পৃথিবী যদি বাড়ত (নাটক)
[বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের দোতলার আড্ডা ঘর। বেশ বড় ঘর। ডান দিকে পেছনে বাইরের বারান্দায় যাবার বড় দরজা দেখা যাচ্ছে। বারান্দায় রেলিং ও আরও দূরে ওপরে ছাদে ওঠবার ন্যাড়া সিঁড়িটার খানিকটা দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটি বজায় রেখে ঘরটি নিজেদের সুবিধা ও পছন্দ মতো যেভাবে তোক সাজানো যাবে। তবে কয়েকটি আসবাবপত্র না থাকলেই নয়। যেমন ঘরের মাঝামাঝি একটু বাঁদিক ঘেঁষে দর্শকদের দিকে মুখ করে পাতা একটি আরাম কেদারা। আর ভাল আয়না গোটা দুই ও বাঁ পাশে গোটা তিন-চার চেয়ার। চেয়ারগুলি এক রকমের হবে না। কোনওটা টিনের, কোনওটা কাঠের। কোনওটার হাতল আছে, কোনওটার নেই। কোনওটা আবার শুধু টুল। দর্শকদের লাইনের চেয়ারগুলির পেছনে একটা ছোট সতরঞ্জিপাতা তক্তপোশ আর সামনে একটি নিচু চৌকো টেবিল আর গোটা দুই টি-পয় থাকবে। দর্শকদের ডান দিকের পেছনে বারান্দায় যাবার দরজা। বাঁ দিকে একেবারে পেছনের দেয়ালে সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত একটি বড় সাদা পর্দা টাঙানো থাকবে। ঘরের সামনের দিকে অভিনয় হবার সময় পর্দাটি আধো-অন্ধকার পেছনের দেওয়াল বলেই মনে হবে। তার ওপর দুটো-একটা কিছুর ছায়াও ফেলে রাখা যেতে পারে। পরে এই পর্দাটি পেছনের উজ্জ্বল আলোয় ছায়ামূর্তি প্রক্ষেপের জন্য ব্যবহার করা হবে।
এ নাটিকার অভিনয়ে এই কটি চরিত্র থাকবে। স্বয়ং ঘনাদা, জটাজুট আর একরাশ দাড়িগোঁফে ঢাকা অথচ ঈষৎ গেরুয়া রঙে ছোপানো ধুতি-পাঞ্জাবি পরা নকল দুর্বাসা, এ ছাড়া গৌর, শিবু, শিশির ও সুধীর। শেষের চারজন কেউ ধুতি-পাঞ্জাবি কেউ প্যান্ট শার্ট পরা থাকতে পারে। ঘনাদার ধুতির ওপর হাত গোটানো শার্ট আর সাধারণ কোঁচানো ধুতি, পায়ে বিদ্যাসাগরি চটি।]
গৌর (ঘর সাজাতে সাজাতে)—আজ্ঞে হ্যাঁ, তা চিকেন বিরিয়ানি আর দুম্বা খাসির রগন জোস তো হেলায় ফেলায় বানাবার জিনিস নয়। রামভুজের সঙ্গে বনোয়ারির তাই আর অন্য কাজের ফুরসুতও নেই।
ঘনাদা (যেন কিঞ্চিৎ আপত্তির সুরে)—তা, রাত্রে অন্য সব হচ্ছে, তার উপর এখন আবার এসব কেন?
সুধীর (বড় বড় দুটি ফিশ রোলের প্লেট ট্রে-তে নিয়ে গিয়ে ঘনাদার হাতে তুলে দিতে দিতে)—আজ্ঞে, ডি লুক্স কাফের ফিশ রোল। ওদিক দিয়েই আসছিলাম। সবে টাটকা ভাজছে দেখে না নিয়ে এসে পারলাম না।
(শিশির তখন তার সিগারেটের টিন রাখা ট্রেটাও সামনে এনে ধরেছে। ঘনাদা কোনটা আগে নেবেন ঠিক করতে না পেরে বেশ দোনামনা ভাবে দুদিক চাইছেন।)।
সুধীর (ফিশ রোলের প্লেটটা ঘনাদার হাতে ধরিয়ে দিয়ে)—নিন, ঠাণ্ডা হতে দেবেন না।
(ঘনাদা প্লেটটা নেবার পর সুধীর, গৌর, শিশির, শিবু এক-একটি আসন নিয়ে বসতে যাচ্ছে আর ঘনাদা বেশ প্রসন্ন হাসি হেসে একটি ফিশ রোল তুলে নিতে যাচ্ছেন, এমন সময়ে বারান্দার দরজার বাইরে নেপথ্যে গর্জন।)
নেপথ্য থেকে—অয়ম্ অহম্ ভোঃ! তিষ্ঠ–
(হঠাৎ সবাই দরজা থেকে সরে ঘনাদার দিকে মুখ ফিরিয়ে যেন হতভম্ব। ঘনাদার প্লেটের ফিশরোলটা তাঁর হাত থেকে শূন্যে উঠে ঠিক তাঁর নাকের ওপর ঝুলছে। এই অবস্থায় বারান্দার দরজা দিয়ে মাথায় একরাশ জটা আর মুখে দাড়ির বিরাট জঙ্গল নিয়ে গেরুয়া ধুতি-পাঞ্জাবি চাদর গায়ে দেওয়া এক অদ্ভুত মূর্তির আবির্ভাব)।
জটাজটধারী (ঘনাদার দিকে হাত তুলে)—-লজ্জা করে না তোমাদের! অতিথি পরিচর্যা ভুলে নিজেদের ভোজন বিলাসে মত্ত। যে লোভে অতিথির অমর্যাদা করেছ সেই লোভের গ্রাসেই তাহলে ছাই পড়ুক।
(ঘনাদার প্লেটের ফিশরোল দুটি অভিশাপের সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে যেন লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে ছাদে ঠেকে ছত্রাকার।)।
শিবু শিশির (সবাই দাঁড়িয়ে উঠে যেন স্তম্ভিত আতঙ্কে)—আরে, আরে, একী কাণ্ড!
ঘনাদা (দাঁড়িয়ে উঠে সবিনয়ে)–ননুক্ৰিয়াতামাসন পরিগ্রহঃ। অবহিতোহস্মি!
(ঘনাদা নিজের আরাম কেদারাটাই জটাজুটধারীর দিকে ঠেলে দিতে যাচ্ছিলেন, জটাধারী তার আগেই নিজে থেকে একটা চেয়ার টেনে তাতে বসতে বসতে…)
জটাজুটধারী (চেয়ারটায় বসে)-যাক আমি প্রীত হয়েছি তোমার বিনয়ে আর দেবভাষা প্রয়োগে! আমার ক্রোধ আমি সংবরণ করলাম! (ক্ষমায় উদার ও প্রসন্ন হবার সুরে) হ্যাঁ, তোমাদের মধ্যে ঘনশ্যাম কার নাম বলো তো!
গৌরা (চাপা স্বরে শঙ্কিতভাবে)—এইরে, সব বুঝি দিলে গুবলেট করে!
শিশির (চাপা গলায় আশ্বাস দিয়ে)—না, না, বোধহয় ভয় নেই। ঘনাদার চেহারাটাই দেখ না।
ঘনাদা (বিগলিত বিনয়ে)আজ্ঞে অধীনের নামই ঘনশ্যাম। আপনার প্রতি অসম্মানের অপরাধে মার্জনা ভিক্ষা করছি। সত্যিই প্রথমে আপনাকে চিনতে না পেরে সেই মালাঞ্জা এমপালে বলে ভুল ভেবেছিলাম।
জটাজুটধারী (বেশ একটু সন্ত্রস্ত অস্বস্তির সঙ্গে)-মালাঞ্জা এম-পালে!
ঘনাদা (যেন অত্যন্ত অনুতপ্ত স্বরে)—আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই যে সাংকুর নদীর ধারে এমবুজি মাঈ থেকে চোরাই হিরে পাচার করার জন্য আমায় ম্যাজিকের ধোঁকা দিয়ে এপুলু-তে নিয়ে গিয়ে মিথ্যে খবরে ইতুরির গহন বনে পাঠিয়ে জংলিদের ঝোলানো ফাঁদের ফাঁসিতে লটকে মারবার চেষ্টা করেছিল। আর যার মতলব হাসিল হলে পৃথিবীটা আরও দশ-বিশগুণ বেড়ে গিয়ে আমাদের কী দশা যে হত জানি না, সেই মালাঞ্জা এমপালে ভেবে আপনাকে একটু তাচ্ছিল্য করেছিলাম গোড়ায়, তবে (ঘনাদা যেন একটা বিশ্রি স্মৃতি ঢাকবার জন্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে) থাক সে কথা।
শিবু, শিশির, গৌর, সুধীর ( প্রায় এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে)—সে কী! থাক কী বলছেন!
জটজুটধারী (সমান আগ্রহের সঙ্গে)না, না থাকবে কেন? মনে যখন হয়েছে তখন বলেই ফেলল। বদখদ কিছু হলে সে স্মৃতি পেটে রাখতে নেই। ওই কী বলে— তাতে আবার বদ হজম হয়।
ঘনাদা (হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে)-না, বদহজম আর কী হবে, পেটে যখন কিছু পড়েনি।
জটাজুটধারী (অপ্রস্তুত ও ব্যতিব্যস্ত)—তাই তো বটে! তাই তো বটে! আমি আবার অভিশাপটা দিয়ে ফেলে খাওয়াটাই নষ্ট করে দিয়েছি। তা তোমরা
(জুটজুটধারীর কথা শেষ হতে না হতেই বারান্দার দরজায় বনোয়ারির আবির্ভাব।)
বনোয়ারি (দরজা থেকে)-মাফি মাঙছি, হামাকে রামভুজজি ভেজে দিলে। পুছ। করতে পাঠালো আর গরমাগরম পিশরুল আসবে কি না।
জটাজুটধারী (সবিস্ময়ে)—গরমাগরম পিশরুল! সে আবার কী?
গৌর, শিশির, সুধীর, শিবু (একসঙ্গে)-হ্যাঁ, হ্যাঁ, বহুৎ খুব আনবে! গরম গরম ভেজে আনবে। যা যা, জলদি যা। (জটাজুটধারীর দিকে ফিরে) পিশরুল হল ফিশরোলের বনোয়াবি বুলি। (ঘনাদার দিকে ফিরে) ফিশরোলগুলো তো এখুনি আসছে। তার আগে ওই আপনার ইতুরি না ফিতুরির জঙ্গলে ঝোলানো ফাঁস থেকে আপনার ওই বৃত্তান্তটা যদি একটু ধরেন।
[ওপরের কথাগুলো চারজনে যে-যেটা-ইচ্ছে একটা একটা টুকরো পর-পর বলবে]
ঘনাদা (যেন দ্বিধাভরে)—সে বৃত্তান্ত শুরু করতে বলছ? কিন্তু জটাজুটধারীর দিকে চেয়ে) কিন্তু এসব কথা ওঁর সামনে বলা ঠিক হবে?
গৌর শিশির ইত্যাদি (সমস্বরে)—খুব হবে, খুব হবে!
জটাজুটধারী—হ্যাঁ, হ্যাঁ শুরু করুন, শুরু করুন।
ঘনাদা (যেন ভরসা পেয়ে)—আসল কথা কী জানো! ওঁকে ম্যালাঞ্জা এমপালে ভাবার জন্য এখন লজ্জা হচ্ছে। কোথায় উনি আর কোথায় সেই শয়তানের শিরোমণি। চেহারায় মিল আছে ঠিক। মালাঞ্জা অবশ্য আরও ফর্সা ছিল। আরও মোটাসোটা জোয়ান চেহারা! তবে এঁকে দেখে ভেবেছিলাম, নিজের শয়তানির সাজাতেই মালাঞ্জা বুঝি অমন শুঁটকো মর্কট-মাকা হয়ে গেছে।
[জটাজুটধারীর আর শিবু-সুধীর ইত্যাদির বেশ একটু অস্বস্তিকর অবস্থা। গলা খাঁকারি দিয়ে শিবু কিছু যেন বলতে যাবার মুখে ঘনাদা আবার শুরু করবেন—]
ঘনাদা—প্রথমে ম্যাজিক দেখিয়েই মালাঞ্জা আমায় মোহিত করে। একটা মানুষের খোঁজে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে তখন এমবুজি মাঈ শহরে এসেছি। (জটাজুটধারীর দিকে চেয়ে) এমবুজি মাঈ-এর কথা আপনি তো সবই জানেন।
জটাজুটধারী (বিব্রত)—আমি—আমি—আমি–
ঘনাদা (যেন ভক্তিভরে)—-আপনার তো সশরীরে যাবার দরকার নেই। যোগবলেই তো সব জানতে পারেন। ও, তার সময় পাননি বুঝি। আচ্ছা, আমিই বলে দিচ্ছি। আগে যার নাম ছিল কঙ্গো আর এখন হয়েছে জানতি পারোনার জয়ের জাইর রাজ্যের একটা শহর এম্বুজি মাঈ, এটা আফ্রিকার পশ্চিম দিকের জাইর রাজ্যের এমন এক শহর যার চারধারের মাটি আঁচড়ালেও হিরে পাওয়া যায়। হিরের খোঁজে নয়, দুনিয়ার এমন একজনের খোঁজে সেখানে এসেছি যার দাম একটা হিরের খনির চেয়ে, আমার কাছে কেন, সমস্ত পথিবীর কাছে বেশি। তিনি আর কেউ নন, পৃথিবীর অসামান্য এক জৈব-রসায়নের বিজ্ঞানী। যিনি হঠাৎ তাঁর আইডাহোর ল্যাবরেটরি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন আর দুনিয়ার সব দেশের সেরা সব গোয়েন্দা বিভাগ হন্যে হয়ে খুঁজেও তাঁর কোনও সন্ধান পায়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ড. লেভিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন স্বেচ্ছায়। তাঁর ল্যাবরেটরিতে তাঁর নিজের হাতে লেখা আর সই করা একটি চিঠিতে তিনি জানিয়ে গেছেন যে তিনি স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং কেউ যেন তাঁর খোঁজ করবার চেষ্টা না করে।
কিন্তু ড. লেভিনের মতো বৈজ্ঞানিকের বেলায় দুনিয়ার মানুষ কি ওই চিঠি পড়ে হাত গুটিয়ে থাকতে পারে! ফল কিন্তু কিছু হয়নি। ড. লেভিন সাধনা সফল করতে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন লিখে গেছেন। কী তাঁর সেই সাধনা অনেক চেষ্টায় সেটা আবিষ্কার করে অবাক হয়েছি। ড. লেভিনের সাধনা আজগুবি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। তিনি নাকি পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করতে পৃথিবীকে আরও বড় করতে চান। পৃথিবী বড় করবেন মানে কী? পৃথিবী কি বেলুন যে ফুঁ দিয়ে হাওয়া পাম্প করে ফাঁপিয়ে তুলবেন! ব্যাপারটা আজগুবি। তবু লেভিন তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রার একমাত্র অনুচর হিসেবে যাকে সঙ্গে নিয়েছেন তার নাম থেকেই তাঁকে কোথায় খোঁজা উচিত তার একটু হদিস পেয়েছি। সেই হদিস থেকে সোজা জাইর-এর এমবুজি মাঈতে গিয়ে উঠলাম।
সেখানে সাংকুর নদীর ধারে নির্জন একটা ছোট্ট বাংলো ভাড়া করলাম থাকবার জন্য।
নির্জন বাসায় থাকলেও হিরে কেনার হাঁক-ডাক করে শহরে তখন খুবই শোরগোল তুলেছি ইচ্ছে করে। ফলও ফলল ক-দিনের মধ্যে। কদিন বাদেই আমার সঙ্গে যে নিজে থাকতে ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে দেখা করতে এল সে স্বয়ং মালাজা এমপালে। কিন্তু আইডাহোতে ড. লেভিনের অনুচর হিসেবে তার যা চেহারা ছিল তা থেকে এখানে একটু আলাদা। সেখানকার ফর্সা শ্বেতাঙ্গ চেহারাটা এখানে হয়েছে ঝামা ইটের রঙের মতো।
মালাঞ্জা ঘরে ঢুকে হাতের কড়া ছিঁড়ে দেবার মতো করমর্দন করে বললে, খুব অবাক হয়েছেন, না, মঁসিয়ে দাস!
যেন উত্তর দিতে না পেরে তার দিকে বোকার মতো চেয়ে রইলাম।
এই কথার ওপরে মঞ্চটা হঠাৎ একটা চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ চমকের পর একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সেই সঙ্গে বেশ জোরে উপযুক্ত কিছু বাজনাও বাজবে। তারপর সামনের দিকটা অন্ধকার হয়ে পেছনের পর্দাটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে দুটি ছায়ামূর্তি দেখা যাবে সিলুটের মতো।
একটি ঘনাদার, আর-একটি তার চেয়ে লম্বায় চওড়ায় প্রকাণ্ড মালাঞ্জা এপালের। ঘনাদার ইউরোপিয়ান পোশাক আর মালাঞ্জার ঢোলা আলখাল্লা। কোমরে চাদর বাঁধা। মাথায় বাবরি চুলে ফেট্টি বাঁধা।
এ দুটি ছায়ামূর্তি অবশ্য আলাদা দুজন অভিনেতার। এরা মূক অভিনয় করবে। গলা দেবে মঞ্চে দেখা ঘনাদা ও জটাজুটধারী। বিদ্যুৎ চমকের পর মঞ্চ অন্ধকার হবার সময় তারা দুজন উইংস দিয়ে পেছনে চলে গিয়ে দুজনে ঝোলানো পর্দার দুধারে দাঁড়িয়ে গলা দেবে।]
মালাঞ্জা (আবার)–কী মঁসিয়ে দাস, বেশ একটু অবাক হয়েছেন, না!
ঘনাদা (আমতা আমতা করে)—তা মানে—তা একটু হয়েছি।
মালাঞ্জা (ঘনাদার কাছে এসে তার ঘাড়ে একটা হাত রেখে চাপ দিতে দিতে)–কীসে অবাক হয়েছেন? এত তাড়াতাড়ি হাজির হয়েছি বলে?
ঘনাদা (যেন চেষ্টা করে কাঁধের চাপটা সইতে না পেরে একটু কাতর ভাবে)–না, আপনার চেহারাটা এত পালটেছেন বলে। আইডাহোতে ছিলেন ফর্সা বেলজিয়ান আর এখানে হয়েছেন বান্টু।
মালাঞ্জা (ঘনাদার পিঠে যেন ঠাট্টা করে একটা প্রচণ্ড চাপড় দিয়ে)—আরে এইটেই আমার আসল চেহারা, সেইটে ছিল মেক-আপ করা নকল। কিন্তু আইডাহো থেকে আমার খোঁজে এখানে এলেন কী করে?
ঘনাদা (যেন চাপড় খেয়ে টলে পড়তে পড়তে)—সামান্য একটু বুদ্ধি খাটিয়ে। তাছাড়া আপনি তো হদিসটা রেখেই এসেছিলেন।
মালাঞ্জা (অবাক হয়ে ও রাগী গলায়)—আমি রেখে এসেছিলাম? কী—
ঘনাদা (যেন ভয়ে ভয়ে)—আজ্ঞে, আপনার নামটা। আপনার সে বিদ্যাবুদ্ধি তো নেই। থাকলে জানতেন যে সব দেশের মানুষের নামের কিছু কিছু আলাদা বিশেষত্ব থাকে। যেমন আপনার মালাঞ্জা এমপালে—এ নাম আপনি ট্যানজানিয়া কি সুদানে পাবেন না।
মালাঞ্জা (যেন ক্ষিপ্ত হয়ে ঘনাদার ঘাড় ধরে নেড়ে)—শুধু নাম দেখেই তুই এখানকার হদিস পেয়েছিস?
ঘনাদা (যেন কাতরাতে কাতরাতে)–শুধু আপনার নয়, ড. লেভিনকেও যে ভুজুং দিয়ে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছেন তারও খোঁজ পেয়েছি।
মালাঞ্জা (এবার যেন হতভম্ব)—তারও খোঁজ পেয়েছিস শুধু আমার নাম থেকেই।
ঘনাদা (পেছনের দিকে সরে গিয়ে সবিস্ময়ে)—আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে লেভিনের স্বপ্ন আর সাধনা হল পৃথিবীকে বড় করার। তার জন্য এই কঙ্গো বা জাইরে না এসে যাবেন কোথায়?
মালাঞ্জা (গর্জন করে)—শোন, যেমন করেই হোক, এখানে যে পৌঁছেছিস এই তোর ভাগ্য। এবার ড. লেভিনের খোঁজ ছেড়ে সুবোধ ছেলের মতো তোকে ঘরে ফিরে যেতে হবে।
ঘনাদা (সবিনয়ে)–কিন্তু আমার ঘর যে বড় দূর। এই গোটা আফ্রিকা আর আরব সাগর পার হবার পরও যেতে হবে ভারতবর্ষের একেবারে পূর্বপ্রান্তে বাঙালিদের দেশে। তার চেয়ে আপনিই ঘরে ফিরে যান ওই কী বলে—বেলজিয়াম না জার্মানির কোনও লুকনো নাৎসি আস্তানায়। যেখানেই যান ইতুরির জঙ্গলের ধারে কাছে অন্তত থাকবেন না।
মালাঞ্জা (রাগে আগুন হয়ে)–ইতুরি! কী জানিস তুই ইতুরির?
ঘনাদা (একটু যেন বাহাদুরির সঙ্গে)—এইটুকু জানি যে পৃথিবী বড় করার সুবিধে দেখিয়ে সেইখানেই ড, লেভিনকে আপনি লুকিয়ে রেখেছেন। সেখান থেকেই তাকে এবার উদ্ধার করব।
মালাঞ্জা (একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে)–কী! তুই তাকে উদ্ধার করবি?
মালাঞ্জা গোরিলার মতো ঘনাদার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঘনাদা কিন্তু ঠিক সময় মতো সরে যাওয়ায় মালাঞ্জা সজোরে দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে নীচে বসে পড়বে। ঘনাদা তাকে তুলতে গেলে সে আবার হুংকার ছাড়বে। ঘনাদা তাই শুনে অন্যদিকের দেওয়ালের কাছে সরে যাবে। মালাঞ্জা সেদিকেই আবার ঝাঁপিয়ে পড়বার আগেই ঘনাদা সরে যাওয়ায় মালাঞ্জা আবার দেয়ালে মাথা ঠুকে ধাক্কা খেয়ে নীচে বসে পড়বে।
এই রকম বার তিন-চার দেওয়ালে প্রচণ্ড ঠোকা খেয়ে মালাঞ্জা একেবারে লুটিয়ে পড়বে নীচের মেঝেয়। নীচের মেঝের দিকটা গোড়া থেকেই অন্ধকারে থাকবে। মালাঞ্জাকে তাই ঠিক আর দেখা যাবে না। সে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘনাদা এক হাতে যেন তার বিশাল দেহটা তুলে দুবার শূন্যে ঘোরাবেন। মালাঞ্জার এ দেহটা আসলে খড়ের। তারপর আবার সে দেহটা মাটিতে আছড়ে আবার আসল মালাঞ্জাকে তুলে একধারে বসাবেন। নীচে মেঝের দিকটা অন্ধকারে রাখার দরুন মালাঞ্জা আর খড়ের ডামি বদলাবদলির সুযোগ হবে। ডামি ঘোরাবার ও আছড়াবার সময় মালাঞ্জার গলায় আর্তনাদ বার করা হবে।
ঘনাদা (সবিনয়ে)—আমি বড়ই দুঃখিত, হের মালাঞ্জা। এই বাংলো বাড়ির দেওয়ালগুলো গদি আঁটা থাকা উচিত ছিল।
মালাঞ্জা (কাতরাতে কারাতে)—আমি দুঃখিত মি. দাস যে, আপনাকে একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। চলুন এবার ইতুরির জঙ্গলে ড. লেভিনের কাছেই আপনাকে নিয়ে যাবার সম্মানটা আমার হোক।
[আবার সেই চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল বিদ্যুৎচমক। তারপর অন্ধকারে যবনিকা নেমে আবার কয়েক সেকেন্ড বাদে উঠে যাবে। খুব জোরালো আবহসঙ্গীত থাকবে।
যবনিকাটা ওঠবার পর আলোকিত মঞ্চে আগের মতো ঘনাদা ইত্যাদি সকলকে নিজের নিজের জায়গায় বসে থাকতে দেখা যাবে।]
ঘনাদা (জটাধারীর দিকে চেয়ে)—মালাঞ্জা তারপর ইতুরি জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিল সত্যিই, তবে ড. লেভিনের কাছে পৌঁছে দেবার ছুতোয় ওখানকার বামনদের মরণফাঁদে ফেলে মারবার ফন্দিই করেছিল ভাল করে। সে ফন্দি ভেস্তে দিয়ে আমি নিজেই ড. লেভিনকে তাঁর গোপন আস্তানায় খুঁজে বার করে তাঁর সর্বনাশা সাধনা ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
গৌর (একটা বাঁকাসুরে)—আপনি গিয়ে ডাকলেন আর ড. লেভিন তাঁর গোপন আস্তানা থেকে তাঁর জীবনের পরম সাধনা একডাকে ছেড়ে দিয়ে সুড়সুড় করে আপনার সঙ্গে চলে এলেন?
ঘনাদা (যেন পরম ঔদার্যে সব ধৃষ্টতা ক্ষমা করে)—তাই এলেন! প্রথমে তাঁর স্বপ্ন আর সাধনার কথা জেনেই যে তাঁর গোপন গবেষণার আস্তানার হদিস পেয়েছি তা জানাতে একটু অবাকই হলেন।
শিশির (বাধা দিয়ে)—সত্যি! সে হদিসটা কী করে পেলেন। শিবু—যোগবলে নিশ্চয়!
ঘনাদা (ক্ষমার অবতার হয়ে)–না, যোগবলে নয়। দুই-এ দুই-এ চারের হিসেবে। সেই কথাটাই ড. লেভিনকে বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলাম—আপনি পৃথিবী বড় করতে চান। কিন্তু পৃথিবী তো বেলুনের মতো ফুলিয়ে বড় করা যায় না। তখন বুঝলাম যে আপনার পৃথিবী বড় করা মানে মানুষকেই ছোট থেকে আরও ছোট করবার একমাত্র স্বপ্ন। যেখানে বামন মানুষ, বামন ছাগল-মোষ, বামন হাতি পাওয়া যায়, সেইখানেই আকার কমবার রহস্যের হদিস পাবেন ভেবে আপনি ইতুরি এসেছেন। কিন্তু শুনুন ড. লেভিন, আপনার গবেষণা, আপনার স্বপ্ন মানুষের পক্ষে সর্বনাশা। মানুষ ছোট হতে হতে পিঁপড়ের মতো হলে পৃথিবী তার পক্ষে বিরাট হবে সত্যি! মানুষের মনটা কিন্তু আরও বড়, আরও উদার না হলে আপনার সব স্বপ্নসাধনা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
(এরপর ঘনাদা দাঁড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই শিবু, শিশির সবাই হাঁ-হাঁ করে উঠবে।]
শিবু, শিশির ইত্যাদি (সমস্বরে)—আরে, যাচ্ছেন কোথায় ঘনাদা। বনোয়ারি যে ফিশরোল ভাজিয়ে এল বলে।
ঘনাদা (তবু দাঁড়িয়ে উঠে জটাধারীর কাছে যেতে যেতে) হ্যাঁ, সেই জন্যই রোল আর ফ্রাই-এর উপযুক্ত অভ্যর্থনার জন্য যোগীবরের জঙ্গলের বাধাটা একটু সাফ করে দিচ্ছি। (ঘনাদা একটানে জটাধারীর মাথার জটা আর মুখের নকল দাড়ি খুলে ফেলে দিয়ে) অপরাধ নেবেন না, যোগীবর, আপনার জটাজুট আর গোঁফ দাড়ি আমার ফিশরোল সরানো সিলিং থেকে ঝোলানো কলো সুতোয় বেঁধেই পাচার করে দিচ্ছি।
[ঘনাদার কথা শেষ করে যেন এক হাতে টান দেবেন আর জটাজুট আর দাড়ি গোঁফের চুল শূন্যে উঠে ছাদে চলে যাবে। সবাই হাত তালি দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বনোয়ারিকে ট্রে নিয়ে ঢুকতে দেখা যাবে। যবনিকাও আবহসঙ্গীতের সঙ্গে এবার নেমে আসবে।]