পৃথা – ৩

এই ভূমিকার পরে, এবার আমাদের যাত্রা, যাদবদের রাজ্য মথুরা নগরে। মথুরাপুরীর সেই সময়ে, যখন যাদবদের রাজা শূরসেন রাজত্ব করছেন।

কিন্তু, সহসা দেখছি, মথুরাপুরী যাত্রা আপাততঃ নাস্তি। কারণ, ইতিহাসের যে-সময়ে আমার যাত্রা আসন্ন, সেই মুহূর্তেই মনে হলো, সংহিতা যুগে একবার সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা সেরে নেওয়া উচিত। সংহিতা যুগ আমার ভবিষ্যতের ঐতিহাসিক ভ্রমণের আবছায়াকে কিছুটা আলোকিত করতে পারে।

সংহতি যুগের একটি বৈশিষ্ট্য দেখছি, আর্যদের জনসংখ্যা খুবই কম। অনার্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে লোকক্ষয় হয়েছিল। সেই সময়ে আর্যরা কৃষিকাজকে আয়ত্ত করেছে। নিতান্ত পশু মাংসভোগী, অস্ত্র- ধারী অশ্বারোহী আদিম যাযাবর ছিলনা। কৃষি উপযোগী ভূমিরও অভাব ছিল না। অভাব ছিল মানুষের। সমাজের যা কিছু নিয়ন্ত্রণ সবই মানুষের প্রয়োজনে। সংহিতা যুগেও দেখছি, লোকসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য, সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা সমাজরীতি ও নীতির পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। পরিবর্তনটা প্রধানতঃ নানা রকমের বিবাহ আর পুত্রোৎপাদন পদ্ধতি।

সেই সংহিতা যুগেও বুদ্ধিজীবীরা একটি বিষয় ভালোই জানতেন। পুরুষ-রমণীর পক্ষে রিপু দমন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। আর তার ফলে, রিপু বশীভূত রমণী পুরুষের ফলোৎপাদনক যদি সমাজে যথার্থ রূপ গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা না যায়, তবে তার পরিণতি শুভ হতে পারে না। এই চিন্তা থেকেই, সমস্ত রকমের দৈহিক মিলনকে, আর সেই মিলন সম্ভূত সন্তানদের বৈধ করণের জন্য, আট রকমের বিবাহ পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছিল। আর দ্বাদশ প্রকারের সন্তান জন্মকেও সমাজে স্থান দেওয়া হয়েছিল। সেইসব বিবাহ পদ্ধতি আর সন্তান ধারণের পদ্ধতির বিবরণে আমি পরে আসছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পন্থাও দেখছি গ্রহণ করা হয়েছিল। যেমন, স্বামী অথবা নিকট সম্পর্কের আত্মীয় আত্মীয়ার নির্দেশ, অনুবর্তন হলো ক্ষেত্রজ সন্তানের। মহা- ভারতের আদি খণ্ডে দেখছি, স্বায়ম্ভব মনু নির্দেশ করছেন, মানুষেরা নিজের বীর্য ভিন্ন, অন্যের কাছ থেকেও ধর্মফলদায়ক শ্রেষ্ঠ সন্তান লাভ করতে পারে। কোনো ব্যক্তি কোনো কন্যাকে বিয়ে করার জন্য শুল্ক দিয়ে অনেকদিনের জন্য বিদেশে চলে গেলে, সেই কন্যা শুল্কদাতার উপকার করার জন্যেই, অন্য পুরুষের দ্বারা গর্ভধারণ করে, সন্তানের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু তার জন্যে সেই কন্যাকে নিয়মানুসারে কেউ বিবাহ করতে পারবে না। একমাত্র কন্যার পিতা যদি আগের বরপক্ষকে শুল্ক ফিরিয়ে দেন, তবে কন্যাকে অন্য পাত্রে বিবাহ দিতে পারেন (মহাভারত-অনু)।

কোনো কন্যা কুমারী অবস্থায় পুত্রবর্তী হলে, পুত্রসহই তার বিবাহের ব্যবস্থা বিধিসম্মত করা হয়, এবং বিবাহিত স্বামীকেই সেই পুত্রকে নিজের ঔরসজাত পুত্রের মতোই লালন পালন অবশ্য কর্তব্য। এটা হলো আসলে কানীন পুত্রকে মেনে নেওয়ারই একটি নির্দেশ। মহা ইতিবৃত্ত, মহাভারতের বনপর্বের পাতা খুলে দেখছি, বেদের উল্লেখ করে, স্পষ্টই বলা হয়েছে, অবিবাহিতা রমণীগণ, যাকে ইচ্ছা তাকেই কামনা করতে পারে বলেই তাদের ‘কন্যা’ বলা হয়। কন্যা হচ্ছে স্বতন্ত্রা। পরতন্ত্রা নয়। স্বেচ্ছানুসারে কাজ করাটাই স্বভাবসিদ্ধ ব্যাপার। আর বিবাহাদি নিয়মগুলো, মানুষের শুধু কল্পনা মাত্ৰ। আমি যে-রমণীর সন্ধানে চলেছি, তাঁর সম্পর্কে এখানে একটি বিশেষ সংকেত পেলাম।

আপাততঃ মহাভারত থেকেই, আমি কিছু নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ঝুলিতে ভরে নিচ্ছি। সেগুলো বিভিন্ন পর্বের থেকে পেয়েছি। পৰ্ব- গুলোর উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। যার দরকার, সে যেন ‘ভারত’ গ্রন্থ দেখে নেয়। যেমন, স্বামীর অবর্তমানে দেবরকে পতিত্বে বরণ করা বিধেয় ছিল। স্বামীর ভর্তা ধর্মানুসারে ভর্তা হতে পারতেন। অতিথির মনোরঞ্জনার্থে গৃহস্বামিণী আত্মসমর্পণ করতেন। প্রত্যেক রমণীর ঋতু রক্ষা অবশ্য পালনীয়। কোনো রমণী কোনো পুরুষকে ঋতু রক্ষা করতে অনুরোধ করে যদি ব্যর্থ হতো, তবে সেই পুরুষ ভ্রূণহত্যা পাতকের জন্য নিরয়গামী হতো।

তারপরেও দেখছি, অতীতের বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : রমণী- গণ অনাবৃত ছিল। তারা ইচ্ছামতো গমন ও বিহার করতে পারতো। কারোর অধীনতায় তাদের কালক্ষেপ করতেহতোনা। কৌমারাবধি এরা পুরুষ থেকে পুরুষান্তরে আসক্ত হলেও অধর্ম হতো না। এসব আচরণব্যবহারধর্ম বলে প্রচলিত ছিল। তপঃস্বাধ্যায় সম্পন্ন মহর্ষিগণ এই প্রামাণিক ধর্মের সবিশেষ প্রশংসা করতেন।

সর্বাপেক্ষা বিস্ময়ের বিষয় হলো, বেদবিৎ মহাত্মারা একথাওনলে গেছেন, ঋতুস্নানথেকে ষোল দিনের মধ্যে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করলে অধর্ম হয়। ষোল দিন পরে সংসর্গ করলে কোনো অধর্ম হয় না। এর সঙ্গে যে নারী দেহে সন্তানোৎপাদনের একটি বৈজ্ঞানিক তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। আধুনিক কালে,অভিজ্ঞ নরনারী মাত্রেই জানেন, ঋতুস্নানের পর দশদিনের মধ্যে সাধারণত, সন্তান ধারণের জন্য,নারীর ডিম্বানুটিবেঁচে থাকতে পারে। দশ দিনও অনেক বেশিই গণ্য করা হয়। সাধারণতঃঋতুস্নানের পর, নারীর জরায়ুতে আবির্ভূ ত ডিম্বানুটি বাহাত্তর ঘণ্টারও সামান্য বেশি কিছু সময় বেঁচে থাকে। সেই সময়ে স্বামী সংসর্গ ঘটলে নারী সন্তানসম্ভবা হয়।

এখানে দেখছি, বেদবিৎ মহাপুরুষরা ঋতুস্নান থেকে ষোল দিন পর্যন্ত, অন্য পুরুষের সংসর্গ নিষেধ করেছেন। যার একটিই মাত্র যুক্তি থাকতে পারে, অন্য পুরুষে সংসর্গ সম্ভব, কিন্তু অন্য পুরুষের সন্তান ধারণ নিষিদ্ধ।

যাইহোক,সমস্ত ব্যাপারগুলো থেকে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে, কোনো ক্ষেত্রেই রমণীর সতীত্ব, পদমর্যাদা, সমাজ প্রতিষ্ঠা,কোনো কিছুই ক্ষুণ্ণ বা ম্লান হতো না। অর্থাৎ দৈহিক শুচিতা সম্পর্কে কোনো গুরুত্ব আরোপ করা হতো না। এটাই হলো সংহিতা যুগের একটা বৈশিষ্ট্য। সেই যুগে নরনারী নির্বিশেষে সকলের কর্তব্য বলতে বোঝাতো, অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন, যাজন, দান, তপ, সত্য, ক্ষমা, অলোভ, অনালস্য, অনসূয়া, ধৈর্য, ধুতি, অহিংসা, সমদর্শিতা, সরলতা, দক্ষতা, মৃদুতা, লজ্জা, স্থিরতা, অদীনতা, অক্রোধ, অপক্ষ পাতিত্ব, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহ, তিতিক্ষা, অসৎসরতা, ত্যাগ, সন্তোষ, প্রিয়- বাদিতা, শৌর্য, বীর্য, নির্ভিকতা। দৈহিক শুচিতার কথা বিশেষ ভাবে কিছুই নির্দিষ্ট করা ছিল না।

রূপই যে নারীর শ্রেষ্ঠ গুণ, এটা সেই যুগেও স্বীকৃত ছিল। দ্বিতীয় গুণ, শীল, তৃতীয় সত্য, চতুর্থ সরলতা, পঞ্চম সৎকর্ম, ষষ্ঠ মাধুর্য, সপ্তম অন্তরে বাহিরে শুদ্ধতা, অষ্টম পিতৃভাব, নবম শুশ্রূষা, দশম সহিষ্ণুতা, একাদশ রতি, দ্বাদশ পাতিব্ৰত্য। পাতিব্রত্যকে যদি সতীত্ব জ্ঞান করি, তা হলে নারীর বিবিধ গুণের মধ্যে এটি হলো দ্বাদশ গুণ। ভারত ইতিহাসেই, সংহিতা যুগের বিবরণে দেখছি, সেই যুগে রমণীগণ গো-গণের মতো স্বজাতির শত সহস্র পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ করলেও, তারা অধর্মে লিপ্ত হতো না। সর্বজনভোগ্য নিত্য ধর্ম বলেই বিবেচিত হতো। কালের প্রভাবে, পরবর্তীকালে, স্ত্রী জাতিকে, গৃহপালিত জীবের ম্যায় কেবল গৃহস্বামী ভোগ্যা রূপে রূপান্তরিত করার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল।

মহাভারতের উদ্যোগ পর্বের, পাতা উল্টে দেখছি, “কামশূন্য জীব কখনও জন্মায়নি,জন্মাবে না। এমন কি, জীবন্মুক্ত মহাত্মারাও কামার্ত হলে, প্রতিনিবৃত্তি না।”

ভীষ্ম শরশয্যায় থেকে, কৃষ্ণকে স্তব করতে গিয়ে বলেছিলেন, “যাঁর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সমুদয় কামময়, যিনি সমস্ত জীবকে কামমদে উন্মত্ত করে থাকেন, সেই কামাত্মাকে নমস্কার।” …

যে-সব প্রাণীর দেহ পঞ্চভূত বিশিষ্ট, তারা সদা কামেরই সাধ্য ও বাধ্য। পঞ্চেন্দ্রিয় কামের আধার। যে-মনুকে নিয়ে আমাদের সমাজে নানা নিষেধ প্রচলিত আছে, দেখছি, সেই মনুও বলছেন, মাংস ভোজন, মদ্য পান, স্ত্রী পুরুষ সংসর্গে দোষ নেই। এ সব ব্যাপারে জীবদের প্রবৃত্তি স্বভাবসিদ্ধই আছে। তবে নিবৃত্ত করতে পারলে মহাফল পাওয়া যায়।

সংহিতার যুগে ফিরে গিয়ে দেখলাম, একটা সময় কাল পর্যন্ত, রমণী জাতির যৌন স্বাধীনতা পুরুষদের মতোই অবাধ আর সমভাব ছিল। কিন্তু কাম প্রবৃত্তির এই অবাধ স্বাধীনতাকে একটা সংহত একমুখী করে তুলতে না পারলে, শৃংখলা রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ে- ছিল।

অবশ্য মানব সমাজের ইতিহাসে, আমি আধুনিক জ্ঞানীদের কাছে যে-পাঠ পেয়েছি, তাতে দেখেছি, প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজেই একমাত্র রমণী পুরুষের অবাধ যৌন সম্পর্ক ছিল। রাহুল সাংস্কৃত্যা- য়নের, ‘ভোলগা থেকে গঙ্গার’ মাতৃতান্ত্রিক সমাজের চিত্র দেখেছি। দেখেছি, কারোরই পিতৃপরিচয় ছিল না। মাতৃপরিচয়ও গ্রাহ্য ছিল না। অতএব মা ও কন্যা, একটি পুরুষের সংসর্গ লাভের জন্য, পর- স্পর লড়াই করে, একজন, আর একজনকে হত্যা করে, সেই পুরুষকে লাভ করছে। সংহিতা যুগ বলে যে সময়কে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা আদি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কথাই মনে পড়িয়ে দেয়। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে, পুরুষরা যখন দৈহিক বলে বলীয়ান হয়ে, নানা রকম সম্পদ আহরণ করতে আরম্ভ করেছিল, সেই সম্পদের দাবী- দার কেউ ছিল না। রমণীরা যখন তাদের সন্তানদের জন্য সেই সব সম্পদ দাবী করলো, পুরুষ জিজ্ঞেস করলো, কে তোমার সন্তানের জন্মদাতা? তুমি তো স্বেচ্ছাবিহারিণী। তোমার সন্তানের জন্য আমার সম্পদ দাবী করতে হলে, তোমাকে কেবল আমারই অঙ্কশায়িনী হতে হবে।

পুরুষের উৎপাদিত সম্পদ বণ্টনকে কেন্দ্র করেই, বিবাহ প্রথার প্রচলন করতে হয়েছিল। তখনই নারীকে একজন পুরুষের স্ত্রী রূপে বন্দী হতে হলো। কিন্তু পুরুষ কখনও সে-জোয়াল নিজের ঘাড়ে নিল না। সে অন্যান্য রমণীকেও ভোগ করতে লাগলো। এবং সকলের সস্তানকেই তার সম্পদের ভাগীদার হিসাবে মেনে নিল। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে, সেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরিবর্তন একদিনে হয় নি, বহুকাল লেগেছিল। এই বিবাহ প্রথার মধ্যে একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাচ্ছি।

সংহিতার যুগেও বিষয়টি বৈজ্ঞানিক বটে। কিন্তু যেহেতু পুরুষের ক্ষমতা, অধিকার, সম্পদ ইত্যাদির কথা ঠিক মতো ব্যক্ত হয় নি, সেই হেতু-ই তাকে আমি অবৈজ্ঞানিক আখ্যা দিতে পারি না। সংহিতা যুগে, রমণী পুরুষের অবাধ যৌন সংসর্গ কে, ‘দৈহিক শুচিতা’ নামে কঠিন লৌহ শৃংখল নাগপাশে আবদ্ধ করে নি। পুরুষ- জাতি অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় নিজের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। আর তারপরেই যৌন শুচিতার গুণকীর্তন এমন কঠোর- তর দেখছি। এর সংরক্ষণের জন্য কঠিন নিয়ম রীতিনীতি তৈরি করা হলো। সেই সব রীতিনীতি না মানলে কঠিন শাস্তির বিধান অসম্মান, অপমানের ব্যবস্থা হলো। শুরু হলো, সংহিতার যুগ অতিক্রম করে, পৌরাণিক যুগের যাত্রা। কিন্তু মনে রাখা উচিত, সেই অতিক্রমণের সময়টা, দ্বাপর ও কলি যুগের মতোই, প্রায় একশো বছরের কম ছিল না। সামাজিক কোনো পরিবর্তনই অল্প সময়ে হয় না। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আরও বেশি সময়ই লাগতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *