পেট সেমেটারি – ১০

অধ্যায় ১০

“আশা করি এলি ব্যাপারটা নিয়ে একদম ভেঙে পড়েনি,” জাড ক্র্যান্ডাল বলেন। লুইস আবারো ভাবলো, বুড়োর একটা খুব অদ্ভুত এবং কিছুটা বিরক্তিকর ক্ষমতা আছে। কারো ক্ষতস্থান খুঁজে বের করে ফেলার ক্ষমতা।

সে, জাড এবং নরমা বিকেলের ঠান্ডা হাওয়ায় ক্র্যান্ডালদের বারান্দায় বসে আছে। বিয়ারের বদলে আজ তারা পান করছে আইসড টি। সামনে রাস্তায় সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ি ফেরা মানুষের গাড়ির ভিড়। আগামীকাল থেকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। কাল থেকেই ক্যাম্পাসের হলে আর অরিঙ্কোর ফ্লাটগুলোয় শিক্ষার্থীরা ফিরতে শুরু করবে এবং আগামী এক বছর ধরে সকাল ৮টার ক্লাস আর অখাদ্য-কুখাদ্য খাবারের কথা চিন্তা করে কপাল চাপড়াবে। রাচেল আজ সারাটা দিন তার সাথে ঠান্ডা-না শুধু ঠান্ডা না, বরং বরফ শীতল আচরণ করেছে। আর সে এটাও ভালো করেই জানে যে, সে বাসায় ফিরে দেখবে রাচেল এর মধ্যেই শুয়ে পড়েছে। রাচেল আজ শোবে বিছানায় নিজের দিকের একদম কোণ ঘেঁসে, যেন আরেকটু হলেই নিচে পড়ে যাবে। আজ লুইসের বিছানার সীমানা হবে পুরো বিছানার তিন-চতুর্থাংশ, যেটাকে তার কাছে লাগবে বিরান কোন মরুভূমির মত।

“আমি বলছিলাম, আমি আশা করি-”

“সরি,” লুইস বলে। “একটা জিনিস ভাবছিলাম। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এলি একটু আপসেট হয়েছে। কিন্তু আপনি তা কী করে বুঝলেন?”

“অনেক তো দেখলাম জীবনে,” জাড তার স্ত্রীর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে তার দিকে মুচকি হেসে বললেন, “কি বলো, বউ?”

“গন্ডায় গন্ডায়,” নরমা ক্র্যান্ডাল বলেন। “ আমরা দুজনেই বাচ্চাদের অনেক পছন্দ করি।”

“অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ওই পেট সেমেটারিটাই বাচ্চাদের মৃত্যুর সাথে প্রথমবারের মত পরিচয় করিয়ে দেয়।” জাড বললেন। “ওরা যখন টিভিতে কাউকে গুলি খেয়ে পেট চেপে ধরে কার্প মাছের মত তাপড়াতে তড়পাতে মরতে দেখে, ওরা কিন্তু বুঝে যায় যে সেটা অভিনয়। সেটার তুলনায় ওই পাহাড়ের ওপরের পেট সেমেটারিটা অনেক অনেক বেশি বাস্তব, তাইনা?”

লুইস মাথা ঝাঁকায়। সেটা আমার বউকে গিয়ে বলুন, সে মনে মনে বলে।

“অনেক বাচ্চাই ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় তবে অনেকের ক্ষেত্রেই…যেন ওরা তাদের প্যান্টের পকেটে করে ব্যাপারটা বাসায় নিয়ে আসে আর পরে এক সময় সেটা পকেট থেকে বের করে নেড়ে চেড়ে দেখে। বেশিরভাগেরই কিছু হয়না। তবে দুই-এক জনের…নরমা, তোমার হলওয়ে ছেলেটার কথা মনে আছে?”

নরমা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালেন, তাতে তার হাতের আইসড টির গ্লাসের বরফগুলো কড়কড় শব্দ করে উঠলো। তার চশমাটা চেইন দিয়ে বুকে ঝোলানো ছিল এবং সামনের রাস্তায় চলতে থাকা একটা গাড়ির হেডলাইটের আলোতে সেটা হীরের মত ঝকমকিয়ে ওঠে। “ও রাতে খুব খারাপ খারাপ দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল,” নরমা বললেন। “কবর থেকে লাশ উঠে এসে ওকে খামচে ধরতে চাইছে এইরকম কিছু আর কি। এর কিছুদিন পরই ছেলেটার পোষা কুকুরটা মারা যায়। কুকুরটা কিভাবে মারা যায় কেউ ধরতে পারেনি। তবে লোকজনের ধারনা কেউ বিষ মাখা টোপ খাইয়ে কুকুরটাকে মেরে ফেলেছে, তাই না জাড?”

“হুম,” জাড মাথা ঝাকালেন। “অন্তত বেশিরভাগ লোকজন তাই মনে করে। সেটা ১৯২৫ সালের কথা। বিলি হলওয়ের বয়স তখন বড়জোর দশ। ও বড় হয়ে স্টেট সিনেটর হয়। পরে ইউ.এস. হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের জন্যে নির্বাচন করে, কিন্তু হেরে যায়। সেটা কোরিয়া যুদ্ধের কিছু আগের ঘটনা।”

“ও আর ওর বন্ধুরা মিলে কুকুরটার জন্যে ফিউনারেলের ব্যবস্থা করেছিল,” নরমা স্মৃতিচারণ করে বলেন। “কুকুরটা একটা সাধারণ মন্ট্রিয়েল জাতের কুকুর হলেও ছেলেটা কুকুরটাকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসতো। ওর দুঃস্বপ্নের কথা বিবেচনা করে ওর বাবা-মা অবশ্য প্রথমে কুকুরের জন্য শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেছিলেন। তবে শেষে দেখা যায় ওর নতুন করে কোন সমস্য হয়নি। কুকুরটার জন্যে দুটো বড় বড় ছেলে মিলে একটা কফিনও বানিয়ে দিয়েছিল, মনে আছে তোমার, জাড?”

জাড মাথা ঝাঁকান। “ডিন আর ডানা হল,” তিনি বলেন। “ওরা দুজনে আর বিলির এক দোস্ত-নামটা ঠিক মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে বাওয়িদের ছেলে। তোমার বাওয়িদের কথা মনে আছে নরমা? ওই যে যারা মিডল ড্রাইভের একটা বাড়িতে থাকতো?”

“হ্যাঁ!” নরমা খুব উত্তেজনার সাথে বলেন, যেন ঘটনাটা মাত্র গতকালের। হয়তো নরমার কাছে ব্যাপারটা আসলেই তেমনটাই মনে হচ্ছে। “বাওয়িদের ছেলেই। এলান অথবা বার্ট-”

“অথবা ক্যান্ডালও হতে পারে,” জাড মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন। “কে কে কফিনটা বয়ে নিয়ে যাবে তা নিয়ে ওরা তুমুল ঝগড়া লেগে যায়। কুকুরটা ছিল একদম ছোট, তাই কফিনও ছোট আর সেটা বেশি হলে দুজন মিলে বইতে পারবে। হল ছেলেরা বলল যেহেতু কফিনটা ওরাই বানিয়েছে, তারপর আবার তারা দুজন জমজ ভাই, তাই কফিন বহন করার হক তাদেরই বেশি। বিলি বলল তারা দুজন তো বোসারকে চেনেই না। বোসার হলো কুকুরটার নাম। বোসারকে যারা চেনেই না তারা কিভাবে তার কফিন বহন করার দাবি করতে পারে? ‘আমার বাবা বলেছেন বন্ধুরাই কফিন বয়ে নিয়ে যাবার হকদার, কোন কাঠমিস্ত্রী না।” এটা ছিল বিলির যুক্তি।” জাড আর নরমা এক সাথে শব্দ করে হেসে ওঠেন। লুইসের মুখেও একটু শুকনো হাসি ফুটে ওঠে।

“ওরা প্রায় মারামারিই লাগিয়ে দিয়েছিল। আর তখনি বিলির বোন একটা মোটা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বই হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে,” জাড বলেন। “তাদের বাবা ওই সময় এই এলাকার একমাত্র ডাক্তার আর ওই রকম একটা বই কেনার সামর্থ্য একমাত্র তারই ছিল।”

“ওদের বাড়িতেই এই এলাকার প্রথম ইলেক্ট্রিক বাতি জ্বলে।” নরমা ফাঁকে বলেন।

“যাই হোক,” জাড আবারো বলতে শুরু করলেন। “বিলির আট বছরের বোন রাজকন্যার মত চুল দোলাতে দোলাতে, স্কার্টের কাপড় ওড়াতে ওড়াতে বইটা নিয়ে ওদের মাঝে এসে হাজির হয়। ততক্ষণে জমজ ভাইদের সাথে বিলি আর সম্ভবত বেন ক্যান্ডাল প্রায় মারামারি লাগিয়ে দিয়েছে।

লুইস প্রথমে খিল খিল করে হেসে ওঠে। এরপর সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। সে বুঝতে পারে রাচেলের সাথে ঝগড়া করার কারণে তৈরি হওয়া গুমোট ভাবটা তার আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে।

“ওর ছোট বোন এসে বলল, ‘এদিকে দেখ; আর সবাই ঝগড়া থামিয়ে ওর দিকে তাকায়। বিশ্বাস করো লুইস, মেয়েটা বইটার ‘ফিউনারেল’ অধ্যায়টা বের করে রাণী ভিক্টোরিয়ার ফিউনারেলের একটা ছবি দেখায়। ছবিতে দেখা যায় দুপাশে অন্তত চল্লিশজন করে লোক রাণী ভিক্টোরিয়ার কফিনটা কাঁধে তুলে নিয়ে আছে। তাদের কেউ ঘামছে, কেউ মুখ কুঁচকে ফেলেছে। আর তাদের পাশেই ফিউনারেলের কালো পোশাক পরে আরো লোক দাঁড়িয়ে আছে, বদলি হিসেবে। মেয়েটার নাম ম্যান্ডি। ম্যান্ডি ছবিটা দেখিয়ে বলল, স্টেট ফিউনারেলে যত খুশি ততো লোক অংশগ্রহন করতে পারে! বইতে তাই লেখা আছে!”

“এতেই ঝামেলা মিটে গেল?” লুইস জিজ্ঞেস করে।

“হুম। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে বিশটার মত পিচ্চি ওই কুকুরের ফিউনারেল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে। ফিউনারেলের সময় ম্যান্ডি সবগুলো বাচ্চাকে ওই ছবিটার মত করে লাইন ধরে দাঁড় করায়। তবে তাদের মাথায় লম্বা টুপি আর গলায় মালা ছিল না। ম্যান্ডি তার বদলে সবার হাতে একটা করে বুনো ফুল ধরিয়ে দেয়। এই ম্যান্ডি মেয়েটা ইউ.এস. সিনেট নির্বাচনে যখন হেরে গিয়েছিল আমি তখন বুঝেছিলাম আমাদের দেশ একটা রত্ন থেকে বঞ্চিত হলো।” তিনি হাসতে হাসতে তার মাথা ঝাঁকালেন। “যাই হোক, সেদিন থেকেই বিলির দুঃস্বপ্নের শুভ সমাপ্তি।”

লুইসের আবারো রাচেলের হিস্টেরিক আচরণের কথা মনে পড়ে যায়।

“এলি মানিয়ে নিতে পারবে।” নরমা নড়ে চড়ে বসে বলেন। “তুমি নিশ্চয়ই ভাবো আমরা হয়তো দুজনে সারাক্ষণ মৃত্যু নিয়ে ভাবি। হয়তো ভাবাটাই স্বাভাবিক। তাবে জানো কি, আমাদের মধ্যে মৃত্যু চিন্তাটা এখনো সেভাবে ঢুকতে পারেনি।”

“আরে না। এসব ভাববো কেন?” লুইস বলে।

“যাই হোক, মৃত্যু জিনিসটা নিয়ে ভাবা খারাপ কিছু না। ইদানিং টিভিতে প্রায়ই দেখি মৃত্যুর দৃশ্য সেন্সর করে দেয়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে কেউ ভাবতেও চায় না, কথাও বলতে চায় না। আর অনেকে আছে ফিউনারেলে গিয়েও লাশের মুখ দেখতে চায় না। অনেকের ধারনা এসব জিনিস বাচ্চাদের মনে আঘাত দিতে পারে। সব মিলিয়ে মনে হয় মানুষ যেন মৃত্যুকে ভুলে থাকতেই পছন্দ করে।”

“আর সেই একই টিভিতে সেসব জিনিস দেখাচ্ছে যেসব জিনিস মানুষ তাদের শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে করে,” জাড বললেন। এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশনের দূরত্বটা কত অদ্ভুত, তাইনা?”

“হুম,” লুইস বলে।

“আমাদের সময়টা এরকম ছিল না,” জাড অনেকটা ক্ষমা প্রার্থনা করার সুরে বলেন। “আমারা মৃত্যুকে এভাবে ভুলে থাকতে চাইতাম না। আমরা বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্লুয়ের মহামারী রূপ দেখেছি, প্রসূতি মায়ের মৃত্যু, শিশুদের ইনফেকশনে মৃত্যু, এমনকি জ্বরে ভুগেও বহু লোককে মরতে দেখেছি; এসব জ্বর এখনকার ডাক্তারেরা তুড়ি মেরে ভালো করে ফেলে। আমি যখন যুবক ছিলাম তখন কারো ক্যান্সার হয়েছে মানে তার অবধারিত মৃত্যু পরওয়ানা রেডি হয়ে গেছে, এখনকার মত কেমোথেরাপি তো আর ছিল না। দুটো বিশ্বযুদ্ধ, খুন, আত্মহত্যা…”

তিনি একটু চুপ করে গেলেন।

“মৃত্যুকে আমরা বন্ধু এবং শত্রুর মত দু’ভাবেই চিনেছি,” এরপর নীরবতা ভেঙে তিনি বললেন। “আমার ভাই পিট মারা গিয়েছিল অ্যাপেন্ডিক্স ফেটে গিয়ে, ১৯১২ সালে। ওর বয়স তখন চোদ্দ আর ও এলাকার সবার মধ্যে সবচাইতে ভালো বেসবল খেলতো। সে সময় মৃত্যুকে জানার জন্যে কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন পরতো না। মৃত্যু তখন মাঝে মাঝেই অনাহূত অতিথির মত বাসায় এসে হাজির হতো এবং সবার সাথে খাবার টেবিলে বসে ডিনারও করতো আর মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হলে পাছায় কষে লাথি মারতো।”

নরমা তার ‘মার্জিত’ ভাষার কোন প্রতিবাদ না করে মাথা ঝাকান। লুইস উঠে দাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে। “আমি যাই,” সে বলে, “ কাল অনেক ঝামেলার দিন।”

“কাল থেকেই খাঁটুনি শুরু, না কি?” জাড়ও দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন। জাড দেখলেন নরমাও দাঁড়াতে চাইছেন, তাই তিনি তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। চোখ মুখ কুঁচকে নরমা উঠে দাঁড়ালেন।

“আজকে ব্যথা খুব বেশি?” লুইস জিজ্ঞেস করে।

“খুব বেশি না,” নরমা উত্তর দেন।

“গরম কিছুর সেক দিয়ে ঘুমোতে যাবেন।”

“দেব। সব সময়ই দেই। আর লুইস…এলিকে নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করো না। ও ওর নতুন বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে আর ওই জায়গাটা নিয়ে ভাববার কোন ফুসরতই পাবে না। একদিন হয়তো দেখা যাবে এলির বন্ধুরা ওকে নিয়েই জায়গাটার আগাছা পরিস্কার করতে বা ফুলের গাছ লাগাতে যাবে। বাচ্চারা ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর এরকমই করে।”

আমার বউকে গিয়ে বলেন সেটা।

“কাল রাতে সুযোগ পেলে এসে বলে যেও কাজের প্রথম দিন কেমন লাগলো।” জাড বলেন। “ক্রিবেজও খেলবো। গো-হারা হারার জন্যে দাওয়াত রইলো।”

“তাই? তাহলে হয়তো আপনাকে প্রথমে বিয়ার খাইয়ে মাতাল করে নেব,” লুইস কৌতুক করে বলে। “এরপর দেখা যাবে কে কাকে খেলায় নাকানি চুবানি খাওয়ায়।”

“ডাক্তার,” জাড গম্ভীর গলায় বললেন, “যেদিন তোমার কাছে ক্ৰিবেজ খেলায় আমি নাকানি চুবানি খাবো, সেদিন তোমার মত হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে আমি নিজের চিকিৎসা করাব, বুঝলে?”

সবার হাসির মাঝেই রাস্তা পেরিয়ে নিজের বাসার দিকে রওনা হলো সে। চারদিকে গ্রীষ্মের রাত।

রাচেল বাবুকে নিয়ে বিছানায় নিজের পাশের এক কোণায় কুকুরকুন্ডলী হয়ে শুয়ে আছে। লুইস ভাবে, রাচেল এসব মনে রাখবে না-আগেও তাদের সম্পর্কে শীতলতা এসেছে, ঝগড়া হয়েছে, তবে এবারেরটাই সবচাইতে নিকৃষ্ট। তার একই সাথে রাগ, অভিমান আর কষ্টের একটা মিশ্র অনুভূতি হয়। তার ইচ্ছে হচ্ছে তাদের মধ্যের ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে কিন্তু সে বুঝতে পারে না সেটা কিভাবে সম্ভব বা কার প্রথমে ‘সরি’ বলা উচিত। আগেও তাদের মাঝে ঝগড়া হয়েছে, তবে এবারের মত তিক্ত পর্যায়ে কখনোই সেই ঝগড়া যায়নি। এরকম আঘাত তাদের সম্পর্কের অবকাঠামোতে ঘুন ধরিয়ে দেয়ার জন্যে খুব বেশি দরকার নেই, তা লুইস বোঝে। তার বন্ধুরা প্রায়ই তাকে ফোন দিয়ে বলে ‘অন্য কারো কাছ থেকে শোনার আগে তোর আমার কাছ থেকেই শোনা উচিত মনে করলাম লু। আমার আর ম্যাগির ডিভোর্স হচ্ছে…’ এবার হয়তো বন্ধুদের ডিভোর্সের খবর পাওয়ার বদলে নিজের ডিভোর্সের খবর দেয়া লাগবে তার।

সে কাপড় ছেড়ে সকাল ছয়টার এলার্ম সেট করে। এরপর সে গোসল করে, শেভ করে। দাঁত মাজার আগে সে একটা গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ চিবিয়ে খায়। নরমার আইসড টি খেয়ে অথবা রাচেলকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তার পেটে এসিডিটি হয়ে গেছে। সীমানাই সব কিছুর নির্ধারক, কলেজের কোন কোর্সে সে যেন পড়েছিল?

এরপর সে শুতে যায় কিন্তু তার ঘুম আসে না। কিছু একটা মনে খচখচ করছে। পাশেই রাচেল আর গেজের সম্মিলিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সেই শব্দ শুনতে শুনতে তার মাথায় গতকাল আর আজকের ঘটনাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে।

দুনিয়ার সেরা কুকুর ছিল হ্যানা…মার্তা আমাদের পোষা খোরগোশ…

এলির ক্ষেপে ওঠা। চার্চ কক্ষনো মরবে না! ঈশ্বর তার নিজের বিড়াল নিয়ে যা খুশি করুক! রাচেলও কম ক্ষেপলো না। একজন ডাক্তার হিসেবে তোমার জানা উচিত…নরমা ক্র্যান্ডালের কথা, আজকাল লোকে মৃত্যুকে ভুলে থাকতে চায়…আর জাডের যুগ যুগের পুরনো কন্ঠের নিশ্চিতভাবে বলা, মৃত্যু সবার সাথে খাবার টেবিলে বসে ডিনারও করতো আর মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হলে পাছায় কষে লাথি মারতো।

আর জাডের কন্ঠটা তার মায়ের কন্ঠের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। তার মা তাকে চার বছর বয়েসে যৌনতা সম্পর্কে মিথ্যে বলেছিলেন, কিন্তু মৃত্যু নিয়ে সত্য কথাই বলেছিলেন, যখন লুইসের কাজিন রুখি একটা ফালতু গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে নিহত হয়। একটা বাচ্চা ছেলে একটা ট্রাকের ভেতরে চাবি ঝোলানো দেখতে পেয়ে সেটা স্টার্ট করে চালাতে শুরু করে। কিন্তু এরপর বালক আবিষ্কার করে, সে গাড়ি চালাতে জানে না। বালকের ট্রাকটা লুইসের আঙ্কেল কার্লের গাড়িতে গিয়ে আঘাত করে। গাড়িটা একদম দুমড়ে মুচড়ে যায়। রুথি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর ওই বজ্জাত ছেলেটার গায়ে কিছু কাটাছেড়া ছাড়া কোন ক্ষতিই হয়নি বলতে গেলে। ‘ও মরতে পারে না,’ লুইস তার মায়ের দেয়া দুঃসংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিল। সে কথাগুলো শুনলেও তার মানে বের করতে পারছিল না। ‘এসব কী বলছো যে রুথ মারা গেছে? কিসব ফালতু কথা বলছো, মা?’ পরে সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রুথকে কে কবর দেবে?’ কারণ রুথের বাবা, মানে লুইসের আঙ্কেল কার্ল নিজেই একজন আন্ডারটেকার। তার কাজই মানুষের কবর দেয়া নিয়ে। তাই সে ভাবতেও পারেনি সেই কাজটা আঙ্কেল কার্ল তার নিজের মেয়ের জন্যেও করতে পারেন। লুইসের মনে সেদিন এই প্রশ্নটাই ধাঁধার মত ঘুরপাক খাচ্ছিল। ধাঁধাটা হলো শহরের একমাত্র নাপিতের চুল কে কেটে দেয়?

“আমার মনে হয় তোমার আঙ্কেল কার্লের ব্যবসার বন্ধু ডন ডোনাহে কাজটা করবে।” লুইসের মা বলেছিলেন। ওনার চোখগুলো ছিল লাল টকটকে আর তাকে দুশ্চিন্তার ভারে অসুস্থ অসুস্থ লাগছিল। ‘কিন্তু লুইস…ছোট রুথি…আমি ভাবতেও পারছি না ও কি কষ্টটাই না পেয়ে গেছে…ওর জন্যে আমার সাথে প্রার্থনা করো লুইস, ঠিক আছে? রুথির জন্যে আমার সাথে প্রার্থনা করো। আমাকে সাহায্য করো লুইস।”

এরপর তারা মা ছেলে মিলে কিচেনের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করে। আর এই প্রার্থনাই তাকে ব্যাপারটাকে আরো ভালো করে বুঝতে সাহায্য করে। যেহেতু তার মা রুথির আত্মার জন্যে প্রার্থনা করছেন, তার মানে হচ্ছে রুথির দেহটা আর নেই। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনারত অবস্থায় লুইস দেখতে পায় রুথি তার পচতে থাকা দেহটা নিয়ে লুইসের তেরোতম জন্মদিনে উপস্থিত হয়েছে। রুথের পচতে থাকা চোখ দুটো তাদের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে গালের ওপর ঝুলে পড়েছে আর তার লাল চুলে নীল রঙের কিছু ময়লা লেগে আছে। এই বীভৎস দৃশ্য তার মনে শুধু যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তা না। সে রুথির জন্যে এক রকম ভালোবাসাও অনুভব করে।

সে তার জীবনে পাওয়া সবচাইতে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে, “ও মরতে পারে না! আম্মু, ও মরতে পারে না, আমি ওকে খুব পছন্দ করি, মা!”

ওর মায়ের জবাব ছিল, “ও আর নেই। আমি সরি, কিন্তু ও আসলেই আর আমাদের মাঝে নেই। রুথি আসলেই আমাদের ছেড়ে চিরদিনের মত চলে গেছে।”

যে মরে গেছে সে তো চিরতরে চলেই গেছে-আর কী চাই তোমার? লুইস ভেবে কেঁপে ওঠে।

হঠাৎ সে বুঝতে পারে কেন তার নতুন চাকরির আগের রাতে ঘুম আসছে না। তার একটা কাজ বাকি আছে।

বিছানা থেকে উঠে সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ এলির রুমের দিকে মোড় নেয়। এলি বিছানায় মুখ হা করে ঘুমোচ্ছে। কি প্রশান্তই না লাগছে ওর মুখটা। এলির পরনে ছোট হয়ে যাওয়া নীল রং এর একটা বেবি ডল পায়জামা। ওহ ঈশ্বর! এলি তোমার পাজামাটা তো ফেটে যাচ্ছে, লুইস মনে মনে বলে। চার্চ এলির দু পায়ের ফাঁকে মরার মত ঘুমোচ্ছে।

নিচতলার টেলিফোনের পাশে একটা বুলেটিন বোর্ডে অনেক রশিদ, বিল আর ম্যাসেজ পিন দিয়ে সাটা। বোর্ডের ওপর রাচেলের গোটা গোটা হাতের লেখা, “যেসব কাজ কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখা যায়।” লুইস টেলিফোন বুকটা থেকে একটা নাম্বার বের করে একটা কাগজে নাম্বারটা লিখে ফেলে। নাম্বারের নিচে লিখলো: ‘কুয়েন্টিন এল. জুলেন্ডার, ডি ভি এম-চার্চের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্যে ফোন কর-জুলেন্ডার নিজে পশু খাসি না করলেও অন্য কাউকে রেফার করবেন।”

সে নিজের লেখা নোটটার দিকে তাকিয়ে ভাবে এখনই চার্চকে খোজা করা ঠিক হবে কি না। তবে চার্চকে খাসি করা যে আসলেই দরকার সে তা জানে। এতো ঝগড়াঝাটির মধ্য দিয়ে যেন অন্তত ফলপ্রসু কিছু একটা হয়। আজকের দিনে কোন এক সময় তার অবচেতন মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, তার সচেতন মনের অগোচরে। লুইস আসলেই চায় না যে চার্চ তাদের বাড়ির সামনের বিপজ্জনক রাস্তাটার ওপর বেশি ঘোরাঘুরি করুক, অন্তত সেটা বন্ধ করার উপায় যেহেতু একটা আছে।

পুরনো কিছু ভাবনা আবারো তার মনে উঁকি দেয়। চার্চকে খাসি করা হলে সে এই বয়সেই মুটিয়ে একটা অথর্ব হুলো বেড়ালে পরিণত হবে। আশে পাশে কি ঘটছে সে ব্যাপারে ওর আর কোন আগ্রহ থাকবে না, খাওয়ার সময় খাবারের বাটিতে খাবার পেলেই তার চলবে। লুইস চায় না চার্চ তেমনটা হয়ে যাক। চার্চের বুনো স্বভাবটা সে আসলেই ভালোবাসে।

বাইরের রাস্তা দিয়ে একটা ভারি ট্রাক গমগম করতে করতে চলে যায় আর তাতেই লুইস তার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করে ফেলে। সে পিন দিয়ে কাগজটা বোর্ডে সেটে দিয়ে বিছানায় ফিরে যায়।

অধ্যায় ১১

পরদিন নাস্তার সময় এলি বুলেটিন বোর্ডে লুইসের ম্যাসেজটা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে সেটার মানে কী।

“এর মানে চার্চের ছোট্ট একটা অপারেশন হতে যাচ্ছে,” লুইস বলে। “অপারেশনের পরে হয়তো ওকে এক রাত ভেটের কাছে থাকতে হবে। এরপর ও ফিরে এলে ওর বাইরে ঘোরাঘুরির স্বভাব একদম কমে যাবে।”

“রাস্তাটাও আর বেশি পারাপার হবে না?” এলি জিজ্ঞেস করে।

এলির বয়স পাঁচ হতে পারে, তবে সে দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিতে পারে-লুইস ভাবে।

“হ্যা, রাস্তার ওপরও আর বেশি যাবে না,” লুইস সম্মতি জানিয়ে বলে। “ইয়েই!,” এলি খুশি হয়ে বলে আর সেখানেই এই বিষয়ের সমাপ্তি I

লুইস ভেবেছিল চার্চ একরাত বাইরে থাকবে তা শুনে এলি হয়তো উৎপাত শুরু করবে, অবুঝের মত গো ধরবে। কিন্তু এলি এরকম কিছুই করলো না দেখে লুইস বেশ অবাক হয়। আর লুইস এটাও বুঝতে পারে এলি আসলেই চার্চকে নিয়ে মারাত্মক দুশ্চিন্তা করছে। হয়তো রাচেল এলির ব্যাপারে যা বলেছে তা একদম ভুল নয়।

গেজকে নাস্তা খাওয়াতে থাকা রাচেলও তার দিকে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তা দেখে লুইসের মনে হলো তার বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেছে। রাচেলের চোখ বলছে গতকালের ঝামেলাটা এখানেই কবর দেয়া হলো। চিরতরে; লুইস প্রার্থনা করে।

কিছুক্ষণ পরে যখন এলির হলুদ স্কুল বাসটা এসে তাকে নিয়ে চলে গেল, রাচেল তার কাছে আসে। রাচেল দুহাতে লুইসের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে চুম্বন করে। “খুব ভালো করেছো,” রাচেল বলে, “আর আমি সরি যে তোমার সাথে জঘন্য ব্যাবহার করেছি।”

লুইসও রাচেলকে চুমু খায়। তবে একটা জিনিস তার মনে খচখচ করতে থাকে। আর ‘আমি সরি যে তোমার সাথে জঘন্য ব্যবহার করেছি,’ এই কথাটা রাচেলের কাছ থেকে লুইসের প্রথম শোনা নয়। সে এই কথাটা বহুবার শুনেছে। যা চায় তা আদায় করে নেবার পরই রাচেল এটা বলে।

গেজ হাঁটিহাঁটি করে হেলতে দুলতে সামনের দরজার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে উঠলো, “বাস…এলি-বাস।”

“ও খুব দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে,” লুইস বলল।

রাচেল সায় দিলো। “আমি যতটা চাই তার চেয়েও দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে।”

“তবে ডায়াপার ছাড়া পর্যন্ত ওকে বড় হতে দাও, এরপর ওই বয়সে ওকে যতদিন ইচ্ছে আটকে রেখো।”

রাচেল হাসে। ওদের মধ্যকার সব ঝামেলা একদম ঢুকে গেছে। রাচেল একটু পেছনে গিয়ে ওর টাইটা একটু ঠিক করে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলায়।

“ড্রেসটা পাশ না ফেল?” লুইস জিজ্ঞেস করে।

“তোমাকে চমৎকার লাগছে।”

“কেমন চমৎকার? বছরে দু লক্ষ ডলার কামানো হার্ট সার্জনের মত চমৎকার?”

“নাহ, স্রেফ বুড়ো লুইস ক্রিডের মতই,” রাচেল বলে হাসে। “রক অ্যান্ড রোল ভক্ত।”

লুইস তার ঘড়ির দিকে তাকায়। “এই রক অ্যান্ড রোল ভক্তকে এখন জুতো পরে অফিসে যেতে হবে,” বলল সে।

“নার্ভাস?”

“হুম, কিছুটা।”

“নার্ভাস হবার কিছু নেই।” রাচেল বলে। “শিক্ষার্থীদের সর্দিজ্বরের ঔষধ, কাঁটাছেড়ার ব্যান্ডেজ আর মেয়েদের বার্থ কন্ট্রোল পিল দেয়ার জন্যে ওরা তোমাকে বছরে ৬৭ হাজার ডলার দেবে।”

“পাছার ফোঁড়া আর কৃমির কথা ভুলে গেছো,” মুচকি হেসে লুইস বলে।

“তোমার প্রথম দিনটা আশা করি ভালই কাটবে,” বলে রাচেল আবারো তাকে লম্বা চুমু খায়। “আর ভুলে যেও না, তুমি এখন সেখানকার বস, কোন দ্বিতীয় বর্ষের ইন্টার্ন ডাক্তার নও।”

“ওকে ডাক্তারসাহেবা,” সে বিনীতভাবে বললে দুজনেই হেসে ওঠে। লুইসের একবার মনে হচ্ছিল ও জিজ্ঞেস করে, ‘এতো কিছুর পেছনের কারণ কি জেন্ডার মৃত্যু, রাচেল? ও কিভাবে মারা গিয়েছিল?’ তবে সে তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করে না; এখনো সময় হয়নি। ডাক্তার হিসেবে সে দুই-একটা বিষয় জানে। সে জানে জন্মের মত মৃত্যুও একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আবার এটাও জানে যে কোন আধা শুকানো ঘায়ে গুতোগুতি করতে নেই।

তাই সে কিছু জিজ্ঞেস না করে রাচেলকে আবারো চুমু খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।

দিনের শুরুটা ভালোই হলো। মেইনে এখন পুরোদস্তুর গ্রীষ্মের রূপ। পরিস্কার নীল আকাশ আর বাহাত্তর ডিগ্রী তাপমাত্রা। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি বের করতে করতে সে ভাবে ঝরা পাতার সৌন্দর্যের সময় এখনো আসছে না কেন?

সে তাদের হোন্ডা সিভিক গাড়িটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঘোরায়। এটা তাদের দু নম্বর গাড়ি। রাচেল আজই ভেটকে ফোন করে চার্চকে ফিক্স করার ব্যবস্থা করবে। তাতেই হয়তো পেট সেমেটারি নিয়ে তৈরি হওয়া সকল ঝামেলাকে তারা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারবে। সেপ্টেম্বরের এই রকম একটা চমৎকার সকালে মৃত্যুর মত বিরস একটা বিষয় নিয়ে ভাবার কোন মানেই হয় না।

লুইস গাড়ির রেডিও ছেড়ে স্টেশান পাল্টে পাল্টে নিজের পছন্দের একটা গান খুঁজে বের করে। সে গানটার সাথে সাথে হেড়ে গলায় গাইতে শুরু করে। তার গানের গলা জঘন্য হলেও সে বেশ আনন্দ পাচ্ছে।

অধ্যায় ১২

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকেই লুইস রাস্তায় অসহনীয় ট্রাফিকের পাল্লায় পড়ে। রাস্তায় গাড়ি, বাইক আর জগিং করতে থাকা লোকজনে গিজগিজ করছে। এরইমধ্যে বাইক আর জগারদের তার গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগা থেকে বাঁচাতে বেশ কয়েকবার হার্ড ব্রেক কষতে বাধ্য হয়েছে সে। সোল্ডার বেল্টটা ভালো করে লক করে নিয়ে বিরক্তি নিয়ে হর্ন বাজাচ্ছে। জগার আর বাইকারদের লুইস কখনোই পছন্দ করে না। তারা রাস্তায় নামার আগে তাদের কান্ডজ্ঞানটা বাসায় ফ্রিজে রেখে আসে। যেহেতু তারা বাইক চালাচ্ছে সেহেতু তাদের কোন দায়িত্ব নেই, সব দায়িত্ব গাড়িওয়ালাদের। শত হোক, তারা তো এক্সারসাইজ করছে। তাদেরই একজন লুইসকে মধ্য-আঙ্গুলি দেখিয়ে দিলো। লুইস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি চালিয়ে যায়।

ইনফার্মারির পার্কিং লটে অ্যাম্বুলেন্সটা নেই। নতুন অফিসে প্রথম দিনেই গোড়ায় গলদ। ইনফার্মারিটা যেকোন অসুখ বা অ্যাক্সিডেন্টের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে উপযোগী। এখানে রোগ নির্নয়ের যন্ত্রপাতি ভরা তিনটি রুম, আর পনের বেড সম্বলিত দুটি ওয়ার্ড আছে। কিন্তু এখানে অপারেশান থিয়েটার তো দূরের কথা, ওই জাতীয় কিছুর খালাতো ভাইও নেই। কোন বড় অ্যাক্সিডেন্টের ক্ষেত্রে ওই অ্যাম্বুলেন্সটাই একমাত্র ভরসা। সেটাতে করেই রোগিকে ইস্টার্ন মেইন মেডিকেল সেন্টারে পাঠানো হয়। এখানকার সহযোগী ফিজিশিয়ান স্টিভ মাস্টারটন ওকে গত দু-বছরের লগ দেখিয়েছে। ওই সময়ে মাত্র আটত্রিশবার অ্যাম্বুলেন্সটা ব্যাবহার করা হয়েছে রোগিকে বড় কোন হাসপাতালে পাঠানোর কাজে। দশহাজার শিক্ষার্থী সহ মোট সতেরহাজার জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যাটা অবশ্য নেহায়েত খারাপ না।

আর সেখানে তার অফিসের প্রথম দিনই অ্যাম্বুলেন্সটা জায়গা মত নেই। তবে কি বড় কোন অ্যাক্সিডেন্টের পেশেন্টকে নিয়ে অন্য কোন হাসপাতালে গেছে সেটা?

সে নতুন ‘রিজার্ভ ফর ডা. ক্রিড’ লেখা স্পটে নিজের গাড়িটা পার্ক করে দ্রুত অফিসের দিকে গেল।

চার্লটনকে সামনে পেয়ে গেল সে। চার্লটন ধূসর চুলের পঞ্চাশোর্ধ ছোটখাট এক মহিলা। একটা জিন্স আর টপ পরা মেয়ের গায়ের তাপমাত্রা মাপছে। মেয়েটার গায়ের তাজা সানবার্ন লুইসের চোখ এড়ালো না।

“গুড মর্নিং, জোয়ান,” লুইস বলে। “অ্যাম্বুলেন্সটা কোথায়?”

“আহা কী ঝামেলা, দেখুন তো,” চার্লটন তরুণীর মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করে রিডিং দেখতে দেখতে বলল। “স্টিভ মাস্টারটন আজ সকালে এসে দেখে অ্যাম্বুলেন্সটা নষ্ট। সেটা ঠিক করতে পাঠানো হয়েছে।”

“চমৎকার!” সার্কাস্টিকভাবে লুইস বললেও মনে মনে একটু খুশিই হয়। অন্তত কোন গুরুতর রোগিকে নিয়ে তো অ্যাম্বুলেন্সটাকে যেতে হয়নি। “আমরা অ্যাম্বুলেন্সটা ফিরে পাবো কখন?”

জোয়ান চার্লটন মৃদু হেসে বলে, “আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ঠিক করার লাইনের দৈঘ্য সম্পর্কে যদ্দুর জানি তাতে মনে হয় ১৫ ডিসেম্বরে ক্রিসমাস রিবনে মুড়ে গাড়িটা ফেরত দেবে ওরা।” এরপর রোগি তরুণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার হাফ ডিগ্রি জ্বর হয়েছে। দুটো অ্যাসপিরিন খাবে আর মদের বার এবং অন্ধকার গলি থেকে দূরে থাকবে।”

মেয়েটা লুইসের দিকে একটা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে বেড থেকে নেমে বাইরে চলে গেল।

“নতুন সেমিস্টারের প্রথম কাস্টমার,” চার্লটন থার্মোমিটারটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল।

“অবশ্য তা নিয়ে আপনাকে খুব একটা খুশি মনে হচ্ছে না।”

“এরা কে কেমন আমি সব বুঝি,” বলল সে। “এদের এক টাইপ হচ্ছে অ্যাথলেট। তারা ফাটা হাড়, ফোলা পা নিয়েও মাঠে খেলতে নামতে চায়, কারণ তা না করলে নাকি তাদের দল তাকে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়বে, তাদের জায়গা হবে সাইড বেঞ্চে। তাদের সুপারম্যান হতে হবে, কিন্তু তাতে যে তাদের ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। আর এক শ্রেণী আছে এই মেয়ের মত মিস হাফ ডিগ্রি জ্বর। তারা একেক জন ননীর পুতুল।” লুইসকে ইশারা করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। লুইস সানবার্নওয়ালা মেয়েটিকে দেখতে পেল ছাত্রি হলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটি পরীক্ষার হল থেকে জ্বরের ছুঁতো দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। সে এমনভাবে হাঁটছে যেন সে খুব দূর্বল, ঠিকঠাক হাঁটতেও পারছে না।

“বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে অতিসচেতন শিক্ষার্থী,” চার্লটন থার্মমিটারটা স্টেরালাইজারে রেখে বলল। “এই মেয়ে বছরে অন্তত দুই ডজন বার এখানে আসবে। তার প্রিলি পরীক্ষা যত ঘনিয়ে আসে এখানে তার হাজিরাও তত বেড়ে যায়। ফাইনাল পরীক্ষার আগে তার মনে হবে টাইফয়েড বা নিউমোনিয়া হয়েছে, না-হলে অন্তত ব্রংকাইটিস। সে চার-পাঁচটা পরীক্ষা কামাই দেবে, বেছে বেছে যেসব বিষয়ের শিক্ষক একটু গাধা টাইপের সেসব পরীক্ষা। সেসব পরীক্ষা পরবর্তীতে তুলনামুলক সহজ প্রশ্নে মেকাপ পরীক্ষার মাধ্যমে পুষিয়ে নেবে। আবার এরা যখন জানতে পারে ফাইনাল বা প্রিলিতে রচনামূলকের পরিবর্তে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা হবে, তাদের অসুস্থ হবার সম্ভাবনা আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।”

“বাপরে। আপনি তো ওদের চামড়া খুলে মনের কথা সব জেনে নিয়েছেন,” লুইস একটু অবাক হয়ে বলল।

“এসব মাথায় রাখবেন না। আমিও রাখি না,” বলে লুইসকে একটা চোখ টিপে দিলো।

“স্টিভ কোথায়?”

“আপনার অফিসে। বিভিন্ন মেইলের রিপ্লাই দিচ্ছে আর অসংখ্য ফালতু ফাইলপত্র সামলানোর চেষ্টা করছে,” বলল সে।

তার রুমে গেল লুইস।

***

সেদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা সে মনে করতে চায় না বা সেটা সহ্য করতে পারে না। সেদিনের দুঃস্বপ্ন শুরু হয় যখন ভিক্টর পাস্কো নামের একটা মুমূর্ষ রোগিকে সকাল ১০টার দিকে ইনফার্মারিতে নিয়ে আসা হয়। এর আগে সব ঠিকঠাকই ছিল। লুইসের অফিসে পৌঁছানোর আধ ঘন্টা পর, ৯টার দিকে দুজন মেয়ে নার্স এসে উপস্থিত হয়। লুইস প্রথমে তাদের প্রত্যেককে ডোনাট আর কফি অফার করে। এরপরের পনেরো মিনিট ধরে মেয়ে দুটিকে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়। তাদের ম্যানেজ করার দায়িত্বটা বুঝে নেন চার্লটন। চার্লটন যখন মেয়েদুটোকে লুইসের রুম থেকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন লুইস শুনলো সে তাদের বলছে, “তোমাদের কারো মানুষের বমি বা গুয়ে অ্যালার্জি আছে? এখানে এগুলো প্রচুর দেখবে কিন্তু।”

ওহ্ ঈশ্বর!” লুইস নিজের চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল। তবে সে মিটিমিটি হাসছে। সে জানে, চার্লটনের মত একজন দজ্জাল মহিলার প্রয়োজন আছে এখানে।

লুইস একটা নীল ফর্ম পূরন করতে শুরু করে। খুবই বিরক্তিকর কাজ যখন ভাবছে যে এই ফালতু কাজটা করতে হলে অন্তত তার আগে তাকে এক কাপ কফি গেলা লাগবে, তখনই সে ওয়েটিং রুম থেকে চিৎকার শুনতে পায়। “লুইস! এদিকে আসুন। এখানে খুবই খারাপ অবস্থা!”

মাস্টারটনের গলায় স্পষ্ট আতঙ্ক। সে সেই আতঙ্কের পরিপ্রেক্ষিতে তার চেয়ার থেকে উঠে সেদিকে এমনভাবে ছুটে যায় যেন সে এতক্ষণ এরকম একটা চিৎকারের জন্যেই অপেক্ষা করছিল।

মাস্টারটনের চিৎকারের উৎপত্তিস্থল থেকে আরেকটি আর্তচিৎকার শোনা গেল। এরপরই একটা ঠাস করে চড়ের আওয়াজ এবং চার্লটনের রাগান্বিত গলা, “নিজেকে ঠিক কর, না হলে এখান থেকে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও।”

লুইস ছুটে ওয়েটিং রুমে ঢুকে। আর ঢুকে প্রথমেই যা দেখতে পেল তা হচ্ছে রক্ত। রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। একটা নার্স মেয়ে কাঁদছে আর আরেকজন প্রবল আতঙ্কে নিজের মুখ চেপে ধরে আছে। মাস্টারটন হাঁটু গেড়ে বসে মুমুর্ষ ছেলেটার মাথা ধরে আছেন। ছেলেটা মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছে।

স্টিভ লুইসের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছে, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না।

লোকজন মেডিকেল সেন্টারের কাচের দরজার সামনে ভিড় জমাচ্ছে।

কাচে আলোর রিফ্লেকশন থেকে বাঁচার জন্যে কেউ কেউ নিজেদের হাত দুটোকে কাপের মত গোল করে কাচের ওপর রেখে তার ভেতর দিয়ে তাকাচ্ছে। মুমুর্ষ ছেলেটাকে দেখা তাদের চাই-ই চাই। ব্যাপারটা দেখে লুইসের অবচেতন মন লুইসের ছোটবেলার সাদৃশ্যপূর্ণ একটা ঘটনা স্মৃতির পাতা থেকে খুঁজে বের করে আনে। তার বয়স তখন ছয়। তার মা কাজে বের হবার একটু আগের ঘটনা। সে টিভিতে টুডে শো নামে একটা প্রোগ্রাম দেখছিল। প্রোগ্রামটা হচ্ছিল একটা স্টুডিওতে যেটার এক পাশের দেয়াল কাচের। কাচের ওদিকে উৎসুক জনতার ভিড়। তারা স্টুডিওর ভেতরের অতি পরিচিত মুখগুলো দেখার জন্যে আগ্রহী।

লুইস খেয়াল করলো উৎসুক জনতা মেডিকেল সেন্টারের জানালা দিয়েও উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করেছে। দরজাটার ব্যাপারে কিছু না করা গেলেও-

“জানালার পর্দাগুলো টেনে দাও,” লুইস চিৎকার করা নার্স মেয়েটিকে ধমকের সুরে বলে।

মেয়েটা তাও নড়ে না। চার্লটন আবারো মেয়েটার গালে চড় মারলে তার সম্বিত ফিরে আসে। “যা বলছে করো, মেয়ে!”

মেয়েটা ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার সবুজ পর্দাটা টেনে দেয়। আর চার্লটন এবং মাস্টারটন দরজা থেকে ছেলেটাকে যতটুকু সম্ভব আড়াল করে বসা যায়, সেভাবে বসে।

“স্ট্রেচার আনবো, ডাক্তার?” চার্লটন জিজ্ঞেস করলেন।

“লাগলে নিয়ে আসুন,” লুইস মাস্টারটনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলল।

“আমি এখনো পেশেন্টকে দেখার সুযোগই পেলাম না।”

“যাও, নিয়ে এসো,” যে মেয়েটা পর্দা লাগিয়েছে চার্লটন সেই মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন। মেয়েটি আবারো আতঙ্কে তার দুহাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরেছে। সে চার্লটনের দিকে তাকায় এবং তার মুখ দিয়ে অস্ফুটে কিছু শব্দ বেরিয়ে আসে, “ওহ, ইয়ে…”

“ওহ! ইয়ে! যাও এক্ষুনি নিয়ে এসো,” চার্লটন এতো কিছুর মধ্যেও মেয়েটিকে ভেঙ্গাতে ছাড়লেন না। এরপর তিনি মেয়েটাকে হালকা চাপড় দিয়ে স্ট্রেচার আনতে পাঠালেন।

লুইস বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে তার প্রথম কাস্টমারের ওপর ঝুঁকে পড়লো।

ছেলেটা যুবক, বয়স বিশের মত হবে। ছেলেটাকে ডায়াগনোসিস করতে তার তিন সেকেন্ড সময় লাগলো। এই সময়ে করা তার একমাত্র ডায়াগনোসিস হচ্ছে ছেলেটার বাঁচার কোন আশা নেই। মাথার অর্ধেক থেতলে গেছে, ঘাড় ভেঙে গেছে আর ডান কাঁধের কলার বোন বেরিয়ে এসেছে। তার মাথা থেকে রক্ত আর হলদে পুঁজের মিশ্রণের মত একটা তরল পদার্থ মেঝের কার্পেটে গড়িয়ে পড়ছে। লুইস ছেলেটার ভাঙা খুলির ফাঁকা দিয়ে ধূসর মস্তিস্ক দেখতে পাচ্ছে। ব্যাপারটা অনেকটা ভাঙা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে দেখার মত। তার মস্তিস্কে তখনো পালস হচ্ছিল। তার মাথায় প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটারের মত একটা ফোকরের সৃষ্টি হয়েছে। ছেলেটার মাথার ভেতর কোন বাচ্চা থাকলে হয়তো সে ওই ফোকর দিয়ে সেটা প্রসবও করতে পারবে, পুরাণের দেবতা জিউস যেভাবে তার কপাল থেকে বাচ্চা প্রসব করে সেভাবে। সে যে এখনো বেঁচে আছে সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। লুইস তার মাথার ভেতর জাড ক্র্যান্ডালের কথা শুনতে পায়। তিনি বলছেন, ‘ইচ্ছে হলে পাছায় কষে লাথি মারতো’ আর তার মায়ের কন্ঠ, ‘যে মরে গেছে সে তো চিরতরে চলেই গেছে।” হঠাৎ তার পাগলের মত হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো।

“অ্যাম্বুলেন্স স্টার্ট করতে বলো,” সে উদ্বিগ্ন কন্ঠে মাস্টারটনকে বলে। “আমাদের এক্ষুনি ওকে—”

“লুইস, অ্যাম্বুলেন্স তো -”

“ওহ, ঈশ্বর!” লুইস হতাশায় নিজের কপালে হাত রেখে বলে। এরপর সে চার্লটনের দিকে ফিরে বলে, “জোয়ান, এরকম পরিস্থিতিতে আপনারা কী করেন? ক্যাম্পাস সিকিউরিটিতে খবর দেন নাকি ইএমএমসি’তে?”

জোয়ানের মুখে হতাশার ছাপ। তাকে এরকম আপসেট হতে আগে কখনোই দেখেনি লুইস। তবে তিনি বেশ দৃঢ় গলায় জবাব দিলেন, “জানি না ডাক্তার। এরকম পরিস্থিতিতে জীবনেও আমাকে পড়তে হয়নি।”

লুইস খুব দ্রুত চিন্তা করে। “ক্যাম্পাস পুলিশে খবর দিন। ইএমএমসির অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে বসে থাকা ঠিক হবে না। পুলিশের গাড়িতে অন্তত সাইরেন আছে। জোয়ান, আপনি ব্যবস্থা করুন গিয়ে।”

জোয়ান উঠে চলে গেলেন। কিন্তু তার চলে যাওয়ার আগেই লুইস জোয়ানের চোখের সহমর্মিতার দৃষ্টিটা দেখতে পায়। এই পেশিবহুল, রোদে পোড়া চামড়ার ছেলেটির হয়তো গ্রীষ্মে রাস্তার কন্সট্রাকশনের কাজ বা বাড়ি রং এর কাজ অথবা কাউকে টেনিস শিখিয়ে এমনটা হয়েছে। কিন্তু ছেলেটার এখন যে অবস্থা তাতে তারা যত চেষ্টাই করুক না কেন বা বাইরে রাস্তায় যদি তাদের অ্যাম্বুলেন্সটা ঠিকও থাকতো তাহলেও তার বাঁচার কোন আশা ছিল না।

কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে মৃতপ্রায় ছেলেটা নড়ে চড়ে ওঠে। তার চোখের পাতা কেঁপে উঠে খুলে যায়। তার চোখে নীল মনির চারদিকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ছেলেটার চোখ দুটো শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সে কিছু দেখতে পারছে না। ছেলেটা তার মাথা নাড়তে চাইলে লুইস মাথাটা চেপে ধরে, কারণ ছেলেটার ঘাড় ভেঙে গেছে। তার মাথা থেতলে গেলেও ব্যথার অনুভূতি এখনো আছে।

ওর খুলির ফোকর…ওহ ঈশ্বর…

“ওর কী হয়েছিল?” লুইস স্টিভকে জিজ্ঞেস করে যদিও সে জানে পরিস্থিতি বিচারে প্রশ্নটা আহাম্মকের মত শোনাচ্ছে। উৎসুক জনতার প্রশ্নের মত। তবে ছেলেটার মাথার অবস্থা বলে দিচ্ছে, সে আসলে উৎসুক জনতার চাইতে বেশি কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না। “ওকে কি পুলিশের লোক নিয়ে এসেছে?”

“না কিছু শিক্ষার্থী চাদরে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছে। আসলে কী হয়েছিল কিছুই জানি না।”

কী হয়েছিল জানতে না পারলেও কি করতে হবে সেটা ঠিক করা লুইসের কর্তব্য। “বেরিয়ে গিয়ে ওদেরকে খুঁজে বের করুন। ওরা যেন কাছাকাছি থাকে তবে ওদের অন্যদিকে নিয়ে যান। আমি চাই না ওরা এই জিনিস আরও দেখুক, যথেষ্ট দেখেছে ওরা।”

মাস্টারটন যেন এখান থেকে সরতে পেরে একটু স্বস্তি পেল। সে দরজা খুলে বাইরে গেল এবং এরপর বাইরে থেকে তার বকবকানির শব্দ আসতে থাকে। লুইস পুলিশের সাইরেন শুনতে পায়। ক্যম্পাস সিকিউরিটি চলে এসেছে তাহলে। লুইস হাফ ছেড়ে বাঁচে।

মুমুর্ষ ছেলেটা গলা দিয়ে ঘর্ঘর্ শব্দ বেরুচ্ছে। সে কথা বলতে চাচ্ছে তবে কিছু অস্পষ্ট ধ্বনি ছাড়া কিছুই তার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না।

লুইস তার দিকে ঝুঁকে বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে…সব ঠিক হয়ে যাবে।” যদিও লুইস জানত কিছুই ঠিক হয়ে যাবে না। হঠাৎ রাচেল আর এলির কথা মনে পরে গেলে লুইসের পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে তার মুখে এক হাত চেপে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া একটা ঢেকুর আটকায়।

“ক্যা…” ছেলেটি বলল। “গ্যা…’

লুইস চারদিকে তাকিয়ে দেখে মৃতপ্রায় ছেলেটির সাথে এই মুহূর্তে সে ছাড়া আর কেউ নেই। সে শুনতে পায় চার্লটন নার্সদের চেঁচিয়ে বলছেন যে স্ট্রেচারটা দুই নাম্বার রুমে আছে। লুইস ভাবে, ওই নার্সেরা দুই নাম্বার রুমের চাইতে ঘোড়ার ডিম ভাল চিনবে, কারণ আজ ওই নার্সদেরও এখানে প্রথম দিন। তারা মেডিকেল জীবন খুব কঠিনভাবেভাবে শুরু করল। মেঝের কার্পেটে ছেলেটার থেতলানো মাথার চারদিকে একটা ভেজা, স্যাঁতসেঁতে বেগুনি বৃত্ত তৈরি হয়েছে। তবে ছেলেটার মাথার ছিদ্র দিয়ে তরলের প্রবাহ আপাতত বন্ধ হয়েছে।

“পেট সেমিটারিটা,” ছেলেটা কর্কশ গলায় বলে উঠলো…আর তার মুখে একটা রহস্যজনক হাসি ফুটে উঠেছে।

লুইস তার নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সে নিজেকে বোঝাল ছেলেটা আগের মতই অস্ফুট কিছু শব্দ করেছে কিন্তু তার নিজের অবচেতন মন সেটাকে তার চেনা কিছু মনে করে নিয়েছে। তবে তার এই ভাবনা যে ভুল, তা সে মুহূর্তখানিক পরেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। আতঙ্কের একটা শিহরণ তার সারা শরীর বেয়ে ঢেউয়ের মত বয়ে যায়।

“কী বললে তুমি? “ লুইস বিড়বিড় করে।

এবার কথা বলতে শেখা টিয়া পাখির মত পরিস্কার গলায় ছেলেটা বলে, “ওটা আসল কবরস্থান না।” তার রক্ত জমাট বাধা চোখে রাজ্যের শূন্যতা আর মুখটা মরা কার্প মাছের মত হা হয়ে আছে।

লুইসের শরীরে আবারো কাঁটা দিয়ে ওঠে। আতঙ্কে তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তার ইচ্ছে হয় মেঝেতে পড়ে থাকা মাথা থেতলানো লাশটাকে ফেলে দৌড়ে পালাতে। তার ধর্ম কর্ম নিয়ে তেমন কোন জ্ঞান নেই। কোন কুসংস্কারেও সে বিশ্বাস করে না। সে এরকম একটা ঘটনার জন্যে একদমই প্রস্তুত ছিল না।

দৌড়ে পালানোর প্রবল ইচ্ছা দমন করে সে ছেলেটার দিকে আরও ঝুঁকে আবারো জিজ্ঞেস করে, “কী বললে তুমি?”

মৃত মানুষটার মুখের বাঁকা হাসি…খুব ভয়ংকর ব্যাপারটা।

“মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে, লুইস।” মৃতপ্রায় লোকটা ফিসফিসিয়ে বলে। “মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।”

লুইস নিজের নাম শোনার পর আর কিছুই মনোযোগ দিয়ে শোনে না। ওহ ঈশ্বর! ছেলেটা আমার নাম ধরে ডাকছে!

“কে তুমি?” লুইস কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে। “কে তুমি?”

“ইন্ডিয়ান, আমার মাছ নিয়ে এসো।”

“তুমি কিভাবে আমার নাম-‘

“দূরে থেকো, আমাদের। জানো -”

“তুমি-”

“ক্যা,” যুবক বলে আর লুইস যেন মৃত্যু, বেদনা আর হারানো ছন্দের মিশ্র গন্ধ পেল তার নিশ্বাস।

“কি?” লুইসের তাকে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করার জিদ চেপে বলে।

“গ্যা আ আ আ -”

লাল জিম শর্টস পড়া ছেলেটার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে। এরপর হঠাৎ তার শরীরের সবগুলো পেশী শক্ত হয়ে একদম নিথর হয়ে যায়। তার চোখগুলোর শূন্যতা এক মুহূর্তের জন্যে লোপ পায় আর সে লুইসের চোখের দিকে তাকায়। কিন্তু এর পরমুহূর্তেই যেন একসঙ্গে সব হারিয়ে গেল। সেখানে একটা কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। লুইস ভাবে, ছেলেটা অবশ্যই আবার কথা বলে উঠবে। এরপর ছেলেটির চোখগুলোতে আবারো শূন্যতা ফিরে আসে…আর চকচক করতে থাকে। ছেলেটা মরে গেছে।

লুইস পিছিয়ে বসে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে চপচপ করছে। সে চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে আর তার চারপাশের দুনিয়া দুলতে শুরু করে। কি হচ্ছে বুঝতে পেরে সে নিজের বাম হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনির নখ দিয়ে দাঁতের মাড়ি এমন জোড়ে চেপে ধরে যে রক্ত বেরিয়ে আসে।

কয়েক মুহূর্ত পর তার দুনিয়া আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে।

অধ্যায় ১৩

একটু পরেই রুমটা লোকজনে ভরে যায়, যেন তারা সকলেই মঞ্চ নাটকের অভিনেতা, পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসার সংকেতের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ব্যাপারটা লুইসের অবাস্তববোধ আরও বাড়িয়ে দেয়-সবকিছু এরকম অবাস্তব লাগাটা সে তার সাইকোলজি কোর্সে পড়েছে, তবে আগে কখনো বাস্তবে অনুভব করেনি। ব্যাপারটা ওকে একদম ভড়কে দেয়। সে ভাবলো, কেউ এলএসডি ড্রাগ নিলে হয়তো এমনি অনুভব করে।

ঠিক যেন শুধুমাত্র আমার উদ্দেশ্যে করা একটি নাটক। প্রথমে সবাই রুম ছেড়ে আমাকে মৃতপ্রায় ভবিষ্যত বক্তার কাছে একদম একা রেখে গেল, যাতে করে সে আমাকে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে, আর যখনি তার দম ফুরালো, হুট করে সবাই ফিরে এল।

নার্স দুজন হার্ড স্ট্রেচারের দুপাশে ধরে ছুটতে ছুটতে এলো। এই স্ট্রেচারটা তারা মেরুদন্ডে বা ঘাড়ে আঘাত পাওয়া রোগিদের জন্যে ব্যবহার করে। তাদের পেছন পেছন আসতে আসতে জোয়ান চার্লটন বললেন পুলিশ আসছে। ছেলেটা জগিং করতে গিয়ে গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছে। লুইসের ওইসব জগারদের কথা মনে পড়ে গেল যারা সকালেই তার গাড়ির সামনে দৌড়ে এসে পড়েছিল। কথাটা মনে পড়ে তার পেটে মোচড় দিয়ে ওঠে।

চার্লটনের পেছন পেছন ঢুকে মাস্টার্টন, তার সাথে দুজন পুলিশ। “লুইস যারা পাস্কোকে এখানে নিয়ে এসেছে তারা…” সে থেমে ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করলো, “লুইস, তুমি ঠিক আছ?”

“হ্যাঁ, ঠিক আছি,” বলে সে উঠে দাঁড়ালো। তার মাথা আবারো চক্কর দিয়ে উঠলে সে চারদিক হাতড়ায়, তবে পরমুহূর্তেই ভাল লাগতে থাকে। “ওর নাম তাহলে পাস্কো?”

ক্যাম্পাস পুলিশদের একজন বলল, “ওর সাথে জগিং করছিল একটি মেয়ে, সে বলল ওর নাম ভিক্টর পাস্কো।”

লুইস তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দুই মিনিট বিয়োগ করলো। যে রুমটায় পাস্কোকে বয়ে আনা ছেলে-মেয়েগুলোকে মাস্টার্টন রেখে এসেছিল, সেখান থেকে একটি মেয়ের বুকফাটা কান্না ভেসে আসছে। ভার্সিটিতে ফিরে আসায় স্বাগতম তোমাকে, সে মনে মনে বলে। নতুন সেমিস্টারের জন্যে শুভকামনা রইলো। “মিস্টার পাস্কো দশটা নয়ে মারা গেছেন,” লুইস বলল।

পুলিশদের মধ্যে একজন হাতের পেছনে মুখ মুছলো।

মাস্টার্টন আবারো জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আসলেই ঠিক আছো লুইস? তোমাকে অসুস্থ লাগছে।”

লুইস জবাব দিতে কেবল মুখ খুলেছে, তখন হঠাৎ নার্সদের মধ্যে একজন হাতের স্ট্রেচার ফেলে দৌড়ে বের হয়ে কোলের কাপড়ের ওপর বমি করতে শুরু করে। একটা ফোন কর্কশভাবে বাজতে শুরু করলো। কাঁদতে থাকা মেয়েটি এবার চিৎকার করে বিলাপের সুরে মৃত ছেলেটির নাম বারবার আওড়াতে লাগলো, ভিক! ভিক! ভিক!” সব মিলিয়ে যেন একটা পাগলা গারদ। বিশৃঙ্খলার চুড়ান্ত। পুলিশদের একজন একটা চাদর চাইলো ছেলেটিকে ঢেকে দেয়ার জন্যে। চার্লটন বললেন তিনি জানেন না তার সেটা দেয়ার এখতিয়ার আছে কি না। আর লুইস মরিস সেন্ডাকের একটা লাইন ভাবতে লাগলো, তাহলে কেওস শুরু হয়ে যাক!

আবারো কুৎসিত হাসিটা তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলে সে অনেক কষ্টে নিজেকে থামায়। এই পাস্কো ছেলেটা কি আসলেই পেট সেমেটারির কথা বলল? সে কি আসলেই তার নাম বলেছে?

ভাবনাগুলো তার মাথায় জট পাকিয়ে দিচ্ছে। তবে তার মস্তিষ্ক এখনই তাকে অদ্ভুত ব্যাপারটার অস্বাভাবিকতা থেকে রক্ষা করতে চাইছে। সে যা শুনেছে অবশ্যই তা তার শোনার ভুল। ছেলেটা অন্য কিছু বলেছে (আদৌ যদি কিছু বলে থাকে), তবে তার বিক্ষিপ্ত মন সেগুলোকে ভুল ব্যাখ্যা করেছে। আসলেই হয়তো পাস্কো কিছু অবোধ্য শব্দ উচ্চারণ করেছে, সে প্রথমে যেমনটা ভেবেছিল।

লুইস নিজেকে ফিরে পেতে চেষ্টা করে। সেই লুইসকে, যাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তেপ্পান্নজন আবেদনকারীর মধ্যে থেকে বেছে নিয়েছে। এখানে সব গোলমাল পাকিয়ে গেছে, কিন্তু নেতৃত্ব দেয়ার মত কেউ নেই।

“স্টিভ, ওই মেয়েটাকে একটা ট্রাঙ্কুলাইজার ইঞ্জেকশন দাও,” সে বলল এবং বলা মাত্রই তার ভাল লাগতে শুরু করে। তার মনে হয় সে কোন রকেটে করে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং অল্পের জন্য একটা গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষ এড়ানো গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে গ্রহাণুটা হচ্ছে পাস্কোর কথা বলে ওঠা। লুইসের কাজ এখানের দায়িত্ব নেয়া, আর সে তাই করবে।

“জোয়ান, পুলিশের লোকটিকে একটা চাদরের ব্যবস্থা করে দিন”

“ডক্টর, চাদরগুলো আমরা এখনো ইনভেন্টরিতে -”

“তবুও দিন। তারপর ওই নার্সকে দেখুন।” সে অপর নার্স মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটি সম্মোহিতের ন্যায় পাস্কোর লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। “নার্স!” লুইস কর্কশ গলায় বলে এবং তাতে মেয়েটি নজর ঝাটকা মেরে সরে গেল।

“হুম… কি?”

“ওই মেয়েটির নাম কী?”

“কোন মেয়ে?”

“যে বমি করলো,” লুইস আরো কর্কশভাবে বলে। “জু-জু-জুডি। জুডি লেসিও।”

“আর তোমার নাম?”

“কার্লা।” এবার মেয়েটিকে কিছুটা স্বাভাবিক শোনায়।

“কার্লা, জুডির কী হয়েছে দেখো। আর চাদরটা নিয়ে এসো। এক্সামিনিং রুম ১-এর আলমারিতে অনেকগুলো চাদর আছে। সবাই যাও। প্লিজ সবাই পেশাদার ব্যবহার করুন।”

সবাই কাজে লেগে পড়ে। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাশের রুমের মেয়েটির কান্নার আওয়াজ থেমে গেল। রিং বন্ধ হয়ে যাওয়া ফোনটায় আবারো রিং হচ্ছে। লুইস রিসিভার না তুলেই হোল্ড বাটন চেপে দেয়।

বয়স্ক পুলিশটিকে লুইসের তুলনামূলক সুস্থির মনে হলো তাই লুইস তার সাথে কথা বলে। “কাকে কাকে ব্যপারটা জানাতে হবে? আমাকে একটি লিস্ট দিতে পারেন?”

পুলিশ লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “এরকম ঘটনা গত ছয় বছরে একবারো দেখিনি। খুব বাজেভাবে সেমিস্টারটা শুরু হলো।”

“হুম,” লুইস বলে। সে ফোনটা তুলে নিয়ে হোল্ড বাটনটা উঠিয়ে দেয়। “হ্যালো, কে?” একটি উত্তেজিত কন্ঠ শোনা গেলে লুইস ফোনটা কেটে দেয়। সে তার ফোন কলগুলো করতে শুরু করলো।

অধ্যায় ১৪

লুইস এবং রিচার্ড ইরভিং, ক্যাম্পাস সিকিউরিটির প্রধান মিলে প্রেসের সামনে স্টেটমেন্ট দেয়ার পরে পরিস্থিতি শান্ত হতে হতে বিকেল ৪টা বেজে যায়। ভিক্টর পাস্কো নামের ছেলেটা তার দুই বন্ধুর সাথে জগিং করছিল, তাদের একজন তার হবু বউ। লেঞ্জিল ওমেন্স জিমনেসিয়াম থেকে ক্যাম্পাস সেন্টারের দিকে আসা একটি দ্রুতগতির প্রাইভেট কার তাকে আঘাত করে, ঠেলেঠুলে একটি গাছের সাথে ধাক্কা দেয়। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন ট্রিমন্ট উইদারস। পাস্কোকে তার বন্ধুসহ আরো দুই পথচারি একটি চাদরে জড়িয়ে ইনফার্মারিতে নিয়ে আসে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যায় সে। উইদারস পুলিশের কাস্টডিতে আছে। তার বিরুদ্ধে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো, বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং গাড়ি দিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে।

ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক জিজ্ঞেস করলেন পাস্কো মাথার আঘাতেই মারা গিয়েছে কি না। লুইসের সেই ভাঙা জানালার কথা মনে পড়ে যায়, যেটা দিয়ে সে পাস্কোর মাথার ভেতরের ব্রেইন দেখতে পাচ্ছিল। তবে সে বলল, মৃত্যুর কারণটা সে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের জন্যেই ছেড়ে দিচ্ছে। সম্পাদক আবার জিজ্ঞেস করলেন যে, যেই চারজন মিলে তাকে চাদরে পেচিয়ে ইনফার্মারিতে নিয়ে এসেছিল, তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে পাস্কোর মৃত্যুর জন্য কোন অংশে দায়ি কি না।

“না,” লুইস জবাব দেয়। “একদমই না। দুঃখের বিষয় পাস্কোর আঘাতই তার মৃত্যুর জন্যে দায়ি।”

আরো কিছু প্রশ্ন হয়েছিল, তবে লুইসের এই উত্তরটাই বলতে গেলে প্রেস কনফারেন্সের ইতি টানে। স্টিভ মাস্টার্টন প্রেস কনফারেন্সের পরপরই বাড়ি চলে গিয়েছে-নিজেকে সন্ধ্যার খবরে দেখার জন্যে, লুইস ভাবে। সে এখন তার অফিসে বসে আছে, সারাদিনের কাজগুলো গোছানোর চেষ্টা করছে। অথবা স্বাভাবিক রুটিন অনুসরণ করে দিনের ঘটনাগুলি ভুলতে চাইছে কিছুটা। সে এবং চার্লটন মিলে ‘ফ্রন্ট ফাইল’-এর কার্ডগুলো দেখছে। কার্ডগুলো সেসব শিক্ষার্থীদের, যারা নানা রকম অসুখ-বিসুখ নিয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। তেইশজনের ডায়াবেটিস, পনের জনের মৃগি, চৌদ্দজনের দুই পা পঙ্গু আরো আছে লিউকেমিয়ার রোগি, বিকলাঙ্গ, অন্ধ, দুজন বধির এবং একজন সিকেল-সেল এনেমিয়ার রোগি, যা সে আগে কখনো দেখেনি পর্যন্ত।

দুপুরের সবচাইতে বাজে ঘটনা বোধ হয় ঘটে স্টিভের চলে যাওয়ার পরপর। চার্লটন একটা পিঙ্ক মেমো লুইসের ডেস্কে রাখে যাতে লেখা, ব্যাঙ্গর কার্পেট কোম্পানির লোক আগামীকাল ৯টায় আসবে।

“কার্পেট?” সে জিজ্ঞেস করেছিল।

“আমাদের কার্পেটটা বদলাতেই হবে,” তিনি ক্ষমার সুরে বললেন। “যে দাগ লেগেছে সেটা কোন ভাবেই উঠবে না।”

অবশ্যই উঠবে না। লুইস গিয়ে ডিসপেন্সারি থেকে নিয়ে একটা টুইনাল ট্যাবলেট খেয়ে নিলো, যেটাকে ওর মেডিকেল কলেজের রুমমেট টুনাল বলতো। “টুনারভিল ট্রলিতে চেপে বস, লুইস।” সে বলতো, “তোর ভেতরে কিছু আত্মবিশ্বাস ঢুকিয়ে দেই।” লুইস বেশির ভাগ সময়ই রুপকথার টুনারভিলে বেড়াতে যাওয়ার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতো। তার সেই রুমমেট টুনারভিল ট্রলিতে চেপে তার তৃতীয় সেমিস্টারে একদম ভিয়েতনাম চলে যায়, মেডিকেল কোরের সৈনিক হিসেবে। লুইস মাঝে মাঝে সেখানে তাকে কল্পনা করতো, গাজা খেয়ে চোখ লাল করে জঙ্গলে দৌড়াচ্ছে।

কিন্তু তার আজ সেই টুনারভিলের টিকিট একটা নিতেই হলো। কারণ সে বোর্ডে লাগানো সেই কার্পেটের পিঙ্ক স্লিপটির দিকে একদন্ডও তাকাতে পারছিল না।

হেড নার্স মিসেস বেইলিংস এসে যখন তাকে খোঁচা দিয়ে বললেন, “লুইস, আপনার ফোন, এক নাম্বার লাইনে,” তখন সে ঘোরের মধ্যে আছে।

লুইস তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৫:৩০ বাজে। আরো দেড় ঘন্টা আগেই তার এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা।

“ওকে, ন্যান্সি। থ্যাঙ্কস।”

ফোন তুলে এক নাম্বার লাইন টিপে দিলো সে। “হাই রাচেল। আমি একটু—”

“লুইস, তুমি ঠিক আছো?”

“হ্যাঁ, ঠিক আছি।”

“আমি খবরটা শুনেছি, লু। আই এম সরি।” সে কয়েক মুহূর্তের জন্যে থামলো। “রেডিওর খবরে শুনলাম। তোমার কথাও ছিল, প্রশ্নোত্তর পর্বটা। তুমি সব ভালো ভাবেই বলেছো।”

“তাই? ভালোই তাহলে।”

“সত্যি তুমি ঠিক আছো?”

“হ্যা রাচেল, আমি ঠিক আছি।”

“বাসায় এসো,” সে বলল।

“আসছি,” সে বলল। তার কাছে বাড়িতে যাওয়ার কথাটা খুব মধুর শোনালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *