৪
পুরাণের ইতিবৃত্তে এসে দেখছি, দৈহিক শুচিতাই যেন ক্রমে চরিত্রের সংজ্ঞা হয়ে দাড়াচ্ছে। অতি ক্রুর স্বভাবাপন্ন নরনারী কোনোক্রমে দৈহিক শুচিতা রক্ষা করতে পারলেই, তারা চরিত্রবান আর চরিত্র- বতী হচ্ছে।
সংহিতা যুগে, এ পরিবর্তনের গৌরব বহন করছেন, উদ্দালক ঋষি- পুত্র শ্বেতকেতু। সেই পরিবর্তনকে পরিশোধিত করেছিলেন দেবগুরু বৃহস্পতির ভাইপো, উতথ্যের পুত্র দীর্ঘতমা।
সংহিতা যুগে উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন। তাঁর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। তবে ইনি উদ্দালকের ঔরসে বা ক্ষেত্রে জন্মাননি। জন্মেছিলেন পিতার এক শিষ্যের ঔরসে। একদিন তিনি পিতা- মাতার পাশে বসেছিলেন। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে, তাঁর মায়ের হাত ধরে তুলে নিয়ে বললেন, ‘চল আমরা যাই।’ পিতার সামনেই মাকে একজন তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে, শ্বেতকেতু দারুণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন। উদ্দালক পুত্রকে সেই অবস্থায় দেখে বললেন, ‘বৎস রাগ করো না। এটি হলো নিত্য ধর্ম। এ ভূমণ্ডল মধ্যে সমস্ত রমণীরাই অবারিতা। গো-গণ যে রকম ব্যবহার করে, প্রজাগণও স্ব স্ব বর্ণে সে রকম আচরণ করে থাকে।’
শ্বেতকেতু তা মানতে পারেন নি। তিনি সেই কাল থেকে নিয়ম করে দিয়েছিলেন, এখন থেকে যে রমণী ভর্তাকে অতিক্রম করে ব্যভিচারিণী হবে, তার ঘোর দুঃখদায়ক ভ্রূণহত্যা সদৃশ পাপ হবে আর যে-পুরুষ কৌমার ব্রহ্মচারিণী পতিব্রতা প্রণয়িনী ভার্যাকে পরস্ত্রী রূপে সম্ভোগ করবে, তারও সেই পাপ হবে। আরও বিধান দিয়েছিলেন, যে-পত্নী স্বামীর দ্বারা পুত্র লাভে দায়ভাগিনী হয়ে, স্বামীর অবাধ্য হবে, তারও সেই পাপই হবে।
শ্বেতকেতু সেই যুগে দেখছি, পক্ষাপাতশূন্য অনুশাসনই প্রতিষ্ঠ। করেছিলেন। যদিও পুরুষরা তাঁর বিধান মানতে। না। আর শ্বেত- কেতু নিজে যেহেতু ক্ষেত্রজ পুত্র ছিলেন, তারও কোনো পরিবর্তন করেন নি।
বেদবিৎ জ্ঞানী জন্মান্ধ দীর্ঘতমা বিদ্যাবলে প্রদ্বেষী নামে এক রূপসী তরুণী ব্রাহ্মণীকে পত্নীরূপে লাভ করেছিলেন। কয়েকটি সন্তানের জন্ম দেবার পরে, তিনি নিখিল গোধর্ম অধ্যয়ন করে, নিঃশঙ্ক চিত্তে প্রকাশ্যে মৈথুনাদি করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। আশ্রমবাসী মুনিগণ দীর্ঘতমাকে মর্যাদা অতিক্রম করতে দেখে, রাগ করে তাঁকে আশ্রম থেকে বের করে দিয়েছিলেন। দীর্ঘতমার পত্নী প্রদ্বেষীও স্বামীর প্রতি পুত্রলাভের জন্য মোটেই তুষ্ট ছিলেন না। একদিন দীর্ঘতমা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেন আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ কর?’
প্রদ্বেষী জবাব দিয়েছিলেন, ‘স্বামী তাঁর স্ত্রীর ভরণপোষণ ও প্রতিপালন করেন বলে তাঁকে ভর্ত। বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তুমি জন্মান্ধ। তার কিছুই করতে পারো না। বরং আমি তোমার ও তোমার সন্তানদের চিরকাল ভরণপোষণ করে অত্যন্ত ক্লান্ত পীড়িত হয়ে পড়েছি। আমি আর তোমার ও তোমার সন্তানদের আগের মতো ভরণপোষণ করতে পারবো না।’
দীর্ঘতমা প্রদ্বেষীর সেই সগর্ব উক্তি শুনে বলেছিলেন, ‘আমি আজ থেকে পৃথিবীতে এই নিয়ম প্রতিষ্ঠিত করলাম, স্ত্রী জাতিকে যাব- জ্জীবন কেবল মাত্র স্বামীর অধীন হয়ে থাকতে হবে। স্বামী বেঁচে থাকলে, বা মারা গেলেও, স্ত্রী পুরুষান্তর ভজনা করলে, তিনি অবশ্যই পতিত হবেন। আর পতিহীনা নারীদের প্রচুর সমৃদ্ধি থাকলেও, তা ভোগ করতে পারবে না। ভোগ করলে, অকীর্তি ও পরিবাদের সীমা থাকবে না।’
অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র-পত্নী গান্ধারী নিজের চোখ সান্দ্র বস্ত্র দ্বারা আবৃত রাখতেন, কারণ তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, স্বামীর প্রতি কখনও অশ্রদ্ধা বা অসূয়া প্রকাশ করবো না। কিন্তু প্ৰদ্বেষী চোখ আবৃত না করায়, তিনি স্বামীর প্রকাশ্য ব্যভিচার দর্শনে অস্থয়া প্ৰকাশ করেছিলেন।
গান্ধারী একবার মাত্র গর্ভধারণ করেছিলেন। আমি এবারের ইতিহাস পরিক্রমায়, গান্ধারীর গর্ভধারণ বিষয় দিয়ে কোনো দিগন্ত উন্মোচিত করবো না। তবে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সেবায় নিযুক্তা, এক বৈশ্যা দাসীর গর্ভে যুযুৎসু নামে একটি পুত্রোৎপাদন করেছিলেন। এবং করণ নামে তাঁর আরও একটি পুত্রের জন্ম হয়েছিল। সংহতি যুগ থেকে, পুরাণের যুগ শুরু হওয়ার স্তরে আমি পৌঁছেছি। কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারত রচনাকাল ঠিক কোন্ সময়ে হয়েছিল? একটা বিষয়ে সন্দেহ নেই, ইতিহাস নির্দেশ করছে, দ্বাপর ও কলিযুগের সন্ধিতে, একশো বছরের মধ্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল। এক্ষেত্রে রামায়ণ রচনার সময় সম্বন্ধে নানা রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পণ্ডিত- দের মধ্যে বর্তমান।
ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় একটি নির্দিষ্ট সূত্র সন্ধানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রামায়ণ ও মহাভারত, এ দুটিই কি ইতিহাস? অথবা রামায়ণ কাব্য মাত্র? আমি ইতিহাসের যে পথ পরিক্রমায় যাত্রা করেছি, দেখেছি, রামায়ণও ভারতের ইতিবৃত্তের মধ্যেই গণ্য হয়। এবং রামায়ণ-মহাভারত, একাধারে মহাকাব্য ও ভারতের ইতিবৃত্তও বটে।
রামায়ণ-মহাভারতের রচনাকালের সঙ্গে, সংহিতা যুগের ব্যবধান কতটা? ইতিহাসের পাতায়, ধুলাস্তর সরিয়ে আমি দ্বাপর ও পুরাণের কালের যে ঐতিহাসিক সময়ের সন্ধান পাচ্ছি, সংহিতা যুগের সন্ধান সেখানে পাচ্ছি না। দ্বাপর যুগকে সংহিতার সঙ্গে এক অর্থে ধরা যায় না। তবে মহাভারত যেমন পুরাণ এবং একই সঙ্গে পঞ্চম বেদ বলে অভিহিত হয়, আমার ইতিহাস পরিক্রমা, সেই মহাভারত রচনারও পূর্বে।
পণ্ডিতবর্গ কিছু ঘটনা ও নিয়ম-নীতি প্রচলনের শুরুর সময়কেই সংহিতাযুগ বলে বর্ণনা করেছেন। সে-বর্ণনা আমি আগেই দিয়ে এসেছি। আধুনিক চিন্তায় যদি এই রকম ব্যাখ্যা করা যায়. নর- নারীর প্রাকৃবিবাহ, এবং বিবাহের যুগের শুরুকেই সংহিতা যুগ বলা যায়, তা হলে দ্বাপরের সঙ্গে সংহিতা যুগের একটা সমসাময়ি- কতা নির্ধারিত করা যেতে পারে।
সংহিতার অভিধানগত অর্থ কী? সংগৃহীত রচনাসমূহ, সংকলন গ্রন্থ, বেদের মন্ত্রসমষ্টি, মন্ত্রাদিত স্মৃতিশাস্ত্র, পবিত্র ও অবশ্য পালনীয় নির্দেশসমূহ বা গ্রন্থ, সংস্কৃত ব্যাকরণের সন্ধি। ( সংসদ বাংলা অভিধান। ) এই একই অভিধানের, ‘যুগ’-এর অর্থ দেখছি, সত্য ত্রেতা দ্বাপর ও কলি, এই চার পৌরাণিক কাল। কিন্তু সংহিতা যুগ বলে নির্দিষ্ট কোনো যুগকে চিহ্নিত করা হয় নি। তবে সংহিতা বলতে ‘পবিত্র ও অবশ্যপালনীয় নির্দেশসমূহ বা গ্রন্থ’- এই কথার সঙ্গে সংহিতা যুগের একটা সম্পর্ক যেন পাওয়া যাচ্ছে। তা হলে, দ্বাপরের সঙ্গে সমসাময়িকতার নির্ধারণ আর করা যায় না। কারণ সত্য ত্রেতা দ্বাপর ও কলি, সংহিতা যুগেরও পরের কাল। সংহিতা আর পৌরাণিক কালকে পণ্ডিতরা আলাদা করে দেখিয়েছেন। সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি, পৌরাণিক কাল। এই পৌরাণিক কালের, দ্বাপরের একেবারে শেষ দিকেই আমার যাত্রা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেরও আগে। কারণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের এক-
পক্ষের নায়কগণ, পঞ্চপাণ্ডবের জন্মেরও আগের কালে আমাকে বিচরণ করতে হবে। আমাকে প্রথম যেতে হবে, যদুবংশের রাজা শুরের আমলে। ইনি পৃথার জনক। আর সেই পৃথা নাম্নী কন্যার উদ্দেশ্যেই আমি চলেছি।
.
যদুবংশের রাজা শূরের সময় যে দ্বাপর যুগ চলছিল, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পাচ্ছি না একটি হিসাব! এক একটি পৌরাণিক কালের আয়ু কত বৎসর? বলা হয়ে থাকে, এখনও এই গৃহে কলিযুগ চলছে। তা যদি হয়, তাহলে কলিযুগ কোন্ সময়ে শুরু হয়েছিল, সেই হিসাবটি পেলে, বর্তমানে কলিযুগের বয়স নিরূপণ করা সম্ভব।
ইতিহাসের পথপরিক্রমায় দেখছি, কলিযুগের ৩১৭৯ বৎসর যখন অতীত হয়েছিল তখন শকাব্দ আরম্ভ হয়েছিল। শকাব্দের হিসাবটা আমরা জানি। এখন এই ১৯৫৮ খৃষ্টাব্দে, শকাব্দ হলো ১৯০৭। তাহলে, কলি—অর্থাৎ কল্যব্দের ৩১৭৯-এর সঙ্গে ১৯০৭ যোগ করলে দাঁড়ায় ৫০৮৬ কল্যব্দ। তার অর্থ, পাঁচ হাজার ছিয়াশি বছর আগে কলিযুগের শুরু হয়েছিল। বর্তমান সময়কেও, কলিযুগই বলা হয়। কলির বয়সই এখন যদি পাঁচ হাজার ছিয়াশি বৎসর চলতে থাকে, তবে সত্য ত্রেতা দ্বাপর যুগের বয়স কত হয়েছিল? ইতিহাসের পাতার ধুলো সরিয়ে, সে-হিসাব আমি উদ্ধার করতে পারছি না। না পারলেও ক্ষতি নেই। আমি নিঃসন্দেহ হতে পারছি, আপাততঃ আমার যাত্রা দ্বাপরের অন্তিম সময়ে। দ্বাপর ও কলি- যুগের মধ্যবর্তী একশো বৎসরের অনধিক সময়ের মধ্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল। সংখ্যাহনাদেশে শতম্। অর্থাৎকোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা না থাকলে, শত সংখ্যা ধরতে হয়। সেই হিসাবে, দ্বাপরের শেষ পঞ্চাশ, কলির প্রথম শঞ্চাশ, এই একশো বছরকে দ্বাপর ও কলির অন্তরকাল বলে ধরা যেতে পারে। সেই কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের সময় থেকে, আজ পর্যন্ত ভারতে একটা কথা প্রচলিত আছে, দ্বাপরের শেষে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ হয়েছিল।
এ যুদ্ধের অনেক আগেই পৃথার জন্ম। যদুবংশের রাজা শূরের রাজ্য ছিল মথুরায়। কৃষ্ণ তখন কোথায়? কৃষ্ণের জন্ম নিয়েও, সেই আবার দ্বাপর কলির সন্ধিক্ষণের সময়ের কথাই আসছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়, কৃষ্ণের বয়স কত? বয়সের বিচারে কৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের থেকে এক বছরের ছোট। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়, যুধি ষ্ঠিরের বয়স ৭২, ভীমের ৭১, অর্জুনের ৭০। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় কৃষ্ণের বয়স ৬৯ ধরতে হয়। কিন্তু তিনি কলিযুগে জন্মেছিলেন? ইতিহাসের হিসাবে দেখছি, না। প্রথমতঃ কৃষ্ণকে সেই সময়ে বলা হচ্ছে কর্মপ্রবর্তক। ধর্মপ্রবর্তক বলতে, অনেকেই বিষয়টিকে একটি সীমাবদ্ধতার মধ্যে রেখে দিতে চান। যাঁরা চান, তাঁদের বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। ধর্মপ্রবর্তক বলতে বোঝায়, প্রকৃত নীতি ধর্মের প্রচারক। কৃষ্ণ সেই অর্থে, রাজনীতি, যুদ্ধনীতি, কূটনীতি, সমস্ত বিষয়েই ছিলেন অতি প্রতিভাধর, দূরদর্শী ব্যক্তি। তাঁর সময়ে তাঁর মতো যে-কোনো বিষয়ে, নীতি নির্ধারক আর কেউ ছিলেন না। যদুবংশকে রক্ষাথেকে, পাণ্ডবদের যথাযোগ্য পরিচয় ও উত্থানের নেতৃত্ব, জরাসন্ধ বধ, প্রাগজ্যোতিষপুর জয়, বহু বিষয়েই তিনি এমন সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনার জনক, সাধারণ মানুষ তাঁকে সাক্ষাৎ ভগবান রূপে পুজো করেছে। তাঁর থেকে যাঁরা বয়সে অনেক বড় ছিলেন, ভীষ্ম, বেদব্যাস, ধৃতরাষ্ট্র, কুম্ভী, গান্ধারী, সকলেই তাঁর পরামর্শ ও উপদেশ প্রার্থনা করতেন।
কলিকে বলা হয় পাপ প্রবর্তক। অতএব, কৃষ্ণ যতোক্ষণ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন, ততোক্ষণ কলি প্রবেশ করতে পারে নি। এক্ষেত্রে দেখছি ‘অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশীয় দিন, ভরণীনক্ষত্রে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল। পরবর্তী আমাবস্যার দিন দুপুরবেলা রাজা শল্য, আর সন্ধ্যাবেলা কুরুরাজ দুর্যোধন যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। তাহলে মুখ্য চান্দ্র অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যাতে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। তার পরদিনই পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদে যুধিষ্ঠির রাজা হয়েছিলেন, আর সেদিন থেকেই যুধিষ্ঠিরাব্দ শুরু হয়েছিল। আর সেই পৌষ মাসের শুক্লপ্রতিপদ থেকে পঁয়তাল্লিশ দিন পরে মাঘী পূর্ণিমায় কলিযুগ আরম্ভ হয়েছিল। অর্থাৎ কল্যব্দের শুরু হয়েছিল।