পেট সেমেটারি – ২৫

অধ্যায় ২৫

দুপুর এগারোটার দিকে চার্চ ফিরে আসে। লুইস গ্যারেজে একটা বেশ উচ্চাভিলাষী শেলফ বানানোর কাজ করছিল। এটা তার শখের প্রজেক্ট এবং এটা সে প্রায় গত ছয় সপ্তাহ ধরে করছে। সে গ্যারেজের সব বিপজ্জনক জিনিস-পাতি, যেমন এন্টি ফ্রিজ, উইন্ডশিল্ড ধোয়ার লিকুইড, ধারালো যন্ত্রপাতি ইত্যাদি এই শেলফে রাখবে, যাতে এসব গেজের নাগালের বাইরে থাকে। সে একটা পেরেক ঠুকছিল যখন চার্চ তার লেজ উঁচু করে হাঁটতে হাঁটতে গ্যারেজে ঢুকে। লুইসের হাত থেকে হাতুড়ি খসে পড়লো না বা সে তার আঙুলেও হাতুড়ির বাড়ি মারলো না। তার হৃদয় চমকে গেছে কিন্তু লাফ মারেনি। তার পেটে একটা গরম ধাতব তার আচমকা জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল, যেমন বাতির ফিলামেন্টের তার হঠাৎ অতি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়। সে পরে চিন্তা করে দেখেছে আসলে সে সারাদিন চার্চের ফেরার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। যেন তার অবচেতন মন ঠিকই জানতো যে গতরাতে তারা মিকমেকদের গোরস্থানে যা করেছে তা চার্চকে ফিরিয়ে আনার জন্যেই করেছে।

সে সাবধানে হাতুড়িটা নামিয়ে রাখে আর মুখে কামড়ে ধরে থাকা কয়েকটা তারকাটা ধীরে সুস্থে নামিয়ে রাখে। সে চার্চের কাছে গিয়ে তাকে উঁচু করে ধরে।

বেঁচে থাকা চার্চের ওজন, সে একরকম অসুস্থ এবং আনন্দদায়ক উত্তেজনা নিয়ে ভাবে। ও ট্রাকের ধাক্কা খাওয়ার আগের ওজনে ফিরে গেছে। ওকে ওই পলিথিন ব্যাগটায় অনেক ভারি মনে হচ্ছিল। মরে গিয়ে ওর ওজন বেড়ে গিয়েছিল।

এবার তার হৃৎপিন্ড প্রায় লাফিয়ে ওঠে।

চার্চ কান দুটো পেছনের দিকে নিয়ে চুপ হয়ে আছে। লুইস তাকে ধরে থাকলেও সে কোন রকম রা করছে না। লুইস চার্চকে নিয়ে বাইরের সিঁড়িতে বসে, রোদের মধ্যে। তখন চার্চ ছুটতে চাইলেও লুইস তাকে নিজের কোলে বসিয়ে রাখে। লুইস তার হৃৎপিন্ডের দ্রুতগতি টের পাচ্ছে।

সে চার্চের ঘাড়ের পশমগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলো। গতকাল চার্চের ভাঙা ঘাড় খুব সহজেই ঘোরানো যাচ্ছিল, যেন সেখানে কোন হাড় ছিল না। তবে এখন সে ঘাড়ের মোটা রগ আর মাংসপেশি ছাড়া কিছুই টের পাচ্ছে না। সে চার্চকে দুহাতে উঁচু করে ধরে ওর নাকের দিকে তাকায়। কিন্তু সে যা দেখে তাতে চমকে গিয়ে সে চার্চকে হাত থেকে ফেলে দেয়। সে তার হাত দিয়ে নিজের চোখমুখ ঢেকে ফেলে। তার চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে—মদ খেয়ে বমি করার ঠিক আগমুহূর্তে যেমন লাগে।

চার্চের নাকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে আর তার লম্বা গোফে গতকালের সেই পলিথিনের চিকন দুটো ফালি আটকে আছে।

আমি তোমাকে আরো খুলে বলবো, হয়তো আজ রাতেই। আর আমার ধারনা ততক্ষনে তুমি নিজেই আরো ভালো করে বুঝতে পারবে…

ওহ খোদা! সে যতটুকু জানতে চায় তার চাইতে বেশি এর মধ্যেই জেনে গেছে।

অনেক বুঝে ফেলেছি, লুইস ভাবে, আর বেশি বুঝলে আমাকে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে পাগলা গারদে পাঠাবে সবাই।

***

লুইস চার্চকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে চার্চের নীল খাবারের বোলটা খুঁজে বের করে এবং একটি টুনা-এন্ড-লিভার ক্যাট ডিনারের কৌটা খুলে। সে যখন কৌটার ভেতর থেকে জঘন্য থকথকে জিনিসটা চামচ দিয়ে বের করতে থাকে, তখন চার্চ পুর্র্ পুর্র্ করতে করতে তার পায়ের চারদিকে ঘুরে ঘুরে গা ঘষতে থাকে। সে টের পায় চার্চের স্পর্শে তার গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে এবং দাঁতে দাঁত চেপে সে চার্চকে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। চার্চের গায়ের নরম পশমের ছোঁয়ায় তার গা গুলাতে থাকে। তার মনে হয় সে আর জীবনেও চার্চকে স্পর্শ করতে চাইবে না।

নিচু হয়ে সে খাবারের বোলটা মেঝেতে রাখতে গেলে চার্চ তার পাশ দিয়ে ছুটে যায় সেটার দিকে। লুইস শপথ করে বলতে পারবে সে চার্চের গা থেকে মাটির বাসি গন্ধ পেয়েছে-যেন চার্চের গায়ের লোমে মাটি লেগে আছে।

পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ালটাকে খেতে দেখে। খেতে খেতে চার্চ অদ্ভুত রকমের চপ-চপ-চপ শব্দ করতে থাকে। সে আগে খাওয়ার সময় এমন করতো কখনো? হয়তো করতো কিন্তু লুইস কখনো খেয়াল করেনি। হতে পারে। তবে যেটাই হোক, শব্দটা খুব বিশ্রী। এলি শুনলে বলতো, ইয়াক।

হঠাৎ লুইস ঘুরে দোতলায় যাবার জন্যে সিঁড়ি বাইতে শুরু করে। সে যখন দোতলায় পৌঁছে, সে তখন রীতিমত দৌড়াচ্ছে। সে দ্রুত তার গায়ের জামা কাপড় খুলে সেগুলো ময়লা কাপড়ের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে গায়ের শেষ সুতোটি পর্যন্ত, যদিও সে আজ সকালেই এই পরিস্কার কাপড়গুলো পড়েছিল। এরপর সে বাথটাবে গরম পানি নেয়, যতটুকু গরম সে সহ্য করতে পারে এবং সেখানে ঝাপিয়ে পড়ে।

তার চারদিকে থেকে বাষ্প উড়ছে এবং সে তার দেহের প্রতিটি পেশিতে গরম পানির আরাম অনুভব করতে পারছে। আরামদায়ক গোসলে তার মাথার জটও খুলতে শুরু করে। পানি যখন ঠান্ডা হতে শুরু করে, তার ঘুম ঘুম লাগে এবং সুস্থ বোধ হতে থাকে।

বালের বিড়ালটা ফিরে এসেছে…আসলেই এসেছে, বড় কোন ঘটনা না। আসলে পুরোটাই একটা নিছক ভুল বোঝাবুঝি। কাল চার্চকে দেখে তার মনেই হয়নি যে বিড়ালটা ট্রাকের ধাক্কায় পটল তুলেছে।

রাস্তায় মড়া কুকুর বিড়াল তো সে কম দেখিনি। সেসবের শরীর থেতলে যায়, নাড়ি-ভুড়ি ফেটে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।

তার কাছে এখন সবকিছু পরিস্কার হয়ে যায়। চার্চ ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে মরেনি, তবে বেহুশ হয়ে গিয়েছিল। সে যে চার্চকে মিকমেকদের গোরস্থানে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেটা অজ্ঞান চার্চ ছিল, মৃত চার্চ না। লোকে বলে বিড়ালের নয়টা জীবন আছে, তাই না? ভাগ্য ভালো সে এলিকে কিছু বলেনি, বেচারি শুধু শুধু কষ্ট পেত। তবে এলি কখনোই জানবে না তার বিড়াল মৃত্যুর কতটা কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।

কিন্তু ওর মুখে আর গলার পশমে রক্ত, ওর মাথা যেভাবে বাধাহীনভাবে ঘুরছিল…

সে একজন মানুষের ডাক্তার, কোন পশু ডাক্তার না। সে একটা ভুল ডায়াগনোসিস করেছে, আর কিছু না। আর ভালো করে পরীক্ষা করার মত কোন অবস্থাও গতকাল ছিল না। ফ্রিজিং টেম্পারেচারে, সন্ধ্যার শেষ আলোতে, জাডের উঠোনের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে আর কতটুকু ভালো ভাবেই বা ডেডবডি পরীক্ষা করা যায়? তাছাড়া সে হাতে গ্লাভস পড়ে ছিল। এমনও হতে পারে-

একটা মোটাসোটা, কদাকার ছায়া বাথরুমের টাইলস করা দেয়ালে ভেসে উঠলো, অনেকটা ড্রাগনের মাথা বা সাপের মাথা যেভাবে আড়াল থেকে ভেসে উঠে। কিছু একটা তার নগ্ন কাঁধে হালকা স্পর্শ করে পিছলে চলে গেল। লুইস তাতে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে এবং তাতে বাথটাবের পানি ছলকে উঠে বাইরে পরে বাথরুমের মেঝে ভিজিয়ে দেয়। হঠাৎ স্পর্শে তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে। সে ঘার ঘুরিয়ে তার মেয়ের বেড়ালের হলদে-সবুজ চোখ জোড়ার দিকে তাকায়। বিড়ালটা টয়লেটের সিটের ওপর বসে আছে।

চার্চ মাতালের মত সামনে পিছে ঝুঁকছে। ওকে দেখে লুইসের সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে আর একটা চিৎকার তার চেপে থাকা দাঁতের গোড়ায় এসে থেমে যায়। চার্চ আগে কখনই এভাবে দুলতো না-সাপের মত নিজের শিকারকে সম্মোহিত করা দুলুনি তাকে খাসি করার আগেও না, পরেও না। তার মাথায় আরেকটা ধারনা খেলা করতে লাগে। হতে পারে এটা অন্য আরেকটা বেড়াল। দেখতে একদম চার্চের মত কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিড়াল। বিড়ালটা ঘুরতে ঘুরতে তাদের গ্যারেজে এসে পড়েছে এবং সে তাকে এলির বিড়াল ভেবে ভেতরে নিয়ে এসেছে। আর আসল চার্চ এখনো মিকমেকদের গোরস্থানে তার তৈরি সেই শিলাস্তম্ভটার নিচে মাটিচাপা অবস্থায় আছে। কিন্তু বিড়ালটার গায়ের দাগগুলো একদম চার্চের সাথে মিলে যায়…সেই একই দাগওয়ালা কান… সেই একই আহত থাবা, যেটাকে দেখলে মনে হয় কেউ চিবিয়ে দিয়েছে। চার্চ ছোট থাকতে এলি একবার ভুলে ওর ওই থাবাটা দরজায় বাড়ি খাইয়েছিল।

এটা চার্চই, কোন সন্দেহ নেই।

“যা ভাগ,” লুইস কর্কশভাবে হিসিয়ে ওঠে

চার্চ আরো কয়েক মুহূর্ত তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কোন এক কারণে চার্চের চোখগুলো তার কাছে অন্য রকম লাগছে, সে একদম হলফ করে বলতে পারে। এরপর চার্চ লাফিয়ে টয়লেটের সিট থেকে নিচে নামে। কিন্তু বিড়ালদের লাফিয়ে নামার মধ্যে যেমন একরকমের পটুতা থাকে, সেই লাফে তার কিছুই ছিল না। সে লাফিয়ে নেমে স্থির থাকতে না পেরে নিয়ন্ত্রণহীন বাসের মত হেলতে দুলতে এগিয়ে গিয়ে বাথটাবের সাথে ধাক্কা খায়। এরপর সে বাথরুম থেকে চলে যায়।

লুইস বাথটাব থেকে বেরিয়ে দ্রুত গা মুছে নেয়। সে যখন জামা গায়ে দিচ্ছিল তখন বাড়ীর নিস্তব্ধতা চুরমার করে দিয়ে ফোনটা বেরসিকের মত বেজে উঠে। লুইস চমকে প্রায় লাফিয়ে ওঠে। এক অজানা আতঙ্কে তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেছে আর সে ঘুরে দাড়িয়ে নিজের হাত দুটো ওপরে মেলে ধরে আত্মরক্ষার্থে। সে এরপর সম্বিত ফিরে পেয়ে ধীরে ধীরে নিজের হাত দুটো নামিয়ে নেয়। তার হৃৎপিন্ড খুব দ্রুত চলছে। সে তার পেশিতে এড্রেনালিনের আধিক্য টের পাচ্ছে।

স্টিভ মাস্টারটন ফোন করেছে, লুইস র‍্যাকেট খেলবে কি না জানার জন্যে। লুইস রাজি হয়ে বলল যে সে এক ঘন্টার মধ্যে সেখানে হাজির হবে। তার হাতে সময় একদমই নেই, আর র‍্যাকেট খেলার কোন ইচ্ছেও তার নেই। কিন্তু তার বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। সে বিড়ালটার কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইছে। বিড়ালটার এখানে থাকা কোন ভাবেই সম্ভব না। কিন্তু তারপরেও সেটা এ বাড়িতেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

লুইস তড়িঘড়ি করে গায়ে একটা শার্ট আর শর্টস চাপিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে।

চার্চ সিঁড়ির একদম নিচ থেকে চার নাম্বার ধাপে শুয়ে ছিল। ওকে মাড়িয়ে দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে লুইস ওকে খেয়াল করে এবং সে প্রায় পা হড়কে পড়েই যাচ্ছিল। সে সিঁড়ির পাশের রেলিং ধরে নিজেকে সামলে নেয়। এখান থেকে পড়লে খুব ভালোভাবেই চোট পেতে পারতো সে।

সে সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে। তার হৃৎপিন্ড খুব দ্রুত চলছে আর শরীরে এড্রেনালিন বেড়ে গেছে।

চার্চ উঠে আড়মোড়া ভাঙে, ওটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লুইসের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে।

লুইস চলে যায় সেখান থেকে। তার বিড়ালটাকে বাসার বাইরে রেখে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে সে মরা বিড়ালটাকে একদমই স্পর্শ করতে চাচ্ছে না।

অধ্যায় ২৬

জাড একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে নিজের সিগারেটটা জ্বালানোর পর কাঠিটাকে ঝাঁকিয়ে নিভিয়ে একটা এ্যাশট্রেতে ছুঁড়ে ফেললেন।

“হুম, স্টানলি বুকার্ডই আমাকে ওই জায়গাটার কথা বলেছিল।” তিনি থেমে চিন্তা করতে লাগলেন।

তাদের সামনে টেবিলে বিয়ারের গ্লাস রাখা আছে, যেগুলো তারা প্রায় ছুয়েও দেখেনি। লুইস স্টিভের সাথে হালকা ডিনার করে এসেছে। পেটে কিছু খাবার পড়ায় তার এখন আগের চাইতে বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে সে আবার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে। তবে বাসায় চার্চ ঘোরাঘুরি করছে বলে সেখানে ফিরে যাওয়ার জন্যে সে কোন রকম চিন্তিত না।

নরমা তাদের সাথে কিছুক্ষণ বসেছিলেন। তিনি টিভি দেখার সাথে সাথে একটা কাপড়ে সুই সুতোর কাজ করছিলেন। তিনি সুই সুতো দিয়ে কাপড়টার মধ্যে একটা বাড়ির পেছনে সূর্যাস্তের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে চাচ্ছেন। বাড়িটার ছাদের ক্রুশটি নিম্নগামী নিস্তেজ সূর্যের গায়ে আবছায়ার মত দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেছেন যে তিনি সেটা বিক্রির জন্যে করছেন। ক্রিসমাসের আগের সপ্তাহে চার্চে মেলার মত হয়, খুব বড় করে। সেখানে বিক্রি করবেন এটা। লুইস ভালো করে দেখলো তিনি খুব সুন্দর এবং সাবলীলভাবে কাপড়ে সুই চালাচ্ছেন। আজকে তার বাতের ব্যথা নেই তেমন একটা। লুইস ভাবে এটা হয়তো আবহাওয়ার কারণে। বাইরে ঠান্ডা হলেও বায়ু খুবই শুষ্ক। তিনি তার হার্ট অ্যাটাক থেকে ভালোভাবেই সেরে উঠেছেন। তবে মস্তিষ্ক সংক্রান্ত জটিলতায় মারা যাওয়ার দশ সপ্তাহ আগের এই দিনে তাকে দেখে লুইসের মনে হয় ওনার বয়স কয়েক বছর কমে গিয়েছে। লুইসের মনে হলো সে তার ভেতরের কিশোরীকে দেখতে পাচ্ছে।

পৌনে দশটার দিকে নরমা তাদের রেখে শুভরাত্রি জানিয়ে উঠে গেলেন। লুইস আর জাড পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু জাড চুপ করে আছেন। তিনি সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছেন সেই ধোঁয়া কোথায় উড়ে যাচ্ছে, অনেকটা বাচ্চারা যেভাবে উড়তে থাকা গ্যাস বেলুনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“স্টানি বি..” লুইস নীরবতা ভেঙে বলে।

জাড চোখ পিটপিট করে যেন নিজের মাঝে ফিরে এলেন। “লাডলোর সবাই তাকে স্টানি বি. বলেই চিনতো। ১৯১০, যে বছর আমার কুকুর স্পট মারা যায়—মানে প্রথম বারের জন্য মারা যায় ততদিনে স্টানি বেশ বুড়িয়ে গেছিলেন আর তার মাথাও সামান্য থেকে একটু বেশিই বিগড়ে গিয়েছিল। ওই সময় অনেকেই মিকমেকদের গোরস্থানটা চিনতেন, কিন্তু আমি ওটা সম্পর্কে জানি ওই স্টানির কাছেই। তিনি জেনেছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। তার পরিবার ছিল একদম ভেজালহীন কানাডিয়ান।”

জাড একটু হেসে তার বিয়ারে চুমুক দিলেন।

“তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলা আমার এখনো কানে বাজে। তিনি আমাকে রুট-১৫’র পাশের একটা আস্তাবলের পাশে বসে থাকতে দেখে কথা বলতে এগিয়ে এসেছিলেন। স্পট তখনো মরেনি কিন্তু তার শেষ সময় চলে এসেছিল। আমার বাবা আমাকে হাস-মুরগির খাবার চেক করে দেখার জন্যে বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। একটা গরুর জন্যে ব্লাকবোর্ড যতটা গুরত্বপূর্ণ, আমাদের জন্যেও হাস-মুরগির খাবার ততটাই গুরত্বপূর্ণ। আর আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম আমার বাবা কেন আমাকে বাড়ির বাইরে পাঠাচ্ছিলেন।

“উনি কুকুরটাকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে মেরে ফেলতে চাইছিলেন?”

“তিনি জানতেন আমি স্পটকে কতটা ভালোবাসি। তাই তিনি চাননি আমি বাসায় থাকি যখন তিনি সেটা করেন। আমি মুরগির খাবারের জন্যে গেলে দোকানদার যখন আমার জন্যে সেটা বস্তায় ভরে দিচ্ছিলেন আমি তখন সেখানকার একটা পাথরের উপর বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি।”

জাড মুচকি হাসতে হাসতে মৃদুভাবে তার মাথা ঝাকান।

“আর তখনই স্টানি এসে হাজির হন,” তিনি বললেন। “শহরের অর্ধেক মানুষ ভাবতো সে মাটির মানুষ আর অর্ধেক ভাবতো সে ভয়ঙ্কর লোক। তার দাদা আঠারো শতাব্দীর শুরুর দিকে পশু শিকার করে চামড়া বিক্রির কারবার করতেন। তিনি একটা বিরাট লাল ওয়াগন গাড়ি চালাতেন যেটার গায়ে অনেকগুলো ক্রুশ আঁকা ছিল, একজন আদর্শ খ্রিস্টানের যা করা উচিত। তিনি ছিলেন এমন ক্রিশ্চিয়ান যে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে মানুষকে ধর্ম আর পরকালের জ্ঞান দিতেন। আবার তার গাড়ির ওপর পেগান ইন্ডিয়ানদের চিহ্নও ছিল। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যত গোত্রের ইন্ডিয়ান আছে সবাই একটি বৃহৎ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত-ইসরায়েলের হারিয়ে যাওয়া গোত্র, যেটির কথা বাইবেলে বলা আছে। তিনি বিশ্বাস করতেন সব ইন্ডিয়ানরাই নরকে যাবে, কিন্তু তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে তাদের যাদু ঠিকই কাজ করে। কারণ তার মতে তারাও আসলে এক রকমের খ্রিস্টানই, সেটা যত অদ্ভুতই শোনাক না কেন।

“অন্যান্য চামড়া শিকারী আর ব্যবসায়িরা যখন সুবিধা করতে না পেরে পশ্চিমে চলে গিয়েছিল, স্টানির দাদা তখনো মিকমেকদের সাথে চামড়ার কারবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কারণ তিনি মিকমেকদের ভালো দাম দিতেন আর পুরো বাইবেল ছিল তার মুখস্ত। মিকমেকরা তার মুখ থেকে বাইবেলের কথা শুনতে খুব ভালোবাসতো।”

জাড চুপ হয়ে গেলেন দেখেও লুইস কিছু না জিজ্ঞেস করে অপেক্ষা করে। “মিকমেকরা স্টানলির দাদাকে ওই গোরস্থানটার কথা বলেছিল, সেখানে তারা আর কাউকে কবর দেয় না কারণ একটা উইন্ডিগো গোরস্থানটার মাটি অপবিত্র করে ফেলেছিল। তারাই তাকে ওই ঈশ্বরের জলা আর ওই পাহাড় কেটে বানানো সিঁড়িটার কথাও বলে।”

“আর এই উইন্ডিগোর গল্প, এটা সেই সময় দেশের এই উত্তরাঞ্চলের সবখানেই শোনা যেত। এই গল্পটা সৃষ্টি করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল, ঠিক যেই কারণে কিছু কিছু খ্রিস্টান গল্পও তৈরি করা হয়েছে। নরমা হয়তো আমাকে এটা বলতে শুনলে নাস্তিক বলে ঝাড়ি দিবে কিন্তু এটাই সত্য। সে সময় শীতে এই উত্তরাঞ্চলের ইন্ডিয়ানদের মাঝে খাদ্যের বিকট অভাব দেখা দিত। পরিস্থিতি মাঝে মাঝে এতোটাই খারাপ হতো যে তাদের হয় না খেয়ে মরা লাগবে অথবা অন্য কিছু।”

“ক্যানাবলিজম?”

জাড কাঁধ ঝাঁকান। “হতে পারে। এমন হতে পারে আর কোন উপায় না পেয়ে তারা অচল কোন বৃদ্ধকে বেছে নিত। এর পর অন্তত কিছু সময়ের জন্যে তারা সিদ্ধ মাংস খেয়ে জীবন বাঁচাতে পারতো। তবে এই কাজকে হালাল করার জন্যে তারা একটা গল্প বানায়। তারা বলে যে একটি উইন্ডিগো তাদের গ্রামে এসে তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় ছুঁয়ে দিয়ে গেছে। আর উইন্ডিগো তাদেরই ছুতো যাদের সে মানুষের মাংসের স্বাদ আস্বাদন করাতে চাইতো।”

লুইস মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। “বলে না, শয়তান আমাদের দিয়ে অকাজ করিয়ে নিয়েছে? অনেকটা ঐ রকম ব্যাপার।”

“হুম। আমার ধারণা আমাদের এখানকার মিকমেকরাও সেরকম কোন পরিস্থিতিতে পড়ে। আর এরপর তারা নিজেদের মধ্যে থেকে হয়তো দু-চার জনকে বা ডজনখানেক লোককে কেটেকুটে খেয়ে নিয়ে তাদের হাড়গোড় ওই গোরস্থানে পুঁতে ফেলে।

“এবং এর পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে সেখানকার মাটি অপবিত্র হয়ে গেছে,” লুইস বিড়বিড় করে বলে।

“আচ্ছা আসল কথায় ফিরে আসি। আমি যেখানে ছিলাম তার কাছেই স্টানি মদ জোগাড় করতে এসেছিলেন। আমার সাথে যখন তার দেখা হয় ততক্ষণে তিনি হাফ মাতাল। তার দাদা যখন মারা যান তখন নাকি তার সম্পদের পরিমান এক মিলিয়ন ডলারের মত ছিল, লোকমুখে শোনা। কিন্তু স্টানি ছিল নগন্য একজন পাপোশ ব্যবসায়ি। সে আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার কী হয়েছে, কেন কাঁদছি আমি। আমি সব কিছু খুলে বললে তিনি বললেন এই সমস্যার সমাধান তিনি জানেন, কিন্তু আমাকে অনেক সাহসিকতা দেখাতে হবে।”

“আমি বললাম যে আমি স্পটকে সুস্থ করে তোলার জন্যে যে কোন কিছু করতে পারি, কিছুর পরোয়া করি না আমি। তারপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কোন ভালো ভেটকে চিনেন কি না যে স্পটকে সারিয়ে তুলবে। ‘আমি? আমি কোন ভেটকে চিনি না, না আমাকে কোন ভেট চিনে।” স্টানি বলেছিলেন। ‘কিন্তু আমি জানি কিভাবে তোমার কুকুরকে ঠিক করা যাবে। তুমি বাসায় যাও। গিয়ে তোমার বাবাকে বলো যাতে কুকুরটাকে একটা বস্তায় ভরে দেয়। তারপর তুমি সেটাকে পেট সেমিটারির ওই মরা গাছগুলোর স্তুপের কাছে রাখবে। কবর দিবে না কিন্তু, শুধু ওখানে রাখবে। ঠিক আছে?’

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা করে লাভ কি হবে? স্টেনি উত্তর না দিয়ে বললেন আমি যাতে রাতে জেগে থাকি। তিনি মাঝরাতের দিকে আমার জানালাতে পাথর ছুঁড়ে মারলে আমি যাতে বেরিয়ে আসি। তখন গভীর রাত, বুঝলে? কিন্তু তুমি যদি আমার কথা ভুলে যাও, তাহলে আমিও তোমার কথা ভুলে যাব। আর তা করলে ওই কুকুর জাহান্নামে যাক, আমার কিছু যায় আসে না।”

জাড লুইসের দিকে তাকিয়ে আরেকটা সিগারেট জ্বালালেন।

“স্টেনি যেভাবে বললেন আমি সেভাবেই করলাম। বাসায় ফিরে যাওয়ার পর বাবা বললেন, তিনি স্পটের মাথায় গুলি করে তাকে তার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমার নিজ থেকে পেট সেমেটারির কথা কিছু বলা লাগলো না। আমার বাবাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমার কী মনে হয়, স্পট কি চাইতো আমি তাকে পেট সেমিটারিতে কবর দেই? আমি বললাম, ‘মনে হয় চাইতো,’। এরপর আমি স্পটের বস্তা নিয়ে পেট সেমিটারিতে রেখে আসি } আমার বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার কোন সাহায্য লাগবে কি না, আমি না করি কারণ আমার স্টানির কথা মনে ছিল।”

“আমি সে রাত জেগে কাটাই। আমার মনে হচ্ছিল অনন্তকালের জন্যে বলছে, জেগে আছি, কিন্তু রাত একদমই আগাতে চাইছে না। জানোই তো ছোটবেলার সময় অন্যরকম, অনেক লম্বা মনে হয়। আমার যখন মনে হয় আমি অনেকক্ষণ যাবত জেগে আছি, কিছুক্ষণ পরে ভোর হবে হয়তো, তখন আমি ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি কাটা দশটা থেকে মাত্র এগারোটায় গিয়ে পৌঁছেছে। কয়েকবার আমি প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, কিন্তু প্রত্যেকবারই আমি এমনভাবে ধরমড়িয়ে জেগে উঠি যেন কেউ আমাকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলছে, ‘ওঠো জাড! ওঠো!’ যেন কেউ চাইছিল যেন আমি জেগে থাকি।”

লুইস তার কথায় ভুরু উঁচু করে তাকালে জাড কাঁধ তুলল।

“নিচতলার ঘড়িতে যখন বারোটা বাজার ঘন্টা বাজে, আমি তখন উঠে পড়ে জামা কাপড় গায়ে দিয়ে রেডি হয়ে বসে থাকি। সে রাতে বেশ জোছনা ছিল, আর চাঁদের আলো আমার জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছিল। এরপর আমি সাড়ে বারোটার ঘন্টা শুনলাম এবং তার পরে একটার। কিন্তু স্টেনির টিকিটিরও কোন খোজ নেই। আমি ভাবলাম বুড়ো হয়তো গাধার মত ভুলে বসে আছে। আমি যেই বিরক্ত হয়ে জামা কাপড় খুলে শোবার চিন্তা করছি ঠিক তখনি জানালার কাচে এসে এতো জোরে দুটো নুড়ি পাথরের ঢিল পড়ে যে আমার মনে হয় জানালার গ্লাস হয়তো ভেঙে পড়বে। তবে না ভাঙলেও গ্লাসে একটা ফাটল দেখা দেয় যেটা আমি পরদিন সকালে আবিষ্কার করি, আর আমার মা আবিষ্কার করেন পরের বছর শীতের সময়। ততদিনে তিনি ভেবেছেন যে ঠান্ডায় হয়তো গ্লাসটা ফেটে গেছে।”

“আমি প্রায় উড়ে জানালাটার কাছে যাই। জানালার পাল্লাটা তুলতে গেলে সেটা খুব জোরে ক্যাচক্যাচ করে ওঠে, ঠিক যেমনটা হওয়া উচিত যখন কোন দশ বছরের বাচ্চা মাঝরাতে বাড়ি থেকে লুকিয়ে বের হতে চায়—”

লুইস হাসে। যদিও সে যখন দশ বছরের বালক ছিল সে কখনো মাঝরাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বের হয়নি। কিন্তু সে যদি ওরকমভাবে পালাতে চাইতো তাহলে সে নিশ্চিত যে তার রুমের জানালাও এভাবেই শব্দ করে প্রতিবাদ জানাতো।

“আমি ভাবলাম আমার বাসার লোকেরা হয়তো বাসায় চোর ঢুকেছে ভেবে হুলস্থুল করবে, কিন্তু আমার হৃৎপিন্ড স্বাভাবিক গতিতে ফিরে এলে আমার কানে নিচতলা থেকে বাবার করাত দিয়ে কাঠ কাটার মত নাক ডাকার শব্দ আসে। আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখি স্টানি আমাদের ড্রাইভওয়েতে দাড়িয়ে আছে। সে হালকা হালকা দুলছিল, যেন চারদিকে খুব বাতাস। কিন্তু আসলে তখন বাতাসের কোন ছিটেফোঁটাও ছিল না। আমি তার আশা একদম ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু সে এমন মাতাল অবস্থাতে আসলো…সে কোন মতে জেগে ছিল, যেমনটা কোন পাতলা পায়খানা করতে করতে হালুয়া টাইট হওয়া পেঁচা রাতের বেলায় জেগে থাকে। সে নিচ থেকে চিৎকার করে বলে (যদিও আমার বিশ্বাস সে ভাবছিল যে সে ফিসফিস করে বলছে) ‘পিচ্চি, তুমি নিচে নামবে না কি আমি তোমাকে নিতে ওপরে আসবো?’

“আমি তাকে ‘শুস্!’ করে থামতে বলি। তখন ভয়ে আমারই পাতলা পায়খানা হবার জোগাড়। আমি ভয়ে আছি আমার বাপ ঘুম থেকে উঠে এসে পিটিয়ে আমার পাছার চামড়া তুলে নেবেন। ‘কী বললে তুমি?’ স্টানি আগের চাইতেও জোরালো গলায় বলে। যদি আমার বাবা মা বাসার রাস্তার দিকটায় থাকতেন তাহলে সেদিন আর রক্ষা ছিল না। কিন্তু তারা থাকতেন উল্টো দিকে, রিভারভিউ পাশটায় যেখানে এখন আমি আর নরমা থাকি, তাই সেদিন বেঁচে যাই।”

“আমার বিশ্বাস তারপর আপনি বুলেটের বেগে সিঁড়ি ভেঙে নামলেন, তাই না?” লুইস বলে। “বাসায় আর বিয়ার আছে, জাড?” লুইস এরই মধ্যে তার অন্যদিনের চাইতে দুই বোতল বেশি গিলে ফেলেছে। কিন্তু আজ তার কাছে এটা কোন ব্যাপার বলে মনে হলো না। বরং তার মনে হচ্ছে আজ বেশি খাওয়াটাই ঠিক আছে।

“আছে। কোথায় রাখি তা তো জানোই, নিয়ে এসো।” জাড বলে আরেকটা সিগারেট ধরালেন। লুইস ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। “না, আমার সিঁড়ি দিয়ে নামার মত দুঃসাহস ছিল না, কারণ সিঁড়িটা আমার বাবা-মার রুমের পাশে। আমি জানালার পাশের আইভির লতা বেয়ে বেয়ে নামি, যত তাড়াতাড়ি পেরেছিলাম। ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিল। তবে জানো কি, মাঝরাতে স্টানির সাথে পেট সেমিটারিতে যাওয়ার চাইতে আমি আমার বাবাকে বেশি ভয় পাচ্ছিলাম।”

জাড় তার জলন্ত সিগারেটের পাছাটা এ্যাশট্রেতে পিষে ফেললেন।

“আমরা একসাথে পেট সেমিটারিতে গেলাম। যাওয়ার পথে সে ডজন খানেকবার আছাড় খায়। সে তার নিজের ভেতর ছিল না, তার গায়ের গন্ধটা এমন ছিল যেন সে ভুট্টার মটকির ভেতর থেকে উঠে এসেছে। একবার তো সে এমনভাবে পড়ে যায় যে একটা লাঠি আরেকটু এদিক সেদিক হলেই তার গলায় ঢুকে যেতো। আমারা সেখানে পৌঁছানোর পর আমার ধারণা ছিল সে গর্ত খোঁড়ার জন্যে আমার দিকে তার হাতের বেলচা আর কুঠারটা ছুঁড়ে দিয়ে সেখানেই বেহুশ হয়ে পড়ে থাকবে।

কিন্তু সে যেন তখন একটু ভদ্রস্থ হয়ে ওঠে। সে বলে, আমাদের এই মরা গাছের স্তূপটা পেরিয়ে জঙ্গলের আরো ভেতরে যেতে হবে, সেখানে আরেকটা গোরস্থান আছে। আমি তার দিকে একবার তাকাই, দেখি সে কোন মতে দু পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর পর আমি আমি সেই স্তুপটার দিকে তাকাই। তারপর বলি ‘আপনি এই অবস্থায় ওইটায় চড়তে পারবেন না, ঘাড় ভেঙে মরবেন শেষে।”

সে বললো, ‘আমার ঘাড় ভাঙবে না, তোমার ঘাড়েরও কিছু হবে না। আমি হাঁটতে পারবো, আর তুমি নিজেও তোমার কুত্তা নিয়ে উঠতে পারবে।” সে ঠিকই বলেছিল। সে সিল্কের মত মসৃণভাবে স্তুপটার ওপর উঠে গেল, এবং একবারের জন্যেও নিচে তাকিয়ে দেখল না। আর আমিও স্পটকে টেনে তুললাম। আমার ওজন তখন ছিল ৯০ পাউন্ডের মত আর স্পটের ওজন ৩৫ পাউন্ডের মত। পরদিন অবশ্য আমার শরীর ব্যথা হয়ে গেছিল। তোমার আজ কেমন লাগছে, লুইস?”

লুইস জবাব না দিয়ে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।

“আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি, হাঁটা আর শেষ হয় না। এক পর্যায়ে মনে হতে থাকে আমরা অনন্ত কালের জন্যে হাঁটছি, আর এই হাঁটা কখনো শেষও হবে না। সেসময় জঙ্গলটা আরো ভূতুড়ে ছিল। গাছের ওপর থেকে অনেক পাখি ডাকছিল আর কোনটা কী পাখি কিছুই চিনতে পারছিলাম না। কিছু জন্তু জানোয়ারও নড়াচড়া করছিল, বেশিরভাগই হরিণ। সে সময় ওখানে মুস হরিণ, ভালুক আর বন বেড়ালও ছিল। আমি স্পটের বস্তা টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমার অদ্ভুতভাবে মনে হলো যে আমার সামনে স্টানি না, হাঁটছে একজন ইন্ডিয়ান। আর সেই ইন্ডিয়ান হয়তো একটু পরে আমার দিকে ফিরলে আমি তার ভালুকের চর্বি দিয়ে বানানো কালি মাখা মুখটা দেখতে পাবো, দেখতে পাবো তার গায়ে চামড়ার বেল্ট দিয়ে বাধা পাথরের স্লেট থেকে বানানো টমাহক কুঠার। আর এরপর সে আমার ঘাড়ে চেপে ধরে এক কোপে আমার খুলির ওপরের অর্ধেক চুলসহ নামিয়ে নিয়ে আসবে। স্টানি আর আগের মত দুলছে না বা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে না। সে ওপরের দিকে তাকিয়ে একদম সহজভাবে হেটে চলছে, যার কারণে আমার তাকে ইন্ডিয়ান মনে হচ্ছিল। তবে যখন আমরা ঈশ্বরের জলাতে পৌঁছালাম, সে আমার দিকে ফিরলো কথা বলার জন্যে। লোকটা স্টানিই ছিল, তবে সে কেন হঠাৎ করে মাতলামি বন্ধ করে ভদ্র হয়ে গেল তা আমি বুঝতে পারি তাকে দেখে। সে বেশ ভয় পেয়েছে এবং ভয়ের কারণেই তার মাতলামি ছুটে গেছে।

সে আমাকে সেসব কথাই বলেছিল, যেগুলো আমি তোমাকে গত রাতে বলেছি। ওই সেইন্ট এলমোর আগুন আর লুন হাঁসদের ব্যাপারে। বলেছিল কিছু দেখলে যেন আমি উল্টো-পাল্টা কিছু মনে না করি। সবচাইতে গুরুত্ব দিয়ে বললেন যে যদি কেউ আমার সাথে কথা বলতে চায় তাহলে যেন আমি কোন উত্তর না দেই। এরপর আমরা জলা দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। এবং জানো লুইস, সে রাতে আমি সত্যই একটা জিনিস দেখেছিলাম। আমি তোমাকে বলবো না কি দেখেছিলাম তবে এটুকু বলি যে এর পর আমি সেখানে আরো পাঁচ বার গিয়েছি, কিন্তু ঐ রকম জিনিস আর একবারো দেখিনি। আর দেখার সম্ভাবনাও নেই, কারণ গতকালের মিকমেকদের গোরস্থানে যাত্রাই ছিল আমার শেষ যাত্রা।”

আমি সত্যি বসে বসে এইসব শুনছি? লুইস নিজেকে জিজ্ঞেস করে। তার মনে হচ্ছে সে নিজের সাথে কথা বলছে। তিন বোতল বিয়ার তাকে বেশ আলাপচারী করে তুলেছে, অন্তত তার নিজের কাছে। আমি এখানে বসে বসে নিশ্চয়ই উইন্ডিগোর কথা, জন্তু কবর দিলে তার জীবিত হয়ে ফিরে আসার কথা বিশ্বাস করছি না…বালের বিড়ালটা ট্রাকের বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল, আর কিছু না। এই বুড়ো যা বলছে তা সব তার ভীমরতি।

কিন্তু লুইস মনের গভীরে জানতো এটা জাডের ভীমরতি না। আর এই ‘জানা’ থেকে সে তিন বোতল বিয়ার খেয়েও মুক্তি পাবে না, এমনকি ত্রিশ বোতলেও না।

চার্চ মরে গিয়েছিল, সেটা প্রথম সমস্যা; সে মরে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে এটা দ্বিতীয় সমস্যা; আবার সে আর আগের মত নেই, তার ভেতর একটা মৌলিক পরিবর্তন এসেছে, সেটা তৃতীয় সমস্যা। কিছু একটা হয়েছে। জাড এটাকে তার ঋণ পরিশোধ হিসেবে দেখেছে কিন্তু মিকমেক গোরস্থানের মাটিতে যেই ঔষধ পাওয়া যায় তা হয়তো খুব একটা ভালো ঔষধ না আর লুইস জাডের চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে যেটা তাকে বলছে যে এটা জাড নিজেও জানে। লুইস গতরাতেও জাডের চোখে কিছু দেখেছিল-চঞ্চল, আনন্দে ভরা কিছু। তার গতকালের একটা ভাবনার কথা মনে পড়ে যায়। সে জাডের চোখের ওই দৃষ্টি দেখে ভেবেছিল তাকে আর তার মেয়ের বিড়ালকে মিকমেকদের গোরস্থানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ জাডের নিজের ছিল না।

জাডের নিজের না হলে কার সিদ্ধান্ত? তার মন তাকে জিজ্ঞেস করে। আর যেহেতু লুইস এই প্রশ্নের উত্তর জানতো না তাই সে অস্বস্তিকর প্রশ্নটা মস্তিষ্ক থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

“আমি স্পটকে কবর দিয়ে তার ওপর একটা শিলাস্তম্ভ তৈরি করি আমার কাজ যখন শেষ হয়, স্টানি ততক্ষনে ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে গেছে। আমি তাকে প্রচন্ড রকমভাবে ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে উঠাই। কিন্তু আমরা যতক্ষণে ওই চুয়াল্লিশ টা ধাপ বেয়ে -”

“পয়তাল্লিশটা,” লুইস বিড়বিড় করে বলে।

জাড মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। “ঠিক, পয়তাল্লিশটা, তাই না? পয়তাল্লিশটা। আমরা যতক্ষণে ওই পয়তাল্লিশটা ধাপ বেয়ে নিচে নেমেছি ততক্ষনে স্টানি আবার এমনভাবে হাঁটতে শুরু করে যেন সে একদমই মাতাল না। আমরা ওই জলা পেরিয়ে, মরা গাছের স্তুপ পেরিয়ে যখন আমার বাসার নিচে ফিরে আসি তখন আমার মনে হয় সব মিলিয়ে আমাদের দশ ঘন্টার মত সময় গিয়েছে। কিন্তু তখনো চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল, অথচ আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম মাঝ রাতের পরে।

“এখন কী হবে?’ আমি স্টানিকে জিজ্ঞেস করি।

“এখন অপেক্ষা করে দেখ কী হয়,’ স্টানি বলেই হেটে চলে যেতে লাগলেন, আগের মত দুলতে দুলতে। দেখা গেল আমার কুকুর স্পট স্টানি থেকে দুই বছর বেশি বেঁচে ছিল। বুড়োর লিভার নষ্ট হয়ে গেছিল। একদিন দুইটা বাচ্চা ছেলে তাকে রাস্তার ওপর মরে লাঠির মত শক্ত হয়ে যাওয়া অবস্থায় খুঁজে পায়।”

“আর আমি সে রাতে সুবোধ বালকের মত আইভি লতা বেয়ে আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ি। বালিশে মাথা লাগার সাথে সাথেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

পরদিন আমি অনেক দেরি পর্যন্ত ঘুমাই। আমার মায়ের ডাকাডাকিতে আমার ঘুম ভাঙে। আমার বাবা রেলরোডে কাজ করে তাই তিনি ভোর বেলা কাজে চলে যান।” জাড থেমে একটু চিন্তা করলেন। “আমার মা শুধু আমাকে ডাকছিলেন না, লুইস। উনি আমার নাম ধরে চিৎকার করছিলেন।

জাড উঠে ফ্রিজ থেকে একটা বিয়ারের বোতল বের করে টোস্টার আর রুটির বাক্সের নিচের ড্রয়ারের হ্যাণ্ডেলে চাপ দিয়ে সেটার মুখ খুললেন। মাথার ওপরের হলুদ আলোতে তার চেহারাও হলুদ দেখাচ্ছে; নিকোটিনের রং। তিনি অর্ধেক বোতল বিয়ার এক নিশ্বাসে গিলে ফেলে গুলির মত শব্দ করে ঢেঁকুর তুললেন। এরপর তিনি নরমা যে রুমে ঘুমাচ্ছে সেই রুমের দিকে তাকিয়ে আবার লুইসের দিকে ফিরলেন।

“এই জিনিসটা নিয়ে কথা বলা আমার জন্যে একটু কঠিন, তিনি বললেন। “আমি আমার মনে এই ব্যাপারটা নিয়ে অসংখ্যবার ভেবেছি কিন্তু কক্ষনো কারো সাথে কোন আলোচনা করিনি। অন্যরা জানতো কী হয়েছে, কিন্তু এটা নিয়ে কেউ আমার সাথে কোন কথা বলতে আসেনি। অনেকটা সেক্সের বিষয় মানুষ যেভাবে এড়িয়ে চলে। লুইস তোমাকে এটা বলে রাখি, তোমার বেড়ালটা আর আগের বেড়াল নেই। এটা বিপজ্জনক কিছু না কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা বেড়াল। তোমার কী মনে হয়েছে?’

লুইসের মনে পড়ে গেল চার্চের সেই ‘অন্যরকম’ আচরণগুলো, কিভাবে চার্চ টয়লেটের সিটের ওপর দুলছিল, কী অদ্ভুতভাবে সে টয়লেটের সিটটা থেকে লাফিয়ে পড়লো, কী আনাড়িভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে বাথটাবের সাথে ধাক্কা খেল; কিভাবে চার্চ নিজের হলদে-সবুজ চোখগুলো দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

এরপর সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।

“আমি নিচে গিয়ে দেখলাম আমার মা স্টোররুমের এক কোণে দাড়িয়ে আছেন। মেঝেতে অনেকগুলো সাদা পর্দা এলোমেলোভাবে পড়ে ছিল, যেগুলো আমার মা ওখান থেকে আনতে গিয়েছিলেন। আর রুমের দরজায় স্পট দাঁড়িয়ে ছিল, আমার স্পট। স্পটের সারা শরীর ধুলোবালিতে মাখামাখি হয়ে ছিল, আর ওর পাগুলো পানির ওপর দিয়ে আসার কারণে ধুয়ে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। ওর পেটের কাছের চামড়া বিশ্রীভাবে কুচকে গিয়েছিল। ও গর্জন বা গরগর কিছুই করছিল না, শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ওই আমার মাকে রুমের কোণায় পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেছে, সেটা ও চাক আর না চাক। মা একদম আতঙ্কিত অবস্থায় ছিলেন, লুইস। তুমি তোমার মা- বাবাকে কেমন চোখে দেখতে আমি জানি না, কিন্তু আমি আমার বাবা-মাকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসতাম। আমি নিজের মাকে এমন একটা পরিস্থিতিতে ফেলেছি ভেবে স্পটের ফিরে আসাতেও আমি কোন আনন্দ পাচ্ছিলাম না। এবং জানো কি? আমি সেখানে স্পটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেমন আশ্চর্যও হইনি।”

“আমি জানি অনুভূতিটা কেমন,” লুইস বলে। “আজ সকালে যখন চার্চকে দেখলাম, আমার মনে হয়েছিল এটাই-” সে এক মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। স্বাভাবিক? এই শব্দটাই তার মনে এসেছিল, কিন্তু এই শব্দটা বলাটা ঠিক মনে হলো না তার কাছে। “মনে হয়েছিল যে এমনটাই হবার কথা ছিল।”

“হুম,” জাড বললেন। তিনি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। লুইস দেখলো তার হাত হালকা হালকা কাঁপছে। “যখন আমার মা আমাকে সেখানে রাতের পোশাক পড়া অবস্থায় দাড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি আমাকে চিৎকার করে বলেন, ‘তোর কুকুর সামলা! এটাকে খেতে দে, এটার ক্ষিদা লেগেছে! তাড়াতাড়ি এটাকে বাইরে নিয়ে যা, পর্দাগুলোকে নোংরা করার আগেই!”

“ঝাড়ি খেয়ে আমি ওকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে ওর জন্যে কিছু বেঁচে যাওয়া খাবার যোগাড় করি। ওকে যখন আমি ডাকি ও সাড়া দেয় না, যেন ও নিজের নাম ভুলে গেছে। এটা দেখে আমি প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম এটা আমার স্পট না, বাইরের কোন নেড়ি কুকুর হবে যেটা দেখতে একদম স্পটের মত, আর কিছু না—”  

“হ্যাঁ! একদম তাই!” লুইস অবাক হয়ে বলে।

জাড মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানান। “তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার যখন ডাকলাম, ও আসলো। ও একরকম ঝাঁকি দিয়ে আমার দিকে এলো। আর যখন আমি ওকে বারান্দায় যেতে দিলাম ও প্রায় দৌড়ে দরজা পার হলো আর ওপাশে গিয়ে প্রায় হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল। ও অবশ্য খাবারগুলো খায়; একদম রাক্ষসের মত খায়। ততক্ষণে আমার আতঙ্ক কেটে গেছে আর কি হয়েছে তা বুঝতে আরম্ভ করি। আমি হাঁটু গেড়ে বসে ওকে জড়িয়ে ধরি, আমি ওকে ফিরে পেয়ে যারপরনাই খুশি। আর ও জিভ দিয়ে আমার গাল চেটে দেয়, আর…”

জাড কেঁপে উঠলেন। বোতলের বাকি বিয়ারটুকু তিনি শেষ করলেন।

“লুইস, ওর জিভ ছিল একদম ঠান্ডা। গালে মড়া মাছ ডললে যেমন লাগে, ওর চেটে দেয়াও আমার কাছে তেমন লেগেছিল।”

এরপর কয়েক মুহূর্তের জন্যে ওরা দুজনেই চুপ করে থাকে। এরপর লুইস নীরবতা ভেঙে বলে, “তারপর বলুন।”

“ওর খাওয়া শেষ হলে আমি আমাদের পেছনের বারান্দার নিচ থেকে একটা পুরনো বড় বোল বের করলাম, যেটাতে আমরা স্পটকে গোসল করাই। স্পট গোসল করতে কখনই পছন্দ করতো না, ওকে গোসল করাতে আমার আর বাবার দুজনের দরকার হতো। আর ওকে গোসল করাতে গিয়ে আমার আর আমার বাবার দুজনেরই জামা কাপড় ভিজে একাকার হয়ে যেত। রেগে গিয়ে আমার বাবা স্পটকে শাপ-শাপান্ত করতেন আর স্পট লজ্জায় কুঁকড়ে যেত, কুকুররা যেমন করে আর কি। আর প্রায় সময় গোসল শেষ হওয়া মাত্র স্পট মাটিতে গড়াগড়ি খেত। আর ধুলো বোঝাই শরীর নিয়ে আমার মার শুকোতে দেয়া কাপড়ের দড়ির কাছে গিয়ে গা ঝারা দিয়ে পরিস্কার কাপড়গুলোর বারোটা বাজাতো। আর আমার মা তো সেই রকম ক্ষেপে গিয়ে আমাদের বাপ-বেটা দুজনকেই ইচ্ছে মত ঝাড়তেন আর বলতেন এই বদের হাড্ডি কুকুরটাকে তিনি গুলি করে মারবেন।”

“কিন্তু সেদিন গোসল করানোর সময় স্পট কোন ঝামেলাই করে না। ও চুপচাপ বোলের পানির মধ্যে বসে তাকে গোসল করাতে দিল। আর ব্যাপারটা আমার একদমই পছন্দ হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল…আমি কোন লাশকে গোসল করাচ্ছি। গোসল শেষ করে আমি একটা পুরনো টাওয়েল দিয়ে ওর গা মুছে দেই। যেখানটাতে ওর কাঁটাতার লেগে ঘা হয়েছিল সেটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম—জায়গাটায় কোন পশম ছিল না। কোন ঘা শুকিয়ে যাওয়ার পাঁচ বছর পর জায়গাটা যেমন দেখা যায়, স্পটের ঘায়ের জায়গাটাও তেমন দেখা যাচ্ছিল।”

লুইস মাথা ঝাঁকায়। তার পেশায় সে এরকমটা অহরহ দেখে। ঘায়ের গর্তগুলো কখনোই পুরোপুরি ভরাট হয় না। এই চিন্তা করতে গিয়ে তার আন্ডারটেকার চাচার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন কবর খোঁড়ার পর আবার ভরাট করার সময় কখনই পুরোপুরি ভরাট করার জন্যে পর্যাপ্ত মাটি থাকে না।

“এরপর আমি ওর মাথা পরীক্ষা করে দেখলাম। সেখানে এরকমই আরেকটা পুরনো ক্ষতের চিহ্ন ছিল কিন্তু সেখানে নতুন করে পশম গজিয়েছে। এটা ছিল ওর কানের কাছে।”

“আপনার বাবা ওকে যেখানে গুলি করেছিলেন?”

জাড মাথা ঝাঁকান।

“কোন মানুষ বা পশুর মাথায় গুলি করলেই যে সে একশোভাগ নিশ্চিতভাবে মারা যাবে, তা কিন্তু না। এরকম অনেকে অথর্ব হয়ে বেঁচে আছে যারা আত্মহত্যা করার জন্যে নিজের মাথায় গুলি চালিয়েছিল। কিন্তু গুলি তাদের ব্রেনে আঘাত না করে অনেকটা প্যারাবোলিক পথে ঘুরে মাথার আরেকপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি নিজে এরকম একটা কেস দেখেছি। লোকটা নিজের কানের নিচে গুলি করে সুইসাইড করে। সে মারা গিয়েছিল কারণ বুলেটটা তার ব্রেনকে আঘাত না করে পাশ কাটিয়ে গেলেও মাথার আরেক পাশে গিয়ে জাগুলার ভেইন কেটে ফেলে। আর মাথার ভেতরে ওই বুলেটের গতিপথ ছিল একদম গ্রামের রাস্তার ম্যাপের মত।”

জাড মাথা ঝাঁকিয়ে মুচকি হাসলেন। “এরকমটা যে হতে পারে তা আমি নরমার একটা ম্যাগাজিনে পড়েছি। কিন্তু আমার বাবা যেহেতু বলেছিলেন স্পট মারা গিয়েছিল, সেহেতু স্পট অবশ্যই মারাই গিয়েছিল, কোন সন্দেহ নেই।”

“আচ্ছা,” লুইস বলে। “আপনি যদি বলেন ঘটনা এভাবে ঘটেছিল, তাহলে এভাবেই ঘটেছিল।”

“তোমার মেয়ের বেড়াল কি মরেনি?”

“আমি তো ভেবেছিলাম ও মারাই গেছে,” লুইস বলে।

“শুধু ভেবেছিলে বললে হবে না, তুমি একজন ডাক্তার।”

“আপনি এমনভাবে বলছেন ‘লুইস তোমাকে ঈশ্বরের মত সব জানতে হবে, কারণ তুমি ডাক্তার।” আমি কোন ঈশ্বর না। তাছাড়া তখন খুব অন্ধকার-”

“অবশ্যই অন্ধকার ছিল এবং চার্চের মাথা বল বেয়ারিংয়ের মত চারদিকে ঘুরছিল। তারপর তুমি যখন তাকে বরফ থেকে টেনে তুললে, তখন এমন ফরফর করে আওয়াজ হলো, যেন তুমি দেয়ালের গা থেকে আঠা দিয়ে লাগানো কোন পোস্টার খুলছো। জীবিত জিনিস এরকম করে না। বরফের ওপর কোন জীবিত জিনিস থাকলে সেটা গায়ের তাপে তার নিচের বরফ গলাতেই থাকে, যতক্ষণ তার জীবন থাকে। গলা বরফ জমতে শুরু করে তার মরার পরে শরীর ঠান্ডা হবার পর।”

পাশের ঘর থেকে ঘড়িতে সাড়ে দশটার ঘন্টার আওয়াজ আসে।

“আপনার বাবা বাসায় এসে আপনার কুকুরকে দেখে কী বললেন?” লুইস জিজ্ঞেস করে।

“আমি ড্রাইভওয়ের মাটিতে বসে মার্বেল খেলছিলাম। বাবার হাতে শক্ত মার খাওয়ার আগে আমার সব সময় যেমন লাগতো তখনো ঠিক তেমন লাগছিল। আমি ওখান থেকেই দেখলাম আমার বাবা গেট দিয়ে বাসায় ঢুকছে। তার পরনে তার কাজের বিব পোশাক। দেখেছো এরকম জামা?”

লুইস মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায় আর হাতের উল্টোদিক দিয়ে নিজের হাই ওঠা ঢাকে।

“দেরি হয়ে যাচ্ছে, না?” জাড বললেন। “তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।” ‘খুব একটা দেরি হয়নি। অন্যদিনের চাইতে বেশি বিয়ার গিলে ফেলেছি তাই একটু ক্লান্ত লাগছে। আপনি আপনার মত করে বলুন, আমি পুরোটা শুনতে চাই।”

“আমার বাবার টিফিন নেয়ার জন্যে টিনের একটা বাক্স ছিল,” জাড বললেন। “উনি ওই খালি টিনের বাক্সটা দুলাতে দুলাতে শিস্ বাজাতে বাজাতে গেট দিয়ে ঢুকলেন। তখন চারদিক প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে, তবে তিনি আমাকে দেখলেন। দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাই জাডসন! কী খবর?’ যেমনটা তিনি সবসময় জিজ্ঞেস করেন, তারপর বললেন, ‘তোমার মা–’

তিনি এটুকুই বলতে পারলেন আর তখনি স্পট অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে এলো। অন্যদিন বাবা ফিরে এলে স্পট আনন্দে তার ওপর গিয়ে লাফিয়ে পড়তো। কিন্তু সেদিন সে লেজ নাড়িয়ে ধীরে ধীরে তার দিকে হেঁটে যেতে লাগলো। আমার বাবা তার হাত থেকে বাক্সটা ফেলে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি স্পটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আর স্পট যখন আসলেই বাবার ওপর ওর সামনের দুই পা তুলে দিলো, আমার বাবা সেগুলো দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন, যেভাবে একসাথে নাচার সময় মহিলা সঙ্গির হাত ধরতে হয়। তিনি কুকুরটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘ওকে গোসল করাতে হবে জাড। ওকে যে মাটির নিচে কবর দিয়েছিলে সেই মাটির গন্ধ এখনো ওর গায়ে।” বলেই তিনি বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।

“আপনি তখন কী করলেন?” লুইস জিজ্ঞেস করে।

“ওকে আবার গোসল করালাম। এবারো সে বোলের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকলো গোসলের সময়টা। এরপর আমি যখন বাসায় ঢুকলাম ততক্ষনে আমার মা শুয়ে পড়েছেন, যদিও তখন মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। আমার বাবা আমাকে বললেন, ‘তোমার সাথে আমার কথা আছে, জাডকিন।” আমি বাবার সামনে গিয়ে বসলাম আর বাবা প্রথমবারের মত আমার সাথে বড় মানুষের মত কথা বললেন।”

জাড ক্র্যান্ডাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। “আমি আগে ভাবতাম আমার বাবা আমার সাথে এভাবে কথা বললে আমার হয়তো খুব ভালো লাগবে। কিন্তু সেদিনের সেই কথার মধ্যে ভালোলাগার ছিটেফোঁটাও ছিল না, লুইস। দুই আয়নার মাঝখানে দাঁড়ালে যেমন লাগে আমার ঠিক তেমন লাগছিল। একটা আয়নার ভেতর আরেক আয়নায় তোমাকে দেখবে, তার ভেতর আরেক আয়নায়ও তুমি নিজেকেই দেখবে, এভাবে আয়না আর আয়নার গর্তে তুমি হারিয়ে যাবে। আমি জানি না এই একই আলাপ আরো কতোবার হয়েছে, শুধু চরিত্রগুলো বদল করে…আর এই কথাটাও প্রথম বাবার সাথে সেক্স নিয়ে আলাপের মতই।”

“আপনার বাবা তাহলে সব জানতেন?”

“হ্যাঁ। ‘তোমাকে ওখানে কে নিয়ে গেছে, জাড?’ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি স্টানির নাম বলে দেই। বাবা শুধু মাথা ঝাকালেন, তিনি আসলে তাকেই সন্দেহ করেছিলেন। আমি পরে জানতে পারি ওই সময়ে লাডলোতে ছয় অথবা আটজন ওই গোরস্থানটার কথা জানতেন। তবে তাদের মধ্যে শুধু স্টানির পক্ষেই আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার মত পাগলামি করা সম্ভব ছিল।”

“আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেননি, তিনি নিজে কেন আপনাকে সেখানে নিয়ে যাননি?”

“করেছিলাম। ওই লম্বা আলাপের মাঝেই তাকে আমি এই প্রশ্নটা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে ওটা খুব খারাপ একটা জায়গা। এটা আদতে পশুর মালিকের কোন উপকার করে না, না করে সেই প্রাণীটার। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন স্পট যেরকম হয়ে গেছে সেরকম স্পটকে আমি পছন্দ করি কি না। আর জানো কি লুইস, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার সবচাইতে কষ্ট হয়েছে…আর এটা গুরত্বপূর্ণ যে আমার তখন কেমন লেগেছিল আমি সেটা তোমাকে বলি, কারণ তুমি এক সময় না এক সময় আমাকে ঠিকই জিজ্ঞেস করবে যদি এতে কোন উপকার না হয় তাহলে আমি কেন তোমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম।”

লুইস মাথা ঝাঁকায়। এলি এসে যখন চার্চকে এভাবে দেখবে তখন ও কী ভাববে? এই চিন্তাটাই আজ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল যখন সে স্টিভ মাস্টারটনের সাথে দুপুরে র‍্যাকেট খেলছিল।

“হয়তো আমি এটা করেছি কারণ আমি মনে করি বাচ্চাদের বোঝা উচিত, মাঝে মাঝে কিছু মরে গেলে সেটাকে সেভাবে রাখাই মঙ্গলের,” জাড বললেন। “এই জিনিসটা তোমার এলি জানে না আর আমার ধারণা এলি এটা জানে না কারণ তোমার স্ত্রীও সেটা জানে না। আর তোমার যদি মনে হয় আমি ভুল বলছি তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই এই ব্যাপারে।”

লুইস কিছু বলতে গিয়ে তার মুখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলে।

জাড বলতে থাকেন, এবার খুব ধীরে ধীরে। তিনি একটা শব্দের পর আরেকটা শব্দে যাচ্ছেন, ঠিক যেমনটা তারা গত রাতে ঈশ্বরের জলায় এক শুকনো জায়গা থেকে আরেক শুকনো জায়গায় পা ফেলেছিল।

“আমি এরকমটা বছরের পর বছর দেখে আসছি,” তিনি বললেন। “আমি মনে হয় তোমাকে বলেছি লেস্টার মরগান তার পুরষ্কার জেতা ষাঁড়টাকে সেখানে গোর দিয়েছিল। কালো ষাঁড়টার নাম ছিল হ্যানরাট্টি। ষাঁড়ের জন্যে বেশ অদ্ভুত নাম, ঠিক?

শরীরের ভেতরের এক রকম ইনফেকশনে সেটা মারা যায় আর লেস্টার একটা স্লেজে করে সেই মরা ষাড়টাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। সে কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করেছিল তা আমি জানি না-কিভাবে সে ওই মরা গাছের স্তূপের ওপর ওটাকে তুলেছিল তাও জানি না। লোকজন বলে যে কেউ মন থেকে কিছু করতে চাইলে সে অবশ্যই সফল হয়। তবে যতক্ষণ আমরা ওই গোরস্থানটার ব্যাপারে বলছি, এই কথাটা একদম সত্য।

যাই হোক, হ্যানরাট্টি ফিরে আসে তবে লেস্টার তাকে দুই সপ্তাহের মাথায় গুলি করে মেরে ফেলে। ষাঁড়টা খুব বিগড়ে গেছিল-বিগড়ে গেছিল মানে চরমভাবেই বিগড়ে গেছিল। তবে এরকম আর কোন পশুর সাথে হতে আমি শুনিনি। বেশিরভাগ পশুই উল্টো আরো বোকা হয়ে যায়, একটু ধীর…একটু একটু…”

“একটু একটু মৃত?”

“হুম,” জাড বললেন। “একটু একটু মৃত। যেন তারা দূরে কোথাও চলে গিয়েছিল…তারপর সেখান থেকে ফিরে এসেছে…কিন্তু পুরোটা আসেনি। তবে তোমার মেয়ে সেটা জানছে না। ও জানতে পারবে না যে ওর বেড়াল ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে অক্কা পেয়েছিল তারপর আবার ফিরে এসেছে। এখন তুমি বলতে পারো যে, কাউকে কী শিখতে হবে তা তাকে না বলে দিলে সে কিভাবে সেটা শিখবে? তবে…”

“তবে কখনো কখনো ঠিকই শেখানো যায়,” লুইস বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বলে।

“হ্যাঁ, কখনো কখনো যায়,” জাড সম্মতি জানালেন। “হয়তো সে শিখতে পারবে মৃত্যু আসলে কী। শিখতে পারবে মৃত্যু মানে কষ্টের সমাপ্তি আর সুন্দর সুন্দর স্মৃতির সূচনা। জীবনের সমাপ্তি নয় শুধু, কষ্টেরও সমাপ্তি। তুমি এসব তাকে বলবে না, সে নিজে থেকেই শিখে যাবে।”

“ও যদি আমার মত হয় তাহলে ও ওর বেড়ালকে ভালোবেসেই যাবে। এটা বদমায়েশি করবে না, কামড়াবে না বা এই জাতীয় কিছুই করবে না। ও ওর বেড়ালকে ভালোবেসেই যাবে। তবে এক সময় সে পরিবর্তনটা ঠিকই ধরতে পারবে আর নিজের মত করে একটা উপসংহার তৈরি করে নিবে…আর অবশেষে যখন এটা মরে যাবে, সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে।”

“আর এজন্যেই আপনি আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছেন,” লুইস বলে। তার এখন আগের থেকে ভালো লাগছে। সে একটা ব্যাখ্যা পেয়েছে। ব্যাখ্যাটা যুক্তির চাইতে মনের সংবেদনশীলতার ওপর বেশি নির্ভর করছে, তবে সে ভেবে দেখলো বর্তমান পরিস্থিতিতে সে তা মেনে নিতে পারছে। আর এর মানে সে গতকাল জাডের মুখে দেখা অভিব্যক্তিটা ভুলে যেতে পারবে, সেই চঞ্চল উল্লাসের অভিব্যক্তিটি। “আচ্ছা, তাহলে-”

লুইসকে চমকে দিয়ে জাড হঠাৎ দুহাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে ফেলেন। লুইস প্রথমে ভেবেছিল জাড হয়তো হঠাৎ কোন তীব্র ব্যথা অনুভব করছেন। লুইস তার চেয়ার থেকে প্রায় উঠে দাঁড়িয়েছে এমন মুহূর্তে সে খেয়াল করলো বৃদ্ধের বুক আক্ষেপ পীড়িতভাবে ওঠানামা করছে এবং সে বুঝতে পারলো বৃদ্ধ আসলে কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন।

“এজন্যেই…কিন্তু আবার এজন্যে না,” জাড বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন। “আমি এই কাজটা করেছি সেই একই কারণে যে কারণে স্টানি এই কাজ করেছিল এবং লেস্টার মরগানও একই কাজ করেছিল। লেস্টার লিন্ডা লেভেস্ককে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল, লিন্ডার কুকুর গাড়ি চাপা পড়ে মারা যাবার পর। সে এটা করেছিল নিজের ষাঁড়কে গুলি করে সেটার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার পর, কারণ সেটা মাঠে বাচ্চাদের পাগলের মত তাড়া করে বেড়াতো। কিন্তু তারপরেও সে তাই করেছিল যা গতকাল আমি করেছি, লুইস,” জাড প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন, “তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো না?”

“আপনি এসব কী বলছেন?” লুইস চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে।

“লেস্টার আর স্টানি এটা যে কারণে করেছিল, আমিও গতকাল তা ঠিক একই কারণে করেছি, লুইস। এই কাজটা আমরা করেছি, কারণ এটা আমাদের পেয়ে বসেছিল। ওই গোরস্থানটা একটা গোপন জায়গা, আর এর গোপনীয়তা তুমি অন্যদের জানাতে চাইবে। আর তখন তুমি এটা কাউকে জানানোর জন্যে উপযুক্ত কারণ খুঁজে নিবে। এরপর…” জাড তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে লুইসের দিকে চাইলো। তার চোখে ছিল প্রাচীন বন্যতা। “এরপর তুমি সেটা করবেই। তুমি নিজেই সেটার পেছনে যুক্তি দাঁড় করাবে… এবং সেই যুক্তিগুলো তোমার কাছে খুব ঠিক মনে হবে, তবে আসল কথা তুমি সেটা করতে চাও। অথবা তুমি সেটা করতে বাধ্য। আমার বাবা আমাকে সেখানে নিয়ে যাননি কারণ তিনি ওই জায়গার ব্যাপারে শুনেছিলেন, কিন্তু নিজে কখনো সেখানে যাননি। কিন্তু স্টানি আগে সেখানে গিয়েছিল…তাই সে আমাকেও নিয়ে গেছে। আর তারপর সত্তর বছর কেটে গেল…এরপর একদিন আমিই…”

জাড় মাথা নাড়লেন আর তার হাতের পিঠে মুখ চেপে ধরে শুকনোভাবে কাশলেন।

“শোন, লুইস,” তিনি বললেন। “আমার জানামতে লেস্টারের ষাঁড় ছাড়া আর কোন পশুই চূড়ান্ত বদ হয়ে যায়নি পেট সেমিটারি থেকে ফেরার পর। মিসেস লাভেস্কির ছোট্ট কুকুরটা একবার এক ডাক পিয়নকে কামড়ে দিয়েছিল আর…আরো কিছু কিছু কথা শুনেছি যে ফিরে আসা পশুরা দু-একটা উল্টাপাল্টা কাজ করেছে…কিন্তু আমার স্পট সব সময়ই খুব ভালো কুকুর ছিল। কিন্তু ওর গা থেকে সবসময় মাটির গন্ধ বের হত, আমি যতবারই ওকে গোসল করাই না কেন, কিন্তু ও সব সময় ভদ্র আচরণ করতো। তবে আমার মা এর পর থেকে ওকে আর কখনই স্পর্শ করেননি। আর লুইস, আজ রাতে যদি তুমি তোমার ফিরে আসা বেড়ালকে আবার মেরে ফেলতে চাও, আমি একটা কথাও বলবো না।

“ওই জায়গাটা…ওই জায়গাটা যদি একবার তোমার ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলে…তুমি সুন্দর সুন্দর যুক্তি উদ্ভাবন করতে শুরু করবে… আমার ভুল হতে পারে, লেস্টার আর স্টানিরও ভুল হতে পারে। আমি কোন ঈশ্বর না। কিন্তু মৃতকে ফিরিয়ে আনা? এই কাজটা করে আমরা ঈশ্বর ঈশ্বর খেলতে পারি, তাই না?”

লুইস আবার তার মুখ খুলে বন্ধ করে ফেলে। সে যা বলতে চাচ্ছিল তা তার কাছে নিষ্ঠুর শোনায়। জাড, আমি কি এই বালের বিড়ালটাকে আরেকবার মেরে ফেলার জন্য এতো কিছু করেছি!

জাড তার বোতলের বাকি বিয়ারটুকু খালি করে পাশে রাখা আগের খালি বোতলগুলোর সাথে রাখেন। “আমার এটুকুই বলার ছিল,” তিনি বললেন। “আর কিছু বলার নেই।

“আমি আপনাকে আরেকটা প্রশ্ন করতে পারি?” লুইস জিজ্ঞস করে। “করো,” জাড বললেন।

লুইস বলল, “ওখানে কেউ কখনো কোন মানুষ কবর দিয়েছে?”

কথাটা শুনে আচমকা জাডের হাত ঝাঁকি দিয়ে উঠলো আর তাতে দুইটা বিয়ারের খালি বোতল মেঝেতে পড়ে গেলে তাদের মধ্যে একটি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।

“ওহ খোদা!” তিনি লুইসকে বললেন। “এই কাজ কে করতে যাবে? এরকম কথা ভুলেও মুখে নিও না, লুইস!”

“আমি শুধু জানার জন্যে জানতে চাইছি,” লুইস অস্বস্তির সাথে বলে।

“কিছু জিনিস জেনে কোন উপকার হয়না,” জাড বললেন। লুইসের কাছে জাডকে প্রথমবারের মত প্রচন্ড বৃদ্ধ আর দুর্বল মনে হলো, যেন তিনি তার নিজের জন্যে খোঁড়া কবরের সামনে দাড়িয়ে আছেন।

পরে বাসায় গিয়ে যখন লুইস বিষয়টা নিয়ে আবার ভাবলো তখন জাডের চেহারায় আরেকটা জিনিস ছিল বলে তার মনে হয়।

জাডকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি মিথ্যা বলছেন।

অধ্যায় ২৭

লুইস নিজেদের গ্যারেজে পৌঁছানোর আগে টের পায়নি যে সে নেশায় মাতাল হয়ে গেছে।

বাইরে তারা এবং চাঁদের আলোয় সে পথ চলে। আলোতে ছায়া পড়ছে না কিন্তু চারদিক মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। গ্যারেজে ঢুকে সে একদম অন্ধ হয়ে যায়। গ্যারেজের বাতির সুইচটা কোথায় কিছুতেই মনে করতে পারছে না। সে আঁধারে খুব সাবধানে পা ফেলে এগুতে থাকে। এক পা এক পা করে আগায় সে। আশঙ্কা করছে এলির সাইকেল বা গেজের খেলনা কুমিরে পা হড়কে পড়ে তার হয়তো আজ এখানেই ভূপাতিত হতে হবে।

বিড়ালটা কই? সে কি বিড়ালটাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছিল?

সে ভুল পথে এগিয়ে একটা দেয়ালের সামনে গিয়ে ঠেকে। হাতের তালুকে একটা চোখা জিনিস খোঁচা দিলে অন্ধকারের উদ্দেশ্যে “বাল!” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। কিন্তু পরমুহূর্তেই বুঝতে পারে তার চিৎকারটা রাগের না, বরং ভয়ের। এবার সে গ্যারেজের ভেতর একদমই দিশা হারিয়ে ফেলে। লাইট সুইচটা কোথায় আছে এটা জানে না শুধু তা নয়, বরং এখন সে কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। কিচেনের দরজাটা কোথায় সেই দিশাও তার আর নেই।

সে আবার হাঁটতে শুরু করে, খোঁচা খাওয়া হাতের তালুটা এখনো জ্বলছে। অন্ধদের হয়তো এমনি লাগে সব সময়, সে ভাবে। তার ছয় বছর আগে প্রেগনেন্ট রাচেলের সাথে যাওয়া স্টিভ ওয়ান্ডারের কনসার্টের কথা মনে পড়ে যায়। ছয় বছর হয়ে গেছে? তার কাছে অসম্ভব মনে হয়। দুইজন লোক ওয়ান্ডারকে ধরে মেঝেতে পড়ে থাকা সাপের মত কেবলগুলোকে ডিঙ্গিয়ে তার সিন্থেসাইজারের কাছে পৌঁছে দেয়। আর পরবর্তীতে সে যখন তার সহশিল্পীর সাথে নাচার জন্যে উঠে দাঁড়ায়, সেই সহশিল্পী মহিলা তাকে ধরে ধরে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসে। সে ভালোই নেচেছিল, লুইসের মনে আছে কিন্তু তাকে ঠিকই নাচার জায়গায় ধরে ধরে নিতে হয়েছিল।

কেউ আমার হাত ধরে কিচেন পর্যন্ত এগিয়ে দিলে কেমন হয়? সে ভাবে…এবং পরক্ষণেই কেঁপে ওঠে

আসলেই যদি অন্ধকার থেকে একটা হাত বের হয়ে তাকে পথ দেখাতে শুরু করে তাহলে…সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেই যাবে তো করেই যাবে।

থমকে দাঁড়ালো সে, তার হৃৎপিন্ড লাফাচ্ছে। “এসব বাল ছাল বন্ধ কর, সে নিজেকে ধমক দেয়। কাম অন, কাম অন-ওই বালের বিড়ালটা কই?”

এরপর সে আসলেই দড়াম করে ধাক্কা খেল, তাদের স্টেশান ওয়াগন গাড়িটার বাম্পারের সাথে খুব বাজেভাবে। তার হাঁটু থেকে ব্যথার একটা ঢেউ তার সারা শরীরে ভেসে গেল এবং ব্যথায় তার চোখে পানি চলে আসলো। সে তার পা তুলে আঘাতের জায়গাটা চেপে ধরে বক পাখির মত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে এখন সে বুঝতে পারছে কোথায় আছে, সে গ্যারেজের ভেতরে তার দিশা ফিরে পেয়েছে। তাছাড়া অন্ধকারে তার দেখার ক্ষমতাও চলে আসছে ধীরে ধীরে। সে বিড়ালটাকে বাড়ির ভেতরেই রেখে গিয়েছিল, তার মনে পড়ে। বিড়ালটাকে স্পর্শ করতে চায়নি বলে ওটাকে বের করা হয়নি আর-

আর ঠিক তখনি সে তার গোড়ালিতে চার্চের উষ্ণ, লোমশ দেহের ঘর্ষণ অনুভব করতে পারে। আর পরমুহূর্তে তার হাঁটুর নিচে চার্চের সাপের মত জঘন্য লোমশ লেজের স্পর্শ পায়। এবার লুইস নিজেকে শান্ত রাখতে পারে না। তার বুক চিড়ে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।

অধ্যায় ২৮

“বাবা!” এলি আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।

এলি জেটওয়ে থেকে তার দিকে দৌড়ে আসতে থাকে। ও বাড়ি ফেরা যাত্রীদের মাঝে দিয়ে এঁকে বেঁকে দৌড়াচ্ছে, অনেকটা গোল্লাছুট খেলায় দৌড়ানোর মত করে। তবে বেশিরভাগ যাত্রীই ওকে হাসতে হাসতে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্যে জায়গা করে দিচ্ছে। এতো মানুষের মাঝে এলির ব্যগ্রতা দেখে সে একটু বিব্রত বোধ করলেও তার মুখে চওড়া একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

রাচেল গেজকে কোলে করে হেঁটে আসছিল। এলিকে চিৎকার করতে দেখে গেজও লুইসকে দেখে ফেলে। “আবুউউ” গেজও আনন্দের আতিশায্যে চিৎকার করে ওঠে আর রাচেলের কোলে মোচড়ামুচড়ি শুরু করে। রাচেল ক্লান্তভাবে হেসে গেজকে নিচে ছেড়ে দিলে সে এলির পেছন পেছন ছুটতে আরম্ভ করে। “আবুউউ! আবুউউ!”

লুইস লক্ষ্য করে গেজের গায়ের জাম্পারটা সে আগে কখনো দেখেনি। গেজের নানার কর্ম হবে, লুইস ভাবে। পর মুহূর্তেই এলি লুইসের ওপর লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরে। “হাই, বাবা!” ও বলতে বলতে লুইসের গাল টিপে দেয়।

“হাই, সোনামনি,” বলে লুইস নিচু হয়ে গেজকেও তুলে নেয়। সে দুজনকেই বুকে জড়িয়ে ধরে। “তোমাদের অনেক মিস করেছি, সোনা।”

রাচেল এক হাতে ট্রাভেল ব্যাগ, আর আরেক হাতে গেজের ডায়াপারের ব্যাগ ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে এগিয়ে আসে। ডায়াপারের ব্যাগে লেখা ‘খুব জলদি আমি বড় হয়ে যাবো।” ডায়াপার ব্যাগের গায়ের এই রসটা ডায়াপারে হাগা- মুতা করা বাবুর চাইতে তাদের বাবা-মাকে বেশি উদ্দেশ্য করে লেখা।

লুইস তার দুই বাচ্চার মাঝখানে জায়গা করে নিয়ে রাচেলের গালে চুমু খায়। “হাই!”

“হাই, জানু,” রাচেল মুচকি হেসে বলল।

“খুব ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।”

“আর বলো না। বস্টন পর্যন্ত ভালোই এসেছি। তারপর ভালোভাবেই প্লেন চেঞ্জ করে নতুন প্লেনে উঠলাম। কিন্তু প্লেন যখন আকাশে উঠলো গেজ জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে বলল, ‘সুন্দর, সুন্দর’, আর তারপরই বমি করে সারা গা ভাসিয়ে দিলো।”

“ওহ খোদা!”

“আমি তখন টয়লেটে গিয়ে ওর জামা কাপড় চেঞ্জ করে দিয়েছি,” রাচেল বলল। “আমার মনে হয় না কোন ভাইরাস বা ওরকম কিছু। মনে হয় ও এয়ার সিক হয়ে পড়েছিল।”

“বাসায় চলো,” লুইস বলে। “আমি স্টোভে চিলি রেখে এসেছি।”

“চিলি! চিলি!” এলি লুইসের কানের কাছে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। “চিওয়ি! চিওয়ি!” এবার গেজ লুইসের আরেক কানে চেঁচিয়ে ওঠে। অন্ততপক্ষে লুইসের দুই কান এখন সমানভাবে ঝিমঝিম করছে।

“বাবা, চার্চ কেমন আছে?” এলিকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিলে এলি জিজ্ঞেস করে। লুইস এই প্রশ্নটার জন্যে প্রস্তুত ছিল কিন্তু এলির চিন্তিত মুখ আর ওর গাঢ় নীল দুচোখের মাঝের দুশ্চিন্তার রেখার জন্যে না। লুইস ভুরু কুচকে রাচেলের দিকে তাকালো।

“ও একদিন ঘুম থেকে চিৎকার করে জেগে উঠেছিল,” রাচেল শান্তভাবে বলে। “ও একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে।”

“আমি স্বপ্নে দেখেছি চার্চ গাড়ি চাপা পড়েছে,” এলি বলে।

“থ্যাঙ্কস গিভিং’ এর পর বেশি বেশি টার্কি স্যান্ডউইচ খাবার ফল,” রাচেল বলে। “ওর আবার ডায়রিয়াও হয়েছিল। ওর দুশ্চিন্তা দূর করো লুইস। আমি আর এয়ারপোর্টে এক মুহূর্তও থাকতে চাই না। এই কদিনে এতো এয়ারপোর্ট আর এয়ারপোর্ট দেখেছি যে আগামী পাঁচ বছরে আর কোন এয়ারপোর্ট না দেখলেও আমার চলে যাবে।”

“কেন সোনা? চার্চ একদম ঠিক আছে মামনি।” লুইস ধীরে ধীরে বলে।

হুম, চার্চ ভালোই আছে। সে সারাদিন ঘরের মধ্যে কিলবিল করে বেড়ায় আর আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়, যেন ও এমন কিছু দেখেছে যাতে ওর যেটুকু বিড়াল বুদ্ধি ছিল, তাও নাই হয়ে গেছে। ও চমৎকার আছে। আমি ওকে রাতের বেলা ঝাড়ুর পাছা দিয়ে ঠেলে ঠেলে বাড়ির বাইরে পাঠাই, কারণ আমার ওকে ছুঁতে ঘেন্না লাগে। আর সেদিন সকালে আমি দরজা খুলে দেখি সে একটা ইঁদুর ধরে নিয়ে এসেছে আর সেটার নাড়িভুড়ি খুবলে বের করে চিবিয়ে চিবিয়ে ব্রেকফাস্ট করছে। ওইদিন আমি নিজে আর ব্রেকফাস্ট করতে পারিনি। এসব বাদ দিলে-

“ও খুব ভালোই আছে।”

“ওহ,” এলি বলল আর ওর দুচোখের মাঝের কুচকানো অংশটা আবার মোলায়েম হয়ে গেল। “ওহ, তাহলে তো ভালই। আমি একদম নিশ্চিত ছিলাম যে চার্চ মারা গেছে।”

“তাই না কি?” লুইস জিজ্ঞেস করে মুচকি হাসে। “স্বপ্ন খুব অদ্ভুত, তাই না?”

“চপ্ন!,” গেজ চিৎকার করে ওঠে। গেজ তার টিয়াপাখি স্তরে পৌঁছে গেছে, যেটা লুইস এলির বিকাশের ক্ষেত্রেও দেখেছে। “চচচপ্ন!” গেজ লুইসের চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়।

ওরা যখন পার্কিং লটে ওদের গাড়ির কাছে পৌঁছালো, তখন গেজ অদ্ভুত ঢেকুর তোলার মত করে বলতে লাগলো, “সুন্দর, সুন্দর,” এবার সে বমি করে লুইসের সারা গা ভাসিয়ে দেয়। লুইস আজ প্লেন সংবর্ধনা উপলক্ষে নতুন একটা জামা পড়েছিল, সেটার শ্রাদ্ধ হয়ে গেল। আর গেজ হয়তো ধরে নিয়েছে বমি করার সিগনাল হিসেবে ‘সুন্দর’ চমৎকার একটি শব্দ।

দেখা গেল গেজ আসলেই ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত।

ওরা সতেরো মাইল ড্রাইভ করে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে গেজ ভালোভাবেই জ্বরের লক্ষন প্রকাশ করতে লাগলো আর অসুখে ঝিমাতে লাগলো। লুইস গাড়িটা উল্টো করে গ্যারেজে ঢোকানোর সময় চোখের কোন দিয়ে দেখলো চার্চ গ্যারেজের দেয়ালের পাশ দিয়ে লেজ উঠিয়ে হেলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে আর অদ্ভুত চোখে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। পরমুহূর্তেই ও দিনের মিলিয়ে যেতে থাকা আলোতে মিশে গেল আর লুইস একটা মরা ইঁদুর দেখতে পেলো টায়ারের স্তূপের পাশে। গ্যারেজের বিষন্ন আলোতে ইঁদুরটার নাড়িভুড়ি লাল টকটকে লাগছে।

লুইস দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে ইচ্ছে করে টায়ারের স্তুপটার সাথে ধাক্কা খেয়ে টায়ারগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ফেলে ইঁদুরটাকে ঢেকে ফেলল। “উউপস্!”

“তুমি একটা বোকা, বাবা,” এলি মমতামাখা গলায় বলে।

“একদম ঠিক,” লুইস অতি উৎসাহের সাথে বলে। তার ইচ্ছে হচ্ছিল সেও ‘সুন্দর, সুন্দর’ বলে তার পেটের সব মালামাল চারদিকে উগড়ে দেয়। চার্চের উৎকট পুণরুত্থানের আগে লুইস তাকে একবার একটা ইঁদুর মারতে দেখেছিল। সে মাঝে মাঝে ইঁদুর ধরে খেলা করতো, যেই নিষ্ঠুর খেলা বিড়াল সম্প্রদায় খেলে থাকে, তবে সে, রাচেল বা এলি কেউ না কেউ সেই খেলা শেষ হবার আগেই ব্যাঘাত ঘটাতো। আর সেটাও চার্চকে খোজা করার আগে। খোজা করার পর সাধারণত বিড়ালরা ইঁদুরের দিকে ফিরেও তাকায় না, যতক্ষণ তাদের পেটে খাবার থাকে।

“তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিবাস্বপ্ন দেখবে নাকি গেজকে নিতে একটু সাহায্য করবে?” রাচেল জিজ্ঞেস করে। “মঙ্গল গ্রহ থেকে ফিরে এসো, ডাঃ ক্রিড, পৃথিবীর লোকজনের তোমার সাহায্য প্রয়োজন।” রাচেলকে খুব ক্লান্ত আরেকটু বিরক্ত শোনালো।

“সরি, বউ,” লুইস বলল। সে ঘুরে গেজকে কোলে নিলো। গেজের শরীর চুলার কয়লার মত গরম।

সে রাতে ওরা শুধু তিনজন লুইসের বিখ্যাত চিলি খায় আর সে সময়টা জ্বরে পীড়িত গেজ লিভিং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে বোতলে ভরা চিকেন ব্রথ পান করে।

ডিনারের পর এলি গ্যারেজের দরজা খুলে চার্চকে ডাকে। রাচেল তাদের জিনিসপত্র ট্রাভেল ব্যাগ থেকে বের করে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখছিল আর লুইস কিচেনে প্লেটগুলো ধুয়ে রাখছিল। এলির ডাক শুনে লুইস মনে মনে চাইছিল যেন চার্চ না আসে। কিন্তু চার্চ আসলো এবং একদম সাথে সাথেই আসলো তার নতুন হেলে দুলে হাঁটার ভঙ্গিতে, যেন-যেন-বিড়ালটা দরজার সামনেই কিলবিল করছিল। হ্যা, কিলবিল। ঠিক এই শব্দটাই তার মনে উদয় হলো।

“চার্চ!,” এলি চিৎকার করে ওঠে। “হাই, চার্চ!” ও বিড়ালটাকে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে। লুইস তার ধোয়াধুয়ি থামিয়ে রেখে চোখের কোন দিয়ে এলিকে দেখে। সে দেখে, এলির খুশি মুখটা ধীরে ধীরে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। বিড়ালটা এলির হাতে শান্তভাবে ঝুলে আছে। চার্চ নিজের কান দুটো চোখা করে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে এক দৃষ্টিতে এলির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।

অনন্তকাল পরে-অন্তত লুইসের কাছে সেরকমই মনে হলো-এলি চার্চকে নামিয়ে রাখে। চার্চ এলির দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে ডাইনিংরুমের দিকে চলে গেল। মিস্টার নেংটি ইঁদুরের যম, লুইস এলোমেলোভাবে চিন্তা করে।

সে আন্তরিকভাবেই সেই রাতের কথা মনে করতে চাইলো, কিন্তু সেসব এখন অনেক প্রাচীন কিছু বলে মনে হচ্ছে। সেদিনের সবকিছু কেমন যেন ধূসর আর বহুদূরের কিছু বলে মনে হচ্ছে, যেমনটা ভিক্টর পাস্কোর বীভৎস

মৃত্যুকেও মনে হয়। তার শুধু সেদিনের মাতাল হাওয়া, জঙ্গল আর তার বাড়ির পেছনের মাঠটাতে তুষারের শুভ্র আভার কথা মনে পড়ছে, ব্যস এটুকুই।

“বাবা?” এলি চাপা গলায় বলল।

“কী, এলি?”

“চার্চের গায়ে কেমন যেন একটা গন্ধ।”

“তাই না কি?” লুইস জিজ্ঞেস করে। সে খুব সাবধানে নিজের গলা স্বাভাবিক রাখে।

“হ্যাঁ!” এলি হতাশা মাখা গলায় বলে। “সত্যি বলছি! আগে কখনোই ওর গায়ে এমন গন্ধ ছিল না।”

“হুম, এমন হতে পারে ও কোন নোংরা জিনিসের ওপর গড়াগড়ি খেয়েছে, সোনামনি,” লুইস বলে। “এই গন্ধ চলে যাবে।”

“যেতেই হবে,” এলি বয়স্ক মহিলাদের মত করে বলে। তারপর ও হেঁটে চলে যায়।

লুইস তার কাজ শেষ করে সিঙ্কের ছিপি খুলে দিল। সিঙ্কের পাইপ দিয়ে বিশ্রী চোষণের শব্দ করে ফেনিল পানি ঘুরতে ঘুরতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আর লুইস বাইরের অন্ধকার রাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

পানি চলে যাওয়ার শব্দ শেষ হলে সে বাইরের তীব্র শীত বয়ে নিয়ে আসা

মাতাল হাওয়ার শব্দ শুনতে পায় এবং তার বোকার মত প্রচন্ড ভয় হতে থাকে, অন্ধকার ঘরে খুটখাট শব্দ হলে সেই শব্দের উৎস কি বুঝতে না পারলে যেমন আতঙ্ক লাগে সেরকম আতঙ্ক।

“১০৩!” রাচেল জিজ্ঞেস করে। “তুমি শিওর লু?”

“এটা ভাইরাস জ্বর,” লুইস বলে। রাচেলের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে ১০৩ ডিগ্রী তাপমাত্রার জন্যে সে দায়ি। রাচেলের ঝাঝালো স্বরে লুইস নিজেকে বিরক্ত হতে দিলো না। রাচেল খুবই ক্লান্ত। সে আজ দেশের আরেক প্রান্ত থেকে দুটো বাচ্চাকে নিয়ে জার্নি করে এসেছে, আর এখন রাত এগারোটা বাজলেও ঘুমোতে পারেনি। এলি নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। গেজ তাদের বিছানাতে জ্বরে অর্ধচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে।

লুইস গেজকে ঘন্টাখানেক আগে লিকুইপিরিন ড্রপ দিয়েছে। “কাল সকালের মধ্যে অ্যাসপিরিন ওর জ্বর নামিয়ে আনবে।”

“তুমি ওকে এম্পিসিলিন বা ওইরকম কিছু দিবে না?”

লুইস ধৈর্য সহকারে বলল, “ওর ফ্লু হলে দিতাম। কিন্তু তা হয়নি। ওর ভাইরাস জ্বর হয়েছে। আর ওই জিনিস ভাইরাস জ্বরে কোন কাজের না। বরং সেটা ওকে অস্থির করে তুলবে আর শরীর থেকে পানি বের করে দিবে।”

“তুমি শিওর তো এটা ভাইরাস জ্বর?”

“আচ্ছা, তুমি চাইলে আর কারো মতামত নিতে পারো, আমার কোন আপত্তি নেই।” লুইস হঠাৎ রেগে গিয়ে বলে।

“আমার সাথে চিৎকার করছো কেন?” রাচেল চিৎকার করে বলে।

“আমি চিৎকার করিনি!” লুইস পাল্টা চিৎকার করে বলে।

“করেছো,” রাচেল বলতে শুরু করে, “অবশ্য-শ-শ–” এর পর তার মুখ কাঁপতে শুরু করলে সে দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে। লুইস রাচেলের চোখের নিচে কালি দেখতে পায়। দেখে খুব খারাপ আর লজ্জিত অনুভব হয় তার।

“আমি সরি,” সে বলে রাচেলের পাশে বসে। “খোদাই জানে আমার কি হয়েছে। আমারই ভুল, আমি মাফ চাইছি, রাচেল।”

“তাই না কি? তোমার আবার ভুল হয় না কি কখনো?” রাচেল বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে। “জার্নিতে যারপরনাই ধকল গেছে আমাদের সবার। তারপর সবসময় ভয়ে ভয়ে ছিলাম তুমি গেজের ড্রেসের ড্রয়ার খুললে বাড়ি মাথায় তুলবে। আমার কথাটা এখনি বলা উচিত, যখন তুমি আমার জন্যে সরি ফিল করছো।”

“বাড়ি মাথায় তোলার মত কি হয়েছে?’

রাচেল আবারো বিদ্রুপের মুচকি হাসি হাসে। “আমার বাবা-মা মিলে ওকে দশটা নতুন জামা কিনে দিয়েছে। আজ ওকে যেই ড্রেসে দেখেছিলে সেটাও একটা।”

“হুম, আমি খেয়াল করেছিলাম ওর গায়ে নতুন জামা।”

“আমিও খেয়াল করেছি যে তুমি খেয়াল করেছো।” রাচেল জবাব দিয়ে এমনভাবে চোখ ট্যারা করে তাকালো যে লুইস হেসে দিলো, যদিও তার হাসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। “আর এলির জন্যে ছয়টা নতুন জামা।”

“ছয়টা!” সে নিজের চিৎকার করার তাড়না চাপা দিয়ে বলল। সে নিজের ভতরে প্রচন্ড ক্ষোভ অনুভব করে, যেটা সে ব্যাখ্যা করতে পারবে না। “কেন, রাচেল? তুমি কেন উনাদের এসব করতে দিলে? আমাদের এসব কোন দরকার…আমারা নিজেরাই কিনতে….”

লুইস থামে। তার ভেতরের প্রচন্ড ক্ষোভ তার কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। এলির বিড়ালকে পলিথিন ব্যাগে ভরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেটে যাওয়ার দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আর সেই সময় ওই বুড়ো বজ্জাতটা নিজের বিশ্বখ্যাত চেকবই আর বিশ্বখ্যাত ফাউন্টেন পেন দিয়ে তার মেয়ের ভালোবাসা কিনতে ব্যস্ত ছিল।

তার হঠাৎ করে চিৎকার করে বলতে মন চাইলো, সে তোমার মেয়েকে ছয়টা জামা কিনে দিয়েছে, খুব মহৎ কাজ করে ফেলেছে। আর আমি সেই সময় তোমার মেয়ের মরা বিড়ালকে বাঁচিয়ে এনেছি। তো এলিকে কে বেশি ভালোবাসে?

সে চিৎকারটা মনের ভেতরেই মরে যেতে দিল। এরকম কথা সে কখনই বলবে না। কখনই না।

রাচেল লুইসের কাঁধ স্পর্শ করে। “লুইস, তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো, প্লিজ। ওনারা বাচ্চাদের খুবই ভালোবাসেন। তাছাড়া খুব একটা দেখতেও পান না কালে ভদ্রে ছাড়া। তাছাড়া আমার বাবা আর মা দুজনে মিলে কিনেছেন এগুলো, বাবা একা না। আর লুইস, আমার বাবা অনেক বদলে গেছে, তুমি এখন তাকে আর চিনবেই না।”

“আমি ঠিকই চিনব,” লুইস বিড়বিড় করে বলে।

“প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো লু। এতে তো তোমার খারাপ লাগার কিছু নেই।”

লুইস রাচেলের দিকে দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। “আছে,” অবশেষে সে বলে। “হয়তো খারাপ লাগা উচিত না, কিন্তু লাগছে।”

রাচেল কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই এলি নিজের রুম থেকে ডাকতে থাকে, “বাবা! মা!”

রাচেল উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু লুইস তাকে টেনে বলল, “তুমি গেজের কাছে থাকো, আমি দেখছি।” লুইস সমস্যাটা আঁচ করতে পারছে। কিন্তু সে তো বিড়ালটাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছিল। এলি শুতে যাওয়ার পর সে বিড়ালটাকে খাবারের বাটির চারদিকে ঘুরঘুর করতে দেখে সে ওটাকে বাইরে বের করে দেয়। সে একদমই চায় না চার্চ আর এলির সাথে ঘুমাক, একদমই না। চার্চ এলির খাটে ঘুমাচ্ছে ভাবলেই তার গা শিউরে উঠছে।

এলি বুঝে যাবে চার্চের কিছু হয়েছে আর আগের চার্চই ভালো ছিল।

সে চার্চকে বের করে দিয়েছিল। কিন্তু সে এলির রুমে গিয়ে দেখতে পায় এলি বিছানায় বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আরো দেখতে পায় বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে রাজকীয় কায়দায় শুয়ে থাকা চার্চের অবয়ব। পাশের হলওয়ের লাইটের আলো চার্চের চোখে পড়ায় সেগুলো জ্বলজ্বল করছে।

“বাবা, চার্চকে বের করে দাও,” এলি প্রায় যন্ত্রণা মিশ্রিত কণ্ঠে বলে। “ওর গায়ে বিশ্রী গন্ধ।”

“স্, মামনি, শুয়ে পড়ো,” বলে লুইস নিজের নিরুদ্বেগ কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে যায়। এতে তার স্লিপ ওয়াকিং ঘটনার পরের সকালের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল; ভিক্টর পাস্কো মারা যাওয়ার পরের দিনের। সেদিন সে কোন রকমে ইনফার্মারিতে পৌঁছে বাথরুমের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের মানসিক অবস্থার কারণে সে ভেবেছিল তাকে আয়নায় জঘন্য দেখাবে। কিন্তু আয়নায় নিজেকে তার একদম স্বাভাবিক লেগেছে। সে ভেবেছিল আশে পাশে হয়তো অসংখ্য মানুষ আছে যারা ভেতরে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব গোপনীয়তা নিয়ে স্বাভাবিক মুখে সবার সাথে মিশে আছে।

এলি ঠিক বলছে। চার্চের গায়ের গন্ধে তার নিজেরই গা গুলিয়ে আসছে। সে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে নিতে বিড়ালটাকে ধরে নিচতলায় নিয়ে আসে। এর চাইতে খারাপ গন্ধ আছে; গুয়ের গন্ধ এর চাইতে বেশি খারাপ, ঘায়ের পচা মাংসের গন্ধও আরো অনেক বেশি খারাপ।

কিন্তু চার্চের গায়ের গন্ধও গা গুলিয়ে ওঠার জন্যে যথেষ্ট। আর এই বিড়ালটা বাসায় ঢুকলোই বা কী করে? সে বিড়ালটাকে বাইরে বের করে দিয়েছিল। বাসার বাকি সবাই যখন দোতলায়, লুইস সুযোগ বুঝে ঝাড়ুর মাথা দিয়ে ঠেলে ঠেলে ওটাকে বাইরে বের করে দিয়েছিল। চার্চ ফিরে আসার পর আজ প্রথম লুইস তাকে নিজের হাত দিয়ে স্পর্শ করলো। তার বাহুতে চার্চের উষ্ণ দেহটাকে একটা বিরতি নিতে থাকা সুপ্ত ব্যাধি বলে মনে হতে থাকে। কোন চিপা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিলি হারামজাদা? লুইস ভাবে।

লুইসের পাস্কোকে নিয়ে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল, কিভাবে সে দরজার ভেতর দিয়েই আরেক পাশে চলে গিয়েছিল।

হয়তো চার্চ কোন চিপা খুঁজে পায়নি, বরং ভূতের মত দরজা ভেদ করেই চলে এসেছে।

“শয়তানের বাচ্চা,” লুইস কর্কশভাবে ফিসফিস করে বলে।

লুইস প্রায় নিশ্চিত হয়ে ভেবেছিল যে চার্চ তার বাহু থেকে ছোটার জন্যে মোচড়ামুচড়ি শুরু করবে আর ওকে খামচে দেবে। কিন্তু চার্চ সেরকম কিছুই না করে আহাম্মকের মত বসে থেকে নিজের দেহ থেকে তাপ বিকিরণ করতে থাকে আর অদ্ভুত দৃষ্টিতে লুইসের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন ও লুইসের মনের ভেতরের সব কিছু পড়তে পারছে।

সে দরজা খুলে চার্চকে গ্যারেজের মধ্য সজোরে ছুড়ে মারে। “যা ভাগ হারামজাদা,” সে বলে। “গিয়ে আরো ইঁদুর মেরে খা।”

চার্চ আনাড়িভাবে মাটিতে ল্যান্ড করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এরপর লুইসের দিকে নিজের সবুজাভ চোখ দিয়ে একটা ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাতালের মত হেলতে দুলতে হেঁটে চলে যায়।

লুইস সিঙ্কে গিয়ে নিজের হাতগুলো এমনভাবে ডলে ডলে বার বার ধোয় যেন সে কোন অপারেশনের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।

এই কাজটা আমরা করেছি, কারণ এটা আমাদের পেয়ে বসেছিল…উপযুক্ত কারণ খুঁজে নিবে…তুমি নিজেই সেটার পেছনে যুক্তি দাঁড় করাবে…এবং সেই যুক্তিগুলো তোমার কাছে খুব ঠিক মনে হবে…তুমি সেটা করতে বাধ্য।

না, সে জাডকে দোষী করতে পারলো না। সে তার নিজের ইচ্ছেতেই সেখানে গিয়েছে আর তাই সে জাডকে দোষী করতে পারে না।

সে পানির ট্যাপ বন্ধ করে তোয়ালে দিয়ে নিজেকে মুছতে শুরু করে; হঠাৎ সে মোছা থামিয়ে জানালায় বাইরের অন্ধকারের দৃশ্যের দিকে তাকায়।

এর মানে কি জায়গাটা আমাকেও পেয়ে বসবে? বাকিদের মত?

না, আমি যদি নিজে থেকে না চাই, তাহলে না।

সে তোয়ালেটা র‍্যাকের ওপর রেখে ওপরে গেল।

***

রাচেল বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। ওর চিবুক পর্যন্ত চাদর টানা আর পাশেই গেজ শুয়ে ছিল। সে অপরাধীর চোখে লুইসের দিকে তাকালো। ওকে আমাদের কাছে রাখি? শুধু আজকের জন্যে। ও কাছে থাকলে আমার ভালো লাগবে। জ্বরে ওর গা পুড়ে যাচ্ছে।

“সমস্যা নেই।” লুইস বলে। “আমি লিভিং রুমে গিয়ে সোফায় বিছানা করে শুচ্ছি।”

“তুমি সত্যি রাগ করবে না?”

এতে গেজের কোন ক্ষতি হবে না আর তোমারও ভালো লাগবে।” সে থেমে হাসে। “তবে তোমাকে গেজের ভাইরাস পেয়ে বসবে মোটামুটি নিশ্চিত থাকো। তবে মনে হয় না তাতে তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে, তাই না?”

রাচেল জবাবে হেসে মাথা নাড়ে। “এলি ডাকছিল কেন?”

“চার্চ। ও চার্চকে ওর রুম থেকে বের করে দিতে বলছিল। “তাই নাকি? আজ সূর্য কোন দিকে উঠলো?”

“আমিও অবাক হয়েছি,” লুইস বলে। “চার্চের গায়ে নাকি ও বিশ্রী গন্ধ পাচ্ছে। কথা ঠিক, আমিও গন্ধ পেয়েছি। বিড়ালটা মনে হয় নোংরা কিছুর মধ্যে গড়াগড়ি খেয়ে এসেছে।”

“এ কেমন হলো?” রাচেল বিছানায় নিজের পাশে গিয়ে শুতে শুতে বলে। ‘বেড়াতে যাওয়ার পর ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও তোমাকে আর চার্চকে সমানভাবে মিস করেছে।”

“বলো কী!” লুইস বলে। সে নিচু হয়ে রাচেলের কপালে চুমু খায়। “ঘুমাও, বউ।”

“আই লাভ ইউ, লু। তোমাকে খুব মিস করেছি এ কদিন। আর সোফায় শোয়ানোর জন্যে দুঃখিত।

“সমস্যা নেই,” লুইস বলে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়।

***

সে নিচে নেমে সোফার কুশনগুলো স্তুপ করে বিছানা পাতে। সে জানে আজ তার সারা রাতই পিঠের নিচে সোফার স্প্রিং বর্শার মত খোঁচাখুচি করবে। ফ্রন্ট হলের ক্লজেট থেকে মোটা দুইটা কম্বল এনে সোফার ওপর বিছিয়ে দিলো, নিজের পিঠ বাঁচাতে। জামা কাপড় খুলতে শুরু করেও থেমে যায় সে।

তুমি কি ভাবছো চার্চ আবারো ঢুকে পড়েছে? তাহলে একটু চারদিক ঘুরে দেখো। এতে কোন ক্ষতি হবে না, তুমি যেমন রাচেলকে বলে আসলে, অথচ কিছু লাভ হতে পারে। আর দরজাগুলোর ছিটকিনি ভালো করে লাগানো হয়েছে কি না দেখে আসলে তোমাকে নিশ্চয়ই ভাইরাস জ্বরেও ধরবে না।

সে নিচতলাটা ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখলো আর দরজা জানালার ছিটকিনিগুলোও চেক করলো। এবার সে আর ভুল করেনি। চার্চকে কোথাও দেখা গেল না।

“বজ্জাত বিড়াল,” সে বলে। “দেখি আজ কিভাবে ঢুকিস, হারামজাদা।” আর মনে মনে সে কামনা করে শীতে যেন চার্চের বিচি জমে যায়। অবশ্য, চার্চের এখন আর জমে যাবার মত কোন বিচি অবশিষ্ট নেই।

বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তেই তার পিঠে সোফার স্প্রিংয়ের খোঁচা লাগে। আজ স্প্রিংয়ের খচখচানিতে সে ঘুমোতেই পারবেনা ভাবতে ভাবতে ঘুমে তলিয়ে গেল। সে সোফার ওপর খুব অস্বস্তিকরভাবে শুয়েছিল, কিন্তু যখন জেগে ওঠলো সে নিজেকে আবার মিকমেকদের গোরস্থানে আবিষ্কার করে। তবে এবার তার সাথে কেউ নেই। এবার সে নিজ হাতে চার্চকে খুন করে কোন এক অদ্ভুত কারণে আবার তাকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। এটা কেন চাচ্ছে সেটা খোদাই জানে, সে জানে না। এবার অবশ্য সে গভীর গর্ত করে চার্চকে কবর দিয়েছে আর এতো নিচ থেকে চার্চ বের হয়ে আসতে পারবে না। চার্চের কান্নার শব্দ কবরের ঝুরঝুরে মাটির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে, কান্নার শব্দটা অনেকটা মানব শিশুর কান্নার শব্দের মত। শব্দের সাথে সাথে মাটির ভেতর থেকে বীভৎস মাংস পচা গন্ধও ভুরভুর করে বেরিয়ে আসছে। কটু গন্ধে শ্বাস নিতে গিয়ে লুইসের মনে হয় তার বুকের ওপর কেউ পাথর চাপা দিয়েছে। ভয়ংকর কান্না…আর্তনাদ…

কান্নার শব্দ চলতেই থাকে…আর তার বুকের ভারটাও …

“লুইস!” রাচেল অধীর গলায় তাকে ডাকছে। “লুইস, তাড়াতাড়ি এসো!”

রাচেলের গলা শুনে শুধু অধীর না, বরং আতঙ্কিত মনে হয় লুইসের কাছে। কান্নার শব্দটা আটকে আটকে যাচ্ছে, যেন তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পরমুহূর্তেই লুইস বুঝতে পারে গেজ কান্না করছে।

সে নিজের চোখ খুলেই দেখলো দুটি সবুজ চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে, খুব বেশি হলে তার নিজের চোখ থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি দূর হতে। চার্চ তার বুকের ওপর কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। এটার গা থেকে কটু গন্ধ ভেসে ভেসে লুইসের একদম ভেতরে এসে ঢুকছে। চার্চ পুর্র্ পুর্র্ করছে।

লুইসের গলা চিড়ে একটা আতঙ্ক ভরা চিৎকার বেরিয়ে আসে। সে তার হাত এলোপাতাড়িভাবে ছুঁড়ে চার্চকে বুকের ওপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে লাফিয়ে পরে চার্চ হেলে দুলে চলে যায়।

ওহ খোদা! শয়তানটা আমার ওপর উঠে বসে ছিল! একদম আমার বুকের ওপর!

একটা জ্যান্ত মাকড়শা তার মুখের মধ্যে ঢুকে গেলেও তার এতো ঘৃণা লাগতো না।

“লুইস!”

গায়ের ওপর থেকে কম্বল ঠেলে সরিয়ে কিছুটা ঘুমের ঘোর নিয়েই দ্রুতপদে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তাদের বেডরুম থেকে হালকা আলো আসছে। সেই আলোয় সে দেখতে পায় সিঁড়ির মাথায় রাচেল তার নাইট গাউন পড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“লুইস, ও আবার বমি করছে… বমি করতে করতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে…আমার খুব ভয় করছে।”

“আমি দেখছি,” সে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলে। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, বজ্জাতটা আবার ঢুকে পড়েছে। যেভাবেই হোক, এটা আবার ঢুকে পড়েছে। মনে হয় সেলারের কোন জানালা ভাঙা। আসলে, সেলারের ভাঙা জানালা দিয়েই এটা ঢুকেছে, আর কোন রাস্তা নেই। কাল অফিস থেকে ফিরেই আমি চেক করবো…নাহ, অফিস যাওয়ার আগেই-

গেজ কান্না থামিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসা গার্গলের মত শব্দ করতে থাকে।

“লুইস!” রাচেল চিৎকার করে উঠে।

লুইস দ্রুত পা চালায়। গেজ তাদের বিছানায় লুইসের পাশটায় শুয়ে আছে। ওই পাশে বিছিয়ে রাখা একটা পুরনো তোয়ালের ওপর ওর মুখ থেকে বমি বেরিয়ে আসছে। ও বমি করছে, কিন্তু যথেষ্ট না। বমি ওর মুখের বা গলার কাছে আটকে যাচ্ছে আর এতে করে ওর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, আর এতে করে ওর কান্নাও আটকে গেছে।

লুইস গেজের দুই বগলের নিচে ধরে ওকে কোলে তুলে নিয়ে গেজের মাথা নিজের কাঁধের ওপর রাখে। গেজের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এবার লুইস পেছনের দিকে ঝাঁকি দিয়ে ঝুঁকে পড়লো, গেজকে সহ। গেজের ঘাড়ে মটকা ফোটার মত একটা আওয়াজ হয় এবং পর মুহূর্তেই গেজ সজোরে ঢেকুর তোলার মত একটা শব্দ করে বমি উগড়ে দেয়। বমিতে তারল্যের চাইতে কাঠিন্যের বৈশিষ্ট্যই বেশি। পরমুহূর্তেই লুইসের কানে গেজের সবেগে কান্নার মধুর ধ্বনি সঙ্গিতের মত বেজে ওঠে। অক্সিজেনের পর্যাপ্ত যোগান ছাড়া এতো উচ্চস্বরে কাঁদা যায় না।

রাচেল হঠাৎ বিছানায় বসে পড়ে। তার সারা শরীর প্রচন্ডভাবে কাঁপছে ও আরেকটু হলে মরেই যাচ্ছিল! ওহ খোদা! আরেকটু হলেই দম আ-আ- আ-ওহ মাই গড!”

লুইস তার ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘরের মধ্যে হাঁটতে থাকে। গেজের তীক্ষ্ণ কান্না ইতিমধ্যেই কমে এসেছে; সে এরমধ্যেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে।

“আটানব্বই ভাগ চান্স ছিল ও নিজেই গলা পরিস্কার করে ফেলবে। আমি শুধু ওকে একটু সাহায্য করেছি।”

“কিন্তু…কিন্তু ও খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছিল।” রাচেল লুইসের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে। “আরেকটু হলেই আজ…ও মৃত্যুর খুব কাছে চলে গেছিল…”

হঠাৎ লুইসের সেদিন বিকেলে রাচেলের সাথে ঝগড়ার কথা মনে পড়ে গেল। রাচেল তাকে কিচেনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ও মরবে না। এই বাসায় কেউ মরবে না…

“বউ,” লুইস বলে, “আমরা সবাই মৃত্যুর খুব কাছাকাছি, প্রতি মুহূর্তেই।”

.

বুকের দুধ খেয়ে গেজের আরেক দফা বমি হয়। গেজ আবার মাঝরাতে জেগে গিয়েছিল, রাচেল বলল। লুইসের ঘুমোতে যাওয়ার দেড় ঘন্টা পরের ঘটনা। গেজ তার ক্ষুধার কান্না কেঁদে জেগে উঠলে রাচেল তাকে বুকের দুধ খেতে দেয়। দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে রাচেল কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না। তার ঘন্টাখানেক পর আবারো বমি করতে করতে গেজের দম বন্ধ হবার মত অবস্থা হয়।

ওকে আপাতত আর দুধ দেয়া যাবে না, লুইস বললে রাচেল খুব সহজভাবে মেনে নেয়। দুধ বন্ধ।

লুইস যখন নিচে নামে তখন রাত প্রায় পৌনে দুটো। নেমে সে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে চার্চকে খোঁজে। খুজতে খুজতে সে কিচেনের সাথে বেসমেন্টের দরজাটা সামান্য খোলা পায়, আর এরকমই সে আশা করেছিল। তার মায়ের একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। তিনি একটা বিড়ালের সম্পর্কে বলেছিলেন যেটা নিজে নিজে দরজা খোলার ব্যাপারে বেশ পটু হয়ে উঠেছিল। বিড়ালটা দরজার হাতলের পাশে কিছুতে চড়ে হাতলটাতে থাবা চালাতে থাকতো, যতক্ষণ না দরজা খুলে যায়। বিড়ালদের জন্যে খুব কিউট একটা ট্রিক, কিন্তু লুইস চার্চকে এই ট্রিক খেলার সুযোগ থেকে একদম বঞ্চিত করতে চায়। আর সেলারের দরজাতে একটা লকও আছে। লুইস চার্চকে সেলারের স্টোভের নিচে আবিষ্কার করে আর কোন রকম ভনিতা না করে সামনের দরজা দিয়ে ছুড়ে ওকে বাইরে ফেলে দেয়। আর তার সোফার বিছানায় যাওয়ার আগে সে সেলারের দরজাটা আবারো বন্ধ করে।

আর এবার সে দরজার ছিটকিনিটাও মেরে দেয়।

অধ্যায় ২৯

পরদিন সকাল হতে হতে গেজের শরীরের তাপমাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসে। ওর গাল ফেটে গেলেও ওকে বেশ প্রাণবন্ত লাগছে। আর এক সপ্তাহের ব্যবধানেই তার আবোল তাবোল বলা এক রকম লাইনে চলে এসেছে; এখন ওকে যা বলা হয় ও সেটাই নকল করার চেষ্টা করে। আর তা দেখে এলি ওকে দিয়ে যা বলাতে চাচ্ছে তা হচ্ছে, গু।

“গেজ, বলো কাচা গু,” এলি ওটমিল খেতে খেতে বলে।

“কাচা-গু,” গেজ সিরিয়াল খেতে খেতে আনন্দের সাথে বলে। লুইস তাকে কম চিনি দিয়ে খাওয়ার শর্তে সিরিয়াল খাওয়াতে মত দিয়েছে। তবে গেজ যথারীতি তার সিরিয়াল খাওয়ার চাইতে তা দিয়ে শ্যাম্পু করতেই বেশি আনন্দ পাচ্ছে।

এলি হাসিতে ভেঙে পড়লো।

“গেজ, বলো আমি গু খাই,” এলি বলে।

“গু খাই,” গেজ নিজের খাবার লেপ্টে থাকা মুখে গম্ভীর হয়ে বলে। “কাচা গু খাই।”

এবার এলির সাথে সাথে লুইসও হাসিতে ফেটে পড়ে। না হেসে উপায় কি?

তবে রাচেল এতো খুশি হলো না। “ওকে বাজে কথা শেখাচ্ছ কেন তোমরা?” সে বলে। “গেজ, পচা কথা বলে না।”

“গু খাই-গু খাই-গু খাই,” গেজ মনের সুখে গান ধরে। এলি মুখে হাত চাপা দিয়ে নিজের হাসি থামায়। লুইস খেয়াল করলো রাচেলও প্রায় হেসে ফেলেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের হাসি থামিয়ে ফেলল। প্রায় নির্ঘুম ক্লান্তিকর একটা রাত কাটানোর পরও রাচেলকে বেশ সতেজ দেখাচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে লুইসের বুকের ওপর থেকে যেন একটা ছোট পাথর নেমে যায়।

“সুন্দর,” গেজ তার বমি করার পাসওয়ার্ড বলেই এতক্ষণে যা খেয়েছিল তার প্রায় সবটা তার সিরিয়ালের বোলের ওপর উগড়ে দিল।

“ইয়াক থুহ্!” এলি চিৎকার করতে করতে খাবার টেবিল থেকে ছুটে পালিয়ে যায়।

লুইস এবার অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে এসেছে। রাচেল আর গেজ তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তার মাথার সব তারগুলো একদম ছিড়ে গেছে।

“পাগল হয়ে গেলে নাকি?” রাচেল বলে।

না, লুইস মনে মনে বলে। আমি আরো আগেই পাগল হয়ে গেছি। তবে এখন মনে হচ্ছে আমি ভালো হয়ে যাব। একদম ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *