দিল্লি থেকে নিউইয়র্ক এলাম পরশু। নিউইয়র্ককেই, খুব অবাক কাণ্ড, দিল্লির চেয়েও আপন মনে হয় বেশি। দেশ থেকে এত দূরে, তারপরও আপন মনে হওয়ার কারণ কী? কিছু আত্মীয় স্বজন থাকে বলে নাকি আমি বহু বছর ধরে নিউইয়র্কে আসছি বলে বা বাস করেছি বলে, বা আমার স্থায়ী বসবাসের অনুমতিপত্র দিল্লিটির তুলনায় নিউইয়র্কেরটি পোক্ত বলে? নাকি আমি যে বিদেশি, তা দিলি্লতে মানুষ যত মনে করিয়ে দেয়, নিউইয়র্কে তত মনে করিয়ে দেয় না বলে? ঠিক জানি না। নিউইয়র্কের বিমানবন্দরেই এবার মন ভালো হয়ে গেল। হেঁটে যেতে থাকা ভিড়ের এক লোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘এখানে পে ফোন’টা কোথায় বলতে পারেন?’ লোকটি বললেন, ‘আপনার ফোন দরকার? এই নিন আমার ফোন। ফোন করুন। আমি আসছি বাথরুম থেকে’। আমার হাতে দামী একখানা স্মার্ট ফোন দিয়ে আফ্রো-আমেরিকান মধ্যবয়সী লোকটি চলে গেলেন। পনেরো মিনিট ওখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর দেখলাম লোকটি আসছেন। এভাবে আজকাল কেউ কাউকে বিশ্বাস করে? অনেককাল দেখিনি। চারদিকে তো দেখি কেবল অবিশ্বাসের ছোবল, সন্দেহের তীর। পৃথিবীতে এখনও কিছু ভালো মানুষ আছেন, সে কারণেই ভালো লাগে বাঁচতে।
নিউইয়র্কের যে এলাকায় এখন আছি আমি, তার প্রায় সব লোকই এশিয়ার। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, চীন, কোরিয়ার। এলাকাটি একসময় ইহুদিদের ছিল। হাতে টাকা পয়সা বেশি এলে ইহুদিরা এর চেয়ে ভালো এলাকায় চলে গেল, বসতি স্থাপন করলো এশিয়া থেকে আসা তুলনায় গরিব লোকেরা। আগে এই এলাকায় ভারতীয় দোকানপাট দেখতাম, এখন দেখছি সেসবও দখল করে নিয়েছে চীনেরা। ম্যানহাটনের চায়নাটাউন মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে সাদা আমেরিকানদের টাউন হয়ে উঠবে আর কুইন্সের ফ্লাসিং হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের চায়নাটাউন। পৃথিবীর বড় শহরগুলোয় ছোটখাটো হলেও একটি চায়নাটাউন থাকেই। কয়েক বছর আগে যখন ম্যানহাটনে থাকতাম, প্রায়ই চায়নাটাউনে যেতাম জ্যান্ত মাছ কিনতে, চীনে রেস্তোরাঁয় খেতেও যেতাম। চীনে খাবার আমার খুব প্রিয়। কিন্তু ম্যানহাটনের চায়নাটাউনে এবং কুইন্সের ফ্লাসিংয়ের চীনে রেস্তোরাঁয় আমার খানিকটা অসুবিধে হয়, বেশির ভাগ কর্মচারী বা মালিক মোটেও ইংরেজি জানে না। মেনুতেও নেই একটি ইংরেজি অক্ষর। কী খেতে চাই না চাই তা মেনুর ছবি দেখে বোঝাতে হয়। ইংরেজির কিছুই না জেনে বংশ পরম্পরায় ব্যবসা বাণিজ্য করে, চাকরি বাকরি করে দিব্যি বহাল তবিয়তে চীনেরা আছে আমেরিকায়।
ফ্লাসিং এলাকাটি আমার মন্দ লাগে না। এখানে এলেই আমার মনে হয় আমি চীন দেশের কোনও শহরে আছি। জানি না কতদিন এখানে চীনেরা বাস করবে। হাতে টাকা পয়সা বেশি হলে লং আইল্যান্ডে বাড়ি কিনে চলে যাবে, অথবা ম্যানহাটনে অ্যাপার্টমেন্ট কিনবে। গরিবরা অনুসরণ করছে মধ্যবিত্তকে, মধ্যবিত্ত করছে ধনীকে, ধনী করছে আরও ধনীকে। আমার জীবনটা আবার এইসব নিয়মে চলে না। ম্যানহাটনের তেইশতলায় ছিল আমার অ্যাপার্টমেন্ট, হাডসন আর ইস্ট নদীর মোহনায়, ছেড়ে চলে গেছি ঘিঞ্জি দিলি্লতে, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ। এখানকার খরচ পোষাতে পারি না বলে অথবা দেশের গা ঘেঁষে থাকবো বলে চলে গেছি। অবশ্য গা ঘেঁষে থাকলে কীই বা লাভ! দেশ কি তার দুয়ার খোলে!
নিউইয়র্ক থেকে যাবো ভার্জানিয়ায়, ওখানে আমাদের কনফারেন্স, ‘উইমেন ইন সেকুলারিজম’। বারবারা এরেনরাইস, সুজান, জেকোবি, রেবেকা গোল্ডস্টাইন, ওফেলিয়া বেনসনের মতো আমেরিকার স্বনামধন্য ধর্মমুক্ত নারীবাদীরা কনফারেন্সে বক্তৃতা করবেন। আমার বক্তৃতার বিষয় ‘নারীর জন্য সেকুলারিজম কেন প্রয়োজনীয়’। নারীর সমানাধিকার সত্যিকার ঘটাতে চাইলে রাষ্ট্র, সমাজ, আইন, আর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে আলাদা করা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সে কথাই বলবো। বলবো ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, একে ব্যক্তিগত ব্যাপারের বাইরে আনাটা মোটেও নিরাপদ নয়। আমি প্রথম নই, এসব কথা মুক্তচিন্তকরা বহুকাল থেকে বলছেন। শত শত বছর এ নিয়ে আন্দোলন হওয়ার পর ধীরে ধীরে বদলেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকে কাউকে না কাউকে তো বলতে হবে। মুশকিল হচ্ছে, বললে জেলে যেতে হয়, মরতে হয় অথবা আমার মতো নির্বাসিত হতে হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারপরও কেউ কেউ প্রতিবাদ করে। সমাজ বদলাবার চেষ্টা চিরকালই হাতে গোনা লোকই করে। সমাজ শেষ পর্যন্ত বদলায় হাতে গোনা কিছু লোকই।
ভাষণটা তৈরি করছিলাম আর সেকুলারিজম, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে রীতিমত ভাবছিলাম, এমন সময় হঠাৎ হাতে এলো যীশুর ওপর কিছু ছবি। ‘দ্যা বাইবেল’ নামে নতুন একটা তথ্যচিত্র করা হয়েছে, সেটি। মার্টিন স্করসেসের পুরোনো একটি ছবি : ‘দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অব ক্রাইস্ট’, মন্টি পাইথনের ‘লাইফ অব ব্রায়ান’, বিবিসির তথ্যচিত্র ‘যীশু কি সত্যিই ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন?’, রিচার্ড ক্যারিয়ারের গবেষণা-ভাষণ, ‘যীশু বলে কোনওকালে কোথাও কেউ ছিলেন না’। এসব দেখে টেখে যীশুতে ডুবে আছি। মজার কিছু তথ্য পেলাম, যেমন, রোমানদের শাস্তি থেকে পালিয়ে কাশ্মীরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যীশু, ওখানেই মারা যান, শ্রীনগরের রোজাবাল মন্দিরেই যীশুর কবর। বিবিসিতে কবরটাও দেখানো হলো। যীশু যদি মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় জীবিত হয়ে আকাশে উড়ে না যান, তাহলে কিন্তু ক্রিশ্চান ধর্ম বলে কিছু আর থাকে না। কাশ্মীরে নাকি যীশু এসেছিলেন একটা বৌদ্ধ সম্মেলনে যোগ দিতে। আবার কেউ কেউ বলে, যীশুর ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সের হিসেব পাওয়া যায় না, ওই বয়সে তিনি কোথায় ছিলেন, কী করেছিলেন কেউ জানে না, ওই সময়টাতেই নিশ্চয়ই তিনি ভারতে এসে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ইহুদি ধর্মে যা ছিল না এবং যা ক্রিশ্চান ধর্মে এসেছে, তা হল বৌদ্ধ ধর্মের মানবতা এবং সহিষ্ণুতা। সে কারণে যীশুকে ভারতের মাটিতে আনার নানারকম কায়দা। মার্টিন স্করসেসে তাঁর ছবিতে যীশু সম্পর্কে অপ্রিয় সত্যি কথা বলেছেন। অপ্রিয় সত্য কথা ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের সয়নি, অনেক দেশেই ছবিটা এখনও নিষিদ্ধ। ছবিতে দেখানো হয়েছে, যে যীশু এক সময় ভালোবাসার কথা বলতেন, সেই যীশুই এক সময় তলোয়ার আর কুড়ুল নিয়ে শত্রু নিধন করতে লেগে গেলেন। শুধু তাই নয়, প্রেমিকা মেরি মাগদালেনের মৃত্যুর পর বিভিন্ন নারী-সঙ্গ ভোগ করতে লাগলেন। পার্থিব সুখের পেছনে দৌড়ে ছিলেন খুব। এসব ঘটনা ক্রিশ্চানদের অপ্রস্তুত করে বলে বাইবেল নামের তথ্যচিত্রে এসব ঘটনার উল্লেখ নেই। তথ্যচিত্রে কেবলই গাদা গাদা অলৌকিক ঘটনা, যীশু নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, পানিকে ওয়াইন বানিয়ে ফেলছেন, তিনটে মাছকে এক তুড়িতে তিন হাজার মাছ বানিয়ে ফেললেন, কুষ্ঠরোগীকে ছুঁয়ে দিলেন অমনি রোগী ভালো হয়ে উঠলো। অনেকে ছবির বিষয় মানবে না, তাই বলে, আমি মনে করি না যে ছবিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। অবশ্য নিষিদ্ধ হয়েছে এমন সব দেশেই যেখানে মত প্রকাশের অধিকারের মূল্য খুব একটা নেই।
মুসলিম দেশগুলোয় এখনও মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা বড় একটা নেই। জেদ্দা শহরে গৃহবন্দি অবস্থায় যে সৌদি রাজকন্যারা আছেন, তাঁদের একজন সাহার আল সাউদ সেদিন সৌদি জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন সৌদি রাজত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। তিনি নিশ্চয়ই সবার গণতান্ত্রিক অধিকারের বা মানবাধিকারের কথা বলছেন, মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা চাইছেন। সৌদি আরবের মতো নারী-বিরোধী সমাজেও কিছু নারী নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। সৌদি রাজকন্যারা তাঁদের বাবাকেও ছেড়ে কথা কইছে না। সাহসী মেয়েরা আজ নজরবন্দি, নির্বাসিতা। মৌলবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন করতে হবে মেয়েদের, কারণ মৌলবাদ দ্বারা মেয়েরাই বেশি ভোগে। আমি খুব অসহায় বোধকরি যখন শুনি মেয়েরা নিজেরাই মৌলবাদী হচ্ছে। শুনলাম তিরিশ থেকে চলি্লশ হাজার মহিলা জামাতে ইসলামীর মহিলা স্কোয়াড থেকে মহিলাবিরোধী জামাতে ইসলামীকে সহায়তা করছে। নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে মেয়েরা যত ভালো পারে, তত ভালো বোধহয় আর কেউ পারে না। বাংলাদেশ কী দ্রুত বদলে গেছে। দেখলে সত্যিই দুঃখ হয়। আশির দশকে মেডিক্যাল কলেজে যখন পড়তাম, আমার মুসলমান বন্ধুরা কেউই ইসলাম ইসলাম করে মুখে ফেনা তুলতো না, কেউ নামাজ রোজা করতো না, দাড়ি রাখতো না, হিজাব পরতো না।
আজ তিরিশ বছর পর নামী দামী সহপাঠী ডাক্তারদের বেশির ভাগই হয়ে উঠেছে কট্টর মৌলবাদী। এত অল্প সময়ে দেশটা এমন ভয়ংকর পাল্টে গেল। সমাজ ক্রমশ ভালো হয়। আর আমাদের সমাজই ক্রমে ক্রমে মন্দ হচ্ছে, কট্টরপন্থী হচ্ছে, অসহিষ্ণু হচ্ছে, নারী বিদ্বেষী হচ্ছে, মূর্খ হচ্ছে। ভাবতে বিস্ময় জাগে যে দেশের মানুষ একদিন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য ভাষা আন্দোলন করেছিল, গণআন্দোলন করেছিল, মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, আজ সেই দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাঙালি লেখিকার স্থান নেই, মানবাধিকারের পক্ষে আর নারীর সমানাধিকারের পক্ষে কথা বলার মানুষটি আজ নিষিদ্ধ। সেদিন দেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান একটি দল ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার পর সন্ধেয় আমার সঙ্গেও দেখা করেছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, একটা সেকুলার পার্টি ক্ষমতায় আছে, আপনাদের তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। দলের নেতা জিজ্ঞেস করলেন, সেকুলার কে? আমি বললাম, ‘হাসিনা’। নেতা তুমুল হেসে বললেন, ‘এইটা কী কইলেন? হাসিনা সেকুলার? হাসিনা সেকুলার হইলে তো আপনারে দেশে নিত’।
০১ মে, ২০১৪