অধ্যায় ২০
গ্রীষ্ম চলে গেছে। গাছে পিত রং আসতে চাইলে গাছেরা প্রথমে হৈচৈ করলেও অবশেষে তারা তাদের নিয়তি মেনে নিয়ে ফ্যাকাসে রং ধারণ করেছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি একবার খুব একচোট বৃষ্টি হবার পর গাছের পাতা ঝরতে আরম্ভ করে। এলি স্কুল থেকে প্রায় প্রতিদিনই হ্যালোইনের নানান রকম সাজসজ্জায় বোঝাই হয়ে বাসায় ফিরতে থাকে আর গেজকে এক স্কন্ধকাটা ঘোড়া সওয়ারির গল্প বলে মজা দিতে থাকে। সেদিন বিকেলে গেজ সারাক্ষণ ‘কনকাটা কনকাটা’ বলে বকবক করছিল। সেটা শুনে রাচেলের হাসি থামতেই চায় না। শরতের শুরুটা ক্রিড ফ্যামিলির ভালই কাটছে।
লুইসের অফিসও ভালই যাচ্ছে। কাজের চাপ থাকলেও লুইসের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজটা বেশ ভালোই লাগছে। সেখানে কাজের পাশাপাশি সে বিভিন্ন মেডিকেল কনফারেন্সেও অংশ নিতে থাকে।
রাতের খাবারের পর বাচ্চাদের সময় দেয়া এবং এরপর জাড ক্র্যান্ডালের সাথে বিয়ারের বোতল হাতে আড্ডা দেয়াটা বাসায় ফিরে তার রোজকার রুটিন। মিসি মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের দেখলে রাচেলও তাদের সাথে বসে আর মাঝেমধ্যে নরমাও তাদের সাথে যোগ দেয়। তবে অধিকাংশ সময় শুধু লুইস আর জাডই থাকতো আড্ডায়। লুইসের লোকটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। তিনি লাডলোর তিনশত বছরের ইতিহাস ফরফর করে বলে দিতে পারেন, যেনো তিনি এই পুরোটা সময় নিজের দুচোখে দেখেছেন। তিনি অনেক কথা বলেন কিন্তু কখনো তাকে লুইসের বিরক্তিকর মনে হয়নি। তবে জাডের কথা শুনে সে রাচেলকে মুখে হাত চেপে হাই তুলতে দেখেছে।
বেশিরভাগ রাতে দশটার আগেই সে রাস্তা পেরিয়ে নিজের বাসায় ফেরে। আর বাসায় ফিরে সে আর রাচেল তাদের স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসায় মেতে উঠতো। তাদের বিয়ের প্রথম বছরের পর থেকে আর কখনই তারা এতো ঘন ঘন মিলিত হয়নি। রাচেলের ধারণা এর কারণ এখানকার অবিরাম বের হতে থাকা কুয়ার টাটকা পানি; লুইসের ধারণা মেইনের হাওয়া বাতাস।
সেমিস্টারের প্রথম দিনে ভিক্টর পাস্কোর মৃত্যুর ঘটনা শিক্ষার্থীদের কাছে এবং তার কাছে অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। তার বিশ্বাস পাস্কোর বাবা মার শোকও আর তীব্রভাবে নেই। লুইস ভিক্টর পাস্কোর বাবার সাথে ফোনে কথা বলেছে। ভদ্রলোক একটি ব্যাপারেই নিশ্চিত হতে চাইছিলেন, যে তার ছেলের চিকিৎসায় কারো কোন ত্রুটি ছিল কি না। লুইস বলে তারা সবাই তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য। সেদিনের হট্টগোল, কার্পেটের দাগ বা তার ছেলেকে যে প্রায় মৃত অবস্থায় ইনফার্মারিতে আনা হয়েছিল, লুইস সেগুলোর কিছুই বলে না। তবে লুইস ওগুলো কখনোই ভুলবে না। তবে যাদের কাছে পাস্কোর ঘটনা একটি নিছক দুর্ঘটনা, তারা পাস্কোকে প্রায় ভুলেই গেছে।
সেই স্বপ্ন আর স্লিপ ওয়ার্কিংয়ের ঘটনাটা লুইসের মনে আছে। তবে এখন সেগুলোর প্রতি তার অনুভূতি এমন যে সেগুলো অন্য কারো সাথে ঘটেছে বা সেগুলো সে কোন টিভি প্রোগ্রামে দেখেছে।
আর, মৃত্যুর আগমুহূর্তে পাস্কো যে কথাগুলো বলেছিল কিংবা বলেনি, সেসব নিয়ে সে একদমই ভাবে না।
হ্যালোইনের রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে। লুইস আর এলি ক্র্যান্ডালদের বাসা থেকে তাদের হ্যালোইনের ট্রিক-অর-ট্রিট শুরু করে। এলি তার ডাইনি ঝাড়ুতে চড়ে ক্র্যান্ডালদের কিচেনে ঘুরে ঘুরে দৌড়াতে থাকে। তা দেখে নরমা বলেন, “কি সুন্দর লাগছে দেখেছো?”
জাড মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে একটা সিগারেট ধরান। “আমি ভেবেছিলাম তুমি গেজকেও হ্যালোইনের পোশাক পরিয়ে নিয়ে আসবে।”
তাদের অবশ্য গেজকে সাথে আনার পরিকল্পনা ছিল, বিশেষ করে রাচেলের এ ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। সে আর মিসি ডেন্ডিজ মিলে গেজের জন্যে একটা পোকার কস্টিউমও বানিয়েছিল। কিন্তু গেজের হঠাৎ মারাত্নক ঠান্ডা লেগে গেছে। তার বুকের শব্দ শুনে আর বাইরের তাপমাত্রা দেখে সে তার বাইরে যাওয়া নাকচ করে দেয়। রাচেল হতাশ হলেও তার সিদ্ধান্তে সম্মতি জানায়।
এলি গেজকে তার নিজের ভাগের চকলেট থেকে কিছু দেয়ার প্রমিজ করে। তবে গেজের কারণে তার শোক প্রকাশের আতিশায্যে লুইসের সন্দেহ হয় আসলে এলি ভেতরে ভেতরে খুশিই হয়েছে। কারণ গেজ তার সাথে থাকলে ওরা অনেক ধীর হয়ে যেতো… অথবা গেজ হয়তো আকর্ষণের কিছু অংশ চুরি করে নিত।
“আহারে,” এলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এমনভাবে বলেছিল, যেন গেজের প্রাণঘাতী ক্যান্সার হয়েছে। গেজ কি মিস করছে তা বুঝতে না পেরে টিভির সামনে বুদ হয়ে আছে। তার পাশে শুয়ে চার্চ ঘুমাচ্ছে।
“এলি ডাইনি,” কোন রকম মনোযোগ ছাড়াই গেজ জবাব দিয়েছিল। বলেই সে আবার টিভি দেখতে শুরু করেছিল।
“আহারে,” এলি আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বললে লুইস কুমিরের কান্নার কথা ভেবে মুচকি হাসে। এলি তার হাত ধরে টানতে থাকে। “চলো বাবা, চলো বাবা-চলো।”
“গেজের খুব কাশি হয়েছে,” লুইস জাডকে বলে।
“হুম, কপাল খারাপ,” নরমা বলেন। “যাক সামনের বার আরো বুঝতে শিখবে ও। এলি, তোমার ব্যাগটা এদিকে আনো…উপস!”
নরমা একটা আপেল আর একটা চকলেট বার নিয়েছিলেন এলিকে দেয়ার জন্য, কিন্তু দুটোই তিনি হাত থেকে ফেলে দিয়েছেন। বৃদ্ধার হাতের চামড়া এতো কুচকে গেছে যে তা দেখে লুইস চমকে যায়। সে নিচু হয়ে তার দিকে গড়িয়ে আসা আপেলটা তোলে। জাড চকলেট বারটা তুলে এলির ব্যাগে দেয়।
“আমি তোমাকে আরেকটা আপেল এনে দিচ্ছি,” নরমা বলেন। “এটাতে দাগ পড়ে যাবে।”
“সমস্যা নেই,” লুইস আপেলটা এলির ব্যাগে রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে।
“আমি দাগওয়ালা আপেল নেবো না, বাবা,” এলি বলে। ও তার বাবার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন তার বাবা পাগল হয়ে গেছে। “দাগ পড়া আপেল…ইয়াক!”
“এলি! অভদ্রের মত কথা বলছো কেন?” লুইস বলে।
“সত্য বলার জন্যে ওকে বকো না, লুইস।” নরমা বলেন। “শুধু বাচ্চারাই পুরো সত্যটা বলে। এটাই বাচ্চাদের সৌন্দর্য। দাগ পড়া আপেল আসলেই ইয়াক।”
“থ্যাঙ্ক ইউ মিসেস ক্র্যান্ডাল,” এলি বাবার দিকে বিজয়ের দৃষ্টিতে তাকায়।
“ইউ আর ওয়েলকাম, সোনামনি,” নরমা বলেন।
জাড তাদের বিদায় দিতে পোর্চে নিয়ে আসেন। আরো দুটো পিচ্চি ভূত এদিকেই আসছে। এলি তার ক্লাসমেটদের চিনতে পেরে ওদের নিয়ে কিচেনে ফিরে যায়। পোর্চে কিছুক্ষণের জন্যে লুইস আর জাড একা হয়ে যায়।
“ওনার আর্থাইটিস তো খুব বেড়ে গেছে,” লুইস বলে।
জাড মাথা ঝাঁকান, “হুম। প্রতি শরতে আর শীতে ওর অসুখ অনেক বেড়ে যায়। তবে এবারের মতো আগে কখনো এতোটা বাড়েনি।”
“ডাক্তার কী বলছে?”
“কিছুই না। বলবে কিভাবে? নরমা ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হচ্ছে না।”
“কেন? যাচ্ছেন না কেন?”
জাড লুইসের দিকে তাকালেন। জাডের চেহারায় হতাশা।
“ব্যাপারটা বলার সময় নির্বাচন হয়তো ভালো হচ্ছে না। তবে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে কিছু চাওয়ার জন্যে হয়তো কোন সময়ই ভালো সময় না। ডাক্তার, ওকে একটু দেখবে তুমি?”
কিচেন থেকে ভূতের বুউউ আর এলির খিক খিক খিক শব্দ আসছে।
“নরমার আর কোন সমস্যা হয়েছে?” লুইস জিজ্ঞেস করে। “উনি কি অন্য কিছুর ভয় করছেন?”
“ওর বুকে ব্যথা হচ্ছে।” জাড নিচু গলায় বলল। “সে ডক্টর ওয়েব্রিজের কাছে আর যেতে রাজি হচ্ছে না। আমি একটু দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।”
“নরমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে না?
জাড় ইতস্তত করে। “আমার ধারণা ও ভয় পাচ্ছে আর এজন্যেই ডাক্তারের কাছে যেতে চাচ্ছে না। ওর সবচেয়ে পুরনো বান্ধবীদের একজন, বেটি কোস্লাও মাত্র গত মাসে ই.এম.এম.সি-তে মারা গেছে। ক্যান্সার। ওদের দুজনের বয়স একই। ও খুব ভয় পেয়ে গেছে।”
“আমি ওনাকে অত্যন্ত আনন্দের সাথেই দেখবো,” লুইস বলে। “কোন সমস্যা নেই।”
“ধন্যবাদ, লুইস,” জাড কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলেন। “আমরা যদি কোন এক রাতে ওকে দুজন মিলে চাপাচাপি করি, তাহলে মনে হয়-”
জাড থেমে গেল। তিনি মাথা উঁচু করে বুঝতে চেষ্টা করলেন ভেতরে কী হচ্ছে।
এরপর কিভাবে কী হলো ভাবতে গেলে লুইসের সবকিছু ঘোলাটে মনে হয়। তার মনে আছে জাডের চেহারা স্বাভাবিক থেকে হঠাৎ খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়।
কিচেন থেকে পিচ্চি ভূতদের ‘বুউউ-হুউউ’ শব্দ আসছিল। হঠাৎ সেই শব্দ পরিবর্তন হয়ে আর্তচিৎকারে পরিণত হয়ে যায়।
“ওওওওও ওওওওও-”
“বাবা!” আতঙ্কিত কণ্ঠে এলি চিৎকার করে ওঠে। “বাবা! মিসেস ক্র্যান্ডাল পড়ে গেছেন!”
“ওহ খোদা,” জাড প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন
এলি দৌড়ে পোর্চে বেরিয়ে আসে। ওর এক হাতে ঝাড়ু। ওর গায়ের ডাইনি কস্টিউমটা ওর দৌড়ের সাথে সাথে দুলছে। ওর চোখে মুখে আতঙ্ক।
ওর পিছে পিছে বাকি দুই পিচ্চি ভূতও চিৎকার করতে করতে দৌড়ে বেরিয়ে আসে।
জাড একরকম ঝাঁপ দিয়েই দরজার ভেতর ঢুকে যায়। এই বয়সে এমন ক্ষিপ্রতা বেশ অবাক করার মতোই। সে তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকছে।
লুইস নিচু হয়ে এলির কাঁধে হাত রেখে বলে, “পোর্চে দাঁড়িয়ে থাকো এলি। কোথাও যাবে না, বুঝেছো?”
“বাবা, আমার ভয় লাগছে,” এলি মৃদু স্বরে বলে।
ভূত দুটো তাদের পাশ কাটিয়ে গুলির বেগে বেড়িয়ে যায়। তারা ‘মা-মা’ করে চিৎকার করছে।
লুইস দৌড়ে কিচেনের দিকে যায় এলিকে অগ্রাহ্য করে, যে তাকে পেছন থেকে ডাকছে।
নরমা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আপেল আর ছোট ছোট চকলেট বারের মধ্যে পড়ে আছেন। মনে হচ্ছে পড়ে যাবার সময় তার হাত লেগে এসব রাখা বোলটা উল্টে গেছে। বোলটা কাছেই পড়ে আছে, যেটাকে একটা ফ্লাইং সসারের মত লাগছে দেখতে। জাড তার স্ত্রীর এক হাতে মালিশ করছেন। তিনি লুইসের দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকালেন।
“সাহায্য করো লুইস,” সে বলে। “ওকে ধর। আমার মনে হয় ও মরে যাচ্ছে।”
“একদিকে সরে যান।” লুইস বলে।
আবারো পাস্কোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, ভাবনাটা লুইসের মনে উঁকি দিতেই সে তা ঝেড়ে ফেলে দেয়।
লুইস নরমার পালস চেক করে দেখে পালস খুব মৃদু, তবে খুব দ্রুত চলছে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের লক্ষণ।
লুইস ওনার জামা খুলে দেয়। তিনি ভেতরে একটা গোলাপি সেমিজ পড়ে আছেন। লুইস তার মাথা একদিকে সরিয়ে দিয়ে সি.পি.আর দেয়া শুরু করে।
“জাড, আমার কথা মন দিয়ে শুনুন,” সে বলে।
“হ্যাঁ। বলো লুইস,” জাড বলেন।
“এলিকে নিয়ে যান,” সে বলে। “সাবধানে রাস্তা পার হবেন, রাস্তার দুদিকে তাকিয়ে। রাচেলকে বলবেন কী হয়েছে। আর বলবেন আমার ব্যাগটা দিতে। স্টাডির ব্যাগটা না, ওপর তলার শেলফের ব্যাগটা। আর ব্যাঙ্গর মেডকুতে ফোন দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলবেন।”
“বাকস্পোর্টেরটা কাছে হবে,” জাড বলেন।
“ব্যাঙ্গরেরটা দ্রুত আসবে। যান। আর আপনি কল করবেন না। রাচেলকে কল করতে বলবেন। আমার ব্যাগটা খুব জরুরি।” রাচেল যখন জানবে এখানে কী হয়েছে আমার মনে হয় না ও নিজে ব্যাগ নিয়ে এখানে আসবে, লুইস ভাবে।
জাড় চলে গেলেন। সে বাইরের কাচের স্ক্রিন ডোরটা বন্ধ হবার শব্দ পায়। সে নরমা ক্র্যান্ডাল আর ঘড়ির টিক টকের সাথে একা হয়ে পড়ে।
নরমা হঠাৎ শব্দ করে একটা লম্বা শ্বাস নেন আর তার চোখের পাতাগুলো কাঁপতে শুরু করে। আর লুইসের মন একটি সুনিশ্চিত আশঙ্কায় ভরে ওঠে।
উনি চোখ খুলবেন। ওহ খোদা, উনি এক্ষুনি চোখ খুলে পেট সেমেটারি নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন।
তবে তিনি চোখ খুলে লুইসের দিকে তাকালেন। তিনি লুইসকে চিনতে পারলেন। এরপরই তিনি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। লুইসের খুব লজ্জা লাগে। সে তো এরকম ছিল না। তবে সাথে সাথে তার উদ্বেগেরও নিরসন হয়। নরমার চোখে ব্যথার ছাপ থাকলেও নিদারুণ যন্ত্রণার কোন চিহ্ন নেই। তার ধারণা বড় কিছু থেকে হয়তো তিনি বেঁচে গেলেন।
লুইস নিজে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর ঘামছে। টিভি প্যারামেডিকরা ছাড়া আর কেউ হয়তো সিপিআর তাদের মত এত সহজে দিতে পারে না। অবিচলিতভাবে ক্লোজ চেস্ট ম্যাসাজ করতে প্রচুর ক্যালরি পুড়ে। তার বাহু আর কাঁধের জয়েন্টগুলো আগামীকাল নিশ্চিতভাবেই ব্যথা করবে।
“আমি কোন সাহায্য করতে পারি?”
লুইস মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। প্যান্ট আর বাদামি সোয়েটার পরা একজন মহিলা দরজার কাছে দাড়িয়ে আছে। সে এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের কাছে ধরে আছে। পিচ্চি ভূতগুলোর মা হবেন হয়তো।
“না,” বলে আবার পরক্ষণেই সে বলল, “হ্যাঁ। একটা কাপড় ভিজিয়ে পানি ঝেড়ে আনুন। এনে ওনার কপালের ওপর রাখুন।
মহিলাটি কাজে লেগে যায়। লুইস নিচে তাকিয়ে দেখলো নরমা চোখ খুলে তাকিয়েছেন।
“লুইস, আমি পড়ে গিয়েছিলাম,” তিনি বিড়বিড় করে বললেন। “মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।”
“আপনার হার্টে কোন সমস্যা হয়েছিল,” লুইস বলে। “তবে সিরিয়াস কিছু মনে হয় না। এখন রিলাক্স করুন আর চুপ করে থাকুন।
লুইস সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার নরমার পালস নিলো। তার বিট খুব দ্রুত চলছে। অনেকটা মোর্স কোডের মত। তার কিছু বিট রেগুলার হচ্ছে আর তার পরই কয়েকটা খুব জোরালো বিট দিচ্ছে, এর পর আবার রেগুলার। বিট-বিট-বিট, ধাম-ধাম-ধাম, বিট-বিট-বিট। জিনিসটা খারাপ তবে কার্ডিয়াক এরিথমিয়া থেকে কিছুটা ভালো।
মহিলাটি ভেজা কাপড় এনে নরমার মাথায় দিয়ে আর কি করবে বুঝতে না পেরে সরে দাঁড়ায়। তখনই জাড লুইসের ব্যাগ নিয়ে রুমে প্রবেশ করেন।
“লুইস?”
“উনি ঠিক হয়ে যাবেন,” লুইস জাডের দিকে তাকিয়ে নরমাকে শোনানোর উদ্দেশ্যে বলে। “মেডকু আসছে?”
“তোমার বউ তাদের ফোন করছে,” জাড বললেন। “আমি দেরি না করে চলে এসেছি।”
“হাসপাতাল…না,” নরমা বিড়বিড় করে বললেন।
“হাসপাতাল…হ্যা,” লুইস বলল। পাঁচ দিনের অবজারভেশন, মেডিকেশন, আর তারপরই ভদ্র মেয়ের মত বাসায় ফিরে আসবেন। আর অন্য কিছু বললে এই সবগুলো আপেল আপনাকে গেলাবো, একদম বিচি সহ।”
তিনি দুর্বলভাবে হেসে চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
লুইস তার ব্যাগ খুলে ভেতরে হাতড়ে আইসোডিলের কৌটাটা বের করে। সেটা ঝাঁকিয়ে একটি পিল বের করে দুই আঙুলের ডগায় টিপে ধরে।
“নরমা, আমাকে শুনতে পারছেন?”
“হুম।”
“আপনার মুখ খুলুন। ট্রিক-অর-ট্রিট। আপনি আপনার ট্রিক দেখিয়েছেন, এখন আপনার ট্রিটের জন্যে মুখ খুলুন। আমি আপনার জিভের নিচে একটা ছোট পিল রাখব। এটাকে নিজে থেকে গলে যেতে দিবেন। একটু তিতা লাগতে পারে, ওকে?”
তিনি তার মুখ খুললেন। বাধানো দাঁতের পাটির বাসি গন্ধ তার নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এলে তার জন্যে লুইসের খুব মায়া হয়। তার মনে হয় এক সময় তিনি ষোড়শী বালিকা ছিলেন। তার দিকে এলাকার কত পুরুষ হয়তো মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো আর তখন তার দাঁতগুলোও ছিল আসল। আর এখন তিনি বাধানো দাঁত নিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আপেল আর চকলেট বারের মধ্যে পড়ে আছেন।
পিলের ওপর জিভ রাখতেই তিনি চোখ মুখ কুচকে ফেলেন। পিলটা বেশ ভালই তেতো। তবে তিনি ভিক্টর পাস্কোর মত সাহায্যের আওতার বাইরে নন। হয়তো এ যাত্রায় বেঁচেই গেলেন। তার হাত বাতাসে হাতড়াতে থাকলে জাড হাতটা নরমভাবে ধরলেন।
লুইস উঠে দাড়িয়ে উল্টানো বোলটা নিয়ে সেটাতে মেঝেতে পড়ে থাকা ট্রিটগুলো তুলতে থাকে। পিচ্চি ভূতদের মা, যিনি নিজেকে সামনের রাস্তার মিসেস বাডিংগার বলে পরিচয় দিলেন, তিনিও লুইসকে সাহায্য করলেন। এরপর তিনি বললেন তিনি তার বাচ্চাদের কাছে গাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। তার বাচ্চারা বেশ ভয় পেয়েছে।
“আপনার সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ মিসেস বাডিংগার,” লুইস বলে। “আমি তেমন কিছুই করিনি। খোদাকে ধন্যবাদ আপনি এখানে ছিলেন, ড. ক্রিড।”
লুইস একটু বিব্রত হয়ে তাকে হাত নেড়ে বিদায় দেয়।
“আসলেই। আজকে তুমি না থাকলে যে কী হতো…” তিনি লুইসের চোখে চোখ রাখলেন। তার চোখে স্থিরতা, জাড আবারো নিজের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। “খুব বড় একটা উপকার করলে। তোমার কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম, লুইস।”
“বাদ দিন তো,” সে একটা আপেল নিয়ে খেতে শুরু করে। আপেলটা এতই মিষ্টি যে তার জিবের টেস্ট বাডগুলোতে খিল ধরে যায়…তবে এই অনুভূতিটা খুব একটা খারাপ না। আজকের খেলায় তুমি জিতেছ, লু, সে ভাবতে ভাবতে আপেলটার ওপর হামলে পড়ে। সে বুভুক্ষের মত আপেলটা খতম করলো।
“আমি সত্যি বলছি। তোমার ঋণ শোধ করার মত না। তবে কখনো যদি তোমার কোন সাহায্য লাগে, তুমি সবার আগে আমাকে বলবে।”
“আচ্ছা,” লুইস বলে। “সহিহ বলেছেন।
***
বিশ মিনিট পর অ্যাম্বুলেন্স আসে। লুইস যখন বাইরে দাড়িয়ে নরমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা দেখছিল, সে দেখতে পেল তাদের বাসার জানালায় দাড়িয়ে রাচেলও এদিকেই তাকিয়ে আছে। লুইস রাচেলকে লক্ষ্য করে হাত নাড়লে রাচেল শুধু একটা হাত তুলে জবাব দেয়।
লুইস আর জাড একসাথে দাড়িয়ে অ্যাম্বুলেন্সের চলে যাওয়া দেখে, অ্যাম্বুলেন্সটার সাইরেন বন্ধ তবে লাইট ফ্লাশ করছে।
“আমি তাহলে হাসপাতালে যাই,” জাড বলেন।
“এখন গেলেও ওরা রোগির সাথে দেখা করতে দিবে না। ওরা ওনার ওপর টেস্ট চালিয়ে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে রাখবে। প্রথম বারো ঘন্টা রোগির সাথে কাউকে দেখা করতে দিবে না।”
“ও কি ভালো হয়ে যাবে, লুইস?”
লুইস কাঁধ ঝাকায়। “কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে না। এটা একটা হার্ট অ্যাটাক ছিল। তবে আমার ধারনা উনি ভালো হয়ে যাবেন। আর ওষুধ খাওয়ার কারণে হয়তো আগের চাইতেও ভাল থাকবেন।”
“হুম,” জাড একটা সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন।
লুইস তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু অবাকই হলো। আটটা বাজতে আরো দশ মিনিট। তবে তার মনে হচ্ছে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। “জাড, আমি যাই, এলি যাতে ট্রিক অর ট্রিটিং করতে পারে।”
“শিওর, যাও।” জাড বললেন। “ওকে বলো যাতে যত বেশি সম্ভব ট্রিট সংগ্রহ করে।”
“আচ্ছা, বলবো,” লুইস বলে।
***
লুইস বাসায় গিয়ে দেখে এলি তার ডাইনির কস্টিউম পরে বসে আছে। রাচেল ওকে ওটা খুলে রাতের জামা পরার ব্যাপারে পটাতে গিয়ে বিফল হলো। এলি গো ধরে আছে। ওর মনে ক্ষীণ আশা যে তার যেই খেলাটি নরমার হার্ট এটাকের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, তা হয়তো আবার শুরু করা যাবে।
“এখন গেলে ওর অনেক রাত হয়ে যাবে, লুইস।”
“আমরা গাড়ি নিয়ে যাব,” লুইস বলে। “প্লিজ রাচেল, ও এই দিনটার জন্যে মাস খানেক ধরে অপেক্ষা করে আছে।
“আচ্ছা বাবা…” রাচেল মুচকি হাসে। এলি তা দেখতে পেয়ে তার কোট আনতে কোট ক্লজেটের দিকে দৌড়ে যায়। “নরমা ঠিক আছেন?”
“হুম, এখন মোটামুটি ভালই অবস্থা।” কথাটা বলে তার খুব ভাল লাগলো। সে খুব ক্লান্ত, কিন্তু তার পরেও খুব ভাল লাগলো। “হার্ট অ্যাটাকটা ছোট ছিল। এখন থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। তবে বয়স পচাত্তর হলে সাবধান হলেও হয়তো যা হবার তা রোধ করা যাবে না।”
“ভাগ্য ভালো যে তুমি সেখানে ছিলে। খোদা হাতে ধরে তাকে সাহায্য পাঠিয়েছেন।”
লুইস মুচকি হাসে। এলি ফিরে আসলে সে বলে, “তুমি রেডি, ডাইনি হেজেল?”
“আমি রেডি,” সে উত্তর দেয়। “চলো চলো-চলো!”
***
ঘন্টা খানেক পর যখন লুইস তাদের অভিযানের ইতি ঘোষনা করে তখন এলি প্রতিবাদ জানায়। তবে তার প্রতিবাদের তেমন তেজ ছিল না কারণ সে নিজেও এর মধ্যে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে এর মধ্যেই হাফ ব্যাগ ক্যান্ডি জোগাড় করে ফেলেছে। বাসায় ফেরার পথে এলি লুইসকে একটা কথা বলে চমকে দেয়, “বাবা আমার জন্যেই কি মিসেস ক্র্যান্ডাল হার্ট অ্যাটাক করেছেন? আমি দাগওয়ালা আপেল নিতে চাইনি বলে?”
লুইস এলির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবে, বাচ্চারা এসব কুসংস্কারের ভাবনা কোথায় পায়।
স্টে অন অ্যা ক্র্যাক, ব্রেক ইওর মাদার’স ব্যাক।
লাড্স মি, লাড্স মি নট।
ড্যাডি’স স্টমাক, ড্যাডি’স হেড,
স্মাইল অ্যাট মিডনাইট, ড্যাডিস ডেড।
এসব ভাবতে ভাবতে তার আবার বাচ্চাদের করা পেট সেমিটারির সেই আনাড়ি বৃত্তগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। সে হাসতে চাইলেও পারলো না।
“না, মামনি,” সে বলে। “তুমি যখন ভেতরে ওই দুই ভূতের সাথে-”
“ওরা ভূত না তো, ওরা দুজন তো বাডিংগার জমজ।”
“আচ্ছা। তুমি যখন ভেতরে ওদের সাথে ছিলে তখন আমাকে মিস্টার ক্র্যান্ডাল বলছিলেন যে তার স্ত্রীর বুকে ব্যথার সমস্যা দেখা দিয়েছে। আসলে তো তোমার জন্যেই আজ তিনি বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে গেলেন।”
এবার এলির চমকানোর পালা। সে অবাক হয়ে লুইসের দিকে তাকায়। লুইস নড করে। “মামনি, তার ওই সময় একজন ডাক্তারের প্রয়োজন ছিল। আর আমি একজন ডাক্তার। আর আমি সেসময় সেখানে ছিলাম কারণ আজ তোমার ট্রিক অর ট্রিটিং এর রাত।”
এলি বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাথা ঝাকায়। “তবে উনি বেশি দিন বাঁচবেন না।” এলি গম্ভীর হয়ে বলে। “যাদের হার্ট অ্যাটাক হয় তারা মরে যায়। আর বেঁচে গেলেও কিছুদিন পরেই আবার আরেকটা অ্যাটাক হয়, তারপর আবার হয় আর হতে হতে এক সময়…বুম!”
“আর তুমি এই জ্ঞানের কথা কোত্থেকে জানলে, জানতে পারি?” লুইস জিজ্ঞেস করে। জবাবে এলি কিছু না বলে শুধু কাঁধ তুলল।
গাড়ি থেকে নেমে এলি লুইসকে ওর ক্যান্ডির ব্যাগ বহন করতে দেয়-বিশ্বাসের প্রায় চূড়ান্ত চিহ্ন। লুইস তার মেয়ের মন নিয়ে ভেবে কূল পায় না। এলি চার্চের মৃত্যুর কথা ভেবে প্রায় হিস্টেরিক হয়ে পড়েছিল। আর আজ যখন তার নানীর মত নরমা ক্র্যান্ডাল প্রায় মরেই যাচ্ছিলেন, সেটা সে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। আর সে কী বলল? হতে হতে এক সময় … বুম!”
কিচেন ফাঁকা হলেও লুইস ওপরতলা থেকে রাচেলের চলাফেরার শব্দ পাচ্ছে। লুইস এলির ক্যান্ডির ব্যাগটা রেখে বলল, “এই রকম হবে তা ভাবা ঠিক না। নরমার অ্যাটাকটা খুব ছোট ছিল আর আমি সাথে সাথে তার প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্ট দিয়েছি। আশা করি তার হার্টে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।”
ওহ, আমি জানি,” এলি হাসি মুখে সম্মতি জানায়। “তবে উনি তো বুড়ো হয়ে গেছেন। কিছুদিন পর উনি এমনিতেই মারা যাবেন। মিস্টার ক্র্যান্ডালও। বাবা, ঘুমুতে যাওয়ার আগে আমি একটা আপেল খেতে পারি?”
“না,” সে নিজের মেয়ের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে বলে। “ওপরে গিয়ে ব্রাশ করে নাও মামনি।”
কেউ কি আসলেই বাচ্চাদের বোঝে? সে ভাবে।
লুইস আর রাচেল যখন তাদের বাড়ির সব কাজ শেষ করে তাদের পাশাপাশি লাগানো টুইন বেডে শুয়ে ছিল তখন রাচেল নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, “এলি কি খুব আঘাত পেয়েছে? ও কি আপসেট?”
না, সে ভাবে। ও জানে বুড়ো মানুষের সাথে মাঝে মাঝে এরকম হয়-ই। ঠিক যেমনি ও জানে কেউ দড়িলাফ খেলার সময় তেরো নাম্বার লাফে পড়ে যাওয়া মানে তার বেস্ট ফ্রেন্ড মরে যাবে, ঠিক যেমনি ও জানে কেউ ঘাসফড়িং ধরার পর সেটা থুতু ফেললে সেটাকে ছেড়ে দিতে হয়…ঠিক যেমনি ও জানে পেট সেমিট্রিতে বৃত্তাকার লাইনে কবরগুলো খুঁড়তে হয়।
“নাহ,” সে বলে। ও নিজেকে ভালই সামলে নিয়েছে। চলো ঘুমিয়ে পড়ি, আচ্ছা?”
সেরাতে ওরা যখন নিজেদের বাসায় ঘুমিয়ে আছে আর জাড ক্র্যান্ডাল যখন তার বাসায় জেগে বসে আছে, বাইরে খুব ঠান্ডা পড়ে। রাতের ঠান্ডা বাতাসে গাছের অবশিষ্ট পাতাগুলোও ঝরে গেল।
বাতাসের শব্দে লুইসের ঘুম ভেঙে গেলে সে ধড়মড়িয়ে হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে জেগে উঠে। সিঁড়ি থেকে পায়ের আওয়াজ আসছে… ধীর, টেনে টেনে হাঁটার শব্দ। পাস্কো ফিরে এসেছে। সে ভেবে দেখলো দুই মাস হয়ে গেছে সেই ঘটনার। এখন দরজা খুললেই সে পচতে থাকা বিভীষিকা চাক্ষুস দেখতে পাবে। পাস্কোর গায়ে থাকবে কাঁদায় মাখামাখি জগিং শর্টস, তার গায়ে থাকবে মাংস খসে পরা গর্ত, তার মাথার ব্রেইন পচে এতোদিনে পেস্ট হয়ে গেছে। শুধু তার চোখগুলো হবে জীবন্ত…নারকীয়ভাবে উজ্জ্বল আর জীবন্ত। এবার পাস্কো কোন কথা বলবে না, তার কন্ঠনালী এতো দিনে পচে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার চোখগুলো…চোখগুলো লুইসকে ডেকে নিয়ে যাবে।
“না,” সে বড় নিশ্বাস ছেড়ে বলে, এবং পায়ের শব্দ থেমে যায়।
সে উঠে দাড়িয়ে দরজার কাছে যায়। উত্তেজনায় আর আশঙ্কায় সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে, তার মাংসপেশিগুলো টানটান হয়ে আছে। সে দরজা খোলার জন্যে দরজা ধরে টান মারে। পাস্কো ওপাশেই থাকবে। তার পচাগলা মৃতদেহ নিয়ে তার জন্যে দাড়িয়ে থাকবে।
কিছুই নেই। দরজার ওপাশটা একদম শূন্য এবং নীরব। বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই নেই। সে তার বিছানায় ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
অধ্যায় ২১
পরদিন লুইস ইএমএমসি’র ইনটেনসিভ কেয়ারে ফোন করে নরমার খোঁজ নিল। নরমার অবস্থা তখনো আশঙ্কাজনক বলে ধরা হচ্ছে সেখানে, যেটা হার্ট অ্যাটাকের পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্যে সাধারণ কার্যপ্রণালী। তবে লুইস নরমার ডাক্তার ওয়েব্রিজের কাছ থেকে আরো উৎসাহমূলক জবাব পায়। “আমি এটাকে ছোটখাট মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশনও বলবো না।” সে বলে। “কোন ক্ষত চিহ্ন নেই, সে ক্ষেত্রে আপনার অবদান অনেক, ড. ক্রিড।”
পরের সপ্তাহে লুইস এক তোড়া ফুল নিয়ে নরমার সাথে দেখা করতে গেল। ওনাকে ইন্টেন্সিভ কেয়ার থেকে একটি সেমি প্রাইভেট রুমে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, এটা একটা ভালো লক্ষণ। জাড তার সাথেই ছিলেন।
নরমা ফুল পেয়ে উচ্ছসিত হলেন। তিনি জাডকে নির্দেশনা দিয়ে দিয়ে ফুলগুলো ফুলদানিতে পানি দিয়ে রাখলেন, ঠিক তার মনের মত করে।
“নানী বেশ ভালোই আছে, আগের চাইতেও ভাল,” জাড তৃতীয়বারের মত নরমার নির্দেশনা অনুযায়ী ফুলগুলো সাজিয়ে শুকনো গলায় বললেন।
“বেশি চালাকি করো না, জাডসন।” নরমা বলেন।
“নো, ম্যাম।”
এরপর নরমা লুইসের দিকে তাকালেন। “জাড আমাকে সব বলেছে, কিভাবে তুমি আমাকে ওই মুহূর্তেই ট্রিটমেন্ট দিয়েছো,” তিনি অনেকটা লজ্জিত গলায় বললেন। “জাড বলেছে তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ।”
অপ্রস্তুত হয়ে লুইস বলে, “উনি বাড়িয়ে বলেছেন।”
“উনি একটুও বাড়িয়ে বলেননি,” জাড বলেন। তিনি তেরছা চোখে লুইসের দিকে তাকালেন, তার মুখ হাসি হাসি। “তোমার মা কি তোমাকে কারো ধন্যবাদ গ্রহন করতে শেখায় নি?”
নরমা তখন কিছু বলেছিল কি না লুইসের ঠিক মনে নেই। তবে তার এটা মনে আছে যে তিনি আগে কখনো বলেছিলেন বিনয় হচ্ছে অহংকারের অর্ধেক পাপ।
“নরমা,” সে বলে, “আপনার জন্য যা করেছি আমি খুশি মনেই করেছি।”
“তুমি খুব ভালো ছেলে, লুইস,” নরমা বলেন। “এখন এই বুড়োকে নিয়ে বাইরে যাও, যাতে সে তোমাকে এক গ্লাস বিয়ার কিনে খাওয়াতে পারে। আমার ঘুম পাচ্ছে, আর এই লোকটা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুক্তি চাই।”
জাড উৎসাহের সাথে উঠে দাঁড়ালেন। “ওরে বাপরে! বলে কী বুড়ি! চলো লুইস, এখানে আর এক মুহূর্তও না, সে তার মত পরিবর্তনের আগেই ভাগি আমরা।”
***
“থ্যাঙ্কস গিভিং’ এর আগের সপ্তাহে প্রথম তুষার পড়ে। বাইশে নভেম্বর আরো চার ইঞ্চি তুষার পড়ে। তবে ছুটির দিন শুরু হবার আগের দিন ঠান্ডা থাকলেও আকাশ পরিস্কার হয়ে যায়। লুইস তার পরিবারের সবাইকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে যায়। এলিরা তাদের নানা বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে, শিকাগোতে।
“এটা ঠিক না,” এ মাসের শুরুতে বেড়াতে যাওয়ার আলোচনা শুরু হবার পর থেকে রাচেল বিশতম বারের মত বলে। থ্যাঙ্কস গিভিং’ এর দিন তুমি বাসায় একা একা বসে থাকবে আর আমরা শিকাগোতে আনন্দ করবো, ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না। এই দিনটা পরিবারের সাথে উদযাপন করার দিন, লুইস।”
“আমি বাসায় বসে একা একা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবো না,” লুইস বলে। “জাড আর নরমা আমাকে ওদের বাসায় টার্কির জন্যে দাওয়াত দেবে। আরে, আমার নিজেরি তো অপরাধী অপরাধী লাগছে। আমার এসব দিন এমনিতেও বিশেষ কিছু মনে হয় না। দুপুরে কোন ফুটবল ম্যাচ দেখতে দেখতে বিয়ার গিলে সাতটার দিকেই ঘুমিয়ে পড়ি, আর পরের দিন ঘুম থেকে উঠে মনে হয় আমার মাথার ভেতর কেউ ঢোল পেটাচ্ছে। আমার শুধু তোমাদের পাঠিয়ে দিতে খারাপ লাগছে।”
“আমরা তো ভালোই থাকবো,” রাচেল বলে। “ফার্স্ট ক্লাসে চড়ে যাচ্ছি, আমার তো নিজেকে প্রিন্সেস মনে হচ্ছে। আর গেজ তো পুরো ফ্লাইট ঘুমিয়েই কাটাবে।”
“দোয়া কর যেন ঘুমিয়ে থাকে বিচ্ছু মিয়া,” লুইস বললে তারা দুজনেই একসাথে হেসে ওঠে।
লাউড স্পিকারে ফ্লাইট ঘোষনা করলে এলি লাফালাফি শুরু করে। “ওটা আমাদের ফ্লাইট, মা চলো-চলো চলো-চলো। পরে ওরা আমাদের রেখেই চলে যাবে।”
“না, যাবে না,” রাচেল বলে। সে তার এক হাতে তিনটি বোর্ডিং টিকেট মুঠ করে ধরে আছে। রাচেল একটা পশমি কোট পড়ে আছে, নকল পশমের কোট। নকল হোক আর যাই হোক, রাচেলকে খুব সুন্দর লাগছে।
রাচেল হয়তো লুইসের চোখে কিছু দেখতে পায়, কারণ সে সাথে সাথে ওকে জড়িয়ে ধরে। ওদের দুজনের মাঝে পড়ে গেজ প্রায় ভর্তা হবার জোগাড়, তবে গেজ রাগ করলো না।
“লুইস ক্রিড, আই লাভ ইউ,” সে বলে।
“আম্মুউউ,” এলি বলে, অস্থির হয়ে। “চলো-চলো–চ-”
“আরে বাবা আচ্ছা,” রাচেল বলে। “ভালোভাবে থেকো, আর একদম দুষ্টুমি করবে না, লুইস।”
“আচ্ছা,” লুইস মুচকি হেসে বলে। “আমি সাবধানে থাকবো। তোমার বাড়ির সবাইকে আমার হয়ে শুভেচ্ছা দিও।”
ওহ, তুমি!” রাচেল বলেই নাক কুচকে ফেলে। রাচেল বোকা না, ও জানে লুইসের না যাওয়ার আসল কারণ কি। “খুব ফা-নিইই”
সে তাদের সিঁড়ি দিয়ে প্লেনে উঠতে আর আগামী এক সপ্তাহের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে। ওর এখনি হোমসিক আর একা লাগতে শুরু করে তাদের জন্যে।
সত্যটা খুব সহজ। রাচেলের বাবা-মা, মিষ্টার এবং মিসেস আরউইন গোল্ডম্যান একদম শুরু থেকেই লুইসকে পছন্দ করেন না। প্রথমত সে তাদের মত সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ না। আরো মন্দ ব্যাপার হচ্ছে লুইস মেডিকেলে পড়ার সময় তাদের মেয়ের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল, যেখান থেকে তার পাস করার মত যোগ্যতাই নেই।
লুইস এগুলো সব মেনে নিতে পারতো, আদতে মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু তার পর এমন কিছু ঘটে যেটা রাচেল জানে না এবং কখনোও জানবে না…অন্তত লুইসের কাছ থেকে তো নয়ই। আরউইন গোল্ডম্যান লুইসের মেডিকেল কলেজের সমস্ত খরচ দিতে চেয়েছিলেন। আর এই স্কলারশিপের (গোল্ডম্যানের নিজের ব্যবহার করা শব্দ) দাম হচ্ছে, লুইসকে ঠিক ওই মুহূর্তে রাচেলের সাথে এনগেজমেন্ট ভেঙে দিতে হবে।
লুইসকে যখন এই নাটকীয় ঘুষের (কোদালকে কোদাল বলাই শ্রেয়) প্রস্তাব দেয়া হয় তখন সময়টা লুইসের অনুকূলে ছিল না। অবশ্য এসব প্রস্তাব অনুকূল অবস্থায় দেয়া হয়ও না। একে সে প্রচন্ড ক্লান্ত ছিল। সপ্তাহে আঠারো ঘন্টা ক্লাস করছিল, বিশ ঘন্টা বইয়ের পেছনে আরো পনেরো ঘন্টা একটা পিজা জয়েন্টে ওয়েটারি করে যাচ্ছিল। সে খুব নার্ভাসও ছিল। মিষ্টার গোল্ডউইন যখন তাকে তার স্টাডিতে সিগারের দাওয়াতে ডেকে পাঠান, তখন সে আসলেই খুব ভয়ে ভয়ে ছিল। তার আশঙ্কা হচ্ছিল যে তিনি যেকোন সময় বলে বসবেন, “লুইস তুমি আমার মেয়ের সাথে শুয়ে বেড়াচ্ছ, আমি সেটা জেনে গেছি।”
যখন মি. গোল্ডম্যান তার অবিশ্বাস্য অফারটি করেন, এমনকি কোটের পকেট থেকে চেকবইটাও বের করেন, লুইস তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ে, তাকে যা-তা শুনিয়ে দেয়। সে বলে, তার মত নিচু মনের মানুষ সে আগে কখনো দেখেনি, যে কি না আর কাউকে মানুষই মনে করে না। সে একজন নির্বোধ হারামজাদা। তবে অনেক দিন পর লুইস স্বীকার করে যে, তার ক্রোধের এই অংশটা অনেকটাই ছিল তার সেই দুশ্চিন্তার ভার নেমে যাওয়ার বহিঃপ্রকাশ।
এরপর দুজনেরই মুখের লাগাম ছুটে যায়, একপর্যায়ে গোল্ডম্যান তাকে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। আরো বলেন, যদি তিনি লুইসকে আর কখনো তার বাড়ির ধারেকাছেও দেখেন তাহলে ওকে কুকুরের মত গুলি করে মারবেন। লুইস তাকে বলে, তিনি তার চেকবইটা তার পাছার ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে পারেন। গোল্ডম্যান জবাবে বলেন, রাস্তার গরু-ছাগলের মধ্যে লুইসের চাইতে বেশি যোগ্যতা দেখেছেন তিনি। পাল্টা সে বলে, তিনি যেন তার ব্যাংক আমেরিকা কার্ডটাও চেকবইয়ের পাশাপাশি পাছার ভেতর জায়গা করে দেন।
মোটকথা জামাই শ্বশুড়ের শুরুটা হয় প্রচন্ড ঠোকাঠুকির মধ্য দিয়ে।
শেষে রাচেল তাদের দুজনের মাঝে মিটমাট করায়, তারা প্রত্যেকে নিজেদের পাপের জন্য মুখে ঠিকই ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে ভেতরে ভেতরে এখনো কেউ কাউকে দেখতে পারে না। তাদের রম্য নাটকের সেখানেই আপাত ইতি হয় এবং আমার আজ-থেকে-কোন-মেয়ে-নেই এরকম নাটকও তাদের দেখতে হয় না। তবে লুইসের কাছে নিজের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার চাইতে তিনি যে রুপকথার কোন দৈত্যকে জামাই হিসেবে বেশি পছন্দ করতেন তা বুঝতে লুইসের কখনই বেগ পেতে হয়নি। তাদের বিয়ের দিন পুরোটা সময় তিনি নিজের মুখটা হাড়ির মত করে রেখেছিলেন। গোল্ডউইনদের পক্ষ থেকে রাচেলের বিয়ের গিফট ছিল চিনে মাটির ডিনার সেট আর একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন। গিফট হিসেবে কোন টাকা তিনি দেননি। লুইসের মেডিকেল পড়াশোনার পুরোটা সময় রাচেল একটা গহনার দোকানে ক্লার্কের চাকরি করেছে। আর তখন থেকে এখন পর্যন্ত রাচেল জানে লুইস আর তার পরিবারের মধ্যে কিছুটা চাপা ক্ষোভ আছে, বিশেষ করে লুইস আর তার বাবার মাঝে।
লুইস চাইলে তাদের সাথে যেতেই পারতো, তবে ইউনিভার্সিটি সিডিউলের কারণে রাচেল আর বাচ্চাদের তিনদিন আগেই তাকে ফিরে আসতে হতো। সেটা তেমন কোন বড় সমস্যা না। অন্য দিকে তার শ্বশুড় রাবন আর শ্বাশুড়ি সুয়োরাণীর সাথে চারদিন কাটানো আসলেই তার জন্যে অনেক বড় সমস্যা।
বাচ্চা হবার পরে অবশ্য রাচেলের বাবা-মা অনেকটাই গলেছেন, নাতি- নাতনী হলে সাধারণত যা হয়ে থাকে। আর লুইস নিজেও হয়তো তাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলাতে পারবে, সেদিনের ঘটনা ভুলে যাওয়ার অভিনয় করে। সে যে অভিনয় করছে সেটা রাচেলের বাবা বুঝতে পারলেও হয়তো কিছু আসতো যেতো না। তবে আসলে সে তাদের সাথে পুনর্মিলনীতে সামিল হতে চাইছিল না। দশ বছর অনেক লম্বা সময়, তবে রাচেলের বাবার স্টাডির সেদিনের ঘটনা ভোলার জন্য যথেস্ট লম্বা নয়। সে আর রাচেল যে দিনগুলো-মোট পাঁচদিন-তার চিপা অ্যাপার্টমেন্টে কাটিয়েছিল সেগুলো রাচেলের বাবা টের না পাওয়ায় সে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল, তবে সেদিনের ঘটনায় তার শ্বশুড়ের প্রতি যেই অশ্রদ্ধা তার মনে জন্ম নিয়েছিল তা দশ বছর পরেও বহাল তবিয়তে আছে।
সে যেতেই পারতো। কিন্তু নিজে না গিয়ে তার শ্বশুরকে একটা মেসেজসহ তার মেয়ে আর নাতি-নাতনীকে পাঠালো
ডেল্টা ৭২৭ চলতে শুরু করে এবং নাকটা ঘোরায়। বিমানের একটা জানালার পাশে সে এলিকে দেখতে পায়, ও তাকে লক্ষ্য করে অত্যন্ত উৎসাহের সাথে হাত নাড়ছে। সে হাসে এবং হাত নেড়ে জবাব দেয়। এরপর কেউ-রাচেল বা এলি-গেজকে জানালার পাশে ধরে। লুইসকে দেখেই হোক অথবা এলিকে নকল করেই হোক, গেজও হাত নাড়তে থাকে।
“আমার ফ্যামিলিকে ভালোভাবে নিয়ে যাও,” সে বিড়বিড় করে বলে এবং এরপর নিজের কোটের চেইন লাগিয়ে পার্কিং লটে চলে আসে। সে গাড়িতে ওঠার আগেই জেট বিমানটাকে আকাশে সশব্দে উড়ে যেতে দেখে।
তার এর মাঝেই একা একা লাগতে শুরু করেছে এবং হাস্যকরভাবে তার কান্না পাচ্ছে। লুইস আবারো সেটাকে লক্ষ্য করে হাত নাড়ায়।
সেদিন রাতে ক্র্যান্ডালদের বাড়িতে আড্ডা দিয়ে ফেরার সময়ও তার খুব খারাপ লাগছিল। সেদিন রাতে সে আর ক্র্যান্ডালরা ক্র্যান্ডালদের কিচেনে বসে আড্ডা দেয়। শীতের কারণে পোর্চে বসা আর সম্ভব না।
জাড ঘর গরম করার মারলেক স্টোভের আঁচ খুব বাড়িয়ে দেন এবং ওরা সবাই সেটাকে ঘিরে বসে। জাড সেরাতে মিকমেক ইন্ডিয়ানদের গল্প বলেন, কিভাবে তারা দুইশত বছর আগে এখানে ব্রিটিশদের আস্তানা গড়ার স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ করে দেয়। সে সময় মিকমেকরা খুব ভয়ঙ্কর ছিল। এবং এখনো অনেকেই তাদের ভয়ঙ্কর মনে করে।
সবকিছু মিলিয়ে বিকেলটা খারাপ ছিল না। তবে শূন্য বাসার কথা ভেবে লুইসের কিছুই ভালো লাগছিল না।
সে যখন রাস্তার ওপর মচমচে বরফের আস্তর মাড়িয়ে বাসায় ফিরছিল, তাদের বাসার ফোন রিং হবার শব্দ শুনতে পায়। সে ছুটতে শুরু করে, সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে লিভিং রুম দৌড়ে পার হয় এবং ছোটার সময় তার গায়ে লেগে তাদের ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডটা ভূপাতিত হয়। আর মসৃণ লিনেলিয়াম বিছানো কিচেনের বাকি অংশটা সে বরফমাখা জুতো দিয়ে পিছলে পিছলে গিয়ে ফোনটা ছো মেরে তুলে নেয়।
“হ্যালো?”
“লুইস?” রাচেলের কন্ঠ। “আমরা পৌঁছে গেছি। পথে কোন ঝামেলা হয়নি।”
“গ্রেট!” বলে সে একটা চেয়ারে বসে পড়ে রাচেলের সাথে কথা বলার জন্য। সে ভাবে, ইস! তুমি যদি এখানে থাকতে।
অধ্যায় ২২
ক্র্যান্ডালদের বাসায় থ্যাঙ্কস গিভিং ডিনারটা বেশ ভালোই হয়। সেই পাঠ চুকিয়ে ভরপেটে লুইস যখন বাসায় ফিরে তখন তার বেশ ঘুম পাচ্ছিল। সে নিজের বেডরুমে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা উপভোগ করে শুয়ে পড়ে। ঘড়িতে তিনটার মতো বাজে, বাইরে তখনো শীতের পাতলা রোদ।
একটু ঘুমিয়ে নেই, ভেবে সে খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে। বেডরুমের টেলিফোন এক্সটেনশনটা বেজে উঠলে ওর ঘুম ভেঙে যায়। ততক্ষনে অন্ধকার নেমে এসেছে। সে বাড়ির চারদিকে বাতাসের শো শো শব্দ শুনতে পারছে। সে হাতড়ে ফোনটা খামচে ধরে কানের কাছে নেয়।
“হ্যালো,” সে বলে। তার ধারণা রাচেল তাকে আবারো থ্যাঙ্কস গিভিং- এর শুভেচ্ছা জানাতে সুদূর শিকাগো থেকে ফোন করেছে। রাচেল প্ৰথমে কথা বলবে, বলে ফোন এলির কাছে দিলে ও কথা বলবে, এরপর ফোন গেজের কাছে দিলে সে আবোল তাবোল কিছু শব্দ করবে। আর সে কিভাবে পারলো ফুটবল ম্যাচ মিস করে পুরো সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে….
তবে ফোনের ওপাশে রাচেল ছিল না, ছিল জাড ক্র্যান্ডাল। “লুইস? তোমার একটা ছোটখাট ঝামেলা হয়েছে।”
সে বিছানায় বসে চোখ ডলতে ডলতে বলল, “জাড, কী হয়েছে?”
“আমাদের উঠোনে একটা বিড়াল মরে পড়ে আছে,” জাড বললেন। “আমার ধারণা এটা তোমার মেয়ের বিড়াল।”
“চার্চ?” লুইস জিজ্ঞেস করে। হঠাৎ তার পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। “আপনি শিওর ওটা চার্চ?”
“না, আমি একশভাগ শিওর না,” জাড বললেন। “তবে দেখে তোমার মেয়ের বিড়ালই মনে হচ্ছে।”
“ওহ। ওহ শিট। আমি আসছি।”
“ঠিক আছে, লুইস।”
সে ফোন রেখে মিনিট খানেক সময় চুপচাপ বসে থাকে। তারপর সে বাথরুম ব্যবহার করে জুতো পড়ে নিচতলায় নেমে আসে।
হয়তো ওটা চার্চ না। জাড তো বললেন উনি শতভাগ নিশ্চিত না। বালের বিড়ালটাতো এখন নিচতলা থেকে ওপরতলাতেও যেতে চায় না, যদি না কেউ ওকে বয়ে নিয়ে যায়…তাহলে কেন বিড়ালটা মরার জন্যে ওই রাস্তাটা ক্রস করতে যাবে?
তবে তার মন বলছিল ওটা চার্চই…আর আজ যখন এলি লুইসের কাছে ওর বিড়ালের কথা জানতে চাইবে, সে কি উত্তর দেবে?
সে রাচেলকে কী বলেছিল তা মনে পড়ে গেল। আমি জানি যে যেকোন প্রাণী যেকোন মুহূর্তে মরে যেতে পারে। একজন ডাক্তার হিসেবে আমি জানি…যদি চার্চের এরকম খারাপ কিছু হয়, তাহলে সেই ব্যাপারটা তুমি নিজে এলিকে বোঝাবে তো?”
তার এক পোকার খেলার বন্ধুর কথা মনে আছে। সেই বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে সে কিভাবে নগ্ন মহিলা রোগিদের দেখে উত্তেজিত না হয়ে পারে? সে যেহেতু তার স্ত্রীকে দেখে উত্তেজিত হয়, তাহলে অন্য নগ্ন নারীদের দেখেও তো তার উত্তেজিত হবার কথা। লুইস তাকে বোঝাতে চেয়েছিল যে দুটো সম্পূর্ণ দুরকম। রোগি দেখার সময় রোগিকে সে যৌনসঙ্গি হিসেবে ভাবে না। সে হয়তো তার বুক দেখে, অথবা তার উরু বা তার যোনি, কিন্তু সেই রোগি তো তার সামনে রানি হেলেনের মত সেক্সি পোজ দিয়ে বসে থাকে না। এবং তার বাকি শরীর তো ঢাকাই থাকে। তাছাড়া সেখানে একজন নার্স উপস্থিত থাকে, যার অন্যতম কারণ হচ্ছে ডাক্তারের রেপুটেশন রক্ষা করা। কিন্তু তার বন্ধু তার কথা মানতে নারাজ। তার বন্ধুর মতে নারীর বুক তো নারীর বুকই, হয় লুইসের সারাদিন উত্তেজিত থাকার কথা আর নাহলে তার কখনই উত্তেজিত হবার কথা না। লুইস জবাবে শুধু বলেছিল যে নিজের বউয়ের বুক আর রোগির বুক এক না, আলাদা।
ঠিক যেমন তোমার পরিবার অন্য সবার চাইতে আলাদা, সে ভাবে। চার্চ মরতে পারে না কারণ যেভাবেই হোক, চার্চ তাদের পরিবারের বৃত্তের ভেতর ঢুকে গেছে।
কিছু মনে করো না, মাথা ঠান্ডা রাখো।
তবে চার্চের মৃত্যুর কথা ভেবে এলি যেভাবে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল তা ভেবে লুইসের পেটের ভেতর আবার পাক দিয়ে ওঠে।
বালের বিড়াল…কী দরকার ছিল আমাদের বিড়াল পালার? মরেই যখন যাবে এতো কসরত করে খাসি করার কি দরকার ছিল?
“চার্চ?” লুইস গলা উঁচু করে ডাকে কিন্তু কোন সাড়া পায় না। নিস্তব্ধতার মাঝে শুধু ফার্নেসের পয়সা পোড়ানোর মটমট শব্দ। চার্চ তার দিনের বেশির ভাগ সময় লিভিং রুমের সোফায় শুয়ে বসে কাটাতো, সেখানেও সে নেই। সে রুম গরম করার কোন রেডিয়েটরের ওপরেও রাজকীয় ভঙ্গিতে শুয়ে নেই। লুইস চার্চের খাবারের ডিশটা ঝাঁকিয়ে শব্দ করে, যেটার আওয়াজ চাৰ্চ শুনতে পেলে যে ছুটে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন বিড়াল দৌড়ে এলো না. আর হয়তো কখনই আসবে না।
গায়ে কোট চাপিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে কী মনে করে আবার ফিরে এলো। সে হাঁটু গেড়ে বসে সিঙ্কের নিচের কাপবোর্ডটা খোলে। সেখানে দুরকমের পলিথিন ব্যাগ ছিল, বাসার ময়লা জমানোর সাদা ছোট ব্যাগ আর বাইরে গার্বেজ ক্যানের জন্যে বড় কালো ব্যাগ। সে কালো ব্যাগগুলো থেকে একটা নিয়ে নেয়। বিচি ফেলার পর থেকে চার্চের ওজন বেশ বেড়ে গেছে।
পলিথিন ব্যাগটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে সে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।
সাড়ে পাঁচটার মত বাজে। গোধূলির শেষ আলোটাও মিলিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে বিষণ্ণতা বিরাজমান। গত সূর্যাস্তের স্মৃতি হিসেবে নদীর ওপারে কমলা আলোর আভা এখনো দেখা যাচ্ছে। রুট ১৫ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে তার গাল অবশ করে দিচ্ছে এবং তার নিশ্বাসের সাথে বের হাওয়া সাদা বাষ্প খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে কেঁপে ওঠে, তবে ঠান্ডার কারণে না। চারদিকের নির্জনতার অনুভূতি তাকে কাঁপিয়ে দেয়। অনুভূতিটা বেশ জোরালো আর ছোঁয়াচে। অজ্ঞাত জিনিসটা কোন উপমা দিয়েই প্রকাশ করা যাবে না। শুধু অস্পৃষ্ট জিনিসটা অনুভব করতে পেরেছে সে।
রাস্তার ওপাশে ডাফল কোটে মোড়া জাডকে দেখতে পায় সে। জাডের পশমের পাড় লাগানো হুডের ছায়ায় তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। নিজের জমাট বাধা উঠোনে দাঁড়ানো জাডকে মূর্তির মত লাগছে, যেন সন্ধ্যালোকের ছবিতে আরেকটি মৃত বস্তু।
লুইস রাস্তা পার হতে শুরু করলে জাড এগিয়ে এসে তাকে পিছিয়ে যেতে ইশারা করতে থাকে। জাড চিৎকার করে কিছু বলছে কিন্তু বাতাসের গর্জনে লুইস কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। লুইস পিছিয়ে যায় এবং উপলব্ধি করতে পারে হঠাৎই যেন বাতাসের গর্জন আরো জোরালো এবং ধারালো হয়ে উঠেছে। এর মুহূর্ত পরেই একটা হর্ন পো-পো করে উঠে এবং একটা মস্ত অরিঙ্কো ট্রাক গর্জন করতে করতে লুইসের এতো কাছে দিয়ে চলে যায় যে তার প্যান্ট এবং জ্যাকেটে বাতাসের ঝাপ্টা লাগে। আরেকটু হলেই সে ওই নরকের দূতের সামনে পড়ে যাচ্ছিল।
এবার সে রাস্তা পার হবার আগে রাস্তার দুদিকেই দেখে নেয়। সন্ধ্যালোকে শুধু ট্যাঙ্কারের টেইল লাইটগুলো দেখা যাচ্ছিল।
“আজ তো আরেকটু হলেই তোমাকে ট্রাকটা খেয়ে দিয়েছিল,” জাড বলেন। “আরেকটু সাবধান হও, লুইস।” এতো কাছ থেকেও লুইস জাডের চেহারা দেখতে পাচ্ছে না। তার অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হয় যে তার সামনের মানুষটা যে কেউ হতে পারে…যে কেউ।
“নরমা কোথায়?” লুইস জাডের পায়ের কাছে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা পশমের পোটলার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে।
“ও থ্যাঙ্কস গিভিং চার্চ সার্ভিস এ্যাটেন্ড করতে গেছে।” বাতাসে জাডের মাথার হুডটা নড়ে গেলে লুইস দেখে যে সেটা আসলেই জাড ক্র্যান্ডাল-তিনি ছাড়া আর কেই বা হতে পারতো? আজব…, “সব বান্ধবীরা এক হয়ে আড্ডা দেয়ার ফন্দি আর কী। রাতে খেয়ে আসবে,” জাড বলেন।
লুইস হাঁটু গেড়ে বসে, বিড়ালটাকে পরীক্ষা করার জন্যে। এটা যেন চাৰ্চ না হয়, সে গ্লাভস পড়া আঙুল দিয়ে বিড়ালটার ঘাড় তার দিকে ফেরাতে ফেরাতে ঐকান্তকতার সাথে কামনা করে। এটা যেন অন্য কারো বিড়াল হয়।
জাডের ধারণা যেন ভুল হয়।
কিন্তু এটা চার্চই। বিড়ালটার দেহ কোন রকম বিকৃত হয়নি বা গায়ে বড় রকমের কোন ক্ষতের চিহ্ন নেই; সে রুট ১৫তে চলাচলকারী কোন বড় ট্রাকের নিচে চাপা খায়নি (থ্যাঙ্কস গিভিং এর ছুটিতে ওই অরিংকো ট্রাকটা রাস্তায় করছেটা কী, সে বিক্ষিপ্তভাবে চিন্তা করে।)। চার্চের চোখগুলো আধা খোলা, সেগুলো সবুজ মার্বেলের মত চকচক করছে। একটা চিকন রক্তের ধারা ওর খোলা মুখ থেকে বের হয়ে এসেছে। রক্তের পরিমাণ বেশি না তবে তার বুকের কাছের সাদা ফুটকিটা রাঙ্গিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।
“তোমাদেরটা, লুইস?”
“হুম,
চার্চ,” সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সম্মতি জানায়।
সে প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলো যে সে চার্চকে ভালোবাসে, হয়তো এলির মত তীব্রভাবে না-তার নিজের মত করে। খোজা করার পর চার্চ বদলে গেছে, সে এখন তার মোটা দেহ নিয়ে হেলে দুলে হাটে। তার যাতায়াতের গণ্ডি এলির বিছানা, সোফা আর তার খাবারের ডিশ এবং কদাচিৎ ঘরের বাইরে। তবে লুইসের কাছে মৃত চার্চকে আগের চার্চের মত লাগছে। তার সুচারু দাঁত বিছানো রক্তাক্ত মুখটা হিংস্রভাবে দাঁত খিচিয়ে আছে। তার চোখেও প্রচন্ড ক্ষিপ্রতা। চার্চ যেন তার খোজা জীবনের অবসানের পরে তার পূর্বের ক্ষিপ্রতা ফিরে পেয়েছে।
“এটা চার্চ, কোন সন্দেহ নেই। এলিকে যে এই কথা কিভাবে বলবো আমার মাথায় আসছে না।”
হঠাৎ তার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। সে চার্চকে পেট সেমিট্রিতে কবর দিয়ে দেবে, কোন স্টুপিড স্মৃতিফলক ছাড়াই। আজ সে এলিকে এই ব্যাপারে কিছুই বলবে না, আর আগামীকাল এলি চার্চের কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে সে সারাদিন চার্চকে দেখেনি। এর পরের দিন সে ইঙ্গিত দেবে চার্চ হয়তো হারিয়ে গেছে। বিড়ালরা এরকম প্রায়ই করে। এলি কষ্ট পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই তবে চার্চের মৃত্যু সংবাদ থেকে অনেক কমই পাবে। আর রাচেল…আর এতে করে তাকে রাচেলের মৃত্যু বিষয়টা নিয়ে বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখিও হতে হবে না।
কাপুরুষ, তার মনের এক কোণে উচ্চারিত হতে থাকে।
হ্যাঁ…এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক নেই। তবে এই ঝামেলায় কে জড়ায়?
“এলি ওকে খুব ভালোবাসে, না?” জাড বলেন।
“হ্যাঁ,” লুইস অন্যমনস্কভাবে জবাব দেয়। সে লুইসের মাথাটা আবারো নাড়ায়। চার্চের দেহ শক্ত হয়ে যেতে শুরু করেছে, তবে সেই তুলনায় তার মাথাটা খুব সহজেই ঘোরানো যাচ্ছে। ভাঙা ঘাড়। এটা দেখে লুইস বুঝে নেয় কি ঘটেছে। চার্চ রাস্তা পেরোচ্ছিল-খোদা জানেন কী কারণে আর কোন ট্রাক তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলে। ধাক্কায় তার ঘাড় ভেঙে যায় অথবা শক্ত বরফে ছিটকে পড়ে…ঘটনাটা যেভাবেই ঘটুক, শেষ কথা চাৰ্চ মারা গেছে।
লুইস তার অনুমানের কথা জাডকে বলতে গেলে সে দেখে জাডের খেয়াল এদিকে নেই। তিনি দিগন্তে গোধূলির কমলা রেখার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মাথার হুড খানিকটা নেমে আসায় লুইস তার মুখখানা দেখতে পায়। তার চেহারায় দুশ্চিন্তা আর কঠোরতার ছাপ।
লুইস তার পকেট থেকে সাদা গার্বেজ পলিথিন ব্যাগটা বের করে শক্ত করে ধরে ভাজ খোলে, যাতে বাতাসের ঝাপ্টায় সেটা উড়ে চলে না যায়। পলিথিনটা বাতাসের ঝাপ্টার ফরফর শব্দ শুরু করলে জাড তার সম্বিত ফিরে পেয়ে বর্তমানে ফিরে আসেন।
এলি খুব ভালবাসে বিড়ালটাকে, বুঝতে পারছি।” জাড বললেন। এই মরা জিনিসটাকে এলি ভালোবাসে, কথাটা লুইসের কানে খুব অতিপ্রাকৃত মনে হয়। চারদিকের নির্জনতা, গোধূলির আধো অন্ধকার, মরা বেড়াল সবকিছু মিলিয়ে যেন একটা ভুতূড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
জমে যাওয়া বরফ থেকে সে চার্চের লেজ ধরে তুলতে চাইলে চার্চের শরীর ফরফর শব্দ করে ওঠে, কারণ চার্চের শরীর বরফের সাথে জমে লেগে গিয়েছে। পলিথিন ব্যাগটার মুখ খুলে সেটাতে চার্চকে ঢুকাতে গেলে সে টের পায় চার্চের ওজন অনেক বেড়ে গেছে, যেন মৃত্যু চার্চের শরীরে ভৌত পদার্থের মত জেঁকে বসেছে। ওহ খোদা, চার্চকে তো বালুর বস্তার মত মনে হচ্ছে।
জাড ব্যাগটার অন্য পাশে ধরলে লুইস চার্চকে সেটার ভেতর ভরে দেয় এবং ওজনদার মরা জিনিসটা হাত থেকে নামাতে পেরে সে বাঁচে।
“ওকে এখন কী করবে?” জাড জিজ্ঞেস করলেন।
“আজকে গ্যারেজে রাখব মনে হয়,” লুইস বলে। “কাল সকালে কবর দিবো।”
“পেট সেমিটারিতে?”
“মনে হয়,” লুইস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে।
“এলিকে বলবে?”
“আমার…আমার একটু ভাবা লাগবে…”
জাড কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন এবং এরপর মনে হলো তিনি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন। “এখানে দুই-এক মিনিট দাঁড়াও, লুইস।”
জাড আর কিছু না বলেই নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। তার মনে একবারও উদয় হলো না যে এই বিশ্রী রাতে লুইস হয়তো আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা চাইছে না। তিনি অবিচলভাবে হেঁটে গেলেন, যা তার বয়সি বৃদ্ধের জন্য অস্বাভাবিক কিছু না। আর লুইসেরও আসলে বলার মত কিছু ছিল না। সে তখন নিজের মধ্যে নেই। সে সন্তুষ্ট মনে জাডকে যেতে দেখে।
দরজা বন্ধ হবার ক্লিক শুনলে সে বাতাসে মুখ তুলে তাকায়। চার্চের লাশ ভরা ব্যাগটা বাতাসে ফরফর করছে।
সন্তুষ্ট।
হ্যা, ঠিক তাই। মেইনে আসার পর এই প্রথম তার মনে হলো সে তার নিজের জায়গায় আছে। এই শীতের রাতে দিনের আলোর শেষ রেখা মিলিয়ে যাবার আগে সে একাকী দাড়িয়ে আছে, মনে কষ্ট নিয়ে। তারপরও তার এক রকম অদ্ভুত উত্তেজনা বোধ হচ্ছে, যে রকমটা সে তার ছোটবেলার পর আর কখনো অনুভব করেনি।
এখানে কিছু ঘটতে যাচ্ছে বন্ধু…খুব অদ্ভুত কিছু।
সে ওপরের দিকে তাকিয়ে ক্রমশ কালো হতে থাকা আকাশে মিটমিটে তারা দেখতে পায়।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, তা সে বলতে পারবে না। তবে সেটা মিনিট আর সেকেন্ডের কাটায় খুব বেশি হবে না হয়তো। এরপর জাডের পোর্চে একটা আলোর উৎস ঝাঁকি দিয়ে জ্বলে উঠে। লুইস দেখতে পায় আলোর উৎসের পেছনে জাড। তিনি তার এক হাতে একটি চার ব্যাটারির ফ্লাশ লাইট ধরে আছেন। লুইসের কিছুক্ষণের জন্যে মনে হলো জাডের আরেক হাতে একটি ইংরেজি X… পরক্ষণেই সে বুঝতে পারলো সেটা আসলে আড়াআড়িভাবে ধরা একটা মাটি খোঁড়ার কুড়াল আর একটা বেলচা।
তিনি বেলচাটা লুইসের হাতে দিলে সে তার খালি হাতে সেটা ধরে।
“জাড, আপনি কী করতে চাচ্ছেন খোলাসা করুন তো। এই রাতের বেলা ওকে কবর দেয়ার তো প্রয়োজন নেই।”
“আছে। এবং আজ রাতেই।” জাডের চেহারা ফ্লাশলাইটের উজ্বল বৃত্তের পেছনে হারিয়ে গেছে।
“জাড, চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। রাত নেমে গেছে। আর যা ঠান্ডা—”
“আরে চলো,” জাড বলেন। “ঝামেলাটা আজই শেষ করে ফেলি।” সে মাথা নেড়ে তার যুক্তিগুলো আবারো বলতে চাইলে সেসব তার নিজের আছেই অর্থহীন বলে মনে হয়।
“কালকে করি। এখন তো কিছু দেখতেই—”
“তোমার মেয়ে বিড়ালটাকে ভালোবাসে?”
“হ্যাঁ, তবে…”
জাডের কোমল কণ্ঠে অযৌক্তিক কথাগুলোকে কোন এক অদ্ভুত কারণে খুব যৌক্তিক মনে হতে থাকে : “তুমি তোমার মেয়েকে ভালোবাসো?”
“অবশ্যই বাসি, ও আমার মেয়ে-”
“তাহলে চলো।”
লুইস গেল।
সে রাতে পেট সেমিটারিতে যাওয়ার পথে লুইস আরো বেশ কয়েকবার জাডের সাথে কথা বলতে চায়, কিন্তু জাড কোন উত্তর দেন না। লুইস হাল ছেড়ে দেয়। আর সেই অদ্ভুত ভালোলাগা অনুভূতিটা এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও বিরাজমান থাকে। সবকিছু মিলিয়েই যেন এই ভালোলাগাটা। এক হাতে চার্চের ব্যাগ আর আরেক হাতে বেলচা ধরে থাকতে তার পেশিগুলোতে যে ব্যথা হচ্ছে, সেটাও এই ভালোলাগার একটা অংশ। মারাত্নক ঠান্ডা বাতাস লুইসের অনাবৃত গায়ের চামড়া অবশ করে দিচ্ছে; সেটিও ওই ভালোলাগারই একটা অংশ। অনুভূতিটা চারদিকের গাছপালায় বাতাসের সাথে ঘুরপাক খাচ্ছে। জাডের হাতের দুলতে থাকা ফ্লাশ লাইটের আলোটাও এর একটি অংশ। লুইস একটা অনুপ্রবেশকারী, অনস্বীকার্য, চুম্বকীয় কিন্তু অতি গোপন উপস্থিতির টের পাচ্ছে। গুপ্ত, কিন্তু খুব অন্ধকার কিছু।
জঙ্গলের ভেতরে তেমন বরফ নেই। তাদের ছায়ারা তাদের অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। তারা পেট সেমিটারিতে চলে এসেছে।
“এখানে বিশ্রাম নাও একটু,” জাড বলেলেন। লুইস তার হাতের ব্যাগটা নিচে রাখে। কপালের ঘাম মুছলো সে। এখানে বিশ্রাম নেবো? কিন্তু তারা তো পেট সেমিটারিতে চলেই এসেছে। জাড পাতলা বরফের ওপর বসে নিজের দুহাতের ভেতর মুখ গুজে দিলেন। তার হাতের ফ্লাশ লাইটের আলোকচ্ছটার লক্ষ্যহীন নড়াচড়ায় সে সেমিট্রির স্মৃতিফলকগুলো দেখতে পাচ্ছে।
“জাড, আপনি ঠিক আছেন?”
“হ্যাঁ। একটু হাপিয়ে গেছি আর কি।”
লুইস তার পাশে বসে হাফ ডজন বারের মত লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়। “জানেন?,” সে বলে, “আমার এতো ভালো লাগছে যে মনে হচ্ছে গত পাঁচ-ছয় বছরেরও কখনো আমার এতো ভালো লাগেনি। নিজের মেয়ের বিড়ালকে কবর দিতে এসে এরকম কথা বলছি শুনে হয়তো আমাকে পাগল মনে হবে, তবে এটাই সত্য। জাড, আমার বেশ ভালো লাগছে।”
জাড নিজেও কিছুক্ষণ লম্বা লম্বা শ্বাস নিলেন। “হুম, জানি,” তিনি বললেন। “কখনো কখনো এরকম হয়। তোমার কখন ভালো লাগবে তা তো আর তোমার হাতে নেই, বা অন্য কারো হাতেও নেই। আর এর পেছনে এই জায়গাটার হাত আছে, তবে তুমি হয়তো তা বিশ্বাস করতে চাইবে না। যেমন হেরোইন আসক্তদের কিন্তু হেরোইন নিতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু তলে তলে কিন্তু আসলে সেটা তার মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তাদের দেহেও বিষক্রিয়া হচ্ছে এবং তাদের চিন্তা করার শক্তিতেও। এই জায়গাটাও সেরকম, আর সাবধান লুইস, এই কথাটা কখনো ভুলবে না। আমি প্রার্থনা করি যে আমি ঠিক কাজটাই করছি, কিন্তু তা আসলেই আমি নিশ্চিত হয়ে জানি না। আমার বুদ্ধি মাঝে মাঝে কাজ করে না, হয়তো ভীমরতি হয়েছে।”
“আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“এই জায়গাটার এক রকমের শক্তি আছে। এখানে এতো বেশি না সেই শক্তিটা, তবে আমরা যেখানে যাচ্ছি…”
“জাড-”
“চলো,” জাড বলেই দাড়িয়ে গেলেন। তার ফ্লাশলাইটের আলোকচ্ছটা সেই মরা গাছের ধ্বংসস্তূপের ওপর গিয়ে পড়েছে। জাড সেদিকেই হেঁটে যাচ্ছেন। লুইসের হঠাৎ সেই স্লিপ ওয়াকিং’ এর কথা মনে পড়ে যায়। স্বপ্নে পাস্কো যেনো তাকে কী বলেছিল?
ওপাশে কখনো যাবে না, তোমার যতোই ইচ্ছে হোক না কেন। এই দেয়াল তৈরি করা হয়েছে অতিক্রম না করার জন্যে।
তবে আজ রাতে সেই সতর্কবার্তাটি অনেক অনেক বছর আগের কিছু বলে মনে হচ্ছে লুইসের কাছে। লুইসের খুব ভালো লাগছে এবং প্রাণবন্ত বোধ হচ্ছে। সে এই অবস্থায় যে কোন কিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্যে প্রস্তুত। তার মনে হচ্ছে এটাও হয়তো একটি স্বপ্ন
এরপর জাড তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। জাডের মাথার হুডটাকে মনে হচ্ছে সেটা একটুকরো অন্ধকার জড়িয়ে আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে লুইসের মনে হয় পাস্কোই তার সামনে দাড়িয়ে আছে। গায়ে বরফ শীতল পানির ঝাপ্টার মত তার পূর্বের সেই ভয় ফিরে আসে।
“জাড,” সে বলে, “আমরা তো স্তুপটার ওপর উঠতে পারবো না। দেখা যাবে দুজনেই পা ভেঙেছি আর এরপর বাড়ি ফিরতে না পেরে ঠান্ডায় জমে মারা যাবো।”
“শুধু আমাকে অনুসরণ করো,” জাড বললেন। “আমাকে অনুসরণ করো আর নিচের দিকে একদম তাকাবে না, লুইস। আগুপিছু করবে না, নিচেও তাকাবে না। আমি রাস্তা চিনি। তবে আমাদের খুব দ্রুত যেতে হবে।”
লুইসের মনে হতে থাকে সে স্বপ্ন দেখছে। সে হয়তো বিকেলের ঘুম থেকে এখনো জাগেইনি। আমি জেগে থাকলে নিশ্চয়ই ওই মরা ডালের স্তূপটায় চড়তে যাওয়ার মতো পাগলামি করতাম না। এটা তো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অংক পরীক্ষা দেয়ার মতো। আমি অবশ্যই স্বপ্ন দেখছি।
জাড স্তুপটার মাঝখান থেকে একটু বামে সরে গেলেন। তার ফ্লাশের তীব্র আলোর বৃত্ত মরা ডাল(হাড়)গুলোর ওপর পড়ছে। জাড একটুও না থেমে, সে সঠিক জায়গায় আছে কি না সে ব্যাপারে কোন রকম নিশ্চিত না হয়ে হঠাৎ করেই ধ্বংসস্তুপটার ওপর উঠতে শুরু করলেন। তিনি কোন রকম ঝুঁকে উঠতে শুরু করেন নি, যেমনটা কেউ কোন ঢালু জায়গায় উঠতে গেলে করে। তিনি স্তূপটার গায়ে এমনভাবে উঠেতে শুরু করলেন যেন তিনি কোন সাধারণ সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। তিনি এমনভাবে হাঁটছেন যেন তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন তার পরের পা ঠিক কোথায় ফেলতে হবে।
লুইস ঠিক একইভাবে তাকে অনুসরন করে।
সে কোথায় পা ফেলবে তা দেখার জন্যে নিচে তাকায় না। তার মনে হতে থাকে সে না চাইলে এই স্তূপটা কোনভাবেই তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ মদ খেয়ে চুর হয়ে নিশ্চিন্তে গাড়ি চালাচ্ছে, কারণ সে জানে তার কাছে সেইন্ট লুইসের মাদুলি আছে, এটা ঠিক ওইরকম একটা নির্বোধ ভাবনা।
কিন্তু এটা কাজ করছে।
ডাল ভাঙার কোন কর্কশ মটমট শব্দ হচ্ছে না, কোন ফাঁকা জায়গায় পা ঢুকে যাচ্ছে না। বেকায়দায় পা পড়লে শুকনো ডালের ধারালো খোঁচায় পায়ের বারোটা বেজে যাবে। তার লোফার জুতো এরকম জায়গায় ওঠার জন্যে মোটেও উপযুক্ত নয়, তবুও মরা ডালে জন্মানো অনেক আগের শুকনো শ্যাওলাতেও তার পা পিছলে যাচ্ছে না। মাতাল হাওয়া তাদের চারপাশের দেবদারু গাছের ডালপালার সহযোগিতায় গান গেয়ে যাচ্ছে।
সে এই দেখলো জাড স্তুপটার একদম চূড়ায় দাড়িয়ে আছেন, আর তার পরেই দেখে তিনি নিচে নামতে শুরু করেছেন। প্রথমে তার পা অদৃশ্য হয়, তার পর হাতগুলো, এর পর কোমর। জাডের হাতের ফ্লাশের আলো কখনো মরা ডালপালাগুলোর ওপর পড়ছে, কখনো এই প্রতিবন্ধকের ওপাশের গাছের ডালের ওপর গিয়ে পড়ছে। এটা আসলে একটা প্রতিবন্ধকই, অন্য কিছু ভান করে লাভ কি?
লুইস নিজেও একদম চূড়ায় পৌঁছে কয়েক মুহূর্তের জন্যে দাড়িয়ে যায়। তার ডান পা আছে একটা পঁয়ত্রিশ ডিগ্রী কোণে পড়ে থাকা পুরনো গাছের গুড়ির ওপর আর বাম পা আছে নরম কিছুর ওপর পুরনো দেবদারু গাছের ডালের স্তূপ? সে দেখার জন্যে নিচে তাকায় না। শুধু ডান হাতের চার্চের লাশের ব্যাগটার সাথে বাম হাতের তুলনামূলক হালকা বেলচাটা অদল বদল করে নেয়। সে মুখ তুলে তাকালে বাতাসের অবিরাম প্রবাহ তার মুখ ঘেসে ঘেসে যেতে থাকে। বাতাসের প্রবাহটা প্রচন্ড ঠান্ডা, পরিস্কার… আর অবিরাম।
সে খুব স্বাভাবিকভাবে হাঁটছে। একবার মানুষের কব্জির মত মোটা একটা ডাল তার পায়ের নিচে কর্কশ শব্দে ভেঙে যায়, কিন্তু তার মনে কোন দুশ্চিন্তা হয় না-তার হড়কে যাওয়া পা তিন-চার ইঞ্চি নিচেই আরেকটা মোটা ডালের ওপর গিয়ে থামে। কিন্তু লুইস একদমই টাল হারায় না। সে ভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চারদিকে ছুটতে থাকা বুলেটের মধ্যে পরিখার ওপর দিয়ে সেনারা এভাবেই হয়তো মার্চ করে যেত। জিনিসটা পাগলামি মনে হলেও খুব উত্তেজক।
নিজেও স্তুপটা থেকে নামতে শুরু করে সে, জাডের ফ্লাশ লাইটের উজ্জ্বল বৃত্তটি তাক করে। জাড সেখানে তার জন্যে দাড়িয়ে আছে। এরপর সে নিচে পৌঁছে যায় আর প্রবল উত্তেজনা তার ভেতরে কয়লার মধ্যে পড়া দাহ্য তেলের মত জ্বলে উঠে।
“চলে এসেছি!” সে চিৎকার করে। সে বেলচাটা নিচে রেখে জাডের কাঁধ চাপড়ে দেয়। তার মনে পড়ে সে ছোটবেলায় একবার জাহাজের মাস্তুলের মত দুলতে থাকা একটা লম্বা আপেল গাছের চূড়ায় উঠেছিল। সে এরপরে গত বিশ বছর যাবত কখনই এতো প্রানবন্ত অনুভব করেনি। “জাড, আমরা চলে এসেছি!”
“তুমি কী ভেবেছিলে? আমরা আসতে পারবো না?”
লুইস কিছু বলার জন্যে মুখ খোলে শুধু আসতে পারবো না? আমি ভেবেছিলাম এখানেই আজ আমরা পটল তুলবো!-কিন্তু সে তার মুখ বন্ধ করে ফেলে। জাড স্তুপটায় ওঠার পর থেকে সে কোন প্রশ্ন করেনি। আর এখন সে ফিরে যাওয়া নিয়েও কোন দুশ্চিন্তা করছে না।
“ঠিক তা না,” লুইস বলে।
“চলো এগোই। আরো বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। তিন মাইলের মত।”
তারা হাঁটে। বাস্তবিকই পথটা চলছে তো চলছেই। কিছু কিছু জায়গায় মনে হচ্ছে পথটা বেশ চওড়া, যদিও চলন্ত টর্চের আলোয় ভালো করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না; লুইসের মনে হচ্ছে গাছেরা তাদের চলার জন্যে পাশে চেপে জায়গা করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে লুইস ওপরে তাকালে গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়া তারাদের দেখতে পায়। একবার তাদের পথের সামনে কিছু নড়ে উঠে। সেখানে লাইট ফেললে শুধু দুটো সবুজ চোখে আলোর প্রতিফলন দেখা যায়, এবং পরমুহূর্তেই সেটা গায়েব হয়ে যায়।
মাঝে মাঝে পথটা এতো সরু হয়ে পড়ে যে লুইসের কোটে ঝোঁপঝাঁড়ের শুকনো আঙুলগুলো খোঁচা দিতে থাকে। সে তার হাতের ব্যাগ আর বেলচাটা বার বার অদল-বদল করে কিন্তু তার দু কাঁধে এখন টনটনে ব্যথা করছে। তার হাঁটা একটা ছন্দের মধ্যে পড়ে গেছে, যেনো তাকে বশ করা হয়েছে। জায়গাটার শক্তি আছে, ঠিক, এবং সে তা অনুভব করতে পারছে। হাইস্কুলের শেষ বর্ষের কথা মনে পড়ে যায় তার। একবার সে আর তার বান্ধবী এবং আরো কিছু কাপল মিলে গ্রামের দিকে বেড়াতে গিয়েছিল। তারা চলতে চলতে একটা পাওয়ার স্টেশনের পাশে একটা রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে হাজির হয়। যদিও তাদের পরিকল্পনা ছিল সেখানে কিছু সময় কাটানো কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই তার বান্ধবী বলে তার ফিলিং করা দাঁতগুলোতে ব্যথা হচ্ছে, তাই সে বাসায় যেতে চায়। কিংবা সেখানে না থেকে অন্তত অন্য কোথাও যেতে চায়। জায়গাটা থেকে চলে যেতে পেরে লুইসও যে খুশি হয়নি তা নয়। পাওয়ার স্টেশনের চারদিকের পরিবেশ তাকে নার্ভাস এবং একই সাথে সতর্ক করে দিচ্ছিল। এই জায়গার অনুভূতিটাও অনেকটা তেমন, কিন্তু আরো জোরালো। জোরালো কিন্তু একদমই অপ্রীতিকর না। এটা-
জাড একটা ঢালু জায়গার সামনে থেমে গেলেন। লুইস তার গায়ের ওপর গিয়ে ধাক্কা খায়।
জাড তার দিকে ঘুরলেন। “আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রায় চলে এসেছি,” তিনি শান্ত গলায় বললেন। “সামনের জায়গাটাও ওই সুপটার মত-স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে হবে। আমাকে অনুসরণ করো আর নিচে তাকাবে না। তুমি টের পাচ্ছো আমরা যে পাহাড়ের নিচের দিকে নামছি?”
“হ্যাঁ, পাচ্ছি।”
এই জলাভূমির মত জায়গাটাকে মিকমেকরা ঈশ্বরের জলা বলতো। যেসব চামড়া ব্যবসায়িরা এর ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতো তারা এটাকে বলতো মড়ার জলা, আর তাদের মধ্যে বেশির ভাগ লোকই এখান থেকে বেরুবার পর আর জীবনেও এই পথ মাড়ায়নি।
“এখানে কি চোরাবালি আছে?”
“আছে তো বটেই; অভাব নেই! আমরা এটাকে সিলিকা স্যান্ড বলতাম। তবে হয়তো আরো ভালো কোন নাম আছে।”
জাড তার দিকে তাকায়, এবং মুহূর্তের জন্য লুইসের মনে হয় সে জাডের
চোখে উজ্জ্বল কিছুর প্রতিবিম্ব দেখতে পায় এবং জাডের চেহারা শক্ত হয়ে যায়।
জাড তার ফ্লাশলাইটটা অন্যদিকে সরায় এবং তখন জাডের চেহারার শক্ত ভাবটা চলে যায়।
“এই পথে অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখা যায় লুইস। এখানকার বাতাস ভারি… তুলনামূলক ইলেকট্রিক্যাল…বা কিছু একটা।”
লুইস চমকে ওঠে।
“কী হয়েছে?” জাড জিজ্ঞেস করেন।
“কিছু না,” লুইস সেই পাওয়ার প্লান্টের রাতের কথা ভাবতে ভাবতে বলে।
“তোমার সেইন্ট এলমোর আগুন চোখে পড়তে পারে, যেটাকে নাবিকরা ফু-লাইট বলতো। এটা অদ্ভুত অদ্ভুত আকার আকৃতি তৈরি করে, কিন্তু এটা আসলে ইলেকট্রিক্যাল চার্জের খেলা ছাড়া কিছুই না। যদি এরকম কোন অদ্ভুত কিছু তোমার চোখে পড়লে ভয় লাগে, তাহলে অন্যদিকে তাকাবে। তুমি হয়তো কিছু শব্দ শুনতে পাবে, মানুষের গলার মত। কিন্তু ওসব কিছু না। ওগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাঁসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।”
“লুন হাঁস?” লুইস অবিশ্বাসের কন্ঠে বলে। “তাও বছরের এই সময়ে, এই ঠান্ডার মধ্যে?”
“ও হ্যাঁ,” জাড এতো নরমভাবে বললেন, লুইস তার মনের কথা কিছুই আচ করতে পারে না। তার বুড়ো লোকটার চেহারাটা দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, যদি তা দেখে কিছু বুঝতে পারে।
“জাড, আমরা আসলে যাচ্ছিটা কোথায়? পেট সেমিটারি পেরিয়ে কোন জঙ্গলে যাচ্ছি? আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না।”
“
“সেখানে গিয়ে আমি তোমাকে বলবো,” জাড ঘুরে দাঁড়ালেন। “ঘন ঘাসের গুচ্ছগুলোর ওপর দেখে দেখে পা ফেলো।”
তারা আবার হাঁটতে শুরু করে। জলার মধ্যে তারা এক উঁচু শুকনো থেকে অন্য শুকনো জায়গায় পা দিয়ে সাবধানে হেঁটে যাচ্ছে। লুইস এবারো নিচে তাকাচ্ছে না। কোন একভাবে তার পা সঠিক জায়গাটাই খুঁজে নিচ্ছে। সে মাত্র একবার পা পিছলেছে, এবং তাতে তার পায়ের নিচের অংশ পাতলা বরফের আবরণ ভেদ করে বরফ শীতল পানিতে ঢুকে যায়। সে পা টেনে বের করে জাডের লাইটের পেছন পেছন অনুসরণ করতে থাকে। জঙ্গলের ভেতর ভেসে বেড়ানো ফ্লাশ লাইটের আলোতে লুইসের ছোটবেলার পড়া জলদস্যুদের গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। বদ লোকেরা চাঁদের আধারে সোনার মোহরের বাক্স পুতে ফেলতে যাচ্ছে…আর অবশ্যই তাদের মধ্যে একজনের পরিনতি হবে সেই বাক্সের সাথেই মাটির তলে, বুকে একটা বুলেট নিয়ে। কারণ জলদস্যুরা বিশ্বাস করে তাদের মৃত সাথী তাদের সম্পদকে পাহারা দেবে।
যদিও আমরা কোন মোহর পুঁততে আসিনি, এসেছি আমার মেয়ের মরা বেড়ালকে পুঁততে।
তার প্রচন্ড হাসি পায় কিন্তু সে তা কষ্ট করে চেপে রাখে।
সে কোন মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পায়নি, অথবা কোন সেইন্ট এলমোস ফায়ারও দেখতে পায়নি। হাফ ডজনবার ঘন ঘাসের গুচ্ছে পা ফেলার পর নিচে তাকিয়ে দেখতে পায় তার পায়ের পাতা থেকে উরু পর্যন্ত মসৃণ, ঘোলা কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে সে পৃথিবীর সবচাইতে পাতলা বরফের ওপর দিয়ে হেটে চলেছে।
লুইস শপথ করে বলতে পারে, এখানকার বাতাসে একটা হালকা আলোর আভা আছে, আর বাতাসটা তুলনামূলক উষ্ণ। জাড কাঁধে কুড়ালটা নিয়ে তার সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছেন। সেটা দেখে লুইসের আবারো গুপ্তধন লুকিয়ে রাখতে যাওয়ার মত একটা ভ্রম হয়।
তার মধ্যে এখনো উত্তেজনাটা কাজ করছে আর সে হঠাৎ ভাবে রাচেল হয়তো তাকে বার বার ফোনে চেষ্টা করছে আর ফোনটা বার বার বেরসিকের মত বেজেই যাচ্ছে। যদি-
সে আবারো প্রায় জাডের ওপর গিয়ে পড়েছিল। বৃদ্ধ রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেছেন। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তার এক পাশে তাকিয়ে আছেন। তার মুখ শক্ত হয়ে গেছে।
“জাড়, কী হয়ে-’ “স্!”
লুইস চুপ করে চারদিকে তাকাতে থাকে। এখানে ভূপৃষ্ঠের ওপরের কুয়াশা বেশ পাতলা, তবে এখনো সে তার জুতো দেখতে পাচ্ছে না। এরপর সে ঝোঁপঝাঁড়ের নড়াচড়া আর ডাল ভাঙার শব্দ শুনতে পায়। ওখানে কিছু নড়ছে-বড় কিছু।
সে জাডকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল এটা মুজ হরিণ কি না, (যদিও তার মনে প্রথমে আশঙ্কা ছিল ভালুক), কিন্তু সে থেমে যায়। এখানে শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে যায়, জাড বলেছিলেন।
জাডের দেখাদেখি আপনা থেকেই তার মাথা সেদিকে ঘুরে যায়। শব্দটা প্রথমে মনে হয়েছিল বেশ দূরে, তার পরে খুব কাছে; জিনিসটা দূরে সরে যাচ্ছে আবার খুব বিপজ্জনকভাবে কাছে চলে আসছে। লুইস টের পায় তার কপালের ঘাম গড়াতে গড়াতে গালে এসে পড়ছে। সে চার্চের ব্যাগটা হাত বদল করে। তার হাত ঘেমে গেছে, আর ঘামে পিচ্ছিল হাত থেকে পলিথিনের ব্যাগটা পিছলে যেতে চাচ্ছে। এখন ওই জিনিসটাকে এতো কাছে মনে হচ্ছে, যে লুইস ভাবে এখনি বুঝি সে সেটা দেখতে পাবে।
এখন সে আর ভালুকের কথা ভাবছে না।
সে যে কিসের কথা ভাবছে নিজেও জানে না।
এর পরেই জিনিসটা সরে যায় এবং একদম উধাও হয়ে যায়।
জাডকে জিজ্ঞেস করতে আবার মুখ খুলে সে। ওটা কী ছিল? কথাটা যখন প্রায় তার কন্ঠে চলে এসেছে সে আবারো থামতে বাধ্য হলো। আঁধারের ভেতর থেকে একটা খুনখুনে উন্মত্ত হাসি চারদিক বিদীর্ণ করে দেয়। আত্মা কাঁপানো অট্টহাসির শব্দ ওঠা নামা করছে চক্রাকারে। লুইসের মনে হয় তার শরীরের প্রতিটি জয়েন্ট জমে গেছে আর তার ওজনও কয়েক গুন বেড়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে সে যদি এখন পালানোর জন্যে দৌড়ায় তাহলে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিচের কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাবে।
হাসিটা বাড়তে থাকে, এরপর একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে সেটা খিক-খিক হাসিতে পরিণত হয়; পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে ভঙ্গুর পাথরের টুকরো পড়তে থাকলে যেমন আওয়াজ হয় অনেকটা সেরকম আওয়াজে। হাসির শব্দটা বাড়তে বাড়তে চিৎকারের মত শোনা যায়। এরপর সেটা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং মনে হয় কেউ কাঁদছে। আর এরপরেই সেটা একদম থেমে যায়।
আশেপাশে কোন এক জায়গায় পানি পড়ার টপটপ শব্দ আর চারদিকে বাতাসের গর্জন ছাড়া কোন শব্দ নেই। হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে জায়গাটা।
লুইসের সারা গা কাঁপতে থাকে। তার গায়ের পেশিগুলো, বিশেষ করে তলপেটের পেশি-শিরশির করতে থাকে। শরীরের পেশিগুলো আক্ষরিক অর্থেই কাঁপছে। তার মুখ শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। কিন্তু এতো কিছুর পরও অদ্ভুতভাবে তার সেই উত্তেজনাটা রয়েই গেছে।
“খোদা! এটা কী ছিল?” সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে।
জাড় তার দিকে ঘুরে তাকালে আবছা আলোয় তাকে দেখে লুইসের মনে হয় তার বয়স বেড়ে একশো বিশ হয়ে গেছে। তার চোখের সেই উজ্জ্বলতাটা আর নেই। তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ আর চোখে পরিস্কার আতঙ্ক। কিন্তু তিনি যখন কথা বললেন তার কন্ঠ বেশ স্বাভাবিক শোনালো। “কোন লুন হাঁস হবে,” তিনি বললেন। “চলো, আমরা প্রায় চলে এসেছি।”
তারা চলতে থাকে। এক মুহূর্তে লুইসের মনে হয় তারা একটা খোলা জায়গায় চলে এসেছে। চারদিকের বাতাসের সেই হালকা আভাটা একদম মিয়মাণ হয়ে এসেছে। তার পায়ের নিচে বরফে জমা শক্ত ছোট ছোট ঘাস। সেগুলো প্রতি পদক্ষেপে কাচের মত ভেঙে যাচ্ছে। তার পরেই তারা আবার
ঘন গাছের জঙ্গলে প্রবেশ করে। সে দেবদারু গাছের সুগন্ধ পাচ্ছে আর পায়ের নিচে পাইনের সুচারু পাতার অস্তিত্বও টের পাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে ডাল পালার খোঁচা বা ঘষা খাচ্ছে।
লুইস তার দিক এবং সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তারপরও সে বুঝতে পারে যে কিছুক্ষণ পরেই জাড থেমে ওর দিকে ফেরেন।
“এখান থেকে পাথরে কাটা সিঁড়ি,” জাড বললেন। “বেয়াল্লিশ অথবা চুয়াল্লিশটা ধাপ, আমার ঠিক মনে নেই। শ্রেফ আমাকে অনুসরণ করো। এটার ওপরে উঠলেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব।”
পাথরের ধাপগুলো বেশ চওড়া। তবে তার ওপরে আলগা মাটির আস্তর খসে খসে পড়তে থাকে, যা তাকে নার্ভাস করে দিচ্ছে।
বারো.. তেরো…চোদ্দ
এখানকার বরফ শীতল বাতাস তার গালে সুইয়ের মত বিধছে। আমরা কি গাছের মাথার চাইতেও উচুতে উঠে এসেছি? সে ভাবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে অসংখ্য তারা দেখতে পায়, আঁধার রাতে সেগুলো ঠান্ডা বাতির মত মিটমিট করছে। তার জীবনে আগে কখনো আকাশের তারাদের দেখে নিজেকে এতো ছোট, এতো নগন্য, এতো অর্থহীন মনে হয়নি। সে নিজেকে সেই প্রাচীন প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে-ওখানে কি কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব আছে?-আর প্রশ্নটা তার মনে ভাবনার উদ্রেক না ঘটিয়ে একটা বিশ্রী শীতল অনুভূতির জন্ম দেয়, যেন সে নিজেকে জিজ্ঞস করেছে যে, কিলবিল করতে থাকা পোকা খেতে তার কেমন লাগবে।
ছাব্বিশ…সাতাশ… আঠাশ
এসব খনন করেছেই বা কারা? ইন্ডিয়ানরা? মিকমেকরা? তারা কি খননের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে জানতো? জাডকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। এসব চিন্তা করতে করতে তার হঠাৎ করেই একটু আগের সেই ছোটাছুটি করতে থাকা জিনিসটার কথা মনে পড়ে। তার এক পা হোঁচট খেলে সে পাশের খসখসে পাথুরে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নেয়।
“তুমি ঠিক আছো?” জাড মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করেন।
“ঠিক আছি,” সে জবাব দেয়, কিন্তু সে হাঁপিয়ে গেছে আর চার্চের ওজনে তার হাতের পেশি টনটন করছে।
বেয়াল্লিশ…তেতাল্লিশ… চুয়াল্লিশ
“পয়তাল্লিশ,” জাড বললেন। “একদমই মনে করতে পারছিলাম না। গত বারো বছরে একবারো আসা হয়নি এখানে এবং মনে হয় না আর কখনো আসা হবে। নাও… হাত ধরো।”
তিনি লুইসের হাত ধরে টেনে তাকে শেষ ধাপটায় উঠতে সাহায্য করলেন।
“চলে এসেছি,” জাড বললেন।
লুইস চারদিকে তাকিয়ে দেখে। সে তারার আলোয় মোটামোটি ভালোই দেখতে পাচ্ছে। জায়গাটা পাথুরে আর চারদিকে প্রচুর ছোট ছোট পাথর বিছানো। এই ঢালু পাথুরে প্লেটটা ভূমির বুক থেকে জিভের মত বের হয়ে আছে। অন্যদিকে তাকিয়ে সে তাদের পেছনে ফেলে আসা জঙ্গলের গাছগুলোর মাথা দেখতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা কোন অদ্ভূত পাহাড়ের সমতল চূড়ায় উঠে এসেছে। এই এলাকায় এরকম প্রাকৃতিক অস্বাভাবিকতা খুব একটা দেখা যায় না। এরিজোনা বা নিউ মেক্সিকোতে হয়তো প্রচুর দেখা যায় এরকম জায়গা। আর অদ্ভুতভাবেই এই পাহাড় চূড়াটা-বা ছোট পর্বতের চূড়াটা বা যাই বলি না কেন-একদমই ছোলা। মানে কোন গাছপালা নেই। সূর্যের আলোয় এখানে বরফ জমতে পারেনি। জাডের দিকে ফিরলে সে দেখতে পায় শুকনো ঘাসের মাথাগুলো ঠান্ডা বাতাসে দুলছে। ঠান্ডা বাতাস তার গালেও চুমু খেয়ে খেয়ে যাচ্ছে। সামনে ভূমি আরো উঁচু এবং সেখানে গাছপালাও আছে। তার মনে হচ্ছে এই সমতল জায়গাটা ইন্ডিয়ানরা যন্ত্রপাতির সাহায্যে খোদাই করেছে।
“চলো,” জাড তাকে ডেকে পচিশ গজের মত এগিয়ে নিয়ে গেলেন, গাছে ঢাকা উঁচু জায়গাটার দিকে। এখানে বাতাসের বেগ বেশ জোরালো। লুইস গাছগুলোর নিচে কিছু অন্ধকার আকৃতি দেখতে পেলো। এই দেবদারু গাছগুলোর মত বয়স্ক আর বিরাট দেবদারু গাছ সে তার জীবনে দেখেনি। এই উঁচু, নির্জন জায়গাটার বৈশিষ্ট্য শূন্যতা, তবে এখানকার শূন্যতাটা যেন কাঁপছে।
সেই অন্ধকার আকৃতিগুলো এক একটা শিলাস্তম্ভ।
“মিকমেকরা এই পাহাড়ের চূড়া কেটে এই জায়গাটা বানিয়েছে,” জাড বললেন। “মায়ানরা কিভাবে তাদের পিরামিডগুলো বানিয়েছে সেটা যেমন কেউ জানে না, এটিও মিকমেকরা কিভাবে করেছে তাও কেউ জানে না। আর মিকমেকরাও নিজেদের ভুলে গেছে, ঠিক যেমনটা মায়ানরাও নিজেদের ভুলে বসে আছে।”
“কেন? ওরা এটা কেন করেছিল?”
“এটা ওদের কবরস্থান ছিল,” জাড বললেন। “আমি তোমাকে এখানে এনেছি যাতে তুমি এলির বিড়ালটা এখানে কবর দিতে পারো। মিকমেকরা মানুষ আর পোষা প্রাণীদের মধ্যে তফাত করত না, মালিকের কবরের পাশেই তাদের পোষা প্রাণীদের কবর দিতো।”
জাডের কথায় লুইসের প্রাচীন মিসরীয়দের কথা মনে পড়ে গেল। তারা আরেক ধাপ এগিয়ে ছিল। তারা রাজবংশের মৃত ব্যক্তির পোষা প্রাণীদের গলা কেটে তাদের সাথেই কবর দিতো, যাতে মৃত ব্যক্তির সাথে তাদের পোষা প্রাণীরাও পরকালে একই সাথে যেতে পারে। সে একবার এক ফারাও’ এর মৃত মেয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যাপারে পড়েছিল। সেখানে লেখা আছে সেই রাজকন্যার মৃত্যুতে দশ হাজারেরও বেশি গৃহপালিত পশুকে জবাই করা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ছয়শো শুয়োর আর দু’হাজার ময়ূর। শুয়োরগুলোর গায়ে গোলাপ ফুলের আতর দেয়া হয়েছিল জবাই করার আগে, কারণ সেই মৃত রাজকন্যার প্রিয় খোশবু ছিল গোলাপের গন্ধ।
আর তারাও পিরামিড বানিয়েছে। কেউ নিশ্চিত করে জানে না মায়ানরা কেন তাদের পিরামিডগুলো বানিয়েছে। কেউ বলে দিক হিসেব করার জন্য বা সময় পরিমাপের জন্য। তবে সবাই জানে মিসরের পিরামিডগুলো কিসের জন্যে…সেসব হচ্ছে এক একটা কবর, পৃথিবীর কবরের সবচাইতে বড় স্মৃতিফলক মিসরের পিরামিডগুলো। এখানে শায়িত আছে রামেস দ্বিতীয়, খুবই বাধ্য ছিল সে, লুইস ভাবতে ভাবতে ফিক করে হেসে দেয়।
জাড কোন রকম অবাক না হয়েই তার দিকে তাকান।
“যাও, চার্চকে কবর দাও,” তিনি বললেন। “আমি একটা সিগারেট টানবো। আমি তোমাকে সাহায্য করতাম, কিন্তু তোমার নিজেরই এটা করা লাগবে। যার যার মৃতকে সে সে কবর দিবে, এটাই তখনকার নিয়ম ছিল।”
“জাড, এসবের মানে কী? আমাকে আপনি এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”
“কারণ তুমি নরমার জীবন বাঁচিয়েছিলে।” জাড বললেন। লুইসের কাছে তার কণ্ঠে আন্তরিকতার কোন অভাব আছে বলে মনে হয় না- আর লুইস বুঝতে পারছে জাড নিজেও বিশ্বাস করেন যে তিনি সত্যি বলছেন-কিন্তু লুইসের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে জোরালোভাবে বলতে থাকে তিনি মিথ্যা বলছেন…অথবা তার কাছে কেউ মিথ্যা বলেছে এবং তিনি সেই মিথ্যাকে সত্য ভেবেই তাকে বলেছেন। সে জাডের চোখে যে চাউনি দেখেছে, সেটিকে চিনতে পেরেছে অথবা তার মনে হচ্ছে সে চিনতে পেরেছে।
তবে এখানে ওসব গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে। তার চাইতে বরং তার কাছে অবিরাম বইতে থাকা বাতাসকে বেশি গুরত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে, যা তার কপাল থেকে চুলগুলোকে ঠেলে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে।
জাড একটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসলেন। এরপর তার দুহাত একটা সদ্য জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠির চারদিকে গোল করে ধরে একটা বিড়ি জ্বাললেন। “শুরু করার আগে একটু জিরিয়ে নেবে নাকি?”
“না, লাগবে না,” লুইস বলে। সে চাইলে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করতে পারে কিন্তু এখন সেসব তার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। তার একবার মন বলছে যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না, আবার মনে হচ্ছে এটাই ঠিক। তার মনে আরেকটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। “আমি কি আসলেই এখানে গর্ত খুঁড়তে পারবো? মাটি তো খুব পাতলা মনে হচ্ছে।” লুইস মাথা নেড়ে ইশারা করে ওদিকটা দেখায়, যেখানে মাটির ভেতর থেকে পাথর মাথা বের করে আছে।
জাড ধীরে ধীরে তার মাথা নেড়ে সায় জানালেন। “পারবে,” তিনি বললেন। “মাটির স্তর পাতলা সেটা ঠিক, তবে যেখানে ঘাস জন্মানোর মত মাটি আছে, সেখানে তুমি কবরও দিতে পারবে, লুইস। আর এখানে লোকে অনেক আগে থেকেই কবর দিয়ে আসছে। যদিও কবর খোঁড়াটা খুব একটা সহজও হবে না।”
জাডের কথা ঠিক। এখানকার মাটি খুবই শক্ত আর পাথুরে। কিছুক্ষণ পরেই সে বুঝতে পারে চার্চকে কবর দেয়ার মত গর্ত খুঁড়তে হলে শুধু বেলচা দিয়ে কাজ হবে না। এরপর সে প্রথমে কুঠারটা দিয়ে কিছু মাটি আলগা করে নিয়ে সেই মাটি বেলচা দিয়ে সরাতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাত ব্যথা হয়ে যায়। তার শরীরের তাপমাত্রাও আবার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। কিন্তু তারপরও সে ভালো করে কাজটা করার একরকম অদ্ভুত অনুপ্রেরণা অনুভব করতে থাকে। সে অস্ফুটভাবে গুন গুন করতে শুরু করে, যেমনটা সে কোন ক্ষত সেলাই করার সময় প্রায়ই করে। মাঝে মাঝে কুঠারটা কোন পাথরকে এতো জোরে আঘাত করছে যে তাতে আগুনের ফুল্কি দেখা যাচ্ছে আর সেই ধাক্কার শিহরন কুঠারের কাঠের হাতল বেয়ে তার হাত পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। সে টের পাচ্ছে তার হাতে ফোসকা পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে তা গ্রাহ্যই করলো না, যদিও অন্যান্য ডাক্তারদের মত সে নিজের হাত নিয়ে বিশেষ যত্নবান। তাকে ঘিরে বাতাস গান গাইতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর পাথর ফেলার শব্দ পেলে মাথা ঘুরিয়ে দেখে জাড তার খুঁড়ে বের করা পাথরগুলোর মধ্যে বড় বড় পাথরগুলো আলাদা করে একটা স্তুপ বানাচ্ছেন।
“তোমার স্মৃতিস্তম্ভের জন্যে,” জাড লুইসকে তাকাতে দেখে বললেন।
“ওহ,” বলেই লুইস আবার তার কাজে লেগে পড়ে।
সে কবরটা তিনফুট লম্বা আর দুইফুট চওড়া করে খুড়লো-কোন বিড়ালয়ের জন্যে বেশ রাজকীয় ব্যবস্থা, সে ভাবে আর যখন এটা প্ৰায় ত্ৰিশ ইঞ্চির মত গভীর হলো এবং প্রতি কোপের সাথে আগুনের ফুল্কি হতে লাগলো, সে বেলচা আর কুঠারটা পাশে ছুড়ে ফেলে জাডকে জিজ্ঞেস করে জিনিসটা ঠিক আছে কি না।
জাড উঠে দাঁড়িয়ে একটু চোখ বুলিয়েই বললেন, “আমার কাছে তো ঠিকই লাগছে। আর আমার কাছে যেমনই লাগুক, তোমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে কি না সেটাই গুরত্বপূর্ণ।”
“আমরা এখানে কেন এসেছি আমাকে বলবেন?”
জাড একটু মুচকি হাসলেন। “মিকমেকরা বিশ্বাস করতো এই পাহাড়ে জাদু আছে,” তিনি বললেন। “তাদের বিশ্বাস ছিল এই পুরো জঙ্গলেই জাদু আছে। তারা এই জায়গাটা তৈরি করে এখানে তাদের মৃতদের কবর দিতো, সবকিছু থেকে দূরে। অন্য গোত্রের লোকেরা এই জায়গাটা এড়িয়ে চলতো-পেনবস্কটরা বলতো এই জঙ্গল ভূত প্রেতে ভরা। পরে চামড়া শিকারীরা প্রায় একই কথা বলতো। আমার ধারণা তারা ঈশ্বরের জলাতে সেইন্ট এলমোর আগুন দেখে ভূত ভেবে ভয় পেয়েছিল।”
জাড মিটিমিটি হাসলেন আর লুইস ভাবে, আপনি নিজে সেরকমটা ভাবেন না।
“পরবর্তীতে মিকমেকরাও এখানে আসা বন্ধ করে দেয়। তাদের মধ্যে একজন দাবি করে সে নাকি এখানে একটা উয়িন্ডিগো দেখেছে আর তাতে এখানকার মাটি অপবিত্র হয়ে গেছে। তারা নিজেদের মধ্যে এটা নিয়ে অনেক দেন-দরবার করে…যে রকমটা আমি শুনেছি। তবে আমি ছোটবেলায় এটা শুনেছি মাতাল স্টেনি বি.’র মুখে। তার পুরো নাম স্টানলি বুকার্ড। কিছু না জেনে বানিয়ে বানিয়ে বলার একটা অভ্যাস তার ছিল।”
লুইস জানতো যে উয়িন্ডিগো হচ্ছে এক রকমের আত্মা। “আপনি কি মনে করেন এখানকার মাটি অপবিত্র হয়ে গেছে?”
জাড হাসলেন অন্তত তার ঠোটগুলো বেঁকে যায়। “আমি মনে করি এ জায়গাটা খুবই বিপজ্জনক,” তিনি নরম গলায় বললেন, “তবে পোষা কুকুর- বিড়াল বা খরগোশের জন্যে না। তোমার বিড়ালটাকে কবর দিতে পারো এখানে, কোন সমস্যা নেই, লুইস।”
লুইস পলিথিন ব্যাগটা তার খোঁড়া গর্তের মধ্যে রেখে ধীরে ধীরে গর্তটা আলগা মাটি দিয়ে ভরতে শুরু করে। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে আর খুব ঠান্ডা লাগছে। পলিথিনের ব্যাগটার ওপর ঝুরঝুরে মাটি পড়ার বিমর্ষ শব্দ হচ্ছে। তার যদিও এখানে আসা নিয়ে কোন অনুশোচনা নেই, তবে তার সেই উত্তেজনায় ভাটা পড়েছে। সে মনে মনে এই অ্যাডভেঞ্চারের ইতি টানতে চাচ্ছে। তাদের ফিরে যাওয়ার জন্যে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
পলিথিনের ফরফর শব্দ কিছুক্ষণ পরেই মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়-এখন শুধু মাটি পড়ার থপ থপ শব্দ হচ্ছে। সে খুঁড়ে তোলা মাটির শেষ অংশটুকুও বেলচা দিয়ে গর্তের ওপর ফেলে। তার আন্ডারটেকার আঙ্কেল বলেছিলেন যে মুর্দার জন্যে খোঁড়া গর্ত ভর্তি করার জন্যে কখনই যথেষ্ট মাটি থাকে না। সে জাডের দিকে তাকায়।
“এবার শিলাস্তম্ভটা,” জাড বললেন।
“জাড, আমি খুব ক্লান্ত আর-”
এটা তোমার মেয়ের বেড়াল,” জাড নরমভাবে বললেও তার কণ্ঠে কোন নমনীয়তা ছিল না। “তোমার মেয়ে নিশ্চয়ই চাইতো তুমি এই কাজটা ঠিকভাবে কর।”
লুইস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সেটা ঠিকই বলেছেন।”
পরবর্তী দশ মিনিট ধরে সে জাডের একটি একটি করে তুলে দেয়া পাথর একটির ওপর আরেকটি রেখে চার্চের কবরের ওপর একটি কৌনিক আকৃতির শিলাস্তম্ভ তৈরি করে।
আশেপাশের স্তম্ভগুলোর সাথে সাথে জিনিসটাকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তার মনে এক রকম ক্লান্তিকর আনন্দ অনুভূত হয়। সে ভাবে এলি হয়তো এটা কখনোই দেখবে না। এই জঙ্গল আর চোরাবালি সমৃদ্ধ জলার মধ্যে দিয়ে এলিকে এখানে নিয়ে আসার কথা শুনলে রাচেলের মাথার সব চুল পেকে যাবে। তবে তার কাছে জিনিসটাকে একদম পারফেক্ট লাগছে।
“বেশিরভাগ স্তম্ভই পড়ে গেছে,” সে দাড়িয়ে নিজের প্যান্টের হাঁটুর কাছ থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে। সে চারদিক এখন আরো পরিস্কারভাবে দেখতে পাচ্ছে। চারদিকে অনেক পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তবে লুইস যেন তার স্তম্ভে নিজের খোঁড়া পাথর ছাড়া অন্য কিছু না ব্যবহার করে, জাড সেই ব্যাপারে খেয়াল রেখেছিলেন।
“হ্যা,” জাড বললেন। “বলেছিলাম তোমাকে, জায়গাটা খুব পুরনো। “ “আমাদের কাজ শেষ এখানে?”
“হুম।” তিনি লুইসের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “লুইস, তুমি খুব ভালোভাবে কাজটা করেছো, আমি জানতাম তুমি তাই করবে। এখন চলো ফিরে যাই।”
“জাড-” সে আবার বলতে শুরু করে, কিন্তু জাড ততক্ষণে কুঠারটা তুলে নিয়ে ধাপগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছেন। তাকে ধরার জন্যে লুইসকে বেশ লম্বা লম্বা পা ফেলতে হয়। সে একবার পেছনে তাকায়, কিন্তু তার তৈরি করা শিলাস্তম্ভটাকে আর দেখতে পায় না। সেটা ছায়ার মধ্যে হারিয়ে গেছে।
আমরা আবার সিনেমাটা উল্টো দিক থেকে চালু করলাম, লুইস জঙ্গল থেকে তার বাড়ির পেছনের মাঠে বেরিয়ে ক্লান্ত হয়ে ভাবে। কত সময় গিয়েছে তার কোন বোধ নেই, সে বিকেলে ঘুমুতে যাওয়ার আগে হাতের ঘড়ি খুলে রেখেছে আর সেটা এখনো তার বিছানার পাশেই থাকার কথা। সে শুধু জানে সে চরম ক্লান্ত আর একদম ছিবড়ে হয়ে গেছে। ১৫ বছর আগে হাই স্কুলে থাকতে সে শিকাগোর আবর্জনা ডিসপোজাল ক্রুতে কাজ করেছিল। সেখানে তার প্রথম দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর তার যেমন লেগেছিল, এতদিন পরে আজকে আবার সেদিনের মত শ্রান্ত লাগছে।
তারা যেভাবে গিয়েছে ঠিক সেভাবেই আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু তার পথের ভ্রমণের খুব কম জিনিসই মনে আছে। সে মরা গাছের স্তুপটির ওপর পা হড়কেছিল, কিন্তু জাড তাকে শক্ত করে ধরে ফেলেন। তার কয়েক মুহূর্ত পরেই তারা স্মাক দ্য ক্যাট, ট্রিক্সি, আমাদের পোষাপ্রাণী মার্তাদের চিরনিদ্রার স্থানটি ক্লান্তভাবে হেঁটে পেরোয়, যেখানে আগেরবার লুইসের সাথে শুধু জাডই ছিল না, তার পুরো পরিবারও ছিল।
সে ক্লান্তভাবে ভিক্টর পাস্কোর সতর্কবাণীর কথা ভেবেছে, কিন্তু কোন এক কারণে সেই স্বপ্নের সাথে আজ রাতের ভ্রমণের কোন যোগাযোগ সে খুঁজে পায়নি। সে এটাও ভেবে দেখেছে যে আজ রাতে তাদের অ্যাডভেঞ্চারটা বেশ বিপদে ঘেরা ছিল। প্রায় ঘোরের মধ্যে থেকে মাটি খুড়ে হাতে ফোসকা ফেলে দেয়া সেই বিপদগুলোর মধ্যে ছোট্ট একটা। সে ওই স্তূপের ওপর মারা পরতে পারতো। তাদের দুজনেই মারা পরতে পারতো। পরিস্কার মাথায় এসব কাজ করাও তো বেশ বিপজ্জনক, যেখানে সে ছিল এক রকম ঘোরের মাঝে। অবশ্য তার বর্তমান ক্লান্তিকর অবস্থায় সে সব কিছুর দোষ তার পরিবারের প্রিয় বিড়ালের মৃত্যুর ওপর চাপাতে চাইছে।
অনেকটা সময় পরে তারা তাদের বাড়ির কাছে পৌঁছে যায়।
তারা চুপচাপ হেটে লুইসদের ড্রাইভওয়েতে এসে থামে। বাতাস এখনো শোঁ শোঁ করে বইছে। লুইস কোন কথা না বলেই জাডকে বেলচাটা ফেরত দিলো।
“আমি বরং চলি,” জাড অবশেষে বললেন। “ওর বান্ধবীদের ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবার সময় হয়ে গেছে। এসে আমাকে না দেখলে কি না কি ভাববে।”
“আপনার কাছে ঘড়ি আছে?” লুইস জিজ্ঞেস করে। নরমা এখনো ফেরেনি শুনে সে খুব অবাক হয়। তার শরীরের ক্লান্ত পেশিগুলো তাকে বলছে এতক্ষণে মাঝরাত হয়ে গেছে।
“অবশ্যই,” জাড বলেন। “আমার গায়ে যতক্ষণ জামা আছে, আমার ঘড়িও ততক্ষণ আছে।”
তিনি তার পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে ঝাকি দিয়ে সেটার কভার সরিয়ে ফেললেন।
“সাড়ে আটটা,” তিনি বলে আবার ঝাঁকি দিয়ে ঘড়ির কাভারটা বন্ধ করে ফেললেন।
“সাড়ে আটটা?” লুইস বোকার মত বলে। “মোটে?”
“তুমি কী ভেবেছিলে?” জাড জিজ্ঞেস করলেন।
“আরো বেশি,” লুইস বলল।
“কালকে দেখা হবে, লুইস।” জাড বলে তার বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন।
এরপর তিনি থেমে লুইসের দিকে ফিরলেন, তার চোখে প্রশ্ন।
“জাড, আজ রাতে আমরা কী করলাম?”
“কেন? তোমার মেয়ের বেড়ালকে কবর দিয়েছি।”
“আর কিছু না?”
“আর কিছুই না,” জাড বললেন। “তুমি ভালো লোক, কিন্তু বড্ড বেশি প্রশ্ন করো। কারো হৃদয়ে কোন কিছু ঠিক মনে হলে মাঝে মাঝে সেটা করতে হয়। কিন্তু সেটা করার পরে তার মনে যদি সেটা সম্পর্কে নানান প্রশ্ন খোঁচাতে থাকে, অনেকটা বদ হজমের মত, তাহলে সে ধরে নেয় সে ভুল করেছে। তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি?”
“হ্যাঁ,” লুইস উত্তর দেয়। সে ভাবে জাড আবার তার মনের ভাবনা পড়ে ফেলছে।
“তবে তাদের হৃদয়কে শুরুতেই প্রশ্ন করার আগে সেসব খোঁচাতে থাকা প্রশ্নগুলিকেই পাল্টা প্রশ্ন করা উচিত।” জাড তার দিকে ঘনিষ্ঠভাবে তাকিয়ে বললেন। “তোমার কী মনে হয় লুইস?”
“আমার মনে হয় আপনার কথাই ঠিক।” লুইস জবাবে বলে।
“আর মানুষের হৃদয়ে যা আছে তাকে প্রশ্ন করেও লাভ নেই, না কি আছে?”
“আচ্ছা–”
“না,” লুইস মেনে নিয়েছে ধরে নিয়ে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন। “কোন লাভ নেই।” জাডের শান্ত গলার কঠোরতায় লুইসের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। তিনি এরপর বললেন, “কিছু কথা থাকে অতি গোপন। মহিলারা নাকি গোপন রাখার ব্যাপারে ওস্তাদ, তবে যে কোন বুদ্ধিমতী মহিলাই বলবে তারা কোনদিন কোন পার্টনারের মনের ভেতরে কি আছে তা বুঝতে পারে না। মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে, অনেকটা মিকমেকদের কবরস্থানের মাটির মত। মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।”
“জাড়-”
“প্রশ্ন করো না, লুইস। যা হয়ে গেছে তা মেনে নাও আর তোমার হৃদয়কে অনুসরণ করো।”
“কিন্তু–”
“কিন্তু না। যা হয়ে গেছে তা মেনে নাও আর তোমার হৃদয়ের কথার অনুসরণ করো। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে আমারা সঠিক কাজটাই করেছি…অন্তত আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যে, আমরা যেন ঠিক কাজটাই করেছি। আবার অন্য কোন পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো এই কাজটাই মারাত্নক রকমের ভুল হতো।”
“আচ্ছা, আপনি আমার একটা প্রশ্নের অন্তত উত্তর দিন।”
“আগে প্রশ্ন শুনি, তারপর দেখা যাবে।”
“আপনি ওই জায়গাটা সম্পর্কে জানলেন কী করে?” ফেরার পথেও এই প্রশ্নটা লুইসের মনে আরেকবার উকি দিয়েছিল। সে আরো সন্দেহ করেছিল যে জাড নিজেই হয়তো আংশিক মিকমেক, যদিও তিনি দেখতে একদমই মিকমেকদের মত না। তিনি দেখতে একদম শতভাগ এংলো।
“কেন? স্টেনি বি.’র কাছ থেকে,” তিনি অবাক হয়ে বললেন।
“সে আপনাকে এমনিই বলেছিল?”
“না,” জাড বললেন। “এরকম জায়গা সম্পর্কে কেউ এমনি এমনি কাউকে বলে না। আমার বয়স যখন দশ তখন আমি আমার কুকুর স্পটকে সেখানে কবর দিয়েছিলাম। সে একটা খরগোশ তাড়া করতে গিয়ে কাঁটাতারে লেগে জখম হয়। ওই যখমে ইনফেকশন হয়ে ও মারা যায়।”
জাডের এই কথায় লুইসের একটু খটকা লাগে। জাড তাকে আগে কিছু একটা বলেছিলেন যেটার সাথে এই কথা খাপ খাচ্ছে না। কিন্তু সে এতটাই ক্লান্ত যে, সেসব নিয়ে চিন্তা করার মত মানসিক শক্তি তার নেই। জাড আর কিছু বললেন না, শুধু নিজের দুর্বোধ্য চোখ দিয়ে লুইসের দিকে তাকালেন।
“গুড নাইট, জাড,” লুইস বলে।
“গুড নাইট।”
বৃদ্ধ তার মাটি খোঁড়ার কুঠার আর বেলচা নিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেলেন। “থ্যাঙ্কস!” লুইস গলা উচু করে বলে।
জাড ঘুরলেন না, শুধু নিজের হাত উঁচু করে ইশারা করলেন যে তিনি শুনেছেন।
আর লুইসের বাসায় হঠাৎ করেই তাদের ফোনটা বাজতে শুরু করে।
লুইস দৌড়াতে শুরু করে। তার ঊরু আর কোমরের ব্যথায় সে চোখ মুখ কুচকে ফেললেও দৌড় থামায় না। কিন্তু সে যখন কিচেনে পৌঁছে, ততক্ষণে ফোনটা ছয়-সাত বার রিং হয়েছে। সে যখন ফোনে হাত রাখে, ফোনের রিং বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও সে ফোনটা তুলে নিয়ে হ্যালো বলল কিন্তু সে ফোনের হাম্ম্…ছাড়া কিছুই শুনতে পেলো না।
রাচেলের ফোন ছিল, সে ভাবে। আমি ওকে কল ব্যাক করবো।
কিন্তু হঠাৎ করেই কাজটাকে তার কাছে অত্যন্ত ক্লান্তিকর বলে মনে হয়। ফোন দিলে প্রথমে ওর শ্বাশুড়ি বা চেকবুকওয়ালা শ্বশুড় ফোন ধরবে। তারপর তাদের সাথে কিছুক্ষণ নাচানাচির পর তারা ফোন রাচেলকে দিবে…এরপর এলিকে। শিকাগোতে সময় একঘন্টা পিছিয়ে, তাই এলি অবশ্যই জেগে আছে আর এলি তাকে চার্চের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলবে না।
চার্চ খুব ভালো আছে। শুধু একটা দ্রুতগামী অরিংকো ট্রাকের ধাক্কা খেয়েছে। আমি শিওর যে ট্রাকটা অরিংকো ট্রাকই, কারণ অন্য ট্রাক হলে নাটকীয়তা জমবে না, বুঝতে পারছো কী বলছি? পারছো না? আচ্ছা বাদ দাও। ট্রাকের ধাক্কায় ও মারা গেছে তবে ওর শরীরে তেমন কোন ক্ষত চিহ্ন নেই। জাড আর আমি ওকে মিকমেকদের গোরস্থানে কবর দিয়ে এসেছি। জায়গাটা পেট সেমিট্রির একটা বর্ধিত অংশের মত। ওখানে যাওয়ার রাস্তাটা খুব ভালো, মামনি। একদিন আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো, চার্চের স্মৃতিফলকে, থুক্কু-শিলাস্তম্ভে ফুল দিতে। তবে অবশ্যই তা হবে সেখানের সবগুলো চোরাবালি জমে যাবার আর সব ভালুকেরা শীতনিদ্রায় যাবার পর।
সে ফোনটা রেখে সিঙ্কের কাছে গিয়ে সেটা গরম পানি দিয়ে ভর্তি করে। তারপর সে তার জামা খুলে সেই পানিতে ধোয়। সে এই শীতের ভেতরেও শুওরের মত ঘেমেছে। আর তার গা থেকে একদম শুয়োরের মতই গন্ধ বের হচ্ছে।
রেফ্রিজারেটরে কিছু থেকে যাওয়া মিটলোফ ছিল। লুইস সেখান থেকে একটা পাতলা টুকরো কেটে নিয়ে এক স্লাইস পাউরুটির ওপর রাখলো। তার ওপর দিলো বারমুডা পেঁয়াজের মোটা মোটা দুই স্লাইস। সে জিনিসটাকে কেচাপ দিয়ে গোসল করানোর আগে বেশ কিছুক্ষণ জিনিসটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সে জিনিসটাকে আরেকটা পাউরুটির পিস দিয়ে চাপা দেয়। যদি রাচেল আর এলি জিনিসটা দেখতো তাহলে তারা দুজনেই তাদের নাক একই ভঙ্গিমায় কুঁচকে ফেলতো—ইয়াক।
মেয়েরা, তোমরা মিস করলে এটা, তোমাদেরই লস, লুইস অত্যন্ত আনন্দিত মনে ভাবে আর নিজের তৈরি করা স্যান্ডউইচটার ওপর হামলে পড়ে। চমৎকার স্বাদ। কনফুসিয়াস বলেছেন, যার গায়ে শুয়োরের গন্ধ, সে খায় নেকড়ের মতো, সে হাসতে হাসতে ভাবে। সে গলা দিয়ে স্যান্ডউইচটা নামানোর জন্যে দুধের বোতল থেকে সরাসরি মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে দুধ পান করে। এটা দেখলেও রাচেল ভয়ঙ্করভাবে চোখ কুঁচকে তাকাতো। এরপর সে ওপরতলায় গিয়ে কাপড় ছেড়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার গায়ের ব্যথা এখন কমে হালকা টিপটিপ বেদনায় রুপান্তরিত হয়েছে, যা সামান্য আরামদায়কও বটে।
সে তার ঘড়িটা যেখানে রেখেছিল, সেখানেই আছে। ঘড়িটা নিয়ে দেখে নয়টা বাজতে দশ মিনিট বাকি। অবিশ্বাস্য।
বাতি নিভিয়ে বিছানায় নিজের পাশে শুয়ে পড়ে, ঘুমিয়ে যায়।
ভোর ৩টার দিকে উঠেই সোজা বাথরুমে যায় সে। বাথরুমে গিয়ে উজ্জ্বল ফ্লোরোসেন্ট বাতির নিচে চোখ পিটপিট করতে করতে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে জাডের কথার গরমিলটা তার মাথায় আসে। তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়।
আজ রাতে জাড বলেছেন যে তার কুকুর স্পট মারা গেছে যখন তার বয়স ছিল দশ বছর-মরচে ধরা কাঁটাতারে লেগে ঘা হয়ে মারা যায় স্পট। কিন্তু এই বছরের গ্রীষ্মের শেষের দিকে তারা সবাই যেদিন পেট সেমিটারিতে ঘুরতে গিয়েছিল, সেদিন তিনি বলেছিলেন তার কুকুর বৃদ্ধ হয়ে মারা যায় এবং তিনি সেটাকে পেট সেমিটারিতে কবর দেন। এমনকি তিনি তার কুকুরের কবরের স্মৃতিফলকটাও তাদের দেখিয়েছিলেন, যদিও সেটার গায়ে কী লেখা
আছে তা পড়া যায় না।
লুইস টয়লেট ফ্লাশ করে বাতি নিভিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। আরেকটা খটকা লাগছে তার কাছে-এবং মুহূর্তখানেক পরেই তার সেটা মনে পড়ে।
জাড বলেছিলেন তার এবং এই শতাব্দীর জন্ম একই বছরে। আর সেদিন পেট সেমিট্রিতে তিনি বলেছিলেন তার কুকুরটা মারা যায় যে বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। তার মানে তার বয়স ছিল চৌদ্দ, যখন তার কুকুর মারা যায়, যদি তিনি যুদ্ধ শুরু বলতে ইউরোপে যুদ্ধের সূচনার কথা বুঝিয়ে থাকেন।
আর যদি তিনি যুদ্ধ শুরু বলতে সেই যুদ্ধে আমেরিকার যোগদানকে বোঝান তাহলে তখন তার বয়স হবে সতেরো।
কিন্তু আজ রাতে তিনি বললেন তার কুকুরটা মারা গিয়েছিল তার বয়স যখন ১০।
তিনি একজন বৃদ্ধ লোক আর তার মত লোকেরা অনেক কিছুই গুলিয়ে ফেলেন, সে অস্বস্তি নিয়ে ভাবে। তিনি নিজেই বলছিলেন তিনি আর আগের মত সব কিছু মনে রাখতে পারেন না-মাঝে মধ্যেই তাকে লোকের নাম- ঠিকানা মনে করতে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে হয়, যেসব তিনি আগে অনর্গল বলতে পারতেন। এমনকি উনি সারাদিন কী কী কাজ করবেন সেটা রাতের বেলা ঠিক করে রাখলে পরদিন সকালে তা ভুলে যান। তবে জাডের বয়স হিসেবে তিনি ভালোই আছেন। তার বয়সে ভীমরতি স্বাভাবিক ব্যাপার; অবশ্য জাডের ক্ষত্রে ভীমরতি না বলে ভুলো মন বললে বেশি সঠিক হবে। তার মত একজন বৃদ্ধের জন্যে সত্তর বছর আগে ঠিক কবে তার কুকুর মারা গিয়েছিল বা কিভাবে মারা গিয়েছিল তা মনে করতে না পারার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। ভুলে যাও এসব, লুইস।
কিন্তু এবার সহজে তার ঘুম আসলো না; সে খালি বাড়ি আর সেটার চারদিকে বইতে থাকা শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দের ব্যাপারে সচেতন মনে বেশ কিছুক্ষণ জেগে থাকে।
এক সময় সে কিছু টের না পেয়েই ঘুমে ডুব দিলো। তবে ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তার মনে হয় সে বাইরের সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ পাচ্ছে। সে ভাবে, চলে যাও, পাস্কো, চলে যাও। যা হয়েছে তা হয়েই গেছে, যা মরেছে তা মরেই গেছে-আর পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যায়।
বছর শেষ হতে হতে যদিও আরো অনেক অদ্ভুত এবং ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ঘটে, লুইস আর কখনই ভিক্টর পাস্কোকে দেখে না, না স্বপ্নে না স্লিপ ওয়াকিংয়ে।
অধ্যায় ২৩
সকাল নয়টায় তার ঘুম ভাঙে। রুমের পূর্বদিকের জানালাগুলোতে সূর্যের আলো এসে খেলা করছে। টেলিফোনটা বাজছে। সে ছোঁ মেরে টেলিফোনটা তুলে নেয়। “হ্যালো?”
“হাই!” রাচেল বলে। “ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম না কি? তাহলেই খুশি হবো।”
“তুই আমার ঘুম ভাঙ্গিয়েছিস, কুত্তি,” সে হাসতে হাসতে বলে।
“ছি, মুখের ভাষা শুনলে গোসল করতে মনে চায়,” রাচেল বলে। “কাল রাতে তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম। তুমি কি জাডদের বাসায় ছিলে?”
সে জবাব দেয়ার আগে মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্যে ইতস্তত করে। “হ্যাঁ,” বলে সে। “বিয়ারের জন্যে গেছিলাম। নরমা কোথায় যেন থ্যাঙ্কস গিভিংয়ের দাওয়াতে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম তোমাকে ফোন দিব, কিন্তু…জানই তো।”
রাচেল লুইসকে তার বাবা-মার খবর দেয়, যেটা লুইসের না শুনলেও চলতো। তবে যখন শুনলো তার চেকবুকওয়ালা শ্বশুড় মশাইয়ের মাথার স্টেডিয়াম আরো দ্রুত গতিতে বাড়ছে, সে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পেল।
“গেজের সাথে কথা বলবে?”
“দাও,” লুইস মুচকি হেসে বলে। “দেখো আবার আগেরবারের মত যেন ফোন না রেখে দেয়।”
ফোনের ওপাশ থেকে লুইস শুনতে পায় রাচেল গেজকে হাই, বাবা বলার জন্যে অনেক কায়দা কসরত করছে।
শেষে গেজ বলল, “হাই ডাডা।”
“হাই, গেজ” লুইস উৎফুল্লভাবে বলে। কেমন আছেন আপনি? জীবন চলে কেমন? আপনি দাদার তামাক টানার পাইপের র্যাক আবারো টেনে ফেলে দিয়েছেন? ফেললে আমি খুব খুশি হব। আর পারলে তার কালেক্ট করা ডাকটিকিটগুলোও ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেবেন।”
গেজ আনন্দিত চিত্তে ত্রিশ সেকেন্ডের মত আবোল তাবোল বলে। আবোল তাবোলের মাঝখানে তার ক্রমবর্ধমান ভোকাবুলারির কিছু শব্দ শুনতে পাওয়া গেল-মা, এলি, নানা, নানু, গাড়ি আর গু।
অবশেষে রাচেল গেজের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নেয়, গেজের ক্রোধকে উপেক্ষা করে। লুইসও হাফ ছেড়ে বাঁচে। সে তার ছেলেকে পাগলের মত ভালোবাসে, তবে দুই বছরের বাচ্চার সাথে ফোনে কথোপোকথন চালিয়ে যাওয়া আর বদ্ধ পাগলের সাথে দাবা খেলতে যাওয়া একই কথা। তুমি যে চালই দাও, সে তা উপেক্ষা করে তার নিজের মত করে যা ইচ্ছা চাল দিবে।
“ওদিকে কেমন চলছে?” রাচেল জিজ্ঞেস করে।
খারাপ না,” লুইস এইবার কোন রকম ইতস্তত না করেই বলে। সে জানে যে সে যখন মিথ্যা করে বলেছিল সে জাডের বাসায় ছিল, সে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন আর এখান থেকে ফেরার পথ নেই। যা মিথ্যা এখন আরো অনেক বাচ্চা মিথ্যার জন্ম দিবে। তার হঠাৎ জাড ক্র্যান্ডালের কথাটা মনে পড়ে যায়, মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে, লুইস। মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে। “সত্য বলতে গেলে একরকম বোরিং সময় কাটিয়েছি কাল। মিস ইউ।”
“তুমি বলতে চাইছো যে তুমি এসব সার্কাস থেকে দূরে থেকে ছুটি উপভোগ করছো না?”
“ওহ, আমার নির্জনতা ভালই লাগে,” সে বলে, “তবে জানো কী, প্ৰথম ২৪ ঘন্টার পর একা একা থাকতে কেমন অদ্ভুত লাগে।”
“আমি বাবার সাথে কথা বলবো,” লুইস ব্যাকগ্রাউন্ডে এলির গলা শুনতে পায়।
“লুইস? এলি কথা বলবে।”
“দাও ওকে।”
এলি প্রায় পাঁচমিনিট ধরে লুইসের সাথে কথা বলে। ও প্রথমে বকবক করলো ওর নানীর কিনে দেয়া পুতুলটার ব্যাপারে। তারপর বলল যে ওর নানা ওকে স্টক ইয়ার্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন। “বাবা, ওদের গায়ে কী গন্ধ,” এলি বলে। লুইস মনে মনে বলে, তোমার নানাও কোন গোলাপের কলি না, মামনি। এলি কিভাবে তার নানিকে রুটি বানাতে সাহায্য করেছে তাও বলে। তার পর বলে গেজ কিভাবে তার ডায়াপার চেঞ্জ করার সময় ছুটে পালিয়ে নানার স্টাডি রুমের দরজায় হাগু করে দিয়েছে (সাবাশ! লুইস মনে মনে বলে আর একটা হাসির রেখা তার মুখের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়)।
লুইস ভেবেছিল সে হয়তো এ যাত্রায় বেঁচে গেছে, অন্তত আজ সকালের জন্যে। সে যখন এলিকে তার মাকে ডেকে দেয়ার কথা বলতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই এলি তাকে জিজ্ঞেস করে, “চার্চ কেমন আছে বাবা? ও আমাকে মিস করে?”
লুইসের মুখ থেকে হাসি উবে যায় কিন্তু সে সাথে সাথেই উত্তর দেয়,
একদম শান্ত স্বাভাবিক গলায়ঃ “ও ভালই আছে। গতকাল রাতে ওকে বেঁচে যাওয়া বিফ স্টু খেতে দিয়েছিলাম। ওর খাওয়ার পর ওকে ঘরের বাইরে যেতে দিয়েছি। এরপর থেকে ওকে আর দেখিনি। তবে মাত্রতো ঘুম থেকে উঠলাম।”
তুমি প্রথম শ্রেনীর একজন খুনি হতে পারবে লুইস, ঠান্ডা মাথার খুনি। ডাক্তার ক্রিড, মৃত ব্যাক্তিকে শেষ কখন দেখেছেন? রাতে খাবার সময়। সে বিফ স্টু খায় ডিনারে। এরপর থেকে তাকে আর দেখিনি।
“আচ্ছা। চার্চকে আমার হয়ে চুমো খেয়ো, বাবা।”
“ইয়াক, নিজের বিড়ালকে নিজে চুমু খাও ইচ্ছে হলে,” লুইস বললে এলি খিকখিক করে হেসে উঠে।
“মার সাথে আবার কথা বলবে, বাবা?”
“হ্যাঁ, দাও।”
সে রাচেলের সাথে আরো কয়েক মিনিট কথা বলে তবে চার্চের ব্যাপারে কিছু বলে না তারা। তারা একে অপরকে “লাভ ইউ” বলে আর তারপর লুইস
ফোন রেখে দেয়।
“বাপরে,” সে শূন্য রুমে বলে ওঠে আর এর সবচাইতে খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে তার একফোঁটাও খারাপ লাগছে না বা অনুশোচনা বোধ হচ্ছে না।
অধ্যায় ২৪
সাড়ে নয়টার দিকে স্টিভ মাস্টার্টন ফোন দিয়ে লুইসকে জিজ্ঞেস করে লুইস র্যাকেট খেলবে কি না-র্যাকেট কোর্ট পুরো ফাঁকা, চাইলে তারা সারাদিন খেলতে পারবে, সে খুব উৎফুল্ল কন্ঠে বলে।
লুইস তার কন্ঠের আনন্দের কারণটা বুঝতে পারছে। ইউনিভার্সিটি চলার সময় র্যাকেট খেলার জন্যে সিরিয়াল পেতে দুইদিন লেগে যায়। কিন্তু তারপরেও সে রাজি হলো না। সে স্টিভকে বলে সে ম্যাগাজিন অফ কলেজ মেডিসিনের জন্যে একটা আর্টিকেল লিখবে, তাই খেলতে পারবে না।
“তুমি শিওর তো?” স্টিভ জিজ্ঞেস করে। “খেলাধুলা বাদ দিয়ে সারাদিন কাজ কাজ করলে মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে যায়, জানো তো?”
“জানি। আচ্ছা দেখি।”
“রাজি হয়ে যাও,” বলে স্টিভ ফোন রেখে দেয়। লুইস এবার অবশ্য অর্ধেক মিথ্যা বলেছে। কারণ সে আসলেই ঐ আর্টিকেলটা নিয়ে কাজ করতে চায়, যদিও তার খেলতে না চাওয়ার আসল কারণ গতকালের অ্যাডভেঞ্চারের কারণে তার পুরো শরীর ব্যথা। বিড়ালটাকে বইতে গিয়ে তার দুই কাঁধই ব্যথা হয়ে আছে। তার পিঠ ব্যথা করছে আর পায়ের পেশিগুলো গিটারের তারের মত টনটনে হয়ে আছে। খোদা জানে সে কিভাবে ভেবেছিল তার শরীর মোটামুটি ফিট আছে। আজ স্টিভের সাথে র্যাকেট খেলতে গেলে তাকে খুব কিউট দেখাতো, বাতের ব্যারামে ভোগা বুড়োদের মত নড়াচড়া করতো সে।
বুড়োদের কথা ভেবে তার মনে পড়ে গেল কাল রাতের ভ্রমণে সে একা যায়নি, তার সাথে একজন আশি বছরের বুড়োও গিয়েছিলেন। সে ভাবে, জাডের শরীরেও কি এরকম ব্যথা হচ্ছে?
ঘন্টাখানেক ধরে আর্টিকেল লিখতে চেষ্টা করে কিন্তু কাজ খুব একটা এগোয় না। একাকিত্ব আর নির্জনতা তার নার্ভে চেপে বসে। সে তাই কাজে ইস্তফা দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরোয়।
জাড আর নরমা বাসায় ছিলেন না কিন্তু তাদের দরজায় একটা খাম পিন দিয়ে আটকানো ছিল। খামের ওপর লুইসের নাম লিখা। সে খামটা নিয়ে ঢাকনা খুলে একটা চিঠি পায়।
লুইস,
আমি এবং আমার মাননীয় স্ত্রী শপিংয়ের জন্যে বাকস্পোর্ট যাচ্ছি। তাছাড়া সেখানে এম্পোরিয়ামের একটা ড্রেসারে মাননীয়ার চোখ পড়েছে প্রায় শত বছর আগে। সেটাও দেখতে হবে। আমরা সেখানেই লাঞ্চ সেরে নেব আর আমাদের ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে। রাতে বিয়ারের জন্যে চলে এসো।
তোমার ফ্যামিলি তোমারই ফ্যামিলি, তাই আমি তাতে মাতব্বরি করতে চাই না। কিন্তু এলি যদি আমার মেয়ে হতো তাহলে ওকে আমি এখনই চার্চের খবরটা দিতাম না। শুধু শুধু ওর বেড়ানোটা মাটি করে কী লাভ? আর আমি তোমার জায়গায় হলে আমাদের গতরাতের ব্যাপারেও কারো সাথে আলাপ করতাম না, বিশেষ করে নর্থ লাডলোর কারো সাথে। এখানকার কেউ কেউ মিকমেকদের গোরস্থানটার কথা জানে আর এই শহরেরই কেউ কেউ তাদের পোষা প্রাণীদের সেখানে কবরও দিয়েছে…যেটাকে তুমি পেট সেমিটারির আরেকটা অংশ বলতে পারো। বিশ্বাস করবে কি না জানি না, ওখানে একটা ষাড় পর্যন্ত কবর দেয়া হয়েছিল। স্টেক পোল রোডের জ্যাক ম্যাকভার্ন তার প্রাইজ পাওয়া ষাড় হ্যানরাট্টিকে মিকমেকদের গোরস্থানে কবর দিয়েছিলেন, ১৯৬৭ বা ৬৮ তে। হা হা! তিনি আমাকে বলেছিলেন তিনি আর তার দুই ছেলে মিলে ষাড়টাকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখান পর্যন্ত। আমার সেটা শুনে হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার অবস্থা! এখানকার লোকজন ঐ জায়গাটা নিয়ে কথা বলা পছন্দ করে না, আর তারা এটাও চায় না ‘বাইরের’ কেউ ঐ জায়গাটার ব্যাপারে জানুক। এটার কারণ এটা না যে মিকমেকদের গোরস্থান নিয়ে তিনশো বছরের পুরনো কুসংস্কার আছে। এর কারণ তারা এসবে বিশ্বাস করে এবং তাদের ধারণা ‘বাইরের’ কেউ ব্যাপারগুলো বুঝবে না এবং তাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে। এসবের কোন আগা-মাথা আছে? হয়তো নেই, কিন্তু প্লিজ তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাখবে।
আমি তোমাকে আরো খুলে বলবো, হয়তো আজ রাতেই। আর আমার ধারনা ততক্ষনে তুমি নিজেই আরো ভালো করে বুঝতে পারবে।
জাড়।
পুনশ্চ-এই চিঠিতে কী লেখা আছে নরমা জানে না। আমি ওকে অন্য কিছু বলেছি। আমার স্ত্রীকে আমাদের আটান্ন বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক মিথ্যেই বলেছি, আমার ধারণা, প্রায় সব পুরুষই তাদের স্ত্রীদেরকে দু-একটা মিছে কথা বলে। তবে অনেকেই সেসবের জন্যে লজ্জিত নয়, কারণ মিথ্যেগুলোর দরকার ছিল।
যাই হোক, রাতে চলে এসো, আজ খুব করে বিয়ার খাওয়া হবে।
জে।
লুইস পোর্চের সিঁড়িতে দাড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এলিকে চার্চের কথা বলো না-সে বলেনি। সেখানে আরো পশু কবর দেয়া হয়েছে? তিনশো বছরের পুরনো কুসংস্কার?…ততক্ষনে তুমি নিজেই আরো ভালো করে বুঝতে পারবে।
সে এই লাইনটা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে আর নিজের মনকে গতরাতে তার কার্যকলাপ নিয়ে প্রথমবারের মতো ভাবতে দেয়। স্মৃতিটা কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে, তার মনে হচ্ছে সে কোন স্বপ্নের কথা ভাবছে, বা শক্তিশালী মাদকে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় করা কিছুর কথা ভাবছে। তার গতরাতের মরা গাছের স্তুপটার ওপর ওঠার কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সেখানকার বাতাসে হালকা আলোর আভা আর সেখানে দশ বা বিশ ডিগ্রী বেশি গরম লাগার ব্যাপারটা। তবে সবটাই কেমন ঝাপসা ঝাপসা, ডাক্তার এনেসথেসিয়া দেয়ার পর যেমনটা হয়…প্রায় সব পুরুষই তাদের স্ত্রীদের মাঝে মধ্যে দুই-একটা মিছে কথা বলে।
স্ত্রীদের পাশাপাশি নিজের মেয়েকেও, লুইস ভাবে। জাড যেন আজ সকালে লুইসের মাথায় কী ঘুরপাক খেয়েছে তার সবই জেনে গেছেন, ব্যাপারটা খুব ভূতুড়ে লাগে লুইসের কাছে।
ধীরে ধীরে সে চিঠিটা আগের মত ভাঁজ করে খামে ঢুকায়। চিঠিটা লেখা হয়েছে দাগ টানা কাগজে, বাচ্চারা যেসব কাগজে লিখে। সে খামটা তার প্যান্টের পেছনের পকেটে রেখে নিজের বাসার দিকে রওনা হয়।