পূর্বক্ষণ – ননী ভৌমিক
দরজাটা ভোলা আছে। আমি যেখারে বসে আছি সেখান থেকে চোখে পড়ে না। কিন্তু জানি ভোলা আছে। খোলা দরজা দিয়ে আমি এসেছি। দরজা খুলে দিয়ে ও আস্তে করে বলেছে :
শোনো!
বলো। আস্তে করে বলি আমি। তারপর চুপ করে থাকি আমরা। ও কি একটা বলতে চেয়েছে, কি একটা শুনতে। আমি কি একটা শুনতে চেয়েছি, কি একটা বলতে। কিন্তু কিছু না বলে একটুখানি চুপ করে থাকি আমরা। চুপ করে একালের মন একখানা ঘরে।
ও জানে আমাকে। আমি জানি ওকে। নানা পথ ঘুরে আমি এসেছি। নানা লোক, নানা কাজ, নানা হিসেব। নানা পথ ঘুরে ও এসেছে। নানা লোক, নানা মোড়, নানা দায়। একটা জগৎ আছে বাইরে। সেই বাইরের রাস্তায় ও একদিন আমার মুখের দিকে চেয়ে থামলো একটু। ও রূপসী নয়। আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে থামলাম। আমি বীর নই। আর আমি জানি ও অনেক সয়েছে। ও জানে আমি অনেক দেখেছি। তারপর দরজা খোলা রেখে একটু বসি আমরা। আমরা একালের একটা ঘরে।
একটু ইতস্তত করেছে ও। আর কিছু বলেনি। সমস্ত ঘরখানা ভরে উঠেছে না বলায়, চুপ করায়। সমস্ত ঘরে না বলা না-শোনা মিড়ের একটা গুন গুন। দুর্বাঘাসের কানে ফল্গুন হাওয়ার একটা বেহালা। ও রূপসী নয়। তবু ওকে চোখ মেলে দেখতে চাই আমি। তাকাই। ও কি করছে দেখি, নাকি আমার কি হচ্ছে শুনি। ও রূপসী নয়, কিন্তু সহসা মনে হয় আমার, ও অপরূপ। কি একটা বলতে চাইছিলো ও, না বলে চুপ করে আছে। আমি কিছু একটা বলতে চাই। আমি জানাতে চাই ও সুন্দর। ও জানে না ও কী আশ্চর্য সুন্দর। তাই ও যখন চুপ করে আছে, তখন আমি আস্তে করে বলি : শোনো!
আর তখন ঘরের মধ্যে একটা ভ্রমর আসে গুনগুনিয়ে। কী মায়া লাগলো চোখে। আহা, মায়া লাগুক, মোহ। সুর লাগুক ততোখানি, যতোখানি ও নিজে সুন্দর। ও রূপসী নয় ব অপরূপ এই কথা জানাতে চেয়েছি আমি। ও শোভা নয়, সুরভি। আস্তে করে বলেছিঃ শোনো! কি বলছি সেটা কিছু নয়, কি সুর লাগছে।
আর অপেক্ষা করি আমি নিজে। কান পাতি নিজের গলার স্বর শোনার জন্যে। চমকে উঠি : যা শোনাতে চাই তা শুনছি না। একটা ভ্রমর এসেছে ঘরে। না, ভ্রমর না মাছি। না, মাছি না, কিছু না। কিছুই না।
কিছুই না, কোন কথাই আর বলি না আমি। কোন কথা না বলে ও চুপ করে আছে অন্যদিকে চেয়ে। আমি জানি এই চুপ করাটা বানানো। ও জানে না ও সেটাকে বানিয়েছে কিনা। আমি জানি না আমি সেটা বানিয়ে তুলতে চাই কিনা।
তবু আমি জানি এর মানে কি। এ শুধু মোহ। এ শুধু বানানো। আমরা যা নই, তাই আমরা বানাতে চাই নিজেদের। এ শুধু ছায়া। একালের ম্লান এই ঘরখানায় আমাদের বানিয়ে নেওয়া ছায়ার আলপনা। আর সব জানা।
জানা।
একদা জানা ছিলো না অনেক। জানা ছিলো না কিসের পর কি। কিসের মধ্যে কি। তাই সৃষ্টি হয়েছে বৃহৎ ট্রাজেডি, মহৎ মাধুর্য। পৃথিবীতে রূপসী নেমে এসেছে। জেগেছে বীর। আবেগ বেজেছে সপ্তমে। আমাদের সপ্তম নেই, এ শুধু এক মামুলী সপ্তক। একক নয়, মিশেল। আর মামুলী। আর জানা কিসের মধ্যে কি, কিসের পর কি। ওকে জানি আমি। ও আমাকে।
ও জানা। আমি জানি নানা পথ ঘুরে এসেছে ও। নানা লোক, নানা মোড়, নানা দায়। বাইরের একটা অস্থির জঙ্গমতা বিপুল চিৎকার তুলে যান্ত্রিক বাধ্যতায় বেগার খেটে চলেছে দিনরাত। সেই বাইরের রাস্তায় ওর সঙ্গে আমার দেখা। সেই জঙ্গম জগৎটার একটা অংশ আমারও একটা টুকরোই। আমাদের জায়গা কোথায় তা জানা। কোন মেশিনের সামনে দিনে ক-ঘণ্টা করে দিতে হবে জানি! কি করে বদলাতে হবে, কি করে অপেক্ষা করতে হবে। আর তাই নানা লোক, নানা দায়, নানা মোড় পেরিয়ে চলেছে ও। আমি। বিনা উত্তেজনায়, বিনা রোমাঞ্চে। তাই ভিড়ের মধ্যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় ও। রুজি রোজগারের মেহনত করার পর দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করে। কখনো সিনেমায় যায় কখনো মিছিলে। কাউকে দেখে হাসে, কারো সঙ্গে দুটো মিষ্টি কথা বলে, কারো জন্যে প্রতীক্ষা করে হঠাৎ। যা সত্যি নয় তাই বলতে চায়। যা বলে তা সত্যি হয় না। কাউকে ঠকায়, কাউকে ফেরায়, কাউকে ভুল বোঝায়। তারপর রুজি রোজগারের জন্যে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যায় আবার। আর জীর্ণ হয়, আর জীর্ণ হয়, জীর্ণ। একটা নির্ভুল জঙ্গমতা বদলে যাবার আগে জীর্ণ করে চলেছে দিনরাত। বাইরের সেই রাস্তায় ও চোখ তুলে তাকিয়েছে আমার দিকে। আমি বলেছি, শোনো!
তারপরেই অনুভত্ব করেছি এটা কি। মায়া নয়, মতিভ্রম নয়, ও শুধু অনুকম্পা। হ্যাঁ, অনুকম্পা। চোখ মেলে ওকে দেখি। একালের ম্লান একটি ঘরে ক্লান্ত একটি মেয়ে। অন্য দিকে তাকিয়ে আছে ও। ওর সারা চেহারায় রূপ নয় ক্ষয়। শোভা নয় শ্রান্তি। ওর গালের ওপর অসহ্য ম্লান নীল একটা শিরা ফুটে উঠেছে। ওর গ্রীবার ভঙ্গি পাখির মতো ভীরু। কাউকে ঠকিয়েছে ও, কাউকে ভুল বুঝিয়েছে। আর সব মিলিয়ে ও অনেক সয়েছে, অনেক। বাইরেটা অনেক বড়ো, আমরা অনেক ছোটো, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আগে আমাদের এক মুহূর্তের আত্মরক্ষা করুণায়। আমাদের শুরু ও শেষ করুণায়। ও অনেক সয়েছে।
আর অসহ্য লাগে ওর গালের ওপরকার ম্লান শিরাটা। আমি জানি আমি কি চাইছি। ওকে করুণা করতে চাই আমি, আর কিছু নয়। ও অনেক সয়েছে অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমাদের জীবন কষ্টের। কাউকে ঠকিয়েছি, কাউকে ফিরিয়েছি, আর সব মিলিয়ে অনেক সয়েছি আমিও। নিজের জন্য করুণা চাই আমি। তাই করুণা করি। ওকে। যা বলতে চাইছিলাম তা বানানো। তাই অন্য একটা সুর আনতে চাই গলায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তাই আবার বলি, শোনো।
চোখ না ফিরিয়েই ও বলে, বলো।
আর ঘরের মধ্যে গুনগুনিয়ে ওঠে একটা সুর। সুরটা করুণার। ও কিছুই বলেনি, শুধু বলেছে, বলো। আর ছলছল করে উঠেছে একটা সুর। ও করুণা করে আমাকে। আমি অনেক সয়েছি, আমরা অনেক সয়েছি। বাইরের নিষ্করুণ জঙ্গমতা থেকে এক একটা মুহূর্ত আমাদের চাই। করুণায় ভেজা। করুণায় বাঁচা। মৃদু, শান্ত, ম্লান। করুণা নিয়ে আমি ওর দিকে তাকাই চোখ মেলে। ওর দেহের দিকে। একটা স্লান ছায়া পড়েছে ওর শরীরে। গ্রীবার ভঙ্গিতে একটা কারুণ্য। কপালের ঢালুতে চূর্ণ অলক। শাড়ি ব্লাউজ। একটু বেঁকে বসেছে ও, আমার দিকে না তাকিয়ে। একটা বাহু নেমে এসেছে বেঁকে। স্নান আভার গুড়ো লেপে আলো-আলো হয়ে উঠেছে হাতের রোয়াগুলো। শাড়ি ব্লাউজ। ওর একপাশের বুকখানা দেখতে পাচ্ছি আমি। ব্লাউজে ঢাকা ব্লাউজে বাঁকা। ভরা। নিশ্বাগ্রে তালে তালে একটু উঠছে, নামছে, উঠছে। একটা সেপটিপিনের মাথা চোখে পড়ে আমার। বোতাম ছেঁড়া ব্লাউজটাকে ও বিধে রেখেছে সেপটিপিন দিয়ে। ঠিকমতো লাগাতে পারেনি। আমার ইচ্ছে হয়, ঠিক করে লাগিয়ে দিই সেপটিপিনটা।
আমি জানি ও শুধু করুণা। ও অনেক সয়েছে। করুণায় নীল ওর গালের ম্লান শিরাটা দেখতে চাই আমি। কিন্তু দেখি না। তাকিয়ে থাকি, কিন্তু তাকিয়ে থাকতে চাই না। একালের একটা ঘর, কিন্তু একালকে খুঁজে পাই না আমি, খুঁজে পাই না কিছুতেই আর ঘরের ম্লান ছায়াটা মনে হয় অন্ধকারের মতো মাতাল। আর বাইরের নিপ্রাণ নির্ভুল জঙ্গমটাকে মনে হয় মত্ত মদালস শেকলে বাঁধা একটা আদিম বৃষ হরপ্পার অন্ধকার থেকে মুখ তুলে ভাঙা ফাটা আহ্বানে ডাকছে তার সঙ্গিনীকে। কুটির প্রান্তের গণ্ডির বাইরে কোনো এক কামার্ত রাবণের মহাকাব্যিক পদচারণা। ওর নীল শিরাটার দিকে তাকাতে চাই আমি। বলতে চাই, শোনো! কিন্তু কিছুই বলি না আমি, কিছুই ভাবি না। শুধু ঘন, ভারী, আর্দ্র নিশাস টানি আমি। ও বলে, কই বলল। আর কিছু না ভেবে না দেখে তাকিয়ে থাকি আমি। ও অনেক দেখেছে, অনেক সয়েছে। আর তাই একটু আশ্চর্য পরিণতি ও জমিয়ে তুলেছে পরতে পরতে ওর মনে, ওর দেহে। একটা ফুল ফুটে উঠেছে তার সবগুলো দল মেলে—একটা মাংসের ফুল। কিছুই বলি না আমি। শুধু তাকিয়ে দেখি। ও শোভা নয়, সুরভি নয়, স্বেদ। ওর ব্লাউজের বাহুমূলের গোল জায়গাটা ভিজে উঠেছে ঘামে, ঘ্রাণে। ওর শাড়ি তেমনি অলস, তেমনি বাঁকা, ভরা ব্লাউজ। সেপটিপিন। উঠছে, নামছে, উঠছে। ভারী আর্দ্র নিশ্বাস টানি আমি। ডাক, শোনো—আর হরপ্পার বৃষের মতো একটি ভাঙা আওয়াজ বেরুতে চায় আমার গলা দিয়ে। কিন্তু না, বেরোয় না। কোনো শব্দই বেরোয় না আমার গলা দিয়ে। শুধু নিশ্বাস টানি আমি, ভারী, ভেজা, অন্ধকার।
আর সেই মুহূর্তে ও আস্তে করে বলে, শোনো।
আমি জানি ও গলার স্বর কার। ওর। একালের একটি মেয়ের। কান পাতি। একটা সুর গুনগুনিয়ে উঠছে আর কেটে কেটে যাচ্ছে কয়েকটি সাংসারিক আলোচনায়। একটি মামুলী গলার স্বর। যা শুধু কয়েকটা প্রাসঙ্গিক বিষয় জানায়, কয়েকটা প্রাসঙ্গিক বিষয় জানে। আর বানিয়ে তোলে একটা অপ্রাসঙ্গিক সত্যকে। যাদুকর অন্ধকার ঘেঁড়া ভেঁড়া হয়ে হারিয়ে যায়। ঘরের ম্লান আলোয়। আমি জানি এই আলোটাই ছিলো। এই আলোটাই আছে। স্নান। মামুলী। প্রাসঙ্গিক।
আমি বলি, বলো।
তারপর ওর দিকে তাকাই। বাইরের দিকে। একটা নির্ভুল জঙ্গমতা বেগার খেটে চলেছে দিনরাত। তার চিৎকার নেই, মত্ততা নেই, বিভ্রম নেই। মসৃণ, নিষ্করুণ, বৃহৎ। বাইরেটা অনেক অনেক বড়ড়া আমাদের চেয়ে। আমরা ছোটো, তুচ্ছ টুকরো। কোন্ মেশিনের সামনে ক-ঘণ্টা দিতে হবে আমাদের জানা! জঙ্গমটা বদলে যাওয়ার আগে কি করে ক্ষয়ে যেতে হবে আমাদের জানি! ওর দিকে তাকাই। নানা পথ, নানা দায়, নানা মোড় ও ঘুরে এসেছে। কাউকে ভুলিয়েছে, কাউকে ঠকিয়েছে, কাউকে ফিরিয়েছে। অনেক সয়েছে ও। অনেক। কিন্তু কেন? অনেক সয়েছি আমি, কেন? অনেক সয়েছি আমরা লু অপ্রাসঙ্গিক, তুচ্ছ, টুকরো, নিষ্ফল, শূন্য।
আমি বলি, বলো। আর কি বলছি সেটা কিছু নয়। কি সুর বাজছে। সুরটা নিষ্ফলতার, শূন্যতার। আর করুণা করতে চাই নিজেকে। না, করুণা করতে চাই না। একটা কষ্ট আছে আমাদের সকলকে ঘিরে। সেই কষ্টের নাম জীবন। কষ্টটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আমাদের। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার নাম জীবন। কিন্তু কেন? ঋষিপত্নী বলেছিলো, কি করে মৃত্যুকে অতিক্রম করবো? তার চেয়ে ভালো বুদ্ধের ধ্যান, কি করে জীবন অতিক্রম করে পৌঁছ শূন্যে, কিছুই না এমন একটা কিছুতে। কিছুই না, কোনো কথাই বলি না আর। ও আমার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকেই চেয়ে আছে এখনো। ও অনেক সয়েছে। কিন্তু কী এসে যায় যদি একটা মেয়ে দৈনিক বরাদ্দ মেহনতের পর দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করে। কাউকে ঠকায়। কাউকে ফেরায়, কাউকে ভোলায়। তারপর আবার হেঁটে যায় ভিড়ের মধ্যে দিয়ে, অনেক পথ অনেক মোড় অনেক দায়ের মাঝখানে। কী এসে যায় যদি কেউ বলে, শোনো, অথবা না বলে। কী এসে যায় যদি আমি বলি বলল, অথবা না বলি। বাইরেটা নিষ্করুণ, মসৃণ। এক মুহূর্তের আত্মরক্ষা আমাদের সাংসারিকতায়, না সাংসারিকতা নয় করুণায়। করুণায় নয়, কামে। না কামে নয় নিষ্করুণ শূন্যতায়। বৃহৎ জঙ্গমটাকে আমরা উত্তীর্ণ হবো শূন্যতায়। কিছু একটা শুনতে চাই ওর কাছ থেকে। আমাদের মাঝখানে একটা নিষ্পাপ, নিপ্রেম শূন্যতা। শূন্যতার ওপার থেকে ও ডেকেছে, শোনো। আমি ওকে ডাকি, বলো। কাছে আসতে চাই আমরা। কিন্তু কাছে আসার মূর্তিটা ফিরে যাওয়ার মতো। শূন্যতার ওপার থেকে ওকে ডাকি। সে ডাকটা ফিরে চলার মতো। শূন্যতার ওপার থেকে আরো ওপারে ওর ফিরে চলা। শূন্যতার এপার থেকে আরো এপারে আমার নিষ্ক্রমণ, এক নিষ্পাপ, নিপ্রেম বিশ্বের শূন্যতায় দুই গাণিতিক নক্ষত্র। গাণিতিক নক্ষত্র। গাণিতিক সেই শূন্যতায় কাছে আসাটা দূরে চলে যাওয়ার মতো সীমাটা অনন্তের মতো।
নির্দিষ্ট অনন্তের ওপার থেকে আমি ওকে কিছু একটা বলতে চাই। ডাকি, শোনো। আর চমকে উঠি। কি বলছি সেটা কিছু নয়, কি সুর লাগছে। আর নিপ্রেম, নিপ্রাণ শূন্যের এপার থেকে চমকে চমকে উঠি আমি। এ কী! এ কোন কান্নার সুর! নিপ্রেম, নিপ্রাণ এ কার অসহ্য কান্না। আর্তনাদের মতো করে আমি ডাকতে চাই, শোনো!
কিন্তু কিছুই বলি না আমি। কোনো শব্দই বেরোয় না আমার গলা দিয়ে। শুধু ওর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি। একালের মান একটা মেয়ে। অনেক সয়েছে ও, অনেক দেখেছে। অনেক পথ, অনেক মোড়, অনেক লোক। তাই কাঁদতে চাই আমি। কিন্তু কাঁদতে পারি না। শিউরে শিউরে উঠি আশঙ্কায়। পরতে পরতে পরিণতি জানিয়ে ফুটে ওঠা ঐ একটা মাংসের ফুল—কিন্তু অন্য কেউ নেবে ওকে। কেননা অনেক পথ, অনেক মোড়, অনেক লোক পেরিয়ে আসছে ও। অনেক মোড় অনেক লোক পেরিয়ে ও যাবে। দৈনিক বরাদ্দ রুজি রোজগারের মেহনতের পর কিছু কেনাকাটা করবে দোকান থেকে। কাউকে ফেরাবে, কাউকে ভোলাবে। তারপর আবার হেঁটে যাবে ও অনেক অনেক ভিড়ের মধ্যে।
স্নান ঘরের বাইরে একটা অন্তহীন উদ্ভট জঙ্গম শেকল বাঁধা এক সার মধ্যযুগীয় কয়েদীর মতো বেগার খেটে চলেছে ঝম্ ঝম্ শেকল বাজিয়ে। তাদের কদাকার কানা। নিষ্ঠুর চোখের কোণে কোণে ধূর্ত হাসি। আর ঝম ঝম্ করে পায়ের বেড়ি বাজছে দিনরাত। আমি জানি, অন্য কেউ ওকে পাবে। অনেক মোড়, অনেক ভিড়, অনেক দায়ের মধ্যে অন্য কেউ। ভিড়ের মধ্যে একদিন ও চোখ তুলে আমার দিকে চেয়েছে। দরজা খুলে দিয়ে বলেছে, শোনো। কিন্তু আর কিছু বলিনি আমরা। আর কিছু বলা হবে না আমাদের। আমি চোখ মেলে ওকে দেখতে চাই। ওর যা দেখেছি, সেটা নয়। যা দেখিনি সেইটে! ও যা বলেছে তা শুনতে চাই না আমি, ও যা বলেনি সেইটে। আর অসহ্য ঈর্ষায় অস্থির হয়ে উঠি। অন্য কেউ ওকে পাবে, কে, কে? অনেক। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ও এসেছে। ভিড়ের মধ্যে কে সে, যে ওকে নেবে? কে? তাহলে আমাকেও নিক অন্য কেউ। ভিড়ের মধ্যেকার অন্য কেউ? কিন্তু তু ঈর্ষায় কালো হয়ে উঠি আমি। আর আমি জানি, আমিও অনেক ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এসেছি। অনেক মোড়, অনেক দায়, অনেক পরিচিতা। ঈর্ষায় জ্বলি আমি আর ইচ্ছে করে ওকে বলি, শোনো সেদিন যাকে নিয়ে সিনেমায় গিয়েছিলাম। কিন্তু না, কিছুই বলি না আমি। আর একালের এই ঘরখানার ম্লান আলো অন্ধকার হয়ে ওঠে ক্রমে। অন্ধকার নয়, কালো। অসহ্য একটা কান্না গলা ঠেলে আসে আমার, আর কান্নাকে পায়ে মাড়িয়ে প্রেতের মতো স্তব্ধ হয়ে উঠি আমি। কালো একটা ষড়যন্ত্র নিশ্বাস চেপে ঘিরে দাঁড়ায় আমাদের চারিদিকে। নিপ্রেম নিপ্রাণ শূন্যতার চারপাশে ফিস্ ফিস্ সংকেত। বাক্যহীন একপাল। কদাকার কয়েদীর মতো বেগার খাটছে বাইরের উদভ্রান্ত জঙ্গম। আমি জানি না। আমি জানি। আমি যা জানি তা জানতে চাই না। যা জানি না, সেইটে। আর বিকৃত গলায় চিৎকার করে বলি শোনো! কিন্তু কিছুই বলি না আমি। কিছুই বলতে পারি না। একটা অসহ্য কান্না, না কান্না নয় ঈর্ষায় গলা বন্ধ হয়ে আসে আমার! গলা চেপে ধরে আমার! একটা ঈর্ষা আমাকে অস্থির করে তোলে।
ও ইতস্তত করে আবার বলে, শোনো।