পৃথ্বীরাজ

পৃথ্বীরাজ

পৃথ্বীরাজ, টিপু সুলতান আর পিণ্ডারী দস্যুদলের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ বাধিয়া গিয়াছে। পিণ্ডারীদের দুই-তিনজন আহত হইয়া ধরাশয্যা লইয়াছে, তবু দুর্ধর্ষ দলটা হটিতে চাহে না। টিপু সুলতানের কানের কাছ দিয়া একটি আঁকাবাঁকা আমের ডাল বোঁ করিয়া বাহির হইয়া গেল; সেটা কুড়াইয়া লইয়া দস্যুদের আক্রমণ করিতে যাইবে, এমন সময় পৃথ্বীরাজের করচ্যুত একটা মাটির চাংড়া পিণ্ডারী-সর্দারের নাকের উপর পড়িয়া নাকের নীচেটা রক্তে এবং মুখের বাকিটা ধূলায় ধূসরিত করিয়া দিল।

এই সময় টিফিন-পিরিয়ড শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়িল। টিপু সুলতান এবং অক্ষত পিণ্ডারী কয়জন ছুটিয়া গিয়া ক্লাসে বসিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত যে যাহার পড়া শুরু করিয়া দিল। তিনটি পিণ্ডারী আহত হইয়াছিল, তাহারা নিজের নিজের জখমে হাত দিয়া মন্থর-গতিতে স্কুলের দিকে আসিতে লাগিল। রণক্ষেত্রে রহিল মাত্র পৃথ্বীরাজ এবং পিণ্ডারী- সর্দার। বিজেতা গিয়া আহত শত্রুকে সমবেদনার কোমল স্বরে প্রশ্ন করে, “বড্ড লেগে গেছে, না ভাই?”

পিণ্ডারী বলিল, “বেশি নয়। ইস্, তোর পা-টা—”

“ও কিছু নয়; দাঁড়া, কাপড়ের খুঁটটা একটু ভিজিয়ে নিয়ে আসি।”—বলিয়া পৃথ্বীরাজ একটু খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে জলের ঘরের দিকে ছুটিল। জল আনিয়া নাকটা মুছাইয়া দিতেছিল, পিণ্ডারী বলিল, “এর পরেই নবীন মাস্টারের ক্লাস, আজ আবার নতুন বেত কেড়েছে।”

এমন সময় স্কুলের বারান্দা হইত টিপু সুলতান হাঁক দিল, “তোমরা সব এস শিগগির, স্যার ডাকছেন; খেলা যে তোমাদের শেষ হতে চায় না?”

পিণ্ডারী বলিল, “নিশ্চয়ই সব ব’লে দিয়েছে।”

পৃথ্বীরাজ বলিল, “তা’লে আজ এপার কি ওস্পার যা হয় একটা করব, ওকে আস্ত রাখব না।”

বারান্দা হইতে তাগাদা আসিল, “চলে এস, স্যার কতক্ষণ ব’সে থাকবেন?”

দুইজন উগ্রভাবে চাহিয়া দেখিল। পৃথ্বীরাজের চেহারাটা অত্যন্ত কালো এবং চোখ দুইটা অত্যন্ত সাদা বলিয়া করুণার চক্ষে চাহিলেও উগ্র দেখায়। আহত পিণ্ডারী-দস্যু কয়টি থামের আড়ালে ইহাদের অপেক্ষায় ছিল; সকলে একসঙ্গে প্রবেশ করিল। টিপু নিজের আসনে বসিয়া একটা বই খুলিয়া বলিল, “স্যার, আমরা ততক্ষণ সময় নষ্ট না ক’রে পুরনো পুড়া করি।”—বলিয়া একবার অপরাধীদের পানে চাহিল।

নবীন মাস্টার প্রশ্ন করিলেন, “রসকে, পৃথ্বীরাজের তারিখ কত?”

রসিক অর্থাৎ বর্তমান ঘটনার পৃথ্বীরাজ চুপ করিয়া রহিল।

নবীন মাস্টার আবার প্রশ্ন করিলেন, “মাখা, টিপু সুলতান কোন্ সালে জন্মেছিল?”

মাখনলাল অর্থাৎ এই আখ্যায়িকার পিণ্ডারী-সর্দার যেন তারিখটা ‘পেটে আসছে মুখে আসছে না’ ভাব দেখাইয়া কড়িকাঠের দিকে চাহিয়া রহিল।

নবীন মাস্টার বলিলেন, “হুঁ। আর আপনারা দয়া করে বলতে পারেন, পিণ্ডারীরা আকবরের কে হ’ত?”

যে তিনটিকে আহত পিণ্ডারী-দস্যু বলিয়া পরিচিত করিয়াছি, তাহাদের দুইজনে, যেন ভয়ানক মুখস্থ আছে এই ভাবে মনে করিবার ভঙ্গিমায় দ্রুত ঠোঁট নাড়িতে লাগিল। তৃতীয়টি অত্যন্ত ঘাবড়াইয়া গিয়াছিল। নবীন মাস্টারের রসিকতা ধরিতে না পরিয়া বৈরাম খাঁর সহিত গোলমাল করিয়া বলিয়া ফেলিল, “আকবরের পিসেমশাই হ’ত স্যার।”

সপাৎ করিয়া বেত নামিল।—”আকবরের পিসেমশায় হ’ত, ভিন্সেন্ট স্মিথের ঠাকুরদাদা রায় দিলেন।” অন্য পিঠগুলোতেও সপাসপ সপাসপ আওয়াজ হইতে লাগিল। নবীন মাস্টার গর্জাইতে লাগিলেন, “লক্ষ্মীছাড়া সব পেটে বোমা মারলে হিস্ট্রির একটা অক্ষর বেরোয় না—পৃথ্বীরাজ, টিপু সুলতান আর পিণ্ডারীদের একসঙ্গে লড়াই হচ্ছে! হিস্ট্রির পিণ্ডি চটকানো হচ্ছে! এই রকে লক্ষ্মীছাড়া হচ্ছে হারামজাদার জড়!”

আবার সপাৎ সপাৎ করিয়া বেতের ঘা পড়িতে লাগিল।

রসিকের কালো মুখ রাগে, অপমানের যন্ত্রণায় তামাটে হইয়া উঠিয়াছিল। উস উস করিয়া চোখ-মুখ কুঁচকাইয়া মার খাইল। শেষ হইলে প্রচণ্ডভাবে একবার টিপুর দিকে চাহিয়া লইয়া দাঁতে দাঁত পিষিয়া বলিল, “আমরা একটুও মারামারি করিনি; কে বলেছে?”

নবীন মাস্টার হঠাৎ বেত বন্ধ করিয়া দিলেন, ডাকিলেন, “অন্তা!”

অনন্তকুমার অর্থাৎ আজিকার টিপু সুলতান মাস্টারকে শুনাইয়া,–”আমায় এখানটা একটু বুঝিয়ে দাও তো ভাই।”—বলিয়া সবে পাশের ছেলের নিকট জিওমেট্রির একটা পাতা মেলিয়া ধরিয়াছিল; আহ্বানমাত্রেই উঠিয়া দাঁড়াইয়া উত্তর দিল, “আজ্ঞে স্যার?”

“এরা আজ মোটেই লড়াই করে নি?”

“করেছিল বই কি স্যার; অমি স্যার কত ক’রে বুঝিয়ে বললাম স্যার, টিফিন পিরিয়ডটা কি ভাই হুড়োহুড়ি দাপাদাপি করবার জন্যে স্যার দিয়েছেন? তা আমার কথা স্যার—”

আর শেষ করিতে হইল না, রসিক বাঘের মত একটা লাফ দিয়া অন্তার ঘাড়ে পড়িল এবং তাহার মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে টানিয়া লইয়া চাপা কান্নার একটা ‘গি-গি’ শব্দ করিতে করিতে কিল চড় আঁচড়ানি কামড়ানি যাহা সুবিধা পাইল, তাহাই দিয়া নিজের আশ মিটাইয়া মাথাটা ঝাঁকানি দিয়া পিছনে ঠেলিয়া দিল এবং পলকের মধ্যে নবীন মাস্টারের লাঠিটা টেবিল হইতে তুলিয়া লইয়া এক দৌড়ে সদর-রাস্তার উপর আসিয়া দাঁড়াইল। সেখানে দাঁড়াইয়া লাঠিটা খেলাইয়া চিৎকার করিতে লাগিল, “আজ সমস্ত স্কুল এক ধারে, আর রসিক এক ধারে। একটা এপার কি ওপার যা হয় কিছু করব। চ’লে আয় অন্তা, মরদকা বাচ্চা হ’স তো।”

সমস্ত স্কুলটা বারান্দায় আসিয়া জড় হইল। শিক্ষকেরা ‘ধ’রে আন্ ছোঁড়াকে, ধ’রে আন্’ বলিয়া অনিশ্চিতভাবে হুকুম করিতে লাগিল; কিন্তু কেহই আর বারান্দা হইতে নামিতে সাহস করিল না। দারোয়ান রামভজ্জু ‘হামি যাবে, হানমানজীকে কিরূপাসে’ বলিয়া নামিয়া গটগট করিয়া কয়েক পা অগ্রসর হইল। রাস্তায় বিছাইবার জন্য এক জায়গায় পাথর-ভাঙা জড় করা ছিল। “চলে আয়, এই তো মাংতা হ্যায়!—” বলিয়া রসিক সেইখানে গিয়া দাঁড়াইল। রামভজ্জু পিছনে ফিরিয়া দেখিতে দেখিতে তাড়াতাড়ি বারান্দায় ফিরিয়া আসিল। বলিল, “ও ডাকু আছে; ইস্কুলের গাছের আমগুলোকে ঢিল মেরে লুকসান করিয়েসে বাবু? ওহি তো।”

রসিকের এই প্রথম অপরাধ নয়, এবং এইটাই যে সবচেয়ে উৎকট তাহাও নহে। ছোকরা পৃথ্বীরাজ, টিপু সুলতান, শিবাজী, নাদিরশাহ প্রভৃতি কয়েকটি দুর্মদ ঐতিহাসিক চরিত্রের অত্যন্ত পক্ষপাতী এবং তাহাদের ভূমিকায় এ যাবৎ যে সব দৌরাত্ম্য করিয়াছে, তাহার এক-একটাতেই এক-একটি রোমাঞ্চকর কাহিনী হইয়া দাঁড়ায়। সে সব ভীষণ ব্যাপারের উল্লেখ যত কম করা যায়, ততই ভাল।

.

রসিকের নাম কাটিয়া দেওয়া হইল। তাহার পিতা গিয়া হেডমাস্টারের হাতে ধরিলেন। নূতন লোক—কড়া প্রিন্সিপ্‌লের, বলিলেন, “অমন দুর্দান্ত বদমায়েশ ছেলের নাম আর লেখা যেতে পারে না; তবে আমি গুড ক্যারেক্টারের সার্টিফিকেট দিচ্ছি, অন্য স্কুলে আপত্তি করবে না। কি জানেন? ছেলেদের সত্যি কথা বলতে উপদেশ দোব আর নিজেদের কথার কিংবা কাজের একটা—” ইত্যাদি।

রসিকের শিক্ষাপর্ব এইরূপে শেষ হইল। পিতা বলিলেন, “হতভাগাকে এবার এমন জায়গায় দোব যে, উঠতে বসতে বেত—উঠতে বসতে বেত।”

রসিকের ঠাকুরমা উৎকণ্ঠিত ভাবে বলিলেন, “ওমা, কি অলুক্ষুণে কথা গো! ঢের বিদ্যে হয়েছে; কুলীনের ছেলে—এইবার বিয়ে দিতে আরম্ভ কর। তিনি বেঁচে থাকলে এতদিন কটা বিয়ে যে-

রসিকের পিতা বলিলেন, “আরম্ভ কর মানে? তোমরা কি ভেবেছ, কুলীন ব’লে ছেলের গলায় দশ বারোটি বউ ঝুলিয়ে দোব? আমার চারটে মা, ছটা সেজো খুড়ি আর তিনটে নিজের পাপ পুষতে পুষতে নাজেহাল হতে হল; আবার ও-পাঠে আমি পড়ি? বিয়ে দোব সেই ‘একে চন্দ্র’—তাও এখন ঢের দেরি।”

রসিকের ঠাকুরমা তখন তিনটি পুত্রবধূ এবং তদনুরূপ নাতনী নাতবউ সকলকে লইয়া একটা কড়া দল তৈয়ারি করিয়া অষ্টপ্রহরই কান্নাকাটি শুরু করিয়া দিলেন। প্রথম প্রথম কর্তার অগোচরেই এবং অবশেষে তাঁহার জ্ঞাতসারেই ঘটকিনী যাতায়াত করিতে লাগিল। প্রথমটা কর্তা রোষ এবং বিরক্তি প্রকাশ করিতে লাগিলেন, তাহার পর ঔদাসীন্য এবং অবশেষে ঘটকিনীর হাতের শাঁসালো কন্যাপক্ষের পরিচয় পাইয়া খোশামোদ শুরু করিয়া দিলেন।

শেষে একদিন, স্কুল ছাড়িবার মাসতিনেকের মধ্যে, এক জমিদার রায় সাহেবের কন্যার সহিত রসিকের শুভবিবাহ হইয়া গেল। মেয়েটি থার্ড ক্লাস পর্যন্ত পড়া; রসিকের ও বিদ্যার সীমা ওই পর্যন্ত বলিয়া সকলে বলিল, “বাঃ, এও এক রকম রাজযোটক।”

জোড়ে গিয়া রসিক অন্যান্য উপহারের মধ্যে শালীদের তরফ হইতে যোগীন্দ্রনাথ বসুর একখানি ‘পৃথ্বীরাজ’ মহাকাব্য লাভ করিল! ছয়-সাত দিন পরে যখন ফিরিয়া আসিল, কাব্যখানি হইতে বাছা বাছা অংশ তাহার অনেক কণ্ঠস্থ হইয়া গিয়াছে। মাখনের সঙ্গে দেখা হইতে বলিল, “অ্যায়সা এক কেতাব পাওয়া গেছে রে!”

মাখন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিল।

“তবে শোন্।”—বলিয়া রসিক বইটা হইতে খানিকটা গুরুগম্ভীর কবিতা গড়গড় করিয়া আওড়াইয়া গেল। শেষ করিয়া বুকটা চিতাইয়া অল্প অল্প হাসিয়া মাথা নাড়াইতে লাগিল। বলিল, “কেমন, রক্ত টগবগ ক’রে ওঠে না।”

মাখন নিরীহ ভাল মানুষের মত মাথা নাড়িয়া জানাইল, “ওঠে।”

রসিক বলিল, “বিকেলবেলায় আসিস; সেইখানটায় গিয়ে দুজনে পড়া যাবে—রোজ। শ্বশুরবাড়িতে বউয়ের সঙ্গে পড়তাম। আগে সে চুপিচুপি কি একটা বই বের করলে—কি বিদ্যের বই, তার বউদি বিয়েতে উপহার দিয়েছে—মোটেই ভাল লাগল না। তারপর দুজন এইখানা পড়তাম। সমস্ত রাত কেটে যেত—তার তো আমার চেয়ে বেশি মুখস্ত হয়ে গেছে। খুব বিদ্বান ভাই; দেখতেও, সবাই বলে, বেশ; মাথায় তোর মতন হবে—”

মাখন বলিল, “তোর সঙ্গে কথা হয়?”

রসিক বিস্মিতভাবেই চাহিল।

মাখন জবাবদিহিস্বরূপ বলিল, “বউদি দাদার সঙ্গে কথা কয় না কিনা!”

রসিক বিজ্ঞের মত প্রায় উচ্চহাস্য করিয়াই বলিল, “ওটা ওদের দিনের বেলা লোক- ঠকানো; রাত্তিরে সব বউয়েরা কথার জাহাজ—তোর বউদিও, আমার বউও। বিয়ে করলে দেখবি, এই রকম অনেক নতুন মজা আছে।”

তাহার পর গম্ভীরভাবে কহিল, “কিন্তু ভাই, গরিব রসিকের একটা কথা মনে রেখো, যে বাড়িতে মেলা শালাজ আছে, সেখানে বিয়ে ক’রো না, আড়ি পেতে পেতে নাকাল ক’রে মারবে। একদিন রাত্তিরে আমার রক্ত মাথায় উঠে গিয়েছিল, একটা এপার কি ওস্পার করেছিলাম আর কি–বউ পা দুটো জড়িয়ে ধরলে তাই রক্ষে। শালাজ কাকে বলে জানিস তো? হুঁঃ, তুই বেচারী আর কোত্থেকে জানবি? শালার বউ—ডবল কুটুম কিনা, এক নম্বর বদমাইশ। তোদের নবীন মাস্টারের বেতকেও হার মানাতে পারে।”

নবীন মাস্টারের নামে তাহার আর একটা কথা মনে পড়িয়া গেল, জিজ্ঞাসা করিল, “অন্তা কোথায় র‍্যা? তাকে একদিন আচ্ছা ক’রে গোবেড়েন দিতে হবে, সেদিন তেমন জুত হয় নি।”

.

এই রকম ভাবে পনরো-ষোল দিন কাটিল; একদিন রসিক চোখ নাচাইয়া বলিল, “তোদের রসিক যে কাঁদিয়ে চলল রে ছোঁড়া, একেবারে যার নাম বিলেত; শ্বশুর টাকা দিচ্ছে।”—বলিয়া মাখনের মুখের ভাবটা লক্ষ্য করিবার জন্য চাহিয়া রহিল। একটু পরে তাহার কাঁধে একটা সখ্যতার চাপড় বসাইয়া বলিল, “না রে না; তুই যে ভেবেই খুন! শ্বশুরের পয়সায় ছেলেকে বিলেত পাঠাবে, বাবা সে বান্দাই নয়। তা ছাড়া আমরা না কুলীন? সে কথা বুঝি ভুলেই গিছলি তুই? শ্বশুর কিন্তু উঠে প’ড়ে লেগেছে ভাই; বলে, ‘এইখানে এসে পড়াশুনো করুক, তারপর বিলেত গিয়ে—

মাখনের মনে অন্য একটা বিষয় তোলপাড় করিতেছিল, কহিল, “অন্তাকে মারবার একটু সুবিধে হয়েছে।”

রসিক সাগ্রহে প্রশ্ন করিল, “কি রকম?”

“আমরা যেখানে বই পড়ি, সে জায়গাটা টের পেয়েছে, আজ আসবে; আমায় বললে— ‘বলে দিস তোর গুরুদেবকে’।”

রসিক তাহার পিঠে তিন-চারটা ছোট চাপড় দিয়া বলিল, “চট ক’রে যা, সেইখানটায় কতগুলো ইঁট ভেঙে জড়—”

মাখন বলিল, “সে রেখে এসেছি, আর নদী থেকে পাঁক তুলে রেখেছি—চোখের জন্যে, আর ভিজে মাটি আর বিচুটির ঢেলা।”

রসিক বিস্ময় এবং প্রশংসায় চাহিয়া রহিল; ভাষা পাইল না যে, মনের ভাবটা প্রকাশ করে।

গিয়া দেখিল, একটা কথাও মিছা নয়; যুদ্ধের মালমসলা গাঁদি করা রহিয়াছে। “কখন আসবে?”—বলিয়া বসিয়া গল্প করিতে লাগিল। বলিল, “বিলেত যাবার আমারই কি ইচ্ছে নাকি তোদের ছেড়ে? বউটাও তা হ’লে বাঁচবে না। বউয়ের নাম অমলা। বাবা বলেছে, ‘এ কটা মাস ঠাণ্ডা হয়ে থাকুক, তারপর হেড-মাস্টারকেও ব’লে ক’য়ে নামটা লিখিয়ে দেব’খন। কেন শ্বশুরের পয়সায় বিলেত যাবে, আর কেনই বা শ্বশুরের ভাতে প’ড়ে থাকতে যাবে?’ তা, আর ডানপিটেপনা ছেড়েই দোব ভাবছি; শুধু একবার অন্তাকে আচ্ছা-আ ক’রে —”

মাখন অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া ছিল, বলিল, “ওই সব আসছে।”

একটা জঙ্গলের মোড় ফিরিয়া চার-পাঁচজন ছেলে দেখা দিল—বিশ-ত্রিশ গজ দূরে। দুই-একজনের পকেট ভারী, মাখন বলিল, “ঢিল আছে।” অন্তা পিছনে ছিল। জিজ্ঞাসা করিল, “আরে, মাখন যে! এখানে? তোমরা সব দেখে রাখ ভাই, স্যার আমাদের অত ক’রে একজনের সঙ্গে মিশতে—”

কথা শেষ হইবার পূর্বেই পাশের একজনের মাথায় ঠকাস করিয়া একটা ঢিল সজোরে আসিয়া পড়িল। আর একজনের ঠোঁটের উপর একট বিচুটি-বাহক ঢেলা পড়িয়া একসঙ্গে যন্ত্রণা এবং কুটুকুটুনিতে অস্থির করিয়া দিল। অনন্তকুমার সুড়ুৎ করিয়া বনের আড়ালে সরিয়া পড়িয়াছিল, সেখান হইতেই বলিল, “তোমরা কেউ পিঠ দেখিও না চালিয়ে যাও; আমি বাবার বন্দুকটা নিয়ে এলুম ব’লে—”

রসিক উৎকট চিৎকার করিয়া তাহাকে তাড়া করিতে তাহার ডান পায়ে একটা আধলা ইঁট আসিয়া পড়িল, তাহারও উপর অগ্রসর হইতে একটা ঢিলে কপালটা ফাটাইয়া দিল। বিপক্ষ দল অনন্তকুমারের পথ ধরিল।

রসিক নিজের কাপড়টা ছিঁড়িয়া মাখনকে বলিল, “বেঁধে দে।” তাহার পর তাহার কাঁধে ভর দিয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে বাড়ি চলিল। পথে বলিল, “অস্তা হারামজাদা খুব সটকে পড়ল। আচ্ছা, রসিককে কতদিন ফাঁকি দিয়ে থাকবে?”

.

বাড়িতে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল। রসিকের বাপ বলিলেন, “নাঃ, ভেবেছিলাম, হতভাগাকে ঘরজামাই হতে দোব না; ওর কপালে শ্বশুরবাড়ির ঝাঁটা লেখা আছে, তার আমি কি করব? কাল পর্যন্ত ওর শ্বশুরের চিঠি এসেছে—আমি কাটান দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আর না, দোব বিদেয় ক’রে। যাক সেখানে গিয়েই থাকুক, আর গ্রামের ত্রিসীমেয় ঢুকতে দোব না।”

ঠাকুরমা কান্নার আওয়াজ চড়াইয়া বলিলেন, “ওরে, তারা যে বিলেত পাঠিয়ে খেরেস্তান ক’রে অমন সোনার চাঁদকে পর ক’রে দেবে রে! আমার বুড়ো বয়সে কি শেষে এই দুর্গতি ছিল! আজ তিনি বেঁচে থাকলে তোরা অমন কথা কি মুখে আনতে পারতিস?” এক সত্মা বলিলেন, “তার চেয়ে বউকে নিয়ে এস বাপু, ছেলে ঠাণ্ডা থাকবে খন, ডাগর বউ—”  

অন্য সত্মা পরামর্শ দিলেন, “কিংবা আর একটি বিয়ের কথাবার্তা শুরু ক’রে দাও না কেন? ছেলে একটু অন্যমনস্ক থাকবে’খন। সেই রাণাঘাটের মেয়েটি যেন আমার চোখে লেগে আছে।”

রসিকের মা কিছু বলিলেন না; শুধু অশ্রুজলের তর্ক চালাইয়া গেলেন।

কিন্তু কোন ফল হইল না। কপালের ঘাটা সারিয়া গেলে শ্বশুরবাড়ির যাত্রী হইয়া রসিক রেলগাড়িতে সওয়ার হইল। গাড়িটা ঠিক ছাড়িবার সময় মাখন প্ল্যাটফর্মের একটা কোণ হইতে সজল নেত্রে মৌনভাবে গাড়ির সামনে দাঁড়াইল, রসিক চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া হাসিয়া বলিল, “কোথায় ছিলি রে এতক্ষণ?” তাহার পর চাপা গলায় ডাকিল, “শোন্।”

মাখন কাছে আসিলে চুপিচুপি বলিল, “শিগগির ফিরে আসছি; শিবাজী সন্দেশের চ্যাঙাড়ির মধ্যে দিয়ে কেমন বাদশাকে কলা দেখিয়ে পালিয়েছিল, মনে নেই?”—বলিয়া মাখনের দিকে চাহিয়া মিটিমিটি হাসিতে লাগিল।

মাখন এই সংকেতের গূঢ় অর্থটুকু হৃদয়ঙ্গম করিয়া অশ্রুসিক্ত মুখখানি অন্য দিকে ফিরাইল।

রসিকের শ্বশুর রায় সাহেব পান্নালাল রায় চৌধুরী জমিদার এবং কোটপ্যান্টধারী বাদ দিয়া আর সবার কাছেই প্রবল প্রতাপান্বিত। রাজসম্মানের ফসল তুলিয়া আবার জমিতে সার দিতেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের শ্যালক সম্প্রতি ভারতে পদার্পণ করিয়াছে, তাহার একটা হিল্লে করিয়া দেওয়ার দায়িত্ব লাভ করিয়া একটু চিন্তান্বিত আছেন। সাহেব বলিয়াছেন, লোকটি বরফের উপর স্কেটিং করিতে ইংলন্ডে অদ্বিতীয়। আর কোন গুণ আছে কিনা, সাহেব নিজেও বলেন নাই এবং রায় সাহেবেরও প্রশ্ন করিবার সাহস হয় নাই। স্ত্রী পুত্র, আমলা গোমস্তা, দাস দাসী সকলের উপরই তিরিক্ষি হইয়া ক্রমাগতই ভাবিতেছেন, বরফের ওপর স্কেটিং করে, এমন লোককে কোথায় বসানো যায়! ইতিমধ্যে বেহাইয়ের পত্র আসিল, তিনি রাজী, রায় সাহেব তাঁহার জামাইকে যে রকম ভাবেই না কেন শিক্ষা দান করেন— বিলাতে পাঠাইয়াই হউক কিংবা বাড়িতে রাখিয়াই হউক।

রায় সাহেবের বিলাতে পাঠানোই ইচ্ছা ছিল। জামাই সেখান হইতে একটা কেষ্টবিষ্টু হইয়া আসিলে মেয়েদের জিদে কলের খাতিরে অপদার্থ জামাই করার অপবাদ তো তাঁহার মিটিবেই, চাই কি ঈশ্বর মুখ তুলিয়া চাহিলে ওই বিলাতফেরত জামাইয়ের জোরেই শেষ বয়সে শাঁসালো-গোছের খেতাব লইয়া মরিতে পারিবেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে গিয়া বলিলেন, “হুজুর আপাতত তো আমার হাতে কোন কাজ নেই, যা মিস্টার আইলের বহুমুখী প্রতিভার উপযোগী হতে পারে। তবে ভাবছি, জামাইটিকে আপনাদের ‘হোমে’ পাঠাব। মিঃ আইল যদি অনুগ্রহ ক’রে তাকে একটু একটু ইংরেজি শিক্ষা দেন এবং ভারতবর্ষীয় অসভ্যতা ছাড়িয়ে আদব-কায়দা একটু তালিম দেন তো মস্ত একটা উপকার হয়। আপনারা রাজার জাত, আমি আর কি প্রতিদান দিতে পারি? তাঁকে আমার বাগানবাড়িটা ছেড়ে দোব; পান তো খান না—সিগারেট খাবার জন্যে মাসে শ-তিনেক ক’রে দোব; একটা মোটর-গাড়ি চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর অধীনে থাকবে, আর—আর চণ্ডীমণ্ডপটা পরিষ্কার ক’রে রাখব, শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধানো আছে, ইচ্ছে হলে স্কেটিং খেলবেন। হতভাগা বাংলাদেশে বরফ জমে না—এসে পর্যন্ত তাঁর স্কেটিঙের কত অসুবিধেই না হচ্ছে! উচ্ছন্ন যাক এমন দেশ।”

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বলিলেন যে, রায় সাহেবের বন্ধুত্বই তাঁহার পরম মূল্যবান সামগ্রী—তিনি তাঁহার কোন প্রস্তাবেই আপত্তি করিতে পারেন না, এবং আশা করেন, তাঁহার শ্যালক মিঃ আইলও তাঁহার খাতিরে সম্মত হইবেন! তবে যেমন সিগারেট খাইবার জন্য রায় সাহেব তিন শত দিবেন বলিয়াছেন, সেই সঙ্গে খানা প্রভৃতির জন্যেও যদি আরও শ খানেক ধরিয়া দেন তো মিঃ আইলকে রাজী করানো সহজ হইয়া পড়িবে।

রায় সাহেব এটা তাঁহার পরম সৌভাগ্য মানিয়া লইলেন। আসিবার সময় শেকহ্যান্ডের পর গোটা দুই-তিন আভূমি দীর্ঘ সেলাম ঠুকিয়া বলিয়া আসিলেন, “হুজুর গোলাম বার্থ-ডে অনার্স-লিস্টে এবার একেবারেই বাদ প’ড়ে গেল। সামনে নতুন বছর, খেতাব-বিবরণ আসছে—আপনারই হাতে সব।”

.

রসিকের তালিম শুরু হইল। শ্বশুর বলিলেন, “বাবাজী, একটু তাড়াতাড়ি সায়েবের কাছে কিছু ইংরেজি লেখাপড়া আদায় ক’রে নাও। যত শিগগির নিজের কাজ গুছিয়ে নিজেকে বিলেত যাবার যুগ্যি ক’রে নিতে পার, ততই ভাল। অন্য মাস্টার রাখলেও চলত, একটা খাতিরে প’ড়ে মাস গেলে এই পাঁচ শো টাকার ধাক্কায় প’ড়ে গেছি।”

রসিকের বিশেষ তাড়াতাড়ি ছিল না। সমস্ত রাত নববধূর সঙ্গে কাব্যচর্চা করে। সমস্ত দিন ধরিয়া বধূটি ঘুমাইয়া কাটায় আর বরটি শিক্ষকের কাছ বসিয়া ঢোলে। শিক্ষক বিলাতের নূতন উৎসাহ লইয়া দিনকতক খুব চেষ্টা করিল! ছাত্রকে ইংরেজি শিক্ষা দেবার সুবিধার জন্য নিজে খানিকটা বাংলাও শিখিয়া ফেলিল। কিছুই ফল হইল না। তখন সে আরামকেদারায় পা তুলিয়া দিয়া অবিচ্ছিন্নভাবে সিগারেট টানিতে শুরু করিয়া দিল। মনে হইল যেন তিন শো টাকার শেষ আধলাটি পর্যন্ত ধোঁয়ায় পরিণত করিয়া উড়াইয়া দিবে।

কথাটা যখন জানাজানি হইয়া গেল, রসিক-দম্পতিকে বিভক্ত করিয়া আলাদা আলাদা ঘরে জায়গা করিয়া দেওয়া হইল। বধূটির বড় লজ্জা ও একটু দুঃখ হইল, এবং রসিকের হইল রাগ। কয়েকদিন পরে যখন ওর লজ্জার জড়তা এবং রাগের বেগ অনেকটা কাটিয়া গেল, তখন গোপনে পত্রাচার আরম্ভ হইল। তাহাতে আমাদের ঘরোয়া আটপৌরে প্রেমের হা-হুতাশ বড় থাকিত না,—এ-দিক হইতে থাকিত বই-থেকে-তোলা পৃথ্বীরাজের বীরোচ্ছ্বাস আর ও-তরফে ক্ষত্রিয়কুমারী সংযুক্তার অগ্নিময়ী বাণী।

এও একদিন অন্তঃপুরের গোয়েন্দার হাতে পড়িয়া গেল। শ্বশুর ভাবিলেন, এ তো ভ্যালা বিপদে পড়া গেল! রসিককে ডাকিয়া বলিলেন, “বাবাজী, আমি বলছিলাম, তুমি গিয়ে না হয় বাগান-বাড়ির এক ধারে সায়েবের সঙ্গে থেকে বিদ্যা অর্জন কর—এইটিই আমাদের সেই ঋষি-মুনিদের আমলের সনাতন প্রথা কিনা।”

রসিক মুখ গোঁজ করিয়া বাগান-বাড়িতে উঠিল এবং সেই দিনই তাহার নিজের সনাতন প্রথায় প্রথমে সাহেবের খানসামা ও পরে খোদ সাহেবের সহিত বিবাদ করিয়া একটি রীতিমত ফ্যাসাদ বাধাইয়া অন্তৰ্ধান হইল। তাহার মানে, সেখানে অন্তর্ধান হইয়া স্বগৃহে আসিয়া আবির্ভূত হইল।

.

পিতা আগুন হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, “এক্ষুনি বেরুক ও বাড়ি থেকে, কার হুকুমে আবার বাড়িতে এসে ঢুকেছে?”

মেয়েরা সব রসিককে ঘিরিয়া কাঁদিতে লাগিল। ঠাকুরমা রসিককে চাপিয়া চক্ষের জলে স্নান করাইয়া বলিলেন, “ষাট, বাছা আমার! জেলার মাচিষ্টকের শালাকে একটু চটিয়ে ফেলেছে; যদি বুদ্ধি ক’রে ঘরে না পালিয়ে আসত তো এতক্ষণ যে হাজতে গিয়ে উঠত— আমার সে কথা ভাবতেও যে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আজ তিনি বেঁচে থাকলে কি তোরা এমন বলতে পারতিস?”

দরদীদের দলের মধ্যে পড়িয়া রসিকেরও চক্ষু ডবডব করিয়া উঠিয়াছিল; ঠাকুরদার উল্লেখে চাপা আবেগে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “ঠাকুদ্দা বেঁচে থাকলে? ঠাকুদ্দা বেঁচে থাকলে আজ শ্বশুর ব্যাটার সঙ্গেও একটা এস্পার কি ওস্পার ক’রে আসতাম—হ্যাঁ।’

অবশ্য ‘এপার কি ওস্পার’ কিছু একটা হয় নাই বলিয়া রসিকের নিরাশ হইবার কোন কারণ ছিল না। শ্বশুরবাড়িতে হুলস্থুল এবং ক্রমে সারা জেলাতেই একটা চাঞ্চল্য পড়িয়া গেল। জেলার চুনোপুঁটি হইতে আরম্ভ করিয়া জজ ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত যত সাহেব ছিল, সকলের নিকট দরবার করিয়া রায় সাহেবের পায়ের জুতা ছিঁড়িল। শেষকালে আইল সাহেবকে চার হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ দিয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বিরাগ এবং খেতাবের উপর ফাঁড়াটা কাটাইয়া দিলেন। টাকাটা গনিয়া দিয়া বাড়িতে আসিয়া বলিলেন, “আজ থেকে অমলী বিধবা হ’ল। কেউ যেন আমার সামনে জামাইয়ের নাম পর্যন্ত না মুখে আনে।”

দিন দুই-তিন পরে কুটুম্বিতা বজায় রাখিবার জন্য রসিকের পিতা পুত্রের আচরণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া একখানি পত্র লোক মারফত পাঠাইয়া দিলেন। লোকটা উত্তম-মধ্যম কয়েক ঘা খাইয়া গালি দিতে দিতে ফিরিয়া আসিল; বলিল, “বললে ‘আমার মেয়েও নেই, জামাইও নেই—নিকালো হিয়াসে—–নিকালো। ওঃ, সে কি গর্জন! তারপরেই এই চোরের মার কর্তামশায়।”

সকলে ক্ষুব্ধ ও চিন্তিত হইয়া পড়িল। শুধু ঠাকুরমা ‘তিনি বাঁচিয়া থাকিলে’ এ অবস্থায় কি করিতেন নির্ণয় করিয়া সমস্যাটা সমাধান করিয়া দিলেন। কহিলেন, “মিন্সের নাকের ওপরে ছেলের বিয়ে দাও; কুলীনের ছেলের আবার বিয়ের ভাবনা কি গা? কি দাদা, বিয়ে করবি তো?”

রসিক, বউ যে কি বস্তু খানিকটা স্বাদ পাইয়াছিল, একটু হাসিয়া ঘাড়টা কাত করিয়া জানাইল, সে খুব রাজী। পেসাদী ঘটকিনীর দেমাকী চালে বাড়িটা আবার টলমল করিতে লাগিল।

রসিক কিন্তু নিজের অন্তরটাকে ভুল বুঝিয়াছিল। দুরন্ত হাঁদাগোবিন্দগোছের ছেলে- কিই বা সে অন্তরের মত সূক্ষ্ম জিনিসের খোঁজ রাখে? যে ভাবটা যখন মনের মত স্পষ্ট হইয়া উঠে, সেইটার উপর তাহার বলিষ্ঠ দেহের সমস্ত শক্তি উৎসর্গ করিয়া দেওয়াই তাহার ধর্ম। নূতন যখন বিরহ হইল, সে দেখিল, বউ নামক সুবিধাজনক পদার্থের অভাব ঘটিয়াছে। তাই ঘাড়টা বাঁকাইয়া একেবারে কাঁধের উপর ফেলিয়া জানাইল, হাঁ, বিবাহ করিবে বইকি। এবং তাহার দাম্পত্য-জীবনে নানান ঝঞ্ঝাট বাধাইত এমন সব অপ্রয়োজনীয় কি অল্প-প্রয়োজনীয় লোকদের লক্ষ্য করিয়া বলিল, “কিন্তু দেখো ঠাকুমা, এ শ্বশুরবাড়িতে যেন মেলা কেউ না থাকে—এই শালী-শালাজ এরা সব।’

কিন্তু কথা হইতেছে যে, দাম্পত্যের দেবতাটি ক্রমাগত মারপ্যাচের মধ্য দিয়াই নিজের অধিকারটি সাব্যস্ত করিয়া যান, সুতরাং তিনি যে রসিক এবং রসিকের পিতা মাতা ঠাকুরমা প্রভৃতির সুবিধার জন্য রসিকের মনে আগাগোড়া একটা ভাবই কায়েম করিয়া রাখিবেন এমন আশা করা নিতান্তই ভুল। সেই জন্য, যখন বিবাহের কথাটা বেশ পাকা হইয়া আসিয়াছে, এমন সময়টিতে রসিকের মনে এই কথা স্পষ্ট হইয়া উঠিল যে, বধূমাত্র হইলেই তাহার চলিবে না; তাহার অমলাকেই চাই, বিশেষ করিয়া—নিতান্তই। এতদিন শুধু বধূর অভাব ছিল—একটা শূন্যতা মাত্র। আজ দেখিল, অভাবটা আসলে অমলার অভাব—শূন্যতাটাও বেদনায় ভরিয়া উঠিল, যাহা তাহার পক্ষে একেবারেই নূতন।

প্রথমে ভালমানুষের মত একটু ওজর আপত্তি করিল। লোকে বলিল, তবু ভাল। ঠাকুরমা বলিলেন, “একটু লজ্জা হয়েছে আর কি, ওটা কেটে যাবে’খন। এক কথাতে রাজী হয়েছিল ব’লে ও কি আমার তেমনই বেহায়া গা!”

গায়ে-হলুদের দিন রসিক একেবারেই বাঁকিয়া বসিল। যখন তাহাকে অত্যধিক প্ররোচনা এবং ভয়প্রদর্শনের দ্বারা সোজা করিবার চেষ্টা করা হইল, সে গায়ে হলুদের সমস্ত সরঞ্জাম ফেলিয়া ছড়াইয়া ভাঙিয়া চুরিয়া বেগে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল। কর্তার গর্জনের সঙ্গে মেয়েদের কান্না মিলিয়া উৎসবের বাড়িতে একটা বীভৎস কাণ্ড হইয়া দাঁড়াইল।

ঠাকুরমা নাতনী এবং নাতবউদের একত্র করিয়া আঁচলে চোখের জল মুছিতে মুছিতে বলিলেন, “আমি ওর এতটুকু বয়স থেকেই ব’লে আসছি, ও ঠিক তোদের ঠাকুদ্দার মত হবে; তাঁর ছিল বটে ছ-ছটা বিয়ে—কি করবেন, কুলীনের ছেলে—কিন্তু এই পেরথোমটার ওপরই যে কি পোড়া টান ছিল!”

.

একটা নির্জন জায়গা বাছিয়া রসিক একখানা চিঠি পড়িতেছিল, মাখন আসিয়া নিঃশব্দে পাশে বসিল। বলিল, “চৌধুরীরা খুব গাল পাড়ছে।”

রসিক চিঠি হইতে মুখ তুলিয়া প্রশ্নের ভাবে মাখনের দিকে চাহিল।

সে সংক্ষেপে বলিল, “কাল নষ্টচন্দ্র ছিল কিনা।”

“ওঃ, মনেই ছিল না, কাল বিকেলে এই চিঠিখানা পেলাম কিনা। এ বছরটা আমার ফাঁকই গেল। কি কি লোকসান করলি?”

“দু কাঁদি কলা, একটা ফলুন্ত কুমড়ো-গাছ আর পাতকুয়োয় কেরোসিন তেল।”

“মন্দ হয় নি; এদের অনেকগুলো কাঁচা ইটও পোড়াবার জন্যে সাজানো রয়েছে—। যাক, আমার আর এ বছর মনেই ছিল না। বউ একটা চিঠি দিয়েছে, শোন্— ‘প্রিয়তম প্রাণেশ্বর’—বেশ বাংলা জানে, না?”

মাখন ঘাড় নাড়িল।

“প্রিয়তম প্রাণেশ্বর!

তুমি গিয়েছ পর্যন্ত আমার যে কি করেই কাটছে তা অন্তর্যামীই জানেন। দাসীকে কি এমনি করেই পায়ে ঠেলে যেতে হয়? কোন্ গুরু অপরাধে অপরাধিনী আমি? কত জন্মের পুণ্যের ফলে তোমা হেন পতি লাভ করিলাম, কিন্তু কি পাপে আমি সে ধনে বঞ্চিত হলাম? আমার প্রাণে অহরহই বিরহের আগুন জ্বলছে, কিন্তু সে আগুন নিবাবার কেউ নেই–বোন ভাজ ছোট ভাইয়েরা সবাই বৈরী, খালি চিঠি লিখছি কি না ভেতরে ভেতরে সেই সন্ধান। আমি তো এ চিঠি বাটী হইতে লিখিতেছি না, অখিলদার বাটী হইতে। অখিলদার বউয়ের সাথে আমার খুব ভাব হইয়াছে। নাম শরৎকুমারী। তুমিও তারই ঠিকানায় চিঠি দিও আমায়, সে আমায় দিয়ে দেবে। বাড়ির ঠিকানায় কখনও চিঠি দিও না। আমরা দুজনে মিলে আজকাল ‘পৃথ্বীরাজ’ পড়ছি। আমার অনেক মুখস্থ হইয়া গিয়াছে। অখিলদার বউ বলে— অখিলদা নাকি বলেন, তুমি খুব সাহসী বীরপুরুষ। অখিলদা নিজে বড্ড স্বদেশী কিনা। কিন্তু হায় পোড়া অদৃষ্ট আমার, আমি বীরজায়া হইতে পারিলাম না; মনের সাধ মনে রহিয়া গেল, পিতা বিমুখ, বিধি বাম! এ পিতৃগৃহ আমার পক্ষে কারাগার হয়ে পড়েছে। হায় স্বামিন, পৃথ্বীরাজ যেমন সংযুক্তাকে বীরদর্পে তাঁহার পিতৃগৃহ হইতে উদ্ধার করিয়া নিজের শৌর্য- বীর্যের পরিচয় দিয়া বিশ্বজগৎকে স্তম্ভিত করিয়াছিলেন, তুমি কি আমায় সেইরূপ করিবে না?

তা বলে তুমি যেন সত্যি অমন কিছু করতে যেও না বাপু, হ্যাঁ। আমার বড্ড ভয় করে। যেদিন অমন মারধোর ক’রে চ’লে গেলে সেদিন আমার যে কি ভয় করেছিল!

শ্রীচরণে শতকোটি প্রণাম নিও। এখন তবে ৮০

ইতি—

তোমার শ্রীচরণের জন্মজন্মের দাসী

শ্রীমতী অমলাবালা দেবী’

“বেশ হয় কিন্তু তা হ’লে, না?”

“কি?”

“এই পৃথ্বীরাজের মত শ্বশুরবাড়ি থেকে কেড়ে নিয়ে আসা।”

“হুঁ।”

“কিন্তু ঘোড়া পাব কোথায়?”

“আমার বাবা যেটাতে চ’ড়ে রুগী দেখতে যান, তাতে হবে না? বাবা তো বাতে ভুগছেন?”

“দূর, তার হাঁটুতে হাঁটুতে ঠেকাঠেকি হয়, শেষকালে তাড়া খেয়ে পৃথ্বীরাজ সংযুক্তা হুড়মুড় ক’রে প’ড়ে মরব? তা ছাড়া চড়বার পর তার রাশ ধ’রে খানিকটা টেনে নিয়ে যেতে হয়, তবে চলে।”

“তা বটে, তবে দুজনের জায়গা বেশ হ’ত; পেটটা বেশ মোটা আছে, আর পিঠটা খুব নীচু।”

“আমি একটা উত্তর লিখেছি। নে পড় দিকিনি। পরের মুখে শুনি, কি রকম হ’ল! তোদের ঘোড়ার কথাও আছে।”

মাখন পড়িতে লাগিল—”প্রিয়তমা প্রাণেশ্বরী অমলাবালা আমার শত-সহস্র চুম্বন গ্রহণ কর—”

রসিক টীকা করিল, “দূর থেকে তো হয় না বটে; কিন্তু আমার পিসতুতো মেজদাকে গোড়াতেই ওই রকম লিখতে দেখেছি। মরুকগে, পড়।”

“আমাকে বীর ব’লে লজ্জা দিও না, তবে সেদিন আরও অনেককে ঠ্যাঙাবার ইচ্ছে ছিল। আমার সঙ্গে যদি মাখন থাকত তা দেখতে। তাকে তুমি চেন না।’

রসিক বলিল, “তোর কথাও লিখে দিলাম।”

‘আগে বেশ ছিল। সবাইকে মেরে ধ’রে যুদ্ধ ক’রে বিয়ে ক’রে আনত। তাতে শ্বশুরবাড়িতে জ্বালাতন করবার লোকও অনেক ক’মে যেত। কিন্তু আজকাল অন্য রকম হয়ে গেছে। সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। তা না থাকগে। বাবা বলেন, নিজের বউ নিজের ঘরে নিয়ে আসব, তাতে আদালত আমার দিকে। সেখানে রায়সাহেবী খাটবে না, হ্যাঁ বাবা। তোমার যেমন সংযুক্তার মত হতে সাধ যায়, আমারও ঠিক তেমনি পৃথ্বীরাজের মত তোমায় নিয়ে অশ্বারোহণে মেদিনী কম্পিত করিয়া পালিয়ে আসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোন সুবিধে নেই। মাখনের বাবার একটা ঘোড়া আছে। তার পিঠে চড়লেই কিন্তু সামনে পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে পেছনে হটতে আরম্ভ করে। তখন জিব দিয়ে টকাস টকাস ক’রে এক রকম শব্দ করতে হয়, তা আমার ভাল আসে না।

আচ্ছা অমলা, আমি যদি একটা ভাল ঘোড়া যোগাড় করি তো আমার সঙ্গে পালিয়ে আসবে তো? আগেকার মেয়েরা আগুনে পুড়ে মরত, আর তুমি এইটুকু পারবে না? বাবা আমার আর একটা বিয়ে দিচ্ছিলেন, আমি করি নি। আমি তোমায় ভয়ানক ভালবাসি। আমারও বিরহানলে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। ঠাকুমা খালি মাঝে মাঝে সান্ত্বনা দেন। শীঘ্র পত্র দিবে। আমার চিত্তচকোর বড় ব্যাকুল হইয়াছে।

ইতি—
জন্ম জন্ম তোমারই
রসিকলাল’

রসিক আবার একটু টীকা করিল, “চিত্তচকোর একরকম পাখি—শেষকালে ওই রকম লিখতে হয়! বেশ হয় নি লেখাটা?”

মাখন বলিল, “হুঁ।”

তাহার পরদিন বেশ করিয়া এসেন্স মাখাইয়া পত্রখানি ডাকে দিয়া দুই-তিন দিন অতীত হইতেই রসিক গিয়া পোস্ট-আপিসে হাজিরা দিতে লাগিল। মাসখানেক নিয়মিতভাবে গেল, কিন্তু কোন উত্তর আসিল না। তখন নিরাশ হইয়া দিনকতক যাওয়াই ছাড়িয়া দিল; তাহার পর আবার আশায় বুক বাঁধিল। এইরকম করিয়া আশা-নিরাশায় দ্বন্দ্বের মধ্যে অনেকদিন কাটিয়া গেল—দুই মাস, চার মাস, পাঁচ মাস কাটিয়া গেল— কোন উত্তর নাই! রসিকও ক্রমাগতই বধূকে উদ্দেশ করিয়া মাখনের কাছে বলিতে লাগিল, ‘আর এক মাস—আর পনেরো দিন—আর এক সপ্তাহ দেখব, তারপর ধাঁ ক’রে বিয়ে করে বসব—এই তোকে ব’লে রাখলাম মাখন।”

ঠাকুরমা তাহার পিতাকে তাগাদা করিতে লাগিলেন, “ছেলে যে এদিকে কালি হয়ে গেল, একটা হেস্তনেস্ত কিছু কর্।”

তিনি বেহাইকে তিন-চারখানা পত্র দিলেন, প্রথমে খুব মিনতির ভাব, ক্ৰমে ক্রোধ এবং পরে কন্যার উপর নিজের দাবি সাব্যস্ত করিয়া। কোন জবাবই আসিল না।

রসিক শেষকালে হার মানিয়া একদিন মাখনের সঙ্গে পরামর্শ করিতেছিল—তাহাকে মালিনী সাজাইয়া কিংবা ভিখারি-বালক সাজাইয়া বধূসকাশে কি করিয়া পাঠানো যায়, এমন সময় তাহার ছোট বোন হাতে একটা চিঠি লইয়া আসিয়া বলিল, “বকশিশ দাও।”

রসিক আগ্রহভরে তিন-চার বার চাহিল, তাহার পর পুরস্কারস্বরূপ তাহার গালে. একটা প্রচণ্ড চড় বসাইয়া চিঠিটা কাড়িয়া লইল।

লেখা ছিল—

‘জীবিতেশ,

কোথা হইতে পত্র দিতেছি, তুমি স্বপ্নেও ভাবিতে পারিবে না। তোমার প্রেমাবেগপূর্ণ পত্র যথাসময় পাইয়াছিলাম। আমার সেই হৃদয়ের নিধিকে সযত্নে বাক্সে বন্ধ করে রেখেছিলাম। তিন দিন ছিল। তারপর চুরি যায়। তাহার পর বাড়িতে হৈ হৈ পড়ে যায়। তোমার সুধামাখা লিপিখানিতে ঘোড়া, পৃথ্বীরাজ আর পালাবার কথা ছিল কিনা সেই হোল কাল। বাবা বললেন, ভ্যালা পাপ তো, এটারও মাথা খেয়েছে! স্থির হোলো আমি গিয়ে মামার বাড়ি থাকব। এখানে দু কোশের মধ্যে পোষ্টাফিস নেই আর কড়া পাহারা। আমার কাগজ কালি কলম টিকিট সব কেড়ে নিয়ে একাবস্ত্রা করে দ্বীপান্তরে দিয়েছেন। সবাই বলে তবে অমন ছেলের সঙ্গে দিতে গেলেন কেন বাপু? আমি মনে মনে বলি, তোমরা সে যে কি ধন কি ক’রে জানবে? হায় নাথ, এই পাঁচ মাস তেরো দিন যে কি নরকযন্ত্রণা ভোগ করছি, কে সেই অন্তরের গূঢ় মর্মবেদনা বুঝিবে! তোমার জন্যে প্রাণ সর্বদাই হু-হু করিতে থাকে। শেষকালে আজ পাঁচ মাস তেরো দিন পরে আমার মামাতো বোন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে দেখে তাহার হাতে পায়ে ধরে, এই চিঠিখানা ফেলে দিতে বললাম। তার মত ধরাধামে আজ সুখী কে? আমারও ইচ্ছে হচ্ছে, আজ লজ্জা-সরম মান অপমান জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার কাছে ছুটে যাই। নারীর হৃদয় তুমি কি বুঝিবে সখে?

বাবা নূতন বছর কোন খেতাব পান নি বলে তোমার উপর ভারি চটে আছেন! বার্থ ডে লিস্টের আশায় আছেন। এই ঝোঁকই হয়েছে কাল, কি যে লাভ এতে? এই সবের জন্যে সাহেবদের এবার একটা মস্ত ভোজ দেবেন ইংরিজি মাসের তেরো তারিখে, শনিবার। খুব ঘটা হবে। আমায় শুনছি দিনকতকের জন্যে সেই উপলক্ষে নিয়ে যাবেন। অহো, এইটে যদি আমার স্বয়ম্বরা সভা হোত, আর পৃথ্বীরাজের মত বাবা তোমার একটা মূর্তি গড়ে দারোয়ান করে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন, আর অমনি আমি মালা নিয়ে সভার আর কারোর দিকে না চেয়ে সটাং গিয়ে তোমার মূর্তির গলায় মালা দিয়ে দিতাম আর অমনি হৈ-চৈ পড়ে যেত, আর তুমি কোথা থেকে এসে আমায় ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পালাতে। আজকাল ঘোড়ার চেয়ে মোটরে ঢের সুবিধে। না বাপু, তোমায় এসব লিখতে সাহস হয় না। একটা কাণ্ড করে বসবে আবার। তবে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। একবার কি এখানে আসতে পারবে না? আমি সেই দিন আমাদের পশ্চিম দিকের খিড়কির দরজার কাছে রাত সাড়ে সাতটার সময় দাঁড়িয়ে থাকব। অন্ধকার রাত্রি। বাড়ির আর সবাই দেখবে, আমি একটা ছুতো করে ওই দিকে সরে পড়ব। দোহাই তোমার একবার এসো, শুধু একটিবারটি। এসো, এসো, এসো—এই তিনবার বলছি। আবার তো সবাই আমায় এই বনবাসে দেবেই।

তুমি চিঠির গোড়ায় শত সহস্র যে জিনিসের কথা লিখেছিলে তা আমারও ইচ্ছে হয় কিন্তু লিখতে বড় লজ্জা করে, যাও। যদি আস তো যত চাও দোব। কেউ যেন টের না পায়। আমার কোটি কোটি প্রণাম নিও! এখন তবে ৮০

ইতি তোমার শ্রীচরণের জন্মজন্মের দাসী,
শ্রীমতী অমলাবালা দেবী’

রসিক অনেকক্ষণ মৌনভাবে কি চিন্তা করিতে লাগিল, তাহার পর অকস্মাৎ প্রশ্ন করিল, “আজ ক তারিখ রে?”

মাখন হিসাব করিয়া বলিল, “তরশু মাইনে দিয়েছি সাত তারিখে; আট, নয়, আজ দশ তারিখ।”

রসিক আরও নিবিষ্ট মনে খানিকটা ভাবিল, তাহার পর বলিল, “ও মেয়েমানুষ, কি বুঝবে? ঘোড়া হলে খুব মানাত, খটাখট খটাখট ক’রে দুজনে এক ঘোড়ার পিঠে চ’ড়ে ছুটেছি—সে এক দেখতেই।”

আর একটু পরে বলিল “মোটর চালাতেও আমার খুব অভ্যেস হয়ে গেছে- শ্বশুরবাড়িতে ওই কাজই করতাম কিনা সমস্ত দিন : মোটরের কথা তোর আমার মাথায় ঢোকে নি; বউ মেয়েমানুষ হ’লেও কি রকম বুদ্ধি দেখেছিস?”

দুইটি হাঁটুর ওপর থুতনিটা চাপিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার পর হঠাৎ উৎসাহভরে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “হয়েছে রে, যাব; একটা অ্যায়সা মতলব এঁটেছি। তোকে বলব’খন—কাল বিকেলে—সেইখানে!”

.

তেরো তারিখের সন্ধ্যা উতরাইয়া গিয়া বেশ গা-ঢাকা-গোছের অন্ধকার হইয়াছে। সাঙ্কেতিক পশ্চিম-দরজার কাছে গিয়া দাঁড়াইল; মস্ত লোক উৎসবের দিকে, এদিকটায় একেবারে কেহ নাই।

দরজা খুলিয়া রঙিন-কাপড়-পরা একটি কিশোরী মূর্তি উঁকি মারিয়া আবার দরজাটা একটু ভেজাইয়া দিল। রসিক আরও খানিক অগ্রসর হইয়া বলিল, “এস, এসেছি।”

কিশোরী বাহির হইয়া আসিল। চোখাচোখি হইতেই রসিক হাসিয়া ফেলিল। মেয়েটি কিন্তু চোখ নত করিল এবং একটু পরে তাহার বুকটা ফুলিয়া উঠিতে লাগিল ও চাপা কান্নার আওয়াজ হইতে লাগিল।

না।”

রসিক বলিল, “তবে চললাম; এইজন্যে আমি মেয়েমানুষকে দুচক্ষে দেখতে পারি

মেয়েটি ফোঁপানোর মধ্যে বলিল, “কি বলছ?”

“মামার বাড়ি বড়, না, শ্বশুর বাড়ি বড়?”

“শ্বশুর বাড়ি।”

“তা হ’লে এগিয়ে এস। মোটর ঠিক ক’রে রেখেছি। ড্রাইভার বেটা তামাশা দেখছে। দেরি ক’রো না, ভেস্তে যাবে।”

মেয়েটি একবার ভীতভাবে মুখের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

রসিক কোমর হইতে একটা ঝকঝকে ছোরা বাহির করিল, বলিল, “তা হ’লে এই দেখ, তোমার সামনে নিজের বুকে আমূল বসিয়ে দোব। আর ভূত হয়ে ওদিকে গিয়ে একটা এপার ওপার ক’রে ছাড়ব!”

বধূটি ভয়মুগ্ধভাবে চাহিয়া পা বাড়াইল। রসিক তাহার হাতটা ধরিলে দুইজনে খুব সন্তর্পণে মোটরে আসিয়া উঠিল, এবং এতক্ষণ পরে বধূকে একটা চুম্বন করিয়া মোটর ছাড়িয়া দিল। বলিল, “ভয় নেই আমায় জড়িয়ে ব’স।”

যেখানে উৎসব হইতেছিল, তাহার সামনে দিয়াই রাস্তা। রসিক গলা বাড়াইয়া চেঁচাইয়া বলিল, “চললাম নিয়ে!”

প্রথমটা সবাই হতভম্ব হইয়া গেল। পরমুহূর্তে হৈ-হৈ পড়িয়া গেল; ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব লক্ষ্য করিয়া দেখিয়া বলিয়া উঠিল, “Oh my! it’s my car running away”। (সর্বনাশ, এ যে দেখছি আমার গাড়ি ছুটে চলেছে।)

‘ধর্ ধর্’ ‘সাজ সাজ্’ রব পড়িয়া গেল। দুই-তিনটা ঘোড়া একখানা মোটরকার আর লোকের পাল ছুটিল, কিন্তু রসিককে তখন আর পায় কে? ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মাইলের রাস্তা একদম পার হইয়া একবারে বাড়ির দরজার সামনে আসিয়া দাঁড়াইল এবং নিজে বাড়ির মধ্যে হনহন করিয়া ঢুকিয়া একটা ঘরে খিল দিয়া ভিতর হইতে বলিল, “ওই এনে দিয়েছি—সদর-দোরে, দেখগে সব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *