পূর্ণ চাঁদের নষ্টামি

পূর্ণ চাঁদের নষ্টামি

পূর্ণিমা-রাত্রি। আকাশের মহাপ্রাঙ্গণ থেকে পৃথিবীর রন্ধ্র পর্যন্ত জ্যোৎস্না যেন আর ধরে না। সামনে প্রশস্ত গঙ্গা, কূলের শেষ সীমা পর্যন্ত জোয়ারের জল ঠেলিয়া উঠিতেছে, আর একটানা সজোর দক্ষিণা হাওয়ায় তাহার উপর বড় বড় ঢেউয়ের সারি জাগাইয়া তুলিয়াছে। পাশের খোলা জায়গাটায় কোথায় একটা হেনার ঝাড় আছে, তাহা হইতে মাঝে মাঝে একটা তীব্র মিঠা গন্ধের গমক ভাসিয়া আসিয়া যেন নেশা ধরাইয়া দিতেছে। একটা পাখি ক্রমাগতই ঘুরিয়া ঘুরিয়া এই মাহেন্দ্রলগ্নে যেন একটা সঙ্গীতরাজ্যের সৃষ্টিতে মাতিয়া উঠিয়াছে।

সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতায় রাত্রিটা যেন আর নিজের মধ্যে আঁটিয়া উঠিতেছে না।

এমন একটি রাত্রির নিকট সতর্ক থাকাই ভালো, কেননা প্রত্যেক সুন্দরীর মতোই এও কখনও কখনও একটা বিশ্রীরকম আত্মবিস্মৃতি ঘটায়। আমি যে গুটি ষাট টাকার একটা কেরানী, আজিকার চাঁদের প্রশান্ত অনবদ্য সৌন্দর্যের চেয়ে আমার যে বড়বাবুর ভ্রুকুটিকুটিল মুখটির ধ্যান করাই বেশি দরকার, আজ এই দক্ষিণা হাওয়ায় মনের পাল না তুলিয়া দিয়া কাল আমার পাওনাদারদের মেজাজে হাওয়া কোন্ দিকে বহিবে তাহার হিসাব রাখিলে যে বেশি কাজ হয়, এসব প্রত্যক্ষ সত্যগুলো মনেই আসে না। এমন রাত্রে, বিশ্বের এই সীমাহীন প্রসারতা, বায়ুর এই বেহিসাবী ছড়াছড়ি দেখিতে দেখিতে মনে হয়, আমিও একটা প্রকাণ্ড কিছু হইতে পারিতাম। ওপারের ওই বিদ্যুৎ-আলোকিত কলের একাধিপতি হওয়া, কি গঙ্গার ওই যে পুলটা গড়িয়া উঠিতেছে ওর চীফ এঞ্জিনিয়ার হওয়া তাহার কাছে কিছুই নয়। তবে হইলাম না কেন? এর মীমাংসা করিতে গিয়া অনেক কথাই মনে পড়ে; সংসারের নানান রকম ছোটবড় প্রতিকুলতা। বহুদিন অতীত সেসবের কোনোটাকেই কিন্তু বেশ বাগাইয়া ধরিয়া আক্রোশ মেটানো যায় না। এই সুদীর্ঘ চিন্তাধারার শেষে আসিয়া পড়ে বিবাহ ব্যাপারটা, যেন কূল পাই এবং রাগের সমস্ত উচ্ছ্বাস লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়ি বউয়ের উপর।

আমার প্রথম যৌবনের অপরিমেয় প্রাণশক্তি—যাহা শত দিকে শত কল্পনায় বিকশিত হইয়া উঠিত—স্বদেশ, স্বাধীনতা, সাহেব ঠেঙানো, বাণিজ্য, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনা, সব জিনিসকেই ফুঁয়ে উড়াইয়া দিবার স্পর্ধা—কে তাহা বিনষ্ট করিল? বউ। যতনষ্টের কু এই বউ। কি যে এক দুর্বল মুহূর্তে ধরা পড়িয়াছি, তাহার পর প্রতিদিনই নিম্নগতি, প্রতিনিয়তই মনের এক-একটা মহৎ বৃত্তির বলিদান। এখনও কি চেষ্টা করিলে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না? আমি কি সেই ‘আমি’ নই? একবার গা-ঝাড়া দিয়া দেখিলে হয় না? ভৈরব হুঙ্কারে একটা নাড়া দিয়া মৃণালবদ্ধ হস্তী যেমন পদ্মবন দলিত করিয়া উঠিয়া আসে, তেমনই ভাবে ওর সমস্ত মাধুর্যের বাঁধন ছিঁড়িয়া কি একবার বাহির হইয়া আসা যায় না? মুক্তি যে চাইনি, এ রাত্রি যখন তাহারই বাণী ঘোষণা করিতেছে, আজ আত্মপ্রতিষ্ঠার ব্রত শুরু করিয়া দিতে হইবে যে।

এই রকম সব উদ্ভট চিন্তা মনে আসে। অন্তত এই বিশেষ পূর্ণিমারাত্রিটিতে, গঙ্গার সামনে ছোট বাড়ির খোলা ছাদটুকুতে বসিয়া অ্যানড্রিউডেভিডসন কোম্পানির ফোর্থ ক্লার্ক, আমাদের অনুকূল ভাদুড়ীর মনে এই চিন্তায় জোয়ার ঠেলিয়া উঠিতেছিল।

ইহাতে বিশেষ কোনো ক্ষতি ছিল না। বাঁধা জীবন-প্রণালীর কোনোখানে কোনো ছন্দপতন ঘটিত না, রাত্রে দিব্য ভালো ছেলেটির মতো বিছানায় শুইয়া শুইয়া বধূ মালতীর নিকট সেই দিনটির একঘেয়ে হিসাব শুনিতে শুনিতে নিদ্রা, সকালে চটকলের বাঁশি শুনিয়া জাগরণ, ত্বরিত স্নান, আহার, আটটা ছত্রিশের গাড়ি ধরা, অফিস, আবার সন্ধ্যার সময় সেই বাড়ি—সব নির্বিবাদে, বিনা ওজরে চলিয়া যাইত; কিন্তু এই সময় বাড়ির মধ্যে একটি ব্যাপার ঘটিতেছিল, যাহা সব ওলটপালট করিয়া দিল।

মালতীকেও আজ পূর্ণিমায় পাইয়াছে; কিন্তু অন্য ভাবে। সে রন্ধন করিতেছিল, এমন সময় কেরোসিনের ডিবরিটা নিবিয়া যাওয়ায় খোলা জানালার মধ্য দিয়া ঘরটা হঠাৎ নীলাভ জ্যোৎস্নায় ভরিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে যে পঞ্চশরে বিদ্ধ হইয়া অচেতন হইবার দাখিল হইল এমন কথা নয়, তবে এই আগন্তুক জ্যোৎস্নাটা তাহার হঠাৎ যেন বেশি রকম মিঠা ঠেকিল, এবং যে হাওয়াটা তাহার প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া কাজের অগোছ করিয়া দিল, সে-ই আবার তাহার মনের কোথায় অন্য একটা প্রদীপ জ্বালিয়া কবেকার কতকগুলো বিস্মৃত ঘটনাকে আলোকিত করিয়া তুলিল। ফলে এই হইল যে, মালতীর হাতা-বেড়ি ঠনঠনাইয়া রোজকার এই রন্ধন-কার্যটা বিশেষ ভালো লাগিল না। ডালের হাঙ্গামাটা উঠাইয়া দিল এবং ডালনা ও ভাজার কুটনা একত্র করিয়া তাড়াতাড়ি যেমন তেমন করিয়া একটা ঝোল নামাইয়া লইল ও দুধটা জ্বাল দিয়া রান্নাঘরে শিকল তুলিয়া দিয়া বাহিরে আসিল। বাহিরে রাত্রিটা আরও সুন্দর; মনে পড়িল, এই রকম একটি ফুটফুটে রাত্রে, আজ হইতে নয় বৎসর পূর্বে একটি উৎসবের কথা, তাহার জীবনের শ্রেষ্ঠ উৎসব। সেদিনকার নিজেকে মনে পড়িল, আর মনে পড়িল রাঙা-চেলি-পরা একজনকে, মুখে খড়কে-দিয়া-আঁকা চন্দনের বঙ্কিম রেখা, ঠোঁটে সলজ্জ হাসির আভাস—”

বড় মেয়েটি একটা ছবির বই পড়িতেছিল; মালতী একটু দ্বিধার স্বরে প্রশ্ন করিল, “কোথায় রে? বেরিয়েছে বুঝি?”

মেয়ে একটু অন্যমনস্ক ছিল, প্রশ্ন করিল, “কে মা?”

“তোর বাবা।” কথা দুইটি বলিতে একটু লজ্জা হইল আজ, কিন্তু লাগিল বড় মিঠা।

মেয়ে উত্তর করিল, “ছাতের ওপর, ডেকে দোব?”

“না, তুমি পড়।”

মালতী মেয়ের আনত মুখখানির পানে একটু চাহিয়া রহিল, সুন্দর মুখখানি, বাপের চোখ দুইটি আর কোঁকড়ানো চুল পাইয়াছে, আর ছোট্ট কপালটি এবং টুকটুকে ঠোঁট দুইখানি নাকি তাহার নিজের দেওয়া।

ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া দুইজনের মধ্যে কত দিনের কত তর্কবিতর্কের কথা মনে পড়ে।

মালতী ঘরের মধ্যে গেল। রাত্রে আরশি দেখিতে মানা, তবুও যে চকিত ছায়াটি পড়িল তাহাতে টের পাওয়া গেল, কতকগুলো ছোট চুলের ঘুমরি ঘামে ভিজিয়া কপালে জড়াইয়া গিয়াছে—মেয়ের ছাঁচের ছোট্ট কপালটিতে।

চুলের গোড়া খুলিয়া আবার ভালো করিয়া আঁটিয়া বাঁধিল। আজ খোঁপা বাঁধা হয় নাই, ঠাকুরঝি যাওয়া পর্যন্ত এদিকে প্রায়ই হয় না। থাক, ও এলোখোঁপাই ভালোবাসে। ওর এই শখের কথা মনে পড়ায় আবার লজ্জা আসে।

গন্ধরাজের গাছটি ফুলে আলো করিয়া রহিয়াছে; আজ ঠাকুরঝি থাকিলে জোর করিয়া পরাইয়া দিত চুলে, যা দুষ্টু! তাই বলিয়া নিজে তুলিয়া খোঁপায় গোঁজা যায় না—না না, কোনোমতেই নয়।

কাপড়খানায় হলুদ আর তেলের দাগ। মালতী আলনায় আপনার কোঁচানো নীলাম্বরী শাড়িটির দিকে লুব্ধভাবে চাহিল, কিন্তু লজ্জাকে অতটা অতিক্রম করিতে না পারায় একটি কাচা আটপৌরে শাড়ি পরিধান করিল। দুইটি পান সাজিল। একটি নিজের মুখে দিয়া অপরটি হাতে রাখিল, ওপরে যাইবার ছুতা

বেশ জ্যোৎস্না। চমৎকার দিব্যি হাওয়া। ও কতবার বলিয়াছে—”তুমি রান্নাবান্না তাড়াতাড়ি সেরে একটু বাইরে হাওয়ায় এসে বস না কেন?” হইয়া উঠে না। তা ছাড়া ওর যে মতলবে বলা— সেসবের আর বয়স আছে নাকি?

জ্যোৎস্নার কথা ভাবিতে ভাবিতে জ্যোৎস্নার ডেলার মতো কখন দুইটি গন্ধরাজ ফুল তুলিয়া ফেলিয়াছে অন্যমনস্ক ভাবে। খোঁপার নিকট হাত লইয়া যাইতে মনে পড়িল; ভাবিল দূর, খোঁপায় পরা চলে না; হাতে থাকে থাক গিয়া, কি আর এমন দোষ হইবে তাহাতে!

তাড়াতাড়ি শুধরাইয়া লওয়া নিজের রূপটির উপর মনে মনে একটু চক্ষু বুলাইয়া লইল। লজ্জাও করে, যেন নিজের কাছে ধরা পড়িয়া যাওয়া। যা কবি-মানুষ, একরাশ উচ্ছ্বাসের ছড়াছড়ি হইবে এখনই!

আরশিতে আবার ভ্রূ জোড়াটির উপর হঠাৎ নজর পড়িল, ওই যাঃ, টিপ পরা হয় নাই—টিপ ওর চাইই যে!

মালতী ক্রমেই বেজায় কুণ্ঠিত হইয়া উঠিতেছিল; তাহারই মধ্যে কে যেন ক্ৰমাগত একটা চটুল হাসি হাসিয়া যাইতেছে, যেন ঠাকুরঝি তাহার মনের অন্তরালে বাসা বাঁধিয়াছে। মালতী যেন সেই অন্তরালবর্তিনীকেই লক্ষ্য করিয়া বলিল, “তা কি করব, বল? মেয়েমানুষকে অন্যের শখেই যে চলতে হবে; নয়তো এত রাত্রে টিপ পরতে আমার বয়ে গেছে!”

কপালে একটি খয়েরের টিপ পরিল।

এই সময়-বরাবর ওদিকে স্বামী অনুকূল “প্রকাণ্ড একটা কিছু না হইতে পারার” সম্বন্ধে শেষ সিদ্ধান্ত করিয়া ভাবিতেছিল, যত নষ্টের কু এই বউ, কি যে একটা দুর্বল মুহূর্তে ধরা পড়িয়াছি!

ভাবিতেছিল, মৃণালবদ্ধ হস্তী যেমন পদ্মবন দলিয়া পিষিয়া উঠিয়া আসে, তেমনই ভাবে ওর সমস্ত মাধুর্যের বাঁধন ছিঁড়িয়া কি বাহির হইয়া আসা যায় না? সংসারের কর্মক্ষেত্রে নিজেকে পূর্ণভাবে প্রকাশ করিয়া দাঁড়ানো যায় না?

.

মালতী সিঁড়ি বাহিয়া ছাতের দরজার কাজে দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিল, “আজ মশাইয়ের জোচ্ছনা আর মলয় খেয়েই কাটবে, না আরও কিছু চাই?”

সকলেই জানেন, দাম্পত্যভাষায় এগুলো লিডিং-কোশ্চেন জাতীয়। এর উত্তর একটি মাত্রই ছিল, জানাইয়া দেওয়া—না প্রিয়ে, আজ বরং যাহা খাইয়া কাটিতে পারে, তাহা তোমার দুইটি অধরে সঞ্চিত আছে, এই জ্যোৎস্না আর মলয় বায়ু তাহার ক্ষুধাটা তীক্ষ্ণই করিয়া দিয়াছে।

তাহার পর যাহা হইবার আপনিই হইয়া যায়। মোটের উপর এ খোরাকটিও জোটে, অথচ পেটের খোরাক যে বন্ধ হয় এমন নয়, বরং প্রীতিসেবার মাধুর্যে আরও উপভোগ্য হইয়া উঠে।

কিন্তু অনুকূলের মাথায় আজ ভূত চাপিয়াছিল; সঙ্গে সঙ্গেই তাহার পরীক্ষার এমন বিপুল সরঞ্জাম দেখিয়া সে মনে মনে সর্ববিজয়ী বীরের মতো দৃপ্ত হইয়া উঠিল। দুয়ারের দিকে চাহিয়া মনে মনে বলিল, ওঃ, আজ যে দেখি সব অস্ত্র শানিয়ে এসেছ! র’স। আমাদের যতটা গোলাম ভাবো ততটা নয়, অন্তত অনুকূল শৰ্মা তো নয়ই।

নিতান্ত অবিচলিত ভাবে বলিল, “না, তা আর কাটে কবে? কতদূর ভাতের?”

মালতী যেন থতমত খাইয়া গেল। চৌকাঠ হইতে পা বাড়াইয়াছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে টানিয়া লইয়া একটু শুষ্ক কণ্ঠেই বলিল, “দেরি? দেরি কিসের, তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম, বাড়া হবে?”

রান্নাঘরের তাতে মুখটা এখনও লাল হইয়া আছে, তাহার উপর পূর্ণিমার জ্যোৎস্না পড়িয়াছে, আবার এই নূতন আঘাতে অপ্রতিভ ভাবটা—ক্ষণিক দুর্বলতা আসিয়া পড়েই যে! তবুও অনুকূল মনকে অতিরিক্ত রকম কড়া করিয়া আরও রূঢ় আঘাত হানিল; বলিল, “তা এত সাজের ধুম যে!”

মালতী অন্তরে অন্তরে যেন লজ্জায় ঘৃণায় মরিয়া গেল। মনে হইল, তাহার এই কপালের টিপ, গালে-টেপা পান আর কাচানো শাড়িটা তাহার পা হইতে মাথা পর্যন্ত যেন দাহ করিয়া দিতেছে। স্বামীর প্রথম উত্তরে একটু অপ্রতিভ মাত্র হইয়াছিল—একটা সন্দেহের সান্ত্বনা ছিল যে, হয়তো সে সরল ভাবেই বলিয়াছে; কিন্তু এখন বেশ বুঝিতে পারিল, এ জানিয়া শুনিয়া প্রত্যাখ্যানের আঘাত। হঠাৎ এ মনোভাবের কারণ বুঝিতে পারিল না, বুঝিবার স্পৃহাও ছিল না; তবে এই অন্যায় অপমানটা তাহাকে বড় তীক্ষ্ণভাবে বিদ্ধ করিল। ওইটুকুর মধ্যেই সে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া যেন গলদঘর্ম হইয়া উঠিল। অথচ পিছাইতেও পা উঠে না। আর সামনের পথ তো নাইই।

এই সঙ্কট হইতে স্বামীর প্রশ্নই আবার তাহাকে পরিত্রাণের পথ দেখাইল। অনুকূল জিজ্ঞাসা করিল, “শুনলে কথাটা? বলি, সেজে-গুজে কোথাও বেড়াতে চললে নাকি? না, এমনিই?”

মালতী শুষ্ক গলায় একটা ঢোক গিলিয়া বলিল, “একবার সইয়ের বাড়ি যাই ভেবে কাপড়টা ছেড়েছি।”

উত্তরটিতে অনুকূলের একটু হার ছিল। তবে আঘাতটা যে লাগিয়াছে, তাহা বেশ বোঝা যায়। প্রশ্ন করিল, “তা কি?”

“তাই বলছিলাম খেয়ে নিতে; একটু দেরি হয়ে যেতে পারে; অনেক দিন যাই নি।”

অনুকূল একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসিয়া বলিল, “তা দুটো ভাত বেড়ে নিতে বেশ পারব। এত অপদার্থ ভাবো কেন বল দিকিন? অথচ এতদিন দেখছ আমায়!”

মালতীর মুখ দিয়া বাহির হইতেছিল, এতদিন দেখছি বলেই ভাবি; কিন্তু এই সময় তাহার মাথায় একটা খলবুদ্ধি আসিয়া জুটিয়া গেল। বলিল, “সে বলতে গেলে তো রান্নাবান্নাও করে নিতে পার, কিন্তু—”

অনুকূল রোখের মাথায় জালের মধ্যে একটা পা বাড়াইয়া দিল, একটু গর্বের সহিত বলিল, “আবার কিন্তু কি, পারিই তো, বেটাছেলে হয়ে জন্মেছি—”

মালতীর দুষ্টু প্ল্যান মাথার মধ্যে জাঁকিয়া উঠিতেছিল, বলিল, “ছেলেপুলে মানুষ করতেও—”

“স্বচ্ছন্দে। একটা সান্ত্বনাও থাকে যে, প্রায়শ্চিত্ত করছি।”—দৃষ্টিটা ওপারের কলের বিজলী বাতির উপর গিয়া পড়িল।

মালতী কথাটা সহ্য করিতে না পারিয়া ভূজোড়াটা একটু কুঞ্চিত করিয়া বলিল, “প্রায়শ্চিত্ত!”

“প্রায়শ্চিত্ত। সামনের ওই কলটা দেখছ? একজন মাড়োয়ারির; ওতে বোধ হয় ক্রোর টাকা খাটছে। সমস্ত দিনের পর রাত বারোটা একটায় একবার অন্দরমহলে এল কি না এল! বাস্, ওই পর্যন্ত মোহ আছে; তবে সেটা কাজের মোহ, লক্ষ্মীর মোহ—”

বাধা দিয়া মালতী বলিল, “বুঝেছি অর্থাৎ অলক্ষ্মীর মোহ নেই আর কি।”

অনুকূলের যেন একটু চমক ভাঙিল; বুঝিতে পারিল, কথাটা অত্যন্ত রূঢ় হইয়া গিয়াছে; এতটা রূঢ় করা তাহার উদ্দেশ্য ছিল না। তবুও একেবারে অনুতাপের দুর্বলতাটা প্রকাশ করিতে কেমন বোধ হইল, তাই শুধু একটু নালিশের সুরে বলিল, “অমনই রাগ হল! আমি কি তাই বললাম? কথাটা বেঁকিয়ে না বললে—”

গ্রহের দোষ হইলে শোধরাইবার সময়ই ভুলগুলো আরও ঠেলাঠেলি করিয়া আসিয়া জোটে, অনুকূল আর কথাটা শেষ করিতে সাহস করিল না।

অবসরও ছিল না; কারণ শেষ করিবার পূর্বেই মালতী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিয়া উঠিল, “আমার কথা তো ব্যাকা হবেই; আমার মন ব্যাঁকা, আমার কপাল ব্যাকা, কথা আর সোজা হবে কোত্থেকে? দেখতে যখন পার না, তখন আমার চলন ব্যাঁকা ঠেকবে। আর সবচেয়ে ব্যাকা আমার বুদ্ধি, তাই সোজা মহাপুরুষদের কথায় থাকতে যাই। ভাত বাড়া হবে কি না, বলা হোক।”—সিঁড়িতে সজোরে পায়ের ঘা দিতে দিতে মালতী নামিতে লাগিল।

অনুকূলের মেজাজটা খাদে নামিতেছিল; আবার সপ্তমে চড়িয়া বসিল। ক্রমে তাহার মনে হইল, সে দুনিয়ার কাহাকেও কেয়ার করে না। ষোলকলায় পূর্ণ চাঁদটা মাথার উপর উঠিয়া আসিয়াছে; আকাশে ছোট ছোট তারাগুলো লুপ্ত। চাই ওই রকম সর্বগ্রাসী পরিপূর্ণতা। সে কাহারও কাছে মাথা নোয়াইবে না। ঘরের বউয়ের কাছে নয়, অফিসে বড়বাবুর কাছে নয়, আরও অনেক জায়গায় অনেক লোকের কাছে নয়। কি বউ? তাহার আবার মোহ! কিসের বড়বাবু? তাহার আবার অত দেমাক! আর সেই ব্যাটা সার্জেন্ট, সেদিন অত তাড়াতাড়ির মধ্যে তাহার ট্যাক্সিটা যে স্ট্র্যান্ড রোডের মোড়ে অতক্ষণ দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছিল, কেরদানি করিয়া একটা হাত বাড়াইয়া দিয়া, ব্যাটা নিজেকে ভাবে কি? এই যে প্রকাণ্ড পৃথিবী, আলো তাহার হাজার বাহু দিয়াও যাহাকে ধরিতে পারিতেছে না, তাহার মধ্যে ইহাদের কর্মক্ষেত্র কত সঙ্কীর্ণ! আর সে নিজে, কত বড়ই না হইতে পারিত! এখনও যদি ইচ্ছা করে, যদি শুধু মন দিয়া ইচ্ছা করে মাত্র তো এত বড় হইতে পারে যে, এ পৃথিবীতে তাহার সঙ্কুলানই হয় না। না, আর দুর্বলতা নয়, নিজেকে চিনিতে হইবে, চেনাইতে হইবে। দাঁড়াও অনুকূল তুমি মাথা তুলিয়া, পৃথিবী তোমার পায়ে লুটাইয়া নিজেকে চরিতার্থ মনে করুক।

.

মেয়েটি আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ভাত দেওয়া হবে বাবা? মা জিজ্ঞেস করলেন। “ অনুকূল বলিল, “তাঁকে যেতে বল বেড়াতে।”

মেয়েটি নামিয়া গেল; তখনই ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “বললেন, বেড়াতে আর যাবেন না; বড় মাথা ধরেছে, শুতে যাচ্ছেন।”

অনুকূল মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া একটু চুপ করিয়া রহিল। মাথা ধরার মানে সব সময় মাথা ধরা নয়—মেয়েদের পক্ষে আবার বেশির ভাগ সময়েই নয়।

জিজ্ঞাসা করিল, “কাপড়-টাপড় ছেড়ে ফেলেছে নাকি?”

“ছাড়ছেন।”

“হুঁ! আচ্ছা, বলগে যা শুতে। বলবি, আমি বেড়ে নোব’খন, যখন ক্ষিদে পাবে। উঃ!”

আবার আত্ম-চিন্তা চলিতে লাগিল। এবার আরও জোরের সঙ্গে চালাইবার চেষ্টা ছিল, কিন্তু এবারে গতির জন্য যেন মাঝে মাঝে লেজমোড়া দিতে হইতেছিল। জ্যোৎস্নাটাও যেন ক্রমেই একটু একটু করিয়া খাদ মিশিয়া মলিন হইয়া উঠিতে লাগিল। খাসা দক্ষিণা হাওয়া, কিন্তু দক্ষিণা হাওয়ায় আবার যেন ক্ষুধাও বাড়ায় বলিয়া অনুকূলের বোধ হইতে লাগিল; আবার এই জ্ঞানটিকে সে যতই অস্বীকার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, ততই যেন পেটের অনুভূতির মধ্য দিয়া সেটা স্পষ্ট হইয়া উঠে।

তখন স্ত্রীলোকের প্রতি তাহার দয়া হইল। আহা, বড্ড সামান্য, বড্ড ছোট ওরা, একটু কথার আদর পাইলেই বর্তিয়া যায়, আবার ইঙ্গিতের মধ্যেও সামান্য অনাদরের ভাব দেখিলেই মুষড়াইয়া পড়ে। পুরুষের এই বিরাট জীবন, তাহার কোথায় এক কোণে একটু জায়গা করিয়া বেচারীরা পড়িয়া আছে কাজ কি ওদের চোট দিয়া? আমাদের জীবনে কতটুকুই বা প্রভাব ওদের?

একটু পরে মেয়েটি আসিয়া সিঁড়ির দুয়ারের কাছে মাথাটি নীচু করিয়া দাঁড়াইল। মুখটি ভার-ভার।

অনুকূল মনে মনে হাসিল, মনে মনেই বলিল, দেখ ব্যাপার! বাপ খাবে না, একটু দেরি করে খাবে, অমনই মেয়ের মুখ ভার, আর তার মা শয্যা ধরা!

মেয়ে এবং তাহার মাকে কৃতার্থ করিবার জন্য অনুকূল বলিল, “আচ্ছা যাও, বল ভাত বাড়তে, আমি আসছি।”

মেয়েটি কাছে সরিয়া আসিল; কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, “মা কাউকেও ভাত দেবে না বললে, আমার ক্ষিদে পেয়েছে বাবা।”

অনুকূল বড় কৌতুক অনুভব করিল; মেয়ের গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল, “আচ্ছা, তুমি বলগে দিকিন—বাবা খেতে আসছে, তা হলে তোমায়ও দেবে; কিংবা বলগে—বাবা ডাকছে, আমায় ভাত দিয়ে ওপরে যাও; না হয় বরং বল—বাবা একবার—”

মেয়ে অভিমানের সুরে বলিল, “না বাবা, তোমার নাম করলে খিঁচিয়ে উঠছেন, বললেন—বাবা বাবা করতে হবে না আমার কানের কাছে, বেরো, দূর হ। তুমি চল বাবা, মা’র কি হয়েছে, আমার ভয় করছে।”

অনুকূল একটু অন্যমনস্ক ভাবে বলিল, “বেশ ভালো করে গুছিয়ে শুয়েছে নাকি? মশারি ফেলে?”

“মশারি ফেলতে গিয়ে একটা কোণ ছিঁড়ে গিয়েছে; টেনে সবটা ছিঁড়ে ফেলেছেন। খোকাকে তোমার বিছানায় মশারির ভেতর শুইয়ে দিয়েছেন।”

অনুকূল একটু শিহরিয়া উঠিয়াই কহিল, “আমার বিছানায়? দেখ দিকিন অত্যাচার, নীচে অয়েল-ক্লথটা পেতে দিয়েছে তো?”

“না, নিজে পাট করে মাথায় দিয়ে শুয়েছেন। বললেন—এটা নিয়ে যেন কেউ টানাটানি না করে, বলে দিস। আমার মাথাটা ঠাণ্ডা থাকবে একটু, বড্ড যেন জ্বলছে।”

অনুকূল ব্যস্তভাবে মাদুর ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল, মুখে ক্রমাগতই—”কি গেরো বলদিকিন! না বাপু, ভ্যালা বিপদ তো!”

যাইতে যাইতে মেয়েকে প্রশ্ন করিল, “আর মিন্তু, সে খেয়েছে?”

বাপ উঠিতে মেয়ে সাহস পাইয়া মা’র বিরুদ্ধে সজোরেই নালিশ করিল, “হ্যাঁ, খেয়েছে! মা তেমনই কিনা! একটা থাপ্পড় খেয়েছে, বেচারী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ল।”

একটু পরে আবার বলিল, “সেও তোমারই বিছানায় শুয়েছে বাবা।”

ততক্ষণে নীচে আসিয়াছে। নামিতেই জাপানী দেওয়াল ঘড়িটা যুক্তকর কপালে ঠেকাইয়া তাহার ভাঙা গলায় গৃহস্বামীকে গৃহস্থালীর মধ্যে অভ্যর্থনা করিল।

ঘড়ির দিকে চাহিয়া অনুকূল সত্রাসে কহিল, “বারোটা? আর তোরা দিব্যি নিশ্চিন্দি হয়ে রয়েছিস? জানাতে হয় না আমায়?”

“ওটা তো ঠিক নেই বাবা। বাঞ্ছা মিস্ত্রী আজই মোটে কলে তেল দিয়ে গেল কিনা। বললে—তেল খেয়েছে, এখন যদি দুদিন একটু জোর চলে তো ঘাবড়ো না মাঠাকরুন।”

অনুকূল বিরক্ত ভাবে চেঁচাইয়া উঠিল, “কে ওর হাতে আবার ঘড়ি দিতে বলেছিল? যত বারণ করি—”

“উঃ” করিয়া বিছানা হইতে একটি করুণ শব্দ উঠিল; মালতী আড়ামোড়া ভাঙিয়া পাশ ফিরিয়া শুইয়া অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বলিল, “তোরা আর কানের কাছে চিৎকার হানিস নি সবি। আমায় একটু শান্তিতে মরতে দে, উঃ বাবা!”

অনুকূল একবার নিজের শয্যার দিকে এবং ঘরের সাধারণ বিশৃঙ্খলার দিকে চাহিল; তাহার পর আস্তে আস্তে বধূর কাছে গিয়া শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, “সত্যি-সত্যিই মাথাটা ধরল নাকি?” সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুলটা শোধরাইয়া লইবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “এ যে সত্যি-সত্যিই মাথা ধরেছে দেখছি; আমি ভাবলাম, এক-একবার যেমন—”

আরও বেশি রকম ভুল হইয়া যায় দেখিয়া জড়িত জিহ্বায় আমতা আমতা করিয়া বলিল, “দেখছি, এই সামান্যের মধ্যে বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে—”

তাহার পর আর সামলাইতে না পারিয়া একেবারে ওদিকটাই ছাড়িয়া দিয়া বলিল, “অডিকলোনটা কোথায় আছে?”

ক্ষীণ কণ্ঠে যতটা আওয়াজ চড়ানো যায়, সে পরিমাণ চিৎকার করিয়া (নেহাত কমও হইল না) মালতী বলিয়া উঠিল; “সবি পোড়ারমুখী, কে তোদের মায়া দেখাতে ডেকেছে লা? আমার মিথ্যে, আমার সামান্য, বাড়াবাড়ি, আমার আদিখ্যেতা আমার থাক্, কে তোদের—আঃ, বাবা গো!”

চেঁচামেচিতে খোকা জাগিয়া উঠিল এবং কাঁদুনির সঙ্গে সঙ্গে বাপের বিছানাটা ভিজাইয়া দিয়া হাত-পা ছুঁড়িতে আরম্ভ করিল। মিন্তু জাগিবার পূর্বসূচনা স্বরূপ পাশ ফিরিয়া ক্রন্দনের ভঙ্গীতে একবার মুখটা কুঁচকাইয়া সে ঝোঁকটা কাটাইয়া আবার ঘুমাইয়া পড়িল।

অনুকূল বেচারী নির্বাক আতঙ্কে সবটা দেখিয়া শুনিয়া খানিকটা সেই ভাবেই বসিয়া রহিল। অবস্থাটা এতই অপ্রত্যাশিত, তাহার মনে হইল, যেন হঠাৎ নূতন কোথায় একা আসিয়া পড়িয়াছে। তাহার মাথার মগজ আলগা হইয়া যেন খুলির মধ্যে ঘোরপাক খাইতে লাগিল। একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া উঠিয়া বলিল, “যাই তবে, দেখিগে—বলছিলাম, একটু অডিকলোন লাগালে ভালো হত—”

কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। অনুকূল সেখানেই একটু দাঁড়াইয়া রহিল; তাহার পর প্রয়োজনমতো সাহস সঞ্চয় করিয়া আবার কহিল, “বলছিলাম, অডিকলোনটা না হয় বের করে—”

মালতী কনুইয়ে ভর দিয়া খানিকটা উঠিয়া ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, “ওগো, নানা- না—না—না, শুনতে পেয়েছ কথাটা এবার?”

অনুকূল আস্তে আস্তে জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। সেই প্রশস্ত গঙ্গা—অগাধ জ্যোৎস্না আর মুক্ত বাতাস; উহাদের আত্মশক্তি যেন কূল ছাপাইয়া বাহির হইয়া পড়িতেছে। উহাদের এই দুই হাতে বিলানো শিক্ষা সে কি কিছুতেই গ্রহণ করিবে না? কেন এই হীনতা? কেন এই অপমান?

মেয়ে সবিতা ধীরে ধীরে আসিয়া গায়ে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “খোকা বড্ড কাঁদছ বাবা, দুধ গরম করে দোব?”

অনুকূল মেয়ের মাথাটা সস্নেহে উরুতে চাপিয়া বলিল, “কেন, বাবা পারে না বুঝি? তুমি বরং ওকে একটু চুপ করাও গিয়ে।”

কোঁচাটা তুলিয়া কোমরে গুঁজিয়া সপৌরুষে কাজে লাগিয়া গেল।

উঁচু করিয়া টাঙানো শিকায় দুধের কড়া তোলা ছিল।

সকলেই স্বীকার করিবেন বোধ হয় যে, গৃহস্থালির মধ্যে শিকা হইতে জিনিস নামানোর চেয়ে শক্ত কাজ আর দ্বিতীয়টি নাই, বিশেষ করিয়া একটু বেঁটে লোকের পক্ষে প্রথমত আপনি ধরিতে গেলেন, আপনার স্পর্শ পাওয়া মাত্রই শিকাটি পাত্রসমেত সামনে একটু আগাইয়া গেল এবং সেখান হইতে একটি গতিবেগ লইয়া আপনার মাথার উপর দিয়া সাঁ করিয়া গোটা তিন-চার দোল খাইয়া গেল। আপনি বুদ্ধিমানের মতো সরিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, আরও একটু বুদ্ধি খরচ করিয়া স্থির করিলেন—না, পাত্রের তলদেশ ধরিতে যাওয়াটা ‘ঠিক’ হয় নাই, একেবারে শিকার দড়িটা বাগাইয়া ধরিতে হইবে। এবার তাহাই করিলেন এবং শিকা যেমন পূর্বের মতো নিজের ঝোঁকে সামনের দিকে হটিয়া গেল, আপনিও বুদ্ধি করিয়া সঙ্গে সঙ্গে দুই পা আগাইয়া গেলেন, বুদ্ধি করিয়া দড়িটা আর ছাড়িলেন না। কিন্তু ছাড়িলেই যেন আসল বুদ্ধিমানের কাজ হইত, শুধু দড়ি নয়—দড়ি, পাত্র, এমন কি সে ঘরটা পর্যন্ত। সেটা টের পাইলেন পরে, যখন পাত্রস্থ তরল পদার্থের খানিকটা আপনার মাথার ব্রহ্মতলে পড়িয়া বুকে পিঠে গোটাকতক তীব্র স্রোতের সৃষ্টি করিয়া নীচে নামিয়া গেল।

আপনি যতক্ষণ আপনার সেই মাথার টিকি হইতে পায়ের নখ পর্যন্ত মুছিয়া পরিষ্কার হইবেন, ততক্ষণে নিজের অভিরুচিমতো দোল খাওয়া রোধ করিয়া শিকাটি স্বস্থানে সুস্থির হইয়া দাঁড়াইয়াছে। উঠিয়া ঘাড় উঁচু করিয়া দেখিলেন, পাত্রটি ঈষৎ নমিত মুখে আপনার দুরবস্থার দিকে চাহিয়া আছে—আপনার বোধ হইল, একটু মিটিমিটি হাসির ভাবও আছে তাহাতে।

এই বিশেষ ক্ষেত্রে অনুকূল দুধ-মোছা গামছাটা মেয়ের হাতে দিয়া খুব সন্তর্পণে কড়াটিকে সিধা করাইয়া বসাইল। মেয়ের নিকট লজ্জাটাকে চাপা দিবার জন্য বলিল, “একেবারে ছাপাছাপি দুধ ছিল।”

মেয়েও বাপকে সপ্রতিভ করিবার জন্য উৎসাহভরে বলিয়া উঠিল, “হ্যাঁ-ই তো; ওথলানো দুধ ছিল বাবা, যেই উথলে উঠেছে, আর মা কড়া নামিয়ে সেই ওথলানো দুধ সুদ্ধু—”  

বিছানা হইতে একটা কি রকম শব্দ হইল। অনুকূলের মনে হইল, যেন চাপা হাসির; কিন্তু পরক্ষণেই বেশ স্পষ্ট শুনিল—না, যন্ত্রণাজনিত ‘উঃ-আঃ’ শব্দ মাত্ৰ।

কন্যাকে বলিল, “খোকাকে একটু হাওয়ায় নিয়ে যা দিকিন, ভেঁপোমি করতে হবে না।”

নামাইবার সময় খুব সাবধান হইয়াছিল; এবার আর দুধ মাথায় পড়িল না, পড়িল নাকের উপর—অল্প একটু; দেখিবারও কেহ সামনে ছিল না। সেটা আর গোঁফের সরটুকু তাড়াতাড়ি মুছিয়া ফেলিল।

উনানে আগুন আর সামান্যই আছে—সেই একেবারে পেটের মধ্যে, উপরটা নিবিয়া গিয়াছে। অনুকূল তাতটা দেখিল—দুধটা গরম হইয়া যাইতে পারে; যদি একটা বুদ্ধি করা যায়—”

অনুকূল একটা চিমটা লইয়া উপরের নিবানো কয়লাগুলি এক একটি করিয়া অতি ধীরে ধীরে বাহিরে ফেলিতে লাগিল। এ আর এক বিপদ—এত নিবানো কয়লা যে উনানের মধ্যে ছিল, আগে তাহা জানা যায় নাই। যখন প্রায় অর্ধেক হইয়া গিয়াছে, অনুকূল লক্ষ্য করিয়া দেখিল, একটি কয়লা তুলিলেই তাহার নীচের আধাজ্বলন্ত রাঙাকয়লাটি মলিন হইয়া যাইতেছে। তখন নিজের ভুলটা বুঝিতে পারিয়া এক-একখানি করিয়া তপ্ত কয়লাগুলি উনানে আবার তুলিয়া রাখিতে লাগিল।

কয়েকখানি রাখিবার পর হুস করিয়া একটা শব্দের সঙ্গে সমস্ত উনানের কয়লাগুলি একেবারে গহ্বরে নামিয়া গিয়া খানিকটা আলগা ছাই সজোরে বাহির হইয়া আসিল।

সবিতা আসিয়া বলিল, “বাবা, খোকা যে কোনোমতেই—”

অনুকূল ধমক দিয়া বলিল, “আঃ, যা না একটু বাইরে, সবাই একসঙ্গে ভিড় করে দাঁড়ালে! দেশলাইটা কোথায়?”

দেশলাই-খোঁজা-পর্ব শেষ হইলে, কাগজ পোড়াইয়া এবং ঘরময় ছড়াইয়া যখন দুধজ্বাল সারা হইল, তখন জাপানী ঘড়িটার মতে একটা। সবি বেচারী ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। অনুকূল বাটিতে দুধ ঢালিয়া জুড়াইয়া, খোকাকে বিছানা হইতে তুলিয়া আনিতে গেল, নিজের কৃতকার্যতায় মনটা একটু প্রসন্ন হইয়াছে। “এস, বাবা এস।”—বলিয়া পুত্ৰকে কোলে তুলিয়া লইল। খোকা কোলে, ডঠিয়া মুখটা সরাইয়া লইয়া পিতাকে নিরীক্ষণ করিল, তাহার পর হঠাৎ এমন ডুকরাইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল যে, একসঙ্গে সবিতা ও তাহার মা ধড়মড়িয়া বিছানায় উঠিয়া বসিল। সবিতা ভীত অসহায় ভাবে বলিয়া উঠিল, “বাবা, ও বাবা, বাবা গো!”

তাহার মা স্বামীকে কিছু না বলিয়া মেয়েকে ধমকাইয়া বলিল, “ভয় করছে! কেন, একটা আরশি এনে দিতে পার না ততক্ষণ? দেখে আক্কেল হয়—এই ঠিক দুপুর-রাত্তিরে, নাঃ, পোড়া সংসারে ম’লেও সোয়াস্তি নেই—”

আবার কপাল টিপিয়া শুইয়া পড়িল।

খোকা আর মিন্তুর কান্না চলিয়াছে পর্দার পর পর্দা চড়াইয়া, মাঝে মাঝে বাপের পানে চায় আর বালিশে মুখ গুঁজিয়া পড়ে। আর সবির সেই ভীত অনুযোগ।

অনুকূল নিজেই আরশিটা লইয়া আলোর কাছে দাঁড়াইল। ডুকরাইয়া উঠার আর দোষ কি? উনানের কয়লা ধসিয়া যে ছাইটা উঠিয়াছিল, সমস্ত তাহার মাথায় আর মুখে; যেখানটায় ছাই নাই, সেখানটায় আছে কড়ার তলার কালি, সমস্ত মুখটি সাদা-কালোর একটা দাবার ছক হইয়া উঠিয়াছে, আরশির মধ্যে কে অন্য একজন যেন অনধিকার প্রবেশ করিয়া বসিয়াছে!

অনুকূলের মনে হইল আরশি আছড়াইয়া, দুধ টান মারিয়া ফেলিয়া, ছেলেমেয়েগুলাকে ঘা-কতক বসাইয়া দিয়া শুইয়া পড়ে কিংবা দেশত্যাগী হয়; দেশত্যাগী হইবার ইচ্ছাটাই উৎকট হইয়া উঠিল, কারণ তাহাতে মালতীর মুখ আর দেখিতে হয় না।

অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করিয়া সাবান দিয়া মুখটা ধুইয়া ফেলিল। তাহার পর যেন মরীয়া হইয়া লাগিয়া গেল। ইতিমধ্যে মিন্তু, খোকা মায়ের জন্য বায়না ধরিয়াছে এবং তাহাদের মায়ের মমতার উদ্রেক না হইয়া শুধু মাথার যন্ত্রণা বাড়িয়া গিয়াছে।

অনুকূল ছেলে দুইটাকে এক-একটা করিয়া চড় কষাইয়া আরও কাঁদাইয়া তুলিল এবং সেই অবস্থাতেই দুধ গিলাইয়া বিছানায় ছাড়িয়া দিল।

রাত্রের অনিয়ম-অত্যাচারে তাহার নিজের মাথা ধরিয়াছে। একটু আচ্ছন্ন ভাবে সে পড়িয়া রহিল। দিনটা কি ভাবে কাটিবে? কাচ্চাবাচ্চা, রেলগাড়ি, আপিস, রান্নাঘর—সমস্ত একটা জগা-খিচুড়ি গোছের ছবি তাহার মনটাকে অভিভূত করিয়া দিতে লাগিল। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিয়া অনুকূল একবার বধূর দিকে চাহিল—স্বাস্থ্যপূর্ণ প্রগাঢ় নিদ্রার তৃপ্তি মুখখানাতে মাখানো।

অনুকূল সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করিয়া লইল। এই তোমার মাথাধরা! তবে দেখ, প্ৰকৃত যাহার মাথা ধরিয়াছে, সে কি ভাবে কাজ করে!

তবে মালতীর জাগ্রত দৃষ্টির সামনে তাহার পৌরুষটা দেখানো চাই। ছেলে দুইটাকে খুব জোরে ধমক দিয়া চেঁচাইয়া উঠিল, “কেন রাত থেকে ‘ম্যা-ম্যা’ করে চেল্লাতে শুরু করেছিস? আর কেউ নেই?”

বিছানা হইতে নামিয়া, মশারি গুটাইয়া মিন্তুর হাতটা ধরিয়া নামাইল। মালতী জাগিয়া উঠিয়াছিল; রাত্রের সেই ক্ষীণ আওয়াজটা টানিয়া আনিয়া বলিল, “সবি, বল্ গিয়ে নিজেকে সামলাক; দিনের বেলায় অত মদ্দাত্তি খাটবে না; আমি মরতে মরতে সেরে নিচ্ছি।”

“সবি বল্, মদ্দর মদ্দাত্তি সব সময়ই খাটবে।” বলিয়া অনুকূল খোকাকে একটা ঝাঁকানি দিয়া নীচে নামাইল, তাহার পর সবিতাকে তুলিয়া বলিল, “যা, দুটোকে বাইরে নিয়ে যা।”

মালতী শুইয়া পড়িয়া বলিল, “ভাঙে তো মচকায় না! আচ্ছা, বেশ।”

অনুকূল যতক্ষণে স্নান আহ্নিক সারিয়া উঠিল, ততক্ষণে ঝি আসিয়া পড়িয়াছে। স্ত্রীসুলভ ক্ষিপ্রতার সহিত সে উনান ধরাইয়া রান্নাবান্নার গোছ করিয়া দিল; সে-সবগুলাকে পুরুষসুলভ নিপুণতার সহিত অগোছ করিয়া অনুকূল যখন রন্ধনকার্য সমাধা করিল, তখন আটটা ছত্রিশ কোন্ কালে হইয়া গিয়াছে। হরিশ হাঁক দিয়া গেল, “কই হে, আছ না গেছ?”

একদফা কাজ শেষ হওয়ায় অনুকূলের মনটা একটু হালকা ছিল, ইয়ারকি করিয়া বলিল, “এই খাবি খাচ্ছি, দেরি নেই, তুমি এগোও।”

ঝিকে বলিল, “উঃ, নটা পনরোয় হরিশ মিত্তির বেরিয়ে গেল, শিগগির ঠাঁই করে দাও। আমি চট করে জামাকাপড় পরে নিই ততক্ষণ। আজ দিন বুঝে ধোপা ব্যাটাও কাপড় দিয়ে গেল, এখনও মেলানো হয় নি।”

কাপড় পরিয়া ফতুয়া গায়ে তুলিয়াছে, ঝি আসিয়া বলিল, “ঠাঁই হয়ে গেছে।”

তাড়াতাড়ি ফতুয়ায় হাত দুইটা গলাইতে গলাইতে অনুকূল বকিতে বকিতে ছুটিল, “ইস, এত কড়া করে ফেলেছে! যত বলি, কড়া ইস্তিরি করিস নি—”  

বোতাম দেওয়ার পূর্বেই ভাত বাড়িতে বসিয়া গেল। ঝি হঠাৎ দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল এবং মিনিটখানেক পরেই পাশের ঘরে যেন চাপা হাসির শব্দ শোনা গেল। মালতী কন্যাকে ডাকিয়া বলিল, “সবি বলে দে, যদি ব্লাউজ পরে রান্নাবান্না করবার শখ হয়ে থাকে তো একটা তোয়ের করিয়ে নিতে; আমারটা ছেড়ে দিক এক্ষুনি; আর ওটা আমার শাড়ি, পাড়টা ফিকে হয়ে গেছে বলে ধুতি হয়ে যায় নি যে পরে বসে আছে!”

অনুকূল খাইতে শুরু করিয়া দিয়াছিল, ঘাড় নীচু করিয়া দেখিল, তাহার মেটে রঙের ফতুয়া গায়ে দেয় নাই, এটা মালতীর গোলাপী রঙের ব্লাউজটাই, আর এ নরুনপাড়ের ধুতি কোথায়!—মেয়ে আসিয়া পড়িবার পূর্বেই দুই-চার গ্রাস নাকে মুখে পুরিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল।

ওইটুকুর মধ্যেই ঘামিয়া উঠায় ব্লাউজের পাতলা কাপড় গায়ে সাঁটিয়া গিয়াছে, তাহার উপর সেই রকম আঁট, খুলিতে প্রায় পাঁচমিনিট গেল।

নয়টা পনেরোর গাড়ি ধরিতেই হইবে, কারণ তাহার পরেই নয়টা পঞ্চান্ন; সেটা আবার থ্রু প্যাসেঞ্জার, আচারই লেট থাকে, আবার লিলুয়াতে পনরো মিনিট দাঁড়ায়।

কোনো রকমে জুতাটা পায়ে দিয়া আর কামিজ ও চাদরটা কাঁধে ফেলিয়া অনুকূল এক রকম ছুটিয়াই বাহির হইয়া গেল।

অর্ধেক রাস্তা হইতে আবার ছুটিয়াই ফিরিল, প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে;—মান্থলি টিকিটটা ধোপের ছাড়া জামার পকেট হইতে বাহির করিয়া লওয়া হয় নাই। স্টেশনে যখন পৌঁছিল, তখন গার্ডের গাড়ির পেছনের লালটা দূরে দেখা যাইতেছে, বিদ্রুপের হাসির মতো।

অনুকূল হতাশভাবে একখানি বেঞ্চে বসিয়া পড়িল। মনটা একবার আপিস হইতে ঘুরিয়া আসিল, সেখানে বড়বাবুর খোঁচা খোঁচা গোঁফগুলা শজারুর কাঁটার মতো সিধা হইয়া উঠিয়াছে।

“যাক, আর উপায় কি!” বলিয়া অনুকূল চাদরটা বেঞ্চের উপর রাখিয়া কামিজটা চড়াইয়া লইল।

ওপারের প্ল্যাটফরমে বেঞ্চের সমস্তটা দখল করিয়া একটি কাবুলী লম্বাচওড়া হইয়া শুইয়া নিদ্রা দিতেছিল। তাহার নিদ্রার কোনোরূপ ব্যাঘাত না হয় এইরূপ দূরে থাকিয়া একজন লোক হাত-পা নাড়িয়া চোখ পাকাইয়া তাহার এই অন্যায়ের আলোচনা করিতেছিল। সেই দিকে চাহিয়া অনুকূল অন্যমনস্কভাবে কামিজের বোতাম দেওয়ার চেষ্টা করিতে লাগিল।

যখন কোনোমতেই আর বোতাম লাগে না, তখন অনুকূলের নজর কাবুলঘটিত ব্যাপার হইতে কামিজের দিকে ফিরিয়া আসিল। দেখিল, কামিজের বোতাম নাই বলিয়া লাগিতেছে না। কড়া ইস্ত্রি দেওয়া কামিজটা মুক্তির আনন্দে যেন হাত-পা ছড়াইয়া দিয়াছে।

রাগটা বউয়ের উপর হইল, কি নিজের উপর হইল, কি কলের মালিকের উপর হইল ভাবিয়া দেখিবার সময় ছিল না। এভাবে তো যাওয়া যায় না। আবার বাড়িতে ছোটা ভিন্ন উপায় নাই। উঠিতেই দূরে ডাউন লাইনের পাখাটা ঘাড় হেঁট করিল। একটা হিন্দুস্থানী কুলি বলিল, “পাগলা গাড়ি হ্যায়, কভি এক ঘণ্টা লেট আতা হ্যায়, আজ দশ মিনিট পহিলেই আ গিয়া।”

.

দশটার সময় আপিস। বারোটা বাজিতে যখন পঁচিশ মিনিট বাকি, অনুকূল অপরাধীর মতো সঙ্কুচিত ভাবে নিজের টেবিলে আসিয়া বসিল। বড়বাবুর পিয়ন পরম শ্রদ্ধার সহিত একটি সেলাম ঠুকিয়া একটি স্লিপ দিল—বড়বাবুর তলব।

অনুকূল গিয়া যখন কামরায় দাঁড়াইল, বড়বাবু অত্যন্ত মনোযোগের সহিত তখন একটা গার্ডেন-পার্টির নিমন্ত্রণ-কার্ড দেখিতেছিলেন। অনুকূলের দিকে না চাহিয়াই বাঁ হাতটা বাড়াইয়া দিলেন। বলিলেন, “দিন, সইগুলো সেরে দিই। আজ আবার এই গার্ডেন-পার্টির হাঙ্গামা আছে, ভালোও লাগে না।”

অনুকূল একটু চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর মৃদুস্বরে বলিল, “টোটালগুলা একটু বাকি আছে, এক্ষুনি সেরে নিয়ে আসছি।”

বড়বাবু আশ্চর্য হইয়া মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “এই দু-ঘণ্টার মধ্যে টোটাল করা হল না!”

রাগে অপমানে কথা বাহির হইতে চাহে না; অনেক কষ্টে অনুকূল কহিল, “আজ্ঞে, আজ একটু দেরি—”

“দু-চার মিনিট দেরি তো সবারই হতে পারে অনুকূলবাবু, আমারই আজ সা— ত মিনিট দেরি হয়ে গেল; কিন্তু তাতে কি কাজ আটকায়?”

অনুকূল কথাটাকে যেন ধাক্কা দিয়া গলা হইতে বাহির করিল, “আজ্ঞে, একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে আজ, এই আসছি।”

“এই আসছি! এখন যে বারোটা, অনুকূলবাবু? না, আপনি ঠাট্টা করছেন ভালো লোক পেয়ে!”

অনুকূল মাথা নীচু করিয়া রহিল।

বড়বাবু তখন ধীর কণ্ঠে প্রত্যেকটি কথা স্পষ্ট করিয়া বলিলেন, “সাহেব আমায় এসে পর্যন্ত তাগাদা করছে অনুকূলবাবু। একটু খাতির করে, অনেক কষ্টে ঠাণ্ডা করে রেখেছি। কি জানেন, ওরা আমাদের বিয়ে করা, ওর নাম কি, ইয়ে তো নয়, কাজ চায়। এই আজ কবার বললে, না বাবু, ও ফার্স্টক্লাস এম. এ.-র কর্ম নয়, বোধ হয় তোমার আমার মতো মুখ্যুদের সম্বন্ধে শেক্‌সপীয়ার কি লিখে গেছে, সেই নিয়ে রিসার্চ করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে বরং তুমি তোমার সেই ব্রাদার-ইন-লটিকে নিয়ে নাও। জেদাজেদি। আমি বললাম, আচ্ছা দেখি আর একবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে।”

অনুকূলের একবার মনে হইল, বলে, ফার্স্ট ক্লাস এম. এ.-র বদলে যদি আপনাদের ফার্স্ট ক্লাস রোগ-এর দরকার হয় তো তাই রাখুন। কিন্তু রাত্রের জ্যোৎস্নার প্রক্রিয়াটা অনেকটা কমিয়া গিয়াছিল, খোদ বড়বাবুকেও না হয় এই রোখের মাথায় দুই-একটা কথা বলা যাইত, কিন্তু বড়বাবুর শালাকে লইয়া বিদ্রূপ করিবার সাহস হইল না। তাহা ছাড়া সে কয়দিন ধরিয়া আপিসে ঘুরঘুর করিতেছে, কাহার চেয়ারের উপর এই শ্যালক বপুখানির শুভাধিষ্ঠান হইবে তাহা লইয়া কেরানীমহলে জল্পনা-কল্পনা চলিতেছিল।

আস্তে আস্তে চলিয়া আসিতেছিল, দুয়ার পর্যন্ত আসিলে বড়বাবু বলিলেন, “হ্যাঁ, আর এক কথা, আমি আজকে পুরো আপিস করতে পারব না, দেখছেনই তো, এক ফ্যাসাদ এসে জুটেছে। আমার এই কাগজগুলো আপনাদের মধ্যেই চারিয়ে নিয়ে শেষ করতে হবে; কাল আবার মেল ডে। ভেবেছিলাম আমার ব্রাদার-ইন-লকে দিয়ে খাটিয়ে নোব, সে যেরকম ইন্টেলিজেন্ট, তার এ ঘণ্টাখানেকের ওয়াস্তা; কিন্তু তাতে আবার কারুর কারুর অভিমান হয়। সেদিন শুনলেন তো নরেশবাবুর কথা?—আমরা কি মরে গেছি বড়বাবু যে ওই দুধের ছেলেকে না-হক কলম পিষিয়ে মারছেন! কাজ কি বাপু?”

আপিস যাইতে যতটা দেরি হইয়া গিয়াছিল, ফিরিতে তাহার অনুপাতে আরও দেরি হইয়া গেল। স্টেশনে যখন নামিল, তখন রাত আটটা। সেই চাঁদটা অনেকখানি উঠিয়াছে, দেখিলে পিত্ত জ্বলিয়া যায়, কি আবার নতুন ফ্যাসাদ বাধাইবে!

বাড়ি ঢুকিবার পূর্বে সবিতা আসিয়া আনন্দে অধীর হইয়া জড়াইয়া ধরিয়া খবর দিল, “বাবা বাবা, কেমন দিদিমা এসেছেন! আহা, অন্যের কাঁধে হাত দিয়ে চলতে হয়, তবুও তো মেয়ে বাবা! অসুখ শুনে কি থাকতে পারেন? আমি যেমন মা’র মেয়ে, মাও তো তেমনই।” প্রস্তরবৎ নিশ্চল হইয়া অনুকূল হতাশভাবে বলিল, “দিদিমা! কখন এলেন তোর দিদিমা? তাই তো আবার রাত্রিতে দেখতেও পান না আজকাল, আর একেবারে বদ্ধ কালা যে।”

“না বাবা, আহা, তবুও তো পেটের মেয়ে! বলছিলেন, ঝি গিয়ে যখন বললে, মালতী কাল থেকে উঠতে পারছে না, আর বুঝি এযাত্রা—”

“ঝি! আঃ, দেখ দিকিন নষ্টামি! কে তাকে গিয়ে সেখানে খবর দিতে বললে? কালই তাকে বিদেয় করে—”

“মা বুদ্ধি করে বলেছিলেন বাবা। দিদিমাকে বলছিলেন, যখন দেখলাম বড্ডই বাড়াবাড়ি হচ্ছে—ঝিকে বললাম, মাকে একটু খবর দে, আর দেখতে পাব কিনা!”

অনুকূল হাঁকিল, “ঝি!”

সবিতা বলিল, “ঝি তো নেই। মা বললেন, ঝি, তুই এই টানাপোড়েন করতে বড় হাক্লান্ত হয়ে গেছিস, বাড়ি যা জল-টল তুলে রেখে। সে এসে একটা দিন চালিয়ে নেবে’খন, সাজোয়ান পুরুষমানুষ, কাল আবার তোকে বদ্যিবাটি ছুটতে হবে।”

বদ্যিবাটি! অনুকূল আতঙ্কে এক রকম চিৎকার করিয়া উঠিল। সেখানে তাহার পিসশাশুড়ি আর পিসশ্বশুর থাকে। ঘরদুয়ার বেচিয়া বৃদ্ধবয়সে বৈদ্যবাটিতে আসিয়া গঙ্গাবাসী হইয়াছে। প্রবল শুচিবেয়ে দম্পতি। একবার আসিয়াছিল, আড়াই মাস ধরিয়া প্রতিদিন তৈজসপত্র হইতে ধোপার বাড়ির কাপড় জামা পর্যন্ত প্রত্যেকটি জিনিস বাঁকে করিয়া জল আনাইয়া বর্ষার গঙ্গাজলে ধোওয়া হইত। যাইবার সময় ভাইঝিকে সান্ত্বনা দিয়া গিয়াছিল, “তোদের কেরেস্তানি কাণ্ডের মধ্যে দুদিনও থাকতে পারলাম না মা, তা দুঃখু করিস নি, গঙ্গার কাছেপিঠে একটা বাসা নে, যদ্দিন বলিস থাকব’খন।”

সে সব কথা ভুলিয়া আবার গঙ্গার কাছেই বাসা লওয়া হইয়াছে!

অনুকূল ঘরে প্রবেশ করিয়া জুতা-জোড়াটা টান মারিয়া এক কোণে ফেলিয়া দিল, কামিজটা তাহার উল্টা দিকে জ্বলন্ত প্রদীপের উপর পড়িয়া সেটাকে নিবাইয়া দিল; সে নিজে অন্ধকার ঘরের ততোধিক অন্ধকার মন লইয়া বিছানার উপর হাত-পা ছড়াইয়া শুইয়া পড়িল। সবিকে হাঁকিয়া বলিল, “দেখ সবি, তোরা যা ইচ্ছে তাই কর, আমি আর তোদের সংসারের মধ্যে নেই; কিন্তু আমায় যদি কেউ জাগাবি তো হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দোব, আমি মরে পচে গলে থাকি, কারুর দেখবার দরকার নেই, তোদের সংসারে তোরা যা ইচ্ছে তাই করগে!”

তাহার পর বৈদ্যবাটির কথা মনে পড়িয়া যাওয়ায় যা-ইচ্ছা করার একটা সীমা নির্দেশ করিয়া দেওয়া অত্যন্ত দরকারী ভাবিয়া বলিল, “কিন্তু যদি ঝি কাল বদ্যিবাটি যায় তো আমি দেশত্যাগী হব, এই বলে রাখলাম।”

.

বাড়ির সময়টা জাপানী ঘড়ির চার্জে, সুতরাং রাত্রি কত হইয়াছে ঠিক বলা যায় না, তবে চারিদিক অনেকটা নিস্তব্ধ হইয়া আসিয়াছে।

অনুকূলের ঘুমটা ভাঙিয়া যাইতে তাহার কপাল হইতে একটি কোমল হাত সরিয়া গেল। পাশে চাহিয়া একটু আশ্চর্য হইল বটে, কিন্তু অভিমানেই হউক আর যে জন্যই হউক, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া হাঁকিল, “সবি, উনুন জ্বলার জোগাড় করে রেখেছিস?”

সেই নরম হস্তটি আবার কপালে আসিয়া সঞ্চারিত হইতে লাগিল এবং নরম গলায় মিষ্টি অনুরোধ হইল, “খাবার তৈরি আছে, ওঠ, খাবে চল।”

“না, আমার হাত-পা আছে।” বলিয়া বেশ দৃঢ়তার সহিত অনুকূল উদ্যোগী হইয়া উঠিয়া বসিল।

একটু চুপচাপ, তাহার পর সেই নরম গলায় বেশ কড়া হুকুম হইল, “আমার রান্নাঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশের অধিকার নেই।”

অনুকূল উঠিতে যাইতেছিল, আবার বসিয়া পড়িয়া বক্ত্রীর মুখের দিকে সবিস্ময়ে চাহিল, নিজের কান দুইটাকে যেন বিশ্বাস করা যায় না। ভূজোড়া কপালে তুলিয়া বলিল, “তোমার রান্নাঘর! বিনা অনুমতি! আর আমি? আচ্ছা বেশ, কাঁচা চাল তো আছে!”

আবার ঠেলিয়া উঠিল। রান্নাঘরের মালিক আপনার অসপত্ন অধিকারের সীমাটা বাড়াইয়া হুকুম করিল, “আমার ভাঁড়ারঘর থেকে চাল নেবারও কারুর অধিকার নেই।”

অনুকূলের আর বাক্যস্ফূর্তি হইল না; স্ত্রীর বৃথা বাক্যব্যয় করা দরকার ছিল না। দুইজনে যেন দুইটি নীরব প্রশ্ন আর নীরব উত্তরের মূর্তি ধরিয়া পরস্পরের দিকে চাহিয়া রহিল।

অনুকূল ব্যাপার বেশ বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না, হাল ছাড়িয়া বলিল, “বেশ, উপোস করে মরব, সে অধিকার তো আছে?” বলিয়া শুইয়া পড়িতে যাইতেছিল, তাহাতেও বাধা দিয়া বধূ বলিল, “আমার বাড়িতে সেটা আরও হতে পারে না, অকল্যাণ হবে, একে তো মাথার ব্যথা ধরেই আছে। অকল্যাণে অকল্যাণে—”

হাসি সামলাইতে পারিল না। স্বামীরও ঠোঁটে সে হাসির একটু ছোঁয়াচ লাগিল। দুইজনের হাসির এই শুভ্র পতাকায় যে শান্তির সূচনাটুকু পাওয়া গেল সেটাকে প্রত্যাখ্যান করিবার প্রবৃত্তি কিংবা উৎসাহ অনুকূলের আর ছিলই না; তাই তাহার সেই যে মহাদম্ভের কাল্পনিক উচ্চপদ, যাহা আসলে রাঁধুনীর পদেই আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সেটাকে ইস্তফা দিয়া অনুকূল চব্বিশ ঘণ্টা আগেকার পুরাতন বাধ্য কেরানী স্বামীটির মতো উঠিয়া বসিল।

আহারে বসিয়া বলিল, “সামনের জানালা বন্ধ করে দাও তো, চাঁদটা চোখে ঠিকরে পড়ছে।”

“মিছে নয়, যেন ড্যাবড্যাব করছে বাপু। এর চেয়ে যখন একটা ফালির মতো থাকে, ভালো।”—বলিয়া স্ত্রী তাহাদের পুনর্মিলনের আসর হইতে যত ফ্যাসাদের মূল পূর্ণচন্দ্রকে বাহির করিয়া দিয়া পাখা হাতে স্বামীকে আহার করাইতে বসিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *