পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন যাঁরা দেখেছিলেন

পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন যাঁরা দেখেছিলেন

মনে রাখা দরকার, জিন্না স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রচনা করেননি। এই বিষয়ে কোনো তত্ত্বগত আলোচনাও তিনি শুরু করেননি। কবি ইকবাল, কেমব্রিজ গ্রুপ ও ড. সৈয়দ আবদুল লতিফ তাঁর মাথায় এই চিন্তা ঢুকিয়ে দেন। তারপর তিনি সুদক্ষ আইনজীবি ও রাজনীতিবিদের মতো পাকিস্তান দাবির সপক্ষে মুসলিম লিগকে সংগঠিত করেন এবং আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর এলাহাবাদে সারাভারত মুসলিম লিগের বাৎসরিক অধিবেশনে কবি ইকবাল সভাপতির ভাষণে ভারতের মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং তাঁদের স্বার্থ রক্ষার্থে একটি পরিকল্পনা রচনা করেন। পরবর্তীকালে এই পরিকল্পনাকে ভিত্তি করেই ভারত বিভাগের চিন্তাধারা বিকশিত হয়। তিনি বলেন, সবদিক থেকেই ভারতের মুসলমানদের একটি পৃথক সত্তা আছে। ইসলামের মূল নীতি ও নির্দেশ তাঁদের পরিচালনা করছে, আর তাকে ভিত্তি করেই তাঁরা ভারতে একটি সুনির্দিষ্ট জনসমষ্টিতে পরিণত হয়েছেন। কবি ইকবাল তাঁর ভাষণে বলেন:

It can not be denied that Islam, regarded as an ethical ideal plus a certain kind of polity—by which expression I mean a social structure, regulated by a legal system and animated by a specific ethical ideal—has been the chief formative factor in the life-history of the Muslims of India. It has furnished those basic emotions and loyalties which gradually unify scatterd individuals and groups, and finally transform them into a well-defined people, possessing a moral consciousness of their own… Is it possible to retain Islam as an ethical ideal and to reject it as a polity in favour of national polities in which the religious attitude is not permitted to play any part? This question becomes of special importance in India where the Muslims happen to be in a minority.

এই প্রশ্নের উত্তরে ইকবাল বলেন, মুসলমানেরা ইসলামের মূল নীতির প্রতি অনুগত থাকবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ব্যক্তির ও রাষ্ট্রের জীবনে ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ইসলামের আদর্শ তার সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জাতীয় ভিত্তিতে যদি এমন কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় যেখানে ইসলামের নীতিসমূহ স্থানচ্যুত হবার সম্ভাবনা আছে, তা একজন মুসলমানের পক্ষে কোনো মতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ইকবাল বলেন:

The religious ideal of Islam, therefore, is organically related to the social order which it has created. The rejection of the one will eventually involve the rejection of the other. Therefore the construction of a polity on national lines if it means a displacement of the Islamic principle of solidarity, is simply unthinkable to a Muslim. This is a matter which at the present moment directly concerns the Muslims of India.

তিনি বলেন, ভারতের মুসলমানেরা যদি তাঁদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী অবাধে বসবাস করার অধিকার না পান তাহলে ভারতের মতো দেশে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। এই মনোভাবকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা বলা উচিত নয়। এই নীতি স্বীকৃত হলেই মুসলমানেরা ভারতের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব পণ করতে প্রস্তুত থাকবেন।

জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ইকবালের যে মতবাদ ছিল তাতে আর্নস্ট রেনানের (Ernst Renan) প্রভাব দেখা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে রেনান লিখেছিলেন যে, একটি জাতি গঠনে ধর্ম ও ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ইকবালও এই মতে বিশ্বাসী হন এবং ভারতীয় পরিবেশে রেনানের যুক্তি প্রয়োগ করে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি করেন। এই মানদণ্ড অনুযায়ী ভারতের মুসলমানেরা একটি পৃথক জাতি। ইকবাল বলেন : ‘Muslim India constituted a nation by itself.’ যে মানসিক গড়নকে ভিত্তি করে একটি জাতি গঠিত হয় তা ভারতে একেবারেই অনুপস্থিত। আকবর অথবা কবির হয়তো এই পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন, যদি তাঁরা অগণিত মানুষকে অনুপ্রাণিত করার ব্যাপারে সাফল্যলাভ করতেন। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ ও জাতিভেদপ্রথার উপরে গড়ে ওঠা হিন্দু সমাজ তাঁদের পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে। ভারতের অসংখ্য জাতি ও ধর্মের গ্রুপগুলি নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব সম্পর্কে এতটা সচেতন যে তারা নিজেদের অস্তিত্ব বৃহৎ ভারতীয় ঐক্যের প্রয়োজনেও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নয়। ইকবালের মতে, এই বৈচিত্র্য ও অনৈক্য মেনে নিয়েই পরস্পরের সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতের জাতীয় ঐক্য সম্পাদন করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে এই মুল ঘটনাকে স্বীকার করার ও এই দিকে সফল পদক্ষেপের উপরই ভারত ও এশিয়ার ভাগ্য নির্ভর করছে। কারণ ভারতকে এশিয়ার একটি সংস্করণ বলা চলে (ইকবালের ভাষায় ‘India is Asia in miniature.’)। হিন্দুদের সঙ্গে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাতিসমূহের সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিল। অন্যদিকে মুসলমানদের যোগ ছিল মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার জাতিসমূহের সঙ্গে। সুতরাং ইকবাল মনে করেন, ভারতে যদি এই দুটি সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি স্থাপন করা যায় তাহলে এশিয়ার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করেন:

If an effective principle of cooperation is discovered in India it will bring peace and mutual goodwill to this ancient land which has suffered so long, more because of her situation in historic space than because of any inherent incapacity of her people. And it will at the same time solve the entire political problem of Asia.

ভারতের মুসলিম চিন্তাধারার মধ্যে অনেক পূর্ব থেকেই দ্বিজাতিতত্ত্বের যে মনোভাব অস্বচ্ছভাবে লুকিয়ে ছিল তাঁকে ইকবাল একটি সুস্পষ্টরূপ দিয়ে আলোচনা করেন। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে স্যার সৈয়দ আহমদ খান এই দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার করেন। তিনি বলেন, ভারতে হিন্দু ও মুসলমান নামক দুটি জাতি বাস করে। ইংরেজরা চলে গেলে তাদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হবে। হিন্দু ও মুসলমান একসঙ্গে থাকতে পারবে এই নিষ্ফল আশা পোষণ না করাই উচিত। স্যার সৈয়দ আহমদ বলেন:

Is it possible that under these circumstances two nations—the Mohammadan and Hindu–could sit on the same throne and remain equal in power? Most certainly not. It is necessary that one of them should conquer the other and thrust it down. To hope that both could remain equal is to desire the impossible and the inconceivable.

তারপরে মৌলানা মহম্মদ আলিও এই ভাবধারার সমর্থনে কিছু মন্তব্য করেন। অবশ্য তাঁরা কেউ পৃথক মুসলিম ভারত গড়বার পরিকল্পনা করেননি। ইকবালই প্রথম এই ধরনের সুনির্দিষ্ট দাবি পেশ করেন। ভারতের মতো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দেশে পশ্চিমী গণতন্ত্রের নীতি প্রয়োগ করা সম্পর্কেও ইকবাল সন্দেহ পোষণ করেন। তিনি বলেন, ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল অর্থাৎ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান একই শাসনতন্ত্রের অধীনে এনে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত All Parties Muslim Conference-এর সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেন। এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবের মধ্যে প্রদেশগুলির স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতাসহ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বজায় রাখা, কেন্দ্রীয় আইনসভায় ৩৩ ভাগ আসন মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত রাখা, সিন্ধু দেশকে একটি পৃথক প্রদেশে পরিণত করা ; উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানকে অন্য প্রদেশের মতো পূর্ণাঙ্গ অধিকার দেওয়া, প্রতিটি অংশের সম্মতি ব্যতীত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনপদ্ধতি পরিবর্তন না করা ইত্যাদি বিষয় ছিল। একথাও ঘোষণা করা হয়, এই সম্মেলনে গৃহীত নীতিসমূহ বাদ দিয়ে কোনো শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করলে তা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। ইকবাল এইসব প্রস্তাব স্বাগত জানিয়েও আরও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। তাই তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল নিয়ে স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করেন, যা কালক্রমে অনেক আঁকাবাঁকা পথে ভারতের রাজনীতিতে পাকিস্তান দাবিতে পরিণত হয়। ইকবাল তাঁর ভাষণে বলেন:

The principle of European democracy cannot be applied to India without recognising the fact of communal groups. The Muslim demand for the creation of a Muslim India is, therefore, perfectly justified. The resolution of the All Parties Muslim Conference at Delhi is to my mind wholly inspired by the noble ideal of a harmonious whole which instead of stifling the respective individualities of its component wholes, affords them chances of fully working at the possibilities that may be latent in them. And I have to doubt that this house will emphatically endorse the Muslim demand embodied in this, resolution. Personally I would go further than the demands embodied in it. I would like to see the Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan amalgamated into a single state. Self-Government within the British Empire, or without the the British Empire, the formation of a consolidated Noth-West Indian Muslim state appears to me to be the final destiny of the Muslims at least of North-West India.

যে ভাষায় ইকবাল এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন তা দ্ব্যর্থক হলেও, একটু যত্ন নিয়ে এই ভাষণ পাঠ করলে বোঝা যায় তখনও হয়তো তিনি একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেননি। তিনি ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক ইউনিটে সংঘবদ্ধ করে তাকে সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে অথবা কনফেডারেশন কাঠামোর মধ্যে রাখতে চান। তাঁর উক্তি থেকেই জানা যায়:

To my mind a unitary form of Government is simply unthinkable in a self-governing India. What is called ‘residuary powers’ must be left entirely to self-governing states, the central Federal state exercising only those powers which are expressly vested in it by the free consent of Federal States. I would never advise the Muslims of India to agree to a system whether of British or of Indian origin, which virtually negatives the principle of true federation, or fails to recognise them as a distinct political entity.

তাঁর মতে, ভারতের জন্য একটি সুদৃঢ় শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা করতে হলে ভাষাগত, জাতিগত, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঐক্য এবং একই অর্থনৈতিক স্বার্থ ভিত্তি করে ‘স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রসমূহ’ (autonomous states) তৈরি করা প্রয়োজন। এইজন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন:

Proper redistribution will make the question of joint and separate electorates automatically disappear from the constitutional controversy of India. It is the present structure of the provinces that is largely responsible for this controversy. … The Muslims of India can have no objection to purely territorial electorates if provinces are demarcated so as to secure comparatively homogeneous communities possessing linguistic, racial, cultural and religious unity.১০

ইকবাল নেহরু কমিটির নিকট যে রিপোর্ট পেশ করেন তাতে এই সব বক্তব্য সন্নিবিষ্ট করেন। কিন্তু নেহরু কমিটি তা অগ্রাহ্য করে। কারণ ইকবালের প্রস্তাব মেনে নিলে প্রস্তাবিত মুসলিম রাষ্ট্র এক অস্বাভাবিক আকৃতির হবে এবং এই রাষ্ট্রের জনসংখ্যাও অন্যান্য ভারতীয় প্রদেশের চেয়ে কম হবে।১১

ইকবাল মনে করেন, একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা একই সঙ্গে ভারত ও ইসলামের স্বার্থ রক্ষা করবে। তা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিরোধ দূর করবে এবং ভারতের শান্তি বজায় রাখবে। আর তা একই সঙ্গে ভারতের মুসলমানদের ইসলামের মূল আদর্শ ও আধুনিক যুগের মূল ধারার সংস্পর্শে আসতে সাহায্য করবে।১২ তাই ইকবালের চিন্তাধারায় আধুনিকতা (modernism) ও মৌলিকতার (fundamentalism) সংমিশ্রণ পাওয়া যায়। অবশ্য এই সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে, ইকবাল ভারতের মুসলমানদের জন্য তুরস্কের মতো একটি সেকুলার রাষ্ট্রের কথা ভাবেন। ইসলামের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচনা করে ইকবাল সিদ্ধান্ত করেন, সংকটময় মুহূর্তগুলিতে সবসময়ে ইসলামই মুসলমানদের রক্ষা করেছে (‘at critical moments in their history it is Islam that has saved Muslims and not vice-versa’.)।১৩

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের এই ভাষণ থেকে জানা যায়, তখন ইকবাল ভারতের মধ্যেই একটি মুসলিম ভারতের কথা চিন্তা করেন। সংখ্যালঘু হিসাবে মুসলমানদের অবস্থান সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি ভারতের সমস্যা সমাধানের কথা বলেন। ফেডারেশন বা কনফেডারেশন সম্পর্কে ইকবালের পরিকল্পনা আলোচনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আর, কুপল্যান্ড বলেন, ইকবাল পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেননি। তিনি উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক ইউনিটরূপে সারা ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করতে চান। যে ভাষায় ইকবাল এই পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন তাও কুপল্যান্ডের নিকট দ্ব্যর্থক মনে হয়েছে। আর একজন ইংরেজ লেখক এইচ, ভি, হডসন মন্তব্য করেন, ইকবালের পরিকল্পনাকে দ্বিজাতিতত্ত্ব অথবা পাকিস্তান মতবাদ বলা যায় না।১৪ কুপল্যান্ড ও হডসনের মন্তব্য থেকে ইকবালের মতবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা করা কষ্টকর। কারণ তাঁরা একটি সুনির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ইউনিটরূপে ভারতে মুসলমানদের অবস্থান এবং ভারতের ইসলাম সম্পর্কে ইকবালের মতবাদ বিশ্লেষণ করেননি। তাঁরা ইকবালের সমগ্র ভাষণ থেকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনাটি আলাদা করে আলোচনা করেন। অথচ ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ইকবাল একটি স্বতন্ত্র গ্রুপরূপে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের যাবতীয় ব্যবস্থা করার পরেই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেন। সমগ্র ভাষণের মধ্যে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রকাশ ও বিভেদের উপকরণ পাওয়া যায়। আমরা কি ভুলতে পারি, ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত ইকবাল প্যান-ইসলামিক মতবাদের একজন গোঁড়া সমর্থক ছিলেন। স্বভাবতই তাঁর রচনাবলিতেও এই মতবাদের বিশেষ প্রভাব পড়ে। এই কারণেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে যুক্ত করেন।১৫

পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গেই ইকবাল মুসলিম রাজনীতিবিদদের নিকট বিশেষ সমাদর লাভ করেন। তাঁরা তাঁকে পথপ্রদর্শক ও তাত্ত্বিক নেতারূপে গ্রহণ করেন। এই অবস্থায় ১৯৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইকবাল ও জিন্নার অন্তরঙ্গতা খুবই গভীর হয়। জিন্নার নিকট লেখা পত্রাবলিতে ইকবাল পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন এবং ভারতে মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ ইকবাল একটি চিঠিতে জিন্নাকে লেখেন, অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কনভেনশনে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু যে ভাষণ দেন তার একটি জোরালো উত্তর দেওয়া উচিত। ভারতে মুসলমানেরা একটি পৃথক রাজনৈতিক ইউনিট একথা আজ উচ্চৈঃস্বরে বলতে হবে। আজ দেশে অর্থনৈতিক সমস্যাই একমাত্র সমস্যা নয়। ভারতের মুসলমানদের নিকট সাংস্কৃতিক সমস্যাই হল সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে এর গুরুত্ব কম নয়। হিন্দুদের পরিষ্কার করেই জানিয়ে দেওয়া দরকার যে, কোনো রাজনৈতিক মতলব, তা যতই সূক্ষ্ম হোক-না-কেন, মুসলমানদের নিজেদের পৃথক সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের কথা ভুলিয়ে দিতে পারবে না। ইকবাল জিন্নাকে লেখেন:

You must restate as clearly and as strongly as possible the political objective of the Indian Muslims as a distinct political unit in the country. It is absolutely necessary to tell the world both inside and outside India that the economic problem is not the only problem in the country. From the Muslim point of view the cultural problem is of much greater consequence to most Indian Muslims. At any rate it is not less important than the economic problem. … It would further make it clear to the Hindus that no political device, however subtle, can make the Indian Muslim lose sight of his cultural entity.১৬

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মে ইকবাল জিন্নাকে আর একখানি চিঠিতে লেখেন, সাধারণ মুসলমানদের সমর্থন পাবার জন্য তাঁদের এই ভরসা দেওয়া উচিত যে, মুসলিম লিগ ইসলামের অনুশাসন প্রয়োগ করে মুসলমানদের দারিদ্র্য দূর করবে। এইভাবেই জওহরলাল কর্তৃক প্রচারিত নিরীশ্বরবাদী সমাজতন্ত্রবাদের যোগ্য উত্তর দিতে হবে। তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস, পণ্ডিত নেহরুর সমাজতন্ত্রবাদ সাধারণ মুসলমানদের নিকট সমাদৃত হবে না। ইকবাল এই চিঠিতে লেখেন:

But the enforcement and development of the Shariat of Islam is impossible in this country without a free Muslim state or states. This has been my honest conviction for many years and I still believe this to be the only way to solve the problem of bread for Muslims as well as to secure a peaceful India. If such a thing is impossible in India the only other alternative is a civil war which as a matter of fact has been going on for some time in the shape of Hindu Muslim riots. I fear that in certain parts of the country, e.g. N.W. India, Palestine may be repeated.১৭

পুনরায় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুন ইকবাল জিন্নাকে লেখেন, ভারতে মুসলমানেরা এক গৃহযুদ্ধের মধ্যে আছে। ভারতের শান্তির প্রয়োজনেই জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় একতা অনুযায়ী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করা উচিত। একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। মুসলিম প্রদেশগুলি নিয়ে একটি পৃথক যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা প্রয়োজন। তাহলে ভারতের শান্তিও বজায় থাকবে, আর অ-মুসলমানদের আধিপত্য থেকে মুসলমানদের রক্ষা করা যাবে। তিনি ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ও বাংলাদেশ নিয়ে একটি পৃথক যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের মুসলমানদের উচিত সমগ্র ভারতের মুসলমানদের স্বার্থে যেসব প্রদেশে মুসলমানেরা সংখ্যালঘিষ্ঠ তার প্রতি কোনো গুরুত্ব আরোপ না করা। লক্ষণীয় এই যে, এই সময়ে ইকবাল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মূল পরিকল্পনা সংশোধন করে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং কোনো দ্ব্যর্থক শব্দ ব্যবহার না করে পরিষ্কার করে মুসলিম প্রদেশগুলি নিয়ে একটি পৃথক যুক্তরাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইকবাল লেখেন:

We are actually living in a state of civil war… In these circumstances it is obvious that the only way to a peaceful India is a redistribution of the country on the lines of racial, religious and linguistic affinities… I remember lord Lothian told me before I left England that my scheme was the only possible solution of the troubles of India, but that may take 25 years to come… To my mind the new constitution with its idea of a single Indian federation is completely hopeless. A separate federation of Muslim provinces, reformed on the lines I have suggested above, is the only course by which we can secure a peaceful India and save Muslims from the domination of non-Muslims. Why should not the Muslims of North-West India and Bengal be considered as nations entitled to self-determination just as other nations in India and outside India are? Personally I think that the Muslims of North-West India and Bengal ought at present to ignore Muslim provinces. This is the best course to adopt in the interests of both Muslim majority and minority provinces.১৮

এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ইকবালের মতবাদ জিন্নাকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করে। জিন্না নিজেও স্বীকার করেন, ইকবালের মতবাদের ফলেই মুসলিম লিগ পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি করে এবং ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে লাহোর অধিবেশনের প্রস্তাবে তা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে জিন্না লেখেন:

It was a great achievement for the Muslim League that its lead came to be acknowledged by both the majority and minority provinces. Sir Muhammad Iqbal played a very conspicuous part, though at time not revealed to public, in bringing about this consummation.১৯

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর ইকবালের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জিন্না বলেন:

With his firm conviction of and faith in the ideals of Islam, he was one of the few who originally thought over the feasibility of carving out of India such an Islamic state in the North-West and North-East zones which are historical homelands of Muslims…২০

এই কারণেই ইকবালকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক বলা হয়।

ইকবালের এই মতবাদে ইংল্যান্ডের কেম্বিªজে অধ্যয়নরত কয়েকজন ভারতীয় মুসলিম ছাত্র খুবই আকৃষ্ট হন। তাঁরা ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে চৌধুরী রহমত আলিকে সভাপতি করে ‘পাকিস্তান ন্যাশন্যাল মুভমেন্ট’ নামক একটি সংস্থা গঠন করেন। চৌধুরী রহমত আলি পাঞ্জাবের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি দাবি করেন, তিনি পাকিস্তান ন্যাশন্যাল মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি তিনি ‘Now or Never’ নামক একটি আট পাতার ইংরেজি পুস্তিকা কেমব্রিজ থেকে প্রকাশ করেন। এই পুস্তিকাতেই সর্বপ্রথম ‘পাকিস্তান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।২১ এই পুস্তিকাতে যাঁরা স্বাক্ষর দেন, তাঁদের নাম হল : চৌধুরী রহমত আলি, মহম্মদ আসলম খান (খাট্টক), শেখ মহম্মদ সাদিক (সাহিবজাদা) এবং ইনায়াত উল্লা খান (চারছাদা)। তাঁরাই ‘পাকিস্তান’ শব্দটি চয়ন করেন।২২ ‘পাকিস্তান’ শব্দের (Pakistan or land of pure) অর্থ হল পবিত্র মানুষের দেশ। উত্তর-পশ্চিম ভারতের Punjab, Afghanis (North-West Frontier Province), Kashmir, Sind এবং Baluchistan-এর নাম থেকেই Pakistan শব্দটি চয়ন করা হয়। এই পুস্তিকাটি পাকিস্তান নামক মুসলিম রাষ্ট্রের তিন কোটি মুসলমানদের পক্ষ থেকে একটি আবেদন পত্ররূপে বিভিন্ন ব্যক্তিদের নিকট পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, এই পাঁচটি অঞ্চলে যাঁরা বসবাস করেন তাঁদের ধর্মীয়, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণে ভারতের অন্যান্য অধিবাসী থেকে একটি পৃথক সত্ত্বা আছে। তাঁদের পাকিস্তান নামক স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস করার সুযোগ দিতে হবে। আর এই রাষ্ট্রের জন্য একটি স্বতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনপদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে।২৩ যে সমস্ত মুসলিম নেতৃবৃন্দ গোলটেবিল বৈঠকে সারা ভারতের জন্য কেবলমাত্র একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে রচিত শাসনতন্ত্র গ্রহণ করেন, তাঁদের এই কেমব্রিজ গ্রুপ তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। কারণ তাঁরা ইসলামের ও ভারতের মুসলমানদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেন। এই পুস্তিকাতে কেম্বিªজ গ্রুপ লেখেন:

India, constituted as it is at the present moment, is not the name of one single country ; nor the name of one single nation. It is, in fact, the designation of a state created by the British for the first time in history. It includes peoples who have never previously formed part of the Indian nation at any period of its history, but who have, on the contrary, from the dawn of history till the advent of the British, possessed and retained distinct nationalities of their own. One of such peoples is our own nation.২৪

তাঁরা বলেন, ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মুসলমানেরা একটি পৃথক জাতি এবং তাঁদের জীবন-যাপন প্রণালী ভারতের অন্যান্য অধিবাসী থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কেমব্রিজ গ্রুপ লেখেন:

We do not inter-dine ; we do not inter-marry. Our national customs and calendars, even our diet and dress are different.২৫

তাঁদের মতে, পাকিস্তানের মুসলমানেরা নিজেদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রস্তাবিত ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে নগণ্য সংখ্যালঘুতে পরিণত হবেন। তা এই জাতির মৃত্যু ঘোষণা করবে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রের আয়তন ফ্রান্সের দ্বিগুণ এবং পাকিস্তানের জনসংখ্যা ফ্রান্সের সমান। তা ছাড়া সমগ্র মুসলিম জগতের এক-দশমাংশ মানুষ এখানে বাস করেন। তাই কেম্বিªজ গ্রুপ এই অঞ্চলকে একটি পৃথক রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতির দাবি জানায়।২৬

অবশ্য কেম্বিªজ গ্রুপ পরিষ্কার করেই বলেন যে, তাঁদের দাবি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের কবি ইকবাল কর্তৃক প্রচারিত পরিকল্পনা থেকে মূলত পৃথক। ইকবাল পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্থান নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করে তাকে সারা ভারত যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইউনিটরূপে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু কেমব্রিজ গ্রুপ এই চারটি প্রদেশের সঙ্গে কাশ্মীরকে যুক্ত করে ভারতের বাইরে একটি পৃথক যুক্তরাষ্ট্র গঠনের দাবি করেন। তাঁরা কোনোমতেই হিন্দু আধিপত্য থাকবে এমন কোনো যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁরা ইকবালের পরিকল্পনা উল্লেখ করে বলেন:

While he proposed the amalgamation of four out of the five abovenamed provinces into a single state forming a unit of the All-India Federation, we propose that all those five provinces should have a separate Federation of their own outside India. We are convinced there can be no peace and progress in India if we, the Muslims are duped into a Hindu dominated federation in which we cannot be the masters of our own destiny and captains of our own souls.২৭

ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে বিরোধিতা করে তাঁরা যে মন্তব্য করে এই পুস্তিকাটি সমাপ্ত করেন, তা হল:

The history of the last century is full of open warnings to us, and they are as plain as were ever given to any nation. Shall it be said of us that we ignored all those warnings, betrayed our ancient nationhood into the Indian Federation, and let our Islamic heritage perish throughout the sub-continent of India?২৮

ঠিক শুরুতেই কেম্বিªজ গ্রুপের মতবাদ ভারতের রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কারণ ভারতের রাজনীতির সঙ্গে তখনও তাঁদের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। একটি ঘটনা থেকেই তা বোঝা যাবে। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সের ও মুসলিম লীগের প্রতিনিধিবৃন্দ ইংল্যান্ডে জয়েন্ট সিলেক্ট কমিটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা সুস্পষ্টভাবে বলেন, পাকিস্তান ছাত্রদের পরিকল্পনা মাত্র এবং তাঁরা এই পরিকল্পনাকে অলীক ও অবাস্তব মনে করেন।২৯ তবুও কেম্বিªজ গ্রুপ ইংল্যান্ডে পাকিস্তান আন্দোলন বন্ধ করে দেননি। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে চৌধুরী রহমত আলি আর একটি পুস্তিকা রচনা করেন। তাতে তিনি প্রথম পুস্তিকার বিষয়বস্তু নিয়েই আলোচনা করেন।৩০ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে করাচীতে পাকিস্তান ন্যাশন্যাল মুভমেন্টের সুপ্রিম কাউন্সিলের একটি সভা হয়। সেখানে চৌধুরী রহমত আলি বিশদভাবে কেমব্রিজ গ্রুপের মতবাদ ব্যাখ্যা করেন। পরে এই ভাষণ ইংল্যান্ড থেকে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়।৩১ এইসব পুস্তিকায় যে মতবাদ প্রচার করা হয়, তা হল:

১. মুসলমানেরা ভারতীয় নন, তাঁরা পাকিস্তানী। তাঁরা নিজেদের এশিয়ান (Asians) মনে করেন।

২. মুসলমান সম্প্রদায় বা মিল্লাত এশিয়া ও ভারত পুনর্গঠিত করার সমস্যার সম্মুখীন। অতীতে ‘ভারতবাদ’ (Indianism) আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে ইসলামের মূলনীতিসমূহ বিনষ্ট করেছে এবং রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের সাম্রাজ্যিক কর্তৃত্ব থেকে বঞ্চিত করেছে, এবং পরিশেষে তাঁদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করেছে। সুতরাং ভবিষ্যতে ‘ভারতবাদ’ তাঁদের সম্পূর্ণভাবে ধবংস করবে।

৩. ভারতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন না করলে মিল্লাতকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

এই মনোভাবের দ্বারা পরিচালিত হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তিনটি স্বাধীন পাকিস্তান জাতির কথা বলতে শুরু করেন, যথা, উত্তর-পশ্চিম ভারত (১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে উল্লিখিত), বঙ্গ-ই ইসলাম (বাংলা দেশে ইসলাম। সঙ্গে আসামও থাকবে) এবং উসমানিস্তান (হায়দ্রাবাদ রাজ্য। নিজামের পারিবারিক নাম হল উসমান)৩২ কেম্বিªজ গ্রুপের মতে, মুসলিম জাতীয়তাবাদ কেবলমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলি দাবি করবে না, এমনকী হিন্দু অধ্যুষিত দেশীয় রাজ্যসমূহ, যেখানে মুসলিম নৃপতিবৃন্দ আছেন সেখানে এবং আজমীড়ের মতো মুসলিম তীর্থস্থান ইত্যাদি স্থানেও মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। আর এইসব বিচ্ছিন্ন ‘মুসলিম জাতি’ নিয়ে Pak Commonwealth of Nations গঠন করতে হবে, ভারতকে Dinia বা Faithland-এ রূপান্তরিত করতে হবে এবং অবশেষে Pakasia নামক একটি Pan-Islamic যুক্তরাষ্ট্র গঠন করতে হবে। কিন্তু চৌধুরী রহমত আলি এই Pakasia নামক ফেডারেশনের কোনো সংগত আলোচনা তাঁর পুস্তিকাতে করেননি।

চৌধুরী রহমত আলি পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রাচীন ঐতিহ্য উল্লেখ করেন।৩৩ তিনি লেখেন, ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল প্রাচীন সভ্যতার জন্মস্থান। তাই পাকিস্তান স্বাভাবিকভাবেই গর্ব অনুভব করতে পারে। প্রাচীন সভ্যতার পীঠস্থানে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্র ইসলামের আত্মাকে ব্রিটিশ-বেনিয়া ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করবে। আর ভারতীয়করণ থেকে মুসলিম-এশিয়াকে রক্ষা করতে এই রাষ্ট্র হবে অতন্দ্র প্রহরী। পাকিস্তান রাষ্ট্র সম্পর্কে চৌধুরী রহমত আলির চিন্তাধারা নিম্লোক্ত উদ্ধৃতি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাবে। তিনি লেখেন:

Again, it is this Pakistan which is its eternal conviction stands to-day, spiritually, as the Frontier-guard of Muslim Asia against the mortal menace of ‘Indianism’ ; nationally, as the leader of the Muslims’ fight against their ‘minorization’, ‘communalization,’ and ‘Indianization’ ; internationally, as the sponsor of the national integration and independence, each in its own fatherland, of all the peoples in the continent, including the nations of the Millat in Bangistan, Osmanistan, Siddiqistan, Faruqistan, Haidaristan, Muinistan, Maplistan, Safistan, and Nsaristan ; and ideologically, as the crusader for the conversion of the ‘country of India’ into the ‘continent of Dinia,’ for the organization of the continent of Dinia and its Dependencies into the cultural Orbit of Pakasia ; and above all, for the rededication of one hundred million Muslims to the achievement of the sovereign freedom of the Millat and the supreme fulfilment of her divine mission throughout the Orbit of Pakasia.৩৪

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত এই কেম্বিªজ গ্রুপ তাঁদের রচনার মাধ্যমে পাকিস্তান দাবির সপক্ষে প্রচার করেন। তাঁদের পরিকল্পিত পাকিস্তান প্রধানত, ভারত-বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। প্রথম দিকে ভারতের মুসলিম রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও তাঁদের রচনার প্রভাব ক্রমান্বয়ে উচ্চশিক্ষিত মুসলমানদের উপর পড়ে। সুতরাং, এই গ্রুপ যে তাত্ত্বিক সংগ্রাম চালায় তার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রভাবশালী মুসলমানদের একটি অংশ দ্বিজাতিতত্ত্বের দ্বারা খুবই প্রভাবান্বিত হন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের স্যার আবদুল্লা হারুনের নেতৃত্বে সিন্ধুর মুসলিম লিগ ঘোষণা করে, ভারতবর্ষ একটি দেশ নয়, একটি উপ-মহাদেশ। এখানে হিন্দু ও মুসলমান নামক দুইটি জাতি বাস করে। তাই ভারতকে দু-টি যুক্তরাষ্ট্রে বিভক্ত করা উচিত। লক্ষণীয় এই যে, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর করাচীতে সিন্ধু প্রদেশ মুসলিম লিগের সম্মেলনে জিন্না সভাপতিত্ব করেন এবং সেখানে একটি প্রস্তাবে ভারতকে মুসলমান ও অ-মুসলমান দু-টি ফেডারেশনে বিভক্ত করার দাবি করা হয়। এই প্রস্তাবে বলা হয়:

The Sind Provincial Muslim League Conference consider it absolutely essential in the interests of an abiding peace of the vast Indian continent and in the interests of unhampered cultural development, the economic and social betterment and political self-determinations of the two nations, known as Hindus and Muslims, that India may be divided into two Federations viz-Federation of Muslim states and the Federation of non-Muslim states.

This conference, therefore, recommends to the All India Muslim League to devise a scheme of constitution under which Muslim majority provinces, Muslim Native states and areas inhabited by a majority of Muslims may attain full independence in the form of a Federation of their own with permission to any other Muslim state beyond the Indian frontiers to join the Federation, and with such safeguards for non-Muslim minorities as may be conceded to the Muslim minorities in the non-Muslim Federation of India.৩৫

প্রায় একই সময়ে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল লতিফ The Cultural Future of India (Bombay, 1938) নামক একখানি পুস্তিকা রচনা করেন। এই পুস্তিকার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল এই যে, একটি জাতি গঠনের জন্য যে-সমস্ত উপাদান একান্ত প্রয়োজন তা ভারতে নেই।৩৬ ইসলাম ও হিন্দুধর্ম পরস্পর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। হিন্দুরা ও মুসলমানেরা নিজেদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য স্থাপনে রত থাকায় ভারত দ্বিধাবিভক্ত রয়েছে। সর্বত্র ভাষাগত প্রাদেশিকতা বিরাজ করছে। এই অবস্থায় নিকটতম প্রতিবেশী হিসাবে হিন্দু ও মুসলমানদের এক সঙ্গে চলা সম্ভব নয়।৩৭ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে করাচী অধিবেশনে কংগ্রেস ভারতের প্রতিটি নাগরিক, সম্প্রদায় ও ইউনিটের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি সংবলিত মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ড. লতিফ এই প্রস্তাবে খুশী হতে পারেননি। তাই তিনি মন্তব্য করেন:

Religion, personal law and culture eover most of the major fields of life’s activity—the spiritual, the social, the economic, the educational (or the intellectual, moral and aesthetic), and in the case of the Muslims, professedly the political as well. It is governed by their all-embracing code of life called the Sheriyat. Under the Congress promise the interests of their Sheriyat will have to be safeguarded…with cultural safeguards conceded to the Muslims, and in like manner to the Hindus, Christians and others, you really establish a federation of culturally autonomous nationalities and do not form a single nationality.৩৮

ড. লতিফের মতে, ভারত একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি নয়। কংগ্রেসের প্রোগ্রাম ও ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইনের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভারতের সমস্যা সমাধানে সক্ষম নয়। তাই তিনি হিন্দুধর্ম ও ইসলামের পার্থক্যের কথা মনে রেখে ভারতীয়দের এগারোটি হিন্দু অঞ্চলে ও চারটি মুসলিম অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রথমে তিনি মুসলিম সাংস্কৃতিক অঞ্চলগুলি নির্দিষ্ট করেন। তারপর তিনি হিন্দু সাংস্কৃতিক অঞ্চলগুলি ভাগ করেন। তিনি মুসলিম সাংস্কৃতিক অঞ্চলগুলি এইভাবে বিভক্ত করেন:

১. উত্তর-পশ্চিম ব্লক (North-West Block): এই অঞ্চলের মধ্যে সিন্ধু, বেলুচিস্থান, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, এবং খেয়ারপুর ও ভাওয়ালপুর নামক দেশীয় রাজ্যগুলিকে রাখা হয়। ড. লতিফ লেখেন:

This area may be converted into a single autonomous state formed on the basis of federal relationship between the six units thereby allowing over 25 millions of Muslims a free home of their own.

২. উত্তর-পূর্ব ব্লক (North-East Block): এই অঞ্চলের মধ্যে থাকবে পূর্ববঙ্গ ও আসাম। এটি একটি সুদৃঢ় মুসলিম ব্লক হবে। ড. লতিফ মনে করেন:

…a solid block of Muslims in Eastern Bengal and Assam of over 30 millions, who may be assigned a free political existence.

৩. দিল্লি-লক্ষ্ণৌ ব্লক (Delhi-Luoknow Block): তিনি মনে করেন, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব ব্লকগুলির মধ্যে মুসলমানেরা অসমানভাবে ছড়িয়ে আছেন। সুতরাং, যাঁরা এই দুটি ব্লকের নিকট বসবাস করেন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবেন। অবশিষ্ট মানুষ উত্তর প্রদেশ ও বিহারের বাসিন্দা হবেন। রামপুর হয়ে পাতিয়ালার সীমান্ত থেকে লক্ষ্ণৌ পর্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানদের নিয়ে এই ব্লক গঠন করা হবে।

৪. দাক্ষিণাত্য ব্লক (Deccan Block): দাক্ষিণাত্যে বসবাসকারী মুসলমানদের নিয়ে এই ব্লক গঠন করা হবে। এই অঞ্চল সম্পর্কে ড. লতিফ লেখেন:

Such a zone the dominions of Hyderabad may provide with a strip of territory restored to them in the south, running through the districts of Kurnool, Cuddapah, Chittoor, North Arcot and Chingleput down to the City of Madras with an opening to the sea will be found absolutely necessary to settle the large Muslim mercantile and marine community living for ages on the Coromandel and Malabar coasts.

তাঁর মতে, অর্থনৈতিক কারণেই এই ব্লক গঠন করা দরকার। হায়দ্রাবাদ এখনও অনুন্নত স্থান। বনজঙ্গল ও পাহাড়ে ঢাকা রয়েছে। ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, বোম্বে, মাদ্রাজ, মহীশূর, কোচিন ও ত্রিবাঙ্কুর থেকে মুসলমানেরা এই ব্লকে এসে বসবাস করবেন। এমনকী এই অঞ্চল উত্তর-পূর্ব ও দিল্লি লক্ষ্ণৌ ব্লকের উদবৃত্ত মুসলমানদেরও আশ্রয় দেবে।

এইসব প্রধান প্রধান ব্লকগুলি ছাড়াও ড. লতিফ অপ্রধান মুসলিম অঞ্চলের (Minor Muslim Centres) কথাও উল্লেখ করেন, যথা, ভোপাল রাজ্য, টঙ্ক, জুনাগড়, আজমীড় ইত্যাদি। তিনি বলেন, রাজপুতানা, গুজরাট, মালওয়া এবং পশ্চিম ভারতীয় রাজ্যগুলিতে যেসব মুসলমানেরা বাস করেন তাঁরাও এই Minor Muslim Centres-এ আসবেন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী খ্রিস্টান, অরণ্যবাসী উপজাতি ও হরিজন ইত্যাদি অপ্রধান সম্প্রদায়গুলি সেই সমস্ত অঞ্চলেই থাকবেন যেখানে তাঁরা বিশেষ সুযোগসুবিধা ভোগ করবেন।৩৯

অবশিষ্ট ভারত হিন্দু সাংস্কৃতিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই পরিকল্পনা কার্যকারী করতে হলে নতুন করে অঞ্চলগুলির সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। এই হিন্দু-মুসলিম সাংস্কৃতিক অঞ্চল গড়ে তুলবার জন্য প্রয়োজনবোধে স্বেচ্ছায়, যথেষ্ট সময় দিয়ে লোক বিনিময়ের (exchange of population) ব্যবস্থাও করতে হবে। ড. লতিফ স্বীকার করেন, লোক বিনিময়ের ফলে হিন্দু ও মুসলমানেরা গভীরভাবে বেদনা অনুভব করবেন। তাহলেও এই ব্যবস্থা অনুযায়ী তাঁরা নিজেদের অঞ্চলে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবেন।৪০ অবশ্য যাঁরা পৈতৃক বাসস্থান পরিত্যাগ করে অন্যত্র যাবেন না তাঁদের ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার Public Law of Indian Natins নামক আইন পাস করবেন। একইভাবে প্রতিটি যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, হরিজন, পারসি ও বৌদ্ধদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষিত হবে।৪১

ড. লতিফ আরও দুটি পুস্তিকা রচনা করেন: A Federation of Cultural Zones of India (Secunderabad, 1938) এবং The Muslim Problem in India (Bombay, 1939)। তাছাড়া এই বিষয় নিয়ে তিনি মুসলিম লিগ সাবকমিটির নিকট একটি বিবৃতিও পেশ করেন।৪২ এই সমস্ত পুস্তিকা ও বিবৃতি থেকে তাঁর পরিকল্পনা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা করা যায়। প্রথম পুস্তিকায় যে পরিকল্পনা তিনি প্রকাশ করেন তা আরও সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করেন The Muslim Problem in India নামক পুস্তিকায়। এই পুস্তিকায় তিনি লেখেন:

The Indian States interspersed all over the country may be distributed between the different zones in accordance with their natural affinities. Each zone will form a homogeneous state with a highly decentralised form of government within… but fitting along with similar states into an all-India Federation.৪৩

ড. লতিফ মনে করেন, যতদিন পর্যন্ত হিন্দু ও মুসলমান পরস্পর পৃথক থেকে নিজস্ব সংস্কৃতি অনুসরণ করবে ততদিন পর্যন্ত ভারতে ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তবুও তিনি এই আশা পোষণ করেন, কানাডার (Canada) অনুকরণে এই দুই সম্প্রদায় একটি জাতি গঠন করতে পারে। হিন্দু ও মুসলমানেরা পৃথক অঞ্চলে বসবাস করবে, কিন্তু একই দেশের জন্য যুক্তভাবে কাজ করবে।৪৪ এই কারণে ড. লতিফ হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য সংস্কৃতিগতভাবে কয়েকটি পৃথক অঞ্চল গঠন করে, সেই অঞ্চলগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র স্থাপন করার পরিকল্পনা করেন। অবশ্য তিনি একথাও বলেন, উপরিউক্ত সমাধানের কথা তখনই ভাবতে হবে যখন উভয় সম্প্রদায় সর্বসম্মতিক্রমে কোনো শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ব্যর্থ হবে। এই সময়ে তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের বিকল্প একটি খসড়া শাসনতন্ত্র তৈরি করেন। তাতে হিন্দু-মুসলিম অঞ্চলে ভারতীয়দের বিভক্ত করে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা ছিল।৪৫

ড. লতিফের পরিকল্পনায় মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ আকৃষ্ট হন। সারাভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য স্যার আবদুল্লা হারুন এই পরিকল্পনার দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ড. লতিফ লিখিত The Muslim Problem in India পুস্তিকার মুখবন্ধ স্যার হারুন লিখে দেন। সেখানে তিনি যেমন্তব্য করেন তা পাকিস্তান প্রস্তাবের পটভূমি আলোচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্যার হারুন লেখেন: গত বছর ড. লতিফের The Cultural Future of India পুস্তিকা প্রকাশের পর হিন্দু-মুসলিম জটিল সমস্যা সমাধানে তাঁর বক্তব্য পাঠ করে আমি খুবই প্রভাবান্বিত হই। তাই আমি তাঁকে লাহোরে মুসলিম লীগের বৈদেশিক বিষয়ক কমিটির সঙ্গে তাঁর মতামত নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি এই কমিটির বৈঠক লাহোরে হয়। এই সভায় পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী স্যার সিকন্দর হায়াৎ খান, মামদোতের নবাব সাহেব ও স্যার ফিরোজ খাঁন কুন উপস্থিত ছিলেন। এখানে ড. লতিফের সঙ্গে তাঁদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। তাঁদের কাছে ড. লতিফ তাঁর পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন। তখন তাঁরা ড. লতিফকে এমন একটি শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা রচনা করতে অনুরোধ করেন যাতে মুসলিম ভারত বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারে। এই অনুরোধের ফলেই ড. লতিফ ভারতীয় শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া প্রস্তুত করেন। এই খসড়া শাসনতন্ত্র নিয়ে সারা ভারত মুসলিম লিগের কার্যকারী সভাতে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়।৪৬

মুসলমানদের জন্য পৃথক বাসস্থানের পরিকল্পনা উদ্ভাবন করায় স্যার হারুন ড. লতিফকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। স্যার হারুন মুসলিম লীগের বৈদেশিক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ড. লতিফের The Muslim Problem in India নামক পুস্তিকা ব্যাপকভাবে ইংল্যান্ডে ও ভারতে বিতরণ করেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি স্যার হারুন একটি চিঠিতে ড. লতিফকে জানান:

I must express my utmost thanks for the labour you undertook for the supreme cause of Mussalmans by evolving such a scheme which if materialised embodies in itself the separate and free Home lands for Mussalmans in India.৪৭

এই পুস্তিকা ইংল্যান্ডে গভীর আগ্রহের সৃষ্টি করে। অনেকেই এই পুস্তিকা পাঠ করেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর অধ্যাপক রাসব্রুক উইলিয়ামস Great Britain and the East নামক কাগজে একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ড. লতিফের পুস্তিকা যত্ন সহকারে পাঠ করবার জন্য ব্রিটিশ জনসাধারণকে অনুরোধ করেন। তিনি মন্তব্য করেন: এই ক্ষুদ্র পুস্তিকা ব্রিটিশ দৃষ্টিভঙ্গি অথবা প্যান-ইসলামিক মনোভাব থেকে লেখা হয়নি, সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে। তাই এই পুস্তিকা মূল্যবান। লেখক একজন জাতীয়তাবাদী হলেও তিনি সেই ধরণের জাতীয়তাবাদ বাধা দেবার জন্য বদ্ধপরিকর যা ভারতে রাজনৈতিক শক্তিরূপে ইসলামকে বিনাশ করতে চায়। অধ্যাপক রাসব্রুক উইলিয়ামস লেখেন:

This little book is important because it is not written from the British point of view, nor from the Pan-Islamic point of view, but the Indian point of view. The author counts himself as good a nationalist by anyone else ; but he is determined to oppose the kind of nationalism which would eliminate Islam as a political force in India.৪৮

ড. লতিফের পরিকল্পনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি পরিকল্পনা পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশ থেকে প্রকাশিত হয়। এই পরিকল্পনাগুলি ‘পাকিস্তান পরিকল্পনা’ নামেই পরিচিত। এইসহ পরিকল্পনার রচয়িতারা ড. লতিফের পৃথক অঞ্চল গঠনের মতবাদ গ্রহণ করলেও তাঁরা নিজেদের মতামতও ব্যক্ত করেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ছদ্মনামে A Punjabi নামক একজন লেখক Confederacy of India পুস্তিকা রচনা করেন। পাঞ্জাবের একজন বিখ্যাত মুসলিম নেতা নবাব স্যার মহম্মদ শাহ নাওয়াজ খান এই ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। তিনি মনে করেন, তত্ত্বগতভাবে ড. লতিফের পরিকল্পনা ঠিক থাকলেও, তা অবাস্তব। কারণ লোক-বিনিময়ের ব্যবস্থা সমগ্র অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলবে। যাঁরা যেখানে আছেন, তাঁদের সেখানে রেখেই শাহ নাওয়াজ খান ভারতকে পাঁচটি অঞ্চলে বিভক্ত করেন:

১. সিন্ধু অঞ্চল

২. হিন্দুভারত: নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে সমস্ত অঞ্চল নিয়ে হিন্দুভারত গঠিত হবে

৩. রাজস্থান: রাজপুতানা ও মধ্যভারত নিয়ে এই অঞ্চল গটিত হবে

৪. দাক্ষিণাত্য রাষ্ট্রসমূহ: প্রধানতঃ হায়দ্রাবাদ ও মহীশূর নিয়ে গঠিত হবে

৫. বাংলাদেশ: এই বাংলাদেশে হিন্দু জেলাগুলি বাদ যাবে।

তবে আসামের কয়েকটি অঞ্চল ও আরও কিছু বিচ্ছিন্ন স্থান এর অন্তর্ভুক্ত হবে। শাহ নাওয়াজ খান বিশ্বাস করেন, সমগ্র পৃথিবীর মুসলমানেরাই একটি জাতি। তিনি বলেন, ‘‘The Muslims all over the world are a single nation (millat) just as the Jews are a single nationality.’’ স্বভাবতই আফগানিস্তান ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র এই ধরণের মুসলিম রাষ্ট্রকে সাদরে গ্রহণ করবে। কারণ তা হবে ইউরোপের হাত থেকে এশিয়ার মুক্তি অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ, আর বহু আকাঙ্ক্ষিত প্যানইসলামিক মতবাদের প্রকাশ। অবশ্য তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলেন নি। মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের কথা ভাবলেও তিনি ভারতীয় কনফেডারেসীর মধ্যে সেই রাষ্ট্রকে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন।৪৯

পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী স্যার সিকন্দর হায়াৎ খান একটি পরিকল্পনা রচনা করেন। তিনি Outlines of a Scheme of Indian Federation (Lahore, 1939) নামক পুস্তিকায় এই বিষয়ে আলোচনা করেন। এই পরিকল্পনা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে তিনি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ পাঞ্জাব লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলীতে ভাষণ দেন।৫০ ড. লতিফের অঞ্চল গঠনের মতবাদ তিনি গ্রহণ করেন। স্যার সিকন্দর যুক্তরাষ্ট্র গঠনের নীতি সমর্থন করেন। তবে এই যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রের ক্ষমতা খুবই সীমিত থাকবে। বেশির ভাগ ক্ষমতা থাকবে প্রদেশগুলির। এই মনোভাব থেকে তিনি ভারতকে সাতটি অঞ্চলে ভাগ করেন:

১. আসাম, বাংলাদেশ (পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলা বাদ দিয়ে,) বাংলার দেশীয় রাজ্য ও সিকিম

২. বিহার, ওড়িশা ও ছেড়ে দেওয়া বাংলাদেশের জেলাগুলি

৩. উত্তর প্রদেশ ও তার দেশীয় রাজ্য

৪. মাদ্রাজ, মাদ্রাজের দেশীয় রাজ্য, ত্রিবাঙ্কুর ও কুর্গ

৫. বোম্বে, হায়দ্রাবাদ, মহীশূর ; পশ্চিম ভারতের দেশীয় রাজ্য, বোম্বের ও মধ্যপ্রদেশের দেশীয় রাজ্যসমূহ

৬. মধ্যপ্রদেশ, রাজপুতানার দেশীয় রাজ্য (বিকানীর ও জয়সালমের বাদ দিয়ে), গোয়ালিয়র, এবং মধ্যভারত, বিহার ও ওড়িশার দেশীয় রাজ্যসমূহ

৭. পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্থান, কাশ্মীর, পাঞ্জাবের দেশীয় রাজ্য, বিকানীর ও জয়সালমের।৫১

এইসব অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধি নিয়ে আঞ্চলিক আইনসভা গঠিত হবে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইন অনুযায়ী প্রাদেশিক আইনসভাগুলি তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, আর দেশীয় রাজ্যের শাসকরা তাঁদের প্রার্থী মনোনীত করবেন। আঞ্চলিক আইনসভাগুলির সদস্যরা কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সভা গঠন করবেন। স্যার সিকন্দর পরিষ্কার করে আঞ্চলিক আইনসভাগুলির ও কেন্দ্রীয় আইনসভার বিষয়গুলি সুনির্দিষ্ট করেন এবং নির্বাচিত ও মনোনীত সদস্যদের সংখ্যাও নির্দিষ্ট করেন। তিনি আশা করেন, গভর্ণর জেনারেল প্রচলিত পার্লামেন্টারি পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রধান মন্ত্রী মনোনীত করবেন ও কেবিনেট গঠন করবেন। কিন্তু তিনি গভর্ণর জেনারেলকে কেন্দ্রীয় কার্যকরি পরিষদ গঠনে অবাধ ক্ষমতার অধিকারী করেন। এই পরিষদে প্রতিটি অঞ্চল থেকে অন্তত একজন সদস্য নিতে হবে এবং কেবিনেটের এক তৃতীয়াংশ সদস্য মুসলমান হবে। দেশীয় রাজ্য থেকে কেবিনেটে দুইজন বা তিনজন সদস্য থাকবে। স্যার সিকন্দর ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা রচনা করেন। তাঁর ধারণা, ব্রিটেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখলে ভারত উপকৃত হবে।৫২

সৈয়দ জাফর আল-হাসান ও আফজল হুসায়িন কাদিরী যে পরিকল্পনা রচনা করেন তা ‘আলিগড় স্কিম’ নামে পরিচিত। এই স্কিম ভারতকে কয়েকটি স্বাধীন হিন্দু ও মুসলিম অঞ্চলে বিভক্ত করার দাবি জানায় এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত, বাংলাদেশ ও হায়দ্রাবাদ স্টেট নিয়ে তিনটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক এই স্কিম রচনা করেন।৫৩ ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে স্যার আবদুল্লা হারুন ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ও কাশ্মীর নিয়ে একটি পৃথক মুসলিম যুক্তরাষ্ট্র গঠন করতে চান। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ও হায়দ্রাবাদ স্টেটের সমস্যা উল্লিখিত হয়নি। আসাদুল্লা ও লক্ষ্ণৌর সৈয়দ রিজাওয়ান উল্লাও পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের জন্য পরিকল্পনা রচনা করেন।৫৪ অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত দাবি এইসব পরিকল্পনায় পাওয়া যায়। এই সমস্ত পরিকল্পনা নিয়ে সারাভারত মুসলিম লিগ ওয়ার্কিং কমিটিতে অনেক আলোচনা হয়। এমনকি ডঃ লতিফের পরিকল্পনা নিয়ে কংগ্রেস মহলেও আলোচনা শুরু হয়। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু প্রভৃতি কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে। ডঃ লতিফ তাঁর পরিকল্পনাকে ভিত্তি করে কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেন। তাঁর মনে হয়, অবিলম্বে ভারতে culturally autonomous states নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করতে না পারলে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি প্রবল হয়ে উঠবে, ভারতের ঐক্যবদ্ধ সত্তা নষ্ট হয়ে যাবে। জিন্না ও অন্যান্য মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের মনোভাব দেখে তিনি এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তাঁর পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি।৫৫ তাই ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি ডঃ লতিফ পণ্ডিত নেহরুকে এক পত্রে আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়ে লেখেন:

The idea of cultural zones is a mild idea compared with that of Pakistan. But that will be thrown into the limbo of oblivion, and the spectre of Pakistan alone will stare you in the face to-morrow, if to-day you fail to use your opportunities to frame a constitution for the country agreeable to all.৫৬

এই পত্রে ড. লতিফ এই কথাও উল্লেখ করেন যে, তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধী, কারণ তিনি এই আন্দোলনকে separatist movement মনে করেন।৫৭ পাকিস্তান আন্দোলন ভারতে দু-টি পৃথক যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিল। আর ড. লতিফ স্বয়ংশাসিত রাষ্ট্রসমূহ নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বজায় রাখতে চান।৫৮

১৯৩৬-১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ড. লতিফ সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে তিনি তাঁর পরিকল্পনা প্রচার করেন এবং তিনি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে হায়দ্রাবাদে মুসলিম কালচারাল সোসাইটি স্থাপন করেন। তখন তিনি মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের নিকট খুবই সুপরিচিত ছিলেন এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর মতামত তাঁদের মনকে আন্দোলিত করে। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে তাঁদের অন্যতম তাত্ত্বিক নেতারূপে বরণ করেন।৫৯ স্বভাবতই জিন্নাও তাঁর মতামত অগ্রাহ্য করেননি। এই সময়ে কবি ইকবালের আমন্ত্রণে ড. লতিফ লাহোরে যান এবং কবির সঙ্গে কয়েকদিন কাটান। সেখানে মুসলিম স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে দুজনের মধ্যে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল একই শাসনতন্ত্রের অধীনে আনার জন্য ইকবাল যে-প্রস্তাব দেন তা ড. লতিফ গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ এই প্রস্তাবের দ্বারা সমগ্র ভারতের মুসলমানদের সমস্যার সমাধান হবে না। তাই ড. লতিফ বলেন, এমন পরিকল্পনা করা দরকার যাতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং বাংলাদেশ ও আসাম অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। আর এই-একই সঙ্গে দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, পাটনা থেকে কেপ কমোরিন এবং দেশীয় রাজ্য সমূহে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের প্রয়োজন মেটানো যায়।৬০

কিন্তু ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার পর জিন্না ও অন্যান্য মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ মনে করেন একটি স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেই সমস্যার সমাধান হবে। ড. লতিফ যে-যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন তার প্রতি আর তাঁরা কোন গুরুত্ব আরোপ করেননি। মোট কথা, লিগ নেতৃবৃন্দের মনোভাবের সঙ্গে ড. লতিফের পরিকল্পনার পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। জিন্না বারে বারে এই দাবি করতে লাগলেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রসমূহ পৃথক থাকবে এবং এই রাষ্ট্রসমূহ ভারতের সঙ্গে কোন শাসনতান্ত্রিক সম্পর্ক রাখবে না। কিন্তু ড. লতিফ এই মতের বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বলেন, তিনি পাকিস্তান দাবির বিরোধী নন। কিন্তু তিনি মনে করেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রসমূহ সম্পূর্ণভাবে ভারত থেকে পৃথক হয়ে গেলে তাদের পক্ষে তা আত্মহত্যার সমতুল্য হবে। শুধু তাই নয়, মুসলমানদের স্বার্থও ক্ষুণ্ণ হবে। ড. লতিফ বলেন:

Mr. Jinnah insists that the Pakistan states should remain in isolation and should have not constitutional relation with the rest of India. I, on the other hand, hold that such an attitude will prove suicidal to the Pakistan states. I firmly believe that in the abiding interests of these states themselves and of the thinly distributed Muslim minorities in Hindu zones, they should, while enjoying perfect freedom or autonomy in their internal affairs, link themselves to the rest of India to administer with others on terms of equality a minimum of subjects indispensably common to the whole of India.৬১

কিন্তু জিন্নাকে বাধা দেবার মত কোন সাংগঠনিক ক্ষমতা ড. লতিফের ছিল না।

তথ্যসূত্র

Mitra, Annual Register, 1930, vol. II, pp. 335–336.

Ibid, p. 336.

Ibid, p. 337.

Ahmad, Aziz, Islamic Modernism in India and Pakistan 1857-1964, London, 1967, p. 161.

Mitra, Register, 1930, Vol. II, pp, 336–337.

Moom, Penderel, Divide And Quit, London, 1964, pp. 11–12.

Ahmad, Islamic Modernism, p. 162.

Mitra, Register, 1930, Vol. II, pp. 337–338; vide also Majumdar, R. C. (Ed.), Struggle For Freedom, Bombay, 1969, p. 460; Das, Durga, India From Curzon to Nehru & After, London, 1969, p. 129.

Mitra, Register, 1930, vol. II, p. 339.

১০ Ibid.

১১ Ibid, p. 338.

১২ Ibid.

১৩ Iqbal, Mahammad, The Struggle For Independence, 1857–1947, Karachi, 1958, pp. 18 and 27.

১৪ Coupland, Constitutional Problem, p. 198; Hodson, H. V., The Great Divide Britain-India-Pakistan, London, 1969, p. 81.

১৫ Ahmad, Islamic Modernism, p. 156.

১৬ Letters of Iqbal to Jinnah (Confidential). Vide Allana, G., Pakistan Movement Historic Documents, Published for the Department of International Relations, University of Karachi, Karachi [195?], pp. 128-133.

১৭ Ibid, pp. 130-131.

১৮ Ibid, pp. 132–133. জিন্নাকে লেখা ইকবালের পত্রাবলী এই গ্রন্থের ১২৫-১৩৭ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত আছে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইকবালের মতবাদ আলোচনায় এই পত্রাবলী বিশেষ প্রয়োজন।

১৯ A History of the Freedom Movement, vol. III (1906–1936), Part II, Prepared by the Board of Editors, Karachi, 1963. Quoted in this volume. p. 535.

২০ Allana, Pakistan Movement, p. 276.

২১ Now or Never, An eight-page pamphlet published from 3, Humberstone Road, Cambridge, England. Full text of this pamphlet was reprinted in Allana’s Pakistan Movement, vide pp. 103–110.

২২ Ibid, p. 110.

২৩ Ibid, p. 103.

২৪ Ibid, pp. 104–105.

২৫ Ibid, pp. 105–106.

২৬ Ibid, pp. 106–107.

২৭ Ibid, pp. 107–108.

২৮ Ibid, p. 110.

২৯ Coupland, Constitutional Problem, p. 200.

৩০ Ibid.

৩১ Ali, Choudhari Rahmat, The Millat of Islam and the Menace of Indianism, Cambridge, 1941.

৩২ Coupland, Constitutional Problem, pp. 200–201.

৩৩ Ali, Choudhari Rahmat, The Millat and Mission, Cambridge, 1942, pp. 1–18.

৩৪ Ali, Choudhari Rahmat, Pakistan, the Fatherland of the Pak Nation, Cambridge, 1947, Part I, Chapter 1, pp. 21–25.

৩৫ Mitra, Register, 1938, vol. II. p. 45.

৩৬ Ibid, pp. 48–49.

৩৭ Ibid, p. 49.

৩৮ Ibid.

৩৯ Ibid, p. 50.

৪০ Ibid, p. 51.

৪১ Ibid.

৪২ The Statesman, 6 April, 1939.

৪৩ Coupland, Constitutional Problem p. 202.

৪৪ Yar Yung, Nawab Dr. Nazir (Ed.), The Pakistan Issue, Lahore, 1943, p. XXIII.

৪৫ Ibid, p. XXIV.

৪৬ Ibid, pp. XXIV–XXV.

৪৭ Ibid, pp. XXV–XXVI.

৪৮ Ibid, p. XXVI.

৪৯ Coupland, Constitutional Problem, pp. 203–204.

৫০ Ibid, p. 204.

৫১ Ibid, p. 205.

৫২ Ibid, pp. 205–206.

৫৩ Yar Yung, Pakistan Issue, p. XXVII; vide also Ahmad, Islamic Modernism, p. 171.

৫৪ Ibid; Narayana, Lakshmi, Pakistan Problem : Hundred Questions to Muslim League Members, Meerut, 1946. The Appendix to this booklet contains several ‘schemes’ hitherto proposed in favour of India’s Partition. Sri Lakshmi Narayana was the President of the Delhi Congress Committee and Parliamentary Secretary of the United Provinces.

৫৫ Yar Yung, Pakistan Issue, p. XXVII.

৫৬ Ibid, P. 25.

৫৭ Ibid, p. 24.

৫৮ Ibid, p. 24–25.

৫৯ Ibid, pp. XIX–XXI.

৬০ Ibid, p. XXI.

৬১ Ibid, pp. VII–VIII.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *