পৃথা ও চন্দ্র দেবতা
একটা কী যেন মন্ত্র জানলে আকাশের দেবতাদের ডাকা যায়। পৃথার সেই মন্ত্রটা খুব শিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কে শেখাবে? আগেকার দিনে মুনি—ঋষিদের অনেক ক্ষমতা ছিল। তাঁরা মন্ত্রবলে অদৃশ হয়ে যেতেন, রেগে গেলে কোনও মানুষকে অভিশাপ দিয়ে সাপ কিংবা ব্যাঙ বানিয়ে দিতেন।
এখনকার দিনে তো আর মুনি—ঋষি নেই, আছেন সাধু—সন্ন্যাসী, তাঁদের এরকম ক্ষমতা আছে কি? বাবাকে জিজ্ঞেস করলে হাসতে হাসতে বলেন, ‘ধুৎ, ওসব গল্প! কোনওকালেই অদৃশ্য হবার ক্ষমতা মুনি—ঋষিদের ছিল না।’
আর মা বলেন, ‘হ্যাঁ, আসল মুনি—ঋষি এখনও আছেন, তাঁরা হিমালয়ের খুব দুর্গম গুহায় বসে সাধনা করেন। শহরের মানুষদের কাছে আসেন না। হিমালয় থেকে নেমে যদি কেউ মানুষের মধ্যে আসেন, অমনই তাঁর ক্ষমতা কমে যায়। মন্ত্র—টন্ত্র কিছুই মনে থাকে না।’
পৃথা চায় হিমালয়ে গিয়ে সেইরকম একজন খাঁটি মুনিকে খুঁজে বার করতে। গত বছর বাবা—মায়ের সঙ্গে সে লছমনঝোলা বেড়াতে গিয়েছিল। সে—ও তো হিমালয়, কিন্তু সেখানে অনেক বাড়িঘর আছে। সেখানে লম্বা লম্বা দাড়িওয়ালা অনেক সাধুর দেখা পাওয়া গিয়েছিল বটে, কিন্তু তাঁরাও কেউ মুনি নন।
আরও অনেক উঁচুতে, পাহাড়ের কোন নির্জন গুহায় সেই আসল মুনিরা থাকেন কে জানে! পৃথার বয়েস মাত্র এগারো বছর, তাকে তো কেউ আর একা—একা যেতে দেবে না?
এক ঋষি পাণ্ডবদের মা কুন্তীকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন, কুন্তী যে—কোনও দেবতাকে ডাকতে পারতেন। একদিন সত্যি সত্যি তিনি সূর্য দেবতাকে ডেকেছিলেন।
পৃথার নামটা রেখেছিলেন তার ঠাকুমা। ঠাকুমা বেথুন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন, খুব লেখাপড়া জানতেন। রিটায়ার করার পর ঠাকুমা এ পাড়ায় মেয়েদের একটা ক্লাব করেছিলেন। ইস, ঠাকুমা কেন যে হঠাৎ মরে গেলেন, ঠাকুমা ছিলেন পৃথার খুব বন্ধু, ঠাকুমার আরও অনেকদিন বেঁচে থাকা উচিত ছিল।
ঠাকুমার কাছ থেকেই পৃথা মহাভারতের গল্প শুনেছে। তারপর বইও পড়েছে অনেকবার। কুন্তীর আর—এক নাম ছিল পৃথা, এটা জানার পরই পৃথার সেই মন্ত্রটা শেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। সেকালের কুন্তী যা পারেন, একালের পৃথা কেন তা পারবে না?
পৃথা অবশ্য সূর্যদেবতাকে ডাকতে চায় না।
বাবা রে! অতদূরে সূর্য, তাতেই দুপুরবেলা গরমের চোটে অস্থির! কাছে এলে কী হবে? কুন্তী সহ্য করেছিলেন কী করে?
পৃথা চায় চাঁদের সঙ্গে একবার দেখা করতে। চাঁদ একজন অল্পবয়সী দেবতা, তার গা থেকে জ্যোৎস্না ফুটে বেরোয়, তা কী সুন্দর ঠাণ্ডা আর স্নিগ্ধ। সূর্য সম্পর্কে ভয় কিংবা ভক্তি কিংবা শ্রদ্ধা করতে পারে, কিন্তু চাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো যায়।
চাঁদ কি সত্যিই দেবতা নাকি? পৃথার বন্ধুরা শুনলে হাসবে। আহা, পৃথাও যেন জানে না! সে বুঝি ভূগোল পড়েনি? চাঁদ তো একটা উপগ্রহ, পৃথিবীকে গোল করে বাঁই—বাঁই করে ঘুরছে। ছবিতে সে দেখেছিল, নিল আর্মস্ট্রং প্রথম মানুষ যিনি চাঁদে নেমে হেঁটে বেড়িয়েছেন। চাঁদের মাটি চকচক করে না, সেখানে শুধু রুক্ষ পাথুরে জমি। চাঁদের পাথরের কত টুকরোও তো পৃথিবীতে আনা হয়েছে।
পৃথা সব জানে।
তবু পূর্ণিমার রাতে ছাদে উঠে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পৃথার মনে হয়, বৈজ্ঞানিকেরা কি সত্যি—সত্যি সব জেনে ফেলেছেন? আকাশের কোথাও দেবতারা থাকেন না?
পৃথার বাবা একটা চিনির কলের ম্যানেজার। সেইজন্য ওরা এখন বীরভূমের আমোদপুর থাকে। ম্যানেজারের বাংলোটা মস্ত বড়, সামনের দিকে অনেকখানি বাগান, পেছন দিকে একটা বড় পুকুর, তার ওধারে নানারকমের গাছপালা, একটা জঙ্গলের মতন মনে হয়। পৃথার কোনও ভাই—বোন নেই, সে পুকুরের ওপাশটায় জঙ্গলের ধারে বসে থাকতে ভালবাসে। এখন অবশ্য গ্রীষ্মের ছুটি, আবার স্কুল খুললেই পৃথাকে চলে যেতে হবে শান্তিনিকেতনের হস্টেলে।
সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকার উপায় নেই, মা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে, এর মধ্যে একদিন, মা আর বাবাকে সিউড়ি যেতে হল ডি.এম সাহেবের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে। মা পৃথাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, পৃথা কিছুতেই রাজি হয়নি। অফিসারদের বাড়ির নেমন্তন্নগুলো বড্ড একঘেয়ে হয়। সবাই খালি কথা বলে আর কথা বলে। রাত্তির এগারোটার আগে খাবার দেয় না।
পৃথা গেল না। বাংলোতে কাজের লোক আছে পাঁচ—ছ’জন। টিভি আছে। ইচ্ছে করলে পৃথা ভি সি আর—এ সিনেমা দেখতে পারে।
মা—বাবা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতেই পৃথা চলে এল পুকুরধারে। ঘরের মধ্যে বসে থাকার চেয়ে গাছপালার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে তার ভাল লাগে। গ্রীষ্মকালের সন্ধেবেলা কত রকম ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। বড়—বড় তিনটে ইউক্যালিপটাসের গাছ থেকে পাতা খসে পড়ছে অনবরত। কী সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে।
বাগানটা জ্যোৎস্নায় সাদা হয়ে আছে। আজ পূর্ণিমা নাকি? আকাশের দিকে তাকিয়েই দেখা গেল বেশ একখানা হলদে রঙের চাঁদ সারা আকাশ আলোকময় করে আছে। হ্যাঁ, এক—একদিন চাঁদের রং হলদে তো হয়ই। কোনও—কোনওদিন কিছুটা নীল বা লালচে ধরনেরও হয়। অনেকের ধারণা, চাঁদের রং বুঝি রুপোর মতন। কিন্তু পৃথা নিজের চোখে নীলচে আর লালচে চাঁদ দেখেছে।
আজকের চাঁদের রং হলুদ। ঠিক সোনার মতন বলা যায় না, অনেকটা যেন চাঁপা ফুলের মতন। চাঁদের চোখ নেই, চাঁদ তো পৃথিবীরই একটা টুকরো। সেখানে শুধু পাথর। তবু কেন মনে হয়, চাঁদ চেয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। খুব একজন ভাল লোক তাকিয়ে থাকলে যেমন লাগে, সেইরকম লাগছে পৃথার।
পৃথিবীতে এত মানুষ, তবু চাঁদ শুধু পৃথার দিকেই তাকাবে কেন? ঠাকুর—দেবতাদের এইটাই তো বিশেষত্ব। দুর্গাপুজোর সময় দুর্গাঠাকুরের মুখের দিকে যে তাকায়, তারই মনে হয়, দুর্গা যেন তার দিকেই চোখ রেখেছেন। পৃথা একবার ডান দিকের এক কোণে গিয়ে দেখেছে, সেখানেও দুর্গাঠাকুর তাকে দেখছেন, আবার একেবারে বাঁ দিকে গিয়েও দেখেছে, দুর্গাঠাকুরের মূর্তি যেন মুখ ফিরিয়েছেন বাঁ দিকে।
চাঁদ পৃথাকে দেখছে, একেবারে সত্যি বলে মনে হয়।
পৃথা পুকুরের ধারে গিয়ে দেখল, সেখানেও জলের মধ্যে আর—একটা চাঁদ।
এই চাঁদ কিন্তু স্থির নয়, দুলছে একটু একটু।
পৃথা সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। জলের মধ্যে চাঁদ সে আগে দেখেনি। এই পৃথিবীতে কত পুকুর, খাল, নদী, সমুদ্র আছে, সব জায়গার জলেই কি চাঁদের এমন ছায়া পড়ে?
পৃথার মনে হচ্ছে যেন আকাশের চাঁদের একমাত্র ছায়া পড়েছে শুধু তাদের পুকুরে।
মনের মধ্যে একই সঙ্গে বিশ্বাস আর অবিশ্বাস পাশাপাশি। পৃথা জানে, চাঁদ কোনও দেবতা নয়, তার চোখ থাকতে পারে না। তবু পৃথার এখন মনে হচ্ছে, চাঁদ চেয়ে আছে তার দিকে।
শুধু তাই নয়, চাঁদ যেন কিছু বলতে চাইছে পৃথাকে। জলের মধ্যে সেইজন্য দুলছে।
বাতাসে জল কাঁপে, সেইজন্য চাঁদের ছায়াও দোলে, এ তো সবাই জানে।
চাঁদ দুলছে, চাঁদ দুলছে। কী যেন বলতে চায়। পৃথাকে বলতে চায়।
হঠাৎ পৃথার সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগল। কী যেন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটছে। বাতাস থেমে গেছে, কোনও গাছের পাতা নড়ছে না। কোথাও কোন শব্দ নেই। চিনিকলে একটা পাম্পের শব্দ সব সময় শোনা যায়। সে শব্দটাও থেমে গেল কী করে। সমস্ত পৃথিবী একেবারে নিস্তব্ধ।
পুকুরের জলে কোনও তরঙ্গ নেই। তবু দুলছে চাঁদ।
কে যেন খুব কাছ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘পৃথা, তুমি ওর জন্যে একটু কাঁদবে?’
পৃথা চমকে তাকাল এদিক—ওদিক। কেউ নেই। কে কথা বললো?
পৃথা আকাশের দিকে তাকাল, আকাশের চাঁদ এক দৃষ্টিতে দেখছে তাকে।
কার জন্য কাঁদবে পৃথা? হঠাৎ এরকম একটা শোনা গেল কেন?
পরের মুহূর্তেই বদলে গেল সব কিছু।
সেই বাংলোর বাগান, পুকুর, কিছুই রইল না। পৃথা দেখল, সে দাঁড়িয়ে আছে একটা পাহাড়ের গুহার মুখে। চারদিকে এবড়ো খেবড়ো পাথর, কিন্তু গুহার ভেতরটা লাল মখমলে ঢাকা। বেশ লম্বা একটা সুড়ঙ্গের মতন, তার ওপাশে একটা ঘরের মতন দেখা যাচ্ছে।
সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলেন একজন ঋষি। ছবিতে যেমন দেখা যায়, মাথায় জটা, মুখে ধপধপে সাদা লম্বা দাড়ি, জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটি।
ঋষি বললেন, ‘এসো’—’
পৃথা ভাবল, এটা কি হিমালয়ের গুহা নাকি? কিন্তু পৃথা সেখানে এল কী করে? সে তো ঘুমিয়েও পড়েনি। পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে নড়েনি এক পা—ও। দাঁড়িয়ে—দাঁড়িয়ে কেউ ঘুমোয় না।
ঋষি ঠিক তার মনের কথা বুঝতে পারলেন। একটু হেসে তিনি বললেন, ‘তুমি দাঁড়িয়ে আছ চাঁদের মাটিতে। মন্ত্র দিয়ে তোমাকে নিয়ে আসা হয়েছে।’
পৃথার বিশ্বাস হল না, মন্ত্রটন্ত্র আবার সত্যি হয় নাকি? মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে এমনি—এমনি পৃথিবীর বাইরে আসা যায়? মহাকাশ—যাত্রার জন্য একটা পেল্লায় জবরজং পোশাক পরতে হয়।
অবিশ্বাস করলেও পৃথার ভয় হল। যেমন, যারা ভূতে বিশ্বাস করে না, তারাও কিন্তু বেশি রাত্তিরে একলা কোনও পুরনো বাড়িতে থাকলে ভূতের ভয় পায়।
পৃথা ভাবল, যদি সত্যি এটা চাঁদ হয়? না, না, সে তো কখনও চাঁদে আসতে চায়নি? চন্দ্রদেবতাকে পৃথিবীতে ডাকার ইচ্ছে হয়েছিল শুধু। সে ইচ্ছের কথাও তো কাউকে বলেনি সে!
পৃথা বলল,’যদি এটা চাঁদ হয়, তা হলে আমি এখানে থাকব না, ফিরে যাব।’
ঋষি আবার বললেন, ‘এসো।’
পৃথা এমনিই বাধ্য মেয়ের মতন হাঁটতে লাগল তাঁর পেছন—পেছন।
সুড়ঙ্গের শেষে একটা ঘর, পাশের দিকে একটা খোলা বারান্দা মতন। সেই বারান্দায় বসে একটি বেশ সুন্দর মতন বৃদ্ধা এক মনে চরকা কেটে চলেছেন।
পৃথার বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল। বৃদ্ধাকে দেখতে যে অবিকল তার ঠাকুমার মতন। মৃত্যুর পর ঠাকুমাকে তো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল! সবাই বলে, ঠাকুমা স্বর্গে গেছেন। চাঁদটা কি স্বর্গ নাকি? যাঃ, তা হতেই পারে না। নিল আর্মস্ট্রং কিংবা তাঁর পরের অনেক মহাকাশচারী এখানে এসেছেন, তাঁরা দেবদেবী কিংবা মানুষজন কিছুই দেখতে পাননি!
ঠাকুমার মতন সেই বৃদ্ধা মুখ ফিরিয়ে একবার পৃথার দিকে তাকালেন। পৃথাকে চিনতে পারার কোনও ভাব ফুটে উঠল না তাঁর মুখে। অথচ অবিকল ঠাকুমার মতন মুখ, থুতনিতে সেই একটা আঁচিল।
একটা কথাও না বলে সেই বৃদ্ধা আবার চরকায় সুতো বানানোতে মন দিলেন। তাঁর এক হাতে বরফের মতন ধপধপে সাদা তুলো।
ঘরের মধ্যে খাটে শুয়ে আছে এক যুবা পুরুষ। বেশ লম্বা আর ছিপছিপে। ফরসা রং, টিকলো নাক, মাথার চুল কোঁকড়া, অনেকটা পৃথার ইস্কুলের বন্ধু অনিতার ছোড়দার মতন। অনিতার ছোড়দা রণেন দারুণ ক্রিকেট খেলে।
অনেকটা রণেনের মতন হলেও রণেন নয়। তা তো বোঝাই যাচ্ছে। রণেন তো আর মারা যায়নি। তা ছাড়া এই ছেলেটি রণেনের চেয়ে বেশি ফরসা। সে চোখ বুজে আছে। ধুতির ওপর ফতুয়া ধরনের একটা ঝকঝকে জামা গায়।
সেই ঋষি ডাকলেন, ‘চন্দ্র, চন্দ্র, এবার দ্যাখো!’
ছেলেটি চোখ মেলেই কাতরভাবে বলল, ‘এসেছে? এসেছে?’
‘এই তো তোমার সামনে, দেখতে পাচ্ছ না?’
পৃথা ভাবল, ‘ঋষি একে চন্দ্র বলে ডাকলেন কেন? এই কি চন্দ্রদেবতা নাকি?’
বাবা যে বলেন, দেবতা—টেবতা কিছু নেই, ওসব গল্প!
চন্দ্র নামের ছেলেটি বলল, ‘এতক্ষণ তো আমি ওকেই দেখছিলাম। একটা পুকুরের ধারে দাঁড়িয়েছিল, তা হলে ও সত্যি এসেছে?’
ঋষি বললেন, ‘আমার মন্ত্র কি মিথ্যে হতে পারে?’
তারপর তিনি পৃথার দিকে ফিরে বললেন, ‘ওকে আমি একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছি। সেই মন্ত্রের জোরে পৃথিবীর যে—কোনও মানুষকে ও ডাকলে সেই মানুষ তৎক্ষণাৎ এখানে এসে উপস্থিত হবে। তাই তুমি এসেছ।’
পৃথা বলল, ‘আমি এখানে থাকব না। আমাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিন।’ ঋষি বললেন, ‘তোমার বয়েস এগারো বছর তিন মাস উনিশ দিন। তোমার একদিনও বয়েস বাড়বে না।’
চন্দ্র নামে সেই ছেলেটি বলল, ‘আমার খুব অসুখ।’
ঋষি বললেন, ‘আহা, ওর বড্ড অসুখ গো!’
পৃথা দিশেহারা হয়ে গেল। এসব কথার মানে কী? এই ছেলেটি যদি দেবতা হয়, তা হলে দেবতারা মন্ত্র পড়ে মানুষকে ডাকেন? এ যে সব উলটো হয়ে গেল। সে যা—ই হোক। পৃথা এখন ফিরতে চায়। চাঁদ হোক আর যে—জায়গাই হোক, তাকে ফিরতেই হবে বাড়িতে। বাবা—মা একটু বাদেই ফিরে আসবেন সিউড়ি থেকে। তখন যদি পৃথাকে না দেখতে পান—।
ঋষি বললেন, ‘ওর খুব অসুখ। তুমি ওর জন্য একটু কাঁদবে?’
চন্দ্র নামের ছেলেটি বলল, ‘আমার খুব অসুখ, তুমি আমার জন্য একটু কাঁদবে? তুমি না কাঁদলে আমার অসুখ সারবে না।’
ঋষি বললেন, ‘জানো তো, দেবতারা কাঁদতে জানে না। ও বেচারাদের চোখের জল পড়ে না। কিন্তু কোনও কন্যার চোখের জলের ফোঁটা ওর মুখে না পড়লে ওর অসুখ সারবে না। তুমি ওর জন্য দু’ফোঁটা দোখের জল ফেলতে পারবে না?’
পৃথা বলল, ‘ইচ্ছে করলেই কি কাঁদা যায় নাকি? আমার তো এখন কান্না পাচ্ছে না।’
ঋষি। বললেন, ‘তোমাকে তো বেশিক্ষণ ধরে রাখা যাবে না। মন্ত্রের জোর বেশিক্ষণ খাটে না। একটু কাঁদো, লক্ষ্মীটি।’
চন্দ্র নামের ছেলেটি হাতজোড় করে বলল, ‘আমার অসুখ তুমি সারিয়ে দাও, আমার জন্য কয়েক ফোঁটা চোখের জল দাও।’
পৃথার সারা শরীর কাঁপছে। ঋষি বললেন, ‘আর বেশি সময় নেই, আর বেশি সময় নেই, ও চলে যাবে। ওগো মেয়ে, এখনও ভেবে দ্যাখো—।’
পৃথার তখনই মনে পড়ল ববি নামে ওদের কুকুরটার কথা। সাদা ফুটফুটে একটা উলের বলের মতন দেখতে ছিল ববি। পৃথার আদরের ববি। গত সপ্তাহে সে একটা মোটর সাইকেলে চাপা পড়ে—।
পৃথা অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ববি’ অমনই চোখের জলের ধারা গড়িয়ে এল তার গাল বেয়ে।
চন্দ্র নামের ছেলেটি ব্যাকুলভাবে বলল, ‘দাও, দাও আমাকে দাও—।’
আর—একটা ঝাঁকুনি লাগল পৃথার শরীরে। আবার মিলিয়ে গেল সব কিছু।
সেই বাংলোর বাগানের পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে পৃথা। সে ঘুমিয়ে পড়েনি। একটু আগে সে একটা ইউক্যালিপটাসের পাতা কুড়িয়ে নিয়েছিল, সেটা তার হাতেই রয়েছে। কিন্তু পৃথার চোখ দিয়ে এখনও জল পড়ছে। এখন আর সে ববির কথা ভেবে কাঁদছে না। চন্দ্র নামে ছেলেটির অসুখের জন্য—।
চিনিকলের পাম্পের শব্দ শোনা যাচ্ছে আবার। বাতাসে কাঁপছে গাছগাছালির পাতা। পুকুরে দুলছে চাঁদের ছায়া।
পৃথা আকাশের দিকে তাকাল। এখনও চাঁদ চেয়ে আছে তার দিকে। যেন বলছে, আবার দেখা হবে। আবার দেখা হবে!