পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী
কিন্তু সাধারণ মানুষ? গ্রামের কৃষক আর শহরের শ্রমিক? তারা কি হাত গুটিয়ে চুপটি করে নিজেদের সর্বনাশের আয়োজন শুধু শুনেই চলবে? নিশ্চয়ই নয়! যদি তাই হতো তাহলে মানুষের গল্প ওইখানেই শেষ হতো। শেষ হতো সভ্যতার ইতিহাস। মানুষের কীর্তির কথা।
কিন্তু তা হয় নি। হবে না। সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ আওয়াজ তুলেছে: দুনিয়ার শ্রমিক এক হও। পায়ের শেকল ছাড়া তোমাদের হারাবার মতো আছে কী? অথচ জয় করবার জন্যে তোমাদের সামনে তো পুরো পৃথিবীই। তবে এক হতে হবে। এক হয়ে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে আজকের পৃথিবীতে বিশাল বিশাল কলকারখানা থেকে শুরু করে উৎপাদনের উপায়গুলোর ওপর একমুঠো মানুষের মালিকানাটাই যতো নষ্টের গোড়া। বিজ্ঞানের অতি আশ্চর্য আবিস্কারগুলোকে মানুষের কল্যাণে যাতে না লাগানো হয় তারই হাজারো ফন্দি-ফিকির! সেই আবিষ্কার কাজে লাগিয়েই মালিকের দল পাওয়া-বারো মুনাফা লুঠছে; আর তা যে পারছে তার আসল কারণটা হলো উৎপাদনের উপায়গুলোর ওপর তাদের দখল। আর তাই যদি বদলানো যায়-বদলানো যায়। ওই উপায়গুলোর ওপর মুষ্টিমেয় মালিকের মালিকানা–তাহলেই অবস্থাটা যায় একেবারে পাল্টে। কিন্তু আজকের মালিকদের হঠাতে পারলে এগুলো আসবে কাদের হাতে ? সাধারণ মানুষের হাতে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো আর শুধু কথার কথা নয়। তাদের পুরো দলটাকে বলে সমাজ আজকের মতো সমাজ নয়, সমাজের একেবারে রদবদল করে সত্যিকারের সাধারণ মানুষের স্বার্থে ঢেলে সাজানো নতুন রকম সমাজ। হাজারো কারচুপি করে এই নতুন ছাঁচে ঢালা সমাজটা হাতেগোনা মালিকদের স্বার্থে চলবে না, থাকবে না। তাদের দেশ চালানোর ক্ষমতা। এই রকমের একটা সমাজ গড়তে পারলে পুরো দেশটার চেহারা পালটে যাবে, আর সব দেশের মানুষ যদি এই নতুন পথে এগুতে পারে তাহলে বদলে যাবে পুরো পৃথিবীর চেহারাটাই। পৃথিবীতে আসবে নতুন পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে বিজ্ঞান দিয়ে মানুষ মারার কল বানানোর পালা শেষ হবে। শুরু হবে বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে লাগানোর পালা।
কিন্তু তাও আবার হয় নাকি? মালিকদের হাতে অমান অজস্র সেপাইশান্ত্রী। লাঠিসোটা তো দূরের কথা; বন্দুক কামান থেকে শুরু করে হাজারো রকম অস্ত্রশস্ত্র। এরা তো সবাই মালিকদেরই ভাড়া খাটছে। মালিকদের বিরুদ্ধে এতোটুকু রা তুললে এরা তো একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়বে; টুটি টিপে ধরবে সাধারণ মানুষের। দলে-পিষে শেষ করতে শুরু করবে। যারা মালিকদের বিরুদ্ধে এতোটুকু রব তুলেছে।
ব্যাপারটা তাই মোটেই সহজ নয়। কিন্তু সহজ না হলেও সম্ভব। মানুষের গল্পেই। তার নজির রয়েছে। রুশ দেশে খেটে খাওয়া মানুষ এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাঁড়িয়েছিল চীন দেশে। দাঁড়াবার আয়োজন করছে আরো নানান দেশে। ফলে মালিকের দল শেষ পর্যন্ত সত্যিই সামাল দিতে পারে নি। হার মানতে হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমন সহজ নয়। সাধারণ মানুষের স্বার্থে ক্ষমতা দখলের পরেও এসব দেশেও নতুন নতুন সমস্যা উঠছে, আর তা সমাধানের জন্য খুঁজতে হচ্ছে নতুন নতুন উপায়। সমস্যাগুলো দেখে অনেকেই কমবেশি হতাশ হয়েছেন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, মানুষের এগিয়ে চলার আর কোনো পথ নেই, মানুষের পক্ষে ফিরতি পথে পৌছুবারও কথা ওঠে না। তাই যে-সব সমস্যা উঠেছে, উঠছে, হয়তো আরো উঠবে।—তার সমাধান মানুষই বের করবে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ
আর একটা কথা ভুললে চলবে না। মানুষের পুরো ইতিহাস কতো বছরের? তার তুলনায় আজকের সমস্যাগুলোর বয়েস ক-দিনেরই বা? মালিকদের হাত থেকে শক্তি কেড়ে নেবার কথা তো এই সেদিনের ব্যাপার।–মাত্র বছর সত্তর হতে চললো। মানুষের পুরো ইতিহাসটার কথা ভাবলে চোখের পলকও নয়। এই সত্তর বছরের পরীক্ষায় যে-সব সমস্যা দেখা দিয়েছে সেগুলোকে চিরকালের সমস্যা বলে ভাবতে যাওয়া বেকুবি নয় কি? এককালে মানুষ সামান্য পাথরের টুকরো হাতে নিয়ে বাঁচবার আয়োজন করেছিল। সেইখান থেকে শুরু করে মানুষ আজ কোথায় এসে পৌঁছেছে! মানুষের এগুবার পথে আজো যতো বাধা তার সমাধানে মানুষের সামনে যেন অনন্তকাল পড়ে আছে।