পাঁচ
শূন্যতায় ভাসমান ছিল যেন। চারদিকে ছায়ার মতো দেয়াল, দড়িতে ঝোলানো কাপড়-জামা, টেবিলের ওপর একটা লণ্ঠন- কে একজন ঝুঁকে রয়েছে মুখের ওপর। মাথাটা অসম্ভব ভারী, একদিক থেকে আরেক দিকে হেলনো যায় না। একজনের হাতে সিরিঞ্জ। ওপরে তোলা হাতসুদ্ধ সিরিঞ্জটি একেকবার আবছা হচ্ছে, আবার একেকবার স্পষ্ট হচ্ছে। অচেনা গলার স্বর শোনা যাচ্ছে- কিন্তু ও কার গলা, ধরা যাচ্ছে না। মা ইস্কুলে গেছে এখন। মামা, ও মামা! মীজানের গলা শোনা গেল বোধহয়। নওজোয়ান, নওজোয়ান, বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান— এক নাম্বার ওয়ার্ডে লকআপের পরে ছেলেরা গান জুড়েছে। জানালার ওপারে শিউলিতলায় সেন্ট্রি গান গাইছে— পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়। ঢং ঢং ঢং পাগলা ঘণ্টি বেজে উঠল— ওয়ার্ডে যাও, ওয়ার্ডে যাও— কে যেন চিৎকার করে বলছে। বিশ্বাস করো, নেতৃত্বে বিশ্বাস করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। বলতে পারিস, আমার বিশ্বাস হয় না কেন?
সেজান এইরকম স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝখানে পড়ে রইল। মাঝে মাঝে জাগল। জেগে দেখল, রাখীর মুখ ঝুঁকে রয়েছে তার ওপরে। রাখী, তুমি এখানে কেন? রাখী শুনল কি না, বোঝা গেল না। চোখ খুলে রাখতে ইচ্ছে করে না। শব্দ হলে কানে ভয়ানক লাগে। হাসান ভাই হা করুন, ওষুধটা খান। ওষুধটা না-তেতো, না-মিষ্টি, না-টক—অদ্ভুত বিশ্রী স্বাদের মুখটা ভরে গেল, থুঃ— এ আবার কে? নিশ্চয়ই মিন্টু, তুমি কখন এলে? তোমাদের এলাকার খবর কী?
একেক সময় শব্দ, মানুষ, দেয়াল, কাপড়চোপড় সব গলে গলে একটা ধূসরতার মধ্যে মিশে যায়। সেখানে আলো পড়ে না, ছায়া পড়ে না। ভোঁতা একটা যন্ত্রণা পেটের দিকে কেবলি পাক খায়। সেই যন্ত্রণাটা স্পষ্ট হয় একসময়, অনেক দূরে চিৎকার হয় কোথায় আর ঐ যন্ত্রণা এবং চিৎকার আবার সবকিছু ফিরিয়ে আনে।
এখন নিশ্চয়ই দুপুর। ও, রাত হয়ে গেছে বুঝি? তাই কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দরজার কাছে কে দাঁড়িয়ে- দেবু দেবু, তুমি চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছ তো? রাখী এখন ঢাকায় নেই, না না ঢাকায় কেন যাব এখন?
এইরকম অসংলগ্ন স্মৃতি, ধূসর ইচ্ছে, শিথিল চেতনা আর অবশ অনুভূতির মাঝখান থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতায় ফিরল সেজান। এবং স্বাভাবিকতায় ফিরে অস্থিরবোধ করতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকে—বোধহয় ঘুমোয়। তারপরই খোঁজ নেয়-মিন্টু কি এসেছিল? হাযদার আসেনি? কালমেঘ হাটের গোলমালের খবরটা শেষপর্যন্ত কী হয়েছে জানো? শিবনাথবাবুকে খবর দাও একবার।
অস্থিরতা দেখে ডাক্তার ভয়ানক বিরক্ত হন।
কামাল, সকালবেলার দিকে যে দেখাশোনা করে সে, একেবারেই বাচ্চাছেলে, একেক দিন ঘাবড়ে যায়। দুপুরে আনোয়ার থাকে- সে শান্ত রাখার চেষ্টা করে— আপনি এখন অসুস্থ, ওসব ভাববেন না— আগে সুস্থ হয়ে উঠুন। সেজান মাথা নাড়ায় হতাশ হয়ে। বলে, ডাক্তার কি আমাকে নর্মাল ডায়েট দেবেন না? আর কতদিন এভাবে শুয়ে থাকতে হবে আমাকে- ডাক্তার কিছু বলেনি?
কিন্তু রাখী এসে যাওয়ার পর সেজান ভারি চুপচাপ হয়ে যায়। বিকেল থেকে রাখী থাকে— ঘরের গোছগাছ ওকেই করতে হয়। পরের দিন বিকেল পর্যন্ত ওষুধ, পথ্যি, দেখাশোনার লোক- সব ঠিক করে, সেজান ঘুমিয়ে গেলে, তবে সে বাসায় ফেরে।
রাখীকে আজকাল অন্যরকম লাগে। ভয়ানক নিঃসঙ্কোচ ব্যবহার ওর। যেন রোগীর অভিভাবক সে-ই। বিকেলবেলা টেম্পারেচার নেয়ার পর থার্মোমিটার ঝেড়ে মুখের কাছে এগিয়ে দেয়, কপালে হাত রাখে। ঘাড়ে হাত রেখে উঠিয়ে বসায়, তারপর দুধের গেলাশ মুখের কাছে তুলে ধরে। খাওয়া হয়ে গেলে আবার আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে মুখ মোছায়। খুব সাবলীলভাবে রাখী এসব করে।
একদিন সেজান একটা চিঠি পড়ছিল। বেশ লম্বা চিঠি, তেঁতুলিয়ার এক কর্মীর পাঠানো। রাখী চিঠিটা পড়তে দেয়নি। বলেছে— এসব পরে হবে, আপাতত শরীরটা সুস্থ হোক।
রাখীর আচরণে সেজানের অবাক লাগে। রাখী তো এমন ছিল না। কিন্তু কিছু বলে না। বলতে পারে না। কী বলবে? রাখী, তুমি খুব পরিশ্রম করছ আমার জন্যে, নাকি জানতে চাইবে, রাখী, তোমার কলেজের কাজে অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়ই। সে বোঝে, এখন আর এসব কথা বলা যায় না। রাখী চুপচাপ বসে থাকে টুলের ওপর। একবার মনে হয়, ঘুমোচ্ছে সেজান— আবার মনে হয়, ঘুম নয়, ভান। ভান করে শুয়ে আছে। রাখী বোঝে, সেজান একেক দিন ঘুমের ভান করে চোখ বুজে থাকে। সে বুঝেও কিছু বলে না। বলার দরকার বোধ করে না। মুখোমুখি শক্তপায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল সে। দেখতে চেয়েছিল সেজান কীভাবে মরে। তো দেখল সে। না, কান্না পায়নি তার। ভয়ও না। প্রথমদিন ভয় আর কান্না মেশামেশি হয়ে উঠে এসেছিল বুকের ভেতর থেকে। কিন্তু ঐ প্রথমদিনই। তারপর সে রোজ এসেছে। একেক দিন সারারাত কাটাতে হয়েছে। কোনো- কোনোদিন ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে এসেছে। হুমায়ুনকে বলে বরফ আনিয়েছে আইসক্রিম কারখানা থেকে। জেলা শহরে লোক পাঠাতে হয়েছে একটা বরফ রাখার ফ্লাস্ক জোগাড় করার জন্যে। একটা ছোট টেবিল, খানদুই তোয়ালে, কিছু বাসন-কোশন, স্টোভ— রোগীর জন্যে যা যা দরকার, সব জুটিয়ে আনতে হয়েছে তাকে। একবার কথা উঠেছিল স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানোর। কিন্তু রাখীই তখন বলেছে, না- রোগী এখানেই থাকবে।
কেন বলেছিল, এখন বলতে পারবে না। শুধু এটুকু জানে যে, ঐ মুহূর্তে মনে হয়েছিল, সেজানের অন্য কোথাও যাওয়া উচিত হবে না। এবং ঐ মনে হওয়াটুকুই যেন যথেষ্ট ছিল তার কাছে। আর কিছু বিবেচনা সে করেনি। শিবনাথবাবু স্থানীয় হাসপাতালের অব্যবস্থার কথা জানতেন। রাখীর কথা বলার ধরন দেখে তিনিও বলেছিলেন— হ্যাঁ, রোগী এখানেই থাকবে- আমরাই দেখাশোনার ব্যবস্থা করতে পারব।
এখন সেজানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায়, ক’দিন আগেও কী ভয়াবহ চেহারা ছিল ঐ মুখের। মৃত্যুর কালো ছায়া কেমন গাঢ় হয়ে নামছিল একটু একটু করে। আর বসে বসে তাই দেখতে হচ্ছিল তাকে। কোনো-কোনোদিন মাঝরাতে অস্থির হয়ে এপাশ-ওপাশ করতে দেখে রাখী ঝুঁকে পড়েছে মুখের ওপরে। জিজ্ঞেস করেছে— কষ্ট হচ্ছে খুব? এরকম করে না, তাহলে আরো কষ্ট হবে।
শীতের গভীর রাত, বাইরে উত্তরের হাওয়া বইছে তখন। কোথায় যেন কুকুর কাঁদছে একটা। রাখীর মনে আশঙ্কা দুলে উঠেছিল, এই কি তাহলে শেষ রাত? মৃত্যু কি ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে? তার বুকের ভেতর কান্না টালমাটাল হয়েছে, দুবাহু দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছে সেজানকে, আর মনের দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে বলেছে— না মরতে পারবে না তুমি, কিছুতেই মরা চলবে না তোমার।
সেদিনের ঐ রাত রাখীকে কোথায় ঠেলে দিয়েছে, রাখী নিজেই জানে না। পরের দিন, দিনের আলোয় স্মরণ করে ব্যাপারটা অবশ্যি অস্বাভাবিক মনে হয়েছে নিজেরই কাছে। কিন্তু লজ্জা পায়নি সে। মনে হয়েছে, ঐরকম অস্বাভাবিক কিছুই তার করণীয় ছিল। ও ছাড়া অন্যকিছু তার করবার ছিল না।
আসলে মৃত্যু বোধহয় মানুষকে বদলে দেয়। মৃত্যুর মুখোমুখি হলে চিন্তাভাবনা আচার-আচরণ সবকিছুতে মানুষ অন্যরকম হয়ে যায়। সুমিতাকে লেখে— সুমি, এ যাত্রা বোধহয় বেঁচে গেল সেজান। তুই যে একবার তোর এক রোগীকে বরফ দেওয়ার কথা বলেছিলি— তোর কাছ থেকে শেখা ঐ বিদ্যেটা খুব কাজে লেগেছে। এখানকার ডাক্তারও অবশ্যি বলেছিলেন, কিন্তু জোর দেননি। আমি বহুকষ্টে বরফ যোগাড় করেছি। ঐ বরফের জন্যে খুব ভালো কাজ হয়েছে— ডাক্তার তো তাই বললেন। সুমি মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করা খুব বড় কাজ রে। আমি কাউকে বাঁচিয়েছি একথা বলা যায় না। কিন্তু তবু একজন মানুষকে বেঁচে উঠতে সাহায্য করেছি, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার সময় আমি তার পাশে ছিলাম- এ উপলব্ধিটা মানুষকে একেবারেই বদলে দিতে পারে। আর শোন্, লোকটাকে এখনও বিছানায় শুইয়ে রেখেছি— কিন্তু তুই তো জানিস, কীরকম লোক ও— শিগিরই সুস্থ হয়ে উঠবে আর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বেরুবে। আর তার ফল কী হবে, সেটাও তোর জানা। বলে দে, আমি এখন কী করি।
সুমিতা তার চিঠির নানান অর্থ করবে সেটা সে জানে। তবু ঐরকম ভাষায় চিঠি লেখে সে। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবও একদিন বলেছিলেন, দ্যাখো, লোকের চোখে কিন্তু ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না, ওখানে রাতে থাকাটা তোমার উচিত নয়। রাখী শুনেও শোনেনি, এমন ভাব দেখিয়েছিল। শেষে বলেছে— লোকে যদি খারাপ দেখে, তাহলে দেখবে, ভদ্রলোককে ঐ অবস্থায় দেখাশোনা না করে পারা যায়? বলুন, আপনি পারতেন?
ঐ কথার পর প্রিন্সিপ্যাল সাহেব স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, তুমি যে একটা মেয়েদের কলেজে চাকরি করছ- সেটা তো ভুললে চলবে না।
শুধু প্রিন্সিপ্যাল নন, জাহানারাও একদিন খোলাখুলি বলে দিল, দ্যাখ্ এটা একেবারেই গেঁয়ো জায়গা— মানুষের ধ্যানধারণা খুবই সংকীর্ণ— তুই রাতটা ওখানে নাইবা থাকলি। ওদের লোকজন তো শুনেছি একেবারে কম নয়।
রাখী যেন জানত এ-ধরনের কথা তাকে শুনতে হবে। সে জাহানারার কথার পিঠে কথা বলেনি। অল্প হেসেছে। বলেছে, দেখি তোমার পরামর্শ অনুযায়ী চলা যায় কি না।
কথাটা বলতে হয় বলে বলা। সে কেমন করে বোঝাবে যে তার আর কোনো উপায় নেই। কেমন করে বোঝাবে যে, সে যেখানে পা রেখেছে, সেখান থেকে আর সরে আসতে পারেনি। অনেকবার ভয় পেয়েছে সে, অনেকবার পাশ কাটিয়েছে, অনেকবার আপোষ করেছে— কিন্তু এখন আর সে ওসব করতে চায় না। শক্তপায়ে যখন একবার দাঁড়িয়েছে সে, তখন সে দাঁড়িয়েই থাকবে। শেষপর্যন্ত তাকে দেখতে হবে।
ইতিমধ্যে দেবতোষের সঙ্গে দেখা হয়েছে বারদুয়েক। সে নাকি কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় রয়েছে। জিজ্ঞেস করলে জানিয়েছে, অন্যকিছু না, আপাতত ইস্কুলমাস্টারি করছি। কথাটা শুনে রাখীর খটকা লেগেছে। দেবতোষের মতো লোকের নিরীহ ইস্কুলমাস্টার হবার কথা নয়। তার কৌতূহল হয়েছিল, কিন্তু খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করার সময় পায়নি। দেবতোষেরও ঐসময় খুব তাড়া ছিল।
তবে অনুমানে বুঝেছে। দেবতোষ আসলে রাজনীতির কাজেই ব্যস্ত এ এলাকায়। ইস্কুলমাস্টারি একটা ছুতো।
মাঝখানে একদিন আশরাফের সঙ্গে দেখা। সেদিন দুপুরবেলা আশরাফ মুখোমুখি বসল। রাখী লাইব্রেরিতে একাকী বসে খাতা দেখছিল। আশরাফ ঐসময় জিজ্ঞেস করল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
রাখীকে হাসতে হল। বলল, করুন, কিন্তু জটিল কোনো কথা নয় তো?
না, আশরাফ হালকা ভাব আনল গলায়। বলল, আপনি কলেজের ব্যাপারে একেবারেই নজর দিচ্ছেন না আজকাল-
রাখী সহসা কথা খুঁজে পায় না। কী বলবে সে? বলবে কি যে আরো বেশি জরুরি কাজে ব্যস্ত বলে কলেজের দিকে নজর দিতে পারছে না? না, আশরাফের কাছে ঐভাবে কথাটা সে বলতে পারবে না। বলল, কে বলল নজর দিচ্ছি না, নইলে দুপুর অব্দি কলেজে একা একা খাতা দেখি?
আশরাফ বুঝল, রাখী পাশ কাটাচ্ছে। বলল, আমি আমার কাজের কথা বলছিলাম। আমি কী করছি তা একদিনও দেখলেন না। আপনাদের ল্যাবরেটরি বিল্ডিঙের ছাদ ঢালাই হয়ে গেল- কিন্তু আপনাকে দেখলাম না।
রাখী এবার মুখোমুখি তাকায়। বলে, ফোপর-দালালি কি ভালো, বলুন? না-বুঝে প্রথম-প্রথম ফোঁপর-দালালি করেছি বলে সবসময়ই করব? আপনি তো চটতেন খুব, চটতেন না?
আশরাফ বোঝে রাখী আসল কথাটা বলতে চান না। তখন সে সোজাসুজি প্রসঙ্গে আসে। জানতে চায়, আপনার আত্মীয় ভদ্রলোকের শরীর কি এখন সুস্থ হয়েছে?
রাখী কিছুটা অবাক হয়। আশরাফ কেমন করে জানল যে সেজান অসুস্থ? সে জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায় শুনলেন, চেনেন ভদ্রলোককে?
আশরাফ মাথা নাড়ায়, বলে, আমি চিনব কোত্থেকে? কলেজের লোকেদের কাছেই শুনলাম, ভদ্রলোককে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আপনাকে— তাই জিজ্ঞেস করলাম।
রাখী লক্ষ করল, আশরাফ আজ একটু বেশি চঞ্চল— তার কথা যেন ক্রমেই ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। আরো কী যেন সে বলতে চায়।
একসময় সত্যিসত্যিই আশরাফ বলল কথাটা। জানাল, আমি বোধহয় চলে যাচ্ছি-
রাখী চমকায় ঈষৎ। বলে, চলে যাচ্ছেন, কোথায়?
দেখি, কোথায় হয়, আশরাফের গলা উদাস শোনায়। বলে, আর ভালো লাগছে না, অনেকদিন হয়ে গেল।
এ চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন?
হ্যাঁ।
অন্য চাকরি পেয়েছেন?
না, ঠিক পেয়েছি বলা যায় না। তবু সেইরকমই আর কী। আসলে চাকরি নয় ঠিক— আমার এক বন্ধু একটা ফার্ম খুলেছে ঢাকায়, কনসালটেন্ট ফার্ম- ওর সঙ্গেই জুটব ভাবছি।
রাখীর সেই মুহূর্তে হাসান ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। হাসান ভাইও চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নেমেছে। আশরাফের মুখের দিকে তাকিয়ে তার খারাপ লাগে। আশরাফ লোক হিসেবে খুব বালো। সে মনে-মনে আঁচ করতে চাইল ক’বছর পর আশরাফের চেহারাটা কীরকম দাঁড়াবে। বলল, খুব বড়লোক হতে চান?
আশরাফ মুখ নিচু করে হাসে, বলে, সবাই অবশ্যি তা-ই ভাবছে, তবে আমি টাকাপয়সার কথাটা এখনো ভাবিনি। আমার এখানে থাকাটাই ভারি উদ্দেশ্যহীন লাগছে— একরকম রুটলেস মানসিক অবস্থায় আর কদ্দিন থাকা যায় বলুন?
রাখীর বিরক্তি লাগে আশরাফের কথার ধরনে। কেন এসব কথা শোনাচ্ছে আশরাফ। রাখী তো তাকে প্রায় স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিল, যে তার চিন্তাভাবনার কাছাকাছি হওয়া রাখীর পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হবে না। সে বলল, হ্যাঁ, রুটলেস অবস্থায় থাকা যায় না- আপনার শুভ কামনা করি।
আশরাফ যাবার জন্যে উঠল, একটা কথা বলে যাই আপনাকে, আপনিও কিন্তু থাকতে পারবেন না এখানে- এরা আপনাকে শেষপর্যন্ত তাড়াবে, দেখবেন।
কেন ওকথা বলল আশরাফ? চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ রাখী একাকী লাইব্রেরিতে বসে রইল। এ কি ক্ষোভ, নাকি ঈর্ষা? মনে-মনে খুঁজল। কখনো কি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হতে পারে এমন আশ্বাস পেয়েছিল আশরাফ? না, তার মনে পড়ে না ঐরকম কোনো ঘটনার কথা। আসলে এ-ও মাজহারের মতোই একটা ঘটনা। অত সোচ্চার নয়- কিন্তু ঐরকমই ঘটনা আসলে। তার কিছুই করার ছিল না এ-ব্যাপারে। সে মনে-মনে আশরাফের শুভ কামনা করল।
তবে আশরাফের শেষ কথাটা তার মনে কাঁটার মতো বিঁধে রইল। রাখীকে চলে যেতে হবে- একথা কেন বলল আশরাফ? এখানে তার কি চলে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে?
আব্বা চিঠি লেখেন আজকাল। শেষ চিঠিতে লিখেছেন- রাখী, বাড়িটা বিক্রি করে দেব ভাবছি। বুলু আর ভালো হবে না। ওর শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে, এখন দেখলে চিনতেই পারবি না। আমাকে দেখলে খিলখিল করে হেসে ওঠে। চিনতে পারে, তবুও হাসে। শুনেছি কলেজের কাজে নাকি তুই খুব ব্যস্ত থাকিস- শুনে খুশি হয়েছি। যদি পারিস, ওখানেই থেকে যাস। আমার অভিশপ্ত বাড়িতে আর ঢুকিস না কখনো।
রাখী ঐ চিঠি পড়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেঁদেছে সেদিন সারা দুপুর। কেবলি মনে হয়েছে, এমন কেন হল আব্বার জীবন? কোথাও তো কোনো অন্যায় করেননি। কোনো পাপের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল না কখনো, সাধ্যমতো সবাইকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে চেষ্টা করেছেন— তবু এমন কেন হল? এখন হয়তো একদিন খবর আসবে, আব্বা নেই। তারপর? তারপর সেদিনকটা একেবারেই শূন্য। যেদিকটাতে স্নেহ ছিল, ভালোবাসা ছিল, সংসার ছিল- অন্ধকার ঘরে গভীর গলায় গুনগুন গান শোনা যেত- বাড়ির গেটে মাধবীলতার ঝাড় ছিল, গুম গুম করে ট্রেন যাবার শব্দে ঘরের মেঝে কাঁপত— সকালে শিউলিফুলের মতো রোদ ছেয়ে থাকত বারান্দায়— সেসব ঘটনা, সেসব দৃশ্য একেবারে নিঃশেষে মুছে গিয়ে শূন্য হয়ে যাবে সেদিকটা।
ক’বছর যেন? রাখীর হিশেব থাকে না আজকাল। ‘৬৪ থেকে নাকি ‘৬৫ থেকে? ঠিক মনে পড়ে না, কখন থেকে ধস নামা আরম্ভ হয়েছে। নাকি, একেবারে গোড়া থেকেই কেউ পুঁতে দিয়েছিল ধসের বীজ। সে বীজ অঙ্কুর হয়ে বেরুল, তারপর ডালপালা ছড়িয়ে বড় হয়ে একসময় ছেয়ে ফেলল গোটা সংসারটাকে। বুবু কতজনকে কতভাবে সাহায্য করেছে অথচ বুবুর কথা কেউ ভাবে না?
পুরনো কথা সে ভাবতে চায়নি। অতীতকে সে পেছনে ফেলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, অতীতকে আসলেই ঝেড়ে ফেলা যায় না। জোর করে আড়াল করা যায় কখনো কখনো, কিন্তু ঐ আড়াল করা পর্যন্তই— ওতেই মনে হয়, এই আমি অতীতকে বাদ দিয়ে দিলাম। কিন্তু তার ছেলেবেলা, তার কৈশোর, তার ভালোলাগার দিনগুলো—এসবই তো তার অস্তিত্বের অংশ, এসব কি আর জীবন থেকে বাদ যায়?
সুমি লেখে— মুখপুড়ি তোর আক্কেল হল না এখনো, এখনো তোর ঐসব চিন্তা। বেশ তো কলেজের কাজটাজ নিয়ে মেতে ছিলি, এসব বাজে চিন্তা এখন আবার তোর মাথায় কে ঢোকাচ্ছে? শোন, তোর বর একটা ঠিকানা রেখে গেছে। দ্যাখ্, লোকটা কিন্তু তোকে সত্যি ভালোবাসত। যদি যোগাযোগ করতে চাস তাহলে জানাস- আমিই নাহয় চিঠিটা লিখে দেব।
রাখী জানে, জামান তাকে ভালোবেসেছিল। বাজে রকমের ঈর্ষা, প্রচণ্ড লোভ, গোপন লাম্পট্য আর মনের বিশ্রী নীচতা- এসব ছিল জামানের, কিন্তু তবু রাখীর মনে হয়, জামান তার জন্যে মনের ভেতরে আলাদা একটা জায়গা করে রেখেছিল। কথাটা তখন মনে হয়নি, আজকাল একেক দিন মনে হয়। কিন্তু রাখী আগ্রহ বোধ করে না। সে বোঝে, এও ছেড়ে যাবারই ব্যাপার। যা ছেড়ে দিলে আর হাতে তুলে নেয়া যায় না।
আসলে রাখীর সবকিছুই ছেড়ে দেওয়া- অতীতের সবকিছুই। এখন আর সেসবের কোনোকিছু হাতে তুলে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ইচ্ছে করলেই আর সেই দিনগুলোতেই ফিরে যাওয়া যায় না। এখন যেটুকু রয়েছে— সেটুকু শুধুই বিষাদের, শুধুই দীর্ঘশ্বাসের।
এরকম হত না- দরজাটা সম্ভবত বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। যদি সেজানের সঙ্গে দেখা না হত, যদি কাছাকাছি হবার কারণ না ঘটত, তাহলে হয়তো দরজাটা বন্ধই থাকত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, দরজাটার দুপাশ খুলে দিয়েছে কেউ— সেই দরজার ওপারে কেবলি অতীতের ছবি আসছে, থেকে-থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হচ্ছে আর কেউ যেন অনন্তকাল ধরে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে।
সেজানের ঘরে ঐ দীর্ঘশ্বাস আরো ভারী হয়— একেক সময় ভয়ানক চুপচাপ হয়ে যায় ঘরের ভেতরটা। কথা বলে না কেউ, বাইরের কেউ আসে না। ওদিকে বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে যায়। রাখী তখন ওঠে। বলে, আমি আজ উঠি।
যাচ্ছ? সেজান সচকিত হয় সামান্য। তারপর বলে, ঠিক আছে, কাল কি আসবে? রাখী সেকথার জবাব দেয় না। জবাবের কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না তার।