ভারতের নির্বাচনী প্রচারে উঠে এলো বাংলাদেশি অবৈধ ‘অনুপ্রবেশকারী’ প্রসঙ্গ। বিজেপি নেতা মোদী বলেছেন, সব অনুপ্রবেশকারী যেন বাঙ্পেটরা গুছিয়ে ফেলে, কারণ ১৬ মে’র পর ওদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। শুনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, বাংলাদেশিদের স্পর্শ করার স্পর্ধা যেন কেউ না করে। না, এ কারণে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে বাংলাদেশিদের বন্ধু ভাবার কোনও কারণ নেই। বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানদের জন্য তাঁর যে দরদ, তা সত্যিকারের দরদ নয়, নেহাত রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির দরদ।
মোদী বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে যারা আসছে, যারা ভারতে দুর্গাষ্টমি করছে, তাদের তাড়ানো হবে না। এর মানে তাড়ানো হবে না শুধু হিন্দুদের। হিন্দুরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসছে, কারণ হিন্দু হওয়ার কারণে বাংলাদেশে তারা অত্যাচারিত। মুসলমানরাও কি অত্যাচারিত হতে পারে না? তারাও কি রাজনৈতিক শরণার্থী হতে পারে না? তাদের তো জাতিসংঘের যে কোনও দেশেই ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন অনুযায়ী রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া উচিত। যদি তারা অর্থনৈতিক শরণার্থীও হয়, তাদের তো ঘাড় ধাক্কা দেওয়া উচিত নয়, মানবতার কারণে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই অর্থনৈতিক শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। ভারত কেন দেবে না? আর কয়েক দশক পর যখন বাংলাদেশ জলে ডুবে যেতে থাকবে, পৃথিবীকে তো শিখতে হবে আবহাওয়া পরিবর্তনের শরণার্থীদের বরণ করে নিতে।
মমতার কোনও দরদ মুসলমানদের প্রতি নেই। তিনি এই যে মুসলমান মৌলবাদীদের মাথায় তুলে নাচছেন, তা সবই ভোটের জন্য। মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য তিনি হেন কাজ নেই করছেন না। তিনি হিন্দু হয়েও, কালীভক্ত হয়েও, মুসলমানদের এলাকায় গিয়ে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ, আল্লাহ এক, এবং মুহম্মদ তার প্রেরিত রসুল, বলেন। এই বাক্যটি বিধর্মীরা উচ্চারণ করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার উদ্দেশে। মমতা কিন্তু তাঁর ধর্ম বদল করার উদ্দেশে কলমা বলেন না। তিনি বলেন মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য। মাথায় হিজাব পরে নামাজ পড়েন, মোনাজাত করেন, রোজা রাখেন, ইফতার করেন। এতই যদি ইসলাম ধর্মের প্রতি ভালোবাসা, ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করলেই পারেন। তাঁর সবই মুসলমান মৌলবাদীদের খুশি করার জন্য। মৌলবাদীরা মুসলমানদের নেতা। মৌলবাদীরা যাকে ভোট দিতে বলবে, মুসলমানরা তাকে ভোট দেবে। সে কারণে মৌলবাদীদের পটানোয় ব্যস্ত রাজনীতিকরা। সবচেয়ে ব্যস্ত শ্রীমতী মমতা বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু মুসলমানদের খুশি করার নামে মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি অপমান করছেন তিনি। তিনি ভাবছেন মুসলমানরা এক একটা গাধা। তারা তাঁর ছলচাতুরী কিছুই ধরতে পারবে না। তিনি যে মুসলমান মৌলবাদীদের সব অন্যায় দাবি মেনে নিচ্ছেন, এবং মুসলমান সম্প্রদায়কে আরও অন্ধকারে রাখার ব্যবস্থা করছেন, ব্যবহার করছেন নিতান্তই ভোটব্যাংক হিসেবে, তা জগতের সব লোক বুঝতে পারলেও মুসলমানরা পারবে না। এরকমই তাঁর বিশ্বাস। আমি জানিনা মুসলমানরা কেন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের এসব আদিখ্যেতার প্রতিবাদ করছে না। কেন বলছে না, ‘তুমি বাপু হিন্দু সে আমরা জানি। তোমার এত মুসলমানের সাজ পোশাক না পরলেও চলবে, অত কলমা না আওড়ালেও চলবে। দেশের নাগরিক হিসেবে মুসলমানদের যে সম্মান পাওনা, সেটুকুই আমরা চাই। আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা বন্ধ কর’।
মমতা বন্দোপাধ্যায়ের যদি বাংলাদেশের অহিন্দু শরণার্থীর প্রতি সামান্যও সহানুভূতি থাকতো তাহলে পশ্চিমবঙ্গে আমার উপস্থিতি তিনি নিষিদ্ধ করতেন না, আমার বই উদ্বোধনের অনুষ্ঠানও তিনি বাতিল করতেন না, আমার নতুন মেগাসিরিয়ালের প্রচারও তিনি বন্ধ করতেন না। আমাকে নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্য একটিই, মুসলমান মৌলবাদীদের তোষামোদ করা। মুসলমান মৌলবাদীরা আমার ওপর অত্যাচার হলে বেশ খুশি থাকে, আমার মাথার মূল্য তারা অনেক আগেই ধার্য করে ফেলেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি মোদী ক্ষমতায় এলে বাঙালি মুসলমানদের ভারতছাড়া করবেন? আমার বিশ্বাস হয় না। এই কাজ করলে সারা বিশ্ব মোদীর নিন্দায় মুখর হবে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোয় লক্ষ লক্ষ ভারতীয় হিন্দু বাণিজ্য করছে, চাকরি বাকরি করছে। মধ্যপ্রাচ্য মোদীবিরোধী হয়ে উঠলে ভারতের বিপদ। জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন না মানলে মোদীকেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মোদী এখন ভারতে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বলছেন, রাম মন্দির গড়ার কথা বলছেন। ক্ষমতায় গেলে তিনি কি এসব বলবেন? ক্ষমতায় যাওয়ার আগে অনেক কিছুই বলা যায়, ক্ষমতায় যাওয়ার পর একটি বিশাল গণতান্ত্রিক দেশকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় চারদিক সামলাতে হয়। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করলে ঠাণ্ডা মাথায় কিছুই সামলানো সম্ভব নয়। সুতরাং ক্ষমতায় দীর্ঘকাল থাকতে হলে ধর্মের রাজনীতি মোদীকে বর্জন করতেই হবে। তিনি এত বোকা নন যে তিনি তা করবেন না। ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের খুশি করার জন্য অল্প স্বল্প তিনি নিশ্চয়ই কিছু করবেন, সে করাটা নিশ্চয়ই কোনও মসজিদ ভেঙে বা মুসলমান খুন করে নয়।
শুনেছি খালেদা জিয়া মহাখুশি। এতকাল পর কংগ্রেস বিদেয় হচ্ছে। কংগ্রেস চিরকালই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। মোদী এলে হাসিনা সরকার আর ভারতের সহযোগিতা পাবে না। এই খুশিতে জামায়াতে ইসলামী আর বিএনপি এখন থেকেই বগল বাজাচ্ছে। কট্টর মুসলমান আর কট্টর হিন্দুর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। তারা যেহেতু সমাজকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায়, অথবা এক জায়গায় থেমে থাকুক দেখতে চায়, তারা ভেতরে ভেতরে অনেকটাই ভাই ভাই। একে অপরের পরিপূরক। এ আছে বলেই ও আছে। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ, বজরং দল, শিবসেনাদের কোনও আদর্শগত পার্থক্য নেই। এই ধর্মভিত্তিক দলগুলো যতদিন ভারতীয় উপমহাদেশে বিরাজ করবে, ততদিন সত্যিকার প্রগতির পথে এরা বাধা হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষিত সচেতন প্রগতিশীল মানুষের কাজ এই নারীবিরোধী ধর্মান্ধ দলগুলোকে নির্মূল করা। তলোয়ার দিয়ে নয়, মানুষের মধ্যে যুক্তি বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে।
০৮ মে, ২০১৪