পূর্ণ স্বাধীনতা

পূর্ণ স্বাধীনতা

কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনে ভাষণ, ডিসেম্বর ১৯২৮

মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক উত্থাপিত এবং বেশি না হলেও আমাদের কিছু প্রবীণ নেতা কর্তৃক সমর্থিত একটি প্রস্তাবের উপর সংশোধনী প্রস্তাব আনবার জন্য উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। আমি যে আজ সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি এই ঘটনা এক মতভেদের স্পষ্ট লক্ষণ, কংগ্রেসের ভিতরে প্রাচীন এবং নবীন চিন্তাধারার মধ্যে মৌলিক মতভেদ।

কিছু কিছু বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছেন, নেহরু রিপোর্টে স্বাক্ষর করেও কেন আমি স্বাধীনতার সমর্থনে কথা বলতে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমি শুধু রিপোর্টের মধ্যে প্রদত্ত বিবৃতিটিরই উল্লেখ করব, যাতে বলা হয়েছিল যে, গঠনতন্ত্রের যে-নীতি আমরা রিপোর্টের মধ্যে দাখিল করেছিলাম তা স্বাধীনতার গঠনতন্ত্রের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য। আমার সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনকে কোনও মতেই সঙ্গতিহীন বলে ব্যাখ্যা করা চলে বলে আমি মনে করি না।

ব্যক্তিগত কৈফিয়ত হিসাবে আমি আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করব। আপনারা অবগত আছেন যে, একান্ত আলোচনায় এবং অন্যত্র আমি বলেছি যে, প্রবীণ নেতাদের পথে বাধা হবার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। যে কারণে আমি এমন করেছিলাম তা হল এই যে, আমাদের সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হলে এই সভায় যে-মতভেদ হবে তার পরিণামের দায়িত্ব গ্রহণ করতে সেই সময়ে আমি নিজেকে প্রস্তুত বলে মনে করিনি। আজ আমি পরিণাম মেনে নিতে এবং আমার সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হলে শেষ পর্যন্ত বিষয়টির মুখোমুখি হবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত বলে মনে করি।

কয়েকটি ঘটনা আমাকে আমার আগের মতামত কিছু পরিমাণে পরিবর্তিত করতে বাধ্য করেছে। আপনারা অবগত আছেন যে, বাংলার প্রতিনিধিরা, অথবা অন্তত তাঁদের অধিকাংশ, সমবেত হয়ে তাঁদের পক্ষ থেকে এই সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন এবং পরিণাম যাই হোক না কেন তাঁরা সভার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। আমি আপনাদের নিশ্চিতরূপে বলতে পারি যে, এই সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করতে আজ আমি এখানে উঠে না দাঁড়ালেও এই কাজ করতে তাঁদের পক্ষ থেকে কেউ উঠে দাঁড়াতেন।

আর একটি ব্যাপার আছে, এবং সেটি হল সংশোধনী প্রস্তাব সমর্থন করতে এবং সভার সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন তা-ই মেনে নিতে ইন্ডিপেন্ডেন্স ফর ইন্ডিয়া লীগের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত।

আমরা, যারা সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন অথবা সমর্থন আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি, অত্যন্ত আন্তরিকভাবে অনুভব করি যে, সময় এমন গুরুত্বপূর্ণ যে, সাম্রাজ্যের অধীনে স্বায়ত্তশাসন (Dominion Status) বনাম স্বাধীনতা এই প্রশ্নে ভারতের মনোভাব স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করা উচিত। আমি আমাদের নেতৃবৃন্দকে বলেছি যে, লালা লাজপত রায়ের মৃত্যু, লখনউ এবং কানপুরের ঘটনাবলী এবং মহামহিম ভাইসরয়ের বক্তৃতার পরে আমরা আশা করব কংগ্রেস এমন এক বলিষ্ঠ মনোভাব গ্রহণ করবে, যা আত্মসম্ভ্রমপূর্ণ মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। তার পরিবর্তে আমরা দেখছি যে, মাদ্রাজ প্রস্তাবকে কিছুটা খর্ব করা হচ্ছে।

আমরা অনুভব করি এবং আমরা বলি যে, মাত্র একটি দিনের জন্যও স্বাধীনতার পতাকা আমরা অবনমিত করতে প্রস্তুত নই। এই সভায় হারি অথবা জিতি তা নিয়ে আমাদের উদ্বেগ নেই। তরুণ প্রজন্মের এ-নিয়ে কোনও উদ্বেগ নেই, কারণ তাঁরা ভারতকে মুক্ত করবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আমরা আমাদের নেতাদের চাই, আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা করি, কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা চাই তাঁরা সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলুন। আমি তাঁদের একথাও বলেছি যে, আমি আর পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু চরমপন্থীদের মধ্যে মধ্যপন্থীরূপে বিবেচিত এবং যদি প্রবীণ নেতারা এই মধ্যপন্থীদের সঙ্গেও আপস করতে প্রস্তুত না থাকেন তা হলে প্রাচীন এবং নবীনদের মধ্যে বিচ্ছেদ হবে অপ্রতিরোধ্য। দেশের তরুণদের মধ্যে এক নতুন চেতনার উন্মেষ হয়েছে। তাঁরা আর অন্ধের মতো অনুসরণ করতে প্রস্তুত নন। তাঁরা হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে, ভবিষ্যতের উত্তরাধিকার তাঁদের, ভারতবর্ষকে তাঁরাই মুক্ত করবেন এবং যে কঠিন দায়িত্ব তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে এই নতুন চেতনা নিয়ে তা পালনের জন্য তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করছেন।

আর একটি যুক্তি আছে যার আবেদন আমার কাছে অত্যন্ত জোরালো, এবং সেটি হল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। আপনাদের মনে থাকা উচিত যে, মাদ্রাজ প্রস্তাবের পরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত এক নতুন মর্যাদা লাভ করেছে। আমার ভয় হয় এই প্রস্তাব পাস হলে মাদ্রাজ কংগ্রেসের পরে আমরা যে-মর্যাদা লাভ করেছি, বেশি না হলেও, অন্তত তার কিছুটা আমরা হারাব। আপনারা হয়তো অবগত আছেন যে, মাদ্রাজ কংগ্রেসের পরে আমরা পৃথিবীর দূর-দূরান্তর থেকে বার্তা পেয়েছি। এখন প্রশ্ন হল : মাদ্রাজে গৃহীত সিদ্ধান্ত থেকে আমরা কি পিছিয়ে যাব? না কি আমরা এগিয়ে যাব? আমরা কি সরকারের মনোভাবের উপযুক্ত জবাব দেব? এবং সেই মনোভাবটি কী? আমরা পেয়েছি লালাজীর শোকাবহ মৃত্যু এবং লখনউ এবং কানপুরের দুঃখজনক ঘটনা। এই সবের পরেও কি আমরা প্রতিরোধমূলক এবং নির্ভীক মনোভাব গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করব না?

আমি সোজাসুজি একটি প্রশ্ন করতে চাই। মূল প্রস্তাবে আপনারা ব্রিটিশ সরকারকে বারো মাস সময় দিয়েছেন। আপনারা কি বুকে হাত রেখে বলতে পারেন যে, এই সময়ের মধ্যে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন (Dominion Status) লাভের যুক্তিসঙ্গত কোনও সম্ভাবনা আছে? পণ্ডিত মতিলাল তাঁর ভাষণে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, এমন বিশ্বাস তাঁর নেই। তবে কেন আমরা এই বারো মাসের জন্য পতাকা অবনমিত করব? কেন বলব না—ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আস্থার শেষ বিন্দুটুকু আমরা হারিয়েছি এবং আমরা এক নির্ভীক পদক্ষেপ করতে যাচ্ছি?

আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, স্বাধীনতার এই প্রস্তাব থেকে আমাদের কী লাভ হবে? আমি বলি, আমরা এক নতুন মানসিকতার বিকাশ ঘটাই। মোট কথা, আমাদের রাজনৈতিক অধঃপতনের মূল কারণ কী? এটা এক মানসিকতার প্রশ্ন, এবং দাসমনোবৃত্তিকে জয় করতে হলে আমাদের স্বদেশবাসীদের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে অটল থাকতে উৎসাহিত করেই তা করতে হবে। আর কাজ শেষ করবার জন্য আমরা পরবর্তী কর্মপন্থা গ্রহণ করব না এটা ধরে নিয়ে আমি আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলতে চাই যে, কেবল সততার সঙ্গে অভ্রান্ত সত্য প্রচার করে এবং আমাদের দেশবাসীর সামনে স্বাধীনতার লক্ষ্য স্থাপন করেই আমরা এক নতুন প্রজন্মকে লালন করে তুলব।

তবে আপনাদের বলে দিচ্ছি আমরা যুক্তকরে বসে থাকব না। আমি আগেই বলেছি যে, তরুণ প্রজন্ম নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং তাঁরা নিজেদের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত। আমাদের প্রস্তাবের ভাগ্যে যাতে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষিপ্ত হবার বিপদ না ঘটে সেজন্য আমরা নিজেদের কর্মসূচী রচনা করব এবং আমাদের সর্বোত্তম যোগ্যতানুযায়ী তাকে কার্যে পরিণত করব।

শেষ করবার আগে আমি আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করব। সমস্ত ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে আর একটি বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। অনেক কারণে আমি একথা বলছি। প্রথম কারণ, যে-সব কারণে যুদ্ধ লাগে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে তা উপস্থিত। ভাসইি-এর সন্ধি যে-মীমাংসা করেছিল তা সকলের জাতীয় উচ্চাকাঙক্ষা তৃপ্ত করতে পারেনি। এই সন্ধি ইতালি, বলকান দেশসমূহ, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশগুলিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এর পরে আছে এশিয়ার পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ধনতান্ত্রিক দেশগুলি জোটবদ্ধ। আবার আছে রণসজ্জার প্রতিযোগিতা। এই সমস্ত কারণ বিশ্বযুদ্ধের প্রবণতা সৃষ্টি করে। আমি বলছি নিরস্ত্রীকরণের কথা এক বিরাট প্রহসন। ঘটনা এই যে, এই সব স্বাধীন দেশগুলি আর একটি যুদ্ধের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ভারতবর্ষকে সতর্ক অবস্থায় থাকতে হলে আমাদের অবশ্যই এক নতুন মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে, এমন এক মানসিকতা যা বলবে যে, আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। কেবল স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে আদর্শ ঘোষণা করেই তা করা সম্ভব।

আমার মনে হয় না আর একটি মুহূর্তও আমরা অপচয় করতে পারি। বাংলার প্রসঙ্গে বলতে পারি যে, আপনারা অবহিত আছেন যে, এখানে জাতীয় আন্দোলনের ঊষাকাল থেকে সর্বদাই আমাদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ পূর্ণ স্বাধীনতা। স্বাধীনতাকে আমরা কখনও ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন রূপে ব্যাখ্যা করিনি। আমাদের এত স্বদেশবাসীর জীবন বিসর্জনের পরে, আমাদের কবিদের স্বাধীনতার বাণী প্রচারের পরে, স্বাধীনতা বলতে আমরা বুঝেছি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা আমাদের দেশবাসীর মনে, যে-নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে তাঁদের মনে, বিন্দুমাত্র সাড়া জাগায় না, এবং আমাদের একথা মনে রাখা উচিত যে, যা-ই হোক না কেন নতুন প্রজন্মের ভারতীয়রাই ভবিষ্যতের উত্তরাধিকারী।

সব শেষে আমি আপনাদের কাছে একটি চূড়ান্ত আবেদন করতে চাই। আমি মনে করি না যে, সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করলে আমাদের নেতাদের প্রতি বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে। নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রীতি, প্রশংসা এবং ভক্তি এক জিনিস আর নীতির প্রতি শ্রদ্ধা অন্য জিনিস। আমার প্রস্তাব গ্রহণ করুন এবং তরুণ সমাজকে নতুন চেতনায় অনুপ্রাণিত করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *