প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

পূর্বপত্র – সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়

পূর্বপত্র – সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় 

প্রেমাঙ্কুর আতর্থীকে আমি দেখলাম বড় একটা ঘরের প্রশস্ত পালংকে আধশোয়া অবস্থায় গ্রীষ্মের প্রথম অন্ধকার নামবার ঠিক আগের মুহূর্তে। কালের অমোঘ নিয়মে ভেঙে পড়া শরীরে এখনও প্রকট অতীতের রূপের জৌলুস। তীক্ষ্ণ নাক। তীক্ষ্ণ মুখ। উজ্জ্বল গায়ের রং। তাঁর রসিক জিহ্বা এখনও ছড়ায় কথার ফুলঝুরি। 

“সেই কবে টেলিফোন করেছিলে”, আমাকে দেখে বিছানার ওপর বসেন প্রেমাঙ্কুর, “আজ এলে! তোমাকে কথা দিয়েছিলাম দেখা হবে। তাই বোধহয় টিকে গেলাম।” 

তাঁর কথায় রসিকতার আভাস পেয়ে আমিও বলে উঠি, “আপনি যেন যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন! কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আপনার আয়ু আরও অনেক ছিল- 

“আরে না ভাই”, আঙুল নেড়ে নিশ্চিত প্রেমাঙ্কুর বলেন, “কাল তো প্রায় হয়ে গিয়েছিল আর কি!” 

“কি হয়েছিল?” 

“প্রেসার! আবার কী! অত্যধিক রক্তের চাপ। সারাটা জীবন তাতিয়ে তাতিয়ে নিজেই রক্ত গরম করে তুলেছি। এখন আমি ঠান্ডা হয়ে গেলেও রক্ত কি ঠান্ডা হয়।” 

হাল্কা সুরে আমি বলি, “আপনার জীবনের সেই সব গরম গরম দিনের কথাই তো শুনতে এলাম।” 

“বেশ করেছ। এখনও মনের মধ্যে কত কথা যে জমা হয়। কিন্তু শোনে কে! এ-বুড়োর কাছে, আজকাল আর কেউ আসে না”, মোটা বালিশটা হাতের কাছে টেনে নেন প্রেমাঙ্কুর। “তাই তোমার টেলিফোন পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম–’দেশ’ পত্রিকার হঠাৎ আমাকে মনে পড়ল কেন!’ 

কী একটা বলতে গিয়ে আমার কথা যেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। ঘরের দুই দরজা দিয়ে ঢোকে দুই কুকুর লালু আর ভুলু। ওরা প্রথমটা অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে তারপর পায়ের কাছে এগিয়ে এসে গরর গরর করে। ব্যস, ওইটুকু। লেজ নাচাতে নাচাতে ওরা আবার বেরিয়ে যায়। আমার অবস্থা দেখে প্রেমাঙ্কুর খুব হাসছেন তখন। সাহিত্যিক আর অসংখ্য বন্ধু মহলে যে নামে পরিচিত প্রেমাঙ্কুর, সে-নামে তাঁকে সম্বোধন করে বলি, “বুড়োদা, এরা কিসের প্রতীক?” 

“ওরা?” হাসিমুখে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “আমায় ধৈর্যহীন অপচয়ের প্রশ্রয় ওরা বোধহয় আর দিতে চায় না। তাই আমাকে আগলে আগলে রাখে। প্যান্ট পরা লোক দেখলেই ভাবে ফিল্মের লোক। কিছু বলে না। শুধু একটু শুঁকে চলে যায়”–হা-হা করে হাসেন প্রেমাঙ্কুর। “নাতির কুকুর। কিন্তু ওরা আমারই বেশি ভক্ত।” 

“নাতি–আপনার ছেলের ছেলে?” 

“ছেলে নেই আমার। দুই মেয়ে। এটা ছোট মেয়ের বাড়ি। বড়ো মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বালিগঞ্জে।” 

যাক্, এবার নিশ্চিন্ত হলাম। বেশি কথা বলবেন কি না প্রেমাঙ্কুর–কথা বলতে বলতে অবসন্ন হয়ে পড়বেন কি না–বিবেকানন্দ রোডের কাছাকাছি চালতাবাগান লেনে প্রেমাঙ্কুরের বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে এমন ভাবনা মনে এসেছিল। কিন্তু এখন আর কোনো সন্দেহ নেই আমার। হু হু করে কথা বলে যাবেন প্রেমাঙ্কুর আর পাপড়ি খুলে খুলে বর্তমানকে স্তব্ধ করে উদ্ধত সূর্যমুখী ফুলের মতো আমার সামনে দুলবে এমন এক সাহিত্যিকের বাঙ্ময় অতীত, যিনি অমিত অপচয়ের–মাধুর্যে আর বিশৃঙ্খলতার নির্মম অট্টহাস্যে একই জীবনে বারবার উপলব্ধি করেছেন জন্ম-জন্মান্তর–সাহিত্যিক হবার কৃত্রিম উদ্যম যাঁর ছিল না। মজ্জাগত শিল্পসত্তা জীবনের শুরু থেকে বারবার দুর্দম বেগে যাঁকে ঠেলে দিয়েছে ঘর থেকে বাইরে, সারা ভারতবর্ষের সব প্রদেশের অলিতে-গলিতে জীবনের অকৃপণ অভিজ্ঞতায়–আলো-অন্ধকারে। আমি সামনে বসে আছি সেই প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর। 

১৮৯০ সালের পয়লা জানুয়ারি জন্ম হলেও কথায় কথায় এক সময় প্রেমাঙ্কুর বলেন, “বাহাত্তর কথাটা বারবার এড়িয়ে এসেছি। তাই এক বছর বাড়িয়ে বয়স বলি তিয়াত্তর। একেবারে মিছে কথাও নয়, বাহাত্তর পূর্ণ হয়ে তিয়াত্তরে পড়লাম তো বটে। গত বছর তুমি এলে বয়স বলতাম, একাত্তর। তা-ও ঠিক হত। কী বল? ‘বাহাত্তরে ধরেছে’ বলার সুযোগ কেউ পাবে না।” 

“সময়টা তখন কেমন ছিল বুড়োদা?” 

“কোন সময়?” 

“আপনার বয়স যখন কম ছিল-“ 

“মানে সাহিত্যের দিকে ঝোঁকটা গেল কেমন করে?” 

“ঝোঁক হল পরীক্ষার ভয়ে–প্রাণের দায়ে। আমার বাবা মহেশ আতর্থী ছিলেন কড়া লোক। আমাদের পড়াশুনোর ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি ছিল সজাগ। আরে, পড়াশুনো যার ধাতে নেই, কড়া বাপের সাধ্যি কি তাকে দিগ্‌গজ করে তোলে। আমিও বুঝলে? পরীক্ষার আগে আগে ওই কড়া বাপের প্রহরার ভয়ে বাড়ি থেকে চম্পট–কেউ সন্ধান পেত না।” কৌতূহলের বৈদ্যুতিক স্পর্শে সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করি “কোথায় কোথায় যেতেন?” “তার কি কিছু ঠিক ছিল? সর্বত্র অবাধ গতি। ঝড়ে [য ] সমুদ্রে অরণ্যে পাহাড়ে! গোয়ালিয়রের দুর্গে। দিল্লির মসনদে কাশীর মন্দিরে, কোয়েটার মরু প্রান্তরে। হরিদ্বারের চটিতে। বৃন্দাবনের ধর্মশালায়–কত জায়গায়। 

এক আশ্চর্য আবেশের দীপ্তিতে প্রেমাঙ্কুরের চোখ-মুখ জ্বলতে থাকে, “কেউ আদর করেছে–আশ্রয় দিয়েছে। কেউ সন্দেহ করেছে–লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে–কোনো কোনোদিন খাওয়া জুটেছে–কোনো কোনোদিন শুধু জল। কিন্তু আদর সন্দেহ আশ্রয় লাথি–সবই আমার অজ্ঞাতে গাঁথা হয়ে রইল একই সুতোয়। আর শুধু সে মালা গলায় দুলিয়ে পার হয়ে এলাম এতটা পথ–তিয়াত্তরের নড়বড়ে ভাঙাচোরা ধাপ অবধি।” 

“আবার বাড়ি ফিরে আসতেন কবে?” অপচয়ের খুশির হাসিতে এখনও নতুন করে ফুটে ওঠেন প্রেমাঙ্কুর, “যখন শরীর ক্লান্ত, মন অবসন্ন। যখন পুঁজি একেবারে শূন্য। যখন যাবার কোনো জায়গাই থাকত না, তখন সুড়সুড় করে বাড়ি ফিরে আসতে হতো সুবোধ বালকের মতো।” 

“আপনার বাবা কি বলতেন তখন?” “ওরে বাবা!” শিউরে ওঠার বিদ্যুৎ ভঙ্গি করে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “মার ধোর কড়া শাসন। কিন্তু তাতে কী হবে? লেখাপড়া যে কিছুতেই করবে না–যার ধাতে নেই পুঁথি মুখস্থ করা তাকে কি কেউ এঁটে উঠতে পারে!” দু’এক মিনিট চুপ করে থেকে তিনি হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি আমার “মহাস্থবির জাতক’ পড়েছ?” 

উৎসাহের প্রবল ঝোঁকে আমি তাকাই প্রেমাঙ্কুরের দিকে “হ্যাঁ ছেলেবেলায়”, আমাকে বাধা দেন প্রেমাঙ্কুর, “আমার সম্বন্ধে কিছু লেখবার আগে যদি পার তো প্রথম খণ্ডটা আর একবার পড়ে নিও।” 

“নিশ্চয়ই” হেসে বলি “ওটা তো আপনারই জীবনী” প্রেমাঙ্কুর বলেন, “যাকগে–যাকগে! হ্যাঁ বুঝলে? পড়াশুনো তো ওইখানেই–মানে শুরু না হতেই খতম করে দিলাম।” 

“কিন্তু তারপর–করি কি। কিছুই তো নেই আমার। না অর্থ, না বিদ্যা। শুধু একটা নেশা–সব উড়িয়ে পুড়িয়ে ছুটে যাবার উৎকট এক নেশা–সেই যে উড়িয়ে দেবার লাগল নেশা– কি সব আছে না?” আমি হেসে জিজ্ঞাসা করি, “রবীন্দ্রনাথের নাম তখন কেমন?” 

“এতটা নয়, তিনি পরিচিত, প্রসিদ্ধও। কিন্তু পরোপুরি প্রতিষ্ঠিত নন। আমাদের পরিণত কৈশোর আর যৌবনের প্রথম-প্রথম বঙ্কিমের প্রভাব। তার যশোদীপ্তিতে চারপাশ আচ্ছন্ন। আমরা লুকিয়ে-লুকিয়ে বঙ্কিম পড়ি”, অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “খবরের কাগজের নতুন মলাট চাপিয়ে বঙ্কিমকে ছদ্মবেশ পরাই–” তাঁর কথার অর্থ ধরতে না পেরে জিজ্ঞাসা করি, “ছদ্মবেশ পরান মানে?” 

“বুঝলে না, গোঁড়া ব্রাহ্ম বাড়ির ছেলে, ওই বয়সে বঙ্কিম-টঙ্কিম পড়া চলত না। চোখের সামনে ছদ্মবেশী বঙ্কিমের আনন্দমঠ খোলা। বাবার পায়ের শব্দ পেলেই তাঁকে শুনিয়ে গলা ছেড়ে পড়তাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের-করুণ বীভৎস বর্ণনা। সুবিধেমতো নিজেই দু-এক লাইন বানিয়ে জুড়ে দিয়ে দুর্ভিক্ষটাকে আরও রিয়্যাল করে তুলতাম।” 

“ব্যস, ঘরে ঢুকে বঙ্কিমের ছদ্মবেশ খুলে আমার কান চেপে ধরবার কথা বাবার মাথায় আসত না। দূরে দাঁড়িয়ে তিনি বোধহয় অবাক হয়ে ভাবতেন এতদিনে ছেলের লেখাপড়ায় মন হল। বাঙলার ইতিহাস পড়ে জাতীয় ঐতিহ্য বোঝবার চেষ্টা করছে।” প্রেমাঙ্কুরের হাসি হাসি মুখ হঠাৎ ম্লান হয়ে যায়। “এমনি করে উড়িয়ে-পুড়িয়ে ফাঁকি দিয়ে নিজেই তৈরি করলাম ভবিষ্যতের অভাব আর অন্ধকারের কঠিন নির্মম এক বেড়াজাল–কী এক অজ্ঞাত দুর্বোধ্য নেশায় বেসামাল হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠলাম –“ 

“এ নেশা সকলের থাকে না বুড়োদা। এ-নেশা শুধু জাত সাহিত্যিকের–” 

“কিন্তু তার দাম তো আমাকেই দিতেই হল জীবনভর,” ভাঙা ভাঙা স্বরে আর একবার প্রেমাঙ্কুর উচ্চারণ করেন “জীবনভর” দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, “আজও নেশা আমার কাটল না–না-না নেশা হয়তো কেটে গেছে–কিন্তু এখনও রয়ে গেছে নেশার ঘোর। এই অক্ষম পঙ্গুশরীর নিয়ে আর কী আমি করব বলতে পার?” 

“কিছু লিখছেন এখন?” “হাত কাঁপে, চলে না। আর চলবেও না। ‘মহাস্থবির জাতকের’ চতুর্থ খণ্ডের কিছুটা লিখেছি। বোধহয় ওটা আর শেষ করে যেতে পারব না। এখন শুধু জুড়িয়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাবার উল্লাস–তাই না?” মাথা নেড়ে বলি, “না, বয়সের হুমকি চলে অভিনেতা-অভিনেত্রী গায়ক-গায়িকার ওপর–লেখকের ওপর নয়। শেষ নিশ্বাস পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর শেষ সৃষ্টি চলতে পারে।” 

“বাঃ, বেশ কথা বলতে পার তো তুমি,” মোটা বালিশটা এবার চেপে ধরেন প্রেমাঙ্কুর।  হাতের কাছে ছোট টেবিল থেকে কাঁচের গেলাস তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে জল খান, “তবে কি জান? এসব কথা আমিও ভাবতাম ছেলেবেলায় –সেই নেশার ঘোরে,” মনে মনে বোধহয় হিসেব করে তিনি বলেন “তখন আমার বয়স কতো–এই চোদ্দো পনেরো থেকে কুড়ি বাইশ।” 

“তখন তো লেখা শুরু করে দিয়েছেন?” 

“হ্যাঁ। উপায় কী। তাছাড়া অপর কিছু করবার গুণ আমার যে ছিল না, সে কথা তো আগেই বলেছি। কিন্তু লেখা তখন অপাঙক্তেয়। পেট চালানো দূরের কথা, লিখে একটা পয়সাও পেতাম না।” 

“একেবারে কিছু না?” 

“কিছু না। শুধু ‘ভারতবর্ষের সম্পাদক জলধর সেন নিজের বাড়িতে হাত বুলিয়ে আমার গালে চুমু খেয়ে বলতেন, ‘বেশ লিখেছ প্রেমাঙ্কুর, খাসা লিখেছ।” 

“শুধু ‘ভারতবর্ষে’র চুমু। আর কোথাও থেকে ‘কিছু না?” এবার আমার হাত ঝাঁকিয়ে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “কিন্তু তোমাদের দেখতে খুব ভালো লাগে। দিব্যি আছ। এখান থেকে টাকা–ওখান থেকে চেক–এখন আর লেখকদের সেদিন নেই–কি বল?” 

মুখ নামিয়ে বলি, “না বুড়োদা, সত্যি এখনকার লেখকদের আর সেদিন নেই। প্রাণের তাগিদে লিখতে আমরা বোধ হয় ভুলেই গেছি। কিছু পাবেন না জেনেও আপনারা লিখে গেছেন সব তুচ্ছ করে-সাহিত্যের জন্য সব ছাড়তে এখনকার কজন লেখক পারে।” 

হঠাৎ আমাকে যেন ধমক দেন প্রেমাঙ্কুর, “দেখ, তুমি আমাকে প্যাঁচে ফেলে জাত সাহিত্যিক বানাবার চেষ্টা কোরো না। আরে, আমার কিছুই ছিল না তো ছাড়ব কী!” 

আমি হেসে, জিজ্ঞেস করি, “আরে কী করতেন তখন?” “হ্যাঁ, চৌরঙ্গীর এক প্রসিদ্ধ খেলার সরঞ্জামের দোকানে একটা চাকরি পেয়েছিলাম। ফুটবল, ক্রিকেন্টের ব্যাট, ক্যারাম বোর্ড এসবের সাথে বিকেল অবধি বসে থেকে ইঙ্গে ধরে যেত। কিন্তু সেখানেও সময় নষ্ট করিনি ভাই –সাহিত্য রোগ জোর চেপে ধরেছে তো তখন–।” 

“আর কী করতেন সেই দোকানে বসে?” “ফাঁক পেলেই লিখে যেতাম। হুসহুস পাম্প করে ফুটবলের ব্লাডার ফুলিয়ে দেখতাম ঠিক ঠিক আছে কি না–তারপরেই কলম চালাতাম খসখস। একহাতে ক্রিকেটের ব্যাট আর একহাতে সাদা কাগজ। একদিকে ক্যাশমেমো অন্যদিকে কলম। কিন্তু একেবারেই ভালো লাগত না ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুধু স্থূল ক্ষুধা মেটাবার জন্য এই চাকরি করা”- 

ছটফট করতে করতে যেন স্বগতোক্তি করেন প্রেমাঙ্কুর, “মহাস্থবির জাতকে’ এসব কথা লিখেছি আমি।” 

“তখন আপনার কোনো বই বেরিয়েছিল?” “না। বই বেরোয় অনেকদিন পর আমার বয়স তখন প্রায় আঠাশ। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স এর হরিদাসবাবু প্রকাশ করেন ‘বাজীকর’–ছোট গল্পের বই।” 

“গুরুদাসবাবুকে কি আপনি দেখেছিলেন?” 

“হ্যাঁ। কিন্তু তিনি তখন অন্ধ হয়ে দেওঘরে চলে গেছেন।” 

“আর উপন্যাস কবে বেরলো?” 

“একবার গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে কি আর থামে? খুব বেশি না লিখলেও, কিছু কম লিখিনি আমি,” একটু ভেবে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “এই ধর চাষার মেয়ে,’ ‘অচল পথের যাত্রী,’’দুই রাত্রি’ ‘অরুণা,’ আরও অনেক–আর ছেলেদের জন্যে ‘আনারকলি’আর ‘ডানপিটে–“ 

তিনি নিজেই বলে ফেলেন, “লোকে নাম করে ‘মহাস্থবির জাতকের, কিন্তু আমার মনে হয়, ‘অচল পথের যাত্রী’ আমার সবচেয়ে সার্থক রচনা। “ 

“ফিল্মের নির্বাক যুগে আপনার ‘চাষার মেয়ে’ তো ছবিও হয়েছিল। আমরা তখন খুব ছোট–” [ ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩১। প্রকাশক ] ঘাড় নেড়ে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “হ্যাঁ, কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। মাখনলালের অনেক কথাই তো শুনলে না–” লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলি, “হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন, চৌরঙ্গীর খেলার দোকানে–“ 

আমার কথা শেষ হবার আগেই প্রেমাঙ্কুর বলে ওঠেন, “সেই চাকরি–! উঃ বড় যন্ত্রণা ভাই! নিজের মনের সঙ্গে এই প্রতারণার সাংঘাতিক যুদ্ধ অসহ্য। ওদিকে বয়স বাড়ছে–সঙ্গে সঙ্গে, সংসারের অভাবও। চাকরিটা ছাড়তে পারছি না–রেখেও বিশেষ সুবিধা হচ্ছে না। কোনো সাহায্য করতে পারি না সংসারে। যেন অর্থ উপার্জনের কোনো পথই খোলা নেই আমার জন্যে। কলম চালিয়ে যাবার মনের জোরও হঠাৎ যেন কমে যায়।” 

অসহায় প্রেমাঙ্কুর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে। কিন্তু আমি লক্ষ করি, ওঁর মুখ আস্তে আস্তে আবার প্রফুল্ল হয়ে ওঠে, “কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে, চোখের সামনে তখন উদীয়মান সূর্যের মতোই মধ্য গগনে অগ্রসর হয়ে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ। নিন্দা প্রতিবাদ বিরূপ সমালোচনার মধ্য দিয়েও অগ্রজ কবি সাহিত্যিকের যশোরশ্মি ম্লান হয়ে যাচ্ছে–প্রভাত হ্রাস হচ্ছে তাঁর প্রথম কিরণের দারুণ দীপ্তিতে। ঘরে ঘরে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ–রবীন্দ্রনাথ। আমাদের আশা-আশ্বাস নির্ভর।” 

চঞ্চল স্বরে প্রশ্ন করি, “তারপর?” 

“তারপর?” মুখ নামিয়ে প্রেমাঙ্কুর বলেন “দাঁড়াও, সেকথা বলবার আগে একটু দম নিয়ে নি,” যেন রহস্যের ঘ্রাণ ছড়িয়ে ছড়িয়ে নিপুণ শিল্পীর মতো কৌতূহল হল–জারিয়ে জারিয় থেমে থেমে কথা বলেন প্রেমাঙ্কুর, “অভাবের খোঁচায় বিব্রত বিষণ্ণ। অশান্তির আগুন জ্বলছে বুকের মধ্যে সারাদিন ধিক ধিক করে। এত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ার গ্লানিতে নিজেরই কাছেই নিজে ছোট হয়ে থাকি। ভাবনায় ভাবনায় বিমর্ষ হয়ে দোকানে যাই–বাড়ি আসি।” 

‘‘উনিশশ’ তেরো সাল। একদিন বিকেলে একটা খবর শুনে আমি থর থর করে কাঁপতে থাকি–দিশাহারা উল্লাসে, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে চাই–উঃ কী তীব্র নিগূঢ় আনন্দ।” 

এখনও উত্তেজনার দীর্ঘকালস্থায়ী আবেশে বিমূঢ় হয়ে থাকেন প্রেমাঙ্কুর। বেশি কথা বলার ক্লান্তিতে দুর্বল শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া হল কি না বুঝতে পারি না। 

আশঙ্কার পীড়নে তাঁকে ব্যাকুল প্রশ্ন করি, “কী, আপনি কী খবর শুনলেন?” “কবির বিশ্বজয়ের খবর। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এ সংবাদ কী অমৃত পরিবেশন করল আমার মুমূর্ষু মনে, সেকথা আমি তোমায় এতদিন পরে কিছুতেই বোঝাতে পারব না। আমার সমস্ত শরীর-মন একটা বিদেশি বাজনার মতো রিমঝিম করে বেজে উঠল।” 

“সে এক আশ্চর্য উজ্জীবন! মনে হল, পারব-এবার আমিও সব বাধা দুই পায়ে ঠেলে সাহিত্যকে সত্যিই আঁকড়ে ধরতে পারব! জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্তভাবনাহীন।” 

প্রেমাঙ্কুরের কথা শুনতে শুনতে চেয়ারে স্থির হয়ে আমি বসে থাকি। নড়বার ক্ষমতা নেই। অতীতের সূক্ষ্ম অনুরণন আমারও শরীরে রোমাঞ্চ জাগায়। উনিশশ’ তেরো সালের সেই খবরটা আমিও যেন আজ প্রথম শুনি। 

অনেকক্ষণ পর মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করি, “রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ নিশ্চয়ই নিবিড় ছিল?” “ব্রাহ্ম পরিবারের ছেলে–ঠাকুরবাড়িতে যাওয়া আসা অনেকদিনের। তবে আমি চিরকেলে ছন্নছাড়া–অসংযমের গুরু। রবীন্দ্রনাথের খুব কাছে ঘেঁষবার বেশি চেষ্টা করতাম না। এই মাঝে মাঝে উৎসবে অনুষ্ঠানে দেখা হত। আড্ডা ছিল যমুনা অফিসে, ‘যমুনা’র-সম্পাদক ছিলেন ফণীন্দ্র পাল। তাছাড়া আরও অনেক মাসিক পত্রিকা ছিল তখন। মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভারতী’, জলধর সেনের ‘ভারতবর্ষ” রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’। কিন্তু প্রথম প্রথম ওসব বড় বড় পত্রিকার দপ্তরে আমরা পাত্তা পেতাম না। আমাদের আসর বসততা ‘যমুনা’র অফিসে। এদিকে আমার এক বন্ধু সুধাকৃষ্ণ বাগচীকে সম্পাদকের [সম্পাদক করে ] ‘জাহ্নবী’ নামে আমরাও এক পত্রিকা বের করেছিলাম। 

-”সেটা কতদিন চলেছিল?” 

“খুব অল্পদিন। ওই সুধাকেষ্টর জন্যই কাগজটা ডুবল। কোন দায়িত্বজ্ঞান ছিল না। ধার-দেনায় ডুবে ‘জাহ্নবী’ গেল। “ 

“আপনাদের মধ্যে আর কে কে ছিলেন?” “প্রভাত গঙ্গোপাধ্যায়। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের তখন নাম, হেমেন্দ্র আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল–আমি তার কাছ থেকে সাহিত্য সম্পর্কে অনেক উপদেশ পেয়েছি। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ও আমার জন্য অনেক করেছেন। আর একজন–’ 

বিনীত শ্রদ্ধার ভারে চোখ দুটো বুজে আসে প্রেমাঙ্কুরের, “পণ্ডিত অমূল্য বিদ্যাভূষণের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে–” 

“তিনি ছিলেন মেট্রোপলিটান-এর-পালির প্রফেসার। কিন্তু সেটা তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। অসীম জ্ঞান তাঁর–অসামান্য পাণ্ডিত্য। তিনি যা করেছেন আমার জন্য!’ 

শান্ত স্বরে আস্তে আস্তে প্রেমাঙ্কুর বলে চলেন, “রোজ সন্ধ্যায় আমি তাঁর কাছে যেতাম। মস্ত লাইব্রেরি তাঁর। কতরকমের বই! যে লেখাপড়া শৈশবে আমার কাছে ভীতির ব্যাপার ছিল পণ্ডিত অমূল্য বিদ্যাভূষণের সঙ্গ পেয়ে তার এক নতুন স্বাদ আমি পেলাম।” 

“তখনও কি চৌরঙ্গীর দোকানে আপনি চাকরি করে যাচ্ছেন?” 

প্রেমাঙ্কুর হাসলেন, “সে চাকরি আমি করেছি পুরো ছ’বছর–১৯১১ থেকে ১৯১৭ সাল অবধি। তারপর হলাম সাংবাদিক। ললিতমোহন গুপ্তর হিন্দুস্থান দৈনিকে চল্লিশ টাকা মাইনের চাকরি।” “ভারত ফটোটাইপের ললিতমোহন গুপ্ত?” “না–না, ইনি আর একজন। কিন্তু সে চল্লিশ টাকাও আমি মাসে মাসে ঠিকমতো পেতাম না ভাই। কখনও পাঁচ–কখনও দশ, এক মাসের পুরো মাইনে আদায় করতে প্রাণ বেরিয়ে যেত। এর মধ্যে বিয়ে হয়েছে আমার–” অনুযোগ-অভিযোগ আর অনুতাপ মিশে অদ্ভুত করুণ শোনায় প্রেমাঙ্কুরের কণ্ঠস্বর,– 

“বিয়ে কিন্তু আমি করতে চাইনি। চাল নেই। চুলো নেই। শুধু অভাব। তার মধ্যে আর একজন ভদ্রলোকের মেয়েকে এনে শুধু শুধু কষ্ট কেন দেব সেটুকু মমত্ববোধ আমার বরাবরই ছিল–”

“তারপর”? 

“কিন্তু বন্ধুরা বোঝাল-জোর করল। বলল জীবনে উন্নতি করতে হলে সংসার চাই। এমন একা একা চললে তুমি শেষ হয়ে যাবে। আর অভাব? একজনের যখন চলছে তখন দুজনেরও ঠিক চলে যাবে। সুতরাং বিবাহ” প্রেমাঙ্কুর হেসে বলেন, “কিন্তু একজন ভদ্রলোকের মেয়ে নতুন সংসারে ঢুকে প্রথম থেকেই অভাবের ঝাঁপটা সহ্য করবে কেন–কেন দারিদ্র্যের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হবে সারাদিন সারা রাত –“ 

ওপরে তাকিয়ে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “পাশের ঘরে বসে যখন লেখায় মন দেবার চেষ্টা করতাম তখন কানে আসত তীক্ষ্ণ ক্ষিপ্ত গলার স্বর “ছাইপাঁশ করে উনি সময় নষ্ট করছেন। একটা পয়সা যে নেই সংসারে কে রাখে, সে খবর। সব দায় যেন আমার। ব্যস ওই শুনেই খাতা কলম বন্ধ করে চুপেচাপ পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে গুটি গুটি বাড়ি থেকে সরে পড়তাম।” 

আমি আস্তে জিজ্ঞেস করি, “বৌদি আছেন নাকি এখন বাড়িতে?” 

অবাক হয়ে হঠাৎ উদাস প্রেমাঙ্কুর তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে। একটু পরে যেন ফিসফিস করে বলেন, “১৯৪৩ সালে তিনি মারা গেছেন–” 

আমার অপ্রস্তুত অবস্থা লক্ষ না করেই তিনি বলে চলেন, “কিন্তু শেষের দিকে আমি বোধহয় তাঁকে সুখী করতে পেরেছিলাম। আমি তখন পঁচিশ টাকা মাইনের ফিল্ম ডিরেক্টর।” আমি বসে থাকি চুপচাপ। ঘরে জ্বলছে জোরালো আলোর বাল্ব। বাইরে ঘন হয়েছে গ্রীষ্মের অন্ধকার। মাঝে মাঝে শুনি গাড়ির হর্ন, রিক্সার ঠুং ঠুং, লালু ভুলুর ডাক। এক চঞ্চল কিশোর মাঝে মাঝে ঘরে আসে আর যায়। তার হাতে একটা ঝকঝকে অটোগ্রাফের খাতা। কিন্তু সে বোধহয় হঠাৎ বুঝতে পারে না তার খাতায় সই করার যোগ্যতা আমার আছে কি না। আর আমার সামনে প্রেমাঙ্কুরকে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত করে। তাকে কাছে ডাকেন প্রেমাঙ্কুর, “আমার নাতি শোভন–” আমাকে দেখিয়ে বলেন, “জানিস এ কে?” 

শোভন ফস করে বলে ফেলে “ডিরেক্টর–?” জোরে হেসে ওঠেন প্রেমাঙ্কুর, “শুনলে? কোনো লেখক যে এখনও আমার কাছে আসতে পারে সে কথা এরা ভাবতেই পারে না–না– 

চঞ্চল কিশোর শোভন লজ্জা পেয়ে সেই অটোগ্রাফের খাতা তাড়াতাড়ি আমার হাতে তুলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় আর আসে না সে ঘরে। 

“এদের আর দোষ কি” আপন মনেই যেন অভিমানের গুঞ্জন তোলেন প্রেমাঙ্কুর, “সাধ করে কি আর ফিলিমে গেছি। বড় কষ্ট পেয়েছি আর দারিদ্র্য। বড় অশান্তি! বড় যন্ত্রণা! আমি তো সাহিত্য সম্বল করেই থাকতে চেয়েছিলাম সারাজীবন! কিন্তু পারলাম কই; ইচ্ছার বিরুদ্ধে আজে বাজে কতরকম কাজ যে করতে হয়েছে–“ 

অন্যদিকে তাকিয়ে কপালের ঘাম মোছবার জন্যে খাটের ওপরে রুমাল খুঁজতে খুঁজতে ক্ষীণস্বরে তিনি বলেন, “এত পত্রিকা তখন ছিল না–অলিতে গলিতে এত প্রকাশকও নয়। আর, যে দু-চারজন প্রকাশক ছিল, কী তাঁদের দাপট!–দাঁড়ান এনেছেন খাতা? রেখে যান। এক বছর পরে খবর নেবেন।’ লেখকরা যেন চোর।” 

অল্প পরে, আবার স্তিমিত স্বর বার হয় প্রেমাঙ্কুরের গলা দিয়ে, “কিন্তু খ্যাতির মোহে এসব আমি গায়ে মাখতাম না। কেন না তখন–সেই প্রতিকূল অবস্থাতেও একটা বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে ফেরে আমার সব অপমান, অপকীর্তি, অক্ষমতা–আমার সব অভাব আর গ্লানি ম্লান হয়ে যাবে–একেবারে মুছে যাবে, একমাত্র পরিচয়ের ছটায়—আমি সাহিত্যিক।” 

“তাই পণ্ডিত অমূল্য বিদ্যাভূষণের বাড়ি আর ‘যমুনা’ অফিস ছিল আমার তীর্থক্ষেত্র–উজ্জীবনের পীঠস্থান। এই দুই জায়গায় যতক্ষণ থাকতাম ততক্ষণ কোনো প্রতিকূল অস্থির মুহূর্ত যেন নামতেই পারত না পৃথিবীতে। আমি তৈরি করে নিতে পারতাম আমার একার–আমার নিজের এক অবিচল নিষ্ঠার জগৎ। যমুনার অফিসেই আমি শরৎচন্দ্রকে প্রথম দেখি–।” এতক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম অতীত ঐশ্বর্যের নিখুঁত বর্ণনায় এবার শরৎচন্দ্রের নাম শুনে কৌতূহলের চমকে প্রশ্ন করি, “তখনই শরৎচন্দ্র কি অপরাজেয় কথাশিল্পী?” 

“না, কিন্তু তিনি যে শিগিরেই আশে-পাশের সকলকে ছাড়িয়ে যাবেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে “রামের সুমতি’ গল্পে। ওটা ‘যমুনা’য় বেরিয়েছিল।” 

“শরৎচন্দ্র তখন কোথায় থাকতেন? বর্মায় না কলকাতায়?” “বর্মায়। মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতেন। সেদিন ‘যমুনা’ অফিসে তিনি এসেছিলেন সঙ্গে এক মোটা-সোটা কুকুর নিয়ে। সম্পাদক ফণীন্দ্র পাল আমাকে বলল ‘এঁকে চেন? ইনিই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’। আমরা দুজনে দুজনকে দেখলাম।” 

“তুমি যেমন আমাকে কুকুরের কথা জিজ্ঞেস করলে, আমিও তেমনি প্রথম দিনই রসিকতা করেছিলাম শরৎচন্দ্রের সঙ্গে। তাঁর কুকুরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলাম, শরৎদা, এটা কী?’ গম্ভীর স্বরে শরৎচন্দ্র উত্তর দিয়েছিলেন ‘রোগো হাউন্ড।’ একটু পরেই স্বর খাদে নামিয়ে বলেছিলেন, ‘বর্মার নেড়ি কুকুর। সম্পাদক প্রকাশকের কাছে এমন একটা জীব নিয়ে আসা দরকার প্রেমাঙ্কুর’। তাঁর সহজ অন্তরঙ্গতায় মুগ্ধ হয়ে আমি বলেছিলাম, “ঠিক-ঠিক।” 

বোধ হয় বলবেন-কি-বলবেন-না ঠিক করতে না পেরে কিছুক্ষণ ইতস্তত করেন প্রেমাঙ্কুর। তারপর স্বাভাবিক আবেগে বলেই ফেলেন, “আমার পুরো নামটা শরৎচন্দ্র উচ্চারণ করলেন, ‘প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। অনন্যসাধারণ নাম। দেখো হে প্রেমাঙ্কুর, নামের মর্যাদা রেখো’। 

“আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমার কোনো লেখা আপনি পড়েছেন’?” 

“শরৎচন্দ্র আমাকে দেখে বলেছিলেন, ‘তোমার সব লেখা আমি পড়েছি। তোমার হবে’!” এতটা বলে বালিশটা কোল থেকে নামিয়ে শুয়ে পড়েন প্রেমাঙ্কুর। কিছুক্ষণ পর আবার জোরে জোরে কথা বলেন, “আমার মনের সবচেয়ে সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে একটা নাড়া দিয়ে বেরিয়ে গেলেন শরৎচন্দ্র। তিনি চলে গেলেন কিন্তু আমি বসে রইলাম ‘যমুনা’ অফিসে অনেকক্ষণ।” 

“আমার হবে। কেমন করে হবে–সে কথা ভাবতে-ভাবতেই ভোর হয়ে গেল সারারাত। হল না। অবস্থা রইল যেমনকার তেমন। কিছুই হল না আমার।” 

আবার শুরু। কাহিনি শোনাবার অদম্য আগ্রহে খাটের ওপর প্রেমাঙ্কুর উঠে বসেন, “এবার আর এক গল্প শোনো। আবার আমি মেতে উঠি; ভাবি, ভাগ্যের চাকা বুঝি ঘুরবে এবার। শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল গভীর। হঠাৎ তার খেয়াল হল, এক ফিলিম কোম্পানি খুলবে। আর আমি স্ক্রীপ্ট লেখার কাজে তাকে সাহায্য করব।” 

“যাক, এবার তাহলে আমার সাহিত্য খ্যাতি কাজে লাগবে-আমি দুপয়সা পাব—”

“কী নাম ছিল সে কোম্পানির?“ 

“তাজমহল কোং। কিন্তু কোথায় কী! দুদিন হই-চই করে সব জুড়িয়ে গেল। আবার যে-কে সেই।” 

“কিন্তু ভালো করে ছায়াচিত্র জগতে আপনি নাম লেখালেন কবে?” 

“দাঁড়াও হে”, হাসিমুখে আমাকেও খোঁচা দেন প্রেমাঙ্কুর, “সেই থেকে তুমি দেখছি ফিলিম ফিলিম করে আমার মাথা খাচ্ছ, আর কিছু শুনবে না?” 

আমিও হেসে চোখ নামাই “বলুন–বলুন।” বোধহয় আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই এবার প্রেমাঙ্কুর বলেন “শিশিরকুমার তো আমার মাথায় ফিলিম ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। এখানে ওখানে আজে বাজে চাকরি করে যা পেতাম, সেই নির্বাক যুগেও ফিলিম থেকে পাওয়া যেত তার চেয়ে অনেক বেশি। ম্যাডান কোম্পানির অভিনেত্রী পেসেন্স কুপার তখনকার দিনেও মাসে মাসে মাইনে পেত বারশ টাকা– 

আমি টেনে টেনে উচ্চারণ করি, “বারশ!” “হ্যাঁ। তখনকার বারশ মানে অনেক টাকা।”

–”তা তো বটেই”, আমি প্রশ্ন করি “আচ্ছা তখন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েদের ছবিতে নামানো হত কেন? বাঙালি অভিনেত্রী কি ছিল না?”

“হয় তো ছিল কিন্তু ফিলিমে নামার হুজুগ তো একালের মতো ছিল না। ভালো চেহারা বের করতে হলে ওইসব পাড়ায় গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করতে হত। তার চেয়ে হাতের কাছে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে তো অনেক ভালো–জোর সেক্স অ্যাপীল–” 

“তা বটে।” 

“পেসেন্স কুপার সীতা দেবী-মিস হিসোলাইট–এরা সবাই মোটা মাইনে পেত। কথা বলার দরকার তো হত না–তখন শুধু চেহারা দেখিয়ে এরা দিব্যি চালিয়ে নিত। আমি এদের সকলকেই চিনতাম। এমন কি, কিছুদিনের জন্যে সীতা দেবীর পাবলিসিটি অফিসারও ছিলাম–” 

উৎসুখ চোখে জিজ্ঞেস করি, “কী রকম?” প্রেমাঙ্কুর রসিকতা করে বলেন, “এবার জমে গেছে না? এদিকে আমার জীবনও বেশ জমজমাট তখন, কিছু কিছু ভালো লোক ফিলিম থিয়েটার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। হিমাংশু রায় তুলল শিকার। আর নিরঞ্জন পাল এক থিয়েটার পার্টি খুলে সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়াচ্ছে। আমি সেই থিয়েটারের পাবলিসিটি অফিসার। দেড় শ টাকা মাইনে। নায়িকা ওই সীতা দেবী–” 

“ঠিক মতো মাইনে পেতেন?” 

“হ্যাঁ, পেতাম। কিন্তু কদিনই বা! থিয়েটার চলল না! বন্ধ হয়ে গেল। তবুও তখন ও লাইনের অনেকের সঙ্গে আমার দহরম মহরম। [? ] সাহেবের, একটা কোম্পানি ‘আনারকলি’ তুলছিল। আপিস লাহোরে। স্যুটিং হয় দিল্লিতে। ওই দেড়শ টাকা মাইনেতেই আমি হলাম ‘আনারকলির কন্টিনিয়্যুটি ম্যান–” 

“চিত্রজগৎ আপনার কেমন লাগত?” 

“খুব ভালো। দামি পোশাক পরা ছেলের দল রং মাখা ভালো ভালো মেয়ে! দুঃখ দারিদ্র্য অভাব ধারে কাছে নেই” হাত নেড়ে একটা ভঙ্গি করে প্রেমাঙ্কুর বলেন “কাজেই চালাও –কিন্তু তোমার বৌদি প্রথম প্রথম বড় গোলমাল করতেন– 

“কি বলতেন?” 

“বলতেন আজে বাজে মেয়ে মানুষের মধ্যে এ কী কাজ জোটালে তুমি?” 

আমি তাকে বোঝাতাম, “আমি হলাম কন্টিনিয়্যুটিম্যান–ওসব মেয়েমানুষের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই –“ 

এখন বোধ হয় স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায় প্রেমাঙ্কুরের। এদিক ওদিক ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে নিয়ে তিনি ফিসফিস করে বলেন, “ঘরের আর বাইরের; কন্টিনিয়্যুটি বজায় রাখতে গিয়ে মাঝে মাঝে হিমসিম খেতে হত–খুব মুশকিলে পড়ে যেতাম।” 

“লেখা কেমন চলত তখন?” 

“খুব কম। কিন্তু মাঝে ভয়ানক মন খারাপ হয়ে যেত। করুণ একটা সুর বাজত মনের মধ্যে। কে যেন ডাকত; ফিরে আয়–ফিরে আয়। কিন্তু ফিরে যাব কোথায়? ফিরে যাব কার কাছে? সেই অভাব দারিদ্র্যের মধ্যে?” 

“ফিলিমে গিয়ে অভাব কি ঘুচেছিল আপনার?” “না। চাকরি তো পাকা নয়। এক একটা ছবি শেষ হয়–আমারও চাকরি–কিন্তু টাকা রোজগার করবার ক্ষমতা যে আমারও যে আছে সে কথা বুঝেছি যেন–” কী ভাবতে ভাবতে প্রেমাঙ্কুর বলেন “উনিশ-শ বিশ থেকে তিরিশ অবধি বোধহয় আমার সব চেয়ে খারাপ সময়। এই চাকরি, এই বেকার, এই রাজা–এই ফকির। কিন্তু টাকার স্বাদ পেয়েছি তখন–এই লোভেও অনেক ব্যবসাও করেছি- 

“ব্যবসা? কিসের ব্যবসা?” 

প্রেমাঙ্কুর হাসতে থাকেন, “জুতোর। ঘিয়ের। সিগ্রেটের। এখান-ওখান থেকে টাকা জোগাড় করে সব ঢেলেছি ব্যবসায়। কিন্তু সব টাকা জলে গেছে। শুধুই লোকসান–” 

“তাহলে ফিলিমের কাজ নিয়ে আর কী লাভ হল?” 

“লাভ হল পরে। দেওঘরে একটা বাড়িও করেছিলাম। সেটা অবশ্য বিক্রি করে দিয়েছি পনেরো হাজার টাকায়–” আর একটু জল খেয়ে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “নিউ থিয়েটার্সের বি এন সরকারের মতো ব্যক্তিত্ব আমি খুব কম দেখেছি। তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট কিন্তু গভীর তাঁর দায়িত্ব জ্ঞান। এই সেদিন অবধি–মানে যতদিন কাজ করতে পারতাম ততদিন তার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ছিল।” 

আস্তে বললাম, “আমিও তাঁকে চিনি।” 

জলের গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে প্রেমাঙ্কুর বলে চলেন “চারু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘চোর-কাঁটা’ করল চারু রায়, আর প্রফুল্ল রায় তুলল, আমার লেখা ‘চাষার মেয়ে’–আমি কিন্তু তখনও সেই কন্টিন্যুয়িটি ম্যান।” প্রেমাঙ্কুর হাসলেন, “এইবার সবচেয়ে করুণ ব্যাপার।” তাঁর ভঙ্গি দেখে ত্রস্ত হয়ে বলি “কী?” 

রসিয়ে রসিয়ে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “বি এন সরকার ছবির জন্যে আমাকে একটা নতুন গল্প লিখতে বলেন–শুধু গল্প নয়, সিনারিও-টিও সব। ব্যস, তখন আর আমাকে পায় কে? সারাদিন খেটে রাত জেগে খাড়া করলাম এক গল্প। বি এন সরকার খুব খুশি। ও গল্পে নাকি বাজি মাৎ হয়ে যাবে। সব ঠিক। দু-একদিনের মধ্যেই সুটিং আরম্ভ হবে।” আবার খাটের ওপর ভেঙে পড়েন প্রেমাঙ্কুর। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ওপরে। 

কৌতূহল দমন করতে না পেরে ব্যস্ত হয়ে আমি জিজ্ঞেস করি, “কী শুনলেন বলুন?” “শুনলাম না ভাই–দেখলাম। টকী এসে গেছে। ছবি কথা বলে। ম্যাডান কোম্পানি ছাড়ল প্রথম বাংলা টকী। [ জামাই ষষ্ঠী। ১৯৩১-এ মুক্তি পায়। প্রকাশক ] কি করুণ! আর নির্বাক ছবির জন্য লেখা আমার গল্প, চিত্রনাট্য সব মাঠে মারা গেল–সবই পণ্ডশ্রম।” 

“তারপর?” 

“তারপর আর কি, আমরাও টকী তুললাম। শরৎচন্দ্রের ‘দেনাপাওনা’। আমি ডিরেক্টর। পাঁচশ টাকা মাইনে।” 

“আপনি কি বরাবরই নিউ থিয়েটার্সে ছিলেন?” 

“না, বম্বেতেও ছিলাম। সেখানে তুলি ‘সরলা’, ভারত কী বেটী’। কোলকাতার ভারতলক্ষ্মী ফিল্মস-এও আমি ছিলাম অনেক দিন। তবে সবচেয়ে বেশিদিন নিউ থিয়েটার্সেই ছিলাম। “ইহুদী কী লেড়কী,” ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দিকশূল,’ ‘সুধার প্রেম’–এসবের ডিরেক্টর আমি। কিন্তু এই নিউ থিয়েটার্সের স্টুডিওতেই, একদিন একটা সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যায়- 

“কী?” “সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে জোর আড্ডা দিচ্ছি–ফিলিমের সব কেষ্ট বিষ্টুরাও রয়েছে। এমন সময় গাড়ি চড়ে হঠাৎ সেখানে শরৎচন্দ্র এসে হাজির। আমরা তো তাঁকে দেখে অবাক। সকলের সামনে আমাকে যা তা বললেন শরৎচন্দ্র। আরে ভাই, আমার ফিলিমের চাকরি বুঝি যায়- 

“কী বললেন?” 

“আমার সাঙ্গপাঙ্গদের হাত দিয়ে দেখিয়ে রূঢ়স্বরে শরৎচন্দ্র বললেন, ‘ছি ছি প্রেমাঙ্কুর, এদের সঙ্গে বসে তুমি সব নষ্ট করলে। তোমার ওপর আমার আশা ছিল–ভরসা ছিল। কিন্তু একী করলে –এ তুমি কী করলে প্রেমাঙ্কুর।’”

সোজা হয়ে বসে বলি, “আপনি কী বললেন?”

“আঁতে ঘা দিয়েছেন শরৎচন্দ্র। প্রথমটায় গুম হয়েছিলাম। কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু একটু পরে আমারও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে, তাঁর মুখের ওপর বললাম, শরৎদা, কী দিয়েছে আমাকে সাহিত্য বলতে পারেন? লাঞ্ছনা গঞ্জনা অপমান আর দারিদ্র্য ছাড়া আর কী আমাকে এতদিন দিয়েছে আপনার সাহিত্য?” 

শরৎচন্দ্র আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “কিন্তু আমাকে তো দিয়েছে। আমি যতটুকু পাব আশা করেছিলাম, ভগবান তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছেন আমাকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি তোমাকেও দিতেন। কিন্তু তাঁর সে দান তুমি গ্রহণ করলে না প্রেমাঙ্কুর।” 

উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে প্রেমাঙ্কুর বলেন “শরৎচন্দ্র চলে গেলেন। আড্ডা আর জমল না। ভারি মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। তাঁর কথাগুলো বিষাক্ত তিরের মতো মনে বিঁধে আছে। তারই ফসল ‘মহাস্থবির জাতক’। আমার শেষ বই। যা কিছু দেখেছি জীবনে, যতই দিয়েছি পেয়েছি হারিয়েছি–লেখার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বুঝতে পারিনি তার এক কণাও নষ্ট হয়নি। আমার অবচেতনের মণিকোঠায় সেই কবে থেকে জমা হয়ে আছে এ বই-এর রসদ!” 

“থামলেন কেন বুড়োদা? তারপর?” 

“আর কিছু নেই। সব কথা বলে ফেললাম তোমায়। যা বলতে চাইনি, তা-ও বলে ফেললাম”–আমার হাত ধরে তিনি মিনতি করেন, “সব কথা যেন লিখ না ভাই! অনেক এডিট করে নিও।” 

হেসে বলি “নেব।” 

“কিন্তু কী হল শেষ অবধি! কিছুই না। না সাহিত্য, না ফিলিম–কিছুই তো করতে পারলাম না”–”সাহিত্য কিছু না করতে পারলে আমি কেন এসে এতক্ষণ বকিয়ে যাব আপনাকে?” একটা হাত বাড়িয়ে খাট চেপে ধরে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “ভালো করে সাহিত্য করবার সময় পেলাম কখন?” 

উঠে দাঁড়িয়ে জোর গলায় তাঁকে বলি “কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধে নানা দপ্তরে আপনার বছরের পর বছর অপচয়ের ছেঁড়া-ছেঁড়া পাতা কত অল্প সময়ে সুপ্ত করে দিল এক ‘মহাস্থবির জাতক’। বুড়োদা আপনি [ যা ] চেয়েছিলেন তাই হয়েছে। আজ আপনার একমাত্র পরিচয় আপনি সাহিত্যিক।” 

উজ্জ্বল মুখে প্রেমাঙ্কুর বলেন, “ঠিক বলছ? 

মাথা হেলিয়ে বলি “হ্যাঁ।” 

একসঙ্গে আরও অনেকের উদাহরণ তাঁকে দিতে চেয়েছিলাম—শিল্পী লিওনার্দ দ্য-ভিঞ্চির কি আর অসংখ্য পরিচয় ছিল না? মাইকেল কি শুধুই কবি ছিলেন? আর রবীন্দ্রনাথ? আর কিছুই কি জীবনে করেননি প্রমথ চৌধুরী? তাঁর কালের শ্রেষ্ঠ আইনজীবী অতুলচন্দ্র গুপ্তর বৃহত্তর পরিচয় কি রবীন্দ্রোত্তর যুগের সার্থক প্রবন্ধকার নয়? 

আর আমাদের প্রেমেন্দ্র মিত্র কি জীবনের প্রথম থেকেই শুধু সাহিত্যের ওপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত থাকতে পেরেছিলেন? 

কিন্তু বলা হল না আর কিছুই। আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক সময় নিঃশব্দে নীচে নেমে এলাম। 

কথা দিয়ে এসেছিলাম রেখে-ঢেকে লিখব। কিন্তু তা পারলাম কই! যত কথা বলে গিয়েছিলেন–জানলাম তার চেয়ে অনেক বেশি। যত দেখব ভেবেছিলাম–প্রেমাঙ্কুরের অপূর্ব ভাষণ দেখাল তার চতুর্গুণ। যে অদৃশ্য যোগসূত্রে বাঁধা পড়ে আছে অতীত ও বর্তমানের অসংখ্য জাত-শিল্পী, সাহিত্যিক, কথা দিয়ে এসেছি বলেই, লৌকিকতার অধিক ভীতিতে তা ছিন্ন করার অতি নাটকীয় অসাধ্য সাধন আমার পক্ষে অসম্ভব। 

আমি কথা রাখতে পারলাম না প্রেমাঙ্কুরের। 

১২ই জুন ১৯৬২ 

কলকাতা 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *