ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – ৭

সাত

মানসিক একটি অস্বস্তি মনের মধ্যে যেন থেকেই যায়।

পরেরদিন কলেজ যাওয়ার সময় গেটের কাছে জাহানারার সাথে দেখা হয়। তার সামনে দুটি ছাত্রী। সে রাখীকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল একপাশে। তারপর বলল, রাখী তুই আজ আর ক্লাসে যাবি না।

ক্লাসে যাব না? কেন? রাখী অবাক হয়।

জাহানারার কপালে অস্বস্তির চিহ্ন দেখতে পায় রাখী। জাহানারা যেন গোপন করছে কিছু। সে জানতে চাইল, কী হয়েছে জাহানারা আপা? না, তেমন কিছু নয়, তবু আজকের ক্লাস তুই বাদ দে।

বাহ্, বলবে তো, কী হয়েছে? রাখীর রাগ হয়।

আহা বললাম তো, তেমন কিছু না- জাহানারা তবু বোঝাতে চেষ্টা করে। বলে, জানিসই তো কীরকম বাজে জায়গা এটা। একটা স্ক্যান্ডাল গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। কলেজের দুতিনটি মেয়েও আছে এর মধ্যে। বাইরের শয়তান ক’টা তো রয়েছেই।

রাখী শুনল, রাগল না। বুঝল, রাগ করার কোনো মানে হয় না। সে আর কথা না বাড়িয়ে অ্যাটেন্ডেন্স খাতা নিয়ে গম্ভীর মুখে ক্লাসের দিকে এগুল। ক্লাসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় অর্ধেক মেয়ে ক্লাস থেকে বার হয়ে চলে গেল। রাখী দেখেও যেন দেখল না। মুখ নিচু করে রোল কল করে যা পড়াবার ছিল পুরো ঘণ্টা ধরে পড়িয়ে গেল। খুব স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য দিন যেমন আচরণ করে, যেমন পড়ানোর মাঝখানে মজার দুএকটা কথা বলা, কি দুএকজনকে প্রশ্ন করা, কি কাউকে একটুখানি হাসানো— এইসবও সে আজ করল। তারপর ক্লাস শেষ করে বার হয়ে এল।

অন্যান্য টিচাররা রাখীর দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়ে দেখছিল। রাখী লক্ষ করল, জাহানারা ভয়ানক করুণ মুখে বসে আছে।

পরের ক্লাসেও ঐ একই পরিস্থিতি এবং এ ক্লাসটাও সে একইভাবে নিল। ক্লাস থেকে ফিরে এসে এক কাপ চা খেল। খাবার আগে ডাকল, জাহানারা আপা, চা খাবে? সিকান্দার ভাই, চা দিতে বলো এক কাপ।

সিকান্দার একটু পর হঠাৎ চলে গেলেন। জাহানারা যেখানে বসেছিল, ঐখানেই বসে রইল।

রাখী বুঝল, ব্যাপারটা বেশ বড় আকারে পাকিয়ে উঠেছে। সে ইচ্ছে করেই প্রিন্সিপ্যালের কামরায় গেল। জানতে চাইল, নতুন বইয়ের প্যাকেটগুলো আজ খোলা হবে কিনা। প্রিন্সিপ্যাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলেন রাখীকে। তারপর বললেন, বসো।

রাখী বসলে বেয়ারাকে ডেকে বললেন, দরজাটা বন্ধ করে দে, কেউ এলে বলবি, ব্যস্ত আছি।

তারপর ড্রয়ার খুলে লম্বা টাইপ করা একটা কাগজ রাখীর দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, এটা পড়ো— দুদিন আগে আমার হাতে এসেছে, ভেবেছিলাম তোমাকে জানাব না, কিন্তু মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা তোমার জানা দরকার।

রাখী বসে বসে চোখ বুলিয়ে গেল। লম্বা অভিযোগ— নানান দফার ফিরিস্তি দেওয়া। যেমন অধ্যাপিকা মহিলা বিবাহিতা বলে পরিচয় দিলেও তিনি বিবাহিতা নন— তাঁর সার্টিফিকেটও ভুয়া- স্থানীয় এঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সম্প্রতি তিনি রাতের অন্ধকারে নানান জায়গায় যাতায়াত করছেন এবং রাত কাটাচ্ছেন-

এই পর্যন্ত পড়ে কাগজটা ফিরিয়ে দিল রাখী।

প্রিন্সিপ্যাল জানতে চাইলেন, পড়লে না?

হ্যাঁ পড়লাম- রাখী জানল।

ব্যাপারটা কীরকম সিরিয়াস, বুঝেছ?

রাখী কিছু বলল না। ব্যাপারটা আসলেই কি সিরিয়াস? মনে হল, প্রশ্নটা করে। কিন্তু করল না। বলল, অভিযোগগুলো যে মিথ্যে, তা তো আপনিই ভালো জানেন। আমার ধারণা, সেই পুরনো লোকেরাই কাজ করছে এর পেছনে।

কিন্তু ওরা অভিযোগ করার মতো একটা সুযোগ পেয়েছে তা তো ঠিক। নয়, বলো? তুমি হাসান সাহেবের ওখানে রেগুলার যাওয়া-আসা না করলে কি এই সুযোগটা পেত?

ঠিক এই অভিযোগটা হয়তো করত না- কিন্তু তখন হয়তো আরো কোনো কিছু আবিষ্কার করত।

প্রিন্সিপ্যালের মুখের ওপর চিন্তার রেখাগুলোর আরো ঘন হতে দেখল রাখী। মুখ নিচু করে বললেন, তুমি বরং দিন কয়েকের জন্যে ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরে এসো।

রাখীর তখন বেশ রাগ হচ্ছিল। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের কাছ থেকে অন্তত সে এইরকম কথা আশা করেনি। বলল, ছুটি নিতে বলছেন, ছুটি নিচ্ছি, কিন্তু বাইরে কোথাও যাওয়া বোধহয় আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

রাখীর গলার স্বরে কী ছিল কে জানে, প্রিন্সিপ্যাল মুখোমুখি তাকালেন একবার। তারপর বললেন, ঠিক আছে, যা ভালো বোঝো করো। রাখী বুঝল প্রিন্সিপ্যাল চটেছেন। তার খারাপ লাগল, কিন্তু ঐ কথা ছাড়া রাখীর অন্যকিছু বলারও ছিল না। সে ধীরপায়ে বেরিয়ে এল।

তবে কি ঢাকাতেই ফিরে যেতে হবে আমার? রাখীর বিশ্রী লাগে গোটা ব্যাপারটা চিন্তা করলে। ক্লান্তিকর মনে হয় আগাগোড়া। খালি ভয়, খালি চোখরাঙানি, পদে পদে বাধা, সহজ হবার উপায় নেই, স্বচ্ছন্দ হবার পথ নেই, নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না- এ অবস্থায় কি মানুষ থাকতে পারে? সে ছুটি নিল, কিন্তু ছুটি নিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারল না। কলেজেও গেল, বাইরে ঘুরল ফিরল। সব ঠিক যেমন-যেমন করত তেমন-তেমনই। বিকেলে সে সেজানকে দেখতে যেত, সেটাও বাদ দিল না।

হুমায়ুন অনুরোধ করেছিল, ক’দিন অন্তত ওখানে যাওয়াটা বন্ধ করুন, গভর্নিং বডির মিটিংটা হয়ে যাক- তারপর নাহয় আবার যাবেন। আমরা সিচুয়েশনটা একটুখানি আয়ত্তে নিয়ে আসি।

রাখী অনুরোধ রাখেনি। বলেছে, ঐরকম অনুরোধ করবেন না। কয়েকটা বাজে লোক নোংরা সব কাজ করবে- আর আমাকে বসে থাকতে হবে ভয় পেয়ে- আত্মীয়-স্বজন মরতে বসলেও দেখতে যেতে পারব না— এ কখনো হয়? আপনিই বলুন?

হুমায়ুন চিন্তিত মুখে চলে গিয়েছে সেদিন। যাওয়ার সময় বলেছে, সাংঘাতিক জেদ আপনার।

রাখীর হাসি পেয়েছে কথাটা শুনে— এর নাম বুঝি জেদ? ভালো না-লাগাটি কি জেদ? অযৌক্তিক কিছু না-মানাটা কি জেদ? একথা সে কাকে বোঝাবে?

ঐসময় ছোট্ট একটি ঘটনা ঘটল— আর তা-ই রাখীকে আশ্বস্ত করে তুলল। সেই যে মেয়েটি, রোকেয়া যার নাম, সে একদিন মুখোমুখি দাঁড়াল। রাখী তখন লাইব্রেরি থেকে বাসায় ফিরছে। রোকেয়াকে দেখে দাঁড়াল, কী খবর, কিছু বলবে?

আপা, আপনি ক্লাস নেবেন না আর?

রাখীর মুখ দিয়ে ঐ মুহূর্তে কথা বেরুল না। শেষে বলল, বাহ্, কেন নেব না, ক’দিন পর ছুটি শেষ হলেই ক্লাস নেব।

আমি আপনার বাসায় যাব, রোকেয়া হঠাৎ বলল।

বাসায় যাবে? রাখী মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে পারে না। বলে, বেশ তো চলো।

আমাকে পড়াতে হবে।

যেন ঘোষণা একেবারে। রাখীর চিন্তা হয়, এ মেয়ে কোন্ বিপদ ঘটায় কে জানে। বলল, ঠিক আছে, চলে এসো, যখনই সময় পাবে।

রোকেয়া সেদিনই রাখীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় এল। সারাটা দুপুর কাটিয়ে বিকেলবেলায় বিদায় নিল।

পরের দিন রোকেয়া একা নয়- সঙ্গে আরেকটি মেয়ে- সেও রোকেয়ার মতোই বাইরে থেকে কলেজে আসে।

তিন দিনের দিন নিজের বাসায় একটা ছোটখাটো ক্লাসের মতো হয়ে গেল। মেয়েরাই জানাল, তাদের বাড়ির লোকদের মত নিয়েই তারা কলেজের পর রাখীর বাসায় এসে পড়াশোনা করছে। তোমরা ভয় পাও না? রাখী একদিন জিজ্ঞেস করে।

না, রোকেয়া মৃদু হাসে, ভয় পাব কেন?

অন্য মেয়েরাও হেসে ওঠে এবার, খারাপ লোকেরা খারাপ কথা বলবে না?

সাকিনা একটু লম্বা চওড়া, বড়সড়। সে বলল, আমরা ছেলেদের ইস্কুলে পড়াশোনা করে এসেছি- ওসব কথা শুনতে শুনতে কান আমাদের পচে গেছে। শুধু রেজাল্টটা বার হোক, তখনই দেখবেন কী হয়।

রাখীর খেয়ালই ছিল না যে রেজাল্ট বার হবার সময় হয়ে এসেছে, এ কলেজে আসার পর সব খাটাখাটুনি গেছে ঐ মেয়েদের পেছনে — তার নিজেরও আশা, মেয়েরা পরীক্ষায় ভালো করবে।

মেয়ে ক’টি হাসতে হাসতে বিদায় নেয়ার পর রাখীর মনে হয়েছে— মিছিমিছি চিন্তা করছে সে এত। যা ঘটবার তা আপন নিয়মেই ঘটে যাবে। তার এখানে থাকা না-থাকাটা খুবই সামান্য একটা ব্যাপার।

হ্যাঁ, আপন নিয়মেই বলতে হবে। কেউ চায়নি, কেউ প্রস্তুতি নেয়নি— কিন্তু মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল। হরিপুর থানার জীবনপুর গ্রামের জোবেদালী শ্বশুরবাড়ি থেকে তিন সের পাট নিয়ে বাড়ি ফিরছিল— গরু ছাগলের জন্যে দড়ি দরকার। মাঝপথে ধরে নিয়ে গিয়ে বেদম মার দিল জোবেদালীকে। খবরটা পৌঁছতে যা দেরি। ছুটে এল গাঁয়ের লোক, মারপিট হল, গুলি চলল, জখম হল কয়েকজন। ভজনপুরের হাটে তেঁতুলিয়ার এক গরিব চাষির গরু ধরা পড়ল। গরুচোরকে ধরা হয়েছে— কী করা হবে তাকে নিয়ে- তাই নিয়ে কথা হচ্ছে- এমন সময় একদল লোক এল তাকে ছাড়াতে, ব্যস্, আর দেখতে হল না- দমাদ্দম শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে য়ুনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বারের বাড়ির চালে লাল আগুনের জিভ লকলক করে উঠল আকাশের দিকে। খানসামা এলাকার এক হাটে ইজারাদারের লোক ঢুকতে পারে না— হাটের লোকজন বাঁহুকা নিয়ে তেড়ে আসে।

একই সময় ঘটেনি ঘটনাগুলো। ঘটেছে এখানে ওখানে, হঠাৎ হঠাৎ। কিন্তু ‘৬৭-র শীতকাল থেকেই যেন হাওয়াটা রুখে ওঠার দিকে বইতে লাগল। কোথায় যেন কী নড়েচড়ে উঠতে চাইছে— তারই আভাস মানুষের চোখেমুখে-মানুষের কথাবার্তায়। ডাকসাইটে জোতদার শৌখিন গরুর গাড়িতে চড়ে হাট সেরে বাড়ি ফিরছে। অন্ধকারের আড়াল থেকে ‘হা রে রে’ বলে ডাক ছেড়ে সমস্বরে চিৎকার করে উঠল কারা। ‘কে, কে ওখানে?’ বলে জোতদার মহাজন হাঁক ছেড়েও আর হদিশ করতে পারে না। শুধু শুনতে পায়, হাসির শব্দ অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।

এসব ঘটনা নতুন কিছু নয়। ক্ষেতমজুরের রক্তের ভেতরে বইছে এসব ঘটনার বীজ যুগ-যুগ ধরে। রাতের অন্ধকারে জোতদারের রোপা আমন ক্ষেতের পানি আল কেটে বার করে দেবার ঠিক আগের মুহূর্তটিতে ঐ বীজ আদিম উল্লাসে অঙ্কুরিত হয়-ক্ষেতমজুরের বুকের ভেতরে। সার সার ধানের পুঞ্জের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবার আগের মুহূর্তটিতে বঞ্চিত কিষাণের দুচোখ যখন ধক ধক করে জ্বলে, তখন ঐ বীজ একটি দুটি করে দল মেলে। ঐ বীজের চারা ডালপালা মেলে উল্লাসে এপাশ ওপাশ করে, কিশোর রাখাল যখন দেখতে পায় মহাজনের নধর গরুটি মহাজনেরই ক্ষেতের ধান খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে। তাই ঘটনাগুলো নতুন নয়।

শুধু তফাত এই যে ‘৬৭-র শীতকালে বিচ্ছিন্ন হলেও ঘটনাগুলো এখানে ওখানে ঘন ঘন ঘটতে লাগল এবং বলা যায়, আপন নিয়মেই ঘটতে লাগল।

রাখী সেদিন বিকেলে গিয়ে দেখে, সেজানের ঘরে চার-পাঁচটি তরুণ ছেলে। বেশ উত্তেজিত কথাবার্তা হচ্ছে। কে একজন বলছে, কেন বাধা দেব না— হামলা হবে আর আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব? আপনারা অসুখের দোহাই দিয়ে হাত গুটিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন- আমরা পারি না। আমাদের সেসময়ই নেই। জীবনমরণ সমস্যা আমাদের। আপনি বলেছিলেন, লোক পাঠাবেন। কোথায় আপনার লোক?

এই বেলাল— কী বলছ পাগলের মতো? ছেলেমানুষের মতো কথা বোলো না। বিচার-বিবেচনার দরকার আছে।

আরে রাখেন ভাই আপনার বিচার-বিবেচনা। আপনাদের ঐরকম ভদ্দরলোকি বিচার-বিবেচনা দেখতে দেখতে চোখ পচে গেছে আমাদের- ওসব ওজর আপত্তি আর শুনতে চাই না আমরা।

রাখী ঐরকম উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে বেরিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় মিন্টুর সঙ্গে দেখা। মিন্টু বলল, চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ, এখন ভালোই তো আছেন দেখছি— দিব্যি রাজনীতির তর্কাতর্কি চলছে।

আর বলবেন না। ক’টা মাথাগরম ছেলেকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল— একটা কিছু ঘটাবার জন্যে যেন মুখিয়ে আছে একেবারে।

তো এখানে কেন? রোগী মানুষকে নিয়ে টানাটানি কি ভালো? উনি কী করবেন, শরীরের ঐ অবস্থায় কি ওসব ধকল সইবে?

মিন্টু ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ায়- ভারি গোলমেলে ব্যাপার পাকিয়ে উঠেছে। ওদিকে আবার দেবু উত্তেজনা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

দেবু? রাখীর খটকা লাগে, মানে দেবতোষ?

হ্যাঁ, মিন্টু জানায়, দেবতোষ তো এদিকেই কাজ করছে এখন।

রাখীর মনে পড়ল— সন্দেহটা তাহলে তার অমূলক ছিল না। সে জানতে চাইল, দেবতোষেরা কী চায়?

ওর, কনফ্রন্টেশনে যেতে চায়, এক্ষুনি— সংগঠন থাক বা না থাক।

আর আপনারা?

আমরা? মিন্টু কেমন হাসে রাখীর প্রশ্ন শুনে। বলে, আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমরা জানি, আন্দোলন হোক, কনফ্রন্টেশন হোক— কিছুই আমরা বাদ দেব না- কিন্তু প্রস্তুতির জন্য সময় চাই আমরা। তাছাড়াও কোন্ জায়গার কীরকম অবস্থা সেসবও জানা দরকার।

রাখী আর কিছু জানতে চায় না। শুধু বলে, দেখবেন, ওঁর শরীরের এই অবস্থায় ধকলটা যেন আর না বাড়ে।

ও-কথা আমাকে বলে লাভ নেই, মিন্টু জবাব দেয়। বলে, হাসান ভাই যা লোক, কিচ্ছু বিশ্বাস নেই— হয়তো দেখবেন, নিজেই একদিন ওদের সঙ্গে চলে গিয়েছেন।

রাখীর খারাপ লাগে মিন্টুর কথার ধরন দেখে। মনে হয়, সেজানের অসুখের ব্যাপারটা যেন ওর কাছে কিছুই নয়— আর দশটা সহজ ঘটনার মতোই। সে কিছুটা ধারালো স্বরেই বলে, উনি চলে যাবেন, আর আপনারাও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন— ওঁর শরীরের ঐ অবস্থা জেনেও। মিন্টু রাখীর গলার স্বর শুনে মুখোমুখি তাকায়। বোধহয় বিরক্ত হয় ঈষৎ। বলে, দেখুন, প্রয়োজন যদি হয় তাহলে নিশ্চয় যেতে দিতে হবে।

কথাটা বলেই মিন্টু আর দাঁড়ায় না, সেজানের ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢোকে। সেখানে তখনও তুমুল কথাবার্তা চলছে।

রাখী আরো কিছুক্ষণ দাঁড়াল। বিকেল আর নেই— শেষ শীতের বাতাসে কেমন একটা প্রখর ভাব। উঠোনে একটা নিমগাছ, একটা পাতা নেই গাছটাতে। ইঁদারার চাতালে বসে একটি মেয়ে বাসন মাজছে। সেজানের ঘরের ভিতরে কে যেন প্রচণ্ড ধমক দিয়ে উঠল। রাখী একমুহূর্ত দাঁড়াল হাঁটতে হাঁটতে। তার কিছুই করার নেই। শুধু আসা আর চলে যাওয়া। তার মনে হল, এভাবে চলে যাওয়াটা ভয়ানক অর্থহীন। সে ফিরল। একটি ছেলে তখন হাত ছুড়ে ছুড়ে চিৎকার করছিল— আপনারা ভয় পেয়েছেন। রাখী কয়েক মুহূর্ত ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়েছিল। কী দেখেছিল সে স্পষ্ট বলতে পারবে না। সম্ভবত একটা উদ্দেশ্যহীন অস্থিরতাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অহেতুক এই চিৎকার। তার গলা দিয়ে সেই মুহূর্তে পাল্টা চিৎকার বেরিয়ে এল— চুপ, আপনারা চুপ করুন।

রাখী গলার স্বরে প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া মতো টানটান তীব্রতা ছিল। আর তাতেই সম্ভবত সবাই চুপ করে গেল। আর সেই মুহূর্তে রাখী হুকুম করতে লাগল— এ ঘর থেকে বেরিয়ে যান। যান বলছি- রোগীর ঘরে এত হল্লা কিসের? রোগীর ঘরে চিৎকার করতে বাধে না আপনাদের? কী রাজনীতি করেন আপনারা?

সেজান তখন উঠে বসেছে। বলছে, রাখী, আহ্ তুমি কেন এলে আবার, চুপ করে বসো তুমি।

রাখী সেজানের কথায় কান দিল না। ঘরের কোণ থেকে গেলাশে পানি নিয়ে ওষুধটা সেজানের মুখের কাছে ধরল, নিন ওষুধ খান, ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। ওষুধ খাওয়ার পর সেজান বালিশে হেলান দিলে রাখী হুকুম করল যেন। বলল, ঘুমোন এবার- আর কোনো কথা নয়। ঘরের ভেতরে যারা তখনও ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা পরে আসবেন- আরেকটু সুস্থ হয়ে উঠুন উনি, তারপর তর্কাতকি যা করার করবেন।

ম্যাডাম, আমাদের অসুখ হলে কি আমাদেরও ঐরকম সেবাযত্ন করবেন? কথাটা কে বলল রাখী বুঝতে পারে না। কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়ায়। ছেলেটাকে সে দেখতে চায়। বলল, হ্যাঁ কে বলল কথাটা, সামনে আসুন, চিনে রাখি আপনাকে- আসুন, সামনে এসে বলুন।

ঘরটা খালি হল বটে, কিন্তু বাইরের নানান ধরনের তীব্র কটাক্ষ শোনা গেল। যেন গনগন করছে এমন ভাব ফুটেছে রাখীর চেহারায়। সেজানকে সে কিছু বলল না। বিছানাটা টেনেটুনে ঠিক করল। ছোট টেবিলে ওষুধপত্র গেলাশ জগ গুছিয়ে রাখল। একবার সেজানের কপালে হাত রেখে উত্তাপ আন্দাজ করল। তারপর বলল, আপনি খুব বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছেন। সেজান চুপচাপ শুয়ে রইল। পেটের ভেতরটাতে পুরনো ব্যথাটা তখন আবার অল্প অল্প পাক খাচ্ছে। তার কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। রাখী বুঝছিল সেজান চটেছে। কিন্তু তার কেমন বেপরোয়া ভাব তখন। সে তৈরি হয়ে রয়েছে। কেউ চটলেও সে পরোয়া করবে না। যা ভালো বুঝছে— তা সে করবেই।

ইতিমধ্যে কে লণ্ঠন দিয়ে গেছে। রাখী টুলের ওপর চুপচাপ বসল, উত্তেজনাটা তখনও মনে রয়েছে। সে জানে না, কেন এইরকম একটা সীন করল সে। সেজানের ভ্রূতে একেকবার কুঞ্চনরেখা দেখতে পাচ্ছিল সে। মনে হচ্ছিল, বোধহয় দুশ্চিন্তা হচ্ছে, আবার মনে হচ্ছিল, বোধহয় কষ্ট। সে মাথার কাছে ঝুঁকে পড়ল, কষ্ট হচ্ছে আপনার? বলুন কষ্ট হচ্ছে, ব্যথাটা আবার আরম্ভ হয়েছে, তাই না?

সেজান চোখ না-খুলেই বলল, রাখী তুমি ঠিক করোনি— আমি ওদের বুঝিয়েসুঝিয়ে ফিরিয়ে দিতাম— কেন ওরকম কাজ করলে, বলো?

রাখী কি জানে, কেন ঐরকম একটা কাজ করল সে। সে মনে-মনে খুঁজে কোনো কারণ পায় না। শুধু মনে হয়, ঐরকম কিছু করা তার দরকার ছিল। কোনো কৈফিয়ত, কোনো যুক্তি সে দিল না। শুধু বলল, আমি এখনই চলে যাব—অসুখটাকে যদি বাড়াবার ইচ্ছে থাকে, তাহলে বাড়াবেন— আমার কিছু বলবার নেই।

তার ভয়ানক বিরক্তি লাগছিল। কী মানে হয় এইরকম লোকদের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে। একবার মনে হল, এক্ষুনি ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায়। পরক্ষণেই মনে হল বেরিয়ে যাওয়াটাও সমান অর্থহীন। সে টুলের ওপর বসে মুখোমুখি হল সেজানের।

সেজান তখনও বলছিল, কাজটা তুমি ভালো করেনি, যদি কোনো অঘটন ঘটায় ঐ ছেলেরা, তাহলে কিন্তু মারাত্মক খেসারত দিতে হবে আমাদের আমরা স্ম্যাস্‌ড হয়ে যাব— একটা লোকের শারীরিক ভালোমন্দের ব্যাপারটা এখানে বড় নয়— তুমি যা করলে তাতে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের। রাখী চোখবোজা মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল। তার মনের ভেতরে তখন অতীত তোলপাড় করছে। মনি ভাইকে মনে পড়ছে, আব্বাকে মনে পড়ছে, বুবুকে মনে পড়ছে- আর সেইসব পুরনো ঘটনার মধ্যে প্রকাণ্ড একটা অর্থহীনতা ছাড়া অন্যকিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। সেজান যখন বলল, তুমি যা করলে তাতে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের, তখন যেন মনের ভেতরে কেউ চিৎকার করল, রাখী এখনো কেন রয়েছিস- যা, চলে যা তুই।

আমি বুঝলাম না, সেজান বলেই চলেছে, ঐরকম করে ওদের তাড়িয়ে দিয়ে তুমি কী প্রমাণ করলে।

গলায় শ্লেষ, সেজান তাকে আক্রমণ করতে চাইছে। সে লক্ষ করে দেখল— ছাইপানা মুখ, চোখ গভীর কালো গর্তে ঢোকা, চোয়াল ঠেলে উঠেছে, মুখভর্তি দাড়ি— কে এই লোক? তার মনের ভেতরে কেউ যেন ফুঁসে উঠছিল থেকে-থেকে। এই লোকের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? কেন এতসব কথা শুনতে হচ্ছে তাকে? লোকটার কাছে তার এমন কী দায়?

সেজানের কথা তখনও ফুরোয়নি। বলল, আমি জানতাম, একটা মিনিমাম সেন্স অফ রেসপন্সিবিলিটি রয়েছে তোমার। ছেলেগুলো অনেকদূর থেকে এসেছিল- অনেক আশা ছিল ওদের- একটা সিদ্ধান্তে আমরা হয়তো পৌঁছে যেতাম, একটা প্রোগ্রাম হয়তো তৈরি করা যেত— কিন্তু তুমি—

সেজানের কথা তখন তীব্র, আর তাই শুনতে হচ্ছিল। এমনভাবে কেউ রাখীর সঙ্গে কথা বলেনি। মনে পড়ল একদিন সে নিজেই সেজানকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিল। সেজান কি সেদিনের সেই আক্রমণের শোধ নিচ্ছে? সে বলল, শান্তস্বরেই বলল, আপনাদের রাজনীতি আমি বুঝি না- অনেক বড় আপনাদের কাজ— কিন্তু কমনসেন্সের যে কথাটা বললেন, সেই কমনসেন্স থেকেই আমার মনে হয়— মানুষের জীবনটা অনেক বেশি দরকারি- বেঁচে থাকাটাই সবচাইতে বড় কাজ।

তারপর রাখী জানাল, রাত হয়েছে, আমি এখন চলে যাব। শুধু অনুরোধ, দয়া করে ওষুধ খাবেন আর নিয়ম মেনে চলবেন— টেনশন তৈরি করবেন না, দোহাই আপনার। মানুষের জীবন একটাই।

রাখী ঐ কথা ক’টি বলল স্পষ্ট করে— তারপরই বেরিয়ে এল।

হ্যাঁ, বেরিয়ে এল। রাখী জানে না, এ কেমন বেরিয়ে আসা। আসলেই কি কোথাও সে ঢুকেছিল। জানে না রাখী। অন্ধকার বারান্দা। অস্পষ্ট উঠোন আর নিঃশব্দতায় মোড়ানো বাড়িটার সীমানা একে একে পার হয়ে এল। তার চোখ থেকে-থেকেই ঝাপসা হয়ে উঠেছে। পেছনে সেজান বোধহয় ডাকছিল তখন। রাখী মনকে জোর করে ফেরাল- না, এখানে নয় আর- এখানে তার জন্য কোনো জায়গা নেই।

সেদিন রাখী চোখ-ফাটানো পানি ফেলতে ফেলতে অন্ধকারের ভেতরে ভেতরে অনেকটা পথ পার হয়ে রিকশয় উঠেছিল। রাস্তাটাও ছিল আলোহীন, সামনের দিক থেকে শীতের শেষ হাওয়া বইছিল। রাস্তার দুপাশে আখের ক্ষেতে বাতাসের এপাশ ওপাশ ফেরার শব্দ কানে আসছিল— রাখী তুই কি অন্ধকারের দিকেই যাবি শুধু? শুধু ঘর থেকে বেরিয়ে আসা তোর? বারবার ঘর থেকে বার হয়ে তুই কোথায় যেতে চাস?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *