ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – ১১

এগারো

রাখীকে টেলিফোনে খবর দিল সুমিতা। আমি বাড়ি যাচ্ছি, মায়ের শরীর ভালো নয়— ফিরতে দুদিন দেরি হতে পারে। তোর গেস্ট-এর তো কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সুলতানের মায়ের হাতে সংসার এবং চাবি রইল। তুই একটু দেখে-শুনে যাস।

রাখী শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, কী অসুখ, জানিস কিছু?

না, যে লোক খবর নিয়ে এসেছে সে একেবারেই হাবা- কিছু বলতে পারে না, আমার আশঙ্কা, সিরিয়াস কিছু হয়েছে, নইলে এভাবে লোক মারফত খবর আসত না। আমার দারুণ তাড়া, বোধহয়, তোর সঙ্গে দেখা হবে না। খোঁজখবর নিস কিন্তু।

রাখীকে বিকেলে বেরুতে হল। এমনিতেই বেরুত, দুদিন ধরে সেজানের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না, কিন্তু সুমির টেলিফোন তাকে ঘর থেকে টান দিয়ে বার করল। বেরুবার সময় আকাশে মেঘ দেখে একটুখানি দাঁড়িয়েছিল। আব্বা বললেন, আজ আর বেরোস না— আকাশের অবস্থা ভালো নয়।

কিন্তু তবু বেরুল রাখী। শহীদ মিনারের কাছাকাছি পৌঁছতে পৌঁছতেই ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দরজা খুলে দিল সুলতানের মা। ছেলেকে নিয়ে ঘুমোচ্ছিল বেচারা। ঘরে যথারীতি সেজান নেই। রাখী রান্নাবান্নার খবর নিল, ঘরদোরের অবস্থা দেখল, তারপর মোটা দেখে একখানা পত্রিকা নিয়ে সুমিতার বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

ওদিকে বৃষ্টির মধ্যেই বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা হল। বাতি জ্বলল, সুলতানের মা জানতে চাইল চা দেবে কিনা। রাখী বলল, এখন না, একটু পরে। কড় কুড়াৎ শব্দ করে বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। রান্নাঘরের একটা জানালা বোধহয় ভাঙা, বাতাসের ঝাপটা ভাঙা-জানালা আছড়ে খটাস খটাস শব্দ করল ক’বার। তারপর জানালার শব্দটা থামলে শোনা গেল বাচ্চা সুলতান গান গাইছে তারস্বরে- আচ্ছা কিয়া দিল না দিয়া। রাত কত হল, কে জানে। রাখী ঘড়ির দিকে নজর দিল না। ভাবল, আর একটু পরে দেব। আর ঠিক ঐসময় দরজায় ধাক্কা এবং ডাক—সুলতানের মা, সুলতানের মা। রাখী ছুটে গেল দরজার দিকে।

এ কী রাখী দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। বলল, এভাবে ভিজেছ কেন, রিকশ পাওনি? কোথাও দাঁড়ালেও তো পারতে। তোমার কি মাথাখারাপ এ্যা? তুমি একটা কী-ই বলো তো? ইশ্ এভাবে ভেজে কেউ?

রাখী সেজানের পেছনে পেছনে এল। তোয়ালে এগিয়ে দিল। সেজান তখন কাঁপছে। কিছুই বলছে না, দুচোখ ভয়ানক লাল। রাখী ভেবে পায় না, কী করে। কাপড় বদলাবার অবসর দিয়ে সে নিজেই রান্নাঘরে গেল দুধ গরম করতে। একটু পর গেলাশে দুধ নিয়ে সেজানের সামনে রাখল।

সেজান বিছানায় চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বসেছিল। দুধের গেলাশে দুবার চুমুক দিয়ে গেলাশটা সরিয়ে রাখল। বলল, পরে খাব। রাখী বুঝতে পারছে না তখন- এ কাকে দেখছে সে? এ কি অন্য লোক? এত করুণ, এত উদ্‌ভ্রান্ত আর এরকম বিধ্বস্ত কি সেজান কখনো হতে পারে? সে সেজানের হাত ধরল, সেজান, কী হয়েছে— বলো কী হয়েছে তোমার?

বাইরে বৃষ্টি আর ঝড়ের দাপাদাপি- আর ঘরের ভেতরে রাখার বেপথু গলার মিনতি— বলো সেজান, দোহাই তোমার।

রাখী যে কী দেখেছিল সে-ই জানে। তার কেমন মনে হচ্ছিল, ভয়ানক কিছু একটা হয়েছে। এমনকিছু যা আমূল আঘাত করেছে সেজানকে। সেজান বলছিল, আমার কিছু হয়নি। কিন্তু রাখী শুনতে পায়নি। সেজানকে বুকের মধ্যে সে জড়িয়ে ধরে রেখেছে আর বলে চলেছে— আমি দেখতে পাচ্ছি, কিছু একটা হয়েছে, বলো সেজান, তোমার কথা আমাকে জানতে দাও, বলো তুমি।

সেজান তখন একে একে বলল, থেমে থেমে, একটু একটু করে, তার হতাশার, ব্যর্থতার আর পরাজয়ের কাহিনী- সবার কাছে আমি গিয়েছি, জানো, কিন্তু কেউ আমার কথা শুনতে চায়নি। গ্রামাঞ্চলের কথা বললে কেউ আমাকে ঠাট্টা করেছে, স্বাধীনতার কথা বললে কেউ আমাকে রি- অ্যাকশনারি বলেছে, টেবিলের তাত্ত্বিক তর্ক ছেড়ে কাজে নামার কথা বললে আমাকে পাগল বলেছে। আজ আমাকে বলা হল, আমি নাকি আগাগোড়া হঠকারী, সাম্রাজ্যবাদের দালাল, দেশের এক নাম্বার শত্রু। ঐরকম কথা সবাই বলল একে একে। আমি কি ভুল করে যাচ্ছি, বলো? সবই কি ভুল আমার?

রাখী কিছুই শুনল না। কানে শুনলেও মনে জায়গা দিল না। তার সুখ, তার সাধ, তার অতীত, তার ভবিষ্যৎ, তার ঘৃণা, তার ভালোবাসা- সব কান্নার স্রোতের মতো উথলে উঠেছে বুকের ভেতরে কোথাও। সে সেজানের মাথা বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখেছে। এই কি তুই চেয়েছিলি রাখী, বল্‌? শুধুই হেরে যাওয়া, শুধুই ক্ষয়ে যাওয়া, শুধুই ধসে যাওয়া? তোর ছেলে কোথায় রাখী?

তার মনের অনেক নিচে তখন এইরকম করে বলে যাচ্ছিল কে একজন। ধীরে ধীরে রাখী শান্ত হল— অনেকক্ষণ ধরে। তারপর সেজানকে নিয়ে উঠে এল। রাতের খাবার একটুখানি খেল। তারপর দুজনে আবার ফিরে গেল ঘরের ভেতরে। ওদিকে দরজা বন্ধ করল সুলতানের মা- বাতি নেভাল- সারাটা বাড়ি একদম নিঃশব্দ, তখন যেন বুকের ঢাকনা খুলে গেল রাখীর। দ্যাখো, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। আমার দাঁড়াবার কোনো জায়গা নেই, আমার ভাই অহেতুক মরে গিয়েছে, আমার বোন পাগল হয়ে মরার দিন গুনছে, আব্বার মুখের দিকে তাকানো যায় না, আমার সন্তান এসেও এল না। দ্যাখো তুমি, আমাকে ভালো করে দ্যাখো।

সেজান রাখীকে বলছে, রাখী আমি জানি, আমি সব জানি।

কিন্তু রাখী যেন শুনতে চায় না সেকথা। বলে, না, শুধু জানলে হবে না। তোমাকে দেখতে হবে। আমার মনকে পায়ের তলায় মাড়িয়েছ সবাই, আমার শরীরকে কলঙ্কিত করেছ, আমার নামে অপবাদ দিয়েছ— আমি এখন কী করব বলো। আমাকে দ্যাখো আর বলো। বলো আমি এই জীবন নিয়ে কী করব?

বাইরে বৃষ্টি আরো তুমুল হয়। সেজান রাখীকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। চুমু খায় কপালে, চোখে, মুখে, বুকের মাঝখানে। তারপর ঐসময় ঐ উত্তাল মুহূর্তগুলোতে রাখীর মনের মতোই শরীরও সকল দল মেলে দেয়। ফুলের মতোই ফোটে রাখী সেজানের দুই হাতের মধ্যে। সেজানকে তখন গ্রহণ করতে হয় আর নিজেকে রাখীর তখন নিবেদন করতে হয়। এ গ্রহণ যেমন নিঃশেষে, নিবেদনও তেমনই নিঃশেষে।

রাখী সেদিন থাকল, পরের দিন থাকল, এবং তারপরের দিনও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *