2 of 2

পৃথিবীটা কার বশ – শৈবাল মিত্র

পৃথিবীটা কার বশ – শৈবাল মিত্র

সাতসকালে একটা টেলিফোন আসার পর থেকে হরষিতের হাবভাব বদলে গেল। বাড়তি রক্তচলাচলে লাল হয়ে উঠল পুষ্ট, গোল মুখ। চোখের তারায় কাচপোকার মতো আলো নেচে বেড়াতে লাগল। মাথার মাঝখানে চকচকে গোল টাকে একনাগাড়ে এত ঘাম জমতে থাকল যে রুমালে মুছে সেই জলস্রোত বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে উঠল। চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকে হরষিতের মুখচোখের চেহারা দেখে তার স্ত্রী সুরভি জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার? কে ফোন করেছিল?

বলতে গিয়ে হরষিত থেমে গেল। স্বামীকে স্থির চোখে কয়েক মুহূর্ত দেখে সুরভি প্রশ্ন করল, শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকব?

হরষিত বলল, শরীর ঠিক আছে। জল দাও এক গ্লাস।

টেবিলে চায়ের কাপ রেখে সুরভি তাড়াতাড়ি জল আনতে গেল। টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল হরষিত। উত্তেজিত হবার সময় এখন নয়। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। মেপে ফেলতে হবে প্রত্যেকটা পা। বেফাঁস কোনও কথা মুখ ফসকে যাতে বেরিয়ে না যায়, খেয়াল রাখা দরকার।

হরষিত বুদ্ধিমান লোক। ভাল এবং মন্দ জীবনে কম দেখেনি। দুঃখ, সুখ, দুটোই যথেষ্ট পেয়েছে। বিহ্বল অবস্থা সামলে নিতে তার সময় লাগল না। জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকে হরষিতকে সুরভি অনেক স্বাভাবিক দেখল। ঢকঢক করে পুরো গ্লাস জল খেয়ে হরষিত তৃপ্তির শব্দ করতে সুরভি জিজ্ঞেস করল, শরীর ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ।

যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।

হরষিত কথা বলল না। সুরভি বলল, চা খাও।

টেবিল থেকে কাপ তুলে হরষিত চায়ে চুমুক দেবার পরে সুরভি আবার জিজ্ঞেস করল, কে ফোন করেছিল?

নিখিল।

কী বলল?

অফিসের কথা।

খারাপ কিছু নয় তো?

না।

খালি জলের গ্লাস নিয়ে ঘর ছেড়ে যাবার সময়ে হরষিতের দু চোখের মণি থেকে কাচপোকার মতো আলো ঠিকরে পড়তে দেখল সুরভি। সুরভিকে নিখিলের নাম বললেও আসলে হরষিতকে ফোন করেছিল মুরারি শীল। মুরারির নাম হরষিত মুখে আনেনি। নিখিলের নাম বলেছে। মুরারির নাম শুনলে, তার পরিচয়, কেন ফোন করেছিল, এ রকম সাতসতেরো প্রশ্ন করত সুরভি। সব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আচমকা সত্যি কথাটা বলে ফেললে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হত। কাল সকাল পর্যন্ত মুরারির দেওয়া খবরটা গোপন রাখতে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চব্বিশ ঘণ্টা পরে সে না চাইলেও খবরটা জানাজানি হয়ে যাবে। হাজার চেষ্টা করেও সে ঠেকাতে পারবে না। একটার পর একটা ফোন আসতে থাকবে বাড়িতে। টেলিফোনের ঝনন্‌ঝন শব্দে কানে তালা লেগে যাবে। উত্তেজনাকর সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে এখনই প্রতিরোধব্যুহ গড়ে তোলা দরকার। খালি চায়ের কাপ সরিয়ে রেখে, কাগজ কলম নিয়ে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সাত বন্ধুর নামের তালিকা তৈরি করল হরষিত। নামের পাশে তাদের টেলিফোন নম্বর লিখল। সাতটা নম্বরই তার মুখস্থ। টেলিফোনের পাশে তালিকা রেখে তালিকার প্রথম নাম, সবচেয়ে পুরনো বন্ধু, সবুজ সরকারকে সবার আগে ফোন করল। সবুজের সঙ্গে স্কুল কলেজে এক ক্লাসে পড়েছে। সবুজ ব্যবসায়ী। চিনেবাজারের তিন পুরুষের কাগজ দোকানের এখন মালিক সবুজ আর তার ভাই রোহিত। সবুজ ফোন ধরতে বিনা ভূমিকায় হরষিত বলল, হাজার দশ টাকা ধার দিতে পারবি?

কেন?

জরুরি দরকার।

কবে চাই?

আজ পেলে ভাল হয়, না হলে কাল।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে সবুজ বলল, দু তিন হপ্তা বাদে দিতে পারি।

সবুজের কথায় হরষিত রীতিমতো চোট খেল। সিন্দুক খুলে যখন তখন দু চার লাখ টাকা যে বার করে দিতে পারে, হরষিতের মতো বাল্যবন্ধুকে দশ হাজার টাকা ঋণ দিতে সে এত ছলচাতুরি করবে, হরষিত ভাবেনি। হরষিত বলল, টাকাটা কাল সকালের মধ্যে না পেলে আমার চলবে না।

দিতে পারলে ভাল লাগত। চারদিন আগে সাতাশি হাজার টাকা আয়কর জমা করতে না হলে দিতে পারতাম।

রিসিভার কানে চেপে হরষিত দাঁড়িয়ে আছে। সাতাশি হাজার টাকা যে আয়কর দেয়, পুরনো বন্ধুকে দশ হাজার টাকা ধার দেওয়া তার কাছে জলভাত। সেটাই স্বাভাবিক। এক দু সেকেন্ড চুপ করে থেকে হরষিত বলল, কোনওভাবে ব্যবস্থা করা যায় না?

না। টাকার বাজার খুব খারাপ। আমিও আটকে গেছি।

কথা না বাড়িয়ে হরষিত রিসিভার নামিয়ে রাখল। তালিকার দ্বিতীয় নাম মানস রায়কে ফোন করতে ডায়ালে তর্জনী ঠেকাল। মানস তার কলেজের বন্ধু। এখনও সৌহার্দ্য আছে। সরকারি দপ্তরে উঁচু পদে মানস চাকরি করে। পদ্য লেখে। প্রগতিশীল আমলা বলতে যা বোঝায়, মানস তাই। সৎ অফিসার হিসেবে তার সুনাম থাকলেও নিন্দুকেরা অন্য কথা বলে। সে সব কথা হরষিত বিশ্বাস করে না। মানসের বাড়িতে ফোন বাজতে রিসিভার তুলে যে খনখনে পুরুষ কণ্ঠ জিজ্ঞেস করল কাকে চাই, তার গলা হরষিত আগে শোনেনি। মানসের নাম হরষিত বলতে উল্টোদিকের খনখনে গলা বলল, আমি মানস।

ঘাবড়ে গিয়ে হরষিত জিজ্ঞেস করল, কী করে গলার এ দশা হল?

ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছিল। এক হাতুড়ে বিশেষজ্ঞ ক্যান্সার হয়েছে বলে পাঠিয়ে দিল আলিপুরের এক হাসপাতালে। সাতদিন সেখানে থেকে বিশ হাজার টাকা গচ্চা দিয়ে জানা গেল ক্যান্সার হয়নি, হয়েছে ফ্যানেনজাইটিস। তবে গলার অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভাল। দুদিন আগেও কথা বলতে পারছিলাম না। ওষুধের খরচ জোগাতে জেরবার হয়ে যাচ্ছি।

মানস কথা বলতে শুরু করলে সহজে থামে না। আজও তাই। সমানে কথা বলে যাচ্ছে। হরষিতের মনে হল ভুল জায়গায় ফোন করেছে। দশ হাজার টাকা মানসের কাছে এ মুহূর্তে চাওয়া উচিত নয়। তবু বলল, একটা দরকারে ফোন করেছিলাম।

কী দরকার?

চোখ কান বুজে হরষিত বলে ফেলল, দশ হাজার টাকা কাল সকালের মধ্যে দরকার। দিতে পারবি?

কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতার পরে মানস বলল, দুদিন আগে হলে দিতে পারতাম। এখন হাত খালি। অসুখের আগে একটা বিশাল খরচ হয়ে গেছে। বড় ছেলে বুবুকে বাঙ্গালোর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করতে দেড় লাখ টাকা ক্যাপিটেশন ফি দিতে হল। চেয়েছিল পাঁচ লাখ। কী ভাবে দর কষাকষি করে পাঁচকে দেড় করেছি, দেখা হলে বলব।

ফোন ছাড়ার জন্যে হরষিত ছটফট করছে। মানসের গল্প শোনার সময় তার নেই। তালিকার বাকি পাঁচজনকে ফোন করতে হবে। দশ হাজার টাকা কাল সকালের মধ্যে চাই। মানসের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হঠাৎ মরে গেছে। ছেলের ভর্তির জন্যে যে দেড় লাখ টাকা দিতে পারে, দশ হাজার টাকা তার হাতের ময়লা। যখন তখন ঝনাত করে ফেলে দিতে পারে। বিশেষ করে যার সঙ্গে পঁচিশ বছরের বন্ধুত্ব, তার বিপদে দশ হাজার টাকা অনায়াসে দেওয়া যায়। বন্ধুত্বটা আসলে কিছু নয়, কথার কথা মাত্র। টাকাটা মানস দেবে না, বুঝতে পেরে হরষিত অসহায় বোধ করল। ভয় পেল। তার ধারণা ছিল আপদবিপদে পাশে দাঁড়াবার মতো বন্ধু তার অনেক আছে। তার বন্ধুভাগ্য ভাল। কথাটা একাধিকবার জাঁক করে সুরভিকে বলেছে। সব এখন পরিহাস মনে হচ্ছে। মানসের হাত থেকে রেহাই পেতে হরষিত জিজ্ঞেস করল, টাকাটা কোনওমতে ব্যবস্থা করা যায় না?

মানস বলল, সামনের মাসে চেষ্টা করতে পারি।

তা হলে ফোন রাখি!

মানসকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হরষিত রিসিভার নামিয়ে রাখল। সুরভি কখন ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, হরষিত খেয়াল করেনি। সুরভি জিজ্ঞেস করল, দশ হাজার টাকা হঠাৎ কি দরকার পড়ল?

পড়েছে।

বাড়তি কথা না বলে তালিকার তিন নম্বর নাম নিলয় ঘোষালকে হরষিত ডায়াল করল। স্কুল, কলেজের বন্ধুর চেয়ে নিলয় তার বেশি ঘনিষ্ঠ। পাঁচ থেকে পঁচিশ বছর বয়েস পর্যন্ত তারক প্রামাণিক রোডে নিলয়ের পাশের বাড়িতে সে থেকেছে। ছেলেবেলার সব খেলা, দুষ্টুমিতে নিলয় ছিল তার সাথী। পাড়াপড়শি তাদের মানিকজোড় বলত। তারক প্রামাণিক রোডে পৈতৃক বাড়িতে নিলয় এখনও থাকে। ভাড়াটিয়া হরষিত তারক প্রামাণিক রোড ছেড়ে পাঁচ বছর ভবানীপুরে কাটিয়ে, এখন ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা। সেখানেও হরষিত ভাড়াটে। বাসা বদল করে আরও কত জায়গায় ভাড়াটে হতে হবে, জানে না। প্রথমবার নিলয়ের ফোন এনগেজড হতে হরষিত আবার ডায়াল করছে। এত তাড়াতাড়ি নিলয় নিশ্চয় ব্যাঙ্কে রওনা হয়নি। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে ত্রিশ বছর আগে কেরানি হয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকে এখন সে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। সান্ধ্য কলেজে পড়ে এম কম পাশ করেছে। নিলয় আর তার পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ, যাতায়াত আছে। নিলয়ের বউ মীনাক্ষী ফোন ধরে হরষিতের গলা চিনে ফেলল। বলল, কী মশাই, ডুমুরের ফুল হয়ে গেলেন নাকি? বাড়ির খবর কী? সুরভি, ছেলেমেয়েরা কেমন আছে?

মীনাক্ষী থামতে নিলয়কে চাইল হরষিত। নিলয় ফোন ধরল। জিজ্ঞেস করল, কী খবর তোর?

খেজুরে আলাপে না গিয়ে হরষিত বলল, দশ হাজার টাকা ধার চাই। কালই দরকার, দিতে পারবি?

নিলয় চুপ। হরষিত বলল, তিন মাসে টাকা ফেরত দেব।

নিলয় জিজ্ঞেস করল, এত তাড়া কীসের? দশ হাজার টাকা নিয়ে কী করবি?

জরুরি দরকার।

হরষিতের জবাবে নিলয় খুশি হল না। অখুশি ভাব মুখের কথায় প্রকাশ না করে বলল, তুই বোধহয় জানিস না, এই মাসে অপারেশন করে মীনাক্ষীর ইউটেরাস বাদ দেওয়া হয়েছে। নার্সিংহোমের খরচ দিয়ে আমি ফতুর। এক, দু মাস পরে হলে, টাকাটা দিতে পারি।

ব্যাকুল গলায় হরষিত জিজ্ঞেস করল, কিছুই কি করা যায় না?

করতে পারলে সবচেয়ে খুশি হতাম আমি। তবে একটা উপায় আছে।

কী উপায়?

এক সেকেন্ড চুপ থেকে নিলয় জিজ্ঞেস করল, সুরভির গয়নাগাটি কেমন আছে?

খুব সামান্য।

কুড়ি হাজার টাকার সোনার গয়না ব্যাঙ্কে মরগেজ রাখলে কালই দশ হাজার টাকা পেতে পারিস।

সুরভির গয়না বন্ধক রেখে টাকা নিতে চাই না।

ইউনিট সিক্সটি ফোর আছে?

না।

মাস্টার শেয়ার, মাস্টার প্লাস, মাস্টার গেন?

না।

কী আছে তা হলে?

এল আই সি পলিসি আছে।

ব্যাঙ্কে এল আই সি চলবে না।

তা হলে?

আমি নিরুপায়।

অযথা বাক্যব্যয় না করে হরষিত রিসিভার রেখে দিল। তালিকার চতুর্থজনকে সে এ বার ফোন করবে। তার পেছনে পাথরের মূর্তির মতো সুরভি দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের পেছনে কখন সায়ন্তন আর সনাতনী, সাতাশ বছরের ছেলে, বাইশের মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, হরষিত দেখেনি। কলকাতার এক কম্পুটার সংস্থায় চার মাস সায়ন্তন চাকরি করছে। সনাতনী এম এ ক্লাসের ছাত্রী। ইতিহাস পড়ে। দু তিনটে টুইশন করে। ভাই, বোন দুজনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে। দুটো অ্যাকাউন্ট মিলে টাকার পরিমাণ, দশ হাজার না হলেও কাছাকাছি হওয়া অসম্ভব নয়। ছেলেমেয়ের কাছে শেষ পর্যন্ত হাত পাতার কথা হরষিত ভেবে রেখেছে। সায়ন্তন, সনাতনী অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেও হরষিত তোয়াক্কা করল না। চতুর্থজন, ক্ষত্রিয় গুপ্তকে ফোন করল। কর্মস্থলে অল্প যে কজন বন্ধু হরষিত পেয়েছে, তাদের একজন ক্ষত্রিয় গুপ্ত। প্রথম জীবনে আধা সরকারি সংস্থায় হরষিতের সহকর্মী ছিল সে। পুরনো কর্মস্থল, সেই আধা সরকারি অফিসে হরষিত আজও পড়ে আছে। তাকে পিছনে ফেলে ক্ষত্রিয় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সে এখন অন্যতম শীর্ষ কর্তা। ক্ষত্রিয় চটপটে, বুদ্ধিমান। বছরে কম করে দুবার অফিসের কাজে বিলেত, আমেরিকা যায়। ক্ষত্রিয়র দু ছেলের একজন পড়ে আমেরিকায়, ছোট জন দুন স্কুলে পড়ে। সব দিক থেকে অনেক ওপরে উঠে গেলেও হরষিতকে ক্ষত্রিয় ভোলেনি। গত বছরেও দুই পরিবার একসঙ্গে গোয়া বেড়াতে গেছে। গোয়ার সমুদ্রসৈকতে ক্ষত্রিয়র অফিসের বিলাসবহুল অতিথিভবনে প্রায় বিনি পয়সায় রাজার হালে সাতদিন থেকেছে। কোনও ছুটির সকালে, এখনও, ক্ষত্রিয় গাড়ি চালিয়ে মিষ্টির বাক্স হাতে হরষিতের ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয়। জমিয়ে এক-দু ঘণ্টা গল্প করে।

ঝনঝন করে ফোন বাজতে বিসিভার তুলল ক্ষত্রিয়। হরষিতের গলা শুনে বলল, রবিবার সকালে আপনার বাড়ি যাব ভেবে রেখেছিলাম। কেমন আছেন? ম্যাডাম, ছেলেমেয়ের খবর কী?

সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে হরষিত বলল, জরুরি দরকারে ফোন করেছি আপনাকে।

বলুন।

দশ হাজার টাকা চাই। কাল দরকার। তিন মাসের জন্যে দেওয়া কি সম্ভব?

সপ্রতিভ গলায় ক্ষত্রিয় বলল, মাত্র দশ হাজার। আমি ভাবলাম, লাখ, দু লাখ চাইবেন। যাই হোক, এ মাসে দশ হাজারও পারব না। গতকাল মারুতি ওয়ান থাউজেন্ডের জন্যে তিন লাখ পঁচিশ হাজার টাকা জমা করে হাত খালি হয়ে গেছে। তা ছাড়া মাসের গোড়ায় বাপ-মরা ভাগ্নির বিয়ে দিতে লাখ দুই টাকা লেগে গেল। সামনে মাসের সাত তারিখে দশ হাজার টাকা আপনাকে দিতে পারি।

ক্ষত্রিয় থামতে হরষিত বলল, টাকাটা কালই দরকার।

কাল পারছি না।

ফোন রাখার আগে হরষিত জিজ্ঞেস করল, রবিবার কি আমার বাড়ি আসছেন?

চেষ্টা করব।

আপাতত বছরখানেক এ বাড়ির দরজা ক্ষত্রিয় মাড়াবে না, রিসিভার নামাবার আগে হরষিত বুঝে গিয়েছিল। তালিকার বাকি তিন বন্ধু, সুকুমার চাকি বলল, সাতটা বিয়ে, চারটে অন্নপ্রাশন, তিনটে জন্মদিন, আর দুটো উপনয়নে উপহার কিনে এ মাসে সে ভিখিরি হয়ে গেছে। ব্যাঙ্কে জমানো টাকা ভাঙতে হয়েছে। ধূর্জটি বলল, সাতদিন আগে তার টিভি, ফ্রিজ-এর দোকানে ডাকাত পড়েছিল। ডাকাতরা দোকান থেকে সর্বস্ব নিয়ে গেছে। ধাক্কা সামলাতে বছরখানেক লাগবে। আপাতত টাকা দেবার সামর্থ্য তার নেই। তালিকার সাত নম্বর, শেষ ব্যক্তি, সরিৎ মুস্তাফি বলল, মহাকবি শেক্সপিয়ার ঋণ নিতে এবং ঋণ দিতে বারণ করেছিলেন। তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে আমি মেনে চলি। দুঃখিত, কিছু করার নেই।

সাত বন্ধুর কথাবার্তা শুনে হরষিত দমে গেলেও ভেঙে পড়ল না। বরং খুশি হল। লুকোচাপা না করে নিজেদের অবস্থা বন্ধুরা জানিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে সেও এ রকম খোলামেলা হবে। জীবনে কারও কাছে সে এক পয়সা ধার করেনি। বাজে খরচ করার দুর্নাম তার নেই। সাত বন্ধুর তিনজনকে তাদের বিপদে, নানা সময়ে সে ধার দিয়েছে। মানসের কাছে আজও তিন হাজার টাকা পাওনা আছে। চার বছরে একবারও তাগাদা করেনি। রিসিভার রেখে হরষিত যখন হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে, ক্ষুব্ধ গলায় সায়ন বলল, তোমার কি কোনও আক্কেল নেই? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? দশ হাজার টাকার জন্যে বন্ধুদের জনে জনে এ ভাবে ফোন করতে তোমার লজ্জা করল না? ছি ছি। টাকাটা নিয়ে কী করবে তুমি? কালই দশ হাজার টাকা কেন দরকার পড়ল? রেসটেস খেলছ নাকি?

আরও খারাপ কথা মুখে এসে গেলেও সায়ন্তন সামলে নিল। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হরষিত বলল, কারও কাছে কখনও ঋণ করিনি। আজ প্রথম চাইলাম।

কেন?

দরকার আছে।

কী দরকার?

সান্তানের চোখে চোখ রেখে হরষিত বলল, দরকারটা শুনলে তুই কি টাকার ব্যবস্থা করতে পারবি?

ঈষৎ থতমত খেয়ে সায়ন্তন বলল, আমি কী ভাবে ব্যবস্থা করব?

তবে শুনে তোর কাজ নেই।

সায়ন্তন মুখে কিছু বলতে না পেরে রাগে ফুঁসছে। দু চারটে কড়া কথা বাবাকে শোনাবার জন্যে সনাতনী তৈরি হচ্ছিল। সায়ন্তন কোণঠাসা দেখে সে চেপে গেল। সায়ন্তনকে হরষিত বলল, তোর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দশ হাজার পুরো না থাকলে বাকিটা আমার সনাতনী মা দিয়ে দেবে, আমি জানি।

তার মুখের কথা শেষ হবার আগে সনাতনী বলল, জমানো টাকায় গত মাসে কানের দুল কেনার পরে আমার অ্যাকাউন্টে এখন পঁচাত্তর টাকা আছে।

সায়ন্তন বলল, আমার অবস্থা আরও খারাপ। মোটর বাইকের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে বাকি টাকা অফিস থেকে ধার চেয়েছি।

ছেলেমেয়ের কথা শুনে হরষিতের মনে হল, শরতের নির্মেঘ, ঝকঝকে নীল আকাশে সামান্য ময়লা লেগে গেল। খাটের ওপর কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থাকার পরে হরষিত শুয়ে পড়ল। তার পেটের মধ্যে হাসি গুড়গুড় করলেও চোখে কেন জল আসছে, সে বুঝতে পারল না। শয্যাশায়ী হরষিতকে না ঘাঁটিয়ে সায়ন্তন, সনাতনী পাশের ঘরে চলে গেল। স্বামীর দিকে তাকাল সুরভি। কান্নায় থমথম করছে তার মুখ। কান্না লুকোতে সে-ও পাশের ঘরে চলে গেল।

হরষিতকে নিয়ে সে ঘরে তখন সায়ন্তন, সনাতনী চাপা গলায় আলোচনা শুরু করেছে। দশ হাজার টাকার জন্যে হরষিতের এই হ্যাংলামির কারণ খুঁজতে গিয়ে অফিসের তহবিল ভাঙা, জুয়ো খেলা, গোপনে নতুন সংসার পাতা, সবরকম সম্ভাবনা, তাদের মাথায় উদয় হচ্ছে। কোনওটা অমূলক নয়। এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কান্না চেপে সুরভি শুধু বলল, তোদের বাবা এত খারাপ মানুষ নন। দশ হাজার টাকার জন্যে হঠাৎ ঠেকে গেছেন।

আঁচলে মুখ চেপে সুরভি রান্নাঘরে চলে গেল। হরষিতকে অফিসের ভাত দিতে হবে। গল্প করার সময় তার নেই। ঠিক সময়ে সুরভি রান্না শেষ করলেও হরষিত সেদিন অফিসে গেল না। সারাদিন শুয়ে বসে কাটাল। দুপুরে স্নান খাওয়ার পরে এমন অঘোরে ঘুমোলো যেন বন্ধুদের হৃদয়হীনতা তার মনে বিন্দুমাত্র দাগ কাটেনি। তবে মাঝে মাঝে তার দুচোখে ঠিকরে ওঠা কাচপোকার দীপ্তি, সুরভির নজর এড়াল না।

রাতের খাওয়া সেরে দশটার মধ্যে হরষিত শুয়ে পড়ল। ঘুম আসছে না। আলো নিভিয়ে সুরভি না শোয়া পর্যন্ত সে উসখুস করবে। এই তার স্বভাব। হেঁসেল তুলে সুরভি যখন ঘরে ঢুকল, রাত এগারোটা। নিস্তব্ধ ফ্ল্যাট। সায়ন্তন, সনাতনী, যে যার ঘরে ঘুমোচ্ছ। ঘরে ঢুকে সুরভি বিছানায় এল না। চাবির গোছা নিয়ে আলমারির সামনে দাঁড়াল। এত রাতে আলমারিতে তার কী দরকার পড়ল, হরষিত বুঝতে পারল না। মশারির ভেতরে শুয়ে সুরভির দিকে তাকিয়ে থাকল। আলমারি খুলল সুরভি। চাবির লকার থেকে গয়নার বাক্স বার করে খাটের পাশে এসে জিজ্ঞেস করল, ঘুমোলে নাকি?

না।

হরষিতের গলা পেয়ে মশারি তুলে গয়নার বাক্স বিছানায় রেখে সুরভি বলল, এটা নাও। গয়না যা আছে, বিক্রি করলে দশ হাজার টাকা হয়ে যাবে।

দরকার নেই।

রাখো।

কথা না বাড়িয়ে হরষিত বাক্সটা নিল। যত্ন করে বাক্স রাখল বালিশের পাশে। সুরভিকে বলল, এবার ঘুমোও।

আলমারি বন্ধ করে আলো নিভিয়ে সুরভি শুয়ে পড়ল।

সকাল ছ’টায় সুরভিকে ঘুম থেকে তুলে হরষিত বলল, বেরোচ্ছি।

কোথায়?

বাসস্ট্যান্ডে।

খালি হাতে হরষিতকে যেতে দেখে সুরভি বলল, গয়নার বাক্সটা নিয়ে যাও।

এখন নয়। দশটার আগে সোনার দোকান খোলে না।

উদ্বিগ্ন সুরভিকে আশ্বস্ত করতে হরষিত বলল, আধঘণ্টার মধ্যে ফিরব।

কথা রাখল হরষিত। আধঘণ্টা পূর্ণ হবার আগে চার পাঁচটা বাংলা, ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র নিয়ে ফিরে এল। সুরভি দেখল গত সকালের মতো বাড়তি রক্ত চলাচলে লাল হয়ে উঠেছে হরষিতের পুষ্ট, গোল মুখ। ঘাম জমছে টাকে। দু’ চোখের তারায় নেচে বেড়াচ্ছে কাচপোকার মতো আলো। সংবাদপত্রগুলো বিছানায় রেখে হরষিত বলল, কাল সকালে নিখিল নয়, আমাকে ফোন করেছিল মুরারি শীল। লটারির টিকিট বেচে মুরারি। গতমাসে হিমাচল প্রদেশ বাম্পার লটারির একটা দশ টাকার টিকিট আমাকে গছিয়েছিল। কাল সকালে ফোন করে মুরারি বলল, আমার সেই টিকিটে প্রথম পুরস্কার, সাত লাখ টাকা উঠেছে। খবর শুনে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। মুরারির কথা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মুরারিও খবরটা সংবাদপত্রে ছাপা না হওয়া পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে চেপে রাখতে বলেছিল। তার নির্দেশ মেনে নিয়েছিলাম। চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়েছে। সংবাদপত্রে আজ খবরটা বেরিয়েছে। এই দ্যাখো।

পাঁচটা সংবাদপত্র পরপর খুলে লটারি জেতার খবর সুরভিকে দেখাল হরষিত। সাত লক্ষ টাকা, ঠিক কত টাকা, ধারণা না থাকলেও সুরভির চোখ ছলছল করছে। হরষিতের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে সে জিজ্ঞেস করল, সাত লক্ষ টাকা জেতার খবর পেয়েও বন্ধুদের কাছ থেকে কেন ধার চাইতে গেলে?

মুচকি হেসে হরষিত বলল, বন্ধুদের ধার চাওয়া ঠেকাতে আর কোনও পথ ছিল না। যারা চাইলে ধার না দিয়ে পারতাম না, তাদেরই ফোন করেছিলাম। সেই সাত বন্ধু নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাকে।

এক মুহুর্ত থেমে হরষিত বলল, শুধু বন্ধুরা কেন, সায়ন্তন, সনাতনীও সমান উপকার করেছে।

আর আমি?

সুরভির প্রশ্নে তার কাঁধে হাত রেখে হরষিত বলল, তুমি আমার দারুণ উপকার করেছ। বাঁচিয়ে দিয়েছ আমাকে। লটারির পুরো টাকা তোমার নামে জমা করে দেব।

স্বামীর বুকে মাথা রেখে সুরভি বলল, কেন?

তোমাকে শাস্তি দিতে। এত টাকা নিয়ে হার্টফেল করে মরব নাকি?

কথা বলতে গিয়ে হরষিতের মুখে হাসি, চোখে জল এসে গেল। স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে সুরভি বলল, ইস, কে মরতে দিচ্ছে তোমাকে?

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *