পেট সেমেটারি – ১

অধ্যায় ১

লুইস ক্রিড তার বাবাকে হারিয়েছে তিন বছর বয়সে, আর দাদাকে তো দেখার সৌভাগ্যই হয়নি। মাঝ বয়সে এসে বাবার মত একজন মানুষ পাবে, তা সে কল্পনাতেও ভাবেনি। কিন্তু ঘটল ঠিক তাই…যদিও সে লোকটিকে নিজের বন্ধু বলে থাকে। যে লোকটির তার বাবা হওয়া উচিত ছিল, তাকে মাঝবয়সে এসে পেলে আর কী-ই বা ডাকা যায়? লোকটির সাথে লুইসের প্রথম দেখা হয় সেদিন, যেদিন বিকেলে সে তার নতুন সাদা বাড়িতে ওঠে। সাথে ছিল তার স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়ে। আর ছিল উইনস্টন চার্চিল, ওরফে চার্চ। চার্চ তার মেয়ের বিড়াল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে একটি বাড়ি খোঁজার কাজ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ঠিক করে দেয়া অনুসন্ধান কমিটি করেছে গদাই লস্করি চালে। একটি “খাসা” বাড়ি খুঁজে বের করতে যেন তাদের কালঘাম ছুটে গেছে।

ক্রিড পরিবারের সবাই বিরক্ত। গেজ হৈচৈ, কামড়া-কামড়ি করে হুলুস্থুল করছে। সে ঘুমাবে না, রাচেল যতই তাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাক না কেন। তাকে রুটিনের বাইরে বাড়তি দুধও দেয়া হয়েছে। গেজ শিশু হলেও নিজের দুধ খাবার রুটিন খুব ভালোভাবে জানে, এমন কি হয়তো তার মায়ের চাইতেও ভালো জানে। কিন্তু সে দুধ খাওয়ার সময় মাকে নিজের নতুন দাঁতগুলো দিয়ে বিচ্ছিরিভাবে কামড়ে দিচ্ছে। নিজের শহর শিকাগো থেকে মেইনে বাসা বদলানোটা ভালো হলো না মন্দ হলো সেই বিষয়ে রাচেল এখনো শতভাগ নিশ্চিত না। সে হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে। মায়ের দেখাদেখি আইলিনও কান্নায় যোগ দেয়। স্টেশন ওয়াগনটার পেছনে চার্চ অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছে, যেমনটা সে গত তিনদিনের ভ্রমণের পুরোটা সময় জুড়ে করছে। খাঁচার ভেতরে বন্দি চার্চের মরা কান্নায় ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে সাড়ে সর্বনাশ হয়েছে। মাথা খেয়ে ফেলছে বিড়ালটা।

লুইসের নিজেরই কাঁদতে মন চাচ্ছিল। বুনো একটি আইডিয়া তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আইডিয়াটি তার বেশ পছন্দও হচ্ছে। আইডিয়াটি হচ্ছে, সে সবাইকে বলবে তারা ব্যাঙ্গর টাউনে ফিরে মুভিং ট্রাকের জন্যে অপেক্ষা করবে। আর তার পরিবারের তিন রত্নকে গাড়ি থেকে নামিয়েই সে গাড়ির স্পিড তুলে পালিয়ে যাবে, একবারও পেছনে না ফিরে। সে দক্ষিণ দিকে ড্রাইভ করে অর্ল্যান্ডো, ফ্লোরিডা পর্যন্ত যাবে। সেখানে গিয়ে ডিজনি ল্যান্ডে মেডিকেল অফিসারের চাকরি নেবে, ছদ্মনামে। অবশ্য পথে সে একবার গাড়ি থামিয়ে বজ্জাত বিড়ালটাকে বাইরে ছুড়ে ফেলবে।

একটুবাদেই, একটা লম্বা বাঁক নেয়ার পর বাড়িটা দেখা যায়। বাড়িটা আগে শুধু লুইস দেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেছে দেয়া সাতটা বাড়ি দেখে এ বাড়িটাই তার পছন্দ হয়েছে। বাড়িটা বেশ বড়, ইংলিশ ঔপনিবেশ আমলে তৈরি। তবে নতুন করে অনেক কাজ করা হয়েছে বসবাসের জন্য। দেয়ালের কাজ, ইনসুলেশনের কাজ নতুন করে করা হয়েছে। বাড়ি গরম রাখার খরচ যথেষ্ট বেশি হলেও তা সহনীয়। নিচতলায় তিনটি আর ওপরতলায় চারটি রুম। সাথে একটা বড় শেড আছে যেটায় পরে আরও রুম করা যাবে। বাড়ির চারদিক ঘিরে বেশ বড়সড় চমৎকার একটা উঠোন। আগস্টের গরমেও উঠোন সবুজ হয়ে আছে।

বাড়ির পেছনে বাচ্চাদের খেলার জন্য বিশাল মাঠ। আর ওই মাঠের পেছনে দুচোখ যদ্দুর যায় তদ্দুর পর্যন্ত বন-জঙ্গল। বাড়ির সীমানা একদম সরকারি খাস জমি ঘেঁসে। বাড়ির রিয়েন্টর বলেছে অদূর ভবিষ্যতে আশেপাশে অন্য কোন স্থাপনা নির্মাণেরও সম্ভাবনা নেই। মিকমেক ইন্ডিয়ানদের অবশিষ্ট বংশধরেরা আট হাজার একর জমি দাবি করছে লাডলো এবং তার পূর্ব দিকের শহরগুলোতে। কিন্তু সেই জমির মামলা এমন কচ্ছপের গতিতে এগুচ্ছে যেন তা জীবনেও শেষ হবে না।

রাচেল কান্না থামিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো “এটাই?”

“এটাই,” লুইস বলল। তার দুশ্চিন্তা না, হয়তো ভয় লাগছে। কিন্তু আসলে সে আতঙ্কিত। তাদের জীবনের বারোটা বছর এই বাড়ির পেছনে বন্ধক রেখেছে সে। সেটা পরিশোধ হতে হতে আইলিনের বয়স হয়ে যাবে সতেরো।

সে ঢোক গিলল।

পেট সেমিটারি

“আমার তো দেখে ভালোই লাগছে,” রাচেলের কোথায় লুইসের মন থেকে একটা বড় পাথর নেমে গেল। রাচেলের একাগ্র দৃষ্টিই তাকে বলে দিচ্ছে কথাটা সে নিছক ঠাট্টা করে বলেনি। বাড়ির পিচঢালা ড্রাইভওয়েতে মোড় নিতে নিতে সে দেখলো রাচেলের দৃষ্টি বাড়ির কালো জানালাগুলোর ওপর ছুঁয়ে যাচ্ছে। হয়তো ও এখনই ভাবছে কী রঙের পর্দা সে জানালায় টাঙাবে, আলমারির ওপরে কেমন রেক্সিন বিছাবে, আর খোদাই জানে আর কোন বিচিত্র ভাবনা!

“বাবা?” এলি পেছন থেকে ডাকে। সেও কান্না বন্ধ করেছে। এমনকি গেজও হৈচৈ থামিয়ে দিয়েছে। লুইস এই নীরবতা খুব উপভোগ করছে।

“কী, মামনি?”

রিয়ারভিউ আয়নায় সে দেখলো, রাচেলের কালচে স্বর্ণকেশের নিচের চোখজোড়া বাড়িটাকে, সামনের খোলা উঠানকে, বামের বাড়িটার ছাদকে আর জঙ্গল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ মাঠটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

এটাই কি আমাদের বাড়ি?” আইলিন জিজ্ঞেস করে।

“এখনো না, তবে শিগগিরই হতে যাচ্ছে, মামনি।”

“হুররে!” এলি চেঁচিয়ে উঠে কান ফাটিয়ে দেয় তার। লুইস যদিও মাঝে মাঝে এলিকে নিয়ে বিরক্ত হয়, তবুও সে তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিল, মেয়েকে নিয়ে সে ডিজনি ওয়ার্ল্ডে যাবে।

শেডের সামনে পার্ক করে ওয়াগনটার ইঞ্জিন অফ করে দিল লুইস। ইঞ্জিন ‘টিক’ করে শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। শিকাগোর কোলাহল, স্টেট স্ট্রিটের ছোটাছুটির পর এখানকার নীরবতাটা বেশ গভীর মনে হচ্ছে। বেলা শেষের এই আরামদায়ক নীরবতার মাঝেই একটা পাখি মিষ্টি করে গেয়ে উঠলো।

“আমাদের বাড়ি,” বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে রাচেল নরম গলায় বলল।

“বাড়ি,” রাচেলের কোল থেকে গেজ বলল।

লুইস এবং রাচেল চট করে একে অপরের দিকে তাকায়। রিয়ারভিউ মিররে আইলিনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

“তুমি কী….. “ও কী…”

“এটা কী হলো?”

তারা সবাই একসাথে বলে ওঠে এবং পরমুহূর্তেই একসাথে হাসতে শুরু করে। গেজ কিছু খেয়াল করে না, সে শুধু তার আঙুল চুষে যাচ্ছে। সে একমাস আগে “মা” বলতে শিখেছে, আর “বাআআ” অথবা ঐ জাতীয় কিছু বলার চেষ্টা করছে। সেটা লুইসের অভিলাষী মনের জল্পনাও হতে পারে।

কিন্তু, কাকতালীয় হোক বা বাকিদের দেখাদেখি হোক, এটা ছিল একটি পূর্ণ শব্দ। বাড়ি।

লুইস তার স্ত্রীর কোল থেকে গেজকে ছো মেরে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে।

লাডলোতে তাদের আগমন ঠিক এভাবেই।

অধ্যায় ২

লুইসের কাছে সেই মুহূর্তটা সবসময় মায়াবী মনে হয়, হয়তো মুহূর্তটাতে আসলেই মায়া করার মত কিছু আছে। তবে তার প্রধান কারণ দিনের বাকি বিকেলটা কাটে খুব ঝামেলায়। পরের তিন ঘন্টায় না ছিল শান্তির ছিটেফোঁটা, না ছিল কোন জাদু বা মায়ার দেখা।

লুইস খুব সাবধানে বাড়ির চাবিটা একটা ছোট ম্যানিলা খামে ভরে উঠিয়ে রেখেছিল (আমাদের লুইস ক্রিড খুব গোছালো শ্রেনীর লোক)। চাবি ভরে খামের ওপর লিখেছিল ‘লাডলো বাড়ির চাবি, প্রাপ্তি জুন ২৯।” খামটা যে সে গাড়ির গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে রেখেছে, তা তার স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু খামটা এখন সেখানে নেই।

যখন সে ক্রমশ বাড়তে থাকা বিরক্তি নিয়ে চাবিটা গরুখোঁজা করছে, রাচেল তখন গেজকে কোলে তুলে আইলিনের পিছু পিছু হাঁটছিল। সে যখন গাড়ির সিটের নিচে তৃতীয়বারের মতো খুঁজে চলছে, তার মেয়ের চিৎকার তার কানে আসে।

“লুইস!” রাচেল ডাকল। “আইলিন হাঁটু কেটে ফেলেছে।”

আইলিন টায়ারের দোলনা থেকে পড়ে গেছে আর ওর হাঁটু গিয়ে পড়েছে একটা কোণা বেরিয়ে থাকা পাথরের ওপর। কাটাটা গভীর না, কিন্তু আইলিনের চিৎকার শুনে লুইসের মনে হচ্ছে (একটু নির্দয়ভাবেই) কেউ ওর পুরো পা কেটে বাদ দিয়েছে। লুইস রাস্তার ওপাশের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে সেটার বসার ঘরে বাতি জ্বলছে।

“এলি, থামো। যথেষ্ট হয়েছে!” লুইস বলল। “ওই বাড়ির লোকেরা ভাববে এখানে কাউকে খুন করা হচ্ছে।”

“ব্যথা করে তো!”

লুইস তার বাড়ন্ত রাগ চেপে ওয়াগনটাতে ফিরে যায়। চাবিগুলো পাওয়া না গেলেও ফার্স্ট এইড কিটটা গ্লাভ কম্পার্টমেন্টেই পাওয়া গেল। সেটা নিয়ে ফিরে আসে লুইস। আইলিন সেটা দেখে আগের চাইতেও ভীষণভাবে চিৎকার করতে শুরু করে।

“না! ঐটা লাগালে জ্বলে…আমি ঐটা দেব না, বাবা! না!”

“আইলিন, এটা একটা কাটাছেঁড়ার মলম। আর এটা লাগালে জ্বলবে না!”

“একটু সাহস করো, মামনি,” রাচেল বলল। “এটা লাগালে একটুও—”

“না-না-না-না-না।”

“চুপ করো! না হলে একটা থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব,” লুইস ধমকে ওঠে।

“ও খুব ক্লান্ত, লু,” রাচেল মৃদু স্বরে বলল।

“আমার নিজের তো খুউব চাঙ্গা লাগছে! ভালো করে ওর পা চেপে ধরো।”

রাচেল গেজকে নামিয়ে রেখে আইলিনের পা’টা চেপে ধরলে লুইস মারকিউরোক্রোম মলম লাগিয়ে দেয়, ওদিকে আইলিন মৃগীরোগির মতো চিৎকার করতে থাকে।

“ওই বাড়ির সামনের বারান্দায় কেউ একজন বেরিয়ে এসেছে,” রাচেল বলে। সে গেজকে কোলে তুলে নেয়। গেজ ঘাসের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছিল।

“চমৎকার” লুইস বিড়বিড় করে বলল।

“লু, ও?”

“ক্লান্ত, জানি।” সে ওষুধের মুখ লাগিয়ে তার মেয়ের দিকে গম্ভীরভাবে

তাকায়।

“শেষ। একটুও ব্যথা পাওনি এলি, স্বীকার করো।”

“পাচ্ছি! সত্যি পাচ্ছি! ব্যথা-”

মেয়েটাকে চড় মারার জন্যে তার হাত নিশপিশ করতে থাকে।

“চাবি পেয়েছো?” রাচেল জিজ্ঞেস করল।

“এখনো পাইনি,” ফার্স্টএইড কিটটা খটাস করে বন্ধ করে লুইস বলে, “আমি দেখছি।”

এবার গেজ চিৎকার করতে শুরু করে। সে শুধু অস্থির হয়ে কান্না করছে না, রীতিমত বুকফাটা আর্তনাদ করছে রাচেলের কোলে মোচড়াতে মোচড়াতে।

“ওর কী হলো?” ওকে লুইসের দিকে অন্ধের মত ঠেলে দিয়ে রাচেল চেঁচিয়ে উঠলো। ডাক্তার বিয়ে করার একটা সুবিধা হলো যখনি মনে হবে বাচ্চা মরে যাচ্ছে, তখনি বাচ্চাকে স্বামীর হাতে গছিয়ে দেয়া যায়, লুইস ভাবে। “লুইস, কি…

বাবুটা ভয়ে তার ঘাড় খাবলে খাবলে ধরছে। লুইস ওকে ঝাটকা মেরে ঘুরিয়ে দেখল ওর ঘাড়ের একটা জায়গা পুতির মতো ফুলে উঠেছে। তাছাড়া ওর জাম্পারের ফিতায় কিছু একটা লেগে আছে, যা ঝাপসা আর দুর্বলভাবে মোচড়ামুচড়ি করছে।

আইলিন এতক্ষণে একটু শান্ত হয়েছিল। কিন্তু ও আবারো চেঁচিয়ে ওঠে, “মৌমাছি! মৌমাছি! মৌমাছিইইইই!” সে লাফিয়ে পিছিয়ে যায় এবং আবার সেই একই পাথরে হোঁচট খেয়ে উল্টো দিকে ধাম করে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে ব্যথা আর ভয়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ও ভাইয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে।

আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, লুইস বিস্মিত হয়ে ভাবল। উই ই ই ই!

“কিছু করো লুইস! দেখো না কিছু করতে পার কি না?”

“হুলটা বের করতে হবে,” ওদের পেছন থেকে একটা ধীর কণ্ঠ বলল। “তাছাড়া কাজ হবে না। হুলটা বের করে বেকিং সোডা লাগিয়ে দিলেই ফোলা কমে যাবে।” কিন্তু কণ্ঠটা এতো ভারি আর আঞ্চলিক টানে ভরা ছিল যে, লুইসের ক্লান্ত, বিভ্রান্ত মন কিছুই বুঝতে পারল না।

সে মাথা ঘুরিয়ে একজন সত্তুরের ঘরের (সুস্থ এবং শক্তসামর্থ্য) বুড়োকে ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। লোকটার গায়ে শার্টের ওপর কাঁধের বেল্ট দিয়ে পা পর্যন্ত লম্বা পোশাক পরা। শার্টের কলারের ফাঁক দিয়ে তার ঘাড়ের ভাজ পড়া কোঁকড়ানো চামড়া উঁকি দিচ্ছে। তার মুখের চামড়া রোদে পোড়া, তিনি একটি ফিল্টার ছাড়া বিড়ি টানছিলেন। লুইস দেখলো লোকটা সহজেই তার বুড়ো আঙুল আর তজর্নির মাঝখানে পিষে হাতের বিড়িটা নিভিয়ে ফেললেন। বৃদ্ধ তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে কুটিলভাবে হাসলেন, হাসিটা লুইস এক নজরেই পছন্দ করে ফেলে। কাউকে চট করে পছন্দ করে ফেলার মানুষ সে না।

“তোমার কাজ তোমাকে শেখানোর জন্যে বলছি না, ডাক্তার,” তিনি বললেন। এভাবেই জাডসন ক্র্যান্ডালের সাথে লুইসের প্রথম পরিচয়। এই সেই লোক, যেই লোকটার উচিত ছিল লুইসের বাবা হওয়া।

অধ্যায় ৩

রাস্তার ওপাশ থেকে তিনি ওদের আসতে দেখে রাস্তা পেরিয়ে চলে আসেন। তাদের হযবরল অবস্থা দেখে ভেবেছেন হয়তো তিনি তাদের কোনো সাহায্য করতে পারবেন।

লুইস বাবুকে ধরে রাখা অবস্থায় ক্র্যান্ডাল এগিয়ে এসে বাবুর ঘাড়ের ফোলা দেখলেন। এরপর তিনি নিজের খড়ির মতো, কোচকানো চামড়া মোড়ানো হাত কাজে লাগিয়ে দিলেন। রাচেল ব্যাপারটায় বাঁধা দেয়ার জন্যে মুখ খুললে তার হাতটা খুব আনাড়ি মনে হচ্ছিল আর সেটা আকারে অনেকটা গেজের হাতের সমান। কিন্তু কিছু বলার আগেই বুড়োর আঙুলগুলো কাজটা মিটমাট করে ফেলে, ঠিক যেভাবে কেউ তাসের খেলা দেখায় বা ম্যাজিশিয়ান পয়সার ভেলকি দেখায়। আর মৌমাছির হুলটা তার তালুর মধ্যে পড়ে থাকে।

“হুম, বেশ বড়,” তিনি মন্তব্য করলেন। “প্রথম পুরস্কার না পেলেও বিশেষ পুরস্কার পাওয়ার মতো বড় হুলটা।” লুইস গলা ফাটিয়ে হাসে বুড়োর রসিকতায়।

ক্র্যান্ডাল লুইসের দিকে তাকিয়ে নিজের সেই কুটিল হাসিটা হাসলেন। “খুব শান্তশিষ্ট ও, তাই না?” আইলিনকে ইঙ্গিত করে বললেন তিনি।

“মা, উনি কী বললেন?” আইলিন জিজ্ঞেস করলে রাচেলও হাসিতে ফেটে পড়ে। ব্যাপারটা খুব অভদ্রের মতো হলেও কেন যেন চমৎকার শোনালো। ক্র্যান্ডালও চেস্টারফিল্ডের প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি নিয়ে নিজের ঠোঁটের কোনায় দিয়ে তাদের হাসাহাসিতে হৃষ্টচিত্তে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন। এমনকি গেজও হুলের ব্যথা সত্ত্বেও শব্দ করে খিলখিল করে উঠে। তার বুড়ো আঙুল দিয়ে একটা ম্যাচের কাঠি ফস করে জ্বালিয়ে ফেললেন। বুড়োদের বেশ ভালো ট্রিকস জানা আছে, লুইস ভাবে। ছোট ছোট ট্রিকস, তবে সেগুলোর মধ্যে কিছু ট্রিকস আসলেই দারুণ।

সে হাসি বন্ধ করে তার এক হাত বাড়িয়ে দেয়, যে হাতে গেজ পাছা দিয়ে বসে ছিল না। গেজের ডায়াপার একদম স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। “আপনার সাথে দেখা হওয়ায় খুব খুশি হলাম, মিস্টার-”

“জাড ক্র্যান্ডাল,” তিনি হাত ঝাকাতে ঝাঁকাতে বললেন। “তুমিই তাহলে সেই ডাক্তার, না কি?”

“হ্যাঁ। লুইস ক্রিড। এ আমার স্ত্রী রাচেল, ও আমার মেয়ে এলি, আর মৌমাছির হুল খাওয়া পিচ্চিটা গেজ।”

“তোমাদের সবার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো হলো।”

“আমি আসলে ঠিক ইচ্ছে করে হাসিনি…মানে আমরা ঠিক বুঝে হাসিনি…আসলে আমরা…একটু ক্লান্ত।”

নিজেকে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে না পারে সে আবারো মুখ চেপে হেসে ওঠে। খুবই ক্লান্ত লাগছে তার।

ক্র্যান্ডাল মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলেন, “অবশ্যই।” তিনি রাচেলের দিকে তাকালেন। “মিসেস ক্রিড, তুমি তোমার বাবু আর কন্যাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে একটু? একটা রুমালে বেকিং সোডা দিয়ে ফোলা জায়গাটায় লাগিয়ে দেয়া দরকার। আমার স্ত্রীও তোমাদের সাথে পরিচিত হতে চায়। ও খুব একটা বের হয় না বাসা থেকে। বাতের ব্যথায় গত দু তিন বছর ধরেই এ অবস্থা।”

রাচেল লুইসের দিকে তাকালে সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।

“তাহলে তো খুবই ভালো হয়, মিস্টার ক্র্যান্ডাল।”

“ওহ, আমাকে জাড বললেই হবে,” তিনি বললেন।

হঠাৎ একটা জোরালো হর্ন বাজে। ক্রমেই মৃদু হতে থাকা ইঞ্জিনের শব্দ পাওয়া যায়, এর পর পরই একটা নীল মালবাহী ট্রাক ড্রাইভওয়েতে মোড় নিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে।

“ওহ খোদা, বাড়ির চাবি তো পাচ্ছি না,” লুইস বলল।

“সমস্যা নেই।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “আমার কাছে তোমাদের বাড়ির চাবির এক সেট আছে। মিস্টার আর মিসেস ক্লিভল্যান্ড, যারা এখানে তোমাদের আগে থাকতো, আমাকে এক সেট চাবি দিয়েছিল, তাও প্রায় চোদ্দ- পনের বছর আগে। তারা অনেকদিন ছিলেন এখানে। জোন ক্লিভল্যান্ড আমার বৌয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন। তিনি দুই বছর আগে মারা যান। আর বিল অরিংটনের বৃদ্ধাশ্রমে চলে যায়। আমি চাবির সেটটা নিয়ে আসছি। এমনিতেও ওগুলো এখন থেকে তোমাদেরই।”

“আপনি খুব উপকার করলেন, মি. ক্র্যান্ডাল,” রাচেল বলল।

“একদমই না,” তিনি বললেন। “আমাদের আশেপাশে কমবয়েসি লোকজন পাওয়ার জন্যে আমরা দুই বুড়ো বুড়ি অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছিলাম। তুমি শুধু বাচ্চারা রাস্তার আশেপাশে যায় কি না খুব খেয়াল রাখবে, মিসেস ক্রিড। এই রাস্তাটায় বড় বড় ট্রাক দিনরাত চলে।”

বাড়ি বদলে দেয়ার শ্রমিকরা ট্যাক্সি থেকে হুড়োহুড়ি করে নেমে শব্দ করে ট্যাক্সির দরজা লাগিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসে।

এলি ঘুরতে ঘুরতে সামান্য দূরে চলে গিয়েছিল। সে বলল, “বাবা, এটা কী?”

লুইস শ্রমিকদের সাথে কথাবার্তা বলছিল। মেয়ের কথা শুনে সে পেছনে ফিরে তাকায়। মাঠের অপর প্রান্তে যেখানে বাড়ির উঠানের সীমানা শেষ, গ্রীষ্মের বড় বড় ঘাস সেখানটা দখল করে নিলেও মসৃণ করে ঘাস কাটা একটা চার ফুটের মতো রাস্তা তৈরি করা আছে। রাস্তাটা মাঠ পেরিয়ে একেবেঁকে পাহাড়ে গিয়ে উঠেছে, কিছু জংলী আগাছা আর বার্চার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

“দেখে তো রাস্তা-টাস্তা মনে হচ্ছে,” লুইস বলল।

“ঠিক তাই,” ক্র্যান্ডাল মুচকি হেসে বললেন।

“ এটার ব্যাপারে তোমাকে একসময় বলব মামনি। এখন আমার সাথে চল, গিয়ে তোমার ভাইয়ের চিকিৎসা করি।”

“আচ্ছা।” এলি বলেই আবার একটু আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল: “বেকিং সোডা লাগালে কি খুব জ্বলে?”

অধ্যায় ৪

ক্র্যান্ডাল চাবি নিয়ে আসতে আসতে লুইস তার চাবি খুঁজে পায়। সেই গ্লাভ কম্পার্টমেন্টের ওপরের দিকের একটা ফোকর দিয়ে ছোট খামটা পেছনের তারের জঞ্জালের মাঝে পড়ে গিয়েছিল। সে কায়দা করে খামটা সেখান থেকে বের করে শ্রমিকদের ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে। ক্র্যান্ডাল তাকে বাড়তি চাবির ঝোপাটা দেয়। চাবিগুলো লাগানো ছিল একটা পুরনো বিবর্ণ রিঙে। লুইস উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে শ্রমিকদের বাক্স, ড্রেসার, আর টেবিলগুলো ভেতরে ঢোকানো দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে চাবিটা নিজের পকেটে চালান করে দেয়। এসব মালামাল তারা তাদের দশ বছরের বিবাহিত জীবনে একটু একটু করে সংগ্রহ করেছে। জিনিসগুলোকে এভাবে, মানে তাদের চিরচেনা জায়গার বাইরে দেখে একদম গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা চিন্তা করে হঠাৎ বিষাদ আর হতাশায় তার মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে। সে ভাবে একেই হয়ত লোকে হোমসিকনেস বলে।

“শিকড় উপড়ে তুলে নতুন করে লাগানো,” ক্র্যান্ডাল হঠাৎ একপাশ থেকে বলে উঠলে সে চমকে ওঠে।

“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আমার অনুভূতিটা বুঝতে পারছেন,” সে বলল।

“আসলে না।” ক্র্যান্ডাল বিড়ি জ্বালালেন। শেষ বিকেলের ছায়ায় ম্যাচের কাঠিটা পপ করে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠলো। “রাস্তার ওপারের বাড়িটা আমার বাবা করেছিলেন। সেখানে তার স্ত্রী এবং বাচ্চাকে নিয়ে আসেন, বাচ্চাটা আমি, যার জন্ম ঠিক ১৯০০ সালে।”

“তাহলে আপনার বয়স…”

“তিরাশি।” ক্র্যান্ডাল এ কথা বললে লুইসের খুব ভালো লাগলো, কারণ তিনি বলেননি, তার বয়স ৮৩ হলেও তিনি এখনো মনে একদম তরুণ। বুড়োদের এই বুলিটা সে সসম্মানে ঘৃণা করে।

“আপনাকে দেখলে এতো বয়স মনে হয় না।”

ক্র্যান্ডাল দুই কাঁধ উঁচু করলেন। “যাই হোক, আমি জন্মের পর থেকে এখানেই থেকেছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আর্মিতে যোগ দিয়েছিলাম। তবে ইউরোপে যুদ্ধক্ষেত্রের সবচাইতে কাছাকাছি যেখানে আমি গিয়েছিলাম সেটা হলো আমেরিকারই বায়ন, নিউ জার্সি। ১৯১৭ সালেও ওই জায়গাটা ছিল জঘন্য। আমি এ জায়গায় ফিরতে পেরেই খুশি। এরপর আমি নরমাকে বিয়ে করলাম, রেলে একটা চাকরি জুটিয়ে এখানেই থেকে গেলাম। তবে এখানেই লাডলোতে অনেক ‘লাইফ’ দেখেছি আমি, সত্যিই।”

হাতে বক্স স্প্রিংটা নিয়ে শ্রমিকেরা শেডের প্রবেশমুখে থামল। স্প্রিংটা তাদের বড় ডাবল বেডের জাজিমের নিচে থাকে, যেটায় সে আর রাচেল শোয়। “এটা কোথায় রাখবো মিস্টার ক্রিড?”

“ওপর তলায়। এক মিনিট, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।” সে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে নিয়ে দাড়িয়ে ক্র্যান্ডালের দিকে পেছন ফিরে চাইল।

“তুমি যাও।” ক্র্যান্ডাল হেসে বললেন। “আমি গিয়ে দেখি তোমার পরিবারের বাকিদের কী অবস্থা। ওদের আর কষ্ট না দিয়ে বরং পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাসা বদল করা হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ। আমি নয়টার দিকে আমার বাসার সামনের বারান্দায় বসে বিয়ার খাই। গরমের সময় চারদিকে রাত নামতে দেখা উপভোগ করি আমি। মাঝে মাঝে নরমাও বসে আমার সাথে। তোমার ইচ্ছে হলে চলে এসো।”

“দেখি, আসতেও পারি,” লুইস বলল যদিও তার যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। গেলে দেখা যাবে বারান্দায় বসে নরমার বাতের চিকিৎসা (বিনামূল্যে) করা লাগছে।

লুইস ক্র্যান্ডালকে পছন্দ করেছিল, পছন্দ করেছিল তার কুটিল মুচকি হাসি, তার দুঃখের কুটিল হাসি, তার চটজলদি কথার পদ্ধতি, তার ভাষার ইয়াংকি টান, যা ক্ষ্যাত শোনাতো না বরং গম্ভীর লাগত। ভালো লোক, তবে ডাক্তাররা দ্রুতই মানুষের মধ্যে ধূর্ততা খুঁজে পায়, লুইস ভাবে। হতাশার কথা হলো, আগে অথবা পরে, ডাক্তারদের খুব কাছের বন্ধুরাও ফ্রি চিকিৎসা চেয়ে বসে। আর বুড়োদের বেলায় তো এর কোনো শেষই নেই।

“তবে আমার জন্যে অপেক্ষা করে জেগে থাকবেন না, খুব কঠিন একটা দিন গেল আমাদের।” সে বলল।

“তোমার আসার জন্যে ইনভাইটেশন কার্ড লাগবে না, মাথায় ঢুকিয়ে নাও।” ক্র্যান্ডাল বললেন। তার কুটিল হাসিতে একটা ব্যাপার ছিল যা দেখে লুইসের মনে হলো, তিনি বোধহয় লুইসের মনের গোপন কথা বুঝে গিয়েছেন।

সে শ্রমিকদের কাছে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্র্যান্ডাল সহজভাবে হেঁটে গেলেন, যেন তার বয়স আশি নয়, বরং ষাট। লুইস আচমকা প্রথমবারের মতো লোকটার প্রতি ভাললাগা অনুভব করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *