জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যখন দেখি পেছনের দিনগুলো ধুসর ধুসর, আর সেই ধুসরতার শরীর থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোনও ভুলে যাওয়া স্বপ্ন এসে আচমকা সামনে দাঁড়ায় বা কোনও স্মৃতি টুপ করে ঢুকে পড়ে আমার একাকী নির্জন ঘরে, আমাকে কাঁপায়, আমাকে কাঁদায়, আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেইসব দিনগুলোর দিকে— তখন কি আমি না হেঁটে পারি জীবনের সেই অলিগলির অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে কিছু শীতার্ত স্মৃতি কুড়িয়ে আনতে! কী লাভ এনে! যা গেছে তো গেছেই৷ যে স্বপ্নগুলো অনেককাল মৃত, যে স্বপ্নগুলোকে এখন আর স্বপ্ন বলে চেনা যায় না, মাকড়শার জাল সরিয়ে ধুলোর আস্তর ভেঙে কী লাভ সেগুলোকে আর নরম আঙুলে তুলে এনে! যা গেছে, তা তো গেছেই৷জানি সব, তবুও আমার নির্বাসনের জীবন আমাকে বারবার পেছনে ফিরিয়েছে, আমি আমার অতীত জুড়ে মোহগ্রস্তের মতো হেঁটেছি৷ দুঃস্বপ্নের রাতের মতো এক একটি রাত আমাকে ঘোর বিষাদে আচ্ছন্ন করে রেখেছে৷ তখনই মেয়েটির গল্প বলতে শুরু করেছি আমি৷ একটি ভীরু লাজুক মেয়ে, যে মেয়ে সাত চড়েও রা করেনি, পারিবারিক কড়া শাসন এবং শোষণে ছোট্ট একটি গণ্ডির মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে, যে মেয়ের সাধ আহ্লাদ প্রতিদিনই ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে, যে মেয়েটির ছোট্ট শরীরের দিকে লোমশ লোভী হাত এগিয়ে এসেছে বারবার, আমি সেই মেয়ের গল্প বলেছি৷ যে মেয়েটি কিশোর-বয়সে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেছে, যে মেয়েটি হঠাৎ একদিন প্রেমে পড়েছে, যৌবনের শুরুতে বিয়ের মতো একটি কাণ্ড গোপনে গোপনে ঘটিয়ে আর দশটি সাধারণ মেয়ের মতো জীবন যাপন করতে চেয়েছে, আমি সেই সাধারণ মেয়েটির গল্প বলেছি৷ যে মেয়েটির সঙ্গে প্রতারণা করেছে তার স্বামী-তার সবচেয়ে ভালবাসার মানুষ, যে মেয়েটির বিশ্বাসের দালানকোঠা ভেঙে পড়েছে খড়ের ঘরের মতো, যে মেয়েটি শোকে, সন্তাপে, বেদনায়, বিষাদে কুঁকড়ে থেকেছে, চরম লজ্জা আর লাঞ্ছনা যাকে আত্মহত্যা করার মতো একটি ভয়ংকর পথে নিয়ে যেতে চেয়েছে, সেই শোকার্ত মেয়েটির গল্প আমি বলেছি৷
চুরমার হয়ে ভেঙে পড়া স্বপ্নগুলো জড়ো করে যে মেয়েটি আবার বাঁচতে চেয়েছে, নিষ্ঠুর নির্দয় সমাজে নিজের জন্য সামান্য একটু জায়গা চেয়েছে, যে মেয়েটি বাধ্য হয়েছে সমাজের রীতিনীতি মেনে পুরুষ নামক অভিভাবকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে, আর তার পরও যে মেয়েটির ওপর আবার নেমে এসেছে একের পর এক আঘাত, যে আঘাত গর্ভের ভ্রুণটিকে নষ্ট করে দেয়, যে আঘাত প্রতি রাতে তাকে রক্তাক্ত করে, যে আঘাত ক্রুরতার, কুটিলতার, অবিশ্বাসের আর অসহ্য অপমানের— আমি সেই দলিত, দংশিত, দুঃখিতার গল্প বলেছি মাত্র৷ দুঃখিতাটি তার শরীরে আর মনে যেটুকু জোর ছিল অবশিষ্ট, সেটুকু নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াবার জন্য সামান্য জায়গা পেতে কারও দ্বারস্থ হয়নি এবার, একাই লড়েছে সে, একাই বেঁচেছে, নিজেই নিজের আশ্রয় হয়েছে, এবার আর কারও কাছে নিজেকে সমর্পণ করেনি, বঞ্চিত হয়েছে বলে যোগিনী সাজেনি, কারও ছিঃর ছিঃর দিকে, কারও ধিক্কারের দিকে ফিরে তাকায়নি— এই ফিরে না তাকানোর গল্প আমি বলেছি৷
সমাজের সাতরকম সংস্কারের ধার ধারেনি মেয়ে, বারবার তার পতনই তাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, বারবার তার হোঁচট খাওয়াই তাকে হাঁটতে শিখিয়েছে, বারবার তার পথ হারানোই তাকে পথ খুঁজে দিয়েছে, ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে যে নতুন একটি বোধ আর বিশ্বাসকে সে জন্ম নিতে দেখেছে, তা হলো, তার নিজের জীবনটি কেবল তারই, অন্য কারও নয়৷ এই জীবনটির কর্তৃত্ব করার অধিকার কেবল তারই৷ আমি মেয়েটির সেই গড়ে ওঠার গল্প বলেছি— যে পরিবেশ প্রতিবেশ তাকে বিবর্তিত করেছে, তাকে নির্মাণ করেছে, পিতৃতন্ত্রের আগুনে পুড়ে পুড়ে শেষ পর্যন্ত যে মেয়ে দগ্ধ হল না, পরিণত হল ইস্পাতে, সেই গল্প৷
আমি কি অন্যায় কিছু করেছি? আমার কাছে অন্যায় বলে মনে না হলেও আজ অনেকের কাছে এটি ঘোরতর অন্যায়৷ আমি ভয়াবহরকম অপরাধ করেছি গল্পটি বলে৷ অপরাধ করেছি বলে জনতার আদালতের কাঠগড়ায় আজ আমাকে দাঁড়াতে হচ্ছে৷ অপরাধ হয়তো হতো না যদি না আমি প্রকাশ করতাম যে, যে মেয়েটির গল্প আমি বলেছি সে মেয়েটি আমি, আমি তসলিমা৷ কল্পনায় আমি যথেচ্ছাচার করতে পারি, মিথ্যে মিথ্যে আমি লিখতে পারি কোনও সাধারণ মেয়ের আর দশটি মেয়ে থেকে ভিন্ন হওয়ার গল্প, ও না হয় ক্ষমা করে দেয়া যায় কিন্তু এই বাস্তব জগতটিতে দাঁড়িয়ে রক্তমাংসের মেয়ে হয়ে কোন স্পর্ধায় আমি ঘোষণা করছি যে, ওই মেয়েটি আমি, আমি দুঃখ ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন করে নিজের জীবনটি যাপন করব বলে পণ করেছি, আমার এই দুর্বিনীত আচরণ লোকে মানবে কেন! এরকম স্পর্ধা কোনও মেয়েকেই মানায় না৷ বড় বেমানান আমি পুরো পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে৷
আমার প্রিয় দেশটিতে, প্রিয় পশ্চিমবঙ্গে আজ আমি একটি নিষিদ্ধ নাম, একটি নিষিদ্ধ মানুষ, একটি নিষিদ্ধ বই৷ আমাকে উচ্চারণ করা যাবে না, আমাকে ছোঁয়া যাবে না, আমাকে পড়া যাবে না৷ উচ্চারণ করলে জিভ নষ্ট হবে, ছুঁলে হাত নোংরা হবে, পড়লে গা রি রি করবে৷
এরকমই তো আমি৷ সে কি আজ থেকে!
দ্বিখণ্ডিত লেখার কারণে যদি সহস্র খণ্ড হতে হয় আমাকে, তবু আমি স্বীকার করতে চাই না যে, আমি কোনও অপরাধ করেছি৷ আত্মজীবনী লেখা কি অপরাধ? জীবনের গভীর গোপন সত্যগুলো প্রকাশ করা কি অপরাধ? আত্মজীবনীর প্রধান শর্ত তো এই যে জীবনের সবকিছু খুলে মেলে ধরব, কোনও গোপন কথা কোনও কিছুর তলায় লুকিয়ে রাখব না৷ যা কিছু গোপন, যা কিছু অজানা, তা বলার জন্যই তো আত্মজীবনী৷ এই শর্তটাই সততার সঙ্গে পালন করতে চেষ্টা করছি৷ আত্মজীবনীর প্রথম দুই খণ্ড আমার মেয়েবেলা আর উতল হাওয়া নিয়ে কোনওরকম বিতর্ক না হলেও তৃতীয় খণ্ডটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
এই বিতর্ক কিন্তু আমি সৃষ্টি করিনি, করেছে অন্যরা৷ বিতর্ক হওয়ার মতো উত্তেজক বিষয়, অনেকেই বলেছেন, আমি বেছে নিয়েছি৷ এই প্রশ্ন আর যখনই উঠুক, আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে ওঠা উচিত নয়৷ কারণ সবরকম অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে আমার বড় হওয়া বা বেড়ে ওঠার ঘটনাগুলোই আমি বর্ণনা করেছি৷ আমার দর্শন-অদর্শন, আমার হতাশা-আশা, আমার সুন্দর, আমার কুৎসিত, আমার শোক, সুখ, আমার ক্রোধ আর কান্নাগুলোর কথাই বলেছি৷ কোনও স্পর্শকাতর বা উত্তেজক বিষয় শখ করে বেছে নিইনি, আমার জীবনটিই আমি বেছে নিয়েছি জীবনী লেখার জন্য৷ এই জীবনীটি যদি স্পর্শকাতর আর উত্তেজক হয়, তবে এই জীবনের কথা লিখতে গিয়ে আমি অস্পর্শকাতর আর অনুত্তেজক বিষয় কোত্থেকে পাবো?
বিতর্ক তৈরি করার জন্য বা চমক সৃষ্টি করার জন্য আমি নাকি বইটি লিখেছি৷ যেন বদ একটি কারণ থাকতেই হবে বই লেখার পেছনে৷ যেন সততা আর সরলতা কোনও কারণ হতে পারে না৷ যেন সাহস, যে সাহসের প্রশংসা করা হত, যে, আমি সাহস করে নাকি অনেক কিছুই বলি বা করি, সেই সাহসটিও এখন আর কোনও কারণ হতে পারে না৷ আমার লেখা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়৷ লেখালেখির শুরু থেকেই তা হচ্ছে৷ এটিই কি মোদ্দাকথা নয় যে, পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের সঙ্গে আপোস না করলেই বিতর্ক হয়৷
আত্মজীবীনীর সংজ্ঞা অনেকের কাছে অনেকরকম৷ বেশিরভাগ মানুষই সেই আত্মজীবনীকে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত, যে জীবনীটি ভূরি ভূরি ভালো কথা আর চমৎকার সব আদর্শ উত্থাপন করে৷ সাধারণত মনীষীরাই আত্মজীবনী লিখে যান অন্যকে নিজের জীবনাদর্শে আলোকিত করতে, সত্যের সন্ধান দিতে, পথ দেখাতে৷ আমি কোনও জ্ঞানী-গুণী মানুষ নই, কোনও মনীষী নই, মহামানব নই, কিছু নই, অন্ধজনে আলো দেয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আমি জীবনী লিখছি না৷ আমি কেবল ক্ষুদ্র একটি মানুষের ক্ষতগুলো, ক্ষোভগুলো খুলে দেখাচ্ছি৷
কোনও বড় সাহিত্যিক বা বড় কোনও ব্যক্তিত্ব না হলেও একথা তো অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, খুব বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনটিতে৷ আমার বিশ্বাস এবং আদর্শের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি পথে নামে আমার ফাঁসির দাবি নিয়ে, যদি ভিন্ন মতের কারণে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করা হয়, যদি সত্য কথা বলার অপরাধে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র আমার নিজের দেশে বাস করার অধিকার হরণ করে নেয়, তবে নিশ্চয়ই জীবনটি একটি সাদামাটা জীবন নয়! এই জীবনের কাহিনী অন্যের মুখে নানা ঢঙে নানা রঙে প্রচারিত যখন হচ্ছেই, তখন আমি কেন দায়িত্ব নেব না জীবনটির আদ্যোপান্তবর্ণনা করতে! আমার এই জীবনটিকে আমি যত বেশি জানি, তত তো আর অন্য কেউ জানে না৷
নিজেকে যদি উন্মুক্ত না করি, নিজের সবটুকু যদি প্রকাশ না করি, বিশেষ করে জীবনের সেইসব কথা বা ঘটনা যা আমাকে আলোড়িত করেছে, যদি প্রকাশ না করি নিজের ভাল মন্দ, দোষ গুণ, শুভ অশুভ, আনন্দ বেদনা, উদারতা ক্রুরতা, তবে আর যাই হোক সেটি আত্মজীবনী নয়, অন্তত আমার কাছে নয়৷ কেবল সাহিত্যের জন্য সাহিত্যই আমার কাছে শেষ কথা নয়, সততা বলে একটি ব্যাপার আছে, সেটিকে আমি খুব মূল্য দিই৷
যেরকমই জীবন হোক আমার, যে রকমই নিকৃষ্ট, যে রকমই নিন্দার্হ, নিজের জীবন কাহিনী লিখতে বসে আমি কিন্তু প্রতারণা করছি না নিজের সঙ্গে৷ পাঠক আমার গল্প শুনে আমাকে ঘৃণা করুক, কি আমাকে ছুঁড়ে ফেলুক, এটুকুই আমার সন্তুষ্টি যে আমার পাঠকের সঙ্গে আমি প্রতারণা করছি না৷ আত্মজীবনী নাম দিয়ে পাঠককে কোনও বানানো গল্প উপহার দিচ্ছি না৷ জীবনের সব সত্য, সত্য সবসময় শোভন বা সুন্দর না হলেও সঙ্কোচহীন বলে যাচ্ছি৷ জীবনে যা কিছু ঘটে গেছে, তা তো ঘটেই গেছে, তা তো আমি বদলে দিতে পারবো না, আর স্বীকারও করতে পারবো না এই বলে যে, যা ঘটেছে, তা আসলে ঘটেনি৷ সুন্দরকে যেমন পারি, অসুন্দরকেও তেমন আমি স্বীকার করতে পারি৷
চারদিক থেকে এখন বিদ্রুপের তীর ছোঁড়া হচ্ছে আমাকে লক্ষ্য করে, অপমান আর অপবাদের কাদায় আমাকে ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে— এর কারণ একটিই, আমি সত্য কথা বলেছি৷ সত্য সবসময় সবার সয় না৷ আমার মেয়েবেলা আর উতল হাওয়ার সত্য সইলেও দ্বিখণ্ডিতর সত্য সবার সইছে না৷ আমার মেয়েবেলায় আমাকে অপদস্থ করার কাহিনী যখন বর্ণনা করেছি, সেটি শুনে লোকে চুক চুক করে দুঃখ করেছে আমার জন্য, উতল হাওয়ায় যখন স্বামী দ্বারা প্রতারিত হয়েছি, তখনও আহা আহা করেছে আমার জন্য, আর দ্বিখণ্ডিতয় যখন বর্ণনা করেছি একাধিক পুরুষের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা, তখন ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করেছে৷ এর অর্থ তো একটিই, যে, যতক্ষণ একটি মেয়ে অত্যাচারিত এবং অসহায়, যখনই সে দুর্বল এবং যখন তার দুঃসময়, ততক্ষণই তার জন্য মায়া জাগে, ততক্ষণই তাকে ভালো লাগে৷ আর যখনই মেয়েটি আর অসহায় নয়, অত্যাচারিত নয়, যখনই সে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ায়, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, নিজের শরীরের এবং মনের স্বাধীনতার জন্য সমাজের নষ্ট নিয়মগুলো ভাঙে, তখন তাকে আর ভালো লাগে না, বরং তার প্রতি ঘৃণা জন্মে৷ আমাদের সমাজের এই চরিত্র আমি জানি, জেনেও কোনও দ্বিধা করিনি নিজেকে জানাতে৷
দ্বিখণ্ডিত বইটি নিয়ে বিতর্কের একটি বড় কারণ, যৌ*ন স্বাধীনতা৷ আমাদের এই সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাই একজন নারীর যৌ* স্বাধীনতার অকপট ঘোষণায় বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রুব্ধ৷ যে যৌ* স্বাধীনতার কথা আমি বলি, তা কেবল আমার বিশ্বাসের কথাই নয়, নিজের জীবন দিয়ে সেই স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছি, অথচ যে কোনও পুরুষ আমাকে কামনা করলেই পাবে না৷ এই সমাজ এখনও কোনও নারীর এমন স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত নয়৷ প্রস্তুত নয় এটা শিরোধার্য করতে, যে, কোনও নারী তার ইচ্ছেমতো পুরুষকে সম্ভোগ করতে পারে এবং তা করেও কঠোরভাবে যৌ*-সতী বজায় রাখতে পারে৷
আমাদের নামী-দামী পুরুষ-লেখকরা আমাকে এখন মহানন্দে পতিতা বলে গাল দিচ্ছেন৷ গাল দিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করছেন— কী ভীষণ নোংরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সুবিধেভোগী পুরুষ-কর্তা তাঁরা৷ পতিতাকে তাঁরা ভোগের জন্য ব্যবহার করেন, আবার পতিতা শব্দটিকে তাঁরা সময় সুযোগমতো গাল হিসেবেও ব্যবহার করেন৷ নারীকে যৌ*-দাসী হিসেবে ব্যবহার করার নিয়ম আজকের নয়৷ যদিও দ্বিখণ্ডিত বইটিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে আমার লড়াই এর কথা বলেছি, বলেছি নারী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সমাজের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা, কেউ কিন্তু তা নিয়ে একটি কথাও বলছেন না, যারাই বলছেন, বলছেন যৌ*তার কথা৷ আমার কোনও কষ্টের দিকে কান্নার দিকে কারও চোখ গেল না, চোখ গেল শুধু যৌ*তার দিকে৷ চোখ গেল আমার সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কগুলোর দিকে৷ যৌ*তার মতো গভীর গোপন কুৎসিত আর কদর্য বিষয় নিয়ে আমার মুখ খোলা স্পর্ধার দিকে চোখ৷
পৃথিবীর ইতিহাসে, কোনও অন্ধকার সমাজে যখনই কোনও নারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে, নিজের স্বাধীনতার কথা বলেছে, ভাঙতে চেয়েছে পরাধীনতার শেকল, তাকেই গাল দেয়া হয়েছে পতিতা বলে৷ অনেক আগে নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য বইটির ভূমিকায় আমি লিখেওছিলাম— নিজেকে এই সমাজের চোখে নষ্ট বলতে আমি ভালবাসি৷ কারণ একথা সত্য যে, যদি কোনও নারী নিজের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করতে চায়, যদি কোনও নারী কোনও ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের নোংরা নিয়মের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়, তাকে অবদমনের সকল পদ্ধতির প্রতিবাদ করে, যদি কোনও নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয় তবে তাকে নষ্ট বলে সমাজের ভদ্রলোকেরা৷ নারীর শুদ্ধ হবার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া৷ নষ্ট না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই৷ সেই নারী সত্যিকার সুস্থ ও শুদ্ধ মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে৷
আজও একথা আমি বিশ্বাস করি, যে, কোনও নারী যদি তার সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়, যদি সত্যিকার মানুষ হতে চায়, তবে এই সমাজের চোখে তাকে নষ্ট হতে হয়৷ এই নষ্ট সমাজ থেকে নষ্ট বা পতিতা উপহার পাওয়া একজন নারীর জন্য কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়৷ এ যাবৎ যত পুরস্কার আমি পেয়েছি, পতিতা উপাধির পুরস্কারটিকেই আমি সর্বোত্তম বলে বিচার করছি৷ পুরুষতন্ত্রের নষ্টামির শরীরে সত্যিকার আঘাত করতে পেরেছি বলেই এই উপাধিটি আমি অর্জন করেছি৷ এ আমার লেখক-জীবনের, আমার নারী-জীবনের, আমার দীর্ঘকালের সংগ্রামের সার্থকতা৷
বইটি লিখেছি বলে বাংলাদেশের একজন লেখক আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন, কলকাতাতেও একজন বাংলাদেশি লেখকের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন৷ কেবল মানহানির মামলা করেই ক্ষান্তহননি, দুজনই আমার বইটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন৷ আমি ঠিক বুঝি না, কী করে একজন লেখক আরেকজন লেখককের বই নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন৷ কী করে সমাজের সেই শ্রেণীর মানুষ, যাঁদের দায়িত্ব মুক্তচিন্তা আর বাক স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করা, মৌলবাদীদের মতো আচরণ করেন৷ আমাকে নিয়ে এ যাবৎ অনেক মিথ্যে, অনেক কল্পকাহিনী লেখা হয়েছে, আমি তো তাঁদের কোনও লেখাই নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে আদালতে দৌড়োইনি! আমি বিশ্বাস করি, ভলতেয়ার যা বলেছিলেন, আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু আমি আমৃতু্য তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য লড়ে যাবো৷ কেন আমাদের বিদগ্ধ লেখকগণ বাক স্বাধীনতার পক্ষে এই চরম সত্যটি অস্বীকার করতে চান!
পৃথিবীর কত লেখকই তো লিখে গেছেন নিজেদের জীবনের কথা৷ জীবন থেকে কেবল পরিশুদ্ধ জিনিস ছেঁকে নিয়ে তাঁরা পরিবেশন করেননি৷ জীবনে ভ্রান্তি থাকে, ভুল থাকে, জীবনে কালি থাকে, কাঁটা থাকে, কিছু না কিছু থাকেই, সে যদি মানুষের জীবন হয়৷ যাঁদের মহামানব বলে শ্রদ্ধা করা হয়, তাঁদেরও থাকে৷ ক্রিশ্চান ধর্মগুরু আগুস্তঁ (৩৩৫-৪৩০) নিজেই লিখে গেছেন তাঁর জীবনকাহিনী, আলজেরিয়ায় তিনি যেভাবে জীবন কাটাতেন, যেরকম অসামাজিক, অনৈতিক, বাঁধহীন জীবন— কিছুই প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি৷ তাঁর যৌ* স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, জারজ সন্তানের জন্ম দেয়ার কোনও কাহিনীই গোপন করেননি৷
মহাত্মা গান্ধীও তো স্বীকার করেছেন কী করে তিনি তার বিছানায় ন্যাংটো মেয়েদের শুইয়ে নিজের ব্রাহ্মচারিতার পরীক্ষা করতেন৷ ফরাসি লেখক জ্যাঁ জ্যাক রুশোর (১৭১২-১৭৭৮) কথা ধরি, তাঁর স্বীকারোক্তি গ্রন্থটিতে স্বীকার করে গেছেন জীবনে কি কি করেছেন তিনি৷ কোনও গোপন কৌটোয় কোনও মন্দ কথা নিজের জন্য তুলে রাখেননি৷ সেই আমলে রুশোর আদর্শ মেনে নেয়ার মানসিকতা খুব কম মানুষেরই ছিল৷ তাতে কি! তিনি তার পরোয়া না করে অকাতরে বর্ণনা করেছেন নিজের কুকীর্তির কাহিনী৷ মাদমাজোল গতোঁ তো আছেই, আরও রমণীকে দেখে, এমনকী মাদাম দ্য ওয়ারেন, যাঁকে মা বলে ডাকতেন, তাঁকে দেখেও বলেছেন, যে, তাঁর যৌ*কাঙ্ক্ষা জাগত৷ বেঞ্জামিন ফ্ল্যাঙ্কলিন (১৭০৯-১৭৯০) তাঁর আত্মকথায় যৌবনের উতল উন্মাতাল সময়গুলোর বর্ণনা করেছেন, জারজ পুত্র উইলিয়ামকে নিজের সংসারে তুলে এনেছিলেন, তাও বলেছেন৷
বার্টরান্ড রাসেল তাঁর জীবনীগ্রন্থে লিখে গেছেন বিভিন্ন রমণীর সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের কথা৷ টি.এস. এলিয়টের স্ত্রী ভিভিয়ানের সঙ্গে, লেডি অটোলিন মোমেলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা কে না জানে! লিও তলস্তয় লিখেছেন চৌদ্দ বছর বয়সেই তাঁর গণিকাগমনের কাহিনী, সমাজের নিচুতলার মেয়ে, এমনকী পরস্ত্রীদের সঙ্গে তার যৌ* সম্পর্ক, এমনকী তাঁর যৌ*রোগে ভোগার কথাও গোপন করেননি৷ এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন তাঁরা, সমাজ যা মেনে নিতে পারে না, এমন তথ্য পাঠককে শোনাতে গেলেন! শোনানোর নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে৷ নিজেদের আসল পরিচয়টি তাঁরা লুকোতো চাননি অথবা এই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই শুনিয়েছেন৷ এতে কি তাঁদের জাত গিয়েছে নাকি তাঁদের আজ মন্দ বলে কেউ? কেউই তাঁদের মন্দ বলে না, যে অবস্থানে ছিলেন তাঁরা সে অবস্থানে তো আছেনই, বরং সত্য প্রকাশ করে নিজেদের আরও মহিমান্বিত করেছেন৷
পশ্চিমি দেশগুলোয় নারী পুরুষ সম্পর্কটি বহুকাল হলো আর আড়াল করার ব্যাপার নয়৷ হালের ফরাসি মেয়ে ক্যাথারিন মিলে তার নিজের কথাই লিখেছেন— The Sexual Life of Catherine M. বইটিতে৷ পুরো বইজুড়ে লিখেছেন ষাটের দশকে অবাধ যৌ*তার যুগে তাঁর বহুপুরুষ-ভোগের রোমাঞ্চকর কাহিনী৷ পুরো বইজুড়ে মৈথুনের নিখুঁত বর্ণনা৷ এতে কী হয়েছে? বইটিকে কি সাহিত্যের বইয়ের তাকে রাখা হয়নি? হয়েছে৷ গ্রাব্রিয়েল গর্সিয়া মার্কেজও Living to Tell the Tale and Memories of My Melancholy Whores বইটিতে পরনারীদের সঙ্গে তার লীলাখেলার কিছুই বলতে বাদ রাখেননি৷ মার্কেজকে কি কেউ মন্দ বলবে তাঁর জীবনটির জন্য, নাকি কেউ আদালতে যাবে বইটি নিষিদ্ধ করতে?
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বিখ্যাত মানুষদের জীবনী প্রকাশ হচ্ছে৷ বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে সেসব জীবনী লিখছেন জীবনীকাররা৷ খুঁড়ে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে সব গোপন খবর৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন কথাটিও তো রইছে না গোপনে৷ বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে কথা বলেও তিনি কেন নিজের বালিকা কন্যাটির বিয়ের আয়োজন করেছিলেন, সেই কারণটি মানুষ আজ জানছে৷ প্রশ্ন হলো, এইসব তথ্য কি আদৌ পাঠকের জানার প্রয়োজন? কে কবে কোথায় কী করেছিলেন, কী বলেছিলেন, জীবনাচরণ ঠিক কেমন ছিল কার, তা জানা যদি নিতান্তই অবান্তর হতো, তবে তা নিয়ে গবেষণা হয় কেন? জীবনীকার গবেষকরা যেসব মানুষ সম্পর্কে অজানা তথ্য জানাচ্ছেন, সেসব তথ্যের আলোয় শুধু মানুষটি নন, তাঁর সৃষ্টিরও নতুন করে বিচার ও বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে৷
বাঙালি পুরুষ লেখকদের অনেকেই গোপনে গোপনে বহু নারীর সঙ্গে প্রেম প্রেম শরীরী খেলা খেলতে কুণ্ঠিত নন, নিজেদের জীবনকাহিনীতে সেসব ঘটনা আলগোছে বাদ দিয়ে গেলেও উপন্যাসের চরিত্রদের দিয়ে সেসব ঘটাতে মোটেও সংকোচ বোধ করেন না৷ কেউ কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না৷ প্রশ্ন ওঠে, কোনও মেয়ে যদি যৌ*তা নিয়ে কথা বলে৷ সে গল্প উপন্যাসে হোক, সে আত্মজীবনীতে হোক৷ যৌ*তা তো পুরুষের বাপের সম্পত্তি৷ আমার তো পুরুষ-লেখকদের মতো লিখলে চলবে না৷ আমার তো রয়ে সয়ে লিখতে হবে৷ রেখে ঢেকে লিখতে হবে৷ কারণ আমি তো নারী৷ নারীর শরীর, তার নিতম্ব, স্তন, উরু, যোনী এসব নিয়ে খেলা বা লেখার অধিকার তো কেবল পুরুষেরই আছে৷ নারীর থাকবে কেন! এই অধিকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাকে দেয়নি, দেয়নি বলে তোয়াক্কা না করে আমি যে লিখে ফেলেছি, যত করুণ হোক, যা মর্মান্তিক হোক— আমার সে কাহিনী আমি যে অনধিকার চর্চা করেছি, তাতেই আপত্তি৷
পুরুষের জন্য একাধিক প্রেম বা একাধিক নারী সম্ভোগ চিরকালই গৌরবের ব্যাপার৷ আর একটি মেয়ে সততার সঙ্গে কাগজে কলমে নিজের প্রেম বা যৌ*তা নিয়ে যেই না লিখেছে, অমনি সেই মেয়ে বিশ্বাসঘাতিনী, সেই মেয়ে অসতী, সেই মেয়ে দুশ্চরিত্র৷ আমার আত্মজীবনীতে আমি এমন কথা বলেছি, যা বলতে নেই৷ আমি সীমা লঙ্ঘন করেছি৷ আমি বাড়াবাড়ি করেছি, আমি অশীলতা করেছি, নোংরা কুৎসিত ব্যাপার ঘেঁটেছি৷ দরজা বন্ধ করে যে ঘটনাগুলো ঘটানো হয়, পারস্পরিক বোঝাপড়ায় যে সম্পর্কগুলো হয়, সেসব নাকি বলা অনুচিত৷ সেসব নাকি বলা জরুরি নয়৷ কিন্তু আমি তো মনে করি উচিত, আমি তো মনে করি জরুরি৷ কারণ আমার সংস্কার সংস্কৃতি, ধ্যান ধারণা, বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে আজ এই যে আমি, এই তসলিমার নির্মাণ কাজে জীবনের সেইসব ঘটনা বা দুর্ঘটনাই অন্যতম মৌলিক উপাদান৷ আমি যে ভুঁইফোঁড় নই, তিল তিল করে চারপাশের সমাজ নির্মাণ করেছে তিলোত্তমার বিপরীত এই অবাধ্য কন্যার৷ নিজেকে বোঝার জন্য, আমি মনে করি, জরুরি এই আত্মবিশেষণ৷
নিজের সম্মান না হয় নষ্ট করেছি, অন্যের সম্মান কেন নষ্ট করতে গেলাম! যদিও অন্যের জীবনী আমি লিখছি না, লিখছি নিজের জীবনী কিন্তু অন্যের পারিবারিক সামাজিক ইত্যাদি সম্মানহানির বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন৷ আমি ঠিক বুঝি না, নিজের মান-সম্মানের ব্যাপারে যাঁরা এত সচেতন তাঁরা এমন কাণ্ড জীবনে ঘটান কেন যে কাণ্ডে তাঁরা ভালো করে জানেন যে, তাঁদের মানের হানি হবে! আমি বিশ্বাসভঙ্গ করেছি! কিন্তু, আমি তো কাউকে প্রতিশ্রুতি দিইনি যে, এসব কথা কোনওদিন প্রকাশ করব না! অলিখিত চুক্তি নাকি থাকে৷ আসলে এই চুক্তির অজুহাত তারাই তুলছেন, গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেলে নিজের দেবতা চরিত্রটিতে দাগ পড়বে বলে যাঁরা আশঙ্কা করছেন আর তাই চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে দিতে চান যে সীমানা লঙ্ঘন করলে চুক্তিভঙ্গের অপরাধে আমার শাস্তিহবে৷
আমার যদি উচিৎ মনে হয় প্রকাশ করতে যা আমি প্রকাশ করতে চাই— তবে? উচিৎ অনুচিতের সংজ্ঞা কে কাকে শেখাবে? আমার কাছে যদি অশীল মনে না হয় সে কথাটি, যে কথাটি আমি উচ্চারণ করছি— তবে? শীল বা অশীল হিসেব করার মাতব্বরটি কে? সীমা মেপে দেয়ার দায়িত্বটি কার? আত্মজীবনীতে আমি কি লিখব না লিখব, কতটুকু লিখবো, কতটুকু লিখব না, তার সিদ্ধান্তআমিই নেব! নাকি অন্য কেউ, কোনও মকসুদ আলী, কোনও কেরামত মিয়া বা পরিতোষ বা হরিদাস পাল বলে দেবে কী লিখব, কতটুকু লিখব!
সমালোচকরা আমার স্বাধীনতাকে চিহ্নিত করতে চাইছেন স্বেচ্ছাচারিতা বলে৷ আসলে আমাদের সুরুচি-কুরুচি বোধ, পাপ পূণ্য বোধ, সুন্দর অসুন্দর বোধ— সবই যুগ-যুগান্তর ধরে পিতৃতন্ত্রের শিক্ষার পরিণাম৷ নারীর নম্রতা, নতমস্তকতা, সতীত্ব, সৌন্দর্য, সহিষ্ণুতা সেই শিক্ষার ফলেই নারীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত৷ আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত চেতনা কোনোও রূঢ় সত্যের মুখোমুখি হতে তাই আতঙ্ক বোধ করে৷ কোনো নিষ্ঠুর বাক্য শুনলে কানে আঙ্গুল দিতে ইচ্ছা করে, ঘৃণায় ঘিন ঘিন করে গা৷ অনেক সমালোচকেরও বাস্তবে তাই হচ্ছে৷ আমি লেখক কিনা, আমার আত্মজীবনী তাও আবার ধারাবাহিকভাবে লেখার অধিকার আছে কিনা— এমন প্রশ্নও তুলেছেন৷ বস্তুত সবার, যে কোনও মানুষেরই আত্মকথা লেখার অধিকার আছে৷ এমনকি আত্মম্ভর সেই সাংবাদিকেরও সেই অধিকার আছে যিনি মনে করেন আমার হাতে কলম থাকাই একটি ঘোর অলক্ষুণে ব্যাপার৷ আমাকে দোষ দেয়া হচ্ছে এই বলে যে, আমি চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি৷ দায়িত্বহীন হতে পারি, যুক্তিহীন হতে পারি, তবু কিন্তু আমার অধিকারটি ত্যাগ করতে আমি রাজি নই৷
জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, A reasonable man adopts himself to the world. An unreasonable man persists in trying to adopt the world to himself. therefore, all progress depends upon the unreasonable man. —বুদ্ধিমান বা যুক্তিশালী লোকরা পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে চলে৷ নির্বোধ বা যুক্তিহীনরা চেষ্টা করে পৃথিবীকে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে৷ অতএব সব প্রগতিনির্ভর করে এই যুক্তিহীনদের ওপর৷ আমি তসলিমা সেই যুক্তিহীনদেরই একজন৷ আমি তুচ্ছ একজন লেখক, এত বড় দাবি আমি করছি না যে পৃথিবীর প্রগতি আমার ওপর সামান্যতমও নির্ভর করে আছে, তবে বিজ্ঞদের বিচারে আমি নির্বোধ বা যুক্তিহীন হতে সানন্দে রাজি৷ নির্বোধ বলেই তো মুখে কুলুপ অাঁটিনি, যে কথা বলতে মানা সে কথা বলেছি পুরো একটি সমাজ আমাকে থু থু দিচ্ছে দেখেও তো সরে দাঁড়াইনি, নির্বোধ বলেই পিতৃতন্ত্রের রাঘব বোয়ালরা আমাকে পিষে মারতে আসছে দেখেও দৃঢ় দাঁড়িয়ে থেকেছি৷ আমার মূর্খতাই, আমার নির্বুদ্ধিতাই, আমার যুক্তিহীনতাই সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ৷
ধর্মের কথাও উঠেছে৷ আমি, যাঁরা আমাকে জানেন, জানেন যে, সব ধরনের ধর্মীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলি৷ ধর্ম তো আগাগোড়াই পুরুষতান্ত্রিক৷ ধর্মীয় পুরুষ ও পুঁথির অবমাননা করলে সইবে কেন পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহকগণ! ওই মহাপুরুষরাই তো আমাকে দেশছাড়া করেছেন৷ সত্যের মূল্য আমি আমার জীবন দিয়ে দিয়েছি৷ আর কত মূল্য আমাকে দিতে হবে!
দাঙ্গার অজুহাত দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নয়, এর আগে বাংলাদেশেও আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে৷ এই যে নিরন্তর দাঙ্গা হচ্ছে উপমহাদেশে, আমার বই বা বক্তব্য কিন্তু দাঙ্গার কোনও কারণ নয়৷ কারণ অন্য৷
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অতাচারে, গুজরাতের মুসলমান নিধনে, অসমে বিহারি নিগ্রহে, খ্রিস্টানদের ওপর হামলায়, পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি হানাহানিতে আমি আদৌ কোনও ঘটনা নই৷ অকিঞ্চিৎকর লেখক হলেও আমি মানবতার জন্যই লিখি, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষই যে সমান, সকলেরই যে সমান অধিকার মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সে কথাটি হৃদয় দিয়ে লিখি৷ না, আমার লেখার কারণে দাঙ্গার মতো ভয়াবহ কোনও দুর্ঘটনা কোথাও ঘটে না৷ যদি কিছু ঘটে, সে আমার জীবনেই ঘটে৷ আমার লেখার কারণে শাস্তিএক আমাকেই পেতে হয়, অন্য কাউকে নয়৷ আগুন আমার ঘরেই লাগে৷ সকল গৃহ হারাতে হয় এই আমাকেই৷