পৃথা – ১১

১১

কুন্তী তাঁর পরবর্তীজীবনে, যখন কৃষ্ণকে দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, শৈশবে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চনা দিয়েই জীবন শুরু হয়েছিল, তখন তিনি আরও কয়েকটি কথা বলেছিলেন, “.. শ্বশুরকুলেও ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রাদির দ্বারা আমি লাঞ্ছিত হয়েছি। কৃষ্ণ! আমার মতো দুঃখীর বেঁচে থাকার আর কী প্রয়োজন?”…

শ্বশুরকুলের কথা বলতে গিয়ে, সে সময় তিনি স্বামী পাণ্ডুর উল্লেখ করেননি। কৃষ্ণজ্ঞানী,অভিজ্ঞ, সমস্ত বিষয়ে নীতিবিশারদ। তথাপি তিনি কুম্ভীর ভ্রাতুষ্পুত্র। হয়তো সেই কারণেই তাঁরদাম্পত্যজীবনের কথা কৃষ্ণকে বলতে পারেননি। প্রথমজীবনে কন্যকাবস্থায় পুত্রলাভ ও পুত্রকে ত্যাগ করা, কোনো কথাই লজ্জায় বলতে পারেননি। কিন্তু শ্বশুরকুলে, কুম্ভী কী লাঞ্ছনা ভোগ করেছিলেন? দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময় ভীষ্মের ও ধৃতরাষ্ট্রের আচরণে তিনি মর্মান্তিক দুঃখ পেয়েছিলেন। পুত্রবধূর লাঞ্ছনা, তাঁরও মানসিক লাঞ্ছনার বিষয়। কিন্তু ‘শ্বশুরের দ্বারাও লাঞ্ছিত হয়েছি’এ অভি- যোগটি যেন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবেই তাঁর নিজের বিষয়ে বলেছেন। কেন?

কারণ নিশ্চয়ই ছিল।

আমিযে-নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছি,সেখানেই তার জবাব নিহিত আছে। চম্পানগরীতে অধিরথ সূতের কাছে কর্ণকে পাঠিয়ে, কুন্তী অনেকটা আশ্বস্ত ছিলেন। পুত্র ত্যাগের কষ্টদূর হয় নি। তা সম্ভবও ছিল না। তবে, রাজা কুন্তীভোজের কন্যা কুস্তী যে এক অসাধারণ সুন্দরী রাজপুত্রী, এ বিষয়টি দেখছি, বেশভালো ভাবেই প্রচারিত ছিল। রাজা তো দেখছি, অনেক বর্তমান। তাঁদের অনেকের কন্যা থাকা সত্ত্বেও, কুন্তীর রূপৈশ্বর্যের যে-প্রচার ছিল, তেমনটি কারোরই দেখছি না। আরও একটি বৈশিষ্ট্য দেখা দিচ্ছিল। বিভিন্ন রাজ্যের রাজারা সকলেই কুম্ভীকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠাচ্ছিলেন রাজা কুন্তিভোজকে।

রাজা কুন্তি ভোজ পড়লেন মুশকিলে। সব রাজ্যের পরাক্রমশালী রাজারাই কুম্ভীর পাণিপ্রার্থী। বিশেষ কোন্ একজন রাজাকে তিনি কুন্তীকে সম্প্রদান করবেন? এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যখন অসম্ভব হলো, তখন তিনি আত্মীয় বান্ধব অমাত্য, সকলের সঙ্গে আলোচনা করে, কুন্তীর বিয়ের জন্য স্বয়ংবর সভা আহ্বান করা স্থির করলেন। এবং আহ্বানও করলেন।

এই স্বয়ংবর সভায় কুরুবংশের রাজা পাণ্ডুকেও দেখছি। ইতিহাসের পাতায়, পাণ্ডুর রূপের বর্ণনা দেখছি, তিনি স্বয়ংবর সভায় : সূর্যসদৃশ স্বীয় অনুপম প্রভাব দ্বারা সমস্ত ভূপতিগণের প্রভা ম্লান করে দিয়ে বসে আছেন। তাঁর কারণ প্রতাপ সিংহের মতো, বক্ষদেশ কষণ- সদৃশ প্রশস্ত, নয়নযুগল পদ্মসদৃশ। মহারাজ পাণ্ডুকে দেখলে, স্পষ্ট বোধহয়, যেন সাক্ষাৎ ইন্দ্র স্বর্গ ছেড়ে কুন্তীকে পাবার জন্য উপস্থিত হয়েছেন।’ বলাবাহুল্য, কুন্তী সেই মহাতেজা পুরুষকে দর্শন করে, তাঁর গলাতেই মাল্যদান করলেন।

এই মাল্যদানের সময়, কুন্তীর কি দক্ষিণ চক্ষু কম্পিত হয়েছিল? কোনো অশুভ ভাবনা কি তাঁর মনে উদয় হয়েছিল? বস্তুতপক্ষে, পাণ্ডুর রূপের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার কতোটাই বা সত্য? যাঁর ওরকম সিংহের মতো প্রতাপ আর সূর্যসম কান্তি, অথচ জন্মের সময় থেকেই দেখছি, তিনি একজন পাণ্ডুবর্ণের পুরুষ। ইতিহাস রূপকথা না। ব্যাসদেবের ঔরসে, ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হয়ে জন্মেছিলেন! কারণ, তাঁর মা ব্যাসদেবকে দেখে ভয়ে চোখ বুজেছিলেন। ইতিহাস যুক্তি চায়। মা গর্ভধারণের জন্য, ব্যাসদেবের সঙ্গে মিলিত হতে গিয়ে যেহেতু ভয়ে চোখ বুজেছিলেন, সেই হেতু সন্তান অন্ধ হয়ে জন্মেছিল, এ কথা বিশ্বাস করবার কোনো কারণ নেই। যেমন পাণ্ডুর জন্মের আগেই তাঁর জননী ব্যাসদেবকে দেখে, ভয়ে পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিলেন, সেই কারণে গর্ভের সন্তানও পাণ্ডুর বর্ণ হয়েছিল। এও কোনো যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যা না। আপাততঃ ত্রুটির সন্ধান করতে গিয়ে, আমি এই মুহূর্তে কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। তবে, আমি একটা বিষয়ে নিঃসন্দেহ, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু স্বাভাবিক সুস্থ পুরুষ ছিলেন না।

ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব বিষয়ে,দেখছিকেউকেউ তাঁর বিষয়েও স্নেহান্ধতাকে বোঝাতে চেয়েছেন। এসব হলো ইতিহাসের পাতাকে দূষিত করার চেষ্টা। ধৃতরাষ্ট্র প্রকৃতই অন্ধ হয়ে জন্মে ছিলেন। সে ত্রুটি কার ছিল? অম্বিকার? না ব্যাসদেবের? যে বিচিত্রবীর্য ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতা ছিলেন (পৈতৃক পরিচয়ের দিক থেকে ) সেই বিচিত্রবীর্যের দ্বারা কি তাঁর দুই পত্নী কোনোরূপ অসুস্থ হয়েছিলেন? ইতিহাস বলছে, বিচিত্রবীর্য দুই পত্নীর সঙ্গে অতিরিক্ত দৈহিক সম্ভোগের কারণে, যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। বিচিত্রবীর্য নামের মধ্যে কি বিশেষ কোনো অর্থ আছে? রূপবান সুপুরুষকে কি বিচিত্রবীর্য বলা যেতে পারে?

এই সব জিজ্ঞাসার মধ্যে কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার। দুই পত্নীর তুলনায়, বিচিত্রবীর্য বয়সে বেশ ছোট ছিলেন। এবং ছিলেন অত্যন্ত কামুক। ইতিহাসের নীরবতার অর্থ এই না, ইতিবৃত্তের অন্তরালের ঘটনাবলীকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা থাকবে না। বিচিত্রবীর্য কি অন্যান্য নারীতেও আসক্ত ছিলেন? যৌনব্যাধি পৃথিবীর মানব সমাজে এই প্রাচীন অভিশাপ। বিচিত্রবীর্য যদি কোনো ব্যাধি তাঁর দুই পত্নীকে দান করে গিয়ে থাকেন, সেটা খুব একটা আশ্চর্যের বিষয় না।

আরও দুটি বিষয় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বেদব্যাস যে দাসীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করেছিলেন, সেই বিছর নিরোগ স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর কোনো শারীরিক ত্রুটি ছিল না। বেদব্যাস এক শূদ্রার গর্ভে তাঁর পুত্র শুকদেবকে জন্ম দিয়েছিলেন। তিনিও সুস্থ ছিলেন। অথচ ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু অস্বাভাবিক ত্রুটিপূর্ণ ছুটি সন্তান। আরও লক্ষণীয়, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্মের পর, অম্বিকা ও অম্বালিকার বিষয়ে আমি আর বিশেষ কোনো সংবাদই পাচ্ছি না যেন, ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুকে জন্মদান করা ছাড়া,তাঁদের আর কোনো ভূমিকা ছিল না! হয় তো বাস্তবিকই তা ছিল না।

ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন। কিন্তু পুত্রোৎপাদনে অক্ষম ছিলেন না। গান্ধারীর দীর্ঘকাল গর্ভধারণ, পিণ্ড প্রসব, তা থেকে একমাত্র পুত্রের জন্ম, এসব নিয়ে আপাততঃ আমার কোনো দরকার নেই। গান্ধারী ছাড়াও, তিনি দাসীর গর্ভে দুটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। বোঝা যায় অন্ধ হলেও সন্তান জন্মদানে তিনি সক্ষম ছিলেন। কিন্তু পাণ্ডু?

‘অন্তিম প্ৰণয়’ কাহিনীতে আমি পাণ্ডুর প্রশ্ন তুলেছিলাম। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন বলে তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হওয়া সত্ত্বেও, রাজা হতে পারেন নি। রাজা হয়েছিলেন পাণ্ডু। ভীষ্ম, ব্যাসদেব, এবং এমন কি ধৃতরাষ্ট্রও কি জানতেন না, পাণ্ডু প্রকৃতপক্ষে ত্রুটিহীন পুরুষ নন? তাঁর যে রূপ ও স্বাস্থ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে পাণ্ডুবর্ণের যোগাযোগ ঘটায় তিনি যথার্থই কেমন দেখতে ছিলেন, তার সঠিক কিছু ব্যক্ত করা যায় নি।

কুন্তী কি সত্যি পাণ্ডুর পরিচয় না জেনে, নিতান্ত চেহারা দেখে মুগ্ধহয়েই তাঁর গলায় মাল্যদান করেছিলেন? অথবা তিনি জানতেন সেই যুগের কুরুবংশের মহারাজা পাণ্ডুই ছিলেন শ্রেষ্ঠ নরপতি?

সম্ভবতঃ এটাই সত্য। তিনি যদি পাণ্ডু সম্পর্কে আরও কিছু জানতেন তা হলে হয়তো সেই শুভ দিন, শুভ মুহূর্তটিতে পাণ্ডুর গলায় মালা পরাতেন না।

এ বিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধ হবার আগে, আমি পাণ্ডুর জীবনের কয়েকটি পাতা উলটে দেখতে চাই। পাণ্ডু বীর এবং যোদ্ধা ছিলেন। কুম্ভীর মাল্যদানের পর রাজা কুন্তিভোজ উভয়ের বেদবিহিতানুসারে বিয়ে দিলেন। আর দিলেন প্রচুর ধনসম্পত্তি। পাণ্ডু অসংখ্য ধ্বজপতাকা- যুক্ত সৈন্য সমভিব্যহারে হস্তিনায় প্রবেশ করলেন। তার মানে, স্বয়ংবরে যাবার সময়, পাণ্ডু সৈন্য সামন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। এ বিয়ের উৎসবে, হস্তিনার কোনো রাজপুরুষকেই দেখছি না? আবার, তার- পরেই দেখছি ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র সবাই বেশ উৎসাহের সঙ্গে, পাণ্ডুকে আবার রাজা শল্যের ভগ্নি মাদ্রীর বিয়ে দিলেন।

কুন্তী আর মাদ্রীকে বিয়ে করার পরে, পাণ্ডু হস্তিনা প্রাসাদে কতো দিন বাস করেছিলেন? ইতিহাস এখানেও কেমন একটি অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন। কোথাও বল। হয়েছে, কুম্ভীও মাদ্রীকে বিয়ে করার পর, তিনি কিছুকাল হস্তিনায় বাস করেছিলেন। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে, দুই পত্নীসহ পাণ্ডু হস্তিনা প্রাসাদে এক মাস বাস করে- ছিলেন। কিছুকাল আর এক মাস, এক কথা নয়। একমাস বলার মধ্যে কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না। ঠিক মাস গণনা করা কঠিন কিন্তু কালটাই ঠিক। একমাস হতে পারে। মাসাধিককাল হতে পারে। আবার এক মাসের কমও হতে পারে। ঐতিহাসিক ইচ্ছা করেই, এই প্রচ্ছন্নতা বজায় রেখেছেন। আরও একটি প্রশ্ন মনে জাগে। কুন্তীকে বিয়ে করে তিনি হস্তিনা নগরে ফিরলেন। তারপরে বাহীক—অর্থাৎ পাঞ্জাবের দুহিতা মাদ্রীকে বিয়ে করলেন। এ দুই বিষয়ের মধ্যে, কতো দিনের ব্যবধান ছিল, তা কিছুই জানা যায় না। শুধু একটি বিষয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কুন্তী আর মাদ্রীর মতো দুটি যুবতী পত্নীর সঙ্গে, পাণ্ডুর মিলন ঘটে নি। অথবা, যদি ধরেও নিই, মিলন ঘটেছিল, তবু এমন প্রত্যাশা করা যায় না, সেই সময়ের মিলনেই, কুন্তী বা মাদ্রী গর্ভবর্তী হবেনই।

তারপরে দেখছি, পাণ্ডু দুই পত্নীকে রেখে, বহু সৈন্য-সামন্ত নিয়ে দিগ্বিজয়ে বের হলেন। এ যুদ্ধ-যাত্রার প্রয়োজনও ছিল। রাজা শান্তনুর তেমন যুদ্ধাভিযানের সংবাদ ইতিহাসে নেই। ভীষ্মও তেমন যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন নি। কিন্তু আশেপাশের অনেক রাজ্য, কুরুবংশের বেশ ক্ষতি করেছিল। পাণ্ডু যুদ্ধযাত্রা করে, দর্শন দেশ প্রথম জয় করেন। তারপরে মগধ, মিথিলা, কাশী,

সুক্ষ ও পুণ্ড জয় করেন। তা ছাড়াও আরও অনেক দেশ জয় করে, কুরু-বংশের গৌরব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিলেন। এবং রাজ্যগুলো জয় করে যে-সব ধনরত্ন সংগ্রহ করেছিলেন, তা ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, সত্যবর্তী, নিজের মা ও ছোট ভাই বিছুরকে দান করেছিলেন। এ সবই ইতিহাসে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। কিন্তু দিগ্বিজয় করে, বহু অর্থ ধনসম্পত্তি নিয়ে ফিরে এসে, রাজা হিসাবে দেশ শাসন করার পরিবর্তে, দুই পত্নীকে নিয়ে পাণ্ডু হঠাৎ বনে গমন করলেন কেন? ইতিহাস এ বিষয়ে একেবারে নীরব। অথচ, এখন পাণ্ডুর হঠাৎ বনে গমন একেবারেই যুক্তিহীন। অথবা, বুঝতে হবে, হস্তিনা নগরী ও প্রাসাদে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল, পাণ্ডু রাজ্য ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ কারণটি যদি বাদ দিই, তবে কি বুঝবো পাণ্ডু বৈরাগ্যবশতঃই বনবাসে গিয়েছিলেন?

তারপরেই দেখছি, সেই অতি পুরাতন অসার একটি কাহিনী। কিমদ্দক নামে এক ঋষি, বনের মধ্যে হরিণীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত ছিলেন। বলা হয়েছে, হরিণীটি কিমদ্দক ঋষির পত্নী। কোনো নাম নেই। ঋষির কুটিরে যেহেতু জায়গা নেই সেই হেতু জঙ্গলের মধ্যে স্বামী স্ত্রী হরিণের বেশ ধরে রমণে লিপ্ত হয়েছিলেন। আবার সেই অযৌক্তিক কাহিনীর অবতারণা। ভূতের গল্পের মতো, ভূতের নানা প্রাণীর বেশ ধারণ। কিন্তু ভৌতিক কাহিনী আর ইতিহাস এক বস্তু না। কোনো মুনি-ঋষিই কখনও কোনো প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারেন না। তবে পশুমৈথুন সম্ভব হতে পারে। কিমদ্দক হয় তো কোনো হরিণীর সঙ্গে মৈথুনে লিপ্ত হয়েছিলেন। পাণ্ডু মৃগয়ায় বেরিয়ে, সেই অবস্থায় দুজনকেই তীর বিদ্ধ করে হত্যা করেছিলেন।

কিমদ্দক পাণ্ডুকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, পাণ্ডুও যখন স্ত্রী সঙ্গমে লিপ্ত হতে যাবেন, তখন তাঁর মৃত্যু ঘটবে।

ইতিহাসে অভিশাপের ঘটনাগুলোকে ঐশী শক্তির দ্বারা প্রমাণিত করার চেষ্টা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, অভিশাপের মধ্যে কোনো ঐশী শক্তি নেই। অলৌকিকতাও নেই। যা আছে, তা হলো, সেই যুগে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জ্যোতিষী বা অন্য কোনো গুণের প্রভাবে ভবিষ্য- দ্বাণী করতে পারতেন। কিন্তু কিমদ্দক মুনির হরিণ বেশে মৈথুন, পাণ্ডুর মৃগহত্যা, অভিশাপ, সবটাই অবাস্তব বোধহয়। কাহিনীটি আগাগোড়া সাজানো। এবং অবশ্যই তার উদ্দেশ্যও রয়েছে।

পাণ্ডু যখন কুন্তী ও মাদ্রীর মতো দুই হস্তিনীর মধ্যে বিশাল হস্তীর ন্যায় বনে মহানন্দে ভ্রমণ করছিলেন, তখন হস্তিনায় বিদুরের বিয়ে হয়। ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে দাসী বা বৈশ্যা পত্নীর গর্ভে যুযুৎসুর জন্ম হয়। গান্ধারীর গর্ভে দুঃশলা নামে এক কন্যারও জন্ম হয়। হস্তিনা নগরে এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। ধৃতরাষ্ট্রের দাসীর গর্ভে ছেলে হলো। গান্ধার প্রসব করলেন এক কন্যা। আর হস্তীর ন্যায় বিশাল তেজস্বীপুরুষ পাণ্ডু দুই পত্নীর গর্ভে একটি সন্তান উৎপাদন করতে পারলেন না? যদি দেখতাম, এসব ঘটনা ঘটবার আগেই, কিমদ্দক মুনির অভিশাপের ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে, তা হলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু যুযুৎসু আর দুঃশলার জন্মও বিছরের বিয়ের পরে, অভিশাপের ঘটনাটি ঘটলো।

প্রকৃতপক্ষে অভিশাপের ঘটনাটি হয় প্রক্ষিপ্ত। অন্যথায় স্বয়ং ব্যাস দেব কুরুবংশের রাজাকে ক্লীব দেখাতে চান নি বলেই এরকম একটি কাহিনীর অবতারণা করেছে। কোনো সন্দেহ নেই, পাণ্ডু যতোই বলশালী পুরুষ হোন, তিনি ছিলেন অসুস্থ। কেবল মৃত শুক্রের ধারক ছিলেন না। তাঁর এমন কোনো ব্যাধি ছিল, যে ব্যাধির কারণে নারী সঙ্গমে লিপ্ত হলেই, মৃত্যু ছিল অবধারিত। অভিশপ্ত হবার আগে দুই পত্নীকে গর্ভবতী করার মতো সময় তিনি অনেক পেয়েছিলেন। কিন্তু পারেন নি। ইতিহাস অলক্ষ্য থেকে, নীরবেই তার প্রমাণ দিচ্ছে। ভবিষ্যতে কুন্তীর, শ্বশুরকুলের লাঞ্ছনার কথাতেই তার প্রমাণ রয়েছে। শ্বশুরকুলের লাঞ্ছনা বলতে তিনি ভীষ্মকে, বেদব্যাসকে, যুদ্ধ বা দ্রৌপদী লাঞ্ছনার জন্য দায়ী করেন নি। শ্বশুরকুলের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রকেও ধরা হয়েছে।

কুন্তী বিয়ের পর, হস্তিনা নগরের প্রাসাদেই পাণ্ডুর অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি স্বয়ংবর সভায় যে-বীর পুরুষকে মাল্যদান করেছিলেন, স্বভাবতই তাঁর প্রত্যাশা ছিল, স্বামী সহ- বাসের দ্বারা অচিরাৎ সুখী হবেন। তাঁর কন্যকাবস্থার পুত্রকে যেহেতু নিজে লালন-পালন করতে পারেন নি, সেই হেতু তিনি স্বাভাবিক কারণেই, দেহে মনে অতি পুত্রার্থিনী হয়েছিলন। অথচ সেই প্রত্যাশিত মিলন ঘটেনি। তারপরেই আবার মাদ্রীর সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা তাঁকে অবাক করেছিল। দুঃখও দিয়েছিল। ভেবেছিলেন, বাহীক কন্যা, মাদ্রীকেই হয়তো মহারাজ বেশি পচ্ছন্দ করেন। কিন্তু কুন্তী দেখেছিলেন পাণ্ডু মাদ্রীর সঙ্গেও সহবাসে লিপ্ত হন নি। পাণ্ডু যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। ফিরে এসে, হস্তিনা ত্যাগ করে বনে গমন।

কুন্তী বনবাসকালেই প্রথম নিশ্চিত বুঝতে পারলেন, বাইরে থেকে যে-পুরুষকে তিনি সূর্যসম উজ্জ্বল বলশালী দেখিয়ে ছিলেন, প্ৰকৃত- পক্ষে তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। মৃগয়ায় গিয়ে যিনি অক্লেশে ব্যাঘ্র সিংহ হত্যা করেন, সেই তিনি স্ত্রী সহবাসে অক্ষম। “শ্বশুরের দ্বারাও লাঞ্ছিত হয়েছি” কুম্ভীর এই কথার একটিই অর্থ হয়। ভীষ্ম বেদব্যাস, এমন কি তাঁর ভাসুর ধৃতরাষ্ট্রও জানতেন, পাণ্ডুর বিবাহ অনুচিত। তাঁর স্ত্রী গ্রহণ করা নিষ্ফল হবে। এসব জেনেও তাঁরা পাণ্ডুকে কুন্তীর স্বয়ংবর সভায় যেতে নিষেধ করেন নি। উপরন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শল্য-ভগ্নী মাদ্রীরও ক্ষতি করেছিলেন।

পাণ্ডুর সঙ্গে বনবাসকালে, কুন্তী মাদ্রী প্রকৃতপক্ষে বৈধব্য জীবন যাপন করেছিলেন। আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি; কিমদ্দকের ঘটনা একটি কল্পিত অবাস্তব কাহিনী মাত্র। পাণ্ডু কুন্তীর কাছে সত্য প্রকাশে বাধ্য হলেন। তিনি কুন্তীকে বললেন, “মহারানী আমি আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতোই জন্ম থেকে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হলে আমার মৃত্যু অনিবার্য। আমি বুথাই বীরত্ব প্রদর্শন করি। এখন থেকে আমি সাত্ত্বিক জীবন-যাপন করবো। আমি আমার সমস্ত রাজপোশাক হস্তিনায় পাঠিয়ে দেবো। তোমাদের নিয়ে শতশৃঙ্গ পর্বতে গিয়ে তপস্যায় রত হবো। তবে তোমাদের আমি আমার সঙ্গে, আমার মতো জীবন-যাপন করতে দিতে চাই না।”

পাণ্ডুর শেষের কথাটি যে কুম্ভী মানবেন না, তা জানাই ছিল। কুন্তী তাঁর দুঃখের কারণসমূহ সকলই অবগত হয়েছিলেন। এবং পাণ্ডুকে বলেছিলেন, “আমি ও মাদ্রী, আপনার সঙ্গে, আপনার মতোই জীবন-যাপন করবো। আমরাও আপনার মতো তপস্যায় নিরত হবো। ব্রহ্মচর্য পালন করবো।”

পাণ্ডুর যে-ব্যাধিই থাক, তথাপি তিনি ছিলেন কুরুবংশের রাজা পথা তিনিই কি বৈরাগ্য নিয়েই, দুই পত্নীসহ হস্তিনা ত্যাগ করে বনে গমন করেছিলেন? না কি আরও গভীর কোনো কারণ ছিল। থাকাই স্বাভাবিক। তিনি জানতেন, তাঁর কোনো সন্তানাদি হবেনা। হস্তিনায় থেকে, তাঁকে দেখতে হবে, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র কুরু সিংহাসনে বসবে। তার চেয়ে পত্নীদের নিয়ে বনগমন শ্রেয়ঃ। সেখানেই তাঁকে ভাবতে হবে, ভবিষ্যতের জন্য কী করা যায়। অথবা, তিনি তখনই ক্ষেত্রজ সন্তানের কথা ভেবেছিলেন। হস্তিনায় থেকে, ক্ষেত্রজ সন্তান পাওয়া তাঁর পক্ষে নিশ্চয়ই কঠিন ছিল। আর কেউ বাধা না দিলেও, ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর সঙ্গীরা বাধা দিতেন। কেন না, ইতিহাসে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, কুন্তী ও মাদ্রীর পরে, আর কোনো রানীই ক্ষেত্রজ সন্তানের জন্ম দেন নি। এর একটাই কারণ। সমাজে সেই সময়ে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অতএব, হস্তিনায় থাকলে, পাণ্ডু ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করতে পারতেন না। অথচ, তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন, তাঁর ক্ষেত্রজ পুত্ররা, তাঁর নামে সিংহাসনের দাবীদার হবে। রাজা হবে।

ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্য শতশৃঙ্গ পর্বতে যেতে হলো কেন?

শতশৃঙ্গ পর্বতে অনেক মুনি ঋষিগণ তপস্যা করতেন। পাণ্ডু তাঁদের সহায়তা চেয়েছিলেন। সেই সব মুনি ঋষিরা যেন ক্ষেত্রজ পুত্রোৎ- পাদনের সম্মতি দেন, এটাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁদের সঙ্গে পাণ্ডুর বিশেষ হৃদ্যতা জন্মালো। তাঁরা পাণ্ডুর মনোগত বাসনার কথা জেনে, বললেন, “যার পুত্র নেই, তিনি পিতৃঋণে আবদ্ধ থাকেন। অতএব পিতৃঋণ পরিশোধের জন্য তাঁর পুত্রোৎপাদন অবশ্য কর্তব্য। পিতৃঋণ অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু পাত্রর নিজের পক্ষে যখন পুত্রোৎপাদন সম্ভব না, তিনি প্রাচীন মতানুসারে ক্ষেত্রজ পুত্র লাভ করতে পারেন। ব্রাক্ষণরা যখন এই নিদান দিলেন, তখন পাণ্ডুর মনে আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলো না। তিনি প্ৰথম অনুরোধ নিয়ে কুন্তীর কাছে গেলেন।

কুন্তী কানীন পুত্রের জননী। তিনি জানতেন, সমাজে সেটি একটি গর্হিত অন্যায় কাজ, সেই কারণে তিনি পুত্র স্নেহ থেকে বঞ্চিত। ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনও অরুচিত। কুম্ভী প্রথমে বললেন, “মহারাজ, আপনি আমার সঙ্গেই সহবাসে লিপ্ত হোন। আপনার সঙ্গে আমিও স্বর্গে যাবো।”

বস্তুতপক্ষে এ কথা কুন্তী আদৌ বলতেই পারেন না। পুত্র লাভের জন্য, স্বামী প্রাণ হারাবেন, তিনি তা কখনও চান নি। বরং তিনি বহু পূর্বের কুরু বংশেরই রাজা ব্যুষিতাশ্বের জীবনের ঘটনা বলে – ছিলেন। ব্যুষিতাশ্ব আপন শক্তিতে বিশাল রাজ্য সৃষ্টি করেছে, সহসা অপুত্রক অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। তাঁর মহিষী ভদ্র! প্রাণত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আকাশবাণী শুনে- ছিলেন, ব্যুষিতাশ্ব বলেছিলেন, তিনি স্বয়ং তাঁর শবদেহে আবির্ভূত হয়ে, স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করবেন।

ব্যুষিতাশ্ব ভদ্রার গর্ভে তিনজন শাল্ব ও চারজন মদ্রের জন্ম দিয়ে- ছিলেন। কুন্তী এই কাহিনী শুনিয়ে, পাণ্ডুকে বললেন, “আপনি এভাবে আমার গর্ভে পুত্রোৎপাদন করে, আমার সতীত্ব রক্ষা করুন।”

পাণ্ডু জানতেন,ঘটনাটি অবাস্তব। অতএব, তিনি কুন্তীকে বোঝাবার জন্য বললেন, “রাজা ব্যুষিতাশ্ব ছিলেন দেবতুল্য মানুষ। তিনি যা পারতেন, আমি তা পারি না।” এই বলে তিনি কুন্তীকে সংহিতা যুগের কথা শোনালেন, নারী পুরুষ যদৃচ্ছা স্ব স্ব জাতিতে মিলিত হলে কোনো দোষ হতো না। উত্তর কুরুতে (সাইবেরিয়ায়) এখনও সে ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। তিনি তখন তাঁর নিজের জন্মের কথাও শোনালেন।

কুম্ভী শেষ পর্যন্ত সম্মত হলেন। শুধু সম্মত হলেন না। কুমারী অবস্থায়, দুর্বাসার সেবার জন্য তিনি যে বর হিসেবে বিশেষ মন্ত্র- প্রাপ্ত হয়ে, যে-কোনো দেবতাকে ডেকে নিজের অভিলাষ পূরণ করতে পারেন, সে-কথাও বলতে ভুললেন না। কিন্তু কর্ণের জন্মের কথা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করলেন না। জীবনে কোনো কালেই স্বামীর কাছে তিনি তা প্রকাশ করেন নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *