দুই
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব একদিন হঠাৎ চিৎকার শুরু করে দিলেন। সবাই অবাক, শান্ত মানুষ, সহজে রাগেন না। কিন্তু সেই লোকের এমন রাগবার কারণ কী? কেরানি সাহেব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে- আর সমানে গালাগাল ছুটছে প্রিন্সিপ্যালের মুখ দিয়ে, ইডিয়েট, বাঁদর, যে পাতে খাও সে পাতে ফুটো করার তালে আছ, এ্যা? খুব সেয়ানা হয়ে গিয়েছ তাই না? এক্ষুনি বেরোও, কলেজের ত্রিসীমানায় যেন না দেখি তোমাকে। এরকম লোক আমি রাখব না।
রাখী এগিয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা জানার জন্যে, কিন্তু রাখীকেও ধমক খেতে হল। বললেন, তুমি আবার এখানে কেন? কে আসতে বলেছে তোমাকে, নিজের কাজ নেই?
রাখী ধমক খেয়ে চুপচাপ টিচার্সরুমে এসে বসল। পুরুষ টিচাররা গম্ভীরমুখে বসে রইলেন। খালি জাহানারা মিটিমিটি হাসতে লাগল।
শেষে জাহানারাই কারণটা জানাল। ব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ করা ছাপানো কাগজ রাখীর হাতে দিয়ে বলল, কারণ হল এই কাগজটা। রাখী চোখ বুলিয়ে নিল। মেয়েদের কলেজ হওয়াতে দেশ যে উচ্ছন্নে যাবে তারই বয়ান। কেরানি কাগজটা হাতে নিয়ে প্রিন্সিপ্যালের ঘরে ঢুকেছিল, কিছুটা বাহবা পাবার আশায়। বেচারা! সে কি আর জানত যে বুড়ো ঐরকম খেপে উঠবে।
অর্থাৎ কলকাঠি যেমন নড়বার তেমনই নড়ে যাচ্ছিল। পোস্টার পড়ছিল। চেক সই হতে দেরি হচ্ছিল, মেয়েদের হোস্টেলের জায়গাটার রেজিস্ট্রি সেই যে আটকা গিয়েছে, রেজেস্ট্রি আর হয় না। তবে ছাপানো হ্যান্ডবিল এই প্রথম। রাখী লক্ষ করল তার ওপর আক্রমণ এই হ্যান্ডবিলেও করা হয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল একদিন ডেকে বললেন, দ্যাখো রোকেয়া, তোমার ওপর কিন্তু আরো আক্রমণ হবে, ভয় পেয়ে যেও না তাতে- দেখি আমরা কী করতে পারি।
আর ঐসময়ই পিকনিকের আয়োজনটা হয়।
রাখী রাজি ছিল না। কিন্তু জাহানারা মেয়েদের দারুণ উস্কে দিয়েছিল। প্রিন্সিপ্যালও কেমন যেন খেপে উঠলেন প্রস্তাবটা শুনে। মহা হৈচৈ লেগে গেল পিকনিকের আয়োজনে।
অন্ধকার থাকতেই মেয়েরা পৌষের শীতে কাঁপতে কাঁপতে কলেজে এসেছে। জাহানারা তার বাচ্চাদের গায়ে কোটমোট চাপিয়ে বেঁধে একেকটাকে ফুটবলের মতো বানিয়ে এনেছে। তারাও মায়ের সঙ্গে সমান পাল্লা দিয়ে চিৎকার করছে। আশরাফের জিপ এসে গেল, সঙ্গে আরেকখানা পিকআপ, তাতে হাঁড়িকুড়ি বাসন-কোসন। হুমায়ুন নিজের জিপ চালিয়ে গেল একবার। আবার এল, আবার গেল। এই চলল কিছুক্ষণ ধরে। একখানা বাস, একখানা পিকআপ, দুখানা জিপ-মস্ত মিছিল। মেয়েরা খুশিতে কলকল করছিল। জাহানারা হুকুম করল, মেয়েরা গান করো। সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত গান শুরু হয়ে গেল, অন্ধকার আর কুয়াশা ঝাঁপিয়ে— চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল।
রাখী কেমন অভিভূত হয়ে পড়ল। ঢাকার পিকনিক অন্যরকম। জাহানারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। মনে হল, জাহানারা অসাধারণ মেয়ে- অন্য কেউ এমন পারত না।
গানটা দুবার হয়েছে, এমন সময় গাড়ি থেমে গেল। কি, থামল কেন গাড়ি? না, পৌঁছে গেছি জায়গায়। রাখী মনে-মনে ক্ষুণ্ণ হল। এত কাছে! তার মন খুশি হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে চলবে এই যাত্রা।
জায়গাটা সুন্দর। টাঙন বাঁক নিয়েছে ঘোড়ার ক্ষুরের মতো, সেখানে চিনিকলের একটা খামারবাড়ি— আর পাশেই একেবারে। একদিকে আখের আবাদ আর অন্যদিকে কুলের বন। অজস্র কুল ধরে আছে গাছে। মেয়েরা বাস থেকে নেমেই ছুটছিল কুলবনের দিকে, জাহানারা ধমকে তাদের ফেরাল, কাজ করতে হবে না? কুল কি ফুরিয়ে যাচ্ছে?
তো কাজ শুরু হল। উনুন তৈরি, আগুন জ্বালানো, চা তৈরি করা,
রুটি কাটা, মাখন লাগানো এইসব হতে হতে অনেক সময় নিল।
তবে হুমায়ুনের উৎসাহ দেখবার মতো। একাই দশজনের কাজ করছে। উনুন জ্বলছে না, দাঁড়াও দেখছি, বলে বেরিয়ে গেল, ফিরল এক পাঁজা আখের শুকনো পাতা নিয়ে। ইঁট নেই, ডেক্চি বসছে না, দাঁড়াও, বসিয়ে দিচ্ছি তোমার ডেক্চি। ঐ দ্যাখো, আদা বাটা আনেনি, কী হবে এখন? কিচ্ছু নেই চিন্তার, আদা বাটা পাওয়া যাবে।
হুমায়ুনকে দেখেও রাখীর অবাক লাগছিল। মানুষটা এত সহজ আর এত প্রাণবন্ত। মেয়েরা দুলাভাই বলতে প্রায় পাগল। রাখীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠাট্টা করে বলল, পৃথিবীতে এত শালী কারো আছে বলুন?
রাখী হেসে বলল, আপনি ভাগ্যবান পুরুষ।
হ্যাঁ, শালীভাগ্য সবার হয় না। যেমন আপনার কর্তাটির হতে পারত, কিন্তু হয়নি।
রাখীর ঈষৎ খোঁচা লাগল মনে। হঠাৎ মনে হল, জামান কোথায় এখন? সত্যিই কি বিদেশে চলে গেছে?
পুরনো কথা মনের ভেতরে ঘোঁট পাকাতে পারত। কিন্তু পারল না। মেয়েরা যারা ফার্স্ট ইয়ারের, তাদের এখন ছুটি, তারা হুড়মুড় করে ছুটল কুলবনের দিকে। জাহানারা ডেকে বলল, তুমি ওদের সঙ্গে থাকো কিছুক্ষণ— আমি এদিকটা দেখে এক্ষুনি আসছি।
রাখী হাঁটতে গিয়ে স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ল। ছিঁড়ল এমনই বেকায়দা জায়গা যে হাঁটা যায় না। আবার খালিপায়েও সে অচল। পায়ের তলায় শক্ত মাটি, কাশের অঙ্কুর, কাটা অড়হরের গুঁড়ি, এসবের খোঁচা খেয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে ফিরে এল।
আশরাফ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তক্ষুনি ফিরল, একটা ক্যাসেট টেপ নিয়ে। রাখীর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল। বলল, রাজধানীর মানুষ আসলে অসহায় কীরকম টের পাচ্ছেন তো?
রাখীর মেজাজ খারাপ ছিল তখন। বলল, যান খালিপায়ে হেঁটে আসুন ঐ মাঠের ওপর দিয়ে— দেখি, আপনি কেমন গাঁয়ের মানুষ।
ঐসময় হুমায়ুন ডাকে, ওহে এঞ্জিনিয়ার, যদি নকল করে পাস না করে থাকো, তাহলে এখানে এসে একটু এঞ্জিনিয়ারিং করো।
হুমায়ুনের বলবার ধরন দেখে রাখী হেসে ওঠে। কিন্তু ঐ কথার প্রতিক্রিয়া কী হবে বুঝে ওঠার আগেই দেখে, তার এক পাটি স্যান্ডেল আশরাফের হাতে এবং ইচ্ছে করেই সে ছেঁড়া ফিতেটা ধরে স্যান্ডেলটা সামনের দিকে তুলে দোলাচ্ছে।
রাখীর ভয়ানক বিব্রত অবস্থা। বলে, প্লিজ রেখে দিন ওটা।
আশরাফ শোনে না। একখানা লোহা বার করে জিপের গায়ে বসিয়ে ঠকা ঠকাং শব্দ করে স্যান্ডেল সারাতে আরম্ভ করে দেয়। স্যান্ডেল সারানো হলে রাখীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, নিন, দেখুন, হয়েছে কি না।
হুমায়ুন জবাব দেয়, হবে না মানে, হতেই হবে। কি ম্যাডাম, হয়নি?
রাখী কিছু বলে না।
জাহানারা এই সময় একটু ঠাট্টা করে বলে, স্যান্ডেল সারানো হলে পায়ের ব্যথা যাবে, কিন্তু হৃদয়ের?
তাহলে তো মুশকিল, হুমায়ুন জবাব দেয়। বলে, সে জিনিস সারানোর জন্যে যা দরকার, তা এখানে কোথায় পাওয়া যাবে বলো?
আশরাফ লাল হয়ে ওঠে ঐ ঠাট্টায়।
কিছুক্ষণ পর চারজনে মিলে নদীর ধারে ধারে আখক্ষেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। এলোমেলো কথা বলে সবাই। একসময় ছেলের চিৎকার শুনে হুমায়ুনকে ফিরে যেতে হয়। একটু পর জাহানারাও ফেরে। বলে, দেখি আমি, আমার কর্তা ছেলে সামলাতে গিয়ে নিজেই বেসামাল হয়ে পড়ল কি না, তোমরা কথা বলো।
হ্যাঁ, গল্প হল। আশরাফ তার ছেলেবেলার গল্প বলল, ভূতের গল্প। আর ছেলেবেলায় নাকি ভূত সেজে ভয় দেখাতে গিয়েছিল মামাতো ভাইকে। তো সেই মামাতো ভাই ভয় পেয়ে- ওরে বাবারে— বলে ভূতকেই অ্যায়সা জোরে জড়িয়ে ধরেছিল যে ভূতের প্রাণ যাওয়ার জোগাড়। আর কলেজে পড়বার সময় ভোজনরসিক হোস্টেলের সুপারকে কবুতরের ফ্রাই বলে ব্যাঙের ঠ্যাং ভেজে খাইয়ে দেয়া হয়েছিল। আশরাফ এইসব গল্প বলে গেল অনেকক্ষণ ধরে।
শীতের হাওয়া বইছে অল্প অল্প, তাতে থেকে-থেকে আখক্ষেতে সরসর আওয়াজ হচ্ছে। সূর্য হেলে আছে দক্ষিণে। টাঙনের স্রোত ভারি ধীর। দূরে মেয়েদের কথা শোনা যাচ্ছে। ঐসময় আশরাফ ডাকল, একটা কথা বলবেন?
রাখী স্বচ্ছ চোখে তাকায়, কী কথা?
আপনি কি এখানে অনেকদিন থাকবেন?
হঠাৎ একথা? রাখী পাল্টা জানতে চাইল।
না, এমনি, আশরাফ নিজেকে গুটিয়ে নিল। বলল, যা জায়গা, বিদেশ থেকে এখানে এসে বেশিদিন থাকা মুশকিল।
রাখী হাসে, বাহ্ কেন, আপনি তো শুনেছি তিন বছরের মতো আছেন এখানে। ধরুন আমিও ঐরকমই থাকব, তিন বছর যাক আগে। আপনার একাকী লাগে না?
একাকী? কেন? চারদিকে এত লোক, একাকী কেন লাগবে?
আশরাফ এবার সরাসরি তাকায়। বলে, আপনি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
রাখীও আশরাফের মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, না আশরাফ সাহেব, যে-নিঃসঙ্গতার কথা বলছেন, সেরকম নিঃসঙ্গতা আসলেই আমার নেই। আপনি মিছিমিছি অসম্ভব কোনো কল্পনা করবেন না।
কিন্তু কল্পনা করে যদি কারো ভালো লাগে, যদি কারো সাধ হয় কল্পনা করতে, তাহলে কী করবেন?
রাখী রাগে না। মায়া হয় আশরাফের ওপর সেই মুহূর্তে। বলে, কল্পনা করার চাইতেও জরুরি বহু কাজ থাকে জীবনে। আমার ধারণা সেসব কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকাটাই ভালো। যা সহজে আসে- আপনা থেকে আসে- তাইই জীবনের জন্যে ভালো। জোর করে কিছু হয় না।
তা হয় না, আশরাফ স্বীকার করে, কিন্তু সহজভাবেও তো ঘটে যেতে পারে জীবনের অনেক ঘটনা— সেজন্যে অপেক্ষা করে না মানুষ?
রাখীর বিরক্তি লাগে, মিছিমিছি অর্থহীন কথা শুধু। বলে, ঠিক আছে, করুন অপেক্ষা, যত খুশি— এখন চলুন ফেরা যাক।
খাওয়াদাওয়া শেষ হতে হতে বিকেল প্রায় শেষ। প্রিন্সিপ্যাল আর এস.ডি.ও. যাবার জন্যে উঠলেন। আশরাফকে দেখে এস.ডি.ও. নিজামউদ্দিন কেমন ভ্রূ কুঁচকে ছিল অনেকক্ষণ। একবার বলেও ফেলল, আমরা জানি কলেজের কাজটা আপনার উপরি, কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেটাই আপনার আসল কাজ।
আশরাফ বিলক্ষণ চটল। কিন্তু মুখের পালিশটা বজায় রেখে বলল, কী করব বলুন, এঁরা এমন করে ধরেন যে না এসে পারা যায় না, আমার অবস্থায় পড়লে আপনিও পারতেন না।
আশরাফের কথা শুনে জাহানারা রাখীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, লোকটা মেনিমুখো হলে কী হবে, তেজ কিন্তু ঠিকই আছে।
প্রিন্সিপ্যাল চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা ওঠার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিল। হুমায়ুন দাঁড়িয়ে গেল। বলল, এক্ষুনি যাচ্ছি না আমরা, আজ সন্ধ্যার সময় ক্যাম্প ফায়ার হবে, তারপর ফিরব আমরা।
শীতের হাওয়া জোর দিচ্ছে তখন। দেখতে দেখতে আকাশের আলো ফুরিয়ে গেল। খামারবাড়ির গরুগুলো ঘরে ফিরছে একে একে। তাদের গলায় ঘুণ্টির টুং টাং আওয়াজ শূন্যে ভাসতে লাগল। শিকার শেষে ঘরে ফেরা সাঁওতাল বাচ্চাদের হাসাহাসির শব্দ সন্ধ্যার ধূসর পর্দাটাকে কাঁপিয়ে দিল একটুখানি। শঙ্খচিলের ডাকটা তখনো অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে।
হুমায়ুন কাঠ সাজিয়ে ফেলেছিল। হারমোনিয়াম তবলার পেছনে যারা বসবার, বসে পড়ল। কাঠের স্তূপের ওপর বোতলভর্তি তেল উপুড় করে ঢেলে তারপর হাতের মশালে আগুন ধরিয়ে হুমায়ুন ডাকল, কে দেবে আগুন, চলে এসো। কেউ গেল না দেখে নিজের দুই ছেলের হাতে মশালটা ধরিয়ে দিয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, দে ব্যাটা, তোরাই দে আগুনটা লাগিয়ে, পুড়ে যাক বুড়োদের দুনিয়া— ওহে শালীরা, তোমরা কিন্তু ঠিক ঠিকমতো গানগুলো গেয়ো— নইলে তোমাদের আঁচলে ধরিয়ে দেব এই আগুন।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। আকাশেও ওদিকে মলিন জোছনা। আগুনের লালচে আভায় সবার মুখ চকচক করতে লাগল।
আর ঐসময় গান আরম্ভ হয়ে গেল। একের পর এক গান হয়ে চলল। কখনো জাহানারা একা, কখনো সবাই মিলে— তোমরা আমায় ডাকো, আমার মন না মানে। মোর বীণা উঠে কোন্ সুরে বাজি শুকনো পাতায় আবর্জনা। রাখীর পাশে আশরাফ বসে ছিল। সেও একসময় গলা মিলিয়ে দিল।
ভারি সুন্দর জমে উঠেছিল সন্ধ্যাটা। তারপর শিশির, জোছনা আর হিমেল হাওয়ার মধ্যে ঘরে ফেরা। রাখী নিজেকে বাইরে কোনোদিন এমনভাবে ছড়ায়নি। তার ভেতরটা সেদিন নড়ে উঠল, সত্যিই কি সে একা?