৬
কোনো কোনো পণ্ডিতবর্গের বিশ্বাস বা ধারণা, রামায়ণ আর মহাভারত রচিত হয়েছিল, সংহিতা যুগ ও পৌরাণিক যুগের সন্ধি- স্থলে। এই ধারণাটি খুবই বিভ্রান্তিকর। এই ১৯৮৫ খ্রীস্টাব্দে, কলি যুগ চলছে পাঁচ হাজার ছিয়াশি বৎসর। কলির নামানুসারেই কল্যদ সৃষ্টি হয়েছিল। এই কল্যব্দ শুরু হবার কিছু আগে বা সেই বৎসরই কিংবা তার সামান্য কিছু কাল পরে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধের আগে, আরও দুটি পৌরাণিক কাল গত হয়েছিল। সত্য ও ত্রেতা। অতঃপর, সংহিতায়ু ও পৌরাণিক যুগের সন্ধিস্থলে রামায়ণ-মহাভারত রচিত হয়েছিল, এ-যুক্তি টে’কে না।
সত্যযুগই যদি পৌরাণিক কালের আদি হয়, তা হলে, সংহিতাযুগ ও সত্যযুগের সন্ধিস্থলে কী করেই বা রামায়ণ-মহাভারত রচিত হতে পারে! মহাভারতের আদি পর্বে, প্রথম অধ্যায়, ৫৮ শ্লোকের বক্তব্য হলো, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, বিছুর জন্মে, বৃদ্ধ হয়ে স্বর্গবাস করলে, মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেছিলেন। ইতিহাসের এক পর্বে দেখছি, স্পষ্টই উল্লেখ করা হয়েছে, পরীক্ষিতের মৃত্যুর পরে, জনমেজয়ের সর্পসত্রের পর্বে, প্রকৃত মহাভারত রচিত হয়েছিল! জনমেজয়ের নিকট প্রকৃত মহাভারত বলার পরে, অন্য কোনো ঋষি অথবা স্বয়ং বেদব্যাসই সমগ্র উপাখ্যানটি সুসংলগ্ন করবার জন্য, প্রস্তাবনা ভাগ রচনা করে, প্রকৃত মহাভারতের সঙ্গে যোগ করে দিয়েছিলেন। তারপরে আরও পরিষ্কার করে, ঐতিহাসিক
আমার সামনে তুলে ধরছেন, ৬১ কল্যব্দে বেদব্যাস মহাভারত রচনা আরম্ভ করেন, এবং তিন বছরে তা শেষ করেন।
কোনো সন্দেহ নেই, বেদব্যাস দীর্ঘকাল বেঁচেছিলেন কিন্তু ইতিহাস আমাকে ক্রমেই নানা বিভ্রান্তির দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। দেখছি, বেদব্যাসও একজন ছিলেন না। বেদকে অনেকেই নানা ভাবে ভাগ করেছিলেন। এবং তাঁরা সকলেই বেদব্যাস নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
যদি তা মেনে নিই, তা হলেও, সেই বেদব্যাসরা তো কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসদেব ছিলেন না। মহাভারত রচয়িতাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস বলা হয়েছে, এবং তিনি যে সত্যবতীর গর্ভে, পরাশরের ঔরসজাত কানীনপুত্র, তারও উল্লেখ আছে। অতএব অন্যান্য বেদব্যাসকে মহাভারতের রচয়িতা বলে মেনে নিতে আমার স্বভাবতঃই অসুবিধা হচ্ছে।
বেদব্যাসের জন্ম দ্বাপর যুগে হয়েছিল, এটিই সর্ববাদী-সম্মত হওয়া উচিত। ইনি পরাশরের পুত্র। অর্থাৎ সত্যবতীর কানীনপুত্র। এঁর থেকে ভীষ্ম বয়সে কতো ছোট ছিলেন, যথার্থ হিসাব পাওয়া যায় না। ভীষ্ম ছিলেন শান্তনুর ঔরসজাত গঙ্গার পুত্র। তারপর শান্তনু সত্যবতীকে দেখে মুগ্ধ হন, এবং তাঁকে বিয়ে করতে চান। সত্যবতী একটি শর্তে বিয়ে করেছিলেন। ভীষ্ম বা তাঁর পুত্র বা তাঁর বংশধর কেউ শান্তনুর সিংহাসনের দাবীদার হবেন না।
ভীষ্ম যখন দেখেছিলেন, পিতা শান্তনু সত্যবতীকে বিবাহার্থে অতি মাত্রায় আকাঙ্ক্ষা করছেন, তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বিবাহও করবেন না। সত্যবতীর পুত্র বিচিত্রবীর্যের বিধবা দুই পত্নীর গর্ভে, সন্তান উৎপাদনের জন্য ভীষ্মকে অনুরোধ করেছিলেন। ভীষ্ম তাঁর প্রতিজ্ঞামতো, অসম্মত হন। তখন সত্যবতী তাঁর কন্যকাবস্থা- জাত পুত্র বেদব্যাসকে ডেকে, অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে
পুত্ৰ উৎপাদনের আদেশ করেন। সেই বেদব্যাসের ঔরসেই, বিধবাদের গর্ভে, সত্যবতী ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করান। পুত্রদ্বয় ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু।
ইতিহাসের এ-প্রসঙ্গ অনেকেরই জানা। কিন্তু বেদব্যাস কানীনপুত্র হওয়া সত্ত্বেও ভীষ্ম তাঁকে উদ্দেশ্য করে কৃতাঞ্জলিপুট হয়ে শ্ৰদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। এটি দ্বাপরযুগের ঘটনা কোনো সন্দেহ নেই। আর এই যুগেই দেখতে পাচ্ছি, ভীষ্ম ও বেদব্যাস দুই ভাই হওয়া সত্ত্বেও, এঁদের পিতা ও মাত। আলাদা। এরকম একটা সম্পর্ক সেই যুগেই সম্ভব দেখছি। সম্পর্কে দুই ভাই, অথচ দুজনের পিতা- মাতা ভিন্ন। পরাশর মুনির ঔরসে, কন্যা সত্যবতীর গর্ভে বেদব্যাসের জন্ম। শান্তনুর ঔরসে, গঙ্গার গর্ভে ভীষ্মের জন্ম। পরে যেহেতু শান্তনু সত্যবতীকে বিয়ে করলেন, তখন স্বভাবতই ভীষ্ম ও বেদব্যাস পরস্পর ভাই হলেন।
আপাততঃ যে-উদ্দেশ্যে আমি বেদব্যাসের প্রতি ভীষ্মের শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা বললাম, সেটার কারণ দেখি। বেদব্যাসে জন্ম- রহস্যের কথা, ভীষ্ম সত্যবতীর কাছ থেকেই শুনেছিলেন, শুনেও তিনি সেই কানীনপুত্রকে কৃতাঞ্জলিপুটে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। এতে প্রমাণ হয়, ভীষ্ম কানীনপুত্রের প্রতি কোনোরকম ঘৃণার ভাব প্রকাশ করেন নি। অথচ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় দেখছি, এই ভীষ্মই শরশয্যা থেকে কর্ণের প্রতি অত্যন্ত অবজ্ঞাসূচক উক্তি করছেন, ‘ধৰ্মলোপে জন্ম’।
ব্যাসদেবকে প্রথম দর্শনের সময়, ভীষ্ম যৌবনের প্রান্তে এসে পৌঁছে- ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র ওপাণ্ডু বড়হয়েছিলেন। তাঁদের পুত্রগণ, কুরুপাণ্ডবে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় পঞ্চপাণ্ডবে এবং কৃষ্ণের বয়সের কথা আমি আগেই বলেছি। তাহলে এখন এই সিদ্ধান্তেই ইতিহাসের অনিবার্য গতি দেখছি, ব্যাসদেব ও ভীষ্মের সাক্ষাতের, অন্ততঃ সামান্য কম বেশি, প্রায় একশো বছর পরে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধের সময় ভীষ্ম শরশয্যা শুয়ে, কানীনপুত্র কর্ণের প্রতি অবজ্ঞাসূচক উক্তি করে বলেছিলেন ‘ধৰ্মলোপে জন্ম।’ অথচ একশো বছর আগে, বেদব্যাস যে কানীন পুত্র, তা জেনেও, তাঁকে শ্রদ্ধা দেখিয়েছিলেন। আর কর্ণের সম্পর্কে ঐরকম উক্তি। তবে কি, একশো বছরের মধ্যেই, কানীনপুত্র সম্পর্কে সমাজে নতুন চিন্তার উদ্ভব হয়েছিল?
সমাজ পরিবর্তনের ঘটনাটি যদি সেই সময়ের মধ্যে ঘটে থাকে, তবে সংহিতা ও পৌরাণিক কালের সন্ধিস্থলের প্রসঙ্গ আসবে কেন? দ্বাপরেরও আগে,সত্য ও ত্রেতা অতিক্রম করেছিল। আর, বস্তুতপক্ষে যা দেখছি, মহাভারতের রচনাকাল তো কলিযুগে। তখন দ্বাপর অতিক্রান্ত। যে-পণ্ডিত রামায়ণ ও মহাভারতের রচনাকাল, সংহিতা যুগ ও পৌরাণিক যুগের সন্ধিস্থল কল্পনা করেছেন, তিনি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। কারণ, তিনি আবার কিছু ঘটনার উল্লেখ করে, রামায়ণের রচনাকাল স্থির করেন, মহাভারতের ষাট বছর আগে। পরে আবার দাশরথি রামের ( রাজা দশরথের পুত্র রাম। ইনি ব্যতিরেকেও আরওরাম ছিলেন) বংশ তালিকা বিচার করে, আর একটি মতামত প্রকাশ করছেন। সেই বিচারে দেখা যাচ্ছে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কম করে পাঁচশো বছর আগে, লঙ্ক। যুদ্ধে রাবণ নিহত হয়েছিলেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পাঁচশো বছর আগে, লঙ্কা যুদ্ধে রাবণ নিহত হয়ে- ছিলেন, এই হিসাবে আসতে, এক ইতিহাসবেত্তাকে, রামের বংশ তালিকা বিচারের দ্বারা, রামের তেত্রিশ পুরুষ পরে, তাঁর বংশের বিশ্রুতবানের পুত্র বৃহদ্বলকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অভিমন্যু বধ করে- ছিলেন। (মহাভারতের দ্রোণ পর্ব, ৪৭ অধ্যায় থেকে এই হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। )
আবার অন্য এক সূত্রে, অবগত হচ্ছি, গৌতম পুত্ৰ শতানন্দ জনক রাজার কুলপুরোহিত ছিলেন। তিনি রামের সঙ্গে সীতার বিয়েতে পৌরোহিত্য করেন। শতানন্দের পৌত্র ও পৌত্রী, যমজ কৃপ ও রুপী ছেলেবেলা থেকেই, রাজা শান্তনুর কাছে মানুষ হন। পরে পাণ্ডব – গণের কুরু ও পাণ্ডব কুমারদের আচার্য দ্রোণের সঙ্গে কূপীর বিয়ে হয়।
লঙ্কার রাজা রাবণের মহিষী মন্দোদরী ময়দানবের কন্যা। এই ময়- দানবই যুধিষ্ঠিরের জন্য ত্রিভুবন বিখ্যাত মণিময়ী সভাস্থল নিৰ্মাণ করে দিয়েছিলেন।
ধর্মাত্মা ভীষ্মের সঙ্গে, অদ্ভুত দর্শন ঋষিসত্তম পুলস্ত্যের দেখা হয়। এই পুলস্ত্য ছিলেন রাবণের পিতা। ভীষ্মের অনুরোধে, এই পুলস্ত্য তীর্থ সমুদয়ের বিবরণ সবিস্তারে বর্ণনা করে শোনান।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞানুষ্ঠানে, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, যথা- ক্রমে পূর্ব, উত্তর, পশ্চিম, দক্ষিণে দিগ্বিজয়ে গমন করেন। মহীস্মতী নগরে সহদেবের সঙ্গে রামানুচর নীলরাজের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়। তারপর সহদেব সমুদ্রের ধারে উপস্থিত হয়ে পুলস্ত্য পুত্র বিভীষণের নিকট প্রীতিপূর্বক দূতাদি প্রেরণ করেন। তার প্রতিদানে বিভীষণও প্রীতিপূর্বক সহদেবকে বহু মূল্যবান বস্ত্ৰ মণি সকল প্রেরণ করে, তাঁর শাসন গ্রহণ করেন।
ওপরে বর্ণিত ঘটনাসমূহ থেকেই, পণ্ডিতমহাশয়, প্রথমে এরকম একটি ধারণায় পৌঁছেছিলেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কমপক্ষে ষাট বছর আগে বা তার কাছাকাছি কোনো সময়ে রামায়ণ রচিত হয়েছিল। রামায়ণ রচনা ও লঙ্কা যুদ্ধে রাবণের বিনাশ, এক কথা না। বাল্মীকির আশ্রমে যদিও সীতা তাঁর দুই পুত্র লব ও কুশকে জন্ম দিয়েছিলেন, ঠিক তার কতোকাল পরে রামায়ণ লিখিত হয়েছিল, সে বিষয়ে নানা প্রশ্ন থেকেই যায়। লব-কুশ রামের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া আটকেছিল। পরে বাল্মীকি লব-কুশকে নিয়ে রামের সভায় যান। সেখানে রামায়ণ কাহিনী গান গেয়ে শোনানো হয়েছিল, এমনটি মনে হয় না। তবে, সীতার সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই, বাল্মীকির কবিসত্তা যে প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাল্মীকি ছিলেন কবি, প্রেমিক।
যাইহোক, গৌতমপুত্র শতানন্দ জনকরাজার কুলপুরোহিত ছিলেন। কোন্ গৌতম? পুরাণের ইতিবৃত্তে একাধিক গৌতমকে পাওয়া যায়। সংহিতা যুগের দীর্ঘতমাকেও পরে গৌতম নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু মুশকিল লাগে, যখন দেখি, শতানন্দর পৌত্র ও পৌত্রী কৃপ ও কৃপী রাজা শান্তনুর রাজগৃহে ছেলেবেলা থেকে বড় হয়েছেন, তখন বুঝতে পারি, এর মধ্যে একটি ইতিবৃত্তীয় সংকেত রয়েছে। অথবা, এই শতানন্দ আরও পূর্বের অন্য কোনো গৌতমের পুত্র। যিনি দ্বাপর যুগে বর্তমান ছিলেন?
আবার রাবণের পিতা অদ্ভুতদর্শন মুনিসত্তম পুলস্ত্যর কাছে ভীষ্ম বিভিন্ন তীর্থের বর্ণনা শুনছেন, এটিও মনকে সংশয়াচ্ছন্ন করে তোলে। কারণ ভীষ্ম যে একজনই ছিলেন, এ বিষয়ে কোথাও কোনে। সংশয়- সন্দেহের অবকাশ নেই তা হলে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় থেকে রামায়ণের রচনাকাল, অথবা লঙ্কারাজ রাবণের নিধন ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান কতোটা ছিল, এ বিভ্রান্তি থেকেই যায়।
মন্দোদরীর পিতা ময়দানব যুধিষ্ঠিরের মণিময়ী সভাস্থল নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, এরূপ বলা হয়েছে। কিন্তু ময়দানব যে একজনই ছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ময়দানব একজন মাত্র ব্যক্তি ছিলেন না। এটি বংশপরম্পরা, অথবা গুরুশিষ্য পরম্পরা। অতএব মন্দোদরীর পিতা ময়দানবই যে যুধিষ্ঠিরের সেই অভূতপূর্ব সভাস্থল তৈরি করেছিলেন, এটি নিঃসংশয়ে বলা যায় না। আপাততঃ সময় ও কাল সম্পর্কে আমি আর বিচরণ ক্ষেত্রকে দীর্ঘ- ভর করতে চাই না! এখন আমি ইতিহাসের পথ ধরে একটি বিশ্বাসে উপস্থিত হচ্ছি। সংহিতা যুগ বলে নিশ্চয়ই একটি যুগ ছিল। আমি পূর্বেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ওপিতৃতান্ত্রিক সমাজেরপতনও উত্থানের কথা বলেছি, সেটি ইতিহাসসম্মত বিষয়। মাতৃতান্ত্রিক সমাজেই, নারীরা যদৃচ্ছাগামিনী ছিলেন। যেমন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে আমরা বর্তমানেও দেখতে পাই, পুরুষ যদৃচ্ছাগামী। এর সঙ্গে অর্থ ও সম্পদের বিষয়টি ছিল।