তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

পেটে খেলে পিঠে সয়

পেটে খেলে পিঠে সয়

মনে কোনও কিছু মিনিটতিনেকের বেশি রাখা উচিত নয়। অন্তত এই আধুনিক যুগে নয়। আধুনিক যুগে মনে নানারকম ভাব, ভাবনা, বিষয়, অনবরত ঢুকবে আর বেরোবে। একটা কিছু ঢোকা মাত্রই নিমেষে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও। মন খালি করো। মন খালি করো, তা না হলে পরেরটা ঢুকবে কি করে। আর যদিও বা ঢোকে মনে ভিড় জমে যাবে। মনটাকে করে ফেলতে হবে হাসপাতালের এমার্জেনসির মতো। এক একটাকে ধরো, ফোঁড়ো, টান মেরে ফেলে দিয়ে এসো বাথরুমের কাছে। বেড খালি করো বেড।

কেউ খুব কড়া কথা বলেছেন। বলুন। মনে পুষে রাখার মতো সেকেলে বিলাসিতা এযুগে চলবে না। মুখ ভার হল। অভিমান হল। কেউ ফিরেও তাকাবে না। মিষ্টি কথার প্রলেপ মেরে মনের ক্ষত মেজে দেবে না। ঈশ্বর দুটি কান দিয়েছেন, সে আমাদের শরীরের ব্যালেন্সের জন্যে নয়। একটা এনট্রেন্স আর একটা এগজিট। এক কান দিয়ে ঢুকবে আর এক কান দিয়ে বেরোবে। ভীষণ প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া মনে কিছু না তোলাটাই বুদ্ধিমানের পথ। সব মানুষই সব মানুষের টার্গেট। তিরন্দাজের অভ্যাসের জন্যে একটা করে চাঁদমারি থাকে। গোলের মধ্যে গোল। সেই গোল অংশে তাঁরা তির ছোঁড়েন। সব মানুষই তিরন্দাজ সব মানুষই চাঁদমারি। এ ওকে ফুঁড়ছে। ও একে ফুঁড়ছে। এটাই জগতের নিয়ম।

সব মানুষই কোনও-না-কোনও মানুষের পরচর্চার বিষয়। ঘরে ঘরে আমরা আলোচিত। কখনও ভালো, কখনও আমরা খারাপ। করতে পারলেই ভালো, তাও ক্ষণকালের জন্যে। না করতে পারলেই খারাপ। মোটা হলে বলবে, খেয়ে খেয়ে ব্যাটা মুটিয়ে গেল। তাও আমার কী খাওয়া, মাল খাওয়া। রোগ হলে বলবে, ব্যাটা খেতে পায় না অথবা, ‘শরীর তো, কত অনাচার আর সইবে।’ এ হল এগোতেও কাটবে, পেছতেও কাটবে। এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা, পেছলেও নির্বংশের ব্যাটা।

 ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি, আমি একটা গাধা আর রামছাগলের কম্বিনেশান। প্রথম প্রথম ভীষণ অভিমান হত। অপর সব ছেলেদের কেউ সোনার চাঁদ, কেউ হিরের টুকরো। পরে বুঝেছিলুম প্রায় সব ছেলেই তার অভিভাবকদের চেখে মনুষ্যেতর প্রাণী। যেমন প্রায় সব ছাত্রই তাদের শিক্ষকদের চোখে নির্ভেজাল এক-একটি বাঁদর। মানুষের মতো দেখতে হলে কী হবে, স্বভাবে শাখামৃগ। শিক্ষার প্রথম পাঠের মতো, নিন্দার প্রথম পাঠটিও আমাদের শুরু হয়ে গেছে শৈশব থেকেই। ট্যানারিতে চামড়া ট্যান করা হয়, মানুষের কারখানায় মনের চামড়া ট্যান হয়। যে যত বড় মোষ সে তত বেশি সফল। সেন্টপারসেন্ট মোষ মানে সেন্ট পারসেন্ট সফল মানব। শীতকালের তেল ছাড়া কোনও কিছুই গায়ে মাখি না। এই হোক আমাদের নীতি।

একশো জন স্ত্রীকে যদি জিগ্যেস করা হয়, ‘আপনার স্বামীটি কেমন?’ কেউই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলবেন না, ‘আহা, তুলনা হয় না।’ একটু ঢোঁক গিলে, একটু আমতা-আমতা করে বলবেন, ‘ওই আর কী, চলে যায়। চলেবল।’ তাও বলবেন ভদ্রতা করে। পাছে কেউ কিছু মনে করেন। পারিবারিক মহলে, শিক্ষক বলতেন গাধা, পিতা বললেন বাঁদর। মা বলতেন, ছাগল। পতিভক্তির তলানি বাঙালি সংস্কারের পাত্রে এখনও আছে, তাই স্ত্রী একটি রাম যোগ করে একটু সন্মান দেখিয়ে বলেন, রামছাগল। তাতেই বা কী যায় আসে। গায়ে না মাখলেই হয়। কথা তো আর শীতের ঠান্ডা বাতাস নয় যে গায়ে লাগলেই সর্দি হবে। কথা কিছু বাক্যের সমষ্টি। একালে কোনোও কথারই কি কোনোও দাম আছে। কথা হল কাজ আদায়ের ছল। এই যে পুত্র, যে মনে মনে বলে, বাবা একটা Fool. সেই মাসের পয়লা থেকে তিন কি চার তারিখ পর্যন্ত বলে বাবা আমার বেলফুল। অমন একটি মাল এপাড়ায় আর দুটি নেই। কারণ এই সময়টায় সে হাত খরচের টাকা আদায় করবে। দু-দশটা বায়না আদায় করবে। ব্যাপারটা সিম্পল। মাসের ছাব্বিশটা দিন ইংরেজি ফুল, চারটে দিন বাংলা ফুল। উচ্চারণ এক। কানে শুনতেও এক। স্ত্রী যখন প্রেমিকা। গাছতলায় সংসারখণ্ডের চিনাবাদাম পর্ব চলছে। প্রেমিক প্রেমিকা যখন দাঁতে ঘাস কেটে কেটে ময়দানের জায়গায় টাক ফেলে দিচ্ছে তখন প্রেমিকা যে ভূত বলত আর বিয়ের দশ বছর পরে যে ভূত বলে, দুটো ভূতের জাত কিন্তু এক নয়। প্রেমের ভূত ঘাড় থেকে নেমে গেছে তখন। তখন দাঁত বের-করা ভূত। ‘তুমি আর দাঁত বের কোরো না তো। গা একেবারে জ্বলে যায়। আজ তিন দিন ধরে বলছি, এ-কান দিয়ে ঢোকাচ্ছ ও-কান দিয়ে বের করে দিচ্ছ। বললেই বলবে ভুলে গেছি। এই কথাতেই বা জ্বলে ওঠার কী আছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই রকম মধুর বাক্যালাপে তৃতীয় কেউ যদি ভুলেও নাক গলাতে আসেন, তাহলে তাঁকে শুনতে হবে, ‘ওই একটাই লোক, ওকে বলব না তো কাকে বলব! রাস্তার লোককে।’ স্বামীরা হলেন স্ত্রীর এজমালি সম্পত্তি। রাখতে হয় রাখো, মারতে হয় মারো। যে সোহাগ করে সে-ই শাসন করে। এই ভেবে নিয়ে সংসারে সদানন্দে থাকতে অসুবিধে কি!

মানুষের জীবন-সংসারে আগে জীবিকা। জীবিকার জগতে মানুষের মান-সম্মান বলে কিছু আছে কি? ওখানে চলে ধাপ-ধোলাই। ওপরের জন নীচের জনকে, নীচের জন তার নীচের জনকে, সুযোগ পেলেই ধাঁতাবে। আমরা কিছু মনে করি না। এইটাই হল সিস্টেম। পেটে খেলে পিঠে সইতে হয়। আমরা বলি, দুটো পয়সা দেবে ভাই আর একটু ধাঁতাবে না!

তা, একজন বললেন, জীবনদায়ী ওষুধ জানো তো! একটা কোর্স খেলে আরোগ্য লাভ করলে; কিন্তু জানবে ওষুধ হলেও সাইড এফেক্ট আছে। যাকে বলে ড্রাগ-রিঅ্যাকশান। প্রথমে মানুষ হয়ে জন্মালুম। দুর্লভ অবশ্যই। তার সাইড এফেক্ট হল, সংসারের ধোলাই। সংসারে সানাই বাজিয়ে ঢুকলুম। সাইড এফেক্ট, মুখ ঝামটা। জীবিকার কামাই। লাইফলাইন। সাইড এফেক্ট—উঠতে বসতে অহংকারে মোচড়। তবে সেই দৃশ্যটি জীবনে ভুলব না।

দূর এক অঞ্চলের রেল প্ল্যাটফর্ম । শীতের সকাল। ট্রেন আসবে। তবে আধঘন্টা তখনও দেরি। চারপাশে ধোঁয়া-ধোঁয়া। গাছের পাতায় পাতায় মাকড়শার জালের মতো কুয়াশা ঝুলছে। প্ল্যাটফর্মের বেনচে এসে বসছেন এক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা। বৃদ্ধের অনেক বয়েস। মাথায় হনুমান টুপি। গরম জামা জড়ানো নড়বড়ে এক মানুষ। চোখে বিশাল পাওয়ারের চশমা। নাকের ডগায় ঝুলে এসেছে। কানেও মনে হয় কম শোনেন। বৃদ্ধা ওরই মধ্যে একটু শক্তসমর্থ। তাঁর গায়ে নীল রঙের একটি চাদর। বৃদ্ধা বৃদ্ধকে বেনচে ধরে ধরে বাসতে বসাতে বেশ জোর গলায় বললেন—’এখানে চুপ করে বসো থাকো, বুঝলে! কোথাও উঠে আবার চলে যেও না। আমি ট্রেনের সময়টা জেনে আসি। উঠবে না কিন্তু!’

লক্ষ্মী ছেলের মতো বৃদ্ধ ঘাড় নাড়লেন। তারপর দুটো হাত অসহায়ের মতো তুলে ফোকলা স্বরে বললেন,—’তুমি তাহলে কখন আসবে!’

বৃদ্ধা বললেন, ‘এই তো যাব আর আসব।’

এই দৃশ্যটুকুর জন্যে সংসারে সব কিছু সহ্য করে নেওয়া যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *