পূর্ণদার মাছ

পূর্ণদার মাছ

এ গল্প আমাদের বন্ধু শিল্পী পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী শিশুসাহিত্যিক শিশিরকুমার মজুমদারকে বলেছিলেন। অনেক দিন আগের কথা। একদিন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ের দোকানে হেমেন্দ্রকুমার রায়, চারু রায়, নরেন দেব আর পূর্ণদা একসঙ্গে জুটেছেন।

মাছ ধরার বিষয়ে নানান রসের গল্প হচ্ছে। এমন সময় দুটো বড় বড় ওয়েলার ঘোড়ায় টানা একটা জুড়ি-গাড়ি দোকানের সামনে থামল। এ-গাড়িকে সেকালে লোকে ব্ৰুহাম বলত, খুব বড়লোকি ব্যাপার।

ব্রুহাম থেকে যিনি নামলেন তাঁর নাম জানে না, এমন লোক সেকালে কম ছিল। ইনি হলেন শ্যামপুকুর স্ট্রিটের কুমারকৃষ্ণ মিত্র। একজন নামকরা বড়লোক। কলকাতায় এবং তার আশেপাশে অনেক সুন্দর সুন্দর বাড়ি, বাগান ইত্যাদির মালিক। মানুষটিও ভারী অমায়িক আর অতিথিবৎসল।

যে কারণেই তিনি সেদিন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের দোকানে এসে থাকুন না কেন, মাছধরার গল্প শুনে মুগ্ধ হলেন। শুধু মুগ্ধই হলেন না, সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবাইকে পরের রবিবার ওঁর দমদমের বাগানবাড়িতে নেমন্তন্ন করে বসলেন।

সারা দিনের ওয়াস্তা। সকাল থেকে মাছধরা, দুপুরে ভূরিভোজন, বিকেলে ইচ্ছে হলে আবার মাছধরা, বাগানে ভ্রমণ, সংগৃহীত মূর্তি-ছবি দর্শন, যতক্ষণ খুশি থাকুন। একেবারে ঢালাও ব্যবস্থা।

তারপর একটু বিনীত ভাবে কুমারকৃষ্ণ বললেন, ‘আপনারা আমার সম্মানিত অতিথি হয়ে যাবেন। আপনাদের আপ্যায়নের জন্য নিখুঁত ব্যবস্থা করা থাকবে। যা থাকবে না, তাও চাইবামাত্র পেয়ে যাবেন। আমার ম্যানেজার, গোমস্তা, বেয়ারা, দারোয়ান, বামুনঠাকুর, সবাই হাজির থাকবে।

‘শুধু আমি থাকতে পারব না। একটা বিশেষ জরুরি কাজে আমাকে মফস্‌সলে যেতে হবে। কিন্তু এই সামান্য কারণে যদি আপনারা আমার সাদর নিমন্ত্রণ গ্রহণ না করেন, তা হলে আমি মর্মাহত হব।’

অবিশ্যি গ্রহণ না করার কোনও কথাই ওঠেনি। অন্যান্য নেশাখোরদের মতো মাছুড়েরাও ভারী উদার হয়। অত আত্মসম্মানের ধার ধারে না। তা ছাড়া অন্যান্য ব্যবস্থাও নিশ্চয় নিতান্ত মন্দ হবে না। আর অচেনা উৎসাহী গৃহস্থরা মাছধরার পক্ষে খুব সুবিধাজনক নাও হতে পারে। কাজেই আনন্দের সঙ্গে তিনজন রাজি হয়ে গেলেন।

রবিবার সকালে সকলে সেই বিখ্যাত বাগানবাড়িতে পৌঁছতেই সাদর অভ্যর্থনা পেলেন। ম্যানেজার গোমস্তা ইত্যাদি ওঁদের সমাদর করে বিশাল পুকুরের ধারে নিয়ে গেলেন। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সব হয়ে গেলে, দুপুরের খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাঁরা চলে গেলেন।

পূর্ণদা শিল্পী মানুষ, মাছ ধরার রোমাঞ্চ উপভোগ করলেও, নিজে মাছ-ফাছ ধরতেন না। তিনি ঘুরে ঘুরে বাগানের গাছগাছড়া, শ্বেতপাথরের মূর্তি ইত্যাদি দেখতে লাগলেন। বাকি তিনজন সঙ্গে করে মাছধরার যাবতীয় সরঞ্জাম এনেছিলেন। তাঁরা জায়গা বেছে, যে যার টোপ, চার, ছিপ, বঁড়শি, ফাতনা নিয়ে গুছিয়ে বসে গেলেন। পুকুরে বড় বড় মাছকে ঘাই দিতে দেখা যেতে লাগল।

সময় কাটতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয়, কারও ছিপে মাছ পড়ল না। ম্যানেজারবাবু খানিকক্ষণ পর পর, একবার এসে নিঃশব্দে দেখে যেতে লাগলেন। মাছ ধরতে গিয়ে ধৈর্য হারালে চলে না। ওঁরা বসে আছেন তো বসেই আছেন। পূর্ণদার মনে হতে লাগল বোধহয় খাওয়ার সময় হতে আর বেশি দেরি নেই।

ঠিক সেই সময় পুকুরপাড় থেকে একটা চাপা উল্লাস শোনা গেল। পূর্ণদা দৌড়ে গিয়ে দেখেন হেমেন্দ্রকুমারের টোপ গিলেছে মনে হচ্ছে ইয়া বড়া মাছ।

তারপর যে খেল শুরু হল, সে এক দেখবার জিনিস। মাছের সঙ্গে মাছুড়ের লড়াই। এ-ও ছাড়ে না, ও-ও ছাড়ে না। ম্যানেজারবাবু গোমস্তা ইত্যাদি ছুটে এসে নিশ্বাস বন্ধ করে খেল দেখতে লাগলেন। হেমেন্দ্রকুমার কখনও সুতো ছাড়েন, কখনও মাছকে খেলিয়ে কাছে আনেন। সে ব্যাটাও যত রকম কসরত জানত, সব দেখাতে লাগল। এমনি করে প্রায় দু’ঘণ্টা খেলিয়ে খেলিয়ে মাছকে ঘায়েল করে আনলেন।

বন্ধুদের এতক্ষণে প্রায় দমবন্ধ হবার জোগাড়। জাত-মাছুড়েদের নিয়ম, না ডাকলে একজনের মাছে আরেকজন হাত লাগাবে না। আর হেমেন্দ্রকুমার সাহায্য চাইবার ছেলেই ছিলেন না। অগত্যা যখন মাছ সত্যি সত্যি ডাঙায় পড়ে খাবি খেতে লাগল, তখন দেখা গেল ইতিমধ্যে ম্যানেজারবাবু আর গোমস্তা গিয়ে লোকজন ডেকে এনেছেন।

তারা মাপবার ফিতে, পেল্লায় এক দাঁড়িপাল্লা, খাতা, পেনসিল নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। হেমেন্দ্রকুমার ছিপ ছেড়ে দিলেন। বঁড়শি তখনও মাছের মুখে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজারবাবুর লোকরা মাছের লম্বা আর বেড় মাপতে লেগে গেল। লম্বা চার ফুট, বেড় ছত্রিশ ইঞ্চি। তারপর মাছকে দাঁড়িপাল্লায় তোলা হল। ওজন সাড়ে বারো সের। সব কিছু খাতায় লেখা হল।

এদিকে মাছের গায়ে হাত দেবার জন্য, বন্ধুদের হাত নিশপিশ করছিল। গোমস্তা সযত্নে বঁড়শি খুলে ফেললেন। তখন সকলের খেয়াল হল যে মাছের নাকে একটা পেতলের নথ পরানো হয়ে গেছে। তাতে খুদে একটা পেতলের টিকিট ঝুলছে। গোমস্তা ডেকে বললেন, ৭৩ নং। সংখ্যাটি খাতায় লেখা হল।

সঙ্গে সঙ্গে কেউ কিছু বুঝবার আগেই, মাছটাকে ঠেলে ঝুপ্‌ করে আবার জলে ফেলে দেওয়া হল। মাছুড়েদের চক্ষুস্থির! এত কষ্টের মাছ গো!!

ইদিকে ম্যানেজার মনিব্যাগ খুলে বললেন, ‘সাড়ে বারোক্কে ছয় আনা হল গিয়ে ছয় বারোং বাহাত্তর আর তিন। এই ধরুন চার টাকা এগারো আনা। বাড়ি যাবার পথে ভাল দেখে একটা কিনে নিয়ে যাবেন, কেমন?’

তারপর চার বন্ধুর বজ্রাহত মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আরে ছি! ছি! কর্তামশাই বোধহয় বলতে ভুলে গেছিলেন যে আমাদের এখানকার নিয়ম যে মাছ ধরা হবে, কিন্তু মারা হবে না। আনন্দটা তো ধরাতেই, মারাতে তো আর নয়। আমরা এই খাতায় মাছদের নম্বর দেখে, ওদের বাড়ের একটা হিসাব পাই। এবার চলুন, খাবার তৈরি।’

না, ওঁরা রেগেমেগে না খেয়ে চলে যাননি। গেলে ভুল করতেন। মখমলের আসনে বসিয়ে, শ্বেতপাথরের থালা বাটিতে ষোলো বেন্নুনে খাইয়েছিল। তারপর দই, রাবড়ি, সন্দেশ। শুধু বোকারাই রেগেমেগে না খেয়ে বাড়ি যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *