ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – ৪

চার

রাখীর ভেতরে কোথায় যেন একটা পরিপূর্ণতার ভাব ভরে উঠতে থাকে ডোনার্স কমিটির মিটিঙের পর। খুব জোর কাজকর্ম আরম্ভ হয়ে গেছে তখন। আশরাফ একেক দিন রাখীর সঙ্গে তাল রাখতে পারে না। রাখী মিস্ত্রিদের কাজ পর্যন্ত দেখছে এখন। আশরাফকে অবাক করে বলে দিচ্ছে, সিঁড়ির সেন্টারিং-এর রড কীরকম বেঁধেছে দেখে আসুন গিয়ে। আশরাফ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবও রাখীর উৎসাহ দেখে অবাক হয়ে যান। পরীক্ষার্থী মেয়েদের কোচিং ক্লাসে ঢুকলে আর বার হয় না। ইংরেজি পড়াচ্ছে, ইতিহাসের প্রশ্ন করছে, লজিক বোঝাচ্ছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছে ক্লাসরুমে।

জাহানারা একদিন বলে উঠল, তুই পারিসও- বাব্বাহ্, এমন জাত মাস্টারনি বলেই তোর বর তোকে পছন্দ করেনি।

রাখী হাসে। মনের ভেতরে একটুখানি নাড়া লাগলেও উচ্ছ্বসিত হাসি সেই নাড়াটুকু তলিয়ে দেয়। সুমিতাকে লেখে— তোকে দেখলে আমার হিংসে হত, এখন আমাকে দেখলে তুই হিংসেতে মরে যাবি। একবার এসে দেখে যা, কীরকম কাজ করতে পারি আমি। রুফ কাস্টিং-এর প্রপোশন কত, বলতে পারবি? প্লাস্টারে কত, জানিস? বলতে পারবি, সিঁড়ির রডে কীরকম বেনডিং দিতে হয়?

জানুয়ারি শেষ হয়ে আসছে। হাওয়ায় এখন দিক বদলের ভাব। কিছুটা তীব্রতাও বেড়েছে। কলেজ থেকে ফিরে এসে গোসল খাওয়া সেরে একটুখানি বিশ্রাম নিতে-না-নিতেই ঝপ করে বিকেল নেমে যায়। বিছানায় একটুখানি পিঠটা পাততে গেলে দিনের আলোর নাগাল সেদিন আর পাওয়া যায় না।

রাখী সন্ধ্যার পর খাতা দেখতে বসেছিল। কিছুক্ষণ পরই বাইরে ডাকাডাকি। রাখী বাইরে এসে দেখে দেবতোষ। রাখীকে দেখে হেসে ফেলল, আবার এলাম অতিথি হতে।

রাখী ঠিক বুঝতে পারে না। দেবতোষ বারবার তার কাছে আসছে কেন। সে ঈষৎ বিরক্ত হয়। কিন্তু কিছু বলে না।

দেবতোষ রাখীকে গম্ভীর দেখেও দমল না। বলল, আজ রাতটা থাকতে চাই, থাকতে দেবেন তো?

রাখী কী বলবে ভাবছে। এই সময় কলেজের বেয়ারা এসে জানাল, প্রিন্সিপ্যাল সাহেব কাল সকালে জেলা শহরে যাচ্ছেন, রাখী যেন সকালেই কলেজে চলে যায়।

রমজান আলী চলে যাচ্ছিল, দেবতোষ ডাকল, ও ভাই শোনো তো একটু। রমজান কাছে এলে রাখীকে বলল, আপনার এখানে না হোক, কলেজে গিয়ে থাকি, কি বলেন?

দেবতোষকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। রাখী রমজান আলীকে বিদায় করে দিল। বলল, কলেজটা কি অতিথিশালা?

দেবতোষ তার ঘাড়ের ব্যাগ নামিয়ে রেখে মুখ হাত ধুয়ে এল। একটু পর চায়ে চুমুক দিয়ে, আরামের নিশ্বাস ছেড়ে বলল, আপনার চায়ের রুচি কিন্তু খুব ভালো। বরাবরই দেখছি, চা খুব ভালো খান আপনি।

রাখী সোজাসুজি প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার, আপনি আবার এখানে?

আর বলবেন না, আবার আমাকেই আসতে হল, আমি ছাড়া নাকি হাসান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবার মতো লোক নেই।

তা এখানে কেন এলেন, সোজাসুজি ওখানে চলে গেলেই ভালো হত না? রাখী না বলে পারে না।

তা হত, দেবতোষ হাসে, কিন্তু ওখানে থাকা যেত না।

কীরকম? রাখীর অবাক লাগে। চেনাজানা লোকের সঙ্গে থাকা যাবে না, এ কেমন কথা।

তাহলে খুলেই বলি আপনাকে, দেবতোষ আরম্ভ করে। বলে, আসলে আমি এসেছি বেশ ক’দিন হল। সোজা সেজান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। কিন্তু কথাবার্তা এগুল না। তাঁর ঐ এক গোঁ, আমরা নাকি হঠকারী, পিপলকে নাকি আমরা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। আমাদের সঙ্গে রাজনৈতিক কথা নাকি বলা যাবে না। এরপর আর থাকা যায় ওখানে? আমি ফিরে না গিয়ে এলাকা ঘুরলাম। কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করলাম। কেউ কেউ আমার যুক্তি মেনেও নিল। কিন্তু সবার মুখে ঐ এক কথা, হাসান ভাইকে বলুন। হাসান ভাইয়ের সঙ্গীরা একেবারেই হোপলেস। এদিকে হাসান ভাইয়ের সঙ্গে যে একটা বোঝাপড়া করব, তারও উপায় নেই। ভদ্রলোক যেন পণ করেছেন, মরে এবার যাবেনই। নিজের চোখে দেখলাম, বমির সঙ্গে রক্ত উঠছে। তবু আমি কথা বলতে গিয়েছিলাম, আর তাতে একজন এমন তাড়া করল যে পালিয়ে আসতে দিশা পেলাম না।

দেবতোষের কথার ভঙ্গিতে একটা চটুল ভাব থাকে। তখনও সেই চটুল ভাবটা ছিল। সেজানের অসুখের কথাটা এমনভাবে বলল, যেন তার কাজে বাগড়া দেবার জন্যেই অসুখ হয়েছে। রাখী দেবতোষের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, অসুখটা কি খুব বাড়াবাড়ি দেখলেন?

শুধু বাড়াবাড়ি, দেবতোষ হাসে, এ যাত্রা টিকলে হয়। কেন, আপনি কিছু জানেন না?

দেবতোষের তাকাবার ভঙ্গিতে কী ছিল কে জানে। রাখীর মনে হল, কেউ যেন তাকে চাবুক মারল। সে যে জানত না, এমন তো নয়। একবার দেখতে যাওয়ার কথাও তো মনে হয়েছিল। অথচ তারপর ক’দিন একেবারেই ভুলে রয়েছে। ছি ছি। রাখী ঘুরেফিরে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল।

দেবতোষকে নিয়ে মুশকিল, সে কখনোই সোজাসুজি কথা বলতে চায় না। সবকিছুতে তার রাজনীতির প্রসঙ্গ। যেমন, সে জানে না সেজানের চিকিৎসা হচ্ছে কি না। বলতে পারে না, এখানে তার কে দেখাশোনা করছে— সেজানের এক ভাই আছে, তাকে খবর দেয়া হয়েছে কি না— এসব কোনোকিছুই সে বলতে পারে না।

রাখীর রাগ হয়। বলে, ভারি দায়িত্ববান লোক কিন্তু আপনারা।

বাহ্ আমরা কী করব বলুন? এখন উনি যাদের সঙ্গে রাজনীতি করছেন এসব ব্যাপারে তো তারা সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা তো বলেই আসছি, আগে তাঁর সুস্থ হয়ে ওঠা উচিত। কিন্তু আমাদের কথা শুনলে তো! আমাদের সব প্রস্তাবই তো তাঁরা এখন সন্দেহের চোখে দেখছেন। আমরা তাঁদের ভালো চাই, কিন্তু তাঁরা আমাদের ক্ষতি করে চলেছেন। আমাদের সমর্থকদের ভাগিয়ে নিয়েছেন। আমাদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে নিজেদের বক্তব্য দিচ্ছেন।

রাখী দেবতোষের কৈফিয়তের কিছুই শুনছিল না। ঐ মুহূর্তে তার ভীষণ খারাপ লাগছিল। কীরকম অকৃতজ্ঞ সে। লোকটা অসুস্থ অবস্থাতেও তার কথা ভেবেছে, পরামর্শ পাঠিয়েছে, লোকজন যেন তার জন্যে কাজ করে সে ব্যবস্থা করেছে— আর সে কিনা অবলীলাক্রমে লোকটার কথা ভুলে থাকতে পারল?

আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন? রাখী হঠাৎ দেবতোষকে বলল।

কোথায়?

সেজান সাহেবের কাছে।

মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? রাখীর কথা যেন ভয়ানক অসম্ভব, এমন ভাব দেখায় দেবতোষ। বলে, এইরকম শীতের রাতে তিন মাইল রাস্তা যাওয়া কি সোজা কথা? ও চিন্তা বাদ দিন, কাল সকালে যাবেন, এখন শুয়ে পড়ুন।

রাখী দেবতোষের মুখোমুখি তাকায়। বলল, আপনি নিয়ে যেতে পারবেন কি না বলুন?

দেবতোষ মহাফাঁপরে পড়ে যায়। এমনকিছু যে হতে পারে, সে কল্পনাও করতে পারে না। শেষে বলল, ঠিক আছে, যদি রিকশর ব্যবস্থা করতে পারেন তাহলে যাব। তবে একটা কথা-

কী? রাখী জানতে চাইল।

আপনাকে পৌঁছে দিয়েই কিন্তু আমি চলে আসব, আমি যে ওখানে গিয়েছি তা আমি জানতে দিতে চাই না।

রাখী তক্ষুনি রমজান আলীকে ডেকে রিকশর ব্যবস্থা করতে বলে যাবার জন্যে তৈরি হল।

রিকশয় যখন উঠল তখন রাত প্রায় দশটা। দীর্ঘ রাস্তা- আকাশে কুয়াশা- ভেজানো জোছনা ছিল। দুপাশে আখক্ষেত। থেকে থেকে হাওয়া বইছে। দেবতোষ পাশে বসে কিছুক্ষণ বকবক করল। তারপর একসময় চুপ করে গেল।

বড় রাস্তা থেকে যেখানে ছোট রাস্তা নেমেছে, সেখানে দেবতোষ নেমে পড়ল। রিকশঅলাকে বাড়িটা দেখিয়ে রাখীকে বলল, সোজা চলে যান। মুনীর বলে একটি ছেলে আছে, ওর নাম ধরে ডাকবেন।

রাখীকে কিন্তু ডাকতে হল না। এত রাতে রিকশ যেতে দেখে একটি ছেলে এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন আপনি? রাখী কিছু বলার আগেই সম্ভবত চিনল। তারপর বলল, ও আপনি, আসুন।

খুব প্রাচীন বাড়ি—কেমন পুরনো পুরনো একটা গন্ধ। বিশ্রী চুপচাপ চারদিকে। কাছেই বোধহয় কোনো জলা আছে, খঞ্জন পাখির ডাক শোনা গেল। একটা রাতের পাখি ব্যাহেক ক্যাহেক শব্দে থেকে-থেকে মাথার ওপর ডেকে যাচ্ছে। বারান্দার পর বারান্দা পার হয়ে যেতে হল, ঘরের পর ঘর। মেঝের ঠাণ্ডা জুতো ভেদ করে পায়ের পাতায় এসে লাগছে। যেন পোড়োবাড়ি। শব্দ নেই কোথাও, আলো নেই কোথাও। রাখীর শরীরে একেকবার কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগল।

কেমন আছেন এখন? রাখী ছেলেটির পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে শুধাল।

ঐ একই রকম, ছেলেটি মুখ না-ফিরিয়ে জবাব দিল। বলল, তবে ডাক্তার এসেছেন, প্রায় সর্বক্ষণই আছেন।

বাহির বাড়ির পরে আবার ভিতরে বাড়ি। প্রথমে একটা টানা চাতাল। তারপর গেটের মতো— সেই গেট দিয়ে ঢুকলে পাকা উঠোন। উঠোনের চারদিকে ঘর। রাখীর মনে হচ্ছিল যেন সে কতকাল ধরে হাঁটছে। বারান্দা যেন ফুরোবে না। উঠোন যেন ফুরোবে না।

আর আশঙ্কা দুলছিল মনের গোপনে- যদি দেখতে না পায়? যদি শোনে সেজান আর নেই, তাহলে? তাহলে সে কী করবে? তার গোটা অতীত ঐ চকিতে চিন্তায় একেবারে টাল খেয়ে ওঠে। কোথায় যাচ্ছে সে? অন্ধকারের পর অন্ধকার, ঘরের পর ঘর- ঠাণ্ডা, স্যাতস্যাতে, নিঃশব্দ— রাখী এবার তুই কী করবি? মনের ভেতরে নিজের গলার স্বর অবিকল সে শুনতে পায়।

ঘরের ভেতরে একজন বুড়োমতো লোক, সম্ভবত ডাক্তার, বসেছিলেন, আর দরজার কাছে একজন দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে কাছাকাছি বোধহয় ছিল আরো কয়েকজন। তাদের চাপা গলা শোনা যাচ্ছিল। রাখী দোরের কাছ থেকেই দেখল। দেখল গলা পর্যন্ত চাদর দিয়ে ঢাকা— মুখ দেখে একেবারে চেনা যায় না। এ কাকে দেখছে সে? তার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে উঠল।

ডাক্তার ভয়ানক বিরক্ত। ক্ষুব্ধ হয়ে থেকে-থেকেই বলছেন, এ রোগীর চিকিৎসা কি এইভাবে হয়? সেদিন এসে বারবার করে বলে গেলাম, ঢাকায় নিয়ে যান— হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। কিন্তু একটা কথাও শুনলেন না কেউ।

কাকে যে বলছিলেন, বোঝা যাচ্ছিল না। রাখী তখনও দেখছে। লণ্ঠনের লালচে আলো কালো মুখের ওপর এসে পড়েছে। চোখ ডুবে আছে কপালের নিচের অন্ধকার গর্তে। রাখী দেখল, আর এক পা এক পা করে এগুল। এগিয়ে শিয়রের কাছে দাঁড়াল।

ডাক্তার চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঐসময় সেজান অস্থির হয়ে ওঠায় যেতে পারলেন না। রাখী দেখল, মাথাটা কখনো কখনো বালিশের এপাশ, কখনো ওপাশ হচ্ছে। কপালের ভাঁজে যন্ত্রণার চিহ্ন, শরীর মুচড়ে আর্তনাদ করে উঠছে থেকে-থেকে। রাখী দেখে আর তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চায়। তার কেবল মনে হচ্ছে তখন সেজান মরে যাবে। এই তাহলে তার শেষ দেখা। উঁ-উহ্ শব্দের আর্তনাদটুকু যতবার বেরুল ততবার রাখীর হৃৎপিণ্ডটা যেন কেউ চেপে চেপে ধরতে লাগল।

ডাক্তার সাহেব বেদম রাগারাগি করছেন তখন। একটু বরফ কেউ জোগাড় করতে পারল না। অদ্ভুত লোক আপনারা সব। ঠিক ঐসময় সেজানের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। ডাক্তার বলে উঠলেন, পটটা ধরুন, বমি হবে বোধহয়। তো বমি হল, সামান্য একটুখানি তরল পদার্থ বার হল। ডাক্তার লণ্ঠন এগিয়ে নিয়ে দেখলেন। তাঁর কপালের রেখাগুলো জেগেই রইল। শেষে হতাশ হয়ে বললেন, আমাকে থাকতেই হবে মনে হচ্ছে— আমার বাড়িতে আপনারা খবর পাঠিয়ে দিন।

রাত আরো বাড়ল। সেজান শান্ত হয়ে পড়ল একসময়। ডাক্তার জানালেন, আমি একটু বিশ্রাম নিই, আবার যদি অস্থির হয়, তাহলে ডাকবেন।

ডাক্তার চলে গেলে রাখী একাকী বসে রইল সেজানের শিয়রে।

পরদিন রাখী ফিরল বেশ বেলা করে। কলেজে গেল প্রথমে। গিয়ে শুনল, নিজামউদ্দিন এসেছিল সকালে। এসে কাউকে না দেখে খুব চোটপাট করে গেছে কেরানির ওপরে। রাখী বুঝল, আবার একটা ঝামেলা পাকানো হবে। জাহানারা রাখীকে দেখে অবাক, এ কী চেহারা হয়েছে তোর, কোত্থেকে আসছিস?

লোকজনের সামনে রাখী কিছু বলতে পারল না। বলল, পরে বলব। ক্লাসে গেল না সে।

মেয়েরা এল দল বেঁধে, আপা ক্লাস নেবেন না?

রাখী তখন প্রায় টলছিল। বুঝছিল, একটু গড়াতে না পারলে সে বিকল হয়ে পড়বে।

বাসায় এসে দেখল, দেবতোষ নেই। কিন্তু চলে যায়নি, তার ব্যাগ চৌকির ওপর ঠিকই আছে।

ঘুম-ঘুম একটা অবসাদ নিয়ে গোসল করল, মুখে কিছু দিল, তারপর দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

ভেবেছিল ঘুমোতে পারবে। কিন্তু পারল না। চোখ বুজলেই দেখল সেজানের ছাই-ছাই নিস্পন্দ মুখখানা। তার খালি মনে হতে লাগল, এক্ষুনি কেউ হয়তো তার দরজায় ধাক্কা দেবে, আর সে শেষ খবরটা শুনতে পাবে।

বিকেলে যখন রিকশয় উঠছে, তখনও খোঁজ নিয়ে জানল দেবতোষ ফেরেনি। ওকে তার খুব দরকার ছিল। লোকটাকে তার ভারি রহস্যময় লাগে। এতদিনের এত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। কিন্তু তার যেন কোনো বিকার নেই। একজন চেনাজানা লোক মরে যাবে এটা যেন তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়।

আসলেই বোধহয় তাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয় একজন লোকের বেঁচে থাকা না-থাকায়। রাজনীতি কি এমনই জিনিস, যে আমার পক্ষে নয়, তার অস্তিত্ব থাকা না-থাকা আমার কাছে সমান? কে জানে, রাখী জানে না। রাখীর অনুমান হয়, এইরকমেরই কোনো মনোভাব সম্ভবত দেবতোষের হয়েছে। নইলে কেমন করে সে জেনেশুনে নিস্পৃহ থাকতে পারছে?

রাখী যখন পৌঁছল, তখন বিকেল ফুরিয়ে আসছে। বারান্দা দিয়ে, ঘরের ভেতর দিয়ে, উঠোন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হল, বোধহয় রাত হয়ে গেছে। বাড়িটা এমন যে মনে হয়, সময়হীনতার মধ্যে সে ক্রমাগত ঢুকে যাচ্ছে— যেখানে রাত ছাড়া আর অন্য কোনো সময় নেই।

ঘরের ভেতরে বাতি জ্বলছিল। একটি ছেলে বসেছিল টুলের ওপর। রাখীকে দেখে ডাকল, আসুন। রাখী বরফের ফ্ল্যাস্ক, দুধ, চিনি এসব জানলার তাকে গুছিয়ে রাখল। একবার জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার এসেছিলেন?

হ্যাঁ, আইসকোল্ড মিল্ক দিতে বলেছেন একটু করে।

আর ওষুধ?

না, ওষুধ নয়, সন্ধের পর নিজে এসে ওষুধ খাওয়াবেন।

রাখীকে একাকী বসতে হল। রোগীর শুশ্রূষা কেমন করে করতে হয় তার জানা নেই। গতকাল যেমন ভয়ে বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসছিল আজ তেমন হল না। সেজানের কপালে আস্তে করে হাত রাখল। কম্বলের বাইরে একটা হাত ছিল, সেটা আস্তে করে কম্বলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। একটু ক্ষীণ আর্তনাদ করে সেজান মাথাটা একপাশে ফেরাল, কিন্তু চোখ মেলল না। রাখী ঝুঁকে পড়েছিল, যদি কোনো কথা বলে। কিন্তু সেজান কিছুই বলল না। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। রাখী বুঝল, গলা শুকিয়ে উঠেছে। সে ফ্লাস্কের বরফ বার করে দুধের সঙ্গে মেশাল, তারপর চামচে করে একটুখানি ঠোঁটের কাছে এগিয়ে ধরল। মুখ মেলে দুধটুকু নিতে দেখে রাখীর ভালো লাগল। ভেতরে গেল কি না বোঝা গেল না। তবে মনে হল, সেজান আজ শান্ত। অন্তত কাল যেমন অস্থির হয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল, আজ তেমন করছে না। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা দুধটুকু মুছে দেবার জন্যে হাতের কাছে তোয়ালে খুঁজল, কিন্তু ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে কোনো তোয়ালে গামছা হাতে পেল না। তখন আঁচল দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিয়ে ঝুঁকে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু না, বোধহয় আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আবার টুলের ওপর বসল।

না, চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে না আর। চিন্তা-ভাবনা, অস্থিরতা, কষ্ট, এসব যা হবার তা গতকালই তার হয়ে গেছে। জাহানারা জেনেছে তার সঙ্গে সেজানের কত দিনের পরিচয়। মনি ভাইয়ের মতো দুশ্চিন্তা আর ভয় তার বুকের ভিতরে চেপে ছিল সারাটাক্ষণ যে কাউকে না বলে তার উপায় ছিল না। শুনে জাহানারা বরফের ব্যবস্থা করে দিল, দুধের ব্যবস্থা করে দিল, রিকশঅলা ঠিক করে দিল যেন রোজ যাতায়াতের অসুবিধা না হয়।

তবু কিন্তু ভয়টা পুরো কাটেনি, কষ্টটা বুকের ভেতরে নড়াচড়া করছিলই, অন্তত বিকেলে আসবার আগে পর্যন্ত। কিন্তু এসে যাবার পর, আর সেই ভয়টা নেই, বুকের ভেতরকার ভারটা আর টের পাচ্ছে না। এখন সে অপেক্ষা করতে পারে।

না, সত্যিই ভয় নেই রাখীর। বরং ভেতরে ভেতরে অন্যরকম একটা ভাব জাগছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, মরে যাওয়া অত সহজ নয়। আর মরণ যদি আসেও, তাহলে সে দেখবে। দেখবে, কেমন করে মানুষ মরে যায়। মুখটা কি আরো বিশ্রী দেখাবে? তখন হাতেপায়ে কি খিঁচুনি আরম্ভ হবে? জিভটা কি বেরিয়ে আসবে? চোখের মনি কি ওপরের দিকে উঠে থাকবে? সে মনে-মনে মৃত্যুর চেহারাটা কল্পনা করে আর সেজানের চেহারার সঙ্গে মেলায়। মনে-মনে প্রস্তুতি নেয়, সে দেখবে, গোটা প্রক্রিয়াটা। সেজানের পাকস্থলীর ভেতরে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে— সেখান থেকে নিঃশব্দে রক্ত ঝরে পড়ছে— আর নিঃশেষ করে আনছে জীবনকে। একসময় রক্তের ধারা দুর্বল হয়ে পড়লে ঠাণ্ডা হতে থাকবে শরীর, মগজে রক্ত পৌঁছবে না— হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন শিথিল হতে থাকবে- আর ঐসময় মৃত্যু শরীরে প্রবেশ করবে। শিরা উপশিরা বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত হয়ে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকবে প্রাণকেন্দ্রের দিকে। তারপর একসময় তার অনিবার্য থাবা বাড়িয়ে দেবে।

রাখী জানে, ঐ গোটা প্রক্রিয়াটা সেজানের শরীরে ঘটতে পারে। আর সেজন্যই সে দেখতে চায় মৃত্যু বড়, না জীবন বড়। মৃত্যুর যেমন একটা প্রক্রিয়া আছে, জীবনেরও তাহলে নিশ্চয়ই তেমনি একটা প্রক্রিয়া আছে, আর সেটাও সে দেখবে।

যদি হিম বরফ ক্ষতের জায়গায় রক্তবাহী শিরাগুলোকে কুঁকড়ে দিয়ে খোলা মুখগুলো বন্ধ করে দেয়, যদি ওষুধ স্টমাকের সঙ্কোচন প্রসারণ থামিয়ে ক্ষতস্থানের নতুন টিস্যু তৈরির প্রক্রিয়া আরম্ভের সুযোগ করে দেয়, যদি তরল প্রাণরস নেমে আসে ইন্টেস্টাইনে- সেখান থেকে শিরা উপশিরায়- তারপর যদি মেটারলিজমের প্রক্রিয়া দ্রুত এবং বেশি রক্তকণিকা তৈরি করতে আরম্ভ করে, নতুন রক্তধারার উত্তাপ সর্বাঙ্গে ধেয়ে যেতে থাকে- তাহলে? তাহলেও কি মরণ হাত বাড়াবে? এতই সোজা?

রাখীর মনের ভেতরে কোথায় কী যেন শক্ত হয়ে উঠতে চায়। এরই নাম বোধহয় আশা, এরই নাম বোধহয় বিশ্বাস। সে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে এবার। আগে কখনো মুখোমুখি হয়নি— আগে কখনো দাঁড়ায়নি। এবার রাখী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দেখতে চায়।

আসলে মুখোমুখি দাঁড়ানো ব্যাপারটা সহজ নয়। চাইলেই কেউ মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে না। এর জোর ভেতর থেকে আসতে হয়। আর সেই জোর আসতে হলে নিঃসংশয় হওয়া দরকার। তো সেজানের সমস্যা ছিল ঐখানে।

ঢাকা থেকে চলে আসার ব্যাপারটা তার বন্ধুদের কাছে ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছিল। ভুল নয়, বলো? তুমি গেলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কাজ করতে। সাফল্য হোক, ব্যর্থতা হোক, তোমার সেখানেই থাকবার কথা। সেখানেই তোমার কাজ। কিন্তু ওপরের দিককার লোকদের কথা মানতে না পেরে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে এলে।

এর কোনো মানে হয়?

৬৪-তে যা ঘটেছিল তার সূচনা কি ৬২-তে ছিল না? ৬২-র আগে তোমাদের ভাবনা ছিল প্রধান শত্রু হল সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদ আর তার দোসরদের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে— এজন্যে সবার সঙ্গে, এমনকি সাম্রাজ্যবাদের যারা দালাল, তাদের সঙ্গেও গণতান্ত্রিক ঐক্য করার নামে হাত মেলাবার কথা বললে। সেই যে হাত মেলালে— সেটার আর ছাড়াছাড়ি হল না।

যারা হাত মেলাতে চায়নি, আলাদা হয়ে গেল, ৬৪-তে তারাও একসঙ্গে কাজ করল। তবু তাদের যুক্তি ছিল, আন্দোলনের জন্যে গণঐক্য করো। ৬৫-তে তোমরা এসে দেখলে সাম্রাজ্যবাদের ভারি মজার চেহারা। যদি আন্দোলনে যাও, তাহলে যেমন বিপদ, তেমনি বিপদ আন্দোলনে না গেলেও। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যে সবার সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধো— এ রব তো একপক্ষের বরাবর ছিলই। তাদের অবস্থাটা ছিল সুবিধাজনক। বিবেক দংশন নেই, নীতিবিচ্যুতি গ্লানি নেই, শ্রেণীসংগ্রামের দায় নেই। কিন্তু তোমরা পড়লে ফাঁপরে। ৬৫-তে এসে তোমাদের সংকট তীব্র হয়ে উঠল। আয়ুবি শাসনের বিরুদ্ধে যেতে হলে সাম্রাজ্যবাদের দালালদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়— আর অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে গেলে আয়ুবি শাসনের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়। ফল হল, তোমাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি চলে গেল তোমাদের প্রতিপক্ষের হাতে, যারা স্বায়ত্তশাসনের একদা বিরোধিতা করেছিল সবচাইতে বেশি। এরপরই শুরু হয়ে গেল তাত্ত্বিক বিতর্ক। এ এমনই চোরাবালি যে তোমাদের পা ডুবতে লাগল। আসলে তোমরা এটা লক্ষ করোনি যে, উঠতি মধ্যবিত্তের রাজনীতি সুযোগসন্ধানী হয়ে উঠেছে, যে-কোনো ছলচাতুরী তারা ব্যবহার করতে শুরু করবে, উঠতি মধ্যবিত্তের এই রাজনীতির মোকাবিলা তোমরা কিছুতেই করতে পারবে না, যদি-না পিপলের মধ্যে তোমাদের সংগঠন থাকে। তোমরা তত্ত্বগতভাবে বলছিলে সংগঠন দরকার, কিন্তু ঐ তত্ত্বগতভাবেই আবার সংগঠন ভেঙে-ভেঙে যাচ্ছিল। ৫২ সালে তোমরা মধ্যবিত্তকে নিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিলে, ৬২ সালেও তা-ই করলে। তারপরের ভূমিকাও তোমাদের ঐ একই। কিন্তু তোমাদের ভূমিকা যে বদলে গেছে, সময়ের দাবি যে অন্যরকম, সেটা বুঝে উঠতে তোমরা ৬৬ পার করে দিলে, ৬৭-ও এখন যাই-যাই করছে।

টঙ্গী এলাকার ঘটনাগুলো, রায়পুরা এলাকার ঘটনাগুলো তোমাদের মনে দাগ কাটল না। ভুখা মিছিলের আন্দোলন পথ খুঁজে পেল না- আর ছয়- দফার আন্দোলন রাজপথে এসে গেল।

সুতরাং সংশয় সবার মনে কাজ করে চলেছে। কোন্ পথে যাবে, এ-পথে নাকি ও-পথে? নাকি দুপথেই একসঙ্গে যেতে হবে- অর্থাৎ আলাদা নয়, দুটো আসলে একই পথ। ব্যাপারটা খুব সোজাসুজি ঘটতে পারত। গ্রামাঞ্চলকে তোমরা সংগঠিত করতে পারতে। স্বল্পবিত্ত কৃষকরা ছিল তোমাদের জন্যে, ভূমিহীন কৃষকদের কাছে যাওয়ার পথ তোমাদের জন্যে খোলা ছিল। আয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি তোমাদের জন্য রাস্তা খুলে দিয়েছিল। আগে রাজনীতি ছিল রাজধানীতে, নির্বাচিত সদস্যরা রাজধানীতে ঠাঁই নিত। গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের নাগাল পেত না। কিন্তু আয়ুব খান সেইসব লোককে নাগালের মধ্যে এনে দিল। রাস্তা বানানো, খাল কাটা, পুল তৈরি- এসবের নামে যা হচ্ছিল, তা দেশময় ছোট ছোট অথচ অসংখ্য ধারাবাহিক আন্দোলন তৈরির জন্য যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি করেছিল।

ঘটনা যে ঘটেনি এমন তো নয়। হাটের খাজনা বাড়ানোর জন্যে হাটুরে দোকানিরা ইজারাদার আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি, বলো? গরুচোরের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল বলে য়ুনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষ খেপে ওঠেনি, বলো?

অথচ ঘটনাগুলো তোমাদের চোখে পড়েনি। হিশেবটা চোখের সামনেই ছিল। মেলাতে পারতে, কিন্তু মেলালে না কেউ। মধ্যবিত্তের আঙিনাটা ছাড়াতে তোমাদের অনেকদিন লেগে গেল। শহরগুলোর বাইরে তোমাদের উপস্থিতি টেরই পাওয়া গেল না।

সেজান ঢাকা থেকে প্রথমে নীলফামারির দিকে যায়- ডোমার ডিমলা অঞ্চলে চেনাজানা বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে। তারপর আসে নিজের জায়গায়। নিজের এলাকায় পুরনো লোক শিবনাথ রায়। সেই শিবনাথ রায়ই সেজানকে প্রথমে সংশয়ের কথাটা জানান। বলেন, গ্রামের কাজের জন্যে আমরাই যথেষ্ট। আপনাদের খামোকা কষ্ট করার কোনো দরকার নেই।

ভদ্রলোকের কথা শুনে আহত হয়েছিল সেজান। বলেছিল, আপনি এভাবে বললে তো মুশকিল।

বাহ্, যা সত্যি তা বলব না! যেমন ধরুন, আমার মতো একজন জোতদার আপনাদের পার্টির মেম্বার। আমি আমার প্রজাদের নিয়ে সমর্থন জানালাম আপনাদের। আপনারা খুব ভালোমানুষ, ভালো ভালো আইনও বানালেন। কিন্তু সে আইন খাটাবে কারা? আমরাই তো? নাকি আমার প্রজা আসবে আমার ওপর আইন খাটাতে? বলুন, তাই কি হয় কখনো? ধরলাম, থানা পুলিশ সরকারি কর্মচারীদের ঐ আইন চালু করতে বলা হল। করবে ওরা, বলুন? ওরা সব আমারই খায় আমারই পরে- ওরা কেন উল্টাপাল্টা কাজ করে নিজেদের জন্যে অসুবিধা সৃষ্টি করবে? আমরা যেমন, ওরাও তেমনই চাইবে। যেমন যেমন নিয়মকানুন আছে, তেমনই থাকুক। ওসব ঘাঁটাঘাঁটি করে ঝামেলা বাড়াতে গেলে মেলা ঝামেলা। সুতরাং পার্টি যতই চেষ্টা করুক- আইনকানুন পুরনোই থেকে যাবে।

তেভাগার কথা উঠলে, প্রায় খেপে উঠলেন শিবনাথবাবু। বলেন, তেভাগার কথা বলবেন না। মানুষ লড়াই করতে নেমে গেল, ওদিকে নেতারা সব একে একে হয় ধরা দিলেন, নয়তো কেটে পড়লেন। লড়াই করতে নেমে গেল লোক, ধরা পড়ল অস্ত্রহাতে আর নেতারা খালিহাতে ধরা দিলেন একের পর এক- এ কি হয় কখনো? লড়াই ফড়াই হবে না। যেমন আছে, তেমনি চলতে দিন।

শিবনাথবাবুর কথায় ভয়ানক জ্বালা আর হতাশ। শেষে বললেন, এখানে কাজ করতে চাইলে এইখানেই থেকে যেতে হবে- এটা ভাই সর্বক্ষণের ব্যাপার। কোনোকিছু আরম্ভ করে দিয়ে চলে যাবেন- সেসব আর হবে না।

.

শফিউদ্দিন তো একেবারেই আমল দিতে চাননি। জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওসব কাজ হবেটবে না ভাই। খামোকা লোকজন নিয়ে মাতামাতি করবেন। আপনারা শহরে আছেন, শহরেই থাকুন। ওখানে আন্দোলন হবে— খবরের কাগজে আন্দোলনের খবর পেয়ে আমরাও খুশি হব- ব্যস্, ঐ পর্যন্তই ভালো। ভোটের সময় হলে ভোটটি দিয়ে আমাদের দায়িত্ব ঠিক ঠিক পালন করে যাব। মিছিমিছি কৃষক সংগঠন, কৃষি বিপ্লব, এসব কথা তুলছেন। ওসব হবে না, হওয়া সম্ভব নয়।

কেন নয়, বলুন। সেজান বুঝতে চেষ্টা করেছে।

।কেন নয়? কারণ জানতে চাইলে আমি নাচার, শফিউদ্দিন বোঝান। বলেন, কারণটা পুরো আমিও জানি না। তবে গ্রামে থাকি বলে একটা সোজা কথা বুঝি। আর সেটা হল- আপনাদের পলিটিক্স সাধারণ মানুষের কাছে খুব একটা বোধগম্য নয়। আসলে আপনারা মানুষের সঙ্গে সেইভাবেই কম্যুনিকেট করতে চান, যেভাবে অন্য পার্টির লোকেরা করে। এলেন, দুচারজন চেনাজানা বড় গেরস্থের বাড়ি অতিথি হলেন, মাতব্বর ব্যক্তিদের ডাকলেন— বোঝালেন- ব্যস্, পার্টি হয়ে গেল আপনাদের, আপনারা চলেও গেলেন। সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা অবশ্যি আপনারা বলেন, কিন্তু ঐরকম সমস্যার কথা তো অন্য পার্টির লোকেরাও আজকাল বলে। আপনারা কৃষকের কথা বলেন, কিন্তু কৃষিজীবন সম্পর্কে কি আপনারা ভালোভাবে জানেন? গরু চুরি হয়ে যাওয়া যে, ছেলেমেয়ে চুরি হয়ে যাওয়ার চাইতেও ভয়াবহ ব্যাপার, সেটা বোঝেন আপনারা? চৈত্র বৈশাখে বৃষ্টি না হলে শুধু জোতদারই নয়, ক্ষেতমজুরেরা পর্যন্ত চোখে কীরকম অন্ধকার দেখে— আপনারা এসব ধারণা করতে পাবেন? এ জগৎটাই আলাদা, এখানে মিশে না থাকলে কিছু করার উপায় নেই।

সেজানকে শফিউদ্দিন নাজেহাল করে দিয়েছিলেন একেবারে। জানা ছিল, শফিউদ্দিন পুরনো কমরেড— তেভাগা আন্দোলন দেখেছিলেন, আটচল্লিশে দেখাদেখির পাট চুকিয়ে নিজেই জুটে গিয়েছিলেন দলে। কলেজের পাট ঐসময় থেকেই চুকেছে। পঞ্চাশের দিকে ছাড়া পেয়েছেন, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত চুপচাপ ঘর-সংসার করছেন আর ইস্কুল, ডিসেপন্সারি, সমবায় এইসব নিয়ে আছেন। সেজান ভদ্রলোকের সম্পর্কে আগেই শুনেছিল। এবার সে ঠাঁই নিল শফিউদ্দিনের বাড়িতে। তার ধারণা হয়েছিল, এখানে থেকেই সে চারদিকে যোগাযোগটা ভালো রাখতে পারবে।

কিন্তু যোগাযোগটা শুরু হতেই লক্ষ করল, সোজাসুজি যাওয়া যায় না। তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে নেতাদের ওপর- কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ভয়ানক মুশকিল। নেতারা অবশ্যই খুব ভালো লোক, অতিশয় সজ্জন কিন্তু নতুন কথা ওরা সহজে নিতে চান না। তাঁদের কৌতূহল ঢাকার ঘটনা নিয়ে, ঢাকায় কী হচ্ছে? এ প্রায় সবারই প্রশ্ন। ছয়-দফা আর আওয়ামী লীগের খুব জোর দাপট, তাই না? ছাত্ররা বোধহয় উল্টে দিল মোনেম খানকে, কী বলেন? এইরকম অন্তহীন প্রশ্ন।

ইত্তেফাক কাগজের পৃষ্ঠা দারুণ আগ্রহের বস্তু। হাটের দিন ইস্কুলঘরে এক মাস্টার সাহেব পড়ে যখন শোনান, তখন সেখানে বেশ ভিড় জমে ওঠে। দেখা যায়, সম্পন্ন গাঁয়ের চাষিরা গভীর মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়া শুনছে। হাসির কথা থাকলে হাসে, রাগের কথা থাকলে হারামজাদা, শ্বশুরের ব্যাটা বলে গালাগাল করে।

শফিউদ্দিন স্কুলের হোস্টেলে ঘর দিয়েছিলেন থাকবার জন্যে। বলেছিলেন, আপাতত এখানে থাকুন। তারপর দেখা যাক, আপনার জন্য পারমানেন্ট কী ব্যবস্থা করা যায়।

তো রইল সেজান সেই হোস্টেলের ঘরেই। চেনাজানা লোকদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হল, নতুন ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ হল। দু-একজন তরুণ ইস্কুল মাস্টার বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। এ ছাড়া সেইসব সমবয়সীরা দু- একজন ছিল, যাদের সঙ্গে জেলে থাকবার সময় বন্ধুত্ব হয়েছিল, এবং পরের দিকে সাংগঠনিক কাজে যাদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ হয়েছে। ভয়ানক উৎসাহিত বোধ করেছিল সে। তার কেমন মনে হচ্ছিল, সবাই খুশি হয়েছে তাকে পেয়ে। কেননা প্রায় সবাইই দেখা করতে আসছিল প্রথম-প্রথম। কিন্তু প্রথম ঐ ক’দিনই। তারপর লক্ষ করল, আর কেউ তার ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে না। ব্যাপারটা তার কাছে অদ্ভুত লেগেছিল। কিন্তু খবর পেতে দেরি হল না, জেলা শহরের নেতারা তার বিরুদ্ধে নানান সন্দেহ আর সংশয় ছড়াচ্ছেন।

সে জানত, এটা তার নিজের লড়াই— একজন কর্মীর নিজেকে তৈরি করার লড়াই। এ লড়াই অন্য কেউ করে দেবে না। সে মানুষের কাছাকাছি যেতে চাইছিল। এমন কাছাকাছি, যেখানে পৌঁছলে সহমর্মিতার স্পর্শ পাওয়া যায়— বিশ্বাসের ভিত্তিতে দাঁড়ানো যায়। মিন্টু তারই মতো ঢাকা ছেড়ে গাইবান্ধা চলে এসেছিল। সেজানের সঙ্গে দেখা করতে এসে সে থেকে গেল। একদিন সবার সামনেই জানাল, আমি রইলাম— দেখি, আপনি যা করতে চাইছেন, তার কতদূর কী হয়।

সেজান নিজেও স্পষ্ট জানত না, সে কী করতে চাইছে। অস্পষ্ট একটা ধারণা ছিল যে, তার এমন কোনো কাজ করা উচিত, যা দেখে কিষাণদের মনে হবে এ তাদের নিজেদের কাজ; এমন কোনো কথা বলা উচিত, যা শুনে কিষাণেরা মনে করবে, এ তাদের নিজেদের কথা। বাইরের চিন্তা এখনে প্রায় অচল। কিষাণের জমি চাই- এ দাবির কথা বললে তাদের চোখেমুখে অবিশ্বাসের ভাব ফোটে। যদি বলে, লাঙল যার জমি তার, তাহলে তারা জিজ্ঞেস করে, যাদের লাঙল নেই তাদের কী হবে? যদি বলা হয়, জোতদারদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়া হবে- তাহলে তাদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার চিহ্ন দেখা যায়। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, জোতদারদের যদি জমি না থাকে তাহলে আমরা কাজ পাব কোথায়? নিজের চিন্তা এবং কাজগুলোকে সে স্পষ্ট করতে পারছিল না। কিন্তু তবু দুজন একজন করে তরুণ ছেলে তার কাছাকাছি এসে যাচ্ছিল। যেমন আনোয়ারউদ্দিন, ম্যাট্রিক পাস করে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠল। হায়দার আলী ঐরকম আরেকজন। তাছাড়া মিন্টু তো সঙ্গেসঙ্গেই ছিল। এর ওপরও ছিল শিবনাথ রায় আর শফিউদ্দিন মোল্লার মতো দুজন পুরনো কমরেডের সহযোগিতা। ফলে সেজানের মোটামুটিভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেরি হল না।

যেমন আধিয়ার উচ্ছেদের ব্যাপারটা। ঐ এলাকার জমি খুব ভালো সেজন্যে ঐ অঞ্চলের জোতদাররা বছর বছর আধিয়ার বদল করে। আর প্রত্যেকবার বদলের সময় সেলামি নেয়। এ ছাড়াও জমিতে ফসল ফলানোর বাড়তি খরচটাও আধিয়ারের ওপর চাপিয়ে দেয়।

ব্যাপারটা নিয়ে কিছু করা যায় কি না, দেখতে চাইল সেজান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আলাপ করল- বোঝাল, আপনারা একজোট হোন জোতদারদের সেলামি দেবেন না। একজনের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়া জমি অন্যে নেবেন না। আধিয়াররা প্রথমে অস্বস্তিবোধ করল, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত দেখা গেল তাদের। কেউ কেউ আবার ব্যাপারটা প্রথমে বুঝেই উঠতে পারেনি- চৈত্র যায়, কিন্তু নতুন বন্দোবস্তের জন্যে আধিয়াররা আসে না কেন? খোঁজখবর হল, কেউ কেউ দেখে এল, পুরনো আধিয়ারই জমিতে লাঙল দিচ্ছে। তাই দেখে চোটপাট হল, শাসন-ধমক ইত্যাদিও করল কেউ কেউ। তার ফলে জমিতে লাঙল দেওয়া গেল বন্ধ হয়ে। শেষে চৈত্রের দু- এক পশলা বৃষ্টির পরই পাট বোনা শুরু হবার কথা— তার পর-পরই আউশের সময়। কিন্তু চৈত্র পার হয়ে বৈশাখও যায় যায়। শহরবাসী জোতদার জমি-তদারকিতে এসে উপায় খুঁজে বার করতে পারে না। গ্রামের লোকদের কাছে পরামর্শ চাইলে তারা শফিউদ্দিনকে দেখিয়ে দেয়। একদিকে শফিউদ্দিন আর অন্যদিকে শিবনাথ। তাদের কাছে গেলে তারা আবার এ-ব্যাপারে গা-ছাড়া ভাব দেখায়। সুতরাং শেষপর্যন্ত এ এলাকায় বছর বছর সেলামি দিয়ে আধি-বন্দোবস্তের ব্যাপারটা বাতিল হয়ে গেল। শহরের জোতদারেরা সহজে মেনে নেবার পর গ্রামের জোতদারদের আর কিছু করার থাকল না।

ব্যাপারটার এরকম নিষ্পত্তিতে সেজান খুশি হয়েছিল। তবে এও বুঝেছিল যে এর জন্যে তার নিজের কৃতিত্ব খুব বড়কিছু নয়। আনোয়ার হায়দারদের মতো তরুণদের চেষ্টা আর শফিউদ্দিন এবং শিবনাথের সমর্থনের ফলেই ব্যাপারটা সম্ভব হল। অর্থাৎ এর নাম লড়াই নয়- এ যেন আপোষের মধ্যেই একরকমের হিশেব-নিকেশ করে সিদ্ধান্তে আসা

কিন্তু সংগঠন এভাবেই আরম্ভ হয়। এবং সংঘর্ষও সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়। মিন্টু অবশ্যি ভীষণ উৎসাহ বোধ করছিল। সে পাঠশালায় একটা মাস্টারি জুটিয়ে নিল। পীরগঞ্জ থানার ইসলামপুর য়ুনিয়নে চাষি সমিতি গড়ে উঠল বটে— কিন্তু ঐ পর্যন্তই। অন্য য়ুনিয়নে তার প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। কারণ সেসব য়ুনিয়নে জমির ফলন সেরকম ভালো নয়, জমির জন্যে আধিয়ারদের মধ্যে কাড়াকাড়ির মতো অবস্থাও সেসব জায়গায় ছিল না। তবে নিরুৎসাহ হবারও কারণ ছিল না। বেকার যুবকেরা, ভূমিহীন কৃষকরা তার কাছাকাছি হচ্ছিল ক্রমেই। অভিযোগ আসছিল একের পর এক। মোহনপুর য়ুনিয়নের চেয়ারম্যান রাস্তা বানানোর টাকা লোপাট করে দিয়েছে— শিবগঞ্জ এলাকার হাটগুলোতে তোলা বাড়ানো হয়েছে দ্বিগুণ তিনগুণ—আখ কেনার সেন্টারে মাতব্বর চাষিরা পুঁজি পায়— কিন্তু ছোট চাষিরা পায় না- অভিযোগের আর শেষ নেই। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জমছিল, উত্তেজনা বাড়ছিল। এইসব দেখে সেজানের আশা হচ্ছিল, গোটা এলাকাজুড়ে কিছু আরম্ভ করা হয়তো যাবে। আর এই আশাতেই সে চষে বেড়াচ্ছিল গোটা এলাকাটা। দুদিন থাকে এক গাঁয়ে তো চারদিন কাটায় আরেক গাঁয়ে। সপ্তাহে দুতিনটি হাটে ঘোরে ফেরে, পুরনো কমরেডদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। আর কেবলি মনে হয়— সে বোধহয় পথ খুঁজে পাচ্ছে।

তখনও তার চলাফেরা রাজনৈতিকভাবে স্পষ্ট নয়। সরকারের বিরোধিতায় সে তখনও যায়নি। তখনও ঐরকম প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় যাবার মতো কোনো কারণ অন্তত ঘটেনি। পার্টির জেলা-নেতৃত্ব তার খবর পেলেও তখন পর্যন্ত কাজেকর্মে এমনকিছু আবিষ্কার করতে পারেনি যে সোজাসুজি বিরোধিতা করতে আসবে। আরো একটা কারণ সম্ভবত এই যে, তারা গণতন্ত্র উদ্ধারের কাজে বেশি মনোযোগী ছিল তখন। ছয়-দফা, স্বায়ত্তশাসন, গণতন্ত্র-এইসব কথা শহরের রাজনীতিকে তখন ক্রমেই গরম করে তুলছে।

এই সময় একদিন দেবতোষ এল। এসে লোভ দেখাল, প্রতিরোধে নামুন, শ্রেণী সংগ্রামের লাইন ধরুন।

কেন আমার লাইন কি শ্রেণীসংগ্রামের লাইন নয়? সেজান জিজ্ঞেস করেছে।

ওভাবে নয়। দেবতোষ কেমন অসহিষ্ণু গলায় বলেছে, ক্ষেতমজুররা জমি দখল করে নিক, ধানের গোলা পেট ভরাবার কাজে লাগাক, খাজনা বন্ধ করে দিক।

সবাই আসবে? সেজান প্রশ্ন করেছে।

নিশ্চয়ই আসবে- প্রথমে সংকোচ থাকবে, ভয় থাকবে, কিন্তু আসবে।

দেবতোষ ভারি স্থিরভঙ্গিতে, প্রায় বিশ্বাসের ভেতর থেকে কথা বলছিল। জানাল, বাজে ভণিতা বাদ দেওয়া দরকার এখন। কোনোরকম আপোষ নয়। দাঁতকা বদলা দাঁত। জোতদাররা কিষাণের শত্রু—কথাটা ঘোষণা করে দিন। দেখবেন বিপ্লবের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।

সেজানের বিশ্বাস হতে চায় না। বিপ্লব এতই যদি সহজ ব্যাপার হত, তাহলে তো ১৯৬৭ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না। সে জানে, যে মুহূর্তে জমি-দখল, ধানের গোলা দখলের দাবিটা উঠবে, সেই মুহূর্তেই নামবে চূড়ান্ত আঘাতটা। তার কেবলি মনে হচ্ছিল, এখনো সময় হয়নি, এখনো বহু কাজ বাকি। এখনই যদি আঘাত আসে, তাহলে পায়ের তলার যেটুকু মাটি পাওয়া গেছে, সেটুকুও থাকবে না। সে দেবতোষকে শেষ কথা বলেছিল, দ্যাখো দেবু, আমি তোমাদের কাজে বাধা দিতে যাব না, তোমরা তোমাদের লাইনে কাজ করো— কিন্তু আমি চাই, তোমরাও আমাকে বাধা দেবে না, আমাকে আমার মতো কাজ করতে দেবে। আমি গোটা ব্যাপারটা নিজের কাজের ভেতরে দিয়ে দেখতে চাই।

দেবতোষ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে উঠেছিল, বেশ দেখুন, তবে আমরাও এ এলাকায় কাজ করছি, সেটা ভুলে যাবেন না।

ইতিমধ্যে আশেপাশের এলাকাগুলোতে হাটের তোলা নিয়ে চাপা উত্তেজনা জাগছিল। হায়দাররা বলছিল, হাসান ভাই, আমরা হাটের তোলা দেওয়া বন্ধ করে দিতে বলি, কি বলেন?

সে জবাব দিতে পারেনি তক্ষুনি। বলেছিল, আলাপ-আলোচনা করে দ্যাখো, কী করা যায়, সাবধানের মার নেই।

ব্যাপারটা তখনও আলাপ-আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে বলে তার ধারণা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা যে অনেকদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে সেটা টের পেল পরে। জেলা শহরের এক পার্টিনেতা এসে একদিন রীতিমতো ধমক লাগালেন। বললেন, এসব কী বাজে কাজ করছেন? যেখানে জাতির মুক্তির আন্দোলনে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে দেশের মানুষ, সেখানে আপনি এসব ঝামেলা পাকাচ্ছেন কেন? বোকামিরও একটা সীমা থাকা দরকার। সেজান ভদ্রলোকের মেজাজ দেখে কিছুক্ষণ থ’ হয়ে তাকিয়েছিল মুখের দিকে। শেষে বলেছিল, জাতির মুক্তির জন্যে কী করতে হবে, বলে যান। ভদ্রলোক থতমত খেয়েছিলেন একটু, তারপরই বলেছিলেন, মিটিং করুন, হরতাল ডাকুন, মিছিল করুন, লোককে জাগিয়ে তুলুন। ম্যাক্সিমাম পিপলকে মবিলাইজ করাটাই এখন আসল কাজ।

সেজান ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখেছিল। এ সেই পুরনো কথা। মিছিল আর সভা, সভা আর হরতাল। ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞেস করে, গ্রামের মধ্যে হরতালটা হবে কোথায়? চাষাবাদ বাদ দিয়ে কি তাহলে লোকজন ঘরে বসে থাকবে? আর জোতদারের মিছিলেই বা কিষাণ যোগ দেবে প্রাণের কোন্ তাগিদে?

কিন্তু ভদ্রলোককে সে কিছুই বলল না। কেননা তখনো সে সরাসরি বিরোধিতায় যেতে চায় না।

অথচ ঐ সময়েই ঘটে গেল সংঘর্ষের ব্যাপারটা। হাটের তোলা নিয়ে গোলমালটা ভেতরে ভেতরে পাক খাচ্ছিল। ইজারাদার মহাজনদের সঙ্গে কথাবার্তাও হয়েছিল দুএকবার। কিন্তু একদিন দেখা গেল ছোট একটি হাটে লেগে গেল হাটের দোকানি আর ইজারাদারের লোকজনদের সঙ্গে। বেশ কয়েকজন জখম হয়ে গেল ঐ গোলমালে।

আর এই ঘটনাটাই সেজানকে প্রায় দিশেহারা করে দিল। এ যেন সময়ের সঙ্গে দৌড়োনো। যে-কোনোরকমের হোক সংগঠন দরকার। তার কেবলি আশঙ্কা হচ্ছিল হাটের খাজনা তোলার ব্যাপারটা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে চারদিকের হাটগুলোতে এবং গোটা এলাকাজুড়ে উদ্দেশ্যহীন, অসংগঠিত নিষ্ফল একটা প্রতিরোধ জেগে উঠবে। সে ঐ প্রতিরোধের সঙ্গে থাকবে, না ঠেকাতে যাবে, তা কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছিল না। শিবনাথকে জিজ্ঞেস করলে তিনি হাসলেন। বললেন, ঐরকম ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাই যদি থাকত, তাহলে তো নেতাই হয়ে যেতাম।

তবু শিবনাথ জানালেন, শহরের নেতাদের কথা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়— বড় রকমের আন্দোলন বোধহয় শিগগিরই একটা আসছে— যা করবেন, ভেবেচিন্তে করবেন।

ওদিকে আবার শফিউদ্দিন কিন্তু বললেন উল্টোকথা। বললেন, যতই আন্দোলন হোক, আপনার ভিত্তিটা কোথায় সেটা দেখবেন না? গোড়াতে তো আপনাকে শক্ত থাকতে হবে। গ্রামের লোকেরা যদি আন্দোলনের দিকে চলেই যায়, আপনি কি বাধা দিয়ে বলবেন, হাটের আন্দোলন কোরো না- জাতির মুক্তির জন্যে লড়াই করতে যাও? আপনি কে সেকথা বলার? ৬৭-র শেষদিক তখন। শহরগুলোতে চাপা উত্তেজনা জাগছে একটু একটু করে। ছাত্ররা একনাগাড়ে আন্দোলন করে চলেছে। ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায়, বিশেষ করে য়ুনিভার্সিটি এলাকার আশেপাশে পুলিশ আর ছাত্ররা প্রায়ই মুখোমুখি হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা ঐক্য গড়ছেন আবার ভাঙছেন। খবরের কাগজের পৃষ্ঠা প্রায়ই গরম হয়ে থাকে। সাংবাদিকরাও আন্দোলনের দিকে পা বাড়াচ্ছেন।

কিন্তু গ্রাম? গ্রামে মিছিল নেই, সভা নেই, হরতাল নেই কিন্তু ক্ষোভ আছে, রাগ আছে, অবরুদ্ধ চিৎকার আছে। সেই রাগ ক্ষোভ এবং চিৎকার ধোঁয়াচ্ছে, ফুঁসে উঠছে, আর এখানে ওখানে হঠাৎ হঠাৎ করে জ্বলে জ্বলে উঠছে।

সে নিশ্চিত করে ধরতে পারে না-কোন্ দিকে তার যাবার রাস্তা। একদিকে দেবতোষদের সমালোচনা আর অন্যদিকে নেতাদের ধমক। শিবনাথ যদি এক কথা বলেন, তো শফিউদ্দিন বলেন আরেক কথা। সহকর্মীদের নিয়ে আলোচনায় বসতে হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত পৌঁছনো যায় না। রাতের পর রাত জেগে তর্ক আর আলোচনা চলে। কিন্তু পথ খুঁজে পাওয়া যায় না- পাওয়া গেলেও নিঃসংশয় হওয়া যায় না।

রাতে ঘুম হচ্ছিল না কিছুদিন থেকে। মনে-মনে আশঙ্কাও ছিল, যে- কোনোদিন শরীরের কল বিগড়ে যেতে পারে। কিন্তু তার উপায়ও কিছু নেই তখন। একেক দিকের মানুষ একেক দিন আসছে আর একেক ধরনের সমস্যার কথা বলছে। কাকে ফেরাবে সে? কাকে বলবে যে পরে এসো আমি এখন ঘুমোব? রাণীসংকৈল হরিপুর এলাকায় শিকল-তালা দিয়ে বেঁধে গরু রাখা যায় না। গরুচোরকে ধরে শান্তি দিতে গেলে থানার লোক বাধা দিতে আসে। বর্ডারের পাঁচ মাইলের মধ্যে যদি কেউ দুচার সের পাট ঘাড়ে নিয়ে এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রামে যায়, অমনি তাকে ধরে চালান দেয়া হয়। ও পাট যে ঘর-বাঁধবার জন্যে দরকার, সেকথা বলেও বোঝানো দায়। এসব বাড়তি অত্যাচারের সঙ্গে চিরকালের সমস্যা যেসব, সে তো রয়েইছে। মোট কথা, গোটা এলাকাজুড়ে ভয়ানক অসহ্য একটা অবস্থা। হরিপুর এলাকার বর্ডার পাহারাদারদের সঙ্গে জোর ফাটাফাটি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে— ফকিরগঞ্জের মানুষ ভাবছে, য়ুনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার চেয়ারম্যানদের ধরবে এবার- লাহিড়ী হাটের আখ কেনার সেন্টারটা জ্বালিয়ে দিতে চায় কেউ কেউ।

এসব কথা শোনার পর ঘুমোবার মতো অবস্থা আর থাকে না। রাত জাগতে হয়, মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়, আলাপ-আলোচনায় বসতে হয়। তাই বিশ্রাম আর হয় না। আর সম্ভবত সেই সুযোগেই শরীরের দিক থেকে আঘাতটা এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *