পেট সেমেটারি – ১৫

অধ্যায় ১৫

বাসায় ঢুকে দরজায় রাচেলকে দেখে লুইসের মুখ হা হয়ে যায়। ও সেসব সেক্সি পোশাক পরে ছিল যেগুলো লুইস পছন্দ করে।

“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে বউ,” সে বলে। “বাচ্চারা কোথায়?”

“মিসি ডেন্ড্রিজ ওদের নিয়ে গেছেন। সাড়ে আটটা পর্যন্ত আমরা বাসায় একা…আমাদের হাতে সময় আছে আড়াই ঘন্টা। ভাবলাম সময়টা কাজে লাগাই।” স্বামী-স্ত্রী মিলে গোসলখানায় পরের সময়টুকুর ভালই সদ্ব্যবহার করে। তাদের স্বামী-স্ত্রীর ‘সময়ের উত্তম ব্যবহারের’ প্রথম রাউন্ডের পর রাচেল লুইসকে গরুর একটা স্পেশাল ডিস খেতে দেয়। লুইস পাস্কোর মাথার ভেতর থেকে উকি দেয়া ঘিলু দেখে ভেবেছিল আগামী হ্যালোইনের আগে তার আর ক্ষুধা লাগবে না। অথচ সে এক প্লেট খাবার শেষ করে আরেক প্লেট খেয়ে নিল।

খাওয়ার পর রাচেল লুইসের হাত ধরে দোতলায় বেড রুমে নিয়ে যায় দ্বিতীয় ইনিংসের জন্যে। “চলো দেখি তুমি আমার জন্যে আর কি কি করতে পারো।” রাচেল বলে।

পরবর্তীতে লুইস যখন বাচ্চাদের আনতে মিসি ডেন্ড্রিজের বাসায় যায়, তিনি দুর্ঘটনাটির ব্যাপারে জানতে চাইলেন। সে ঘটনাটা তাকে এতো সংক্ষেপে বলল যে তার চাইতে বেশি তথ্য তিনি পরদিনের পত্রিকাতেই পাবেন। ঘটনাটা নিয়ে কথা বলতে চাইছিল না সে। তবে বাচ্চাদের বেবিসিট করার জন্য মিসি কোন পয়সা নিতে রাজি হন না। সে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই যতটুকু না বললেই নয়, ঠিক ততটুকুই বলল। তার সাহায্যেই আজ রাচেলের সাথে একটা সুন্দর সময় কেটেছে।

গেজ ফেরার পথে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর এলিও ঘন ঘন হাই তুলতে থাকে, তার চোখ ঘুমে লাল হয়ে আছে। বাসায় ফিরে সে গেজকে ফ্রেশ ডায়াপার পরিয়ে ক্রিবে শুইয়ে দেয়। এর পর সে কিছুক্ষণ এলিকে বিছানায় গল্পের বই পড়ে শোনায়। এলি বরাবরের মত ‘হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড

থিঙ্গস আর’ পড়ে শোনাতে বায়না ধরে। তবে লুইস তাকে ‘দ্য ক্যাট ইন দ্য হ্যাট’ বইটা শুনতে রাজি করায়। কয়েক মিনিটের মাথায় এলি ঘুমে কাঁদা হয়ে গেলে রাচেল ওকে ঘুমের মাঝেই ঠিকঠাক করে শুইয়ে দেয়।

লুইস নিচতলায় নেমে দেখে রাচেল দুধের গ্লাস হাতে লিভিং রুমে বসে আছে। তার কোলে একটা ডরোথি সয়ারের রহস্য উপন্যাস।

“লুইস তুমি সত্যিই ঠিক আছো?”

“একদম ঠিক আছি বউ,” সে উত্তরে বলে। “সব কিছুর জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।”

রাচেল মিষ্টি করে হাসে। “তুমি কি জাডের বাসায় আড্ডা দিতে যাবে?” সে মাথা নাড়ে। “আজ না। আমি আজকের মত ফুরিয়ে গেছি।”

“সেজন্যে কি আমি দায়ি?”

“ঠিক ধরেছো।”

“তাহলে এক গ্লাস দুধ খেয়ে শুতে চলো।”

লুইস ভেবেছিল সহজে তার ঘুম আসবে না, যেমনটা ইন্টার্নি লাইফে হতো। খুব কঠিন জীবন ছিল সেসময়। কিন্তু সে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সারাদিনের শ্রান্তি তাকে আরামদায়কভাবে জেঁকে ধরে। নরম বিছানায় তার শরীর যেন একদম মাখনের মত গলে গেল। সে কোথাও পড়েছে একজন মানুষের ঘুমাতে গড়ে সাত মিনিট সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যেই মানুষের শরীরের সবগুলো সুইচ অফ হয়ে যায়। সাত মিনিট, এর মধ্যেই সচেতন আর

অবচেতন মন অদল-বদল হয়ে যায়।

অবচেতনে পৌঁছানোর খানিক আগে সে যেনো বহু দূর থেকে রাচেলের গলা শুনতে পেল… “পরশু?”

“হুমম?”

“পশু ডাক্তার চার্চকে পরশু নিয়ে যেতে বলেছে।”

“ওহ।” চার্চ, তোর ধন শেষ বারের মত উপভোগ করে নে। তার পরেই তার চেতনা তাকে ছেড়ে কোন গভীর গর্তে তলিয়ে যায়।

অধ্যায় ১৬

গভীর রাতে একটা জোরালো শব্দে লুইসের ঘুম ভেঙে যায়। শব্দটা এতো জোরালো ছিল যে লুইস বিছানায় ধড়মড়িয়ে বসে পড়ে। তার আশঙ্কা হয় এলি হয়তো খাট থেকে পড়ে গেছে। কিন্তু আকাশের মেঘ সরে গেলে চাঁদের আবছা আলোয় সে দেখতে পায় ভিক্টর পাস্কো তার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আওয়াজটা ছিল পাস্কোর সজোরে দরজা খোলার শব্দ।

তার মাথার বাম দিকটা হা হয়ে আছে আর মুখে বেশ কয়েকটি জমাট বাধা রক্তের ধারা। কাঁধের হাড় বেরিয়ে আছে। তার মুখে হাসি।

“চলো ডাক্তার,” সে বলে। “আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।”

লুইস চারদিকে তাকিয়ে দেখলো। তার স্ত্রী গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। এরপর সে আবার পাস্কোর দিকে তাকায়। ছেলেটা মরে গেছে কিন্তু, কিভাবে যেনো আবার মরেওনি। তা সত্ত্বেও লুইসের কোন ভয় লাগে না। ভয় না লাগার কারণটাও সে সাথে সাথে বুঝতে পারে।

এটা একটা স্বপ্ন, সে ভাবে। মৃতরা ফিরে আসে না, এটা ফিজিওলজিক্যালি অসম্ভব। এই ছেলেটার লাশ এখন ব্যাঙ্গরের ময়নাতদন্ত ড্রয়ারে সংরক্ষণ করা আছে ময়নাতদন্তের নকশা সহ-দেহের সামনের দিকে Y-এর মত একটা সেলাই। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার হয়তো তার ব্রেনের টিস্যু স্যাম্পল রেখে ব্রেনটা তার চেস্ট ক্যাভিটিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে আর মাথার ফাঁকা জায়গাটা কাগজ দিয়ে ভরে দিয়েছে। ব্রেনটা তার ভাঙা খুলিতে জায়গামতো বসানোর চাইতে এই কাজটা অনেক সহজ। তার কার্ল চাচা-হতভাগী রুখির বাবা তাকে বলেছিলেন যে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তাররা এসব করে থাকে। এটা ছাড়াও আরও অনেক কথাই তাকে তার চাচা বলেছিল যেগুলো রাচেল শুনলে

আতঙ্কে ওর রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেত। পাস্কো এখানে থাকতে পারে না-নো ওয়ে, বেবি। পাস্কোকে মর্গের ফ্রিজে বুড়ো আঙুলে ট্যাগ পড়িয়ে লক করে রাখা হয়েছে। আর ও কোনভাবেই সকালের সেই লাল জগিং হাফ প্যান্ট পড়ে নেই।

কিন্তু তবুও পাস্কোর কথা শোনার জন্যে সে এক রকমের প্রবল তাড়না অনুভব করছে। পাস্কোর চোখ তার দিকে।

সে তার গায়ের চাদর সরিয়ে মেঝেতে পা রেখে উঠে বসে। সে তার পায়ের তলায় পাপোশের রোয়াগুলোর খোঁচা অনুভব করতে পারছে। স্বপ্নটা বড়ই বাস্তব মনে হয় তার কাছে। এতটাই বাস্তব যে পাস্কো উল্টো দিকে ফিরে সিঁড়ি বেয়ে নামার আগ পর্যন্ত সে নড়ল না। সে পাস্কোকে অনুসরণ করার জন্যে তাড়না অনুভব করছে। তবে স্বপ্নের মধ্যেও সে চায় না কোন লাশ তাকে স্পর্শ করুক।

কিন্তু সে তার পিছু নেয়।

তারা একে একে লিভিং রুম, ডাইনিং রুম এবং কিচেন পার হয়। লুইস ভেবেছিল পাস্কো কিচেন থেকে গ্যারেজের দরজাটা লক ঘুরিয়ে, ছিটকিনি টেনে খুলবে। কিন্তু পাস্কো এরকম কিছুই করে না। সে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে কাঠের দরজা ভেদ করে ওপাশে চলে যায়। এটা দেখে লুইস বিস্মিত হয়ে ভাবে, আচ্ছা! দরজা ভেদ করে যাওয়া এতো সোজা? এ তো যে কেউ পারবে!

সে নিজেও এভাবে বের হতে গিয়ে দরজার শক্ত কাঠে ধাক্কা খায়। লুইস বাস্তববাদী মানুষ, এমনকি তার স্বপ্নের মাঝেও। সে লক ঘুরিয়ে ছিটকিনি তুলেই দরজা খুলে গ্যারেজে ঢুকলো। কিন্তু পাস্কো সেখানে ছিল না। স্বপ্নের চরিত্রদের পরিণতি প্রায়ই এমন হয়, আর তাদের অবস্থানেরও। এক দৃশ্যে দেখা যাবে তুমি কোন সুন্দরি মেয়েকে আদর করছো, পরমুহূর্তেই দেখা যাবে বিল্ডিঙের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ছো। হয়তো স্বপ্নের দ্বিতীয় দৃশ্য শুরু হয়ে গেছে তাই সে পাস্কোকে দেখতে পাচ্ছে না আর।

তবে লুইস গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে চাঁদের আলোয় সেই জঙ্গলের পথের মুখে পাস্কোকে আবার দেখতে পেলো।

আতঙ্ক এবার লুইসের মনে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। তার ওখানে যেতে ইচ্ছে করছে না। সে দাঁড়িয়ে থাকে।

পাস্কো ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। চাঁদের আলোয় তার চোখ দুটো রুপালী মনে হচ্ছে। ওই চোখের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। হয়তো স্বপ্নটাই হচ্ছে সম্মোহনের স্বপ্ন…নিজের ইচ্ছে মত কিছু না করতে পারার স্বপ্ন, ঠিক যেমন আজ খুব চাইলেও সে পাস্কোকে বাঁচাতে পারেনি। বিশ বছর ডাক্তারি শিখেও তা কোন কাজে আসে না যখন মাথা ফাঁক হয়ে ঘিলু বের হয়ে যাওয়া কোন রোগিকে আনা হয়। এসব ক্ষেত্রে ডাক্তার যে কথা, নাপিত আর মুচিও একই কথা।

এসব ভাবতে ভাবতেই লুইস ওই পথ ধরে পাস্কোর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।

তার স্বপ্নটা একদমই ভাল লাগছে না। স্বপ্নটা খুব বেশি বাস্তব। এটা কেমন স্বপ্ন, যেখানে ও পাপোশের রোয়ার খোঁচা অনুভব করতে পারে, কাঠের বন্ধ দরজা ভেদ করে বের হতে পারে না? এখন আবার সে তার পায়ে ঘাসের ঠান্ডা শিশির অনুভব করতে পারছে। তার গায়ে শর্টস ছাড়া কোন পোশাক নেই কিন্তু তাই বলে স্বপ্নের মধ্যেও তার ঠান্ডা লাগতে হবে? আর পাইন গাছের নিচে আসলে সে পায়ের তলায় মাটিতে ছড়িয়ে থাকা পাইনের সুচারু পাতার খোঁচাও অনুভব করতে থাকে। প্রয়োজনের চাইতে বড্ড বেশি বাস্তব স্বপ্নটা।

চিন্তার কিছু নেই। তুমি তোমার বেডরুমে শুয়ে আছো। যতই বাস্তব মনে হোক, এটা স্বপ্নই। কাল সকালেই এটাকে হাস্যকর মনে হবে। তখন তোমার জাগ্রত মন ঠিকই স্বপ্নের ফাঁকগুলো খুঁজে বের করতে পারবে।

বাহুতে একটা শুকনো ডালের সাথে বেশ ভালোভাবে খোঁচা খেয়ে লুইস চোখ মুখ কুচকে ফেলে। সামনে পাস্কোকে একটা চলমান ছায়ার মত লাগছে। আর তখন লুইসের মনে আতঙ্ক বেশ জোরালোভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমি একটা লাশের পেছন পেছন হাঁটছি আর সে আমাকে পেট সেমিটারির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এবং এটা বাস্তব, কোন স্বপ্ন না। ওহ ঈশ্বর, এটা বাস্তব।

তারা জঙ্গলঘেরা পাহাড়টায় পৌঁছে গেছে। এখানে এসে পথটা অলসভাবে সর্পিল বাঁক নিয়ে ঝোঁপঝাঁড়ের ভেতর গিয়ে পড়েছে। পায়ের নিচের থকথকে কাঁদামাটিতে তার পা আটকে যাচ্ছে। পা তুলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আর পা তোলার সময় বিশ্রী ফচফচ শব্দ হচ্ছে।

সে নিজেকে জোর করে বোঝায়, এটা একটা স্বপ্ন মাত্র।

তারা পেট সেমিটারির খোলা জায়গাটায় পৌঁছে গেছে। আকাশের মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ দেখা দিয়েছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় জায়গাটা ভেসে যাচ্ছে। এই আলোতেই পেট সেমিটারির আনাড়ি হাতের তৈরি ফলকগুলো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।

“আমাদের বিড়াল পাস্কো স্মাকি, প্রভুভক্ত ছিল সে’ লেখা ফলকটার কাছে থেমে ঘুরে লুইসের দিকে ফিরে দাঁড়ায়। লুইসের মনে আতঙ্ক আর ভয় পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে-তার মনে হয় আতঙ্ক বাড়তে বাড়তে তার হৃৎপিণ্ডটাই হয়তো চাপ না নিতে পেরে ফেটেই যাবে। পাস্কো তার রক্তাক্ত ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসছে। তার রোদে পোড়া তামাটে চামড়া চাঁদের রুপালি আলোয় কাফনে মোড়া ফ্যাকাসে লাশের মত মনে হচ্ছে।

পাস্কো তার এক হাত তুলে একদিকে ইশারা করে। লুইস সেদিকে তাকিয়ে গুঙিয়ে ওঠে। সে তার চোখ বড় বড় করে হাতের আঙ্গুলের গাঁট কামরে ধরে। লুইস বুঝতে পারে আতঙ্কে তার চোখ ভিজে গেছে।

জাড ক্র্যান্ডাল এলিকে অনেক পুরনো যে মরা গাছের ধ্বংসস্তূপের ব্যাপারে সাবধান করেছিল, সেগুলো অসংখ্য হাড়ের স্তূপে রুপান্তরিত হয়ে নড়াচড়া করছে। হাড়গুলো মোচড়ামুচড়ি করছে এবং নানান রকমের হাড়ে রুপান্তরিত হচ্ছে—মানুষের উরুর লম্বা হাড়, বুকের পাজর, আবার মানুষ এবং অন্যান্য পশুর হাসতে থাকা মাথার খুলি।

জিনিসটা কিলবিল করছে।

পাস্কো এবার তার দিকে হেঁটে আসতে শুরু করে। চাঁদের আলোতেও বোঝা যাচ্ছে তার রক্তাক্ত মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে আছে। এবার লুইসের অবশিষ্ট সচেতন মন একটা কথাই ভাবতে থাকে, জেগে উঠো লুইস। প্রয়োজনে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নিজেকে জাগাও। রাচেল, এলি, গেজ বা পুরো এলাকার মানুষ জেগে উঠুক তোমার চিৎকারে। জেগে-ওঠো-জেগে-ওঠো-জেগে-ওঠো- 607637-30511

কিন্তু তার গলা দিয়ে নির্গত বাতাসের ফিসফিসানি ছাড়া কিছুই বের হয় না। বাচ্চারা শিস্ দেয়া শিখতে গিয়ে যেরকম আনাড়ি শব্দ করে ঠিক তেমন একটা আওয়াজ বের হলো।

“এই দরজা খুললে খুব খারাপ হবে,” পাস্কো লুইসের দিকে তাকিয়ে বলল। লুইস হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। লুইস পাস্কোর মুখের অভিপ্রায় দেখে প্রথমে সমবেদনা ভেবে ভুল করেছিল; তার চেহারায় আছে এক রকমের ভয়ঙ্কর দৃঢ়তা। সে এখনো হাত উঠিয়ে ধ্বংসস্তূপের দিকে পয়েন্ট করে আছে। “স্তুপটার ওপাশে কখনো যাবে না, তোমার যতোই ইচ্ছে হোক না কেন। এই দেয়াল তৈরি করা হয়েছে অতিক্রম না করার জন্যে। খুব ভাল করে শুনে রাখো ডাক্তার, ওখানে এমন অশুভ শক্তি আছে যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। শক্তিটা অনেক পুরনো আর ক্ষতি করার জন্যে সর্বদা ক্ষুধার্ত।”

লুইস আবারো চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু এবারো ওর গলা দিয়ে বাতাস ছাড়া কিছুই বের হয় না।

“আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে এসেছি,” পাস্কো বলে। “তোমার এবং তোমার ভালবাসার সবকিছুর সর্বনাশ খুবই কাছে, ডাক্তার।” সে লুইসের এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে লুইস তার গায়ে মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছে।

পাস্কো তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।

হাড়ের মোচড়ামুচড়ির মৃদু কিন্তু ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা যেতে থাকে।

লুইস পাস্কোর বাড়িয়ে দেয়া হাতটা থেকে চট করে দূরে সরতে চাইলে সে খানিকটা ভারসাম্য হারিয়ে শুন্যে হাতড়াতে থাকে। তার হাতের সাথে ধাক্কা লেগে সেমিটারির একটা স্মারক উল্টে মাটিতে পড়ে যায়।

পাস্কো তার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলে, “ডাক্তার, মনে রেখো।”

লুইস চিৎকার করতে চেষ্টা করে আর তার সমগ্র পৃথিবী দুলে ওঠে—কিন্তু এখনো সে হাড়ের সাথে হাড়ের কিলবিল শব্দ শুনতে পায়।

অধ্যায় ১৭

একজন মানুষের ঘুমোতে গড়ে সাত মিনিট লাগে, তবে হ্যান্ডস হিউম্যান ফিজিওলজি অনুসারে, একই মানুষের ঘুম থেকে বের হতে পনের থেকে বিশ মিনিট লাগে। ব্যাপারটা এমন যে ঘুমকে যদি একটা জলাশয়ের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে সেই জলাশয়ে ডুব দিতে যত সময় লাগবে, ডুব থেকে ভেসে উঠতে আরো বেশি সময় লাগবে। ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময় মানুষ ধাপে ধাপে জাগে, গভীর ঘুম থেকে হালকা ঘুমে। হালকা ঘুমের শেষ পর্যায়ে মানুষ শব্দ শোনে, এমনকি প্রশ্নেরও উত্তর দেয়, তবে পরে তা মনে থাকে না…মনে পড়লেও তা বিচ্ছিন্ন স্বপ্ন হিসেবে মনে পড়ে।

লুইস হাড়ের মটমট শব্দ শুনছিল, তবে সেই শব্দটা ক্রমশ জোরালো আর ধাতব শব্দে বদলে যেতে থাকে। একটা কিছু বাড়ি খাওয়ার শব্দ হলো, এরপর একটি চিৎকার, এবং আরও কিছু ধাতব শব্দ …কিছু কি গড়াচ্ছে? তাই তো, তার বিক্ষিপ্ত মন সায় দেয়। হাড়গুলো গড়াচ্ছে।

সে তার মেয়ের চিৎকার শোনে, “ধরো গেজ! ধরো!”

এরপরই সে গেজের আনন্দভরা চিৎকার শুনতে পায় এবং চোখ খুলে নিজের বেডরুমের সিলিং দেখতে পেলো।

লুইস নিজেকে স্থির রেখে বাস্তবতার সবটুকু নিজের মধ্যে স্বাগতম জানায়।

পুরোটাই একটা স্বপ্ন, যতই ভয়ঙ্কর হোক, যতই বাস্তব মনে হোক। তার মনের ভেতরের মনের গভীরে থাকা একটি ফসিল মাত্র।

ধাতব শব্দটা আবার শোনা গেল। গেজ তার খেলনা গাড়িগুলো নিয়ে খেলছে।

“গেজ! ধরো গেজ!”

“ধরো! ধরো!,” গেজ চেঁচিয়ে ওঠে। “ধরো! ধরো!-ধরো! ধরো!”

থপ-থপ-থপ। গেজের ছোট্ট পায়ের দৌড়ানোর আওয়াজ পাওয়া যায়। এলি আর গেজ খিলখিল করে হাসছে।

লুইস তার ডানে তাকিয়ে দেখলো বিছানার সেদিকটা খালি। বাইরে সূর্য ওঠেছে, নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বেজে গেছে। রাচেল তাকে একটু বেশি ঘুমাতে দিয়েছে, হয়তো ইচ্ছা করেই।

অন্যদিন হলে লুইস একটু বিরক্ত হতো, তবে আজ হলো না। সে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বাস্তব জগৎটাকে উপভোগ করতে থাকে।

রাচেল উচ্চস্বরে ডাকে, “এলি নেমে এসে টিফিন নাও, স্কুল বাস এসে গেছে।”

“আসছি!” এরপর এলির পায়ের তুলনামূলক জোরালো থপথপ শব্দ। “গেজ, তোমার গাড়ি নাও, আমাকে স্কুলে যেতে হবে।”

গেজ এরপর চিৎকার করে কিছু বলতে চেষ্টা করে। পরিস্কারভাবে যেসব শব্দ শোনা গেল সেগুলো হচ্ছে, “গেজ, গাড়ি, ধরো।” তবে সে কী বুঝাতে চাইছে তা একদম পরিস্কার, “এলি থাকুক। শিক্ষা ব্যবস্থা একদিনের জন্যে চুলোয় যাক।”

আবার রাচেলের গলা শোনা গেল, “নামার আগে বাবাকে ঝাঁকি দিয়ে এসো, এলি।”

এলি ওর চুলের বেণী দোলাতে দোলাতে রুমে ঢুকে।

“আমি জেগে আছি মা,” সে বলল। “গিয়ে বাস ধরো।”

“আচ্ছা বাবা।” এলি এগিয়ে এসে তার বাবার গালে চুমু খেয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটলো।

বাস্তবতার রেশে স্বপ্নটা মিলিয়ে যেতে শুরু করে।

“গেজ!,” সে চিৎকার করে ডাকে। “আব্বুকে একটা চুমু দিয়ে যাও।” গেজ পাত্তা দেয় না। সে এলির পেছন পেছন নিচে নামছে আর গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, “ ধরো! ধরো ধরো ধরো!”

নিচ থেকে রাচেল বলল, “লুইস, তুমি উঠেছ?”

“হ্যাঁ,” সে উঠে বসে উত্তর দিলো।

“বললাম তো উঠেছে!” এলি বলে। “আমি গেলাম, বাই!” দরজা লাগার

শব্দের পরপরই গেজের রাগান্বিত চিৎকার শোনা গেল।

“ডিম কটা খাবে? একটা না দুটো?” রাচেল নিচ থেকে জিজ্ঞেস করে।

লুইস গায়ের কম্বল সরিয়ে মেঝেতে পাপোশের ওপর পা রাখে। রাচেলের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েও নিজের পায়ের দিকে তাকালে তার কথাগুলো গলাতেই মরে যায়।

তার পা কাদা আর পাইন গাছের সূক্ষ্ম পাতায় মাখামাখি হয়ে আছে।

এক লাফে তার হৃৎপিন্ড গলার কাছে চলে আসে। হকচকিয়ে গিয়ে তার জিভে কামড় লেগে যায়। কম্বলটা বিছানা থেকে একদম সরিয়ে ফেলে সে চোখ বড় বড় করে দেখে, বিছানায় তার পায়ের জায়গাটাতে কাদা আর পাইন গাছের পাতা মাখামাখি হয়ে আছে।

“লুইস?”

সে তার হাঁটুতেও কিছু পাইনের পাতা লেগে থাকতে দেখে। সে হঠাৎ তার বাহুতে তাকিয়ে দেখে একটা সদ্য ছুঁলে যাওয়া ক্ষত, ঠিক যেখানে স্বপ্নের মধ্যে সে মরা ডালের খোঁচা খেয়েছিল।

আমি চিৎকার করব।

তার ভেতর থেকে একটি চিৎকার দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তার বাস্তবতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আসল বাস্তবতা হচ্ছে তার পায়ে আর বিছানায় লেগে থাকা কাঁদা আর পাইন গাছের পাতা, তার বাহুতে ছুঁলে যাওয়া

আমি পাগল হয়ে যাব। প্রথমে আমি চিৎকার করব এরপর পাগল হয়ে নেংটো হয়ে ঘুরে বেড়াব। তাহলে এসব নিয়ে আমাকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

“লুইস?” রাচেল এবার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসছে। “তুমি আবার ঘুমিয়ে পড়লে না কি?”

সে নিজেকে ধাতস্ত করতে চেষ্টা করে, যেমনটা সে করেছিল পাস্কোকে চাদরে মুড়িয়ে তার ইনফার্মারিতে নিয়ে আসার পর। সে আবারো নিজের সাথে জয়ী হয়। সে চায় না রাচেল তাকে এভাবে দেখুক, পায়ে কাদা মাখা, বিছানায় কাদা মাখা, কম্বল মেঝেতে ফেলা।

“আমি জেগে আছি,” সে উৎসাহী কন্ঠে বলে। হঠাৎ কামড় লেগে তার জিভ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে।

“একটা ডিম না দুটো?” রাচেল সিঁড়ি বেয়ে ওঠা থামিয়ে দিয়েছে। ধন্যবাদ ঈশ্বর।

“দুটো,” সে জবাব দেয় কোন রকম চিন্তা না করেই। “স্ক্রাম্বলড।”

“বেশ,” রাচেল সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে।

স্বস্তিতে সে কিছুক্ষনের জন্যে চোখ বন্ধ করে ফেললে অন্ধকারে সে পাস্কোর রুপালী চোখ জোড়া দেখতে পায়। আর কিছু না ভেবে লুইস দ্রুত কাজে লেগে পড়ে। বিছানার চাদরটা একটানে তুলে ফেলে সে। কম্বলটা ঠিকই আছে। চাদরটা দলা পাকিয়ে ময়লা কাপড়ের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে। এরপর প্রায় ছুটে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। শাওয়ারের পানি এতই গরম যে তার মনে হয় চামড়া পুড়ে যাবে। পা থেকে খুব ভাল করে ময়লাগুলো ধুয়ে ফেলে সে।

কিছুটা শান্ত হয়ে গা মুছতে মুছতে ভাবে, খুনের আলামত লুকিয়ে ফেলার পর খুনিদের হয়তো এ রকমই লাগে। গা মুছতে মুছতেই হাসতে শুরু করে সে। তার হাসি যেন থামতেই চায় না।

“কী ব্যাপার?” রাচেল নিচ থেকে বলল। “এতো হাসি কিসের জন্যে?”

“একটা জোক মনে পড়ে গেছে,” লুইস ওপর থেকে বলল। তার ভয়ও লাগছে কিন্তু হাসিও বন্ধ করতে পারছে না। তার পেটের ভেতর থেকে দমকে দমকে হাসি বেরিয়ে আসছে। কাঁদামাখা চাদরটা ময়লার ঝুরিতে ফেলা সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, সে ভাবে। মিসি ডেন্ডিজ সপ্তাহে পাঁচ দিন এসে তাদের বাসা পরিস্কার করেন, নোংরা কাপড়-চোপড় ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে দেন। রাচেল এই চাদরটি আবার কখনো বিছানায় পাতার আগে আর দেখবেই না। যখন দেখবে তখন এটা হবে ঝকঝকে পরিস্কার একটা বিছানার চাদর। তবে মিসি হয়তো চাদরে কাদার ব্যাপারটা রাচেলকে বলতে পারে, আবার নাও পারে। কারণ সে হয়তো ভাববে রাচেল আর লুইস হয়তো কোন অদ্ভুত সেক্স গেম খেলেছে বিছানার ওপর। অনেকে সেক্স গেমে গায়ে রং ব্যবহার করে, মিসি ভাববে লুইসরা হয়তো রং এর বদলে কাদা মেখেছে।

এটা ভেবে লুইস আরো ভীষণভাবে হাসতে থাকে।

সে যখন জামা পড়তে থাকে তার হাসি বন্ধ হয়। তার ভালো লাগতে শুরু করে। সে ভাল করে তাকিয়ে দেখে রুমটা পুরোপুরি স্বাভাবিক লাগছে, শুধুমাত্র চাদরহীন খাটটি ছাড়া। সে বিষ সরিয়ে ফেলতে পেরেছে। হয়তো ‘প্রমাণ’ শব্দটা বেশি যৌক্তিক ছিল, তবে তার মনে এগুলোকে বিষই মনে হচ্ছে।

লোকজন হয়তো এভাবেই ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলো হজম করে, লুইস ভাবে। যখন কেউ তার বাড়ির পেছনের আকাশে পরিস্কারভাবে ফ্লায়িং সসার দেখে, বা আকাশ থেকে পড়া মাছের বৃষ্টি দেখে অথবা রাতের আঁধারে কেউ খাটের নিচ থেকে পা টেনে ধরলে ঘটনাগুলোকে হয়তো এভাবেই হজম করতে

চেষ্টা করে। কেউ পাগলের মত হাসে, কেউ পাগলের মত কাঁদে। কিন্তু দেখা যায় যে এসব আতঙ্ক অনেক সময় হজমের অযোগ্য। তখন এই আতঙ্কগুলোকে গিলে ফেলা পয়সার মত পায়ুপথ দিয়ে আস্তই বের করে দিতে হয়।

গেজ তার বেবি চেয়ারে বসে কোকো বেয়ার খাচ্ছিল। খাওয়ার পাশাপাশি সে টেবিলটাও কোকো বেয়ার দিয়ে নকশা করছে। তাছাড়া একই জিনিস দিয়ে সে মাথায় শ্যাম্পু এবং মুখে ফেসিয়াল করতেও বেশ ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে।

রাচেল কিচেন থেকে ডিম এবং কফি নিয়ে বেরিয়ে এলো। “অস্থির জোকসটা কী ছিল লুইস? তুমি তো ওপরতলায় পাগলের মত হাসছিলে। আমি তো ভয় পেয়ে গেছি।”

লুইস কী বলবে ভাবতে ভাবতেই সে গত সপ্তাহের একটা কাহিনি বলতে শুরু করে। লুইস গত সপ্তাহে টেইলরের দোকানে গিয়ে দেখতে পায় ইহুদি টেইলর লোকটি তার পোষা টিয়া পাখিটি নিয়ে এসেছে যেটা একটা কথাই বলতে পারে। “এরিয়াল শেরন গু খায়।”

সে বলা শেষ করতে করতে রাচেলও হাসিতে ভেঙে পড়ে, এমনকি গেজও।

যাক, আমাদের নায়ক তাহলে প্রমানগুলো ধামাচাপা দিতে পেরেছে। ময়লা বিছানার চাদর এবং বাথরুমের উন্মত্ত হাসি। আমাদের নায়ক এখন সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর জন্যে পত্রিকা পড়বে অন্তত পত্রিকা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকবে।

লুইস পত্রিকা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরে।

সে স্বস্তি নিয়ে ভাবে, যাক ঘটনাটা আপাতত কবর দেয়া গেছে, এবং সেটা এভাবেই থাকবে। যদি কোনদিন কোন ক্যাম্প ফায়ারে সবাই তাদের জানা ব্যাখ্যাতীত ঘটনা বলতে শুরু করে, তাহলে হয়তো সে এটাকে তখন কবর খুড়ে বের করবে, তার আগে নয়।

সে তার নাস্তা খেয়ে রাচেল আর গেজকে চুমু খেয়ে বিদায় নেয়। সব ঠিকঠাক। বাইরে চমৎকার সকাল। গ্যারেজ থেকে গাড়ী বের করে রওনা হবার সময় সে মাঠের সেই পথটার দিকে তাকায়। ওখানেও সব ঠিক আছে। লুইস তুমি পাস করেছো।

শুরুতে সবকিছুই ঠিক ছিল। তবে প্রায় দশ মাইল ড্রাইভ করার পর তার গায়ে প্রচন্ড কাপুনি হতে থাকলে সে সিং’স চাইনিজ রেস্টুরেন্টের পার্কিং লটে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়। রেস্টুরেন্টটা থেকে ই.এম হাসপাতাল খুব একটা দূরে নয়, যেখানে পাস্কোর লাশ রাখা আছে। ঠিক, ই.এম হাসপাতালে, সিংস চাইনিজে না। ভিক্টর পাস্কো আর কখনই কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে থাই সুপ খেতে যাবে না, হা-হা।

কাঁপতে কাঁপতে তার শরীর কোকড়াতে শুরু করে। লুইস একই সাথে হতাশ এবং আতঙ্কিত বোধ করে। কোন ভৌতিক জিনিসের ভয় দিনের আলোয় লাগে না। তার ভয় হয় তার মাথার তারগুলো ছিড়ে যাচ্ছে। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে সে।

“আর না,” সে বলে। “প্লিজ, আর না।”

সে হাতড়ে হাতড়ে রেডিওতে গান ছেড়ে দেয়। পছন্দের একটা গান পুরোটা শেষ করে তার মনে হয় সে আবারো ড্রাইভ করতে পারবে।

সে মেডিকেল সেন্টারে পৌঁছে চার্লটনকে হ্যালো বলেই বাথরুমে ঢুকে যায়। কারণ তার ধারণা তাকে উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়, শুধু তার চোখের ভেতর একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সে তার চোখমুখে পানি দিয়ে, মুখ মুছে, চুল আঁচড়ে অফিস রুমে যায়।

লুইস অফিস রুমে ঢুকে দেখলো সেখানে স্টিভ মাস্টারটন আর ভারতীয় ডাক্তার সুরেন্দ্র হারদু বসে কফি খাচ্ছে।

“সুপ্রভাত, লু,” স্টিভ বলে।

“সুপ্রভাত।”

“দোয়া কর যেন আজকের সুপ্রভাত গতকালকের মত কুপ্রভাত না হয়,” হারদু বলে।

“ঠিক। তুমি তো অনেক কিছু মিস করেছো।”

“সুরেন্দ্র নিজেও অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছে গত রাতে,” মাস্টারটন বলল। “ওকে বলো, সুরেন্দ্র।”

হারদু মুচকি হাসতে হাসতে নিজের চশমাটা মুছতে থাকে। “কাল রাত ১টার দিকে দুটি ছেলে তাদের এক মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে আসে। মেয়েটি প্রচন্ড মাতাল হলেও তাকে বেশ খুশি খুশি লাগছিল। তার এক উরুতে বেশ ভালোভাবে কেটে গেছে। আমি তাকে বললাম যে অন্তত চারটা সেলাই লাগবে, ক্ষতচিহ্ন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সে বলল, ‘যত ইচ্ছা সেলাই মারুন।” আমি তাই সেলাই দিতে তার দিকে ঝুঁকে-

হারদু ঝুঁকে দেখালো। লুইস কী হতে যাচ্ছে তা আঁচ করতে পেরে মুখ টিপে হাসতে শুরু করে।

“আর আমি যেই সেলাই শুরু করলাম সে তার পেটের অমৃত জিনিসগুলো আমার মাথার ওপর উগরে দিলো।”

মাস্টারটন হাসিতে ভেঙে পরে, সাথে লুইসও। হারদু মুখ টিপে হাসে, যেনো সে এই জিনিস জীবনে বহুবার দেখেছে।

“সুরেন্দ্র, তুমি কখন থেকে ডিউটিতে আছো?” হাসি থামলে লুইস জিজ্ঞস করে।

“মাঝরাত থেকে। ভাবলাম তোমাদের হ্যালো বলে যাই।”

“আচ্ছা, হ্যালো,” লুইস তার হাত নেড়ে নেড়ে বলল। “এখন বাসায় গিয়ে ঘুম দাও।”

“ইয়েস, স্যার!” সুরেন্দ্র বিদায় নিয়ে চলে যায়।

সুরেন্দ্র চলে গেলে ওরা দুজন আবারো প্রচন্ড হাসিতে ফেটে পড়ে। লুইসের হাসতে এত ভালো খুব কমই লেগেছে। সবকিছু স্বাভাবিক মনে হতে থাকে তার।

“আজ থেকে ওষুধ কম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা আসা শুরু করবে।” স্টিভ বলল।

লুইস মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বেলা দশটা থেকে তারা আসা শুরু করে। ওই রিপ্রেজেন্টেটিভরা প্রায়ই তাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করে।

“একটা কথা শুনে রাখো বস,” স্টিভ বলল। “আমি জানি না শিকাগোতে কেমন ছিল…তবে এখানকার রিপ্রেজেন্টেটিভরা খুবই দিল দরিয়া। তারা প্রায় সব রকম আবদারেই রাজি হয়ে যায়। ফ্রি এক্সপ্রেস হান্টিং ট্রিপ থেকে ফ্রি সমুদ্রপারের লাক্সারিয়াস হোটেলে ফ্যামিলি ট্যুর পর্যন্ত। এক লোক তো আমাকে একটা বাতাস দিয়ে ফোলানো যায় এমন সেক্স ডল দিতে চেয়েছিল। আমাকেই! যেখানে আমি সামান্য একজন পি.এ! তারা তাদের ওষুধ বিক্রীর জন্য হেন কিছু নাই যে করবে না।”

“ওই পুতুলটা নিলেই তো পারতে।”

“নাহ, পুতুলটা ছিল লালচুলো। লাল চুল ভালো লাগে না।”

যাই হোক, আমি সুরেন্দ্রর সাথে একমত। আজকের দিনটা কালকের মতো না হলেই হলো।

অধ্যায় ১৮

দমটা বেজে গেলেও যখন ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ না আসে, লুইস একটু হতাশই হয়। সে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টার অফিসে ফোন দিয়ে পাস্কোর রেকর্ডগুলো তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলে। লুইস ফোন রাখতেই রিপ্রেজেন্টেটিভ হাজির হয়। সে তাকে কিছু দিতে চেষ্টা না করে বরং ডিসকাউন্টে ফুটবল ম্যাচের টিকিট কিনতে অফার করে।

“না,” লুইস বলে।

“আমিও তাই ভেবেছিলাম,” লোকটি হতাশা নিয়ে বলে সেখান থেকে চলে যায়।

দুপুরে লুইস বেয়ার’স ডেন রেস্টুরেন্ট থেকে একটা টুনা মাছের স্যান্ডউইচ কিনে নিয়ে আসে। অফিসে বসে পাস্কোর রেকর্ডে চোখ বুলাতে বুলাতে জিনিসটা পেটে চালান করে দেয় সে। তার ধারণা পাস্কোর সাথে তার নিজের অথবা পেট সেমিটেরিটার কোন সম্পর্ক আছে। সে ভাবছে তার সাথে যা ঘটেছে তার নিশ্চয়ই কোন ব্যাখ্যা আছে। হয়তো পাস্কো লাডলোতেই বড় হয়েছে আর হয়তো সে তার কোন পোষা কুকুর বা বিড়াল পেট সেমিটেরিতে কবর দিয়েছে। লুইস সচেতনভাবে ব্যাপারটা ধরতে না পারলেও তার অবচেতন মন হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার সাথে এই বিশ্রী খেলা খেলছে।

কিন্তু লুইস এরকম কোন সম্পর্ক খুঁজে পায় না রেকর্ডে। পাস্কো বেড়ে উঠেছে বার্গেনফিল্ডে আর এখানে সে তড়িৎ কৌশলে পড়াশোনা করে। লুইস তার নিজের সাথে বা পেট সেমেটারির সাথে পাস্কোর কোন সম্পর্কের নাম গন্ধও খুঁজে পায় না।

সে তার খাওয়া শেষ করে মর্গে ফোন দেয়। নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাদের ওখানে ভিক্টর পাস্কো নামে আমাদের এক ছাত্রের লাশ-”

“নেই,” ফোনের অপর পাশ থেকে উত্তর এলো।

লুইস হতবিহব্বল হয়ে পড়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য। পরে সে কোনমতে বলে, “কী?!?”

“গত রাতেই ওর লাশ বিমানে করে ওর বাবা-মার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আপনি কি ভেবেছেন? সে মেলা দেখতে গেছে?”

“না,” লুইস বলে। “অবশ্যই না। মানে…” মানে কী? কী সব আবোল তাবোল বলছে ভেবে নিজেকে কষে একটা ধমক দেয় লুইস। ঘটনাটাকে একদম কবর দিয়ে দিতে হবে। জিনিসটা নিয়ে ভেবে ভেবে মাথাটাই যাচ্ছে। “লাশ খুব দ্রুত নিয়ে গেল মনে হচ্ছে,” সে কিছু বলা দরকার তাই বলে।

“গতকাল দুপুরেই লাশের অটপ্সি শেষ। ততক্ষণে তার বাবা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। আমার ধারণা রাত দুটোর আগেই লাশ নিউইয়র্ক পৌঁছে গেছে।”

“ওহ। তাহলে তো-”

“যদি না তাকে ভুল করে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়ে থাকে,” ফোনের ওপাশের ক্লার্ক বলে। “এরকম হয়, বুঝলেন? এক লোক ফিশিং ট্রিপে জঙ্গলের অনেক ভেতরে গিয়ে মারা পড়েছিল। তার সাথের বন্ধুরা তাকে জঙ্গলের ভেতর থেকে বের করতে দুইদিন লাগিয়ে দেয়। ততক্ষনে লাশ ফুলে গিয়েছে। তারপরেও সবাই বিমানের ওপর ভরসা করে লাশ তার বাড়ি গ্রান্ড ফলসে পাঠাতে বিমানে তুলে দেয়। কিন্তু কোন এক গাধা প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে। লাশটা প্রথমে মায়ামি যায়, তারপর ডেস মইন্সে তারপর ফার্গোতে। যতক্ষণে কারো মাথায় গন্ডগোলটা বোঝার মত বুদ্ধি গজায় ততক্ষনে লাশ ফুলে পঁচে কালো হয়ে গিয়েছে। আর লাশের গন্ধ হয়েছিল পচা শূকরের রোস্টের মত, অন্তত সে রকমই শুনেছি। ছয়জন ব্যাগেজ বয় এই মারাত্বক গন্ধে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।”

এরপর ওপাশ থেকে হাসির শব্দ আসে।

লুইস তার চোখ বন্ধ করে এবং বলে, “আচ্ছা, আপনাকে ধন্যবাদ- ‘ “আপনি চাইলে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের নাম্বার আপনাকে দিতে পারি।”

“না, লাগবে না।” লুইস বলে।

সে টেলিফোনটা রেখে দেয়। লুইস, তুমি স্বপ্ন দেখে থাকো আর যাই দেখে থাকো, পাস্কোর লাশ ততক্ষণে দেশের অন্য এক রাজ্যের কোন এক ফিউনারেল হোমে পড়ে ছিল। ঘটনাটা এখানেই কবর দাও।

বাড়িতে ফেরার সময় সে ঘটনাটা নিয়ে আরো চিন্তা করে এবং নিজের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করায়।

পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে এক রকমের স্লিপ ওয়াকিং। আর এটা ঘটার কারণ হলো তার চাকরি পুরোদমে শুরু হওয়ার প্রথম দিনেই তার হাতে একজন শিক্ষার্থী প্রচন্ড আঘাত নিয়ে আসে এবং তার জন্যে সে কিছুই করতে পারেনি।

এতে সব কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। স্বপ্নটা মাত্রাতিরিক্ত বাস্তব মনে হয়েছে, কারণ স্বপ্নটা আসলেই অনেকটুকু বাস্তব ছিল। এজন্যেই তার পাপোশের রোয়ায় পায়ের ছোঁয়া, পায়ে ঘাসের ঠান্ডা শিশিরের স্পর্শ, বাহুতে মড়া ডালের খোঁচা সবই বাস্তব লেগেছে। এজন্যেই পাস্কো দরজার মধ্যে দিয়ে যেতে পারলেও সে নিজে পারেনি।

সে একটা দৃশ্যের কল্পনা করে, মাঝরাতে বন্ধ দরজা দিয়ে বের হতে চাইছে সেটা রাচেল দেখলে কী ভাবতো? ভাবনাটা তার মুখে হাসি ফোটায়।

সে স্বপ্নে পাস্কোর সাথে পেট সেমিটারিতে যাওয়ার কারণটাও ভেবে ফেলল। সেখানে সে গিয়েছে কারণ সম্প্রতি পেট সেমিটারিকে নিয়ে তার আরেকটি বেদনাদায়ক স্মৃতি আছে। তার সাথে তার স্ত্রীর ঝগড়ার কারণ ছিল এই পেট সেমিটারি। সেখানে গিয়েই তার মেয়ের মৃত্যুর সাথে প্রথম পরিচয় হয়। তার অবচেতন মন ঘটনাটা ভোলেনি।

ভাগ্য ভালো যে আমি ঠিকঠাক ফিরতে পেরেছি। আমার তো ফেরার কথা কিছু মনেই নেই। মনে হয় অটোপাইলটে ফিরে এসেছি।

ভাগ্যটা নেহাত ভাল যে পেরেছিল। না হলে তার ঘুম ভাঙতো পেট সেমিটারিতে, স্মাক নামের বিড়ালটার কবরের পাশে, শিশিরে কাদায় মাখামাখি হয়ে। ভয়ে তার তো পাতলা পায়খানা শুরু হতোই, আর তার স্ত্রীর কী হতো সেটা বলাই বাহুল্য।

যাক, আপাতত বাঁচা গেছে। ঘটনাটা ভুলে যাও, লুইস, সে স্বস্তির সাথে ভাবে। হুম, তবে পাস্কো মারা যাওয়ার আগে আমাকে কী বলে গেল? তার মন খচখচ করে উঠে, কিন্তু লুইস সেটাকে চুপ করিয়ে দেয়।

***

সেদিন বিকেলে রাচেলকে হাঁটতে বের হবার কথা বলে সে পেট সেমিটারিতে হাজির হয়। সেখানে পৌঁছেই তার ডেজা ভ্যু’র অনুভূতি হয়। সে যে এখানে এসেছে, তাতে তার মনে আর কোন সন্দেহ থাকে না : ‘বিড়ালের নাম স্মাক’ লেখা স্মৃতিফলকটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। লুইসের স্বপ্নে এই ফলকটিই তার হাতে লেগে উপড়ে পড়ে যায়। লুইস আনমনে ফলকটা ঠিক করে দিয়ে সেই মরা গাছগুলোর ধ্বংসস্তূপের কাছে যায়।

তার একদম ভাল লাগছে না। কাল রাতের মরা ফ্যাকাশে ডালগুলোর মোচড়ামুচড়ির কথা মনে পড়ে তার পেট হালকা একটা মোচড় দেয়। সে মনে জোর খাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা মরা ডাল স্পর্শ করতেই ডালটা হুড়মুড় করে ভূপাতিত হয়। ডালটা লুইসের পায়ের ওপর পড়ার আগেই সে লাফিয়ে সরে যায়।

সে ধ্বংসস্তূপটার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটে যায়। এটার দুপাশের কোন দিক দিয়েই অপর পাশে যাওয়ার উপায় নেই। দুদিকেই বিষাক্ত পয়জন আইভির ঝোঁপ আর কাঁটা গাছে ভরা। কেউ এসব ডিঙ্গিয়ে ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করবে না, অন্তত যদি তার মাথায় ঘিলু বলে কিছু থাকে।

লুইস স্তূপটার মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে জিনিসটা দেখতে থাকে।

তুমি ওটার ওপর চড়ে বসতে চাইছো না তো?

নো বস। ওই বালের ধ্বংসস্তূপের ওপর চড়ে কী হবে?

যাক, আমাকে তো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে লু। জিনিসটা ঠেং ভেঙে নিজের ইনফার্মারিতে ভর্তি হওয়ার জন্য বেশ ভাল ব্যবস্থা।

একদম ঠিক! তাছাড়া চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।

নিজের সিদ্ধান্তের ব্যপারে সে যখন নিশ্চিত, তখন সে হঠাৎ করেই স্তুপটার গা বেয়ে উঠতে থাকে।

সে যখন প্রায় অর্ধেক উঠে গেছে তখন তার পায়ের নিচের ডালগুলো আলগা হয়ে বিপজ্জনকভাবে নড়তে আরম্ভ করে। সে থেমে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই যখন আবারো ডালগুলো নড়তে আরম্ভ করে, লুইস পড়িমরি করে কোন রকমে সেখান থেকে নেমে আসে।

কোন রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই সে নিচে নেমে আসতে পারে। নেমে প্যান্টে হাত ঝেড়ে সে হাতে লেগে থাকা মরা ডালের ছাল বাকলের গুড়োগুলো ফেলে দেয়। এরপর সে হেঁটে পথটার মাথায় চলে আসে, যেটি তাকে পৌঁছে দিবে তার বাড়িতে, তার সন্তানদের কাছে, চার্চের কাছে, যেই চার্চ তার পৌরুষত্বের শেষ দিনটি কাটাচ্ছে।

সে ফিরে যাবার আগে জায়গাটা আরেকবার দেখে নেয়। হঠাৎ করেই ভূমির ওপরে কুয়াশার আবির্ভাব হয়েছে। কুয়াশার দল স্মারকগুলোর ওপরে ভেসে ভেসে পাঁক খাচ্ছে।

শুধু কি এই?

লুইস ধ্বংসস্তূপটায় উঠে এক মুহূর্তের জন্য ওপাশে তাকাতে পেরেছিল। সে শপথ করে বলতে পারে সে ওপাশে একটা পথ দেখেছে।

তাতে তোমার কী লুইস? নিজের কাজে যাও।

ওকে বস।

লুইস ঘুরে নিজের বাড়ির পথ ধরে।

সেদিন রাতে রাচেল বিছানায় যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরেও সে জেগে থাকে। সে তার পূর্বে পড়া কিছু মেডিকেল জার্নালে চোখ বুলাতে থাকে। সে স্বীকার করতে না চাইলেও সে আসলে ঘুমোতে যেতে ভয় পাচ্ছে। তার আগে কখনো ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস ছিল না। আরেকবার না ঘটা পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না এরকম আবারো হবে না।

সে রাচেলকে খাটে উঠতে শুনলো। রাচেল সেখান থেকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, “এই, তুমি আসছো?”

“এখনি আসছি,” সে টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলে।

সেদিন রাতে তার মস্তিষ্ক যন্ত্রের কাজ বন্ধ করতে সাত মিনিটের চাইতে অনেক বেশি সময় লাগে। পাশে রাচেলের লম্বা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে তার কাছে গতরাতের ভিক্টর পাস্কোর চেহারাটা বেশি বাস্তব বলে মনে হতে থাকে। সে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় দরজাটা ধাম করে খুলে যাচ্ছে আর আমাদের স্পেশাল গেস্ট ভিক্টর পাস্কো দরজার ওপাশে জগিং শর্টস পরে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারা ফ্যাকাসে আর কাঁধের হাড় বেরিয়ে আছে।

সে ঘুমে তলিয়ে যেতে লাগলে তার মনে হতে থাকে পেট সেমিটারিতে জেগে উঠলে কেমন লাগবে। সেখানে জেগে উঠে চাঁদের আলোয় জায়গাটা কেমন রহস্যময় লাগবে এবং সেখান থেকে পথটা ধরে বাড়ি ফিরে আসতে কেমন লাগবে, এসব ভাবনা তাকে অগভীর ঘুম থেকে ঝাটকা মেরে টেনে তোলে।

অবশেষে মাঝরাতের দিকে চোরের মত, নিদ্রা তার দেহে প্রবেশ করে

এবং সে এক ঘুমে রাত পার করে দেয়। রাতে সে কোন স্বপ্ন দেখে না। সকাল সাড়ে সাতটায়, জানালায় হেমন্তের ঠান্ডা বৃষ্টির শব্দে তার ঘুম ভাঙে। জেগে উঠে সে ভয়ে ভয়ে গায়ের ওপর থেকে চাদর সরায়। মেঝে আর বিছানায় কোন ময়লার দাগ নেই। তার পায়েও কাদার কোন ছিটেফোঁটা নেই।

গোসল করার সময় সে শিস দিতে থাকে।

অধ্যায় ১৯

রাচেল গেজকে মিসি ডেন্ড্রিজের কাছে রেখে ভেটের কাছে চার্চকে দিয়ে আসে। সেদিন রাতে এলি চার্চের জন্যে বেশ উৎপাত করে। সে রাত এগারটা পর্যন্ত জেগে থাকে। তার কথা, সে চার্চকে ছাড়া ঘুমাতে পারবে না এবং একটু পর পর গ্লাসের পর গ্লাস পানি চাইতে থাকে। শেষে বিছানা ভেজানোর দোহাই দিয়ে লুইস বলে ও আর পানি খেতে পারবে না। আর এর ফলে এলি এমন দুর্বার ক্রোধে কান্না শুরু করে যে লুইস আর রাচেল একে অপরের দিকে হতাশা নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।

“ওর চার্চকে নিয়ে ভয় হচ্ছে,” রাচেল বলে। “নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে।”

এই ভলিউমে ও বেশিক্ষণ চিৎকার করতে পারবে না,” লুইস বলে। “অন্তত সেটাই আশা করি।”

তার কথাই ঠিক। কিছুক্ষণ পরেই এলির কর্কশ চিৎকার ফোঁপানি আর গোঙানিতে পরিণত হয়। এবং অবশেষে আসে নীরবতা। লুইস ওর ঘরে গিয়ে দেখে, ও ফ্লোরে শুয়ে আছে চার্চের ক্যাট-বেডটা জড়িয়ে ধরে, যেটাতে চার্চ আদৌ কখনো ঘুমাতে প্রসন্ন হয়েছে কি না সন্দেহ।

সে সেটাকে এলির হাত থেকে ছাড়িয়ে এলিকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সে এলির কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ওর কপালে চুমু খেল। লুইস আবেগে তাড়িত হয়ে রাচেলের ছোট্ট অফিস রুমটা থেকে একটা কাগজ নিয়ে তাতে বড় বড় করে লিখে-আমি কাল ফিরে আসছি, ভালোবাসা, চার্চ-নোটটা চার্চের ক্যাট বেডের কুশনের সাথে পিন দিয়ে লাগিয়ে দেয় সে। এরপর নিজের রুমে রাচেলের কাছে যায়। তারা তাদের স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার পর্ব চুকিয়ে একে অপরের বাহুডোরে ঘুমিয়ে পড়ে।

লুইসের অফিসের কাজ পুরোদমে শুরু হবার পর প্রথম শুক্রবারে চার্চ ফিরে আসে। এলি তাকে ফিরে পেয়ে বেশ খাতির যত্ন করে। ও নিজের হাতখরচের টাকা দিয়ে চার্চের জন্যে ক্যাট-ট্রিট কিনে আনে, আর গেজ চার্চকে ধরতে চাইলে ও গেজকে প্রায় চড় মেরে বসে। গেজ তাতে খুব কাতর হয়ে কাঁদতে থাকে। তার কাছে এলির তিরষ্কার আর ঈশ্বরের তিরষ্কার একই কথা।

চার্চকে দেখে লুইসের মন খারাপ হয়। চার্চের মধ্যে তার চিরচেনা বুনো আর কু-স্বভাবগুলো অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তার বখাটে ছেলেদের মত হাঁটার ভঙ্গি আর নেই, সে এখন হেলেদুলে হাটে। এলি চার্চকে হাতে করে খাইয়ে দিতে চাইলেও লুইস বাধা দেয় না। চার্চ বদলে গেছে। হয়তো ভালই হয়েছে যে চার্চ বদলে গেছে।

তবে ব্যাপারটা রাচেল বা এলি কারোরই চোখে পড়লো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *