পৃথা – ২

ইতিহাসের এ সকল পাতাগুলো দেখতে হচ্ছে, কারণ, সমস্ত অলৌকিক ও অবাস্তব ব্যাপারগুলো যেন আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন না করতে পারে। আমার চিন্তাকে জ্ঞানের বাইরে নিয়ে গিয়ে, সত্য দর্শনের বাধা সৃষ্টি করতে না পারে।

রানী বা মহারানী থাক। যাঁকে দর্শন করতে আমার এবারের যাত্রা, তাঁকে আপাততঃ আমি রমণী বলেই উল্লেখ করবে!। যে রমণীকে ঘিরে, বহুকাল ধরে মানুষের নানা প্রশ্ন, নানা উক্তি, নানা মন্তব্য, যে-সবের মধ্যে আসল রমণীটি হারিয়ে গিয়েছেন। যার বাস্তব সত্তার ওপর বহুতর কল্পিত আর অলৌকিক সব আবরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে, ইতিহাসের পথ ধরে, সমস্ত কুহেলিকা আর কল্পিত অজ্ঞানতা থেকে তাঁকে আমি দেখবো।

পুরাণের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাকারদের একটি কথা আমাকে জেনে নিতেই হচ্ছে। সাধারণ মানুষ, সে দেবতা অসুর-গন্ধর্ব যে জাতিরই হোক, নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের চেতনা ছিল না। অথচ ধর্ম বিষয়ে সকলেরই ছিল বিশ্বাস। ধর্মকে কেন্দ্র করে সমস্ত কিছুকেই তারা শ্রদ্ধা করেছে। যে-কোনো বস্তুকে বংশানুক্রমে পুজো করেছে, রক্ষা করেছে। সেই কারণেই পুরাণ বেদ ইত্যাদির রচয়িতারা সাধারণদের সেই সব রচনাকে ধর্মগ্রন্থরূপে চিহ্নিত করতেন এবং রক্ষা করতে বলতেন। পুরাণের মধ্যে আমাদের যে ইতিবৃত্ত রয়েছে, সাধারণ মানুষ যদি তা ধর্মগ্রন্থরূপে রোজ পূজা ও পাঠ না করতেন, অলৌকিক বস্তু হিসাবে রক্ষা না করতেন, তা হলে আমরা আমাদের প্রাচীন জন্মদাতা ও তাঁদের ইতিহাস হারিয়ে ফেলতাম। আর সেই কারণেই হয়তো, পরবর্তীকালে অন্যান্য পণ্ডিতদের হাত পড়ে, পুরাণকে সত্যিই অলৌকিক আর অবাস্তব হতে হয়েছে। একশো বছরের আয়ুষ্মান ব্যক্তিকে এক হাজার বছর বা তারও অনেক বেশি বাঁচিয়ে রাখার মিথ্যা দিয়ে, মানুষের মনকে অজ্ঞানতার অন্ধকার দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। স্বর্গলোক অত্যন্ত সুন্দর আর স্বাস্থ্যকর স্থান ছিল বলেই, অধি- বাসীরা দীর্ঘজীবি ছিলেন বলেই, বেদে প্রচারিত দেখছি, স্বৰ্গ- লোক ‘অমৃতভূমি’ এবং দেবতারা ‘অমর’। তবে ইতিহাসের পাতায় দেখছি, সুমেরু—অর্থাৎ আলটাই পর্বতের সামুদেশে ‘ছ্যাবা” বা মঙ্গোলিয়া, হিমালয়ের সানুদেশে ‘ভূ’—অর্থাৎ পৃথিবী বা ভারতবর্ষ, মানুষের আদি জন্মভূমি। মঙ্গোলিয়া সমস্ত জীবের প্রথম জন্মভূমি। সেই কারণেই, প্রাচীনতর দেখছি মানবের কাছে, মঙ্গোলিয়া ছিল, ‘পিতৃলোক’। আর বৈদিক যুগের মানুষের কাছে ভারত ছিল ‘ভূলোক’।

সুদূর অতীতের ইতিহাসের সমস্ত পাতা ঘটিতে গেলে যথাস্থানে পৌঁছুতে অনেক বিলম্ব হবে। আর মাত্র দু একটি বিষয় উল্লেখ করে, আমরা গন্তব্যে যাত্রা করবো।

মহারাজ উত্তানপাদের পুত্র ‘ধ্রুব’ বিমাতার প্ররোচনায় রাজ্যচ্যুত হয়ে, বিষ্ণুলোকের বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণু তাঁকে কৃপা করে ব্রহ্মলোকে একটি ছোট রাজ্য দান করেন। ধ্রুব সেখানেই সুখেই রাজত্ব করছিলেন। কিন্তু সেই রাজ্য তুষারপাত ও প্রলয়ে ধ্বংস হয়েছিল। কেবল ধ্রুবর রাজ্য নয়, সমগ্র ব্রহ্মলোকই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয়েছিল। তখন ব্রহ্মলোকের দেবতারা সকলেই ‘সূর্য’ অর্থাৎ ‘নর সূর্যের উষ্ণ দেশে আশ্রয় নেন। সূর্যলোক পরিপূর্ণ হয়ে গেলে, দেবতারা যান চন্দ্রলোকে। অর্থাৎ ‘নরচন্দ্রের’ রাজ্যে।

অনেকে ব্যক্ত করেছেন, প্রাকৃতিক কারণে সূর্যলোক, চন্দ্রলোক, সবই ধ্বংস হয়েছিল। সেই কারণে দেবতারা সকলেই দক্ষিণে সরে এসে, ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। এটাই কি যথার্থ ইতিহাস? না, কি তেত্রিশ কোটি দেবতা অধিবাসীদের পক্ষে আর স্বর্গে স্থান সংকুলান সম্ভব ছিল না বলেই, তাঁরা নিচে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন? ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি যেন এ বাস্তবেরই সাক্ষী দিচ্ছে। যে কারণে, ভারতবাসীদের কাছে তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা শোনা যায়।

আমাদের অতীত সম্পর্কে, যে-ভ্রান্তি জ্ঞানও দৃষ্টিশক্তিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, ইতিহাস তা দূর করার জন্য, আজিও বর্তমান। সেই ইতিহাসের পাতায় দেখছি, দেবতারা দানবদের জয় করছেন। দানবরা দেবতাদের জয় করছেন। কিন্তু নহুষাদির মতো মহা- রাজারাও স্বর্গে গতায়ু হয়েছেন। দেবগণের উপর্যুপরি অনোন্যাতি- শায়িনী দীপ্তশ্রী দর্শনে, স্বর্গেই বা সুখের অস্তিত্ব কোথায়? মানুষ স্বর্গে সমূলে পুণ্যফল ভোগ করে। সেখানে অন্য কর্ম করা হয় না, এটি একটি দোষ। ছিন্নমূল বৃক্ষ যেমন ভূমিতে আছড়ে পড়ে, দেবতারাও তেমনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। স্বর্গে সুখাভিলাষনিষ্ঠ দেবগণেরও সমপ্লবে সহসা দুঃখ উপস্থিত হয়। স্বর্গেও দেগণের কোনো সৌখ্য নেই। বিবিধাকার ব্যাধিসকল দেবলোকেও লব্ধ- প্রসর। যজ্ঞের শিরোরোগ সর্বদাই বিদ্যমান। ভামুর কুষ্ঠ, বরুণের জলোদর, পুষার দত্তবৈকল্য, ইন্দ্রের ভূজস্তম্ভন, চন্দ্রের প্রবল ক্ষয়রোগ, দক্ষ প্রজাপতির প্রবল জ্বর, এ সবই দেবতাদের রোগ-নিৰ্দেশ। ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, ‘দেব দানব গন্ধর্বদিগকেও মৃত্যু হরণ করে থাকে। মৃত্যুকে অতিক্রম করা নিতান্ত দুঃসাধ্য।’ ইতিহাসের পথে যাত্রা করে, আমি দেখলাম, এই গ্রহের যা কিছু অতীত ও বর্তমান, তা নানা নামের জাতি মানুষেরই কীতি। স্বৰ্গ নামক স্থানগুলোতে বাস করতেন, নানা উপাধি নিয়ে দেবতা জাতির মানবরা। আর আমি দেখলাম, মানুষই সূর্য নামে অভিহিত হতেন। চন্দ্র সূর্য বরুণ অগ্নি—অনেক তাঁদের নাম। তাঁদের শৌর্য বীর্য যেমন ছিল, তেমনই ছিল রোগ শোক মৃত্যু। তাঁদের মধ্যে কেউকেউ, তাঁদের কাজের দ্বারা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ইতিহাসের এই সব অধ্যায় আমাকে মনে রাখতে হচ্ছে। কারণ, যে অনন্যা অবিস্মরণীয়। রমণীর সন্ধানে আমার যাত্রা, তাঁকে দর্শন করার দৃষ্টির সকল আচ্ছন্নতা আমার ঘুচে যাবে।

বহু প্রাচীনকালের মানব জাতির যে-ইতিহাসের সামান্য বিবরণের মধ্যে, আমি মরণশীল দেবতাদের দেখা পেয়েছি, তাঁরা যে কাল- প্রভাবে চালিত ছিলেন, স্থয়ং ব্যাসদেব তারই ব্যাখ্যা করেছেন, “পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই যে, যুগধর্মের প্রভাব প্রতিরোধ করতে পারে। ভাব, অভাব, সুখ, দুঃখ, সকলই কাল- সহকারে ঘটে থাকে। কাল প্রজা সকলকে দগ্ধ করছেন। আবার কালই তাদের শান্ত করছেন। নিখিল ভূমণ্ডলস্থ শুভাশুভ সমুদয় পদার্থ, কাল হতে সৃষ্ট হচ্ছে, কালেতেই লোকসকল লয়প্রাপ্ত হচ্ছে, এবং আবার কাল হতেই উৎপন্ন হচ্ছে। সমগ্র জীব নিদ্রিত হলেও কাল জাগরিত থাকেন। কালকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না। কাল অপ্রতিহত রূপে সর্বভূতেই সমভাবে বিচরণ করছেন। বর্তমান ভূত, ভবিষ্যৎ সকল বস্তুই কাল নির্মিত।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *