১৫
যুদ্ধ শেষ! কেবল চারদিকে কান্নার রোল আর স্তূপীকৃত মৃতদেহ সর্বত্র ছড়ানো। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে, বিছর সমস্ত মৃতদেহের দাহ- কার্য সমর্পণ করলেন। তারপর ধৃতরাষ্ট্রকে সম্মুখে রেখে, নারী পুরুষ সকলে গঙ্গায় উপস্থিত হলেন। সকলেই যুদ্ধে নিহত আপন- জনদের উদ্দেশে সলিলাঞ্জলি দান করলেন।
কুন্তী এ সময়ে আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি কেঁদে উঠে, সকলের সামনেই বলে উঠলেন, “ওরে আমার বৎসগণ! যে-মহা- বারকে তোমরা রাধাতনয় বলে জানতে, যে-সত্যসন্ধ বীর্যবান দুর্যোধনের সহায়ক ছিলেন, অর্জুনের দ্বারা যিনি নিহত হয়েছেন, সেই পুণ্যকর্মা কর্ণ তোমাদেরই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। তিনি সূর্যসম পিতা কর্তৃক আমার গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন। তোমরা তাঁর উদ্দেশ্যেও তর্পণ কর।”
সেই শোকবাক্য শুনে, সকলের থেকে বেশি পাণ্ডবরাই বিস্মিত ও শোকমগ্ন হলেন। বিশেষ করে যুধিষ্ঠিরের শোক যেন শত গুণে বর্ধিত হলো। মাকে তিরস্কার করে তিনি কাঁদতে লাগলেন। কর্ণের উদ্দেশে সলিলাঞ্জলি দিয়ে তিনি অভিশাপ দিলেন—”আজ থেকে স্ত্রীলোকগণ কোনো কথাই মনে গোপন রাখতে পারবেন না।” ইতিহাসের এটাই বিস্ময়, এবং কুন্তী চরিত্রেরও। তিনি যে-কথা বহু কাল গোপন করেছিলেন, আজ তা প্রকাশ করলেন সর্ব সমক্ষে। এখানেই তিনি মহৎ মহিয়সী।
অতঃপর যুধিষ্ঠির সিংহাসনে আরোহণ করলেন। কিন্তু কুন্তীর মনে কিছুমাত্র আনন্দ নেই। নিজ পুত্রকে রাজা দেখেও, তাঁর অন্তরের বিষাদ দূর হলো না। তিনি গান্ধারীর সেবায় কোনোক্রমে দিন কাটিয়ে পনরো বছর অতিক্রম করলেন।
ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী, যুধিষ্ঠিরের শত অনুরোধ সত্ত্বেও বাণপ্রস্থে গমন করলেন। কুন্তী গান্ধারীর হাত টেনে নিজের কাঁধে রাখলেন। গান্ধারীর কাঁধে ধৃতরাষ্ট্রের হাত। কুন্তী সকলের আগে। পিছনে সমস্ত পুত্রগণ, পুত্রবধূগণ চলেছেন। কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে, হস্তিনার বর্ধমান-দ্বার দিয়ে তাঁরা যাত্রা করেছেন। পিছনে পিছনে অগণিত শোকমগ্ন নরনারী।
কুম্ভী যে বাণপ্রস্থে চলে যাচ্ছেন, কেউ তা বুঝতে পারেন নি। কিছু দূরে এগিয়ে যুধিষ্ঠির কুন্তীকে বললেন, “মা, আপনি গৃহবধূদের নিয়ে ফিরে যান। আমি এঁদের সঙ্গে আরও একটু এগিয়ে যাই।” কুন্তী জবাবে বললেন, “সহদেবকে সর্বদা সস্নেহে রক্ষা করবে। সে তোমার ও আমার একান্ত অনুরক্ত। তোমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, সূর্যতনয়, যার পরিচয় আমি এতকাল গোপন করেছিলাম, তাঁকে স্মরণ করে আমার প্রাণ অপরাধবোধে বিদীর্ণ হচ্ছে। তোমরা তাঁর নামে দক্ষিণাদি দিও। আমি ভাসুর ও ভাসুর পত্নীর সেবায় তপস্বিনী হয়ে বসবাস করবো।”
এ কথা শুনে পাণ্ডবরা শোকে ভেঙে পড়লেন। বললেন, “আপনি চলেই যদি যাবেন, তবে কৃষ্ণের মুখ দিয়ে বিছলার কথা শুনিয়ে আমাদের পিতৃরাজ্য উদ্ধারের আদেশ কেন দিয়েছিলেন?” কুন্তী চোখের জল মুছে বললেন, “তোমরা ক্ষত্রিয় পুত্রগণ শত্রু- পরাভূত হয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াবে, এই ভেবে আমার দুঃখ হতে।। এই জন্যই, তোমাদের ক্ষাত্রতেজে উদ্বুদ্ধ করেছি, রাজ্য উদ্ধারের প্ররোচনা দিয়েছি। দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার প্রতিশোধের জন্য তোমাদের উত্তেজিত করেছি।…শোন, আমি স্বামীর ঐশ্বর্য ভোগ করেছি, স্বামীর ধন দান করেছি, যথাবিধি সোমরসপান করেছি। নিজের ভোগের জন্য আমি বিছুলার কাহিনী শোনাই নি। তোমাদের রক্ষা করার জন্যই শুনিয়েছি।…আরও শোন, তোমার বিজিত রাজ্যে ঐশ্বর্য ভোগের স্পৃহা আমার নেই। কুরুশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির! তুমি সবাইকে নিয়ে ফিরে যাও। ধর্মে তোমার মতি স্থির থাকুক। তোমার অন্তর মহৎ হোক।”
.
অরণ্যে কাল কাটছে। যুধিষ্ঠির সবাইকে দর্শন করবার জন্য অরণ্যে গমন করলেন। এই সময়ে বিদুরের মহাপ্রয়াণ ঘটলো যুধিষ্ঠিরের সামনেই।
যে-মহাপ্রয়াণের ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, যুধিষ্ঠির ধর্মাত্মা বিদুরের ঔরসজাত পুত্ৰ ছিলেন!
ব্যাসদেবও এলেন। তপস্বিনী কুন্তী তাঁকে বললেন, “ভগবন,নিতান্ত মন্দবুদ্ধিবশতঃ আমি আমার কন্যকাবস্থার সন্তানটিকে নদীপথে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। সে কথা মনে করে, আমার অন্তর পুড়ে যাচ্ছে। এ পাপ না অপাপ, জানি না, আপনার কাছে অকপটে স্বীকার করি, দুর্বাসার বরেই আমার সব লাভ হয়েছে। এখন আমি আমার সেই পুত্রটিকে একবার দেখতে চাই। একবার তাকে দেখান।”
ব্যাসদেব বললেন, “তোমার স্বীকারোক্তি ও চরিত্রই তোমার সমস্ত অপরাধ ধুয়ে দিয়েছে। কোনো পাপই তোমার নেই।”
তারপরে তিনি যোগবলে মৃতদের সবাইকে দেখালেন। পাণ্ডবরা অনেক চেষ্টা করেও ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী ও কুম্ভীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেন না।
এ ঘটনার, একবছর পরে, নারদ হস্তিনায় আগমন করলেন। তাঁর কাছেই জানা গেল, গঙ্গাদ্বারের ( অধুনা হরিদ্বার ) কাছে এক মহারণ্যে, দাবানলে প্রাণ আহুতি দিয়েছেন। তিনি সঞ্জয়ের মুখে এই বৃত্তান্ত শুনেছেন সেই দাবানলে দগ্ধ বনে গিয়ে, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী আর কুন্তীর দগ্ধ দেহ দেখে এসেছেন।
আমি দেখছি, ইতিহাসের পাতায়, কী ঐশ্বর্যময়ী রমণী চিত্র অঙ্কিত। সারা জীবনের দুঃখের মধ্যেও যিনি ভেঙে পড়েন নি,এবং যোগাসনে বসে দাবানলে প্রাণ ত্যাগ করছেন। পৃথার জীবন যেন সমস্ত সুখ দুঃখের ঊর্ধ্বে। যিনি প্রেম কী তা জেনেছেন। কিন্তু সারা জীবন দুঃখের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। বিশেষ করে, তাঁর পাপবোধ, বিশ্বের সকল মানবীকে নতুন চেতনা দিয়েছে।
পৃথা! তুমি আমাদের সকলের প্রণাম নাও।