ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – ১

এক

গাড়িটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার সময় সুমি হাত নাড়াচ্ছিল। সেই ছবিটা রাখীর মনের মধ্যে আঁকা হয়ে রয়েছে। সুমি নয়, যেন সে নিজেই হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে। আর ফিরে আসা নয়। শৈশব, কৈশোর, তার ভালোলাগার দিন, বুবু, আব্বা, মনি ভাই, তার ব্যর্থ সংসার, তার সাধ— সবার কাছ থেকে বিদায়। কে জানে— হয়তো সেইদিন নিজের কাছ থেকেও রাখী বিদায় নিয়েছিল।

ঠাকুরগাঁও আসবার পর রাখী নিজেকে সহজেই কাজের সঙ্গে জুড়ে দিল। প্রিন্সিপ্যাল করিম সাহেব নিজের বাড়ির প্রায় লাগোয়া একটি ছোট বাড়ি জুটিয়ে দিয়েছেন। একটি বিধবা মেয়েমানুষও পাওয়া গেছে রান্নাবান্নার জন্যে। থাকা খাওয়ার ব্যাপারে সে প্রায় নিশ্চিন্ত। ফলে প্রায় সারাক্ষণই কলেজে থাকতে পারে। লাইব্রেরি থেকে শুরু, প্রিন্সিপ্যাল লাইব্রেরির দায়িত্বটা তার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তবে শুধু লাইব্রেরিই নয়, অফিসও এসে পড়েছে তার ঘাড়ে। একজন কেরানি সাহেব অবশ্যি আছেন। কিন্তু ভদ্রলোক নিজের পদের নামটা যেভাবে উচ্চারণ করেন তাঁর কাজকর্মও প্রায়ই সেই রকমই। তাঁর সব চিঠির ড্রাফ্ট উয়িথ রেফারেন্স টু ইয়োর মেমো নাম্বার দিয়ে শুরু এবং ইয়োর মোস্ট ওবেডিয়েন্ট সারভেন্ট দিয়ে শেষ— তা সে চিঠি যিনিই লিখুন আর যার কাছেই পাঠানো হোক। তো, সেইজন্যেই শুধু লাইব্রেরি নয়, অফিসও তার দায়িত্বের মধ্যে।

দিনের কাজ শুরু হয় অফিস থেকে। চিঠির ড্রাফ্ট দেখা, টাইপ হয়ে যাওয়া চিঠিগুলোর ওপর চোখ বোলানো, কোনো ছুটির দরখাস্ত থাকলে সেটা প্রিন্সিপ্যালকে আগেই জানানোর ব্যবস্থা করা— এইসব করতে করতে বেলা হয়ে যায়। মাঝখানে দুটি ক্লাস। ছেলেদের কলেজ থেকে কয়েকজন আসেন পার্টটাইম পড়াতে। মহিলা মাত্রই দুজন— সে নিজে আর জাহানারা আহমদ। জাহানারা সংসারী মেয়ে, দুতিনটি বাচ্চা, স্বামী বেশ ভালো ব্যবসায়ী- স্বামীর পীড়াপীড়িতেই আসা- নইলে চাকরিবাকরি তার একদম পছন্দ নয়। বেচারা সংসার আর মাস্টারি একসঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খায়।

অফিস আর ক্লাসের দিকটা সামাল দিয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে। সেখানে ডেসিমেল সিস্টেমে যাতে বই রাখা হয় তার চেষ্টা। কেউ বলে দেয়নি, নিজের অতি-উৎসাহের জন্যে হাত দিয়েছিল, এখন পস্তাচ্ছে। পাঁচ হাজার বই-এ নাম্বারিং করা, কার্ড বানানো- সোজা কথা নয় একেবারে।

এরই মাঝখানে এঞ্জিনিয়ার আসে। আসে ঠিকাদাররা। প্রথম-প্রথম প্রিন্সিপ্যাল থাকতেন, তিনিই কথাবার্তা বলতেন, সে পাশে বসে শুনত। এখন হয়েছে উল্টা, কোনো কথা উঠলে প্রিন্সিপ্যাল রাখীর দিকে তাকান, আর রাখীকে তখন কথা বলতে হয়। তাই আজকাল সে কথা বলে এঞ্জিনিয়ার ঠিকাদারদের সঙ্গে আর প্রিন্সিপ্যাল সাহেব পাশে বসে বসে শোনেন। রাখীর কোনো অসুবিধা হয় না। এঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দিব্বি কথা বলে যায়। নকশার ওপর পেন্সিলের উল্টোদিক দিয়ে দেখায়- এ জায়গাটা বদলান, পূর্বদিকে ল্যাব আনুন- প্রচুর আলো চাই তো— না ২০X৩০-এ হবে না, ২৫×৪০ করুন। হ্যাঁ ক্লাসরুমে টানা ডায়াস হবে। না, স্টেজের মতো নয়- কিন্তু চওড়া হওয়া দরকার। টেবিল থাকবে, পেছনে বোর্ড থাকবে, মুভ করার মতো জায়গায়ও রাখতে হবে। আর হ্যাঁ, এটা কী? বাথ? এখানে স্পেস বাড়ান, মেয়েদের কলেজ, কথাটা মনে রাখতে হবে। এঞ্জিনিয়ার আশরাফ আহমদের প্রথম-প্রথম মজা লাগত। আজকাল একেক দিন বিরক্তি বোধ করে।

একেক দিন আবার রাখী নিজেই এঞ্জিনিয়ারের কথা মেনে নেয়। যেমন হোস্টেলের বারান্দা দক্ষিণে না করে পুবে করা হল, প্রত্যেক রুমে দুটোর বেশি সিট পড়বে না। দরজা জানালার খরচ অবশ্যি বাড়ছে, পরে যদি সম্ভব না হয় বদলে দেবেন, এখন প্ল্যানে থাক। কি বলেন?

রাখী মাথা হেলায়, বেশ থাক তবে।

আশরাফকে রাখীর দিকে ঐ মুহূর্তে তাকিয়ে থাকতে হয়। ভারি শান্ত আর কোমল লাগে তখন মহিলাকে। মহিলাকে সে একদম বুঝতে পারে না। ধারালো ঝকঝকে রাখী আসল, না এই শান্ত ধীর রাখী আসল- অনেকের মতো আশরাফেরও ধরতে কষ্ট হয়।

সি.এস.পি. নিজামউদ্দিন কিন্তু ঐরকম বোঝাবুঝির ধার ধারে না। সময় নেই অসময় নেই, জিপ চালিয়ে চলে আসে। আর এসে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নতুন

নতুন সি.এস.পি., সবে গায়ের চামড়ায় চেকনাই ধরেছে—একেক দিন জিজ্ঞেস করে, কই লাইব্রেরিতে নতুন কী বই এল দেখালেন না?

রাখী তখন কেটেলবির ইতিহাস এগিয়ে দেয়, মায়ার্স দেখায়, কিংবা লেগুই কাজামিয়া সামনে রাখে।

না, এসব নয়। ফিকশন আসেনি কিছু? ম্যাথেমেটিক্সের এমএসসি কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে।

রাখী তখন ডিকেন্স থ্যাকারে হার্ডি আনে।

নিজামউদ্দিন এরপর আর কিছু বলে না, জিপ চালিয়ে ফিরে যায়।

এইরকম ব্যস্ততার মধ্যেও একেক দিন ভারি নিঃসঙ্গ লাগে। তখন রাখী বের হয়।

কলেজবাড়ির পেছনে আখের আবাদ। তার পাশ ঘেঁষে রাস্তা নেমেছে ঢালুতে। নিচে নদী, টাঙন। ভারি ধীর স্রোত জলধারায়। দূর থেকেও নিচের নুড়ি পাথর আর লালচে বালি চোখে পড়ে। কোথাও কোথাও লম্বা ঘাসের মতো জলজ গুল্ম স্রোতের মুখে কখনো এদিক কখনো ওদিক মাথা হেলায়- দুটি একটি ফিচকে মাছও চোখে পড়ে।

ওদিকে বেলা চলে যেতে থাকে— শীত শীত লাগে— ব্রিজের নিচ দিয়েও উত্তরদিকটা নজরে পড়ে। দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালি রঙ সরে আবার ধূসর হয়ে যেতে থাকে। রাখী এইসব দেখে, শুধুই দেখে, ভাবে না কিছু মাঝে মাঝে সুমিতার চিঠি আসে- রাখী, তুই বেঁচে আছিস, না মরে গিয়েছিস? গত মাসে একটা পোস্টকার্ড লিখেছিলি শুধু, এ মাসে সেটাও নেই। তুই ভেবেছিস কী? চোখের আড়াল হয়ে কি সংসারটাকে পাশ কাটিয়ে যাবি? নাকি ওখানেও কোনো ঝামেলা বাধিয়েছিস। এদিকে কিন্তু তোর ঝামেলা আমাকে এখনও পোয়াতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু-আধটু পার্টির কাজ করে দিতাম বলে ওরা এখন আমার ঘাড়ে চেপে বসতে চায়। ওদের পার্টির ভেতরে কিন্তু এখন বেশ মতভেদ শুনতে পাই। ওরা এখন সুর বদলেছে। মতে মিলছে না বলে আলাদা আলাদা সব গ্রুপ হয়ে যাচ্ছে। ওরা ভেবেছে কী বল্ তো? নিজেরাই মিলতে পারে না। দেশের লোককে মেলাবে কেমন করে? কী কী যে বলে আমার মাথায় একদম ঢোকে না।

একেক দিন আবার লেখে- রাখী, আর ভালো লাগে না রে। সহজভাবে জীবন কাটানো আসলেই খুব মুশকিল। স্বার্থ মানুষকে ভয়ানক ছোট করে দেয়। মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছিস কি মরেছিস। রেহানাকে মনে আছে তোর? সেই-যে একসময়ে আমার ঘরে জায়গা দিয়েছিলাম। এখন চাটগাঁয়ে থাকে। ঢাকায় এলে আমার কাছেই উঠত। সেই রেহানা এখন একমাস ধরে ঢাকায় এসে রয়েছে আর আমাকে ঢাকা থেকে সরাবার ফিকির খুঁজছে। বোখ্ ব্যাপারটা।

একদিন লিখল— সখী তোমার স্বামীরত্নটি দেখছি দালালির চূড়ান্ত করে চলেছে। এন.এস.এফ.-এর পাণ্ডাদের সঙ্গে এখন ওকে ঘুরতে দেখা যায়। আমার সঙ্গে কয়েকবারই দেখা করল। এ মাসেই নাকি ওর বিদেশ যাওয়ার কথা। তোকে জানাতে বলেছে, তুই ইচ্ছে করলে ওর সঙ্গে যেতে পারিস।

রাখীও চিঠি লেখে। কিন্তু ওসব প্রসঙ্গ নিয়ে লেখে না। তার নিজের কাজের কথা লেখে, কলেজের ছাত্রীদের কথা লেখে, নতুন কী কাজ হাত দিয়েছে সেকথা লেখে। কখনো কখনো মাঠ, নদী, দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা— এইসব থাকে ওর চিঠিতে।

প্রিন্সিপ্যাল একদিন একান্তে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা জামান সাহেব একবারও এলেন না কেন? একবার অন্তত দেখে যেতে পারতেন।

রাখী জামানের বিদেশ যাবার কথা বলে পাশ কাটায়। কিন্তু কারণ বুঝতে পারে না, কেন প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের এইরকম কৌতূহল।

এঞ্জিনিয়ার আশরাফ আহমদও একদিন শুধাল, আচ্ছা জামান সাহেব কি বিদেশে আছেন?

রাখীর রাগ হয়েছিল কথাটা শুনে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে আশরাফের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু দেখল, না, কোনো বদমতলব থেকে আশরাফ প্রশ্নটা করেনি। বরং প্রশ্নটা করে সে নিজেই বিব্রত হয়ে পড়েছে। রাখীর চোখমুখের ভাব দেখে সে কথাটা ফিরিয়ে নিতে চাইল। বলল, কিছু মনে করবেন না, হঠাৎ কথাটা মনে হল বলেই জিজ্ঞেস করলাম।

রাখী তবু বিরক্তি গোপন করে না। বলে, না বিদেশ নয়, দেশেই রয়েছে, বলুন কী দরকার তাকে।

আশরাফ আর কথা বাড়ায় না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নকশার কাগজপত্র গুটিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে। মৃদুস্বরে জানায়, আচ্ছা, চলি, দেখা হবে আবার। রাখী কলেজের মেয়েদের খেলাধুলোর ব্যাডমিন্টন সেট আনাল। শালোয়ার কামিজ পরে মেয়েরা দুপুরবেলা ব্যাডমিন্টন খেলছে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে মফস্বল শহরের মানুষ মেয়েদের ঐ খেলা দেখতে লাগল।

আসলে খেলার ব্যাপারটা যে বেশ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে এটা সে ধারণা করতে পারেনি। একদিন দেখল কলেজের মাঠ দিয়ে উঁচু করে বেড়া দেয়া হচ্ছে।

মেয়েদের গানবাজনা শেখানোর কথা হচ্ছিল। জাহানারার খুব উৎসাহ। সে হারমোনিয়াম তবলা এসব জুটিয়ে আনল। মাস্টারও ঠিক হল একজন, ক্ষেতুবাবু। বেজায় বুড়ো, দাঁত নেই সামনের দিকে। রাখী আমতা আমতা করছিল মাস্টার মশাইকে দেখে। জাহানারা রাখীর আপত্তি উড়িয়ে দিল। বলল, হোক বুড়ো, হোক দাঁত নেই— মাস্টার তো। গান তো গাইবে মেয়েরা। একজন লোক থাকা দরকার, তাই থাকল।

তো বেশ জোরেশোরে গানবাজনার চর্চা আরম্ভ হয়ে গেল। জাহানারাই শেখায়— ক্ষেতুবাবু তবলায় ঠেকা দেন শুধু, আর মাথা দোলান। জাহানারা খান দুই-তিন গান সুন্দর তুলে দিল দু-তিনটি মেয়ের গলায়। ব্যাপারটা এমনই জমে উঠল যে রাখারও ইচ্ছে হচ্ছিল, সেও হারমোনিয়ামের পেছনে গিয়ে বসে।

ঐরকম সময়ই সম্ভবত প্রস্তাবটা করেছিল কেউ। কে যে বলা মুশকিল হুমায়ুন হতে পারে, আশরাফ হতে পারে, নিজামউদ্দিনও হতে পারে। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের কথাটা মনে লাগে। কথাটা রাখীর কাছে পাড়লে রাখীরও মন্দ লাগেনি। জাহানারার কানে কথাটা পড়তে পেল না। সে রীতিমতো হৈ হৈ কাণ্ড শুরু করে দিল। গান তো হবে, সেইসঙ্গে নাচ হলে হয় না? তখুনি খোঁজ হল। উমা নামে একটি মেয়েকে পাওয়া গেল— উমা ঘোষ। সে নাচতে চাইল। কিন্তু একা উমা হলে চলবে না, আরেকজন চাই। উমাই রাজি করাল, সুলতান মোক্তারের মেয়ে আবিদাকে। আবিদা রাজি হল, কিন্তু তার গার্জেনদের মত করাতে হবে। জাহানারা নিজেই গেল মত আনতে।

দিন-পাঁচেকের বিহার্সাল, একটুখানি কবিতাও হল- বিদায় অভিশাপ। ব্যস্, ফাংশান হয়ে গেল। নাচ, গান, বিদায় অভিশাপ এইসব মিলিয়ে- মফস্বল শহরের ফাংশান যেমন হয়। কিন্তু জমল দারুণ। ফাংশন শেষে নিজামউদ্দিন একবার দাঁড়িয়েছিল রাখীর কাছাকাছি। ঐ সুযোগে বলল, আপনাকে যত দেখছি তত মুগ্ধ হচ্ছি, এত গুণ আপনার।

রাখী নিজামউদ্দিনের চোখের ওপর নজর রেখে দেখল একমুহূর্ত। তারপরই সরে গেল সেখান থেকে। ঠিক ঐসময়ই আশরাফ কাছাকাছি এসে যাওয়াতে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মনে হচ্ছিল নিজামউদ্দিন বোধহয় তার পিছু ছাড়বে না।

আশরাফ কাছে এসে মন্তব্য করল, বেশ করল কিন্তু আপনার ছাত্রীরা, এইরকম জায়গায় এমন সুন্দর ফাংশন কল্পনাই করা যায় না।

কৃতিত্বের সবটাই কিন্তু জাহানারার।

সেটা জানি, আশরাফ সহজভাবে বলল, মহিলা নিজেও নিশ্চয়ই ভালো গাইতে পারেন। কিন্তু তাঁর স্বামী একদিনও জানতে দেননি, এমনই চাপা মানুষ। কিন্তু একটা কথা, আশরাফ ইতস্তত করল। তারপর বলল, দেখবেন, আপনাদের এই ফাংশন নিয়ে কিন্তু কথা উঠবে।

রাখীর বিশ্বাস হতে চাইছিল না কথাটা। বলল, এস.ডি.ও. নিজে উপস্থিত ছিলেন, তবু?

হ্যাঁ তবু, মনে হচ্ছে কিছু কিছু লোক ঘোঁট পাকাবে।

দুদিনেই দেখা গেল আশরাফের কথা একশো ভাগ সত্যি। কলেজের দেয়ালে পর্যন্ত পোস্টার পড়ে গেল— শিক্ষার নামে বেহায়াপনা চলবে না, চরিত্রহীন অধ্যাপিকার অপসারণ চাই।

রাখীর শোনা ছিল, মফস্বল শহরে নানা ধরনের নোংরা দলাদলি থাকে। কিন্তু তাকে নিয়েও যে ঐরকমের ব্যাপার ঘটতে পারে, সে ধারণা করেনি। রাখী খোঁজখবর করল ব্যাপারটা জানবার জন্যে। কিন্তু যেটুকু জানল, তাতে বুঝল ব্যাপারটা অনেকদূর গড়িয়েছে। কিছু গোঁড়াপন্থি লোক সব জায়গায় যেমন থাকে, তেমনি এখানেও আছে-তারা কলেজ হওয়ার বিরোধী ছিল। এখন একটা ছুতো পেয়েছে, তাই এমন হৈচৈ। জাহানারা স্থানীয় মেয়ে, সে হুমায়ুন সাহেবের মতো লোকের বউ, তাকে কিছু বলা যায় না- তাই রাখীর ওপর আক্রমণ।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বাইরে কিছু বললেন না, রাখীকেও না। কিন্তু আসলে তিনি ভেতরে ভেতরে দারুণ খেপে গিয়েছেন— সে খবরটা রাখী জাহানারার কাছ থেকে পেল।

শহরের তরুণ ক’টি ছেলে বেশ কয়েক জায়গায় কয়েকজন লোকের সঙ্গে হাতাহাতি পর্যন্ত করেছে, এ খবরটাও তার কানে এল। মোট কথা সে বুঝল, ব্যাপারটা গড়িয়েছে অনেকদূর।

এরকম কোনো অভিজ্ঞতা রাখীর ছিল না। সে বেশ অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। সে সাতে নেই পাঁচে নেই, মাঝখান থেকে তাকে নিয়ে টানাটানি। সে প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে জানায়, মেয়েদের খেলাধুলো ব্যাপারটা তাহলে বন্ধ থাক।

কেন? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব কেমন রেগে উঠলেন রাখীর কথা শুনে। গম্ভীর মুখে বললেন, যেমন চলছিল, সবকিছু তেমনই চলবে, যদি দরকার হয়, তখন আমি যা বলবার বলব।

এদিকে এস.ডি.ও. নিজামউদ্দিন আবার নতুন আবদার তুলল। একদিন কাগজপত্র দেখতে দেখতে রাখীকে লক্ষ করে বলল, এরপর থেকে আমি আর এখানে আসব না, আপনি যাবেন আমার ওখানে।

রাখীর অবাক লাগে, লোকটা কী বলতে চায়? রাখীর দায়টা কিসের? ভেবেছিল যাবে না, কিন্তু গেল সে। প্রিন্সিপ্যাল সঙ্গেই গেল। কিন্তু প্রিন্সিপ্যালকে দেখে মহাবিরক্ত হল ব্যাচিলর সি.এস.পি.। মুখোমুখি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা দুজনেই কাজের লোক, আর দুজনেই একসঙ্গে চলে এলেন? ওদিকে কলেজ কেমন করে চলবে? রাখীকে বলল, আপনি আবার ওঁকে নিয়ে এলেন কেন?

ঐ কথার পর রাখীকে জানাতেই হল, কাজটা তো ওঁর সঙ্গে, উনিই তো প্রিন্সিপ্যাল।

রাখীর কথা শুনে নিজামউদ্দিনের ফর্সা মুখ লাল হয়ে যায়।

যে-কারণেই হোক নিজামউদ্দিন যে চটেছে তা রাখীর বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু কিছু বলে না সে। লোকটার সম্পর্কে ইতিমধ্যে নানান কথা কানে এসেছে তার। জাহানারা সাবধান করে দিয়েছিল সেই প্রথমদিকেই। বলেছিল, সাবধান থেকো ভাই, লোকটা আসলে মেয়ে-খেকো বাঘ। সেজন্যেই সম্ভবত লোকটার আচরণ সম্পর্কে রাখীর অস্পষ্ট একটা হিশেব প্রথম থেকেই ছিল। আর সেই কারণেই নিজামউদ্দিনের ব্যাপারে তার মনের ভেতরে একধরনের প্রস্তুতি আগে থেকে তৈরি হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু মুশকিল হয়ে যাচ্ছে অন্য জায়গায়। এস.ডি.ও. গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান, তার হাতেই আসল কলকাঠি অর্থাৎ টাকাপয়সা। চেয়ারম্যান চেক সই করেন না, দিনের পর দিন ঘোরান, নানা কাগজ ঘাঁটেন। ওদিকে লেবার পেমেন্ট বাকি থেকে যায়, টিচারদের মাইনে হতে হতে ১০/১২ তারিখ পার হয়ে যায়।

ঐরকম সময়ে আশরাফ একদিন বেশ বিরক্ত হয়েই জানাল, আপনাদের এখানে কাজকর্ম হওয়া খুব মুশকিল।

কীরকম? রাখী জানতে চেয়েছে।

রকম বেশি কিছু নয়, একটাই রকম, আপনাদের আসল খুঁটিটাই নড়বড়ে। দেখছেন না, ফাংশানের ব্যাপারটা নিয়ে কীরকম ঘোঁট পাকাচ্ছে এখনো। ওদিকে মানুষের মনে বিষ ছড়ানো হচ্ছে, এদিকে বটলনেক সৃষ্টি করে গণ্ডগোল তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।

আশরাফ মনে হয় অনেক কিছু জানে। রাখী বলল, একটু খুলে বলুন ব্যাপারটা শুনি

খুলে বলার তো কিছু নেই। আপনারা গোলমাল করার পথ নিজেরাই খুলে দিয়েছেন। ঐ নাচের ব্যাপারটা না-করলেই পারতেন। ব্যাকওয়ার্ড জায়গা তো, ধীরে ধীরে সওয়াতে হয়, নতুন জিনিস কি আর হুট করে নেবে সবাই?

কিন্তু ঐ নাচগানের সঙ্গে অতসব কাণ্ড ঘটিয়ে দেয়ার কী সম্পর্ক? রাখীর ভয়ানক গোলমেলে লাগে পরিস্থিতিটা।

এমনিতে সম্পর্ক নেই। কিন্তু কেউ যদি নিজের কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চায় তাহলে সম্পর্ক তৈরি করে নিতে কতক্ষণ?

রাখীর মুখে চিন্তার ভাব দেখে আশরাফ তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল। বলল, আপনি চিন্তা করছেন কেন? আপনার তো এসবের মধ্যে কিছু করার নেই। এ অবস্থাটা হতই— নাচের ব্যাপারটা আসলে একটা ছুতো। রাখী আশরাফের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, আপনার কী মনে হয়? কলেজ কি এরা তুলে দেবে?

দিক তুলে, আশরাফ সহজ ভঙ্গিতে হেসে ওঠে। বলে, তাতে আপনার কী? আপনি ঢাকার মানুষ, ঢাকায় ফিরে চলে যাবেন। এসব ঝক্কি-ঝামেলা পোয়ানোর ব্যাপারে আপনার কী দায়?

আশরাফের কথার ধরন রাখীকে কিছুটা সহজ করে দেয়। আরো মনে হয়, মিছামিছি সে চিন্তা করছে- সত্যিই তো তার কী আসবে-যাবে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে? তার মধ্যে যেটুকু চিন্তা এবং দ্বিধার ভাব ছিল, সে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলল ক’দিনেই। যা হয় হবে— এইরকম একটা ভাব আপনা থেকে উঠে আসতে লাগল মনের ভেতর থেকে।

একই সঙ্গে মেয়েদের খেলাধুলো আর গানবাজনার চর্চায় সে আরো বেশি উৎসাহী হয়ে উঠল। আর তার ফল হল, এখন শুধু কলেজের মেয়েরাই নয়, ইস্কুলের উঁচু ক্লাসের মেয়েরাও আসতে লাগল কখনো খেলতে, কখনো গাইতে। জাহানারা হল এই নতুন নাটের গুরু। এখন সে বাচ্চাদুটিকেও কলেজে নিয়ে আসে। তার স্বামী স্ত্রীকে খুব উৎসাহ দিচ্ছে। রাখী বুঝতে পারে, জাহানারার স্বামীও কলেজ নিয়ে বাইরে যে দলাদলি পাকিয়ে উঠেছে তার একটি পক্ষে।

রাখী নিজের ছেলেবেলায় স্পোর্টস কি গানবাজনা নিয়ে কখনো মাতামাতি করেনি। তাই তার দ্বিধা থাকে, জাহানারা যেমন পারে, সে তেমন পারে না। কিন্তু দেখা গেল রাখীও পারছে। আসলে মেয়েদের সঙ্গে, বিশেষ করে অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশাটা এমনই জিনিস যে নিজেকে শেষপর্যন্ত আলগা রাখা যায় না। জড়িয়ে পড়তেই হয়।

যেমন সাকিনার ব্যাপারটা। খুব হাসিখুশি মেয়ে- ওড়না কোমরে জড়িয়ে তীরের মতো ছুটতে পারে। এদিকে আবার যখন গান গায়, মনে হয় সমস্ত মন ঢেলে দিচ্ছে গানে। রাখী ভাবছিল ইস্কুলের ফিজিক্যাল টিচারকে ডাকিয়ে এনে একটু ভালো ট্রেনিঙের ব্যবস্থা করবে। ইস্কুলের ফিজিক্যাল টিচার ওর দৌড় দেখে উৎসাহও বোধ করেছিলেন।

কিন্তু একদিন দেখা গেল সাকিনা শুকনো মুখে বারান্দার এককোণে বসে আছে।

কী ব্যাপার, তুমি একলা এভাবে বসে? রাখী কাছে এগিয়ে গেল।

আর তাতেই ফুঁপিয়ে উঠল মেয়ে। জানা গেল সাকিনার আব্বা মেয়েকে আর কলেজে পড়াতে চান না। কলেজে বেপর্দা শিক্ষা দেওয়া হয়, বেশরিয়তি কাজ-কারবার চলে। অতএব মেয়ে যেতে পারবে না।

রাখীর খারাপ লাগে। কী বলবে মেয়েটাকে, বুঝে উঠতে পারে না। ব্যাপারটা জাহানারার কানে তুলল। জাহানারা স্থানীয় মেয়ে, তার জোর অন্যরকম। সে বলল, তোমার আব্বা যতই ইচ্ছে নিষেধ করুন, তুমি চলে আসবে, তোমার মা’র অমত নেই তো?

সাকিনা জানায়, না, মায়ের অমত নেই। কিন্তু আব্বাকে ভয় করেন খুব।

জাহানারাই গোটা ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত সামাল দিল। কিন্তু রাখীকে জড়িয়ে পড়তে হল। সঙ্গে কথা বলার সময় রাখীকেও থাকতে হয়েছিল। মেয়েটা যে পড়াশোনায় খুব ভালো, সাপ্তাহিক পরীক্ষার খাতা খুলে খুলে প্ৰমাণ দিয়ে ভদ্রলোককে রাখীই সেকথা বোঝাল।

একজনের হলেই আরো অন্যজন আসে। ঐভাবে শাহানা এল। তারও ঐ একই ধরনের সমস্যা। জোহরার কলেজে আসা তো বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। তার আবার বিয়ে সামনে, মা বলে সেজন্যে কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। কিন্তু জাহানারার ভীষণ জেদ। দেখা গেল জোহরাও কলেজে আসছে।

নিজের জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা শুধু ঘটনাক্রমের নয়। হিশেবেরও নয়। জড়িয়ে পড়ব, এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে বোধহয় কেউ জড়িয়ে পড়ে না। ব্যাপারটা আরম্ভ হয় নিজেরই অগোচরে, এবং খুব ধীরে ধীরে। মেয়েদের ছোটাছুটি, খেলাধুলা, কথাবার্তা, হাসাহাসি— এইসবের মধ্যে দিয়েই শুরু হয় প্রক্রিয়াটা। যেমন মেয়েরা কোরাস গাইছে, রাখীকেও গাইতে হবে, মেয়েরা খেলছে, রাখীকেও খেলতে হবে। খেলতে খেলতে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ল দুজনই দুদিকে। একদিকে রাখী আর অন্যদিকে রাখীর ছাত্রী। মাথায় আলু বেরিয়ে গেল। মাথায় হাত চেপে ছাত্রীর সঙ্গেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে হল রাখীকে।

গান অথবা খেলা শেষ হয়ে যাবার পর রাখী যখন মাঠের ওপরে দিয়ে হেঁটে আসে, তখন একেক দিন মনে হয়, চারদিকে কীরকম যেন একটা সাড়া জেগে উঠছে। সাড়াটা আগে ছিল না, কেউ ভাবেনি যে, একটা ঐরকম কিছু জেগে উঠবে। কিন্তু সাড়াটা জাগাল, হাসিতে, কোলাহলে, ছুটোছুটিতে, দুঃখে, বেদনায় এমনকি সে যে বাইরের লোক, তবু সে-ও অনুভব করছে, সাড়াটা জাগল তাহলে! এটা আরো বড় ব্যাপার রাখীর জন্যে এ কারণে যে, সে নিজেকেও দেখতে পাচ্ছে ঐ জেগে উঠবার প্রক্রিয়ার মধ্যে।

সময়টা ১৯৬৭ সাল হলেও উত্তরবঙ্গের সুদূরে এই মহকুমা শহরের মিউনিসিপ্যালিটিতে পানি নেই, ইলেকট্রিসিটি নেই। মেয়েদের ইস্কুলটা পুরনো। কিন্তু ছেলেদের কলেজের বয়স মাত্র বছর-পাঁচেক। বড় জোতদারই হর্তাকর্তা। ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকেদারি, ডাক্তারি, ওকালতি- এসব তাদেরই ব্যাপার। রাজনীতিতে তারাই সর্বত্র। ড্রামাটিক ক্লাব আছে, স্পোর্টস ক্লাব আছে, লাইব্রেরি আছে— সর্বত্র ঐ একই মাতব্বরি। নিজেদের এলাকার মান রাখবার জন্যে কলেজ করা হয়েছে। সেই একই উদ্দেশ্যে মেয়েদের এই কলেজটারও সম্ভবত আরম্ভ। ভাবখানা এরকম যে নতুন কিছু হোক, শহর হোক, আধুনিকও হোক— কিন্তু সবই থাকবে আমাদের হাতে। সেজন্যে মিলাদ মাহফিলে আমরাই টুপি মাথায় ওয়াজে শামিল হব, আবার নাটকেও সাজ-পোশাক পরে রঙ মেখে আমরাই অভিনয় করব। মুসলিম লীগ আমরা হব, আমরাই আওয়ামী লীগ করব আবার আমরাই জামাতে ইসলামীও করব।

ওদিকে ঢাকায় ১৯৫২ গেছে, ‘৬২ পার হয়েছে, ‘৬৪-ও চলে গেল— কিন্তু তার সাড়া এই এলাকায় এসে পৌঁছে কি না ধরা মুশকিল। ১৯৪৭/৪৮- এর জের এ শহরে কাটছে না। সময়ের দেবে-যাওয়া চাকা ভয়ানক স্থির। কিন্তু তবু সময়টা ১৯৬৭। কলেজের ছেলেরা লাইব্রেরির মেম্বার হয়ে নতুন বই কেনার দাবি জানাচ্ছে, ড্রামাটিক ক্লাবের কর্মকর্তা হবার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছে, স্পোর্টসে মাতব্বরদের ছেলেমেয়েদের কারচুপি করে ফার্স্ট সেকেন্ড করানো হলে হৈ হৈ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কবে কখন ৪৫/৪৬-এ তেভাগা আন্দোলন হয়েছিল, সেই ঘটনার ব্যাপারে এখন খোঁজখবর হচ্ছে। আলাদা সংগঠন হয় কি না, আলাদা পার্টি করা যায় কি না- তাই নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা।

ঢাকা শহর এমনিতেই অনেকদূর- নতুন মধ্যবিত্তের নতুন চিন্তাভাবনা আরো বেশিদূর।

তবু সময়টা ১৯৬৭। ইতিমধ্যে নতুন চিনিকল হয়েছে, মাটিতে গভীর নলকূপ বসিয়ে আবাদ বাড়ানোর জন্যে আরম্ভ হয়েছে সরকারি উদ্যোগ। রাস্তা পাকা হওয়ায় শুধু রেলগাড়ির ওপর ভরসা নয়, এখন ঝকঝকে নতুন নতুন বাস চলতে শুরু করছে।

ছোট শহর, এখনো ইলেকট্রিসিটি আসেনি, সন্ধ্যা হতে-না-হতেই অন্ধকার এবং ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যায়। কিন্তু তবু এর ভেতরে ভেতরে অনেক উল্টোপাল্টা স্রোত। সেই স্রোতে পায়ের তলার মাটি বসে যাচ্ছে অগোচরে। অন্ধকারের মধ্যে, ঘুমের মধ্যে তলিয়েও চোখ মেলে রাখছে কেউ কেউ। কান পেতে আছে, অচেনা পায়ের আওয়াজ কানে এসে লাগে কি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *