ্য কালশিটে। শুধু যে ছেলেটা আরেকজনের ঘাড়ে চড়ে নামছিল সে অক্ষত অবস্থায় আছে। সে তার কপালের জোরে উড়ে গিয়ে পুরু তুষারের ওপর গিয়ে পড়ে। এতোগুলো আহাম্মক ছাত্রের চিকিৎসা করা কোন সহজ কাজ না, আর লুইস তাদের চিকিৎসা করার সময় খুব ভালোভাবেই তাদের বকাবকি করেছে। তবে পরে যখন রাচেলকে এই ঘটনার কথা বলে সে আবার হাসতে হাসতে চোখে পানি এনে ফেলে। রাচেল তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ভাবছিল এতে এতো হাসার কী আছে। তবে লুইস তাকে বলতে পারলো না যে এটা একটা বেকুবের মতো অ্যাক্সিডেন্ট ছিল আর তারা আহত হলেও সবাই প্ৰাণ নিয়ে ফিরে গেছে। তার হাসিটা ছিল অনেকটা হাফ ছেড়ে বাঁচার হাসি, বিজয়ের হাসি। আজ সে জিতেছে। লুইস ৬, মৃত্যু ০।

তার নিজের পরিবারের গণ-কাশির সমস্যা ক্রিসমাসের সপ্তাহ খানেক আগেই সেরে যায় আর এলির স্কুলও ষোল তারিখে ছুটি হয়ে যায়। আর তারা চারজন মিলে একসাথে ক্রিসমাস কাটানোর জন্যে প্রস্তুত হয়। এই বাসায় প্রথম যেদিন সবাই এসে উঠে সেদিন বাড়িটাকে খুব অদ্ভুত লাগছিল লুইসের, খুব অচেনা লাগছিল। সেদিনেরই কত স্মৃতি; এলির পা কেটে ফেলা, গেজের গায়ে মৌমাছির হুল…তবে এখন বাড়িটাকে একদম নিজেদের বাড়ি মনে হয়।

ক্রিসমাসের আগের রাতে বাচ্চারা শুতে গেলে লুইস আর রাচেল চোরের মত তাদের এ্যাটিকে গিয়ে ওঠে। সেখান থেকে তারা দুজন হাত ভরে গিফ্‌ট নিয়ে নিচতলায় ক্রিসমাস গাছের নিচে সাজিয়ে রাখে। গেজের জন্যে নানান রকম খেলনা গাড়ি, কারণ সে ইদানিং গাড়ি নিয়ে খেলার মাঝে অত্যাধিক আনন্দ আবিষ্কার করেছে। আর এলির জন্যে বারবি আর কেন্ পুতুল, তিন চাকার একটা সাইকেল, পুতুলের কাপড় এবং আরো অনেক কিছু।

ওরা দুজন ক্রিসমাস ট্রির পাশে গা ঘেষে বসে জিনিসগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে। খুব আহামরি কিছু না হলেও এরকম আনন্দদায়ক বিকেল লুইস আগে কখনো কাটিয়েছে বলে মনে করতে পারে না। ফায়ার প্লেসের আগুন কমে আসলে তাদের একজন উঠে মাঝে মাঝে একটা করে চাড়া কাঠ দিয়ে আসছে।

এর মধ্যে উইনিস্টন চার্চিল একবার লুইসের গা ঘেষে যেতে চাইলে সে বিড়ালটাকে একরকম অরুচি নিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয়। চার্চের গায়ের দুর্গন্ধ সে একদমই সহ্য করতে পারে না, আর এর জন্যে শুধু গন্ধটাই দায়ি না। তার কাছে জায়গা না পেয়ে চার্চ রাচেলের পায়ের কাছে গিয়ে বসতে চায়। কিন্তু রাচেলও “যা ভাগ!” বলে ওকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। লুইস লক্ষ্য করলো রাচেল যে হাত দিয়ে চার্চকে ঠেলে দিয়েছে তা পায়জামার ওপর ঘষছে, যেমনটা হাতে খুব নোংরা কিছু লাগলে কেউ ঘষে। রাচেলকে দেখে লুইসের মনে হলো সে যে হাত ঘষছে সেটা সে নিজেও জানে না।

চার্চ হেলতে দুলতে ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়ে আগুনের সামনে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। চার্চ তার নিজের স্টাইল হারিয়ে ফেলেছে সেদিনই, যেদিন সে ফিরে এসেছিল। তবে চার্চের মধ্যে আরেকটা বড় রকমের পরিবর্তন হয়েছে আর সেটা ধরতে লুইসের মাস খানেক লেগে গেছে। সেটা হচ্ছে চার্চ এখন আর পুর্র্…পুর্র্ করে না। আগে চার্চ ঘুমোতে গেলে মেশিনের মত এই আওয়াজ করতো। আর এখন সে ঘুমায় নিশব্দে, পাথরের মত। মৃতের মত।

না, লুইস একটা ব্যতিক্রম ঘটনা মনে করতে পারে। সেদিন রাতে সোফায় ঘুমানোর সময় দুঃস্বপ্ন দেখে সে যখন জেগে উঠে চোখের সামনে চার্চকে দেখেছিল, চার্চ তখন পুর্র্… পুর্র্… করছিল।

জাড ক্র্যান্ডাল তাকে যেমন বলেছিলেন তা অনেকটা ঠিক, সেটা তিনি বিশ্বাস করেই বলে থাকেন আর অনুমান করেই বলে থাকেন না কেন। চার্চ একদম বিগড়ে গেছে তা বলা যায় না। লুইস তাদের সেলারে একটা ভাঙা জানালা খুঁজে পেয়েছে, ফার্নেসের পেছনে। আর সেটা ঠিক করানোতে তার বাসা গরম করার জন্যে কম পয়সা খরচ হবে। চার্চ সেটা আবিষ্কার না করলে লুইসের হয়তো সেটা খুঁজে পেতে অনেক সপ্তাহ, মাস বা বছরও লেগে যেতে পারতো। সেভাবে চিন্তা করলে লুইসের চার্চকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত।

এলি এখন চার্চকে নিজের সাথে ঘুমোতে দেয় না, এটা ঠিক। তবে ও যখন সোফায় বসে টিভি দেখে, চার্চ মাঝে মাঝে ওর কোলে এসে বসলে ও ওকে বসতে দেয়। তবে কিছুক্ষণ পরেই ওকে সরিয়ে দিয়ে বলে, “যাও চার্চ, তোমার গায়ে গন্ধ।” এলি চার্চকে নিয়মিত খেতে দিত আর সেটা ভালোবেসেই দিত। আর গেজও মাঝে মাঝে আদর করে চার্চের লেজ নিয়ে খেলা করতে ভুলেনি। এরকম সময় চার্চ রেডিয়েটরের নিচে পালিয়ে যেত, যেখানে গেজ ওর নাগাল পাবে না।

চার্চ বিড়াল না হয়ে কুকুর হলে হয়তো আরো বেশি পরিবর্তন দেখা যেত, লুইস ভাবে। আর বিড়ালরা এমনিতেই স্বাধীনচেতা প্রাণী। স্বাধীন আর অদ্ভুত। লুইসকে এটা অবাক করে না যে, প্রাচীন মিসরীয় রাজারাণীরা চাইতেন তাদের মৃত্যুর পর তাদের বিড়ালগুলোকেও মমি করে তাদের সাথে কবর দেয়া হোক, যাতে করে তাদের পোষা বিড়াল তাদের আত্মাকে পথ দেখিয়ে স্বর্গে নিয়ে যেতে পারে।

“ব্যাট-সাইকেলটার কী অবস্থা, ওস্তাদ?” রাচেল জিজ্ঞেস করে।

সে ব্যাট-সাইকেলটা উঁচু করে বলল, “টা-ডা!”

“ওগুলো কী?” রাচেল প্লাস্টিক পার্টসে ভরা একটা পলিথিনের ব্যাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে।

“বাড়তি পার্টস,” লুইস দোষীভাবে বলে।

“এগুলোয় আছাড় খেয়ে ঘাড় ভাঙবে তো ওদের,” রাচেল বলে।

“সরিয়ে ফেলবো তার আগেই। আর ঘাড় এতো আগে ভাঙবে না। ওদের দশ-বারো বছর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো, তার পর স্কেটবোর্ড নিয়ে কাবিলতি দেখাতে গিয়ে ঘাড় ভাঙবে।”

“ছি, লুইস! এভাবে নির্দয়ের মতো বলতে পারলে!”

লুইস দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে আর ওর একটা হাড় মট্ করে ওঠে। “সব খেলনা সেট করা শেষ।”

“গত বছরের কথা মনে আছে?” বলেই রাচেল হিহি করে হাসতে থাকে। লুইসও মুচকি হাসে। গত বছর তারা এতো খেলনা কিনেছিল যে সেগুলো সেট আপ করার ক্লান্তিকর কাজ করতে রাত প্রায় চারটা বেজে গেছিল। কিন্তু দেখা গেল যে ক্রিসমাসের দিন দুপুর না হতে হতেই বাচ্চারা কেউই তাদের খেলনাগুলো দিয়ে খেলছে না, তাদের পছন্দ হয়নি সেসব। সেই খেলনাগুলো দিয়ে খেলার চাইতে তারা খেলনাগুলোর বাক্স দিয়ে খেলতেই বেশি মজা পাচ্ছিল।

“ইয়াক!” লুইস এলিকে নকল করে বলে।

“আচ্ছা। বেড়ে চলো,” রাচেল বলে। “তোমাকে আগে আগেই একটা গিফট দেই।”

“ভদ্র মহিলা,” লুইস বলে, “এটা আমার নিজেরই।”

“স্বপ্ন দেখতে থাকো,” রাচেল হাসতে হাসতে বলল আর হাসার সময় তাকে অনেকটা এলির মত দেখায়…কিছুটা গেজের মতোও।

“এক মিনিট,” সে বলে। “আমার আরেকটা ছোট্ট কাজ বাকি আছে।” সে দ্রুত তাদের ক্লজেট থেকে নিজের একটা বুট জুতা বের করলো। এরপর জুতোটা নিয়ে ফিরে এসে ফায়ার প্লেসের গ্লাসের পাল্লাটা সরিয়ে ফেলে।

“লুইস, কী করছো-”

“এখনি দেখতে পাবে।”

ফায়ার প্লেসের আগুন কমে এসেছে। ফায়ার প্লেসের এক কোনায় আগুন নিভে গেছে আর বেশ পুরুভাবে ছাই জমে আছে। লুইস বুট জুতোটা দিয়ে ছাইয়ের ওপর গভীরভাবে জুতোর ছাপ ফেলল। এরপর জুতোর সাথে লেগে থাকা ছাই দিয়ে সে আরো কয়েকটা ছাপ ফায়ার প্লেসের বাইরেও ফেলল।

“শেষ,” লুইস জুতোটা ক্লজেটে রেখে এসে বলে।

“কাল সকালে সান্টা ক্লজ এসেছে ভেবে এলির মাথা খারাপ হয়ে যাবে,” রাচেল হিহি করে হাসতে হাসতে বলে।

সপ্তাহখানেক আগে এলি স্কুলে একটা গুজব শুনতে পেয়েছে যে, সান্টা ক্লজ বলে কিছু নেই, বাবা-মায়েরাই আসলে সান্টা ক্লজ। আর ওর এই সন্দেহ আরো জোরদার হয়েছে বেঙ্গর শপিং মলে এক দোকানে খেতে যাবার পর। সেখানে একজন রোগাপটকা সান্টা বসে ছিলেন। তিনি তার নকল দাড়ি খুলে সামনে রেখেছিলেন যাতে করে তিনি তার মস্ত বার্গারটা খেতে পারেন। সান্টা বার্গার খাচ্ছেন এই ব্যাপারটা এলি মেনে নিতে পারছে না, এই ব্যাপারটা তাকে সান্টার খুলে রাখা নকল দাড়িটা থেকেও বেশি খোঁচাচ্ছে। রাচেল ওকে বুঝিয়েছিল যে এই সান্টা আসল সান্টা না, ইনি শুধু প্রধান সান্টার একজন সহকারী মাত্র। প্রধান সান্টা বাচ্চা-কাচ্চাদের নানান আবদারের চিঠি পড়তে এতো ব্যস্ত যে এখানে বার্গার খেতে আসার মত সময় তার হাতে একদমই নেই।

লুইস ফায়ার প্লেসের কাচের পাল্লাটা সাবধানে লাগিয়ে দেয়। পায়ের ছাপগুলো দেখলে মনে হবে সান্টা ফায়ার প্লেস দিয়ে নেমে ক্রিসমাস গাছটার কাছে হেঁটে গিয়েছেন। ভাওতাবাজিটা বেশ ভালো হয়েছে একটা খুঁত ছাড়া, সেটা হচ্ছে দু পায়ের ছাপই বাম পায়ের বুটের। তবে লুইসের ধারনা এটা এলির মত পাঁচ বছরের বাচ্চা কিছুতেই টের পাবে না।

“লুইস ক্রিড, আই লাভ ইউ,” রাচেল বলে লুইসকে চুমু খায়।

“তুমি একজন মহামানবকে বিয়ে করেছো বউ,” লুইস হেসে হেসে বলে। “আমার সাথে লেগে থাকো, আমি তোমাকে সুপারস্টার বানিয়ে দিব।”

তারা সিঁড়ির কাছে গেলে লুইস রাচেলকে ইশারা করে টিভির সামনে এলির বিছিয়ে রাখা কার্ডবোর্ডের টেবিলের দিকে। টেবিলের ওপর একটা বাটিতে কয়েকটা ওটমিল কুকি আর রিং-ডিং। টেবিলে এক ক্যান বিয়ারও আছে। সান্টা, আপনার জন্যে,” একটা কাগজে এলির হাতের বড় বড় অক্ষরে লেখা। “কুকি খাবে না রিং ডিং?” লুইস জিজ্ঞেস করে।

“রিং-ডিং,” রাচেল বলে এক কামড়ে সেটার অর্ধেক খেয়ে নেয়। লুইস বিয়ারের ক্যানটা খোলে।

এই সময় বিয়ার গিললে আমার নিশ্চিত গ্যাস্ট্রিক হবে,” লুইস বলে। “ঢং করো না তো,” রাচেল বলে। “কিছুই হবে না।”

লুইস বিয়ারের ক্যানটা রেখে নিজের বুকে এমনভাবে হাতড়াতে থাকে যেন সে কিছু খুঁজে পাচ্ছে না-যদিও সে আজ সন্ধ্যার পর থেকে বুকপকেটে রাখা অল্প ওজনের জিনিসটার কথা একবারও ভোলেনি।

“নাও,” লুইস বলে। “মাঝরাত পেরিয়ে গেছে, এখন খুলতে পারো এটা। ম্যারি ক্রিসমাস, বউ।”

রাচেল সিলভার কাগজে মোড়া, নীল ফিতা দিয়ে বাধা ছোট বক্সটা নেড়ে চেড়ে দেখে। “লুইস, কী এটা?”

লুইস কাঁধ তুলল। “সাবান…বা শ্যাম্পু স্যাম্পল। আসলে ভুলে গেছি।” সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রাচেল বাক্সটা খোলে। ভেতরের জিনিসটা উকি দিতেই তার মুখ হা হয়ে যায়। ভেতরে একটা সোনার চেইন।

“হুম?” লুইস অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করে। সে এই প্রথম কোন জাতের অর্নামেন্ট কিনে দিচ্ছে রাচেলকে, আর তাই সে বেশ উদ্বিগ্ন। “পছন্দ হয়েছে?”

রাচেল চেইনটা বের করে আনে। চেনের সাথে একটা নীলকান্তমণি ঝুলছে। সেটা ঝকমক করছে আর যেন চারদিকে নীল আলো বিকিরণ করছে। “লুইস, এতো সুন্দর জিনিসটা-” লুইস খেয়াল করে রাচেল কাঁদছে। আহা, এমন করো না তো,” সে বলে। “গলায় পড়োতো দেখি।”

“লুইস, আমাদের এসব কেনার সামর্থ্য নেই-তুমি-”

“স্… আমি গত ক্রিসমাসের পর থেকেই জমাচ্ছিলাম, কোন রকমে হয়ে গেছে। আর তুমি যা ভাবছো দাম অতো বেশিও না।”

“কত পরেছে?”

“আমি আমার জীবন থাকতে এই কথা তোমাকে বলব না, রাচেল,” লুইস গম্ভীর হয়ে বলে। “এমনকি চাইনিজ আর্মি আমাকে পিটিয়েও এর দাম জানতে পারবে না। মাত্র দুই হাজার ডলার।”

“দুই হাজার ডলার-!” রাচেল লুইসকে এতো জোরে জড়িয়ে ধরলো তাতে সে আরেকটু হলে সিঁড়ি থেকে পড়েই যাচ্ছিল। “তুমি পাগল নাকি!”

পড়ে দেখো,” সে আবারো বলে।

রাচেল হারটা পড়ে। লুইস হারটার হুক লাগিয়ে দিতে সাহায্য করে। তারপর রাচেল তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“ওয়াও! রাচেল, রূপের জ্বালায় তো আমার চোখ পুড়ে যাচ্ছে!”

“হয়েছে। এখন আমি ওপরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢং করবো। আর আজ সব খুলে ফেললেও এটা আমি গলা থেকে খুলছি না।” বলেই লুইসকে চোখ টিপে দেয় রাচেল।

“আচ্ছা ম্যাডাম। আপনি যান। আমি আপদ বিদেয় করে আসছি।” চার্চের দিকে ইশারা করে লুইস বলে।

লুইস চার্চকে দুহাতে ধরে কিচেন থেকে গ্যারেজের দরজাটার কাছে নিয়ে যায়। এখন চার্চকে ধরার বদলে সে আর ঝাড়ু ব্যবহার করে না। এতো কিছুর পরেও সে বদলে যাওয়া চার্চে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে হয়তো। সে দরজা খুললে ঠান্ডা বাতাসের একটা জোরালো ঝাপটা তার গায়ে এসে লাগে।

“যাও চার্চ, ম্যারি ক্রিস-”

লুইস থমকে যায়। দরজার সামনের পাপোশে একটা মাথা থেতলানো কাক পড়ে আছে। কাকটির একটি ডানা ছেড়া কাগজের মত পাশেই পড়ে আছে। চার্চ কোন বিলম্ব না করেই লুইসের হাত থেকে মোচড়ামুচড়ি করে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে লাশটা শুকতে শুরু করে। লুইস দেখলো চার্চ তার কানগুলো পেছনে নিয়ে মাথাটা চোখা করে ফেলেছে। আর দেখতে না দেখতেই চার্চ কাকটার মাথা থেকে একটা চোখ খুবলে বের করে নেয়।

চার্চ স্ট্রাইকস এগেইন, লুইস ঘৃণায় তার মাথা ঘুরিয়ে ফেলে-কিন্তু ঘোরানোর আগেই সে কাকটার শূন্য কোটরটা দেখে ফেলে। এই জিনিসে আমার কিছু হবে না। এর চাইতে ঢের বীভৎস জিনিস আমি দেখেছি। যেমন ভিক্টর পাস্কোর মাথার ভেতর দিয়ে ওর ব্রেন আমার দিকে উকি দিচ্ছিল। এই জিনিসের চাইতে সেটা হাজার গুনে বীভৎস-

কিন্তু তবুও তার গা গুলিয়ে বমি আসে। তার যৌন উত্তেজনার পোকাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, সেটা নিমেষেই নিস্তেজ হয়ে গেল। ইয়া খোদা! কাকটা আকারে প্রায় চার্চের সমান। কাকটার অসাবধানতায় চার্চ চোরা-গোপ্তা হামলা করেছে নিশ্চয়। এই বীভৎস জিনিসটা সরিয়ে ফেলতে হবে। ক্রিসমাসের দিন সকালে উঠে কেউ এই জিনিস দেখতে চাইবে না। আর এটা সরানোর দায়িত্ব লুইসের নিজেরই, আর কারো না। এই জিনিসটা তার অবচেতন মন ঠিক করে নিয়েছে যেদিন তার পরিবারের সবাই ফিরে আসে আর সে টায়ারের স্তূপটা ফেলে দিয়ে খুবলে খাওয়া ইঁদুরটাকে লুকিয়ে ফেলছিল।

মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে, লুইস।

এই ভাবনাটা এতো বাস্তব মনে হয় লুইসের কাছে যে সে ঝটকা দিয়ে ওঠে, যেন জাড মাত্রই তার ঘাড়ের ওপর থেকে তাকে কথাটা বললেন।

মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়, আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।

চার্চ এখনো মরা কাকটার ওপর লোভীর মত ঝুঁকে আছে। এখন সে কাকটার বাকি ডানার ওপর হামলা করছে। ডানাটা কামড়ে ধরে একবার ডানে টানছে, একবার বামে। ডান-বাম-ডান…পাখিটা এমনিতেই মরে কাঠ হয়ে আছে, এখন চার্চ এটাকে খেলে আর ক্ষতিই বা কি-লুইস হঠাৎ করেই চার্চকে একটা লাথি মেরে বসে। চার্চ লাথি খেয়ে লাফিয়ে সরে গিয়ে লুইসের দিকে তার বিশ্রী হলদে-সবুজ চোখগুলো দিয়ে তাকিয়ে আবার পরমুহূর্তেই হেঁটে চলে যায়। “আমাকে খা, হারামজাদা।” লুইস বিড়ালের মতই হিসিয়ে হিসিয়ে বলে।

“লুইস?” ওপর থেকে রাচেল ডাকে। “কী ব্যাপার?”

“কিছু না, আসছি,” লুইস জবাব দেয়। শুধু একটা ঝামেলা শেষ করে আসছি, রাচেল, বুঝলে? এটা আমাকেই করতে হবে কারণ এটার জন্যে আমিই দায়ি। সে হাতড়ে হাতড়ে গ্যারেজের বাতির সুইচটা জ্বেলে দেয়। সে দ্রুত কিচেনে গিয়ে একটা পলিথিন ব্যাগ আর গ্যারেজের সেলফ থেকে বেলচাটা নামায়। বেলচা দিয়ে সে প্রথমে মরা কাকটা ব্যাগে ঢোকায়। এরপর সে কাকটার ছেঁড়া ডানাটাও পলিথিনে চালান করে পলিথিনের মুখটা শক্ত করে বেঁধে দেয়। এরপর গ্যারেজে রাখা ডাস্টবিনে পলিথিনটা ফেলল। এর মধ্যেই প্রচন্ড শীতে তার অনাবৃত হাঁটু প্রায় বোধহীন হয়ে পড়েছে।

চার্চ গ্যারেজের খোলা দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে। লুইস তাকে দেখে বেলচাটা তুলে একটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গি করলে চার্চ সেখান থেকে লেজ গুটিয়ে পালায়।

সেই রাতের সেক্স বেশ ভালই হয়, কিন্তু লুইসের ঘুম আসতে চায় না। সাধারাণত ভাল সেক্সের পর লুইস খুব সহজেই ঘুমে তলিয়ে যায়। সে ক্রিসমাসের আগের রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে পাশে ঘুমিয়ে থাকা রাচেলের লম্বা লম্বা গভীর শ্বাসের শব্দ শুনছে। তার মাথায় মরা কাকটার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে-তার জন্যে চার্চের ক্রিসমাস প্রেজেন্ট।

আমার কথা মাথায় রেখো ডঃ ক্রিড। আমি মরে গিয়ে আবার বেঁচে উঠেছি। আমি পুরো চক্র ঘুরে এসেছি তবে ফিরে আসার সময় আমার পুর বক্স নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তার বদলে আমি শিকার করার অভ্যাস নিয়ে ফিরে এসেছি। আমি তোমাকে বলতে চাই, মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায় আর সেটা সে যত্ন করে রাখে। ভুলে যাবে না, তোমার হৃদয়ে এখন আমার ছোট্ট ঘটনাও তোমাকে যত্ন করে রাখতে হবে। তোমার হৃদয়ে তোমার স্ত্রী, ছেলে আর মেয়ের পাশে আমাকেও জায়গা করে দিতে হবে, অনন্তকালের জন্যে। মনে রাখবে…তোমার মনের বাগানের যত্ন নেয়ার দায়িত্ব তোমারই।

একসময় লুইস ঘুমিয়ে পড়ে।

অধ্যায় ৩১

ক্রিড পরিবারের শীত চলে গেল। লুইসের ভুয়া পায়ের ছাপের কারণে সান্টা ক্লজের ওপর এলির বিশ্বাস আবার ফিরে এসেছে-হোক সেটা কিছু দিন বা কয়েক বছরের জন্যে। গেজ খুব চমকপ্রদভাবে তার উপহারগুলোর র‍্যাপিং খুলছিল আর মাঝে মাঝে র‍্যাপিং কাগজের থেকে টুকরো টুকরো ছিড়ে নিয়ে মুখে পুড়ে দিচ্ছিল। এবং এই বছরও দুপুর হবার আগেই বাচ্চারা এই সিদ্ধান্তে আসলো যে তাদের খেলনাগুলো থেকে সেগুলোর বক্সগুলো দিয়ে খেলতেই বেশি মজা।

নিউ ইয়ার ইভে ক্র্যান্ডালরা লুইসদের বাসায় দাওয়াতে আসেন, সেদিন রাচেল তার বিখ্যাত এগনগ রান্না করে খাওয়ায়। লুইস সেদিন মনের অজান্তেই নরমাকে দুচোখ দিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করে। নরমাকে অদ্ভুত রকমের ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল, যেরকমটা লুইস আগেও দেখেছে। তার দাদি এইরকম দেখলে বলতেন নরমা ‘ফেইল’ করতে শুরু করেছে। অবশ্য অবস্থা বিচার করলে ফেইল শব্দটা বেশ মানানসই। হঠাৎ করেই যেন নরমার হাত আর্থাইটিসে ফুলে গেছে আর মেছতার মত দাগে ভরে গেছে। তার মাথার চুলও কমে গেছে। তারা রাত দশটার দিকে নিজেদের বাসায় ফিরে যায় আর ক্রিড ফ্যামিলি তাদের টিভির সামনে বসে নিউইয়র্কের নতুন বছর উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা দেখে। ক্রিডদের বাসায় নরমার এই শেষ আসা।

লুইসের সেমিস্টার ব্রেকের সময়টায় খুব বৃষ্টি হয়। যদিও বাসা গরম করার খরচ কমে যাওয়ায় সে কৃতজ্ঞ ছিল তারপরও এই আবহাওয়াটা তার বড্ড বিষন্ন মনে হয়। সে এই সময়ে ঘরের জন্যে বেশ কিছু জিনিস বানিয়ে ফেলল; কয়েকটা বুকসেলফ, রাচেলের জন্যে কাপবোর্ড আর স্টাডিতে বসে নিজের জন্যে একটা মডেল পোর্শ। তেইশে জানুয়ারি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় ক্লাস শুরু হয়, সে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই নিজের কাজে ফিরে যায়।

ক্লাস শুরুর সপ্তাহ খানেক পরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্লু ছড়িয়ে পরে। আর এতে তার কাজের চাপ এতো বেড়ে যায় যে সে প্রায় দিনই দশ থেকে বারো ঘন্টা করে কাজ করতে শুরু করে। দিনের শেষে সে একদম শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতো…কিন্তু তারপরো সে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল।

একজন নার্স লুইসকে বলল তার বাসা থেকে ফোন এসেছে। লুইস একটি ছেলের ভাঙা হাত চেক করছিল যে কি না বার বার জিজ্ঞেস করছে সে আসছে সিজনে বেসবল খেলতে পারবে কি না।

লুইস তার অফিসে গিয়ে ফোন ধরে। রাচেল কাঁদছিল আর এতে লুইস বিপদের গন্ধ পায়। এলির কিছু হলো না তো? ও কি স্লেজ থেকে পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছে বা মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে? সে ভয়ে ভয়ে সেদিনের স্লেজ

থেকে পড়ে হাড়-গোড় ভাঙা ছাত্রদের কথা ভাবে।

“বাচ্চাদের কিছু হয়নি তো?” সে জিজ্ঞেস করে। “রাচেল?”

“না, না,” রাচেল বলে। “বাচ্চাদের কিছু হয়নি…নরমা ক্র্যান্ডাল…লু। তিনি আজ সকালে মারা গেছেন, আটটার দিকে। জাড এসেছিলেন তোমাকে খুঁজতে, আমি বললাম তুমি আধা ঘন্টা আগে বের হয়ে গেছো। ওহ লু! ওনাকে যে কেমন অসুস্থ আর দুর্বল দেখাচ্ছিল…মনে হচ্ছিল উনি হারিয়ে গেছেন। ভাগ্য ভালো যে এলি স্কুলে চলে গেছে আর গেজের বোঝার মত বয়সই হয়নি।”

লুইস ভুরু কুঁচকে ফেলে। এরকম একটা খারাপ সংবাদ শোনার পরও সে রাচেলের প্রতিক্রিয়ায় বিরক্ত না হয়ে পারে না। রাচেল কোনভাবেই মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না অথবা নিতেই চায় না। তার মনে মৃত্যু এমন একটা ভয়ঙ্কর সিক্রেট যেটা বাচ্চাদের কোনভাবেই জানতে দেয়া যাবে না। বড়রা যেভাবে বাচ্চাদের কাছে ‘সেক্স’ নিয়ে লুকোচুরি করে, রাচেল মনে করে, বাচ্চাদের সাথে মৃত্যুর ব্যাপারেও একই রকম লুকাছাপা করতে হবে।

“ওহ খোদা,” লুইস বলে। “হার্ট অ্যাটাক?”

“আমি ঠিক জানি না,” রাচেল বলে। তার কান্না থেমে গেলেও সে এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথা বলছে। “তুমি আসতে পারবে, লুইস? তুমি ওনার বন্ধু আর আমার মনে হয় এখন তোমার তার পাশে থাকা উচিত।”

তুমি ওনার বন্ধু।

আসলেই, আমি উনার বন্ধু, লুইস একটু অবাক হয়ে ভাবে। আমি কখনো চিন্তাই করিনি আমার একজন আশি বছরের দোস্ত থাকবে, কিন্তু বাস্তবতা সেটাই। আর তাদের সম্পর্কের কথা চিন্তা করে সে ভাবে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব হয়ে বেশ ভালই হয়েছে। আর এই কথাটা হয়তো জাড তার আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তাই তিনি লুইসের প্রয়োজনে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মরা ইঁদুর, মরা কাক বা বিশ্রী গন্ধ, যাই হোক, লুইস এখন মনে করে সেদিন রাতে জাডের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। আর সেটা ভুল হলেও জাড সেটা করেছিলেন তার দায়িত্ববোধ থেকেই। এখন জাডের প্রয়োজনে তার যতটুকু করা সম্ভব সে করবে, আর তার জন্যে যদি তার নরমার ফিউনারেলে জাডের বেস্টম্যান হতে হয় তাতেও তার কোন আপত্তি নেই।

“আমি এক্ষুনি আসছি,” লুইস বলেই ফোন রেখে দেয়।

অধ্যায় ৩২

নরমার হার্ট অ্যাটাক হয়নি। তিনি স্ট্রোক করে মারা গেছেন। ব্যাপারটা ঘটে গেছে খুব দ্রুত আর সম্ভবত কম কষ্টদায়কভাবেই। লুইসের কাছ থেকে স্টিভ মাস্টারটন ব্যাপারটা শুনে বলে, নরমার বয়েসি একজনের জন্যে এভাবে মরে যাওয়া খারাপ কিছু না।

রাচেল লুইসের সাথে এই ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাইছে না এবং সে লুইসকেও এই ব্যাপারে তাকে কিছু বলতে দিচ্ছে না।

এলি কিছুটা আপসেট হলেও তার চাইতে বেশি অবাক আর কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। লুইসের মতে এটা ছয় বছরের বাচ্চার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঠিকই আছে। এলি তার কাছে জানতে চেয়েছে নরমা মারা যাওয়ার সময় তার চোখ খোলা ছিল না কি বন্ধ ছিল। লুইস বলেছিল সে তা জানে না।

জাডকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি তার মন বেশ শক্ত রেখেছেন এই বিবেচনায় যে তার ষাট বছরেরও বেশি সময়ের বিছানার সঙ্গি আর নেই। আজ তাকে দেখে একজন প্রকৃত তিরাশি বছর বয়সি বৃদ্ধ বলেই মনে হচ্ছে। তিনি কিচেনের টেবিলে বসে আছেন, তার এক হাতে একটি সিগারেট আর সামনে একটি বিয়ারের বোতল। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে লিভিং রুমের দিকে তাকিয়ে আছেন।

লুইসকে দেখে তিনি বললেন, “ও চলে গেছে, লুইস।” তিনি সেটা এমনভাবে বললেন যেন এই ব্যাপারে হয়তো এখনো কোন সন্দেহ আছে। এরপরেই তার ঠোট কাঁপতে থাকে আর তিনি তার এক বাহু দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে ফেলেন। লুইস এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে নিজের এক হাত রেখে তাকে সমবেদনা জানায়। জাড এবার কাঁদতে শুরু করেন।

“কাঁদুন একটু,” লুইস বলে। “মনটা হালকা হবে। আর নরমা যদি জানতে পারে যে আপনি কাঁদেননি, তাহলেই হয়তো রাগ করে বসতে পারেন।” লুইসের নিজের চোখেও পানি চলে আসে। জাড তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে লুইসও তাকে জড়িয়ে ধরে।

জাড মিনিট দশেকের মত কাঁদলেন। এরপর কান্না থামিয়ে তিনি নরমার কথা বলতে লাগলেন। লুইস জাডের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে, একজন বন্ধু এবং একই সাথে একজন ডাক্তার হিসেবে। সে খেয়াল করলো যে জাড এখনো নরমার কথাগুলো বর্তমান কাল হিসেবে বলছেন। তবে সব শুনে লুইসের মনে হয় না জাড নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন বা ওরকম কিছু। লুইস জানে বুড়ো কাপলদের জন্যে একই সাথে-এক মাসের ব্যবধানে, সপ্তাহের ব্যবধানে এমন কি একই দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া বিরল কিছু না। অনেকেই এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন না বা আগে চলে যাওয়া সঙ্গির পেছনে না পড়ে যাওয়ার জন্যে দেরি করতে চান না। লুইস ভাবে, জাড মারাত্নক শোকে থাকলেও তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে। নিউ ইয়ার ইভের রাতে নরমার গায়ে যেন মরনের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল লুইস, জাডের ব্যাপারে তার এরকম কিছুই মনে হচ্ছে না।

জাড উঠে ফ্রিজ থেকে লুইসের জন্যে একটা বিয়ার এনে দেয়, তার চেহারা এখনো কাঁদার কারণে লাল হয়ে আছে।

“বিয়ারের জন্যে একটু সকাল সকাল হয়ে গেল,” তিনি লুইসের দিকে বোতলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন। “তবে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও রাত নেমে গেছে। আর এই অবস্থায়…”

“আর বলতে হবে না,” বলে লুইস বোতলটা নিয়ে ছিপি খুলে। এরপর সে জাডের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমরা কি নরমার স্মৃতিতে পান করবো?”

“তা না করে উপায় কী?” জাড বলেন। “তুমি যদি নরমাকে ষোল বছর বয়সে দেখতে…তোমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতো। ও বললে স্বয়ং ইবলিশও মদ খাওয়া ছেড়ে দিত। ভাগ্য ভালো যে ও আমাকে কখনোই তা করতে বলেনি।”

লুইস মাথা ঝাঁকায় এবং তার বিয়ার উঁচু করে বলে, “নরমার স্মৃতিতে, “ জাড তার নিজের বোতল লুইসের বোতলের সাথে আলতো করে টোকা দেয়। তার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়লেও তিনি হাসছেন। “সে যেখানে গিয়েছে আশা করি সেখানে কোন বাতের ব্যথা নেই।”

“আমেন,” লুইস বলে এবং তারা একই সাথে পান করে।

লুইস এই প্রথমবারের মত জাডকে হালকা থেকে একটু বেশি মাতাল হতে দেখলো কিন্তু এই অবস্থায়ও তিনি পুরো সজ্ঞানে আছেন। তিনি পূর্বের নানান স্মৃতি আর মজার মজার কাহিনি স্মরণ করলেন। আর তার মাঝে মাঝে তিনি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও যা বলছেন তাতে লুইস অবাক না হয়ে পারে না। রাচেল যদি কোনদিন সকালে সিরিয়াল আর আঙুর দিয়ে নাস্তা করে হঠাৎ‍ করে মরে যায়, তাহলে সে হয়তো জাড যেমন আছেন তার অর্ধেক স্বাভাবিক ও থাকতে পারবে না।

জাড ব্রুকিং-স্মিথ সৎকার কোম্পানির অফিসে ফোন দিয়ে ফোনে যতটুকু ব্যবস্থা করা যায় তা করলেন। তিনি একে একে ফোনে নানান প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেলেন। হ্যা, তিনি চান তার স্ত্রীকে সুগন্ধি দেয়া হবে; হ্যা, তিনি চান নরমাকে যেন তার দেয়া জামা পরানো হয়; না, তিনি চান না মরচুয়ারি থেকে ফিতাওয়ালা কোন জুতো ব্যবহার করা হোক। ওর চুল ধুয়ে দেয়ার মত কেউ আছে? তিনি জিজ্ঞেস করেন। নরমা গত সোমবার শেষ চুল ধুয়েছিলেন, তাই তার চুল ধোয়া প্রয়োজন। লুইস এই প্রশ্নের উত্তর জানতো, কারণ তার চাচা এই কারবারে ছিল। উত্তরটা হলো এই ফিউনারেল সার্ভিসের অংশ হিসেবে নরমাকে এমনিতেই গোসল দেয়া হবে। জাড ফোনে উত্তর শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে ধন্যবাদ বলে আবারো শুনতে লাগলেন। হ্যা, তিনি চান তার স্ত্রীর মৃতদেহ কসমেটিকস দিয়ে সাজানো হোক কিন্তু তিনি চান খুব হালকাভাবে তার স্ত্রীকে সাজানো হোক, কারণ সবাই এমনিতেই জানবে তিনি মৃত। আরো কথা হলো ফিউনারেলের দিন কফিনের ডালা বন্ধ থাকলেও আগের দিন ভিজিটিং আওয়ারে কফিনের ডালা খোলা থাকবে সবার দেখার জন্যে। তাকে কবর দেয়া হবে মাউন্ট হোপ সেমেটারিতে যেখানে তিনি ১৯৫১’তে কবরের জন্যে প্লট কিনে রেখেছেন। তিনি হাতে জমির কাগজটা নিয়ে ফোনে বললেন যে কবরের প্লট নাম্বার হচ্ছে ঐ-১০১। আর তিনি পরে লুইসকে বলেন যে তার নিজের জন্যে বরাদ্দ আছে প্লট নাম্বার ঐ-১০২।

তিনি ফোন রেখে লুইসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার দেখা সবচাইতে সুন্দর সেমেটারি আমাদের ব্যাঙ্গোরের সেমেটারিটাই। আরেকটা বিয়ার নাও, এসব ঝামেলা শেষ করতে আরেকটু সময় লাগবে।”

লুইস না করতে যাচ্ছিল, তার এর মধ্যেই সামান্য মাতাল মাতাল লাগছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো; জাড নরমাকে একটা চাদরে পেচিয়ে জঙ্গলের ভেতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, মিকমেকদের গোরস্থানটার দিকে।

দৃশ্যটা কল্পনা হলেও সেটা লুইসকে বেশ আঘাত করে, সে আর কোন কথা না বলে ফ্রিজ থেকে আরেকটা বিয়ার আনতে উঠে যায়। জাড তার দিকে নড করে আবার ফোন ডায়াল করতে থাকেন। সেদিন দুপুরে লুইস নিজের বাসায় লাঞ্চ করতে ফিরে যাওয়ার আগেই জাড ক্র্যান্ডাল তার স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতার অনেকটাই ঠিকঠাক করে ফেলেন। তিনি এতো দৃঢ়তার সাথে সব ব্যবস্থা করলেন দেখে তার প্রতি লুইসের সম্মান আরো বেড়ে যায়। এরপর তিনি একটা পুরনো ফোনবুক বের করে খুঁজে খুঁজে নরমার এবং তার নিজের জীবিত আত্মীয়দের ফোন করে সবকিছু জানান। আর ফোনের মাঝখানে মাঝখানে তিনি লুইসের সাথে পুরনো নানান ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করেন।

সব মিলিয়ে বৃদ্ধের প্রতি লুইস গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করে।… আর ভালোবাসাও।

হ্যা, তার মন বলল, সে বুড়োকে ভালোবাসে।

এলি সেদিন রাতে চুমু খেতে নেমে এসে লুইসকে জিজ্ঞেস করলো মিসেস ক্র্যান্ডাল বেহেস্তে যাবেন কি না। এলি ফিসফিসিয়ে প্রশ্নটা করে, যেন ও বুঝতে পারছে ওদের কথা আর কেউ না শুনলেই ভালো হবে। রাচেল তখন আগামীকাল জাডের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে কিচেনে চিকেন পাই রান্নায় ব্যস্ত।

রাস্তার ওপারে জাড ক্র্যান্ডালের বাড়ির সবগুলো বাতি জ্বলছে। তার বাড়ির সামনের রাস্তায় দুদিকেই প্রায় একশো ফিট জায়গা নিয়ে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড় করানো। যদিও অফিসিয়াল ভিজিটিং আওয়ার আগামীকাল, তবুও অনেকেই আজই জাড ক্র্যান্ডালকে সমবেদনা জানাতে এবং নরমার অন্তহীন যাত্রাকে শুভকামনা জানাতে এসেছেন। দুই বাড়ির মাঝখান দিয়ে খুব ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলছে। রাস্তাতে কালো বরফ জমেছে। মেইনের সবচাইতে ঠান্ডা আবহাওয়া তাদের ওপর চেপে বসেছে।

“আসলে আমি ঠিক জানি না মামনি,” লুইস এলিকে তার কোলে বসিয়ে বলে। টিভিতে একটা গোলাগুলির দৃশ্য চলছে। একজন মানুষ হঠাৎ ঘুরে গিয়ে মাটিতে পরে গেলেন। লুইস অস্বস্তি নিয়ে ভাবে এলি হয়তো যিশু, মুসা অথবা সেইন্ট পলের চাইতে রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড, স্পাইডারম্যান আর বার্গার কিং সম্পর্কেই বেশি জানে। তার কারণ এলির মা একজন ইহুদি, যে নিজের ধর্ম একদমই চর্চা করে না; আর তার বাবা এককালে মেথডিস্ট হলেও এখন নির্দিষ্ট কিছুতেই বিশ্বাস করে না। এলির বয়স ছয় হলেও লুইসের মনে হয় এসব জিনিস তাকে আরো অনেক আগেই তাদের বলা উচিত ছিল।

কিন্তু এলি তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে তার কিছু না বললেই নয়। “মরার পর মানুষের কি হয় তা একেক জন একেক রকম বিশ্বাস করে, মামনি,” লুইস বলে। “কেউ ভাবে মানুষ মরে যাওয়ার পর হয় বেহেস্তে যায় অথবা নরকে যায়। আবার কেউ বিশ্বাস করে মানুষ মরে গেলে আবার ছোট বাচ্চা হয়ে-”

“ওহ, পুনর্জন্ম। অড্রি রোজ মুভিতে এমন হয়।

“তুমি তো ওই মুভি দেখোনি!” রাচেল যদি জানতে পারে এলি অড্রি রোজ দেখেছে তাহলে ওর স্ট্রোক হয়ে যাবে, লুইস ভাবে।

“স্কুলে মেরি আমাকে বলেছে,” এলি বলে। মেরি এলির স্বঘোষিত বেস্ট ফ্রেন্ড। মেয়েটা দেখতে খুবই রোগা পাতলা আর নোংরা; ওকে দেখলে মনে হয় ওর কিছুদিনের মধ্যেই কুষ্ঠ হবে অথবা পেট ফেটে কৃমি বেরিয়ে আসবে। লুইস আর রাচেল দুজনেই তাদের মেয়ের এই বন্ধুত্বে উৎসাহ দেয় তবে সেদিন মেরি ওদের বাসা থেকে যাওয়ার পর রাচেল লুইসকে বলেছিল যে এই মেয়েটি যাওয়ার পর তার এলির মাথায় উকুন আছে কি না খুঁজে দেখতে মন খচখচ করে। কথাটা শুনে লুইস হেসে মাথা ঝাঁকিয়েছিল।

“মেরির মা ওকে সবকিছু দেখতে দেয়,” এলির কন্ঠে অভিযোগের একটা সুর আছে যেটা লুইস এড়িয়ে যায়।

“যাক, তাহলে তুমি পুনর্জন্ম কী তা জানো। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর বেহেস্ত আর নরকে। তাছাড়া তারা লিম্বো আর পার্গেটরি নামক দুটো জায়গাতেও বিশ্বাস করে। আর হিন্দু এবং বৌদ্ধরা নির্ভানাতে।

কিচেনে রাচেলের ছায়া স্থির হয়ে আছে। সে সব কান পেতে শুনছে।

লুইস আরো ধীরে ধীরে বলতে থাকে।

“এরকম আরো অনেক কিছুর কথাই মানুষ বিশ্বাস করে। তবে তারা কেউই নিজের চোখে এসব দেখেনি। তারা তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে এসব জায়গার কথা না দেখেও বিশ্বাস করে। তুমি জানো তো ধর্মবিশ্বাস কি?”

“আচ্ছা…”

“এই যে আমরা চেয়ারে বসে আছি। আমরা যদি বলি এই চেয়ারটা কালও এখানেই থাকবে তাহলে এর মানে আমরা বিশ্বাস করি চেয়ারটা কালও এখানেই থাকবে, যদিও আমরা সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কিন্তু যেসব মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, তারা বিশ্বাস করে তাদের ঈশ্বর যা বলবেন তাই হতে বাধ্য; যদি ঈশ্বর বলেন এই চেয়ারটা আগামী একশো বছর ধরে এখানেই থাকবে, তাহলে ঐসব বিশ্বাসীরা তাই মেনে নিবে। তবে আমার কথা ধরো, আমি যেকোন একদল লোকের কথা বিশ্বাস করি না। হয় মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মা বেঁচে থাকবে, তাহলে আসলে অনেক কিছুই হতে পারে। আর যদি

মৃত্যুর সাথে সাথে সব শেষ হয়ে যায়, তাহলে সেখানেই সমাপ্তি।” “একবারে ঘুমিয়ে যাওয়ার মত?”

লুইস কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “হ্যাঁ, এরকম হতে পারে।”

“তুমি কিসে বিশ্বাস করো বাবা?”

দেয়ালের ছায়াটা নড়ে আবার স্থির হয়ে গেল।

লুইস তার মেডিকেলে পড়াশোনার সময় থেকেই বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পর আর কিছু নেই, মৃত্যুই সমাপ্তি। সে অনেককে মৃত্যুশয্যায় দেখেছে এবং তার চোখের সামনেই অনেককে শেষ নিশ্বাস নিতে দেখেছে। কিন্তু তার কখনই মনে হয়নি তার পাশ দিয়ে কোন আত্মা উড়ে গেছে বা তার গা ঘেষে চলে গেছে; কিন্তু ভিক্টর পাস্কোর বেলায় কি তার একদম সেই জিনিসটিই হয়নি? অনেকে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসে বলে তারা নাকি নানান অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখেছে। লুইসের সাইকোলজির শিক্ষক বলেছিলেন মানুষ মৃত্যুর কাছে চলে আসলে সে প্রচন্ড মানসিক স্ট্রেস থেকে এসব দেখে; লুইস তার শিক্ষকের সাথে একমত হয়েছিল। তাছাড়া তার এক হোস্টেলের বন্ধু বলেছিল যে এই যুগে বাইবেল অচল, কারণ এতে অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি; আর লুইস তার সাথেও একমত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে লুইস অন্যদের যুক্তি মেনে নিয়ে সে কট্টর নাস্তিকতা থেকে এক ধাপ পিছিয়ে এসেছে। সে আর তার আরেক বন্ধু তাকে বলেছিল, “যিশু খৃষ্টের হাতে লেজারাসের বেঁচে ওঠা খুব অদ্ভুত। কিন্তু আমি আরো অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। অনেক সময় মায়ের পেটে যখন জমজ বাচ্চা আসে, এক বাচ্চা আরেক বাচ্চাকে খুব ছোট থাকতেই গিলে ফেলে। আর সেই খেয়ে ফেলা ভাইকে হজম করলেও তার দাঁতগুলো সে হজম করতে পারে না। সেই দাঁতগুলো তার শরীরের নানান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে গিয়ে জমা হয় আর তা হয়তো বিশ-ত্রিশ বছর পর এক্স-রেতে ধরা পড়ে। ধরা পড়ে যে সে তার নিজের ভাইকে মায়ের পেটে থাকতেই খেয়ে ফেলেছে। এই জিনিস আমি বিশ্বাস করতে পারলে পুনর্জন্মে বিশ্বাস করা কঠিন কিছু না।”

কিন্তু লুইস নিজে কখনই পুনর্জন্মে বিশ্বাস করতো না। অন্তত চার্চের ফিরে আসার আগে।

“মামনি, আমি বিশ্বাস করি মৃত্যুর পরও আমাদের আত্মা বেঁচে থাকে। তবে কিভাবে থাকে, কোথায় থাকে সেসব ব্যাপারে আমি কারো কথা বিশ্বাস করি না। এমন হতে পারে যে যেটা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর সে সেভাবেই থাকবে। তবে আমি বিশ্বাস করি আমাদের আত্মা বেঁচে থাকে আর মিসেস ক্র্যান্ডালও এমন জায়গায় আছেন যেখানে তিনি খুব ভাল আছেন।”

“তুমি তাহলে এটায় বিশ্বাস করো,” এলি বলল। এটা কোন প্রশ্ন ছিল না, তবে এলি এতে খুশি হয়েছে বোঝা গেল।

লুইস অপ্রস্তুত হয়ে মুচকি হেসে বলে, “আমি এটাও বিশ্বাস করি তোমার বিছানায় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, আরো প্রায় দশ মিনিট আগে।”

সে তার মেয়েকে চুমু খায়। একবার ঠোঁটে, একবার নাকে।

“বাবা, পশু পাখিদের আত্মাও কি মরার পর বেঁচে থাকে?”

“হ্যাঁ, থাকে,” আর কিছু চিন্তা না করেই সে প্রায় বলেই ফেলেছিল, বিশেষ করে বিড়ালরা। কথাগুলো তার ঠোঁটে চলে এসেছিল আর সে টের পেল তার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।

“আচ্ছা,” এলি বলে বাবার কোল থেকে নেমে গেল। “আম্মুকে কিস করতে হবে।”

“আচ্ছা, যাও।”

লুইস তাকিয়ে তাকিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছে। ডাইনিং রুমের দরজার কাছে গিয়ে ও লুইসের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, “সেদিন আমি চার্চ মরে যাবে ভেবে খুব গাধার মত কান্না করেছি তাই না বাবা?

“না মা, তুমি মোটেও গাধার মত কিছু করনি।”

“এখন যদি ও মারা যায়, আমি তাহলে মেনে নিতে পারবো,” ও বলে নিজের কথা শুনে নিজেই যেন একটু অবাক হয়ে গেল। তারপর সে আবার নিজের সাথেই একমত হয়ে বলে, “আমি পারবো, অবশ্যই পারবো।” বলেই ও রাচেলকে খুঁজতে চলে গেল।

***

সেদিন বিছানায় রাচেল বলে, “আমি এলির সাথে তোমার কথা শুনেছি।”

“তুমি কি এতে রাগ করেছো?” লুইস বলে। সে ঠিক করেছে এটা নিয়ে লুকোছাপা না করে সরাসরি কথা বলবে।

“না,” রাচেল ইতস্তত করে বলে। “না, লুইস, এরকম কিছু না। আমার এসব ব্যাপারে…ভয় লাগে। আর তুমি জানো আমি ভয় পেলে রক্ষণাত্মক হয়ে যাই।”

লুইস বুঝতে পারছে রাচেল নিজের সাথে প্রায় যুদ্ধ করে তার সাথে কথাগুলো বলছে। সে হঠাৎ করেই সাবধান হয়ে গেল; এলির সাথে যত সাবধানে বলেছে তার চাইতেও বেশি সাবধান। তার মনে হলো সে মাইন পোঁতা মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে, একটু ভুল জায়গায় পা দিলেই সর্বনাশ।

“কিসের ভয়? মরে যাবার?”

“আমার নিজের মরে যাওয়া নিয়ে না,” সে উত্তর দেয়। “আমি নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবি না বললেই চলে। তবে ছোটবেলায় খুব ভয় পেতাম। রাতে ঘুমুতে পারতাম না ভয়ে। ঘুমের মধ্যে মনস্টার নিয়ে নানান স্বপ্ন দেখতাম আর সেই মনস্টারগুলো দেখতে হতো আমার বোন জেন্ডার মত।”

যাক! এতো দিন পর! আমাদের বিয়ের এতোদিন পর সে এই ব্যাপারে তার মুখ খুলছে।

“তুমি তোমার বোনের ব্যাপারে কখনই কিছু বলনি আমাকে,” সে বলে।

রাচেল হেসে লুইসের মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি খুব ভালো লুইস। আমি ওর ব্যাপারে কখনই কথা বলি না। আমি ওকে একদম ভুলে থাকতে চেষ্টা করি।”

“আমি ধরে নিয়েছি এই নিয়ে কথা না বলার পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।”

“হ্যাঁ। আছে।”

“আমি এটুকু জানি যে সে স্পাইনাল মেনিনজাইটিসে মারা গেছে।”

“হ্যাঁ, স্পাইনাল মেনিনজাইটিসে।” রাচেল বলে। “আমাদের বাসায় ওর কোন ছবি রাখা হয় না।”

“তোমার বাবার স্টাডিতে একটা মেয়ের ছবি দেখেছি।”

“ও, হ্যাঁ। ওইটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার মাও হয়তো এখনো তার ওয়ালেটে জেল্ডার ছবি রাখেন। ও আমার চাইতে দুই বছরের বড় ছিল। ওর অসুখ হবার পর ওকে আমাদের পেছনের বেডরুমে রাখা হতো, অনেকটা নোংরা সিক্রেটের মত। ও পেছনের বেড রুমে পড়েই মৃত্যুর প্রহর গুনছিল, আর পুরো ব্যাপারটা ছিল একটা নোংরা সিক্রেট-ও সব সময়ই ছিল একটা নোংরা সিক্রেট!”

হঠাৎ রাচেল ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার বাড়ন্ত কান্না দেখে রাচেল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে কি না ভেবে লুইস ভয় পায়। সে রাচেলের কাঁধে সান্ত্বনার হাত রাখলে রাচেল ঝটকা মেরে তার কাঁধ সরিয়ে নেয়।

“এমন করবে না,” রাচেল বলে। “আমাকে থামিও না লুইস। আমি আজ বলার মত শক্তি সঞ্চয় করেছি; আর এটা আমি একবারই বলবো, আর কখনো এটা নিয়ে কোন কথা আমি বলবো না। আর খুব সম্ভবত আজ রাতে আমার ঘুমও হবে না।”

“এতো খারাপ ছিল ব্যাপারটা?” লুইস প্রশ্নের উত্তর জেনেও জিজ্ঞেস করে। সে মৃত্যু নিয়ে রাচেলের অদ্ভুত আচরণের কারণটা এখন কিছু কিছু বুঝতে পারছে। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে রাচেল কখনোই তার সাথে কোন ফিউনারেলে যায়নি। এমনকি এ্যাল লকের ফিউনারেলেও না—ছেলেটা লুইসের সাথে মেডিকেলে পড়তো এবং প্রায়ই তাদের বাসায় আসতো। সে বাসের সাথে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায়। রাচেল তাকে বেশ পছন্দ করতো কিন্তু তার ফিউনারেলেও ও যায়নি।

ফিউনারেলের দিন হঠাৎ রাচেল অসুস্থ হয়ে পড়ে, লুইসের মনে পড়ে যায়। ফ্লু জাতীয় কিছু। দেখে বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছিল। কিন্তু পরের দিনই আবার ও ঠিক হয়ে গেল।

শেষকৃত্যের পর ও সুস্থ হয়ে গেল, লুইস নিজেকে সংশোধন করে নেয়। লুইস ওই সময়ও ভেবেছিল রাচেলের অসুস্থতা তার মানসিক চাপের কারণে হয়ে থাকতে পারে।

“তুমি কল্পনাও করতে পারবে না লুইস। ও আমাদের চোখের সামনে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কারোই করার কিচ্ছু ছিল না। ও সব সময় ব্যথায় কাতর হয়ে থাকতো। ব্যথায় ওর শরীর কুঁকড়ে যেত,

কাঁধ উঁচু হয়ে মাথা নিচু হয়ে আসতো, আর ওকে দেখলে মনে হত ও কোন মাস্ক পরে আছে। ওর হাতগুলো পাখির হাতের মত হয়ে গেছিল শুকিয়ে। আমার মাঝে মাঝে ওকে খাইয়ে দেয়া লাগতো, ব্যাপারটা আমি ঘৃণা করলেও আমি কখনো তা নিয়ে কোন ঝামেলা করিনি। ওর ব্যথা যখন অনেক বেশি বেড়ে যায় ডাক্তাররা ওকে নানান রকম ড্রাগস দিতে শুরু করে; প্রথম দিকে কম পাওয়ারের দিলেও পরে হাই পাওয়ারের। ও যদি বেঁচে যেত তাহলে ওইসব হাই পাওয়ারের ড্রাগসে ও আসক্ত হয়ে পড়তো। কিন্তু সবাই জানতো যে ও বাঁচবে না…আর এজন্যেই ও আমাদের সবার মাঝে একটা সিক্রেট হয়ে ছিল। কারণ আমরা চাইতাম ও মরে যাক। লুইস আমরা মনে প্রাণে চাইতাম ও মারা যাক; এজন্যে না যে তাতে করে ওর যন্ত্রণার অবসান হবে। আমরা চাইতাম ও মরে যাক কারণ এতে করে আমরা বাকিরা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব…কারণ ও দেখতে দানবের মত হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন…আর ও মানসিক দিক দিয়েও দানব হয়ে যাচ্ছিল…ওহ খোদা, আমি জানি এটা শুনতে কেমন অমানবিক শোনাচ্ছে…”

রাচেল দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে।

লুইস ওর গায়ে হাত রেখে বলে, “রাচেল, এটা একদমই অমানবিক শোনাচ্ছে না।”

“শোনাচ্ছে!” সে উচ্চস্বরে বলে। “আমি জানি এটা কেমন শোনাচ্ছে।”

এটা শুধু সত্যের মত শোনাচ্ছে,” সে বলে। “দীর্ঘ সময় ধরে জটিল রোগে ভোগা রোগিরা প্রায়ই খিটখিটে মেজাজের দানবে পরিণত হয়। লম্বা সময় ধরে রোগে ভোগা কেউ ফেরেশতার মত আচরণ করে গল্প উপন্যাসে, বাস্তবে না। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে যখন তাদের পাছার চামড়া ঘা হয়ে যেতে শুরু করে তাদের অনেকেই নিজেদের মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলে। তারা যে এটা ইচ্ছে করে করে তা না, কিন্তু এতে তার পাশের মানুষেরা ঠিকই কষ্ট পায়।”

রাচেল তার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকায়, যেন ও আশার আলো খুঁজে পেয়েছে লুইসের কথায়। কিন্তু পরক্ষণেই ওর চেহারায় অবিশ্বাসের ছায়া পড়ে। “তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছো।”

লুইস গম্ভীর হয়ে হাসে। “তোমাকে বই খুলে দেখালে তুমি বিশ্বাস করবে? তাছাড়া সুইসাইড পরিসংখ্যানের কথা চিন্তা কর। কোন পরিবারের জটিল রোগে ভোগা সদস্যকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করলে তার মৃত্যুর পরের ছয় মাসে সেই পরিবারের কারো সুইসাইডের সম্ভাবনা প্রায় আকাশ ছোঁয়া।”

“সুইসাইড!”

“হুম, কেউ ঘুমের ঔষধ খায়, কেউ গুলি করে নিজের মাথার ঘিলু বের করে দেয়, কেউ বা সিলিং ফ্যানে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ে। তারা মানসিকভাবে একদম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের হতাশা…বেদনা…বিতৃষ্ণা…তারা মনে করে তারা খুন করেছে, তাই তারা পৃথিবীকে বিদায় জানায়।”

রাচেলের মুখ থেকে উদ্বেগের কালো ছায়া ধীরে ধীরে দূর হয়ে যায়। “ও খুব খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। ও যা বলতো তা না হলেই হুলুস্থুল করতো। আর আমি বুঝতে পারতাম ওর বুক ঘৃণায় ভরে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে ও ইচ্ছে করে বিছানায় পেশাব করে দিত। আমার মা ওকে জিজ্ঞেস করতেন ওকে বাথরুমে নিয়ে যাবেন কিনা; আর পরে যখন ও আর বাথরুমে যেতে পারতো না তখন বেড পেন এনে দিবেন কি না… ও বলতো লাগবে না…আর এরপর ও পেশাব করে বিছানা ভাসিয়ে দিত যাতে করে আমার অথবা আম্মুর বিছানা বদলানো লাগে…ও বলতো এটা ভুলে হয়ে গেছে…কিন্তু ওর মুখের মিটিমিটি হাসি দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে ও ইচ্ছা করেই কাজটা করেছে…আমাদের কষ্ট দেয়ার জন্যে। রুমটা পেশাব আর ওর ওষুধের গন্ধে ভুরভুর করতো। আমি রাতে মাঝে মাঝে জেগে উঠলে…এখনো…আমার মনে হয় যে আমি জেল্ডার রুমের ওই ওষুধের গন্ধ পাচ্ছি…আর ভেবে উঠি ও কি এখনো…এখনো মরেনি?”

রাচেল থেমে দম নিতে থাকে। লুইস রাচেলের হাত ধরলে ও লুইসের আঙুলগুলো খুব শক্ত করে চেপে ধরে।

“আমরা যখন ওর গায়ের জামা চেঞ্জ করে দিতাম, আমরা দেখতে পেতাম ওর পিঠ কিভাবে কুচকে যাচ্ছিল। শেষের দিকে, লুইস…শেষের দিকে অবস্থা এতো খারাপ হয় যে ওর পাছার মাংস প্রায় ওর কোমরের ওপর চলে আসে।”

রাচেলের চোখে খুব ভয়ের একটা ছায়া পড়ে, যেন ও কোন ভয়ঙ্কর কিছু মনে করেছে।

“আর মাঝে মাঝে ও আমাকে ছুঁয়ে দিত…ওর পাখির থাবার মত হাতগুলো দিয়ে…আর মাঝে মাঝে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠতাম আর ওকে বলতাম…বলতাম ও যেন এটা আর না করে…একবার আমি ওকে সুপ খাওয়ানোর সময় ও আমার মুখে হাত ছুঁইয়ে দেয় আর গরম স্যুপ পড়ে আমার হাত পুড়ে যায় আর সেবার আমি সত্যই আমার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠি…আমি কাঁদতে কাঁদতেই ওর মুখের মিটিমিটি হাসি দেখতে পাচ্ছিলাম।”

“একদম শেষের দিকে ওর ওষুধগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তখন ও সবসময় চিৎকার করতে থাকতো ব্যথায়। ওর ওই অবস্থা দেখতে দেখতে ও আগে কেমন ছিল তা আমি একদম মনে করতে পারতাম না…আমাদের মাও পারতেন না। তখন ও একটা জিঘাংসাপূর্ণ, নোংরা, চিৎকার করতে থাকা জিনিসে পরিণত হয়… আমাদের নোংরা গোপনীয়তায়।”

রাচেল শব্দ করে ঢোক গিলে।

“আমার বাবা মা কেউ বাসায় ছিলেন না… যখন… মানে যখন ও…” রাচেল অনেক চেষ্টা করে কথাটা শেষ করে।

“যখন ও মারা যায়। তখন আমার বাবা মা কেউ বাসায় ছিলেন না, ওর সাথে শুধু আমি একা ছিলাম। ওই সময় ইহুদিদের পাস ওভারের সময় চলছিল তাই বাবা-মা তাদের কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। আমি কিচেনে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলাম…ম্যাগাজিনের পাতার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর কি…আর অপেক্ষা করছিলাম কখন জেল্ডাকে আবার ঔষধ দেয়ার সময় হবে, কারণ ও ব্যথায় চিৎকার করছিল…বাবা-মা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওর চিৎকার শুরু হয়। ওর চিৎকারে আমি পড়তে পারছিলাম না। আর এর পরেই…এর পরেই হঠাৎ করেই ওর চিৎকার একদম বন্ধ হয়ে যায়। লুইস আমার বয়স তখন আট। আমি প্রতি রাতে দুস্বপ্ন দেখতাম…আমি ভাবতাম জেন্ডা আমকে ঘৃণা করে কারণ আমার পিঠ ওর মত বেঁকে যায়নি, কারণ আমি সব সময় ব্যথায় চিৎকার করি না…কারণ আমি হাঁটতে পারি, কারণ আমি বেঁচে থাকবো…আমার এরকম ধারণা হতে শুরু করে যে জেন্ডা আমাকে খুন করতে চায়। তবে আজ রাতেও আমি বলবো, আমার ওরকম চিন্তার পুরোটাই আমার কল্পনা থেকে হয়নি। আমি জানি ও আমাকে ঘৃণা করতো। তবে আমি এটা ভাবি না যে ও আমাকে আসলেই খুন করতো, তবে আমি এটা বিশ্বাস করি, ওর যদি ক্ষমতা থাকতো, ও আমার শরীর থেকে আমাকে বের করে দিয়ে নিজে দখল করার রূপকথার মতো, তাহলে ও সেটা করতো। ওর চিৎকার বন্ধ হয়ে গেলে আমি দেখতে যাই সবকিছু ঠিক আছে কি না, ও বিছানা থেকে পড়ে গেছে কিনা…কিন্তু আমি সেখানে গিয়ে যা দেখি তাতে আমার মনে হয় ও ওর নিজের জিভ গিলে ফেলেছে আর ও দম বন্ধ হয়ে নিশ্বাস নেয়ার জন্যে হাসফাঁস করছে। লুইস”-রাচেলের গলার স্বর আবার উঁচু হয়ে আসে, বাচ্চাদের অভিমানে কাঁদার মত, যেন ও ওর চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছে–“লুইস, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে আমি কী করবো! আমার বয়স তখন মাত্র আট!”

“ওই বয়সে তোমার কিছু বোঝার কথাও না,” লুইস বলে। সে রাচেলের কাছে এগিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। রাচেলও ওকে খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, যেন ওর নৌকা ডুবে গেছে আর লুইস পানিতে ডুবতে থাকা অবস্থায় বাঁচাতে এসেছে। “তোমাকে এজন্যে কি কেউ কিছু বলেছিল?… বকেছিল তোমাকে?”

“না,” সে বলে, “কেউ আমাকে দোষ দেয়নি। কিন্তু যা হয়েছিল তা তো কেউ বদলে দিতে পারেনি। ও আসলে নিজের জিভ গিলে ফেলেনি। ও একটা অদ্ভুত শব্দ করতে থাকে… আমার ঠিক মনে নেই-গাআআআ-এরকম কিছু একটা—”

রাচেলের গাআআআ শব্দ শুনে লুইসের ভিক্টর পাস্কোর কথা মনে পড়ে গেল। ও আরো শক্ত করে রাচেলকে জড়িয়ে ধরে।

“-আর ওর গাল দিয়ে থুতু গড়িয়ে পরছিল-”

“রাচেল, থাক। আর বলা লাগবে না,” লুইস বলে। তার নিজের গলাও আর স্বাভাবিক নেই।

“আমি বলতে চাই,” রাচেল জেদী গলায় বলে। “আমি ব্যাখ্যা দিচ্ছি কেন আমি নরমার ফিউনারেলে যেতে পারবো না, প্রথমত। আর দ্বিতীয়ত কেন আমি সেদিন তোমার সাথে আহাম্মকের মত ঝগড়া করলাম-”

“আমি সেদিনের কথা ভুলে গেছি, বাদ দাও।”

“আমি ভুলিনি। আমার মনে আছে লুইস, যেমন আমার মনে আছে কিভাবে আমার বোন জেল্ডা দম বন্ধ হয়ে মারা যায়, ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিলে।”

এরপর বেশ কিছুক্ষণ ওরা চুপ করে থাকে। রুমে নীরবতা নেমে আসে।

“আমি ওকে ওর পেটের ওপর শুইয়ে দিয়ে ওর পিঠে হাত দিয়ে দুম-দাম করে মারতে থাকি,” রাচেল অবশেষে নীরবতা ভেঙে বলে। “এটা ছাড়া আর কিছু করার কথা আমার আট বছর বয়সী ব্রেনে আসেনি। ও ওর পাগুলো দিয়ে বিছানায় ক্রমাগত লাথি মারছিল…আমার মনে আছে তখন একটা পাদের মত শব্দ হয়েছিল…আমি ভেবেছিলাম ও পাদ দিয়েছে বা আমি…কিন্তু আসলে ওটা ওকে উল্টো করে শোয়ানোর সময় আমার জামার বগলের সেলাই ছিড়ে যাওয়ার শব্দ ছিল…এরপর…এরপর ওর খিচুনি শুরু হয়…আমি খেয়াল করলাম ওর মুখ বালিশের ওপর পরে আরো দম বন্ধ হয়ে গেছে…আমি ভয় পেলাম সবাই বাসায় এসে বলবে আমি জেন্ডাকে বালিশে মুখে চেপে মেরে ফেলেছি…ওরা বলবে আমি ওকে ঘৃণা করতাম, যেটা সত্য…ওরা বলবে আমি চাইতাম ও মরে যাক, এটাও সত্য। জানো লুইস? ওর শরীরে যখন ভয়ঙ্করভাবে খিচুনি শুরু হয় আমার মনে প্রথম যে কথাটা এসেছিল সেটা হচ্ছে, ওহ! এবার তাহলে জেন্ডা মরবে আর আমাদের কষ্টের অবসান হবে। আমি ওকে আবার উল্টিয়ে আগের মত শুইয়ে দিলাম। লুইস, ওর মুখ একদম কালো হয়ে গিয়েছিল…ওর চোখগুলো বেরিয়ে আসছিল আর গলা একদম ফুলে গিয়েছিল। এর পরপরই ও মারা যায়। আমি খাটের কাছ থেকে পিছিয়ে যাই। আমি রুমের বাইরে যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু আমি দেয়ালে ধাক্কা খাই আর তাতে দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ফ্রেমে বাধানো ছবি ফ্লোরে পড়ে যায়—ছবিটা ছিল ওজ, মহান এবং ভয়ঙ্কর-এর। ওর অসুখের আগে ও ওজের গল্পগুলো খুব পছন্দ করতো আর তাই ও অসুস্থ হবার পর আমার মা তারই একটা ছবি বাঁধাই করে এই রুমে টাঙ্গিয়ে দিয়েছিলেন। ছবির ফ্রেমটা নিচে পড়ে খুব জোরে শব্দ করে ভেঙে যায় আর আমি চিৎকার করতে শুরু করি…আমি চিৎকার করি কারণ আমি জানতাম ও মারা গেছে আর ভেবেছিলাম যে ওর ভূত আমাকে ধরার জন্যে এসেছে… আর আমি জানতাম ও বেঁচে থাকতে আমাকে খুব ঘৃণা করতো আর ওর ভূতও যে আমার ক্ষতি করতে চাইবে তাতেও আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না। তাই আমি চিৎকার করতে থাকি…আমি চিৎকার করতে করতে বাসা থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তায় নেমে আসি…আমার চিৎকার শুনে আমাদের প্রতিবেশীরা বাইরে বেরিয়ে আসে…তারা আমাকে রাস্তায় হাতা ছেঁড়া জামা পড়ে চিৎকার করতে করতে ছুটতে দেখে। আমি চিৎকার করছিলাম জেন্ডা মরে গেছে! জেন্ডা মরে গেছে! আমার ধারণা তারা ভাবছিলেন আমি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করছিলাম…কিন্তু লুইস জানো? আমার এখন মনে হয় আমি হাসতে হাসতে চিৎকার করছিলাম।”

“ পরিস্থিতির কারণে এমন হতেই পারে,” লুইস বলল।

“তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলছো লুইস, আমি জানি,” রাচেল এমনভাবে বলে যেন সে এই ব্যাপারে একদম নিশ্চিত। লুইস ভাবলো এটা নিয়ে আর ঘাটানো উচিত হবে না। সে ভাবে রাচেল হয়তো অবশেষে তার বিভীষিকাময় স্মৃতি থেকে মুক্তি পাবে, পুরো মুক্তি না পেলেও অনেকটাই হালকা হতে পারবে সে। তার বোনের অসুস্থতার সময় তার মানসিক অবস্থার জন্যে নিজেকে সে যেভাবে দোষী ভাবতো তা থেকে তার মুক্তি মিলবে হয়তো, কিন্তু শেষের এই ঘটনাটা মনে হয় না সে কখনই একদম ভুলতে পারবে। লুইস কোন সাইক্রিয়াটিস্ট না কিন্তু সে জানে মানুষের মনের গভীরে এমন অনেক ঘটনা, দুর্ঘটনা বাসা বেধে থাকে আর তারা মাঝে মাঝে মাথা চারা দিয়ে উঠে মানুষকে কষ্ট দেয়। রাচেল আজ তার মনের ভেতরের এমন অনেক জিনিস বের করে এনেছে, অনেকটা পচে যাওয়া দাঁত তোলার মত করে। সব বের করে আনলেও হয়তো মাঝে মাঝে তার স্বপ্নে সেসব স্মৃতি উঁকি দিয়ে যাবে। তারপরও লুইসের খুব ভালো লাগছে কারণ রাচেল আজ তার ভেতরের জমে থাকা অনেক বিষাক্ত স্মৃতি বের করতে পেরেছে।

সে বসে বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি বুঝেই বলছি। তোমার অবস্থায় আট বছরের একটা মেয়ের জন্যে এমন আচরণ একদমই অস্বাভাবিক না। আর তোমার বাবা-মাকে আরো বেশি অপছন্দ করার মত আরেকটা কারণও আমি আজ পেয়ে গেলাম। ওই রকম অবস্থায় তোমার বোনের কাছে শুধু তোমাকে একা রেখে যাওয়া কোনভাবেই আমি মেনে নিতে পারছি না। কোনভাবেই না।”

রাচেল সেই ঘটনার সময় যেমন শিশু ছিল সেরকম শিশুর মত করেই বলল, “ওই সময় পাসওভারের সময় চলছিল লুইস-”

“পাসওভারের সময় চলুক আর বিশ্বযুদ্ধই হোক না কেন—” লুইস কর্কশভাবে কথাটা বললে রাচেল একটু সরে যায়। রাচেলের মুখটা দেখে লুইসের সেই পাস্কোর মৃত্যুর সকালের একজন নার্সের কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটা সেদিনের পর থেকে আর ইনফার্মারিতে আসেনি। লুইস এজন্যে তাকে কোন দোষও দেয় না।

জেন্ডার জন্যে নার্স রাখতে পারেনি তারা? ওই রকম পরিস্থিতিতে অবশ্যই একজন নার্স পাশে থাকা জরুরি। তাদের বাইরে বেড়াতে যেতে হবে, কিন্তু নার্স রাখবেন না। তার কী দরকার? তাদের তো একটা আট বছরের মেয়ে আছে। তাকেই তারা রেখে গেলেন তার মুমূর্ষু বোনকে দেখভাল করার জন্যে, যে কি না জটিল রোগে ভুগে ততদিনে প্রায় ক্লিনিক্যালি ইনসেনিটির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মিসেস গোল্ডম্যানের সেদিন তার মেয়ের পেশাবের গন্ধ একদম সহ্য হচ্ছিল না, তাই তিনি তার আট বছরের মেয়েকে মুমূর্ষু রোগির দায়িত্ব দিয়ে বাইরে হাওয়া খেতে গেলেন। এখন বুঝতে পারছি কেন তারা রাচেলকে প্রতি বছর ভার্মন্টে ছয় সপ্তাহের জন্যে ক্যাম্পিং করতে পাঠাতেন; তার মৃতপ্রায় বোনের দুর্গন্ধ ভোলার জন্যে নয় তো আর কিসের জন্যে? গেজের জন্যে দশ রকমের জামা, এলির জন্যে ছয়টা ড্রেস…আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকো লুইস, তাহলে তোমার মেডিকেলে পড়ার সব খরচ আমি এক্ষুনি চেকে লিখে দিচ্ছি…তো ওই বালের চেক বই তখন কোথায় ছিল, যখন নার্সের অভাবে নিজের আট বছরের মেয়েকে মুমূর্ষু রোগির দেখভাল করতে দিয়ে গেছিলে, হারামজাদা?

লুইস বিছানা থেকে উঠে যায়।

“কোথায় যাচ্ছো তুমি?” রাচেল প্রায় আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

“তোমার জন্যে একটা ভ্যালিয়াম আনতে।”

“তুমি জানো আমি এসব ঘুমের ওষুধ-”

“আজ রাতে তোমার একটা লাগবে,” সে বলে।

***

রাচেল ঔষধ খেয়ে লুইসকে বাকিটা বলে। বাকি সময়টা ওর গলা বেশ স্বাভাবিক ছিল; ঘুমের ঔষধে কাজ হয়েছে।

পাশের বাসার প্রতিবেশী রাচেলকে একটা গাছের পেছনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখেন। ও “জেন্ডা মরে গেছে! জেন্ডা মরে গেছে!” বলে অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছিল। রাচেলের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল। ওর গায়ের জামা রক্তে মাখামাখি হয়ে যায়। ঐ প্রতিবেশী রাচেলকে তার বাসার ভেতরে নিয়ে গিয়ে নাকের রক্তপাত বন্ধ করে অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে খবর দেন। রাচেলকে অনেক্ষণ যাবত চেষ্টা করে শান্ত করার পর ও বলতে পারে ওর বা-মা কোথায় আছে। তারা ছিলেন শহরের আরেক মাথায় রাচেলের বাবার এক বন্ধুর বাসায়।

সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই গোল্ডম্যানদের বাসার অনেক পরিবর্তন ঘটে 1 জেন্ডা চিরতরে সেখান থেকে চলে গেছে। ওর রুমটাতে ধুয়ে মুছে সাফ করে সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয়া হয়। রুমের সব আসবাব ফেলে দেয়া হয়। রুমটা একদম ফাঁকা করে ফেলা হয়। এরপর অনেক পরে ডরি গোল্ডম্যান ওই রুমটাকে তার সেলাইয়ের রুম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।

সেদিন রাতেই রাচেল প্রথম দুঃস্বপ্ন দেখে। দুঃস্বপ্ন দেখে সে যখন মাঝরাতে চিৎকার করে তার মাকে ডাকতে থাকে সে আবিষ্কার করে সে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। তার পিঠে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে সে। সে জেল্ডাকে নড়াতে গিয়ে পিঠে টান খেয়েছিল। ওই মুহূর্তের উত্তেজনার এড্রিনালিনের আধিক্যে সে তার ছোট্ট শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জেল্ডাকে নড়াতে গিয়ে নিজের জামার হাতার কাপড় ছিঁড়ে ফেলে।

জেল্ডাকে দম বন্ধ হওয়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে রাচেল তার পিঠে চোট খেয়েছে; বড়ই মহৎ কাজ। সবাই তাই ভাবলেও রাচেল নিজে অন্যকিছু ভাবছিল। তার বিশ্বাস ছিল তার পিঠের ব্যথা কবরবাসী জেন্ডার প্রতিশোধ। জেল্ডা জানতো যে সে মরে যাওয়ায় রাচেল খুশি হয়েছে। ও আরো জানতো যে রাচেল যখন “জেন্ডা মরে গেছে! জেন্ডা মরে গেছে!” চিৎকার করতে করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সে আসলে কাঁদছিল না, সে হাসছিল। জেল্ডা জানতো রাচেল তাকে খুন করেছে তাই সে রাচেলকে তার মেনিনজাইটিস রোগ দিয়ে গিয়েছে; আর খুব শীঘ্রই রাচেলের পিঠও জেল্ডার মত বাঁকা হয়ে যাবে আর ধীরে ধীরে সেও জেল্ডার মত মনস্টারে পরিণত হবে, ওর হাতও পাখির থাবার মত হয়ে যাবে। আর আরো কিছুদিন পর সেও জেন্ডার মত ব্যথায় চিৎকার করতে থাকবে। সেও বিছানা ভিজাতে শুরু করবে, আর শেষে নিজের জিভ গিলে ফেলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে।

রাচেলের এই বিশ্বাস কেউ দূর করতে পারে না; না তার বাবা-মা, না ডাঃ মুরায়, যিনি রাচেলের পিঠের মাংসপেশিতে টান লাগা ছাড়া আর কিছুই হয়নি বলে ঘোষনা দেন। এরপর তিনি খুব কঠিন গলায় ( লুইসের ধারনা খুব নির্দয়ের মত) রাচেলকে বলেন তার এইসব নাটক বন্ধ করতে। তার বাব-মা এমনিতেই তার বোনের মৃত্যুতে প্রচন্ড শোকে আছে। তাদের মনোযোগ পাওয়ার জন্যে তার এই শিশুতোষ নাটক সেই মুহূর্তেই বন্ধ করতে বলেন তিনি। অবশেষে যখন ওর পিঠের ব্যথা কমে গেল রাচেল তার বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারলো। পরের কয়েক মাস ( লুইসের ধারনা কয়েক বছর ) ধরে রাচেল তার বোনের মৃত্যুর দৃশ্য দুঃস্বপ্নে দেখে রাতে চিৎকার করতে করতে জেগে উঠতো। উঠেই সে সাথে সাথে তার পিঠে হাত দিয়ে দেখতো সেটা বাঁকা হয়ে গিয়েছে কি না। আর এসব স্বপ্ন দেখার পর তার মনে হতো তখনি তার রুমের ক্লজেটের দরজা ধাম করে খুলে যাবে আর সেখান থেকে জেল্ডা বেরিয়ে আসবে; তার নীল মুখ আর দুমড়ানো-মুচড়ানো দেহ নিয়ে, তার চোখগুলো একদম সাদা আর কাকের থাবায় পরিণত হয়ে যাওয়া হাতগুলো নিয়ে…তাকে খুন করতে, প্রতিশোধ নিতে।

সেই থেকে জেল্ডার বা অন্য কারোর শেষকৃত্যে যায়নি রাচেল।

“তুমি এসব আমাকে যদি আগে বলতে,” লুইস বলে, “তাহলে আমার অনেক কিছু বুঝতেই বেশ সুবিধা হতো।”

“লুইস আমি পারিনি,” রাচেল বলে, “আমি ছোট থেকেই এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে সামান্য ভয় পাই।”

সামান্য ভয় পাও, লুইস ভাবে, ভালোই বলেছো।

“আমি নিজেকে বোঝাতে পারি না…আমি জানি যে তুমি যখন বলো মৃত্যু একদম স্বাভাবিক একটা ঘটনা, তুমি ঠিকই বলো। কিন্তু শুধু আমি জানি কী চলে…আমার মনের ভেতর…”

“হুম,” লুইস বলে।

“সেদিন যখন এলিকে মৃত্যুর ব্যাপারে বলার জন্যে তোমার সাথে ঝগড়া করেছিলাম…আমি বুঝতে পারছিলাম যে তুমি ভুল কিছু করনি, কিন্তু আমি নিজের ওপর একদম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম…আমি সরি, লুইস।”

“সরি বলার কিছু নেই,” সে রাচেলের চুলে বিলি কেটে বলে। “আমার এখন একটু হালকা লাগছে…মনে হচ্ছে আমি আমার দেহ থেকে বিষাক্ত কোন অংশ কেটে বাদ দিয়েছি।”

“হয়তো তুমি তাই করেছো এইমাত্র, বেবি।”

রাচেলের চোখ ঘুমে লেগে আসে এবং সে আবার চোখ খুলে।

ধীরে ধীরে সে বলে, “এজন্যে আমার বাবা-মাকে তুমি প্লিজ দোষী করো না। তাদের জন্যে ওই সময়টা খুব খারাপ গিয়েছে। জেন্ডার চিকিৎসার খরচ টানতে টানতে আমার বাবার প্রায় দেউলিয়া হবার অবস্থা হয়েছিল। আমার মাও আধ-পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জানো, জেন্ডার মৃত্যুর পর আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। যেন জেল্ডার মৃত্যু আমাদের কপাল খুলে যাওয়ার জন্যে সংকেত ছিল। আমার বাবা বড় একটা লোন পেয়ে যান ব্যবসা বড় করার জন্যে। আর এরপর তাকে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আর আমার মনে হয় তারা আমার ব্যাপারে এতো বেশি সাবধানী, কারণ আমি ছাড়া তাদের আর কেউ নেই—”

“এটা তাদের অনুশোচনা,” লুইস বলে।

“হতে পারে। আর আমি যদি নরমার ফিউনারেলের দিন অসুস্থ হয়ে পড়ি তাহলে প্লিজ আমার ওপর রাগ করো না তুমি।”

“আমি রাগ করবো না, বউ।” সে বলে চুপ করে যায়। এরপর সে রাচেলের হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, “আমি এলিকে নিয়ে যেতে পারি?”

রাচেলের হাত তার হাতের মধ্যে শক্ত হয়ে যায়।” ওহ, লুইস, আমি জানি না,” সে বলে। “ও এখনো অনেক ছোট আর-

“রাচেল, মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে আসে সেটা এলি আরো এক বছর আগে থেকেই জানে।” সে তাকে আবারো মনে করিয়ে দেয়।

রাচেল বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এরপর সে সিলিং-এর দিকে ঠোট চেপে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে, “তোমার যদি ভালো মনে হয়…তোমার যদি মনে হয় ওর কোন ক্ষতি হবে না তাহলে-‘

“এদিকে এসো, রাচেল,” সে রাচেলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আর মাঝরাতে যখন ঘুমের ওষুধের প্রভাব কেটে গেলে রাচেল দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে, লুইস তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় আর কানে কানে বলে সব ঠিক আছে। রাচেল আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।

অধ্যায় ৩৩

এলি নরমার ফিউনারেলে একটা সুন্দর নেভিব্লু জামা পড়ে এসেছে। নতুন কেনা জামাতে তাকে ছোট্ট পরীর মত লাগছে। এলি আগেও কয়েকবার চার্চে গিয়েছে তবে এই প্রথম কোন ফিউনারেলে এসেছে। ও একদম চুপচাপ হয়ে লুইসের পাশে বসে আছে। যখন জাড তার সাথে কথা বলতে আসে তখনো ও কিছু বলেনি। জাড আজ ব্ল্যাক সুট আর পালিশ করা শু পড়ে এসেছেন। লুইস তাকে আগে কখনো এরকম মার্জিত পোষাকে দেখেনি। তিনি এলির কাছে এসে নিচু হয়ে ওকে চুমু খেয়ে বলেন, “তুমি আসায় খুব খুশি হয়েছি আমি। আমার বিশ্বাস নরমাও খুব খুশি হয়েছে।”

এলি শুধু তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল।

চার্চের মেথডিস্ট মিনিস্টার বাইবেল পড়া শেষ করে সবার জন্যে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এরপর বললেন, “কফিন বহনকারীরা এগিয়ে আসুন।”

লুইস তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালে এলি খুব শক্ত করে তার হাত টেনে ধরে। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। “বাবা!” ও ফিসফিস করে বলে। “কোথায় যাচ্ছো?”

“মা, আমি নরমার কফিন বহনকারীদের একজন,” লুইস আবার তার জায়গায় বসে বলে। সে এলির কাঁধে হাত রেখে বলে, “তার মানে আমি নরমার কফিন বয়ে নিতে সাহায্য করবো। বেশি সময় লাগবে না আমার, মামনি।”

“আমি তোমাকে যদি খুঁজে না পাই?”

লুইস সামনে তাকিয়ে দেখলো বাকি তিনজন কফিন বহনকারী এর মধ্যেই সামনে কফিনের কাছে চলে গিয়েছে। বাকি লোকজন চার্চ থেকে বের হচ্ছে, অনেকেই কাঁদছে

“আমি তোমাকে চার্চের সামনের সিঁড়িতে খুঁজে নেব। তুমে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকো, মামনি। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা। শুধু আমার কথা ভুলে যেও না।”

“ভুলবো না।”

সে উঠে দাঁড়ালে এলি আবার তার হাত টেনে ধরে।

“বাবা?”

“কী, মামনি?”

ওনাকে সাবধানে নিয়ে যেও, ফেলে দিও না।” এলি ফিসফিস করে বলে।

লুইস সামনে গিয়ে বাকিদের সাথে যোগ দেয়। তাদের মধ্যে একজন নরমার ভাই আর দুইজন জাডের দূরবর্তী আত্মীয়। ফ্যামিলি সার্কেলের মধ্যে একজন বাইরের মানুষ হয়ে লুইসের একটু অস্বস্তি লাগছে।

“আপনাদের সাথে দেখা হয়ে ভালো হলো,” লুইস তাদের বললে তারা নড করে।

“এলি ঠিক আছে?” জাড এলিকে নড করে লুইসকে জিজ্ঞেস করে। ও দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে।

একদম-তবে ও ভয় পাচ্ছে আমি না হাওয়ায় মিলিয়ে যাই, সে ভাবে।

“আছে মনে হয়,” লুইস বলে তার একহাত এলিকে উদ্দেশ্য করে নাড়ে, এলিও জবাবে নিজের হাত নাড়ে। এরপর সে তার নেভিব্লু ড্রেস দোলাতে দোলাতে বাইরে চলে যায়। ওই মুহূর্তে এলিকে লুইসের একদম বড় মানুষের মত মনে হয়।

“সবাই রেডি?” নরমার ভাই জিজ্ঞেস করেন।

লুইস গিয়ে কফিনের পেছনের বাম দিকে ধরে। এরপর চারজন একসাথে কফিনটা তুলে ধীরে ধীরে আগায়। ঠান্ডায় রাস্তায় বরফ জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। কেউ একজন বুদ্ধি করে রাস্তার ওপর ছাই ছড়িয়ে দিয়েছে যাতে রাস্তার পিচ্ছিলতা কমে আসে। ফিউনারেলের পরিচালক আর তার ছেলে তাদের পাশে পাশে আসছিল। কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়লে বা পিছলে পড়লে এগিয়ে আসার অপেক্ষায়।

তারা যখন কফিনটা ক্যাডিলাক গাড়িটায় ঢুকায়, জাড তাদের পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখে।

“গুডবাই, নরমা,” তিনি বলে একটা সিগারেট জ্বালালেন। “কিছুদিনের মধ্যেই আবার দেখা হবে, ওল্ড গার্ল।” লুইস জাডের কাঁধে হাত রাখে।

লুইস আরো কিছুক্ষণ পরে এলির কাছে ফিরে যায়। তারা তাদের স্টেশান ওয়াগনের কাছে হেঁটে যায় পাশাপাশি। লুইস এলির একহাত ধরে রাখে যাতে ও পিচ্ছিল রাস্তায় পিছলে না পড়ে যায়। চারদিকে গাড়িগুলোর ইঞ্জিন একটার পর একটা গর্জন করে চালু হতে থাকে।

“সবাই গাড়ির হেডলাইট জ্বালাচ্ছে কেন?” এলি জিজ্ঞেস করে। “বাবা, সবাই এই দিনের বেলা গাড়ির লাইট জ্বালাচ্ছে কেন?”

“তারা এটা করে,” লুইস বলতে শুরু করে নিজের গলা শক্ত হয়ে যাওয়া টের পায়। “মৃতকে সম্মান জানানোর জন্যে, মামনি।” সে নিজেও গাড়ির হেডলাইট জ্বেলে দেয়। “চলো।”

লুইস ভাবছিল, নরমার কবর আগামী বসন্তের আগে খোঁড়া হবে না। এতো দিন তিনি একটা ফ্রিজারে-এমন সময় এলি হঠাৎ কান্নায় ফেটে পড়ে।

লুইস একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। “এলি, কি হয়েছে?”

“ওনার কুকি আর খাওয়া হবে না,” এলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে। “উনি পৃথিবীর বেস্ট ওটমিল কুকি বানাতেন বাবা। উনি এখন আর ওগুলো বানাতে পারবেন না, কারণ উনি মরে গেছেন। বাবা, মানুষের মরে যেতে হয় কেন?”

“আমি ঠিক জানি না মামনি,” লুইস বলে। “হয়তো নতুন মানুষের জন্যে জায়গা করে দেয়ার জন্যে। ছোট ছোট মানুষের জন্যে, যেমন তুমি আর তোমার ভাই গেজ।”

“আমি কক্ষনো বিয়ে করবো না বা সেক্স করব না আর বাচ্চা নেব না!” এলি আগের চাইতেও কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে। “ওগুলো করলে আমার সাথেও নরমার মত এমন হবে! আমি তা চাই না!”

“কিন্তু এতে তাদের যন্ত্রণারও অবসান হয়,” লুইস মৃদু গলায় বলে। “আর আমি ডাক্তার হিসেবে এরকম প্রচুর যন্ত্রণাকাতর মানুষ দেখি, যাদের জন্যে বেঁচে থাকাটাই একটা অভিশাপ। আর আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিটা নিয়েছি কারণ এখানের রোগিরা প্রায় সবাই যুবক বয়সের। এরা মাঝে মধ্যে রোগে ভুগে…কিন্তু বুড়ো মানুষদের মত কমই ভোগে।”

সে একটু থামে।

“বিশ্বাস করো আর না করো, মামনি, মানুষেরা যখন বুড়ো হয়ে যায়, তাদের কাছে মৃত্যু কোন ভয়ের বিষয় না, যেমনটা তোমার কাছে লাগছে। আর তোমার বুড়ো হতে আরো অনেক বছর বাকি আছে।”

এলি আরো কিছুক্ষণ কাঁদল, এরপর কিছুক্ষণ ফোঁপালো, এরপর থামল। বাসায় পৌঁছানোর আগেই সে লুইসকে জিজ্ঞেস করে যে ও গাড়ির রেডিও শুনতে পারবে কি না। লুইস হ্যাঁ বলে আর ও রেডিও ঘোরাতে ঘোরাতে ওর একটা প্রিয় গান পেয়ে যায় আর নিজেই গানের সাথে সাথে গাইতে থাকে।

বাসায় পৌঁছে ও রাচেলের কাছে গিয়ে ফিউনারেলের গল্প শোনাতে থাকে। রাচেল সেসব মনযোগ দিয়ে শোনে, আর এলিকে সান্ত্বনাও জানায় মাঝে মাঝে…কিন্তু লুইসের মনে হয় রাচেলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে আর খুব চিন্তিতও লাগছে।

এরপর এলি তাকে জিজ্ঞেস করে সে ওটমিল কুকি বানাতে পারে কি না। রাচেল তার হাতের সুই সুতো রেখে সটান হয়ে উঠে দাঁড়ায়, যেন সে এলির এই কথাটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। “হ্যাঁ,” সে বলে। “তুমি বানাতে চাও?”

“ইয়েই!” এলি চিৎকার করে ওঠে আনন্দে। “সত্যি, মা?”

“হুম, যদি তোমার বাবা গেজকে ঘন্টাখানেকের জন্যে দেখে তাহলে।”

“আমি একশভাগ রাজি আছি,” লুইস বলে। “এবং আনন্দের সাথেই। লুইস বিকেলবেলা একটা মেডিকেল জার্নাল পড়ে কাটায়। একসময় রাচেল সিঁড়ির মাঝখানে নেমে বলল, “তুমি আসছো, লু?”

“আরেকটু সময় লাগবে,” সে রাচেলের দিকে তাকিয়ে বলে। “সব ঠিক আছে?”

“ওরা ঘুমিয়ে গেছে, দুজনেই।”

লুইস আবারো রাচেলের দিকে তাকালো। “ওরা তো ঘুমিয়েছে। তুমি না।”

“আমি ঠিক আছি। বই পড়ছিলাম।”

“তুমি ঠিক আছো? সত্যি?”

“হ্যাঁ,” রাচেল বলে মুচকি হাসে। “আই লাভ ইউ, লুইস।”

“লাভ ইউ টু, বেবি।”

লুইস আবার তার সামনে রাখা জার্নালে চোখ রাখে।

“তোমরা যখন বাইরে ছিলে তখন চার্চ একটা মড়া ইঁদুর নিয়ে এসেছিল,”

রাচেল বলে হাসতে চেষ্টা করে। “খুব বিশ্রী অবস্থা, ইয়াক।”

“ওহ খোদা! রাচেল, আমি সরি।” সে আশা করে সে মনে মনে যতটা অনুশোচনা বোধ করছে সেটা যেন তার কথার স্বরে প্রকাশ না পায়।

রাচেল সিঁড়িতে বসে পড়ে। তার মুখ থেকে সে মেকাপ মুছে ফেলেছে, তার কপাল চকচক করছে। আর চুলগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে পনিটেল করে বেধে রেখেছে। ওকে একদম বাচ্চাদের মত লাগছে দেখতে। “আমি পরিস্কার করে ফেলেছি,” ও বলে, “তবে জানো, স্টুপিড বিড়ালটাকে ঝাড়ুর ডাণ্ডা দিয়ে পিটিয়ে ঐ মরা ইঁদুরের কাছ থেকে সরাতে হয়েছে। চার্চ আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় ফুলিয়ে গর্জন করছিল…ও আগে কখনো আমার সাথে গর্জন করেনি। বিড়ালটা বদলে গেছে…ওর কোন অসুখ হয়নি তো? তোমার কী মনে হয়?”

“আমার এরকম কিছু মনে হয় না। তবে তুমি চাইলে আমি ওকে ভেটের কাছে নিয়ে যেতে পারি।”

“থাক, লাগবে না,” রাচেল বলে লুইসের দিকে দৃষ্টির সবকটি আবরণ সরিয়ে তাকায়। “কিন্তু তুমি ওপরে আসবে? আমি শুধু…আমি জানি তুমি কাজ করছো, কিন্তু…”

“অবশ্যই,” সে বলে এতো দ্রুত উঠে দাঁড়ায় যেন সে যা করছিল তা কোন জরুরি কিছুই ছিল না; অথচ কাজটা বেশ জরুরি। ইঁদুরটাকে তো এক রকম সে নিজেই বাসায় নিয়ে এসেছে তাই না? চার্চ যে ইঁদুরটাকে নিয়ে এসেছিল সেটাকে চার্চ নিশ্চয়ই বীভৎসভাবে মেরেই নিয়ে এসেছিল; ইঁদুরটার নাড়ি ভুড়ি হয়তো বেরিয়ে এসেছিল, হয়তো মাথা ছিল না, হয়তো চামড়া খুবলে উঠিয়ে নিয়েছিল চার্চ। হ্যা, ইঁদুরটাকে লুইসই এনেছে। ওটা তারই ইঁদুর।

“চলো বিছানায় যাই,” সে বাতি নিভাতে নিভাতে বলে। সে এবং রাচেল সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি ওঠে, সে রাচেলকে তার ডানহাত দিয়ে আগলে ধরে। সে বিছানায় রাচেলকে খুব আদর করে কিন্তু সেই মুহূর্তেও তার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। সে চার্চের কথা ভাবে, যে আগে তার মেয়ের বিড়াল থাকলেও এখন চার্চ তার নিজের বিড়াল। সে ভাবে চার্চ এখন কি করছে, কিসের পেছনে ওৎ পেতে আছে বা কিসের নাড়িভুড়ি খুবলে বের করে আনছে। বাইরে শীতের হাওয়ার গোঙানি শোনা যাচ্ছে। সে ভাবে অনেক মাইল দূরে নরমা ক্র্যান্ডাল তার শেষ বাসস্থান কালো কফিনটায় শুয়ে আছেন, যিনি কিছুদিন আগেও তার ছেলে মেয়ের জন্যে নিজ হাতে উলের টুপি বুনে দিয়েছিলেন। ফিউনারেল হোমের লোকেরা তাকে সাজানোর জন্যে তার গাল চাপায় যে সাদা তুলো গুজে দিয়েছেন তাও হয়তো এতক্ষণে কালো হতে শুরু করেছে।

অধ্যায় ৩৪

এলির ছয় বছর হলো। ও সেদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরল মাথায় কাগজের টুপি পড়ে আর তার বন্ধুদের হাতে আঁকা তার কয়েকটি ছবি নিয়ে; সেসব ছবির মধ্যে সবচাইতে ভালোটিতে ওকে একটা ভদ্র কাকতাড়ুয়ার মত দেখাচ্ছে। ফ্লুয়ের মহামারী চলে গেছে। এর মধ্যে লুইসের দুজন ছাত্রকে তার ইনফার্মারি থেকে ব্যাঙ্গর হসপিটালে পাঠাতে হয়েছে। আর সুরেন্দ্র একজন ছাত্রের জীবন বাঁচিয়েছে, যার ইনফার্মারিতে ভর্তি হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচন্ড খিঁচুনি হতে থাকে।

রাচেলের এ অ্যান্ড পি দোকানের একটা সোনালি চুলের ব্যাগ বয়ের জন্যে হালকা ক্রাশ তৈরি হয়েছে, যেটা সে-রাতে লুইসকে বলছিল সে, “ওই ছেলেটার প্যান্টের সামনেটা কিভাবে যে ফুলে থাকে…না দেখলে বিশ্বাস করবে না।”

“ও হয়তো ভাব মারার জন্যে ওখানে টয়লেট টিস্যু গুঁজে রাখে। তুমি ভালো করে টিপে দিয়ে দেখতে পারো,” লুইস বলে। “যদি ও চিৎকার করে ওঠে তাহলে বুঝবে আসলেই কিছু আছে।” শুনে হাসতে হাসতে রাচেলের চোখে পানি চলে আসে।

ফেব্রুয়ারির শূন্যের নিচের তাপমাত্রার আবহাওয়া মার্চে বদলে গেল। মার্চে কিছুদিন অদল বদল করে বৃষ্টি আর হিম শীতল আবহাওয়া চলতে থাকে। জাড ক্র্যান্ডালের প্রথম পর্যায়ের শোকের তীব্রতা কমে এসেছে। সাইকিয়াট্রিস্টদের মতে এই শোক আপনজনের মৃত্যুর তিন দিন পর শুরু হয়ে চার থেকে ছয় সপ্তাহ জারি থাকে, তীব্র শীতের মত। সময় মানুষের মনের ক্ষত ধীরে ধীরে শুকিয়ে দেয়। প্রথম পর্যায়ের শোকের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে আসে। আরো সময়ের ব্যবধানে সেই শোক বেদনায় পরিণত হয়। আরো সময়ের সাথে সেটা স্মৃতিচারণে পরিণত হয়-এই পুরো প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিকভাবে শেষ হতে ছয় মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। গেজের প্রথম চুলকাটার দিন চলে এলো। লুইস যখন দেখলো তার ছেলের চুল ব্লন্ড না হয়ে কালো হচ্ছে, সে তা নিয়ে কৌতুক করে নিজেও একটু শোক পালন করলো মনে মনে।

এরপর বসন্ত এলো। বসন্ত এলো থাকার জন্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *