৫
কৃষ্ণের জন্ম তাহলে দ্বাপরেই। কিন্তু পাপপ্রবর্তক কলি, কৃষ্ণ বর্তমান থাকতে প্রবেশ করতে পারে না, এমন কথা আমি শুনেছি। অথচ হিসাবে মিলছে না। মৌষল পর্বে দেখছি, যুধিষ্ঠির যুদ্ধজয়ের পর ছত্রিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। কৃষ্ণ সেই বছরেই মহাপ্রয়াণ করেন। তাহলে কলিকে আটকানো গেল কোথায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষদিন থেকে, পঁয়তাল্লিশ দিনে, মাঘী পূর্ণিমায় কলি প্রবেশ করেছিল। তার ছত্রিশ বছর পরে যদি কৃষ্ণ গত হন, তখন কলির প্রবেশ ঘটে গেছে।
এখানে তৎকালীন অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বক্তব্য হলো, এ কথা ঠিক যে, কৃষ্ণ বেঁচে থাকতেই কলি দ্বাপরকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কৃষ্ণ বিদ্যমান থাকায়, কলি তার নিজের প্রভাব আদৌ বিস্তার করতে পারে নি। এই কারণেই শ্রীমদ ভাগবত প্রভৃতি, কলির প্রভাব ব্যক্ত করাকেই কলির প্রবেশ বলেছেন। কিন্তু ইতিহাসের সভ্যতায়, কৃষ্ণ যে কলিযুগেই গত হয়েছিলেন, সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে।
এই পরিক্রমার কারণ দুটি। এক পৃথার জন্ম সময়ে যাওয়া। এবং পৃথার জীবনে যে-সব ঘটনা ঘটেছে, তার সামাজিক মূল্যায়ন। সামাজিক মূল্যায়ন ব্যতীত, পৃথা, তথা কুন্তীর জীবনের সমস্ত ঘটনাকে যুক্তি দিয়ে বোঝা সম্ভব না। পুরাণ ও পুরাণের নায়ক- নায়িকাদের যখন আমি ইতিবৃত্ত, ঐতিহাসিক চরিত্র বলেই বিশ্বাস করেছি, অতএব সে সময়ের ঘটনাকে ও নায়ক-নায়িকাদের আমি কোনো রকম অযৌক্তিক, অলৌকিক ভাবে উপস্থিত করতে পারি নি।
রামায়ণে সীতার দেহ-শুচিতা নিয়ে যে-সব প্রশ্ন উঠেছিল, যে কারণে সীতাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, গর্ভবতী অবস্থায় বনবাসে যেতে হয়েছিল তারপরেও পাতাল প্রবেশ করে তাঁকে সতীত্বের প্রমাণ দিতে হয়েছিল। স্বভাবতঃই মনে হয়, সংহিতার যুগের অনেক পরে এ ঘটনা ঘটেছিল। কারণ সংহিতা যুগে নরনারীর অবাধ যৌন মিলনকে, নিত্য, অর্থাৎ চিরকালীন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এবং তার মধ্যে কোনো দোষ ছিল না। কেবল একটি বিষয়ে নির্দিষ্ট ছিল, মিলিত নরনারীদের হতে হবে স্বজাতি। যে কারণে গো- জাতির সঙ্গে তুলনা দিয়ে বলা হয়েছে, গো-গণ যেমন নিজেদের মধ্যে যদৃচ্ছা মৈথুনাদি ক্রিয়ায় লিপ্ত হতে পারে, মানুষও তাদের স্বজাতি- দের মধ্যে সেই রকমই লিপ্ত হতে পারে।
তা হলে কি, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর আর কলি, এই চার পৌরাণিক কালই সংহিতা যুগের পরবর্তীকাল? ইতিহাসের ধুলাচ্ছন্ন পাতায়, তার কোনো হদিস পাচ্ছি না। অথচ সংহিতা যুগে নরনারীর দৈহিক সম্পর্ক যা প্রচলিত ছিল, দ্বাপরেও তার কিছু অবশিষ্ট আছে দেখছি। যদিও সংহিতা যুগেই নরনারীর অবাধ মিলনের বিরুদ্ধে শ্বেতকেতু এবং দীর্ঘতম নতুন নীতির প্রচলন করে গিয়েছিলেন। তা হলে, সত্য আর ত্রেতায় কী এই প্রথা প্রচলিত ছিল? যদি ধরে নিতেই হয়, সত্য আর ত্রেতা, সংহিত। যুগের পর পৌরাণিক কাল। পণ্ডিতবর্গও সেই হিসাবই দিয়েছেন, সংহিতা যুগের পর পৌরাণিক কালের শুরু।
সীতাকে তো চিরকাল ধরে সত্য যুগের মানবীই বলা হয়েছে। সত্যযুগ ছাড়া অমন সতীর আবির্ভাব ছিল অসম্ভব। আবার যে পঞ্চ কন্যার এক কন্যার সময়েই আমার যাত্রা, সেই পৃথারও আগে নিশ্চয়ই গৌতম পত্নী অহল্যার ঘটনা ঘটেছিল। অহল্যার ঘটনা ঘটেছিল রামায়ণের যুগে। পঞ্চকন্যার আর একজন হলেন মন্দোদরী।
তিনিও রামায়ণ যুগেরই মহিলা।
পৌরাণিক কালকে এই ভারতের মানুষ নামক জাতির, কাল বিভাগকেই বলা যায়। স্বর্গবাসী দেবতা জাতির সেরকম কোনো ইতিবৃত্ত আমরা পাই না। মানুষের ইতিবৃত্তের ঘটনা বিশেষে, দেবতাদের এই ভারত-ভূমিতে আগমন ঘটেছে। বা মানুষকে কোনো কারণে স্বর্গে যেতে হয়েছে কোনো কাজে। তখন স্বর্গ ও দেবতার সম্পর্কে আমরা কিছু সংবাদ পাই। যেমন অর্জুন স্বর্গে গিয়ে পাঁচ বছর ইন্দ্রের কাছে অস্ত্র বিদ্যা শিক্ষালাভ করেছিলেন।
কিন্তু কোন্ ইন্দ্র, তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। কারণ ইতিহাসের পাতায় স্পষ্টতঃই দেখতে পাচ্ছি, স্বৰ্গ নামক স্থানে যিনি রাজা বা প্রধান ছিলেন, তাঁকেই ইন্দ্ৰ বলা হতো। অর্থাৎরাজা। স্বর্গের পালক এবং শাসকদের মধ্যে, যুগে যুগে একাধিক ইন্দ্র ছিলেন। যেমন আমরা আগেই দেখে এসেছি, স্বর্গের আরও বিভিন্ন রাজ্যের অধি- পতিদের, ইন্দ্রের মতোই, সূর্য, চন্দ্ৰ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো। বলা বাহুল্য সে-সব সূর্য ইত্যাদিও বংশগত বা যিনি রাজ্যের অধিপতি হতেন, তাঁকেই বলা হতো। দেবতা জাতিও মানুষই ছিলেন।
যাই হোক, পঞ্চ কন্যার মধ্যে চারজনই ছিলেন এই ভারতের রমণী। একমাত্র বৃহস্পতি পত্নী তারাকেই মনে হচ্ছে স্বর্গবাসিনী। অনেকে তারাকে রামায়ণের বালীর পত্নী মনে করেন। বস্তুতপক্ষে তা নয়। ইনি সুর গুরু বৃহস্পতির অতি সুন্দরী পত্নী তারা। সুর মানেই দেবতা। অর্থাৎ স্বর্গবাসী। চন্দ্র তিনি, যে চন্দ্রই হোন, স্বর্গেরই কোনো রাজ্যের কোনো এক অধিপতি, যাঁদের রাজপদবীই ছিল চন্দ্র, এমনই একজন তারাকে বলাৎকার করেছিলেন। এই চন্দ্ৰ যে একজন মানুষ রাজা ছিলেন, তা তারার অভিশাপের কথাতেই জানা যায়, “ওরে মূর্খ! তুই রাজসূয় যজ্ঞ করিয়া আপনাকে বলবান বিবেচনা করিতেছিস” ইত্যাদি।
চন্দ্র অবশ্য কোনো কথাই শোনবার পাত্র ছিলেন না। নিজের সুন্দর রথে যেতে যেতে সুন্দরী তারাকে দেখে রথে তুলে বল- পূর্বক রমণ করতে লাগলেন। দেবগুরু বৃহস্পতি বার বার স্ত্রীকে প্রার্থনা করলেনও, মদমোহিত চন্দ্র কিছুতেই তারাকে পরিত্যাগ করলেন না। ফলে তারার উপলক্ষ্যে দেবতা আর অসুরদের মধ্যে লেগে গিয়েছিল প্রচণ্ড বিবাদ। বৃহস্পতির ওপর অস্থরদের গুরু শুক্রাচার্য কোনো কালেই খুশি ছিলেন না। ফলে তিনি চন্দ্রের পক্ষ নিয়েছিলেন।
যাই হোক, তারার ঘটনা আমার বিষয় না। গর্ভিণী তারা সুন্দর একটি পুত্র জন্ম দিয়ে, সত্য কথা প্রকাশ করেছিলেন, চন্দ্রের ঔরষেই তিনি গর্ভধারণ করেছিলেন। একটি পুত্রের জন্ম রহস্য যে তিনি সকল মূল্যবোধের ওপর স্থান দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন, সেই কারণেই তৎকালে তাঁকে সকলে ধন্য ধন্য করেছিলেন।
‘তারা’র ঘটনা স্বর্গের এটাই প্রমাণ হলো। এবং সময়ের কোনো নির্দেশ না থাকলেও স্বর্গেও যে নারীর দেহ-শুচিতার বিষয়টি ছিল তারার ঘটনায় তা জানা যায়। ভারতের প্রাতঃস্মরণীয় কন্যাদের সঙ্গে, স্বর্গবাসী দেবগুরু বৃহস্পতির পত্নী তারার নাম যে কেন যুক্ত করা হয়েছিল, তা বোধগম্য হচ্ছে না।
তারা-র যুগ নিরূপণ সম্ভব হলো না। মন্দোদরী ও অহল্যা রামায়ণের যুগের নারী। কুন্তী ও দ্রৌপদী মহাভারতের যুগের। আমার যাত্রা কুন্তীর জন্মলগ্নে অর্থাৎপৃথার। পৃথার জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটেছে সেই সব ঘটনার সঙ্গে যুগ ও কালের মহিমা একান্ত ভাবে যুক্ত। সেই সঙ্গে সকলপ্রকার অলৌকিক অবাস্তবকে প্রক্ষিপ্ত আবর্জনার ম্যায় ত্যাগ করা বিধেয় বলে মনে করি।