পেঁজিয়া

পেঁজিয়া

এখন লক্ষ্ণৌয়েরই বাসিন্দা হয়ে গেছি। আমিনাবাদে থাকি। বেঙ্গল ক্লাবের কাছেই আমার ভাড়া বাড়ি। ক্লাবের ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে কী করে যে সারাবছর কেটে যায় বুঝতে পর্যন্ত পাই না। কখনো ভাবিনি যে, কলকাতা ছেড়ে থাকতে পারব পুজোতে। কিন্তু আজ প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল কলকাতাতে যাইনি পুজোতে। এখানকার পুজো নিয়েই থাকি। কয়েক হাজার বাঙালির জমায়েত হয় তখন। খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা সব মিলিয়ে হই-হই করে কেটে যায় দিনগুলো; লক্ষ্ণৌতে আমাদের ক্লাবের পুজোতে ইলাহাবাদ, বেরিলি থেকে যেমন বাঙালিরা আসেন, তেমনিই আসেন এটাওয়া এবং লাখিমপুর খিরি থেকেও। আমিনাবাদ তখন চৌরাহা হয়ে ওঠে।

কিন্তু এবারে লক্ষ্ণৌ ছেড়ে কলকাতাতে আসতে হল। আমাদের কৃতী জামাইবাবু অফিসের কাজে ব্রাজিলে যাচ্ছেন। দিদির ছেলে বস্টনে, মেয়ে হুস্টনে। তাদের পক্ষে সেমিস্টার ছেড়ে এসে দিদিকে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। যতদিন দিদি ভবানীপুরের যৌথ পরিবারে ছিল ততদিন কখনো পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু দিদিরা হাইল্যাণ্ড পার্কের প্রকান্ড ফ্ল্যাটে উঠে আসার পর থেকে খুবই একা একা লাগে দিদির।

যদিও সিকিয়োরিটির ব্যবস্থা খুবই ভালো, তবুও একটা বহুতল বাড়িতে ইনসিকিয়োরিটির ফিলিং হয়ই। দিদি লিখেছিল। সে কারণেই ছুটি নিয়ে আমাকেই আসতে হয়েছে কলকাতাতে। যেহেতু আমি ব্যাচেলার, ছাই ফেলার ভাঙা কুলোর মতো আমারই ডাক পড়ে যতরকম odd jobs-এর জন্যে।

জামাইবাবু যাচ্ছেন মাস খানেকের জন্যে। মাস খানেক তো আমি থাকতে পারব না, দিন পনেরো থেকে ফিরে যাব, তখন আমার এক মাসতুতো ভাই জামশেদপুর থেকে এসে থাকবে। এখানে অন্য কোনো অসুবিধাই নেই। চমৎকার কণ্ডোমনিয়াম, জগিং, ট্র্যাক, জিম সব আছে। দু-টি গাড়ি। একটি অফিসের, একটি পার্সোনাল। সকালে উঠে একবার বাজারে যাই, কোনোদিন গড়িয়াহাট, কোনোদিন মানিকতলা। রাতের খাবার আসে হয় ক্যালকাটা ক্লাব, নয় বেঙ্গল ক্লাব, নয় ক্যালকাটা ত্রিকেট অ্যাণ্ড ফুটবল ক্লাব থেকে। স্মার্ট কার্ড সঙ্গে দিয়ে অর্ডার লিখে দেয় দিদি, ড্রাইভার গিয়ে নিয়ে আসে। দিদির রান্নার মেয়েটির নাম ছিল বিস্পতি। তার সোনারপুরে বাড়ি। বিবাহিতা। দুটি মেয়ে। দুটিরই বিয়ে হয়ে গেছে অনায়াসে। বিস্পতির বর ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ও অবশ্য বলে, ওই ছেড়ে দিয়েছে। কাজ করে না, বাড়ি বসে মদ খেত শুধু।

বিস্পতি একেবারে নিরক্ষর। তাই নিজের নামটাও সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারত না। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড ইত্যাদি জায়গাতে বিসপাতিয়া নামের অনেক মেয়ে দেখা যায়। মুঙ্গনি, বুধিয়া, শুকরি, শানিচারোয়া, ইতোয়ারিন প্রমুখ নামের নাম। তারা তা-ও পুরোনো নামটি উচ্চারণ করতে পারে কিন্তু বৃহস্পতি ‘বৃহস্পতিও’ উচ্চারণ করতে পারত না, বলত বিস্পতি।

আমি যেদিন কলকাতা এসে পৌঁছোলাম তার পরদিনই সন্ধেবেলার ফ্লাইটে জামাইবাবু দিল্লি হয়ে চলে যাবেন। আমি আর দিদি দুজনেই যাব এয়ারপোর্টে। আজ যাবার পথে, বৃহস্পতির কথা হচ্ছিল। দিদি বলল, তাকে তো পরশু রাতেই বিদায় করেছি। দশ দিনের ছুটিতে গেছিল। আমি বলেই দিয়েছিলাম একদিন দেরি হলে আর রাখব না।

জামাইবাবু বলেন, আহা। অমন করো কেন? সাত বছর কাজ করেছে, মাসে দু-দিন তো মোটে ছুটি নেয়, তা-ও প্রতিবারে যাবার আগে সেই দু-দিন রান্না করে রেখে যায়। কখনো কথার খেলাপ করে না। স্বামী নেই, নতুন নাতনি মেয়ে জামাই, নাতি-নাতনির সঙ্গে একটু সাধ-আহ্লাদ করবে—এক-দু-দিন দেরি করলে করুক।

না। আমি ইনডিসিপ্লিন একেবারে সহ্য করতে পারি না। দিদি বলল।

জামাইবাবু বললেন, ট্রিট হার লাইক আ হিউম্যান বিইং। তা ছাড়া, আর বেশি দিন কাজের লোকজন পাবে না। চারদিকে কত কত কারখানা হয়ে যাচ্ছে, বড়ো বড়ো ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের প্যালেসিয়াল বাড়ি—তাদের কাজের লোকেরা তো টেরিলিনের জামা-কাপড়, বছরের দুটি, বোনাস, প্রফিডেন্ট ফাণ্ড সবই পায়। আমাদের বাড়ি দু-আড়াই হাজার টাকা মাইনেতে তারা কাজ করবে কেন?

তারপর বললেন, মেয়েটাকে আমার কিন্তু খুব মিষ্টি লাগে। রোজ সকালে চান করে যখন ডিউটিতে আসে ছোট্ট একটা লাল-রঙা টিপ পরে, তখন ওকে আমি খুব সুন্দরী দেখি।

দিদি বলল, তা তো দেখবেই। কুমড়োপটাস একটা, কেলে ভুজুং। বয়স হলে পুরুষদের রুচি এইরকমই বিকৃত হয়ে যায়।

জামাইবাবু কথা ঘুরিয়ে বললেন, মেয়েটা কিন্তু খুব মজার। মনে আছে তোমার? ও আমাদের এখানে আসার পরে পরে যেদিন খিচুরি আর পেঁয়াজি করতে বলেছিল, ও এসে বলল, পেঁজিয়া করব কি ময়দা দিয়ে, না বেসন দিয়ে?

আমি জামাইবাবুর কথাতে হেসে উঠলাম, বললাম ‘পেঁজিয়া?’

হ্যাঁ রে। জামাইবাবু বললেন। কীরকম ইনোসেন্ট বোঝ একবার।

তারপর বললেন, এমন এমন সব শব্দ চয়ন করত বিস্পতি যেকোনো কবি সেসব শব্দ পেলে লুফে নিত।

দিদি বলল, তা নিত। তোমারই মতো কিছু কিছু পুরুষ তো চিরদিনই ছিল যাদের কাছে মেয়ে হলেই হল, রুচি-ফুচির বালাই তোমাদের মতো পুরুষদের ছিল না কোনোকালেই।

দুই

জামাইবাবুর ফ্লাইট সময়েই উড়ল। আমি ফিরে এলাম দিদির সঙ্গে। ফেরার পথে দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম। বিস্পতির বাড়ি কোথায় ছিল?

কে জানে! সোনারপুরের কোথায়। প্রতি মাসে দু-বার ছুটি নিত। ওর বস্তির ঘরের ভাড়া দেওয়ার জন্যে আর মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনিদের দেখে আসার জন্যে। এবার দশ দিন ছুটি নিল ছোটোমেয়ের বাচ্চা হওয়ার জন্যে। কিন্তু এল বারো দিনের মাথাতে। তা-ও এল রাত দশটাতে। বলল, ট্রেন চলছিল না, তা ছাড়া যা বৃষ্টি।

তাই?

তাই আবার কী? ও-সব ছোটোলোকদের বাহারা। তুই কি সত্যি ভাবছিস নাকি?

আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, তারপর কী হল?

কী আবার হবে? যে-ক-দিনের মাইনে হিসেব হয় তাই দিয়ে বললাম, এখুনি বিদেয় হও। ইনডিসিপ্লিন আমি সহ্য করি না।

তখন তো বৃষ্টি পড়ছিল জামাইবাবু বলছিলেন।

তাতে কী। ছোটোলোকদের আবার বৃষ্টি।

রাতে খেয়ে না হয় শুয়েই থাকত। ভোরে চলে যেত। এতরাতে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে মানুষে কুকুর-বেড়ালকেও তাড়ায় না।

তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ও রাতে তো ফ্ল্যাটেই থাকত, নাকি?

হ্যাঁ, আর কোথায় থাকবে। খাবার ঘরের মেঝেতে শুয়ে থাকত। তোর জামাইবাবু তো আজ কুড়ি বছর হল অন্য ঘরে শোয়। বিস্পতি আমার ঘরেই মেঝেতে বসে আমার সঙ্গে বাংলা সিরিয়ালস দেখতে, এয়ার কণ্ডিশানড ঘরে বসে। এমন আহ্লাদ আর কে দেবে?

আমার মনে পড়ল যে, জামাইবাবু একদিন আমাকে বলেছিলেন, কেন আলাদা ঘরে শুই জানিস রবু? মেয়েদের সঙ্গে সর্বক্ষণ একসঙ্গে থাকলে বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যায়। সব মেয়ে আবশ্য সমান হয় না। তোর দিদি জগতের পরিধিটা এতই ছোটো করে এনেছে, দিন-রাত সংসার, চাকরবাকর শুচিবায়ুগ্রস্ততা। আর টিভি। চব্বিশ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকলে হয় স্ত্রৈণ হয়ে যাব, নয় বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যাবে।

তারপর বলেছিলেন, আলাদা ঘরে শোওয়া মানেই যে সম্পর্ক নেই তা তো নয়। তা একঘরে থেকে অন্য ঘরে যেতে আর অসুবিধে কী? তা ছাড়া, শুয়ে শুয়ে অভ্যেসই খারাপ হয়ে গেছে। তারপর একটু হেসে বলেছিলেন, পরস্ত্রী ছাড়া কারও সঙ্গেই একঘরে রাত কাটানো বোধ হয় অসম্ভব হয়ে গেছে।

দিদিকে বলব একথা?

বলতে পারিস। তবে বলে কী লাভ। পরস্ত্রী আর পাচ্ছি কোথায় বল। কত নারীকেই তো ভালো লাগে কিন্তু সেই ভালো লাগাটুকু দিয়ে স্বপ্নই সার। আসলে আমাদের সকলের জীবনই স্বপ্নময়। তোর দিদিও হয়তো স্বপ্ন দেখে কারও কারওকে।

তারপর বলেছিলেন, ব্যাপারটা কী জানিস। বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নই বোধ হয় ভালো। ত্বকের ছোঁয়ায় স্বপ্ন মরে যায়।

বাব্বা:। আপনি দেখি কবির মতো কথা বলছেন।

কবি তো আমরা সবাই-ই। কেউ মনে লিখি আর কেউ কাগজে।

গাড়িটা যখন বাইপাস দিয়ে চলেছে আমি দিদিকে বললাম, তা বিস্পতি কোথায় গেল ওই বৃষ্টিঝরা রাতে? খোঁজ করেছিলে?

দিদি বলল, আমার ভারী দায় পড়েছে। জানি না। ওর বড়োমেয়ের কাছে গিয়ে থাকবে হয়তো রাতটা।

সে কোথায় থাকে?

ওই বৈষ্ণবঘাটা না পাটুলি কোথায় যেন। তাচ্ছিল্যের গলাতে বলল দিদি।

সেইসব জায়গাও তো তোমার ফ্ল্যাটে থেকে অনেকই দূর। তা ছাড়া ওকে যদি ছাড়িয়েই দেবে, কিছু থোক টাকা দিয়ে দিলেই পারতে। এত বছর কাজ করল। জামাইবাবুও তো তাই-ই বলেছিলেন।

ছাড় তো। বেশি কমিউনিস্টগিরি করিস না। যা করেছি, বেশ করেছি। তোর জামাইবাবু সংসার চালানোর কী বোঝে?

আমি চুপ করে রইলাম।

দিদি তারপরে বলল, চলল ফেরার পথে আই. টি. সি. সোনার বাংলাতে খেয়ে যাই। দারুণ চাইনিজ রেস্তরা করেছে ওরা। হুইস্কিও খেতে পারিস।

সেভেন স্টার হোটেলে হুইস্কি? বাব্বা: আমার হজম হবে না। বড়োজোর এক বোতল বিয়ার খেতে পারিস।

ওখানে বিয়ারও কি সস্তা নাকি? দুশো টাকা নেবে কম করে।

ছাড়ো তবে।

দু-জনের খেতে হাজার দুই তো লাগবেই। একবোতল বিয়ারে আর কতটুকু ফারাক হবে। বোঝার ওপরে শাকের আঁটি, চলল চলল। তুই একবছর পরে এলি, তোকে খাতির করতে বলে গেছে জামাইবাবু।

রাতে বাড়ি ফিরে গেস্টরুমে শুয়ে আমি অদেখা বিস্পতির কথা ভাবছিলাম।

বাইরে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। সাইক্লোনিক ওয়েদার। এ-দিকটাতে একেবারে ফাঁকা। হাওয়া শোঁ শোঁ শব্দ করছে একটানা।

তাকে আমি চোখে দেখিনি। জামাইবাবুর বর্ণনা মনে পড়ছিল। সকালে চান করে আসা ছোট্ট লাল টিপ পরা সুন্দর মুখটির কথা ভাবছিলাম। বিস্পতি থাকলে খিচুড়ি আর পেঁজিয়া খেতাম আজ রাতে। এই দুর্যোগের রাতে মেয়েটা কোথায় আছে কে জানে। বিস্পতির অভিযোগে বোধ হয় দিদি এখনও কাজের লোক পাচ্ছে না। গরিবের আশীর্বাদও কাজে লাগে। যদিও আমার আপন দিদি, কিন্তু ভাবছিলাম সময় মানুষকে কত বদলে দেয়। ভবানীপুরের বাড়ির বাগানে এমন রাতে ঝড়ে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া পাখি বা কাঠবিড়ালির প্রতি ছেলেবেলাতে দিদির যা দরদ ছিল আজকে মানুষের ওপরও সেই দরদ আর রাখে না দিদি। বড়ো দুঃখ হচ্ছিল আমার। যতখানি না বিস্পতির কথা ভেবে, তার চেয়েও বেশি দিদির কথা ভেবে। সাচ্ছল্য মানুষকে যতখানি বদলে দেয় দারিদ্র্যও ততখানি বদলায় না।

তারপরেই ‘পেঁজিয়া’র কথা মনে হল। নিজের মনেই, দুঃখের মধ্যেও হেসে উঠলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *